দেবশর্মা ও রুচি

পাষাণের প্রাচীর দিয়ে নয়, শুধু পর্ণতরুর ছায়া আর শ্যামলতা দিয়ে বেষ্টিত এক সুন্দর গৃহনীড়। তবু দেবশর্মার এই সুন্দর গৃহনীড় ঋষিপত্নী রুচির কাছে কারাগারের মত দুঃসহ মনে হয়। এক বনমৃগীর উদ্দাম স্বপ্নকে যেন এখানে খর কন্টকশরের প্রাকার দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রুচি মনে ক’রে, ছায়াময় গৃহনীড় নয়, দেবশর্মার এই সংসার যেন ক্ষুদ্র এক মরুখণ্ড; শুধু জ্বালা আর উত্তাপ। নেই সজল বর্ষণ, নেই গোধূলি, নেই জ্যোৎস্না, নেই কুহেলিকার সুখ-মন্থর তন্দ্রা। বৃথা এই স্বর্ণবর্ণ কেতকীর সৌরভবিলাস; বৃথা মেঘমেদুর মধ্যাহ্নের এই নীপরজ ও নবজলকণার উৎসব। সন্ধ্যার মল্লিকা ফোটে অকারণে, শালনির্যাসের গন্ধভারে মন্থরিত, প্রভাতবায়ু বৃথা ছুটাছুটি করে। ব্যর্থ জীবন, ব্যর্থ যৌবন। প্রতি মুহূর্তের অনাদরে সুন্দরাঙ্গনা রুচির যৌবনের অনঙ্গমাধুরী এখানে যেন অবমানিত হয়। প্রতি মুহূর্তে মরুজ্বালায় এক তরুণী নারীর শত কামনার পুষ্পদল শুকিয়ে আর পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। দুঃসহ এই নিষ্ঠুর বন্ধন। মুক্তি খোঁজে রুচি।

স্বামীকে ভালবাসতে পারেনি রুচি। কেন ভালবাসবে, তার কারণও খুঁজে পায় না। দেবশর্মার এই ক্ষুদ্র গৃহনিকেতনের বাহিরে কত তরুণের মুগ্ধচক্ষুর দৃষ্টি তাকে অভ্যর্থনা করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, সেকথা জানে রুচি। রূপোত্তমা নামে এত বড় লোকখ্যাতি লাভ করেছে যে নারী, শ্রেষ্ঠ রূপবানের পাশে তার জীবনের স্থান হওয়া উচিত। এই ধারণা শুধু রূপস্তাবক লোকসমাজের ধারণা নয়। রুচি নিজেও মর্মে মর্মে বিশ্বাস ক’রে এই সত্য। এরই নাম বুঝি ইন্দ্ৰমায়া।

হ্যাঁ, রুচির হৃদয় ইন্দ্ৰমায়ায় অভিভূত হয়েছে। জীবনের কামনাকে ক্রীতদাসীর মত দেবশর্মা নামে ওই রূপযৌবনহীন এক অকিঞ্চন পুরুষের পদপ্রান্তে অবনত ক’রে রাখতে চায় না রুচি। এই জীবন হবে চির অভিসারের এক অবারিত উল্লাসের বীথিকা, যার প্রতি ছায়াকুঞ্জের অভ্যর্থনায় তরুণী নারীর প্রাণ নিত্য নবতর মিলন অন্বেষণ করে ফিরবে! প্রেমের জীবন হবে অবিরল উৎসবের মত। প্রেমের জীবনে বন্ধন বলে যদি কিছু থাকে, সে বন্ধন হবে কুসুম-মালিকার সূত্রের মত; এবং কুসুম হবে সেই কুসুম, পুষ্পধন্বার তূণীর হতে বিহ্বল কামনার পরাগ নিয়ে ছুটে যায় আর লুটিয়ে পড়ে যে কুসুম, এই জগতের যৌবনান্বিত সকল প্রাণের উপর।

 

 

তাই, মুক্তি খোঁজে রুচি। উটজদ্বারের কাছে এক সপ্তপর্ণীর অঙ্গে অঙ্গভার সঁপে দিয়ে যেন কারও প্রতীক্ষায় দূর পথপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে থাকে রুচি।

এই প্রতীক্ষার অর্থ জানেন দেবশর্মা। পরপ্রণয়িনী রুচির অন্তরাত্মা কেন এই পথের ধ্যানে ডুবে রয়েছে, তার রহস্য দেবশর্মার কাছে অজানা নয়। প্রভাতের কুহেলিকার অন্তরালে এই পথে এক সুন্দরদর্শন প্রণয়ী ক্ষণকালের মত দেখা দিয়ে সরে যায়। স্মিত জ্যোৎস্নার ধারাস্নাত রজনীর প্রতি প্রহরে এই পথেই তার পদধ্বনি শোনা যায়; কিন্তু তাকে দেখা যায় না। এক অশরীরী প্রলোভ যেন অস্থির হয়ে কাকে অন্বেষণ ক’রে ফিরছে। কত ছদ্মরূপে সে মায়াবী আসে আর যায়। ঐ নবকাশ বনে তাকে দেখা যায়, শ্বেতবাসে সজ্জিত তার অঙ্গ, দূর সপ্তপর্ণীতলে সুচিত্রিত এক নারীর মূর্তির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেবশর্মা তাকে চেনেন, তার নাম পুরন্দর। তারই অনুরাগে প্রতিমুহূর্ত উন্মনা হয়ে আছে রুচি।

ক্ষমা করতে পারেননি দেবশর্মা। ইন্দ্ৰমায়ায় চঞ্চল এই প্রগল্ভ-যৌবনা নারীকে সতর্কতার এক পাষাণ প্রাচীর দিয়ে কঠোরভাবে বন্দী ক’রে রাখতে চান। প্রত্যেক মুহূর্তের উপর যেন শাসন স্থাপিত ক’রে রেখেছেন দেবশর্মা। সুযোগ পায় না মায়াবী পুরন্দর, সুযোগ পায় না রুচি।

