সেই অজানার খোঁজে ২.৬

…সেটা সাতচল্লিশ সালের শেষের দিক। এই বাংলার মানুষ স্বাধীনতার মাশুল গুণছে। পৃথিবীর অনেক দেশকেই রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা পেতে হয়। কিন্তু এই বাংলার মাটি লাল চোরাগোপ্তার অন্তর্ঘাতী রক্তে সাম্প্রদায়িক হানাহানির রক্তে। এই সময়ে কোন্নগরে গঙ্গা আর শ্মশানের কাছাকাছি কল্যাণীকে নিয়ে নির্জনে বাসা বেঁধেছেন অবধূত। সঙ্গে লোক বলতে তখন একমাত্র হারু।

এই নব-দম্পতীকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো লোকালয় নয় তখন এটা। আশপাশে তখনো কোনো বাড়িই হয় নি। সামনের দিকে দূরে ছাড়া ছাড়া দুই একটা বাড়ি। পড়শী বলতে বেশ কিছু উদ্বাস্তুর চালাঘর। কলকাতার থেকে পুব-বাংলার ঘর ছাড়া মানুষ এই উপকণ্ঠেও উপছে পড়েছে।

কালীকিংকর অবধূত এখানে এসেই বেশ-বাস বদলেছেন। রক্তাম্বর ধরেছেন। রক্তবর্ণ ধুতি, রক্তবর্ণ পাঞ্জাবি বা ফতুয়া। ম্যাড়মেড়ে নয়, দস্তুর মতো সৌখিন কাপড়ের অথবা সিল্কের। এ-ব্যাপারে কল্যাণীর নির্দেশ মেনেছেন। তিনি হেসে বলেছেন, যা খুশি পরো, কিন্তু ভালো জিনিস এনো বাপু। অবধূতের এই পোশাক আর তাঁর নিঃশব্দ আচরণ অনেকটাই পাবলিসিটির কাজ করেছে। উদ্বাস্তুরা আর কিছু, দূরের মানুষেরাও লক্ষ্য করেছে, তাদের চোখে লালের ধাক্কা লাগে। দেখে, মানুষটা কারো সঙ্গে মেশে না, প্রায়ই শ্মশানে যায় আসে, শ্মশানের শব-বাহকরা এক-একদিন তাঁকে রাতেও ধ্যানস্থের মতো বসে থাকতে দেখে। অনেকে বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা সাগ্রহে আলাপ করতে আসে। তান্ত্রিক যে এটা সকলেই বুঝেছে, কিন্তু মানুষটা কখনো তন্ত্রীয় আচার বিচার বা অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি কথা ও বলেন না। বরং কারো অসুখ করলে দেখতে আসেন, ওষুধ দেন। আর অশ্চর্য, তাঁর ওষুধ যেন কথা বলে। দেখতে দেখতে এটাই প্রচারের বড় জিনিস হয়ে উঠতে লাগল। শহর ছাড়িয়ে এই দূরের নির্জনে আস্তানা নিলেও হারুকে নিয়ে অবধূতের দোকান-হাটে পাটে-বাজারে যাওয়া তো আছেই। লোকে সসম্ভ্রমে ঝকঝকে লাল-বসন পরা প্রসন্নমুখ তান্ত্রিককে দেখে। কোথা থেকে এলো তা নিয়েও গবেষণা করে।

আর একটা প্রচারও একটু একটু করে দানা বেঁধে উঠল। লাল বসন তান্ত্রিকের ঘরে একটি অনন্য রূপসী বউ আছে। কখনো তাঁকে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কোনোদিন বা গঙ্গা স্নান সেরে ফিরতে দেখা যায়। তান্ত্রিকের ভৈরবী-টেরবী মনে হয় না, দেখে বিয়ে করা বউই মনে হয়। কপালে সিঁথিতে সিঁদুর, গলায় সোনার হার, হাতে সোনার চুড়ি শাঁখা। কিন্তু রোগের ওষুধ বিসুদ জানে একজন তান্ত্রিক এমন এক দিব্যাঙ্গনা বউ যোগাড় করলেন কি করে? মানুষটার উপার্জন কিছু আছে বলেও তো মনে হয় না, ওষুধ-টসুধ যা দেন তারও দাম পর্যন্ত নেন না। চলে কি করে?

এ-প্রসঙ্গে হেসে অবধূত মানবাচরণের একটু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সাধকরা যদি সাধনা নিয়ে কচকচি না করেন, আর কিছু আধি-ব্যাধি তাক্-লাগানোর মতো করে সরিয়ে দিতে পারেন—লোকের তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলের সীমা থাকে না, আর তাঁর প্রতি এক ধরনের ভয়-মেশানো শ্রদ্ধাও উপছে ওঠে। কোন্নগরের মানুষেরা এই রীতির ব্যাতিক্রম নয়। এই দুটো কারণেই কাছের দূরের আর আরো দূরের লোকের আনাগোনা বাড়তে থাকল। অনেকেরই কর্মক্ষেত্র কলকাতায়। এমন লোক সম্পর্কে প্রচার সর্বত্রই মুখে মুখে ছড়ায়। কলকাতার মানুষদেরও আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে অবশ্য কয়েকটা বছর গেছে। ততদিন বহু-রোগের ধন্বন্তরী চিকিৎসক হিসেবে তিনি অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। হারুর কাজ দিনে দিনে বাড়ছিল। কিন্তু তাঁর চিকিৎসার সঙ্গে চোখ-ধাঁধানো লাল-বসন তান্ত্রিকের সাধনার কিছু অলৌকিক যোগ লোকে নিজেরাই কল্পনা করে নিয়েছে। তা যদি না হবে, লোকটা শ্মশানে যান কেন, কোনো কোনো রাত সেখানে কাটান কেন?

শুধু শরণার্থী নয়, উপদ্রবও এসে জুটত গোড়ার দিকে। এই প্রজন্মে মাস্তানের আবির্ভাব কোথায় না ঘটেছে। ঘরে ওই বয়সের রূপসী বউ থাকলে উপদ্রব এড়ানো খুব সহজ নয়। আর চোখে দেখার থেকে না-দেখা সুন্দরীর আকর্ষণ ঢের বেশী। রমণীর যে রূপ দেখে অনেক মুনি-ঋষির ধ্যান ছুটেছে, যে রূপ দেখে পৃথিবীর অনেক রাজা-বাদশার মাথা বিগড়েছে, অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক আগুন জ্বলেছে—তেমনি তিলেতিলে গড়া এক তিলোত্তমা আছে তান্ত্রিকের ঘরে, তাকে একবার চোখে না দেখলে চলে? অনেকেই সকাল বিকেলে এ-দিকে ঘুরঘুর করত, যাদের ভাগ্যে দর্শন মিলত তাদের প্রচারে কল্যাণীর রূপ এক-আধগুণ বেড়ে যেত। অসুখের ভান করেও এইসব মাস্তানদের কেউ কেউ এসে হাজির হয়েছে। এঁদের মুখ দেখলেই অবধূত রোগ বুঝতে পারতেন, আর অন্দর মহলের দিকে চোরা-চাউনি দেখলে চিনতে তো পারতেনই। অবধূত বলতেন, আপনাদের সহজ আর স্বাভাবিক রোগ ভাই, এক্ষুণি সেরে যাবে। বলেই হাঁক দিতেন, কল্যাণী!

তিনি সামনে এসে দাড়ালে বলতেন, এঁদের অসুখ করেছে তাই তোমাকে ডাকা, তারপর রোগী দুজন বা তিনজনকে বলতেন  একা কেউ আস না ), দেখুন ভাইয়েরা, খুব ভালো করে দেখে নিন, বার বার তো ওঁকে বিরক্ত করা যাবে না—কিন্তু ভাই একটা কথা রাত-বিরেতে যেন খাঁড়া হাতে মা-কালীকে স্বপ্নে-টপ্নে দেখে আঁকতে উঠবেন না।

মান বাঁচাতে কেউ কেউ চোখ লালও করছেন, স্ত্রীকে ডেকে এ-কি রকম যাচ্ছেতাই রসিকতা মশাই আপনার!

