সেই অজানার খোঁজে ২.২

সম্ভব হলে অথবা অবধূতের বাড়ি কোন্নগরে না হয়ে কলকাতায় হলে এক বুধবার বাদ দিয়ে রোজই আমি হয়তো দুই এক ঘণ্টার জন্য তাঁর ডেরায় গিয়ে বসে থাকতাম। বুধবার নয় কারণ সেদিন তিনি কোনো কেস নেন না। ওই একটা দিন সকালে তাঁর ওষুধের গাছগাছড়া শিকড়-বাকড় লতাপাতার স্তূপের মধ্যে বসে কাটে। আর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত কাটে ওষুধ তৈরির তদারকিতে। ভৈরবী মা মহামায়ার সেই যোগানদার লোকটি, যার নাম হারু, এ-ব্যাপারে সে-ই এখন অধধূতের ডানহাত। মা-ই বলে দিয়েছিলেন একে ছাড়িস না, তোর ওর দুজনেরই উপকার হবে। ছাড়েন নি। এই হারুরও এখন বয়েস হয়েছে, অবধূতের থেকে কিছু ছোট। কিন্তু দেহের বাঁধুনি দিব্বি শক্ত-পোক্ত এখনো। কোন্নগরে এসে বসবাসের শুরু থেকেই সে আছে। কাছাকাছির মধ্যে তার জন্যেও টালির ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতায় আসার ফলে গাছগাছড়া শেকড়-বাকড় লতাপাতা ফল-ফলাদি সংগ্রহের জন্য আর তাকে বনে-বাদাড়ে ঘুরতে হয় না। এখানে এ-সব কাঁচা মালের ব্যবসার অনেক ঘাঁটি আছে। হারুর অধীনে আবার ঝাড়াই বাছাইয়ের ঠিকে লোক আছে দুজন। এ ব্যাপারে তারও অভিজ্ঞ চোখ কম সজাগ নয়। এছাড়া ওষুধ তৈরির জন্য মাঝ-বয়সী কবিরাজ আছেন একজন। কিন্তু এখানে তাঁর বিদ্যে ফলাবার কোনো সুযোগ নেই। নির্দেশের নিক্তি মেপে তাঁকে কাজ করতে হয়। বুধবারটা অবধূতের এ-সবের তদারকিতেই কাটে। বাড়ির পিছনের অভিনার শেষ মাথায় বড়সড় আউট-হাউসটা তাঁর ল্যাবরেটারি। অবধূত প্রথম যেদিন আমাকে সেই ল্যাবরেটারি দেখাতে নিয়ে যান, কল্যাণী দেবী আলতো সুরে আমাকে সতর্ক করেছিলেন, ওই ল্যাবরেটারি থেকে হামেশা চেলা বিছেটিছেও বেরোয়, একটু সাবধানে দেখবেন। বক্রেশ্বরে ভৈরবী মায়ের সব ওষুধের দাম ছিল শুনেছি চার আনা। এখানে সব ওষুধের দাম এক টাকা। এ-সম্বন্ধে অবধুত আর কল্যাণী দেবীর সামনেই পেটো কার্তিকের বিরস মন্তব্য শুনেছি, বাবার কি বিবেচনা বলুন তো, যে দিন পড়েছে, সব-কিছুর দাম বাড়ছে, ঠায় এক জায়গায় দাড়িয়ে আছে কেবল বাবার ওষুধের দাম-লোকজনের মাইনে ধরলে বেশির ভাগ ওষুধেই এক টাকার বেশি খরচ পড়ে—যারা গরিব তারা না-হয় এক টাকাই দিল, কিন্তু নানা জায়গা থেকে গাড়ি ঘোড়া হাঁকিয়ে কত বড়লোকও তো আসে, তাদের কাছ থেকেও এক টাকা নেবার কি মানে হয়?

ওঁরা দুজনেই হাসছিলেন। হুল ফুটিয়ে অবধূত বলেছেন, ওষুধের দাম যা-ই হোক তুই যে লোকের ট্যাক বুঝে আরো ফী আদায় করিস? পেটো কার্তিক লজ্জা পাওয়ার কারণ কল্যাণী দেবী ব্যক্ত করেছেন। পুরনো যারা তারা ওষুধের দামও জানে, যে-যার সাধ্য মতো প্রণামী কত দেবে তা-ও জানে। কিন্তু নতুন রোগীও তো হরদম আসে। কার্তিককেই তারা চুপি চুপি জিজ্ঞেস করে, ওষুধের দাম কত। কার্তিক তখন অম্লান বদনে ওষুধের এক টাকা দাম জানিয়ে বাবার প্রণামীর কথাটা বলে। বলে, ওষুধের কোনো দাম নেই, বিনে পয়সার ওষুধই বলতে পারেন। তারপর গরিব মনে হলে বলে, এক-টাকা দু‘টাকা যা পারেন ভক্তিভরে বাবার পায়ে প্রণামী রেখে মনে মনে প্রার্থনা করে যান। মাঝারি অবস্থার লোক মনে হলে কার্তিক এক-টাকা দু‘টাকাকে পাঁচ-টাকা দশ-টাকায় তুলে একই কথা বলে। আর বড় অবস্থার লোক মনে হলে প্রণামী অর্থাৎ টাকার অঙ্ক মোটে মুখেই আনে না। বলে, ওষুধের আবার দাম কি, ওই ওষুধের বাক্সে একটা টাকা ফেলে রেখে চলে যান—

গাড়ি হাঁকিয়ে যারা আসে এক টাকা শুনে স্বাভাবিক ভাবেই তারা অবাক হয়। অনেকে সেই কাঠের বাক্সে এক টাকার জায়গায় দশ-বিশ টাকা ফেলতে যায়। কার্তিক তক্ষুনি হা-হা করে উঠে বাধা দেয়, ওষুধের ওই এক টাকাই দাম, তার বেশি এক টাকাও নয়, আর দিয়ে তৃপ্তি যদি পেতে চান যত খুশি বাবার পায়ে প্রণামী ফেলে যান— যা দেবেন সবই আবার বাবার মারফৎ দরিদ্রনারায়ণের কাছেই পৌঁছে যাবে। দু’দশ টাকার জায়গায় তখন দু‘শ পাঁচশও প্রণামী পড়তে দেখা যায়।

জব্দ হয়েও পেটো কার্তিক কটকট করে প্রতিবাদ জানাতে ছাড়ে না। আমাকেই সালিশ মানে, টাকা যা-ই আদায় করে দিই তার কতটুকু আমাদের ভোগে আসে জিজ্ঞেস করুন তো? বাবার সিগারেট আর ড্রিংক তো ভক্ত গৌরী সেনেরা জোগায়, মাতাজীর তো নিজেরই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, দেওয়া ছাড়া নেওয়া নেই—ও-দিকে খোঁজ নিয়ে দেখুন বাবার নামে কোনো ব্যাঙ্কে পাঁচ টাকার অ্যাকাউন্টও নেই—তাহলে এত যে টাকা আসে সে-সব যায় কোথায়? ফি মাসে খরচের টাকা তুলতে মায়ের চেক ভাঙানোর জন্য আমাকে ব্যাঙ্কে যেতে হয় বুঝলেন—বাবার টাকার কোনো হিসেব নেই।

পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে ‘সেই অজানার খোঁজে’ প্রথম পর্বের কাহিনীতে বিয়ের আগে কল্যাণীর বিত্ত সম্পর্কে মোটামুটি কিছু হিসেব দাখিল করা হয়েছিল। তার বাবার কলকাতা আর রামপুরহাটের বিশাল বাড়ি আর জমি-জমা বিক্রি করে কল্যাণীর নামে ছ’লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ব্যাঙ্কে মজুত ছিল। সুদে আসলে সেই টাকা বেড়ে চলেছিল। আর বক্কোমুনির থানের কংকালমালী ভৈরবের নির্দেশে তাঁর পুলিশ অফিসার শিষ্য মোহিনী ভট্‌চায সেই টাকা থেকে কিছু তুলে কোন্নগরের এই বাড়ি করে এখানে এঁদের স্থিতি করে দিয়ে গেছলেন। বাকি টাকা কল্যাণীর নামেই মজুত ছিল। সেই টাকার অঙ্ক এখন কতোয় দাড়িয়েছে আমার ধারণা নেই। পেটো কার্তিককে মাতাজী তাঁর বিত্তের হিসেব দিতে গেছেন বলে মনে হয় না, কিন্তু ব্যাঙ্কের কাজ-কর্ম তার মারফতই হয় যখন, তার মোটামুটি ধারণা থাকা স্বাভাবিক। তা নাহলে সে বলে কি করে মাতাজীর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। কিন্তু বাড়ির খরচ এখনো এই টাকা থেকেই আসে শুনে আমি একটু অবাকই বটে। বলেছিলাম, এবারে আমি কার্তিকের দিকে, এত টাকা দিয়ে কি করেন হিসেব দিন—

অম্লান বদনে অবধূত জবাব দিয়েছেন, প্রণামীর টাকা সবই তো কার্তিকের পকেটে জমা পড়ে, ও তার মধ্যে কতটা ফাঁক করে আমি জানব কি করে?

—শুনলেন মা—বাবার কথা শুনলেন? আমি পাঁচটা টাকা সরালেও ওনার যেন জানতে বুঝতে বাকি থাকে! অভিমানাহত চাউনি আবার আমার দিকে।—চিনির বলদ চিনি খায় না চিনির বস্তাই কেবল টানে? অবধূতের নিরাসক্ত টিপ্পনী, বেশি না হোক একটু একটু চিনি খাস সেটা স্বীকার কর্।

কার্তিকের অসহায় মুখ, যেন আমার সামনে চোর প্রতিপন্ন করা হচ্ছে তাকে।—মা, আপনি এখনো কিছু বলছেন না? বরাদ্দ হাত খরচের এক পয়সাও বেশি নিই আমি?

কল্যাণী হাসছিলেন। উসকে দিয়েছেন।—তুই এত বোকা কেন, টাকাগুলো কোথা দিয়ে পাখা মেলে উড়ে যায় সে-হিসেব এঁকে দিয়ে দিলেই তো পারিস।

আমারও এ-টুকুই জানার কৌতূহল। এক হরিদ্বারে যাতায়াতের পথেই তো পায়ে হাজার কয়েক টাকা প্রণামী পড়তে দেখেছিলাম। আর এই দেড় দু‘বছর ধরেও কম দেখছি না। এ-দিকে দামী সিগারেট আর মদের খরচ অন্যের ঘাড়ে, আর সংসারের খরচও শুনছি কল্যাণীর জমা টাকা থেকে। তাহলে টাকাগুলো যায় কোথায়!

