“বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে
ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥”
বাঙ্গলা ভাষা যে বোঝে সেই এ শ্লোকটা শুনলেই বলবে—‘বুঝলেম’, কিন্তু ‘ভারতী’ কাগজের মলাটের নিচে থেকে টেনে বার ক’রে আজকালের একখানা ছবি সবার সামনে যদি ধরে দিই, সাড়ে পনেরো আনার চেয়ে বেশি লোক বলবে, ‘বুঝলেম না মশায়!’ এই শেষের ঘটনা ঘটতে পারে, হয় যে ছবিটা লিখেছে সেই আর্টিষ্টের ছবির ভাষায় বিশেষ জ্ঞান না থাকায়, অথবা যে ছবি দেখেছে চিত্রের ভাষার দৃষ্টিটা তার যদি মোটেই না থাকে। ভারতীর বন্দনাটা যে ভাষায় লেখা সেই ভাষাটা আমাদের সুপরিচিত আর ‘ভারতী’র ছবিখানা যে ভাষায় রচা সে ভাষাটা একেবারেই আমাদের অপরিচিত; সেই জন্য চিত্র-পরিচয় পড়েও ওটা বুঝলেম না এমনটা হতে বাধা কোন্খানে? চীনেম্যানের কানের কাছে খুব চেঁচিয়ে সরস্বতীর স্তোত্র পাঠ করলেও সে বুঝবে না, কিন্তু ছবির ভাষার বেলায় সে অনেকখানি বুঝবে, কেননা ছবির ভাষা অনেকটা সার্বজনীন ভাষা। ‘আবর্’ কথাটা ফরাসীকে বল্লে সে গাছ বুঝবে, আবার ‘আবর্’ শব্দ হিন্দুস্থানীর কাছে মেঘরূপে দেখা দেবে, ইংরেজ সে শব্দটার কোনরূপ অর্থ আবিষ্কার করতে পারবে না, কিন্তু আঁকার ভাষায় ‘আবর্’ হয় গাছ নয় অভ্র স্বরূপ হয়ে দেখা দেয়; কথিত ভাষার মতো কৃত্রিম উপায়ে জোর ক’রে চাপিয়ে দেওয়া রূপ নিয়ে নয়। সুতরাং ছবির ভাষার মধ্যে, বলতেই হয়, অপরিচয়ের প্রাচীর এত কম উঁচু যে সবাই এমন কি ছেলেতেও সেটা উল্লঙ্ঘন সহজেই করতে পারে, কিন্তু ঐ একটু চেষ্টা যার নেই তার কাছে ঐ এক হাত প্রাচীর দেখায় একশো হাত দুর্গপ্রাকার,—ছবি ঠেকে সমস্যা। কবির ভাষা চলেছে শব্দ চলাচলের পথ কানের রাস্তা ধরে’ মনের দিকে, ছবির ভাষা অভিনেতার ভাষা এরা চলেছে রূপ চলাচলের পথ আর চোখের দেখা অবলম্বন ক’রে ইঙ্গিত করতে করতে, আবার এই কথিত ভাষা যেটা আসলে কানের বিষয় এখন সেটা ছাপার অক্ষরের মূর্তিতে চোখ দিয়েই যাচ্ছে সোজা মনের মধ্যে; ‘নবঘনশ্যাম’ এই কথাটা—ছাপা দেখলেই রূপ ও রং দুটোর উদ্রেক করে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে!
নাটক যখন পড়া হয় কিম্বা গ্রামোফোনের মধ্য দিয়ে শুনি তখন কান শোনে আর মন সঙ্গে সঙ্গেই নটনটীদের অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি মায় দৃশ্যপটগুলো পর্যন্ত চোখের কোন সাহায্য না নিয়েই কল্পনায় দেখে চলে, ছবির বেলায় এর বিপরীত কাণ্ড ঘটে,—চোখ দেখলে রূপের ছাপগুলো, মন শুনে চল্লো কানের শোনার অপেক্ষা না রেখে ছবি যা বলছে তা; বায়স্কোপের ধরা ছবি, চোখে দেখি শুধু তার চলা ফেরা, ছবি কিন্তু যা বল্লে সেটা মন শুনে নেয়।
কবির মাতৃভাষা যদি বাঙ্গলা হয় তবে বাঙ্গলা খুব ভাল ক’রে না শিখলে ইংরেজ সেটি বোঝে না; তেমনি ছবির ভাষা অভিনয়ের ভাষা এসবেও দ্রষ্টার চোখ দোরস্ত না হলে মুস্কিল। মুখের কথা একটা না একটা রূপ ধরে আসে, কাগ্ বগ্ বল্লেই কালো সাদা দুটো পাখী সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির! শব্দের সঙ্গে রূপকে জড়িয়ে নিয়ে বাক্য যদি হল উচ্চারিত ছবি, তবে ছবি হল রূপের রেখার রংএর সঙ্গে কথাকে জড়িয়ে নিয়ে—রূপ-কথা, অভিনেতার ভাষাকেও তেমনি বলতে পারো রূপের চলা বলা নিয়ে চলন্তি ভাষা! কবিতার ছবির অভিনয়ের ভাষার মতো সুর আর রূপ দিয়ে বাক্যসমূহকে যথোপযুক্ত স্থান কাল পাত্র ভেদে অভিনেতা ও অভিনেত্রীর মতো সাজিয়ে গুজিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে ছেড়ে দিলে তবেই যাত্রা সুরু ক’রে দিলে বাক্যগুলো, চল্লো ছন্দ ধরে, যথা—
“করিবর—রাজহংস-গতি-গামিনী
চললিহুঁ সঙ্গেত—গেহা
অমল তড়িত দণ্ড হেম মঞ্জরী
জিনি অপরূপ সুন্দর দেহা॥”
কিন্তু বাক্যগুলোকে ভাষার সূত্রে নটনটী সূত্ৰধার এদের মতো বাঁধা হ’ল না, তখন কেবলি বাক্য সকল শব্দ করলে—ও, এ, হে, হৈ, ঐ কিম্বা খানিক নেচে চল্লো পুতুলের মতো কিন্তু কোন দৃশ্য দেখালে না বা কিছু কথাও বল্লে না, কোলাহল চলাচল হ’ল খানিক, বলাবলি হল না, যেমন—
“হল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন মতি
হয় শান্ত কি ক্ষান্ত কৃতান্ত গতি
করি গঞ্জিত গুঞ্জিত ভৃঙ্গ সবে
ত্যজি মৃত্যু কি চিত্ত কি নিত্য রবে?”