কল্যাণীরও চোখে মুখে হাসি উছলে উঠত। বলতেন, ওঁর ওই-রকমই বিচ্ছিরি কথাবার্তা, আপনারা বলুন, মায়ের প্রসাদ পাঠিয়ে দিচ্ছি। হারু প্রসাদ নিয়ে আসত। তাই খেয়ে তারা খাবি খেতে খেতে চলে যেত।

… কাকতালীয় কিছু কি ঘটে না? তা-ও একবার ঘটেছিল। এদেরই একজনের চোখের কি খারাপ ব্যামো হয়েছিল। ওমনি রটে গেছল, এটা পাপের শাস্তি। শ্মশানচারী তান্ত্রিকের ঘরে গিয়ে তাঁর বউয়ের রূপ গিলতে চাওয়ার শাস্তি। এমনকি যার ব্যাধি তারও পর্যন্ত এই ধারণাই হয়েছিল। আবার এসে অবধূতের পা জড়িয়ে ধরেছে। অবধূত নিজে টাকা খরচ করে তাকে কলকাতার ভালো চোখের ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছেন, চিকিৎসা করিয়ে রোগ সারিয়েছেন। পরবর্তী জীবনে সেই মাস্তান মাতাজীর মহা ভক্ত শিষ্যদের একজন।

একে একে সাত বছর কেটে গেছে, কিন্তু এর মধ্যে কালীকিংকর অবধূতের নিজের সমাচার সুস্থির নয় খুব। অস্থিরতার সবটুকুই মানসিক। হঠাৎ-হঠাৎ রোগের মতো সেটা চাড়িয়ে ওঠে। কল্যাণীর লক্ষ লক্ষ টাকা। এ-জন্য অবশ্য নিজের প্রতি ভদ্রলোকের কোনোরকম হীনমন্যতা বোধ নেই। এই সম্বলের ব্যবস্থা বক্রেশ্বরের ভৈরবী মা অন্যথায় শাশুড়ী শুধু মেয়ের জন্য করেন নি। আর কংকালমালী ভৈরবের অনুমোদন ছাড়া এ বিয়ে কখনোই হতে পারত না। তিনি কি আর কতটুকু তা জেনেই এবং তাঁর কাছ থেকে বিষয়-গত কোনো প্রত্যাশা না রেখেই এই বিয়ে হয়েছে। আর ঠাণ্ডা মাথায় আর একটা সত্যও তিনি অনুভব করতে পারেন। কল্যাণী যে-রকম স্থির মেজাজের মেয়ে, তাঁর অপছন্দেও এই বিয়ে কখনোই হতো না। হয়তো বা তার মায়ের চেষ্টায় এ-পছন্দটা কিছুটা এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে এই মেয়ের আচরণের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করেও অবধূতের মনে হয়েছিল তাঁরও নিজস্ব পছন্দ কিছু আছেই।

মুখেও জানতে বুঝতে কসুর করেন নি। —আচ্ছা, তুমি শুধু তোমার মায়ের ইচ্ছেয় আর ভৈরবগুরু মত দিলেন বলেই আমাকে বিয়েটা করলে, তাই না?

কল্যাণীর সাদা-সিধে জবাব, তা কেন, তাঁদের জন্য মনে একটু বেশি জোর পেয়েছিলাম অবশ্যই কিন্তু প্রথম দিন দেখেই আমার কেমন মনে হয়েছিল বিয়েটা তোমার সঙ্গে হতে পারে।

—নাঃ, আমি বিশ্বাস করি না—কেন মনে হয়েছিল?

—তা কি করে বলব, তার আগে অবশ্য মেসোমশাইয়ের মুখে শুনেছিলাম, এম. এ. পড়া একটি ঘর-ছাড়া ছেলেকে মা নিজের ছেলের আদরে শিবঠাকুরের আশ্রয়ে রেখেছেন—তখন অবশ্য একটু খটকা লেগেছিল, বরাবরই জানি আমার মা অনেক দূরের চিন্তা করতে পারেন…। তবে আমার পছন্দ ভিন্ন এ বিয়ে হতো না এটা জেনে রেখো, শিবঠাকুরও আগে আমার মত জেনে তারপর নিজের মত জারি করেছিলেন।

অবধূতের শোনার লোভ।—তোমার পছন্দ হতে গেল কেন? কল্যাণীর সোজা জবাব, হলে কি করব!

না, টাকার জোর নয়, টাকা রোজগারের বরাত অবধূতের নিজেরই শুরু হতে খুব সময় লাগে নি। কল্যাণীর চালচলন আচরণে আর একটা সহজ অথচ অব্যর্থ জোরের আভাস তিনি পান যা তাঁর নিজের নেই মনে হয়। এটা বলিষ্ঠ আর স্বতঃস্ফূর্ত সত্তার জোর কিনা তিনি ভেবে পান না। সবকিছু সহজে আর অনায়াসে গ্রহণ করার যেন একটা অদ্ভূত শক্তি আছে তাঁর মধ্যে। অবধূত সেটাই পরখ করতে চান, ধাক্কা দিয়ে দেখতে চান—সময় সময় এই চেষ্টাটা আঘাতের মতোও হয়ে ওঠে—কিন্তু কল্যাণী সব বুঝে সব-কিছু মেনে নিয়েই তাঁকে আরো বেশি জব্দ করেন। ফলে থেকে থেকে মনে হয়, তিনি যেন কল্যাণীর জীবনে অপরিহার্য একজন হয়ে উঠতে পারছেন না এমনি তাঁর সত্তার জোর। এই শক্তি কল্যাণী তার শিবঠাকুরের কাছ থেকে পেয়েছেন ভাবেন, তবু চ্যালেঞ্জ করার ঝোঁক। পরখ করার ঝোঁক। ভৈরবী মা হঠাৎ চলে যেতে অবধূতের চোখে জল এসেছিল, ভৈরব-গুরুর জন্যও মনটা বিষাদে ভরে গেছল, কিন্তু আশ্চর্য সহজ নির্বিকার দেখেছেন নিজের এই স্ত্রীটিকে। এ-রকম হবে এ-যেন তাঁর জানাই ছিল। উল্টে বলেছেন, আমার দুঃখ হবে কেন, শিবঠাকুরাকে তো চোখ বুজলেই দেখতে পাই, ডাকলে তো পাই-ই প্রায় আড়াই বছর বাদে অবধূতের হঠাৎই মনে হলো, কল্যাণীর ছেলেপুলে হচ্ছে না কেন? না হবার তো কোনো কারণ নেই, ভোগের সময় কোনোরকম সাবধানতারও ধার ধারেন না তিনি। তাহলে কি ব্যাপার?

কথাটা কল্যাণীকে বলতেই তিনি খুব সহজেই একেবারে অবাক করা কথা বলেছেন।—ছেলেপুলে তো হবে না, শিব ঠাকুর তো বলেই ছিলেন, শুধু তোমাকে নিয়েই আমার এ-জন্ম শেষ, প্রারব্ধও শেষ, সন্তান-সন্ততি হবে না।

শুনে অবধূত রেগেই গেছলেন।—আলবত হবে! ছেলেপুলে হওয়াটা তাঁর হাত না আমার হাত?

কল্যাণী হেসে ফেলেছিলেন, তোমার হাতেই তো আড়াই বছর ধরে আছি চেষ্টার কসুর করেছে? হলে হতো না?