স্ত্রীর কথা শুনেই অবধূত ব্যস্ত হয়ে বাধা দিয়েছেন, থাক, আর হিসেব দিতে হবে না, তোমার খাতিরে মেনেই নিলাম কার্তিক বরাদ্দ থেকে খুব বেশি টাকা হাপিস করে না—

আমার দিকে ঘুরে বসে কার্তিক পোড়া দাগের মুখখানা যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলেছে, মায়ের পরোয়ানা পেয়ে গেছি যখন বাবার টাকার হিসেব শুনুন তাহলে।…যদি কখনো শোনেন কারো যক্ষ্মা-টক্ষ্মা হয়েছে, হাসপাতালে সীট পাচ্ছে না, উপযুক্ত পথ্য পাচ্ছে না—এখানে কোন্নগরে বাবার ঠিকানা দিয়ে দেবেন, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যদি শোনেন কোনো বিধবার ছেলে স্কুলে পড়তে পারছে না বা পরীক্ষার ফী দিতে পারছে না, তাকে এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন। বিশ তিরিশ চল্লিশ টাকা করে মাসে মাসে হাজার বারোশ’ টাকা মনি-অর্ডার যায় কিনা এখানকার পোস্ট-অফিস থেকে সে-খবরও নিতে পারেন। যদি শোনেন টাকার জন্য কোনো গরিব ঘরের মেয়ের বিয়ে আটকে যাচ্ছে, চোখ বুজে তাকে এখানে পাঠিয়ে দেবেন, ধার করে হলেও তার টাকা এসে যাবে—

অবধূত ধমকে উঠেছেন, তুই থামবি এখন। হাসি মুখে আমার দিকে ফিরেছেন, ভালো পাবলিসিটি অফিসার জুটেছে আমার—

কার্তিক গম্ভীর মুখে উঠে দাড়িয়েছে, আরো কত রকমের লোককে এখানে পাঠাতে পারেন তার একটা ফুল লিস্ট আপনাকে সময় মতো দিয়ে দেব। গটগট করে ঘর ছেড়ে প্রস্থান। আমি অন্য দুজনের কাকে ছেড়ে কাকে দেখি। অবধূতের কাঁচুমাচু মুখ। আর কল্যাণীর প্রসন্নসুন্দর মুখখানা দেখে সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল স্বামী নিয়ে তাঁর সব থেকে বড় গর্ব এই কারণেই।

হালকা সুরে অবধূত নিজেকেই নস্যাৎ করতে চেয়েছেন।—এক-দিক থেকে বিচার করলে পৃথিবীর মানুষ বড় সরল, বুঝলেন। চোখের ওপর ভাওতাবাজী দেখেও ওপর-ওপর যা দেখে তাই ধরে নিয়ে বসে থাকে। রামকৃষ্ণ ঠাকুর ফতোয়া দিলেন, কামিনী আর কাঞ্চন সব থেকে বড় বন্ধন, মন থেকে ত্যাগ করো। সেই ত্যাগের মহড়া কত সময়ে কত জনে দেখছে, কিন্তু মন থেকে হলো কিনা সেটা কত জনে জানছে? আঙুল দিয়ে স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, ওই কামিনীর বন্ধন ত্যাগ করতে গিয়ে কতবার নাজেহাল হয়ে ফিরে এলাম সে-তো আপনিও জানেন, কিন্তু লোকে ভাবে, আ-হা, কি মুক্ত মনের অধিকারী—এমন দিব্যাঙ্গনা রূপসী স্ত্রীকে রেখে বিবাগী হয়ে কতবার ঘর ছাড়ল ঠিক নেই। ফিরে আসাটা কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে কিনা তা ওই উনিই সব থেকে ভালো জানেন, কিন্তু লোকের ভুল ভাঙাতে তাঁরও আপত্তি—

কল্যাণীর সমস্ত মুখ রাঙা। বলে উঠেছেন, নিজের সম্পর্কে তোমার এই ব্যাখ্যা কে শুনতে চেয়েছে?

—কেউ না, কেউ না—ভাঁওতাবাজীর জিতের মজাটাই এঁকে বলছি। আমার দিকে ফিরেছেন।—তারপর শুনুন, আর এক সর্বনেশে বন্ধন হলো গিয়ে কাঞ্চন। এখানেও ভাঁওতাবাজীর জিত এমন যে আমার স্ত্রীর কাছেও তা বড় আনন্দের ব্যাপার। কিনা, কাঞ্চনের মোহ নেই, টাকা যা পাই বিলিয়ে দিই। কিন্তু কোন্ জোরের ওপর তা করি সেটা কারো চোখে পড়ে না। একটা ছেলেপুলে নেই যে চিন্তা থাকবে, ওর (স্ত্রীকে দেখিয়ে) যা আছে পায়ের ওপর পা তুলে খেয়ে পরেও তার বেশিরভাগ পড়ে থাকবে—দেহ ছাড়লে পর টাকা ট্রান্সফার করা যায় এমন কোনো ব্যাঙ্কও অন্য জগতে নেই—এমন কি এখানকার নেশা আর ভালো খাওয়া-দাওয়ার রসদও ভক্তরা জুটিয়ে দিচ্ছে, তাহলে আমি টাকা দিয়ে করব কি? লোকের টাকা লোককে বিলোচ্ছি, দাতাকর্ণ নাম হচ্ছে আমার—কাঞ্চন মোহমুক্ত মানুষ হয়ে বসে আছি—পৃথিবীটা কেমন মজার জায়গা ভাবুন একবার, সর্বত্র ভাওতাবাজীর জয়!

…এই ভাওতাবাজীর বিরাট এক জয়ের নজির আমি নিজের চোখে দেখেছি। প্রথমে বুঝি নি কেবল অবাক হয়েছি। পরে এই মানুষের কথা থেকেই বোঝা গেছে আক্ষরিক অর্থে সমস্ত ব্যাপারটা ভাঁওতাবাজীই বটে। কিন্তু সেটা জানা আর বোঝার পরেও এই মানুষের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়েছে।

ঘটনাটা বলি।

মন টানলে হঠাৎ এক-এক সময় যেমন এসে উপস্থিত হই তেমনি এসে গেছলাম। এই হঠাৎ আসার মধ্যেও দিন বাছাইয়ের ব্যাপার আছে। বুধবার বাদ কারণ গল্প করার সুবিধে থাকলেও সেদিন তাঁর মন পড়ে থাকে ওষুধ তৈরির দিকে। শনি মঙ্গলবারে আসি না কারণ রাতে সেই ছদিন তিনি শ্মশানে বসেন বলে বহু-রকমের আর্জি নিয়ে লোকে বিকেল পর্যন্ত তাঁর দ্বারস্থ হয়। রবিবারও বাদ কারণ লোকের ভিড়ে বেলা তিনটে-চারটের আগে সেদিন তাঁর খাওয়া-দাওয়ারও ফুরসৎ মেলে না। বিকেলের দিকে ওই একটা দিনই কোথাও না কোথাও তাঁর আবার সফরসূচীও থাকে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী কেউ না কেউ এসে ধরে নিয়ে যায়। তাই আমার হঠাৎ-আসাটাও সোম বৃহস্পতি আর শুক্র এই তিনদিনের গণ্ডীর মধ্যে বাঁধা। সেই দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। দেড় মাসের মধ্যে দেখা হয় নি তাই মন টানছিল। বিকেলের আগেই চলে এসেছিলাম।

এলে খুশির অভ্যর্থনা পেয়ে থাকি। অবধূত অনেক আগন্তুককেই হতাশ করেন, অর্থাৎ দু‘চার কথায় বিদায় করে ছ্যান, অন্যদিন আসতে বলেন। সেদিন লক্ষ্য করলাম কথার ফাঁকে ফাঁকে অবধুত নিজের হাতঘড়ি দেখছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কারো আসার কথা আছে নাকি?

অবধূত হেসে জবাব দিলেন, বড়সড় এক বোয়ালমাছ জালে পড়ার কথা, দু‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে যাবে।

—তাহলে সরে পড়ি?

সরে পড়বেন কেন, জাঁকিয়ে বসে মজা দেখুন, মৃত্যুর ছায়া সামনে দুলছে এমন কোটিপতি মানুষ ক’জন দেখেছেন?

আমি উৎসুক।—আপনি সেই ছায়া সরাবেন?

হাসিমুখে জবাব দিলেন, আমি কিছুই করব না, কিন্তু সরলে ক্রেডিটটা আমার হবে, আর তার ফলে ভদ্রলোকের কয়েক লাখ টাকার ভার কমবে।

কয়েক লাখ শুনে আমি থ। বাবার এ-ভাবে বলাটা পেটো কার্তিকের একটুও পছন্দ হলো না। হড়বড় করে বলে উঠল, বিশ্বাস করবেন না সার, বাঁচলে ভদ্রলোক বাবার জন্যেই বাঁচবে, গত মঙ্গলবার বাবা সমস্ত রাত ধরে শ্মশানে বসে ওই ভদ্রলোকের জন্য কাজ করেছেন—

অবধূত হালকা সুরে ধমকে উঠলেন, এখানে বসে কে তোকে সর্দারির বচন ঝাড়তে বলেছে, তোর ‘স্যার’ রাতে কি খেয়ে যাবেন সে ব্যবস্থা কিছু করেছিস?

এর মধ্যে এক-প্রস্থ চা জল-খাবারের পর্ব শেষ হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিলাম, না না, আমি সন্ধ্যার আগেই পালাব, আপনি আর এ হুজুগ তুলবেন না—

কিন্তু বাবার ইচ্ছে বুঝেই চেলাটি অন্তর্ধান করেছে। অবধূত বললেন, মোটে তো আসেন না আজকাল, ড্রাইভার সঙ্গে আছে একটু রাত হলেই বা, আপনাকে দেখেই মনে পড়েছে একটা ভালো জিনিস মজুত আছে, তাছাড়া একখানা ঢাউস বোয়াল মাছ জালে পড়বে এমন মওকার দিনে এসে গেছেন যখন আপনাকে এখন ছাড়ি! সেলিব্রেট করার চোটে রাতে বাড়িতে যদি ফিরতে না-ই পারেন, একটা ফোন করে দিলেই তো হলো। অগত্যা ঢাউস বোয়াল সম্পর্কে আমার কৌতূহল। ভদ্রলোক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী। তেল ঘি মাখন চীজ ইত্যাদির মস্ত কারবার। তার গলার পাশে বাঁ-দিকের কাঁধ জুড়ে ক্যান্সার। বায়পসিতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তারপর থেকে চিকিৎসার উৎসব চলেছে। ডাক্তারদের শেষ কথা, অপারেশন করে দেখা যেতে পারে কতদূর ছড়িয়েছে, এ-ছাড়া আর কিছু করার নেই। আত্মীয় পরিজন শুধু নয়, রোগীও বুঝেছে বাঁচার আশা শতেকে একভাগও নেই। অপারেশনের ফলে মৃত্যু ত্বরান্বিত হতে পারে, এ ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না, রোগী আর তার আত্মীয় পরিজনদের এটাই বিশ্বাস। এখন দৈব নির্ভর। অবধূতের নাম শুনে তাঁর এখানে এসে হত্যা দিয়ে পড়েছে। কিছু যদি করতে পারেন তারা চিরকাল তাঁর হুকুমের দাস হয়ে থাকবে। …ভদ্রলোক এসে তাঁর পায়ের ওপর আছড়ে পড়েছিল। অবধূত বললেন, মৃত্যুর থেকেও মৃত্যু-ভয় কত বেশি ভয়ংকর যদি দেখতেন—

