অগস্ত্য ও লোপামুদ্রা

বিদ্রুমসঙ্কাশ বর্ণশিলার সোপান এবং বৈদূর্যখচিত স্তম্ভ, বিদর্ভরাজের সেই নয়নরম্য নিকেতনের এক স্ফটিকুট্টিমে নৃত্য করে এক মণিনূপুরিতা সৌদামিনী। বিদর্ভরাজের কন্যা লোপামুদ্রা যেন কোটি বনচম্পকের কান্তিপীযূষধারায় শতধৌত এক কলধৌতদেহিনী। কজ্জলিতাক্ষী শত কিংকরীর কলহাস্যে পরিবৃতা লোপামুদ্রার অবিরল নৃত্যামোদচঞ্চল দেহ এই স্ফটিককুট্টিমের বক্ষে ক্ষণে ক্ষণে সুলাস্যলীলায়িত দ্যুতিচ্ছবির মায়াকুহক সঞ্চারিত করে। কনককেয়ূরের প্রভা, রত্নকাঞ্চীর বিপুলস্ফুরিত লাস্য, আর স্বর্ণতাটঙ্কের বিচ্ছুরিত রশ্মি দিয়ে রচিত মূর্তির মত সুশোভিতা কুমারী লোপামুদ্রা যেন পিতা বিদর্ভরাজের সকল ঐশ্বর্যের স্নেহে অভিষিক্তা এক আভরণেশ্বরী।

স্ফটিককুট্টিমে নৃত্য করে বিকচযৌবনা লোপামুদ্রা, আর সেই লীলায়িত বাহুক্ষেপ কটিভঙ্গ ও পচ্ছন্দের উৎসবে যেন আত্মহারা হবার জন্য বিগলিত হয় লোপামুদ্রার মণিস্তবকিত বেণী, শিথিল হয় স্তোকোৎফুল্ল বক্ষের স্বচ্ছ অংশুকবসন, ছিন্ন হয়ে মৌক্তিকনির্ঝরের মত ঝরে পড়ে কণ্ঠের একাবলী রত্নহার।

চঞ্চল নিঃশ্বাস সংবরণের জন্য শান্ত হয়ে একবার দাঁড়ায় লোপামুদ্রা, বেপথুভঙ্গা ভামিনীর মত কুতুকতরল নেত্রান্ত সমুত্তিত ক’রে হাস্যচঞ্চল স্বরে কিংকরীকে বলে— নব আভরণে সাজিয়ে দাও কিংকরী। নিয়ে এস ইন্দ্রনীলের কণিকা দিয়ে রচিত নূতন কটিমেখলা।

কিংকরী বিস্মিত হয়ে বলে—এইবার নৃত্য ক্ষান্ত কর রাজকুমারী।

 

 

লোপামুদ্রা বলে—না, বাধা দিও না কিংকরী। দাও; এই মুহূর্তে আমার দুই পায়ে পরিয়ে দাও কলহংসকণ্ঠের চেয়েও নিঃস্বনমধুর দু’টি স্বর্ণবিনির্মিত হংসক। এখনি ক্ষান্ত হতে দেব না এই উৎসব।

কৌতুকিনী কিংকরী বলে—এমন ক’রে সকল রত্নাভরণ শিঞ্জিত ক’রে আর মন্দিরদাসী নর্তকীর মত ছন্দোময়ী হয়ে মনের কোন্ স্বপ্নের দেবতাকে বন্দনা করছ রত্নাধিকা লোপামুদ্রা?

চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তান্বিতার মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লোপামুদ্রা। বিষণ্ণ অথচ স্নিগ্ধ স্বরে বলে—তোমার অনুমান নিতান্ত মিথ্যা নয় কিংকরী। দেখতে পেয়েছি, যেন আমার এই মনের এক স্ফটিককুট্টিমের নিভৃতে উৎসবের প্রদীপ জ্বলছে। দেবোপমকান্তি এক প্রেমিকের বিশালতৃষ্ণ দু’টি চক্ষুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে আমার সব রত্নাভরণ, কেয়ূর কাঞ্চী মঞ্জীর আর মৌক্তিকহার। আমার এই মধুর আতঙ্কের অর্থ বুঝতে পারছি না কিংকরী।

আতঙ্কিতের মত ছুটে এসে দাঁড়ায় বিদর্ভদুহিতা লোপামুদ্রার ধাত্রেয়িকা। সাশ্রুনয়নে বলে—উৎসব ক্ষান্ত কর, দুর্ভাগিনী কন্যা।

লোপামুদ্রা—কেন?

ধাত্রেয়িকা—চুপ, কথা বলো না, প্রশ্নমুখরা কন্যা। সাবধান, যেন ভুলেও তোমার স্বর্ণমঞ্জীর রণিত হয় না।

লোপামুদ্রা—কেন?

