বনভূমির নিভৃতে কলম্বনা এক স্রোতস্বিনীর নিকটে রক্তপাষাণের বুকের উপর কুহেলিকালীনা প্রতি সন্ধ্যায় পল্লবিত দ্রুমবাহু হতে পুরটকণিকার মত পীতমঞ্জরীর পুঞ্জ লুটিয়ে পড়ে। নিবিড় অধরবন্ধ রচনা ক’রে কেলিশ্রমালস মৃগদম্পতি সেই পুঞ্জীভূত কোমলতার ক্রোড়ে নিশীথের প্রহর যাপন করে। আর, প্রভাত হতেই মৃগদম্পতি যখন নবতৃণের গন্ধামোদে চঞ্চল হয়ে স্রোতস্বিনীর কূলে ছুটাছুটি ক’রে বেড়ায়, তখন বনপথের দুই দিক হতে উৎসুক নয়ন নিয়ে কীর্ণ মঞ্জরীর কোমলতায় আবৃত সেই রক্তপাষাণের নিকটে দেখা দেয় বরযৌবনা এক ঋষিকুমারী, কণ্ঠে তার গন্ধে আকুল স্ফূটকেতকীর মালিকা, এবং মদাঞ্চিততনু এক তরুণ ঋষি, বক্ষে তার মৃগমদবাসিত কুঙ্কুমের অঙ্কন। মহর্ষি বদান্যের কন্যা সুপ্রভা ও ঋষি অষ্টাবক্র।
যেন দুর্বহ এক তৃষ্ণার বেদনা নয়নে বহন ক’রে ছুটে আসে মিলনোন্মুখ দুই জীবনের যৌবনান্বিত দুই স্বপ্নভার। কিন্তু ছুটেই আসে শুধু, আর এসেই ক্ষুদ্র অথচ কঠোর রক্তপাষাণের বাধায় হঠাৎ আহত হয়। নিকটে এসেও যেন এক দুরূহ সুদূরতার শাসনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভুলতে পারে না অষ্টাবক্র, সুপ্রভাও ভোলে না, দু’জনেরই জীবনের একটি কঠিন অঙ্গীকার দু’জনের মাঝখানে এই ব্যবধান আজও রচনা ক’রে রেখেছে।
দরোৎফুল্ল সরোরূহের মত সুপ্রভার বিকচ আননশোভার দিকে ঋষি অষ্টাবক্র সম্পৃহ নয়নে তাকিয়ে থাকে। আর, বিমুগ্ধা বনকুরঙ্গীর মত সমুত্তান নয়নভঙ্গীর নিবিড়সান্দ্র বিহ্বলতা নিয়ে অষ্টাবক্রের কুঙ্কুমপিঞ্জরিত বক্ষঃপটের দিকে তাকিয়ে থাকে সুপ্রভা। তরুণ ঋষির সেই মৃদুশ্বাসকম্পিত বক্ষের তরঙ্গিত আবেদনের উপর মাথা লুটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে সুপ্রভা। এবং সুপ্রভার ফুল্ল আননের রক্তিম সুষমা অধরাশ্লেষে পান ক’রে নিয়ে তৃপ্ত হতে ইচ্ছা করে অষ্টাবক্র, বনবিটপীর কিশলয় যেমন প্রভাতের অরুণিত মিহিরলেখার রাগসুষমা পান ক’রে তৃপ্ত হতে ইচ্ছা করে।
কিন্তু এই ইচ্ছা নিতান্তই ইচ্ছা। বাসকল্পের মত সুন্দর ঐ পুঞ্জায়িত মঞ্জরীর মদাকুল ইঙ্গিতে এই ইচ্ছা ক্ষণে ক্ষণে চঞ্চলিত হয়, কিন্তু এই চঞ্চলতা কোনক্ষণে জীবনের সেই অঙ্গীকারকে বিচলিত করতে পারে না।
অঙ্গীকার ক’রে কঠোর এক পরীক্ষা জীবনে স্বীকার ক’রে নিয়েছে প্রেমিক অষ্টাবক্র ও তার প্রেমিকা সুপ্রভা। কে জানে কোন্ বিশ্বাসের দুঃসাহসে মহর্ষি বদান্যের কাছে এই অঙ্গীকার নিবেদন করেছে অষ্টাবক্র ও সুপ্রভা, শুধু স্বেচ্ছার অধিকারে কখনই পরিণয় বরণ করবে না ওদের দু’জনের জীবন। যদি কোন শুভ লগ্নে স্বয়ং মহর্ষি বদান্য সাগ্রহে সানন্দে ও সমন্ত্রসংস্কারে সুপ্রভাকে অষ্টাবক্রের কাছে সম্প্রদান করেন, তবেই সেই লগ্নে জগতের স্বীকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাল্যবিনিময় ক’রে মিলিত হবে ঐ কুঙ্কুম আর কেতকীর সুরভিত ইচ্ছা। তার আগে নয়, এবং জগতের কোন গোপন নিভৃতেও নয়।
তাই সুপ্রভা আর অষ্টাবক্র, দুই উৎসুক আকাঙক্ষার ব্যাকুলতা প্রতি প্রভাতের জাগ্রত আলোকের পথে এক স্বপ্নাভিসারে আসে, বননিভৃতের এই কলস্বনা স্রোতস্বিনীর নিকটে এক সুরভিত সান্নিধ্যের ছায়াটুকু মাত্র অনুভব ক’রে চলে যায়।
ঋষি অষ্টাবক্র ও কন্যা সুপ্রভার প্রণয়কলাপে বিস্মিত বিরক্ত ও ব্যথিত হয়েছেন মহর্ষি বদান্য। তিনি মনে করেন, এই প্রণয় প্রণয় নয়। বনের মৃগ ও মৃগীর মত নিতান্ত এক আসক্তির তাড়নাকে জীবনের প্রেম বলে বিশ্বাস করেছে এক ঋষিকুমার ও এক ঋষিকুমারী। ঐ আগ্রহ আকালিক ঝটিকার মত বিচলিত যৌবনের উদ্ভ্রান্তি মাত্র; দক্ষিণমলয়ের মৃদুবিধূত নিঃশ্বাসের মত স্নিগ্ধ স্থিরসৌহার্দ্যের সঞ্চার নয়। ঐ চাঞ্চল্য লোষ্ট্রাহত সরসীসলিলের ছন্দোহীন উচ্ছলতা মাত্র; সুতরঙ্গিত ভঙ্গিমার মঞ্জুল বিঞ্জোলী নয়। ওদের মুখের ভাষা আসঙ্গাকামনার মুখরতা মাত্র; প্রেমমহিমার কল্লোল নয়। দুই জনের দুই মুগ্ধ মুখচ্ছবি ও অধরবিসর্পিত রক্তোচ্ছ্বাস দু’টি দাবানলদ্যুতি মাত্র; সুশান্ত জ্যোৎস্নারাগ নয়। আসক্তি সত্য হলেই পরিণয় লাভের অধিকার সত্য হয় না। এই আসক্তি প্রেম নয়, অনুরাগ নয়, দাম্পত্যের মিলনসূত্রও নয়।
স্মরণ করেন মহর্ষি বদান্য, অঙ্গীকার করেছে অষ্টাবক্র ও সুপ্রভা। কিন্তু ঐ অঙ্গীকারে কোন সত্য নেই। মনে করেন বদান্য, ঐ অঙ্গীকার হঠামোদে উদ্ধত দুই যৌবনের কৌতুকরঙ্গ মাত্র, মহর্ষি বদান্যের রোষ প্রশমিত করবার জন্য যৌবনচটুল দুই অভিসন্ধির চাটুভাষিত স্তুতি। বিশ্বাস হয় না, যে দুই আকাঙক্ষা প্রতি প্রভাতে বননিভৃতের ক্রোড়ে গোপনাভিসারে এসে সান্নিধ্য লাভ করে, সেই দুই আকাঙক্ষা কখনও কোন সংযমের অঙ্গীকারকে শ্রদ্ধা করতে পারে। আসক্তি কেমন ক’রে পাবে এই শক্তি? সন্দেহ করেন মহর্ষি বদান্য, কপট অঙ্গীকারের অন্তরালে কৌতুকমদে মদায়িত এক ঋষিকুমারী এবং এক তরুণ ঋষির দেহ ক্ষণপুলকিত উদ্ভ্রান্তির অনাচারকলুষে ক্লিন্ন হয়েছে। লোকসমাজের আশীর্বাদের জন্য সেই দুই অবিধিপ্রগলভ আসক্তির প্রাণে কোন মোহ আর শ্রদ্ধা নেই।
অভিশাপ বর্ষণের জন্য মহর্ষি বদান্যের কোপপীড়িত দুই চক্ষু খর দৃষ্টি-বর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ দেখতে-পেয়ে বিস্মিত হন বদান্য, তাঁর আশ্রমভবনের দ্বারোপান্তে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ ঋষি অষ্টাবক্র।
মহর্ষি বদান্য বলেন—আমি জানি, তুমি কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ অষ্টাবক্র। কিন্তু শুনে যাও, সুপ্রভার পাণি প্রার্থনা করবারও অধিকার তোমার নেই।
অষ্টাবক্র—কেন মহর্ষি?
বদান্য—কেতকীগন্ধবাসিত একটি কন্ঠের আর কুঙ্কুমাঙ্কিত একটি বক্ষের আসক্তিময় প্রগল্ভতা আমার আশীর্বাদ পেতে পারে না।
অষ্টাবক্র—প্রগল্ভতা বলে ধারণা করছেন কেন, মহর্ষি?
অষ্টাবক্রের প্রশ্নে আরও কুপিত হয়ে শ্লেষাক্ত স্বরে উত্তর দেন মহর্ষি বদান্য।— শিলাখণ্ড যেমন তরল হতে পারে না, শিশিরবিন্দু যেমন কঠিন হতে পারে না, আসক্তিও তেমনি কখনও অপ্রগল্ভ হতে পারে না।
অষ্টাবক্র—কিন্তু আপনারই ইচ্ছাকে সম্মানিত ক’রে আমরা দু’জনে যে অঙ্গীকার জীবনে গ্রহণ করেছি, সেই অঙ্গীকার কোন মুহূর্তেও আমাদের আচরণে অসম্মানিত হয়নি।
চমকে ওঠেন মহর্ষি বদান্য। তাঁর সন্দেহ ও বিশ্বাসের কঠিন হৃৎপিণ্ডের উপর যেন এক উদ্ধতের হঠভাষিত গর্বের আঘাত পড়েছে।
বদান্য বলেন—কিন্তু আমি জানি, একদিন না একদিন তোমাদের উদ্ভ্রান্ত আসক্তির কাছে তোমাদের অঙ্গীকার মিথ্যা হয়ে যাবে।
অষ্টাবক্র—কখনই হবে না।
তীব্রতর উষ্মায় তপ্ত হয়ে ওঠে বদান্যের কণ্ঠস্বর।—তবে শোন অষ্টাবক্র, বৎসরকাল পূর্ণ হবার পর আজিকার মত এমনই এক প্রভাতে আমার কাছে এসে যদি এই সত্য ঘোষণা করতে পার যে, তোমাদের অঙ্গীকার ঐ বননিভৃতের ভৃঙ্গগীতগুঞ্জরিত কোন মুহূর্তেও বিচলিত হয়নি, তবেই আমি বিশ্বাস করব, সুপ্রভার পাণি প্রার্থনা করবার অধিকার তুমি পেয়েছ।
অষ্টাবক্র—তারপর?
