মহাতেজা প্রমতির পুত্র রুরু এসেছিলেন মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমে এবং মহর্ষির সাক্ষাৎ না পেয়ে ফিরে চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ বিস্মিত হয়ে থেমে রইলেন কিছুক্ষণ। দেখলেন, ছায়াপাণ্ডুর সন্ধ্যাকাশের ক্রোড়ে নয়, অজস্র সৌরভ্যরম্য এই আশ্রম-প্রাঙ্গণের লতাপ্রাচীরের ছায়াচ্ছন্ন অন্তরালে যেন পূর্ণিমার কোরক লুকিয়ে রয়েছে।
নিকটে এগিয়ে গেলেন রুরু এবং বুঝলেন, মিথ্যা নয় তাঁর অনুমান। রূপাভিরামা এক কুমারী। যেন রাকারজনীর আকাশলোক হতে কৌমুদীকণিকা আহরণ করে এক শিল্পী এই তরুণীর দেহকান্তি রচনা করেছেন। ভুল হবে না, যদি জ্যোৎস্নাপিপাসী চকোর এই মুহূর্তে এসে মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমনিভৃতের এই লতাপ্রাচীরের উপর লুটিয়ে পড়ে। ভুল হবে না, যদি দক্ষিণ সমীর তার চন্দনগন্ধভার নিয়ে এখনি ছুটে আসে। এই স্মিতাননের সিতরশ্মির স্পর্শ পেয়ে আরও স্নিগ্ধ হয়ে যাবে দক্ষিণ সমীর।
প্রশ্ন করেন রুরু—তোমার পরিচয় জানতে ইচ্ছা করি, শুচিস্মিতা।
কুমারী বলে—আমি মহর্ষি স্থূলকেশের কন্যা প্রমদ্বরা। আপনি কে?
—আমি ভার্গবগৌরব প্ৰমতির পুত্র রুরু।
পূর্ণিমার কোরকের মত সুযৌবনা কুমারীর রূপরুচির তনুভঙ্গিমার দিকে বিস্ময়বিচলিত বক্ষের তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন রুরু। তাঁর দুই চক্ষুর কৌতূহল যেন সুদুঃসহ এক আগ্রহে চঞ্চল হয়ে ওঠে। ঋষির কন্যা, আশ্রমচারিণী কুমারী, কিন্তু তপস্বিনী নয়। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকেন রুরু, যেন নিদ্রিতা কেতকীর নিশীথের বাসনার মত সুস্বপ্নবিহসিত এক কামনার শিহর এই নারীর অধরপুটে ঘুমিয়ে রয়েছে। পরাগচিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে নারীর চম্পকগৌর গ্রীবার উপর; বোধ হয়, অপরাহ্নের পুষ্পরেণুমেদুর ভ্রমরের মদামোদিত চুম্বনের স্মৃতি। বরবর্ণিনী প্রমদ্বরার কপালে কিসের রেণু বর্ণমনোহর তিলকের মত অঙ্কিত রয়েছে? দেখে বুঝতে পারেন রুরু, লুব্ধ প্রজাপতি তার পক্ষধূলির চিহ্ন রেখে দিয়ে চলে গিয়েছে। বিশ্বাস হয়, এই রূপরম্যারই পীনবক্ষের আলিঙ্গন লাভ করে ফুটে উঠেছে ঐ রক্তকুরুবকের কুট্মল।
রুরু বলেন—সার্থক তোমার নাম।
প্রমদ্বরা বলে—কেন, আমার নামের মধ্যে কি অর্থ দেখলেন?
রুরু—তুমি প্রমদ্বরা, তুমি এই পৃথিবীর সকল প্রমদার মধ্যে শ্রেষ্ঠা। তোমার তনুশোভা উপভোগ করবার জন্য, তোমারই প্রস্ফুট যৌবনের সঙ্গ লাভের জন্য আকুল হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সকল পুষ্পকুঞ্জের ভ্রমর আর প্রজাপতি। ধন্য তোমার রূপ।
অপাঙ্গে রুরুর মুখের দিকে একবার নিরীক্ষণ করে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে প্রমদ্বরা, যেন তার মনের স্বপ্ন একটি হঠাৎ-আঘাতে আহত হয়েছে। এ হেন প্রগল্ভ প্রশংসা আশা করেনি প্রমদ্বরা এবং এই প্রশংসা যে প্রশংসাই নয়। অধন্য এই রূপ, যদি এই রূপ শুধু এক প্রমোদসঙ্গিনী প্রমদার রূপ মাত্র হয়। কি আনন্দ আছে সে-নারীর জীবনে, যে-নারীর জীবন শুধু দিনরজনীর প্রমদার জীবন?
রুরু ডাকেন—বিম্বোষ্ঠী প্রমদ্বরা!
চমকে এবং মুখ তুলে ব্যথিত নেত্রে রুরুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রমদ্বরা বলে— ঋষির কুমারী কন্যার প্রতি এই সম্ভাষণ উচিত নয়।
রুরু বলেন—আমি আমার আকাঙিক্ষতা নারীকে আহ্বান করেছি।
প্রমদ্বরা—ক্ষমা করুন প্রমতিতনয়, আমি আপনার আকাঙ্ক্ষার পরিচয় কিছুই জানি না।
রুরু—আমার এই মুগ্ধ চক্ষুর দিকে তাকিয়েও কি কিছুই বুঝতে পার না?
