পিতামহ অত্রির আশ্রমে থাকে সোমসুতা চান্দ্রেয়ী।
তপস্বিনী নয়; কিন্তু দেখে মনে হয়, যেন ক্ষান্তিহীন তপস্যার জীবন গ্রহণ করেছে চান্দ্রেয়ী। এক পরম কাম্যের পদধ্বনির জন্য তপস্যা।
ঊষাগমে যখন প্রাচীকপোল আর সন্ধ্যাগমে যখন প্রতীচীর ললাট অরুণিত হয়, তখন অত্রি-আশ্রমের ঘনশ্যামল তপোবনের নিভৃতে হেমপুষ্পের ছত্রের মত প্রস্ফুট এক সিন্ধুবারতরুর ছায়ার নিকটে এসে দাঁড়িয়ে থাকে চান্দ্রেয়ী। তরুতলের দূর্বা মঞ্জরীর দিকে সস্পৃহ নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে এবং পরক্ষণেই যেন তার বিপুলপিপাসিত অন্তরের বেদনাকে ক্ষণিক সান্ত্বনায় প্রশমিত করবার জন্য দূর্বামঞ্জরীর গুচ্ছ সাগ্রহে চয়ন ক’রে নিয়ে স্তবকিত কুন্তলে গ্রন্থিত করে চান্দ্রেয়ী। এই তো সেই সিন্ধুবারতরুর ছায়াতল, যেখানে একদিন এসে দাঁড়িয়েছিলেন অঙ্গিরার পুত্র উতথ্য। দিব্যসলিল সরোবরের বিকশিত কমলের মত কমনীয়কান্তি উতথ্য। তারই পদরেণুপূত স্পর্শের পুলক এই দূর্বামঞ্জরীর বক্ষে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে।
সেই যে কবে, আকাশের নক্ষত্ৰকুলের পরিচয় বিচারের জন্য অত্রির আশ্রমে একবার এসেছিলেন উতথ্য, সেই দিন থেকে সেই সিন্ধুবারতরুর ছায়াতল সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর জীবনে এক আরাধনাস্থলী হয়ে উঠেছে। সেদিন তমস্বিনী শর্বরীর শেষযাম যখন ফুরিয়ে গেল, আর জেগে উঠল আভাময় ঊষাভাস, তখন চলে গেলেন উতথ্য। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শেষ হয়ে গেল উতথ্যের দুই চক্ষুর কৌতূহল, তাই দেখতে পেলেন না এবং বুঝতেও পারেননি যে, ভূতলবাসিনী ইন্দুলেখার মত এক নারী এই অত্রি-আশ্রমের লতাকুঞ্জের অন্তরালে দাঁড়িয়ে তাঁরই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রতীক্ষার তপস্যা। কুসুমিত সিন্ধুবারের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে সুদূরের নিবিড়নীলাঞ্চিত দিগ্বলয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে চান্দ্রেয়ী। তার বক্ষের গভীরে সকল নিঃশ্বাস যেন দুর্বার এক কামনাময় আগ্রহে একটি পদধ্বনির জন্য উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, প্রতীক্ষাময় এক তপস্যা, সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর দুই চক্ষু যেন নিমেষ আর উন্মেষ হারিয়ে এক অব্যাজমনোহর প্রিয় মুখচ্ছবিকে তারই স্বপ্নমায়ানুলীন অনুভবের মধ্যে দেখতে থাকে।
অকস্মাৎ স্বপ্নের আবেশ ভেঙে যায়। ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় চান্দ্রেয়ী, তৃষিত কলবিঙ্কের পংক্তি আর্তকূজননাদে আকাশবায়ুকে বেদনামুখরিত ক’রে উড়ে চলেছে। অমল ক্ষৌমপটের মত ঐ আকাশের বক্ষে কোন কাদম্বিনীর রেখা নেই। যেন বিরাট শূন্য ও শুচিনির্মল আকাশবক্ষের শুষ্কতা দেখে কেঁদে উঠেছে তৃষিত কলবিঙ্ক।
বাষ্পাসারে মেদুর হয় সোমতনয়া চান্দ্রেয়ীর নীলকঞ্জপ্রভ দুই নয়ন। অঙ্গিরাতনয় উতথ্য, তোমার হৃদয়ও কি ঐ শুচিতাময় আকাশবক্ষের মত শূন্য শুষ্ক ও বিরাট? জলদসরসা এক বিন্দু মায়াও কি নেই সেই বক্ষের কোন নিভৃতে?
পুষ্পিত সিন্ধুবারের অঙ্গে চম্পকসঙ্কাশ চিবুক সমর্পণ ক’রে তৃষিত কলবিঙ্কের আর্তনাদের মত বেদনাবিধূত স্বরে প্রার্থনা করে চান্দ্রেয়ী—এস অঙ্গিরাতনয় উতথ্য, তোমারই প্রেমিকা চান্দ্রেয়ীর এই স্তবকিত কুন্তলে নিজের হাতে পরিয়ে দিয়ে যাও, নবদূর্বার মঞ্জরী।
—পৌত্রী!