মহর্ষি—তারপর, আমি বিচার করব, সুপ্রভার পাণি গ্রহণের অধিকার তোমার আছে কি না।
অষ্টাবক্র—আপনার ইচ্ছাকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্বীকার ক’রে নিলাম।
হ্যাঁ, সত্যই আসক্তি। মনে মনে স্বীকার করে অষ্টাবক্র ও সুপ্রভা, মহর্ষি বদান্যের অনুমানে কোন ভুল নেই। কুমারী সুপ্রভা তার উষ্ণ নিঃশ্বাসবায়ুর চঞ্চলতার মধ্যে বক্ষের গভীর হতে উৎসারিত এক তৃষ্ণার মর্মররোল শুনতে পায়। যেন তার শোণিতে সঞ্চারিত এক স্বপ্নের প্রাণ দোহদবেদনা বরণের জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছে। বিশ্বাস করে সুপ্রভা, পিতা বদান্যের অভিযোগ মিথ্যা নয়, স্ফুট প্রসূনের নবপরাগের মত এক সুরভিত মোহ তার সকলক্ষণের ভাবনাকে অবশ ক’রে রেখেছে। উদ্দলকুসুমসুরভির মত কি-এক বাসনার শিহর তার অধরপুটে ক্ষণে ক্ষণে দুরন্ত প্রলোভ সঞ্চারিত ক’রে যায়। বিশ্বাস করে সুপ্রভা এই তৃষ্ণার পরম তৃপ্তি দাঁড়িয়ে আছে তারই সম্মুখে, নাম যার অষ্টাবক্র, তরুণতরুর মত স্নিগ্ধদর্শন যে ঋষির কণ্ঠে কেতকীমালিকা অর্পণের জন্য সুপ্রভার মন তার স্বপ্ন জাগর ও সুষুপ্তিরও প্রতিক্ষণে উৎসুক হয়ে রয়েছে।
অষ্টাবক্রও সুপ্রভার কাছে অকপট ভাষায় নিবেদন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করে না—হ্যাঁ ঋষিনন্দিনী, ঐ বনমৃগদম্পতির জীবনের প্রতি সন্ধ্যার উৎসবের মত অধরবন্ধ রচনার জন্য আমার ধমনীধারায় এক স্বপ্নাতুর আকাঙক্ষা ছুটাছুটি করে। আমি জানি, আমার সেই আকাঙক্ষার সকল তৃপ্তির আধার তোমার ঐ সুন্দর অধর। পরিমলগ্রাহিণী সমীরিকা তুমি, আমার যৌবনোত্থ বাসনার সৌরভভার তোমারই সমাদরে ধন্য হতে চায়। এই ক্ষিতিতলের এক নিভৃতের স্নেহে লালিত স্নিগ্ধ কেকা তুমি, আমার প্রাণের সকল তৃষ্ণার নীলাঞ্জন তোমারই আহ্বান অন্বেষণ ক’রে বেড়ায়। নিবিড়সলিল নিকুঞ্জসরিৎ তুমি, আমার সকল আনন্দের হিল্লোল তোমারই কান্তিসুধারসের অভিষেক নিতে চায়। স্বীকার করি সুপ্রভা, আমার বক্ষের কুঙ্কুমে আমার আসক্তিরই প্রাণ ছড়িয়ে রয়েছে।
কুন্ঠাহত স্বরে প্রশ্ন করে সুপ্রভা।—কিন্তু এই কি প্রেম?
বিস্মিত হয় অষ্টাবক্র। —জানি না, প্রেম নামে কোন্ আকাশসম্ভব আকাঙক্ষার কথা তুমি বলছ, ঋষিতনয়া।
সুপ্রভা—ক্ষমা করবেন ঋষি, আমি পিতা বদান্যের দুর্বহ এক চিন্তার প্রশ্ন আপনাকে নিবেদন করছি। শুধু তাই নয়, এই প্রশ্ন আমার নিজেরই জীবনের প্রতি আমার সংশয়কাতর মনের প্রশ্ন। বলাকার প্রাণ যে আকাঙক্ষায় বিদ্যুন্ময় জীমূতের ধ্বনিত শিহর নিজ দেহের শোণিতধারায় বরণ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, আমার প্রাণ সেই আকাঙক্ষা নিয়ে আপনার দীপ্ত যৌবনের হর্ষ বরণ করতে চায়। কোন সন্দেহ করি না ঋষি, আমার কণ্ঠমালিকার কেতকীতে আমার আসক্তিই সুরভিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু এই আসক্তি কি জীবনের কোন সুন্দর আকাঙক্ষা?
অষ্টাবক্র—সুন্দর আসক্তি অবশ্যই জীবনের সুন্দর আকাঙক্ষা।
সুপ্রভা বিস্মিত হয়। —সুন্দর আসক্তি?
অষ্টাবক্র—হ্যাঁ, সে আসক্তি দেহজ বাসনারই প্রসূত প্রসূন, কিন্তু দেহজ বাসনার নিঃশ্ৰীক উল্লাস নয়। সে আসক্তি কখনও প্রগল্ভ হয় না। মহর্ষি বদান্য বৃথাই বিশ্বাস করেছেন, আমাদের কামনা ক্ষণোদভ্রান্ত হয়ে আমাদের অঙ্গীকারের গৌরব নাশ ক’রে দেবে।
বুঝতে না পেরে প্রশ্নাকুল দৃষ্টি তুলে নীরবে শুধু তাকিয়ে থাকে সুপ্রভা।
অষ্টাবক্র বলে—ভুলে যাও কেন কুমারী, তোমাকে আজও আমি স্পর্শ করিনি? এইখানে কতবার ক্ষণে ক্ষণে বনসমীরণ উদ্ভ্রান্ত হয়েছে, কিন্তু তোমার চিরঘন-সঙ্কাশ চিকুরের সুচারু স্তবক আর নিবিড় নীবিতটের নবীনাংশুক মেখলা কখনও উদ্ভ্রান্ত হয়নি। যেন শতকুম্ভের কান্তি দিয়ে রচিত দু’টি কুম্ভ, পুষ্পহারের সলজ্জ শাসন তুচ্ছ ক’রে ললিত লাবণ্যভঙ্গে স্তকিত হয়ে রয়েছে তোমার অভিরাম উরজশোভার বিহ্বলতা। তবু আমার লুব্ধ বক্ষ ও বাহু দস্যু হয়ে উঠতে পারে না সুপ্রভা। এই সংযম বরণ ক’রেই তোমার ও আমার আসক্তি সুন্দর হতে পেরেছে।
সুপ্রভা—আপনি এই যুক্তি দিয়ে কোন্ সত্য প্রমাণ করতে চাইছেন ঋষি?
অষ্টাবক্র—তুমি আমার এবং আমি তোমার; আমার ও তোমার জীবন পরিণয়ে মিলিত হবার অধিকার পেয়েছে।
অষ্টাবক্রের ভাষণে সুপ্রভা যেন তার জীবনের এক মধুর বিশ্বাসের জয়ধ্বনি শুনতে পায়। তবু, এই বিশ্বাসের আনন্দ অনুভব করতে গিয়েও হঠাৎ আর-এক ক্ষীণ সংশয়ের বেদনা সুপ্রভার আয়ত নয়নের কোণে বাষ্পায়িত হয়ে ওঠে।—সুপ্রভা ব্যথিত স্বরে বলে—তবু সংশয় হয়।
অষ্টাবক্র—বল কিসের সংশয়?
সুপ্রভা—বদান্যতনয়া সুপ্রভার চেয়ে সুন্দরতর অধরের নারী এই জগতে কতই তো আছে।
অষ্টাবক্র—আছে, অস্বীকার করি না সুপ্রভা।
সুপ্রভা—ভয় হয় ঋষি, আপনার এই সুন্দর আসক্তি, আপনার বাসনাবিহ্বল দুই চক্ষু যে-কোন ক্ষণে যে-কোন বিম্বাধরার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ ও লুব্ধ হয়ে উঠতে পারে।
অষ্টাবক্র—পারে, অস্বীকার করি না প্রিয়া।
সুপ্রভা—সব চেয়ে বড় ভয় ঋষি, আপনারই প্রিয়াতিপ্রিয়া এই সুপ্রভার মনও ঠিক এই ভুল ক’রে ফেলতে পারে।
অষ্টাবক্র—অসম্ভব নয়।
সুপ্রভা—এত ভঙ্গুরতা দিয়ে রচিত যে আসক্তির প্রাণ, সেই আসক্তি সুন্দর হলেই বা কি আসে যায় ঋষি? স্থিরতাবিহীন সেই আসক্তি আমাদের জীবনে পরিণয়ের বন্ধন হতে পারে না।
অষ্টাবক্র—সুন্দর আসক্তির প্রাণ তৃণশীর্ষের শিশিরের মত ভঙ্গুর নয়, সুন্দরাননা। সেই আসক্তি নিষ্ঠায় কঠিন। পথিবীর কোন বিম্বধরার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার নয়ন মুগ্ধ হলেও আমার সেই মুগ্ধ নয়ন যে তোমাকেই অন্বেষণ করবে সুপ্রভা।
সুপ্রভা—তা হলে এই কথা বলুন ঋষি, আমি আপনার আকাঙক্ষার উৎসবে প্রয়োজনের এক প্রেয়সী মাত্র।
অষ্টাবক্র—তুমি শ্ৰেয়সী; আমি বিশ্বাস করি, তুমিই আমার আকাঙক্ষার মহত্তমা তৃপ্তি। আমার এই বিশ্বাস মিথ্যা নয় বলেই আমার জীবনে তোমাকে আপন ক’রে নেবার অধিকার আমি পেয়েছি।
পূর্ণশশিপ্রভার মত পূর্ণ এক বিশ্বাসের জ্যোৎস্না সুপ্রভার প্রত নয়নের নীলিমায় উদ্ভাসিত হয়। সুপ্রভা বলে—আর কোন সন্দেহ নেই ঋষি। আমার প্রশ্নের সকল কুটিলতা ক্ষমা করুন। আমার মনে আর কোন প্রশ্ন নেই।
অষ্টাবক্র হাসে—কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন আছে, সুপ্রভা।
সুপ্রভা—বলুন।
অষ্টাবক্র—তুমিও কি বিশ্বাস কর যে, এই জগতীতলের সকল যৌবনাঢ্য সুন্দরতার মধ্যে আমার কুঙ্কুমাঙ্কিত বক্ষ তোমারও বক্ষের ঐ বিপুলপীবর অভিলাষের শ্রেষ্ঠ তৃপ্তি? যদি জানি, তোমার মন এই ধরণীর যে-কোন রমণীয়চ্ছবি মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলেও শুধু আমারই আলিঙ্গনে তৃপ্ত হতে চায়, তবেই আমি তোমাকে আমার জীবনে আহ্বান করতে পারি, সুপ্রভা।
চকিত জ্যোৎস্নার মত হেসে ওঠে সুপ্রভার নয়ন।—চন্দ্রকিরণে বিমুগ্ধ হয়েও চক্রবাকী কখনও চন্দ্রমার বক্ষ অন্বেষণ করে না ঋষি, অন্বেষণ করে তার একান্তের সহচর সেই প্রিয়কান্ত চক্রবাকেরই কণ্ঠ। বিশ্বাস করুন ঋষি, আমিও এই সত্যে বিশ্বাস করি যে, আমার কেতকীমালিকার আরাধ্য আপনি, স্বপ্ন আপনি, শ্রেষ্ঠ তৃপ্তি আপনি। কিন্তু…।
সুপ্রভার কেতকীবাসিত জীবনের স্বপ্ন যেন এক অন্তহীন প্রতীক্ষার শঙ্কায় হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কবে সমাপ্ত হবে এই ব্যাকুলতার অভিসার? কেতকীমালিকার তৃষ্ণা কি চিরকাল এই ভাবে এক রক্তপাষাণের বাধায় স্তব্ধ হয়ে থাকবে? কবে শেষ হবে কঠোর অঙ্গীকারে শাসিত এই বেদনাবহনের ব্রত?
—কিন্তু আর কতদিন? প্রশ্ন ক’রেই সুপ্রভার অভিমানভীরু যৌবনের বেদনা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে দুই নয়নের প্রান্তে দু’টি জললবমায়া রচনা করে।
—আজই শেষ দিন সুপ্রভা। অষ্টাবক্রের কণ্ঠস্বরে উচ্ছল এক আশ্বাসের ভাষা হর্ষায়িত হয়। মনে পড়ে সুপ্রভার, পূর্ণ হয়েছে বৎসরকাল। এবং মনে পড়তেই দুই নয়নপগোবিন্দুর বেদনা জ্যোতিরুদ্ভাসিত রত্নকণিকার মত সুস্মিত হয়ে ওঠে। আজ এই প্রভাতে পিতা বদান্যের কাছে গিয়ে পাণি প্রার্থনা করবে সুপ্রভারই কেতকীমালিকার বাঞ্ছিত অষ্টাবক্র।
বদান্য বলেন—সুপ্রভার পাণি গ্রহণের অধিকার তোমার নেই।
অষ্টাবক্রের কণ্ঠস্বর হঠাৎ দুঃসহ বিস্ময়ে ব্যথিত হয়ে ওঠে—অঙ্গীকার পালন করেছি, এই সত্য জেনেও আমার প্রার্থনা কেন প্রত্যাখ্যান করছেন মহর্ষি?
