শিল্পকে পাওয়া আর বাস্তব শিল্পকে পাওয়ার মানেতে তফাৎ আছে—“There is true and false realisation, there is a realisation which seeks to impress the vital Essence of the subject and there is a realisation which bases its success upon its power to present a deceptive illusion.” —R. G. Hatton. বহির্জগতের কাল্পনিক প্রতিলিপিই চিত্র, মনোজগতে ধরা নানা বস্তুর যে স্মৃতি তার আলেখ্যই চিত্র,—এ দুটোই মত, মন্ত্র নয়। বাইরে যা দেখছি খুঁটে খুঁটে তার কাপি নেওয়া কিম্বা চোখ উল্টে ভিতরের দিকে বাইরেরই যে সব স্মৃতি রয়েছে জমা তার হুবহু ছাপ তোলায় তফাৎ একটুও নেই, দুটোই একজাতির চিত্র-–এও ছাপ সেও ছাপ, কাপি ছবি নয়। ফটো যন্ত্র বাইরের গাছপালার ছাপ নেয়, আর আচার্য জগদীশচন্দ্রের কল গাছের ভিতরকার ব্যাপারের রেকর্ড তোলে, দুটোই কিন্তু কল, artist নয় ; ধর, কোন উপায়ে যদি কল দুটোই বেঁচে উঠে কাজে লেগে যায় তা হ’লেও তারা কি artist, একথা বলাতে পারবে আপনাদের? চোখের সামনে সূর্যোদয় আর অতীত সমস্ত সূর্যোদয়ের স্মৃতিচিত্র (memory picture) দুয়ের মধ্যেও না হয় রং চংএর তফাৎ হ’ল, কিন্তু তাই বলে একটা আর্ট আর অন্যটা আর্ট নয়, স্মৃতির যথাযথ প্রতিলিপিই আর্ট, সামনের যথাযথটা আর্ট নয়, কিম্বা সামনেরটাই আর্ট আর মনেরটা ঠিক তার উল্টো জিনিষ, এ তর্ক উঠতেই পারে না, কেননা যথাযথ প্রতিলিপি, তা সে এ-পিঠেরই হোক বা ও-পিঠেরই হোক, সে কাপি, এবং যারা তা করছে তারা নকলই করছে, কেউ আসল গড়ছে না। মুখস্থ আউড়ে গেল পাখী একটু না হয় ভুল করে তার পাঠ, বলে গেল ছেলে পরিষ্কার বইখানার পাতা খুলে—দু’জনেই পুনরুক্তি করলে, অন্যের কথার প্রতিধ্বনি দিলে, বানিয়ে দুটাে রূপকথা বল্লে না, ছড়া কাটলে না, কেননা কল্পনা নেই দুজনেরই, কাজেই রচনা করলে না তারা কেউ, সুতরাং আর্টিষ্ট হবার দিকেও গেল না এরা, নকলনবিশ হয়েই রইল। কল্পনাশূন্য চোখের দেখা বা ওই ভাবে চোখে দেখার স্মৃতি শিল্প-শব্দকল্পদ্রুম লিখতে হ’লে এর মানে দিতে হবে গাছের জড় বা শিকড় ; জড় সে জগৎকে আঁকড়ে রয়েছে, খুব কাজের জিনিষ কল্পনা এবং রচনার রস যেমনি শিকড়ে লাগলে আমনি ডাল পাল বিস্তার না করে সে থাকতে পারলে না। নিশ্চল মাটির তলায় অন্ধকার ছেড়ে সে প্রকাশিত হ’ল আলোর জগতে, ভাবের বাতাস লাগলো তার দেহে, ফুটলো পাতা হ’য়ে ফুল হ’য়ে ফল হ’য়ে, হাওয়ায় দুল্লো রূপের ডালি, রসের রচনা বীজের মধ্যে যতটা বস্তু এবং শিকড়ের মধ্যে যতটা সঞ্চয় ছিল তাই নিয়ে! বাইরেটা এবং বাইরের স্মৃতিটা শিল্পীর ভাণ্ডার, শিল্পীর কল্পনালক্ষ্মী সেখান থেকে এটা ওটা সেটা নিয়ে নানা সামগ্ৰী বানিয়ে পরিবেশন করেন। মূর্খেরাই কেবল এই ভাণ্ডারকে হোটেল এবং দোকান বলে’ ভ্রম করে যেখানে ready-made সমস্ত পাওয়া যায়— “People regard Nature as a store-house of ready-made ornaments instead of a book of reference for ideas and principles to be thought out with diligence and applied with care. Ready-made ornaments are too often like ready-made clothes badly fitting and ill-suited to the subject.–Frank Jackson.