ইনি দু‘বার করে বলেছেন ঢাউস বোয়াল জালে পড়বে—আমি ভুলি নি। আমার ভিতরে একটা অবাঞ্ছিত সংশয়ের আঁচড় পড়েছে। মৃত্যু অবধারিত জেনেও কাউকে তিনি কোনোরকম স্বার্থের জালে জড়াতে পারেন এ আর আমি এখন কল্পনাও করতে পারি না। পেটো কার্তিকের মুখেও শুনেছি দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের আশা নিয়ে কত লোকই বাবার কাছে আসে, হাজার ছেড়ে লাখ টাকা খরচ করতে রাজি এমন পয়সাঅলা লোককেও এখানে এসে বাবার পা জড়িয়ে ধরতে দেখেছে। কিন্তু বাবা বিষণ্নমুখে দু‘হাত জোড় করে নিজের অক্ষমতা জানিয়ে তাদের বিদায় করেছে। ফল কিছু হোক না হোক শেষ চেষ্টা হিসেবে যাগ-যজ্ঞ করার জন্যও কত লোক দশ-বিশ হাজার টাকা নিয়ে সাধাসাধি করেছে। কিন্তু কিছু করা সম্ভব নয় বুঝলে বাবা তাদের প্রার্থনার রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, নিজেরা প্রার্থনা করুন আর চিকিৎসার অন্য রাস্তা আছে কিনা খুঁজুন—পথ থেকে থাকলে তিনিই হদিস দেবেন, আমার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। শুনে কত ভালো লেগেছিল আমিই জানি। কিন্তু এই লোকই কোটিপতি ক্যান্সার রোগী হাতে পেয়ে বোয়াল মাছ জালে পড়ার কথা বলছেন কেন ভেবে পেলাম না। সন্দেহ বড় বিচ্ছিরি জিনিস। কখন কোন্ ফাঁক দিয়ে হুল ফোটায়, আঁচড় কাটে বলা যায় না।

জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এই কোটিপতি ব্যবসায়ীর জন্য শ্মশানে গিয়ে বসেছিলেন?

মুচকি হেসে জবাব দিলেন, বসেছিলাম।

—কিন্তু আপনি নিজেই তো বলেন অলৌকিক কিছুতে আপনি বিশ্বাস করেন না?

—করি না তো।

—তাহলে এ ভদ্রলোককে জালে ফেলছেন কি করে?

অবাক ভাব।—আমি ফেলছি আপনাকে কে বলল! তার নিজের ভাগ্যই তাকে জালে টানবে মনে হচ্ছে। একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, আমি অলৌকিকে বিশ্বাস করি না মানে কি? মানুষের অঘটনকে ঘটিয়ে দেবার, বা ঘটনাকে অঘটনের দিকে টেনে নিয়ে যাবার ক্ষমতায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু তা বলে কি আমার বিদ্যা বুদ্ধির অগম্য কিছু কি ঘটছে না? হামেশাই ঘটছে। সেটাকে অলৌকিক বলব কেন—এ-সবের পিছনে আমার অজানা কোনো সায়েন্স বা কোনো শক্তি কাজ করছে না, এ আমি জোর করে বলব কি করে? আপনাকে তো বলেছি কেন ঘটে কে ঘটায় সেই খোঁজই আমি করে বেড়াচ্ছি!

অপ্রিয় কথাটা মুখে আপনিই এসে গেল।—তাহলে এই যে ভদ্রলোক আজ আপনার জালে পড়তে যাচ্ছেন সেটা আপনি ঘটাচ্ছেন না? হাসতে লাগলেন। তারপর বেশ মিষ্টি করে বললেন, আমাকে আপনি যে একটি ঠগ ভাবছেন সেটা আপনার চোখে মুখে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।.. কিন্তু আপনার দোষ নেই, লোকের হিতের জন্য মওকা বুঝে একটু-আধটু অ্যাকটিং তো আমাকে করতেই হয়—

গাড়ির শব্দ কানে আসতে থেমে গিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। দুটো ঝকঝকে গাড়ি এসে বাঁশের গেটের সামনে দাঁড়ালো। একটা এয়ার কডিশনড বিলিতি গাড়ি। অবধূত বললেন, এরপর আপনার খানিকক্ষণ কেবল নির্বাক দর্শকের ভূমিকা, হেসেটেসে ফেলে আমাকে ডোবাবেন না যেন—

মুহূর্তের মধ্যে মিষ্টিমুখে গাম্ভীর্যের মাধুর্য দেখলাম। এর কতটা খাঁটি কতটা মেকি বোঝা দায়। কয়েক মুহূর্তের আগের মানুষ নন যেন আর। দু-আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে। চৌকি ছেড়ে উঠে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোলেন। পরনে সিল্কের রক্তাম্বর ধুতি, গায়ে তেমনি রক্তাম্বর ফতুয়া, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। সর্বাঙ্গে লালের জেল্লা। যে মানুষের সঙ্গে এতক্ষণ আলাপে মগ্ন ছিলাম এ যেন আর সেই মানুষ নন্।

এয়ার কন্‌ডিশন গাড়ি থেকে দুজন লোক ধরাধরি করে এক প্রৌঢ়কে নামালো। আমি জানলায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছি। বছর বাহান্ন-তিপান্ন হবে বয়েস। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ। বাঁ-দিকের ঘাড় কাঁধ জুড়ে চামড়া ওঠা দগদগে পোড়া ঘায়ের মতো। সেখানে দুটো ফোলা-ফোলা লাল মাংসখণ্ড। মনে হয়, ডিপ-রে‘র দরুন জায়গাটার ওই চেহারা হয়েছে। মোটাসোটা মোটেই নয়, রোগের প্রকোপে বরং শীর্ণ দোহারা চেহারা। তার পিছনে যে মহিলাটি নামলেন, তাঁর মুখখানা মিষ্টি, নাকে মস্ত একটা জ্বলজ্বলে হীরের নাকছাবি—কিন্তু মেদবহুল স্কুল বপু। সামনের এয়ার কনডিশন গাড়ি থেকে এরা দুজন নামলেন। অন্যেরা অর্থাৎ পিছনের গাড়ি থেকে নেমে রোগীকে ধরে নিয়ে আসছে।

আমারও মনে হলো রোগীর মুখে মৃত্যুর স্পষ্ট ছায়া দেখছি।

অবধূত দু‘হাত জুড়ে অভ্যর্থনা জানালেন, আসুন।

তিনি দু‘তিন হাত পিছিয়ে আসতে কোটিপতি রোগীটি মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে অবধূতের দু‘পা জড়িয়ে ধরলেন। পায়ের ওপর নিজের কপাল ঘষতে লাগলেন। মহিলাটি ভদ্রলোকের স্ত্রী হবেন। তিনিও আঁচলে চোখ চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

ঘরের হাওয়া স্তব্ধ কয়েক মুহূর্তে। এ-দিকের দরজার আড়ালে দাড়িয়ে পেটো কার্তিক থেকে থেকে গলা বাড়াচ্ছে।

অবধূত দু‘চোখ বুজে হাত জোড় করে দাড়িয়ে আছেন। একটু বাদে তাকালেন। সঙ্গের লোকদের বললেন, সারাওগিজীকে ধরে তুলুন—

অল্প বয়স্ক যে দুটি ছেলে তাঁকে ধরাধরি করে তুলল, পরে শুনেছি তারা ভদ্রলোকের ছেলে। আর অপেক্ষাকৃত বয়স্ক তৃতীয় জন তাদের মামা। কোটিপতি রোগীর নাম রতনলাল সারাওগি।

অবধূতের নির্দেশে ছেলেরা তাঁকে সামনের সোফায় বসিয়ে দিল। মহিলাকে বললেন, মা আপনি ওঁর পাশে ওই সোফাতেই বসুন।

আদেশ পালন করেন কৃপা প্রার্থনার ভঙ্গীতে তিনি দু‘হাত জোড় করে রইলেন। তৃতীয় ভদ্রলোক আর ছেলেরা অন্য সোফায় বসতে অবধুত আমার দিকে ফিরলেন। —দাড়িয়ে কেন, বসুন—

আমি চৌকিতে বসতে পরিচয় দিলেন, ইনি আমার বিশেষ আত্মজন, আর আপনাদেরও শুভার্থী জানবেন।

বলতে বলতে ঘরের কোণের টেবিলটার কাছে গিয়ে কিছু কাগজপত্র বার করে নিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন। একটা ভাঁজ করা কাগজ ছেলেদের একজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ওঁর বায়পসি রিপোর্টটা রাখুন—

রতনলাল সারাওগি ঈষৎ অসহিষ্ণু আর্তকণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না, কি দেখলেন বলে ফেলুন, কোনো আশা নেই তো?

খুব কোমল গলায় অবধূত বললেন, উতলা হবেন না, কোনো আশা না থাকলে আপনাদের এখানে আসার জন্য আমি অপেক্ষা করতাম না, লোক পাঠিয়ে খবর দিতাম আসার দরকার নেই।

প্রত্যেকের মুখ আমি লক্ষ্য করছি। বিশেষ করে রোগী আর তাঁর স্ত্রীর মুখ। এমন আকৃতি-ভরা আশার কারুকার্য এ-যাবত কেবল একজনের মুখে দেখেছি। আমার স্ত্রীর মুখে। একমাত্র ছেলের দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হবে এমন আশা আর আশ্বাস তিনিও একজনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। পরের বিপরীত হতাশার মূর্তি এখনো আমার চোখে লেগে আছে।

শ্যালক ভদ্রলোকটি সাগ্রহে বলে উঠলেন, মঙ্গলবারের শ্মশানের কাজের ওপর সব নির্ভর করছে বলেছিলেন, সে কাজ সফল হয়েছে তাহলে? আদেশ পেয়েছেন?