বদান্য—নিতান্তই দেহসুখ লাভের অভিলাষে ব্যাকুল হয়েছে তোমাদের উভয়েরই মন। তাই তোমরা বিবাহিত হবার সংকল্প গ্রহণ করেছ।
অষ্টাবক্র—আপনার ধারণা মিথ্যা নয় মহর্ষি।
ঈষৎ শিহরিত ভ্রূকুটি সংযত করে বদান্য বলেন—এই অভিলাষকেই আসক্তি বলে।
অষ্টাবক্র—স্বীকার করি।
বদান্য—আসক্তি সত্য হলেই পরিণয় লাভের অধিকার সত্য নয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরীক্ষা সহ্য করতে পারলেও আসক্তিকে কখনও প্রেম বলে স্বীকার করতে পারি না। মানব ও মানবীর জীবন বনেচর মৃগ ও মৃগীর জীবন নয়। আসক্তি দম্পতির মিলিত জীবনের প্রকৃত বন্ধনও নয়।
অষ্টাবক্র—প্রকৃত বন্ধনেরই প্রথম গ্রন্থি।
বদান্য—সে গ্রন্থি নিতান্তই ক্ষণভঙ্গুর।
অষ্টাবক্র—স্বীকার করি না।
বদান্য—আসক্তির নিষ্ঠা কয়েকটি মুহূর্তের প্রতীক্ষায় মিথ্যা হয়ে যায়, খর নিদাঘের কয়েকটি মুহূর্তে যেমন শুষ্ক হয়ে যায় ক্ষুদ্ৰজল গোষ্পদ।
অষ্টাবক্র—সুন্দর আসক্তি কখনও মিথ্যা হয় না।
বদান্য—কি বললে অষ্টাবক্র?
অষ্টাবক্র—ঠিকই বলেছি মহর্ষি। সুন্দর আসক্তি তপস্বীর সংকল্পের মত নিষ্ঠায় অবিচল। সে আসক্তি সদানীরা তটিনীর বক্ষের মত চিররসে উচ্ছসিত নীলাকাশের ক্রোড়ের মত বিপুল মায়ায় অভিভূত, সে আসক্তি পরিচুম্বনচতুর বাসন্ত দ্বিরেফের মনোবাসনার মত পুষ্পে পুষ্পে অবিরল তৃপ্তির উৎসব সন্ধান করে না। সে আসক্তি শুধু তার শ্রেয়সীকে, তার মহত্তমা তৃপ্তিকে সন্ধান করে। সূর্যসুখিনী জলনলিনীর কামনা কোনক্ষণেই দিক্ভ্রান্ত হয় না।
অষ্টাবক্রের মুখের দিকে জ্বালালিপ্ত দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন বদান্য। সহ্য করতে পারেন না অষ্টাবরে এই অবিরল হঠভাষণ। দেহজ কামনার চাঞ্চল্যে উদ্ভ্রান্ত এই যৌবনবানের আসক্তি যেন গর্বে আত্মহারা হয়েছে, এবং প্রলাপ বর্ষণ ক’রে ঋষি-জীবনের এক পরম নীতিকে বিদ্রূপ করছে!
নীরব হয়ে বসে থাকেন, এবং ভ্রূকুটিখিন্ন ললাটের রুক্ষতাকে নিজেরই হস্তের রূঢ় স্পর্শে পিষ্ট ক’রে চিন্তা করতে থাকেন বদান্য, যেন তাঁর মনের গোপনের এক প্রতিজ্ঞার কঠিনতা স্পর্শ ক’রে দেখছেন। না, এই তরুণ ঋষির চিন্তার ভয়ংকর ভুল এবং সেই ভুলের দর্প আর-এক পরীক্ষায় চুর্ণ ক’রে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কী রূঢ় বিশ্বাস! মানব ও মানবীর জীবনে পতি-পত্নী সম্বন্ধের প্রকৃত বন্ধনের গ্রন্থি হলো আসক্তি! হঠবিশ্বাসে দুঃসাহসে মুখর হয়ে উঠেছে চটুলচিন্তক এক ঋষিযুবা, এবং সেই দুঃসাহসকেই প্রেমাভিলাষের চেয়েও পরতর আকাঙক্ষা বলে বিশ্বাস করেছে তাঁরই কন্যা সুপ্রভা। মিথ্যা বিশ্বাসে উদ্ভাসিত এই অন্ধতা দগ্ধ না ক’রে দিলে জীবনে প্রকৃত প্রেমের পথ ওরা কখনই চিনে নিতে পারবে না।
আর-এক পরীক্ষা, কিরাতরচিত লতাজালের মতো নয়নরম্য ও মায়াবিকরাল এক পরীক্ষা। সে পরীক্ষাকে স্বয়ং মহর্ষি বদান্যই বহুদিন আগে আয়োজিত ক’রে রেখেছেন। অষ্টাবরে সুন্দর আসক্তির উদ্ধত নিষ্ঠা চূর্ণ করবার জন্য দূরান্তরের এক নিভৃতে রচিত প্রবল ও প্রগল্ভ এক ছলনা। কেলিকুতুকিনী প্রমদার কটাক্ষে শিহরিত, অবিধিবশা অবধূর লোল প্রলোভে লসিত, অনধীনা স্বৈরিণীর শীৎকারে শ্বসিত এক জগৎ, যে জগতের একটি মুহূর্তের উদ্দামতার কাছে নতশির হয়ে লুটিয়ে পড়বে যে-কোন মানবের আসক্তির নিষ্ঠা।
এখান হতে অনেক দূরে, নগাধিপ হিমবানের তুহিনধবল শৈলপ্রদেশ ও রত্নাধীপ কুবেরের অলকাপুরীর অলকাবলিমোহিত মহীধরমালারও উত্তরে, মেঘসন্নিভ এক রমণীয় নীলবনে বাস করে প্রবীণা উদীচী। শুক্লাম্বরা, বিবিধ রত্নাভরণে ভূষিতা এবং অপাররঙ্গপারঙ্গমা সেই বর্ষীয়সীর নিবিড় ভ্রূভঙ্গ যেন মদনমনোন্মদ বিভ্রম ধারণ ক’রে রয়েছে। উত্তর দিগভূমির অনল অনিল ও সলিল হতে উদ্ভূত সকল মোহ প্রতিপালনের জন্য এই নীলবনে অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছে স্বতন্ত্রা স্ববশা ও চিরকন্যকা উদীচী। সেই নীলবনের পল্লবমর্মরে আসক্তির সঙ্গীত, বিহঙ্গের কলরবে আসঙ্গবাসনার আহ্বান; যেন অবিরল লিপ্সার নিঃশ্বাসে উচ্ছ্বসিত দ্বিতীয় এক অনঙ্গনিকেতন পথিকনয়নে মোহ সঞ্চারের জন্য মেঘসন্নিভ নীলবনের রূপ ধারণ ক’রে রয়েছে।
প্রবীণা উদীচী মহর্ষি বদান্যের অনুরোধ সানন্দচিত্তে গ্রহণ করেছে। শুনেছে উদীচী, তরুণ ঋষি অষ্টাবক্র বদান্যতনয়া সুপ্রভাকে তার আকাঙক্ষার শ্রেয়সী বলে বিশ্বাস করে। আসক্তির একনিষ্ঠা সম্পর্ধকণ্ঠে ঘোষণা করেছে তরুণ এক ঋষি, শুনে হাস্য সংবরণ করতে পারেনি উদীচী। সেই ঋষির কামনাকে একটি মদবিভ্রমের আঘাতে নিষ্ঠাহীন ক’রে দিতে কতক্ষণ? বহুদিন থেকে প্রস্তুত হয়েই আছে এবং প্রতীক্ষায় দিন যাপন করছে নীলবনচারিণী উদীচী। কবে আসবে অষ্টাবক্র? সেই ভুল স্বপ্নের স্তাবক অষ্টাবক্র?
দূর উত্তরের গগনবলয়ের দিকে দৃক্পাত ক’রে মহর্ষি বদান্য যেন তাঁর সংকল্পিত পরীক্ষার ভয়ংকরতাকে দেখছিলেন। একবার সেই পরীক্ষার সম্মুখীন হলে আর ফিরে আসবে না অষ্টাবক্র, উদীচীর নীলবনঘন বিভ্ৰমনিলয়ের মত্তসুখের অবিরল আলিঙ্গনে চিরকালের নির্বাসন লাভ করবে এই গর্বিত ঋষিযুবার আসক্তি। এবং মূঢ়া কন্যা সুপ্রভাও এই সত্য উপলব্ধি করবে যে, আসক্তি খলশিখ অনলের মত নিজের নিষ্ঠা নিজেই দগ্ধ করে। আসক্তিকে জীবনের এক দিব্য প্রেমাভরণ বলে মনে ক’রে যে ভুল করেছে সুপ্রভা, ভেঙ্গে যাবে সেই ভুল।
দূরান্তরের নভঃপটে কুবেরগিরির ধবলিত শিখর আপন শোভায় উদ্ধত হয়ে রয়েছে, কিন্তু তারও চেয়ে যেন বেশি উদ্ধত তরুণ অষ্টাবক্রের মস্তকে ফুল্লমল্লিকামোদে পুলকিত ধম্মিল্লের শোভা। অষ্টাবক্রের দিকে একবার সহেল ভ্রূকুটি নিক্ষেপ ক’রে উদ্ধত এক আসক্তির প্রতি যেন নীরবে ধিক্কার বর্ষণ করলেন বদান্য।
বদান্য বলেন—আমার একটি প্রস্তাব আছে, অষ্টাবক্র।
অষ্টাবক্র—আদেশ করুন, মহর্ষি।
বদান্য—কুবেরগিরির উত্তরে রমণীয় এক নীলবনে বাস করেন প্রবীণা উদীচী, চিরকন্যা উদীচী। আমার ইচ্ছা, তুমি সেই নীলবনে উদীচীর নিলয়ে কয়েকটি দিবস ও রাত্রি যাপন ক’রে ফিরে এস।
অষ্টাবক্র—তারপর?
বদান্য—যে-দিনের যে-ক্ষণে তুমি ফিরে আসবে, সে-দিনেরই সে-ক্ষণে আমি কন্যা সুপ্রভাকে তোমার কাছে সম্প্রদান করব।
অষ্টাবরে নয়ন চকিত হর্ষে উজ্জ্বল হয়—আশীর্বাদ করুন।
বদান্য—এখনি আশীর্বাদ আশা কর কেন অষ্টাবক্র? সম্প্রদত্তা সুপ্রভার পরিণয়মাল্য গ্রহণ ক’রে তোমরা দু’জনে যে-ক্ষণে আমার সম্মুখে দাঁড়াবে, সেই ক্ষণে তোমাদের মিলিত জীবনকে আমি আশীর্বাদ করব, তার আগে নয়।
অষ্টাবক্র শ্রদ্ধাভিভূতস্বরে নিবেদন করে।—স্বীকার করি মহর্ষি, আপনার আশীর্বাদ গ্রহণ ক’রে সেই ক্ষণে ধন্য হবে আমাদের জীবনের পরিণয়। একটি অনুরোধ, এখনি আপনার আশীর্বাদ দান না করুন, একটি প্রার্থিত বর দান করুন।
বদান্য— আমার কাছ থেকে এই মুহূর্তে কোন শুভেচ্ছা আশা করো না অষ্টাবক্র, সেই অধিকার এখনও তুমি পাওনি। যে-ক্ষণে আমার আশীর্বাদ লাভ করবে তোমাদের পরিণীত জীবন, সেই ক্ষণে আমি তোমাদের মিলিত জীবনের প্রার্থিত বর দান করব, তার আগে নয়।
অষ্টাবক্র—তথাস্তু মহর্ষি, আপনার এই প্রতিশ্রুতি আমার আজিকার যাত্রাপথের মাঙ্গল্য।
উত্তর দিগ্দেশের অভিমুখে চলে গেল হৃষ্টমানস অষ্টাবক্র। মহর্ষি বদান্যের মনে হয়, এক যৌবনবানের গর্বান্ধ আসক্তি নূতন এক মূঢ়তার আনন্দে চঞ্চলিত হয়ে চলে যাচ্ছে। এক মূর্খ শিশুসর্পের অহংকার নিজ বিষের জ্বালায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে নকুল-বিবরের অভিমুখে এগিয়ে চলেছে। আর ফিরে আসবে না অষ্টাবক্র। আশ্বস্ত হয়েছেন বদান্য।
কিন্তু তারপর? আশ্রমের প্রাঙ্গণের উপর অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন বদান্য, যেন তাঁর তাপিত চিন্তার ক্লেশগুলি আর-একটি আশ্বাসময় ছায়া খুঁজছে। মূঢ়া কন্যা সুপ্রভার পরিণামের কথা চিন্তা করেন বদান্য। নয়নমোহে উদ্ভ্রান্তা ঐ কেতকীরেণুকুতুকিনী কুমারীও যে তার আকাঙক্ষার ভুল বুঝতে পারে না। কি হবে ওর জীবনের পরিণাম?