যে গড়ছে বা আঁকছে তার মনের কল্পনার সংস্পৰ্শ-শূন্য ছবি কলে এঁকেছে মানুষ, হাতেও গড়েছে কেষ্টনগরের পুতুল,—ঘটনার যথাযথ প্রতিরূপ। শিল্পের যতগুলো কৌশল, রূপ, প্রমাণ, ভাবলাবণ্য, সাদৃশ্য, বর্ণিকাভঙ্গ, anatomy, perspective, shade-and-light, depth, space, movement ইত্যাদির নিয়মাবলী নির্ভুল ও সম্পূর্ণভাবে মেনে চল্লো কেষ্টনগরের কারিগরের গড়নটি কিন্তু এই বাস্তবের নিয়ম মেনে চলার ফলে একটা গ্রীক প্রস্তরমূর্তির সঙ্গে কি ঘুরণী পাড়ার মাটির পুতুলটিকে সমান করে তুলতে পারলে, না এইটেই প্রমাণ করলে যে মানুষ চেষ্টা করলে কলের চেয়ে নির্ভুল ও পরিপূর্ণ নকল নিতে পাকা হয়ে উঠতে পারে? বাস্তবের দিকে যেমন দেখা গেল, কল্পনাশূন্য বাস্তব ছবি নেওয়া চল্লো বহির্জগতের, তেমনি অন্তর্জগতের বাস্তবম্পৰ্শ-শূন্য নিছক কল্পনার একটা কিছু ধরবার চেষ্টা করা যাক। কিন্তু কোথায় তেমন জিনিষ ? সত্যপীরের মাটির ঘোড়া, কালীঘাটের পট, নতুন বাঙলার আমাদের ছবি, পুরোণো বাংলার দশভুজা এর একটাও নিছক কাল্পনিক জিনিষ নয়, এরা সবাই বাস্তবকে ধরে তবে তো প্রকাশ হ’ল? মন যে বাস্তবকে স্পর্শ করেই আছে, নানা বস্তুর নানা ভাবের স্মৃতি জমা হচ্ছে মনে। নিছক কল্পনা সে মনেই উঠতো মনেই থাকতো যদি না বাস্তব-জগতের ভাব ও রূপের সংস্পর্শে সে আসতো। অসীমের কল্পনা তাও সীমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রকাশ পায়, সমুদ্রের অসীম বিস্তার ডাঙার সীমারেখাতে এসে না মিল্লে ছবি হয় না, নকল যা তার সঙ্গে কল্পনার একটুও যোগ নেই কিন্তু বাস্তব জিনিষের সঙ্গে আমার স্মৃতির সঙ্গে কল্পনার যোগ সসীম থেকে আরম্ভ করে’ অসীমের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে দেখা যাচ্ছে। এই চোখের সামনে যে বিদ্যমান সৃষ্টি এটার মূলে দেখি সৃষ্টির কল্পনা রয়েছে, তাই এ এত বিচিত্র ও মনোহর—একটা গাছ আর একটার, একটি ফুল আর একটির, এক জীব আর এক জীবের, এক দিন আর এক দিনের মতো নয়; নীল আকাশ একই চন্দ্র-সূর্যকে নিয়ে পলে পলে আলো-অন্ধকারে নতুন থেকে নতুন স্বপ্ন রচনা করে চলেছে চিরকাল ধরে, পুরোণো আর হতে চাচ্ছে না এই পৃথিবী, শুধু এর পিছনে রচয়িতার কল্পনা এবং দর্শকের কল্পনা কাজ করছে বলেই। বহির্জগৎ যেমন সৃষ্টি, তেমনি ঐ সত্যপীরের ঘোড়া, সেটা ঘোড়া নয় অথচ ঘোড়া, কালীঘাটের পট যেটা প্রকৃতির নয় কিন্তু নানা রূপ ধরেছে এটার ওটার সেটার রেখা নানা রঙ্গের নানা তাক বাকের সাহায্যে, এরাও সৃষ্টি; দেখতে কেউ বড় সৃষ্টি, কেউ ছোট সৃষ্টি, কেউ ভাল সৃষ্টি, কেউ হয় তো বা অনাসৃষ্টি, কিন্তু সৃষ্টি, নকলের মতো প্রতিবিম্ব নয়।