বনমৃগীর এই উদ্দাম স্বপ্নকে এত সতর্কতা দিয়ে বেঁধে রাখবার প্রয়োজন কি? মক্ত ক’রে দিলেই তো পারেন দেবশর্মা। কিন্তু পারেন না, মন চায় না। তাঁর স্বামিত্বের অধিকার চরম ঘৃণায় তুচ্ছ ক’রে দিয়েছে রুচি, কিন্তু হেরে গিয়েও যেন হার মানতে চান না দেবশর্মা। পুরন্দরের লালসার অভিসন্ধি প্রতিরোধ করবার জন্য কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছেন।

সপ্তপর্ণীর ছায়াতলে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না রুচি! দেবশর্মার কঠোর আহ্বানে কুটীরের অভ্যন্তরে চলে যেতে হয়। কখনও বা সরোবরের সোপানের উপর বসে হিল্লোলিত রক্তকোকনদের দিকে তাকিয়ে থাকে রুচি। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, দেবশর্মা এসে বাধা দেন আর ডেকে নিয়ে যান। মধ্যনিশীথে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় সুপ্তোত্থিত রুচি মুক্তকপাট বাতায়নের নিকট এসে দাঁড়ায়। দেবশর্মা এসে বাতায়ন রুদ্ধ ক’রে দিয়ে চলে যান।

 

 

রুচির অন্তরাত্মায় বিদ্রোহ জাগে। মুছে ফেলে অঙ্গরাগ, কবরীমাল্য দূরে নিক্ষেপ ক’রে। যেন নির্মম আক্রোশের বশে এক রূপের লতিকা নিজ দেহেরই উপর কন্টকক্ষত বর্ষণ ক’রে। তবু বিচলিত হন না দেবশর্মা।

কিন্তু মাঝে মাঝে যেন অবসন্ন হয়ে পড়েন দেবশর্মা। বড় অর্থহীন এই সংগ্রাম। রুচি তাঁকে ভালবাসে না, ভালবাসবে না, ভালবাসতে পারে না; কারণ প্রেমকে রূপযৌবনের উৎসব বলে মনে করেছে রুচি। তৃপ্ত কামনার সুখময় বন্ধন ছাড়া পুরুষের কাছে আর কোন বন্ধন স্বীকার করতে চায় না এই নারী।

গর্ব করবার মত রূপ নেই, যৌবনও নেই দেবশর্মার; তবু রুচি নামে এই বিপুলযৌবনা নারীকে কেন যেন ভাল লাগে। আশ্চর্য হন দেবশর্মা, তাঁর নিজেরই মনের এই রহস্য বুঝে উঠতে পারেন না। তাই বোধহয় হেরে গিয়েও হার মানতে চান না। রুচি মুক্তি খুঁজলেও তিনি মুক্তি দিতে পারেন না।

যজ্ঞের নিমন্ত্রণে একটি দিনের মত দূরস্থানে যেতে হবে, বিমর্ষ হয়ে বসেছিলেন আর ভাবছিলেন দেবশর্মা। প্রতি মুহূর্ত শুধু এক পরপ্রেমিকা নারীর প্রতিটি আকুলতাকে বাধা দিয়ে অর্থহীন জীবনের অনেক দিন কেটে গিয়েছে। বড় জ্বালা ও বড় বেশি অপমানে ভরা অনেকগুলি দিন। তবু আজ বাহিরে যাবার লগ্নক্ষণের আসন্নতায় তাঁর সমস্ত অন্তর বেদনায় ভরে উঠেছে। মনে হয়েছে দেবশর্মার, ফিরে এসে এই জ্বালাভরা দিনগুলিকেও আর ফিরে পাবেন না। মুক্তির সুযোগ পেয়ে যাবে রুচি। বনমৃগীর উদ্দাম স্বপ্ন অবাধ আনন্দে এই আশ্রমের শান্ত ও শ্যামল ছায়ার সব দুর্বল বাধা ছিন্ন ক’রে চলে যাবে। সার্থক হবে রুচির ইন্দ্ৰমায়া, সফল হবে পুরন্দরের অভিসার।

অনেকক্ষণ ধ’রে নিবিড় চিন্তার মধ্যে যেন একটি পথ খুঁজতে থাকেন দেবশর্মা। চলে যাবার সময়ও নিকট হয়ে আসছে। দেবশর্মা ব্যস্তভাবে ডাকলেন—বিপুল!

 

 

উপাধ্যায়ের এই ব্যস্ত আহ্বান শুনতে পেয়ে পাঠগৃহ থেকে অধ্যয়নরত শিষ্য বিপুল সম্মুখে এসে দাঁড়ায়।

দেবশর্মা বলেন—মাত্র একটি দিনের জন্য যজ্ঞের নিমন্ত্রণে আমাকে দূরস্থানে যেতে হবে, বিপুল। কিন্তু যেতে মন চাইছে না।

দেবশর্মার কণ্ঠস্বরে বড় বেশি বেদনার সুর ছিল। বিপুলও সমবেদনার সুরে প্রশ্ন করে—কেন গুরু?

চুপ ক’রে থাকেন দেবশর্মা। যেন বহু দ্বিধা ও লজ্জার মধ্যে তাঁর মুখের ভাষা পথ হারিয়ে ফেলেছে। বিপুলের সাগ্রহ এবং বারংবার অনুনয়ে মনের ভার একটু লঘু হয়ে ওঠে। দেবশর্মা বলেন—তোমার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে বিপুল।

—অনুরোধ নয় গুরু, বলুন নির্দেশ।

—প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বিপুল, আমার সেই নির্দেশ তুমি পালন করবে।

—সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও পালন করব গুরু।

দেবশর্মা শান্তভাবে বলেন—তুমি জান, রুচি আমাকে ভালবাসে না?