ধাত্রেয়িকা—চুপ চুপ। নীরব ক’রে রাখ তোমার মুখের রত্নাভরণ, যেন শুনতে না পায় ঋষি অগস্ত্য। লুকিয়ে ফেল তোমার বেণীমণিপ্রভা, যেন দেখতে না পায় ঋষি অগস্ত্য।

বিস্মিত স্বরে লোপামুদ্রা বলে—ঋষি অগস্ত্য?

ধাত্ৰেয়িকা—হ্যাঁ, নিঃস্ব রিক্ত ও চীরবাসসম্বল তপস্বী অগস্ত্য বিদর্ভরাজের এই রত্নপুরদ্বারে এসে দাঁড়িয়েছেন।

বিপন্নের মত আতঙ্কিত স্বরে সংবাদ শুনিয়ে দিয়ে পুনরায় অন্তঃপুরের দিকে চলে যায় ধাত্রেয়িকা। বিস্মিত হয় লোপামুদ্রা। এক রিক্ত ও নিঃস্ব তপস্বী এসে দাঁড়িয়েছেন কুবেরপ্রতিম ধনশালী বিদর্ভরাজের বৈদূর্যখচিত ভবনস্তম্ভের ছায়ার নিকটে; কিন্তু তার জন্য এত আতঙ্কিত হবার কি আছে? রহস্য বুঝতে পারে না কিংকরীর দল, কলহাস্য স্তব্ধ ক’রে বিষণ্ণ মুখে লোপামুদ্রার বিস্ময়াপ্লুত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপরেই সেই অদ্ভুত বিপদের রহস্য বুঝবার জন্য অন্তঃপুরের অভিমুখে ত্বরিতপদে প্রস্থান করে।

 

 

নীলাকাশের দিকে আর একবার দুই ভ্রমরকৃষ্ণ চক্ষুর দৃষ্টি তুলে অস্ফুটস্বরে হৃদয়ের বিস্ময় ধ্বনিত করে লোপামুদ্রা—ঋষি অগস্ত্য!

এক নিঃস্ব তপস্বী এসে দাঁড়িয়েছেন বিদর্ভরাজের ভবনদ্বারে, কিন্তু তার জন্য এমন ক’রে কেন আতঙ্কিত হয় ঐশ্বর্যসমাকুল এই বিরাট ভবনের অন্তরাত্মা? কেন লুকিয়ে ফেলতে হবে এই বেণীমণিপ্রভা! কেন নীরব ক’রে রাখতে হবে এই স্বর্ণমঞ্জীর? কঠোরহৃদয় লুণ্ঠকের মতই কি এই তপস্বীও এসেছেন একটি কঠোর প্রার্থনার দ্বারা দানপুণ্যপরায়ণ বিদর্ভরাজের এই ভবনের সকল রত্ন হরণ ক’রে নিয়ে চলে যাবার জন্য! তাই কি ভীত ও বিচলিত হয়েছে ধাত্রেয়িকা, আর, তার দুই চক্ষু জলে ভরে উঠেছে?

দেখতে ইচ্ছা করে, কেমন সেই রত্নলোভাতুর ঋষির রূপ, আশ্রমনিভৃতের মৌন আর প্রশান্তি হতে ছুটে এসে যে ঋষি এমন লুব্ধ প্রার্থীর মত এক নৃপতির ভবনের দ্বারপ্রান্তপথে দাঁড়িয়ে আছে। তপশ্চর্যার চেয়ে রত্নকামনা বড় হয়ে উঠেছে যে অদ্ভুত তপস্বীর চিত্তে, তার প্রার্থনাকে ভয় করবারই বা কি আছে? এমন লুব্ধের কঠোর প্রার্থনাকে একটি কঠোর প্রত্যাখ্যানে বিমুখ ক’রে দিলে এই পৃথিবীর কোন দানব্রত যশস্বীর পুণ্যহানি হবে না।

স্ফটিকুট্টিমের অভ্যন্তর হতে যেন এক কৌতূহলের বিহগীর মত দুর্বার আগ্রহে ছুটে গিয়ে ভবন-পুরোভাগের নিকটে নবীন দূর্বায় আস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের প্রান্তে এসে দাঁড়ায় লোপামুদ্রা। গ্রীবাভঙ্গে হেসে ওঠে বেণীমণিপ্রভা, বায়ুভরে আন্দোলিত হয় স্বচ্ছ অংশুকবসনের অঞ্চল, কেলিমদ মরালের কলস্বরের মত বেজে ওঠে রূপমতী লোপামুদ্রার চরণলগ্ন স্বর্ণহংসক। পৃথিবীর এক অতিকঠোর লোভীর চক্ষু ও কর্ণকে উপেক্ষা করার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে ভীতিলেশবিহীনা লোপামুদ্রা।

