জনক ও সুলভা

দূরে মিথিলা নগরী, দেখা যায় বিদেহরাজ ধর্মধ্বজ জনকের নিবিড়ধবল প্রাসাদের শিখরকেতন। যেন এই প্রভাতের নবারুণপ্রভা পান করবার জন্য জাগ্রত বিহঙ্গমের মত চঞ্চল হয়ে উঠেছে পবনাবধূত কেতনের মণিজাল। আর, মিথিলার পুরপ্রাকার হতে অনেক দূরে কাননভূভাগের এই নিভৃতে এক কুসুমিত কিংশুকের ছায়ায় অচঞ্চল নেত্রে রক্তলাজানুরঞ্জিত দিগ্‌ললাটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কাযায়পরিহিতা এক সন্ন্যাসিনী, সন্ন্যাসিনী সুলভা।

জানে না সন্ন্যাসিনী সুলভা, শেষ নিশীথের শিশিরে অভিষিক্ত কিংশুকের একটি মঞ্জরী কখন বৃন্তচ্যুত হয়ে তারই জটাকীর্ণ রুক্ষ অলকস্তবকের উপর পড়েছে। বুঝতে পারে না সুলভা, তার ধ্যানস্তিমিত এই দেহের কাযায় আচ্ছাদনের উপর কখন বিন্দু বিন্দু পরাগচিহ্ন অঙ্কিত ক’রে রেখে গিয়েছে কুসুমরজে অন্ধীভূত চপল মধুপের দল। ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে বনসরসীর তটে এসে দাঁড়ায় সন্ন্যাসিনী সুলভা। তার পরেই অঞ্জলিপুটে সলিল গ্রহণ ক’রে মন্ত্রপাঠের জন্য প্রস্তুত হয়।

উপাসিকা সুলভা, মুনিব্রতে দীক্ষিতা সুলভা, সুকঠোর ব্রহ্মচর্যে অভ্যস্তা সুলভ বিগত দশ বৎসর ধরে এইভাবে তার কামনাহীন জীবনের প্রতি প্রভাতে মন্ত্রপাঠ ক’রে এসেছে। সংসারনিলয়ের সকল ভোগ স্পৃহা ও অনুরাগের বন্ধন হতে অনেক দূরে সরে গিয়েছে সুলভার জীবন। রাজর্ষি প্রধানের কন্যা সুলভা, ক্ষত্রিয়াণী সুলভা আজ এই পৃথিবীর এক বিষয়রাগরহিতা সন্ন্যাসিনী মাত্র। দশ বৎসরের তপঃক্লেশ আর বৈরাগ্যভাবনা রাজতনয়া সুলভার চক্ষুর সম্মুখে এক নূতন জগতের রূপ অপাবৃত ক’রে দিয়েছে। এই জগৎ তৃষ্ণাহীন ও বেদনাহীন এক জগৎ। এখানে সুখবোধ নেই, দুঃখবোধও নেই। উল্লাস নেই, ক্ৰন্দন নেই। সর্বত্যাগের আনন্দে অভিমণ্ডিত এই জগতে সুখাসুখ লাভালাভ ও প্রিয়াপ্রিয় জ্ঞানের দ্বন্দ্ব নেই। এই জীবন শুদ্ধ আত্মজ্ঞানের আলোকে ভাস্বরিত জীবন। অখণ্ড প্রশান্তির জীবন। দেহ থাকে, যৌবনও থাকতে পারে, কিন্তু দেহ ও যৌবনের কোন অভিমানের বেদনা এই জীবন্মুক্ত জীবনের প্রশান্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে না।

 

 

মোক্ষাভিলাষিণী সুলভার জীবনকে তার এই পরম এষণা অহর্নিশ ব্যাকুল ক’রে রেখেছে। পরিব্রাজিকা সুলভার জীবনের দশটি বৎসরের প্রতি মুহূর্ত এই আত্মজ্ঞানের সন্ধানে ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। অনুভব করেছে সুলভা, এতদিনে যাতনাহীন হয়েছে তার এই দেহ, অনেক আকাঙক্ষায় ও অনেক স্পৃহায় একদিন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল যে দেহ ও দেহের কল্লোলিত যৌবন। যেমন নিদাঘ-তপনের খরকিরণের জ্বালা, তেমনি শিশিররজনীর হিমভারপীড়িত বায়ুর দংশন এই দেহে বরণ ক’রে নিয়ে ধ্যানাসনে সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারে সুলভা। তপ্ত রৌদ্র যেন তপ্ত নয়, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নাও যেন স্নিগ্ধ নয়। তপ্ততায় আর স্নিগ্ধতায়, রৌদ্রে ও জ্যোৎস্নায় কোন প্রভেদ অনুভব ক’রে না সন্ন্যাসিনী সুলভার দেহ। এই তো সেই দেহ, কিন্তু কল্পনা করতেও বিস্ময় বোধ ক’রে সুলভা, আজ কোথায় গেল রাজপ্রাসাদের স্নেহ ও গর্বে লালিত সেই দেহের বাসনাবিলসিত নিঃশ্বাসগুলি? কে জানে কোথায় চিরকালের মত হারিয়ে গিয়েছে সেই মঞ্জীরিত চরণের চলচঞ্চলতা! এই তো সেই দুই বাহু, কিন্তু কনককেয়ূরে শোভিত হবার জন্য আজ আর এই দুই বাহুতে কোন তৃষ্ণা নেই। শীতল সিতচন্দনের চিত্রকে চিত্রিত হতো যে বক্ষঃফলক, আজ সেই বক্ষঃফলকে তপ্ত বনভূমির ধূলি উড়ে এসে ক্ষতচিহ্ন অঙ্কিত করে। কিন্তু তার জন্য সুলভার মনে কোন ক্লেশ আর কোন দুঃখ জাগে না।

তাই আরও বিস্মিত হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে সুলভা, তবে সে কি আজ এতদিনে সত্যই এই সংসারের সকল হিমাতপ ক্ষুৎপিপাসা আর কামনাকে পরাজয় করতে পেরেছে? সন্ন্যাসিনীর জীবন কি এতদিনে তার আত্মসম্বোধি খুঁজে পেল? কিন্তু কি আশ্চর্য, নিজেরই মনের এই জিজ্ঞাসার ভাষা শুনে সন্ন্যাসিনী সুলভার মন হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে যায়। যদি সত্যই তৃষ্ণাহীন হয়ে থাকে এই দেহ, তবে শান্ত হয় না কেন এই মন? এই তপঃক্লিষ্ট দেহের দিকে তাকিয়ে আজও কেন হঠাৎ ভয়ে বিহ্বল হয়ে ওঠে উপাসিকার অক্ষিতারকা?