যে শিল্পজগৎ সত্য কল্পনার দ্বারা সজীব নয় সে বুদ্বুদের উপরে প্রতিবিম্বিত জগৎ-চিত্রটির মতো মিথ্যা ও ভঙ্গুর; দর্পণের উপরেই তার সমস্তখানি কিন্তু দর্পণের কাচ ও পারার এবং বুদ্বুদের জলবিন্দুটির যতটুকু সত্তা—তাও তার নেই। রচনা যেখানে রচয়িতার স্মৃতি ও কল্পনার কাছে ঋণী সেইখানেই সে আর্ট, যেখানে সে অন্যের রচনা ও কল্পনার কাছে ঋণী সেখানে সে আর্ট নয়, আসলের নকল মাত্র। হোমার, মিল্টন দুজনেই অন্ধ ও কবি কিন্তু বিদ্যমান ও অবিদ্যমানের দুয়েরই ঋণ বিষয়ে তাঁরা অন্ধ ছিলেন না তাঁরা বাস্তব কল্পনা করে’ গেছেন অন্ধ কল্পনা করেননি। কালিদাস, ভবভূতি চক্ষুষ্মান কবি কিন্তু তাঁরাও কল্পনা বাদে বাস্তব কিম্বা বাস্তব বাদে কল্পনার ছবি রেখে যান নি। গানের সুর সম্পূর্ণ কাল্পনিক জিনিষ কিন্তু এই বাস্তব জগতের বায়ুতরঙ্গের উপর তার প্রতিষ্ঠা হ’ল, কথার ছবির সঙ্গে সে আপনাকে মেলালে তবে সে সঙ্গীত হয়ে উঠলে,—অনাহত আপনাকে করলে আহত বাতাস ধরে, কিন্তু হরবোলার বুলি বাস্তব জগতের সঠিক শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি দিলে সেইজন্য সে সঙ্গীত হওয়া দূরের কথা খুব নিকৃষ্ট যে টপ্পা তাও হ’ল না। বাস্তবকে কল্পনা থেকে কতখানি সরালে কিম্বা কল্পনাকে বাস্তব থেকে কতটা হঠিয়ে নিলে art হয় এ তর্কের মীমাংসা হওয়া শক্ত, কিন্তু কল্পনার সঙ্গে বাস্তব, চোখে-দেখা জগতের সঙ্গে মনে-ভাবা জগতের মিলন না হলে যে art হবার জো নেই এটা দেখাই যাচ্ছে। “One of the hardest thing in the world is to determine how much realism is allowable to any particular picture.” —Burn Jones. এই হ’ল ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ চিত্রকর Burn Jonesএর কথা। অনেক দিন ধরে চিত্র এঁকে যে জ্ঞান লাভ করলেন শিল্পী তারি ফলে বুঝলেন যে বস্তুতন্ত্রতা ছবিতে কতখানি সয় তা ঠিক করা মুস্কিল। ইংরেজ শিল্পী এখানে কোন মত দিলেন না, ছবি আঁকতে গেলে সবারই যে প্রশ্ন সামনে উদয় হয় তাই লিখলেন, কিন্তু আমাদের দেশে মত দেওয়া যেমন সুলভ, মত ধরে চলাও তেমনি সাধারণ—কে চিত্রবিদ তার সম্বন্ধে পরিস্কার মত, কি চিত্র তারও বিষয়ে পাকা শেষ মত প্রচারিত হ’ল এবং সেই সব মতের চশমা পরে’ ভারতবর্ষের চিত্রকলার অাদর্শগুলোর দিকে চেয়ে দেখে’ অজন্তার শিল্পও আমাদের শ্রদ্ধেয় অক্ষয়চন্দ্র মৈত্র মহাশয়ের চোখে কি ভাবে পড়লে তার পরিষ্কার ছবি কার্তিক সংখ্যার প্রবাসীর কষ্টিপাথর থেকে তুলে দিলেম—“যাহা ছিল তাহা নাই। যাহা আছে সেই অজন্তাগুহার চিত্রাবলী, তাহাতে যাহা আছে, তাহা কিন্তু চিত্র নহে চিত্রাভাস। তাহা পুরাতন ভারতচিত্রের অসম্যক্ নিদর্শন, চিত্র-সাহিত্যদর্পণের দোষ-পরিচ্ছেদের অনায়াসলভ্য উদাহরণ। তাহা কেবল বিলাসব্যসনমুক্ত যোগযুক্ত