আহ্বান শুনে চমকে ওঠে চান্দ্রেয়ী। দেখতে পায়, পিতামহ অত্রি নিকটে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
অত্রি বলেন—শান্ত হও চান্দ্রেয়ী। সফল হবে তোমার প্রার্থনা।
প্রস্ফুট সিন্ধুবার কুসুমের মত প্রসন্নহাস্যে দীপ্ত হয়ে ওঠে চান্দ্রেয়ীর কুন্দেন্দুসুন্দর আননের ক্ষণমেদুরিত প্রভা। সস্নেহ স্বরে এবং সান্ত্বনাবাক্যে চান্দ্রেয়ীকে আশ্বস্ত করেন অত্রি— চিন্তা করো না পৌত্রী। জানেন না উতথ্য, মূর্তিমতী ঐন্দবী দ্যুতির মত সুচারুদর্শিনী ও সুরাকাঙ্ক্ষিতা চন্দ্রদুহিতা আমার এই তপোবনে তাঁরই প্রেমাভিলাষে তপস্বিনী হয়ে রয়েছে।
চান্দ্রেয়ী বলে—কিন্তু সে তো জীবনে কোনদিনই জানতে পারবে না।
মৃদু হাস্যে পৌত্রী চান্দ্রেয়ীর উদ্বিগ্ন চিত্তকে সহসা লজিত ক’রে দিয়ে অত্রি বলেন—আমি এখনি অঙ্গিরার আশ্রমে যাব। তোমার তপস্যার কথা জানতে পারবেন অঙ্গিরাতনয় উতথ্য। তারপর…।
করুণাদ্রাবিত কণ্ঠস্বরে অত্রি বলেন—তারপর এক পুণ্য লগ্নে আমিই নিজের হাতে তোমাকে উতথ্যের কাছে সম্প্রদান করব।
চলে গেলেন অত্রি! ঊর্ধ্বাকাশের দিকে অপলক নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চান্দ্রেয়ী। মনে হয়, যেন তার এই জীবনের আকাশ হতে চিরকালের মত দূরে সরে গিয়েছে তৃষিত কলবিঙ্কের আর্তকূজন। সন্ধ্যাপনের অনুরাগে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে নিবিড়নীল দিগ্বলয়ের রেখা। দূর কান্তারের পল্লবমর্মর ভেসে আসে, যেন ভেসে আসছে প্রিয় জীবনকান্তের পদধ্বনি, সমীরিত সঙ্গীতের মত। শোনা যায়, সরোবরতটের ক্রৌঞ্চ কলরব। তরুশিরের পত্রগুচ্ছ পক্ষশিহরে চঞ্চলিত ক’রে নীড় সন্ধান করে দিনান্তের পরিক্লান্ত পতত্রী। আশ্রমকুটীরের অভ্যন্তর হতে কর্পূরদীপের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, যেন এক সুবাসবিহ্বল উৎসবের হর্ষে অভিভূত হয়েছে সন্ধ্যার তপোবনবায়ু।
আশ্রমকুটীরে ফিরে আসে চান্দ্রেয়ী। এবং ফিরে এসেই প্রতিদিনের মত আজও আবার বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে পায় চান্দ্রেয়ী, প্রতি সন্ধ্যার মত এই সন্ধ্যাতেও কুটীরের দ্বারপ্রান্তে পড়ে আছে একটি কনকবর্ণ কুবলয়ের কলিকা।
কোন্ এক অদৃশ্য ও গোপনচারী পূজকের নৈবেদ্য এইভাবে প্রতি সন্ধ্যায় সুন্দরী সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর কুটীরদেহলীর পদপ্রান্তে অধঃপাতিত আবেদনের মত পড়ে থাকে। জানে না, বুঝতে পারে না এবং কল্পনাও করতে পারে না চান্দ্রেয়ী, কোথা থেকে আসে এই দুর্লভ কনকবর্ণ কুবলয়ের কলিকা। কিন্তু প্রতিদিন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আর আতঙ্কিত নেত্রে দেখেছে চান্দ্রেয়ী, যেন তার প্রেমব্যাকুল হৃদয়ের তপস্যাকে আঘাত দিয়ে উদ্ভ্রান্ত করবার জন্য তার কুটীরের দ্বারপ্রান্তে এসে এই রহস্য পড়ে থাকে। মনে হয়, এক মায়াবীর আকাঙ্ক্ষা অলক্ষ্য ছায়ার মত চান্দ্রেয়ীর প্রতি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। কে সে, কোথায় থাকে এবং কখন আসে আর চলে যায়, কিছুই জানে না চান্দ্রেয়ী। যেন তার কণ্ঠ নেই, কণ্ঠস্বরও নেই। সে শুধু এক নীরব আবেদন।
দেখে ভয় পেয়েছে চান্দ্রেয়ী, শিহরিত হয়েছে নিঃশ্বাস, কিন্তু পরমুহূর্তে সকল ত্রাস তুচ্ছ ক’রে আর ঘৃণাভরে সেই কুবলয়কলিকার স্পর্শ পরিহার ক’রে কুটীরে প্রবেশ করছে চান্দ্রেয়ী। সন্দেহ হয় চান্দ্রেয়ীর, যেন সিন্ধুবার কুসুমের হেমপ্রেমপ্রভা মলিন ক’রে দেবার জন্য অতিকঠোর এক অভিসন্ধি নিত্য এসে তার জীবনপথের সম্মুখে কনকবর্ণ কুবলয়কলিকার রূপ ধারণ ক’রে পড়ে থাকে। ভুলেও অথবা অবহেলাভরেও ঐ ধূলিলীন কুলবলয়কলিকার দিকে আর দৃক্পাত করে না চান্দ্রেয়ী। নিশীথের অন্তে বিহগের প্রথম কাকলী যখন আশ্রমতরুর সুপ্তি ভেঙে দেয়, তখন কুটীরের বাইরে এসে দেখতে পায় চান্দ্রেয়ী, রাত্রিচর কৃকলাসের দংশনে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে কুবলয়ের কলিকা।
ভালই হয়েছে। তবু সেই ছিন্ন কুবলয়কলিকা যেন চকিত আঘাতে ব্যথিত ক’রে তোলে চান্দ্রেয়ীর সুপল দু’টি নীল নয়নের তারকা। কে জানে কোন দুরাকাঙ্ক্ষের অবুঝ স্বপ্ন ভুল পথে আসার ভুলে এমন ক’রে ধূলি হয়ে গেল! হোক দুরাকাঙ্ক্ষা, তবু তো আকাঙ্ক্ষা। হোক অবুঝ স্বপ্ন, তবু তো স্বপ্ন। ছিন্ন কুবলয়কলিকা যেন পদদলিত নৈবেদ্যের মত সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর কুটীরদ্বারের প্রান্তে পড়ে আছে। ভালই হয়েছে, তবু দেখতে ভাল লাগে না, এবং দেখতে বেদনাও বোধ করে চান্দ্রেয়ী।
ছিন্ন কুবলয়কলিকার দিকে তাকিয়ে চান্দ্রেয়ীর ব্যথিত চক্ষু যেন নীরবে আবেদন করে—দূরে যাও অদৃশ্য মায়াবীর কামনার উপহার। ভুল কর কেন ঋষি উতথ্যের অনুরাগিণী চান্দ্রেয়ীর কুটীরদ্বারে এসে?
কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে চান্দ্রেয়ীর আবেদন। তপোবন হতে কুটীরে ফিরে এসে প্রতি সন্ধ্যায় দেখতে পেয়েছে চান্দ্রেয়ী, অলক্ষ্য প্রেমিকের মুগ্ধ হৃদয়ের উপহারের মত পড়ে আছে সেই কনকবর্ণ কুবলয়ের কলিকা।
আজও দেখতে পায়, আর দেখে আরও বিস্মিত হয় চান্দ্রেয়ী, কুবলয়কলিকার বক্ষে চিত্রিত হয়ে রয়েছে রক্তচন্দনের একটি বিন্দু। কী ভয়ানক দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে গূঢ়প্রণয়চতুর মায়াবীর মনের অভিলাষ! মনে হয়, চিত্রিত রক্তচন্দনের বিন্দু নয়, লুব্ধ এক ভুজঙ্গের রুধিরাক্ত ওষ্ঠের চুম্বনচিহ্ন বক্ষে ধারণ ক’রে ঐ কুবলয়কলিকা চান্দ্রেয়ীর সফল তপস্যার পুণ্য ও আনন্দ বিনাশ করবার জন্য এই সন্ধ্যায় উপস্থিত হয়েছে। আর সহ্য করা উচিত নয়, অদৃশ্য লুব্ধের দুঃসাহস ছলনা ও অভিসন্ধিকে আঘাত দিয়ে এখনি নিঃশেষ ক’রে দেওয়া ভাল। নিজের হাতেই এই কুবলয়কলিকা তুলে নিয়ে বিষবাহ অসিলতায় আর কণ্টকগুল্মে আবৃত ঐ বিগলিত বল্মীকস্তূপের বিবরে নিক্ষেপ করতে হবে। কঠোর আগ্রহে চঞ্চল হয় চান্দ্রেয়ী।
—পৌত্রী!