চমকে ওঠে বিপুল—না গুরু, এই প্রথম শুনলাম।

দেবশর্মা—তুমি জান, ইন্দ্ৰমায়ায় পড়েছে রুচি, পুরন্দরকে সে ভালবাসে?

ব্যথিতভাবে তাকিয়ে থাকে বিপুল, গুরুর এই অপমানের জ্বালা শিষ্যের অন্তরেও যেন বেদনা সৃষ্টি করে।—এই প্রথম জানলাম।

 

 

দেবশর্মা—পুরন্দরের প্রতীক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে আছে রুচির মনের সর্বক্ষণের ভাবনা। আমি সেই পথে পাষাণপ্রাচীরের মত শুধু বাধা তুলে দিয়ে বসে আছি। জানি না, কেন তা’কে এত বাধা দিই, কেন এত কঠোর বন্ধনে তা’কে রুদ্ধ ক’রে রাখি।

কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থেকে দেবশর্মা আবার ধীরস্বরে বলতে থাকেন—কিন্তু, আজ আমাকে দূরস্থানে যেতে হবে। ফিরে এসে এই গৃহে আর যে রুচিকে দেখতে পাব, বিশ্বাস হয় না বিপুল।

বিপুল—আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম গুরু, আপনি যতদিন না ফিরে আসেন, কোন পুরন্দরের ইন্দ্ৰমায়া আমার গুরুপত্নীর দেহ স্পর্শ করতে পারবে না।

দেবশর্মাকে প্রণাম ক’রে উঠে দাঁড়ায় বিপুল। দেবশর্মা চলে যান।

রুদ্ধ হলো বিপুলের পাঠগৃহের দ্বার, ক্ষান্ত হলো অধ্যয়ন। দেবশর্মা চলে যেতেই অপূর্ব অদ্ভুত এক দায় স্মরণ ক’রে শঙ্কিত হয়ে ওঠে ব্রহ্মচারী বিপুল। পৃথিবীর কোন গুরুভক্ত শিষ্যকে এমন গুরুভার দায় নিতে হয়েছে, এমন কাহিনী কোন পুরাণে পাঠ করেনি বিপুল।

পরপ্রণয়িনী এক নারীর কামনাকে প্রহরীর মত সদাজাগ্রত ও সতর্ক দুই চক্ষুর শাসন দিয়ে অচঞ্চল ক’রে রাখবার দায় গ্রহণ করেছে বিপুল। পারদারিক পুরন্দরের গোপন অভিসার ব্যর্থ ক’রে দেবার দায় নিয়েছে বিপুল। তরুণ ব্রহ্মচারী বিপুল, জীবনে কোনদিন কোন নারীর যৌবনশোভার দিকে মুখ তুলে যে তাকায়নি, অনুরাগের লীলাকলা আর রীতি-নীতি যার কাছে এক অবিদিত কল্পলোকের রহস্য মাত্র, তাকেই আজ থেকে গ্রন্থ ফেলে রেখে এক ক্ষমাহীন ও কঠোর স্বামীর মত কৌতূহল সংশয় আর আগ্রহ নিয়ে এক অপতিব্ৰতিনী নারীর জীবনে শাসন রচনা ক’রে রাখতে হবে।

 

 

পর্ণতরুর ছায়া আর শ্যামলতা বলয়িত এই গৃহনিকেতন আজ আর কারাগার বলে মনে হয় না, রুচির অবরুদ্ধ জীবনের আকাঙ্ক্ষা অবারিত পথের আশ্বাস দেখতে পেয়েছে। যে মুক্তির লগ্নকে এতদিন ধ’রে প্রতিমুহূর্তের চিন্তায় কামনা ক’রে এসেছে রুচি, আজ আসন্ন হয়ে উঠেছে সেই মুক্তি। প্রতি কুঞ্জের নিকটে গিয়ে পুষ্প চয়ন করে রুচি।

কিন্তু অন্তরাল হতে এক তরুণ ব্রহ্মচারীর সতর্ক দৃষ্টি কুঞ্জচারিণী সেই নারীর মদপুলকিত অঙ্গশোভা অনুসরণ ক’রে ফিরতে থাকে, যেন মুহূর্তের মতও দৃষ্টির বাইরে না চলে যায়। গুরুর নির্দেশ।

সরোবরসলিলে স্নান করে রুচি। যেন অনুপম এক রক্তকোকনদের অঙ্গে সলিলের হিল্লোল লাগে। অন্তরাল থেকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে সেই সুন্দর দৃশ্যকে নয়নে ধারণ ক’রে রাখে বিপুল। যেন ডুবে না যায় সেই রূপের কোকনদ। গুরুর নির্দেশ।

সন্ধ্যা হয়। দীপ জ্বলে রুচির ঘরে। গোপন একান্তে দাঁড়িয়ে অতি সন্তর্পণে দীপালোকে পুলকিত সেই কুটীরের অভ্যন্তরে প্রসাধনরতা এক যৌবনময়ীর মূর্তির দিকে বিস্ময়াহত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে বিপুল। সে মূর্তির যবাঙ্কুরের কর্ণপুরে মন্দানিলের লুব্ধ পরশ ক্ষণে ক্ষণে লাগে। কেতকীরজে সুবাসিত তনু, ওষ্ঠাধরে বন্ধুক পুষ্পের অরুণতা, সায়ন্তন মল্লিকার গুচ্ছ তার বেণীপ্রান্তে দোলে। নিরঙ্ক কুঙ্কুমপঙ্কে আলিম্পিত বাহু, অলক্তে সেবিত চরণ, মৃদুচ্ছন্দে স্পন্দিত বক্ষঃপটে শ্বেতচন্দনের পত্রাবলী, ইন্দ্রমায়ার এক পরমরমণীয় অর্ঘ্যরূপে প্রস্তুত হয়েছে রুচি। সতর্ক হয়, প্রস্তুত হয় দেবশর্মার তরুণ শিষ্য বিপুল।