অঞ্জলিপুটে গৃহীত সলিলের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রপাঠ করতে গিয়ে আজও অকস্মাৎ অন্যমনা হয়ে যায় আর মন্ত্র ভুলে যায় সুলভা। অন্যদিনের মত আজও নিজের এই ক্ষণবৈচিত্ত্যের রহস্য বুঝতে না পেরে বিষণ্ণ হয় সুলভা, কিন্তু পরমুহূর্তে চমকে ওঠে।

দেখতে পেয়েছে সুলভা, এইবার বুঝতে পেরেছে সুলভা, কোথায় আর কেন তার এই দশ বৎসরের কঠোর ব্রহ্মব্রত আর তপশ্চর্যায় গঠিত জীবনে, যাতনাবোধহীন এই বক্ষঃফলকের অন্তরালে একটি বেদনা অভিমানকুণ্ঠিত নিঃশ্বাসের মত লুকিয়ে রয়েছে। সন্ন্যাসিনী সুলভা তার যে হাতে মন্ত্রপূত সলিল ধারণ ক’রে রয়েছে, সেই হাতে অঙ্কিত রয়েছে অতীতের এক ক্ষতরেখার চিহ্ন, যেন কমলপত্রের উপর বিগত দিবসের এক করকাশিলার আঘাতের স্মৃতি। দশ বৎসর পূর্বে জীবনের এক আশাভঙ্গের বেদনা সহ্য করতে না পেরে রাজর্ষি প্রধানের কন্যা মানিনী সুলভার অন্তর তার নিজেরই রূপ আর যৌবনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। নিজের হাতের পুষ্পমাল্য নিজেই ছিন্ন ক’রে ভূতলে নিক্ষেপ করেছিল সুলভা! আর, সেই পুষ্পমাল্যও যেন আহত ভুজঙ্গের মত একটি চকিত দংশনে রাজতনয়ার করকমলে রুধিরবিন্দু স্ফুটিত ক’রে ভূতলে লুটিয়ে পড়েছিল। সেই ক্ষত আজ আর নেই, সেই ক্ষতের জ্বালাও কবে মুছে গিয়েছে, শুধু আছে সেই ক্ষতের একটি স্মৃতিচিহ্নরেখা।

রাজর্ষি প্রধান তাঁর কন্যা সুলভার জন্য বার বার তিনবার স্বয়ংবরসভা আহ্বান করেছিলেন। চন্দ্রোদয়ে বিলোল সমুদ্রবেলার মত অঙ্গে অঙ্গে যৌবনকল্লোলিত রূপ আর শোভা নিয়ে কুমারী সুলভা তার জীবনের চিরসঙ্গী আহ্বানের আশায় যে প্রসূনমালিকাকে সাদর চুম্বনে চঞ্চলিত ক’রে রেখেছিল, সেই মালিকা কণ্ঠে ধারণ করতে পারে, এমন কোন যোগ্যজন খুঁজে পেলেন না রাজর্ষি প্রধান। এসেছিল কত শত ক্ষত্রিয়কুমার, রাজর্ষি প্রধানের বিবেচনায় তাদের মধ্যে একজনও কিন্তু তাঁর কন্যা সুলভার স্বয়ংবরসভায় প্রবেশলাভ করারও যোগ্য ছিল না। সুলভার পাণিপ্রার্থী কুমারেরা সুলভার পাণিগ্রহণের অযোগ্য বলে ধিক্কৃত হয়ে স্বয়ংবরসভার প্রবেশপথ হতে ফিরে গিয়েছিল।

সকলেই অযোগ্য, কিন্তু বিদেহরাজ জনক তো অযোগ্য নন। রাজর্ষি প্রধানের কন্যা সুলভার স্বংবরসভার কথা তো তিনিও শুনতে পেয়েছেন। ফুল্লযৌবনা সুলভার সেই রূপের কাহিনী শুনতে পেয়েছেন জনক, যে রূপের প্রভায় রাজর্ষি প্রধানের প্রাসাদের সকল মণিদীপের দ্যুতিও ম্লান হয়ে যায়। সুলভার স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হবার জন্য সাগ্রহ আমন্ত্রণের লিপিও বিদেহরাজ জনকের কাছে কতবার প্রেরিত হয়েছে। কিন্তু আসেননি জনক।

 

 

জেনেছে সুলভা, জেনেছেন রাজর্ষি প্রধান, আর যে-ই আসুক, আসতে পারেন না জনক। বিষয়কামনারহিত মোক্ষব্রত নিষ্কাম ও আত্মজ্ঞানী জনক এই জগতের কোন রূপোত্তমা নারীর বরমাল্য লাভের জন্য প্রলুব্ধ হতে পারেন না।

বার বার তিনবার। বৃথাই শুধু প্রতীক্ষা কল্পনার আর হৃদয়চাঞ্চল্য সহ্য করে কুমারী সুলভার হাতের বরমাল্য। বাষ্পভিভূত হয় পিতা প্রধানেরও চক্ষু। কিন্তু শুধু বার বার তিনবার, তারপর আর নয়। শেষ স্বয়ংবরসভার শূন্য বক্ষে একাকিনী দাঁড়িয়ে শুধু দেখতে থাকে সুলভা, অপরাহ্নের আকাশবক্ষ হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ক্লান্ত দিবসের সৌরকরপ্রভা; সন্ধ্যার রক্তরাগ ফুটে উঠল শান্ত চিতানলদ্যুতির মত, তার পরেই পৌর্ণমাসী রজনীর পূর্ণ শশধর। কিন্তু মনে হয় সুলভার, তার জীবনের একটি ব্যর্থতার বেদনা যেন পূর্ণকলার রূপ গ্রহণ ক’রে আকাশে ফুটে উঠেছে। বরণমাল ছিন্ন ক’রে, ভূতলে নিক্ষেপ ক’রে সুলভা। মাল্যসূত্রের খরম্পর্শে ক্ষতাক্ত হয় সুলভার করতল।

রাজর্ষি প্রধান এসে কম্পিতস্বরে প্রশ্ন করেন—এ কি করলে কন্যা?