অবুঝের মতো গোঁ ধরে অবধূত বলেছেন, সে-রকম সংকল্প নিয়ে চেষ্টা করি নি-একটা ছেলে বা মেয়ে অন্তত চাই আমার। বলতে বলতে বসে আমার দিকে চেয়ে হেসে ফেলেছিলেন। চেষ্টাটা প্রায় অত্যাচারের মতোই হয়ে উঠেছিল…বুঝলেন, তবু অন্যজনের সহিষ্ণুতার অপবাদ দিতে পারব না।

আবার বছর ঘুরে গেল। ছেলেপুলে হবার কোনো লক্ষণ না দেখেও অবধূত কংকালমালী ভৈরবের উক্তি মেনে নিতে রাজি নন। বলেছেন, দুজনের কারো কিছু গণ্ডগোল আছে, কলকাতায় গিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হবে। কল্যাণীর কাছে এ-ও যেন এক কৌতুকের ব্যাপার। একবারও আপত্তি করেন নি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরীক্ষা করে কোনো রকম দেহগত ত্রুটি খুঁজে পান নি কারো। অবধূত নিজের বা কল্যাণীর ঠিকুজির খোঁজ রাখেন না! তিনি লক্ষ্য করেছিলেন তাঁর বা স্ত্রীর হাতে দুই একটি করে সন্তানের স্বাভাবিক রেখা আছে।

তাঁর মন্তব্য কানে লেগে আছে। বলেছিলেন, ঘটনা কোন্ পর্যায়ে গেলে সেটা অলৌকিক বলব আমি ঠিক জানি না। অভ্যাস বা অনুশীলনে অনেক কিছুই পারা যায় যা সাধারণ লোকের বিচার-বুদ্ধির অগোচরে। কিন্তু আমার কাছে শুধু এ-সব ধরনের ব্যাপারগুলোই অলৌকিক।

…ক্রমশ অবধূত একটু বেশি আত্মসচেতন হয়ে উঠতে লাগলেন। নিজের ভিতর দেখেন, প্রবৃত্তি দেখেন, বিশ্লেষণ করেন। নিজের তুলনায় কল্যাণীর সত্তার জোরের পাল্লাটা অনেক বেশি ভারী মনে হয়। অসহিষ্ণুতা বাড়ে। তাঁরও ভিতরে বিবাগী সুপ্ত মন একটা আছেই। সে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় তাঁর মনের একটা দিক স্ত্রীর ক্রীতদাস হয়ে আছে। অবধূত মাঝে মাঝে ঘর ছাড়তে শুরু করলেন, মাঝে মাঝে পালাতে শুরু করলেন। নিজের কাছ থেকে নিজেকে উদ্ধার করা বড় কঠিন ব্যাপার।

ঘটনার সাজ দেখা শুরু হলো তখন থেকে। পুরী বেনারস গেছেন, লক্ষ্ণৌ হরিদ্বার দেরাদুন মুসৌরি করেছেন। সর্বত্র কিছু না কিছু ঘটেছে। কারো না কারো সঙ্গে আশ্চর্য রকম যোগাযোগ হয়েছে। পরে মনে হয়েছে কেউ যেন তাঁকে নাকে দড়ি পরিয়ে টেনে নিয়ে গেছল। তাঁর পার্টটুকু তাঁকে দিয়ে করিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এক-দিক দিয়ে তাঁর লাভ হয়েছে বইকি। মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি তাঁর কাছে থেকে এসেছে।

কিছুদিন বাদে ফিরে এসে কিছুটা সুস্থির হয়ে বসেন। তারপর আবার ছটফটানি শুরু হয়। ক্রীতদাসের বন্ধন ছেঁড়ার তাগিদে সময় সময় নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন। কিন্তু কল্যাণী নির্লিপ্ত, তার মনে যেন কোনো আঁচড়ই পড়ে না। কিছু বললে হেসে জবাব দেন, শিবঠাকুর তো বলেই রেখেছিলেন কারণে অকারণে তুমি জ্বালাবে আমাকে।

ঘটনার সাজ একটা বড় রকমের বাঁক নিল কোন্নগরে আসার সাত বছর বাদে। পাটনা যাবেন বলে কলকাতায় এসেছিলেন। বয়েস তখন সাঁইতিরিশ। রক্তাম্বর বেশ-ভূষা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লম্বা সিঁদুর চি; মাথার চুলে কদম-ছাট—সব মিলিয়ে চেহারার মধ্যে বলিষ্ঠ গোছের তন্ত্র-সাধকের ছাপ পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছে। জিনিস-পত্রের মধ্যে কাঁধে কেবল একটা ভারী ঝোলা। বাইরে বেরুনোর সময় প্রয়োজনীয় যা-কিছু সব ওই ঝোলাতে।

পাটনার গাড়ি রাতে। একজন ভক্তের সঙ্গে কথা হয়েছিল সকালের দিকে তাঁর বাড়িতে এসে রাতে রওনা হবেন। পাটনার টিকিটও তাঁরই কেটে রাখার কথা। তাঁর ছেলের রোগ নিরাময়ের বিনিময়ে অবধূত কিছু গ্রহণ করেন নি বলে সাগ্রহে এটুকু তিনি করতে চেয়েছিলেন।

বসে আছেন। ভিড় এড়িয়ে প্ল্যাটফর্মের অন্য ধার দিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বছর তিরিশ একত্রিশের একটি লোক বসে আছে, পাশে ছোট একটা সুটকেশ। পরনে প্যান্ট শার্ট, কিন্তু তেমন দামী কিছু নয়। আপাতদৃষ্টিতে স্মার্ট। তাঁকে দেখে অবধূত দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখতে লাগলেন। খুব মনে হলো এই লোকের সঙ্গে তাঁর কিছু নাড়ির যোগ আছে।

লোকটি বিমনা ছিল। গোড়ায় খেয়াল করে নি। কিন্তু লাল বেশ-বাসের এমনি মজা, চোখে পড়তেও খুব সময় লাগে না। লোকটি দেখল। তারপর অমন বেশের একজনকে ও-ভাবে চেয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক। ঝক-ঝকে দু‘চোখ যেন তাঁর মুখের ওপর বিঁধে আছে।

অবধূত পায়ে পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দৃষ্টি মুখের ওপর তেমনি অপলক। লোকটি যেন একটু অস্বস্তি নিয়ে নিজের অগোচরে উঠে দাড়ালো। —বলবেন কিছু?

—সুবু…!

জবাব দেবে কি, ভদ্রলোক ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে চেয়ে রইলো। অবধূত আবার জিজ্ঞেস করলেন, সুবীর চ্যাটার্জী?

এবারে তেমনি অবাক মুখেই মাথা নাড়ল। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল, আপনি…?

—চাঁদু নামে তোর কোনো দাদা ছিল কখনো?

—দাদা··· চাঁদুদা তুমি!

এই বেশ না হলেও চিনতে পারা আশ্চর্য। আরো আশ্চর্য তিনি ভাইকে চিনেছেন। ষোল বছর হয়ে গেল ঘর ছেড়েছিলেন। এই ভাইয়ের বয়েস তখন বছর পনেরো! পনেরো বছরের ছেলেকে একতিরিশে চেনা খুব সাধারণ চোখের কাজ নয়। বিশেষ করে যে ভাই বা বাড়ির কথা এত বছরের মধ্যে কখনো মনেও আসে নি।

অবধূত হৃষ্ট মুখে বসলেন, তাকেও বললেন বোস। এই যোগাযোগ বড় অদ্ভুত লাগছে তাঁর। আজ সাত বছর হয়ে গেল কলকাতার এত কাছে আছেন। নিজের ভিতরেই বিবেকের খোঁচা খেলেন একটু। কর্তব্য বোধেও বাবা বা বৈমাত্রেয় মা ভাই বোনদের কথা একবার মনে পড়ে নি। ভাইয়ের মুখের দিকে একবার চোখ দুটো হোঁচট খেল কেন বুঝলেন না। ভিতরের ঈষৎ আবেগে ফের ভালো করে দেখার কথা মনে হলো না। বললেন, ঠিক ঠিক চিনেছিস না এখনো সন্দেহ আছে? … বাড়ির খবর কি?

ছ’বছরের বড় ভাইকে এতকাল পরে দেখে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার কথা। কিন্তু ভাই তা করল না খেয়াল করেও অবধূত ভাবলেন, বেশি রকম হকচকিয়ে গেছে বলেই ভুলে গেছে।

সুবীর চ্যাটার্জী পাশে থেকে আর একদফা নিরীক্ষণ করল।—এখন আদল আসছে ..কিন্তু চেহারা অনেক বদলে গেছে তোমার।… বাড়ির খবর বলতে সাত বছর হলো বাবা নেই, তারও বছর দুই আগে আবু গেছে, বাবা সেই শোকই মৃত্যু পর্যন্ত সামলাতে পারেন নি।

আবু··· আবির, সব থেকে ছোট ভাই, তারও নিচে অবশ্য বোন সুলু—সুলতা। …বেঁচে থাকলে আবুর বয়েস এখন উনত্রিশ হতো, আট বছর আগে মারা গেছে মানে একুশ বছরে গেছে। জিজ্ঞেস করলেন, আবুর কি হয়েছিল?