প্রমদ্বরা—হ্যাঁ, বুঝতে পারি, আপনার ঐ সুন্দর চক্ষু দুটি শুধু মুগ্ধ হয়েছে।
রুরু—মুগ্ধ হয়েছে আমার এই দেহের সকল শোণিতকণিকা, সন্ধ্যারুণের রক্তরাগে রঞ্জিত হয়ে যেমন মুগ্ধ হয়ে ওঠে সুশ্বেত শারদ মেঘের বক্ষের পরমাণু। শালীননয়না বনহরিণীর মত অয়ি নিবিড়েক্ষণা নারী, তোমার নেত্রবিচ্ছুরিত রশ্মি বহ্নি হয়ে আমার অন্তরে প্রবেশ করেছে। ক্ষীণকটিমধুরা অয়ি শোভনাঙ্গী, তোমার ঐ অনুপম অঙ্গহিল্লোল পান করবার জন্য প্রমতিতনয়ের এই আলিঙ্গনসমুৎসুক দুটি বাহু বাসনায় বিহ্বল হয়ে উঠেছে। এস, এই শুভক্ষণে ক্ষণপ্রণয়ের মহোৎসবে জীবন ধন্য কর, শুভাননা।
আর্তনাদ করে পিছনে সরে যায় প্রমদ্বরা, যেন এক বিষধরের গরলময় নিঃশ্বাসের বায়ু তার অঙ্গে এসে লেগেছে। কী ভয়ংকর এক আকাঙক্ষার প্রাণী ভার্গবগৌরব প্রমতির পুত্রের মূর্তি ধরে তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
বেদনাদিগ্ধ স্বরে রুরু বলেন— তুমি তপস্বিনী নও প্রমদ্বরা।
প্রমদ্বরা—আমি তপস্বিনী নই।
রুরু—তবে কেন এই কঠোর কুণ্ঠা?
প্রমদ্বরা—আমি সাধারণী, আমি ঋষি পিতার স্নেহে পালিতা কন্যা, আমি কুমারী, এই কুণ্ঠা যে আমার জীবনের ধর্ম।
রুরু বলেন—এমন ধর্মের কোন অর্থ হয় না।
প্রমদ্বরা কুপিত স্বরে বলে—বুঝেছি, আপনার পৌরুষ ধর্মহীন হয়েছে প্রমতিতনয়। আপনি প্রস্থান করুন। আপনার সান্নিধ্য আমি সহ্য করতে পারছি না।
অপলক নেত্রে বিস্ময়াবিষ্টের মত ঋষিকুমারী প্রমদ্বরার মুখের দিকে তাকিয়ে এই নিষ্ঠুর ধিক্কারবাণীর অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেন রুরু; কিন্তু বুঝতে পারেন না। কোপকঠোর স্বরে ধিক্কারবাণী শুনিয়ে দিয়েছে প্রমদ্বরা, কিন্তু কেন? বসন্তের কুঞ্জবনের পুষ্প কি পিকনাদ শুনে বিমর্ষ হয়? কলহংসের কণ্ঠস্বর শুনে কি জলনলিনী কুপিতা হয়? নীলাঞ্জনের ছায়া দেখে কি দুঃখিত হয় সুনিবিড়া নীপবনলেখা?
অভিমানকাতর কণ্ঠে রুরু বলেন—তোমার এই ধিক্কারবাণীরও অর্থ বুঝতে পারছি না।
প্রমদ্বরা বলে—আমি অপ্সরা নই প্রমতিতনয়, ক্ষণপ্রণয়ের ঘৃণ্য আনন্দে আত্মসমর্পণ করতে পারে না কোন ঋষিকুমারী।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন রুরু। তারপর শান্তভাবে বলেন—শোন ঋষিকুমারী, আমি আমার পিতার ও মাতার ক্ষণপ্রণয়ের সন্তান।
চমকে ওঠে প্রমদ্বরা—আপনার এই কথার অর্থ কি প্রমতিতনয়?
রুরু—অপ্সরী ঘৃতাচী আমার মাতা।
প্রমদ্বরা নিষ্পলক নয়নে প্রমতিতনয় রুরুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রুরু বলেন—বিস্মিত হয়ে কি দেখছ নারী? ক্ষণপ্রণয়ের সন্তান কি দেখতে মানুষের মত নয়?
প্রমদ্বরার দুই চক্ষু অকস্মাৎ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। রুরু বলেন—অকারণে বেদনার্ত হও কেন নারী?
প্রমদ্বরা বলে—আমিও সত্যই ঋষিকুমারী নই, প্রমতিতনয়।
রুরু—তবে কে তুমি?
প্রমদ্বরা—আমি মহর্ষি স্থূলকেশের পালিতা কন্যা। আমার পিতা গন্ধর্ব বিশ্বাবসু, মাতা অপ্সরা মেনকা। আমিও ক্ষণপ্রণয়ের সন্তান।
প্রসন্নচিত্তে রুরুর মুখ আনন্দে দীপ্ত হয়ে ওঠে। হাস্যতরলিত কণ্ঠস্বরে রুরু বলেন—কিন্তু তার জন্য দুঃখ কেন প্রমদ্বরা?
