মন্দপাল ও লপিতা

—একি? আজও তুমি একাকিনী?

—হ্যাঁ।

—কেন?

—কেউ যে এখনও আসেনি।

—কবে আসবে?

—জানি না।

নিকুঞ্জের নিভৃতে দাঁড়িয়ে যেন এক প্রতিধ্বনির সঙ্গে আলাপ করে আর প্রশ্নের উত্তর দেয় ঋষিকুমারী লপিতা। কিন্তু এই প্রতিধ্বনি সত্যই সমীরসঞ্চারিত কোন প্রতিধ্বনি নয়। সত্যই সুন্দরী লপিতার শ্রবণপদবী শিহরিত ক’রে এই প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে না। তবু শুনতে পায় লপিতা। সুন্দরী লপিতার কল্পনা যেন উৎকর্ণ হয়ে মাঝে মাঝে শুনতে পায়, তার জীবনের সব চেয়ে বেশি সুখকর এক আকাঙ্ক্ষার ভাষা তার মনের আকাশে নিয়তচঞ্চল এক চন্দনানিলের স্পর্শে পুলকিত হয়ে রবমধুর প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করেছে।

ঋষি পিতার আশ্রমে তপোবন আছে, কিন্তু তপোবনতরুর ছায়ার কাছেও কোন দিন এসে দাঁড়ায়নি লপিতা। তপোবনের অদূরে ভ্রমরজল্পিত পুন্নাগতরুর মেখলায় পরিবৃত এই নিকুঞ্জের ছায়াকে ভালবাসে লপিতা।

 

 

কখনও দেখতে পায় লপিতা, নিকুঞ্জের লতাপল্লব যেন অন্য এক ছায়ার স্পর্শে শিহরিত হয়। লপিতাকে বরদান ক’রে কবে চলে গিয়েছে সেই হৃষ্ট কিন্নরমিথুন, কিন্তু হঠাৎ মনে হয়, সেই কিন্নরমিথুনের মায়াশরীর এসে লতান্তরাল হতে লপিতার দিকে তাকিয়ে আছে।

—সুন্দরী লপিতা।

—কি?

—নিরাশ হয়ো না।

—কখনই হব না।

—বিশ্বাস কর, আমাদের প্রদত্ত বর সত্য হবে একদিন।

—বিশ্বাস করি।

সত্যই ছায়া নয়, আর কিন্নরমিথুনের মায়াশরীরও নয়। কল্পনাবিষ্ট নেত্রে বায়ুশিহরিত লতান্তরালের দিকে তাকিয়ে নিজেরই মনের অন্তরালে এক উপবনের ছবি দেখতে থাকে লপিতা। সেই উপবনে আছে শুধু লপিতা আর লপিতার প্রেমিক। আর কেউ নয়।

এই নিকুঞ্জে বাস করত এক কিন্নরমিথুন। তৃষ্ণার্ত কিন্নরমিথুনকে একদিন জল দান করেছিল লপিতা। তৃপ্ত কিন্নরমিথুন প্রশ্ন করেছিল লপিতাকে—কি বর চাও ঋষিকুমারী?

—কি বর দিতে পার?

—আমাদের মত হও, এই বর দান করা ছাড়া অন্য কোন বর দানের শক্তি আমাদের নেই।

—কে তোমরা?

—আমরা চিরাসঙ্গলীন প্রেমিক ও প্রেমিকা। আমরা কখনও ভিন্ন হই না। আমরা শুধু চিরকালের দম্পতি, আমরা কখনও পিতামাতা হই না। আমাদের ক্রোড়ে ও বক্ষে কখনও সন্তান দেখা দেয় না। আমরা চির আলিঙ্গনে সমর্পিত প্রিয় ও প্রিয়া। আমাদের মাঝখানে তৃতীয় কোন স্নেহভাক্ প্রাণের প্রশ্রয় আমরা দিই না। আমাদের জীবন চিরনর্মের জীবন।

লপিতা বলে—এই তো জীবন।

কিন্নরমিথুন—চাও কি এই জীবন?

লপিতা—চাই।

কিন্নরমিথুন—যদি চাও, তবে নিশ্চয়ই পাবে।

বরদান ক’রে চলে গিয়েছে কিন্নরমিথুন। আজও নিকুঞ্জের নিভৃতে এসে প্রতিদিন তার মনের এই আকাঙ্ক্ষার ভাষা আর ছায়ার সঙ্গে যেন নীরবে আলাপ ক’রে চলে যায় লপিতা। কিন্তু কই? এ নিকুঞ্জপথে এমন কোন পথিকের মূর্তি আজ পর্যন্ত দেখা দিল না যাকে জীবনে আহ্বান ক’রে লপিতা তার সুখস্বপ্ন সফল ক’রে তুলতে পারে।

তাই লপিতা আজও একাকিনী। নিকুঞ্জের নিভৃতে পুষ্পদামে সজ্জিত প্রেঙ্খার দু’টি আসনের মধ্যে একটি আসন শূন্য হয়েই রয়েছে। কবে পূর্ণ হবে এই শূন্য আসন? কবে দয়িতকণ্ঠ ধারণ ক’রে ধন্য হবে লপিতার দক্ষিণ বাহুভাগ? কবে আসবে লপিতার কল্পনার সেই প্রেমিক, যার বামাঙ্গসঙ্গিনী হয়ে এই পুষ্পদামসজ্জিত প্রেঙ্খায় আন্দোলিত হবে লপিতার প্রতিক্ষণমধুর কামনার স্বপ্ন?