শোলোক্টা কি যেন বলতে চাইলে কিন্তু খাপছাড়া ভাবে, এ যেন কেউ তুরকী আরবী পড়ে ফরাশি মিশালে! কিন্তু কথাকে কবি কথা বলালেন ভাষা দিয়ে, চালিয়ে দিলেন ছন্দ দিয়ে, কথাগুলো তবে সজাগ সজীব অভিনেতার মতো নেচে গেয়ে বাঁশি বাজিয়ে চল্লো পরিষ্কার।
“‘চলিগো, চলিগো, যাইগো চলে’।
পথের প্রদীপ জ্বলে গো
গগনতলে।
বাজিয়ে চলি পথের বাঁশি
ছড়িয়ে চলি চলার হাসি
রঙীন বসন উড়িয়ে চলি
জলে স্থলে।”
ছবির বেলাতেও এমনি, সুর সার কথাবার্তা এসবের সূত্রে রূপকে না বেঁধে, আঁকা রূপগুলো অমনি যদি ছেড়ে দেওয়া যায় পটের উপরে, তবে তারা একটা একটা বিশেষ্যের মতো নিজের নিজের রূপের তালিকা দ্রষ্টার চোখের সামনে ধরে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে, বলে না চলে না—পিদুম, ফুল, ফুলদানি, বাবু, রাজা, পণ্ডিত, সাহেব কিম্বা অমুক অমুক অমুক এর বেশি নয়; কিন্তু প্রদীপ আঁকলেম, তার কাছে ফেলে দিলেম পোড়া সল্তে, ঢেলে দিলেম তেলটা পটের উপর—ছবি কথা ক’য়ে উঠলো,—“নির্ব্বাণদীপে কিমু তৈলদানম্”।
ছবিকে ইঙ্গিতের ভাষা দিয়ে বলানো গেল, চলানো গেল। নাট্যকলা প্রধানতঃ ইঙ্গিতেরই ভাষা বটে কিন্তু তার সঙ্গেও কথিত ভাষার সঙ্কেত অনেকখানি না জুড়লে নাটকাভিনয় করা চলে না—এই ‘লেকচার’ লিখছি সামনে এতটুকু ‘টোটো’ ছেলেটা বোবা নটের মতো নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে চল্লো, ভেবেই পাইনে তার অর্থ! হঠাৎ অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে শিশু নট বাক্য আর সুর জুড়ে দিলে অং অং ভুস্ ভুস্, বোঁ বন্, বন সোঁ শন্ শন্, হিং টিং ছট্ ফট্, আয় চট্ পট্, লাগ লাগ ভোজবাজি, চোর বেটাদের কারসাজি, ঠিক দুপুরে রদ্দুরে, তাল পুকুরে উত্তুরে, কার আজ্ঞে? না, কথিত ভাষার আজ্ঞে পেয়ে বোবা ইঙ্গিত যাদু-মন্ত্র কথা ক’য়ে ফেল্পে, যেন ঘুড়ি উড়িয়ে চল্লো ঘুরে ফিরে।
ছবির ভাষা, কথার ভাষা, অভিনয়ের ভাষা ও সঙ্গীতের ভাষা এই রকম নানা ভাষা এ পর্যন্ত মানুষ কাযে খাটিয়ে আসছে। এর মধ্যে সঙ্গীত শুধু যা বলতে চায়, কিম্বা যখন কাঁদাতে চায় বা হাসাতে চায়, কাকুতি মিনতি জানাতে চায় তখন ছবির ভাষা ও কথার ভাষাকে অবলম্বন না করেও নিজের স্বতন্ত্র ভাষার মীড় মূৰ্ছনা ইত্যাদি দিয়ে সুব্যক্ত হয়ে উঠতে পারে। রং এর ভাষারও এই ক্ষমতা ও স্বাধীনতা আছে—আকাশের রূপ নেই কিন্তু রংএর আভাস দিয়ে সে কথা বলে। কিন্তু আর সব ভাষা কথিত চিত্রিত অভিনীত সমস্তই এ ওর আশ্রয় অপেক্ষা করে। সুর আর রূপ, বলা ও দেখা, এরা সব কেমন মিলে জুলে কায করে দু একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। মধুর বাক্যগুলো কানের জিনিষ হলেও মাধবীলতার মতো চোখের দেখা সহকারকে আশ্রয় না করে পারে না। দৃশ্য বা ছবিকে আশ্রয় না করে কিছু বলা কওয়া একেবারেই চলে না তা নয়, যেমন—
“কাহারে কহিব দুঃখ কে জানে অন্তর
যাহারে মরমী কহি সে বাসয়ে পর।
আপনা বলিতে বুঝি নাহিক সংসারে
এতদিনে বুঝিনু সে ভাবিয়া অন্তরে।”
এখানে মনোভাব বাচন হল, কোন রূপ কোন ভঙ্গি, ছবি বা অভিনয়ের সাহায্য না নিয়েও। বাচনের বেলায় বাক্য স্বাধীন কিন্তু বর্ণনের বেলায় একেবারে পরাধীন, যেমন—
‘একে কাল হৈল মোর নয়লি যৌবন
আর কাল হৈল মোর বাস বৃন্দাবন।’
নব যৌবন আর বৃন্দাবনের বসন্ত শোভার ছবি বাক্যগুলোর মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের মতো চমকাচ্ছে!
‘অার কাল হৈল মোর কদম্বের তল
আর কাল হৈল মোর যমুনার জল।’
বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো কালো যমুনা তার ধারে কদমতলা, তার ছায়ায় সহচরী সহিত রাধিকা—
‘আর কাল হৈল মোর রতন ভূষণ
আর কাল হৈল মোর গিরি গোবর্দ্ধন।’
রাধিকার রত্ন অলঙ্কারের ঝিকমিকি থেকে দূরের কালো পাহাড়ের ছবি দিয়ে Landscapeটা সম্পূর্ণ হল, ছবি মিলে গেল কথার সঙ্গে, কান চোখ দুয়ের রাস্তা একত্র হয়ে সোজা চল্লো মনোরাজ্যে! এর পর আর ছবি নেই বর্ণনা নেই শুধু কথা দিয়ে বাচন—
‘এত কাল সনে অামি থাকি একাকিনী
এমন ব্যথিত নাহি শুনএ কাহিনী।’
এ বারে কথিত ভাষার ছবির সাক্ষাদ্দর্শন—
‘জলদ বরণ কানু, দলিত অঞ্জন জনু
উদয় হয়েছে সুধাময়—
নয়ন চকোর মোর, পিতে করে উতরোল
নিমিষে নিমিখ নাহি রয়।
সই দেখিনু শ্যামের রূপ যাইতে জলে!’