নিবিড়তর হয় সন্ধ্যা। গন্ধধূমে আচ্ছন্ন উটজ-প্রাঙ্গণের অলস বাতাস সৌরভে মূৰ্ছিত হয়। গগনপটে আঁকা রাকা হিমকর নিখিল মহীতলের রূপ আলোকাপ্লুত ক’রে শুধু সপ্তপর্ণীতলে একখণ্ড ছায়াময় অন্ধকারের নিবিড়তা রচনা করেছে। দেখতে পায় বিপুল, তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক অভিসারচারী পুরুষের ঘনঘোর ছায়াদেহ।

ব্যস্ত হয়ে ওঠে বিপুল। বিপুলের প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ করবার জন্য সকল শক্তি নিয়ে আজ প্রস্তুত হয়ে এসেছে মায়াধর পুরন্দর। এই মুহূর্তে দেবশর্মার গৃহ-নিকেতনের সকল পুণ্য গ্রাস ক’রে আর দীপ নিভিয়ে দিয়ে চলে যাবে ঐ ছায়াদেহ।

 

 

কোন্ শক্তি দিয়ে আজ ইন্দ্ৰমায়ার এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করবে বিপুল? অস্ত্রবলে? না, সম্ভব নয়। আবেদন ক’রে? না, বিশ্বাস হয় না। ঐ বনমৃগীর উদ্দাম স্বপ্নকে আজ কোন লৌহ শৃঙ্খলেও বেঁধে রাখতে পারা যাবে না।

সপ্তপর্ণী তরুতলে সেই ভয়ংকর ছায়াদেহ অস্থির হয়ে উঠেছে দেখা যায়। দেখতে পায় বিপুল, দীপ নিভিয়ে দিয়ে প্রাঙ্গণের জ্যোৎস্নলোকে এসে দাঁড়িয়েছে গুরুপত্নী রুচি। সপ্তপর্ণীর ছায়ার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠেছে প্রণয়ব্যাকুলা রুচির নয়নদ্যুতি।

অন্তরাল হতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে প্রাঙ্গণের জ্যোৎস্নালোকের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় বিপুল।

চমকে ওঠে রুচি—একি? তুমি এখানে কেন বিপুল?

পথ রোধ ক’রে দাঁড়িয়েছে বিপুল। ইন্দ্রমায়ার ছলনাকে সে আজ জীবনের এক চরম দুঃসাহসের বলে পরাভূত করতে চায়। গুরুর নির্দেশ ব্যর্থ হতে দেবে না বিপুল। তার প্রতিশ্রুতির সত্য সর্বস্ব দিয়েও রক্ষা করবে তরুণ ব্রহ্মচারী।

ভ্রূকুটিকুটিল দৃষ্টি তুলে কঠিন ধিক্কারের সুরে রুচি বলে—বুঝেছি বিপুল। গুরুভক্ত তুমি, গুরুর নির্দেশে আমার পথ রোধ ক’রে দাঁড়িয়েছ। কিন্তু ভুল করো না, আমার অভিশাপ থেকে যদি বাঁচতে চাও, তবে দূরে সরে যাও।

মাথা হেঁট ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে বিপুল। দূরে সরে যেতে পারে না। গুরুভক্ত শিষ্য আজ যে-কোন ভর্ৎসনা আর অভিশাপ নিজ জীবনে গ্রহণ ক’রেও গুরুপত্নী রুচিকে পুরন্দরের প্রণয়ের আকর্ষণ হতে ছিন্ন ক’রে এই কুটীরের প্রাঙ্গণে ধ’রে রাখবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু বিপুলের সকল আশা যেন হঠাৎ ভীত হয়ে বুকের ভিতরে কেঁপে ওঠে। শিষ্যের এই নত মস্তকের আবেদনে এমন কোন শক্তি নেই যে পরপ্রণয়িনী ঐ প্রগল্ভার অভিসার স্তব্ধ ক’রে দিতে পারে।

অকস্মাৎ শিহরিত হয় শিষ্য বিপুলের অচঞ্চল মূর্তি; অন্তরের প্রতিজ্ঞাকে সুন্দর এক ছলনায় সাজিয়ে নেবার জন্য প্রাণপণে এক দুঃসাহস আহ্বান করেছে বিপুল।

 

 

ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকায় বিপুল, প্রণয়ানুরাগে বিহ্বল এক প্রেমিকের মুখ। চমকে ওঠে রুচির দুই কজ্জলিত নয়নের মদিরতাময় কৌতূহল। মনে হয় রুচির, যেন তারই রূপগরীয়সী মূর্তির কাছে ভক্ত পূজকের মত বুকভরা আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিপুল।

রুচি শান্তস্বরে প্রশ্ন করে—কি বলতে চাও, বিপুল?

বিপুল বলে—গুরুভক্ত নই, আমি তোমারই ভক্ত।

বিস্ময়ে অভিভূত দৃষ্টি তুলে বিপুলের সেই সম্মোহিত তরুণ মুখচ্ছবির দিকে তাকায় রুচি—আমার ভক্ত তুমি? কোন দিন শুনিনি একথা!

বিপুল—আজ শোন রুচি, তুমিই আমার জীবনের প্রথম বিস্ময়। আমার আকাঙক্ষার স্বপ্ন অবরুদ্ধ হয়ে ছিল এই পাঠগৃহের কারাগারে, সে-স্বপ্নের মুক্তি এনেছ তুমি। তুমি আমার সেই স্বপ্নলোকের প্রথম মাধুরী, প্রথম কামনার দীপ। তুমি ছাড়া আমার সব ধ্যান আর সব তপস্যা বৃথা।

এই প্রাঙ্গণ যেন অদ্ভুত এক প্রণয়মন্ত্রপূত উৎসবস্থলীর বেদিকা। তার উপর দাঁড়িয়ে আছে এক যৌবনগর্বিতা রূপসীর প্রসাধিত মূর্তি এবং তারই সম্মুখে প্রসন্নতাপ্রার্থী এ তরুণ পূজক।

রুচির দুই নয়নের প্রান্তে মোহময় হর্ষের বিদ্যুৎ স্ফুরিত হতে থাকে। রুচির মরুজ্বালাময় জীবনের কত কাছে একটি স্নিগ্ধ উপবন লুকিয়ে ছিল। আজ হঠাৎ সেই উপবন আপনি প্রকট হয়ে বসন্ত সমীরের উচ্ছ্বাস ডেকে এনেছে। রুচির নিঃশ্বাস চঞ্চল হয়, দুই চক্ষুর দৃষ্টি নিবিড় হয়ে ওঠে।

রুচি বলে কি—চাও বিপুল?

