সোনার হরিণ নেই – ১

এক

বেশ মজার স্বপ্ন দেখছিল বাপী তরফদার। শহরটা যেন পাঁচ মাসের দেখা কলকাতার শহর নয়। জঙ্গলটাও বানারজুলির চেনা জঙ্গল নয়। কলকাতার মতোই আর একটা শহর। বানারজুলির মতোই আর একটা জঙ্গল। সেই শহর আর জঙ্গল পাশাপাশি নয়। একটার মধ্যে আর একটা। জঙ্গলের মধ্যে শহর, আবার শহরের মধ্যেই জঙ্গল। হাতি বাঘ ভালুক হায়না চিতা হরিণ মানুষ মেয়েমানুষ সব যে-যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না। কারো প্রতি কারো ভূক্ষেপ নেই।

ঘোরের মধ্যেই ঘুমটা ভেঙেছে। বাপী তরফদার হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারছিল না কোথায় শুয়ে সে। উদ্ভট স্বপ্নের রেশ মগজে লেগে আছে। সামান্য নড়াচড়ার ফলে দড়ির খাটিয়া ক্যাচ-ক্যাঁচ করে উঠতে সজাগ হল। সবে সকাল। মাথাটা ভার-ভার।

দেড় মাস হল খুপরি ঘরের এই দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে রাত কাটছে। তার আগে যেখানে ছিল সেটা ভদ্রলোকের আশ্রয়। সেখানে সুখ ছিল। ভোগ ছিল। মণিদার বউ গৌরী বউদির চোখের তারায় আগুন ছিল। সে আগুনে ব্যভিচারের প্রশ্রয় ছিল। রমণীর অকরুণ ইশারায় মণিদার পুরুষকার বাপী তরফদারের পিঠে চাবুক হয়ে নেমে আসে নি। ভালো মানুষ মণিদা সাদামাটা দু’চার কথায় তাকে বিদায় দিয়েছিল।

তারপর থেকে এই দেড় মাস এখানে।

ভদ্রলোকের সেই সুখের ঘরের আশ্রয় থেকে ঢের ভালো। তবু সকালে ঘুম ভাঙলে মাথাটা রোজই ওই রকম ভার-ভার লাগে। সেটা দড়ির খাটিয়ার দোষ নয়। নিজের দোষ। মাথার দোষ। অমন পাগলের স্বপ্ন ক’টা লোক দেখে? স্বপ্ন দেখুক বা না দেখুক, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সে খাপছাড়া ভাবনাগুলো আর ইচ্ছেগুলো মাথার মধ্যে ঠিকি দিয়ে জমতে থাকে, সেগুলো তরল হবার মতো গাঢ় ঘুমের প্রলেপই বা কতটুকু পড়ে? নইলে এই রকম দড়ির খাটিয়ায় চেপেই তাদের মতো লোকেরা নিমতলা-কেওড়াতলায় চলে যায়। আবার ওতেই শুয়ে ঘুমোয়ও দিব্যি।

টালি-ছাওয়া পঁচিশ ঘর বাসিন্দার মধ্যে ক’টা ঘরেই বা খাট-চৌকি আছে। ভালো ঘুম না হওয়াটা নিজের স্বভাবের দোষ বাপী তরফদারের। তার বুকের তলায় অসহিষ্ণু বাষ্প ছড়ানোর একটা মেসিন বসানো আছে। মুখ দেখলে কিছু বোঝা যায় না, সেটা তার নিজের কৃতিত্ব। কিন্তু ওই মেসিনটার ওপর তার কোনো হাত নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওটা কাজ করে চলেছে। বাষ্পগুলো ঠেলেঠেলে মাথায় নিয়ে গিয়ে ঠাসছে। ওই নিয়ে ঘুম, ওই নিয়ে জাগা।

 

গোল চাপ-বাঁধা এই পঁচিশটা টালিঘরের শতেক বাসিন্দাদের একজন ভাবতে চেষ্টা করে নিজেকে। কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় কেউই তা ভাবে না। এমন কি, যার আশ্রয়ে ওই আধখানা ঘরে সে আছে, সেই রতন বনিকও ভাবে না। তার বউটার কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। কিন্তু বাকি সকলে তাকে ভদ্রলোক ভাবে। ভদ্রলোকের ছেলে ভাবে। ভদ্রলোকের মস্ত পাশ-টাশ করা ছেলে ভাবে। তাদের চোখে এখানে সে রতন বনিকের সমাদরের অতিথি। নেহাৎ বিপাকে পড়ে দিন কতকের জন্য এসে ঠাঁই নিয়েছে। দিন ফিরলেই চলে যাবে। নইলে বিপুলবাবুও ওদের মতো ওই আধখানা টালি-ঘরে পাকা বসবাসের ভাঙা কপাল নিয়ে এসেছে নাকি! রতন বনিক কপাল চেনে। বিপুলবাবুর কপাল এরই মধ্যে সকলকে সে ঢাক পিটিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে।

…বিপুল তারই নাম। শুধু বিপুল নয় বিপুলনারায়ণ তরফদার। গরিব বাবা-মা কোন্ বিপুল আশার খুঁটি ধরে এরকম একটা নাম রেখেছিল জানে না। গোটা নামটা মনে হলে নিজেরই হাসি পায়। তবে এই পোশাকি নাম ভালো পোশাকের মতো তোলাই থাকে বেশির ভাগ সময়। বাবা মা আত্মীয় পরিজন বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছেই সে বাপী। বাপী তরফদার। জ্ঞান বয়সের আগে থেকে ওই নাম শুনে তার কান পেকেছে। কিন্তু খিদিরপুর ব্রুকলিন গোডাউনের বাবুদের পিয়ারের পিওন ‘আট-কেলাস’ পড়া রতন বনিকের সঙ্গে কার্য-কারণ সুবাদে এখানে তার ওই পোশাকি নামটাই চালু।

অন্য সব দিনের সঙ্গে এই দিনটার সকাল দুপুর বা বিকেলের রঙে তফাৎ ছিল না একটুও। টালি এলাকার সক্কলের আগে রোজ যেমন ঘুম ভাঙে আজও তাই ভেঙেছিল। তফাৎ শুধু উদ্ভট স্বপ্নটা। তার রেশ ছিঁড়তে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে একবার চোখ তাকিয়ে খুপরি জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের  আলোর আভাস দেখেছিল। নড়বড়ে জানলা দুটো বন্ধ করলেও খানিকটা ফাঁক থেকেই যায়। সেই ফাঁক দিয়ে  আলো ঢোকে। মাথার ওপরের টালির ছাদের ফাঁক দিয়েও আলোর রেখা হামলা করে। আলোর এরকম বেয়াড়া স্বভাব বরদাস্ত করতে ইচ্ছে করে না বাপী তরফদারের। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো শতেক ফুটোর কম্বলটা মাথার ওপর টেনে দিয়ে অন্য দিনের মতোই সে আবার অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেছল।

 

উনিশ-শ আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারির একেবারে গোড়ার দিক এটা। চার কি পাঁচ তারিখ হবে। সকালের শীতের কামড়ের হাত থেকে বাঁচার তাগিদেও আপাদ—মস্তক কম্বলে ঢাকা দিতে হয়। কিন্তু শেষ রাতে হোক বা প্রথম সকালে হোক, চোখ একবার দু’ ফাক হলে ঘুমের দফা শেষ। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুলেও সবার আগে কলতলার কলরব কানে কটকট করে লাগবে। এই শীতের সকালেও জল নিয়ে কাড়াকাড়ি। কম্বলের তলায় ঢুকে বাপী তরফদারের ইচ্ছে করে ওদের সক্কলের মাথায় ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে দিয়ে আসতে।