 

 

বিশ্বাস আছে, হতাশও হয় না ঋষিকুমারী লপিতা, তবু বড় দুঃখের এই প্রতীক্ষা। উৎসুক নয়নে নিকুঞ্জের প্রান্তে পুন্নাগতরুর ছায়ায় আকীর্ণ পথের দিকে তাকিয়ে থাকে লপিতা। প্রৌঢ় তরুণ ও কিশোর, কত পথিক যায়। নিকুঞ্জচ্ছায়ে প্রেঙ্খোলিত এক যৌবনশোভার দিকে তাকিয়ে সকলে চলে যায়। কেউ মুগ্ধ, কেউ বিস্মিত এবং কেউ বা শঙ্কিত। পুষ্পদোলায় দুলছে যেন এক স্বপ্নায়িত কামনার রূপ, যেন এক অমর্ত্যমানবী বসন্তসমীরে ভেসে এসে নিকুঞ্জে আশ্রয় নিয়েছে। দোলে পুষ্পদামে সজ্জিত প্রেঙ্খা, দোলে লপিতার অলসনয়নের স্মরতরলিত দৃষ্টি, দোলে লপিতার আবেশবিলোল চিকুরভার। মুগ্ধ পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় লপিতা। মুগ্ধ হয় না লপিতা।

কিন্তু একদিন আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না লপিতা।

দেখতে পায় লপিতা, পুন্নাগতরুর ছায়ার কাছে এসে লপিতার দিকে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছেন নবীন কিংশুকের মত রূপবান এক ঋষিযুবা।

সত্যসন্ধ অনসূয়ক প্রিয়বাদী ও বেদবিৎ মন্দপাল তাঁর জীবনের এক আকাঙ্ক্ষিত ব্রতের আহ্বানে চলেছেন। স্বৰ্গত পিতার একটি বিশেষ আগ্রহের কথা এতদিনে মন্দপালের মনে পড়েছে। বিবাহ ক’রে পুত্রবান হও পুত্র, পিতার সেই অনুরোধ অগ্রাহ্য ক’রে লোকসমাজে নিন্দিত হয়েছেন মন্দপাল। কিন্তু শুধু লোকনিন্দার আঘাত হতে আত্মরক্ষা করবার জন্য নয়, স্বৰ্গত পিতার আর একটি কথা এতদিনে মনে পড়েছে মন্দপালের।—খাণ্ডবপ্রস্থের শার্ঙ্গিককুমারী জরিতার পাণি গ্রহণ করো পুত্র। আমি জানি, সে তোমার অনুরাগিণী।

মনে পড়েছে শার্ঙ্গিককুমারী জরিতার কথা। তাই খাণ্ডবপ্রস্থের দিকে চলেছেন মন্দপাল। এই নিকুঞ্জপ্রান্তের ছায়াঞ্চিত পথের উপর দাঁড়িয়ে দেখা যায়, কাননসমাকুল খাণ্ডবপ্রস্থের শ্যামশোভা যেন তরঙ্গভঙ্গে বিস্তারিত হয়ে রয়েছে। আজ কল্পনা করতেও বিস্ময় বোধ করছেন মন্দপাল, ঐ শ্যামশোভার এক নিভৃতের ক্রোড়ে বিফল অনুরাগের বেদনায় অশ্রুসিক্তা হয়ে রয়েছে জরিতা নামে তাঁরই প্রণয়কাঙিক্ষণী এক নারী। কিন্তু মন্দপালের চক্ষুর সম্মুখে, যেন তাঁর পথের বাধার মত, কে এই বিস্ময়?

 

 

প্রেঙ্খা হতে অবতরণ করে লপিতা। উৎসুক নয়ন আর উৎফুল্ল অধরের শোভা বিকশিত ক’রে বিকচযৌবনা লপিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মন্দপালের সন্মুখে দাঁড়ায়।

প্রশ্ন করে লপিতা—আপনি কেন বিস্মিত হয়েছেন ঋষি?

মন্দপাল—আমার বিস্ময় দেখে তুমি বিচলিত হয়েছ কেন কুমারী?

লপিতা—সত্য কথাই বলেছেন ঋষি। জানি না কে আপনি, তবু মনে হয়, আপনিই আমার কল্পনার সেই প্রেমিক, যার প্রতীক্ষায় পথের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে আমার জীবন যৌবন ও বাসনা।

মন্দপাল—ভুল করেছ কুমারী। আমি সত্যসন্ধ ও বেদবিৎ মন্দপাল। ঐ কাননসমাকুল খাণ্ডব প্রদেশের শ্যামশোভার এক নিভৃতে আমারই প্রতীক্ষায় অপলক নয়নে পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক নারী।

লপিতা—কে সেই নারী?

মন্দপাল—জরিতা।

লপিতা—শার্ঙ্গিককুমারী জরিতা?

মন্দপাল—হ্যাঁ।

লপিতা—সে কি আপনার ভার্যা?

মন্দপাল—আমার ভার্যা হবে জরিতা।

লপিতা—এতদিন কি বাধা ছিল, কেন আপনার ভার্যা হতে পারেনি জরিতা?

মন্দপাল—আমারই ভুল, আমার বিস্মৃতি। ভুলে গিয়েছিলাম পিতার নির্দেশ। বুঝতে পারিনি, অবিবাহিত ও অপুত্রক জীবন সুখের জীবন নয়।

 

 

বিস্ময়বিচলিতস্বরে লপিতা বলে—আপনি কি সপুত্রক জীবন লাভের লোভে অনুরাগিণী জরিতার কাছে চলেছেন?

মন্দপাল—হ্যাঁ।

লপিতা—কিন্তু সে জীবন কি সত্যিই সুখের জীবন?