অকস্মাৎ পিতামহ অত্রির আহ্বান শুনে নিরস্ত হয়, আর মুখ ফিরিয়ে তাকায় চান্দ্রেয়ী।
অঙ্গিরার আশ্রম হতে ফিরে এসেছেন অত্রি। কৃতার্থ হয়েছেন অত্রি। মৃদুহাস্যে হৃদয়ের প্রসন্নতা মুক্ত ক’রে দিয়ে পিতামহ অত্রি বলেন—আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ সফল হয়েছে চান্দ্রেয়ী। অবিচল তপস্যার মত তোমার প্রেমাভিলাষের কাহিনী শুনে বিস্মিত হয়েছেন উদারচেতা উতথ্য। তোমার পাণিগ্রহণে সম্মত হয়েছেন।
পিতামহ অত্রিকে প্রণাম ক’রে কুটীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চান্দ্রেয়ী। কর্পূরপ্রদীপের সুরভিত ধূমলেখা যেন আলিম্পন রচনার জন্য উৎসুক হয়ে চান্দ্রেয়ীর পুলকিত কপোল ও চিবুক বারংবার স্পর্শ করে। অনুভব করে চান্দ্রেয়ী, তার জীবনের কামনা এতদিনে সুরভিত হয়ে উঠল।
স্নিগ্ধ হয়ে গিয়েছে চৈত্রসন্ধ্যার সমীর। অত্রি-আশ্রমের প্রাঙ্গণে উৎসব আহ্বান ক’রে কর্পূরের প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। পিতামহ অত্রি মন্ত্রপাঠ ক’রে ঋষি উতথ্যের কাছে চান্দ্রেয়ীকে সম্প্রদান করেছেন। চান্দ্রেয়ীর পাণিগ্রহণ করে চান্দ্রেয়ীর হস্তে কুশতৃণের বলয় পরিয়ে দিয়েছেন উতথ্য। আশীর্বাদ ক’রে চলে গিয়েছেন পিতামহ অত্রি।
উতথ্য ডাকেন—চান্দ্রেয়ী।
চান্দ্রেয়ী—বলুন স্বামী।
উতথ্য—এখন আমি প্রস্থান করি।
অকস্মাৎ যেন দৃষ্টিহারা হয়ে যায় চান্দ্রেয়ীর উৎফুল্ল নীলকঞ্জপ্রভ দুই নয়ন। যেন সান্ধ্য চৈত্ৰবায়ু সহসা হিংস্র হয়ে ঐ কর্পূরের প্রদীপ এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চাইছে। অগ্নিজ্বালার স্ফুলিঙ্গ এসে দগ্ধ করছে কুশতৃণের বলয়। উৎসবের সুরভিত প্রাণ যেন ঋষি উতথ্যের ঐ একটি কথার ধ্বনি শুনেই মূর্ছাহত হয়েছে।
চান্দ্রেয়ী বলে—এখনি কেন প্রস্থান করবেন স্বামী?
উতথ্য—আমার কর্তব্য সমাপ্ত হয়েছে এবং তোমারও অভিলাষব্ৰত সফল হয়েছে!
চান্দ্রেয়ী—ক্ষমা করবেন স্বামী, আপনার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না।
উতথ্য—তুমি ঋষি উতথ্যের ভার্যা, এই পরিচয় তোমার জীবনে সত্য হয়ে রইল। আমাকে পতিরূপে লাভ করবার জন্য তুমি তপস্যা করেছিলে, তোমার সে তপস্যা সফল হয়েছে, সোমতনয়া চান্দ্রেয়ী। নিজের হাতে কুশতৃণের বলয় তোমার হাতে বেঁধে দিয়েছি, আমার কর্তব্য সমাপ্ত হয়েছে। কৃতমানসা, সফলবাসনা, ব্রতোত্তীর্ণা ও ধন্যা চান্দ্রেয়ী, এইবার সুতৃপ্ত অন্তরে আমাকে বিদায় দাও।
চান্দ্রেয়ী বলে—আমার কর্তব্য সমাপ্ত হয়নি; আর আমারও অভিলাষব্রত সফল হয়নি ঋষি।
বিস্মিত হয়ে চান্দ্রেয়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন উতথ্য—কি বলতে চাও?
চান্দ্রেয়ীর মুখচ্ছবি ধারাহত কমলের মত সিক্ত ও ব্যথিত হয়ে ওঠে। সজলাসারে প্লাবিত চিবুকের কুঙ্কুম মুছে যায়। চান্দ্রেয়ী বলে—অভিলাষ আছে মনে, তুমি তোমারই পরিণীতা এই প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী নারীর শূন্য কবরীতে নীহার-স্নেহে অভিষিক্ত শ্যাম দূর্বার মঞ্জরী নিজের হাতে পরিয়ে দেবে। আমি আমার জীবনের এই তৃপ্তিময় সমাদর এতদিন ধ’রে তপোবনের তরুচ্ছায়াতলে বসে তপস্বিনীর মত প্রার্থনা করেছি ঋষি।
আক্ষেপ করেন উতথ্য—ভুল করেছ, আর জীবনে বড়ই ভুল স্বপ্ন পোষণ করেছ।
চান্দ্রেয়ী—কেন?
উতথ্য—তোমার কবরী দূর্বামঞ্জরীতে শোভিত করবার জন্য ঋষি উতথ্যের মনে কোন লোভ নেই।
আহত কুররীর মত করুণস্বরে আর্তনাদ ক’রে ওঠে চান্দ্রেয়ী—কেন ঋষি?
উতথ্য—সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর প্রণয় কামনা ক’রে আমি তো কোন তপস্যা করিনি! জীবনে কোনদিন তোমাকে আমি দর্শনও করিনি, সুদর্শনা সোমতনয়া। আমি তোমার তপস্যাকে শুধু অনুগ্রহ দান করেছি। তুমি ঋষি উতথ্যের ভার্যা, তোমার এই পরিচয় শুধু সর্বলোকে সত্য ক’রে দেবার জন্য তোমার হাতে কুশতৃণের বলয় বেঁধে দিয়েছি। এর অধিক আর কেন প্রত্যাশা কর, চান্দ্রেয়ী? অঙ্গিরাতনয় উতথ্য তোমার পতি, কিন্তু প্রণয়ী নয়।
নীরব হয়ে ঋষি উতথ্যের শান্ত কণ্ঠস্বরের ভাষণ শুনতে থাকে চান্দ্রেয়ী; আর মনে হয়, হ্যাঁ, এই ভাষা সত্যই অতি শান্ত শুচি-নির্মল ও বিরাট এক আকাশের বক্ষের ভাষা। জলদসরসা কোন মায়া বর্ষণ করে না সেই আকাশ, কিন্তু বজ্ৰ হানতে পারে; আর, বুঝতেও পারে না যে, সে বজ্রের অগ্নিময় আঘাত সহ্য করতে গিয়ে ঐ ক্ষীণ কুশতৃণের বলয়বন্ধন অঙ্গার হয়ে যেতে পারে।
চান্দ্রেয়ী শান্ত স্বরে বলে—আজও কি দেখতে পাননি?
