তাঁর নাম ভগবান আদিত্য, লোকে তাঁকে বলে লোকপ্রদীপ। সমাজকল্যাণ তাঁর জীবনের ব্রত।
সমাজকল্যাণ কোন নূতন কথা নয়, নূতন আদর্শও নয়। বহু আদর্শবাদী আছেন, যাঁরা সমাজের কল্যাণসাধনার কাজকেই জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করেছেন।
এই জন্য নয়; ভগবান আদিত্য সমাজকল্যাণের এমন একটি নীতি প্রচার করেন, যা তাঁর আগে কেউ করেননি। সমদর্শিতার নীতি। পাত্র ও অপাত্র বিচার নেই, সকলের প্রতি তাঁর সমান মমতা, সমান সম্মান। নিতান্ত পাপাচারীর প্রতি তাঁর যে আচরণ, সদাচারীর প্রতিও তাই।
শাস্ত্রজ্ঞানীরা মনে করেন এই আদর্শে ভুল আছে।—আপনি যে আলোক দিয়ে নিশান্তের অন্ধকার দূর ক’রে তৃষ্ণার্ত হরিণশিশুকে নির্ঝরের সন্ধান দেন, সেই আলোকে আবার ক্ষুধার্ত সিংহ হরিণশিশুকে দেখতে পায়। যে আলোক দিয়ে হরিণশিশুকে পথ দেখালেন, সেই আলোক দিয়ে হরিণশিশুর মৃত্যুকেও পথ দেখালেন, কি অদ্ভুত আপনার সমদর্শিতা?
আদিত্য বলেন—আবার সেই আলোকে সন্ধানী ব্যাধও সিংহকে দেখতে পায়।
শাস্ত্রজ্ঞানীরা তবু তর্ক করেন—কিন্তু এমন সমদর্শিতায় কা’র কি লাভ হলো? হরিণশিশুর প্রাণ গেল সিংহের কাছে, সিংহের প্রাণ গেল ব্যাধের কাছে। আবার ব্যাধের প্রাণ হয়তো…।
আদিত্য—হ্যাঁ, সেই আলোকে ব্যাধের শত্রুও ব্যাধকে দেখতে পেয়ে হয়তো সংহার করবে। এই তো সংসারের একদিকের রূপ, এক পরম সমদর্শীর নীতি সকল জীবের পরিণাম শাসন ক’রে চলেছে। আমি সেই নীতিকেই সেবা করি।
শাস্ত্রজ্ঞানীরা আদিত্যের এই মীমাংসায় সন্তুষ্ট হন না। তর্কের ক্ষণিক বিরামের মধ্যে হঠাৎ উপস্থিত হয় ভগবান আদিত্যের কন্যা তপতী।
তপতী বলে—যে আলোকে নিশান্তের অন্ধকার দূর হয়, সেই আলোকে মুদ্রিত কমলকলিকা স্ফুটিত হয়; সেই আলোকেই সন্ধান পেয়ে অলিদল কমলের মধু আহরণ ক’রে নিয়ে যায়; সেই মধু আবার ওষধিরূপে প্রাণকে পুষ্টি দান করে। শুধু সংহার কেন, সৃষ্টির লীলাও যে এক পরম সমদর্শীর সমান করুণার আলোকে চলেছে।
শাস্ত্রজ্ঞানীরা অপ্রস্তুত হন। আদিত্য সস্নেহ দৃষ্টি তুলে তপতীর দিকে তাকান। শুধু আদিত্যের স্নেহে নয়, আদিত্যের শিক্ষায় লালিত হয়ে তপতীও আজ সিদ্ধসাধিকার মত তার অন্তরে এক আলোকের সন্ধান পেয়েছে। বহু অধ্যয়নেও শাস্ত্রজ্ঞানীরা যে সহজ সত্যের রূপটুকু ধরতে পারেন না, পিতা আদিত্যের প্রেরণায় শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই সত্যের রূপ উপলব্ধি করেছে তপতী। ঐ জ্যোতিরাধার সূর্য, ঊর্ধ্বলোক হতে মর্ত্যের সকল সৃষ্টির উপর আলোকের করুণা বর্ষণ করছেন, যেন এক বিরাট কল্যাণের যাজ্ঞিক। কিন্তু কারও প্রতি বিশেষ কৃপণতা নেই, কা’রও প্রতি বিশেষ উদারতাও নেই। সমভাবে বিতরিত এই কল্যাণই নিখিলের আনন্দ হয়ে ফুটে ওঠে।
কল্যাণী হও! এ ছাড়া তপতীকে আর কোন আশীর্বাদ করেন না আদিত্য। রূপ যৌবন অনুরাগ বিবাহ ও পাতিব্ৰত্য ও মাতৃত্ব, সবই সমাজকল্যাণের জন্য, আত্মসুখের জন্য নয়। এই নিখিলরাজিত কল্যাণধর্মের সঙ্গে ছন্দ রেখে যে জীবন চলে, তারই জীবনে আনন্দ থাকে। যে চলে না, তার জীবনে আনন্দ নেই।
পিতা আদিত্যের এই শিক্ষা ও আশীর্বাদ কতখানি সার্থক হয়েছে, কুমারী তপতীর মুখের দিকে তাকালেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। মন্ত্রবারিসিক্ত পুষ্পস্তবকের মত স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে রচিত একখানি মুখ। এই রূপে প্রভা আছে, জ্বালা নেই। এই চক্ষুর দৃষ্টি নক্ষত্রের মত করুণমধুর, বিদ্যুতের মত খরপ্রভ নয়। সত্যই এক কুমারিকা কল্যাণী যেন অন্তরের শুচিতা দিয়ে তার যৌবনের অঙ্গশোভাকে মধুচ্ছন্দা কবিতার মত সংযত ক’রে রেখেছে।