সকালের আলো গরম হতে না হতে একটু আগে পরে গাঁ-গাঁ করে রেডিও বেজে উঠবে দু’ ঘর থেকে। পঁচিশ ঘর বাসিন্দার মধ্যে মাত্র দু’ ঘরেই এই সম্পদ আছে। তারা সক্কলকে জানান দিয়ে বাজায়। প্রথমেই শোকের প্রসঙ্গ শুরু হবে। সমস্ত দেশ জুড়ে শোকের কাল, শোক-পক্ষ চলেছে এখন। আজ ফেব্রুয়ারির চার তারিখ কি পাঁচ তারিখ বাপী তরফদার ঠিক করে উঠতে পারছিল না। যাই হোক, পাঁচ-ছ’দিন আগে নীল আকাশ থেকে আচমকা একটা বাজ পড়ার মতো সেই শোকসংবাদ সমস্ত পৃথিবীর বুকের ওপর ফেটে পড়েছিল। গান্ধীজী দিল্লীর প্রার্থনা সভায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ‘হা-রাম’ বলে চিরকালের মতো মাটিতে লুটিয়েছেন।

খবরটা শুনে পৃথিবীর শত-সহস্র-কোটি মানুষের মতো বাপী তরফদারও প্রথমে সচকিত আর পরে স্তব্ধ হয়েছিল। কলকাতায় এসেছে মাত্র পাঁচ মাস আগে। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার এক মাসের মধ্যে। দূরে বসে দাসত্বের শেকল ভাঙার ঝনঝনানি কানে যত মিষ্টি লেগেছিল, এই পাঁচ মাস যাবৎ আবেগশূন্য বাস্তব-ভূমির ওপর বিচরণের ফলে তার রেশ প্রায় মিলিয়েই গেছে। তার চোখে মহাত্মার হত্যা সেই আবেগ-শূন্যতার শেষ নজির। এই নজির দেখে সেদিন সে স্তব্ধ বোবা হয়ে বসেছিল। সকলেরই তাই হবার কথা। কিন্তু তারপর থেকে দেখছে শোকের আনুষ্ঠানিক দিকটাও কম ব্যাপার নয়। যত বড় শোক, ততো বড় অনুষ্ঠান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রেডিওয় শোকের গান আর শোকের বক্তৃতা, পথে ঘাটে শোকের মিছিল আর শোকের মিটিং। বাপী তরফদারের এক-একসময় মনে হয়েছে দেশটা সত্যি শোকে ডুবে গেল নাকি শোকের উচ্ছ্বাসে। বাইশ বছর বয়সের মধ্যে সে নিজে তো কখনো সরবে শোক করেনি।

 

…যে মহারানীর ঘুম ভাঙলে বাপী তরফদারের শরীর খানিক চাঙা হতে পারে আর মাথার ভার একটু কমতে পারে, তাঁর সকাল হতে কম করে এখনো ঘণ্টা দুই দেরি। রতন বনিকের বউ কমলা বনিক। আজ দেড়মাস হয়ে গেল ওরাই তার আশ্রয়দাতা এবং আশ্রয়দাত্রী। রতন বনিকের কড়া হাতের ধাক্কা না খেলে রেডিও বাজুক বা কলতলা সরগরম হোক বেলা আটটার আগে সেই দেমাকীর ঘুম ভাঙতে চায় না। ঠেলা মেরে ঘুম ভাঙানোর পরে রতনকে আবার মিষ্টি সোহাগের সুরে দু’চার কথা বলতে হয়। তা না হলে সাত-সকালে বউয়ের বচনের তোড়ে অনেক সময় তাকে ছিটকে এই খুপরি ঘরে চলে আসতে হয়। সপ্তাহে একদিন করে নাইট ডিউটি পড়ে রতন বনিকের। ফেরে পরদিন সকাল দশটায়। সেদিন বেলা আটটা সাড়ে-আটটার আগে কেউ আর বাপী তরফদারের এই খুপরি ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে না।

গত রাতে রতনের নাইট ডিউটি ছিল না অবশ্য। তাই সোয়া সাতটা থেকে সাড়ে-সাতটার মধ্যে চায়ের আশা আছে। খুপরি ঘরের দরজা আছে কিন্তু হুড়কো নেই। অন্য দিনের মতোই কমলা দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছিল। কম্বলের তলা থেকে বাপী তরফদার সেটা টের পেয়েছে। কারণ, ভেজানো দরজা দুটো শব্দ করেই খোলা হয় আর এই কমলার চলনও লঘু নয়। ঘরে ঢুকে রোজ সে আপাদমস্তক কম্বলে মোড়া একই দৃশ্য দেখে, আর বাপী তরফদারও একই সম্ভাষণ শোনে।

—কই গো, বড়বাবুর ঘুম ভেঙেছে—নাকি ফিরে যাব?

এক ডাকে সাড়া না দিলে সত্যি ফিরে যাবে। দ্বিতীয়বার আর ডাকবে না। সাড়া না পেয়ে এরকম ফিরে গেছে দুই-একদিন। কমলার নিজের ঘুমের ওপর মমতা আছে বলেই বেশি হাঁকডাক করে কারো পাকা ঘুম ভাঙাতে চায় না। ডাক শোনা মাত্র বাপীকে কম্বল ফেলে তড়াক করে দড়ির খাটিয়ার শয্যায় উঠে বসতে হয়।

সকালের এই একটা সময় রতন বনিকের বউটাকে ভালোই লাগে। ঘুমের দাগ লাগা ফোলা-ফোলা মুখ। কালো চোখের তারায় ঘুম-ছোঁয়া ঢুলু ঢুলু ভাব একটু। তার এক হাতে শাড়ির আঁচলে জড়ানো গরম চায়ের গেলাস, অন্য হাতে শস্তা দামের খানচারেক বিস্কুট, নয়তো হাতে-গড়া দু’খানা রুটি আর গুড়। বিস্কুট বা রুটি পছন্দ নয়, ওই চায়ের গেলাসটাই লোভনীয়। কিন্তু কমলার শাসনে পড়ে বিস্কুট বা রুটি-গুড়ও নিতে হয়। না নিলে কমলা ধমকে উঠবে, খালি পেটে চা গিললে কারো ‘নিভার’ আস্ত থাকে!

 

‘আট-কেলাস’ পড়া রতন বনিকের ‘ছ-কেলাস’ পড়া বউয়ের ভুলটা বাপী তরফদার একদিন শোধরাতে চেষ্টা করেছিল। কথাটা নিভার নয়, লিভার।

পলকা ঝাঁঝের মুখঝামটা দিয়ে উঠেছিল কমলা বনিক।—থাক, নিজের বিদ্যে নিজের মাথায় ঠেসে রাখো, আমাকে আর বিদ্যে দান করতে হবে না!

এরপর আর ভুল সংশোধনের চেষ্টা করেনি। কিন্তু রোজ সকালে ওই শামলা মুখের ধমক একটু খেতেই হয়। কারণ, কম্বল ফেলে ধড়মড় করে উঠে বসেই চায়ের গেলাসের জন্য হাত বাড়ায় সে। ফল কি হবে জেনেও। শাড়ির আঁচল তেমনি গেলাসে ধরে রেখেই কমলা চোখ পাকাবে। —মুখ ধোয়া হয়েছে?