সুলভা—আর এই বৃথা প্রতীক্ষার জীবন সহ্য করতে ইচ্ছা করে না পিতা।

রাজর্ষি প্রধান অশ্রুসজল চক্ষু তুলে প্রশ্ন করেন—বৃথা প্রতীক্ষা কেন বলছ?

সুলভা—বুঝেছি পিতা, আমার অদৃষ্ট চায় যে, আমার হাতের বরণমাল্য যেন আমার হাতেই শুকিয়ে শেষ হয়ে যায়। বার বার তিনবার ব্যর্থ হয়েছে আমার প্রতীক্ষা। আমাকে আর এই উপহাস সহ্য করতে বলবেন না।

কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থাকেন রাজর্ষি প্রধান। তার পরেই ব্যথিত স্বরে বলেন—তবে তুমি কি চিরকুমারী হয়ে জীবনাতিপাত করতে চাও?

সুলভা—হ্যাঁ।

আবার কিছুক্ষণ নীরবে কি-যেন চিন্তা করতে থাকেন রাজর্ষি প্রধান। পরক্ষণে তাঁর বিষাদমেদুর দুই চক্ষুর দৃষ্টি হঠাৎ দীপ্ত হয়ে ওঠে। রাজর্ষি প্রধান বলেন—আমার কুলযশের কথা তুমি কি জান না?

সুলভা—জানি পিতা, আপনি সকল ক্ষত্রিয়ের সম্মান ও শ্রদ্ধার আস্পদ। আপনি রাজর্ষি, আপনার পূর্বপুরুষের অনুষ্ঠিত যজ্ঞকর্মে স্বয়ং সুরপতি ইন্দ্রও উপস্থিত থাকতেন। আমি সেই যনিষ্ঠ ক্ষত্ৰকুলের কন্যা।

 

 

রাজর্ষি প্রধান—কিন্তু সেই বংশের কন্যা যদি চিরকুমারীর জীবন যাপন করে, তবে সর্বসমাজে এই বংশের অপযশ প্রচারিত হবে না কি কন্যা?

পিতার প্রশ্ন শুনে অকস্মাৎ সন্ত্রস্তের মত চমকে উঠলেও, ধীর দৃষ্টি তুলে শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করে সুলভা—আপনি কি বলতে চাইছেন পিতা? চিরকুমারী হয়ে বেঁচে থাকার পরিবর্তে আপনার কন্যা যদি এখনি মৃত্যু বরণ করে, তবেই কি আপনার কুলখ্যাতি অক্ষুণ্ণ থাকবে?

অশ্রুপ্লাবিত হয় সুলভার চক্ষু—আমার রূঢ় ভাষণের অপরাধ ক্ষমা করুন পিতা, এবং আদেশ করুন আমাকে; বলুন, কি করলে আপনার কুখ্যাতি ক্ষুণ্ণ হবে না।

রাজর্ষি প্রধান বলেন—তুমি আমার কুলখ্যাতি বৃদ্ধি কর কন্যা।

সুলভা—বলুন, তার জন্য কি করতে হবে?

রাজর্ষি প্রধান—তুমি ব্ৰহ্মব্রত গ্রহণ কর। বিষয়সংসর্গ হতে মুক্ত হয়ে আত্মজ্ঞানলাভ কর তুমি। ভবিষ্যতের মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে তোমার পিতৃকুলের এই সুযশ কীর্তিগাথা হয়ে ধ্বনিত হবে, মোক্ষপথের পথিক হয়েছিল আর আত্মসিদ্ধি লাভ করেছিল ক্ষত্রিয় প্রধানের কুমারী কন্যা ব্রহ্মবাদিনী সুলভা। আমার ইচ্ছা, সাত্ত্বিকা হও তুমি, পরম জ্ঞানে প্রশান্ত হোক তোমার জীবন। সুখাকাঙক্ষারহিত এক জগতের পথে পরিব্রাজিকা হও তুমি।

রাজর্ষি প্রধানের মুখ হতে যেন এক নূতন জীবনের পরিচয়বাণী মন্ত্রধ্বনির মত উৎসারিত হয়ে চলেছে। উৎকর্ণ হয়ে শুনতে শুনতে প্রসন্ন হয়ে ওঠে সুলভার বিষণ্ণ নয়নের দৃষ্টি। সুলভা বলে—তাই হোক, পিতা।

 

 

তারপর দীর্ঘ দশটি বৎসর। ব্রহ্মচারিণী সুলভার জীবন তপস্যায় আর পরিব্রজ্যায় অতিবাহিত হয়েছে। তবু আজ বিদেহদেশের এই বনসরসীর জনহীন তটে বসে সুলভা তার অঞ্জলিপুটে গৃহীত সলিলের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখতে পায়, দশ বৎসর পূর্বের সেই ঘটনার স্মৃতি ধারণ ক’রে আজও রয়েছে তার করতলের সেই ক্ষতরেখার চিহ্ন, ছিন্ন মাল্যের সেই চকিত দংশনের চিহ্ন।

অঞ্জলিপুটে গৃহীত সলিল বনসরসীর বক্ষে নিক্ষেপ ক’রে উঠে দাঁড়ায় সন্ন্যাসিনী সুলভা। কি ভয়ংকর এই চিহ্নের প্রাণ, যে চিহ্ন আজও তার মনের মন্ত্রমালা ছিন্ন ক’রে দেয়! সন্দেহ হয় সুলভার, এ কি সত্যই জ্ঞানার্থিকা পরিব্রাজিকার জীবন, অথবা নিজেরই মনের এক অভিমানের বেদনায় সুখের প্রাসাদ হতে পলাতক এক বনচারিণীর জীবন?