শাস্ত্রজ্ঞানীরা যা-ই বলুন আর যতই বিরোধিতা করুন, আদিত্যের প্রচারিত সমাজকল্যাণ ও সমদর্শিতার নীতিকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেছেন আরও একজন, নৃপতি সংবরণ। সংবরণের সেবিত প্রজাসাধারণ নুতন এক সুখী ও সম্মানময় জীবনের অধিকার পেয়েছে।
রাজ্য বিত্ত রূপ ও যৌবনের অধিকার পেয়েও রাজা সংবরণ এখনও অবিবাহিত। আত্মসুখের সকল বিষয় কঠোরভাবে বর্জন করেছেন সংবরণ। সংবরণ বিশ্বাস করেন, কল্যাণব্রত মানুষের ধর্ম হবে ঐ জ্যোতিরাধার সূর্যের ব্রতের মত, যার পুণ্যরশ্মি ভূলোকের সর্ব প্রাণীকে সমান পরিমাণ আলোক দান করে। উচ্চনীচ ভেদ নেই, পাত্রবিশেষ তারতম্য নেই। সমগ্র চরাচর যেন এই সূর্যের সমান স্নেহে লালিত এক কল্যাণের রাজ্য। যখন অদৃশ্য হন সূর্য, তখনও সর্বজীবকে সমভাবেই অন্ধকারে রাখেন। এই সমদর্শিতার নীতি নিয়ে নৃপতি সংবরণ তাঁর রাজ্যের কল্যাণ করেন।
সংবরণ বিবাহ করেননি, বিবাহের জন্য কোন ঈপ্সা নেই। সংবরণের ধারণা তিনি বিবাহিত হলে তাঁর সমদর্শিতার নীতি ক্ষুণ্ণ হবে, লোকহিতের ব্ৰত বাধা পাবে। ভয় হয়, সংসারের সকলের মধ্যে বিশেষভাবে শুধু একটি নারীকে দয়িতারূপে আপন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সকলকে পর মনে করতে হবে।
সেদিন ছিল সংবরণের জন্মতিথি। যে মহাপ্রাণ শিক্ষকের কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় আদর্শের পাঠ গ্রহণ করেছেন, তাঁরই কাছে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য অর্ঘ্য মাল্য ধূপ ও দীপের উপহার নিয়ে আদিত্যের কুটীরে সংবরণ উপস্থিত হলেন। উপবাসশুদ্ধ স্নানস্নিগ্ধ ও সুকঠোরব্রত তরুণ সংবরণের মুখের উপর নবোদিত সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আদিত্য মুগ্ধভাবে ও সস্নেহে প্রিয় শিষ্য সংবরণের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর দুই চক্ষুর দৃষ্টি আশীর্বাদের আবেগে স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।
তবু আজ আদিত্যের মন যেন এক বিষণ্ণতার স্পর্শে প্রলিপ্ত হয়ে রয়েছে। মনে হয়েছে আদিত্যের, শিষ্য সংবরণ যেন তার জীবনের কী-এক ভুল বিশ্বাসের আবেগে ভর ক’রে চলেছে। এই তারুণ্যলালিত জীবনকে এত কঠোর কৃচ্ছ্রে ক্লিষ্ট ক’রে রাখবার কোন প্রয়োজন ছিল না। সমদর্শিতার জন্য, সমাজকল্যাণের জন্য এই কৃচ্ছ্রের কোন প্রয়োজন নেই। এই ব্রত বনবাসী যোগীর উপযোগী ব্রত, প্রজাহিতব্রত রাজন্যের জীবনে এমন ব্ৰত শোভা পায় না।
আশীর্বাদের পর আদিত্য বলেন—একটি অনুরোধ ছিল, সংবরণ।
—বলুন।
—তোমার সমদর্শিতায় প্রজার জীবন কল্যাণে ভরে উঠেছে। কিন্তু তুমি বিবাহিত হলে তোমার ব্রতের সাধনায় বাধা আসবে, এমন সন্দেহের কোন অর্থ নেই।
—অর্থ আছে, ভগবান আদিত্য।
সংবরণের কথায় চমকে ওঠেন আদিত্য। শিষ্য সংবরণ গুরু আদিত্যের উপদেশের ভুল ধরেছে।
সংবরণ বলেন—আত্মসুখের যে-কোন বিষয়কে জীবনে প্রশ্রয় দিলে স্বার্থবোধ বড় হয়ে ওঠে।
আদিত্য বলেন—আত্মসুখের জন্য নয়, সমাজের মঙ্গলের জন্যই বিবাহ। বৈরাগ্য তোমার ব্রত নয়। সমাজে সবাকার মাঝখানে থেকে সমাজের সকল হিতের সাধক হবে তুমি। যাঁরা আদর্শবান, তাঁরা সমাজকল্যাণের জন্যই বিবাহ করেন। এক পুরুষ ও এক নারীর মিলিত জীবন সমাজকল্যাণের একটি প্রতিজ্ঞা মাত্র। এ ছাড়া বিবাহের আর কোন তাৎপর্য নেই। তুমি জান সংবরণ, আমি সমদর্শী, কিন্তু আমিও বিবাহিত। আমিও পুত্রকন্যা নিয়ে সংসারজীবন যাপন করি। এমন কি, কুমারী কন্যার বিবাহের জন্য অনেক ভাবনাও সহ্য করি।
সংবরণ কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেন—আপনার কুমারী কন্যা?
আদিত্য—হ্যাঁ, আমার কন্যা তপতী। তাকে উপযুক্ত পাত্রে সম্প্রদান করতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হই।
সংবরণ আরও কৌতূহলী হন—আপনি কি বলতে চাইছেন, ভগবান আদিত্য?
আদিত্য—তুমি বিবাহিত হও।
সংবরণকা—কা’কে বিবাহ করব?