মন্দপাল—এ কি অদ্ভুত প্রশ্ন কুমারী?

লপিতা—আপনি ভুল করছেন ঋষি। আপনি সলিলের সন্ধানে মরুভূর দিকে চলেছেন। আপনি মুক্তাফলের সন্ধানে পাষাণের কাছে চলেছেন। আপনি অমৃতের সন্ধানে হলাহলের দেশে চলেছেন। শার্ঙ্গিককুমারী জরিতার প্রেমে আপনি পুত্রবান হবেন, কিন্তু প্রেমিকতার আনন্দ পাবেন না ঋষি।

মন্দপাল—কেন?

লপিতা—আপনার সন্তান দস্যুর মত কেড়ে নেবে আপনারই প্রিয়া জরিতার নয়নের ও অধরের সকল আগ্রহ।

মন্দপাল—তাই তো এই জীবনের নিয়ম।

লপিতা—নিতান্তই অনিয়ম।

মন্দপাল—তুমি কি অমর্ত্যমানবী?

লপিতা—আমি এই মর্ত্যেরই নারী, কিন্তু মর্ত্যের দীনতা হীনতা ও বেদনা হতে প্রেমের জীবনকে চিরসঙ্গে সুখী ক’রে রাখবার রীতি আমি জানি। আমি জানি সে জীবনের সন্ধান।

মন্দপাল—সে কেমন জীবন?

লপিতা—আমার পুষ্পদামসজ্জিত প্রেঙ্খার মত সদা উল্লাসে আন্দোলিত জীবন। পাশাপাশি শুধু দু’টি আসন, শুধু প্রিয় ও প্রিয়ার জন্য দু’টি ঠাঁই। অনুক্ষণ বাহুবন্ধনে বিলীন দু’টি জীবন। সে বন্ধন কোন মুহূর্তে ছিন্ন হয় না। জীবনে কোন শিশুর কণ্ঠস্বর শুনতে হয় না।

মন্দপাল—তোমার পরিচয় জানতে ইচ্ছা করি।

লপিতা—আমি লপিতা, ঋষির তপোবনের কাছে থাকি আমি, কিন্তু তপোবনতরুর ছায়া স্পর্শ করি না কোনদিন। আমি বসন্তসমীরের মত এই নিকুঞ্জের তরুলতার কাছে আমার জীবনের স্বপ্ন নিবেদন করি।

অকস্মাৎ প্রণয়াভিভূত স্বরে আবেদন করে লপিতা—আমার নিকুঞ্জের এই পুষ্পদামসজ্জিত প্রেঙ্খায় আমার পাশে চিরকালের প্রেমিক হয়ে উপবেশন করুন ঋষি।

মন্দপাল—ক্ষমা কর।

লপিতা—আমি ছলনা নই, আমি কুহকিনী নই, আমি অমর্ত্যমানবীও নই। আপনার চিরপ্রিয়া হয়ে আমার জীবন ও যৌবনের প্রতি মুহূর্তের আগ্রহ আপনারই বক্ষে উপহার দিতে চাই। আমি জরিতা নই ঋষি, আমি সন্তানের কলরব ও ক্রন্দনে মুখরিত গৃহধর্ম নই। আমি শুধু প্রেমিকা, প্রেমিকের চিরক্ষণের বক্ষোলগ্ন ললন্তিকা।

মন্দপাল—তুমি সুন্দর, কিন্তু তোমার কামনা সুন্দর নয়।

আর্তনাদ করে লপিতা—অপমান করবেন না ঋষি।

মন্দপাল—কিন্তু তুমি সত্যই বিস্ময়। জীবনে এই প্রথম শুনলাম, বসন্তের ব্রততী পুষ্পান্বিতা হতে চায় না।

দূরে কাননসমাকুল খাণ্ডবপ্রস্থের শ্যামশোভার দিকে তাকিয়ে রইলেন মন্দপাল। তার পরেই নিকুঞ্জপ্রান্তের তরুচ্ছায়া হতে সরে গেলেন।

—ঋষি!

আহ্বান শুনে পিছনে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন মন্দপাল। দেখলেন, নিকুঞ্জচারিণী মায়াহরিণীর মত তাকিয়ে আছে লপিতা, বাষ্পাসারে মেদুরিত তার দুই চক্ষুর দৃষ্টি।

লপিতা বলে—যান ঋষি, কিন্তু লপিতার এই নিকুঞ্জ-নিভৃতের পুষ্পপ্রেঙ্খায় একটি আসন শূন্য পড়ে রইল। যদি কখনও ফিরে আসেন, তবে দেখতে পাবেন, শূন্য হয়েই রয়েছে এই আসন। লপিতার জীবনের পাশে আপনি ছাড়া আর কারও স্থান নেই।

 

 

চমকে ওঠেন মন্দপাল, এবং ব্যথাভিভূত নেত্রে লপিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ক্ষণিক মোহের ভুলে, বিচলিত বাসনার বিভ্রমে কী কঠোর প্রতিজ্ঞ ঘোষণা ক’রে দিল লপিতা! শূন্য হয়েই থাকবে ওর পুষ্পপ্রেঙ্খার একটি আসন। কোনদিনও এখানে আর ফিরে আসবেন না মন্দপাল। এই নিকুঞ্জের নিভৃতে চিরকালের একাকিনী লপিতা শুধু তার ব্যথিত ও বিষণ্ণ মূর্তির ছায়া দেখে জীবনযাপন করবে। ভুল, ভয়ানক ভুল করল এই কল্পনাসুখিনী নারী।