ঐ যে, ঐ লতাগৃহের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রার্থী। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় আর তাকিয়ে থাকে লোপামুদ্রা। বর্ষার বারিপরিস্ফীতা তটিনী যেন তার বিপুল ঊর্মিল প্রগল্ভাতা ক্ষণিকের মত সংযত ক’রে তটস্থিত দেবদারুর দিকে তাকিয়েছে। ব্যাধের সায়কাঘাতে বিদ্ধ হয়ে কূজনরতা পক্ষিণীর কণ্ঠ যেমন রবহারা হয়, তেমনি হঠাৎ নীরব হয়ে যায় স্বর্ণহংসকের উদ্দাম মুখরতা। সলজ্জ সন্ত্রাসের স্পর্শে শিহরিত হয়ে লোপামুদ্রা এক হাতে চেপে ধরে তার বেণীবন্ধের মণি, অন্য হাতে অলজ্জ অংশুকবসনের অঞ্চল। বিদর্ভতনয়ার রত্নাভরণের সকল গর্বের উজ্জ্বলতা যেন সেই মুহূর্তে ক্ষুদ্র খদ্যোতের মত আত্মকুণ্ঠায় লুকিয়ে পড়বার পথ খুঁজতে থাকে।

 

 

দেখতে ইচ্ছা করে আরও ভাল ক’রে। এই অদ্ভুত ইচ্ছার আবেগ সংবরণ করতে পারে না লোপামুদ্রা। ধীরে ধীরে, যৌবনের প্রথম লজ্জাভারে মন্থর বনমৃগীর মত অদূরের লতাগৃহের শ্যামলতার দিকে লক্ষ্য রেখে সতৃষ্ণ নয়নে এগিয়ে যেতে থাকে লোপামুদ্রা। কিন্তু আর বেশী দূর এগিয়ে যেতে পারে না। নবোদ্‌গত কিশলয়ে সমাকীর্ণ কোবিদারের বীথিকার অন্তরালে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। অভিসারভীরু দুরাকাঙ্ক্ষিণীর মত গোপন নেপথ্যে দাঁড়িয়ে তরুণ তপস্বীর তপনীয়োপম তনুর অনুপম শুচিশোভাসুধা পান করতে থাকে লোপামুদ্রার বিস্ময়বিমুগ্ধ নয়নের কৌতূহল।

অগস্ত্য! নিঃস্ব রিক্ত চীরবাসসম্বল ঋষি অগস্ত্য। বিশ্বাস হয় না, জগতে দুর্লভতম কোন রত্নের জন্য কোন লোভ ঐ দু’টি দ্যুতিময় চক্ষুর ভিতরে লুকিয়ে থাকতে পারে। মনে হয়, ঐ রূপমানের পায়ের স্পর্শ পেলে রত্ন হয়ে যাবে তুচ্ছ যত ধূলির কণিকা। তবে প্রার্থীর মত কেন এসে দাঁড়িয়েছেন অগস্ত্য?

—তুমিই তো নিখিল রোদসীর রূপরুচির হৃদয়ের পর প্রার্থনীয় রত্ন, তবে তুমি কেন এসে দাঁড়িয়েছ প্রার্থীর মত? কোবিদারকর্ণিকায় আসক্ত ষট্পদের ধ্বনি নয়, নিজেরই পিপাসিত চিত্তের গুঞ্জন শুনতে পেয়ে স্ফুটনোন্মুখ শতপত্রের মত সুস্মিত হয়ে ওঠে লোপামুদ্রার মুখশোভা।

মনে হয় লোপামুদ্রার, ঐ তো তার অন্তরনিভৃতের সেই স্ফটিককুট্টিমের সেই উৎসবের প্রদীপ, লতাগৃহের শ্যামলতার পাশে প্রভাময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন বলে, যাও বিদর্ভতনয়া লোপা, সকল সংকোচ পরিহার ক’রে একেবারে তার দুই চক্ষুর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াও, আর মন্দিরদাসী নর্তকীর মত নৃত্যভঙ্গে সকল আভরণ শিঞ্জিত ক’রে বন্দনা জানিয়ে ফিরে এস।

কিন্তু অসম্ভব, অসাধ্য এবং উচিতও নয়। নিজের মনের এই লজ্জাহীন দুঃসাহসকে নিজেই ভ্রূকুটি হেনে স্তব্ধ ক’রে দেয় লোপামুদ্রা। দেখে বুঝতে পারে লোপামুদ্রা, না ডাকলে ঐ মূর্তির কাছে আপনা হতেই এগিয়ে যাওয়া যায় না। আর, এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেও বোধ হয় কোন লাভ নেই। অতি খরপ্রভ অতি অচঞ্চল, আর অতি অবিকার ঐ তরুণ তপস্বীর দু’টি চক্ষু। ঐ চক্ষুতে কোন স্বপ্ন নেই, আছে শুধু সংকল্প। কে জানে কিসের সংকল্প!