দেখতে পেলেন বদান্য, লতাগৃহের দ্বারোপান্তে দাঁড়িয়ে নববসন্তাগমে পুলকিত বনস্থলীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সুপ্রভা। শাল রসাল ও শাল্মলীর কান্তিসমারোহের দিকে তাকিয়ে একটি তৃষ্ণা যেন সুস্মিত হয়ে রয়েছে। হ্যাঁ, উপায় আছে, মহর্ষি বদান্য দুঃখিতচিত্তে তাঁর চিন্তার মধ্যে আর-এক পরিকল্পনা আবিষ্কার করেন। তৃষ্ণাচারিণী নারীর সম্মুখে এমনই এক শোভাময় নয়নোৎসব এনে দিতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই।
চলেছে অষ্টাবক্র। সিদ্ধচারণসেবিত হিমালয়ে উপস্থিত হয়ে ধর্মদায়িনী বাহুদ নদীর পূতসলিলে স্নান করে অষ্টাবক্র। তারপর ধনপতি কুবেরের কাঞ্চনময় পুরদ্বারে এসে দাঁড়ায়। গন্ধর্বের বাদিত্ৰনিঃস্বন আর নৃত্যপরা অপ্সরার অবিরল মঞ্জীরশিঞ্জনে মুখরিত যক্ষভবনের সমাদর গ্রহণ ক’রে। তারপর কৈলাস মন্দর ও সুমেরু, একের পর এক সমুদয় পর্বতপ্রদেশ অতিক্রম ক’রে উত্তর দিগ্ভূমির প্রান্তে এসে দাঁড়ায়, বিস্মিত হয়ে দেখতে পায় অষ্টাবক্র, অদূরে এক নীলচ্ছায়াঘন কাননে স্ফুট কুসুমের উৎসব যেন মত্ত হয়ে বিচিত্র বর্ণরাগচ্ছটা উৎসারিত করছে। বিহগকূজনে কম্পিত হয়েও বায়ু যেন এক যৌবনময় বনলোকের নাভিসুরভির ভার ধারণ ক’রে মন্থর হয়ে রয়েছে।
কাননের অভ্যন্তরে প্রবেশ ক’রে এবং অরণ্যক্রোড়ের নিভৃতে কুবেরনিলয়ের চেয়েও দীপ্ততর রত্নপ্রভায় ভাসুর এক নিকেতন দেখতে পেয়ে আরও বিস্মিত হয় অষ্টাবক্র। নিকেতনের সম্মুখে মণিভূমিনিখাত সরোবর। পার্শ্বদেশে মন্দাকিনীর কলনিনাদিত প্রবাহের তটরেখা মারকুসুমে অলংকৃত। স্তব্ধ নিকেতনের প্রবেশপথে মুক্তাজালময় তোরণের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত অষ্টাবক্র ডাক দেয়—আমি অতিথি।
অষ্টাবক্রের সেই আহ্বানে উদ্দীপ্ত ফণিমণিরাগের মত চমকে ওঠে সেই অদ্ভুত নিকেতনের প্রভাময় শোভা। শুনতে পায় অষ্টাবক্র, নিকেতনের নীরবতা হতে হঠাৎ ঝংকার দিয়ে জেগে উঠেছে সুপ্তিবিবশ কাঞ্চী কেয়ূর আর মঞ্জীরের উল্লাস। অকস্মাৎ, তন্বী তড়িল্লতার চেয়েও চকিতলাস্যচপলা, মন্দাকিনীর জলমালা-ভঙ্গিমার চেয়েও তরলতর অনুভঙ্গে ছন্দায়িতা, সান্দ্রসিন্দূররেণুময়ী নবোষার চেয়েও সুনিবিড়স্মিতা সাতটি যৌবনবতী দেহিনী যেন অলক্ষ্য এক স্মরতূণীরের ভিতর হতে হঠাৎ উৎক্ষিপ্ত হয়ে সাতটি পুষ্পবিশিখের মত অষ্টাবক্রের বুকের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ে।
বিস্ময়ে বিমুগ্ধ অষ্টাবক্রের দুই নেত্রে বিচিত্র এক সুখের বর্ণালী নর্তিত হতে থাকে। মায়ানিকেতনবাসিনী সাতটি সুযৌবনা যেন সাতটি অঙ্গমাধুরীর অধীশ্বরীর মত অষ্টাবক্রের বিস্ময়কে ধন্য করবার জন্য সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। অপলক নয়নে দেখতে থাকে অষ্টাবক্র।
ক্ষামকটিতটে ক্ষীণনিনাদিনী কিঙ্কিণী যেন মণিত রণিত ক’রে, নিধুবনোৎসুকা কে এই বনিতা?
প্রিয় প্রাগল্ভ্যে অভীরু ভ্রূলতা বিলোল লালসা হানে; পীনপয়োধরভারে অলসা, কে এই ললনা সুরসা?
বদন যেন সুষমাসদন, মদয়িত স্মরামোদনিদান, বিবশ বাসনা হানে; রাকাশশিমুখী রুচিরময়ী কে এই নারী?
অপাঙ্গে ভঙ্গিমা ঝরে, অনঙ্গে উন্মাদ করে, আসঙ্গ আহবে উন্মুখিনী; রভসরঙ্গিনী কে এই অঙ্গনা?
কিবা গ্রীবাগৌরিমা, সিতমলয়জে অভিরামা, অনুপ রূপের অনল গোপন করে; কে এই রামা?
ক্ষণ ঈক্ষণে বহ্নি শিহরে, রাতুল অধরে তনুশোণিমার স্ফার জ্যোৎস্না স্ফুরে মুনিমনোৰনে প্রালেয়কারিণী কে এই কামিনী?
অশাসিত যৌবন অশেষ উল্লাসে লসিত করে নিঃশ্বাস, নীবিবন্ধবিহীনা বিশ্লথবেণী ব্রীড়াবিরহিতা তনুকা, কে এই ভামিনী?
তরুণ ঋষির নয়নে বিস্ময়! যেন বিগলিত ইন্দ্রধনুর মায়ানুরাগে রঞ্জিত কাদম্বিনীর সুষমা ভূতলে লুটিয়ে পড়েছে, এবং সেই সঙ্গে সাতটি খরবাসনার বিদ্যুৎ। লীলাভঙ্গে চঞ্চল সেই সাত রূপসীর অবয়বশোভার দিকে তাকিয়ে অষ্টাবক্রের বিচলিত বক্ষের সমীর মুগ্ধ হয়ে যায়।
মণিবলয়ের চকিত ঝংকারে তরুণ ঋষির দুই উৎসুক শ্রবণ বন্দিত ক’রে সাত সুন্দরী অভিবাদন জানায়।—উত্তর দিগ্ভূমির অধিষ্ঠাত্রী দেবী উদীচীর এই নিকেতনে প্রবেশ করুন, বরেণ্য।
বংশীনিনাদে মোহিত তরুণ কুরঙ্গের মত দুর্নিবার কৌতূহলে অভিভূত অষ্টাবক্র সাত সুন্দরীর মঞ্জীরিত চরণের ধ্বনি অনুসরণ ক’রে নিকেতনের ভিতরে প্রবেশ করে, এবং দেখতে পায়, রত্নপর্যঙ্কের উপরে সমাসীন হয়ে রয়েছেন শুক্লাম্বরা এক বর্ষীয়সী। সীমন্তে সিন্দূরের রেখা নেই, কিন্তু দেহ বিবিধ হেমময় আভরণে বিভূষিত। দেখে মনে হয়, প্রবীণার আভরণের মধ্যে জগতের সকল কলধ্বনির মুখরতা যেন এক উৎসবের প্রতীক্ষায় উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে।
বর্ষীয়সী বলে—আমি চিরকুমারী উদীচী।
অষ্টাবক্র—আমি ঋষি অষ্টাবক্র, মহর্ষি বদান্যের আদেশে আপনার ভবনের অতিথি হতে চাই।
উদীচী—আমার সৌভাগ্য। আমি ধন্য হব ঋষি, যদি এই ভবনের অতিথি হয়ে আপনি আমার সমাদর গ্রহণ করেন।
অষ্টাবক্র—গ্রহণ করতে চাই।
উদীচী—আমি প্রীত হব ঋষি, যদি আমার সমাদরে আপনি প্রীতি লাভ করেন।
অষ্টাবক্র—প্রীতি লাভ করতে ইচ্ছা করি, উত্তরদিগ্দেবী।
গ্রীবাভঙ্গে ঝংকৃত হয়ে, স্মিতায়িত অধরের স্পন্দন মুক্তাপংক্তিরও চেয়ে খরোজ্জ্বল দশনরেখায় মৃদু দংশনে আহত ক’রে উদীচী বলে।—আদেশ করুন ঋষি। বলুন, কি চায় আপনার ঐ সুন্দর নয়নের বিস্ময়? আপনার প্রীতি সম্পাদনের জন্য উত্তরদিগ্ভূমির সকল প্রীতির সুধাসাররসিতা উদীচী আপনারই কণ্ঠস্বরের একটি নির্দেশ শুধু শুনতে চায়।
অষ্টাবক্রেরে নিমেষবিহীন দুই নেত্রের নিবিড় বিস্ময় অকস্মাৎ চঞ্চল হয়। নারীর দুই ভ্রূবল্লী যেন দু’টি বিলোল অলজ্জা, আসক্তির এক অভিনব ভঙ্গিমনোহর রূপচ্ছবি। বর্ষীয়সীর সেই ভ্রূভঙ্গীর মধ্যে যেন কোদি মদিরাক্ষীর কটাক্ষপীযূষ, পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে।
নীরব অষ্টাবক্রের দুই নেত্রের কৌতূহল চমকে দিয়ে প্রশ্ন করে উদীচী—বলুন ঋষি, কি চায় আপনার বক্ষের ঐ ঝঞ্ঝায়িত নিঃশ্বাস, পুলকাঞ্চিত কপোল আর অধীর অধরসন্ধি?
অষ্টাবক্র বলে—ক্ষণকালের মত আপনার সান্নিধ্য চাই।
বিভ্ৰমসঞ্চারিণী বর্ষীয়সীর ভ্রূকৌতুকে যেন এক স্বপ্নের আনন্দ বিপুল হর্ষে উৎসারিত হয়। উচ্চকিত স্বরে প্রশ্ন করে উদীচী।—শুধু আমারই সান্নিধ্য?
অষ্টাবক্র—হ্যাঁ, চিরকুমারী।
সেই মুহূর্তে সাত সুন্দরীর চরণমঞ্জীরে ঝংকারিত ধ্বনিও যেন ব্যাধবধূচিত্তের উল্লাসের মত হর্ষায়িত হয়। অষ্টাবক্রের অভিভূত মুখচ্ছবির দিকে, যেন এক পাশবদ্ধ বনকুরঙ্গের অসহায় মূর্তির দিকে সহেলচ্ছুরিত দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে হেসে ওঠে উদীচীর অনুচারিণী সাত সুন্দরী, পর মুহূর্তে কক্ষ হতে চলে যায়।
মণিজ্যোতিবিহ্বল মায়াভবনের একটি একান্ত, যেন জগতের সকল লোক-লোচনের শাসন হতে মুক্ত একটি নিভৃত, এবং সেই নিভৃতের অন্তরে মীনকেতুর নূতন কেতনের মত বিজয়াবহ আনন্দে চঞ্চল হয়ে ওঠে লীলাসঙ্গচতুরা এক বর্ষীয়সীর মসিনিবিড় ভ্রূপতাকা। উদ্ভ্রান্তির বন্ধনে রচিত একটি সান্নিধ্য। শুধু অষ্টাবক্র ও উদীচী, আর কেউ নয়, এই নিভৃতের আকাঙক্ষাকে কোন প্রশ্নের স্পর্শে ব্যথিত করতে পারে, এমন কোন ছায়াও এখানে নেই।
উদীচী বলে—আমার সান্নিধ্য পেয়েছেন ঋষি, এইবার বলুন, কি অভিলাষে বিহ্বল হয়েছে আপনার কুঙ্কুমপিঞ্জরিত বক্ষের স্বপ্নভার?
অকস্মাৎ যেন নিজেরই বক্ষের তপ্ত নিঃশ্বাসের আঘাতে চঞ্চল হয়ে, পাবকতাপে উত্তাপিত শিশুভুজঙ্গের মত ব্যথিত হয়ে নিবেদন করে অষ্টাবক্র।—স্নানোদক চাই।
কলোচ্ছলা স্রোতস্বতীর মত তরলহাস্যে শিহরিত হয় উদীচীর কণ্ঠস্বর।— স্নানোদকে শীতল হতে পারবেন না ঋষি। বলুন, কি চায় আপনার জ্বালা-নিঃসারী নিঃশ্বাসের ঝঞ্ঝা, স্ফুর অধরের সুশোণ রৌদ্র, আর বহু কেতকীর গন্ধে পীড়িত ভুজভুজঙ্গের হিল্লোল?