একেবারে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ছবি-দেখা কথার ভাষা দিয়ে! এইবার অঙ্গভঙ্গি আর চলার সঙ্গে কথার যোগাযোগ পরিষ্কার দেখাবো—
‘চলিতে না পারে রসের ভরে
আলস নয়ানে অলস ঝরে
ঘন ঘন সে যে বাহিরে যায়
আন ছলে কত কথা বুঝায়।’
চোখের সামনে চলাফেরা সুরু ক’রে দিলে কথার ভাষা অভিনয় করে নানা ভঙ্গিতে।
চিত্রিত ভাষা কথিত ভাষা অভিনীত ভাষা এসব যদি এ ওর কাছে লেনা দেনা করে চল্লো তবে কথিত ভাষার ব্যাকরণ অলঙ্কারের সূত্র আইন কানুন ইত্যাদির সঙ্গে আর দুটো ভাষার ব্যাকরণাদির মিল থাকতে বাধ্য। কথার ব্যাকরণে যাকে বলে ‘ধাতু’, ছবির ব্যাকরণে তার নাম ‘কাঠামো’ (form)। ধারণ করে রাখে বলেই তাকে বলি ধাতু। ধাতু ও প্রত্যয় একত্র না হ’লে কথিত ভাষার শব্দরূপ পাই না, ছবির ভাষাতেও ঠিক ঐ নিয়ম—মাথা হাত পা ইত্যাদি রেখে দিয়ে একটা কাঠামো বা ফর্মা বাঁধা গেল। কিন্তু সেটা বানর না নর এ প্রত্যয় বা বিশ্বাস কিসে হবে যদি না ছবিতে নর বানরের বিশেষ প্রত্যয় দিই! শুধু এই নয়, বিভক্তি যিনি ভাগ করেন ভঙ্গি দেন, তাঁর চিহ্ন ইত্যাদি নানা ভঙ্গিতে কাঠামোয় জুড়ে দেওয়া চাই। বর্ণে বর্ণে রূপে রূপে নানা বস্তুর সঙ্গে নানা বস্তুতে সন্ধি সমাস করার সূত্র আছে, ছবির ব্যাকরণে, বচন ক্রিয়া বিশেষ্য বিশেষণ সর্বনাম অব্যয় এমন কি মুগ্ধবোধের সবখানি অলঙ্কারশাস্ত্রের সবখানির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া চলে ছবির ব্যাকরণ আর অলঙ্কারের ধারাগুলো। কথিত ভাষার বেলায় ‘ভৃ’ ধাতু গক্ প্রত্যয় করে যেমন ‘ভৃঙ্গ’, ছবির ভাষায় কালো ফোঁটার উপরে দুটো রেফ্ যোগ করলেই হয় ‘দ্বিরেফ্ ভৃঙ্গ’ আবার ভৃঙ্গের কালো ফোঁটায় রেফ্ না দিয়ে শুণ্ড প্রত্যয় দিলে হয় ‘ভৃঙ্গার’ যেমন ‘ভৃ’ ধাতুতে ‘গিক’ প্রত্যয় জুড়লে হয় ‘ভৃঙ্গি’।
ছবি লেখার উৎসাহ নেই কিন্তু ছবির ব্যাকরণ লেখার আম্বা আছে এমন ছাত্র যদি পাই তো চিত্ৰকরে আর বৈয়াকরণে মিলে এই ভাবে আমরা ছবি দেওয়া একটা ব্যাকরণ রচনা করতে পারি, কিন্তু এ কাজে নামতে আমার সাহস নেই কেননা ব্যাকরণ বলে জিনিষটা আমার সঙ্গে কি কথিত ভাষা কি চিত্রিত ভাষা দুয়ের দিক দিয়েই চিরকাল ঝগড়া করে বসে আছে। সংকীর্তিত ভাষা যেমন, তেমনি সংচিত্রিত ভাষাও একটা ভাষা, ব্যাকরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে এইটে যদি সাব্যস্ত হল তবে এও ঠিক হ’ল যে ছবি দেখা শুধু চোখ নিয়ে চলে না ভাষা-জ্ঞানও থাকা চাই দ্রষ্টার, ছবি-স্রষ্টার পক্ষেও ঐ একই কথা। ‘রসগোল্লা খেতে মিষ্টি, টাপুর টুপুর পড়ে বৃষ্টি’, এটা বুঝতে পারে না পাঠশালায় না গিয়েও এমন ছেলে কমই আছে, কিন্তু শিশুবোধের পাঠ থেকে ভাষা-জ্ঞান বেশ একটু না এগোলে—
‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে
হৃদয়-কমল-বন মাঝে!’
এটা বোঝা সম্ভব হয় না চট্ ক’রে বালকের। শুধু অক্ষর কিম্বা কথা অথবা পদ কিম্বা ছত্রের পর ছত্র লিখতে পারলে অথবা চিনে চিনে পড়তে পারলেই সুন্দর ভাষায় গল্প কবিতা ইত্যাদির লেখক বা পাঠক হয়ে ওঠা যায় একথা কেউ বলে না, ছবি অভিনয় নর্তন গান ইত্যাদির বেলায় তবে সে কথা খাটবে কেন! যেমন চিঠি লিখতে পারে অনেকে তেমনি ছবিও লিখতে পারে একটু শিখলে প্রায় সবাই, কিন্তু লেখার মতো লেখার ভাষা, আঁকার মতো আঁকার ভাষার উপর দখল ক’জনে পায়? কাযেই বলি যে ভাষাই হোক তাতে স্রষ্টাও যেমন অল্প তেমনি দ্রষ্টাও ক্বচিৎ মেলে। ভাষাজ্ঞানের অভাব বশতঃ ফুলকে দেখারূপে আঁকা এক ফুলের ভাষা শুনে নিজের ভাষায় ফুলকে বর্ণনা করায় তফাৎ আছে কে না বলবে!
বাঙ্গলা দেশে অপ্রচলিত সংস্কৃত ভাষা, কিন্তু সেই অপ্রচলিত ভাষা চলিত বাঙ্গলার সঙ্গে মিলিয়ে একটা অদ্ভুত ভাষা হয়ে প্রচলিত যেমনি হ’ল, অমনি বাঙ্গলার পণ্ডিত সমাজে খুব চলন হল সেই ভাষার, সবাই লিখলে কইলে বুঝলে বুঝালে সেই মিশ্র ভাষায়, চলিত বাঙ্গলায় খাঁটি বাঙ্গলায় লেখা অপ্রচলিত হয়ে পড়লো, ফল হ’ল—এক কালের চলতি ভাষা সহজ কথা সমস্তই দুর্বোধ্য হয়ে পড়লো, এমন কি কথার অক্ষর মূর্তিটা চোখে স্পষ্ট দেখলেও কথাটার ভাব-অর্থ ইত্যাদি বোঝা শক্ত হয়ে পড়ল। বাঙ্গলা অথচ অপ্রচলিত কথাগুলোর বেলায় যদি এটা খাটে তবে ছবির ভাষার বেলায় সেটা খাটবে না কেন? ছবির মূর্তির অপ্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাষা বোঝাও দুঃসাধ্য হয়ে যে পড়ে তার প্রমাণ দেশের ইতিহাসে ধরা থাকে, আর সেইগুলোর নাম হয় অন্ধযুগ, এই অন্ধতার মধ্য দিয়ে আমাদের মতো পৃথিবীর অনেকেই চলেছে সময় সময়! চোখে দেখা মাত্রই সবখানি বোঝা না গেল সে ছবি ছবিই নয় একথা না হয় শিল্পীর উপরে জবরদস্তিতে চালানো গেল, কিন্তু আমাদের নিজ বাঙ্গলার মুখের কথা আমরা অনেক সময়ে নিজেরাই বুঝিনে বোঝাতেও পারিনে ভাষাতে পণ্ডিতেরা না বুঝিয়ে দিলে, তবে কি বলবো বাঙ্গলা ভাষা বলে বস্তুটা বস্তুই নয়?—‘ছীয়াল’, ‘ছিমনী’, ‘ছোলঙ্গ’ এই তিনটেই বাংলা কথা, কিন্তু বুঝলে কিছু? ফরিদপুরের ছেলে ‘ছোলঙ্গ’ বলতেই বোঝে, বহরমপুরের লোক বোঝে না, বাঙ্গলা শব্দকোষ না আয়ত্ত হ’লে ওয়েবষ্টার জ্ঞান নিয়েও বুঝতে পারে না ‘ছোলঙ্গ’ হচ্ছে বাতাবি লেবু, লারঙ্গ ছোলঙ্গ টাবা কমলা বীজপুর। ‘ছিয়াল’, ‘ছিমনী’ এ দুটোও বাঙ্গলা কিন্তু বাঙ্গলার সাধুভাষা বলে কৃত্রিম ভাষা নিয়ে যারা ঘরকন্না করছেন তাঁরা এর একটাকে শৃগালের অপভ্রংশ আর একটাকে ইংরাজি চিম্নি কথার বাঙ্গলা বলেই ধরবেন কিন্তু এ দুটোই তা নয়—ছীয়াল মানে শ্ৰীল বা শ্ৰীমান ও শ্ৰীমতী, আর ছিম্নী মানে পাথর-কাটা ‘ছেনী’, শৃগালও নয় চিমনিও নয়। দুশো বছর আগে যে ভাষা চলিত ভাষা ছিল, পট ও পাটার ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রাচীন বাঙ্গলা পুঁথির ভাষাও অপ্রচলিত হয়ে গেছে; সুতরাং যে শোলোক্টা এবারে বলবো তা বাঙ্গলা হলেও আমাদের কাছে চীনে ভাষারই মতো দুর্বোধ্য—