মন্দপাল বলেন—বিদায় দাও, লপিতা। প্রার্থনা করি, তোমার ভুল যেন ভেঙে যায়।

কাননসমাকুল খাণ্ডবপ্রস্থের শ্যামশোভার এক নিভৃতের ক্রোড়ে শার্ঙ্গিককুমারী জরিতার প্রতীক্ষা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। জরিতার পাণি গ্রহণ করেছেন মন্দপাল। যেন হেসে উঠেছে সংসারের দু’টি প্রাণের প্রদীপ, আর সেই হাসিতে একটি কুটীরের বক্ষ মধুর হয়ে গিয়েছে।

কালচক্রে ধাবিত হয় মাস ঋতু ও বৎসর। আসে নিদাঘ, আসে প্রাবৃষা, আসে শিশির ও বসন্ত। খাণ্ডবকাননের লতাকুঞ্জের মত মন্দপাল আর জরিতার জীবন কুঞ্জেও নূতন প্রাণের আবির্ভাব পুষ্পিত হয়ে ওঠে। সন্তান ক্রোড়ে নিয়ে স্বামী মন্দপালের মুখের দিকে স্মিতনেত্রে তাকিয়ে ব্রীড়াবশে নতমুখিনী হয় পত্নী জরিতা। মন্দপাল বলেন—পুষ্পিতা ব্রততীর মত ধন্য ও সুন্দর তুমি, প্রিয়া জরিতা।

শিশুকণ্ঠের ক্রন্দনস্বরে ব্যাকুল ও বিহ্বল হয় মন্দপালের কুটীর।

মন্দপাল বলেন—তুমি আমার স্বপ্ন সফল করেছ, জরিতা। তুমি এই কুটীরের বাতাসে স্নেহ সঞ্চারিত করেছ, তুমি আমার বক্ষের কাছে কিশলয়দেহ শিশুর মধুর স্পর্শ নিয়ে এসেছ।

 

 

খাণ্ডবকাননের নিভৃতে এক কুটীরের বক্ষে গৃহধর্ম জেগে উঠেছে। ফুটে উঠেছে এক দম্পতির পরিতৃপ্ত জীবনের আনন্দ। সে আনন্দের নাম সন্তান। পিতৃত্ব লাভ করেছে এক পুরুষ, মাতৃত্বে মণ্ডিত হয়েছে এক নারী। দম্পতির প্রেমের জীবন বাৎসল্যে অভিষিক্ত হয়ে ফুল্লদল নব কুসুমের মত ফুটে উঠেছে।

অতিক্রান্ত হয়েছে বৎসরের পর বৎসর। চারিটি পুত্রসন্তানের জননী জরিতা একদিন মন্দপালের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়।—এ কি, বিষণ্ণ কেন তুমি?

মন্দপাল বলেন—এই কি প্রথম দেখতে পেলে?

জরিতা—হ্যাঁ।

মন্দপাল—আমার আশঙ্কা সত্য হলো।

জরিতা বেদনার্তভাবে তাকায়—কিসের আশঙ্কা?

মন্দপাল—তোমার নিকট থেকেও আমি আজ একাকী।

জরিতা—একথা বলছেন কেন স্বামী?

মন্দপাল—হ্যাঁ, আমি একাকী ও নিঃসঙ্গ। আমি আজ তোমার এই বাৎসল্যবিহ্বল কুটীরে তোমার সর্বক্ষণের ব্যস্ততার পাশে একটি অবান্তর ছায়া মাত্র।

ব্যথিতভাবে জরিতা বলে—আপনার দুঃখ বুঝতে পেরেছি স্বামী। কিন্তু…।

মন্দপাল—কিন্তু বুঝলেও তোমার সেই হৃদয় আজ আর নেই।

জরিতা—কোন্ হৃদয়?

মন্দপাল—প্রেমিকার হৃদয়! তুমি আজ শুধু সন্তানের মাতা। সন্তানের অধরহাস্য তোমার সকল চুম্বন লুণ্ঠন ক’রে নেয়। সন্তানের অধরের স্পন্দন দেখে তার তৃষ্ণা তুমি বুঝতে পার। কিন্তু ভুলে গিয়েছ, তোমারই অনুরাগের আহ্বানে সুদূর হতে ষে প্রেমিক এসে তোমাকে এক শুভদিনে কণ্ঠলগ্ন করেছিল, সে আজও তোমার নিকটেই আছে, আর তার হৃদয়ে পিপাসাও আছে। ভুলে গিয়েছ, সে প্রেমিকহৃদয় আজও উৎসব অন্বেষণ করে। কিন্তু বৃথা, বৃথা এই কাননভূমির নিভৃতে শীতাংশুকিরণ এসে লুটিয়ে পড়ে, বৃথা ফুটে ওঠে বাসন্তী কুসুম, বৃথা নীরব হয় যামিনীর মধ্যপ্রহর; প্রেমিক মন্দপাল তার প্রেমিকাকে আর খুঁজে পায় না।

অশ্রুসিক্ত নয়নে জরিতা বলে—আমার ভুল ক্ষমা করবেন স্বামী।

 

 

নয়নমায়া সুস্মিত ক’রে মন্দপালের মুখের দিকে তাকিয়ে মধুর প্রতিশ্রুতির মত সুস্বরে জরিতা বলে—আর কখনও এ-ভুল হবে না। আজ রজনীতে তোমারই জরিতার কণ্ঠ হতে আপন কণ্ঠে তুলে নিও সেই বাসন্তী কুসুমের মালিকা, যে কুসুমের মালিকা দিয়ে তোমাকে আমার জীবনে প্রথম বরণ করেছিলাম। আজ তোমারই বামবাহু তোমার প্রেমিকা জরিতার উপাধান হবে প্রিয়।