নীলবনের ছায়াঘন রহস্যের কুহরে লুক্কায়িত সেই মণিময় মায়াভবনের বাহিরে নীড়াগত বিহগের ক্লান্ত কূজনস্বর শোনা যায়। সন্ধ্যা হয়েছে। অষ্টাবক্রের কণ্ঠস্বর শিহরিত হয়ে আবেদন করে।—সন্ধ্যা পূজার জন্য আসন চাই।
হেসে ওঠে ঝংকারময়ী উদীচী—এই রত্নপর্যঙ্কে উপবেশন করুন ঋষি।
চমকে ওঠে অষ্টাবক্র এবং অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে। উদীচী বলে—এই তো যথার্থ আসন। উত্তর দিগ্ভূমির নীলবনের ছায়ায় আবৃত এই সুখময় জগতে সন্ধ্যাবন্দনার জন্য কর্কশ কুশতৃণে রচিত আসনের প্রয়োজন হয় না ঋষি। এই জগতের সন্ধ্যাও মন্ত্র স্তব আর জপমালায় বন্দিত হতে চায় না।
রত্নপর্যঙ্কের উপর উপবেশন করে অষ্টাবক্র। আরও সুন্দর হয়ে ওঠে উদীচীর দুই ভ্রূবল্লীর বিলোল অলজ্জা। বর্ষীয়সী উদীচীর কজ্জলমসিমদির দৃষ্টিও নিবিড় সমাদর বর্ষণ ক’রে অষ্টাবক্রের বিচলিত চিত্তের তৃষ্ণাকে আশ্বাস দান করতে থাকে।
বিমুগ্ধ অষ্টাবক্র। নীলবনঘন অভিনব লালসার জগতে এক মায়াভবনের মণিপ্রদীপের প্রখর দ্যুতিনখরের স্পর্শে যেন উচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে অষ্টাবক্রেরে স্মরণপথের সব আলো-ছায়া। মনেও পড়ে না অষ্টাবক্রের, ত্রিলোকের কোন উপবনের লতাচ্ছায়ে সুযৌবনা এক অনুরাগিণী নারীর অভিলাষ অষ্টাবক্রের জন্য নয়নে অমেয় মায়া সঞ্চিত ক’রে প্রতীক্ষায় রয়েছে। ভুলেই গিয়েছে অষ্টাবক্র, জীবনের কোন প্রভাতবেলায় কোন বননিভৃতের একান্তে তরুণ তপনের আলোকে শ্রেয়সীর যৌবনগরীয়সী কান্তির কল্লোলিত সুষমাকে মহত্তমা তৃপ্তি বলে চিনতে পেরেছিল অষ্টাবক্র, অষ্টাবক্রের দুই চক্ষু হতে কেতকীরেণুবাসিত এক ভঙ্গুর স্বপ্ন এই বর্ষীয়সী লালসাময়ীর মদির ভ্রূলাস্যের একটি কঠোর আঘাতে চূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
আর একবার চমকে ওঠে অষ্টাবক্র, উল্লাসচপল অথচ নিবিড়কোমল এবং হর্ষায়িত এক স্পর্শের উৎসব হঠাৎ এসে অষ্টাবক্রের বুকের উপর লুটিয়ে পড়েছে। উদীচীর উদ্যত দুই বাহু অকস্মাৎ মত্ত হয়ে আভরণমুখর মাল্যের মত ঝংকার দিয়ে কঠিন আলিঙ্গনে গ্রহণ করেছে অষ্টাবক্রের কুঙ্কুমবাসিত কণ্ঠ, যেন গরল-প্রগল্ভা বাল্যবধূর সন্তাপিত দেহ চন্দনতরুর দেহ জড়িয়ে ধরেছে। অষ্টাবক্রের দুই চক্ষুর বিবশ বিস্ময়ের সম্মুখে শুধু ভাসতে থাকে প্রবীণা কেলিকলানিপুণার মসিমদির ভ্রূভঙ্গীর বিলোল অলজ্জা।
উদীচী বলে—বল ঋষি, সকল কুণ্ঠা অপহত ক’রে মুক্তকণ্ঠে বল, উত্তর দিগ্ভূমির সুন্দর সন্ধ্যায় এই মধুরক্ষণে কি চায় তোমার যৌবনাঞ্চিত জীবনের আকাঙক্ষা?
অষ্টাবক্র—তৃপ্তি চায়।
উদীচী—সে তৃপ্তি এখানেই আছে। এই রত্নপর্যঙ্কের পুষ্পশয্যায় কোন নিশীথবিহ্বলতার বক্ষে সে তৃপ্তিকে অবশ্যই দেখতে পাবে, প্রতীক্ষায় থাক, ঋষি।
অষ্টাবক্র—প্রতীক্ষায় থাকতে পারি, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দাও, আমার আজিকার আকাঙক্ষার তৃপ্তিকে আমার চক্ষুর সম্মুখে এনে দেবে তুমি।
কুটিল হাস্য বিচ্ছুরিত ক’রে উদীচীর অধরপুট শিহরিত হতে থাকে। —প্রতিশ্রুতি দিলাম ঋষি। কিন্তু শপথ ক’রে বল, তোমার আকাঙক্ষার তৃপ্তিকে সম্মুখে পেলে তাকে জীবনের চিরসহচরী ক’রে নেবে।
অষ্টাবক্র—নেব, শপথ ক’রে বলছি।
দূর উত্তরের দিগ্বলয়ে অলক বলাহকে বিভ্রাজিত আকাশপথের দিকে তাকিয়ে মহর্ষি বদান্যের দুই চক্ষুর আক্ষেপ হঠাৎ হাস্যায়িত হয়। সুন্দর আসক্তির গর্বে উদ্ধত সেই অষ্টাবক্র আর ফিরে এল না। অনুমান করতে পারেন বদান্য, এতদিনে সেই হঠভাষী ঋষির সুখকামুক অভিলাষের একনিষ্ঠা এক কজ্জলমসি-মদিরার ভ্রূভঙ্গের গরলে প্রলিপ্ত হয়ে নীলবনের একান্তে নির্বাসন লাভ করেছে।
দিবসের পর রাত্রি এবং রাত্রির পর দিবস, একের পর এক বহু দিবস-রাত্রি অতীত হয়েছে। বহু কুহেলিকালসা সন্ধ্যায় পুলকবন্ধুর বনদ্রুমদেহ হতে শিথিল মঞ্জরীর ভার ভূতলে লুটিয়ে পড়েছে। যেমন রাকেন্দুবন্দিত রজনীর, তেমনি তরুণ তপনে নন্দিত প্রভাতের রশ্মিরাশি কলস্বনা স্রোতস্বিনীর দুই তটের শিশিরসিক্ত তৃণভূমির বক্ষে হেসেছে। কিন্তু সেই সুন্দর আসক্তির মানুষ, সুপ্রভার কেতকীমালিকার স্বপ্ন সেই অষ্টাবক্র সেই বনপথে আর আসে না। শুধু আসে আর ফিরে যায় সুপ্রভা। বৃথা প্রতীক্ষায় ব্যথিত হয় কেতকীমালিকার সুরভি। কোথায় গেল, কেন গেল, এবং কবে ফিরে আসবে সুপ্রভার কামনার বাঞ্ছিত সেই কুঙ্কুমিততনু ঋষি সুকুমার? কল্পনাও করতে পারে না সুপ্রভা এবং বুঝতেও পারে না, সেই একনিষ্ঠ অভিলাষ কেমন ক’রে তারই শ্রেয়সীর অধরসুষমা না দেখতে পেয়েও শান্তচিত্তে দূরে সরে থাকতে পারে?
বদান্যের তপোবনস্থলীর উপান্তে এক লতাবৃত কুটীরের নিভৃতে মৃদুদীপশিখার দিকে তাকিয়ে বিহগের সান্ধ্য কূজন শোনে সুপ্রভা। কেতকীমালিকার সুরভি সুপ্রভার চিন্তাপীড়িত নয়নের মত জাগরণে যামিনী যাপন করে। প্রিয়বিচ্ছেদভীরু চক্রবাকীর মত চকিতশ্বসিত বক্ষের সন্দেহ শান্ত করবার জন্য কুটীরের দ্বারোপান্তে দাঁড়িয়ে সুপ্রভার সমগ্র অন্তর যেন উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু বৃথা; কোন প্রিয় পদধ্বনি, কোন গুঞ্জন, মৃদুতম কোন মর্মরও শোনা যায় না। কুঙ্কুমাঙ্কিত কোন বক্ষের বিহ্বল নিঃশ্বাস বদান্যতনয়ার কবরীসৌরভ অন্বেষণের জন্য মৃদুল নিঃস্বন সঞ্চারিত ক’রে লতাগৃহের দিকে আসে না।
অষ্টাবক্রের রহস্যময় অন্তর্ধান সুপ্রভার সকলক্ষণের ভাবনার আকাশে যেন এক মেঘমেদুরতা ঘনিয়ে রেখেছে। সবই সহ্য করতে পারে সুপ্রভা, শুধু সহ্য করতে পারে না একটি সংশয়। তীক্ষ্ণমুখ কুশসায়কের মত সেই সংশয় যখন সুপ্রভার কল্পনাকে বিদ্ধ করে, তখনই সবচেয়ে বেশি বিচলিত হয় সুপ্রভার অন্তরের প্রশান্তি। মনে হয়, সুন্দর অথচ কপট এক আসক্তির হঠভাষিত প্রতিশ্রুতি নিষ্ঠুর বিদ্রূপে সুপ্রভার কণ্ঠের কেতকীকে তুচ্ছ ক’রে চলে গিয়েছে। নয়নোপান্তে অদ্ভুত এক জ্বালাময় সিক্ততা অনুভব করে সুপ্রভা। মনে হয়, অশ্রু নয়, তারই যৌবনের প্রথম অনুরাগে উদ্দীপ্ত বিশ্বাস যেন নিষ্ঠাহীন এক পৌরুষের চটুল কৌতুক-লীলার আঘাতে মথিত হয়ে রুধিরবিন্দুর মত ফুটে উঠেছে।
এইভাবে প্রতিক্ষণ সংশয়খিন্ন ভাবনার ভার নীরবে সহ্য ক’রে, আর সুপ্তিহীন নয়নের কৌতূহল নিয়ে প্রতি নিশান্তের আকাশে ও বনতরুশিরে নবোষার অরুণিত সঞ্চার লক্ষ্য করে সুপ্রভা। দীপ নিভিয়ে দেয়, স্নান সমাপন করে। পুষ্পে ও পরাগে প্রসাধিত তনুতে যেন এক নূতন আশার আবেশ ভরে ওঠে। বননিভৃতের রক্তপাষাণের নিকটে এসে দাঁড়ায় সুপ্রভা। দেখতে পায়, রক্তপাষাণের বক্ষের উপর কোমল দ্রুমমঞ্জরীর পুঞ্জ ছিন্নভিন্ন হয়ে রয়েছে, যেন পদাঘাতে পীড়িত এক বাসকশয্যা। আসেনি অষ্টাবক্র, কে জানে, ত্রিজগতের কোন্ বনলোকের নিভৃতে কোন্ স্রোতস্বিনীর কাছে এখন তৃষ্ণার্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই আসক্তির পুরুষ অষ্টাবক্র?