বিপুল—অনন্তকাল আমার এই জীবনকে তোমারই মন্দির ক’রে রাখতে চাই, রুচি।

বিপুলের আলিঙ্গনে লুটিয়ে পড়ে রুচি।

সপ্তপর্ণী তরুতলে সেই প্রতীক্ষায় পুরন্দর কেঁপে ওঠেন, যেন হঠাৎ এক আঘাত পেয়েছে তাঁর ছায়াদেহ। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন পুরন্দর। দেখতে পান, দেবশর্মার কুটীরের প্রাঙ্গণে এক নতুন ছলনার মোহে ইন্দ্রমায়ার ছলনা পরাভূত হয়ে গিয়েছে। এক তরুণ প্রেমিকের ব্যগ্র দুই বাহুর আকুল আগ্রহের নীড়ে বিলীন হয়ে রয়েছে এক প্রেমের পারাবতী।

অপমানিত হয়েছে পুরন্দরের প্রতীক্ষা। একান্তে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সেই দুঃসহ দৃশ্য দেখতে থাকেন পুরন্দর। পরমুহূর্তে জ্বালালিপ্ত চক্ষু নিয়ে ঝঞ্ঝাতাড়িত মেঘখণ্ডের মত ছুটে যান।

 

 

বাহুবন্ধনে ও নিবিড় ছলনার আলিঙ্গনে এতক্ষণ যে রুচিকে শুধু অবরুদ্ধ ক’রে রেখেছিল বিপুল, পুরন্দরের রথচক্রের শব্দ দূরান্তে মিলিয়ে যেতে সেই রুচিকে মুক্ত ক’রে দিয়ে আবেদন করে।—ক্ষমা কর।

বিস্মিত রুচি প্রশ্ন করে—কেন বিপুল?

বিপুল—আমার অভিলাষ সিদ্ধ হয়েছে।

রুচি—এ কেমন অভিলাষ? তোমার এই সুন্দর দুই বাহু কি দৃঢ় শৃঙ্খলের মত শুধু বন্ধনে আবদ্ধ করবার জন্য নির্মিত দু’টি শুষ্ক কঠিন ও শীতল স্পৃহা?

উত্তর দেয় না বিপুল।

রুচি বলে—বল বিপুল, ভীরু কেন তোমার অধর? কুন্ঠিত কেন তোমার বক্ষের নিঃশ্বাস?

প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় আর ছিল না, সুযোগও ছিল না। দেবশর্মা এসে কুটিরে প্রবেশ করেন। বিপুল এগিয়ে যায়; এবং গুরুকে প্রণাম করে।

পর্ণতরুর ছায়া আর শ্যামলতায় বেষ্টিত দেবশর্মার গৃহনিকেতনে আবার প্রভাত হয়। বিপুল তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে, ইন্দ্ৰমায়া ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে, সবই শুনতে পেয়েছেন দেবশর্মা। শুনে শান্ত হয়েছেন। যেখানে যা ছিল, আর যেমন ছিল, সবই তেমনি ফিরে পেয়েছেন দেবশর্মা। রুচি আছে, বিপুল আছে, আছে সেই সপ্তপর্ণী।

কিন্তু সেই পুরাতন দিনগুলিকে আর ফিরে পেলেন না দেবশর্মা। সেই প্রত্যহের সংশয় আর অপমানের জ্বালায় ভরা দিনগুলি, বনমৃগীর উদ্দাম স্বপ্নকে কন্টকমেখলা দিয়ে রুদ্ধ ক’রে রাখবার জন্য সেই কঠোর প্রয়াসের দিনগুলি।

বনমৃগী যেন এই গৃহ প্রাঙ্গণের ভিতরে তার স্বপ্নরাজ্য লাভ করেছে। সপ্তপর্ণীর ছায়ায় দাঁড়িয়ে দূর পথের ধ্যানে রুচিকে আর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। এই গৃহপ্রাঙ্গণের বক্ষে ধ্বনিত এক তরুণের পদশব্দ রুচির উৎকর্ণ আগ্রহের নূতন স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। প্রতীক্ষার মুহূর্ত যাপন করে রুচি। কবে আসবে সেই সন্ধ্যা, যে সন্ধ্যায় রুচির দীপান্বিতা কক্ষের দ্বারে ধ্বনিত হবে তারই যৌবনের ভক্ত ঐ তরুণ বিপুলের অভিসারোৎসুক চরণধ্বনির হর্ষ?

অনুভব ক’রেন দেবশর্মা, তাঁর অন্তর যেন এক শূন্যতার গভীরে ডুবে রয়েছে। বুঝতে পারেন না, কেন। তাঁর জীবনের সকল আগ্রহ স্তব্ধ হয়ে গেল কেন? রুচি আছে, কিন্তু মনে হয় দেবশর্মার, তাঁর দুই নয়নের সম্মুখে থেকেও রুচি যেন হারিয়ে গিয়েছে।

রুচিকে প্রতিমুহূর্ত শুধু কঠোর শাসনে রুদ্ধ ক’রে রাখবার দিনগুলি আর ফিরে পেলেন না, সুখী হবারই কথা, কিন্তু যেন উদাস ও অসহায় হয়ে গিয়েছেন দেবশর্মা। শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন দেবশর্মা।

রুচি এসে স্মিতমুখে সম্মুখে দাঁড়ায়—আমার একটি অনুরোধ আছে।

দেবশর্মা—আমার কাছে?