অবধূত জবাব দিলেন না। ফুলস্ক্যাপের তিন পাতা জোড়া নিজের কষা অঙ্কগুলো মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। ঘরের আবহাওয়া আশ্চর্য-রকম থমথমে। অনেকক্ষণ বাদে মুখ তুলে রোগীর দিকে তাকালেন। বললেন, আপনার জন্মের তারিখ সময় সব ঠিকই আছে মনে হচ্ছে…।

ভদ্রলোক বিড়বিড় করে জবাব দিলেন, আমার পিতাজীর কাজে ভুল হবার কথা নয়, এসব ব্যাপারে তিনি খুব পাট্টিকুলার ছিলেন— হ্যাঁ, আমার হিসেবের সঙ্গেও মিলে যাচ্ছে।

তার পরেই যে চিত্রটা দেখলাম, ভোলার নয়। অবধূতের দু‘চোখ রতন সারাওগির মুখের ওপর অপলক। এক মিনিট যায় দু‘মিনিট যায় তিন মিনিট যায় চোখের পাতা পড়ে না। ভদ্রলোকের সমস্ত ভিতরটা যেন আঁতি-পাতি করে দেখে নিচ্ছেন তিনি। সেই দেখার একাগ্রতায় অবধূতের সমস্ত কপাল মুখ ঘেমে উঠেছে। কিন্তু চোখে পলক পড়ছে না। রতনলাল সারাওগি এ-দৃষ্টি সহ্য করতে পারছেন না। বার বার চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন, চিবুক নিজের বুকে ঠেকছে। অবধূতের বিস্ময়কর চাউনির এই অন্তর্ভেদী দিকটা আগেও লক্ষ্য করেছি, হঠাৎ-হঠাৎ যেন সব-কিছু দেখে নেবার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে—কিন্তু এমন দীর্ঘ-মেয়াদি দৃষ্টি সঞ্চালনের কশাঘাত আর দেখেছি বলে মনে হয় না। আমার মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক না এই দৃষ্টির আঘাতে মূর্ছা যান অথবা ঘুমিয়ে পড়েন।

ফতুয়ার হাতা দিয়ে কপালের আর মুখের জবজবে ঘাম মুছলেন। তাঁর থমথমে গলা শুনে ঘরের সকলে ছেড়ে আমিও সচকিত। দু‘চোখ এখন ওই শ্যালক ভদ্রলোকের মুখের ওপর।—হ্যাঁ, আদেশ পেয়েছি। উনি ভালো হয়ে যাবেন। রোগ নির্মূল হবে। সেজন্য কি করতে হবে পরে বলছি। রোগীর দিকে ফিরে তাকালেন, কিন্তু আরো যা জেনেছি সেটা আপনার জানা আর শোনা দরকার—আপনার স্ত্রী আর ছেলেদের মুখ চেয়ে আপনার সাধ্য মতো প্রতিকার করাও দরকার।

জবাবে রতনলাল সারাওগি আকৃতির আবেগে দু‘হাত জোড় করে তাঁর দিকে তাকালেন।

অবধূতের গলার স্বর অনুচ্চ কিন্তু জলদগম্ভীর। —আপনার ব্যবসার তেল ঘি মাখন খেয়ে হার্টের রোগে এ পর্যন্ত তিনশো সাতাশি জন লোক মারা গেছে, আর কত হাজার লোক পেটের রোগে ভুগেছে আর ভুগছে তার হিসেবও আমি চেষ্টা করলে বার করতে পারি…এর জবাবদিহি আপনি কি করে করবেন?

ঘরের মধ্যে একটা বাজ পড়লেও বোধহয় এত চমকের ব্যাপার হতো না। রোগী নিয়ে যারা এসেছে তারা নির্বাক বিমূঢ় বিবর্ণ। বেশ একটু সময় নিয়ে দু‘হাত জোড় করেই রতনলাল সারাওগি বললেন, আমার কারবার মুঙ্গেরে, সেখান থেকে ফিনিশড প্রোডাক্ট সব জায়গায় চালান যায়, সুস্থ থাকলে আমি নিজে গিয়ে দেখাশুনো করতাম, এই অসুখটার পর আমার ছেলেরা মাঝে মাঝে যায়, আর সেখানে আমার তিন ভাই প্রোডাকশন দেখে…আর পাঁচ জন ব্যবসাদার যেভাবে কারবার চালায় আমরাও ঠিক সেভাবেই চালাচ্ছি—

ঈষৎ কঠিন গলায় অবধূত প্রশ্ন করলেন, আপনাদের জ্ঞানত কোথাও কোনোরকম ভেজালের ব্যাপার থাকছে না—কোনোরকম কারচুপি থাকছে না?

অসুস্থ ভদ্রলোক ঘামতে লাগলেন। নাকের হীরের জ্যোতিতে তাঁর স্ত্রীর থলথলে মুখ রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। ভদ্রলোকের শ্যালকের মুখ অতিরিক্ত গম্ভীর। মন্তব্যের সুরে বললেন, আপনি যা বললেন সে-রকম হলে তো এদের এত দিনের ব্যবসা উঠে যাবার কথা অবধূতের দু’চোখ তার দিকে ঘুরল। চাউনি নয়, দৃষ্টির চাবুক তার মুখের ওপর যেন কেটে কেটে বসতে লাগল। কথাগুলো একটা একটা করে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল।—আমার প্রশ্নের জবাব আপনার ভগ্নিপতি দিতে পারেন নি…আপনি দিতে পারেন? এঁদের হয়ে হলপ করে বলতে পারেন আপনাদের জ্ঞানত কোনোরকম ভেজাল বা কারচুপি থাকছে না?

বিপাকে পড়েও ভদ্রলোক দমে গেলেন না। জবাব দিলেন, ইনি তো বললেন আর পাঁচ জনের মতো করেই ব্যবসা চালিয়ে আসছেন, বিপজ্জনক কিছু করছেন না।

অবধূত আরো খানিক চেয়ে থেকে রতনলাল সারাওগির দিকে ফিরলেন।

খুব কোমল অথচ স্থির গলায় বললেন, আপনাদের সম্পর্কে আমার প্রাথমিক বিচারেই ভুল হয়ে গেছে দেখছি, জ্ঞানত আপনারা যখন কোনো গলদের মধ্যেই নেই, আমি কোন্ প্রতিকারের রাস্তা ধরে এগবো… ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি, আপনার জন্য কিছু করা আমার ক্ষমতায় কুলবে না। ছেলেদের বললেন, এঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলুন—

প্রত্যেকের মুখ বিবর্ণ পাংশু। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে মহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁর ভাই এবারে বলে উঠলেন, কিন্তু আপনি যে একটু আগে বললেন, শ্মশানে কাজে বসে আপনি আদেশ পেয়েছেন…উনি ভালো হয়ে যাবেন!

অনুচ্চ কঠিন গলায় অবধূত জবাব দিলেন, আদেশ পেয়েছি, কিন্তু সেটা কোনোরকম মিথ্যের সঙ্গে বেসাতি করার আদেশ নয়! ওঁর ভালো হবার একটাই শর্ত, সেটা সত্যের কাছে বিনীত সমর্পণ, কিন্তু গোড়াতেই আপনারা সেই সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আছেন!

রোগ জর্জরিত রতনলাল সারাওগি এবারে দু‘হাতে জোড় করে কাঁপতে কাপতে উঠে দাড়ালেন। — আমাকে ক্ষমা করুন বাবা, দয়া করুন, এব্যবসায় ষোল আনা সৎ রাস্তায় কেউ চলে না, আমিও চলি নি…কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার তেল ঘি মাখন খেয়ে তিনশ সাতাশিজন মারা গেছে এ আমি জানতাম না, এখনো ভাবতে পারছি না…আপনি প্রতিকারের উপায় বলুন, আমি সব করতে প্রস্তুত। আমাকে দয়া করুন—

অবধূতের কঠিন মুখ আবার নরম কোমল। বললেন, বসুন। আপনার তেল ঘি মাখন খেয়ে তিনশ সাতাশিজন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে-জন্য অবশ্য কেবল আপনাকে দায়ী করা ঠিক নয়।… পৃথিবীর সেরা নির্ভেজাল তেল ঘি মাখনও হার্ট পেশেন্টের কাছে বিষ, না জেনে আর জেনেও হাজার হাজার লোক এই বিষ খেয়ে মরছেও। এটা আপনি ইচ্ছে করলেও ঠেকাতে পারবেন না।

সকলেরই এবারে একটু আশান্বিত মুখ।

নির্লিপ্ত মুখে অবধূত বলে গেলেন, ভালো হয়ে মাস চারেকের মধ্যে স্ত্রী আর ছেলেদের নিয়ে মুঙ্গেরে আপনার কারবারের জায়গায় যেতে পারবেন। সেখানে গিয়ে আপনার প্রথম কাজ হবে, আপনার মোট মুনাফা চার ভাগের এক ভাগ হয়ে গেলেও কোথাও কোনোরকম ভেজাল বা কারচুপির ব্যাপার থাকবে না তার পাক্কা ব্যবস্থা করা। এতে আপনি কক্ষনো আর এতটুকু অপোস করবেন না—এটা আমার প্রথম শর্ত।

রতনলাল সারাওগির রোগজীর্ণ পাণ্ডুর মুখে আশার আলো।—আমি সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে আবার কারবারের জায়গায় যাব—আপনি এ-কথা এমন জোর দিয়ে বলতে পারলেন! যদি তাই হয়, আমি যাব—নিশ্চই যাব! চার ভাগের এক ভাগ লাভ কেন, ব্যবসা তুলে দেব তবু আর কোনোদিন ভেজাল বা কারচুপির রাস্তায় যাব না—আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি!

অবধুত হাসলেন, ব্যবসা তোলার দরকার হবে না, এখন দ্বিতীয় শর্ত “শুনুন, আমি ইনকাম ট্যাক্সের লোক নই জেনে খুব খোলা মনে জবাব দেবেন।…এক নম্বর দু নম্বর মিলিয়ে আমি যদি ধরে নিই আপনার কোটি টাকার ওপর আছে তাহলে কি খুব ভুল হবে? আপনার বাড়ি ঘর জমি-জমা আর ব্যবসার অ্যাসেট বাদ দিয়ে বলছি—

প্রশ্নটা এমনি চাঁছাছোলা গোছের স্কুল যে আমি সুদ্ধ বিড়ম্বনা বোধ করছি। রতনলাল সারাওগি ব্যাধির প্রকোপে জীবন সম্পর্কে হতাশ, কিন্তু মানুষ আদৌ নির্বোধ নন। চুপচাপ চেয়ে রইলেন একটু। তারপর ঠাণ্ডা গলায় ফিরে প্রশ্ন করলেন, আপনার অনুমান ঠিক হলে আমাকে কি করতে হবে বলুন?