এটুকু ভালো লাগে বলেই বাপী তরফদার মিথ্যে বলে না। বিব্রত মুখে মাথা নেড়ে জানান দেয়, ধোয়া হয়নি।

ঘেন্নাও করে না বাসি মুখে কিছু গিলতে—যাও মুখ হাত ধুয়ে এসো!

এই নিয়মিত অধ্যায় চটপট সারা হলে তবে চায়ের গেলাস আর বিস্কুট বা রুটি তার হাতে আসে।

আজও এর খুব ব্যতিক্রম হল না। তবে একটু হল চায়ের গেলাস আর বিস্কুট হাতে নিয়ে বসার পর। গজেন্দ্রগমনে কমলা বনিক দরজার কাছাকাছি এগিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। এটুকু অপ্রত্যাশিত। চা দিয়ে চলে যাবার সময় বিপুল তরফদারের দু’চোখ নিজের অগোচরে দরজা পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করেই। আজ হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে চাউনিটা তার মুখের ওপর হোঁচট খেল। আর এটুকুও কমলার চোখে ধরা পড়ল। হাসির ঝিলিক ঢাকা দেবার জন্যেই সে ছোট করে হাই তুলল একটা। —বুড়ো বলছিল বিপুলবাবু দুই-একদিনের মধ্যেই চলে যাবে।… ঠিক? আ হা, ষাট ষাট, জিভে গরম চায়ের ছেঁকা লাগল বুঝি?

 

চায়ের গেলাস কোলের কাছে নামিয়ে বাপী তরফদার গম্ভীর মুখে জবাব দিল, দেড় মাস হয়ে গেল আর কত অসুবিধে করব তোমাদের…

কমলাও গম্ভীর মুখেই সায় দিল, আমাদেরই বা সকালে এক গেলাস চা আর দু’খানা বিস্কুট দিয়ে কতকাল কেষ্ট ঠাকুরকে ধরে রাখার ক্ষ্যামোতা বলো। …তা এবার কোন্ মহলে ঘর ঠিক হল?

—কোথাও না। দেশেই চলে যাব ভাবছি। এখানে আর কিছু হবে-টবে না— কমলার কালো চোখের তারায় চাপা হাসির ঢেউ খেলে গেল একটু। বলল, কোথায় যে তোমার হবে ভগবানই জানে। বুড়ো অবিশ্যি বলে, হবে যখন দেখে নিস, বিপুলবাবুর ভাগ্যিখানা কালবোশেখীর ঝড়ের মতোই সবদিক তোলপাড় করে নেমে আসবে একদিন—তা দেখো, যেখানে গেলে হবে সেখানেই যাবে, তার আর কথা কি।

হেলেদুলে চলে গেল।

…আর এই সকালেই ইদানীংকালের সেই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধটা তার মধ্যে ছড়িয়ে রেখে গেল। বাপী তরফদারের ওই কমলার ওপরেই রাগ হতে থাকল। ভদ্রলোকের সংস্রব এড়িয়ে রাতের এই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু তার নিশ্চিত আশ্রয় হয়ে উঠতে পারত। রতনের সঙ্গে কথা বলে সামান্য কিছু ভাড়াও ঠিক করে নেওয়া যেত। কিন্তু এখান থেকে যাওয়ার কথা ইদানীং রতনকে বলতে হচ্ছে নিজের ভিতরের অস্বস্তি দিনে দিনে বাড়ছে বলে। যাবার কথা রতনকে কাল রাতেও বলেছে।

অস্বস্তি শুরু হয়েছিল এখানে আসার দিনকতকের মধ্যেই. বয়স্ক রতন বনিকের ওই তরতাজা বউটা ঠারেঠোরে তাকাতে জানে। চোখের কোণে আর ঠোঁটের ফাঁকে হাসির ঝিলিক ফোটাতে জানে। প্রথম কটা দিনই শুধু ধারেকাছে ঘেঁষেনি, আড়াল থেকে লক্ষ্য করেছে। সমস্ত দিন ঘোরাঘুরি করে বাপী তরফদার তখন বিকেলের দিকে ঘরে ফিরত। ঘণ্টা দুই-তিন দড়ির খাটিয়ায় চিৎপাত শুয়ে থেকে আবার বেরুতো। বাইরে রাতের খাওয়া সেরে ঘরে ফিরত।

 

একদিন সন্ধ্যার ঠিক পরে ব্যস্তসমস্ত মুখে ঘরে ঢুকে রতন বনিক বলেছিল, আজ নাকি সমস্ত দিন খাওয়াই হয়নি আপনার?

বাপী তরফদার সচকিত।—কে বলল?

—বউ বলছিল, আজ সমস্ত দিন উপোস গেছে কেষ্ট ঠাকুরের—

বলে ফেলেই লজ্জা পেয়ে জিভ কামড়েছে সে। তারপর সে বলেছে, কিছু মনে করবেন না বাবু, বউটার লঘু-গুরু জ্ঞান নেই—ওই রকমই কথা। বলে, কেষ্ট ঠাকুরপানা মুখখানা—। আজ ঘরে ফিরতেই বলল, কেষ্ট ঠাকুর সমস্ত দিন উপোস দিয়েছে। এরই মধ্যে ভাত তরকারি রেঁধে ফেলেছে, সকালের একটু মাছও আছে—আপনাকে এক্ষুনি ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঠেলে পাঠালো আমাকে। চলুন —

বাপী তরফদার বাধা দিয়েছিল, না না, তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না, আমি একটু বাদেই বাইরে থেকে খেয়ে আসছি—

মাথা নেড়ে রতন বনিক বলেছিল, আজ আর সেটি হচ্ছে না বিপুলবাবু, রাঁধা ভাত-তরকারি সব তাহলে ড্রেনে ঢেলে দেবে, আমাকেও খেতে দেবে না। চলুন শিগগীর—

অগত্যা উঠে আসতে হয়েছে। সকালের চা-রুটির পর সেদিন সত্যিই চার পয়সার মুড়ি আর চার পয়সার চিনেবাদাম ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। সেটা যে নিছক অভাবের দরুন তা নয়। তিন মাসের চাকরির কিছু পুঁজি হাতে আছে এখনো। অবশ্য হিসেবের বাইরে একটিও বাড়তি পয়সা খরচ করে না সে। কিন্তু একেবারে না খাওয়াটা পয়সা বাঁচানোর তাগিদে নয়। মেজাজ না থাকলে এক—আধ বেলা ওরকম উপোস দিতে অভ্যস্ত।

 

খেতে খেতে একটু সহজ হবার জন্যেই রতন বনিকের বউয়ের দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়েছিল। আর তার পরেই কি-রকম ধাক্কা খেয়েছিল একটু। এ—কদিনে দুই-একবার আভাসে দেখলেও মুখখানা চোখে পড়েনি। আধবয়সী রতন বনিকের ঘরে এরকম বউ থাকা সম্ভব সে ভাবেনি। গায়ের রং তারই মতো কালো ঘেঁষা, কিন্তু অল্প বয়েস, সুঠাম স্বাস্থ্য। কালো চোখে সরমের বালাই নেই। উল্টে সে নিজেই রমণীটির চোখে একটি দর্শনীয় বস্তু।

চোখাচোখি হতে বাপী তরফদার হেসেই বলেছিল, সমস্ত দিন সত্যিই আজ ভালো করে খাওয়ার ফুরসত হয়নি, কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে?