প্রমদ্বরা—তার জন্য নয়; আমার রূঢ় সম্ভাষণে আপনি ব্যথিত হয়েছেন।
রুরু—ব্যথিত হইনি, তোমার কঠোর কুণ্ঠার নিষ্ঠুরতায় বিস্মিত হয়েছিলাম। অপ্সরাতনয়া প্রিয়হাসিনী প্রমদ্বরা, গন্ধর্বনন্দিনী মঞ্জুভাষিণী প্রমদ্বরা, এস, সকল কুণ্ঠা পরিহার করে এক অপ্সরাতনয়ের ক্ষণপ্রণয়ের অনুরাগে রঞ্জিত কণ্ঠমাল্য গ্রহণ কর। এই স্নিগ্ধ সন্ধ্যার আশীর্বাদে ধন্য হোক আমাদের মিলন, আর কারও আশীর্বাদ চাই না।
প্রমদ্বরা—কিন্তু…।
রুরু—মিথ্যা দ্বিধা বর্জন কর, প্রমদ্বরা। তুমি ঋষিকন্যা নও।
প্রমদ্ধরার সুন্দর আনন তাপিতা কেতকীর মত যেন নীরবে বেদনার জ্বালা সহ্য করতে থাকে। উত্তর দেয় না প্রমদ্বরা। শুধু দুই চক্ষু অশ্রুজলে ভরে গিয়ে ছলছল করে।
অকস্মাৎ আশাহত স্বরে আক্ষেপ করে ওঠেন রুরু।—বুঝেছি প্রমদ্বরা।
প্রমদ্বরা—কি বুঝেছেন?
রুরু—তুমি অন্য কোন প্রেমিকের আকাঙিক্ষতা নারী, তাই প্রমতিতনয়ের আহ্বান এত সহজে তুচ্ছ করতে পারছ।
আর্তনাদ করে ওঠে প্রমদ্বরা—অকারণে নিষ্ঠুর হবেন না, প্রমতিতনয়। আপনি আমার জীবনের একমাত্র বাঞ্ছিত পুরুষ। আপনি আছেন আমার স্বপ্নে, আপনি আছেন আমার প্রতীক্ষায়, আপনি আমার অন্তরমন্দিরের একমাত্র বিগ্রহ।
রুরু—বিশ্বাস করতে পারছি না।
প্রমদ্বরা—বিশ্বাস করুন। উপবনপথে দাঁড়িয়ে দূর হতে দেখেছি আপনাকে কিন্তু আপনি দেখতে পাননি, ঋষিপিতার পালিতা এক আশ্ৰমচারিণী কুমারীর চক্ষু তখন কোন্ বেদনায় সজল হয়ে উঠেছিল। পথের উপর নবমুকুলের স্তবক ফেলে রেখে ছায়াতরুর অন্তরালে লুকিয়েছি। আপনার চরণস্পর্শে আহত সেই মুকুলস্তবক তুলে নিয়ে এই আশ্রমের কুটীরে ফিরে এসেছি। কেউ দেখতে পায়নি, কেউ সাক্ষী নেই, শুধু আকাশ হতে দেখেছে প্রতিপদের চন্দ্রলেখা, কুমারী প্রমদ্বরা কি শ্রদ্ধায় আর কত আগ্রহে সেই নবমুকুলের স্তবকে তার কবরী শোভিত করেছে। আপনাকে প্রণাম করবার সৌভাগ্য কোনদিন হয়নি এই প্রণয়ভীরু কুমারীর, কিন্তু আপনার পদস্পর্শপূত পথধূলি তুলে নিয়ে এই কুমারী নিজের হাতে তার শূন্য সীমন্তসরণি কতবার লিপ্ত করেছে। আপনি পূজ্য, আপনি প্রিয়; আপনিই এই আশ্রমচারিণীর চিরকালের প্রেমের আস্পদ।
রুরু ডাকেন—প্রিয়া প্রমদ্বরা।
প্রমদ্বরা বলে—এই সম্ভাষণ চিরন্তন হোক, প্রিয় প্রমতিতনয়।
রুরু বিব্রতভাবে প্রশ্ন করেন—চিরন্তন? চিরন্তন হবে কেমন করে?
প্রমদ্বরা—চিরপ্রণয়ে।
রুরু—বিবাহের বন্ধনে?
প্রমদ্বরা—হ্যাঁ।
উচ্চহাস্যে প্রমদ্বরার চিরপ্রণয়ের অভিলাষ যেন বিদ্রূপে ছিন্ন করবার জন্য বলে ওঠেন রুরু—চিরপ্রণয়ের বন্ধন স্বীকার করতে চাও ক্ষণপ্রণয়িনী অপ্সরার কন্যা?
প্রমদ্বরা বলে—হ্যাঁ প্রমতিতনয়, আমি তোমারই জীবনের চিরসঙ্গিনী হতে চাই।
রুরু—কেন?
প্রমদ্বরা—নারীর জীবন ক্ষণপ্রণয়িনী প্রমদার জীবন নয়।
রুরু—তবে কিসের জীবন?
প্রমদ্বরা—দয়িতার জীবন।
রুরু—সে কেমন জীবন?