উতথ্য—কি?
চান্দ্রেয়ী—আপনার প্রেমাভিলাষিণী চান্দ্রেয়ীর মুখ।
সহসা উতলা চৈত্রবায়ুর মত উচ্ছ্বসিত স্বরে আকুল হয়ে উতথ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে চান্দ্রেয়ী—সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর এই মুখের দিকে তাকিয়ে বলে যাও ঋষি, লুব্ধ হয়নি তোমার দ্যুতিময় দু’টি চক্ষু। বলে যাও, এই কবরী স্পর্শ করবার জন্য কোন পিপাসায় চঞ্চলিত হয় না তোমার বাহু। বলে যাও, তোমারই প্রেমবিধুরা চান্দ্রেয়ীর এই দুই বাহু যদি তোমার কণ্ঠাসক্ত হয়, তবে ব্যথিত হবে তোমার নিঃশ্বাস।
উতথ্য বলেন—সত্য কথা বলতে পারি।
চান্দ্রেয়ী—স্বাধ্যায়ী শুচিব্রত ও সত্যপরায়ণ ঋষি উতথ্যের কাছে সত্য কথাই শুনতে চাই।
উতথ্য বলেন—সুন্দরেক্ষণা সুতনুকা ও যৌবনবিহসিতা চান্দ্রেয়ীকে সত্য কথাই শুনিয়ে দিতে চাই।
চান্দ্রেয়ী—বলুন।
উতথ্য—তুমি সত্য, তোমার রূপ সত্য, তোমার প্রণয়ও সত্য। কিন্তু আমি মুগ্ধ নই চান্দ্রেয়ী; প্রণয়িজনোচিত কোন মোহ আমার অন্তর স্পর্শ করতে পারে না।
মাথা হেঁট ক’রে স্তব্ধ শিলাপুত্তলিকার মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চান্দ্রেয়ী। তারপরেই উতথ্যকে প্রণাম ক’রে চান্দ্রেয়ী বলে—আশীর্বাদ কর স্বামী।
উতথ্য—কি আশীর্বাদ চাও?
কয়েক মুহূর্ত শুধু কি-যেন চিন্তা করে চান্দ্রেয়ী। তার পরেই বলে—আশীর্বাদ কর, যেদিন তুমি কাছে ডাকবে, সেদিন যেন তোমার কাছে ছুটে যেতে পারি।
মৃদুহাস্যে উতথ্য বলেন—কিন্তু তোমাকে আমার কাছে ডাকবার প্রয়োজন কি হবে কোনদিন?
চান্দ্রেয়ী—যদি প্রয়োজন হয়, যদি এই চান্দ্রেয়ীর কথা মনে ক’রে কোনদিন তোমার উদার হৃদয়ের নিভৃতে কোন দীর্ঘশ্বাস জাগে, যদি শূন্য মনে হয় গৃহ, যদি তৃষ্ণার্ত হয় বামবাহু, তবে তোমার কুশতৃণের বলয়বন্ধনে অনুগৃহীতা চান্দ্রেয়ীকে আহ্বান করো।
উতথ্য—তাই হবে।
চলে গেলেন ঋষি উতথ্য।
অচঞ্চলমূর্তি চান্দ্রেয়ী নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
আশ্রমপ্রাঙ্গণের কর্পূরদীপ নিভে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তবু বিহ্বল হয়ে রয়েছে চৈত্ৰবায়ু। আশ্রমপ্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তপোবনতরুর পল্লবমর্মর শোনে চান্দ্রেয়ী, যেন চান্দ্রেয়ীর জীবনের বিফল তপস্যার বেদনায় বিলাপমুখর হয়ে উঠেছে তপোবন।
প্রাঙ্গণ পার হয়ে ধীরে ধীরে শূন্যমনা পথচারিণীর মত অগ্রসর হতে থাকে চান্দ্রেয়ী। তপোবনের পথও শেষ হয়ে যায়। মুক্ত প্রান্তরের প্রান্তে এসে দেখতে পায় চান্দ্রেয়ী, অদূরে সরিদ্বরা যমুনার জল চন্দ্রকিরণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
চমকিত নেত্রে আকাশের দিকে তাকায় চান্দ্রেয়ী, উদিত চন্দ্রমার দিকে অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি তুলে এবং হৃদয়ের দুঃসহ ক্ষোভ মুক্ত ক’রে দিয়ে অভিযোগ করে চান্দ্রেয়ী— বিফল তপস্যার জ্বালা হতে মুক্তি দাও, পিতা।
যমুনার তরঙ্গভঙ্গে চন্দ্রবিম্ব আন্দোলিত হয়। যেন আহ্বান করছে জ্যোৎস্নায়িত যমুনাসলিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে চান্দ্রেয়ী। বিফল তপস্যার জ্বালা স্নিগ্ধ সলিলস্নানে শান্ত করবার জন্য সদানীরা যমুনার তটে এসে দাঁড়ায় চান্দ্রেয়ী; তারপর মৃদুলগতি মরালীর মত ধীরে ধীরে সলিলে অবতরণ করে। স্নান করে চান্দ্রেয়ী। জলকমলের রেণুপুঞ্জ ভেসে এসে চান্দ্রেয়ীর সিক্তকবরী রঞ্জিত করে। মৃণাল আলিঙ্গন ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে চান্দ্রেয়ী, আর যমুনার তরঙ্গসঙ্গীত উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকে।
স্নান সমাপনের পর তীরে ওঠে চান্দ্রেয়ী। কিন্তু সহসা সন্ত্রস্ত হয়ে দেখতে পায়, সম্মুখে এক অপরিচিতের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চান্দ্রেয়ীর সিক্ত তনু শোভার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তার ব্যাকুল দু’টি চক্ষু।
ক্ষুব্ধস্বরে প্রশ্ন করে চান্দ্রেয়ী—কে তুমি?
—আমি জলাধিপতি বরুণ। আমি পশ্চিম দিক্পাল বরুণ।
—বিসদৃশ আপনার আচরণ, অন্যায় আপনার আগমন।
—মিথ্যা বলনি চান্দ্রেয়ী।
বিস্মিত হয় চান্দ্রেয়ী।—আমার পরিচয় জেনেও আপনি আমার সম্মুখে কেন এসেছেন?
বরুণ—একটি অনুরোধ জ্ঞাপন করতে এসেছি।
চান্দ্রেয়ী—আমার কাছে আপনার কি অনুরোধ থাকতে পারে, জলাধিপতি?
বরুণ—একবার বরুণনিকেতনের সকল শোভার মাঝখানে এসে দাঁড়াবে তুমি, এই অনুরোধ।
চান্দ্রেয়ী—কেন?