—পুরী বেড়াতে গিয়েছিল, সমুদ্রে ডুবে শেষ।

অবধূত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন একটু। নিজেকে স্বার্থপরই মনে হচ্ছে এখন।—সুলুর বিয়ে হয়ে গেছে তো? কোথায়?

—ধানবাদে। ওর হাসব্যাণ্ড সেখানে এক কলিয়ারির অ্যাকাউনটেন্ট।

—আর মা…?

মা এখনো চাকরি করছে, ওই পুরনো স্কুলেরই অ্যাসিসট্যান্ট হেড-মিসট্রেস এখন, ষাটে রিটায়ারমেন্ট, আরো একবছর চাকরি আছে…তার পরেই ভাবনা।

অবধূতের দু‘চোখ আবার ভাইয়ের মুখের ওপর থমকালো একটু।

—ভাবনা কার… কেন ভাবনা?

এড়ানো গোছের জবাব শুনলেন, নানারকমর ঝামেলা, ভাবনা চিন্তা। ভুগছেও খুব তক্ষুনি বুঝলেন সরল জবাব পেলেন না। চেয়ে রইলেন একটু। চাউনিটা মুখের ওপর হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে সুবীর চ্যাটার্জী থতমত খেল একটু। অবধূত বললেন, তোরও তো দিন খুব সুবিধের যাচ্ছে মনে হচ্ছে না… মদ-টদ বেশি মাত্রায় খাস নাকি?

শুনে প্রথমে সচকিত একটু। তারপর হেসে সহজ হবার চেষ্টা।—বেশি মাত্রায় আর জোটে কোথায়, তুমি মুখ দেখেই বুঝে ফেললে?

—মুখ দেখে আমি কিছু কিছু বুঝতে পারি।

বেশ-বাস, গলায় রুদ্রাক্ষ, আঙুলে রূপোর ওপর মস্ত পলার আংটি সুবীর চ্যাটার্জী আর এক প্রস্থ ভালো করে দেখে নিল।—তান্ত্রিক সাধু-টাধু হয়ে গেছ নাকি?

প্রশ্নের মধ্যে একটু তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই স্টেশনে যে, চলেছিস কোথায়?

—রাউরকেল্লা।

—সেখানে কেন?

—একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। হঠাৎ উৎসুক একটু। —মুখ দেখে কিছু-কিছু বুঝতে পারো… মুখ দেখে বলে দিতে পারো চাকরিটা হবে কি না?

অবধূতের তখনো ধারণা ভাই যে চাকরি করছে তার থেকে কোনো ভালো! চাকরির ইন্টারভিউ হবে। স্থির দুটো চোখ আবার তার মুখের ওপর বিদ্ধ হলো। ছোট ভাই দুটো আর বোনকে ভালোই বাসতেন তিনি। কিন্তু এতকাল বাদেও ভিতরে একটা অপ্রসন্ন অনুভূতি কেন জানেন না। জবাব দিলেন, পারি। হবে না।

আধফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠতে লাগল। ক্রোধের স্পষ্ট অভিব্যক্তি। একটা হতাশার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো যেন। সুবীর চ্যাটার্জীও ভুলে গেল দীর্ঘ ষোল বছর বাদে বড়আকস্মিক ভাবে এই দাদাটির সঙ্গে তার দেখা। বিদ্রূপের সুরে বলে উঠল, আর যদি হয়…তোমার দেখা পাব কোথায়? —কোন্নগরে। গঙ্গার ধারে শ্মশানের দিকে যেতে যে কোনো লোককে জিজ্ঞেস করলে বাড়ি দেখিয়ে দেবে।

…বাড়ি না তোমার আশ্রম?

—বাড়ি। তোর গাড়ি ক’টায়?

আটটা পঞ্চাশ, এখন কটা বেজেছে?

অবধূত লক্ষ্য করলেন, ইন্টারভিউ দিতে চলেছে, কিন্তু হাতে একটা ঘড়িও নেই।সাড়ে আটটা।…মা সেই আগের বাড়িতেই আছেন তো?—না। একটু ইতস্তত করে সুবীর চ্যাটার্জী জবাব দিল, বাবা জীবিত থাকতেই দুজনে মিলে ধার দেনা করে ছোট একটু বাড়ি করেছিল, বেশির ভাগই মায়ের টাকায় হয়েছে, এখনো ধার শোধ হয় নি বলে মায়ের মাইনে থেকে টাকা কাটান যায়, তার জন্য মা-কে টিউশনিও করতে হয়—

অবধূত থমকে চেয়ে আছেন। হেসে ফেললেন, তোর অত ফিরিস্তি দেবার কোনো দরকার নেই, তোদের বাড়িতে আমি কোনো ভাগ বসাতে যাব না—কোথায় বাড়ি? নম্বরটা কি?

বাড়ি ফার্ন রোডের কাছে। নম্বরও বলল। অবধূতের মনে হলো চাকরি হবে না বলায় এখনো তার ভিতরের উষ্মা যায় নি।…আশা নিয়ে যাচ্ছে এ-রকম না বলাই উচিত ছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য কেন যে একটা বিরূপতা তাঁকে পেয়ে বসল কে জানে।

—এখন গেলে মায়ের সঙ্গে দেখা হবে? স্কুলের জন্য ক’টা থেকে তৈরি হন?

ভাইয়ের চাউনি দেখে মনে হলো এক্ষুনি বলবে যাওয়ার দরকার কি তোমার? মোলায়েম না হলেও অন্য জবাবই পেলেন।—দুদিন ধরে মা হাপের টানে খুব কষ্ট পাচ্ছিল, স্কুলে যাচ্ছে না।

আর কিছু না বলে অবধূত উঠে পড়লেন। যাবার আগে বলে গেলেন, ফিরে এসে পারলে কোন্নগরে যাস একবার, আমি আজই দিন পাঁচ সাতের জন্য পুরী যাচ্ছি।

ট্রামে বাসে এ-সময় প্রচণ্ড ভিড়। অবধূত একটা ট্যাক্সি নিলেন। মন থেকে ভক্তের চিন্তা বা পুরীর চিন্তা সরে গেছে। ড্রাইভারকে বললেন বালীগঞ্জের দিকে যেতে।…ভিতরটা টানছে খুব। কেন? জানেন না। ভাই সুবুকে দেখে একটুও ভালো লাগল না। এত কালের সমাচার জানেন না, কিন্তু মনে হলো তার ভিতরে অনেক রাগ ক্ষোভ আর অসহিষ্ণুতা জমে আছে। আর মনে হলো সে-রকম সহজ সরল রাস্তায় চলে নি।… স্কুল মাস্টার মায়ের কড়া শাসনে থেকেও ভাইটা এ-রকম হলো কি করে? বাড়ি ছাড়ার সময় তো ক্লাস নাইনে পড়ত, স্কুলে তো বরাবর ফার্স্ট সেকেণ্ড হতো, এই ছেলের জন্য মায়ের মনে মনে বেশ গর্ব ছিল। বাবাকে শোনাতেন, শাসনে রাখতে পারলে ছেলে-মেয়ে আবার বিগড়য় কি করে?…এই বয়সে সুবু নতুন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে রাউরকেল্লা, তার মানে যে কাজে আছে তাতে আদৌ খুশি নয়।

রাস্তাটা সরু হলেও ট্যাক্সি ঢোকে। বন্ধ দরজার গায়ে বাড়ির নম্বর আঁটা।

যাঁর কাছে আসা দোতলার ঘরের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তিনিই তাঁকে ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে দেখলেন। তারপর তারই দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আরো অবাক। নমিতা দেবী ভিতরের দিকের বারান্দায় এসে দাড়ালেন। নিচে কর্মব্যস্ত ঠিকে ঝি দরজা খুলে দিতে চোখে আবার লালের ধাক্কা।

ভারী গলার প্রশ্ন শুনলেন, মা কোথায়?