কিন্তু ভুল হল জরিতার। বুকের কাছে শিশুর ক্রন্দনে যখন স্বপ্ন ভেঙে গেল নিদ্রামগ্ন জরিতার, তখন জাগ্রত পিকের সঙ্গীতে মুখর হয়ে উঠেছে খাণ্ডবকাননের প্রত্যূষের সমীর। দেখতে পায় জরিতা, তার বাসন্তী কুসুমের মালিকাও যেন বৃথা প্রতীক্ষার বেদনায় বিষণ্ণ হয়ে তারই শিয়রের কাছে পড়ে আছে।

বৃথা পুষ্পমালিকা তুলে নিয়ে ছুটে যায় জরিতা। কুটীরের চতুর্দিকে অন্বেষণ ক’রে ফিরতে থাকে জরিতা। কিন্তু মন্দপাল নেই। জরিতার প্রেমিক মন্দপাল, জরিতার স্বামী মন্দপাল, জরিতার সন্তানের পিতা মপাল চলে গিয়েছেন।

স্বামী! বৃথা আর্তনাদ করে জরিতা। খাণ্ডবকাননের প্রত্যূষ জরিতার সেই ব্যাকুল আহ্বানের কোন উত্তর দেয় না।

ভ্রমরজল্পিত পুন্নাগতরুর ছায়ার স্নিগ্ধকণ্ঠের আহ্বান ধ্বনিত হয়।—আমি এসেছি, লপিতা।

লপিতা বলে—এস, দেখ আমার পুষ্পপ্রেঙ্খার একটি আসন আজও শূন্য পড়ে আছে কি না।

মন্দপাল—দেখেছি। আমার সকল কঠোরতা ক্ষমা ক’রে আজ তোমার জীবনের পাশে আমাকে গ্রহণ কর। তোমার পুষ্পপ্রেঙ্খার ঐ আসন স্বপ্ন হয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। তোমাকে ভুলতে পারিনি। বুঝেছি, তুমিই প্রেমিকা এবং সত্য তোমার প্রেম।

লপিতার পাণি গ্রহণ করলেন মন্দপাল। লপিতা বলে—এস, বিরহবিহীন চিরাসঙ্গমধুর জীবনের নায়ক হয়ে আমার জীবনে এস।

 

 

দোলে, নিকুঞ্জের নিভৃতে পুষ্পপ্রেঙ্খায় দু’টি প্রেমবিধুর জীবনের ক্ষান্তিহীন আকাঙ্ক্ষা দোলে। মন্দপাল ও লপিতা, চিরক্ষণের প্রেমিক ও চিরক্ষণের প্রেমিকা। ওদের জীবন সংসারের কোন কুটীর চায় না, ওদের ক্রোড় ও বক্ষ কোন শিশুদেহের স্পর্শ চায় না। মন্দপাল শুধু লপিতার জন্য, লপিতা শুধু মন্দপালের জন্য। আর কারও জন্য ওরা নয়।

কালচক্রে মাস ঋতু ও বৎসর আবর্তিত হয়। আসে নিদাঘ, আসে প্রাবৃষা, আসে শিশির ও বসন্ত।

নিকুঞ্জের পুষ্পপ্রেঙ্খার আসনে বসে দেখতে পান মন্দপাল, দূরে কাননসমাকুল খাণ্ডবপ্রস্থের শ্যামশোভা তরঙ্গিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু দেখেও যেন মনে পড়ে না, ঐ শ্যামশোভার নিভৃতে অসহায় অশ্রুর কুহেলিকায় আবৃত কোন কুটীরের কথা। মাঝে মাঝে শুধু মনে পড়ে মন্দপালের, খাণ্ডবকাননের এক প্রেমহীন ও আনন্দহীন শুষ্কপত্রস্তূপের ছলনার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি চিরসুরসিত এক নিকুঞ্জের ছায়ার কাছে চলে এসেছেন।

সুখী হয়েছে লপিতা। প্রতিদিন প্রশ্ন করে লপিতা—তুমি সুখী হয়েছ তো ঋষি?

মন্দপাল বলেন—সুখী হয়েছি লপিতা।

কিন্তু অকস্মাৎ একদিন প্রশ্ন ক’রেও উত্তর শুনতে না পেয়ে বিস্মিত হয়ে মন্দপালের মুখের দিকে তাকায় লপিতা। দেখতে পায় লপিতা, শ্যামায়মান খাণ্ডবকাননের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছেন মন্দপাল।

লপিতা বলে—কি দেখছ স্বামী?

অকস্মাৎ আর্তনাদ ক’রে ওঠেন মন্দপাল—রক্ষা কর।

পুষ্পপ্রেঙ্খা হতে অবতরণ ক’রে ব্যথিতস্বরে মন্দপাল বলেন—ঐ দেখ লপিতা, অগ্নিশিখার ঝটিকা খাণ্ডবকাননের দিকে ছুটে চলেছে। ঐ দেখ খাণ্ডব দাহনে চলেছেন ভগবান হুতাশন।

লপিতা—কিন্তু তার জন্য তুমি এত বিচলিত হলে কেন স্বামী?

মন্দপাল—ঐ খাণ্ডবকাননের নিভৃতে একটি কুটীরে আমারই প্রাণের পুষ্পিত আনন্দের চারিটি মূর্তি, চারিটি শিশু রয়েছে লপিতা।

চমকে উঠে লপিতা বলে—বুঝেছি ঋষি।

—কি?