অনাসক্ত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের নিভৃত নিবাসের ভিত্তি বিলেপন…ভারতচিত্রোচিত প্রশংসা লাভের অনুপযুক্ত। তাহা এক শ্রেণীর পূর্ত কর্ম …তাহাতে যাহা কিছু চিত্রগুণের পরিচয় পাওয়া যায় তাহা অযত্নসম্ভূত আকস্মিক,…চিত্র-গুণের এবং চিত্র-দোষের যথাযথ পর্যবেক্ষণে যাঁহাদের চক্ষু অভ্যস্ত, তাঁহাদের নিকট অজন্তা-গুহা চিত্রাবলী ভারত চিত্রের অনিন্দ্যসুন্দর নিদর্শন বলিয়া মর্যাদা লাভ করিতে অসমর্থ। যাঁহাদের তুলিকাসম্পাতে এই সকল ভিত্তি-চিত্র অঙ্কিত হইয়াছিল, তাঁহারাও পুরাতন ভারতবর্ষে ‘চিত্রবিৎ’ বলিয়া কথিত হইতে পারিতেন না। তাঁহারা নমস্য; কিন্তু চিত্রে নহে, চরিত্রে। তাঁহাদের ভিত্তি-চিত্রও প্রশংসার্হ; কিন্তু কলা-লালিত্যে নহে, বিষয়-মাহাত্ম্যে।” (শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্র, ভারত চিত্র চর্চ্চা)। মতের চশমা দিয়ে দেখলে অজন্তার ছবিতে কেন চাঁদের মধ্যেও অপরিণতি ও কলঙ্ক দেখা যায় এবং সেই দোষ ধরে বিশ্বকর্মাকেও বোকা বলে’ উড়িয়ে দেওয়া চলে, কিন্তু সৃষ্টির প্রকাশ হ’ল স্রষ্টার অভিমতে, শিল্পের প্রকাশ হ’ল শিল্পীর অভিমতটি ধরে’, ব্যক্তিবিশেষের বা শাস্ত্রমতবিশেষের সঙ্গে না মেলাই তার ধর্ম, কাযেই কলঙ্ক ও অপরিণতি যেমন হয় চাঁদের পক্ষে শোভার কারণ, শিল্পের পক্ষেও ঠিক ঐ কথাটাই খাটে। চিত্র-ষড়ঙ্গের কতখানি পরিপূর্ণতা পেলে চিত্র চিত্র হবে চিত্রাভাস হবে না, মডেল ড্রয়িং কতখানি সঠিক হ’লে তবে অজন্তার ছবিকে বলব চিত্র আর কতখানি কাঁচা থাকলে অজন্তার চিত্রাবলী হবে “চিত্র সাহিত্যদর্পণের দোষ-পরিচ্ছেদের অনায়াসলভ্য উদাহরণ” তা বলা কঠিন, তবে পাকা ড্রয়িং হলেই যে সুন্দর চিত্র হয় না এটা বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী রোঁদা বলেছেন—“It is a false idea that drawing in itself can be beautiful. It is only beautiful through the truths and the feeling that it translates….There does not exist a single work of art which owes its charm only to balance of line and tone and which makes appeal to the eye alone.” —Rodin. আদর্শ জিনিষটি নিছক অবিদ্যমান জিনিষ, বস্তুতঃ তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলন অসম্ভব, ধর্মে-কর্মে, শিল্পে সমাজে, ইতিহাসে, কোন দিক দিয়ে কেউ মেলেনি, না মেলাই হ’ল নিয়ম। সৃষ্টিকর্তার নিরাকার আদর্শ যা আমরা কল্পনা করি তার সঙ্গে সৃষ্ট বস্তুগুলো এক হ’য়ে মিল্লে সৃষ্টিতে প্রলয় আসে, তেমনি শাস্ত্রের আদর্শ গিয়ে শিল্পে মিল্পে শিল্প লোপ পায়—থাকে শুধু শাস্ত্রের পাতায় লেখা ভারত-শিল্পের ছ’ছত্ৰ শ্লোক মাত্র। দাঁড়ি পাল্লা বাটখারা ইত্যাদি নিয়ে