তক্ষুণি জবাব এলো, মাটির কেষ্ট হলে বোঝা যেতনি, ওই বুড়োর চোখ থাকলে সে-ও বুঝত

বউয়ের কথা শুনে রতন বনিক হেসে উঠেছিল, তোর মতো চোখ আর কার আছে বল্। পরে বলেছিল, তোর স্বভাব জানি, বিপুলবাবুর সামনে কক্ষনো ঠাট্টা-—ঠিসারা করে বসিসনি যেন—আমাদের কত ভাগ্যির জোরে উনি এখানে এয়েছেন—একদিন ওঁর দিন কেমন ফেরে দেখে নিস—

নিরীহ বিস্ময়ে কমলা বলেছিল, দিন ফিরলে আমি দেখে নেব কি করে গো!

তুষ্ট মুখে হার মেনে রতন বলেছিল, সবেতে কেবল ফষ্টিনষ্টি কথা তোর—দিন ফিরলেই বিপুলবাবু কি আমাদের ভুলে যাবেন!

সেই দিন থেকে ভিতরে ভিতরে কেমন অস্বস্তি বোধ করেছিল বিপুল তরফদার। দীর্ঘকাল জঙ্গলে বাসের ফলে বুনো জন্তু-জানোয়ার ছেড়ে মানুষেরও প্রবৃত্তির দিকটা অনেকখানি চেনা তার। সেই সঙ্গে নিজের খোলস-ঢাকা চরিত্রও ভালোই জানা। মনের তলায় সেই রাতেই একটা বিপদের আভাস উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে।

 

পরদিন থেকেই সকালে চা-বিস্কুট বা চা-রুটি-গুড় নিয়ে রতন বনিকের বদলে কমলা নিজেই দরজা ঠেলে অনায়াসে ঘরে ঢুকেছে। আর তখন অতিথির অস্বস্তি—টুকুও তার কাছে উপভোগ্য কৌতুকের মতো। তারপরে আবারও এক-আধদিন দুপুরের খাওয়া বাদ পড়লে এই বউটার চোখে ধরা পড়বেই। আর তখন জুলুম করে ধরে নিয়ে গিয়ে খেতে বসাবে তাকে। ঠিসারার সুরে রতনকে বলবে অসময়ে তোমার ভাগ্যিমন্ত অতিথির একটু সেবা-যত্ন করে রাখলে আখেরে কাজ দেবে—কি বলো?

রতন বনিকেরও তুষ্ট মুখ—এখন ঠাট্টা করছিস কর, পরে দেখে নিস।

বাপী তরফদার এরপর বিকেলে ঘরে ফেরাই ছেড়ে দিল। একেবারে রাতের খাওয়া সেরে ঘরে ঢুকত।

কমলা সেই সময় থেকে তাকে বড়বাবু বলে ডাকতে শুরু করেছে। শুনে কান করকর করেছে বাপী তরফদারের। কিন্তু এ নিয়ে তাকে কিছু বলেনি। বলতে গেলেই কমলা দুটো রসের কথা বলে বসবে। সেটা নিজেকে প্রশ্রয় দেওয়ার সামিল হবে বাপী তরফদারের। সব থেকে বেশি ভয় নিজেকে। বনে-জঙ্গলে বাসের কালে বিষাক্ত সাপের আচমকা ছোবলে এক একটা বড় বড় জীবকে ধরাশায়ী হতে দেখেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে ওই রকম একটা হিংস্ৰ প্ৰবৃত্তি তার মধ্যেও লুকনো আছে। এই কারণেই নিজেকে সব থেকে বেশি ভয়।

…দেড় মাস আগে প্রবৃত্তির এই দিকটা আচমকা অনাবৃত হয়ে গেল। গৌরী বউদি দেখেছিল। চিনেছিল। গৌরী বউদি কম করে ছ’ বছরের বড় তার থেকে। কিন্তু জানোয়ার বয়েস দেখে না। গৌরী বউদিও চোখের সামনে সেদিন তাজা জ্যান্ত পুরুষ দেখেছিল একটা। তার চোখের আগুনে পতঙ্গ পোড়ে না। পতঙ্গ করুণার পাত্র। মণিদা করুণার পাত্র। গৌরী বউদির চোখের আগুনে ব্যভিচারের প্রশ্রয়।

…কিন্তু জানোয়ারটা ততক্ষণে খোলসে সেঁধিয়েছিল আবার। গৌরী বউদি তাকে ক্ষমা করেনি। তাকে আশ্রয়-ছাড়া করেছে।

…এই কমলার মতোই গায়ের মাজা রং গৌরী বউদির। সুপটু প্রসাধনে আর একটু উজ্জ্বল হয়তো। মাথায়ও কমলার থেকে কিছু লম্বা। কিন্তু গৌরী বউদির মতো নয় কমলা। তার মতো তীক্ষ্ণ নয়। নির্লিপ্ত নয়। অকরুণ নয়। মায়া-মমতা আছে। বুড়ো স্বামীর যত্ন-আত্তি করে। মেজাজ ভালো থাকলে সহজ কৌতুকে আর উচ্ছ্বাসে টইটম্বুর। সে ঠারেঠোরে তাকাতে জানলেও তাকে দেখে গৌরী বউদির মুখ মনে পড়ত না বাপী তরফদারের।

কিন্তু ইদানীং মনে পড়ে। পড়ছে। হঠাৎ-হঠাৎ মনে হয়, সে-রকম পরিস্থিতি—বিপর্যয়ে এই কমলাও গৌরী বউদির মতো হয়ে উঠতে পারে। মণিদার মতো রতন বনিকও হয়তো তখন নিরীহ মুখে ওকে এখান থেকে চলে যেতে বলবে। সেই ভয়েই মাঝে মাঝে এই আশ্রয় ছেড়ে পালানোর কথা ভাবছে সে। যাবার কথা রতন বনিককে বলেছেও।

.

কমলা নিজের স্বামীকেই বলে বুড়ো। রতনের সামনেই বলে। কিন্তু রতন তাতে রাগ করে না। এই বউয়ের পাশে একগাল কাঁচা-পাকা দাড়ির জন্য একটু বেখাপ্পাই দেখায় তাকে। দ্বিতীয় পক্ষের এই বউকে খুশি করার জন্যও রতন বনিক কেন দাড়ির মায়া ছাড়তে পারে না বাপী তরফদার সেটা ভালোই অনুমান করতে পারে।

ব্রুকলিনের বাবু এমন কি বড়বাবুদের কাছেও কোনো কারণে রতনের একটু বিশেষ সমাদর আছে। এই দাড়ির বোঝা সাফ করে ফেললে সেই বিশেষ কদরে ঘাটতি পড়ার আশংকা। কিন্তু দাড়ির কারণে এই স্বামী-সম্ভাষণ কি অন্য কোনো চাপা ক্ষোভের ফলে সেটা একমাত্র কমলাই জানে। রতনের বয়েস এখন উনচল্লিশ আর কমলা খুব বেশি হলে কুড়ি ছাড়িয়েছে। কমলা বাপীর থেকে দেড়-দু’ বছরের ছোট হতে পারে।

সন্ধ্যায় পর মাত্রা রেখে একটু-আধটু নেশা করার অভ্যাস আছে রতন বনিকের। এই খুপরিটা তার নেশার ঘর। বোতল থেকে সাদা জলের মতো খানিকটা দিশি মাল খায় আর সেই সঙ্গে নুন মেশানো কিছু আদার কুচি। আগে হয়তো ওই পর্বের পর এই দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে খোয়াব দেখত। এখন মেঝেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে অল্প অল্প দোলে। কেউ সামনে থাকলে মন খুলে গল্প করে তার সঙ্গে। সামনে গোড়ার দিকে বাপী তরফদারই থাকত। রতনের সংকোচ সে-ই কাটিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আমি তোমার আশ্রিত, কিন্তু তোমার কোনরকম অসুবিধে হচ্ছে দেখলে আমি সরে পড়ব।