প্রমদ্বরা—যে জীবনে সর্বক্ষণ শুনতে পাব তোমার প্রাণের আহ্বান। তোমার শ্রান্তিতে তুমি খুজবে আমার সেবা, তোমার সংকল্পে তুমি খুঁজবে আমার সাহায্য, তোমার শান্তিতে তুমি খুঁজবে আমার সান্নিধ্য।
প্ৰমতিতনয় রুরুর মনে হয়, যেন চতুরা এক বাচালিকা নারী সুন্দর কথার ছলনা দিয়ে তার আজিকার কঠোর হৃদয়ের অপরাধ আর প্রত্যাখ্যানের নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে। যার জীবনের দয়িতা হতে চায় এই নারী, তারই বক্ষের এই মুহূর্তের ব্যাকুলতা উপেক্ষা করে কি আনন্দ লাভ করছে এই বিচিত্রহৃদয়া প্রেমিকা?
যেন শেষবারের মত প্রমদ্বরার হৃদয় পরীক্ষার জন্য ব্যগ্রভাবে হস্ত প্রসারিত করে রুরু বলেন—প্রিয়া প্রমদ্বরা, তোমার ঐ স্নিগ্ধ করপল্লব তোমার দয়িতের হস্তে সমর্পণ কর। সাক্ষী থাকুক সন্ধ্যাকাশের তারকা, দয়িতের সাকাঙক্ষ চুম্বনে সিক্ত হোক প্রেমিকা প্রমদ্বরার করপল্লব।
দুই হস্ত অঞ্জলিবদ্ধ করে সিক্ত নেত্রে এবং সাগ্রহ স্বরে প্রমদ্বরা বলে—আজ আমাকে ক্ষমা কর। আর, আমার একটি অনুরোধের বাণী শোন।
রুরু—বল।
প্রমদ্বরা—মহর্ষি স্থূলকেশের কাছে গিয়ে আমার পাণিগ্রহণের ইচ্ছা জ্ঞাপন কর।
চিৎকার করে ওঠেন রুরু—বিবাহের প্রস্তাব?
প্রমদ্বরা—হ্যাঁ। এস এক শুভক্ষণে, এস আমার ঋষিপিতার আশীর্বাদে পূত এই ভবনে, এস এক মাঙ্গল্য উৎসবের অঙ্গনে, তোমার প্রেমিকা প্রমদ্বরার আজিকার এই ভীরু পাণি সেইদিন নির্ভয় আনন্দে তোমারই পাণিতে আত্মসমর্পণ করবে।
নিষ্পলক নেত্রে প্রমদ্বরার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন তাঁর অপমানিত আকাঙক্ষার জ্বালা সহ্য করতে চেষ্টা করেন রুরু। সন্ধ্যাকাশের নক্ষত্রকেও অপমানিত করল এই নারী। এই নারীর কঠিন ও অদ্ভুত এক লোকবিধিশাসিত হৃদয়ের কাছে প্রণয়ের রীতিই শুধু পূজ্য হয়ে উঠেছে, প্রণয় নয়।
তবু প্রতিবাদ করতে পারেন না প্রমতিতনয় রুরু; এই নারীর প্রস্ফুট অধরের দ্যুতি তুচ্ছ করে চলে যেতে ইচ্ছা করে না। বুঝতে পারেন রুরু, ধিক্কার আর অভিশাপ দিয়ে এখনি চলে যেতে পারতেন, যদি এই মুহূর্তেও চিরপ্রণয়াকাঙিক্ষণী এই নারীকে ঘৃণা করতে পারতেন। কিন্তু সে যে অসম্ভব! ধন্য এই নারীর সুরম্য যৌবন, ঘৃণ্য শুধু এই নারীর প্রণয়ের রীতি। কিন্তু, জানে না এই আশ্রমচারিণী নারী, কত সহজে এই রীতিকেও ছলনা করা যায়। সংকল্প করেন রুরু, সুন্দর কথার ছলনা দিয়েই এই কঠোর মাঙ্গল্য উৎসবের শাসন আর চিরপ্রণয়ের রীতি ব্যর্থ করে দিতে হবে।
রুরু বলেন—তাই হবে, তোমার অনুরোধের জয় হোক।
প্রমদ্বরা—জয়ী হোক তোমার হৃদয়ের প্রেম।
মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রম পিছনে রেখে ফিরে চললেন প্রমতিতনয় রুরু। পিছনে মুখ ফিরে আর তাকালেন না, তাই দেখতে পেলেন না রুরু, পূর্ণিমার কোরকের মত সেই রূপাভিরামা নারী পূজার্থিনীর মত সশ্রদ্ধ আগ্রহে তাঁরই পদপীড়িত তৃণ চয়ন করে তার চেলাঞ্চলের প্রান্তে তুলে রাখছে।