ঝিয়ের জবাব, ওপরে ডেকে দিচ্ছি। এই বেশের মানুষ দেখে সে-ও সন্ত্রস্ত।

—তিনি অসুস্থ শুনেছি, ডাকতে হবে না, আমাকে ওপরে নিয়ে চলো। নমিতা দেবী ওপরে দাঁড়িয়ে মানুষটাকে দেখছেন। তাঁর কথা শুনছেন। পরিচিত জনের মতোই ওপরে নিয়ে যাবার প্রস্তাব। তাড়াতাড়ি তিনিই নিচে চলে যাবেন না অপেক্ষা করবেন ভেবে পেলেন না। ততক্ষণে ঝিয়ের পিছনে রক্তাম্বর বেশ বাসের আগন্তুক দোতলায় হাজির।

অবধূত থমকে দাড়ালেন। স্থির চোখে কয়েক পলক চেয়ে রইলেন। সাদাটে চামড়ায় মোড়া কংকাল-সার রমণী দেহ। … মা কোনোদিনই স্বাস্থ্যবতী ছিলেন না, কিন্তু তা বলে এই চেহারা কল্পনা করা যায় না। অবধূত পায়ে পায়ে এগোলেন।… মায়ের বিভ্রান্ত ফ্যালফেলে চাউনি।

অবধূত বারান্দাতেই জানু মুড়ে হাঁটুর ওপর বসলেন, উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা রেখে প্রণাম করলেন।

নমিতা দেবী শশব্যস্তে দু‘পা পিছিয়ে গেছেন, নিজের অগোচরে দু‘হাত জোড় করে ফেলেছেন। আর তেমনি বিমূঢ় চোখে চেয়ে আছেন। রক্তাম্বর বেশ-বাসের দরুন শুধু নয়, অনায়াসে ওপরে উঠে আসা, এগিয়ে আসার মধ্যে এক-ধরনের স্নিগ্ধ সৌম্য ব্যক্তিত্ব দেখেও হঠাৎ অভিভূত তেমনি। তাঁরই উদ্দেশ্যে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে দেখলে। সন্ত্রস্ত হবার কথা।

অবধূত মুখ তুলে সোজা হলেন। চোখে চোখ রেখে বললেন, আমি চাঁছ।

রক্তশূন্য কোনো শীর্ণ মুখে বিস্ময়ের এমন রেখাপাত অবধূত কমই দেখেছেন।

…চাঁদু! গলার স্বরেও বিস্ময় ঝরল। চাঁদু কে এ-ও ভালো করে মাথায় বসছে না যেন। এবারে দু‘তিন পা এগিয়ে এলেন।—তুমি …তুই চাঁদু! সেই চাঁদু-!

অবধূত উঠে দাড়ালেন। সহজ ভারী গলায় বললেন, আমি বছর কয়েক হলো কোন্নগরে আছি, পুরী যাব বলে সকালেই কলকাতায় চলে এসে ছিলাম, স্টেশনে সুবুর সঙ্গে দেখা, শুনলাম ইন্টারভিউ দেবার জন্য রাউরকেল্লা যাচ্ছে, তার কাছ থেকে তোমাদের ঠিকানা নিয়ে চলে এলাম। কোটরাগত দু’চোখে এখনো যেন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব।—সুবু তোকে দেখে চিনতে পারল…?

—তা পারে নি, আমিই ওকে দেখে চিনেছি।…কিন্তু এ-কি তোমার চেহারা হয়েছে মা! সুবুর মুখে শুনলাম হাঁপানিতে কষ্ট পাচ্ছ খুব, ডাক্তার কি বলে, কার্ডিয়াক কিছু নয় তো?

নিজের স্বাস্থ্য সমাচার বলবেন কি, বিমাতাটির এখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। কোনোরকমে জবাব দিলেন, না, আজ ছ’সাত বছর হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি দেয়ালের দিক থেকে একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে এলেন, —তুই সেই চাঁদু…আমার কথা শুনে আমাকে দেখতে এসেছিস, তোকে এত কষ্ট দেবার পরেও আমাদের মনে রেখেছিস। শুনে দুঃখই হলো অবধূতের। বিমাতা বলে ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনো কোনো কষ্ট তাঁকে দেন নি। সর্ব ব্যাপারে নীতির দিকে প্রখর দৃষ্টি ছিল, তাই রেগে যেতেন আর বাবার কাছে নালিশ করা কর্তব্য ভাবতেন। অবধুত কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে দেওয়ালের কাছে রাখলেন। নিঃসংকোচে বিমাতার দুই কাঁধে নিজের দু হাত রেখে তাঁকে ওই চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। —আগে তুমি স্থির হয়ে বোসো মা, উত্তেজনাতে আবার হাঁপাচ্ছ দেখছি—দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আর একটা বেতের চেয়ার টেনে এনে মুখোমুখি বসলেন।…মায়ের দু‘চোখ ও-রকম হয়ে উঠল কেন! সন্তানের হাতের দরদরে স্পর্শ কতকাল পান নি? এই ব্যাপারগুলো অনুভব করতে অবধূতের সময় লাগে না।

—এবার সব খবর বলো, বাবা নেই আর আবুটাও নেই শুনেছি—নমিতা দেবীর শীর্ণ মুখের পাতলা ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল বার কয়েক। তারপর বললেন, সবই আমার অদৃষ্ট আর কর্মের ফল বাবা, নিজের ছেলেদের নিয়ে বড় গর্ব ছিল…সব থেঁতলে দিয়ে গেল। তুই অমানুষ হয়ে যাচ্ছিস ভেবে তোকে কত যন্তন্না দিয়েছি, নিজের অদৃষ্টের কথা ভাবলে এখনো মনে হয় আমার জ্বালাতেই তুই ঘর ছেড়েছিস।

—ও-কথা তুমি আর একবারও বলবে না মা, কেউ আমার উপকার বই অপকার করে নি, জীবনে যা পেয়েছি তার জন্য আমি সক্কলের কাছে ঋণী।…যাক, সুলুর কেমন বিয়ে হলো, ধানবাদে থাকে শুনলাম, ছেলে-পুলে কি?

—মোটামুটি পর পর তিনটেই মেয়ে, এ হয়েছে আমার আর এক চিন্তা। মেয়েগুলোর অসুখ লেগেই আছে, খরচে টান পড়লে চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে আমাকেই টাকা পাঠাতে লেখে…ভাই-বোন দু‘জনেই ভাবে আমি টাকার গাছ—ঝাঁকালেই পড়বে। উৎসুক হঠাৎ, ও-কথা থাক, আগে তোর কথা বল, ভোর এই বেশভূষা কেন?

অবধূত ফিরে প্রশ্ন করলেন, খারাপ লাগছে?

—খারাপ লাগছে না, হঠাৎ তোকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে আমার মনে হচ্ছিল কোন্ মহাপুরুষ এলো!…সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে গেচিস? অবধূত হেসে জবাব দিলেন, লোকে আমাকে তান্ত্রিক কালীকিংকর অবধূত বলে জানে…কিন্তু সাধু হয়েছি কি ভণ্ড হয়েছি সেটা এরপর তুমি কোন্নগরের বাড়ি এসে নিজে বিচার করবে কবে তোমাকে নিয়ে যাব বলো—আমার ইচ্ছে করছে আজই নিয়ে যাই।

মায়ের পাতলা ঠোঁট আবার একটু থরথর করে কেঁপে উঠল কেন বুঝলেন না। অস্ফুট স্বরে বললেন, যাওয়া অদৃষ্টে থাকলে যাব, কবে হবে কে জানে। পরের প্রশ্নটা সুবুর মতোই, কিন্তু আদৌ তির্যক নয়।—কোন্নগরে তোর আশ্ৰম।

অবধূত হেসে জবাব দিলেন, গার্হস্থ আশ্রম বলতে পারো, সেখানে তোমার বৌ-মা আছেন, তাঁর তদারকে খেয়েদেয়ে বহাল তবিয়তে আছি।

—কতদিন বিয়ে করেছিস?

—তা প্রায় আট বছর হতে চলল।

—ছেলেপুলে কি?