চলে যায় সুপ্রভা এবং এক নিশান্তে লতাগৃহের দীপ নিভিয়ে দিয়েও চুপ ক’রে বসে থাকে। ব্যর্থ অভিসারে শুধু চরণ ক্লান্ত ক’রে আর লাভ কি? অতনুতাপিত তনুর দুর্ধর তৃষ্ণা অধরে ধারণ ক’রে ঐ রক্তপাষাণের কাছে ছুটে যাবার আর কিবা প্রয়োজন? সুপ্রভা যেন কল্পনায় তার হতমান আকাঙক্ষার শোণিম বেদনার দিকে অমেয় মায়ায় অভিভূত নয়নের করুণা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, ব্যর্থ অভিসারে আহত তার যৌবনময় জীবন যেন অধঃপতিত জ্যোৎস্নার মত ধূলিপুঞ্জের উপর পড়ে রয়েছে।
এই অবহেলার ধূলিময় মালিন্য হতে মুক্ত হবার জন্য হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে সুপ্রভার মন। আকাশের শেষ তারকা নিভেছে, বনতরুশিরে প্রভাময় ঊষাভাস দেখা দিয়েছে। স্নিগ্ধ স্নানোদকের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে সুপ্রভার তাপিত দেহের তৃষ্ণা। লতাগৃহ হতে বের হয়ে আশ্ৰমতড়াগের নিকটে এসে দাঁড়ায় সুপ্রভা।
তড়াগসলিলে দেহ নিমজ্জিত ক’রে স্নান ক’রে সুপ্রভা। সুতনুকা সুপ্রভার অনাবরণ অঙ্গশোভা যেন মৃণালবন্ধনচ্যুত স্ফুট কোকনদের মত সলিলের শীতল সিক্ততায় লিপ্ত হয়ে তড়াগের বক্ষে হিল্লোলিত হতে থাকে। অকস্মাৎ চমকে ওঠে সুপ্রভা, বিস্ময়ে বিকশিত নূতন এক কৌতূহল দুই নেত্রে অপলক হয়ে তড়াগতটের পুষ্পময় বীথিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।
অরুণিত তটবীথিকায় অপরিচিত পথিকের মূর্তি দেখা যায়। একজন নয়, দুই জনও নয়, অনেক জন। একে একে আসে আর আশ্রমস্থলীর প্রাঙ্গণের দিকে চলে যায়। সুন্দরদর্শন এক এক জন ঋষিযুবা। দেখতে পায় সুপ্রভা, কোন আগন্তুকের কপোলমণ্ডল যেন ঊষালোকে লিপ্ত ঐ পূর্বাকাশের মত নবীনযৌবনরাগে উদ্ভাসিত। কোন জনের বিশাল বক্ষঃপটে রক্তচন্দনের আলিম্পন, যেন পুষ্পহাস শাল্মলীর কান্তিচ্ছটা রম্যতর আশ্রয় লাভের লোভে সেই উন্নতকায় ঋষিযুবার বক্ষের উপর এসে লুটিয়ে পড়েছে। ইন্দীবরবিনিন্দিত দুই নীলনিবিড় নয়নে কম্র কামনার কল্লোল, কে ঐ তরুণ ঋষি? কুসুমস্রগাসক্ত কণ্ঠ আর স্মিত দশনদ্যুতি নিয়ে চলে যায়, কে ঐ পুরুষপ্রবর, ঋতুরাজনীরাজিত রতিরাজোপম সুকান্ত?
সলিলহীন দেহের স্নানোৎসুক চাঞ্চল্য সংযত ক’রে তড়াগকমলের মৃণাল আলিঙ্গন ক’রে সুপ্রভা, যেন হিল্লোলিত কোকনদের প্রাণ এক আকস্মিক বিস্ময়ে বিবশ হয়ে গিয়েছে। কমলবনের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কমলাননা ঋষিকুমারী যেন সূর্যালোকিত এক স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে এক তৃষ্ণার কুসুম। কিংবা, সুপ্রভার সিত্তোজ্জ্বল ঐ দুই আভমেয় নয়ন যেন যামিনীচারিণী এক চক্রবাকীর চক্ষু, চন্দ্রালোকে লিপ্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে তার নিজেরই বক্ষের উষ্ণশ্বাসময় অথচ মধুরায়িত এক বেদনার উৎসব লক্ষ্য করছে। দুঃসহ এই বেদনা, স্ফুট কোকনদের সৌরভময় আকাঙক্ষার বক্ষে তৃষ্ণাকুল ঝঞ্ঝানিলের নিঃস্বন সঞ্চারিত হয়েছে।
অনেকক্ষণ সুপ্রভার দেহ-মন যেন এক অভিনব স্বপ্নের সলিলে নিমজ্জিত হয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ দেখতে পায় সুপ্রভা, তটবীথিকা জনহীন হয়ে গিয়েছে। নূতন এক বিস্ময় ও বিমুগ্ধতার ভার বক্ষে বহন ক’রে লতাগহের দিকে ফিরে যায় সুপ্রভা।
—প্রস্তুত হও কন্যা।
লতাগৃহের দ্বারোপান্তে এসে আর এক আকস্মিক রহস্যের আহ্বান শুনে চমকে ওঠে সুপ্রভা। প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন মহর্ষি বদান্য।
বদান্য বলেন—প্রস্তুত হও সুপ্রভা, তুমি আজ পতি বরণ ক’রে ধন্য হবে। এই প্রভাতের শুভক্ষণে তোমার জন্য স্বয়ংবরসভা আহূত হয়েছে। জ্ঞানী গুণী ও প্রিয়দর্শন বহু ঋষিযুবা আমার আহ্বানে আশ্রমোপবনে সমবেত হয়েছেন।
সুপ্রভার বিস্মিত ও বিমুগ্ধ নয়নের তৃষ্ণালস দৃষ্টি চকিত তড়িল্লেখার মত ক্ষণলাস্যে দীপ্ত হয়ে পরক্ষণে সলজ্জ ঘনপক্ষ্নভারে অবনত হয়। মহর্ষি বদান্যের নেত্রে বিচিত্র এক শ্লেষের ছায়া ফুটে ওঠে। সুপ্রভার উৎফুল্ল মুখের দিকে তাকিয়ে এই সত্যই দেখতে থাকেন বদান্য, আসক্তির কেতকীও কেমন ক’রে আর কত সহজে নিষ্ঠা হারায়। জয়ী হয়েছে মহর্ষির চিন্তার সেই রক্তপাষাণসদৃশ কঠিন তত্ত্ব, আসক্তি কখনও একনিষ্ঠা স্বীকার করে না।
কেতকীমালিকা হাতে তুলে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে সুপ্রভা। বনস্পতিময় উপবনের কাছে গিয়ে প্রিয়দেহ সন্ধানের জন্য আগ্রহের শিহর সহ্য করছে এক যৌবনবতীর দেহলতিকা। বনমৃগীর মত শুধু দেহজ অভিলাষের আবেশে জীবনসঙ্গী বরণ করবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছে এক ঋষিতনয়ার চিত্ত। দুঃখিত হন বদান্য। ঋষির আশ্রমের শিক্ষায় লালিত হয়েও প্রেম ও অপ্রেমের প্রভেদ অনুভব করবার মত মনের অধিকারিণী হতে পারেনি তাঁর কন্যা। মনোময়ী নয়, নিতান্ত নয়নময়ী। যার মুখ দেখে মুগ্ধ হয় নয়ন, তারই কণ্ঠে জীবনের বরমাল্য দান করে।
দুঃখিত হয়েও চিন্তার গভীরে একটি হর্ষের সঞ্চার অনুভব করছিলেন বদান্য। আসক্তি কখনও একনিষ্ঠা স্বীকার করে না, এই সত্য আজ স্বীকার করবে সুপ্রভা। সুপ্রভার জীবনের একটি মিথ্যা বিশ্বাসের মোহ সুপ্রভা আজ নিজের হাতেই চূর্ণ ক’রে দিতে চলেছে। আর সময় নেই, শুভলগ্ন উপস্থিত।
বদান্য বলে—এস কন্যা।
মরালীর মত মৃদুলগতি, অথচ নয়নে খঞ্জনবধূর চঞ্চলতা, সুপ্রভা ধীর-সঞ্চারিত চরণে মহর্ষি বদান্যের ছায়া অনুসরণ ক’রে স্বয়ংবরসভার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কেতকীমালিকার সুরভিত ও বিমুগ্ধ তৃষ্ণা তৃপ্তি লাভের জন্য নূতন এক জগতের দিকে চলেছে।
নীলবনের মায়াভবনের মণিদীপিত কক্ষে রত্নপর্যঙ্কের উপর নিদ্রাভিভূত ঋষি অষ্টাবক্র। বাহিরে নিবিড় সন্তামসী রাত্রির অন্ধকার। পিকরবের শেষ ঝংকারও ক্লান্ত হয়ে নীলবনের অন্ধকারে সুপ্তিময় স্তব্ধতার মধ্যে নীরব হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সুপ্ত অষ্টাবক্র যেন এক জ্যোৎস্নাময় উপবনের শোভা দেখছে, আর শুনছে মধুর পিকধ্বনির সঙ্গীত। বক্ষঃপুটে সঞ্চিত সকল কামনার পরাগ ধমনীধারায় উচ্ছলিত সকল অনুরাগের শোণিমা এবং নিঃশ্বাসে আকুলিত সকল তৃষ্ণার সমীর যেন তৃপ্তিরসরভসা এক অধরশোভাকে নিকটে পেয়েছে। দেখছে অষ্টাবক্র, চঞ্চল দক্ষিণসমীরের প্রবল কৌতুকে শিথিলিত হয়েছে এক নিবিড় নীবিতটের নীলাংশুক মেখলা। বহুলচিকুরচ্ছায়া ও বিপুলনয়নমায়ার এক উচ্ছ্বাসময়ী ছবি। সে নারীর পুষ্পহারের সলজ্জ শাসন দীর্ণ হয়ে গিয়েছে; এক অশান্তা অভিসারচারিণীর বক্ষোজ বাসনা যেন সুপীণ বিহ্বলতা উৎসারিত ক’রে উৎসবের উৎসর্গ হবার জন্য উৎসুক হয়ে অষ্টাবক্রের বুকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অষ্টাবক্রের স্বপ্নই সুরভিত হয়ে গিয়েছে। কি আশ্চর্য, সেই সুরভি যে এক কেতকীমালিকার সুরভি! অষ্টাবক্রেরে আকাঙক্ষার মহত্তমা তৃপ্তি! সেই তৃপ্তিকে বক্ষোলগ্ন করবার জন্য সাগ্রহে বাহু প্রসারিত করে অষ্টাবক্র। ভেঙ্গে যায় স্বপ্নের আবেশ, চমকে জেগে ওঠে অষ্টাবক্র।
সেই মুহূর্তে এক হাস্যধরার সুস্বর ঝংকার দিয়ে বেজে ওঠে।—আমি এসেছি ঋষি।
কে তুমি? বিস্ময়ে কম্পিকণ্ঠে অষ্টাবক্র প্রশ্ন ক’রেই দেখতে পায় রত্নপর্যঙ্কের উপর তারই বক্ষের সন্নিধানে এসে বসে রয়েছে উদীচী। বর্ষীয়সীর মূর্তি নয়, যৌবনরুচিরা ও সুচারুদেহিনী এক নবীনার নয়নমনোহারিণী মূর্তি। সেই ঝংকারমুখর মণিময় আভরণের ভার যেন ঝরে পড়ে গিয়েছে। তড়িল্লতার মত নিরাভরণা সুন্দর এক বহ্নির লতিকা অনাবরণ তরুণতনুর লাস্য স্ফুরিত ক’রে অষ্টাবক্রের বুকের কাছে এসে লুটিয়ে পড়েছে। যেন খরকামনার সুবর্ণকশা।
—তুমি উদীচী? অষ্টাবক্রের কণ্ঠস্বরে আহত স্বপ্নের বেদনা কম্পিত হতে থাকে।
—হ্যাঁ ঋষি, আমিই তোমার তুপ্তি। অষ্টাবক্রের মুখের দিকে নয়নকিরণ বর্ষণ করে নীলবনের মায়া দিয়ে রচিত কামনাময়ী তরুণী।
অষ্টাবক্র বলে—তুমি মিথ্যা বিশ্বাসে উদ্ভ্রান্ত হয়েছ, উদীচী। তুমি আমার তৃপ্তি হতে পার না।
উদীচীর খরনয়নের হর্ষ হঠাৎ আহত হয়।—সত্য স্বীকার কর ঋষি। তোমার ঐ তৃষ্ণাকাতর দুই চক্ষুর দৃষ্টি আমার এই দেহচ্ছবির দিকে নিবদ্ধ ক’রে বল দেখি, বিচলিত হয় না কি তোমার আসক্তিময় বক্ষের নিঃশ্বাস?
অষ্টাবক্র—বিচলিত হয়, অস্বীকার করি না।
উদীচী—মুগ্ধ হয় না কি?
অষ্টাবক্র—মুগ্ধ হয়, স্বীকার করি। কিন্তু আমার এই বিচলিত নিঃশ্বাসের শান্তি তুমি নও। আমার এই বিমুগ্ধ চিত্তের তৃপ্তি তুমি নও! আমার তৃপ্তি কেতকীরেণুপরিমলে সুরভিত হয়ে আমারই প্রতীক্ষায় এই জগতের এক আশ্ৰমস্থলীর লতাবৃত কুটীরের নিভৃতে রয়েছে।
উদীচী—কে সে?
অষ্টাবক্র—মহর্ষি বদান্যের কন্যা সুপ্রভা।
উদীচী—সে কি এই উদীচীর চেয়েও সুন্দরতর অধরের, মদিরতর ভ্রূভঙ্গের, আর খরতর নয়নপ্রভার নারী?