বরুণ—তোমারই জীবনের একটি কৌতূহলের নিরসন হয়ে যাবে। জানতে পারবে, যে-সত্য কখনও জানতে পারনি। বুঝতে পারবে, যে-রহস্য কখনও বুঝতে পারনি। কোনদিন শুনতে পাওনি যে নীরব কনকবর্ণ কুবলয়কলিকার ভাষা…।
চান্দ্রেয়ীর সকল বিস্ময় যেন আতঙ্কিত হয়ে সহসা চিৎকার ক’রে ওঠে—আপনি?
বরুণ বলেন—হ্যাঁ সোমতনয়া চান্দ্রেয়ী, আমিই তোমার কুটীরদ্বারে কনকবর্ণ কুবলয়ের কলিকা পাঠিয়েছি। তুমিই আমার জীবনের আকাঙ্ক্ষা।
চান্দ্রেয়ী—ভুল আকাঙ্ক্ষা, অযোগ্যজনের আকাঙ্ক্ষা। আমি উতথ্যের পত্নী চান্দ্রেয়ী, আমার এই পরিচয় হয়তো আপনি জানেন না।
বরুণ—জানি।
চান্দ্রেয়ী—তবে চলে যান।
বরুণ—যাব, কিন্তু একাকী যাব না চান্দ্রেয়ী। যমুনার স্নিগ্ধসলিলে সিক্ত আর চন্দ্ররশ্মির স্নেহে উদ্ভাসিত এই স্বপ্নকুসুমকে বক্ষোলগ্ন ক’রে আমার সঙ্গে নিয়েই চলে যাব।
চান্দ্রেয়ী—নিবৃত্ত হও পারদারিক দুরিতদূষিত দিক্পাল।
ধিক্কার দিয়ে মূর্ছাহত হয় চান্দ্রেয়ী।
বরুণ নিকেতন, এখানে শশিতপনের আলোকের প্রয়োজন হয় না। লক্ষ নাগমণির রশ্মিপুঞ্জে জলাধিপতির নিলয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। প্রবালকীটের পঞ্জরে গঠিত সৌধদেহ, মরকতযুত বেদিকা আর বৈক্রান্তস্তবকে খচিত স্তম্ভশ্রেণী। বিগলিত ইন্দ্রধনুর চেয়েও বর্ণাঢ্য শোভায় যেন আলিম্পিত হয়ে রয়েছে রসাতলের এক রত্নপুরী। চারিদিকে বিস্ময়বিহ্বল অপলক চক্ষুর দৃষ্টি বর্ষণ ক’রে বুঝতে চেষ্টা করে চান্দ্রেয়ী, কিন্তু বুঝতে পারে না। শুধু মনে হয়, যেন তার দুঃস্বপ্নাহত প্রাণ যমুনাসলিলে নিমজ্জিত হয়ে এই বিচিত্র জগতের নিভৃতে চলে এসেছে।
কোমল পুষ্করপলাশে রচিত একটি শয্যা, সৌরভতরুর নির্যাস পোড়ে রত্নাধারে, কে যেন তার জীবনের এক আরাধনাস্থলীর মাঝখানে সোমসুতা চান্দ্রেয়ীকে বসিয়ে রেখে গিয়েছে। দেখতে পায় চান্দ্রেয়ী, মরীচিকার ছবি নয়, সম্মুখের এক সরোবরে তরল স্ফটিকের মত সলিল, তার মধ্যে ফুটে রয়েছে কনকবর্ণ কুবলয়।
আর বুঝতে কিছু বাকি থাকে না। এক রসাতলবাসী প্রেমিকের কামনা চান্দ্রেয়ীর মূর্ছাহত দেহ লুণ্ঠন ক’রে নিয়ে এই অদ্ভুত রত্নমায়াবৃত জগতের মাঝখানে চলে এসেছে।
—জলাধিপতি বরুণ! সন্ত্রস্ত স্বরে চিৎকার ক’রেই দেখতে পায় চান্দ্রেয়ী, সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন বরুণ।
চান্দ্রেয়ী বলে—আমাকে মুক্তি দান করুন।
চান্দ্রেয়ীর মুখের দিকে মুগ্ধ ও সাগ্রহ চক্ষুর অপলক দৃষ্টি তুলে বরুণ বলেন—কার কাছ থেকে মুক্তি চাও?
চান্দ্রেয়ীর নয়নে খর বিস্ময়ের ক্ষণপ্রভা চমকে ওঠে। প্রেমবিধুর পুরুষের কণ্ঠস্বর চান্দ্রেয়ীর কানের কাছে বেজে উঠেছে। এমন কণ্ঠস্বর জীবনে এই প্রথম শুনতে পেল চান্দ্রেয়ী।
বরুণ বলেন—আশ্রমচারিণী চান্দ্রেয়ীর পদধ্বনির তপস্যা ক’রে দিনযাপন করেছে রত্নপুরপতি এই বরুণ। তোমারই নীলকঞ্জপ্রভ ঐ নয়নের প্রভা পান করবার জন্য তোমার তপোবনতরুর অন্তরালে উৎসুক হয়ে কত লক্ষ মুহূর্ত যাপন করেছে লক্ষ প্রভামণির অধীশ্বর এই বরুণের সতৃষ্ণ দু’টি চক্ষু। আমার কামনাকলিত কুবলয় তোমারই চরণ চুম্বনের আশায় নিত্য তোমার কুটীরদ্বারে উপস্থিত হয়েছে। আমি প্রণয়ী, নিদ্রাহীন শত নিশীথের সকল মুহূর্ত ও ভাবনা দিয়ে আমি পূজা করেছি তোমার ঐ প্রবল কবরীভার, চম্পকসঙ্কাশ চিবুক, ঐ মনসিজমনোহরণ ভুরু-শরাসন, ঐ মুক্তাচ্ছ রদরুচি, আর যৌবনরাগে শোণীকৃত ঐ অধর।
প্রণয়সঙ্গীতের ঝংকার যেন নিশাবসানের বিহগকাকলির মত সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর অন্তরে এক নবোষার অরুণিত বিহ্বলতা সঞ্চারিত করে। চান্দ্রেয়ীর সুস্মিত অধরপুট দীপ্ত হয়ে ওঠে। নীলকঞ্জপ্রভ নয়নের প্রভা খর দীপশিখার মত জ্বলে ওঠে। জলাধিপতি বরুণের হাত থেকে কনকবর্ণ কুবলয় তুলে নিয়ে কবরীতে ধারণ করে চান্দ্রেয়ী।
চান্দ্রেয়ী ডাকে—সলিলেশ্বর বরুণ!
বরুণ বলেন—বল, সুচারুদর্শিনী।
চান্দ্রেয়ী—সুখী হও তুমি!