—আপনি সন্তানের পিতা। আপনার হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে এক পিতার প্রাণ। কিন্তু তার জন্য কোন দুঃখ করি না ঋষি। আমার সন্দেহ…।

চিৎকার করেন মন্দপাল—সন্দেহ দূরে রাখ লপিতা। চল হুতাশনের কাছে গিয়ে প্রার্থনা করি, যেন আমার চারিটি শিশুপুত্রের প্রাণ রক্ষা পায়।

শুনে প্রসন্ন না হ’লেও যেন এক দুঃসহ সন্দেহের পীড়ন হতে মুক্ত হয় আর নিশ্চিন্ত হয় লপিতা। শুধু চারিটি শিশুপুত্রের প্রাণের জন্য কেঁদে উঠেছে পিতা মন্দপালের প্রাণ। তবু ভাল, আর কারও জন্য নয়।

নিকুঞ্জের নিভৃত হতে অগ্রসর হয়ে দীর্ঘ প্রান্তরপথ অতিক্রম ক’রে ভগবান হুতাশনের নিকটে এসে দাঁড়ায় মন্দপাল ও লপিতা। প্রার্থনা করেন মন্দপাল—খাণ্ডব দাহনে অভিলাষী ভগবান, হে পিঙ্গলাক্ষ লোহিতগ্রীব হুতাশন, মন্দপালের কুটীর যেন আপনার জ্বালায় ভস্মীভূত না হয়।

হুতাশন—কেন? কে আছে তোমার কুটীরে?

মন্দপাল—আমার ভার্যা জরিতা ও আমার চারিটি শিশুপুত্র।

হুতাশন আশ্বাস দান করেন—চিন্তা করো না ঋষি। অগ্নির কোন শিখা আর জ্বালা তোমার কুটীর স্পর্শ করবে না।

আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এলেন মন্দপাল।

আবার নিকুঞ্জের নিভৃতে সেই পুষ্পপ্রেঙ্খা।

লপিতা ক্ষোভকঠোর কণ্ঠস্বরে বলে—আমার সন্দেহ মিথ্যা নয় ঋষি। আপনিই প্রমাণ ক’রে দিলেন যে, আমার সন্দেহ সত্য।

—কিসের সন্দেহ?

—আপনার প্রথমবিত্তা জরিতা এখনও আপনার স্বপ্নে লুকিয়ে রয়েছে ঋষি।

—কেমন ক’রে বুঝলে?

—আপনি শুধু চারিপুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য নয়, আপনার প্রথম প্রণয়িনী জরিতারও প্রাণরক্ষার জন্য হুতাশনের কাছে প্রার্থনা করতে ভুলে যাননি।

—তুমি কি সত্যিই সুখী হবে লপিতা, যদি পৃথিবীর চারিটি শিশুর এক মাতা বিনা অপরাধে অগ্নিজ্বালায় ভস্ম হয়ে যায়?

—না ঋষি, আমি শুধু চাই, আমার প্রেমিকাজীবনের সকল আকাঙ্ক্ষার বাধা সেই জরিতার প্রতি আমার প্রেমিক মন্দপালের মনের শেষ অনুরাগের স্মৃতিটুকুও যেন ভস্ম হয়ে যায়।

উত্তর দেন না মন্দপাল। আবার সেই বিপুল বহ্নিজ্বালায় অভিভূত ধূমায়মান খাণ্ডবকাননের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

লপিতা ডাকে—স্বামী।

মন্দপাল মৃদুস্মিত মুখে উত্তর দেন—সন্দেহ করো না লপিতা।

দুই অধর সুহাস্যে স্পন্দিত ক’রে লপিতা বলে—সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে না স্বামী।

আবার নিকুঞ্জনিভৃতের পুষ্পপ্রেঙ্খা দোলে। অবিরলপ্রগল্ভ প্রেমিকতায় পরস্পরের বাহুলগ্ন দু’টি জীবনের উল্লাস আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে।

কিন্তু পরক্ষণেই যেন দুর্বার এক আলস্যে শিথিল হয়ে পড়ে মন্দপালের দু’টি অন্যমনা বাহু। যেন দুঃসহ এক ক্লান্তির বেদনা এতদিনে এসে এই নিয়ত-অস্থির পুষ্পপ্রেঙ্খার জীবন গ্রাস করেছে।

লপিতা বিস্ময়ব্যথিত স্বরে প্রশ্ন করে—একি? অন্যমনা কেন তুমি স্বামী?

মন্দপাল বলেন—দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত হতে পারছি না লপিতা।

—কিসের দুশ্চিন্তা?

—জানতে ইচ্ছা করে, আমার কুটীরের প্রাণ সত্যই রক্ষা পেল কিনা?

—ভগবান হুতাশনের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েও বৃথা এত দুশ্চিন্তা করছ কেন স্বামী?

—আশ্বাস পেয়েও আশ্বস্ত হতে পারছি না। যেতে চাই খাণ্ডবকাননে। নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারব না।

খরবহ্নির স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে ওঠে লপিতার অক্ষিতারকা।—সত্য ক’রে বল দেখি সত্যসন্ধ ঋষি, কা’র মুখ দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তোমার মন?

—পুত্রদের দেখবার জন্য।

—আর কারও জন্য নয়?

—না।

—তবে যাও। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাও, ফিরে আসবে তোমার লপিতার কাছে।

—আসব।

—ভুলে যেও না, এক বৎসর পূর্বে আজিকার মত এই শুক্লা চতুর্দশীর সন্ধ্যায় তোমার কণ্ঠে পুন্নাগপুষ্পের মালিকা দান করেছিল এই লপিতা।

—ভুলতে পারি না।

—বলে যাও, তেমনি একটি প্রণয়কামনাবাসিত পুন্নাগপুষ্পের মালিকা আমার হাত হতে আজই সন্ধ্যায় কণ্ঠে বরণ করবে তুমি।

—প্রিয়া লপিতা! আজই সন্ধ্যায় তোমার কাছে এসে তোমার উপহার গ্রহণ করবে তোমার প্রেমিক স্বামী মন্দপাল।

—যদি আসতে না পার?