চাল ডাল ওজন করা চলে, ছবির চারিদিকের গিল্টির ফ্রেমখানাও ওজন করা যায়, ছবির কাগজটা—মায় রংএর ডেলা, রংএর বাক্স, তুলি এমন কি শিল্পীকে পর্যন্ত সঠিক মেপে নেওয়া চলে, কিন্তু শিল্পরস যে অপরিমেয় অনির্বচনীয় জিনিষ, শাস্ত্রের বচন দিয়ে তার পরিমাণ করবে কে? তাই শাস্ত্রকারদের মধ্যে যিনি রসিক ছিলেন, শিল্প সম্বন্ধে লেখবার বেলায় মতের আকারে মনোভাব প্রকাশ করলেন না তিনি; শিল্পের একটি স্তোত্র রচনা করে অলঙ্কারশাস্ত্রের গোড়া পত্তন করলেন, যথা—“নিয়তিকৃতনিয়মরহিতাং হ্লাদৈকময়ীমনন্তপরতন্ত্রাং। নবরসরুচিরাং নিৰ্ম্মিতিমাদধীতি ভারতী কবের্জয়তি॥” নিয়তিকৃতনিয়মরহিতা আনন্দের সঙ্গে একীভূত অনন্তপরতন্ত্র নবরসরুচির নির্মিতিধারিণী যে কবি ভারতী তাঁর জয়। শুধু ভারতশিল্পের জন্য নয়, কাব্যচিত্র ভাস্কর্য সঙ্গীত নাট্য নৃত্য সব দেশের সব শিল্পের সবার জন্য এই মন্ত্রপূত সোণার পঞ্চপ্রদীপ ভারতবর্ষ ছেড়ে যে মানুষ একদিনও যায়নি সে জ্বালিয়ে গেছে। মতের ফুৎকারে এ কোন দিন নেভ্বার নয়, কেননা রস এবং সত্য এই দুই একে অমৃতে সিঞ্চিত করেছে। সূর্যের মতে দীপ্যমান এই মন্ত্র, এর আলোয় সমস্ত শিল্পেরই ভূত, ভবিষ্যৎ, বৰ্ত্তমান, কল্পনারাজ্য ও বাস্তবজগৎ যেমন পরিষ্কার করে দেখা যায় এমন আর কিছুতে নয়। মতগুলো আলেয়ার মত বেশ চক্মকে ঝকঝকে কিন্তু আলো দেয় যেটুকু তার পিছনে অন্ধকার এত বেশী যে, সেই আলেয়ার পিছনে চলতে বিপদ পদে পদে।
শিল্প সম্বন্ধে বা যে কোন বিষয়ে যখন মানুষ মত প্রচার করতে চায় তখন একটা সৃষ্টিছাড়া আদর্শ আঁকড়ে না ধরলে মতটা জোর পায় না; “খোঁটার জোরে মেড়া লড়ে”। শিল্প বিষয়ে মত যাঁরা দিলেন তাঁদের কাছে আদর্শই হ’ল মুখ্য বিষয়, আর শিল্পটা হ’ল গৌণ; শিল্পের মন্ত্রগুলো তা নয়, শিল্পকেই মুখ্য রেখে তারা উচ্চারিত হ’ল। এই মত থেকে দেখি ভারত-শিল্প মিশর-শিল্প চীন-শিল্প পাশ্চাত্য-শিল্প প্রাচ্য-শিল্প—এখানে শিল্পে শিল্পে ভিন্ন, শিল্পীতে শিল্পীতে ভিন্ন, “ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই, কারু মতে বেরাল-চোখ কারু মতে পদ্ম-আঁখি; কারু মতে সাদা কারু মতে কালো হ’ল ভাল, কিন্তু রসের ও সৌন্দর্যের যে মন্ত্র স্তন্যধারার মতো বিভিন্ন শিল্পকে এক করেছে সেটি প্রাণের রাস্তা ধরে’ চলেছে, মতের এতটুকু নালা বেয়ে নয়, কাজেই সে ধার দিয়ে শিল্পের বড় দিকটাতেই আমাদের নজর পড়ে। শিল্পের আপনার একটা যে জগৎজোড়া আদর্শ রয়েছে তাকেই লক্ষ্য করে চলেছে এ যাবৎ সব শিল্পী ও সব শিল্প তাই রক্ষে, না হ’লে শাস্ত্রের মতের পেষণে শিল্পকে ফেল্লে এক দিনে শিল্প ছাতু হ’য়ে যেতো। ভারতীয় মতে বিশুদ্ধ ছাতু কিম্বা ইউরোপীয় মতে পরিষ্কার ধবধবে বিস্কুটের