রুচি—হ্যাঁ।

দেবশর্মা—বল।

রুচি—একটি বস্তু উপহার চাই।

দেবশর্মা—কী?

রুচি—গন্ধর্ববধূ যে দিব্যগন্ধ চম্পক কবরীতে ধারণ করে, সেই চম্পক আমি চাই।

অনুরোধ জ্ঞাপন ক’রে কক্ষান্তরে চলে যায় রুচি। অনুরোধ শুনে দেবশর্মার আননে অতি বিষণ্ণ ও বেদনার্ত এক শঙ্কার ছায়া ছড়িয়ে পড়ে, যেন আরও অসহায় হয়ে গেল তাঁর জীবন, এবং মনে হয়, তাঁর শিষ্য বিপুলও হারিয়ে গিয়েছে।

দেবশর্মা ডাকেন—বিপুল।

পাঠগৃহের নিভৃতে বসে গুরুর আহ্বান শুনে চমকে ওঠে বিপুল, যেন তার বক্ষের গভীরে গোপনে সঞ্চিত এক মধুর অনুভব হঠাৎ ভয় পেয়ে চমকে উঠেছে।

কেন চমকে ওঠে বিপুল? পরপ্রণয়িনী এক অভিসারিকা নারীকে কপট আলিঙ্গনে রুদ্ধ করতে গিয়ে বিপুলের অভিলাষহীন দেহের কঠোর শুচিতা কি হঠাৎ এক মোহময় কোমলতার আঘাতে চমকে উঠেছিল? সে-নারীর অঙ্গরাগের কেতকীরেণু কি তরুণ ব্রহ্মচারীর অন্তরে ক্ষণমধুরতার কুহক সৃষ্টি করেছিল?

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছে বিপুল। গুরুপত্নী রুচিকে ইন্দ্ৰমায়ার গ্রাস থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু কেমন ক’রে এক মোহ থেকে মুক্ত হয়েও আর এক ছলনার কাছে রুচির তৃষ্ণা নতুন ক’রে হারিয়ে গিয়েছে, সেই কাহিনীর কিছু জানেন না গুরু। সেই কাহিনী গুরুর কাছে প্রকাশ করেনি গুরুভক্ত ও সত্যনিষ্ঠ শিষ্য বিপুল। কিন্তু কেন এই গোপনতা?

গ্রন্থ ফেলে রেখে গাত্রোত্থান ক’রে পাঠগৃহ হতে ধীরপদে অগ্রসর হয়ে দেবশর্মার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় বিপুল। কেন ডাকছেন গুরু? কি বলতে চাইছেন গুরু? দেবশর্মার শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করতে পারে না শিষ্য বিপুলের অশান্ত মন। বক্ষের গভীর গোপনে সঞ্চিত এক মধুর অনুভবের স্মৃতি শুধু উদ্বিগ্ন নিঃশ্বাসের আঘাত সহ্য করতে থাকে।

দেবশর্মা বলেন—রুচি উপহার চেয়েছে। দিব্যগন্ধ চম্পক কোথায় আছে জানি না। তুমি নিয়ে এস।

শঙ্কা দূর হয়; শান্ত হয় বিপুলের মন।

চলে যায় বিপুল। প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে, সপ্তপর্ণীর ছায়া পার হয়ে, উটজদ্বার অতিক্রম ক’রে দূর পথের রেখার দিকে চলে যেতে থাকে বিপুল। দেখতে পান দেবশর্মা, সেই পথের দিকে নিষ্পলক নয়নের দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে আছে রুচির দুই সাগ্রহ ও সম্পৃহ নয়ন।

আবার দীপ জ্বলে রুচির ঘরে। নূতন পথের ধ্যানে ডুবে আছে রুচির মন, যে পথে এ সন্ধ্যায় আকুল হয়ে দেখা দেবে দিব্যগন্ধ চম্পকের অভিসার।

বুঝতে পারবে না কি বিপুল, কার কাছ থেকে আর কেন এই দিব্যগন্ধ চম্পক উপহার নেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে রুচির অন্তর? কল্পনা কি করতে পারবে না তরুণতরুর মত যৌবনান্বিত ঐ প্রণয়ী বিপুল, সেদিনের অসমাপ্ত উৎসবের পিপাসা তৃপ্ত করবার জন্য বিপুলকে ইঙ্গিতে আহ্বান করেছে বিপুলেরই স্বপ্নের আকাঙিক্ষতা নারী?

প্রতীক্ষার মুহূর্ত গণনা করে রুচি, দিব্যগন্ধ চম্পকের উপহার নিয়ে আর কতক্ষণ পরে ফিরে আসবে বিপুল? এই কক্ষের দ্বারে কতক্ষণে দেখা দেবে প্রেমাভিলাষী বিপুলের স্মিতপুলকিত তনুচ্ছায়া?

কিন্তু সেই দিব্যগন্ধ চম্পক তখন দেবশর্মার পায়ের কাছে পড়েছিল। ফিরে এসে গুরুরই সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে বিপুল। পরিশ্রান্ত ও বিষণ্ণ স্বরে বিপুল বলে—আপনার অভীপ্সিত বস্তু এনেছি গুরু। গ্রহণ করুন এই দিব্যগন্ধ চম্পক।

দেবশর্মা বলেন—এই দিব্যগন্ধ চম্পকের উপহার আমার জন্য চাইনি। যে চেয়েছে তাকে দিয়ে এস।

বিপুল—কে চেয়েছে?