আদিত্য সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারেন না। সংবরণের প্রশ্নে একটু বিব্রত হয়ে পড়েন।
সংবরণ বলেন—আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভগবান আদিত্য। আপনার কাছ থেকেই আমি সমদর্শিতার জ্ঞান লাভ করেছি। আপনি আমার শিক্ষাগুরু। তাই অনুরোধ করি, এমন কিছু বলবেন না, যার ফলে আপনার প্রতি আমার বিশুদ্ধ শ্রদ্ধা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়।
আদিত্য জিজ্ঞাসুভাবে তাকান—আমার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা ক্ষুণ্ণ হবে, আমার উপদেশের মধ্যে এমন কোন গর্হণীয় আগ্রহের আভাস কি তুমি পেয়েছ?
সংবরণ—হ্যাঁ গুরু। মনে হয়, আপনার কুমারী কন্যার বিবাহের জন্য আপনার যে ভাবনা, এবং আমাকে বিবাহিত জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখবার জন্য আপনার যে অনুরোধ, এই দু’য়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে।
ভগবান আদিত্য নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মিথ্যা বলেনি সংবরণ। কন্যা তপতীর জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজছেন ভগবান আদিত্য। তাঁর মনে হয়েছে, কুমার নৃপতি সংবরণই তপতীর মত মেয়ের স্বামী হওয়ার যোগ্য। নিজের মনের ইচ্ছাকে আর এক যুক্তি দিয়ে বিচার ক’রে দেখেছেন এবং বুঝেছেন আদিত্য, তাঁর পুত্রবৎ এই তরুণ সংবরণ, তাঁরই শিক্ষা ও দীক্ষায় লালিত আর সমদর্শিতার আদর্শে ব্ৰতী এই সংবরণের জীবনে তপতীর মত মেয়েই সর্বোত্তমা সহধর্মিণী।
আদিত্য তাঁর অন্তর অন্বেষণ ক’রে আর একবার বুঝতে চেষ্টা করেন, সত্যই কি তিনি শুধু তাঁর আত্মজা তপতীর সৌভাগ্যের জন্য সংবরণকে পাত্ররূপে পেতে প্রলুব্ধ হয়েছেন? নিজের মনকে প্রশ্ন ক’রে কোথাও সে-রকম কোন স্বার্থতন্ত্রের কলুষ আবিষ্কার করতে পারেন না ভগবান আদিত্য। কিন্তু কি ভয়ঙ্কর অভিযোগ করেছে সংবরণ।
আদিত্য শান্তভাবে বলেন—যদি এই দু’য়ের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকে, তাতে অন্যায় কিছু হয়েছে কি, সংবরণ?
সংবরণ—যদি সেরকম কোন ইচ্ছা আপনার থাকে, তবে আপনাকে সমদর্শী বলতে আমার দ্বিধা হবে, ভগবান আদিত্য। আপনার কন্যাকে পাত্রস্থ করবার জন্যই আপনার আগ্রহ, সমদর্শিতা ও সমাজকল্যাণের আদর্শের জন্য নয়।
আদিত্য শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বলেন—ভুল করছ সংবরণ। আমি সমদর্শী। তপতী আমার কন্যা হয়েও যতটা আপন, তুমি আমার পুত্র না হয়েও পুত্রের মতই ততটা আপন। শুধু তপতীকে পাত্রস্থ করবার জন্যই আমার চিন্তা নয়, সংবরণের জন্য যোগ্য পাত্রী পাওয়ার সমস্যাও আমার চিন্তার বিষয়। এক কুমার ও এক কুমারীর জীবন দাম্পত্য লাভ ক’রে সমাজের কল্যাণে নূতন মন্ত্ররূপে সংকল্পরূপে ব্রতরূপে ও যজ্ঞরূপে সার্থক হয়ে উঠবে, এই আমার আশা। এর মধ্যে স্বার্থ নেই, অসমদর্শিতাও নেই।
আদিত্য নীরব হন। কিন্তু সংবরণের আত্মত্যাগের গর্ব যেন আর একটু মুখর হয়ে ওঠে—ক্ষমা করবেন, আপনার সমদর্শিতার এই ব্যাখ্যা আমি গ্রহণ করতে পারছি না, গুরু। আপনি ভুল করছেন। আমি শুদ্ধচারী ও সংযতেন্দ্রিয়, আমি আত্মবর্জিত সমাজসেবার ব্রত গ্রহণ করেছি। বিবাহিত হলে আমার জীবন স্বার্থের বন্ধনে জড়িয়ে পড়বে। এক নারীর প্রতি প্রেমের পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমার জীবনে মানবসেবা সর্বকল্যাণ ও সমদর্শনের পরীণ ব্যর্থ হয়ে যাবে।
আদিত্য আর কোন কথা বললেন না। শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে নূতন শিক্ষা নিয়ে নয়, শিক্ষার আতিশয্যে শিক্ষাগুরুকে হারিয়ে দিয়ে প্রাসাদে ফিরে গেলেন সুপ্রসন্ন সংবরণ।