জয়ী হয়েছে প্রমদ্বরার অনুরোধ। আশ্রমের লতাপ্রাচীরের অন্তরালে দাঁড়িয়ে শুনতে পেয়েছে প্রমদ্বরা, ভার্গবগৌরব প্রমতি স্বয়ং এসে মহর্ষি স্থূলকেশের পালিতা কন্যা প্রমদ্বরাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করবার ইচ্ছা জ্ঞাপন করেছেন। প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন মহর্ষি। সানন্দে এবং সাশ্রুনয়নে পিতা স্থূলকেশ তাঁর কন্যাকে প্ৰমতিতনয় রুরুর হস্তে সম্প্রদানের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে মন্ত্রপাঠ করেছেন। সেদিন আসন্ন, যেদিন ঐ আকাশেই একটি সন্ধ্যায় হীরকবিন্দুর মত তারকা উত্তরফল্গুনী ফুটে উঠবে। সেই সন্ধ্যায় প্রমদ্বরার প্রেমের পুরুষ প্রমতিতনয় রুরু শুভবিবাহের মাঙ্গল্য উৎসবের মধ্যে আবির্ভূত হয়ে প্রমদ্বরার পাণিগ্রহণ করবে। আশ্রমচারিণী নারীর পুষ্পচয়নব্রত এই হাত সেদিন প্রেমিকের পাণিস্পর্শে ধন্য হবে।
আশ্ৰমতড়াগের সলিলশোভার দিকে নয়, অপর প্রান্তে উপবনবীথিকার দিকে তৃষ্ণাতুরার মত দৃষ্টি তুলে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল প্রমদ্বরা। নবীনার্ক কিরণে উদ্ভাসিত হয়েছে উপবনস্থলী। বিহগের কাকলী আর মধুপের গুঞ্জনে যেন এক উৎসবের আনন্দ নিঃস্বনিত হয়ে উঠেছে। প্রভাতপ্রসূনের সৌরভে বায়ু বিহ্বল হয়েছে।
পুষ্প চয়নের জন্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে উপবনস্থলীর প্রান্তে এসে দাঁড়ায় প্রমদ্বরা। কিন্তু অদূরের তৃণাঞ্চিত পথরেখার দিকে আবার তৃষ্ণাতুরার মত তাকিয়ে থাকে। এই তো সেই পথ, যে-পথের প্রান্তে প্রতি প্রভাতে তার হৃদয়বরেণ্য প্রেমিকের মূর্তিকে অভ্যুদিত হতে দেখেছে প্রমদ্বরা।
—প্রিয় প্রমদ্বরা!
আহ্বান শুনে চমকিত হয়ে পিছনে তাকায় প্রমদ্বরা এবং দেখতে পায়, দাঁড়িয়ে আছেন তারই প্রেমাস্পদ প্ৰমতিতনয় রুরু।
—বাগ্দত্তা প্রমদ্বরা!
সম্ভাষণ শুনে ব্রীড়াভঙ্গে কুষ্ঠিত হয়ে যেন দুই অধরের সুস্মিত আনন্দ গোপন করতে চেষ্টা করে প্রমদ্বরা।
রুরু বলেন—আমি এক স্বপ্ন দেখেছি, প্রমদ্বরা। তারকা উত্তরফল্গুনী আকাশে হাসছে, এবং প্রেমব্যাকুলা এক নারী বিবাহের মাঙ্গল্য উৎসবের পর এই উপবনের নিভৃতে এসে তার পরিণেতার সঙ্গ লাভ করেছে।
প্রমদ্বরার অধর সুস্মিত হয়। —তারপর?
রুরু—তারপর সেই শুভরজনীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মিলনোৎসবের আনন্দ বক্ষোলগ্ন করে তৃপ্ত হলো দু’জনের জীবনের আকাঙক্ষা।
প্রমদ্বরা—তারপর?
রুরু—তারপর প্রভাত হতেই শূন্য হয়ে গেল উপবন।
প্রমদ্বরা—তারপর কোথায় গেল তারা দু’জন?
রুরু—দুই দিকে, ভিন্ন দিকে, কেউ কারও জীবনের বন্ধন হয়ে উঠল না।
সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তুলে এবং ব্যথিত স্বরে প্রমদ্বরা বলে—এ কি সত্যই আপনার স্বপ্ন, অথবা কল্পনা?
রুরু বলেন—আমার সংকল্প।
—সংকল্প? বাণবিদ্ধা হরিণীর মত যন্ত্রণাক্ত প্রমদ্বরার দুই চক্ষু সজল হয়ে ওঠে। প্রমদ্বরা বলে—এইবার আমার স্বপ্নের কথা শুনবেন কি?
রুরু—বল।
প্রমদ্বরা—আমার স্বপ্ন জানে, মিথ্যা হবে প্রমতিতনয়ের সংকল্প। ক্ষণপ্রণয়াভিলাষী প্রমতিতনয় দেখতে পাবেন, তাঁর পরিণীতা নারী ছলনায় মুগ্ধ হয়নি, একরাত্রির কামনার লীলাকুরঙ্গীর মত এই উপবনে সে আসেনি। প্রমদ্বরা ভুলেও কখনও সে ভুল করবে না, যে-ভুলের পরিণাম নারীর শূন্য বক্ষের ব্যথিত পীযূষের চিরক্রন্দন!