অবধূতের মুখে সংকোচের আঁচড়ও পড়ে নি। নির্লিপ্ত গম্ভীর। আজ থেকে আড়াই তিন মাসের মধ্যে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা একমত হয়ে যদি ঘোষণা করেন আপনার দেহে ওই ব্যাধির আর চিহ্নমাত্র নেই, তাহলে আপনার নগদ যা আছে তার দশ পারসেন্ট এখানকার দুটো ক্যান্সার হাসপাতালে দান করতে হবে, কোনোরকম প্রচারের দান নয়, নিঃশব্দে নিঃস্বার্থ দান—এমন কি আমাকেও জানাবার দরকার নেই, সময় হলে দুই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের হাতে আপনি টাকাটা তুলে দেবেন—এই টাকায় তাদের অভাব দূর হবে না, কিন্তু কিছু কাজ হবে।

অবধূতের চোখ-কান-কাটা প্রশ্ন এই মীমাংসায় এসে থামবে রতনলাল সারাওগি বা তাঁর পরিজনেরা কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি। প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শ্যালকের ভ্রূকুটি তো স্পষ্টই হয়ে উঠেছিল। অবধূত তাঁর বক্তব্য শেষ করার পর সকলে নির্বাক।

রোগক্লিষ্ট ভদ্রলোকের নীরব বিস্ময়টুকু বোধহয় আমি আঁচ করতে পারছি।

..

অবধূত বলেছেন, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বয়ং তিনি মুঙ্গেরে যাবেন তাঁর কারবার দেখতে আর সমস্ত রকমের দুর্নীতি দূর করতে।…অবধূত আরও বলেছেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা একমত হয়ে তাঁকে সম্পূর্ণ রোগমুক্ত ঘোষণা করার পর তাঁর নগদ টাকার এক দশমাংশ হাসপাতালে দান করতে হবে। এই কাল-ব্যাধি থেকে মুক্ত হবার আগে কোনো কড়ার বা শর্তের কথা এখনও পর্যন্ত অন্তত বলেন নি। তবু রতনলাল সারাওগির মুখে আশার আলোই বেশি স্পষ্ট।— আমি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাব আপনি এতটাই শিওর হয়ে এই নির্দেশ দিচ্ছেন?

সিওর না হলে আপনাকে এ সব কথা বলে আমার লাভ কি—সম্পুর্ণ আরোগ্য হবার আগে তো শর্ত মানার কোনো দায় নেই আপনার …হ্যাঁ এই কারণেই শর্তের তাৎপর্য দশগুণ হয়ে উঠেছে। ভদ্রলোক আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু এর আগে আপনার জন্য কি করতে হবে?

অবধূতের অবাক মুখ।—আমার জন্যে আপনার আবার কি করতে হবে, যা করার সে তো আমি আপনার জন্য করব! তাহলে আরো একটু স্পষ্ট করে শুনুন, আপনাকে ভালো করে তোলাটাই আমার ষোল আনা স্বার্থ, কারণ, আপনার সামনে আমি অন্য জীবন দেখতে পাচ্ছি, আপনি নীরোগ হলে এরপর বহুজনের মঙ্গল — এটাই আমার সব থেকে বড় স্বার্থ, এছাড়া আমার আর কোনো স্বার্থ নেই। শ্যালক ভদ্রলোকটির দিকে আঙুল তুলে বললেন, আমি আপনার আর্থিক সঙ্গতির কথা তোলার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ওই সম্বন্ধীর মুখে সন্দেহের আঁচড় পড়তে দেখেছি, তাই খুব বিনীতভাবে একটা কথা আপনাদের জানিয়ে আরো নিশ্চিন্ত করে রাখি, আপনাদের অনেক টাকা থাকতে পারে কিন্তু আমাকে দিতে পারেন এমন ঐশ্চর্যের কানা-কড়িও আপনাদের নেই।

সকলে এমন কি ছেলে দুটিও হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার আকৃতি প্রকাশ করল। রতনলাল ক্লান্ত টানা সুরে বললেন, আমরা বড় অধম বাবা, এক কোটি নয়, আমার প্রায় দেড় কোটি টাকা আছে, আপনাকে কথা দিচ্ছি সুস্থ হয়ে উঠলে পনরো লক্ষ টাকার চেক আমি দুই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব-কোনো পাবলিসিটি চাইব না—আমার ছেলেদের নামে শপথ করে আপনাকে আমি এই কথা দিচ্ছিা।…কিন্তু আমাকে আপনি দয়া করুন, আপনার ক্রিয়াকাজের জন্য যেটুকু দরকার সেটুকু আমাকে করতে দিন।

বিমনার মতো অবধূত একবার আমার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। অনুক্ত কৌতুকটুকু বুঝতে বাকি থাকল না। অর্থাৎ, কেমন জমিয়ে তুলেছি দেখে নিন—

রতনলাল সারাওগির দিকে ফিরলেন, আমার ক্রিয়াকাজের মধ্যে আপনাদের কেবল দুটি কাজ করার আছে—

ভদ্রলোক আর মহিলা হাত জোড় করেই আছেন।

—প্রথম কাজ, এই মুহূর্ত থেকে আপনাদের সক্কলকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে আপনি সেরেই গেছেন, দেহের কষ্ট যেটুকু আছে তা-ও শিগগীরই চলে যাবে। আপনি ভালো হয়ে গেলে সকলে কি করবেন না করবেন সেই আলাপ আলোচনাও নিজেদের মধ্যে করতে পারেন। মনে কোনো যদি রাখবেন না, স্থির জেনে রাখবেন আপনি ভালো হয়ে যাবেনই।

বিশ্বাস করা সহজ নয়, কিন্তু এমন জোরের কথার পর না করাটাও যেন কঠিন।

কিন্তু অবধূতের পরের নির্দেশ এঁদের ছেড়ে আমাকেও বিচলিত করেছে। দুই ছেলে আর তাদের মামার দিকে চেয়ে বললেন, আজ বেস্পতিবার, যে দুজন বড় ডাক্তার অপারেশনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন কালকের মধ্যেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, যে বড় নার্সিংহোমে তাঁরা অ্যাটাচড্‌ এই রবিবারের মধ্যেই এঁকে সেখানে ভর্তি করে দিন। উঠে টেবিল থেকে পঞ্জিকাটা নিয়ে আবার বসলেন। পাঁচ-সাত মিনিট ধরে দিন-ক্ষণ দেখলেন। পঞ্জিকা বন্ধ করে আবার ওই তিনজনের দিকেই তাকালেন। —সার্জনদের বলে দেবেন সামনের সতেরো তারিখ থেকে বাইশ তারিখের মধ্যে সকালে অপারেশন হবে।

এত আশ্বাসের পর হঠাৎ যেন মৃত্যুর পরোয়ানা সামনে তুলে ধরা হলো। শ্রীমতী সারাওগি আঁতকেই উঠলেন।—অপারেশন! অপারেশন করতে হবে!

—শুনুন, এরপর থেকে আমি ধরে নেব আপনাদের সব ভাবনা-চিন্তা আমার কাছে জমা দিয়েছেন—সার্জন কেবল অপারেশনই করবে কিন্তু দায়িত্ব আমার—অপারেশনের দিনে আমি নিজে নার্সিংহোমে উপস্থিত থাকব—আর উনি সুস্থ হলে আমি নিজে গিয়ে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব, এ নিয়ে আপনারা আর কোনো কথা বলে ওঁর বা নিজেদের মন দুর্বল করবেন না। যা বললাম সেই ব্যবস্থা করুন—করে আমাকে খবর দেবেন। আপনারা একবারও ভাববেন না সার্জন কিছু করছেন—এটাই আপাতত ক্রিয়া-কাজ—যার নির্দেশে এটা হচ্ছে সে আমিও নই, সার্জন ও নন। আপনারা খুব নিশ্চিন্ত মনে এঁকে নিয়ে বাড়ি চলে যান, আর যা বললাম তাই করুন—সব থেকে বড় সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, আর তাদের পরামর্শ মতো সব থেকে ভালো নার্সিংহোমে দেবেন। বিধাতার নির্দেশ কাকে বলে জানি না। কিন্তু আমার কাছে এই নির্দেশ তেমনি অমোঘই মনে হলো।

ওঁরা চলে গেছেন। সন্ধ্যা হয় হয়। আমি সামনে বসে অবধূত যেন ভুলেই গেছেন। নিজের মধ্যে তলিয়ে গেছেন। ভাবছেন কিছু। কপাল মুখ ঘামে জবজব করছে। পায়ে পায়ে কল্যাণী ঘরে ঢুকলেন। আলো জ্বালতে অবধুত আত্মস্থ একটু। কল্যাণী দুই এক পলক দেখলেন তাঁকে। বেরিয়ে গিয়ে একটা তোয়ালে হাতে ফিরলেন। নিঃসংকোচে তাঁর কপাল ঘাড় আর কমুই থেকে হাত দুটো নিজের হাতে বেশ করে মুছে দিলেন। আমার মনে হলো দু‘চোখ ভরে দেখার মতোই এটুকু। অবধূত হেসে বললেন, কপাল ভালো থাকলে আমার স্ত্রীর সেবাও জোটে দেখলেন তো?

—তোমার ভিতরের অবস্থা জানলে উনি বুঝতেন কেন জোটে।-শোনো, এই শেষ, নিজেকে তুমি আর এ’রকম টানা হেঁচড়ার মধ্যে ফেলবে না। অবধূতের মুখের হাসি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বললেন, আমি নিজেকে টানা হেঁচড়ার মধ্যে ফেললাম না তুমি উৎসাহ দিয়ে আমাকে উসকে দিলে?

মহিলা আমার দিকে ফিরলেন। কেমন জ্বালায় দেখুন, তিনদিন আমার পিছনে লেগে থেকে আমার ভিতর থেকে কথা টেনে বার করলেন, আর এখন কিনা আমি উৎসাহ দিয়ে উসকে দিলাম।

অবধূত সানন্দে নিজের ফর্মে ফিরলেন।—যাক দেবী, টানা ক’টা দিনের ধকলের আজ নিষ্পত্তি, এরপর আমার মাথায় লাঠি পড়বে কি গলায় ফুলের মালা — তোমার ঈশ্বর জানেন, এখন পেটোকে আমাদের বোতল গেলাস নিয়ে অসতে বলো, আর অতিথির মুখ চলার মতো তুমি কি দিতে পারে৷ দেখো-—আপাতত সব ভাবনা চিন্তা রসাতলে পাঠিয়ে মনে মনে কেবল তোমাকেই জাপটে ধরে থাকি।

আমার সামনে এ-সব কথাতেও কল্যাণীকে আজকাল আর তেমন লজ্জা পেতে দেখি না। আমার দিকে চেয়ে টিপ্পনীর সুরে বললেন, বাংলাভাষায় আপনার আর কি দখল, ওঁর হাতে ছেড়ে দিলে ভাব-ভাষা দুই-ই উল্টোদিকে দৌড়বে।

মাথা চুলকে অবধূত ত্রুটি সংশোধনের সুরে বললেন, আ-হা, উনি কি তা বলে ধরে নিলেন ওঁর সামনেই তোমাকে জাপটে ধরে থাকব—এই জাপটে ধরার অর্থ তোমার স্বস্তি-বচন আঁকড়ে ধরে থাকা।

কল্যাণী হেসে বললেন, বুড়ীকে নিয়ে রঙ্গ-রসের কথা কেউ লেখেও না পড়েও না, তবু এঁকে দেখে লোক হাসাবার জন্যেও আপনি কিছু লিখতে চেষ্টা করুন।

অবধূত প্রায় গর্জন করে উঠলেন, খবরদার! কতদিন বলেছি তোমার নিজেকে বুড়ী বলাটা আমার সব থেকে বেশি অসহ্য!