বনপ্রদেশে একাকী ভ্রমণে বের হয়েছেন সংবরণ। কোথায় কোন্ বনবাসী যোগী একান্তে দিন যাপন করছেন, কোন্ নিষাদ ও কিরাতের কুটীরে দুঃখ আছে, সবই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবেন সংবরণ এবং দুঃখ দূর করবেন। সমদর্শী সংবরণের অনুগ্রহ কা’রও জন্য কম বা বেশি নয়। যেমন রাজধানীর প্রজা, তেমনি বনবাসী প্রজা, সর্বপ্রজার সুখ ও শুভের প্রতি স্বচক্ষুর কৌতুহল নিয়ে সর্বদা লক্ষ্য রাখেন সংবরণ, দূতবার্তার উপর নির্ভর ক’রে থাকেন না।
ভ্রমণ শেষ ক’রে বনপ্রান্তে এসে একবার দাঁড়ালেন সংবরণ। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কি সুন্দর ও শোভাময় হয়ে রয়েছে পৃথিবী! নীলিমার শান্তি সমুদ্রের মত আকাশে হীরকপ্রভ সুর্যের গায়ে অপরাহ্ণের রক্তিমা; নিম্নে বিপুলবিসর্পিত অরণ্যানীর নিবিড় শ্যামলতা। নিকটে অল্পোচ্চ মেঘবর্ণ শৈলগিরি, যার পদপ্রান্তে পুষ্পময় বনলতার কুঞ্জ। একটি দীর্ঘায়ত পথরেখা বনের বক্ষ ভেদ ক’রে এসে, শৈলগিরির ক্রোড়ে উঠে, তারপর প্রান্তরের বনে নেমে গিয়েছে। কিঞ্চিৎ দূরে এক জনপদের কুটীরপংক্তি দেখা যায়।
চলে যাচ্ছিলেন সংবরণ, কিন্তু যেতে পারলেন না। গিরিপথ ধ’রে কেউ একজন আসছে। যোগী নয়, নিষাদ নয়, কিরাত নয়, কোন দস্যুর মূর্তিও নয়। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে যে, তার দেহের ভঙ্গী ও পদক্ষেপে অদ্ভুত এক ছন্দ যেন স্পন্দিত হচ্ছে। মঞ্জীর নেই, তাই তার মধুর ধ্বনি শোনা যায় না।
সেই মূর্তি কিছুদূর এগিয়ে এসে হঠাৎ থেমে গেল। সংবরণ এতক্ষণে দেখতে পেলেন, এক তরুণী নারীর মূর্তি।
পথের উপর দাঁড়িয়ে আছেন সংবরণ। তরুণীর মূর্তিও আর অগ্রসর হয় না। তীব্র কৌতূহলে বিচলিত সংবরণ আগন্তুকার দিকে এগিয়ে যান, এবং বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই শোভাময় পৃথিবীর রূপে কোথায় যেন একটু শূন্যতা ছিল, এই বিচিত্র নিসর্গচিত্রের মধ্যে কোথায় যেন একটি বর্ণচ্ছটার অভাব ছিল, এই তরুণী পৃথিবীর সেই অসমাপ্ত শোভাকে পূর্ণ ক’রে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পর মুহূর্তে মনে হয়, শুধু তাই নয়, এই নিভৃতচারিণী রূপমতী যেন এই ধরণীর সকল রূপের সত্তা। পুষ্পে সুরভি দিয়ে, লতিকায় হিল্লোল দিয়ে, কিশলয়ে কোমলতা দিয়ে, পল্লবে শ্যামলতা দিয়ে এবং স্রোতের জলে কলনাদ জাগিয়ে এই রূপের সত্তা অলক্ষ্যে ভূলোকের সকল সৃষ্টির পথে বিচরণ করে। সংবরণের সৌভাগ্য, আজ তার চক্ষুর সম্মুখে সেই রূপের সত্তা পথ ভুল ক’রে দেখা দিয়ে ফেলেছে।
অনেকক্ষণ দেখা হয়ে গেল। এতক্ষণে পথ ছেড়ে পাশে সরে যাবার কথা। কিন্তু নৃপতি সংবরণ এই শিষ্টতার কর্তব্যটুকুও যেন এই মোহময় মুহূর্তে বিস্মৃত হয়েছেন।
সংবরণের এই বিস্ময়নিবিড় অপলক দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়িয়ে থেকে তরুণীর মূর্তি ধীরে ধীরে ব্রীড়ানত হয়ে আসে। কিন্তু এই অক্ষান্ত পল্লবমর্মর, চঞ্চল সমীরের অশান্ত আবেগ, অবারিত মিলন ও আকাঙ্ক্ষার জগৎ এই বনময় নিভৃতে তরুণীর এই ব্রীড়ানত দৃষ্টির সংযম যেন নিতান্ত অবান্তর বলে মনে হয়।
সংবরণ বলেন—শোভান্বিতা, তোমার পরিচয় জানি না, কিন্তু মনে হয় তোমার পরিচয় নেই।
তরুণীর আয়ত নয়নের দৃষ্টি ক্ষণিকের মত বিহ্বল হয়ে ওঠে। এই সুন্দর পুরুষের মূর্তি যেন সব অন্বেষণের শেষে তারই জীবনের পথে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পল্লবের সঙ্গীত, এই বনতরুর শিহরণ, এই গিরিক্রোড়ের নিভৃত এবং এই লগ্ন, সবই যেন এই দুই জীবনের দৃষ্টি বিনিময় সফল করবার জন্য পার্থিব কালের প্রথম মুহূর্তে রচিত হয়েছিল। মনে হয়, এই মর্ত্যভূমির সঙ্গে আর এই বর্তমানের সঙ্গে এই বরতনু পুরুষের কোন সম্পর্ক নেই। যেন দেশকালের পরিচয়ের অতীত এক চিরন্তন দয়িত, যার বাহুবন্ধন বরণ করবার জন্য নিখিলনারীর যৌবন আপনি স্বপ্নায়িত হয়। ঐ কণ্ঠে বরমাল্য অর্পণের জন্য কামিনীর করলতা আপনি আন্দোলিত হয়।
মাত্র ক্ষণিকের বিহ্বলতা, পরমুহূর্তে তরুণীর মূর্তি যেন সতর্ক হয়ে ওঠে।
তরুণী প্রশ্ন করে—আপনার পরিচয়?