বিদ্যুল্লেখার মত স্ফুরিত লাস্যে চঞ্চলিত হয়ে ওঠে আশ্রমচারিণী ইন্দুলেখার তনু। জলাধিপতি বরুণের সতৃষ্ণ দু’টি বাহুর আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করে চান্দ্রেয়ী।
বরুণনিকেতনের নিদ্রা ভেঙে যায়। বিপুল এক প্রতিশোধের নিঃশ্বসন্ত আক্রোশ যেন ঝটিকার মত মত্ত হয়ে রসাতলের উপর এসে লুটিয়ে পড়ছে। কেঁপে উঠছে বরুণনিলয়ের সকল স্ফটিক মরকত আর নাগমণি।
নিকেতনের বদ্ধদ্বারের কপাটে করাঘাত। কে যেন ডাকছে। পুষ্করপলাশে রচিত শয্যায় উৎসবের ক্লান্ত নায়িকার মত বরুণের বাহুবন্ধনে সুখসুপ্তা চান্দ্রেয়ী যেন হঠাৎ এক দুঃস্বপ্নের আঘাত পেয়ে চমকে ওঠে—কে ডাকে!
—কে ডাকে? জলাধিপতি বরুণও সেই উৎসবমদবিহ্বল পুষ্পশয্যার আবেশ হতে চমকে জেগে ওঠেন, এবং কক্ষ হতে বের হয়ে বাইরে এসে দাঁড়ান। তারপরেই অগ্রসর হয়ে বরুণনিকেতনের প্রধান প্রবেশদ্বার মুক্ত ক’রে দেন।
প্রবেশ করেন নারদ।
নারদ বলেন—ঋষি উতথ্য জানতে পেরেছেন, আপনি তাঁর পত্নী চান্দ্রেয়ীকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছেন।
শ্লেষযুত স্বরে বরুণ বলেন—জ্ঞানী ঋষি ঠিকই জেনেছেন, কিন্তু এই তুচ্ছ সংবাদ বৃথা নিবেদনের জন্য এখানে আপনার আগমনের কোন প্রয়োজন ছিল না, নারদ।
নারদ—আমি ঋষি উতথ্যের অনুরোধের বাণী নিয়ে এসেছি। চান্দ্রেয়ীকে মুক্ত ক’রে দিন।
বরুণ—না।
নারদ—ঋষি উতথ্যের কোপ আর অভিশাপ থেকে যদি মুক্ত হতে চান, তবে এই মুহূর্তে তাঁর প্রণয়াভিলাষিণী ও পরিণীতা চান্দ্রেয়ীকে মুক্ত ক’রে দিন।
বরুণ বলেন—না।
নারদ—প্রেমিক উতথ্যের আকাঙ্ক্ষিতা নারী চান্দ্রেয়ীকে মুক্ত ক’রে দিন।
দুই চক্ষুর দৃষ্টিতে কুটিল বিদ্রূপ আর কঠোর অবিশ্বাস স্ফুরিত ক’রে বরুণ বলেন—কূটতাকুশল দূত, হে নারদ, আপনার বচনচাতুরী সত্য, কিন্তু নিতান্তই মিথ্যা আপনার বচন। সুকঠিন শিলার বক্ষেও শ্যামলতা জেগে উঠতে পারে, কিন্তু শুষ্কজ্ঞানের কুশতৃণ ঐ ঋষি উতথ্যের বক্ষে কখনও প্রেম-কামনা দেখা দিতে পারে না।
নারদ—এই কল্পনামোহ বর্জন করুন। অত্রি-আশ্রমের এক সিন্ধুবারতরুর ছায়াতলে এখন দাঁড়িয়ে আছেন যে কামনাকুল প্রেমিক উতথ্য…।
চমকে ওঠেন বরুণ—কি বললেন নারদ?
নারদ—হ্যাঁ, দিক্পাল বরুণ, প্রণামনমিতা মে চান্দ্রেয়ীর সীমন্তস্খলিত সিন্দুরবিন্দুর চিহ্ন এখনও ঋষি উতথ্যের চরণে অঙ্কিত রয়েছে, সে চান্দ্রেয়ীকে স্বামী সন্নিধানে চলে যেতে দিন।
গর্জন করেন বরুণ—না।
বিষণ্ণ স্বরে নারদ প্রশ্ন করেন—সোমসুতা চান্দ্রেয়ী কোথায়?
বরুণ—কেন?
নারদ—ঋষি উতথ্যের প্রেরিত একটি উপহার চান্দ্রেয়ীকে দিতে চাই।
বরুণ—কি উপহার?
নারদ—এই দূর্বামঞ্জরী।
বরুণ—ঐ তুচ্ছ দূর্বামঞ্জরী ধূলিতে নিক্ষেপ করুন।
নারদ—কেন?
বরুণ প্রত্যুত্তর দেন—দুর্লভ কনকবর্ণ কুবলয়ের কলিকা কবরীতে ধারণ ক’রে সুখী হয়েছে চান্দ্রেয়ী, বরুণনিকেতনে সুখে আছে চান্দ্রেয়ী। এই সংবাদ নিয়ে গিয়ে উতথ্যকে নিবেদন করুন ঋষি। এখানে আপনার আর আসবার প্রয়োজন নেই।
ফিরে চললেন নারদ। অকস্মাৎ নেপথ্য হতে আর্তনাদ ক’রে ভীতা বনকুরঙ্গীর মত ছুটে এসে বরুণের সম্মুখে দাঁড়ায় চান্দ্রেয়ী। ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করে—কা’কে ফিরিয়ে দিচ্ছেন, জলাধিপতি বরুণ?
বরুণ—ঋষি উতথ্যের দূত নারদকে।
চান্দ্রেয়ী—আমি জানি, আমি সবই শুনতে পেয়েছি, জলাধিপতি।
আর্তস্বরে চিৎকার ক’রে ওঠে চান্দ্রেয়ী এবং দেখতে পায়, বিমুখ হয়ে চলে যাচ্ছেন বিষণ্ণ নারদ, হাতে দূর্বামঞ্জরীর একটি গুচ্ছ।
ব্যাকুলা প্রলাপিকার মত উচ্ছ্বসিত স্বরে ডাকতে থাকে চান্দ্রেয়ী—ঋষি নারদ! চান্দ্রেয়ীবল্লভ উতথ্যের দূত ঋষি নারদ, দিয়ে যাও ঐ শ্যামদূর্বার মঞ্জরী। দিয়ে যাও প্রেমিক উতথ্যের ঐ উপহার, চান্দ্রেয়ীর জীবনের স্বপ্ন আর মৃত্যুর শান্তি ঐ দূর্বামঞ্জরী।
কিন্তু তখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন নারদ। শূন্য দ্বারপথের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ওঠে চান্দ্রেয়ী। দুই হাতে যন্ত্রণাক্ত দুই চক্ষুর দৃষ্টি আবৃত ক’রে সন্তাপিতা লতিকার মত নতমুখিনী হয়ে বরুণের কাছে আবেদন করে চান্দ্রেয়ী—আমাকে মুক্তি দান করুন। পৃথিবীর আশ্রমচারিণী নারীকে এই রসাতলের রত্নপুর হতে চলে যেতে আদেশ করুন।
বরুণ—তোমার এই আকুলতার অর্থ কি, চান্দ্রেয়ী?