—কেন পারব না লপিতা?

—যদি না আস, তবে শুনে রাখ স্বামী, সেই মালিকা চারি খণ্ডে ছিন্ন ক’রে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করব।

আতঙ্কে চমকে ওঠেন এবং বাণবিদ্ধ মৃগের মত ব্যথিত নেত্রে তাকিয়ে থাকেন মন্দপাল।

লপিতা বলে—যদি তোমার চারিপুত্রের জীবনের জন্য কোন মায়া থাকে, যদি লপিতার অভিশাপ থেকে তোমার চারি পুত্রের জীবন রক্ষা করতে চাও, তবে লপিতার প্রেমের অপমান করো না ঋষি।

নীরবে, শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুলে লপিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন মন্দপাল। বিষলতার হৃদয়েও মায়াময় বাৎসল্যভাবনা আছে। বিষলতাও অঙ্গে পুষ্প প্রস্ফুটিত ক’রে তৃপ্ত হয়। কিন্তু এ কেমন সৃষ্টিবিমুখিনী পীযূষবিহীনা কামনার নারী? নিতান্ত এক শোণিতব্রতী নারী।

কোন বাক্য উচ্চারণ না ক’রে ব্যস্তচরণে চলে গেলেন মন্দপাল।

খাণ্ডবকাননের নিভৃতের ক্রোড়ে সেই কুটীর। কুটীরে অগ্নিজ্বালার স্পর্শ লাগেনি। ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে কুটীরের অঙ্গনে এসে দাঁড়ালেন মন্দপাল।

জরিতা এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। কোন কথা না বলে শুধু প্রণাম করে জরিতা। সুস্মিতা হয় না, বিস্মিত হয় না, বিচলিত হয় না, বিব্রত হয় না জরিতা। যেন, এতকাল মন্দপালের প্রাণের চারিটি শিশুমূর্তিকে স্নেহচঞ্চলচ্ছায়া দান ক’রে রক্ষয়িত্রীর মত এই কুটীরের নিভৃতে দিনযাপন করেছে জরিতা। দেখে তৃপ্ত আর শান্ত হোক মন্দপাল, তাঁর সন্তানদের কোন ক্ষতি হয়নি।

সন্তানেরা এসে একে একে মন্দপালের নিকট দাঁড়ায়। চারিটি কিশলয়দেহ শিশু। একে একে সন্তানদের শির চুম্বন করেন মন্দপাল।

এই সুন্দর দৃশ্যের এক পাশে এক অবান্তর ও অপ্রয়োজন ছায়ার মতে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে জরিতা। হ্যাঁ, নিশ্চিন্ত হয়েছে জরিতা, দেখে সুখী হয়েছে জরিতা, কিন্তু এই ঘটনার কাছে জরিতার জীবনের যেন কোন প্রশ্ন নেই, বক্তব্যও নেই। এসেছেন নিতান্ত এক সন্তানম্নেহের পিতা, বিপন্নপ্রাণ সন্তানের জন্য উদ্বিগ্নচিত্ত এক পিতার হৃদয় ছুটে এসেছে। জরিতার হাত থেকে বাসন্তী কুসুমের মালিকা কণ্ঠে গ্রহণ করবার জন্য ছুটে আসেনি কোন প্রেমিকের লোভ আর স্বামীর মন।

কিন্তু অকস্মাৎ দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয় জরিতা, যেন এক বিভ্রমের বশে বিচলিত দুই চক্ষুর দৃষ্টি তুলে নতমুখিনী জরিতার মুখের দিকে তৃষ্ণার্তের মত তাকিয়ে আছেন মন্দপাল।

—জরিতা!

মন্দপাল আহ্বান শুনেও সাড়া দেয় না জরিতা। অভিমানকুণ্ঠিতা নায়িকার মত নয়, যেন নিদাঘতাপিতা বাসন্তী কুসুমের মত অবমানিত ও উপেক্ষিত সৌরভের বেদনায় কুণ্ঠিত হয়ে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে থাকে জরিতা।

মন্দপাল বলেন—আজও কি আমার এই আহ্বানের অর্থ বুঝতে পারবে না জরিতা?

—বুঝতে পারি স্বামী, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি না।

—কি বিশ্বাস করতে পার না?

—আপনার নয়নের ঐ দৃষ্টি আর আপনার কণ্ঠস্বরের এই আহ্বান তৃপ্ত করার মত কোন রূপ আর গুণ আছে কি এই জরিতার?

—এ সন্দেহ কি এখনও হৃদয়ে পোষণ ক’রে রেখেছ?

—সন্দেহ নয় স্বামী!

—তবে কি?

—শিক্ষা।

—কিসের শিক্ষা?

—আমি চিরাসঙ্গমধুর পুষ্পপ্রেঙ্খা নই ঋষি, আমি নিতান্তই এক বাৎসল্যবিধুর কুটীর।

মন্দপাল—পুত্রবতী জরিতা, পুষ্পিতা ব্রততীর মত তুমি। পরাগলিপ্তা কেতকীর মত তুমি। কল্লোলিনী তটিনীর মত তুমি। তোমারই নিঃশ্বাসের সৌরভ আমার এই কুটীরে চারিটি পুষ্পের মূর্তি নিয়ে ফুটে উঠেছে।

—আপনি ক্ষণিক করুণায় ভুলে এই ধারণা করছেন ঋষি।

—না জরিতা।

—আপনি আপনার দুই চক্ষুকে প্রশ্ন করুন ঋষি।

—করেছি জরিতা। আমার দুই চক্ষু আজ একটি সত্যকে দেখতে পেয়েছে।

—কি?