—আমি নৃপতি সংবরণ।
আকস্মিক ও রুঢ় এক বিস্ময়ের আঘাতে তরুণী চমকে ওঠে, পিছনে সরে যায়। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দূরান্তের দিগ্বলয়ের দিকে নিষ্কম্প দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিলোল স্বর্ণাঞ্চল দু’হাতে টেনে নিয়ে যেন তার বিপন্ন যৌবনের সংকোচ কবচিত করে। যেন এক অপমানের স্পর্শ থেকে আত্মরক্ষা করতে চাইছে অনাম্নী এই নারী।
সংবরণ বিচলিত হয়ে ওঠেন—মনে হয়, তুমি যেন এই কল্পলোকের কামনা।
—না রাজা সংবরণ, আমি এই ধূলিমলিন মর্ত্যলোকেরই সেবা।
—তুমি মূর্তিমতী প্রভা, তোমার পরিচয় তুমিই।
—না, দিবাকর তার পরিচয়।
—তুমি স্ফুটকুসুমের মত সুরুচিরা।
—পুষ্পদ্রুম তার পরিচয়।
—তুমি তরঙ্গের মত ছন্দোময়।
—সমুদ্র তার পরিচয়। আমার পরিচয় আছে রাজা সংবরণ। আমি সাধারণী, সংসারের নারী, কুমারী।
সংবরণ—যে-ই হও তুমি, মনে হয়, তুমি আমারই জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আমার এই কণ্ঠমাল্য গ্রহণ কর।
তরুণীর অধরে মৃদু হাসি রেখায়িত হয়ে ওঠে।—আমি মানুষের ঘরের মেয়ে, পিতৃস্নেহে লালিতা কন্যা। আমি সমাজে বাস করি রাজা সংবরণ। স্বেচ্ছায় বা যথেচ্ছায় কোন পুরুষের কণ্ঠমাল্য গ্রহণ করতে পারি না, পারি সমাজের ইচ্ছায়।
—তার অর্থ?
—সমাজকুমারী কোন পুরুষকে স্বামিরূপে ছাড়া অন্য কোনরূপে আহ্বান করতে পারে না।
সংবরণের সকল আকুলতায় হঠাৎ যেন এক কঠোর বাস্তব সত্যের আঘাত লাগে। তৃষ্ণাতুরের মুখের কাছ থেকে যেন পানপাত্র দূরে চলে যাচ্ছে। সংবরণ বলেন— মনোলোভা, তোমার স্বামিরূপেই আমাকে গ্রহণ কর।
—আমি নিজের ইচ্ছায় আপনাকে গ্রহণ করতে পারি না রাজা সংবরণ। আপনি আমার পিতার অনুমতি গ্রহণ করুন।
—কেন?
—আমি সমাজের মেয়ে। পিতা আমার অভিভাবক।
—কোথায় তোমার সমাজ?
—ঐ যেখানে কুটীরপংক্তি দেখা যায়।
—এখানে এসেছ কেন?
—এসেছি, সকল কল্যাণের আধার সমদর্শী সূর্যকে দিনান্তের প্রণাম জানাতে, এই আমার প্রতিদিনের ব্রত।
সংবরণ যেন দুঃসহ বিস্ময়ে হঠাৎ চিৎকার ক’রে ওঠেন—কে তুমি?
তরুণী বলে—আমি কল্পনা নই, কল্পলোকের সৃষ্টিও নই, আমি লোকপ্রদীপ আদিত্যের কন্যা তপতী।
দুই চক্ষুর উপর যেন তপ্ত বালুকার দংশন ছুটে এসে লেগেছে, চকিতে মাথা হেঁট করেন সংবরণ। শিশির ঋতুর হিমপীড়িত বনস্পতির মত স্তব্ধ সংবরণ নীরবে দাঁড়িয়ে শুধু তাঁর বক্ষঃপঞ্জরের একটি কাতরতার ধ্বনি শুনতে থাকেন। যখন মুখ তোলেন সংবরণ, তখন বুঝতে পারেন, তরুণী তপতীর তনুচ্ছবি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
সূর্যও অস্তাচলে অদৃশ্য, বনের বুকে অন্ধকার, তপতী নেই, শুধু একা দাঁড়িয়ে থাকেন সংবরণ। সারা জগতের সত্যমিথ্যার রূপে যেন এক বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে। তাঁর আদর্শের অহংকার এবং তাঁর ত্যাগের দর্প এক নিষ্ঠুর বিদ্রূপের আঘাতে ধূলি হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু সব স্বীকার ক’রে নিয়েও এই মুহূর্তে মর্মে মর্মে অনুভব করেন সংবরণ, ঐ মূর্তিকে ভুলে যাবার শক্তি তাঁর নেই। কোথায় তাঁর সমদর্শিতা আর চিরকৌমার্যের সংকল্প! কোথাও নেই। তপতী ছাড়া এ বিশ্বে আর কোন সত্য আছে বলে মনে হয় না।
সংবরণের সত্তা যেন অন্ধকারে তার সকল মিথ্যা গর্বের মূঢ়তা ও লজ্জা থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। কোথাও চলে যাবার অথবা ফিরে যাবার সাধ্য নেই। সংসারের ঘটনার কাছে আজ হাতে হাতে ধরা পড়ে গিয়েছেন সংবরণ। কিন্তু যে স্বপ্নকে কাছে পাওয়ার জন্য তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাস আজ কামনাময় হয়ে উঠেছে, সেই স্বপ্নকে নিজেই বহুদিন আগে নিজের অহংকারে অপ্রাপ্য ক’রে রেখে দিয়েছেন। আজ তাকে ফিরে চাইবার অধিকার কই?
সংবরণ আর নিজ ভবনে ফিরলেন না।
সংবরণের এই আত্মনির্বাসনে সারা দেশে ও সমাজে বিস্ময়ের সীমা রইল না। কেন, কোন্ দুঃখে আর কিসের শোকে সংবরণ তাঁর এত প্রিয় সেবার রাজ্য ও কল্যাণের সমাজ ছেড়ে দিলেন? এ কি বৈরাগ্যের প্রেরণা?