আবার সলিল গ্রহণ করবার জন্য অঞ্জলি প্রসারিত ক’রে বনসরসীর সলিলের দিকে নমিত মস্তকে তাকাতে গিয়েই আর্তনাদ ক’রে ওঠে সুলভা—এ কি?

নিজেরই সুন্দর মুখের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছে সুলভ। কবরীতে কিংশুমঞ্জরীর গুচ্ছ। সন্ন্যাসিনী তপঃক্লিষ্ট মুখের প্রতিবিম্ব নয়, যেন এক অভিসারিকার বিহ্বল মুখচ্ছবি বনসরসীর সলিলে ভাসছে। কবরীতে কিংশুকমঞ্জরীর গুচ্ছ পরিয়ে দিয়েছে কে জানে কোন্ ভুলের দেবতা। নিজের দেহের দিকে তাকাতে গিয়ে আরও বিস্মিত হয় সুলভা; সন্ন্যাসিনীর কাষায় বসনের উপর বিন্দু বিন্দু পরাগধূলি চিত্রিত হয়ে রয়েছে।

বিষয়সংসর্গ হতে পলাতকা ও আত্মজ্ঞানসাধিকা এক ব্রহ্মচারিণীর জীবন নিয়ে আজ এই বিদ্রুপের খেলা খেলছে অদৃষ্টের কোন অভিশাপ? তাই কি তার জীবন আজও খুঁজে পেল না পরম প্রশান্তি? সত্যই কি সন্ন্যাসিনী সুলভ আজও কাষায় বসনে আচ্ছাদিত একটি অভিমান মাত্র? জ্ঞানান্বেষিণীর এই দশ বৎসরের পরিব্রজ্যা কি শুধু এক কণ্টকক্ষতবিব্রত অভিসার?

বনসরসীর তট হতে উঠে, ধীরে ধীরে আবার কিংশুকতরুর ছায়ায় এসে দাঁড়ায় সুলভা। বনবিহগের কলকূজনে প্রভাতবায়ু মুখরিত হয়। মনে হয় সুলভার, এই কলকূজন যেন এক আর্তস্বর; যেন এক শমীলতার অন্তরে সুগুপ্ত পাবকশিখার আভাস দেখতে পেয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে বনভূমি। বুঝতে পারে সুলভা, দশ বৎসর পরে আজ নিজের অন্তরের দিকে তাকাতে গিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে সন্ন্যাসিনীর প্রাণ। পরিব্রাজিকা আজ নিজেরই অজ্ঞাত মনের ইঙ্গিতে অভিসারিকার মত মিথিলা নগরীর উপান্তে এই বনভূভাগের এক কিংশুকের ছায়াতলে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

 

 

এখানে কেন এসেছে সুলভা? মিথিলা নগরীর নিবিড়ধবল রাজপ্রাসাদের শিখরকেতনের দিকে নিষ্পলক চক্ষু তুলে কেন তাকিয়ে থাকে সুলভা? কেন বার বার অকারণে ধ্যান ভেঙ্গে গিয়েছে? বহু জনপদ, বহু আশ্রম, বহু ঋষিকুটীর, বহু তপোবন আর বহু তীর্থের ভূমি অতিক্রম ক’রে অগ্রসর হয়েছে যে পরিব্রাজিকার জীবন, তার চরণ কেন বিদেহদেশের এক কিংশুকের ছায়াশ্রয়ে এসে ক্লান্তি বোধ ক’রে?

দুই হাতে অশ্রুসিক্ত নয়ন আবৃত ক’রে সুলভা। বুঝতে পারে সুলভা, মিথিলা নগরীর ঐ নিবিড়ধবল প্রাসাদের অন্তর পরীক্ষার জন্য এক অদ্ভুত তৃষ্ণা বক্ষে নিয়ে এই কিংশুকের ছায়ায় সে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ প্রাসাদে বাস করেন বিদেহাধিপতি ধর্মধ্বজ জনক, বেদজ্ঞ ক্ষত্রিয় জনক, মহাত্মা পঞ্চশখের শিষ্য জনক। সাংখ্যজ্ঞান যোগ ও নিষ্কাম যজ্ঞ, এই ত্রিবিধ মোক্ষতত্ত্ব অবলম্বন ক’রে আর পরব্রহ্মে চিত্ত সমর্পণ ক’রে বিষয়রাগবিহীন নৃপতি জনক বিষয়াদির মধ্যেই বিশুদ্ধ বৈরাগ্য নিয়ে অবস্থান করছেন। তিনি আত্মজ্ঞানী, তিনি বিমুক্ত, তিনি নির্লিপ্ত। ভর্জিত বীজ যেমন সলিলাসিক্ত হলেও অঙ্কুর উৎপাদন করে না, জনকও তেমনি বন্ধনের আয়তনস্বরূপ তাঁর এই ধর্মার্থকামসঙ্কুল রাজকীয়তার মধ্যেই মুক্তসঙ্গ অবস্থায় জীবনযাপন করেছেন।

দেখতে ইচ্ছা করে, এই আত্মজ্ঞানী জনকের বৈরাগ্যভাবনায় অনুলিপ্ত দুটি চক্ষুর রূপ। জানতে ইচ্ছা করে, দিনরজনীর কোন মুহূর্তে কি মনের কোন চিন্তার ভুলে ছিন্ন হয়ে যায় না জ্ঞানী জনকের মন্ত্রমালা? সত্যই কি লোষ্ট্রে ও কাঞ্চনে সমজ্ঞান লাভ করেছেন বিপুল রত্নের অধিপতি জনক? কেমন সেই বীতরাগ পুরুষের বক্ষ, যে বক্ষের নিঃশ্বাসে অনুরাগ নেই, ঘৃণাও নেই?