—নেই।

এম. এ. বি. টি. পাস অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস মা বলে উঠলেন, এত দিনেও নেই কেন রে?

অবধূত হাসতে লাগলেন। তারপর জবাব দিলেন, তোমার বউমাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলবেন, তাঁর শিবঠাকুর মানে বক্রেশ্বর থানের কংকালমালী মহা-ভৈরবের ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর প্রারব্ধ এ-জন্মেই শেষ—তাই কোনো পিছুটান নেই, সন্তানও নেই।

নমিতা দেবীর কোটরের দু‘চোখ উৎসুক। —সেখানকার মস্ত সাধক বুঝি তিনি?

—মস্ত সাধকই বলতে পারো, কিন্তু সেখানে আর নেই—আদৌ কোথাও আছেন কিনা তাও জানি না।

সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, তুই তাঁকে দেখেছিস?

আগে হলে এই এম. এ. বি. টি. মা সাধুসন্তদের প্রসঙ্গে নাক সিঁটকোতেন! অবধূত জবাব দিলেন, তিনি আমার সাক্ষাৎ গুরুদেব, পাঁচ বছর ধরে দেখেছি।

নমিতা দেবী সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে আছেন। কেন বোধগম্য হলো না। একটু বাদে জিজ্ঞেস করলেন, তোর পুরীর গাড়ি কখন?

—রাতে।…কিন্তু পুরী আর যাব কিনা ভাবছি।

—কেন?

—এখনো তোমার বেশ হাঁপের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি।…নাঃ, পুরী আর যাবই না, শোন মা, তোমার এই ছেলেকে লোকে মস্ত উঠতি তান্ত্রিক সাধু ভাবে, কিন্তু সত্যিই সে-রকম কিছু না—আসলে যেটা কিছু জানি সে হলো চিকিৎসা বিদ্যা—তার ফল পেয়েই লোকে অলৌকিক শক্তি ভাবে যেতে দাও, এতক্ষণ তোমাকে দেখে আমি আঁচ করতে পারছি কি ওষুধ তোমার দরকার, আর কয়েকটা কথা কেবল জেনে নেব, সে হবে‘খন, পুরী যাওয়া থেকে আগে তোমাকে সারিয়ে তোলা বেশি দরকার—তুমি তোমার অসুখের ভাবনা এবার আমার হাতে ছেড়ে দাও মা।

বিমাতার দুই পাতলা ঠোঁট আবার থরথর করে কেঁপে উঠতে দেখলেন অবধূত। কোটরের চোখও ঝাপসা হয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বললেন, মা…মা…মা বলে এখন কেউ আর ডাকেও না।

অবধুত নির্বাক। চেয়ে আছেন।

সামলে নিলেন, বললেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তোর কোনো অসুবিধে নেই তো? এখানে খেয়ে যেতে পারিস না?

—পারি। কে রাঁধে?

—কে আবার। অমিই।

—কি খাও?

—আমি তো সেদ্ধ আর সুক্তো-ভাত খাই, তা বলে তোকেও তাই খাওয়াব নাকি! কি খাস জেনে এক্ষুণি ঝি‘টাকে বাজারে পাঠাব—ও-ই আমার বাজার-টাজার করে।

—ওকে বাজারে পাঠালে আমি খাব না। আজ আমি মায়ের প্রসাদ পাব —মায়ে ছেলেতে সেদ্ধভাত খাব।

বিমাতার দুচোখ আবারও ঝাপসা হয়ে আসছে। উঠে চলে যেতে বললেন, বোস, আসছি—। একটু এগিয়ে আবার ঘুরে দাড়ালেন।—তোর আমিষ চলে কি চলে না বল—

—আমার সব চলে, কিন্তু কিছু দরকার নেই বললাম তো।

চলে গেলেন। দশ মিনিটের মধ্যে একটা ডবল ডিমের ওমলেট আর ছ’পিস টোস্ট ডিশে নিয়ে এলেন।—পাশেই দোকান, কিছু অসুবিধে হয় নি, খেতে তো একটু দেরি হবে, পরে আমার সঙ্গে খাবি। অবধূত খুশি হয়েই ডিশ হাতে নিলেন।

মা-কে বলে পনেরো বিশ মিনিটের জন্য বেরুলেন। কিন্তু ধারে কাছে কোনো দোকানে ফোন পেলেন না। খোঁজ করতে করতে একেবারে পোস্ট অফিসে এসে তবে পেলেন। কলকাতার ভক্তকে জানালেন তাঁর ওখানে যাওয়া হচ্ছে না, পুরীও না। ট্রেনের টিকিট বিক্রী করে দিতে বলে ফিরতে আধ ঘণ্টার বেশী সময় লেগে গেল।

এসে দেখেন বিমাতা রান্নায় ব্যস্ত। সেদ্ধ আর সুক্তো ছেড়ে বাসনে দু’ রকমের তরকারিও কোটা রয়েছে। পাশে দুটো ভাঁড় দেখেই বুঝলেন, দই আর মিষ্টি আনানো হয়েছে। মায়ের রান্নার ব্যবস্থা দোতলাতেই। এক তলার পর পর দুটো ঘরেই দোকান, তার মানে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। খুশিমুখে বলে উঠলেন, এ-যে মস্ত ব্যবস্থা দেখছি!

মা হাসলেন একটু। বললেন, রান্নার আনন্দ ভুলেই গেছি, আজ তুই খাবি বলে আমার উৎসাহ বেড়ে গেছে।

অবধূত বারান্দা থেকে একটা বেতের চেয়ার এনে কাছে বসলেন। দুই এক কথার পর জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মা, সুবুর বউ ছেলে নেয়ে কাউকেই এখানে দেখছি না, কি ব্যাপার বলো তো?

শীর্ণ মুখে টান ধরতে দেখলেন। একটু বাদে জবাব দিলেন, ও হতভাগার কথা থাক এখন বাবা—

অবধূত স্তব্ধ একটু। ও-প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে একটু বাদে বললেন, তুমি কষ্ট পেলে থাক মা… মুখ দেখে আমারও মনে হয়েছিল ও খুব ভালো নেই। আমার সত্যি সে-রকম কোনো ক্ষমতা আছে কিনা বোঝার জন্য জিজ্ঞেস করেছিল, যে ইন্টারভিউ দিতে রাউরকেল্লা যাচ্ছে সেই চাকরিটা হবে কি না। আমি হবে না বলতে ও রেগেই গেল—

মা ঈষৎ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, তুই না বললি…সত্যি হবে না তাহলে? হতভাগার দূরে কোথাও চাকরি হলে যে আমি বেঁচে যেতাম…তুই এরকম বলতে পারিস?

—মুখ দেখে ভাগ্যের লক্ষণ কিছু কিছু চিনতে পারি, দ্যাখো, আমার ভুল হতেও পারে। ভাইকে ও-রকম বলার জন্য অবধূত মনে মনে আর এক দফা পস্তালেন। একটু চুপ করে থেকে আবার মুখ খুললেন, তারপর তোমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে দিতে চায় না মনে হলো, ওর ভয় পাছে আমি বাড়ির অংশ দাবি করি—

রধিতে রধিতে মা রূঢ় মন্তব্য করলেন, যেমন স্বভাব, দুনিয়ায় ও ভালো কিছু দেখে না—

যাক, শেষে দিল অবশ্য, কিন্তু এ-ও জানিয়ে দিল, এ-বাড়ির বেশিরভাগই তোমার টাকায় হয়েছে, তুমি এখনো দেনা টানছ আর অসুস্থ শরীর নিয়ে এ-জন্য তোমাকে টিউশানিও করতে হচ্ছে.. সত্যি নাকি?