“ঘাত বাত হাত ঘর জোহি অয়লাহু
ন ভেতল চোলে অারে সবে অকলাহু।’
পরিচিত বাংলায় আন্দাজে আন্দাজে এর যতটা ধরা গেল তার তর্জমা করলেম, তবে অনেকটা বোধগম্য হল ভাবার্থটা—
ঘাট বাট হাট ঘর করিনু সন্ধান
চোরে না পাইরা মোরা হইনু হয়রান।
দুই তিন শত বছরের আগেকার বাঙ্গালী যে চলিত ভাষায় কথা কইতো তাই দিয়েই উপরের কবিতাটা লেখা, আজকের আমরা সে ভাষা দখল করিনি অথবা ভুলে গেছি, কবিতা দুর্বোধ হল সেইজন্য, ভাষার দোষেও নয় কবির দোষেও নয়।
কথিত ভাষার হিসেব পণ্ডিতেরা এইরূপ দিয়েছেন—সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, মিশ্র অথবা সংস্কৃত, ভাষা আর বিভাষা। আর্টের ভাষাতেও এই ভাগ, যথা–শাস্ত্রীয় শিল্প Academic art, লোকশিল্প Folk art, পরশিল্প Foreign art, মিশ্রশিল্প Adapted art. লোকশিল্পের ভাষা হল—পটপাটা গহনাগাটি ঘটিবাটি কাপড়চোপড় এমনি যে সব art শাস্ত্রের লক্ষণের সঙ্গে না মিল্লেও মন হরণ করে। শাস্ত্র ব্যাকরণ ইত্যাদি ‘পণ্ডিতানাম্ মতম্’ যে art এর সঙ্গে যোগ দেয়নি কিন্তু ‘যত্র লগ্নং হি হৃৎ’ হৃদয় যার সঙ্গে যুক্ত আছে, শুক্রাচার্যের মতে তাই হল লোকশিল্পের ভাষার রূপ। আর যা ‘পণ্ডিতানাম্ মতম্’ যেমন দেবমূর্তি-রচনা শিল্প শাস্ত্রের লক্ষণাক্রান্ত অথবা রাজা বা পণ্ডিতগণের অভিমত শিল্প সেই হল শিল্পের সংস্কৃত ভাষা—কোথাও লোকশিল্পের চলিত ভাষাকে মেজে ঘষে সেটা প্রস্তুত, কোথাও প্রাচীন লুপ্ত ভাষাকে চলিতের সঙ্গে মিলিয়ে নব কলেবর দিয়েও সাধুভাষারূপে সেটা প্রস্তুত করা হয়। পরশিল্প হ’ল যেমন গান্ধারের শিল্প, একালের অয়েল পেণ্টিং। মিশ্রশিল্প চীনের বৌদ্ধশিল্প, জাপানের নারা মন্দিরের শিল্প, এসিয়ার ছাঁচে ঢালা এখনকার ইয়োরোপীয় শিল্প, গ্রীসের ছাঁচে ঢালা স্থানবিশেষের বৌদ্ধশিল্প এবং এখনকার বাঙ্গলার নবচিত্রকলা পদ্ধতি! সুতরাং সব ছেড়ে দিয়ে বাঙ্গলার নব চিত্রকলাকেই ধ’রে দেখা যাক—ছবিগুলো সমস্যা হয়ে উঠলে তো বড় বিপদ! ছবির ছবিত্ব চুলোয় গেল, সেগুলো হয়ে উঠলো ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব এবং বর-ঠকানো কূট প্রশ্ন! নব চিত্রকলার এ ঘটনা যে ঘটেনি তা অস্বীকার করবার যে নেই যখন সবাই বলছে, কিন্তু ছবিটা যে সমস্যার মতো ঠেকে সেটা ছবির বা ছবি লিখিয়ের দোষে অথবা ছবি দেখিয়ের দোষে সেটা তো বিচার করা চাই! “বায়বা যাহি দর্শতে মে সোমা অরং কৃতাঃ, তেষাং পাহি শ্রুবী হবং!” সব অন্ধকার ছবির সমস্যার চেয়ে ঘোরতর সমস্যা আমাদের মতো অজ্ঞানের কাছে, কিন্তু বেদের পণ্ডিতের কাছে এটা একেবারেই সমস্যা নয়! ছবি যেমন তেমনি রাজাও রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সৈন্য-সামন্ত, ধূম-ধাম, হাঁক-ডাক, দ্বারপাল, দুর্গ ইত্যাদির দুর্গমতা নিয়ে একটা মস্ত সমস্যার মত ঠেকেন প্রজার কাছে, কিন্তু উপযুক্ত মানুষ বলে রাজার একটা স্বতন্ত্র সত্তা আছে—সেখানে রাজা হন রাজামহাশয়—দুর্গম সমস্যা নয়, তেমনি ছবি মূর্তির সত্তা হ’ল সুন্দর ছবি বা সুন্দরমূর্তি বা শুধু ছবি শুধু মূর্তিতে। রাজাকে উপযুক্ত মানুষের সত্তার দিক দিয়ে দেখার পক্ষেও যেমন দুর্গদ্বার ইত্যাদির বাধা আছে এবং কারো কারো কাছে নেইও বটে, ছবি মূর্তির সত্তার বোধের বেলাতেও ঠিক একই কথা। ছবিকে মূর্তিকে শুধু ছবি মূর্তির দিক দিয়ে বুঝতে পারলে আর সব দিক সহজ হয়ে যায় কিন্তু এ কাজটাও যে সবাই সহজে দখল করতে পারে—হঠাৎ ছবি মূর্তি দেখেই তাদের সত্তার দিক দিয়ে তাদের ধরা চট্ করে যে হয়—তা নয়, সেই ঘুরে ফিরে আসে পরিচয়ের কথা।
সুরের ভাষা যে না বোঝে সঙ্গীত তার কাছে প্রকাণ্ড প্রহেলিকা, দুর্বোধ শব্দ মাত্র! সুতরাং এটা ঠিক যে মানুষ কথা কয়েই বলুক অথবা সুর গেয়ে বা ছবি রচে’ কিম্বা হাতপায়ের ইসারা দিয়েই বলুক সেটা বুঝতে হলে যে বোঝাতে চলেছে তারও তেমন ভাষা ইত্যাদির জটিলতা ভেদ করা চাই।
কথায় যেমন ছবি ইত্যাদিতেও তেমনি যখন কিছু বাচন করা হ’ল তখন সবাই সেটা সহজে বুঝলে, না হলে বাচন ব্যর্থ হ’ল। ‘হুঁকো নিয়ে এস’, এটা ব্যাকরণ আড়ম্বর অলঙ্কার ইত্যাদি না দিয়ে বল্লেম, তবে হুকোবরদার বুঝলে পরিষ্কার, দরজার দিকে আঙ্গুল হেলিয়ে বল্লেম, “যাও”, বেরিয়ে গেল হুকোবরদার, একটা মটর-কারের ছবি এঁকে দোকানের দরজার উপর ঝুলিয়ে দিলে সবাই বুঝলে এখানে মটর-কার পাওয়া যায় কিন্তু বর্ণনের বেলায় ভাষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, অলঙ্কার ইত্যাদির অবগুণ্ঠন আর আবরণ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া গেল কথা ছবি সুর সার সমস্ত, কেমন করে সে বোঝে ভাষার গতিবিধির সঙ্গে যার মোটেই পরিচয় হয় নি!