গুঁড়োর পুনরাবির্ভাবের জন্য শিল্পার্থীরা প্রাণপাত করতে উদ্যত হয়েছে, এ দৃশ্য অতি মনোরম এটা বেদব্যাস বল্লেও আমি বলব নহি নহি, এভাবে শিল্পকে পাওয়া না পাওয়াই। যা এক কালে হ’য়ে গেছে তা সম্ভব হবে না কোন দিন—“Efforts to revive the art principles of the past will at best produce an art that is still-born. It is impossible for us to live and feel, as did the ancient Greeks. In the same way those who strive to follow the Greck methods in sculpture achieve only a similarity of form, the work remaining soulless for all the time. Such imitation is mere aping.” –Kandinsky. যে সমস্ত শিল্প সম্ভূত হয়ে গেছে তাদের আজকের দিনে আবার সম্ভব করে তোলবার চেষ্টা—যে একবার জন্মেছে তাকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করাবার চেষ্টার মতোই পাগলামি। বিদ্যমান ছবি যা বাতাসের মধ্যে আলোর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার বিরাট কল্পনার প্রেরণায় অত্যাশ্চর্য রূপ পেয়ে এসেছে তাকে চারকোণা এতটুকু কেম্বিসে তেল-জলের সাহায্যে দ্বিতীয় বার জন্ম দিতে চায় কোন পাগল? অগ্নিশিখাকে যতই সঠিক নকল কর সে আলো দেবে না তাপও দেবে না ; শুধু ভ্রান্ত একটা সাদৃশ্য দেবে ‘ইব’তে গিয়ে যার শেষ। বায়ুগতিতে পতাকার বিচলন দেখাতে পারলেই যদি মানুষ শাস্ত্রমতে চিত্রবিদ হ’ত—তবে ছবি যারা আঁকে এবং ছবি যারা দেখে সবাইকে বায়স্কোপের কর্তার পায়ের তলায় মাথা নোয়াতে হত। শিল্পীর কল্পনায় শিল্পের জিনিষ আগুন হয়ে জ্বলে, বাতাস হয়ে বয়, জল হ’য়ে চলে, উড়ে আসে মনের দিকে সোনার ডানা মেলে, নিয়ে চলে বিদ্যমান ছাড়িয়ে অবিদ্যমান কল্পনা ও রসের রাজত্বে দর্শক ও শ্রোতার মন—এই জন্যেই শিল্পের গৌরব করে মানুষ। বায়স্কোপের চলন্ত বলন্ত ভয়ঙ্কর রকমের বিদ্যমানের পুনরুক্তিকে মানুষ ‘সশ্বাস ইব’ অতএব চিত্র বলে তখনি মত প্রকাশ করে যখন তার বায়ু বিষম কুপিত হয়েছে। এখনকার ভারত-শিল্পের সাধনা অনাগত অজ্ঞাত যা তারি সাধন না হয়ে যদি পূর্বগত প্রাচীন ও আগত আধুনিক এবং সম্ভূত শিল্পের আরাধনাই হয় সবার মতে, তবে কলাদেবীর মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি যথেষ্ট উঠবে কিন্তু এক লহমার জন্যেও শিল্পদেবতা সেখানে দেখা দেবেন না; “যস্যামতঃ তস্য মতং যস্য ন বেদ সঃ’। বিদ্যমান যে জগৎ তাকে প্রতিচ্ছবি দ্বারা বিদ্যমান করা মানে পুনরুক্তি দোষে নিজের আর্টকে দুষ্ট করা। বিদ্যমান জগৎ বিদ্যমানই তো রয়েছে, তাকে পুনঃ পুনঃ ছবিতে আবৃত্তি করে ড্রয়িং না হয় মানুষ পেলে, রূপকে চিনতে শিখলে, রংকে ধরতে শিখলে—কিন্তু এতো প্রথম পাঠ। এইখানেই যে ছেলে পড়া শেষ করলে সে কি শিল্পের সবখানি পেলে? অথবা মানুষের চেষ্টা তার কল্পনাতেই রয়ে গেল, অবিদ্যমান অবস্থাতেই মূকের স্বপ্ন দর্শনের মতো হ’ল ছেলেটির দশা! অন্ধের রূপকল্পনার মতো অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের মধ্যে ধরতে সক্ষম রইলো সে নির্বাক ও চক্ষুহারা? একে রইলো বাইরে বাঁধা, অন্যে রইলো ভিতরে বাঁধা।