শুষ্ক ও কঠোর অথচ ব্যথিত দৃষ্টি তুলে রুরু বলেন—তবে চিরকালের মত বিদায় দাও।
চলে গেলেন প্রমতিতনয় রুরু। যেন এক ভুজঙ্গীর নির্বোধ হৃদয়ের নিষ্ঠুরতা ভাঙ্গতে গিয়ে নিজেই পরাহত হয়ে আর চূর্ণ হয়ে গিয়েছেন। ভালই হয়েছে, মিথ্যা হয়ে যাক আকাশের উত্তরফল্গুনী। এক নারীর চিরপ্রণয়ের বন্ধন তাঁর জীবনের অভিশাপ হয়ে উঠবার জন্য স্বপ্ন দেখছে। চূর্ণ হয়ে যাক সেই নারীর অভিসন্ধির স্বপ্ন।
নিজভবনে ফিরে এলেন প্রমতিতনয় রুরু, কিন্তু অনুভব করেন তাঁরই মনের গভীরে বিষণ্ণ একখণ্ড মেঘের মত একটি স্তব্ধ দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে যেন এক দুরন্ত বিদ্যুতের জ্বালা অশান্ত হয়ে রয়েছে। কেন, কিসের জন্য এই বেদনা, বুঝতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বুঝতে পারেন না।
অপ্সরা-জীবনকে ঘৃণা করে অপ্সরাতনয়া প্রমদ্বরা। কিন্তু কেন? কোন্ সুখের আশায় নিজের জীবনকে চিরপ্রণয়ের বন্ধনে বদ্ধ করে এক দয়িত পুরুষের পায়ে সমর্পণ করতে চায় প্রমদ্বরা? কোন্ লাভের লোভে? বুঝতে পারা যায় না, কিন্তু মনে পড়ে প্রমতিতনয়ের, আশ্রমচারিণী সেই প্রেমিকার কাছে এই প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছেন তিনি।
অনেকক্ষণ, মধ্যাহ্নের খরতাপিত প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন প্রমতিতনয় রুরু। তাঁর মনের ভাবনা যেন ঐ তপ্তপ্রান্তরের মত এক ছায়াহীন জগতের পথে দিক্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছে। যেন তাঁর কল্পনায় তৃষ্ণার্ত এক অসহায় শিশুর ক্রন্দনধ্বনির করুণতা বেজে উঠেছে।
চমকে উঠলেন প্রমতিতনয় রুরু এবং বুঝলেন, তাঁর জীবনের এক বিস্মিত অতীত যেন তাঁর চেতনার নিভৃতে কেঁদে উঠেছে। পরভৃতিকার মত আপনবক্ষের সন্তান অপরের স্নেহনীড়চ্ছায়ার নিকটে ফেলে রেখে চলে গেলেন এক অপ্সরা মাতা, কিন্তু পরিত্যক্ত শিশুর ক্রন্দনস্বর শুনেও কি সেই মাতার নয়নে এক বিন্দু অশ্রু দেখা দেয়নি সেদিন? দুই চক্ষুর উদগত অশ্রুবিন্দু মুছে ফেলে বক্ষের দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করেন প্রমতিতনয়।
শূন্যবক্ষের চিরক্রন্দন সহ্য করতে পারবে না, এ কি কথা বলে ফেলেছে প্রমদ্বরা? কি বলতে চায় প্রমদ্বরা? মনে পড়তেই আবার চমকে ওঠেন, যেন ছিন্নমেঘ আকাশের শশিলেখার মত এক সত্যের রূপ হঠাৎ দেখতে পেয়েছেন রুরু।
এতক্ষণে যেন প্রেমিকা প্রমদ্বরার স্বপ্নের অর্থ বুঝতে পারছেন প্ৰমতিতনয় রুরু। তবে কি অমাতা হবার অভিশাপ হতে বাঁচতে চায়, সন্তানের পালয়িত্রী আর প্রেমিকের গৃহিণী হতে চায় প্রমদ্বরা? অপ্সরা-জীবনের সেই ভয় হতে রক্ষা পেতে চায় প্রমদ্বরা?
নিজের মনের এই প্রশ্নের আঘাতে প্রমতিতনয়ের ক্ষণপ্রণয়লুব্ধ হৃদয়ের মূঢ়তা অকস্মাৎ চূর্ণ হয়ে যায়। এবং মনে পড়ে যায়, আজই তো আকাশে উত্তরফল্গুনী ফুটে উঠবার তিথি।
ব্যথিত অপরাধীর মত জীবনের এক ভয়ংকর মূঢ়তা হতে পরিত্রাণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উপবনস্থলীর দিকে ছুটে চলে যান প্রমতিতনয়। স্নিগ্ধ উত্তরফল্গুনীর মত দ্যুতিময় যার নিবিড়ায়ত নয়নের কনীনিকা, সেই চিরপ্রেমের উপাসিকা প্রমদ্বরা, প্রমতিতনয়ের জীবনোপবনের প্রেমবাপীমরালী প্রমদ্বরা, সে কি এখনও তার চিরদয়িতের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে?