অষ্টাবক্র—না উদীচী, তবু এই সত্য তোমারই নীলবনঘন মায়ালোকের এই মণিদীপ্ত ভবনের কক্ষে, তোমারই সমাদরে কোমলীকৃত এই রত্নপর্যঙ্কে সুশয়ান এক স্বপ্নময় অনুভবের মধ্যে উপলব্ধি করেছি, সেই বদান্যকন্যা সুপ্রভাই আমার আকাঙক্ষার মহত্তমা তৃপ্তি!
উদীচীর দৃষ্টি যেন বহ্নি উৎসারিত করে।—আমি অতৃপ্তি?
অষ্টাবক্র—তুমি বান্ধবী।
অভাবিত বিস্ময়ে নম্র হয়ে যায় উদীচীর দৃষ্টি।—কি বললে ঋষি?
অষ্টাবক্র—তৃষ্ণাকে তৃষ্ণায়িত কর, বাসনাকে দাও বহ্নি, অয়ি কেলিকটাক্ষলক্ষ্মী তন্বী, তুমি মনোভৰভবনের খরদ্যুতিময়ী দীপ্তি। কামিজনচিত্ত কর পুলকিত বিপুল হর্ষে, তুমি ভ্রূভঙ্গীময়ী প্রীতি। অভিলাষে কর উল্লসিত, নিঃশ্বাসে দাও ঝাঞ্ঝা, তুমি মদবিলসিত উৎসব। তোমারই সমাদরে মদিরায়িত আমার স্বপ্ন কেতকীরেণুর সুরভি বক্ষে ধারণ করবার জন্য বাহু প্রসারিত করেছে। ব্যাকুল করেছ, বিহ্বল করে, আমার তৃষিত নয়নপথে তুমিই তাকে ডেকে এনে চিনিয়ে দিয়েছ, যে আমার আসক্তির উপাসনা, মহত্তমা তৃপ্তি, শ্রেয়সী। তুমি আমার বান্ধবী, অষ্টাবক্রের কৃতজ্ঞ অন্তরের শ্রদ্ধা গ্রহণ কর উদীচী।
উদীচীর দুই নয়নের পক্ষ্মপল্লবে যেন কুহেলিকাপীড়িত এক শীতসন্ধ্যার বেদনা শিশির সঞ্চারিত করে। উদীচী বলে—নীলবনলোকের এই চিরকুমারীকে যদি বান্ধবী বলে মনে ক’রে থাক ঋষি, তবে তাকে জীবনের চিরসঙ্গিনী ক’রে নাও। তোমাকে পতিরূপে বরণ করুক উদীচী।
অষ্টাবক্র—তা হয় না, ক্ষমা কর উদীচী।
উদীচীর কণ্ঠস্বর তীব্র আর্তনাদের মত বেজে ওঠে—তোমার আসক্তিময় বক্ষের কঠিন নিষ্ঠার নিষ্ঠুরতা অন্তত এই মুহূর্তে বর্জন কর ঋষি। আমাকে ক্ষণকালের প্রেয়সীরূপে গ্রহণ কর। তার পরে চলে যেও যেথা চায় তোমার আকাঙক্ষা, আশ্রমবাসিনী সেই সুপ্রভাময়ী এক অমেয় মায়ার পূর্ণিমার কাছে।
অষ্টাবক্র—অসম্ভব, ক্ষমা কর, বিদায় দাও বান্ধবী।
—যাও! জ্বালাধ্বনির মত তীব্রস্বরে ধিক্কার দিয়ে সরে যায় খরকামনার সুবর্ণকশা।
নীরবে এবং মাথা নত ক’রে চলেই যাচ্ছিল অষ্টাবক্র। কক্ষের অবারিত দ্বারের প্রান্তে এসে দাঁড়াতেই, পিছন হতে যেন চমকে ওঠে একটি অনুরোধ।—একবার থাম ঋষি।
দেখে বিস্ময় অনুভব করে অষ্টাবক্র, দাঁড়িয়ে আছে উদীচী, এক শান্তা স্নিগ্ধা স্মিতরুদিতার মূর্তি। প্রখর প্রগ্লভা অলজ্জার মূর্তি নয়, যেন হিমবায়ুলাঞ্ছিতা এক বনলতিকা। নতমুখিনী উদীচীর কপোলে অশ্রুসলিলের রেখা। যেন অমল ধারাসলিলে গলে গিয়েছে সেই কজ্জলমসিমদির ভ্রূভঙ্গী।
অষ্টাবক্রের বিস্ময়কেই বিস্মিত ক’রে হেসে ওঠে উদীচী। —ব্যথিত হয়ো না ঋষি, উদীচীর এই নয়নবারি বেদনার অশ্রু নয়, আনন্দের অশ্রু।
অষ্টাবক্র—আনন্দ?
উদীচী—হ্যাঁ ঋষি, নিষ্ঠায় সুন্দর এক আসক্তির কাছে জীবনে এই প্রথম পরাভূত হয়েছে নীলবনলোকের এক লালসাময়ীর অনিষ্ঠা। আমি তোমার পরীক্ষা।
অষ্টাবক্র—তুমি আমার শিক্ষা।
উদীচী—জয়ী তুমি।
অষ্টাবক্র—জয়দাত্রী তুমি।
জাগ্রত বিহগের ক্ষীণস্ফূট কলরব শোনা যায়। শেষ হয়েছে সন্তামসী রাত্রি। কক্ষের অবারিত দ্বারপথ অতিক্রম ক’রে বনপথের উপরে এসে দাঁড়ায় অষ্টাবক্র; এবং দূর দক্ষিণের গগনবলয়ের দিকে নেত্র সম্পাত ক’রে পথ অতিক্রম করতে থাকে।
কার কণ্ঠে মাল্য দান করবে সুপ্রভা? শত প্রিয়দর্শনের মধ্যে প্রিয়তম বলে মনে হয় কার মুখ? কার কণ্ঠালগ্ন হলে তৃপ্ত হবে সুপ্রভার কেতকীমালিকার সুরভিত স্পৃহা?
শুভক্ষণ উপস্থিত। স্বয়ংবরসভায় পাণিপ্রার্থী বহু ঋষিযুবার সমাবেশ। যেন শত তরুণ তরুবরের বরতনুশোভায় বিনোদিত বাসন্ত প্রভাতের এক উপবন। সুপ্রভার কেতকীমালিকার সুরভিত স্পর্শ কণ্ঠসক্ত করবার জন্য বিচলিত চিত্তের আগ্রহ সহ্য করছে প্রবল পৌরুষে পেশল শত অভিলাষ। সেই শোভার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় বদান্যকন্যা সুপ্রভার নেত্রোত্থিত হর্ষ।
তবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুপ্রভা। তার মুগ্ধ নয়নের দৃষ্টি যেন হঠাৎ এক স্বপ্নের আবেশে অন্য জগতে চলে গিয়েছে। সুপ্রভার কবরী কপোল আর অধরের উপর যেন কুঙ্কুমবাসিত একটি বক্ষ হতে তরঙ্গিত বাসনার নিঃশ্বাস এসে লুটিয়ে পড়ছে; সুপ্রভার স্বপ্নের বক্ষে মৃগমদামোদিত কুঙ্কুমের উৎসব ঝরে পড়ছে: কেতকীমালিকার উৎসারিত পিপাসার সুরভি তার পরমা তৃপ্তির আধার এক বক্ষের পৌরুষোচ্ছল স্পর্শ নিকটে পেয়েছে। অষ্টাবক্র, আর কেউ নয়, মল্লিকাপুলকিত ধম্মিল্লের গুরুগৌরবে গরীয়ান্ সেই অষ্টাবক্রের মূর্তি যেন ঋজুকান্ত বনস্পতির মত কামনাবিধুরা এক মাধবীলতিকার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এই তো সুপ্রভার যৌবনের সকল আকাঙক্ষার উপাস্য, শ্রেষ্ঠ তৃপ্তি। সেই তৃপ্তির কণ্ঠে বরমাল্য অর্পণের জন্য সাগ্রহে বাহু প্রসারিত করে সুপ্রভা। ভেঙ্গে যায় স্বপ্নময় আবেশ। স্বয়ংবরসভা হতে ছুটে চলে যায় সুপ্রভা, দাবানলভীতা মৃগবধূ যেমন কাননের লতাজাল ছিন্ন ক’রে ছুটে যায়।
লতাগৃহের নিভৃতে ফিরে এসে কেতকীমালিকার উপর অশ্রুসিক্ত নয়নের চুম্বন অঙ্কিত ক’রে ক্ষণোদ্ভ্রান্ত নয়নের জ্বালা শান্ত করতে চেষ্টা ক’রে সুপ্রভা। কিন্তু হঠাৎ বাধায় ব্যথিতভাবে চমকে ওঠে। শান্ত লতাগৃহের নীরবতা চূর্ণ ক’রে দিয়ে মহর্ষি বদান্যের ভর্ৎসনা গর্জিত হয়।—এ কেমন আচরণ সুপ্রভা? আমারই ইচ্ছায় আহূত স্বয়ংবরসভাকে কেন তুমি এইভাবে অপমানিত করলে, রীতিদ্রোহিণী কন্যা?
সুপ্রভা—ক্ষমা করুন পিতা, আমার জীবনে স্বয়ংবরসভার কোন প্রয়োজন নেই।
বদান্য—কেন?
সুপ্রভা—আমার কেতকীমালিকা জানে, কে আমার জীবনের সহচর হলে সবচেয়ে বেশি সুখী হবে আমার জীবন।
বদান্য—কে সে?
সুপ্রভা—আপনি জানেন পিতা, তার নাম অষ্টাবক্র।
তবু তারই নাম! বিস্মিত বদান্যের চিরকালের বিশ্বাসের সেই কঠিন তত্ত্বের গর্ব যেন কুলিশকঠোর একটি আঘাতে শিহরিত হতে থাকে। সেই অষ্টাবক্রের নাম উচ্চারণ করছে সুপ্রভা। নিতান্তই দেহজ অভিলাষে ব্যাকুল এক কেতকীমালিকার সৌরভে কি এত নিষ্ঠার গৌরব থাকতে পারে?
বদান্যের ভর্ৎসনাময় ভ্রূকুটি হঠাৎ হেসে ওঠে। জানে না সুপ্রভা, তার কেতকীমালিকার কামনার আস্পদ সেই অষ্টাবক্রের আসক্তির নিষ্ঠা যে এতক্ষণে নীলবনচারিণী এক লালসাময়ীর ঘনমসিময় ভ্রূভঙ্গের আঘাতে চূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কল্পনাও করতে পারে না সুপ্রভা, কেতকীমালিকার আশা মিথ্যা হয়ে এক দুঃস্বপ্নের জগতে মিলিয়ে গিয়েছে। সুপ্রভার কামনার এই নিষ্ঠা নিষ্ঠাই নয়, কঠিন মোহ মাত্র। সত্য অবহিত হলে এই কঠিন মোহ এখনি আর্তনাদ ক’রে ভেঙ্গে যাবে।
বদান্য বলেন—শোন কন্যা, তোমার মোহবিমূঢ় নয়নতৃষ্ণার বাঞ্ছিত সেই অষ্টাবক্র এক বর্ষীয়সী স্বৈরিণীর বিলাসলীলার বান্ধব হয়ে উত্তর দিগ্ভূমির নীলবনের নিভৃতে এক মায়াভবনের কক্ষে দিবস ও রাত্রি যাপন করছে। সে আর ফিরে আসবে না, ফিরে আসবার সাধ্য তার নেই।
—পিতা! সুপ্রভার কণ্ঠ ভেদ ক’রে করুণ আর্তনাদ উৎসারিত হয়, যেন অকস্মাৎ এক কিরাতের বিষয়ক ছুটে এসে বনমৃগীর হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ করেছে।
পর মুহূর্তে, বনমৃগীর বাষ্পমেদুরিত করুণ নয়নের দৃষ্টি স্মিতহাস্যে উদ্ভাসিত হয়, এবং মহর্ষি বদান্যের ভ্রূকুটি অকস্মাৎ এক বিস্ময়ের আঘাতে যেন নীরবে আর্তনাদ ক’রে ওঠে। লতাগৃহের দ্বারোপান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এক আগন্তুক, মস্তকে মল্লিকামোদিত ধম্মিল্লের সেই উদ্ধত শোভা অনাহত, তরুণ ঋষি অষ্টাবক্র।
অষ্টাবক্রের স্মিতোৎফুল্ল মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় দুই অপলক চক্ষু তুলে সত্যই দেখতে থাকেন বদান্য, তাঁর এতদিনের বিশ্বাসের কঠিন তত্ত্ব মিথ্যা হয়ে গিয়েছে। সত্যই জয়ী হয়ে ফিরে আসতে পেরেছে আসক্তির গর্ব। সত্যই পরাভূত হয়েছে নীলবনের সন্তামসী রাত্রির মসি। সত্যই তপস্বীর তপস্যার মত অবিচল নিষ্ঠায় কঠিন এই আসক্তি। সত্যই সুন্দর এই আসক্তি। কিন্তু…।
কিন্তু এই আসক্তি কি সত্যই প্রণয়ের প্রথম সঙ্কেত, পতিপত্নী সম্বন্ধের প্রথম হেতু, মিলনের প্রথম গ্রন্থি? মহর্ষি বদান্যের নেত্রে আর একটি কঠিন প্রতিজ্ঞার ছায়া দেখা যায়। যেন শেষবারের মত নির্মমতম এক পরীক্ষায় তাঁর এতদিনের বিশ্বাসের বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে দেখতে ইচ্ছা করছেন বদান্য, সে বিশ্বাস সত্য না মিথ্যা। জানতে ইচ্ছা করছে, দেহজ অভিলাষের সৌরভের মত ঐ আসক্তির বক্ষে কোন সত্যের গৌরব আছে কি না আছে।
মহর্ষি বদান্য বলেন—স্বীকার করি অষ্টাবক্র, সুপ্রভার পাণি গ্রহণের অধিকার তুমি পেয়েছ। এবং আমার প্রতিশ্রুতিও স্মরণ করি। সুপ্রভাকে তোমার কাছে এই ক্ষণে সম্প্রদান করতে চাই।
সুপ্রভা ও অষ্টাবরে নয়নে স্নিগ্ধ এক হর্ষের জ্যোৎস্না ফুটে ওঠে। মহর্ষি বদান্যের সম্মুখে এগিয়ে আসে প্রীতিভারে বিনত দু’টি মূর্তি।
মহর্ষি বদান্য বলেন—কিন্তু তোমারই আর একটি প্রতিশ্রুতির কথা তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, অষ্টাবক্র।
অষ্টাবক্র—বলুন মহর্ষি।
বদান্য—তোমরা আমার মন্ত্রসংস্কারে পরিণীত হবার পর আমার আশীর্বাদ গ্রহণ ক’রে ধন্য হবে।
অষ্টাবক্র—অবশ্যই গ্রহণ করব, এবং ধন্য হব মহর্ষি।
বদান্য—কল্পনা করতে পার, কি আশীর্বাদ আমি দান করতে চাই?