কল্যাণী হাসতে হাসতে চলে গেলেন। হাসছি আমিও। কিন্তু এই প্ৰায়-বৃদ্ধ বয়সেও একটা সত্যি কথা কবুল করতে আপত্তি নেই। বয়েস যা-ই হোক এমন সুঠাম সৌষ্ঠবের সঙ্গে বার্ধক্যের যোগের কল্পনা আমার মনেও আসে না।

পেটো কার্তিক বোধহয় সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তিন মিনিটের মধ্যে ট্রে-তে সরঞ্জাম সাজিয়ে হাজির। সে-সব সামনে রেখে মেঝেতে তার বাবার পায়ের সামনে বসে গেল। অবধূত গম্ভীর মুখে বললেন, পা টিপতে হবে না, খাবার কি আছে দ্যাখ—’

—মা পাঁপড় ভাজছেন, তারপর মাছ ভাজা আর মেটের চচ্চড়ি আসছে। একখানা পা নিজের কোলের কাছে টেনে নিল।

—পা টিপতে হবে না বললাম যে!

পেটো কার্তিক ভ্রূক্ষেপ না করে তার কাজ শুরু করে দিল। তারপর ঘরের দেওয়ালকে শুনিয়ে বলল, আরামের জন্য টিপতে হবে না বুঝেছি, আমি নিজে আনন্দ পাবার জন্য টিপছি।

অবধূত হাসতে লাগলেন। —হারামজাদার ট্যাকটিকসটা লক্ষ্য করেছেন, কি ব্যাপার বোঝার জন্য ক’দিন ধরে ওর মায়ের পিছনে ঘুর ঘুর করছে—কিন্তু সেখানে তো দু-কথার পর তিন কথাতেই ধমক, এখন আপনার জেরা শুরু হবে বুঝেই এসে পা টিপতে বসে গেল—

পেটো কার্তিক হেসে ফেলে আমাকেই সালিশ মানল, বলল, শুনুন সার এই কেটা আসার পর থেকে বাবাকে চিন্তিত দেখছি, কেবল ভাবছেন আর ভাবছেন, পাতার পর পাতা কি সব অঙ্ক আর হিসেব করে চলেছেন, মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করছেন, মঙ্গল বুধ পর পর দু‘দিন শশ্মানে গিয়ে বসলেন — যা সচরাচর করেন না, যে মা কোনো চিন্তা-ভাবনার ধার ধারেন না তাঁকেও বাবার জন্য চিন্তিত দেখছি—আজ সকালে মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর বাবাকে কিছুটা নিশ্চিন্ত মনে হলে। —এখন আপনিই বলুন সার, ভাবনা হয় না?—এত বছরের মধ্যে আর একবার মাত্র বাবাকে খুব অস্থির হতে দেখেছিলাম, সে অবশ্য এর থেকেও ঢের বেশি—

এবারে অবধূত সত্যি সত্যি একটা দাবড়ানি দিয়ে উঠলেন, এই! ফের মুখ খুলবি তো তোকে আমি সত্যিই ঘর থেকে বার করে দেব! মুখ দেখে মনে হলো পেটো কার্তিক বেফাস কিছু বলে ফেলেছিল। জিভ কেটে সামলে নিয়ে নিজের দু‘কান একবার মলে আবার পা টেপায় মন দিল। আর একবার ঢের বেশি অস্থিরতার কি কারণ ঘটেছিল সে-কৌতূহল আপাতত বড় নয়। একটু আগে যে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি দেখলাম পেটো কার্তিকের এ-কথার পর সে-সম্পর্কেই দ্বিগুণ কৌতূহল এখন। ক্যান্সার অপারেশনের ফতোয়া দেবেন একজন দেড়কোটিওয়ালা মানুষকে সেটাই এই লোকের অস্থিরতার বড় কারণ আমার একবারও মনে হলো না। কারণ শর্ত যা হলো তাতে ব্যক্তিগত লাভের কানা-কড়ি স্বার্থও নেই। অবধূত ততক্ষণে দুজনের গেলাসই রেডি করেছেন। কল্যাণী দেবীও গরম পাঁপড় ভাজার থালা হাতে উপস্থিত। বললাম, ব্যাপারটা ভালো করে না জানা আর না বোঝা পর্যন্ত এ-সব পরম উপাদেয় জিনিসও সচ্ছন্দে তল হবে না… কার্তিক বলছিল এই একটা কেস নিয়ে আপনিযুদ্ধ, উতলা হয়ে পড়েছিলেন!

শ্রীমতি সুন্দর একটা ভ্রূকুটি করে কার্তিকের দিকে তাকালেন, তোর বুঝি সবেতে সর্দারির কথা না বললেই না? তারপর আমার কথার জবাবে বললেন, আমি উতলা হয়েছিলাম ওর এত ভাবনা-চিন্তা দেখে…যার কাজ তিনি করছেন করাচ্ছেন আর উনি ভেবে সারা একটা লোকের জীবন-মরণের দায়িত্ব নেবেন কি নেবেন না গেলাসে বড়-সড় একটা চুমুক দিয়ে অবধূত মিটি মিটি হাসছিলেন। মন্তব্য করলেন, কথাটা ঠিক বললে না, আমি ভাবছিলাম মন যা বলছে সেই সাহসের জমির ওপর শক্ত পায়ে দাঁড়াব, না কাপুরুষের মতো লোকটাকে সোজা মৃত্যুর রাস্তায় এগোতে দেব—

—ওই একই হলো, দুইয়ের কোনোটারই তুমি মালিক নও।

—কিন্তু মালিকের কাজখানা তো আজ সকালে তুমিই করলে, ছক্কার ওভার বাউণ্ডারিখানা হাঁকিয়ে আমার হার-জিতের ফয়সলা করে দিলে! —আমি ছাই করলাম। হাসি মুখে ঘর ছেড়ে প্ৰস্থান।

বার দুই গেলাসে চুমুক দিয়ে পাঁপড়ভাজা চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলাম, এই ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে আপনি পর-পর দু‘দিন শ্মশানে গেছলেন?

—গেছলাম তো…

—নির্দেশ পাবার জন্যে?

মাথা নাড়লেন। তাই।

—নির্দেশ পেলেন?

—মনে তো হচ্ছে পেলাম, না হলে এতবড় ঝুঁকি নিই কি করে। এবারে আমি বেশ চেপে ধরার সুরেই বললাম, এরপর আমি আপনার কোন্ কথা বিশ্বাস করব—নিজের মুখে অনেকবার বলেছেন আপনি কোনোরকম অলৌকিকে বিশ্বাস করেন না, আপনি যা করেন আর যা পারেন সেটা কেবল শিক্ষা অভ্যাস আর অধ্যবসায়ের ব্যাপারে—

অবাক মুখ।—ঠিকই তো বলি এর মধ্যে আপনি অলৌকিকের কি দেখলেন?

ভদ্রলোক হা-হা করে হেসে উঠলেন। পা টেপা ভুলে পেটো কার্তিক ও তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে। গেলাস তুলে এক চুমুকে চার ভাগের তিন ভাগ শেষ করে তোয়ালেতে মুখ মুছলেন। তখনো হাসছেন। বললেন, শুনুন মশাই, আমি কখনো কোনো অলৌকিক নির্দেশ পাবার আশায় শ্মশানে যাই না, যাই নিজের মনঃসংযোগ করতে। নিজের মনকে সব-দিক থেকে গুটিয়ে এনে লক্ষ্যের দিকে স্থির করার মতো এমন জায়গা পৃথিবীতে আর নেই। আমার সবই ক্যালকুলেশনের ব্যাপার, অঙ্কের মতো মিলে না গেলে বুঝতে হবে গলদ আছে। শ্মশানে গিয়ে মন স্থির করে বসলে গলদ আছে কি নেই সেটা ধরা পড়ে। আর নির্দেশও তখন নিজের ভিতর থেকেই আসে।

কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি। দু‘দুবার শ্মশানে গেছলেন শুনেই ভাবছিলাম অলৌকিক কোনো ঘটনার ওপর নির্ভর করেই তিনি এমন এক রোগীকে অপারেশনে যাবার ফতোয়া দিয়ে বসেছেন। কিন্তু এমন জোর তিনি কোথা থেকে কি করে পেলেন সেটা এখনো বোধের অতীত। কল্যাণী দেবী একটা বড় রেকাবিতে মাছভাজা নিয়ে ঘরে এলেন। অবধূত তখন নিজের গেলাসে বোতলের জিনিস ঢালছেন। ঠাট্টার সুরে কল্যাণী বললেন ক’দিন বাদে আজ যে ফুর্তি দেখছি ওই বোতল খালি হতে বেশি সময় লাগবে না-আপনার নিজের ভাগ আগেই সরিয়ে রাখুন।

অবধুত হাসি মুখে স্ত্রীকে জানান দিলেন, ইনি ভেবেছিলেন আমি কোনো অলৌকিক নির্দেশ পাবার আশায় পর পর দু‘রাত শ্মশানে কাটিয়ে এসেছি।

কল্যাণী সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা যেন আমাকেই সমর্থন করলেন।—ভুল কি ভেবেছেন, বুদ্ধি বিবেচনার মধ্যে না আসা পর্যন্ত সব-কিছুই অলৌকিক, তুমি যদি কলম নিয়ে বসে এঁর মতো একটা গল্প লিখে ফেলতে পারো আমি তো হাঁ হয়ে বসে সেটাই অলৌকিক ভাবব।

মাছ ভাজার রেকাবি রেখে হাসি মুখে প্রস্থান করলেন। মনে মনে ভাবলাম, এই দিব্যাঙ্গনা প্রিয়দর্শিনীটি চারু-ভাষিণীও কম নন। এখনো আমার সমস্ত মন জুড়ে আছেন রতনলাল সারাওগি। এমন ফতোয়া দেবার মতো জোর অবধূত পেলেন কি করে সেটা আমার কাছে অলৌকিকের মতোই রহস্যজনক। জিজ্ঞেস করলাম, এখন বলুন তো কোন্ জোরের ওপর নির্ভর করে লোকটাকে অপারেশনে পাঠাবার মতো রিস্ক আপনি নিতে পারলেন? অবধূত হাসি মুখে পল্‌কা জবাব দিলেন, এর মধ্যে রিস্ক আবার কি দেখলেন, লোকটা বেঁচে গেলে দুটো হাসপাতাল পনেরো লক্ষ টাকা পাবে, আরো বহু লোকের উপকার হবে—আর না বাঁচলে তার ছেলেরা বড়জোর এখানে এসে ভাঁওতাবাজ বলে আমাকে গলা ছেড়ে গালাগাল করে যাবে —তাতে আমার মতো লোকের গায়ে কি বা ফোস্কা পড়বে?