রতনের অসুবিধের ব্যাপারটা প্রথম সন্ধ্যাতেই টের পেয়ে গেছল। অন্য কারো ঘরে গিয়ে নেশা সেরে এসে রতন এই খুপরিতে এসে বসেছিল। মেঝেতে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকে একটু একটু দুলতে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর ওর জিভ আলগা হতে সমস্যা বুঝেছে। বউটার বিবেচনার অভাবের কথাই বলছিল রতন। মাতাল তো আর হয় না, সমস্ত দিন খাটা-খাটনির পর সামান্য মৌজের লোভে যা একটু খায়। শরীর মন ভালো থাকে রাতে ভালো ঘুম হয়। এই খুপরি ঘরে অতিথি আছেন জেনেও বোতল সুদ্ধু বউ তাকে নিজের ঘর থেকে বার করে ছাড়ল। বোতল হাতে দেখলে রতনকে সাদরে ডেকে নেবার মতো ঘর এখানে আরো দু-পাঁচটা আছে। কিন্তু যে ডেকে নেবে তাকে ভাগ তো দিতেই হয়। সেদিনই খামোখা একটা ছোট বোতল একেবারে ফাঁক হয়ে গেল। রোজ রোজ লোককে এ-রকম ভাগ দিতে হলে সে যে ফতুর হয়ে যাবে বউয়ের এই সামান্য বিবেচনাও নেই।

বাপী তরফদার তারপর ওই কথা বলে তাকে নিশ্চিন্ত করেছিল। ঢুলু ঢুলু দু’ চোখ টান করে রতন বলেছিল, বিপুলবাবুর মতো এমন দরাজ মনের মানুষ সমস্ত ব্রুকলিনেও আর দুটি নেই, অথচ বরাত এমন যে তারই চাকরিটা সকলের আগে খোয়া গেল। কিন্তু সে নিশ্চিন্ত, বিপুলবাবু ঢের ঢের বড় হবেন বলেই এই ধাক্কাটা খেতে হল।

ওর বড় হওয়ার ভবিতব্যের কথা শুনে কমলা তাকে ঠাট্টা করে বড়বাবু বলা শুরু করেছে।

অতিথির কাছ থেকে রতন বনিক ঘর ভাড়া নেবেই না যখন, অন্যভাবে বাপী তরফদারকে তার দরাজ মনের পরিচয় দিতে হয়েছে। বার দুই নিজে ছোট বোতল কিনে ওর হাতে গুঁজে দিয়েছে। রতন বনিক খুশিতে আটখানা। এ-সময় একটুআধটু চেখে দেখলে বাবুরও মন ভালো হত এ-কথা অনেকবার বলেছে। কিন্তু জঙ্গলের মানুষদের এ জিনিস হামেশাই খেতে দেখেছে বাপী। অনেক বেলেল্লাপনাও দেখেছে। ফলে এই লোভ সে বাতিল করেছে। রতনের কথায় ও বিন্দুমাত্র আগ্রহ হয়নি। উল্টে বউয়ের ওকে ঘরে বসে এ জিনিস খেতে না দেওয়ার তেজটুকু ভালো লেগেছে।

এ-সময় ওই দ্বিতীয় পক্ষটির গল্প রতন বনিকের মুখেই শুনেছিল সে।… কমলা রতনের নিজের শালী। প্রথম পক্ষ দুর্গার থেকে ঢের ছোট অবশ্য। শ্বশুর-শাশুড়ীর বুড়ো বয়সের মেয়ে। …দুর্গার সর্বাঙ্গ মায়ের দয়ায় ছেয়ে গেছল। সেটা জানাজানি হতে সরকারী গাড়ি এসে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে রেখে এসেছিল। আর ঘরের মুখ দেখতে পায়নি, সেখানেই সব শেষ। পাঁচ বছর আগের কথা। দুর্গাকে হারিয়ে রতন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেছিল। কমলার তখন বছর পনের কি ষোল বয়েস। মফঃস্বলে বিধবা মায়ের কাছে থাকে। শাশুড়ী তাকে চিঠি লিখত, একটা তো গেছেই, যেটা আছে তার ভয়ে বুকের ভিতরটা সর্বদা হিম হয়ে থাকে। মেয়েটা দিনকে দিন দজ্জাল হয়ে উঠছে।

রতনের তখন শোকের সময়। অতশত কান দেয়নি। বছর ঘুরতে শাশুড়ীর জোর তাগিদ এলো, জামাইয়ের শিগগীর একবার আসা দরকার—এখানকার ঘর বাড়ি বেচে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার ইচ্ছে তার। ততদিনে রতন বনিকের শোক হালকা হয়েছে। কিন্তু বোতলের অভ্যাসটাও তখন থেকেই।

ছুটি নিয়ে শাশুড়ীর কাছে গিয়ে তার সমস্যা স্পষ্ট করে বুঝল। সমস্যা ছোট মেয়ে। কমলার তখন বছর সতেরো বয়েস। বাড়ন্ত গড়ন। তাকে দেখে চোখে পলক পড়ে না রতনের। অনেক ছোট শালী, কাছে ডেকে আগের মতোই গায়ে পিঠে হাত বোলাবার লোভ ছাড়তে পারেনি। কিন্তু সতের বছরের ওই কমলা পাকা ঝানু মেয়ে তখন। তার হাত একটু বেসামাল হতেই ফোঁস করে উঠেছে। আর তাই দেখে ভিতরে ভিতরে রতন বনিকও পাগল হয়েছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি।

গম্ভীর মুখে সামনে বসে শাশুড়ীর নালিশ শুনেছে সে। সমস্যা আর দুর্ভাবনার কথা শুনেছে। এই মেয়েকে আর সামলাতে পারছে না শাশুড়ী। তার ফষ্টিনষ্টি বেড়েই চলেছে। আগে আশপাশের সমান পর্যায়ের ছেলে-ছোকরাগুলো উৎপাত করত। ওই পাজী মেয়েও তাদের আসকারা দিত। যার সঙ্গে খুশি বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো। কোথাও যাত্রা হচ্ছে শুনলে মায়ের শাপমনিতে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে যেত। এখন ভদ্দরঘরের ছেলেদের উৎপাত শুরু হয়েছে। দিনেদুপুরে জানলা দিয়ে ঢেলার মতো চিঠির মোড়ক ঘরে এসে পড়ে। শাশুড়ী লেখাপড়া জানে না, আর কমলাও চোখ-কান বুজে মায়ের কাছে মিথ্যে কথা বলে। কিন্তু ফাঁক পেলেই চুপিচুপি বেরিয়ে যায়। একা শহরে গিয়ে সিনেমা দেখে আসে। ওই সব পাজী ছেলেগুলোই নিশ্চয় পয়সা যোগায়। চৌদ্দ-পনের বছর বয়েস পর্যন্ত বাখারিপেটা করে মেয়েকে মাটিতে শুইয়ে ফেলা গেছে, কিন্তু এখন মেয়েটা মায়ের সমস্ত শাসনের বাইরে।