অশ্রুসিক্তা চান্দ্রেয়ী বলে—পৃথিবীর দূর্বামঞ্জরী আমাকে ডাকছে। ঋষি উতথ্যের প্রিয়া এই চান্দ্রেয়ীকে মুক্ত ক’রে দিন।
বরুণ বলেন—না।
সেই মুহূর্তে এক তপ্ত মরুধূলির ঝঞ্ঝা ছুটে এসে আর দ্বার চুর্ণ ক’রে বরুণনিলয়ের বক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। লক্ষ জ্বলদর্চিশিখার জ্বালা করাল উৎপাতের মত বরুণনিকেতনের সরোবরসলিল বাষ্পীভূত ক’রে দেয়। পুড়তে থাকে কনকবর্ণ কুবলয়।
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আর অবিচলিত নেত্রে পৃথিবীর আশ্রমবাসী এক ক্রোধোন্মত্ত ঋষির অভিশাপলীলা দেখতে থাকেন আর সহ্য করেন বরুণ।
মিনতি করে চান্দ্রেয়ী—আমাকে মুক্ত ক’রে দিন, দিক্পাল বরুণ।
বরুণ বলেন—না।
লক্ষ বজ্রনাদ একসঙ্গে ধাবিত হয়ে এসে বরুণনিলয়ের সকল রত্নস্তূপের উপর আক্রোশ হানে। ধূলি হয়ে যায় রত্নের স্তূপ।
চান্দ্রেয়ী বলে—আমাকে মুক্ত ক’রে দিন, রত্নেশ্বর বরুণ।
বরুণ বলেন—না।
বরুণনিকেতনের হৃৎপিণ্ড চূর্ণ ক’রে দিয়ে অকস্মাৎ সহস্র শুষ্ককণ্ঠের হাহাকার ধ্বনিত হয়। ঋষি উতথ্যের আদেশে বরুণনিলয়ের বক্ষে ঊষরতার অভিশাপ নিক্ষেপ ক’রে নদী সরস্বতী তাঁর জলধারা সরিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, দূর হতে দূরান্তরে। মৃত্যুযন্ত্রণায় শিহরিত হয়ে উঠেছে পিপাসার্ত বরুণনিকেতন। এইবার বিচলিত হন জলাধিপতি এবং সন্ত্রস্ত কণ্ঠে চিৎকার ক’রে ওঠেন—কোপ শান্ত কর ঋষি উতথ্য।
চান্দ্রেয়ী বলে—আমাকে মুক্ত ক’রে দিন, সলিলেশ্বর বরুণ।
বরুণ বলেন—যাও।
উতথ্য বলেন—আমার ভুল ক্ষমা কর, চান্দ্রেয়ী।
অত্রি-আশ্রমের তপোবনে সিন্ধুবার কুসুমের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে চান্দ্রেয়ীর মুখের দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে ঋষি উতথ্য বলেন—ধন্য তোমার প্রেম, তুমি আমার মহত্ত্বের অহংকার ধূলি ক’রে দিয়ে সেই ধূলিতে প্রেমের দূর্বামঞ্জরী ফুটিয়ে তুলেছ।
প্রণয়ের সঙ্গীত! সেই ঋষি উতথ্যের কণ্ঠস্বর প্রণয়ানুরাগে সঙ্গীতময় হয়ে উঠেছে, যে ঋষি এই আশ্রমের প্রাঙ্গণে এক কর্পূরসুরভিত সন্ধ্যার সকল আবেদন তুচ্ছ ক’রে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজ জীবনের চিরাকাঙ্ক্ষিত সেই সঙ্গীত শুনতে পেয়েও বেদনাহতের মত দুই হাতে মুখ ঢাকে চান্দ্রেয়ী।
উতথ্য বলেন—তোমার সেদিনের আহ্বান তুচ্ছ করতে গিয়ে আমার প্রণয়হীন এই হৃদয় কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই পৃথিবীর সকল তরুলতা ও আলোছায়ার মায়া আমার জীবনে তোমারই স্মৃতিময় মূর্তি হয়ে ফুটে উঠবে। বুঝতে পারিনি, সেদিনের কর্পূরদীপের সৌরভ আমার স্বপ্ন সুরভিত ক’রে তুলবে।
চান্দ্রেয়ীর করতল অশ্রুপ্রবাহে সিক্ত হয়। মনে হয় চান্দ্রেয়ীর, সে আজ আর চান্দ্রেয়ী নয়। এই প্রণয়সঙ্গীতের শুচিতাকে শুধু ছলনায় মুগ্ধ করবার জন্য চান্দ্রেয়ীর ছদ্মরূপ ধারণ ক’রে বসে আছে এক ছায়া।
উতথ্য বলেন—ধারণা করতে পারিনি, অনুরাগের পরাগের মত তোমার সেই প্রণমিত সীমন্তের সুন্দর সিন্দূর সুরঞ্জিত ক’রে দেবে মরুলোকের আকাশের মত আমার অমায়াবিরস অন্তরের সকল ক্ষণের চিন্তা। বুঝতে পারিনি চান্দ্রেয়ী, চন্দনবাসিত তোমার ঐ তরুণ তনু বক্ষে ধারণ করবার জন্য চঞ্চলিত হয়ে উঠবে উতথ্যের নির্মোহ জীবনের উদাস নিঃশ্বাস। শুন্য মনে হয়েছে গৃহ, তৃষ্ণার্ত হয়েছে বামবাহু, কেঁদে উঠেছে বক্ষের পঞ্জর আমার দীর্ঘশ্বাসে অস্থির হয়ে তপোবনের বায়ু তোমাকেই অন্বেষণ ক’রে ফিরেছে।
মুখ তুলে তাকায় চান্দ্রেয়ী।
উতথ্য বলেন— কিন্তু, আজ আমি ধন্য। আমি সুখী, আমি কৃতার্থ। আমার প্রতীক্ষার তপস্যা সফল হয়েছে।
সম্পৃহ নয়নে চান্দ্রেয়ীর কবরীর দিকে তাকিয়ে থাকেন উতথ্য। তার পর দূর্বামঞ্জরীর গুচ্ছ হাতে নিয়ে চান্দ্রেয়ীর কাছে এগিয়ে যান। কিন্তু অকস্মাৎ আতঙ্কিতের মত দুই হাতে কবরীভার আবৃত ক’রে সরে যায় চান্দ্রেয়ী।
ব্যথাহত স্বরে উতথ্য বলেন—আমার একদিনের ভুল কি ভুলতে পারবে না, চান্দ্রেয়ী?
চান্দ্রেয়ী বলে—সব ভুলে গিয়েছি, ঋষি।
উতথ্য—তবে?
চান্দ্রেয়ী—কিন্তু তোমার হাত থেকে দূর্বামঞ্জরীর উপহার গ্রহণ করবার অধিকার হারিয়েছে চান্দ্রেয়ী।
উতথ্য—কেন?