মা জবাব দিলেন না। তাইতেই বোঝা গেল সত্যি। অবধূতের জানার আগ্রহ কত দেনা। কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলেন না।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ঘণ্টা দুই বিশ্রাম করে কোন্নগরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁর আগে মায়ের অসুখ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। নাড়ি দেখার অছিলায় হাতের রেখাও দেখে নিলেন। হিজিবিজি রেখাগুলো সব টানা অশান্তির চিহ্ন, শারীরিক এবং মানসিক। কিন্তু ঋণের চিহ্ন তেমন স্পষ্ট নয়, ফিকে হয়ে এসেছে। সে-রকম বড় অবস্থার কারো হাতে ঠিক এটুকু চিহ্ন থাকলে ঋণের পরিমাণ বেশি হতো। কিন্তু মায়ের অবস্থা যতটুকু আঁচ করতে পেরেছেন তাতে ঋণের পরিমাণ চার-পাঁচ হাজার টাকার বেশি হতে পারে না মনে হলো। বলে গেলেন, পরশু সকালের মধ্যে আমি তোমার ওষুধ নিয়ে আসছি—সেদিনও আমি তোমার হাতের ঠিক এই রান্নাই খেয়ে যাব কিন্তু।

অনেকদিন বাদে অবধূত একটা আত্মতৃপ্তির কাজ হাতে নিয়েছে যেন। একদিন বাদ দিয়ে তার পরদিন সকালেই এলেন। মা-কে দেখে আজ আগেরদিনের থেকে একটু প্রফুল্ল মনে হলো। বললেন, আমি ভাবছিলাম তুই কতক্ষণে আসবি।

জলখাবারের আয়োজনও করে রেখেছিলেন। মুখ হাত ধোয়া হতে নিয়ে এসে সামনে বসলেন। বললেন, তুই পরশু চলে যাবার পর থেকে আমার সমস্তক্ষণই মনে হয়েছে তুই আর এক মানুষ হয়ে ফিরেছিস, তোর এখন মস্ত শক্তি—

অবধূত হেসে উঠলেন। বললেন, শক্তি বলতে গুরুর দয়ায় আর আমার শাশুড়ী মায়ের দয়ায় রোগের চিকিৎসা কিছু শিখেছি, এছাড়া মোটামুটি এক-রকমই আছি। আসলে তোমার নিজের মন বড় দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই এতকাল পরে দেখা ছেলের অনেক শক্তি ভাবতে ভালো লাগছে। জলখাবারের দিকে তাকালেন, অনেক আয়োজন করেছ দেখছি, ভালোই হয়েছে, খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু তার আগে তুমি একটা কাজ করো—

থলে থেকে একটা প্যাকেট বার করে তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন, এটা ধরো দেখি—

কিছু না বুঝেই হাতে নিলেন, ওষুধের মোড়ক এ-রকম হয় কি করে ভেবে পেলেন না।—এতে কি?

—তোমার বউমার সামান্য কিছু প্রণামী, আগে তুলে রেখে এসো।

শোনা-মাত্র আঁতকে উঠলেন, এত টাকা, না না না—

অবধূত বসা থেকে আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালেন।—খিদের মুখে চলে যাব তুমি চাও? আমার রাগ আর অভিমান কিন্তু এখনো সেই রকমই আছে—

মা ধড়ফড় করে উঠলেন, পাগলের মতো এ তুই কি কাণ্ড করছিস, এখানে তো অনেক টাকা! তোকে আবার পেলাম এই ঢের—

—আমাকে আবার পেতে হলে এ ক’টা টাকা তোমাকে নিতে হবে। শোনো মা, আমার মা চাকরির পর এই শরীর নিয়ে টিউশনি করবে এ আর আমি হতে দেব না। খুব বেশি নয়, এখানে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে এ-দিয়ে তোমার সব ধার শোধ হয়ে যাবে না? হ্যাঁ কি না বলো? অস্ফুট জবাব দিলেন, হয়েও বেশি হবে, প্রভিডেণ্ড ফাণ্ড আর লাইফ ইনসিওরেন্স লোন মিলিয়ে আর চার হাজার দু‘শ টাকা বাকি… কিন্তু এতকাল পরে এসে আমাকে তুই এ-ভাবে—

—বললাম তো আমাকে যদি ছেলে ভাব, এ নিয়ে আর একটি কথাও বলবে না। হাসলেন।তাছাড়া আমি পরের ধনে পোদ্দারি করি মা, নিশ্চিন্ত থাকো, এ-টাকা আমারও না, তোমার বউয়ের।

—ছি ছি, যাকে চোখেও দেখি নি, তার থেকে তুই টাকা নিয়ে এলি! কি ভাবল আমাকে—সে কিছু ভাবার মেয়ে কিনা একবার চোখে দেখলেই বুঝতে পারবে, তুমি গ্রহণ করলে নিজেকে ধন্য ছাড়া আর কিছু ভাববে না, যাও, চট্‌ করে রেখে এসো—-আমার খিদে পেয়েছে বললাম না?

…চেয়ে আছেন। পাতলা দুই ঠোঁট থরথর করে এবারে বেশ কাঁপল। চোখের দৃষ্টি জলে ঝাপসা। বিড়বিড় করে বললেন, তোর কিছুই খিদে পায় নি, আমাকে টাকা নেওয়াবার জন্য খিদে-খিদে করছিস। টাকার প্যাকেট শাড়ির আঁচল টেনে বড় করে জায়গা করে বেঁধে গলায় জড়ালেন।—ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে রাখব, তুই খা।

অবধূত আনন্দ করে খেতে শুরু করলেন। মা অপলক চেয়ে আছেন। একটু বাদে জিজ্ঞেস করলেন, বেশি না হলেও এই দেনাটুকু শোধ হবার আগে যদি মরে যাই এ-জন্য আমার মনে খুব দুশ্চিন্তা ছিল…তুই সেটা আমাকে দেখে বুঝতে পেরেছিলি?

—কিছু পেরেছিলাম, তাছাড়া সুবুও বলেছিল। কি মনে হতে তাড়াতাড়ি বললেন, তুমি কিন্তু টাকার কথা সুবুকে একদম বলবে না মা—ও শুনলেই ধরে নেবে আমার কোনো মতলব আছে।

অনুচ্চ কঠিন স্বরে মা বললেন, ওর মতলবের আর আমি ধার ধারি না, দিনে দিনে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে আমাকে…তবে তোর টাকা আছে জানলে তুই মুশকিলে পড়তে পারিস—

অবধূত উতলা।—কেন, ও চাকরি বাকরি করছে না?

—সব গেছে! বলব, খেয়ে নে…ওই ভাইয়ের যদি মতি ফেরাতে পারিস এই পৃথিবীতে আর আমি কিছুই চাই না।

…মাকে ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিয়ে ঘড়ি ধরে তা খাবার তাগিদ দিয়ে অবধূত বিকেলের দিকে কোন্নগর রওনা হয়েছেন। পনেরো দিন ওষুধ চলার পর আবার এসে খবর নেবেন বলে গেছেন।

মনটা বড় বিষণ্ণ। কড়া নিয়ম-নীতির এই মাটির কপালে সুবুকে নিয়ে এত দুঃখ আছে ভাবতে পারেন নি। এত ভালো ছেলে এমন পরিণামের দিকে গড়ায় কি করে, কে এই ভাবে কাকে সুখের বিপরীত দিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেয়, কেন দেয়, ভেবে পেলেন না।

…শুধু ম্যাট্রিকে বেশ ভালো রেজাল্ট করেছিল। ছোট-খাট স্কলারশিপও একটা পেয়েছিল। বি. এ. আর এম. এ.-তে খুব অল্পের জন্য ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস পায় নি। চব্বিশ বছরের মধ্যে পরীক্ষা দিয়ে ভালো চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। গেজেটেড অফিসারের পোস্ট। মা দেখে শুনে একটি পছন্দের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছিলেন চাকরির এক বছরের মধ্যে। মেয়েও বি. এ. পাশ, এমনিতে বেশ ভালো, কিন্তু একটু মেজাজী। … স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে সুবুর চাকরির কপাল আরো খুলে গেল। আর সেটাই কাল হলো। রিলিফ অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশনের পদস্থ অফিসার হয়ে বসেছে। উদ্‌বাস্তুদের নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় বিস্তর মাথা ঘামাচ্ছেন। সুবু তাঁরও নেক নজরে পড়েছিল। ফলে ওর হাতে তখন অনেক ক্ষমতা, তার তদারকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে।