এতদিন বুঝতে পারেনি, আজ বুঝতে পারে সুলভা, আত্মজ্ঞানী জনককে দেখবার জন্য যে দুর্বার কৌতূহল তার তপঃক্লিষ্ট মনের আকাশে সুপ্রভ তারকার মত গোপনে ফুটে উঠেছিল, সে কৌতূহল আজও ফুটে রয়েছে। নৃপতি জনকের জীবনকাহিনী সুলভার কল্পনায় এক অদ্ভুত মোহ সঞ্চারিত করেছে। সিক্ত চক্ষু কাষায় বসনের অঞ্চল দিয়ে মুছে নিয়ে মনে মনে আজ স্বীকার করে সুলভা, জনক নামে একটি জীবনের রূপ দেখবার জন্যই পরিব্রাজিকা সন্ন্যাসিনী আজ অভিসারিকার আগ্রহ নিয়ে বিদেহদেশের এই কিংশুকতরুর আশ্রয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

 

 

আর দ্বিধা করে না সুলভা। ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। পিছনে পড়ে থাকে কিংশুকের ছায়া। নিবিড়ধবল প্রাসাদের শিখরকেতনের দিকে লক্ষ্য রেখে বনপথ অতিক্রম করতে থাকে সুলভা।

যেন দূর কাননের নিভৃত হতে স্তবকিত কিংশুকের দ্যুতি মৃদুপবনকম্পনে সঞ্চারিত হয়ে এই রাজসভাস্থলের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। কাষায় বসনে আবৃতদেহা এক সন্ন্যাসিনী, কিন্তু দেখে মনে হয়, যেন এক কান্তবিয়োগবিধুরা নিশিচক্রবাকীর স্বপ্ন পথ ভুল ক’রে মিথিলাধীশ জনকের এই সভাভবনের অভ্যন্তরে চলে এসেছে।

সন্ন্যাসিনী সুলভা সভাস্থলে প্রবেশ করতেই বিস্ময়াবিষ্ট নেত্রে তাকিয়ে থাকেন নৃপতি জনক। বুঝতে পারেন না, এই নারী সত্যই কি বিষয়রাগরহিতা এক সন্ন্যাসিনী, অথবা দয়িতবাহুবিচ্যুতা এক বিরহিণী প্রেমিকা? দীর্ঘকালের তপঃশ্রমের ক্লান্তি অঙ্কিত রয়েছে এই বরযৌবনা নারীর নয়নে, যেন কিরাতধাবিতা কুরঙ্গীর বেদনার্ত নয়ন। জটাজীর্ণ হয়েছে নারীর কুন্তলকলাপ; কিন্তু এই পরিব্রাজিকার পথক্লেশে অভিভূত দুই চরণের নখমণি হতে যেন জ্যোৎস্না স্ফুরিত হয়। মনে হয়, এক আতপতাপিতা কেতকীর দেহ স্মিগ্ধ ছায়ার অনুসন্ধানে এই পৃথিবীর পথে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে, দিশা হারিয়ে, আর ভুল ক’রে এই সভাস্থলে এসে দাঁড়িয়েছে।

বিনয়নম্র বচনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জনক। স্বাগত সম্ভাষণ জ্ঞাপন ক’রে আগন্তুকের পরিচয় জানাতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।—মনে হয়, আপনি সকল ভোগসুখস্পৃহা বর্জন ক’রে আত্মজ্ঞানের সন্ধানে সন্ন্যাসিনী হয়েছেন। বলুন, বিদেহাধিপতি জনকের এই রাজসভাস্থলে আপনার শুভাগমনের হেতু কি?

সুলভা বলে—আপনাকে দেখবার ইচ্ছা।

বিব্রত বোধ করেন জনক—আপনার এই ইচ্ছারই বা হেতু কি?

সুলভা—আমার মনের একটি আশা সফল হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে আপনাকে দেখতে এসেছি, মিথিলেশ রাজর্ষি

জনক বিস্মিত হয়ে বলেন—আমাকে দেখে আপনার মনের একটি আশা সফল হবে, আপনার মনে এ কেমন বিচিত্র ভাবনা, সন্ন্যাসিনী!

 

 

সুলভা—আত্মজ্ঞানী জনকের, মোক্ষধর্মানুব্রত জনকের বৈরাগ্যভাবিত দু’টি নয়নের দৃষ্টি দেখে শুধু বিস্মিত হয়ে আমি ফিরে যেতে চাই। আর কোন ইচ্ছা নিয়ে আপনার সমীপে আসেনি এই পরিব্রাজিকা সন্ন্যাসিনী।

নৃপতি জনক প্রশ্ন করেন—আপনার মনে কি কোন সংশয় আছে যে, মিথিলাপতি জনকের জীবন সত্যই বাসনাবিহীন বিমুক্তের জীবন নয়?

সুলভা—সন্দেহ করতে ইচ্ছা ক’রে না, বিদেহরাজ।

নৃপতি জনক বলেন—আপনার এই কথাই প্রমাণিত করছে যে, আপনার মনে সন্দেহ আছে।

ভাববিচলিত সাগ্রহ স্বরে অনুরোধ করে সুলভা।—সন্ন্যাসিনীর সেই সন্দেহ দূর ক’রে দিন।

যেন ক্লান্ত জীবনের ভার নিবেদন করছে সুলভা। কি-এক গূঢ় বেদনায় বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে নৃপতি জনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সন্ন্যাসিনী সুলভা। যেন জনকের ঐ বিশাল বক্ষঃপটের উপর লুটিয়ে পড়ে শান্ত হতে চায় সুলভার জটাকীর্ণ কুন্তলের বেদনা। কামনাবিহীন ঐ জ্ঞানীর বদনসন্নিধানে গিয়ে আত্মহারা হতে চায় সুলভার অধরসুষমা। দেখে মনে হয়, অকস্মাৎ এক প্রণয়মহোৎসবের উচ্ছ্বাসে এসে শিহরিত করেছে সন্ন্যাসিনীর কাষায় বসনের অঞ্চল। দশ বৎসর পূর্বের এক পৌর্ণমাসী সন্ধ্যার একটি তৃষ্ণা যেন অদৃশ্য বরমাল্যের মত সুলভার হাতে চঞ্চল হয়ে দুলছে। স্বয়ংবরা নায়িকার মত প্রেমবিধুর নেত্রে জনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সুলভা।

মুগ্ধ জনকের বিবশ দৃষ্টি হঠাৎ চমকে ওঠে। সন্ত্রন্তের মত বিচলিত কণ্ঠস্বরে যেন আচ্ছন্ন এক ভর্ৎসনার ভাষা ধ্বনিত করেন জনক।—এ কি সন্ন্যাসিনী, এ কেমন আচরণ?