উপবনস্থলীর নিভৃতে এসে দাঁড়ালেন রুরু, এবং দেখলেন, যে পুষ্পতরুতলের তৃণাস্তীর্ণ ভূমির উপর দাঁড়িয়েছিল প্রমদ্বরা, সেইখানে এক কৃষ্ণসর্প ক্রীড়া করছে। পল্লবিত উপবনতরুর শ্যামশোভার উপর অপরাহ্নের আলোক ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রমদ্বরা নেই।
ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমের লতাপ্রাচীরের নিকটে এসে দাঁড়ালেন প্রমতিতনয় রুরু। শুনলেন, আশ্রমের এক কুটীরের অভ্যন্তরে যেন বেদনাহত সঙ্গীতের মত করুণ বিলাপের রোল বেজে উঠছে। অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠ মহর্ষি স্থূলকেশের উচ্চারিত মন্ত্রস্বরও শুনতে পেলেন রুরু। এবং আরও এগিয়ে এসে কুটীরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখছেন, কিশলয়াস্তীর্ণ ভূমিশয্যার উপর ঘুমিয়ে আছে সেই পূর্ণিমার কোরক। প্রমতিতনয় রুরুকে দেখতে পেয়ে অধোবদনা আশ্রমসখীদের বিলাপের রোল আরও করুণ হয়ে ওঠে। সকলে অনুরোধ করে—আসুন প্রমতিতনয়, আপনার প্রমদ্বরাকে আপনিই মৃত্যু হতে রক্ষা করুন।
—মৃত্যু হতে?
—হ্যাঁ, কৃষ্ণসর্পের দংশনে বিষজ্বালায় মূর্ছিতা হয়েছে আপনার প্রিয়া প্রমদ্বরা। এই মূর্ছাই মৃত্যু হয়ে উঠবে প্রমতিতনয়; কৃষ্ণভুজঙ্গের গরলে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে আপনারই প্রেমাভিষিক্ত পুষ্পের প্রাণ।
প্রিয়া প্রমদ্বরা! আর্তনাদ করে প্রমদ্বরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রমতিতনয় রুরু। কিন্তু সেই প্রিয়সম্ভাষণে প্রণয়িনীর নয়নকমল অক্ষিপল্লব বিকশিত করে আর হেসে ওঠে না। অধরের রক্তরাগ বিষজ্বালায় নীল হয়ে গিয়েছে, কুন্তলভার চূর্ণ মেঘস্তবকের মত লুটিয়ে পড়ে আছে। কোকনদোপম পদতলে ফুটে রয়েছে একটি রক্তবিন্দু, হিংস্র কৃষ্ণসর্পের দংশনের চিহ্ন।
মহর্ষি স্থূলকেশ এসে সম্মুখে দাঁড়াতেই অশ্রুসিক্ত নেত্রে ও ব্যাকুলম্বরে প্রশ্ন করেন প্রমতিতনয় রুরু—বলুন মহর্ষি, আপনার কন্যার এই নিদ্রা কি আর ভাঙ্গবে না?
মহর্ষি বলেন—ভাঙ্গবে, যদি তোমার জীবনে কোন পুণ্য থেকে থাকে।
অশ্রুরুদ্ধস্বরে মন্ত্র পাঠ করেন বৃদ্ধ মহর্ষি এবং মন্ত্রপূত বারি নিয়ে কন্যার ললাটে সস্নেহে সিঞ্চন করেন।
কক্ষান্তরে চলে গেলেন মহর্ষি, চলে গেল আশ্রমসখীর দল। আর, নীরব কুটীরের নিভৃতে প্রমদ্বরার নিদ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন রুরু। দেখতে থাকেন রুরু, যেন মৃত্যুময় অথচ মধুর এক স্বপ্নের স্নেহে ডুবে রয়েছে তাঁরই জীবনের উত্তরফল্গুনী। মনে হয়, কৃষ্ণসর্পের দংশনে নয়; তাঁরই ছলনার বিষ সহ্য করতে না পেরে উপবনের সেই কৃষ্ণসর্পের দংশন স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে প্রমদ্বরা।
কিন্তু কি বলে গেলেন মহর্ষি? কোন পুণ্য আছে কি রুরুর জীবনে? যদি থাকে কোন পুণ্য, তবে হে নিখিল প্রাণের বিধাতা, ঐ দুটি সুরুচির অধর হতে অপসারিত কর এই মৃত্যুময় নীলচ্ছায়া। প্রার্থনা করেন রুরু।
তারপরেই উন্মত্ত পিপাসার মত দুই ব্যগ্র হস্তের বিপুল আগ্রহে প্রমদ্বরার কোকনদোপম পদতল বুকের উপর তুলে নিলেন প্রমতিতনয় রুরু। কৃষ্ণসর্পের দংষ্ট্রাঘাতের চিহ্ন প্রেমিকের চুম্বনে চিহ্নিত হয়ে বিষবেদনার রক্তবিন্দু মুছে নিল। ওষ্ঠপুটে আহৃত গরলের জ্বালায় প্রমতিতনয় রুরু মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন।
যেন এক স্বপ্নের জগতে দাঁড়িয়ে এক সন্ধ্যাকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন রুরু। দেখছেন, সে আকাশে ফুটে ওঠে কি না তাঁর জীবনের আকাঙিক্ষত উত্তরফল্গুনী। কিন্তু কিছুই দেখা যায় না, শুধু শোনা যায়, আকাশের বক্ষ স্পন্দিত করে যেন কার বাণী প্রণাদিত হচ্ছে।
প্রশ্ন করেন রুরু—কার বাণী তুমি, হে আকাশবাণী?