শিল্পকে জানতে হ’লে যেখান থেকে কেবল মতই বার হ’চ্ছে সেই টোলে গেলে আমাদের চলবে না। ঋষি ও কবি এবং যাঁরা মন্ত্রদ্রষ্টা তাঁদের কাছে যেতে হবে চিত্রবিদ্কে। এর উত্তর কবীর দিয়েছেন চমৎকার—
“জিন বহ চিত্র বনাইয়া
সাঁচা সূত্ৰধারি
কহহী কবীর তে জন ভলে
চিত্র বংত লেহি বিচারি।”
যিনি এই চিত্রের রচয়িতা তিনি সত্য সূত্রধর; সেইজন শ্রেষ্ঠ, যে চিত্রের সহিত চিত্রকরকেও নিলো বিচার করে’।
“বিদ্যমান এই যে জগৎ-চিত্র এর উৎপত্তিস্থান অবিদ্যমানের মধ্যে”,—চিত্রের রহস্য এক কথায় প্রকাশ করলেন ঋষিরা।
ঘটনের মূলে রচনের মূলে শিল্পের মূলে শিল্পী না শাস্ত্র-এ বিষয়ে পরিষ্কার কথা বল্লেন ঋষি—“সর্বে নিমেষা জজ্ঞিরে বিদ্যুতঃ পুরুষাদধি” কল্পনাতীত প্রদীপ্ত পুরুষ, নিমেষে নিমেষে ঘটনা সমস্তের জাতা তিনি। অমুক শর্মার না বিশ্বকর্মার অভ্রান্ত শিল্পের প্রসাদ পেতে হবে মানুষ শিল্পীকে? সে সম্বন্ধে ঋষিদের আশীর্বচন উচ্চারিত হ’ল, “হংসাঃ শুক্লীকৃতা যেন শুকাশ্চ হরিতীকৃতাঃ। ময়ূরাশ্চিত্রিতা যেন স দেবত্ত্বাং প্ৰসীদতু”।
হংস এল সাদা হয়ে, শুক এল সবুজ হয়ে, ময়ূর এল বিচিত্র হয়ে, তারা সেই ভাবেই জগৎচিত্রের মধ্যে গত হয়েই রইল, অবিদ্যমানকে জানতে পারলে না। রচনাও করতে পারলে না কল্পনাও করতে চাইলে না। মানুষ মনের মধ্যে ডুব দিয়ে অবিদ্যমানের মধ্যে বিদ্যমানকে ধরলে, —সে হ’ল শিল্পী, সে রচনা করলে, চিহ্ণবর্জিত যা ছিল তাকে চিহ্ণিত করলে, পাথরের রেখায় রঙ্গের টানে সুরের মীড়ে গলার স্বরে।
বর্ষার মেঘ নীল পায়রার রং ধরে এল, শরতের মেঘ সাদা হাঁসের হাল্কা পালকের সাজে সেজে দেখা দিলে, কচি পাতা সবুজ ওড়না উড়িয়ে এল বসন্তে, নীল আকাশের চাঁদ রূপের নূপুর বাজিয়ে এল জলের উপর দিয়ে, কিন্তু এদের এই অপরূপ সাজ দেখবে যে সেই মানুষ এল নিরাভরণ নিরাবরণ, শীত তাকে পীড়া দেয়, রৌদ্র তাকে দগ্ধ করে, বাস্তব জগৎ তার উপরে অত্যাচার করে বিশ্বচরাচরে রহস্যের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মধ্যে তাকে বন্দী করতে চায়—এই মানুষ স্বপন দেখলে অগোচরের অবাস্তবের অসম্ভবের অজানার, সেই দেখার মধ্য দিয়ে দৃষ্টি বদল করে’ নিলে সৃষ্টির বাইরে এবং সৃষ্টির অন্তরে যে তার সঙ্গে অদ্বিতীয় শিল্পীর অপরাজিত প্রতিনিধি মানুষ মনোজগতের অধিকারী বহির্জগতের প্রভু।