সুলভা—আপনি বিচলিত হলেন কেন?

জনক—আমার সন্দেহ হয় সন্ন্যাসিনী, তুমি সন্ন্যাসিনী নও।

নৃপতি জনকের এই ভর্ৎসনাকে প্রশান্ত চিত্তে বরণ ক’রে নেবার জন্যই নীরবে মাথা হেঁট ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে সুলভা। নিজের হৃদয় সম্বন্ধে সুলভার মনে আর কোন সন্দেহ নেই। উপলব্ধি করেছে সুলভা, সন্ন্যাসিনী সুলভার এই জীবন এক সবাসনা অভিসারিকার জীবন মাত্র। সুলভার এই প্রাণ এক পরমার্থিকার প্রাণ নয়, জগতের এক প্রেমার্থিকা নারীর প্রাণ মাত্র। দীর্ঘ দশ বৎসর ধ’রে কাষায় বসনের বন্ধনের বেদনায় শুধু নীরবে আর্তনাদ করেছে এক ছিন্ন বরমাল্যের অভিমান। ভর্ৎসনা নয়, যেন এক অতিকঠোর সত্যের ঘোষণাকে অন্তরের সকল তৃষ্ণা নিয়ে স্নিগ্ধ আশীর্বাণীর মত গ্রহণ করছে সুলভা। নিজের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে সুলভা, ভালই হয়েছে। আরও ভালো লাগে, ঐ কান্তিমান সৌম্য ও সত্তম পুরুষের বিস্মিত দু’টি সুন্দর চক্ষুর কাছে নিজেকে ধরা পড়িয়ে দিতে।

সুলভা বলে—আপনার সন্দেহ মিথ্যা নয়। কিন্তু সে সন্দেহে বিচলিত হবে কেন বিমুক্ত মোক্ষধর্মানুব্রত আত্মজ্ঞানী মন?

নীরব হন জনক, তার পর শান্তভাবে সুলভার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন।— আপনি ঠিকই বলেছেন সন্ন্যাসিনী, কিন্তু আমার অনুরোধ, আপনি বিদায় গ্রহণ করুন।

সুলভার অধরে সুন্দর হাস্যরেখা শিহরিত হয়ে ফুটে ওঠে।—আমার সান্নিধ্যকে এত ভয় কেন, নৃপতি জনক? লোষ্ট্রে ও কাঞ্চনে যার সমজ্ঞান, সে কেন এক প্রগল্ভা নারীর চোখের দৃষ্টিকে এত ভয় করবে? আপনার মনে এই বিকার কেন অবিকারহৃদয় আত্মজ্ঞানী?

কি কঠোর ভর্ৎসনা! সুলভার সুন্দর হাস্যবিভ্রমে শিহরিত এই প্রশ্নের আঘাতে ক্ষণতরে আর্ত হয়ে যায় নৃপতি জনকের বক্ষের স্পন্দন। কে এই নারী, যে আজ বিপুল কৌতুমদে মত্ত হয়ে নৃপতি জনকের বক্ষের নিভৃত সঞ্চিত আত্মবিশ্বাসের তন্তুগুলি ছিন্ন-ভিন্ন করছে? কে এই নিরপত্রপা, যে আজ প্রেমাভিলাষিণী নায়িকার মত মদাঞ্চিত লাস্যে অধরদ্যুতি বিকশিত ক’রে জনকের অন্তরপটে মনোহারিণী মোহচ্ছবি মুদ্রিত ক’রে দিচ্ছে? এ কি এক মায়াবিনীর মায়াকেলি, অথবা, এক সাত্ত্বিকার যোগবলের লীলা? অনুভব করেন জনক, তাঁর দুই চক্ষুর দৃষ্টিকে মুগ্ধ করেছে, তাঁর কল্পনাকে অভিভূত করেছে, তাঁর বাসনাবর্জিত চিত্তের শূন্য গহনে কামনাময় পরাগধূলির ঝটিকা সঞ্চারিত করেছে এই নারী।

সুলভার নিকটে এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে জনক বলেন—আমার একটি অনুরোধ রক্ষা কর, কাষায়পরিহিতা কামিনী।

সুলভা—বলুন।

জনক—তোমার এই ভয়ংকর মায়াকৌতুক প্রত্যাহার ক’রে শান্তচিত্তে বিদায় গ্রহণ কর।

সুলভা—আপনি কি আমাকে শান্তচিত্তে বিদায় দিতে পারবেন, নৃপতি জনক?

জনক বলেন—অবশ্যই পারব।

সুলভা—তবে বিদায় নিলাম।

চলে যেতে থাকে সুলভা। হ্যাঁ, বিশ্বাস ক’রে সুলভা, শান্তচিত্তে সুলভাকে বিদায় দিতে পারবেন জনক, কারণ শান্তি আছে জনকের মনে। নিজেকে এখনও চিনতে পারেননি এই আত্মজ্ঞানী, এবং নিজেরই হৃদয়ের এক অন্ধকারের সান্ত্বনায় শান্ত হয়ে রয়েছেন।

জনক বলেন—তুমি বলে যাও, কোন দুঃখ রইল না তোমার মনে?

থমকে দাঁড়ায়, হেসে ফেলে সুলভা—আবার এই প্রশ্ন কেন মিথিলেশ? এ প্রেমিকোচিত হৃদয়ের কৌতূহল, এ যে প্রণয়ানুরাগী পুরুষের মুখের ভাষা!

নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন জনক, এবং সন্ন্যাসিনী সুলভা ধীরে ধীরে সভাস্থল হতে অগ্রসর হয়ে ভবনোপবনের বীথিকার নিকটে এসে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে শুধু তাকিয়ে দেখতে থাকেন জনক। কাষায় বসনে আবৃতদেহা কে ঐ নারী, কিংশুকমঞ্জরীর দ্যুতি দিয়ে রচিত যার মুখরুচি? বিঘল নয়নভঙ্গীর মায়া বিচ্ছুরিত ক’রে চলে গেল নারী, কিন্তু জেনে গেল না, তাকে বিদায় দিতে গিয়ে মহাত্মা পঞ্চশিখের শিষ্য ও তত্ত্বজ্ঞ এই জনকের হৃৎপিণ্ডের নিভৃতে সত্যই অদ্ভুত এক বেদনা বেজে উঠেছে।

—শুনে যাও রহস্যময়ী। সভাস্থল হতে ছুটে বের হয়ে উপবনের বীথিকার দিকে তাকিয়ে আহ্বান করেন জনক। দাঁড়ায় সুলভা। যেন এই ব্যাকুল আহ্বানের অর্থ বুঝবার জন্য মুখ ফিরিয়ে তাকায়। নৃপতি জনক ব্যস্তভাবে নিকটে এসে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মত কম্পিতকণ্ঠে বলেন—বিদায় নেবার আগে জেনে যাও নারী, তোমাকে আমি শান্তচিত্তে বিদায় দিতে পারছি না।

চকিতস্মিতা বিদ্যুল্লেখার মত খরহাস্যভায় দীপ্ত হয়ে ওঠে সুলভার নয়ন কপোল ও চিবুক। অভিসারিকার অন্তর এতদিনে তার অন্বেষণার শেষ খুঁজে পেয়েছে। দশ বৎসর পূর্বের একটি দিবসের ছিন্ন পুষ্পমাল্যর দংশন যে-বেদনার চিহ্ন অঙ্কিত ক’রে দিয়েছিল কুমারী সুলভার মনে, নৃপতি জনকের বেদনাবিধুর কণ্ঠের এই একটি আবেদনের স্পর্শে সেই চিহ্ন মুছে গেল।

আশা সফল হয়েছে সুলভার। আর কোন দুঃখ নেই সুলভার মনে। নিজের এই দেহের দিকে তাকাতে আর ভয় ক’রে না। এতদিনে পরিব্রাজিকার পথের বাধা দূর হয়ে গেল। আজ এইখানে এই জ্ঞানীর পায়ের কাছে তার অন্তরের তৃষ্ণার বোঝা নামিয়ে দিয়ে মুক্ত হতে পারবে সুলভা। এইবার একেবারে রিক্ত হয়ে সংসারবাসনার সীমা ছাড়িয়ে চিরকালের মত চলে যেতে পারবে সুলভা।

প্রশ্ন করেন জনক—তোমার পরিচয় জানতে চাই রূপোত্তমা।

সুলভা—আমি রাজর্ষি প্রধানের কন্যা কুমারী সুলভা।

জনকের কণ্ঠস্বরে দুঃসহ বিস্ময় চমকে ওঠে।—তুমি!

সুলভা—হ্যাঁ জনক।

ব্যথাৰ্তস্বরে প্রশ্ন করেন জনক—ক্ষত্রিয়াণী সুলভা, তুমি বৃথা কেন সন্ন্যাসিনীর জীবন গ্রহণ করলে?

সুলভা—সন্ন্যাসিনীর জীবন আজও গ্রহণ করতে পারিনি, কিন্তু পারব, যদি আপনি আমার একটি অনুরোধ রক্ষা করেন, ক্ষত্রিয়োত্তম জনক।

অপরাহ্নের সূর্য ধীরে ধীরে অস্তাচলে অদৃশ্য হয়ে যায়। উপবনের লতাপ্রতানের উপর স্নিগ্ধ রশ্মি সম্পাত করে পৌর্ণমাসী সন্ধ্যার চন্দ্রমা। সুলভার মুখের দিকে অপলক চক্ষুর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আহ্বান করেন জনক।—সুলভা! বল, কি তোমার অনুরোধ?

সুলভা—আপনার বক্ষের সান্নিধ্য চাই।

চমকে ওঠেন জনক—আমার বক্ষের সান্নিধ্য?

সুলভা—হ্যাঁ, নৃপতি জনক। আপনার বক্ষের স্পর্শ নয়, শুধু সান্নিধ্য।

জনক—এ কি সন্ন্যাসিনীর জীবনের অভিলাষ?

সুলভা—প্রেমিকার জীবনের অভিলাষ।

জনক—সে অভিলাষ আমার কাছে নিবেদন ক’রে কি লাভ হবে তোমার?

অকস্মাৎ কঠোর হয়ে ওঠে সুলভার কণ্ঠস্বর—শুধু আমার লাভ নয় মিথিলেশ, তোমারও লাভ হবে।

চকিত আঘাতে সন্ত্রস্ত হয়ে এক পদ পিছনে সরে গিয়ে কঠোরভাষিণী সুলভার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন জনক। দেখতে পান, সুলভার দুই নয়ন কৌমুদীধারার মত সুতরল জ্যোতিঃসুধা উৎসারিত ক’রে হাসছে।

সুলভা বলে—তোমারও লাভ হবে আত্মজ্ঞানের অভিমানে আবৃত হে পুরুষসুন্দর। বুঝতে পারবে, তোমার ঐ মোক্ষব্রতকঠিন অন্তরের কোনখানে বাসনার অবলেশ আছে কি না-আছে। জানতে পারবে, আত্মপর প্রভেদবুদ্ধি যদি কোন মোহ তোমার জীবনে লুকিয়ে রেখে থাকে।

উত্তর দেন না নৃপতি জনক। এই কুহকিনী নারীর ধিক্কার স্তব্ধ ক’রে দেবার মত যুক্তি আর শক্তি হারিয়ে মূক হয়ে গিয়েছেন জনক।

অকস্মাৎ উচ্ছল অশ্রুর বাষ্পে সিক্ত হয়ে যায় সুলভার নয়নজ্যোৎস্না। সুলভা বলে—শূন্য মন্দির দেখতে পেলে ভিক্ষুক যেমন ভিতরে প্রবেশ ক’রে নিশিযাপন ক’রে, আমিও তেমনি আপনার ঐ বক্ষোনিলয়ের আশ্রয়ে এই পৌর্ণমাসী রজনী যাপন করতে চাই।