…হ্যাঁ, বুদ্ধির চালে সেই একবার শাশুড়ী আর তার মেয়ে দুজনকেই ঘায়েল করতে পেরেছিল রতন বনিক। ভেবে-চিন্তে শাশুড়ীকে বলেছে, কমলাকে এখান থেকে সরানো দরকার। কলকাতা দেখাবার নাম করে শাশুড়ী আর শালী দুজনকেই তার ওখানে নিয়ে যাবে সে। আর তারপর কমলার মতো মেয়ের ভালো বিয়ে হতে কতক্ষণ? কমলার যে ভালো বিয়ে হবে নিঃসংশয়ে সেই ভবিষ্যৎবাণীও করেছে। জামাইয়ের এই ঘোষণার ওপর শাশুড়ীর ভারী আস্থা। তার ওপর শুনেছে খরচাপত্রের জন্যেও ভাবনা নেই—যা করার জামাই-ই করবে। কলকাতার এই চাকুরে জামাই শাশুড়ীর মস্ত গর্ব।

কমলাও সানন্দে এসেছে। কলকাতা দেখার লোভ, তার ওপর দিনে একটা করে সিনেমা দেখার লোভ। এত লোভের টোপ না গিলে থাকতে পারবে এমন মেয়ে কমলা নয়। সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে বিয়ের আগের দিন মতলবটা শাশুড়ীকে জানিয়েছে রতন বনিক। প্রথম শোনার পর শাশুড়ী ঘণ্টা-কতক গুম হয়ে ছিল অবশ্য। কিন্তু আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে মেয়ের হাল কি হতে পারে সেই ভবিষ্যৎবাণী শোনার পর শাশুড়ী আর আপত্তি করেনি। উল্টে ভেবেছে এ বরং ভালোই হল, মেয়েটা তোয়াজে থাকবে।

কমলা জেনেছে একেবারে বিয়ের দিন সকালে। কিন্তু সেদিন আর রতন বনিক এই টালি এলাকা থেকে তার পালাবার মতো কোনো ফাঁক রাখেনি। শেষে মুখ বুজেই বিয়েটা করতে হয়েছে তাকে। তবে ওই দজ্জাল বউকে বাগে আনতে বেশ সময় লেগেছিল রতন বনিকের। কখন কোন্ ফাঁক দিয়ে পালায় সেই ভয়ে আস্ত একটা মাস আপিসে ছুটি নিতে হয়েছিল। আর রোজ একটা করে সিনেমা দেখাতে হয়েছিল।

কথায় কথায় একদিন বউয়ের আর একটা খেদের কথা জেনেছিল রতন বনিক। এখানে কারো ঘরে কোনো শুভ কাজ হলে বউ নাকি অপমান বোধ করে। কুড়ি পার হতেও ছেলেপুলে হল না বলে এখানকার এয়োরা কোনো শুভ কাজে প্রথমে তার মুখ দেখতে চায় না। রতন বনিক অবশ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছে কমলা ছেলের মা হবে, ব্যস্ত হবার কি আছে, সবে তো কুড়ি গড়ালো বয়েস। কিন্তু বউ তক্ষুনি গলা উঁচিয়ে তর্ক করবে, তাহলে দিদির কেন তিরিশ বছরেও ছেলেপুলে হল না! এ-সব কথা শুনলে রতন বিরক্ত হয়। —দিদির বরাতে ছিল না তাই হয়নি—তা নিয়ে তোর এত বড় ভাবনা কেন, তোর হলেই তো হল! কপালের ব্যাপারে এত লোকের এত বিশ্বাস রতন বনিকের ওপর, এতটুকু বিশ্বাস নেই শুধু ঘরের বউয়ের। আর বিশ্বাস না থাকলে কারো কোনোদিন কিছু হয়!

…আপিসের সহকর্মীদের কাছে তো বটেই, বাবুদের আর বড় দরের বাবুদের কাছেও পিওন রতন বনিকের ওই কপাল গোনার গুণেই বাড়তি খাতির। মাস দুই আগে পর্যন্ত বাপী তরফদার নিজেও ওই ব্রুকলিনেরই সাধারণ কেরানীবাবুদের একজন ছিল। রতন বনিক সেই বিভাগেরই পিওন। কিন্তু পিওনের কাজ খুব একটা করতে হয় না তাকে। কারণ, দশটা-পাঁচটা অফিসের মধ্যে নিজের বা অন্য বিভাগের কোনো না কোনো বাবু ডিউটির অর্ধেক সময় তাকে ডেকে নিয়ে পাশে টুল পেতে বসিয়ে ভবিষ্যতের জট ছাড়াতে চায়।

নিজস্ব পদ্ধতিতে ভবিষ্যৎ গণনার সুনাম দিনে দিনে বাড়ছিল রতনের। হাত দেখা বা ঠিকুজি দেখার সঙ্গে এই গণনার কোনো সম্পর্ক নেই। তার কোন্ এক গুরুর আশীর্বাদে এক ভিন্ন পদ্ধতিতে সে ভবিষ্যৎবক্তা আর ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হয়ে বসেছে। একমাথা চুল, একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, আর চওড়া কপালে তেমনি মোটা করে মেটে সিঁদুর ঘষা। অনেকেরই বিশ্বাস লোকটার তন্ত্রমন্ত্র জানা আছে কিছু। ছোট বড় বাবুদের কাছ থেকে দু’দশ টাকা রোজগার হয় রতন বনিকের।

সে তার খদ্দেরের মাথার শেপ দেখে, ভুরু কান নাক চোখ দেখে, ঠোটের বক্রাভাস দেখে—আর সব থেকে বেশি মুখ আর কপালের রং। শুধু তার চোখেই যে কোনো লোকের সুসময়ে অথবা দুঃসময়ে কপাল আর মুখের রং—বদল ধরা পড়ে। খুব নিবিষ্ট মনে এইসব দেখে নিয়ে চোখ বুজে সে ভবিষ্যৎ বলা শুরু করে। যা বলে তার কিছু সত্য হতে পারে, বেশির ভাগই হয়তো সত্য হয় না। বাপী তরফদারের তাই ধারণা। একশটা ঢিল ছুঁড়লে দুদশটা লেগে যায়ই। কিন্তু মানুষের মন এমনি দুর্বল, যেটা লাগল সেটারই দাগ থেকে গেল। অনেককে বলতে শুনেছে, ব্যাটা ভাঁওতাবাজ, কিসসু জানে না। কিন্তু বিপাকে পড়লে অথবা কোনো আশার সম্ভাবনা দেখলে তাদেরও ওকে খাতির করে কাছে ডেকে বসাতে দেখেছে।

শাশুড়ীর কাছে চিঠি লিখতে হলে বা টাকা পাঠাতে হলে নতুন বাবু অর্থাৎ বাপী তরফদার তার সেই চিঠি অথবা মানিঅর্ডার ফর্ম লিখে দিত। আর রোজ ওকে দিয়ে চা আনানোর সময় ওকেও চা খাওয়ার পয়সা দিত। সেই কারণে হোক বা সমস্ত বিভাগের মধ্যে এমন কি আপিসের মধ্যে একমাত্র বিপুল তরফদারই ভাগ্য যাচাইয়ের ব্যাপারে কখনো শরণাপন্ন হয়নি বলে হোক— রতন বনিকের তার ওপর একটু বেশি টান ছিল। তার আগ্রহ না থাকলেও নিঃসংশয়ে সে তার সম্পর্কে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যা শুনে সহকর্মীদের চোখ ট্যারা আর বাপী তরফদারের মেজাজ গরম। তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সে গোটা ব্রুকলিন ডিপোর মালিক হয়ে বসলেও অবাক হবার কিছু নেই।