এর কিছুকাল পর থেকেই মা লক্ষ্য করলেন, বউয়ের সঙ্গে সুবুর প্রায়ই খিটির-মিটির ঝগড়াঝাঁটি বাঁধছে। তিনি জানেন কাজের চাপে সুবুর বাড়ি ফিরতে রাত হয়। পরে ওই বউয়ের কাছ থেকে জেনেছেন সুবু মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে। মা কঠিন হাতে শাসনের চেষ্টা করেছেন। স্পষ্ট বলে দিলেন, এ-ভাবে চললে এ-বাড়িতে ঠাঁই হবে না। এরপর থেকে সুবু কিছুটা গোপনতার আশ্রয় নিল। তার প্রায়ই ট্যুর থাকে, ক্যাম্প ইন্সপেকশন থাকে। তখনকার খবর আর তিনি পাবেন কি করে।

কিন্তু অনেক খবর রাখত সুবুর বউরের এক মামাতো দাদা। সে ওই বিভাগের না হলেও অন্য বিভাগের ছোট-খাটো অফিসার। সে এই ভগ্নিপতির সম্পর্কে অনেক খবর রাখত। ফোনে সাবধানও করত। কাগজে মাঝে মাঝে উদ্বাস্তু মেয়ে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অভিযোগও থাকত। নাম না করলেও কোনো কোনো অফিসার এ-সব কেলেংকারির সঙ্গে যুক্ত এমন ইঙ্গিত বা কটাক্ষও থাকে। মা বউয়ের সঙ্গে সুবুর তুমুল ঝগড়ার আভাস পান। এক-এক রাতে সুবুর চাপা গর্জনও কানে আসে, মিথ্যে কথা! সব মিথ্যে। কাগজের লোকের চোখ টাটায় তাই এ-রকম লেখে।

…এরপর দেখা গেল কটাক্ষ এক-এক সময় এমন স্পষ্ট যে, এই অফিসার কে বা কারা স্পষ্টই ধারণা করা যায়। গণ্ডগোলের সূচনা দেখা দেয়। কিন্তু এত ক্ষমতা যাদের, যাদের হাত দিয়ে স্রোতের মতো টাকা খরচ হচ্ছে, তাদের ধামা-চাপা দেবার শক্তিও খুব কম নয়। কিন্তু সুবুর বউ তো কাগজের খবরের ধার ধারে না, নিজস্ব কোনো ধারণা নিয়েও বসে নেই, সে তার মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে সঠিক খবরই পায়। ওদের ঝগড়ায় মায়ের ওই বাড়ি দিনে দিনে নরক হয়ে উঠতে লাগল।

এরপর এক উদ্‌বাস্তু ক্যাম্প থেকে বাইশ বছরের একটি বিধবা মেয়ে নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কাগজে তোলপাড় কাণ্ড। পরে জানা গেছে এটা একই মেয়ে নিয়ে দুই অফিসারের মধ্যে ঈর্ষা আর রেষারেষির ফল। কিন্তু ওই গণ্ডগোল দানা বেঁধে উঠেছে মেয়েটি নিখোঁজ হবার মাস তিনেক পরে। তার আগে পর্যন্ত ধামা-চাপা দিয়ে চলছিল। ওই দুজনের মধ্যে ব্যর্থ অফিসারটি একজন পরিচিত সাংবাদিককে গোপনে খবর সরবরাহ করেছে, মেয়েটিকে উধাও করে কোথায় রাখা হয়েছে, কোথায় তাকে ছোট-খাটো একটি শেলাইয়ের দোকান করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি সেই মেয়ের ছবি পর্যন্ত এক কাগজে ছাপা হয়ে গেছে।

মেয়েটি ধরা পড়েছে। অভিযুক্ত অফিসার সুবীর চ্যাটার্জী। মেয়েটির নাম বকুল মিত্র। পূর্ববঙ্গের ভালো ঘরের উদ্‌বাস্তু। একটু কালোর ওপর যেমন স্বাস্থ্য তেমনি পটে আঁকা সুন্দর চেহারা। পরীক্ষা করে দেখা গেছে বকুল মিত্র সন্তান-সম্ভবা। জেরায় সে বাধ্য হয়ে কবুল করেছে, সুবীর চ্যাটার্জী বিবাহিত সে জানত না, এবং সে বিশ্বাস করেছিল সুবীর চ্যাটার্জীর মহৎ অন্তঃকরণ বলেই তার মতো অনাথা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছিল। তাকে সময়ে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। সে জেনেছিল, বর্তমানে বিয়ে করার ব্যাপারে নানা-রকম অসুবিধে আছে। মোট কথা, বিশ্বাসের ভুলে হোক বা যে কারণেই হোক স্বেচ্ছাতেই সে ক্যাম্প থেকে উধাও হয়েছিল।…হ্যাঁ, শেলাইয়ের ওই ছোট দোকান সুবীর চ্যাটার্জীই তাকে করে দিয়েছেন, সে-জন্য তাঁর প্রতি সে কৃতজ্ঞ। সে কার সন্তান ধারণ করছে এই জেরার কোনো উত্তর দেয় নি, মুখ শেলাই করে ছিল। বিচার সাপেক্ষে সুবু চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে গেল। এর কয়েক দিনের মধ্যে কাগজে আবার হৈ-চৈ ব্যাপার। সুবীর চ্যাটার্জীর স্ত্রী অঞ্জলি চ্যাটার্জী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। লিখে গেছে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কিন্তু দায়ী নয় লিখে গেলেই সুবুর পক্ষে দায় থেকে খালাস পাওয়া সহজ নয়। —তার বিরুদ্ধে অমন একটা কেলেংকারির মামলা ঝুলছে। পুলিশের টানা-হেঁচড়া আর দুই বিচার পর্বে সে আধ-মরা হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত জেল খাটা থেকে মুক্তি অবশ্য পেল। বকুল বিচারে একই কথা বলে গেছে, সে স্বেচ্ছায় ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আর অন্যজন লিখে গেছে তার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। অতএব জেল খাটা থেকে অব্যাহতি।

কিন্তু চাকরিটা গেলই।

…এর পর এই বাংলায় এ-রকম ছেলেকে আর চাকরি কে দেবে? কলকাতার বাইরে কলেজে চাকরি পেতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সুবীর চ্যাটার্জী নামটা তখন স্ট্যাম্প-মারা হয়ে গেছে।

…এর পরেও সুবু বকুলকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। মা তাকেশুদ্ধ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। বকুলও আর তাকে বিয়ে করে নি, কিন্তু আশ্রয় দিয়েছে। ওর ছেলে হয়েছে একটি। সেই ছেলের এখন তিন বছর বরেন। ওইটুকু শেলাইয়ের দোকান থেকে কি-বা আয় কে কাকে আশ্রয় দেয়। নাম ভাঁড়িয়ে টিউশানির রোজগারই সুবুর এখন একমাত্র সম্বল। কলকাতার শহরে ইকনমিক্সে এম. এ. পাশ ছেলে গোঁ ধরলে টিউশানিতেও খুব কম রোজগারই হবার কথা কম নয়। কলেজের ছাত্র পর্যন্ত পড়াতে পারে। কিন্তু টিউশানি বেশিদিন টেকে না। মাস্টার মদ খায় জানলে কোন্ গাডিয়ান বা ছাত্র তাকে রাখবে? ওর মদ খাওয়াটা একদিন না একদিন ধরা পড়েই যায়। এখন এমন হয়েছে যে দূরের এলাকায় টিউশানি খুঁজে নিতে হয়। তারও কোনোটা রাখতে পারে কোনোটা বা পারে না।

প্রায়ই এসে মায়ের কাছে হাত পাতে, ছেলের ওই হয়েছে, এই হয়েছে— টাকা দাও। না দিলে চিৎকার চেঁচামিচি। এই ভয়েই মা যা পারেন দ্যান। কিন্তু ছেলের মদের খরচ যোগানোর মতো টাকার সম্বল তাঁর কোথায়? বাড়ি ফিরতেই কল্যাণী জিজ্ঞেস করলেন, মা-কে টাকা দিতে পেরেছ? অবধূত ছোট্ট জবাব দিলেন, অনেক কষ্টে।


© 2024 পুরনো বই