দেবমাতা অদিতি তিনি স্বর্গেই থাকেন সুতরাং দেবভাষাতেই তাঁর অধিকার হল। একদিন তিনি শুনলেন জল সব চলেছে কি যেন বলতে বলতে! দেবমাতা বামদেবকে শুধালেন, “ঋষি! অ-ল-লা এইরূপ শব্দ করিতে করিতে জলবতী নদীগণ আনন্দ-ধ্বনি করতঃ গমন করিতেছে, তুমি উহাদের জিজ্ঞাসা কর, উহারা কি বলিতেছে?” অদিতির মতো, ঋষিরও যদি জলের ভাষাজ্ঞান জলের মতো না হতো, তবে তিনিও শুধু অ-ল-লাই শুন্তেন, কিন্তু ঋষি আপনার প্রকাণ্ড জিজ্ঞাসা নিয়ে বিশ্বের ভাষা বুঝে নিয়েছিলেন, জল কি বলে, মেঘ কি বলে, নদী সমুদ্র কি বলে, সমস্তই তিনি অবগত ছিলেন, কাজেই মেঘ থেকে ঝ’রে-পড়া জলের সেদিনের কথাটি দেবভাষাতে তর্জমা করে অদিতিকে জানানো তাঁর সুসাধ্য হল, যথা—‘জলবতী নদীগণ ইহাই বলিতেছে, মেঘসকলকে ভেদ করে জলসমূহের এমন শক্তি কোথায়? ইন্দ্র মেঘকে বিনাশ করতঃ জলসমূহ মুক্ত করেন, মেঘের আবরণ ইন্দ্রই ভেদ করেন।’
অ-র-ণ্য এই কটা অক্ষর জুড়ে দিলেই মূর্তিমান অরণ্যটা আমাদের চোখ দিয়ে সাঁ করে গিয়ে আজকাল প্রবেশ করে মনে, কিন্তু ভাষা যখন অক্ষরমূর্তি ধরেনি, শব্দমূর্তি দৃশ্যমূর্তিতে চলেছে তখন দেখি শুধু অরণ্য এইটে বাচন মাত্র করে দিয়েই ঋষির ভাষা স্তব্ধ হচ্ছে না, কিন্তু ছন্দে সুরে, অরণ্যের ভাষা শব্দ আর নানা রহস্য ধরে ধরে তবে অরণ্যের সত্তা আবিষ্কার কর্তে কর্তে চলেছে ঋষির ভাষা জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়ের ভিতর দিয়ে—“অরণ্যান্যরণ্যান্যসৌ যা প্রেব নশ্যসি, কথা গ্রামং ন পৃচ্ছসি নত্বা ভীরিব বিদন্তি॥ বৃষারাবায় বদতে যদুপাবতি চিচ্চিকঃ। আঘাটিভিরিব ধাবয়ন্নরণ্যানির্মহীয়তে॥ উতগাব ইবাদন্তুত বেশ্মেব দৃশ্যতে। উতো অরণ্যানিঃ সায়ং শকটীরিব সর্জতি॥ গামং গৈষ আ-হুয়তি দার্বং গৈষো অপাবধীৎ। বসন্নরণ্যান্যাং সায়মক্রুক্ষাদিতি মন্যতে॥ ন বা অরণ্যানিহংত্যন্যশ্চেন্নাভি গচ্ছতি। স্বাদো ফলস্য জগ্ধায় যথাকামং নি পদ্যতে॥ আঞ্জনগন্ধিং সুরভিং বহুন্নাসকৃষিবলাং। প্রাহং মৃগানাং মাতরমরণ্যানি মশংসিষং॥” ১৪৬ দেবমুনি ঋক্দেব॥
“হে অরণ্যানি! হে অরণ্যানি! তুমি যেন দেখিতে দেখিতে লুপ্ত হও (কত দূরেই তুমি চলিয়াছ)! অরণ্যানি, তুমি গ্রামের বার্ত্তাই লও না, তোমার ভয় নাই এমনি ভাবে একাকী আছ।
“জন্তুরা বৃষের ধ্বনিতে কি যেন বলিতেছে, উত্তর সাধক পক্ষীরা চিচ্চিক স্বরে যেন তাহার প্রত্যুত্তর দিতেছে। এ যেন বীণার ঘাটে ঘাটে ঝনৎকার দিয়া কাহারা অরণ্যানীর মহিমা কীর্ত্তন করিতেছে। বোধ হয় অরণ্যানীর মধ্যে কোথাও যেন গাভী সকল বিচরণ করিতেছে, কোথাও অট্টালিকার মত কি দৃশ্যমান, ছায়ালোকে মণ্ডিত সায়ংকালের অরণ্য যেন কত শত শকট ওখান হইতে বাহির করিয়া দিতেছে! কে ও! গাভী সকলকে ফিরিয়া ডাকিতেছে, ও কে! কাষ্ঠ ছেদন করিতেছে, অরণ্যের মধ্যে যে লোক বাস করে সেই লোক বোধ করে সন্ধ্যাকালে যেন কোথায় কে চীৎকার করিয়া উঠিল! বাস্তবিক কিছু অরণ্যানী কাহারো প্রাণবধ করে না, অন্যান্য শ্বাপদ জন্তু না আসিলে ওখানে কোন আশঙ্কা নাই। নানা স্বাদু ফল আহার করিয়া অরণ্যে সুখে দিন যাপন করা যায়, মৃগনাভি গন্ধে সুরভিত অরণ্য সেখানে কৃষিগণ নাই, অথচ বিনা কর্ষণেই প্রচুর খাদ্য উৎপন্ন হয়। মৃগগণের জননীস্বরূপা এমন যে অরণ্যানী তাঁহাকে এইরূপে আমি বর্ণন করিলাম।”
এখন উপরের এই অরণ্য বর্ণনার একটা তর্জমা বাঙ্গলায় না করে ছবির ভাষায় করলে অনেকের পক্ষে বোঝা সহজ হতো সবাই বল্বে। ভাল কথা—বর্ণনাটা ছবিতে ধরতে আর্ট স্কুলের পরীক্ষার দিনে কাঁচা আধপাকা পাকা সব আর্টিষ্টদের হাতে দেওয়া গেল, ফল কি হল দেখ। কচি আর্টিষ্ট যে ছবি দিয়ে শুধু বাচন করতেই জানে সে অরণ্যানী এইটুকু মাত্র একটা বনের দৃশ্যে বাচন মাত্র করে হাত গুটিয়ে বসলো—আর তো বাচন করবার কিছু পায় না। পক্ষীর চিক্ চিক্ বৃষের রব বীণার ঝনৎকার এ সবতো ছবিতে ধরা যায় না, বাকি সমস্তটা মরীচিকার মতো এই দেখতে এই নেই। এদের স্থিরতা দিয়ে ছবিতে ধরলে সমস্তটা মাটি। কিন্তু আধপাকা আর্টিষ্ট little learning বা স্বল্প শিক্ষা যাকে ভীষণ সমস্ত পরীক্ষায় ভুলিয়ে নিয়ে চলে, সে ‘অরণ্য’ কথাটি মাত্র ছবিতে বাচন করে খুসি হলো না; সে নির্বাচন করতে বসে গেল—যেন যা হচ্ছে, যেন যা দেখা