…ভবিতব্যের কথা শুনে অপরের হাসি দেখে সাধারণ েেকরানীবাবু বিপুলনারায়ণ তরফদারের মেজাজ গরম হবার আরো কারণ আছে। খুব ছেলেবেলা থেকে সে আকাশ-ছোঁয়া রকমের বড় হওয়ার স্বপ্নই দেখে এসেছে। সেই স্বপ্ন এত প্রত্যক্ষ যে এর প্রতিকূল কোনো বাস্তব সম্ভাবনার সঙ্গে এতটুকু আপোস নেই। মনের তলায় এক বিশাল সাম্রাজ্যই গড়ে বসে আছে। বড় হওয়ার এই তাড়নাটা বাসা বেঁধে আছে অনেক দিনের এক অসহ্য তাচ্ছিল্যের আঘাত থেকে। আর, নিজের সেদিনের ছোট শরীরটার তাজা রক্তের নোনতা স্বাদ থেকে।

…মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে দুঃসহ অপমানের বিকৃত প্রতিশোধের প্ররোচনায় কোনরকম জ্ঞানবুদ্ধি বিবেচনার অবকাশ ছিল না। তারপর শাসনের চাবুকে অপরিণত বয়সের সেই দেহ ঝাঁঝরা হয়েছে। দুই কশ-ঝরা নিজের সেই তাজা রক্তের স্বাদ বাপী তরফদার এ জীবনে ভুলবে না।

সেই থেকেই বড় হওয়ার একটা অফুরন্ত তাগিদ ধমনীর রক্তে টগবগ করে ফুটত সর্বদা। এখনো ফোটে। কত বড় হলে মন ভরে সে-সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। কোনো গণ্ডী বা কোনো সীমানার মধ্যে কুলোয় না সেটা।

.

বাপী তরফদারের সমূহ সমস্যা রতন বনিকের বউ কমলাকে নিয়ে। তার হাবভাব রকম-সকম দ্রুত বদলাচ্ছে। ওকে দেখলেই মনের তলায় অঘটনের ছায়া পড়ে। বাপী তরফদার সরোষে ওটা ছিঁড়েখুঁড়ে মন থেকে সরায়

মাত্র দিন পাঁচ-ছয় আগের কথা। বিকেলের আগেই রেডিও মারফৎ খবরটা আগুনের গোলার মতো ছড়িয়ে পড়তে স্তব্ধ বাপী তরফদার আর বাইরে টহল না দিয়ে এই খুপরি ঘরে এসে বসেছিল। ও-পাশ থেকে কমলা দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছে। একপিঠ খোলা চুল, ঢিলে-ঢালা বেশ-বাস, উত্তেজনায় দুচোখ কপালে।—তুমিও খবর শুনেছ তাহলে? তোমাদের ভদ্দরলোকদের হল কি গো বড়বাবু, দেশসুদ্ধ মানুষ জানে উনি মানুষ নন্—দেবতা—তাঁকেই গুলি করে মেরে দিলে?

এর কি জবাব দেবে বাপী তরফদার। তার নিজের মাথার মধ্যেই সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।

আগ্রহে আর উত্তেজনায় কমলা খাটিয়ার সামনেই মেঝের ওপর বসে পড়েছিল। তার শোনার ইচ্ছে, জানার ইচ্ছে, বোঝার ইচ্ছে। এ-রকমও কেন হয়, দেবতার আবার শত্রু থাকে কি করে?

বাপী তরফদার টুকটাক দুই-এক কথায় জবাব দিচ্ছিল। জানতে বুঝতে এসে কমলা নিজেই বেশি কথা বলছিল। গেল বছর বেলেঘাটায় গিয়ে কমলা নিজের চোখে গান্ধীজীকে দেখে এসেছিল। এখানকার আরো অনেকে গেছিল। নিজের কানে তাঁর কথা শুনেছে, নিজের চোখে তাঁর হাসি দেখেছে—জন্ম সার্থক। আর আজ কিনা এই!

বলতে বলতে কমলা থমকে মুখের দিকে তাকিয়েছে। নিজের অগোচরে বাপী তরফদারের দু’চোখ তার মুখে বুকে ওঠা-নামা করেছে হয়তো দুই একবার! কিন্তু আসলে সে নিজের প্রতি বা কারো প্রতি সচেতন ছিল না একটুও।

গা-ঝাড়া দিয়ে কমলা বসা থেকে সোজা উঠে দাঁড়িয়েছিল আর সঙ্গে সঙ্গে খসা আঁচলটা সজোরে বুকের ওপর দিয়ে পিঠের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। তার পর ছদ্ম ঝাঁঝে বলে উঠেছিল, খুব যে পরের বউকে সামনে বসিয়ে চোখের সাধ মেটানো হচ্ছে—অ্যাঁ?

বলতে বলতে ঘর ছেড়ে চলে গেছল সে। বাপী তরফদার কাঠ।

পরের চার-পাঁচ দিনের মধ্যে কমলার হাবভাব আরো অন্যরকম দেখছে। বাইরে গম্ভীর, কিন্তু চোখে চোখ পড়লে অঘটনের অস্বস্তিকর ছায়াটা আরো ঘন হয়ে উঠেছে। বাপী তরফদার বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে দুবেলার খাওয়া সেরে একেবারে রাতে ফেরে। গতকাল বেরুনোর আগে কমলা এই খুপরিতে এসে হাজির। কালো মুখ পলকা-গম্ভীর, চোখের কোণে কৌতুক চিকচিক

—আজকাল তোমার কোন্ পার্কে ডিউটি চলছে গো?

—তার মানে? না বুঝেও বিরক্ত।

—মানে আবার কি, রোজ সাড়ে এগারোটা বারোটায় বেরিয়ে রাত নটা পর্যন্ত হন্যে হয়ে তুমি চাকরি খুঁজে বেড়াও সেটা ওই হাঁদা বুড়ো বিশ্বাস করলেও আমি করি না। চাপা হাসি উছলে উঠতে চাইল কিন্তু উঠতে দিল না।—মরুকগে, এদিকে একটা ভালো ছবি হচ্ছে, এখানকার অনেকে দেখেছে; দুকুরের শোয়ের দু’খানা টিকিট কাটতে পারবে? আমি পয়সা দিচ্ছি—

কমলার চোখ এড়িয়ে মাথা নেড়ে বাপী তরফদার বিড়বিড় করে জবাব দিল, আমার সময় হবে না।

এ জবাবের জন্য প্রস্তুতই ছিল কমলা।—ঠিক আছে, টিকিট আমিই কেটে রাখব না হয়…তোমার দেখার সময় হবে?

এবারে ওর চোখের দিকে তাকালো বাপী তরফদার। কমলা ফিক করে হেসে ফেলল।—তোমার অত ভয় কিসের, কেউ টের পাবে না। ছবি দেখার পর বেরিয়ে এসে আমি তোমাকে চিনতেও পারব না—সোজা ঘরে চলে আসব—কমলার দুচোখের কৌতুক সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। জবাব না দিয়ে বাপী তরফদার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।

তারপর কাল রাতেই রতন বনিককে এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলেছে। আর তাই শুনেই কমলার সকালের এই ঠেস।

.