দেবশর্মা—রুচি।

বিপুল—কিন্তু এই উপহার গুরুপত্নীর কাছে আমি নিয়ে যাব কেন গুরু? সে কাজ আমার কাজ নয়।

দেবশর্মা—আমি জানি, রুচি তোমারই হাত থেকে এই উপহার নিতে চায়।

আর্তনাদ করে বিপুল—আমাকে ভুল বুঝবেন না, গুরু।

দেবশর্মা—তোমাকে ভুল বুঝিনি। তোমাকে মুক্তি দিতে চাই। তুমি আর আমার শিষ্য নও।

বিপুল—কেন গুরু?

দেবশর্মা—নিজের মনের কাছে এই প্রশ্ন কর।

চমকে ওঠে বিপুলের মনের গভীরে লুক্কায়িত এক মধুর অনুভবের অপরাধ। আর্তস্বরে চিৎকার করে বিপুল—আমার একটি গোপনতার অপরাধ ক্ষমা করুন, গুরু।

দেবশর্মা—কিসের গোপনতা?

বিপুলের চক্ষু বাষ্পায়িত হয়ে ওঠে। পুরন্দরের প্রণয়ের মোহ হতে গুরুপত্নী রুচিকে রক্ষা করবার সেই বিচিত্র দুঃসাহসের কাহিনী গুরুর কাছে ব্যক্ত করে বিপুল। বিচলিত স্বরে বিপুল বলে—বিশ্বাস করুন গুরু, আমি ছলনা মাত্র, তার বেশি কিছু নই। শুধু গুরুপত্নীকে রক্ষা করেছি। শুধু প্রণয়ের অভিনয় করেছি। নিতান্তই হৃদয়হীন সেই প্রণয়, তার মধ্যে আর কোন অভিলাষ ছিল না গুরু।

দেবশর্মার শান্ত মুখে অদ্ভুত এক ক্ষমার প্রসন্নতা দেখা দেয়—ভালই করেছ বিপুল। বিশ্বাস করি আমি, তোমার সেই ছলপ্রণয়ের অভিনয় নিতান্তই অভিনয়। গুরুপত্নীকে রক্ষা করা ছাড়া আর কোন অভিলাষ তোমার ছিল না। কিন্তু…

বিপুল—বলুন গুরু।

দেবশর্মা—তোমার ছলনা হৃদয়হীন বটে, কিন্তু তুমি তো হৃদয়হীন নও!

কি ভয়ংকর সত্য ঘোষণা করেছেন গুরু! বিপুলের বক্ষের পঞ্জর বজ্ৰনাদে আতঙ্কিত বল্মীকধূলির মত কেঁপে ওঠে। সেই বক্ষঃপঞ্জরের অন্তরালে, গভীর গোপনে সঞ্চিত এক মধুর অনুভব যেন ক্রন্দন ক’রে উঠেছে—‘তুমি তো হৃদয়হীন নও বিপুল। আমি যে তোমার সেই ছলনারই দান। আমি যে তোমারই আলিঙ্গনে লুন্ঠিত এক বিপুলযৌবনার ললিতকোমল ও মোহময় স্পর্শের সৌরভ।’

ক্ষমা করেছেন গুরু। কিন্তু অনুভব করে বিপুল, এই আশ্রমে গুরুসন্নিধানে থাকবার অধিকার সত্যই হারিয়েছে শিষ্য বিপুলের জীবন। চলে যেতে হবে চিরকালের মত। কিন্তু স্মরণ করে বিপুল, গুরুপত্নী রুচিকে সত্যই রক্ষা করতে পারেনি গুরুভক্ত বিপুল। ইন্দ্রমায়ার মোহ হতে রুচিকে রক্ষা করতে গিয়ে স্বয়ং বিপুলই রুচির জীবনে নূতন এক মোহ হয়ে উঠেছে।

নূতন এক প্রতিজ্ঞার আবেগ বিপুলের নয়নে শিহরিত হতে থাকে। গুরুভক্ত শিষ্য অবশ্য তার প্রতিশ্রুতির সত্য রক্ষা করবে। গুরুপত্নী রুচিকে গুরুপ্রিয়ার গৌরবে বিভূষিত ক’রে চলে যাবে বিপুল। জয়ী হবে গুরুভক্ত শিয্যের জীবনের অভিলাষ।

এই গুরুগৃহে শিষ্য বিপুলের জীবনে পালনীয় আর কোন ব্ৰত নেই। আছে শুধু একটি পরীক্ষা। শুধু একবার হৃদয়হীন হতে হবে, বক্ষের গভীর গোপনে সঞ্চিত একটি মধুর অনুভবের উপর জ্বালাময় ভস্ম নিক্ষেপ ক’রে যুক্ত হয়ে যেতে হবে। দিব্যগন্ধ চম্পক হাতে তুলে নেয় বিপুল।

দেবশর্মার শান্ত চক্ষুর কৌতূহল হঠাৎ চমকে দিয়ে দৃপ্ত স্বরে নিবেদন করে বিপুল—আমি আপনারই শিষ্য, আমি চিরকালের গুরুভক্ত শিষ্য।

দেবশর্মাকে প্রণাম ক’রে ত্বরিত পদে চলে যায় বিপুল।

রুচির ঘরে দীপশিখা কেঁপে ওঠে। দিব্যগন্ধ চম্পকের উপহার নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বিপুল।—এনেছি আপনার দিব্যগন্ধ চম্পক।

বিপুলের ভাষণ যেন বিচিত্র এক রূঢ়তার ধিক্কার। বিস্মিত হয় রুচি।—এই কি উপহার অর্পণের রীতি?

বিপুল—আমি আপনাকে উপহার অর্পণ করছি না গুরুপত্নী, আমি গুরুর আদেশ পালন করছি।

রুচির প্রতীক্ষার আনন্দ নির্মম আঘাতে ব্যথিত হয়ে চমকে ওঠে—গুরুর আদেশ?

রুচি—কিন্তু তুমি সত্যই কি বুঝতে পারনি বিপুল, তোমারই হাত থেকে ঐ দিব্যগন্ধ চম্পক গ্রহণ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে রয়েছে আমার অন্তর?