যাচ্ছে এমনি নব ছায়ারূপ মায় কস্তুরীগন্ধী সোনার মৃগটাকে পর্যন্ত রং রেখার ফাঁদে ধরতে চল্লো মহা উৎসাহে। প্রজাপতিকে যেমন ছেলেরা কুঁড়োজালিতে ধরে সেই ভাবে সব ধরলে ছবিতে চিত্রভাষায় নীতিপরিপক্ব আর্টিষ্ট, কিন্তু দেখা গেল ধরা মাত্র সব চিত্র পুত্তলিকার মত কাঠ হয়ে রইলো, ঋষির গতিশীল বর্ণনা দুৰ্গতিগ্রস্ত হয়ে গিলটির ফ্রেমের ফাঁস গলায় দিয়ে অপঘাত মৃত্যু লাভ করলে। তারপর এল পাকা শিল্পীর পালা। সে ঋক্বেদের সূক্তটা হাতে পেয়েই তার সমস্ত রসটা মন দিয়ে পান করে ফেল্লে, তারপর ছবির শাদা কাগজে মোটা মোটা করে লিখলে—ছবি মানে Book illustration নয়, একমাত্র stage craft এই বর্ণনার illustration চিত্র শব্দ আলো ছায়া এবং নানা গতিবিধি ইত্যাদি দিয়ে ফুটিয়ে দিতে পারে নিখুঁতভাবে, আমি stage manager নই, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করবেন। কথাগুলো অরণ্যের সত্তাকে একদিক দিয়ে বোঝালে, ছবির ভাষা অন্যদিক দিয়ে তাকে বোঝাবে এই জানি, illustration চান্, না ছবি চান্ সেটা জান্লে এই পরীক্ষায় অগ্রসর হব ইতি—
পুঃ—ঋষিরা এক জায়গায় বলেছেন ‘অন্যের রচনার সাহায্যে তোমরা স্তুতি করিও না,’ সুতরাং আমার নিজের মনোমতো রচনা দিয়ে আমি ঘরে গিয়ে অরণ্যের স্তুতি ছবি দিয়ে লিখে পাঠাবো মনে করেছি; বিদায়—।
যে ছেলেটা সব চেয়ে জ্যেঠা, পরীক্ষক যদি পাকা হন তো জ্যেঠা হিসেবে তাকেই দেবেন ফুল মার্ক, আর কাঁচা যার পক্ষে ignorance bliss তাকে দেবেন পাস্ মার্ক, আর মাঝামাঝি ছেলেটিকে দেবেন শূন্য, এটা নিশ্চয়ই বলতে পারি। ছবি, কথা, ইঙ্গিত, সুর সার ইত্যাদি যদিও এরা ভাষা—কিন্তু ব্যক্ত করার উপায় ও ক্ষেত্র এদের সবারই একটু একটু বিভিন্ন, এরা মেলেও বটে, না মেলেও বটে, এরা একই ভাষা-পরিবারভুক্ত কিন্তু একই নয়—“Language is a system of signs, of Ideas and of relation between Ideas. These signs may be spoken sounds as in ordinary speech or purely visual (নাট্যচিত্র) or as the Egyptian Hieroglyphs (অক্ষর মূর্তি বা নিরূপিত বাক্য) or as construction of movements as in the finger language used by deaf mutes (ইঙ্গিত)”—(F. Ryland)
মানুষের ভাষা সব প্রথম শব্দকে ধরে’ আরম্ভ হল কি বিচিত্র রূপকে ধরে’ তা বলা শক্ত, তবে স্বভাবের নিয়মে দেখি জন্মাবধি শিশু শব্দ শোনা, শব্দ করা, আলো ছায়া এবং নানা পদার্থের রূপ রং ইত্যাদি দুটোই এক সঙ্গে ধরে বুঝতে এবং বোঝাতে চলেছে! ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র মানুষ যে ‘মা’ শব্দ উচ্চারণ করেছে এবং যে চোখের তারা ফিরিয়েছে বা যে হাত বাড়িয়েছে মায়ের দিকে, তারি থেকে কথিত চিত্রিত ও ইঙ্গিতের ভাষার একই দিনে সৃষ্টি হয়েছে বল্লে ভুল হবে না।
পুরাকালেরও প্রাক্কালে মানুষ যে সব শব্দ করে’ এ ওকে ডাক্তো, সে তাকে আদর করে’ কিছু শোনাতো কি জানাতো, যে বাক্য তারা বল্তো তার সুর সার ইঙ্গিত আভাষ কোন্ কালের আকাশে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু সেই সব দিনের মানুষের চিত্রিত যে বাক্য-সকল তা এখনো যে গুহায় তারা থাক্তো তার দেওয়ালে বিচিত্র বর্ণ আর মূর্তি নিয়ে বর্তমান আছে; ইউরোপে এসিয়ার নানাস্থানে কত কি যে ছবি তার ঠিকানা নাই—গরু, মহিষ, শৃগাল, হস্তী, অশ্ব, মৃগ-যূথ, দলে দলে জলের মাছ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অস্ত্ৰ-শস্ত্র, কত কি! চিত্রের ভাষা দিয়ে তারা কি বোঝাতে চেয়েছিল তা এখনো ধর্তে পাচ্ছি—দিনের খবর, রাতের খবর, জলের খবর, বনের পশুর খবর, এমন কি হরিণের চোখটা কেমন তার খবরটা পর্যন্ত! সেই সব ইতিহাসের বাইরে ও-যুগের মানুষ এবং সাধক পুরুষেরা নিজেদের তপস্যালব্ধ চিত্রভাষার সাহায্যে মনোভাবগুলো লিখে গেছে, সুতরাং ছবিকেও খুব আদিকালে ভাষা হিসেবেই মানুষ যে দেখেছে তাতে সন্দেহ নেই। শব্দের দ্বারায় বাক্যের দ্বারায় যেমন, আঁকা ও উৎকীর্ণ রূপের দ্বারাও তেমনি, পরিচিত সব জিনিষকে চিহ্নিত নিরূপিত নির্বাচিত করে’ চলেছে মানুষ—এই হ’ল গোড়ার কথা। যারা জীবন্ত কিম্বা যারা গতিশীল কেবল তাদেরই আদি যুগের মানুষেরা চিত্রের ভাষায় ধরতে চেয়েছে