এগিয়ে আসে সুলভা। জনকের বক্ষঃসন্নিধানে এসে প্রভাপুলকিত নয়নে অদ্ভুত এক তৃষ্ণা উদ্ভাসিত ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে সুলভা, যেন এক সৌম্য মেঘের বক্ষের কাছে সহচরী বিদ্যুল্লেখা এসে দাঁড়িয়েছে।

পৌর্ণমাসী রজনীর আকাশে হিমকর ভাসে। একে একে ক্ষয় হতে থাকে সময়ের পল অনুপল ও বিপল। সুলভার মুখের দিকে নিমেষবিহীন দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন জনক। সন্ন্যাসিনী সুলভ নয়, মোক্ষব্রত জনক নয়, যেন প্রেমিক ও প্রেমিকা এক চন্দ্রিকাস্নাত লতাপ্রতানের নিভৃতে শুভমিলনবাসর যাপন করছে।

নেই চন্দনের অনুলেপন, নেই কুঙ্কুমের চিত্রক, তবু নববধূর মুখের মত সুস্মিত হয়ে ফুটে উঠছে সন্ন্যাসিনী সুলভার তপঃক্লিষ্ট মুখশোভা। সহসা, যেন বিপুল পিপাসাভারে শিহরিত হয়ে নৃপতি জনকের অধর চঞ্চল হয়ে ওঠে।

সুলভা বলে—না নৃপতি জনক, ভুল করবেন না।

নিরুত্তাপ জনক ব্যথিতভাবে তাকিয়ে থাকেন। সমব্যথিনীর মত নম্র কণ্ঠস্বরে সুলভা বলে—আমার এই দেহে কোন তৃষ্ণা নেই। তৃষ্ণা ছিল মনে, সে তৃষ্ণা আজ মিটে গেল আপনার এই বক্ষের সন্নিধানে এসে, আর আপনারই চর প্রেমবিহ্বল দৃষ্টি বরণ ক’রে।

উপবনতরুর পল্লবঘন অন্তরাল হতে কোকিলনাদ উত্থিত হয়ে নিশীথ বায়ুর তন্দ্রা ভেঙ্গে দেয়। নৃপতি জনকের দুই বাহু সহসা যেন অসহ ঔৎসুক্যে অস্থির হয়ে সুলভার কণ্ঠে আলিঙ্গন দানের জন্য উদ্যত হয়।

পিছিয়ে সরে যায় সুলভা—ভুল করবেন না।

জনকের বক্ষের নিঃশ্বাস যেন ক্ষোভিত আর্তনাদ ক’রে—সত্যই তোমাকে চিনতে পারলাম না, মায়াকুতুকিনী সুকঠোরা নারী।

জীবনসহচরীর মত সৌহার্দ্যভাবনায় ব্যাকুল হয়ে শান্তস্বরে প্রশ্ন করে সুলভা— কিন্তু নিজেকে এখনও কি চিনতে পারবেন না, নৃপতি জনক?

জনকের দুই বাহুর চাঞ্চল্য সহসা সন্ত্রাসিত হয়। সুলভার প্রশ্নের ধ্বনি যেন এক বজ্রের নির্ঘোষ, স্তব্ধ হয়ে নীরবে শুধু তাকিয়ে থাকেন জনক।

হ্যাঁ, এতক্ষণে জ্ঞানী জনকের ভুল ভেঙ্গেছে। এতক্ষণে নিজেরই দুই চক্ষুর চকিতাহত দৃষ্টি দিয়ে আজ নিজেকে দেখতে পেয়েছেন জনক, শুধু মোক্ষব্রতের এক ছদ্মবেশ ধারণ ক’রে মিথ্যা সন্তোষের জীবন যাপন করেছেন জনক। আত্মজ্ঞানের অহংকারকেই এতদিন আত্মজ্ঞান বলে যে মোহ পোষণ করেছিলেন জনক, সেই মোহ চূর্ণ ক’রে দিল সুলভা, নৃপতি জনকের কল্যাণকারিণী বান্ধবী সুলভা।

সুলভা বলে—ঐ দেখুন নৃপতি জনক, পৌর্ণমাসী রজনীর চন্দ্র অস্তাচলে মিলিয়ে গিয়েছে।

চন্দ্ৰাস্তবিধুর দিগ্‌বলয়ের দিকে বিষাদালস দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন জনক। কিন্তু সুলভা তার সুন্দর অধর যেন স্নিগ্ধ এক সান্ত্বনা সুস্মিত ক’রে বলে—এই বিষাদ বর্জন করুন জনক। ভুল ভেঙ্গে গেল আপনার, ভুল ভেঙ্গে গিয়েছে আমার। দু’জনের জীবনের পরম অম্বেষণার পথে শুষ্ক ধূলির আড়ালে একটি মায়াভীরু বাসনার কাঁটা লুকিয়ে ছিল, সেই কাঁটা আজ ভেঙ্গে গেল, নৃপতি জনক।

ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, জনকের দুই চক্ষু। সুস্মিত ও শান্ত দৃষ্টি নিয়ে সুলভার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন জনক। এবং জনকের সেই সুস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে দিব্য এক প্রসন্নতায় উদ্ভাসিত হয় সুলভারও আননশোভা। এক পরম অন্বেষণার সাধনায় দু’টি জীবনের ভ্রমজয়ের প্রশান্ত আনন্দ বান্ধব আর বান্ধবীর মত দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

সুলভা—এইবার আমাকে শান্তচিত্তে বিদায় দিন।

জনক বলেন—বিদায় দিলাম বান্ধবী।

চলে গেল সুলভা। দেখতে থাকেন জনক, পৌর্ণমাসী রজনীর শেষ যামের চন্দ্রের মত ধীরে ধীরে ছায়াময় কাননের প্রান্তরেখার অন্তরালে মিলিয়ে যাচ্ছে সন্ন্যাসিনী সুলভা।


© 2024 পুরনো বই