চান্দ্রেয়ী—আমার একদিনের ভুল কি বিস্মৃত হতে পেরেছ তুমি?
উতথ্য—রসাতলের এক কামুকী তোমাকে অপহরণ করেছিল, সে তো তোমার অপরাধ নয়। আমি জানি, ধৃষ্ট বরুণের হঠপ্রণয় ও অভিলাষ অপ্রমেয়প্রেমা চান্দ্রেয়ীর এই কুন্দেসুন্দর ও শুচিস্মিত তনু স্পর্শ করতেও পারেনি।
চান্দ্রেয়ীর অশ্রুসিক্ত নয়নে সিন্ধুবার কুসুমের প্রভা বিম্বিত হয়ে আরও দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। চঞ্চল হয় না, আর্তনাদ করে না, যেন ক্ষমাহীন এক শাস্তির জগতে শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছে চান্দ্রেয়ী। অকম্পিত স্বরে চান্দ্রেয়ী বলে—তোমার বিশ্বাস সত্য নয়।
চমকে ওঠেন ঋষি উতথ্য। সত্য নয় তাঁর বিশ্বাস? তবে সত্যই ভূতলবাসিনী এক ইন্দুলেখার দেহ দংশন করেছে রসাতলবাসী এক সরীসৃপ?
উতথ্য শান্তস্বরে বলেন—সে অপমান আমার অপমান। সে দুঃখ আমারই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত। তোমার ভুল নয়, তোমার অপরাধও নয় চান্দ্রেয়ী। পতিপ্রেমিকা চান্দ্রেয়ীর শুচিতাময় অন্তরের প্রতিবাদ তুচ্ছ ক’রে এক কলুষের দস্যু তার লালসা তৃপ্ত করেছে। তুমি নিষ্কলুষা।
চান্দ্রেয়ী—তোমার এই বিশ্বাসও সত্য নয়।
বিস্মিত হন উতথ্য—সত্য নয়?
চান্দ্রেয়ী—না। সোমসুতা চান্দ্রেয়ী স্বেচ্ছায় জলাধিপতি বরুণের উপহার এই কবরীতে ধারণ করেছে।
আর্তনাদ করেন উতথ্য—স্বেচ্ছায়?
চান্দ্রেয়ী—হ্যাঁ, স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে, জলাধিপতি বরুণের প্রণয় ভাষণে প্রীত ও মুগ্ধ হয়ে তার আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করেছে চান্দ্রেয়ী।
অন্তরের পিপাসিত বাসনার আশাগুলি যেন অকস্মাৎ এক কঠোর পরিহাসের আঘাতে উতথ্যের বক্ষের গভীরে আর্তনাদ ক’রে উঠেছে। স্তব্ধ হয়ে এবং নীরবে চান্দ্রেয়ীর দিকে অদ্ভুত এক বিস্ময়বিপন্ন দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন উতথ্য। চান্দ্রেয়ী, উতথ্যের কামনার স্বপ্ন চান্দ্রেয়ী শুধু এই সত্য জানিয়ে দিতে এসেছে যে, সে আজ পাতালপুরের এক প্রণয়ীর বক্ষের গৌরব। সত্যই এক রত্নপুরের রশ্মির স্পর্শে দগ্ধ হয়ে গিয়েছে ক্ষীণ কুশতৃণের বলয়!
কিন্তু কেন ফিরে এল চান্দ্রেয়ী? বরুণনিকেতনের রত্নকিরণে অভিনন্দিতা নারী কেন ফিরে এসে এবং কিসের জন্য এই কুসুমিত সিন্ধুবারতরুর ছায়াতলে দাঁড়িয়েছে? মনে হয়, জীবনের এক পরমকাম্য আশ্বাস খুঁজছে চান্দ্রেয়ীর অন্তর। বরুণলোকের আনন্দের উপর ঋষি উতথ্যের কোপ যেন আর জ্বালা বর্ষণ না করে, যেন আবার স্নিগ্ধ সুন্দর ও রত্নময় হয়ে ওঠে বরুণের নিলয়, উতথ্যের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে চলে যাবার জন্যই ফিরে এসেছে চান্দ্রেয়ী।
উতথ্য ডাকেন—চান্দ্রেয়ী!
চান্দ্রেয়ী—আদেশ কর, ঋষি।
উতথ্য বলেন—কি চাও তুমি? বল, কি তোমার প্রার্থনীয়?
চান্দ্রেয়ী—অভিশাপ দাও স্বামী, যেন এই মুহূর্তে মৃত্যু হয় চান্দ্রেয়ীর, আর কিছু চাই না।
কুসুমিত সিন্ধুবারতরুর যে ছায়াতল সোমসুতা চান্দ্রেয়ীর প্রেমের তপস্যা লালন ক’রে এসেছে, সেই ছায়াতলেই সে তপস্যাকে ঋষি উতথ্যের অভিশাপের সম্মুখে উপহার দিয়ে যেন ধন্যা হবার জন্য প্রস্তুত হয় চান্দ্রেয়ী। দেখতে পান উতথ্য, অবনতমুখিনী চান্দ্রেয়ীর স্তবকিত কুত্তল যেন অগ্নিজ্বালা বরণ করবার জন্য প্রতীক্ষায় অচঞ্চল হয়ে রয়েছে।
সহসা অনুভব করেন উতথ্য, ঐ নীলাকাশের মত এক অপাবৃত অন্তরের মহিমা যেন চান্দ্রেয়ীর মূর্তি ধ’রে ভূতলে দাঁড়িয়ে আছে, একবিন্দু মিথ্যার ও গোপনতার ধূলি সহ্য করতে পারে না যে অন্তর। জীবনের সকল শুচিতা নিয়ে মন্ত্রমিলিত আহুতির মত সুন্দর হয়ে রয়েছে এই নারী। হ্যাঁ, সত্যই নিষ্কুলষা।
ঋষি উতথ্য অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকেন। উতথ্যের পিপাসিত বাসনার ক্ষণমেদুর আশাগুলি যেন হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠেছে। চান্দ্রেয়ীর সেই অতিপরিচিত সুন্দর মুখশোভাকেই কত নূতন বলে মনে হয়। দেখতে অদ্ভুত লাগে এবং আরও ভাল লাগে। এবং কি আশ্চর্য, মনে আরও মোহ জাগে। নতমুখে এবং দুই নেত্র নিমীলিত ক’রে দাঁড়িয়ে আছে চান্দ্রেয়ী, যেন ব্রীড়াভারে বিনতা এক অভিনবলা বধূবদনের ছবি।
চান্দ্রেয়ীর কাছে এগিয়ে আসেন উতথ্য। উৎসুক প্রণয়ীর মত সস্পৃহ নেত্রসম্পাতে প্রেমিকার স্তবকিত কুন্তলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপরেই সেই স্তবকিত কুন্তলে নবীন দূর্বার মঞ্জরী পরিয়ে দিয়ে স্মিতহাস্যে আহ্বান করেন উতথ্য—প্রিয়া চান্দ্রেয়ী!