একটুও বিশ্বাস হলো না। পেটো কার্তিকও দেখলাম অবিশ্বাসে মুখ মচকে জোরে জোরে পা-টেপা শুরু করেছে।

বললাম, এটুকুই কেবল সত্য হলে মনঃসংযোগ করার জন্য দু‘দিন আপনি শ্মশানে গিয়ে বসতেন না, বা ক’টা দিন এত অস্থিরতার মধ্যে কাটাতেন না, বলতে বাধা থাকলে অবশ্য জোর করব না—

হৃষ্ট মুখে গেলাসে ছোট ছোট দু‘তিনটে চুমুক দিয়ে খানিকটা ভাজা মাছ ভেঙে মুখে পুরলেন। তারপর গেলাসে আর একটা বড় চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ঠোঁটে ঝোলাতেই পেটো কার্তিক চট করে উঠে দাড়িয়ে লাইটার জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে দিয়ে আবার পা নিয়ে বসে পড়ল।

এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে অবধূত বললেন, আপনাকে বরাবর যা বলে এসেছি এ-ও তেমনি এক ঘটনার সাজ। কেউ ঘটালো, সাজালো। তারপর কারো না কারো ডাক পড়ার কথা, ঘুরে-ফিরে এই সাজের আসরে শেষে আমার ডাক পড়ল। তবে রতনলাল সারাওগিকে যদি জীবনে ফেরানো যায় সে বাহাদুরি আমার নয়, আমার শাশুড়ী মায়ের … বক্রেশ্বর শ্মশানের আমার সেই ভৈরবী মায়ের। কারণ লোকটাকে দেখা মাত্র প্রথমে আমি তাঁকে খরচের খাতাতেই ফেলে দিয়েছিলাম।

শুরুটাই আমার কাছে অলৌকিকের মতো ঠেকল, কারণ এর মধ্যে বহুকালের নিরুদ্দিষ্ট সেই ভৈরবী মা এসে গেলেন কি করে! কিন্তু বাধা না দিয়ে রুদ্ধশ্বাসেই শুনছি।

—রতনলাল সারাওগির এই ব্যাধি তিন বছরের। কলকাতা বম্বে আর মাদ্রাজের কোনো বড় বিশেষজ্ঞকে দেখাতে বাকি রাখেন নি। গোড়া থেকেই রে-ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছিল, তাই অমন বিশাল দগদগে ঘা। বিদেশে যাবার জন্যও প্রস্তুত হয়েছিলেন কিন্তু যাবতীয় রিপোর্ট দেখে সেখানকার বিশেযজ্ঞদের জবাব এসেছে করার কিছু নেই। সকলেই তিলে তিলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তার মধ্যেই একযোগে অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি কবিরাজী হেকিমি দৈব সমস্ত চিকিৎসাই চলছিল।… এই দৈবের রাস্তা ধরেই কি করে তাঁরা অবধূতের সন্ধান পান। এয়ারকণ্ডিশন গাড়ি নিয়ে রতনলালের দুই ছেলে এসে হাজির। টাকার জোরে তাদের কোনো চাহিদাই অপূর্ণ থাকে না। তাদের আর্জি বাবাকে, একবার দেখতে যেতে হবে। কি ব্যাপার অবধূত শুনে বললেন, আমি তো ঈশ্বর নই বাবারা, গিয়ে কি করব।…তবে তোমাদের বাবাকে এখানে একবার নিয়ে এলে চোখের দেখা দেখতে পারি।

ছেলেরা জানালো, বাবাকে কলকাতা থেকে এতদূরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়, দয়া করে তাঁকেই একবার যেতে হবে, এ-জন্য তিনি যত টাকা চান পাবেন।

অবধূত হেসে বললেন, আমার একটা বদ স্বভাব কেউ আমাকে টাকা দেখালে আমি তাকে বেরুবার দরজা দেখিয়ে দিই, এখন তোমরা এসো বাবারা—

তারা চলে গেল। কিন্তু ওই উক্তিই যে একটা আকর্ষণের কারণ হবে তা কি ভাবতে পেরেছিলেন! পরদিনই সেই এয়ারকণ্ডিশন গাড়ি আর তার পিছনে আর একটা গাড়ি বাড়ির দোরে হাজির। রতনলাল সারা ওগি তাঁর স্ত্রী, শ্যালক আর দুই ছেলে। ধরাধরি করে রোগীকে এই ঘরেই এনে বসানো হলো। তাঁকে দেখা মাত্র অবধূত একটা মৃতদেহ দেখলেন। এই দেখাটা যে প্রাথমিক অনুভূতির দেখা এটা পরে বুঝেছেন। রোগীর সম্পর্কে যা শুনেছেন আর প্রথম দর্শনে যা দেখলেন তাই থেকেই একটা ধারণা! কিন্তু তার পরেই রোগীর দিকে ভালো করে চেয়ে কিছু যেন একটা ব্যতিক্রম চোখে পড়ল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে ভৈরবী মায়ের একটা শিক্ষা হঠাৎই যেন মনে পড়ে গেল।…বলেছিলেন, কপালে কানে আর নাকে এই এই চিহ্ন আর ছায়া না দেখলে মৃত দেহও সম্পূর্ণ মৃত নয় ধরে নিতে হবে, অর্থাৎ দেহে তখনো আত্মা উপস্থিত বুঝতে হবে। আর দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে মৃত্যু অবধারিত হলে ছ’মাস এমন কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছর আগে থেকেও কপালে কানে আর নাকে সেই লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। ভৈরবী মায়ের কৃপায় সেই লক্ষণ অবধূত খুব ভালোই চেনেন। কিন্তু আশ্চর্য, রতনলাল সারাওগির কপালে কানে বা নাকে সেই লক্ষণ আদৌ দেখলেন না। তবু ভাবলেন, ভয়ংকর রকমের ক্যানসার যখন, সেই লক্ষণ আর চিহ্ন এখনো না পড়লেও শিগগীরই পড়বে। আবার মনে হলো, যে ব্যাধি তিন, বছরের মধ্যে তো শেষই হয়ে যাবার কথা।

মনসংযোগ করে দেখতে লাগলেন। যে ছায়া বা চিহ্ন পড়বে তার আভাসও অনেক সময় আগে থাকতে দেখতে পান। অবধূতের এই দৃষ্টি সঞ্চালনের কথায় এখন আর আমার অবিশ্বাস হয় না। হরিদ্বারের পথে ট্রেনে আমার স্ত্রীর মুখে নির্ভুল ভাবে শোকের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন।…এত বড় ব্যাধি সত্ত্বেও রতনলাল সারাওগির সমূহ মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা তাঁর তো চোখে পড়ছে না!

অবধূতের হাত-টাত দেখার খুব একটা দরকার হয় না। সংশয়ে পড়লে তখন দেখেন। কিন্তু এর থেকে বড় সংশয় কি আর হতে পারে। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল বড় রকমের অস্ত্রোপচারের লক্ষণই কেবল দেখছেন। মৃত্যুর যোগ দেখছেন না। হাতের রেখাতেও তাই দেখলেন। সমূহ অস্ত্রোপচার জনিত রক্তক্ষয় আর ভোগ দেখছেন কিন্তু আয়ুরেখা দীর্ঘ সবল। কৌতূহল বাড়তেই থাকল। রোগীর জন্ম সন তারিখ সময় আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে তাঁর ছেলেদের একজন ঠিকুজি বার করে দিল। এ-রকম জায়গায় আসছে বলে সঙ্গে নিয়েই এসেছে।

নিবিষ্ট মনে দেখলেন।… বাহান্ন বছর মাত্র বয়েস কিন্তু আটাত্তরের আগে মৃত্যু যোগ নেই। সাধারণ হিসেবে তাঁর অন্তত চোখে পড়ছে না।

এরপর অবধূতের নিজের কৌতূহলই তুঙ্গে। ঠিকুজির নকল লিখে রাখলেন। কি ভেবে বায়োপসির রিপোর্টও চেয়ে রেখে দিলেন। তারপর জানালেন, এখানে হবে না, তাকে তাঁর আসনে গিয়ে বসতে হবে—আদেশ পেলে কিছু করার আছে কিনা জানাবেন।

· রতনলাল সারাওগি আর তাঁর স্ত্রী কি কারণে অভিভূত নিজেরাও জানেন না। আমার ধারণা অবধূতের দৃষ্টি সঞ্চালন দেখেই। সাধারণের কাছে সেটা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার মতোই ব্যাপার। এই চাউনি, দৃষ্টি কত যে বদলে যায় নিজের চোখেই দেখেছি। তখন সত্যই মনে হয় দেহের অভ্যন্তরে যা-কিছু আছে তার সবটুকু দেখে নেবার ক্ষমতাও এই লোকের আছে। সেই ভাবে দেখে নেবার সময় ভরা শীতকালেও তাঁর কপাল আর মুখ ঘামতে থাকে। পরে জিজ্ঞেস করতে নিজেই বলেছেন, ওটা মনঃসংযোগের ধকল ছাড়া আর কিছু না, আর তার মধ্যে কিছুটা শো-বিজনেসেও আছে, লোকে অভিভূত হয়, তার ভিতরের দোষগুণ আরো বেশী ধরা পড়ে।

রতনলাল সারাওগি বললেন, আদেশের জন্য আসনে গিয়ে বসতে হবে বলছেন.. সে কোথায়?