সকলে তাই মনে করেন। ভগবান আদিত্যেরও তাই ধারণা। শুধু একমাত্র যে এই ঘটনার সকল রহস্য জানে, সে-ও নীরব।
তপতীকে নীরব হয়েই থাকতে হবে। বনপ্রান্তের অপরাহ্ণবেলার আলোকে যার মুখের দিকে তাকিয়ে তপতী তার অন্তরের নিভৃতে প্রেমিকের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছে, তাকে ভুলতে পারা যাবে না। কিন্তু সেকথা এই জীবনের ইহকালের কানে কানে কখনও বলাও যাবে না। সেই সুতরুণ কুমারের অভ্যর্থনাকে চিরকাল এক প্রহেলিকার আহ্বান বলে মনে করতে হবে। তপতী জানে, সংবরণ তাঁর হতদর্প জীবনের লজ্জা অতিক্রম ক’রে সমাজে আর ফিরে আসবেন না। কেউ জানবে না, বনপ্রান্তের এক অপরাহ্ণবেলায় এক পুরুষ ও এক নারীর সম্মুখ-সাক্ষাৎ শুধু চিরবিরহের বেদনা সৃষ্টি ক’রে রেখে গিয়েছে।
শুধু নীরব থাকতে পারলেন না সংবরণের কুলগুরু বশিষ্ঠ। রাজাহীন রাজ্যে অশাসন দুঃখ অশান্তি ও উপদ্রব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে অবহেলা ও বিশৃঙ্খলা। বশিষ্ঠ একদিন সংবরণের কাছে উপস্থিত হলেন।
বশিষ্ঠ বেদনার্তভাবে বলেন—হঠাৎ এ কি করলে সংবরণ?
—হঠাৎ ভুল ভেঙে গেল গুরু।
—কিসের ভুল?
উত্তর দেন না সংবরণ। বশিষ্ঠ আবার প্রশ্ন করেন—জানি না, কোন্ ভুলের কথা তুমি বলছ। কিন্তু ভুলের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তোমাকে এখানে থাকতে হবে কেন?
—হ্যাঁ, এখানেই। এই বনপ্রান্তের গিরিশিখর আমার মন্দির। কল্যাণাধার সূর্যের উদয়াস্তের পথের দিকে তাকিয়ে এখানেই আমাকে জীবনের শান্তি ফিরে পেতে হবে।
হেসে ফেলেন বশিষ্ঠ—ভুল করো না সংবরণ। তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারি, তোমার এই তপস্যা নিশ্চয় এক অভিমানের তপস্যা। তোমার মনে পূজাচারীর আনন্দ নেই। তুমি তোমার এক আহত স্বপ্নের বেদনা ঢাকবার জন্য মিথ্যা বৈরাগ্য নিয়ে নিষ্ঠাহীন পূজায় ব্যস্ত হয়ে রয়েছ।
সংবরণ চুপ ক’রে থাকেন, আত্মদীনতায় কুণ্ঠিত অপরাধীর নীরবতার মত। কিন্তু অতি স্পষ্ট ও কঠিন এক প্রশ্নের মূর্তির মত বশিষ্ঠ জিজ্ঞাসুভাবে সংবরণের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
সংবরণ বলেন—ভগবান আদিত্যকে আমি মিথ্যা গর্বের ভুলে অশ্রদ্ধা করেছি, এই প্রায়শ্চিত্ত তারই জন্য গুরু।
কৌতূহলী বশিষ্ঠের দুই চক্ষুর দৃষ্টি নিশিত প্রশ্নের মত তেমনি উদ্যত হয়ে থাকে, যেন আরও কিছু তাঁর জানবার আছে।
সংবরণ বলেন—ভগবান আদিত্যের কন্যা তপতী আমার কামনার স্বপ্ন; কিন্তু সেই স্বপ্নকে আমার জীবনে আহ্বান করবার অধিকার আমি হারিয়েছি গুরু।
স্নেহপূর্ণ এবং সহাস্য স্বরে বশিষ্ঠ বলেন—সেই অধিকার তুমি আজ পেয়েছ সংবরণ। সমাজহীন এই অরণ্যময় নিভৃত তোমার জীবনের অধিষ্ঠান নয়; ফিরে চল তোমার রাজ্যে, তোমার কর্তব্যের সংসারে ও সমাজে, এবং আদিত্যের কন্যা তপতীর পাণিগ্রহণ ক’রে সুখী হও।
বনপ্রান্তের নিভূত হতে প্রাসাদে ফিরে এলেন সংবরণ এবং আদিত্যের ভবনে এলেন বশিষ্ঠ। ঘটনার রহস্য এতদিনে জানতে পেরে আদিত্যও বিস্মিত হলেন। এবং তপতী এসে বশিষ্ঠ ও আদিত্যকে প্রণাম করতেই দু’জনে তপতীর সুস্মিত ও সলজ্জ মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত হলেন। আশীর্বাদ করলেন বশিষ্ঠ ও আদিত্য—তোমার অনুরাগ সফল হোক, তোমার জীবনে সূর্যারতির পুণ্য সফল হোক, সুস্মিতা।
পতিগৃহে চলে গিয়েছে তপতী। কল্যাণাধার সূর্যের উপাসক সংবরণ ও উপাসিকা তপতীর মিলিত জীবন সংসারে নূতন কল্যাণের আলোক হয়ে উঠবে এই আশায় প্রসন্ন ছিলেন আদিত্য। কিন্তু দেখা দিল আশাভঙ্গের মেঘ। আবার বিষণ্ণ হলেন আদিত্য। বেদনাহত চিত্তে তিনি নির্মম সংবাদ শুনলেন, প্রজাসেবার সকল ভার অমাত্যের উপর ছেড়ে দিয়ে তপতীকে নিয়ে দূর উপবনভবনে চলে গিয়েছে সংবরণ।
এমন বেদনা জীবনে পাননি আদিত্য। তাঁর আদর্শ যাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠা লাভ করবে বলে তিনি আশা করেছিলেন, তারাই দু’জন যেন সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সমাজের জন্য নয়, সংসারের জন্য নয়, যেন বিবাহের জন্যই এই বিবাহ হয়েছে। কোথা থেকে যেন এক মদোৎকট রীতির অভিশাপ এসে দু’টি জীবনের সৌন্দর্য ছিন্নভিন্ন ক’রে দিল। গুরু বশিষ্ঠও এসে আদিত্যের সম্মুখে অনুতপ্তের মত বিষণ্ণ মুখে থাকেন।