—তুমি সাবিত্রী, তাই তুমি সুন্দর।

—স্বামী।

—তুমি শুধু সুন্দর নও জরিতা, তুমিই সুন্দরতা। তুমি শুধু আমার প্রেমিক নও, তুমি আমার প্রেম।

কুটীরের এক বৃক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জরিতা। একটি পুষ্পমালিকা হাতে নিয়ে ফিরে এসে মন্দপালের বক্ষঃসন্নিধানে দাঁড়ায়। জরিতার স্মিত অধরের মতই স্নিগ্ধ অথচ বিহ্বল সেই সদ্যশ্চয়িত বাসন্তী কুসুমের মালিকা, সিতচন্দনে অভিষিক্ত।

মন্দপাল কণ্ঠে পুষ্পমালিকা অর্পণ করে জরিতা।

মন্দপাল বলেন—আর এখানে নয় প্রিয়া। চল, এই খাণ্ডবকাননের নিভৃত হতে বহুদূরে চলে যাই, যেখানে কোন পুষ্পপ্রেঙ্খার কঠোর স্বপ্ন শত অন্বেষণেও আমাদের এই স্নিগ্ধ তৃপ্ত ও সসন্তান গৃহজীবনের সন্ধান পাবে না।

জরিতা বলে—চল স্বামী।

মন্দপাল—কিন্তু…।

জরিতা—চিন্তান্বিত হলেন কেন স্বামী?

মন্দপাল—কিন্তু সেই পুষ্পপ্রেঙ্খার সেই কঠোরস্বপ্না যে আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। আমি তাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্বস্ত ক’রে এসেছি, সেই প্রতিশ্রুতি আমাকে ভঙ্গ করতে হবে। আমার এই অপরাধে তার প্রতিহিংসা আর অভিশাপ যদি…।

অকস্মাৎ সেই অভিশাপোৎসুক কঠোরস্বপ্নাকেই সম্মুখে দেখতে পেয়ে মন্দপালের আতঙ্কিত বক্ষের আর্তনাদ শিহরিত হয়।—তুমি?

—হ্যাঁ, আমি। কুটীরপ্রাঙ্গণের এক লতান্তরাল হতে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মন্দপালের সম্মুখে দাঁড়ায় লপিতা।

হেসে ওঠে লপিতা।—ভয় পেও না স্বামী। শুনে সুখী হও, হার মেনেছে লপিতা, আর সেই পরাজয় ঘোষণা ক’রে দিয়ে চলে যাবার জন্যই এসেছে লপিতা।

মন্দপাল—পরাজয়?

লপিতা—হ্যাঁ, কিন্তু তোমার কাছে নয় ঋষি।

নীরব হয় লপিতা। তারপর জরিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে—পরাজয় তোমার কাছেও নয় জরিতা। তোমাকে আমার চেয়ে বেশি সুন্দর ক’রে তুলেছে যারা, তারাই আমাকে হারিয়ে দিয়েছে, তারা হলো ঐ চারিটি…।

চিৎকার ক’রে ওঠেন মন্দপাল—অভিশাপ দিও না লপিতা। ওরা কোন অপরাধ করেনি।

আবার হেসে ওঠে লপিতা—কথা ছিল, তুমি যদি ফিরে না আস আমার কাছে, তবে আমার প্রেমের পুন্নাগমালিকা চারি খণ্ডে ছিন্ন ক’রে…।

সহসা অশ্রুধারায় প্লাবিত হয়ে মুছে যায় সুন্দরী লপিতার চিবুকের কুঙ্কুমরোচনা।

লপিতা বলে—আপনারই প্রাপ্য মালিকাকে চারি খণ্ডে ছিন্ন ক’রে চারিটি ক্ষুদ্র মালিকা রচনা করেছি। ভয় পাবেন না পুত্রবৎসল ঋষি।

আরও নিকটে এগিয়ে আসে লপিতা। মন্দপাল ও জরিতার ক্রোড়লগ্ন চারিটি শিশুর অধর চুম্বন করে লপিতা। চারিটি শিশুকণ্ঠকে সস্নেহে পুষ্পমালিকায় শোভিত ক’রে দিয়ে লপিতা বলে—হার মেনেছি যাদের কাছে, তাদেরই গলায় মালা দিয়ে গেলাম। সুখী হও ঋষি মন্দপাল, সুখী হও জরিতা।

চলে গেল লপিতা।

নিকুঞ্জের নিভৃতে দোলে পুষ্পপ্রেঙ্খা। ভ্রমরজল্পিত পুন্নাগতরুর ছায়া স্নিগ্ধ হয়েই থাকে। বসন্তসমীরের স্পর্শে চঞ্চলিত হয় লতাপল্লব। দোলে, পুষ্পপ্রেঙ্খায় এক পীযূষবিহীন কামনার ক্লান্ত ও বেদনাক্লিষ্ট জীবনভার দোলে। দোলে এক নির্বাসিতা অপূর্ণবাসনা।

প্রতিধ্বনি বলে—এ কি লপিতা? তুমি এখনও একাকিনী?

লপিতা বলে—হ্যাঁ, আমি চিরকালের একাকিনী।


© 2024 পুরনো বই