এখানকারই শ্মশানে। আজ রোববার, মঙ্গলবার রাতে গিয়ে বসব… বুধবার হবে না, আপনি বেস্পতিবার বিকেলের দিকে ছেলেদের কাউকে পাঠিয়ে দেবেন।

চুপচাপ খানিক চেয়ে থেকে রতনলাল আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। বিড়বিড় করে বললেন, আমার ভাগ্য জানতে আমি নিজেই আসব। একটু থেমে আবার বললেন, এই এক রোগের কারণে এত দিনে কত লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে ঠিক নেই, কিন্তু আপনার কাছে আসার পর আমার ভিতর থেকে কেন একটু আশা হচ্ছে জানি না…

অবধূতের ভিতরটা তক্ষুনি সজাগ আবার। দু‘চোখ একাগ্র। কপাল দেখছেন, মুখ দেখছেন। সোজা জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি নিজের মন থেকে বলছেন না আরো অনেককে এ-কথা বলে শেষে হতাশ হয়েছেন? প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক বিস্মিত একটু। আবার মাথা নাড়লেন। বললেন, বিপদ কাটিয়ে দেবার জন্য অনেক সাধু মহারাজকে অনুরোধ করেছি, কিন্তু কাউকে দেখে এ-রকম আশা আর কখনো হয় নি।

অবধূতের বিবেচনায় এ-ও এক ধরনের সুলক্ষণ। কিন্তু তা আর মুখে ব্যক্ত করলেন না। বিদায় নেবার জন্য উঠে দাড়ানোর পরেও সকলের চোখে মুখে একটু ইতস্তত ভাব। ছেলে ছুটির আরো বেশি। গতদিনে এদেরই একজনকে অবধূত বলেছিলেন, কেউ টাকা দেখাতে এলে তাকে তাঁর বেরুনোর দরজা দেখিয়ে দেবার বদ অভ্যাস।

আমার দিকে চেয়ে অবধূত হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, প্রণামী নেবার ব্যাপারে আমার অরুচি নেই নিজের চোখেই তো দেখছেন, কিন্তু এদের বেলায় আমার মাথায় হঠাৎ যেন বক্কোমুনির থানের কংকালমালীর মেজাজ ভর করল। নিজেই দো-টানার মধ্যে পড়ে গেছি বলেই বোধহয়। ওই ছেলে দুটোর দিকে চেয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললাম, বেস্পতিবারে আবার আসতে চাও না ফের টাকা দেখিয়ে বেরুনোর দরজা দেখে নিতে চাও?… ভয়ে সকলে একসঙ্গে হাত জোড় করে ফেলল।

…বলে ফেলার পরেই নাকি অবধূত আবার নিজের স্বভাবে ফিরলেন। রতনলাল সারাওগির দিকে চেয়ে হাসি মুখেই বললেন, কেউ না বললেও আমি জানি আপনি কোটিপতি মানুষ, সেই সুদিন এলে আপনাকে দিয়ে আমার খরচ করানোর ক্ষমতাটাও দেখে নেবেন—তখন আমার খাঁই দেখে পালাবার পথ না খোঁজেন—এখন আসুন, এই ক’টা দিন যতটা পারেন মনটাকে নিরাসক্ত রাখতে চেষ্টা করুন।

… রতনলাল সারাওগির কি ব্যবসা আগের দিন ছেলেদের মুখেই শুনেছিলেন। সেদিন তাঁর কপাল আর হাত দেখে জেনেছেন ভদ্রলোকের টাকার কোনো লেখাজোখা নেই।

এ-রকম কঠিন পরীক্ষার মধ্যে অবধূত নিজেকে কমই ফেলেছেন। এযাবত তাঁকে অনেক জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু তার বেশির ভাগই নিজের প্রত্যক্ষ চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত। অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন, আবার ব্যর্থতার নজিরও কম নেই। যে-চেষ্টার নাম পুরুষকার, বিচার বিবেচনা অনুযায়ী নিজের সেই চেষ্টার ওপরেই তাঁর প্রধান নির্ভর। কিন্তু এ-ব্যপারটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। চিকিৎসা তাঁর হাতে নয়, অপারেশন করবে আর একজন, তাঁর নিজস্ব চেষ্টার কোনো ব্যাপারই নেই। সকলেই জানে মৃত্যু অবধারিত, অথচ ওই জীর্ণ দেহে তিনিই কেবল পরমায়ুর জোর দেখছেন। তাঁর হিসেবে ভুল হলে কি হবে? হয়তো অপারেশন টেবিলেই মরবে বা তার দু‘দশ দিনের মধ্যে মরবে। আর অপারেশন না হলে বড়জোর ছ’মাস আট মাস বাঁচবে, তারপর মরবে। ভুল হলে পরি নামের তফাৎ শুধু এইটুকু।…কিন্তু এই অনিশ্চয়তার দায়িত্ব নেবার অধিকার কি তাঁর আছে? ছ’মাস আট মাস ছেড়ে ছ’ঘণ্টা আট ঘণ্টার জন্যও কারো মৃত্যু এগিয়ে আনার উপলক্ষ কি তিনি হতে পারেন?

অবধূত ভেবে চলেছেন। ভাবনার জট বাড়ছে ছাড়া কমছে না। মন যা বলে হুট-হাট তা করে ফেলাই অভ্যাস। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে ভিতরে দ্বিধা কেন, দ্বন্দ্ব কেন? কাগজ কলম নিয়ে রোগীর জন্মক্ষণ ধরে হিসেব করে চলেছেন, আগে বা পরে পাঁচ-সাত মিনিটের ব্যতিক্রমে কি হয় সেই হিসেবও করেছেন। তাতেও রোগীর মৃত্যুর ছায়া পর্যন্ত দেখছেন না। মানুষটাকে বার বার চোখের সামনে এনে দাড় করিয়েছেন। মৃত্যু যন্ত্রণার ভোগ দেখছেন লক্ষণ দেখছেন, কিন্তু মৃত্যু দেখছেন না, ভোগযন্ত্রণা থেকে উত্তীর্ণ মুখই চোখে ভাসছে।

মঙ্গলবার রাতে শ্মশানে গিয়ে বসলেন। কিন্তু আশ্চর্য নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারলেন না। লক্ষ্যের দিকে মন সে-ভাবে নিবিষ্ট হলো না। কেবলই মনে হতে লাগল এতকাল ধরে মানুষকে বিধান আর নির্দেশ দিয়ে দিয়ে একটা অহং-ভাবের বেষ্টনের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। রতনলাল সারাওগির সম্পর্কে যে বিধান আর নির্দেশ মনে এসেছে সেটা ওই অহংএর নির্দেশ না ভৈরবী মায়ের শিক্ষার নির্দেশ?

রাত ভোর হলো। তিনি কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না। ঘরে ফিরতে মুখের দিকে চেয়েই কল্যাণী কি বুঝলেন তিনিই জানেন। জিজ্ঞেস করলেন, মন স্থির করতে পারলে না?

অবধূত অসহায়ের মতো মাথা নাড়লেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কেন পারছি না বলো তো, হিসেবে যা স্পষ্ট দেখছি বিশ্বাস দিয়ে তা আঁকড়ে ধরতে পারছি না কেন?

কল্যাণী ছোট করে মন্তব্য করলেন, এ তো ভালো লক্ষণ—।

অবধূত অবাক।—ভালো লক্ষণ কেন?

—যে-বিচার তোমার মনে এসেছে সেটা তুমি তোমার বিচার ভাবছ, তার সঙ্গে তুমিটা যুক্ত হয়ে পড়ছে, তোমার দৌড় কতটুকু সেটা কেউ তোমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

হতভম্বের মতো খানিক চেয়ে থেকে অবধূত চুপচাপ ঘরে এসে বসলেন! .. কল্যাণীর বিশ্বাসের ধারা আলাদা, পথ আলাদা। সেই ধারায় বা পথে অবধূত কখনো চলেন নি। জাগতিক কর্মের পথই তাঁর বিশ্বাসের উৎস। কল্যাণীর চোখে এই কর্মের মধ্যে কিছু গলদ চোখে পড়েছে। নিজের অগোচরে তিনি কর্তা হয়ে বসেছিলেন। তাই সংশয়, তাই বিভ্রম। দিনটা একটা গ্লানির মধ্যে কাটল। রাতে নিঃশব্দে আবার শ্মশানে চলে গেলেন। এইদিনে সমর্পণটাই বড় হয়ে উঠল। মনঃসংযোগে কোনো বাধা হলো না। ভৈরবী মা সত্যিই কি তাঁর সামনে এসে দাড়িয়েছেন? না, তা কখনো হয় না, হতে পারে না। সমর্পণের ভিতর দিয়েই তিনি তাঁর উপস্থিতি অনুভব করতে চেষ্টা করেছেন, অনুভব করতে পেরেছেন। তাঁর শিক্ষার পাতাগুলো পর পর উল্টে গেছেন।…সদ্য বর্তমানের এই ঘটনার সাজে তাঁর কোনো কর্তৃত্ব নেই সেটা অনুভব করেছেন। কেউ ঘটিয়েছে, কেউ সাজিয়েছে।… রতনলাল সারাওগির আয়ুর জোর তিনি দেখেন নি তাঁকে দেখানো হয়েছে। এই দেখার বিশ্লেষণটুকুও আর বুদ্ধির অগোচর নয়। বাইরে থেকে রোগের প্রকোপ দেখে ভিতরের শিকড় যতটা ছড়িয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, ততো দূর পর্যন্ত ছড়ায় নি। যে-কারণেই হোক এক জায়গা পর্যন্ত এসে থেমে আছে। অপারেশন করলে নির্মূ হয়ে যাবে, আর ছড়াবে না। ঘটনার সাজে শুধু এই নির্দেশটুকু ঘোষণা করাই তাঁর ভূমিকা, এর বেশি কিছুই না।

অনেকটা হালকা মনেই ঘরে ফিরেছেন। একটু কেবল সংশয় এই নির্দেশ রতনলাল বা তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা মানবেন কি না।… তবে, লোকের আয়ুর জোর যে-রকম স্পষ্ট, মনে হয় মানবেন। ঘরে ফিরে আরো নিশ্চিন্ত। তাঁকে দেখেই কল্যাণী হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ভাবনা চিন্তার শেষ তো না আরো বাকি?

অবধূত জবাব দিলেন, মনে হয় শেষ, কেন? —মনে হয় আবার কি, আমি জানি শেষ।—কি করে জানলে?

খুব খুশি মুখে কল্যাণী বললেন, রাতে তোমার এই ব্যাপারটা চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ভোর রাতে স্বপ্ন দেখলাম আমার শিবঠাকুর হাসি মুখে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আর তোমার নাম ধরে সেইসব মধুর সম্ভাষণ করে গালাগালি করছেন—

—মানে শালা-শালা করছেন?

কল্যাণী হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

—কি বলছিলেন? অবধূত উদ্‌গ্রীব।

এর পরে কল্যাণী শালা শব্দটা মুখে উচ্চারণ না করলেও তার শিবঠাকুর অর্থাৎ কংকালমালী ভৈরব কি বলেছেন বুঝতে অসুবিধে হয় নি। বলেছেন, শালা দিনে-দিনে কর্তা হয়ে বসছিল, ওকে আরো ভালো-রকম ভোগাবো ভেবেছিলাম, তুই আর তোর মা শালাকে খুব বাঁচিয়ে দিলি।

না, এ-ও আলৌকিক কিছু ভাবেন না অবধূত। স্বপ্ন স্বপ্নই। মানসিক উদ্বেগ অথবা চিন্তার প্রতিফলন। তবু ভিতরটা খুশি হয়ে উঠেছিল।


© 2024 পুরনো বই