অষ্টাবক্র—পারি না মহর্ষি।
বদান্য—আমি এই আশীর্বাদ দিতে চাই, তোমাদের দেহ মন ও প্রাণ হতে আসক্তির শেষ লেশও লুপ্ত হয়ে যাক। বল, প্রস্তুত আছ, গ্রহণ করবে এই আশীর্বাদ?
—মহর্ষি! অষ্টাবক্রের কণ্ঠে অভিশাপভীরু শঙ্কিতের সন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বর শিহরিত হয়। শিহরিত হয় সুপ্রভার শান্ত কবরীভার, যেন তার সীমন্তের উপর দংশন দানের জন্য ফণা উদ্যত করেছে এক দুর্ভাগ্যের ভুজঙ্গ।
বদান্য বলেন—প্রতিশ্রুতির অবমাননা করতে চাও অষ্টাবক্র?
অষ্টাবক্র—চাই না মহর্ষি, কিন্তু এ কেমন আশীর্বাদ? আপনি ভুল ক’রে আশীর্বাদের নামে অভিশাপ দান করতে চাইছেন। আপনার কাছ থেকে অভিশাপ গ্রহণ করব, এমন প্রতিশ্রুতি আমি আপনাকে দান করিনি মহর্ষি।
বদান্য—তুমি বুঝতে ভুল করছ, অষ্টাবক্র।
অষ্টাবক্র—আমার ভুল বুঝতে পারছি না মহর্ষি। আমি জানি অপরের জীবনে সুখ ও কল্যাণ আহ্বান করে যে বাণী, সেই বাণীই হলো আশীর্বাণী। কারও জীবনকে অসুখী করবার জন্য যে বাণী উচ্চারিত হয়, সে বাণী আশীর্বাণী নয়।
বদান্য—আমার এই আশীর্বাণীও তোমাদের জীবনকে সুখী করবার জন্য শুভ ইচ্ছার বাণী। তোমাদের জীবনে আসক্তি থাকবে না, তার জন্য অসুখী হবে না তোমাদের জীবন। তৃষ্ণা না থাকলে তৃষ্ণাহীনতার জন্য কেউ দুঃখ অনুভব করে না, অষ্টাবক্র। ইচ্ছা না থাকলে অক্ষমতার ব্যথা কেউ বোধ করে না। অননুভূত অভিলাষ কখনও অতৃপ্তির ক্লেশ সৃষ্টি করে না। আসক্তিহীন জীবন সুখেরই জীবন।
অষ্টাবক্র—কল্পনা করতে পারি না মহর্ষি, সে কেমন সুখের জীবন।
বদান্য—জলমীনের মনে মহাকাশের জন্য কোন আকাঙক্ষা নেই, যেহেতু মহাকাশের নীলিমা তার অনুভবে নেই। বনমধুকরের প্রাণে সুলোকের পারিজাতের জন্য কোন তৃষ্ণার গুঞ্জরণ নেই, যেহেতু সে পারিজাত তার অনুভবে নেই। অরণ্যমৃগের মনে সমুদ্রস্নানের জন্য কোন ক্ৰন্দন নেই, যেহেতু সলিলোচ্ছল সমুদ্রের রূপ তার স্বপ্নের অনুভবে ও কল্পনায় নেই। যার জন্য আসক্তি নেই, তার অভাবের জন্য অতৃপ্তিও নেই। আসক্তিহীন এই জীবন এক বেদনাহীন সুখের জীবন। বিশ্বাস করতে পারছ কি অষ্টাবক্র?
অষ্টাবক্র—বিশ্বাস করছি।
বদান্য—তবে আমার আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হও অষ্টাবক্র, দেহ মন ও প্রাণ হতে আসক্তিকে চিরজীবনের মত বিদায় দান করবার জন্য প্রস্তুত হও।
অষ্টাবক্র—কেন মহর্ষি? আপনি তো আজ এই সত্যের প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছেন যে, আসক্তিও নিষ্ঠায় সুন্দর হতে পারে।
বদান্য—আসক্তি সুন্দর হলেই বা কি আসে যায় অষ্টাবক্র? বিষসলিল স্নিগ্ধ হলেই বা কি? সে সলিল প্রাণের পানীয় হতে পারে না। খলপাবক হেমবর্ণ হলেই বা কি? সে পাবক গৃহদীপের আলোক হতে পারে না। মরুসমীর উচ্ছ্বসিত হলেই বা কি? সে সমীর নিকুঞ্জের হরিন্ময় আনন্দের বান্ধব হতে পারে না।
অষ্টাবক্র ও সুপ্রভার জীবন, পরিণয়োৎসুক দুই সুন্দর বাসনা যেন আসন্ন এক শুভ বাসকোৎসবের দিকে তাকিয়ে চিতানলের উৎসব দেখতে থাকে। দুর্বহ অঙ্গীকারের বন্ধনে আবদ্ধ দুই অসহায়ের মূর্তি। বদান্য প্রশ্ন করেন।—নিরুত্তর কেন অষ্টাবক্র? বল, কি তোমার ইচ্ছা?
অষ্টাবক্র ও সুপ্রভা পরস্পরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, অপলক স্নেহে অভিষিক্ত দু’টি দৃষ্টি। অষ্টাবক্র যেন তার জীবনের আলিঙ্গন হতে স্খলিত এক কেতকীরেণু-বাসিত স্বর্গের দিকে মায়াময় নেত্রে তাকিয়ে আছে। সুপ্রভার নয়নের শিশিরেও সেই অমেয় মায়ার সুষমা অভিনব এক মদিরতায় আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। অষ্টাবক্রের কুঙ্কুমপিঞ্জরিত বক্ষের উপর অলক্ষ্য চুম্বনধারার মত ঝরে পড়ে সুপ্রভার সিক্ত নয়নের দৃষ্টি। আসন্ন এক মৃত্যুর বজ্রনাদ শুনতে পেয়েছে, তাই যেন শেষবারের মত ভালবেসে বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত হয় এক কুঙ্কুম আর কেতকীর আসক্তি।
মৃত্যু হবে আসক্তির, সত্য হবে শুধু মিলন, অদ্ভুত এই আশীর্বাদ সহ্য করবার জন্য হৃদয় কঠিন করতে চেষ্টা করে নবীন রসালসম যৌবনধর অষ্টাবক্র, চেষ্টা করে উপবনের সমীরপ্রিয়া লতিকার মত সরসতনুকা সুপ্রভা। কিন্তু পারে না।
বদান্যের আশীর্বাদ যেন দক্ষিণ পবনের বড় হতে চন্দনগন্ধভার কেড়ে নিয়ে চায়। প্রজাপতির পক্ষ্মপতাকায় বর্ণায়িত আলিম্পন থাকবে না? গোধূলি হারাবে আভা? আকাশ হারাবে নীলিমা, পুষ্প হারাবে সৌরভ, সমুদ্র হারাবে তরঙ্গ, যৌবন হারাবে আসক্তি? আসক্তিহীন সেই মিলন যে দুই নিঃস্ব রিক্ত চলকঙ্কালের বেদনাহীন সুখের মিলন। সে মিলন মিলনই নয়, সে জীবন জীবনই নয়, আসক্তিহীন সেই মিলনের বেদনাহীন সুখ এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করা যাবে না। তার চেয়ে মুত্যু শ্রেয়।
সুপ্রভার সেই দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারে অষ্টাবক্র, এবং অষ্টাবরে সেই দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারে সুপ্রভা। সুস্মিত হয়ে ওঠে উভয়ের ক্ষণবিষাদমেদুর নয়নের দৃষ্টি, সে দৃষ্টি নূতন এক সংকল্পের আলোকে উদ্ভাসিত।
অষ্টাবক্র বলে—আপনিও একটি প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করুন মহর্ষি। বলুন, আপনার মন্ত্রসংস্কারের পুণ্যে পরিণীত আমাদের জীবনে আপনার ঐ আশীর্বাদ দানের পর আপনি আমাদের প্রার্থিত বর প্রদান করবেন।
বদান্য—হ্যাঁ, মনে আছে। বল, কি বর প্রার্থনা করতে চাও তোমরা?
অষ্টাবক্র—আপনার আশীর্বাণী ধ্বনিত হবার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমাদের মৃত্যু হয়, এই বর পেতে চাই মহর্ষি।
চিৎকার ক’রে ওঠেন মহর্ষি বদান্য।—মৃত্যু চাও তোমরা?
অষ্টাবক্র—হ্যাঁ, মহর্ষি।
নীরব, স্তব্ধ, শিলীভূত বৃক্ষের মত সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বদান্য, যেন এইবার তাঁর সেই বিশ্বাসের হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আর, আসক্তির গৌরব ঘোষণা ক’রে তাঁরই সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে মিলনোৎসুক কেতকী আর কুঙ্কুমের অপরাভূত দুই সংকল্প।
মহর্ষি বদান্যের দুই চক্ষুর কঠিন দৃষ্টি হঠাৎ বাষ্পসারে প্লাবিত হয়। সুপ্রভার কণ্ঠস্বর ব্যথিতভাবে চমকে ওঠে।—পিতা?
বিস্মিত অষ্টাবক্র ডাকে।—এ কি মহর্ষি?
মহর্ষি বদান্য বলেন—নির্মম পরীক্ষার প্রাণ আনন্দে গলে গিয়েছে অষ্টাবক্র, এই অশ্রু আনন্দেরই অশ্রু। স্বীকার করি সুপ্রভা, তোমাদের সুন্দর আসক্তিই সত্য। স্বীকার করি অষ্টাবক্র, আসক্তিই এই মর্ত্যের মানব ও মানবীর মিলিত জীবনের মালিকা, প্রকৃত বন্ধনের প্রথম গ্রন্থি।
সস্নেহ আগ্রহে সুপ্রভা ও অষ্টাবক্রের দুই পাণি সমন্বিত ক’রে মন্ত্র পাঠ করেন মহর্ষি বদান্য। তার পরেই আশীর্বাণী উচ্চারণ করেন। —কুঙ্কুম ও কেতকীর জীবন চিরসুখী হোক।
অষ্টাবক্র—বর প্রদান করুন মহর্ষি।
বদান্য—বল, কি বর চাও?
অষ্টাবক্র—চাই আপনার পদধূলির স্পর্শ।
মহর্ষি বদান্যের চরণ স্পর্শ ক’রে প্রণাম ক’রে অষ্টাবক্র ও সুপ্রভা। অষ্টাবক্র ও সুপ্রভার শির চুম্বন করেন মহর্ষি বদান্য।