কিন্তু সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত আজকের দিনটায় আর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। অভ্যাসমতো বাপী ঘণ্টাকয়েক আপিসপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেছে; সেখানে লালদীঘির মাছ দেখে ঘণ্টা দুই কেটেছে। বিকেলে ময়দানের মাঝখান দিয়ে অন্য দিনের মতোই দক্ষিণে হাঁটা দিয়েছে। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের পয়সা কটাও বাঁচে আবার লম্বা হাঁটাও হয়। এই হাঁটারও কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। পা যখন আর চলতে চায় না, ধারেকাছের কোনো একটা পার্ক-টার্ক-এ বেঞ্চিতে নয়তো ঘাসের ওপরে বসে পড়ে। ততক্ষণে শীতের ছোট বেলার শেষ আলোটুকু অন্ধকারের জঠরে চলে যায়।

আজ ক্লান্ত লাগছিল না। বেলা তিনটে নাগাদ ছেলেবেলার বন্ধু নিশীথ সেন—এর আপিসে গেছল। সে ভর-পেট জলখাবার খাইয়ে দিয়েছে। লোকালয়ের ফুটপাথ ধরে চলতে চলতে নিজের বাসের এলাকা ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণে চলেছে। হাজরা পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে গেল একটু। লাইট জ্বালিয়ে প্যান্ডেল খাটিয়ে এখানেও গান্ধীজীর শোকসভা চলেছে।

এর পাশেই আর এক দৃশ্য দেখে হাসি পেয়ে গেল বাপী তরফদারের। রেলিং—ঘেঁষা ফুটপাথে গজ দশেক দূরে দূরে কুপী জ্বালিয়ে দু’জন শীর্ণকায় গণৎকার বসে। সামনে ফুটপাথের ওপরেই খড়ির ছক-কাটা। তাদের সামনে একজন করে খদ্দের হাত বাড়িয়ে বসে আছে। এখানেও ভাগ্য গণনা চলছে। এক-আধজন আবার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। বসে পড়বে কি পড়বে না—দোনামনা ভাব।

বাপী তরফদার এগিয়ে চলল। মানুষ কত দূরের ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে নিশ্চিন্ত হতে পারে? আসলে এ একটা রোগ। রোগের মতো কিছু। এই রোগে বাপী নিজেও জর্জর। কিন্তু কোনো লোককে সে হাত দেখায় না। ঠিকুজি দেখায় না। সে জানে, দেখালে একটা রূঢ় বাস্তব তাকে হাঁ করে গিলতে আসবে। কল্পনায় যে সাম্রাজ্যের সে অধীশ্বর, সেটা কোনদিন সত্যের ধারেকাছে ঘেঁষবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী কোনো গণৎকার করবে না। বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, রতন বনিকের ভবিষ্যৎ-বচন বরং শুনতে ঢের ভালো লাগে তার।

কিন্তু ঠিক এই এক ব্যাপার থেকেই যে এই দিনটা অন্য সবগুলো গতানুগতিক দিন থেকে এত তফাৎ হয়ে যাবে, তখন পর্যন্ত এ-রকম সম্ভাবনা তার কল্পনা মধ্যেও নেই।

…বড় রাস্তা ছেড়ে ভিতরের একটা মাঝারি রাস্তা ধরে আরো আধ মাইলটাক দক্ষিণে হেঁটে এসেছিল। সামনের মোড়ের মাথায় একটা তিনতলা বাড়ির রাস্তাঘেঁষা একতলার ঘরটার দিকে চোখ গেল। বাপী আবারও হেসে উঠল। ওই . ঘরেই একজন জ্যোতিষী বসে সে জানে। এই রাস্তায় আরো এসেছে-গেছে। এই একজন বড়লোকের জ্যোতিষী। বড়লোকের ভাগ্য দেখে, ভাগ্য ফেরায়। ঘরের সামনে দু’টো তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে অভিজাত মেয়ে-পুরুষেরা অপেক্ষা করে। ভিতরের খদ্দের বেরিয়ে এলে তবে আর একজনের পালা।

আজও দূর থেকে সেই একই দৃশ্য দেখল। দু’খানা গাড়ি দরজায় দাঁড়িয়ে। বাইরে দু’জন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা। বাপী তরফদার হাসছে মৃদু মৃদু, এগিয়ে আসছে। সামনের দরজা দিয়ে ফরাস-ঢাকা চৌকিতে বসা জ্যোতিষীকে দেখা গেল। তার সামনে দুটি অভিজাত মহিলা বসে। পিছন থেকে তাদের পিঠ দেখা যাচ্ছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। জ্যোতিষীর মুখে হুঁকো-গড়গড়ার নল। নলের তামাক টানছে আর নিবিষ্ট মনে দেখছে কিছু।

দরজা ছাড়িয়ে এসে পাশের জানলা দিয়ে ভিতরে তাকাতেই বাপী তরফদার স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ডটা লাফালাফি করে বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। এ কাকে দেখছে বাপী তরফদার? কাদের দেখছে? সত্যি দেখছে না স্বপ্ন কিছু।

সত্যি না হলে গত আটটা বছরের এতগুলো দিন থেকে এই দিনটা—এই রাতটা মুহূর্তের মধ্যে এত তফাৎ হয়ে গেল কি করে? সত্যিই এখানে এত বড় একটা চমক তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে!

জানালার গরাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত দুই চক্ষু মেলে দেখছে। ওই দু’জনই এত বেশি চেনা তার যে দেখামাত্র সর্বাঙ্গের স্নায়ুগুলো একসঙ্গে টানটান হয়ে গেল। বয়স্কা মহিলার জমকালো বেশবাস, গলায় কানে হাতে ঝকমক এক রাশ গয়না। …মনোরমা নন্দী। জ্যোতিষীর সামনে কচি পদ্মের মতো দু’হাত মেলে বসে আছে তার মেয়ে মিষ্টি…মালবিকা। ছেড়ে আসা এক জায়গায় সে যেমন বিপুল নয়—বাপী, সেখানে এই মেয়েও তেমনি মালবিকা নয়—মিষ্টি। মিষ্টি মিষ্টি! বাপী, অপলক চেয়ে আছে। দশ আর আটে আঠেরো হবে এখন বয়স। দশ বছরের সেই গরবিনী মেয়েটা আঠেরোয় এই হয়েছে!

বাপী তরফদার তাদেরই দেখছে আর তার মা-কে দেখছে এ কি বিশ্বাস করবে?

ভিতরে জোরালো আলো। বাইরেটা সে তুলনায় অন্ধকার। ভিতর থেকে তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

কতক্ষণ কেটেছে জানে না। উঠতে দেখল তাদের। মনোরমা নন্দী হাসছেন। মিষ্টি নন্দীও হাসছে। মনোরমা নন্দী সুন্দর হাতে ব্যাগ খুলে দুটো দশ টাকার নোট জ্যোতিষীর সামনে রাখলেন। ভিতরের কথাবার্তা আসছে না।

নিজের ওপর আর এতটুকু দখল নেই বাপী তরফদারের। তারা বেরিয়ে আসতে সে দু’হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল।

মনোরমা বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালেন। পা-জামা পরা খয়ের রঙের গরম আলোয়ান জড়ানো একটা ছেলে হাঁ করে তাঁর মেয়েকে দেখছে। দেখছে না, দুই চোখ দিয়ে গিলছে।

—স্টুপিড! খুব অস্পষ্ট ঝাঁঝে কথাটা বলে মেয়ের হাত ধরে তিনি গাড়িতে উঠলেন। মেয়েটারও বিরক্তি-মাখা লালচে মুখ।

সাদাটে রঙের গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে আরো দক্ষিণে চলল।

পিছন থেকে গাড়িটার নম্বর চোখে পড়ল বাপী তরফদারের। তখনো স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে সে। গাড়ির রক্তবর্ণ সাইডলাইট দুটোও মিলিয়ে গেল।

হঠাৎ জিভে করে নিজের শুকনো ঠোঁট বার দুই ঘষে নিল বাপী তরফদার। আট বছর আগের সেই অকরুণ আঘাতের চিহ্ন আট দিনেই মিলিয়েছে। কিন্তু নিজের দেহের সেই তাজা রক্তের নোনতা স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে।


© 2024 পুরনো বই