বিপুল—বুঝতে পারি। কিন্তু বুঝতে পারি না, গুরুপত্নী কেন তাঁর স্বামীর এক শিষ্যের কাছ থেকে এমন উপহার আশা করেন।

রুচির সুন্দর চক্ষু প্রখর সন্দেহের স্পর্শে বহ্নিময় হয়ে ওঠে—ভুলে যাও কেন বিপুল, গুরুপত্নীর অন্তরে সে আশা যে তুমিই সঞ্চারিত ক’রেছ, জ্যোৎস্নারমিত এক সন্ধ্যার পরমক্ষণে, তোমার প্রেমবিধূত সম্ভাষণে, আর ব্যগ্র আলিঙ্গনে?

বিপুল—সেই সম্ভাষণ আর সেই আলিঙ্গন নিতান্ত এক অভিনয়। পরানুরাগিণী অভিসারিকার পথরোধের কৌশল।

রুচির ভ্রূকুটিকুটিল চক্ষুর দৃষ্টিতে অসহ দাবদাহের জ্বালা শিখায়িত হয়ে ওঠে—তোমার যে ব্যাকুল আহ্বানের মায়ার কাছে ইন্দ্ৰমায়াও হার মেনে চলে গিয়েছে, সেই আহ্বান কি সকলই ছলনা?

বিপুল—হ্যাঁ।

বজ্রাহতা হরিণীর মত আর্তস্বরে চিৎকার ক’রে ওঠে রুচি—যাও।

চলে যায় বিপুল।

দীপ নিভে যায়। দিব্যগন্ধ চম্পকের উপহার ভূতলে লুটিয়ে পড়ে থাকে। আর লুটিয়ে পড়ে থাকে রুচি। ছলনা, সকলই ছলনা। এই রূপ আর যৌবন জীবনের কয়েকটি প্রমত্ত বসন্তের ছলনা। একটি ধিক্কারে আজ রুচির স্বপ্নরাজ্য চূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তার নিরাশ্রয় প্রাণ আজ এই অন্ধকারের সমাধিতে একটুকু হৃদয়ের আশ্রয় খুজছে।

উষ্ণ সলিলধারায় আপ্লুত হয় নয়ন এবং সেই নয়নে এক শান্ত স্বপ্নচ্ছবি ফুটে উঠতে থাকে। সন্ধ্যামেঘের রক্তিমার মত এই রূপ আর যৌবন জীবনের আকাশপট হতে মুছে গিয়েছে, তবু প্রেম আছে, সে প্রেম হৃদয়ের ডোরে বাঁধা। কামনার মায়া ফুরিয়ে যায়, তবু হৃদয় ফুরিয়ে যায় না। যে ভালবাসে হৃদয় দিয়ে, সে-ই ভালবাসতে পারে চিরকাল। হৃদয়ের বন্ধনে ভালবাসা চিরন্তন হয়। তটশিলার কঠিন বন্ধন সত্য, তাই সত্য তটিনীর রূপ। আর সবই গোপনের ইন্দ্ৰমায়া, ক্ষণিকের ছলনা, মরীচিকার মত সুন্দর ও মিথ্যা।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় রুচি। দিব্যগন্ধ চম্পকের উপহার হাতে তুলে নেয়। আজিকার এই দীপহীন অন্ধকারে সত্যই যেন এক চিরকালের প্রেমিকের সন্ধানে নূতন অভিসারে যাত্রা করে রুচি। কক্ষদ্বার পার হয়ে প্রাঙ্গণের উপর এসে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায়, এবং একটি দীপহীন কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

দীপহীন অন্ধকারের মধ্যে সমাহিত মূর্তির মত স্তব্ধ ও নিঃশব্দ ঋষি দেবশর্মা হঠাৎ চমকে ওঠেন। জানেন না, কল্পনাও করতে পারেন না এবং বুঝতেও পারেন না দেবশর্মা, তাঁর পায়ের উপর শুধু দিব্যগন্ধ চম্পকের অর্ঘ্য নয়, পুষ্পের চেয়েও কোমল অলকস্তবকের অর্ঘ্য নিয়ে রুচির মাথাও লুটিয়ে পড়ে রয়েছে।

কিসের অর্ঘ্য? দেবশর্মা বিচলিত হয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সে অর্ঘ্য স্পর্শ করতে গিয়েই রুচির মাথা স্পর্শ করেন। দুই হাত দিয়ে সাগ্রহে দেবশর্মার হাত চেপে ধরে রুচি।

দেবশর্মা বিস্মিত হন—এ কি? কে তুমি?

রুচি—আমি, তোমারই রুচি।

দেবশর্মা—এত ব্যথিত হলে কেন রুচি? যে মুক্তি তুমি চাও, সেই মুক্তি আমি তোমাকে দিয়েছি।

রুচি—চাই না মুক্তি।

দেবশর্মা—কি চাও বল।

রুচি—চাই তোমার বন্ধন, চাই তোমার দেওয়া শাস্তি, চাই তোমার বাধা, চাই তোমার শাসন।

দেবশর্মা—কোন দিন যা চাওনি, আজ তাই কেন চাইছ, রুচি?

রুচি—কোন দিন যা বুঝিনি, আজ তাই বুঝতে পেরেছি, ঋষি।

দেবশর্মা—কি?

রুচি—তুমি সহৃদয়, আর সবই ছলনা।

কয়েকটি মুহূর্ত শুধু স্তব্ধ হয়ে থাকেন দেবশর্মা। তারপর সান্ত্বনার সুরে বলে ওঠেন—ওঠ রুচি।

রুচি ওঠে। দীপ জ্বালে। সে দীপের আলোকে দেখা যায়, দেবশর্মার পদস্পর্শে পূত দিব্যগন্ধ চম্পক রুচির অলকস্তবকে গাঁথা রয়েছে।


© 2024 পুরনো বই