সুংসার সমাজ ও রাজনিকেতন হতে বহুদূরে এক উপবনভবনের নিভৃতে যেন এক স্বপ্নের নীড় রচনা করেছেন সংবরণ। এখানে তপতী ছাড়া কোন সত্যই সত্য নয়। এই যৌবনধন্যা রূপাধিকা নারীর কুন্তলসৌরভের চেয়ে বেশি সৌরভ পৃথিবীর কোন পুষ্পকুঞ্জে নেই। এই নারীর কম্র নয়নের কনীনিকার কাছে আকাশের সব তারা নিষ্প্রভ। ভুলোকললামা এই ললনার চুম্বনে ঊষা জাগে; নিশা নামে আলিঙ্গনে। কমনীয়তনু তপতীর দেহ যেন অন্তহীন কামনার পুষ্পময় উপবন, যার অফুরান পরিমল প্রতি মুহূর্তে লুণ্ঠন ক’রে জীবন তৃপ্ত করতে চান সংবরণ।
কিন্তু হাঁপিয়ে ওঠে তপতী। উপবনের মৃদুল অনিলের স্পর্শও জ্বালাময় মনে হয়। কোথায় সমাজ আর সমাজের কল্যাণ? কোথায় সূর্যারতির পুণ্য? কোথায় আদিত্যের সমদর্শিতার দীক্ষা? পতি-পত্নীর জীবন নয়, শুধু এক নর ও নারীর কামনাকুল মিলন।
সংবাদ আসে—আদিত্য বিষণ্ণ হয়ে রয়েছেন, বশিষ্ঠ দুঃখিত হয়েছেন, রাজপ্রাসাদে আতঙ্ক, প্রজাসমাজে বিদ্রোহ অশান্তি ও অনাচার। শত্রু ইন্দ্র সুযোগ বুঝে রাজ্যের শস্য ধ্বংস করেছেন, দুর্ভিক্ষপীড়িতের আর্তরবে জাতির প্রাণ চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সংবরণ বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না! ওসব যেন এক ভিন্ন পৃথিবীর দুঃখের ঝড়, এই উপবনভবনের নিভৃতে ও সুখলালস জীবনে তার স্পর্শ লাগে না। সংবরণের দিকে তাকিয়ে তপতীর দৃষ্টি ব্যথিত হয়ে ওঠে। সমদর্শী প্রজাসেবক সংবরণের এমন পরিণাম তপতী কল্পনা করতে পারেনি।
তপতীর দুঃখ চরম হয়ে উঠল সেদিন, গুরু বশিষ্ঠ যেদিন আবার সংবরণের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে উপবনভবনের দ্বারে উপস্থিত হলেন। গুরু বশিষ্ঠ এসেছেন, এই সংবাদ শুনেও সংবরণ গুরুদর্শনের জন্য উৎসাহিত হলেন না। উপবনভবনের বহির্দ্বারেই দাঁড়িয়ে রইলেন বশিষ্ঠ।
সংবরণের মূঢ়তার রূপ দেখে আতঙ্কিত হয় তপতী। নিজেকেও নিতান্ত অপরাধিনী বলে মনে হয়। কিন্তু আর নয়। নিজেকে যেন আজই এক চরম পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে চায় তপতী। নতমুখে ও সাশ্রুনয়নে ও নীরবে এক মধুরায়িত মোহের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধ’রে মনে মনে সংগ্রাম করে।
উপরে মধ্যাহ্নসূর্য, গুরু বাইরে দাঁড়িয়ে, এদিকে উপবনভবনের অভ্যন্তরে লতাবিতানে আচ্ছন্ন এক আলোকভীরু ছায়াকুঞ্জে গন্ধতৈলের প্রদীপ জ্বলে। তারই মধ্যে সাধের স্বপ্ন নিয়ে লীলাবিভোর সংবরণ, দুই বাহু দিয়ে তপতীর কণ্ঠদেশ ভুজঙ্গের বন্ধনের মত জড়িয়ে ধ’রে রেখেছেন। লুব্ধ ভৃঙ্গের ব্যগ্রতা নিয়ে সংবরণের সুন্দর মুখ তপতীর অধর অন্বেষণ করে।
হঠাৎ অশান্ত হয় তপতী। মুখ ফিরিয়ে নেয় তপতী, এবং দুই হস্তের আপত্তির আঘাতে রূঢ়ভাবে সংবরণের বাহুবন্ধন ছিন্ন ক’রে সরে দাঁড়ায়।
সংবরণ বিস্মিত হন—এ কি তপতী?
—আমি তপতী নই।
—এই কথার অর্থ?
—তপতী কোন পুরুষের শুধু আসঙ্গবাসনার উপবননিভৃতের প্রমোদসঙ্গিনী হতে পারে না।
বিমূঢ়ের মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সংবরণ, তপতীর এই অদ্ভুত ধিক্কারের অর্থ বুঝবার চেষ্টা করেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য সত্যই মনে হয় সংবরণের, তপতীর ছদ্মরূপে যেন অন্য কোন নারী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। দুই চক্ষুতে মূর্খের বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেন সংবরণ—তুমি কে?
—আমি এক নারীর দেহমাত্র।
শঙ্কিতের মত চমকে ওঠেন সংবরণ। তপতীর কথাগুলি যেন শাণিত ছুরিকার মত নির্মম; নিজেরই মায়াময় রূপের নির্মোক মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন ক’রে দেখিয়ে দিচ্ছে, ভিতরে তপতী নামে কোন সত্তা নেই। সংবরণ অসহায়ের মত প্রশ্ন করেন—তবে তপতী কে?
—তপতী হলো এক নারীর মন, যে মন পিতা আদিত্যের কাছে দীক্ষালাভ করেছে, কল্যাণাধার সূর্যের আরতি ক’রে জীবনে একমাত্র পুণ্য লাভ করেছে, যে মন সংসারের মধ্যে প্রিয়তমরূপে এক স্বামীর মন খুঁজছে; যে মন স্বামীর মনের সাথে মিলিত হয়ে সমাজ-সংসার সবাকার প্রিয় হয়ে উঠতে চাইছে। সেই শিক্ষিতা সুরুচি কল্যাণী ও প্রিয়া তপতীর মন তুমি কোন দিন চাওনি, পাওনি।
—তবে এতদিন কি পেয়েছি?