গাছ, পাথর, আকাশ যারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, শব্দ করে না, চলে না, বলেও না, আলোতে অরণ্যানীর মতো হঠাৎ দেখা দেয় আবার অন্ধকারে হঠাৎ মিলিয়ে যায়, ছবির ভাষায় তাদের ধরা তখন সম্ভব বোধ করেনি মানুষ, হয়তো বা কথিত ভাষাতেও এ সব বর্ণন করে নি তখনকার মানুষ, কেন যে তা এক প্রকাণ্ড রহস্য! ধরতে গেলে, বিদ্যুৎগতিতে দৌড়েছে যে হরিণ কি মাছ তাদের ছবিতে ধরার চেয়ে, পাথর গাছ কি ফুল যারা স্থির রয়েছে চিরকাল ধরে’, আঁকা দিয়ে তাদেরই ধরা সহজ ছিল, কিন্তু তা হয়নি। গাছ, পালা, পাহাড়, পর্বত, এরা বাদ পড়ে গেল, আর যাদের শব্দ অঙ্গভঙ্গি এই সব আছে—এক কথায় যাদের ভাষা আছে—পুরাতন মানুষের ছবির ভাষা আগে গিয়ে মিল্লো তাদেরই সঙ্গে! এ যেন মানুষের সঙ্গে চারিদিকের যারা এসে কথা কইল তাদেরই পরিচয় আগে লিখ্তে বস্লো মানুষ; জলকে মানুষ জিজ্ঞাসা কর্লে—জল, তুমি কেমন করে চল? জল স্রোতের রেখা ও গতি-ভঙ্গি দিয়ে এঁকে ইঙ্গিত করে’ শব্দ করে’ যেন জানিয়ে দিলে—এমনি করে ঢেউ খেলিয়ে এঁকে বেঁকে চলি। হরিণ, তুমি কেমন করে দৌড়ে যাও?—হরিণ সেটা স্পষ্ট দেখিয়ে গেল। কিন্তু গাছকে পাথরকে শুধিয়ে মানুষ পরিষ্কার সাড়া পেলে না। গাছ, তুমি নড় কেন? এর উত্তর গাছ মর্মর ধ্বনি করে’ দিলে—এই এমনিই নড়ি থেকে থেকে, জানিনে কেন! গাছের কথাই বোঝা গেল না, ছবিতেও তার রূপ ধরলে না মানুষ। পাহাড়, দাঁড়িয়ে কেন? আকাশ দিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসার প্রতিধ্বনি ফিরে এল, কেন! ছবির ভাষায় এদের কথা লেখা হলই না, শুধু এদের বোঝাতে মানুষ গাছ বল্তে গোটাকতক দাঁড়ি কসি, পাহাড় বল্তে একটা ত্রিকোণ-চিহ্ণ দিয়ে গেল কখন কখন কতকটা চীনে অক্ষরের মতো,—রূপাভাষ, কিন্তু পুরো রূপচিত্র নয়। ব্রতধারী মানুষ কামনা ব্যক্ত করবার সময় পুরাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যে কথা, ছবি, সুর, নাট্য ইত্যাদি মিশ্রিত ভাষা প্রয়োগ করে চলেছে তার রীতি আমাদের এখনো ধরে থাক্তে হয়েছে,—শুধু এক কালের অস্ফুট শিশুভাষ স্ফুটতর হয়ে উঠেছে, পুরাকালের ব্রতধারীর ভাষার সঙ্গে এখনকার ভাষার।
যে মানুষ ছবি কথা কিম্বা কিছু দিয়েই এককালে জননী পৃথিবীকে ধারণার মধ্যে আনতে পারেনি, স্ফুট ভাষার সাহায্যে সেই মানুষ আস্তে আস্তে একদিন পৃথিবীকে নিরূপিত করলে—আলপনার পদ্মপত্রের উপরে একটি বুদ্বুদের আকারে; স্তোত্রের উদাত্ত অনুদাত্ত সুরে ধরা পড়লো বসুন্ধরা—’হে বিচিত্র গমনশালিনী পৃথিবী! স্তোতৃবর্গ গমনশীল স্তোত্র দ্বারায় তোমার স্তব করেন।’ জীবন্ত হরিণ যে দ্রুত চলেছে তাকে ব্যক্ত করতে হল যেমন গমনশীল রেখা, তেমনি গমনশীল বাক্য ও সুর বর্ণনা করে চল্লো আকাশে ভ্ৰাম্যমাণা পৃথিবীকে। স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ, অকার থেকে ক্ষ ইত্যাদি শব্দ এই মিলিয়ে হল কথিত ভাষা, আর আকার থেকে আরম্ভ করে চন্দ্রাকার ও তার বিন্দুটি পর্যন্ত নানা রেখা বর্ণ ও চিহ্ণ মিলিয়ে হল চিত্র বিচিত্র ছবির ভাষা, এবং হাতপায়ের নানা সংকেত ও ভঙ্গি নিয়ে হল অঙ্কের পর অঙ্ক ধরে’ গতিশীল নাটকের চলতি ভাষা। এই হল ভাষার আদি ত্রিমূর্তি এর পার্শ্ব-দেবতা হল দুটি—‘বাচন’ ও ‘বর্ণন’, এই মূর্তি নিয়ে ভাষা এগোলেন মানুষের কাছে। ঋষি বলেছেন—“হে বৃহস্পতি! বালকেরা সর্ব্বপ্রথম বস্তুর নামমাত্র বাচন করিতে পারে, তাহাই তাহাদিগের ভাষা শিক্ষার প্রথম সোপান—নামরূপ হল গোড়ার পাঠ।” এর পরে এল বন্দনা থেকে আরম্ভ করে বর্ণনা পর্যন্ত, আবৃত্তি থেকে সুরু করে বিবৃতি পর্যন্ত—“বালকদিগের যাহা কিছু উৎকৃষ্ট ও নির্দোষ জ্ঞান হৃদয়ের নিগূঢ় স্থানে সঞ্চিত ছিল তাহা বাগ্দেবীর করুণায় ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পাইল।”