—আমি এক বাণীময় দেবদূত।
—কোন্ দেবতার দূত?
—জীবনের দেবতার দূত।
—আমাকে শান্তি দান করুন দেবদূত।
দেবদূত বলেন—ভুল ভেঙ্গেছে কি ক্ষণপ্রণয়াভিলাষী মূঢ়?
রুরু বলেন—ভেঙ্গেছে।
—আশ্রমচারিণী প্রমদ্বরাকে চিনতে পেরেছ কি?
—চিনেছি।
—কি চিনেছ? তোমার জীবনের প্রমদা অথবা দয়িতা?
—দয়িতা।
—তবে তাকে মৃত্যু হতে রক্ষা কর।
—কেমন করে?
—তোমার জীবনের পুণ্য দিয়ে!
—কি পুণ্য আছে জানি না।
—তোমার প্রিয়াকে তোমার আয়ুর অর্ধ দান কর।
—বলুন আকাশচারী দেবদূত, কেমন করে আমার প্রাণহীনা প্রিয়াকে আমার আয়ুর অর্ধেক দান করি?
দেবদূত বলেন—সে দান সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। তোমার প্রাণের অর্ধ তোমারই প্রিয়া প্রমদ্বরার দেহে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছে।
রুরু—বুঝতে পারছি না, দেবদূত।
দেবদূত—তোমার প্রমদ্বরার পদতলক্ষত হতে বিষবেদনা নিজ অধরপুটে আহরণ করে তুমি তোমার আয়ুর অর্ধ হারিয়েছ, কিন্তু প্রাণ লাভ করেছে তোমার প্রিয়া। শুনে সুখী হলে কি, প্রমতিতনয়?
বিপুল হর্ষে উদ্বেল হয় রুরুর কণ্ঠস্বর—শুনে ধন্য হলাম, দেবদূত।
—কেন প্রমতিতনয়?
—প্রিয়াহীন অনন্ত আয়ুর চেয়ে প্রিয়ার প্রণয়ে বিলীন একটি মুহূর্তের জীবনকেও যে প্রিয়তর বলে মনে হয়।
—ধন্য তোমার প্রেম! সুহাস্য বর্ষণ করে আকাশের বাণী। চলে গেলেন আকাশচারী দেবদূত এবং সেই স্বপ্নময় মূর্ছা হতে জেগে উঠলেন রুরু। দেখলেন, তেমনি ঘুমিয়ে আছে প্রমদ্বরা।
—জাগো চিরদয়িতা প্রমদ্বরা। ব্যাকুল আগ্রহে আহ্বান করেন প্রমতিতনয় রুরু। নিভে আসছে অপরাহ্নের আলোক, দক্ষিণ সমীর হঠাৎ ছুটে এসে প্রমদ্বরার চূর্ণকুন্তলের স্তবক লীলাভরে চঞ্চলিত করে যায়। দেখতে পান রুরু, তিরোহিত হয়েছে মৃত্যুময় গরলের নীলচ্ছায়া, ফুটে উঠেছে প্রমদ্বরার প্রভাময় অধরের কৌমুদীকণিকা।
আহ্বান করেন প্রমতিতনয় রুরু।—চিরপ্রণয়ীর প্রাণের অর্ধ উপহার নিয়ে জেগে ওঠো, প্রমদ্বরা। প্রমতিতনয় রুরুর জীবন প্রাণ গৃহ ও সন্তানবাসনা তোমারই জন্য প্রতীক্ষার পথ চেয়ে আছে। প্রণয়ী প্রমতিতনয়ের প্রাণার্ধা প্রমদ্বরা, মিথ্যা হতে দিও না তোমার জীবনের উত্তরফল্গুনী।
যেন বিকশিত হয় মুদ্রিত কমলকলিকা। চোখ মেলে তাকায় প্রমদ্বরা। এই জগতের এক প্রেমের সঙ্গীত যেন তার অন্তর স্পর্শ করে মৃত্যুময় নিদ্রা ভেঙ্গে দিয়েছে। কিন্তু প্রাণের অর্ধ উপহার দিয়ে চিরজীবনের সঙ্গিনীকে এমন করে কে আহ্বান করছে?
বিস্মিত হয়ে প্রমতিতনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে প্রমদ্বরা।—কে ডাকছে আমাকে?
রুরু বলেন—আমি।
প্রমদ্বরা—প্রাণের অর্ধ উপহার দিয়ে কাকে ডাকলে তুমি?
রুরু—আমার জীবনের চিরদয়িতাকে।
অপলক নয়নে প্রমতিতনয় রুরুর মুখের দিকে স্নিগ্ধ ও স্মিতপুলকিত দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকে প্রমদ্বরা। রুরু বলেন— কি দেখছ, প্রিয়া প্রমদ্বরা?
প্রমদ্বরা—দেখছি, স্বপ্নও কি সত্য হয়!
রুরু বলেন—সত্য হয়েছে। ঐ সন্ধ্যাকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ।
বিস্ময়াকুল দুই চক্ষুর দৃষ্টি তুলে সন্ধ্যাকাশের দিকে তাকিয়ে প্রমদ্বরা বলে—কি?
রুরু বলেন—ঐ দেখ, আকাশে উত্তরফল্গুনী।