—এতদিন যা পেয়েছ তার মধ্যে তপতীর এতটুকু আগ্রহ ছিল না।
—সুতনু তপতীর কোন অনুভব কোন আনন্দে ধন্য হয়নি?
—এতটুকুও না।
উপবনভবনের স্বপ্ন যেন চূর্ণ হয়ে যায়। সংবরণের মনে হয়, ধূলিময় এক জনহীন মরুস্থলীতে একা দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তপতী এত নিকটে দাঁড়িয়ে, কিন্তু সুদূরের মরীচিকা বলে মনে হয়। রূপ নয়, রূপের শব নিয়ে এতদিন শুধু বিলাস করেছে সংবরণ।
সংবরণ—এই শাস্তি তুমি আমায় কেন দিলে তপতী? তুমি যে নিতান্ত আমারই, আমারই বিবাহিতা নারী তুমি।
তপতী—সত্য, কিন্তু শুধু বিবাহের জন্য তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়নি সংবরণ।
সংবরণ—তবে কিসের জন্য?
তপতী—জগতের জন্য। শুধু তোমার ও আমার আনন্দের জন্য নয়, জগতের আনন্দের জন্য।
জগতের জন্য! জগতের আনন্দের জন্য! তপতীর উত্তর যেন মন্ত্রধ্বনির মত উপবনভবনের বাতাসে এক নূতন হর্ষ সৃষ্টি করে।
গন্ধতৈলের প্রদীপ হঠাৎ নিভে যায়। উপবনের তরুবীথিকার শীর্ষ চুম্বন ক’রে এবং বল্লীবিতানের বাধা ভেদ ক’রে ছায়াকুঞ্জের অভ্যন্তরে সূর্যনিঃসৃত রশ্মিধারা এসে ছড়িয়ে পড়ে। এক অভিশপ্ত বিস্মৃতির দীর্ঘ অবরোধ ভেদ ক’রে বহুদিন আগে শোনা এই ধ্বনি যেন নূতন ক’রে শুনতে পেয়েছেন সংবরণ—জগতের জন্য। সংসারের মানব ও মানবীর জীবন মিলিত হয় সমাজকল্যাণের নূতন মন্ত্ররূপে, সংকল্পরূপে, ব্রতরূপে, যজ্ঞরূপে! তারই নাম বিবাহ। শুধু নিজের জন্য নয়, নিভৃতের জন্যও নয়, জগতের জন্য।
বাষ্পায়িত হয় সংবরণের দুই চক্ষু। অবহেলিত রাজ্য সমাজ ও সংসারের দুঃখ যেন ঐ সূর্যরশ্মির সঙ্গে এসে তাঁর হৃদয় স্পর্শ করেছে। এই দৃশ্য দেখতে করুণ হলেও তপতী যেন এক পাষাণীর মূর্তির মত অবিচল ও অবিকার দু’টি চক্ষুর শান্ত কঠোর দৃষ্টি তুলে দেখতে থাকে।
সংবরণ শান্তভাবে বলেন—বার বার তিনবার আমার ভুল হয়েছে তপতী, কিন্তু তুমিই চরম শাস্তি দিয়ে শেষ ভুল ভেঙে দিলে।
উত্তর দেয় না তপতী। চরম শাস্তি গ্রহণের জন্য তপতীও আজ প্রস্তুত হয়েছে।
সংবরণ ধীরস্বরে বলেন—সত্যই তোমাকে আমি আজও আমার জীবনে পাইনি তপতী, কিন্তু এইবার পেতে হবে।
চমকে ওঠে তপতীর শান্তকঠোর চক্ষুর দৃষ্টি।
তপতীর হাত ধরবার জন্য এক হাত এগিয়ে দিয়ে সংবরণ বলেন—চল।
তপতী—কোথায়?
সংবরণ—ঘরে, সমাজে, জগতে।
তপতী বিস্মিত হয়। সংবরণ যেন সে বিস্ময়কে চরম চমকে চকিত ক’রে দিয়ে বলেন—চল তপতী; গুরু বশিষ্ঠ আমাদের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।
লুব্ধ লুণ্ঠকীর মত তপতী তার দুই বাহু সাগ্রহে নিক্ষেপ ক’রে সংবরণের কণ্ঠ নিবিড় আলিঙ্গনে আপন ক’রে নিয়ে বক্ষে ধারণ করে। জীবনের আনন্দের সঙ্গীকে এতদিনে খুঁজে পেয়েছে তপতী।
হ্যাঁ, সারা জীবনের তৃষ্ণা যেন এতদিনে সত্যই তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছে। সংবরণের মুখেও সেই তৃপ্তির সুস্মিত আভাস ফুটে ওঠে।
লতাবিতানের ছায়াচ্ছন্ন নিভৃত হতে বের হয়ে অঝরিত সূর্যালোকে আপ্লুত তৃণপথভূমির উপর দু’জনে দাঁড়ায়। মনে হয় সংবরণের, মনে হয় তপতীর, যেন ক্ষুদ্র এক কারাগারের গ্রাস হতে মুক্ত হয়ে এইবার সত্যই জীবনের পথে এসে দু’জনে দাঁড়াতে পেরেছে।
তরুপল্লবের অন্তরাল হতে অকস্মাৎ পিকস্বর ধ্বনিত হয়। স্মিত সলজ্জ ও মুগ্ধ দৃষ্টি তুলে সংবরণ ও তপতী পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, যেন নব পরিণয়ে প্রীতমানস এক প্রেমিক ও এক প্রেমিকা।
সংবরণ হাসেন—তুমি শাস্তি দিয়ে আমাকে ভালবেসেছ, তপতী।
তপতী লজ্জিত হয়—তুমি ভালবেসে আমাকে শাস্তি দিয়েছিলে, সংবরণ।