—ভাষা, বোধোদয় বস্তুপরিচয় ইত্যাদি ছাড়িয়ে অনেকখানি এগোলো। তারপর এলো ভাষার মহিমা সৌন্দৰ্য ইত্যাদি—“যেমন চালনীর দ্বারায় শক্তুকে পরিষ্কার করা হয় সেইভাবে বুদ্ধিমান বুদ্ধিবলে পরিষ্কৃত ভাষা প্রস্তুত করিয়াছেন। (সেই ভাষাকে প্রাপ্ত হইলে পর) যাহাদিগের চক্ষু আছে কর্ণ অাছে এরূপ বন্ধুগণ মনের ভাব প্রকটন বিষয়ে অসাধারণ হইয়া উঠিলেন……সেই ভাষাতে বন্ধুগণ বন্ধুত্ব অর্থাৎ বিস্তর উপকার লাভ করেন,…ঋষিদিগের বচন রচনাতে অতি চমৎকার লক্ষ্মী স্থাপিত আছেন…বুদ্ধিমানগণ যজ্ঞ দ্বারা ভাষার পথ প্রাপ্ত হয়েন…ঋষিদিগের অন্তঃকরণের মধ্যে যে ভাষা সংস্থাপিত ছিল তাহা তাঁহারা প্রাপ্ত হইলেন, সেই ভাষা আহরণপূর্বক তাঁহারা নানাস্থানে বিস্তার করিলেন, সপ্ত ছন্দ সেই ভাষাতেই স্তব করে…।” বিশ্বরাজ্যের প্রকট রূপ রস শব্দ গন্ধ স্পর্শ সমস্তই পাচ্ছিল মানুষ ভাষাকে পাবার আগে থেকে, কিন্তু মনের মধ্যে তবুও মানুষের একটা বেদনা জাগছিল—মনের কথাকে খুলে বলবার বেদনা, মানসকে সুন্দররূপে প্রকট করার বাসনা, সুপরিষ্কৃত ভাষাকে পাবার জন্যে বেদনা মনে জাগছিল। মানুষের সব চেয়ে যে প্রাচীন ভাষা তাই দিয়ে রচা বেদ এই বেদনের সুরে ছত্ৰে ছত্রে পদে পদে ভরা দেখি; “আমার কর্ণ, আমার হৃদয় আমার চক্ষুর্নিহিত জ্যোতি সমস্তই তোমাকে নিরূপণ করিতে অবগত হইতে ধাবিত হইতেছে…দূরস্থবিষয়ক চিন্তাব্যাপৃত আমার হৃদয় ধাবিত হইতেছে…আমি এই বৈশ্বানর স্বরূপকে কিরূপে বর্ণন করি কিরূপই বা হৃদয়ে ধারণ করি!” কিম্বা যেমন—“কিরূপ সুন্দর স্তুতি ইন্দ্রকে আমাদের অভিমুখে আনয়ন করিবে।” হৃদয়ের বেদনার অন্ত নেই, দেখতে চেয়ে শুন্তে চেয়ে প্রাণ ব্যথিত হচ্ছে, ধাবিত হচ্ছে। অতি মহৎ জিজ্ঞাসার উত্তর পাচ্ছে মানুষ অতি বৃহৎ পরম সুন্দর, কিন্তু তার প্রত্যুত্তরের মতো মহাসুন্দর ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না!—“যজ্ঞের সময় দেবতারা আমাদিগের স্তব শুনিয়া থাকেন, সেই বিশ্বদেবতাসকলের মধ্যে কাহার স্তব কি উপায়ে উত্তমরূপে রচনা করি!” মনের নিবেদন সুন্দর করে উত্তম করে জানাবার জন্য বেদনা আর প্রার্থনা। কোন রকমে খবরটা বাৎলে দিয়ে খুসি হচ্ছে না মানুষের মন, সুন্দর উপায় সকল উত্তম উত্তম সুর সার কথা গাথা ইঙ্গিতাদি খুঁজছে মানুষ এবং তারি জন্যে সাধ্য সাধনা চলেছে—“হে বৃহস্পতি! আমাদিগের মুখে এমন একটি উজ্জ্বল স্তব তুলিয়া দাও, যাহা অস্পষ্টতাদোষে দূষিত না হয় এবং উত্তমরূপে স্ফূরিত হয়।” ছবি দিয়ে যে কিছু রচনা করতে চায় সেও এই প্রার্থনাই করে—রং রেখা ভাব লাবণ্য অভিপ্রায় সমস্তই যেন উজ্জ্বল এবং সুন্দর হয়ে ফোটে। ধরিত্রীকে বর্ণন করতে ঋষি গতিশীল স্তোত্র আর ভাষা চাইলেন। ভাষার পথে গতি পৌঁছয় কোথা থেকে? মানুষের মনের গতির সঙ্গে ভাষাও বদলে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি—বাঙ্গলার পক্ষে সংস্কৃতমূলক সাধুভাষা হল অচল ভাষা, কেননা সে শব্দকোষ ব্যাকরণ ইত্যাদির মধ্যে একেবারে বাঁধা, মনের চেয়ে পুঁথির সঙ্গে তার যোগ বেশি! বাঙ্গালীর মন বাঙ্গলায় জুড়ে আছে, সুতরাং চলতি বাঙ্গলা চলেছে ও চলবে চিরকাল বাঙ্গালীর মনের গতির সঙ্গে নানা দিক থেকে নানা জিনিষে যুক্ত হতে হতে, ঠিক জলের ধারা যেমন চলে দেশ বিদেশের মধ্যে দিয়ে। ছবির দিক দিয়েও এই বাঙ্গলার একটা চলতি ভাষা সৃষ্ট হয়ে ওঠা চাই, না হলে কোন্ কালের অজন্তার ছবির ভাষায় কি মোগলের ভাষায় অথবা খালি বিদেশের ভাষায় আটকে থাকা চলবে না। ঋষিরা ভাষাকে বৃষ্টিধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন—“হে ইন্দ্র, হে অগ্নি! মেঘ হইতে বৃষ্টির ন্যায় এই স্তোতা হইতে প্রধান স্তুতি উৎপন্ন হইল।” বৃষ্টির জল ঝরণা দিয়ে নদী হয়ে বহমান হল, তবেই সে কাজের হল, আর জল আঁট হয়ে হিমালয়ের চূড়োয় বসে রইলো—গল্লোও না চল্লোও না, গলালেও না চালালেও না, জলের থাকা না থাকা সমান হল। বাঁধা বস্তুর বা styleএর মধ্যে এক এক সময়ে একটা একটা ভাষা ধরা পড়ে যায়। কথিত ভাষা চিত্রিত বা ইঙ্গিত করার ভাষা সবারি এই গতিক! যেমনি style বেঁধে গেলো অমনি সেটা জনে জনে কালে কালে একই ভাবে বর্তমান রয়ে গেল—নদী যেন বাঁধা পড়লো নিজের টেনে আনা বালির বাঁধে! নতুন কবি নতুন আর্টিষ্ট এঁরা এসে নিজের মনের গতি ভাষার স্রোতে যখন মিলিয়ে দেন তখন style উল্টে পাল্টে ভাষা আবার চলতি রাস্তায় চলতে থাকে। এ যদি না হতো তবে বেদের ভাষাই এখনো বলতেম, অজন্তার বা মোগলের ছবি এখনো লিখতেম এবং যাত্রা করেই বসে থাকতেম সবাই! ভাষা সকল গোলক ধাঁধার মধ্যেই ঘুরে বেড়াতো অথচ দেখে মনে হতো ভাষা যেন কতই চলেছে!