 

 

ফিরে যায় লোপামুদ্রা। কোবিদার-বীথিকার ছায়া পার হয়ে, নীরব ও নির্জন স্ফটিককুট্টিমের নিভৃতে আবার এসে দাঁড়ায়। দুঃসহ এক আত্মকুণ্ঠার বেদনা সহ্য করতে চেষ্টা করে লোপামুদ্রা, কিন্তু পারে না। নিরোধ করতে পারে না উদ্‌গত অশ্রুর ধারা। বুঝতে পারে লোপামুদ্রা জীবনে সে এই প্রথম এক প্রিয়দর্শনের মুখ দেখতে পেয়েছে, আর মনে মনে হৃদয় দান ক’রে চলে এসেছে। কিন্তু এ যেন নীলাকাশের বক্ষ লক্ষ্য ক’রে ক্ষুদ্র দু’টি বাহুর আলিঙ্গনস্পৃহা। চুম্বনরসে বারিধির প্রাণ সিক্ত করার জন্য ক্ষুদ্র দু’টি অধরের শিহরণ। অলভ্যকে লাভ করার জন্য অক্ষমের বাসনাবিলাস! প্রার্থী ঋষি তাঁর প্রার্থিতব্য কয়েক মুষ্টি রত্ন লাভ ক’রে চলে যাবেন এবং কল্পনাও করতে পারবেন না যে, তাঁরই প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী এক মণিনূপুরিতা নারী আজ অশ্রুসিক্ত হয়ে এই সংসারের এক নিভৃতে করকাহত শস্যমঞ্জরীর মত পড়ে রয়েছে।

কি চিন্তা করছেন বিদর্ভরাজ? ঋষি অগস্ত্যের প্রার্থনা কি তিনি পূর্ণ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন? শান্তভাবে চিন্তা করতে করতে লোপামুদ্রা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। সকল কৌতুহল মথিত ক’রে শুধু একটি প্রশ্ন তার অন্তরে মুখর হয়ে ওঠে। কি বস্তু প্রার্থনা করলেন ঋষি অগস্ত্য? দ্রুতপদে অন্তঃপুরের দিকে চলে যায় লোপামুদ্রা।

কক্ষের দ্বারপ্রান্তের নিকটে এসেই হঠাৎ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে লোপামুদ্রা। শুনতে পায় লোপামুদ্রা, শোকাক্রান্ত স্বরে আলাপ করছেন পিতা ও মাতা।

আর্তনাদ করেন বিদর্ভরাজমহিষী—না, কখনই না, আমার সুখলালিতা রত্নময়ী কন্যাকে নিঃস্ব রিক্ত চীরবাসসম্বল ঋষির হস্তে সম্প্রদান করতে পারব না। প্রত্যাখ্যান কর লুব্ধ ঋষির প্রস্তাব।

বেদনাবিচলিত স্বরে উত্তর দান করেন বিদর্ভরাজ—উপায় নেই, অগস্ত্যের কাছে আমি অঙ্গীকারে আবদ্ধ।

—কিসের অঙ্গীকার?

—বলেছিলাম অগস্ত্যকে, যদি কোনদিন গাৰ্হস্থ্যব্রত গ্রহণে অভিলাষী হন তপস্বী অগস্ত্য, তবে আমি আমারই কন্যাকে তাঁর কাছে সম্প্রদান করব।

ধিক্কার দিয়ে আবার বেদনামূর্ছিত স্বরে বিদভরাজমহিষী বলেন—গৃহী হোক তপস্বী অগস্ত্য, এবং তার জীবনসঙ্গিনী তোক অন্য কারও কন্যা। রিক্তের ও নিঃস্বের গৃহজীবনের সকল ক্লেশ ও দুঃখের সহভাগিনী হবে দীনসাধারণের কন্যা, আমার ঐশ্বর্যসুখিনী কন্যা লোপামুদ্রা নয়।

 

 

বিদর্ভরাজ বলেন—কিন্তু তুমি আমার সেই প্রতিশ্রুতির সব ইতিহাস জান না মহিষী। তোমার কন্যা লোপামুদ্রা যে ঋষি অগস্ত্যেরই কল্পনার সৃষ্টি।

—একথার অর্থ?

—মনে আছে কি মহিষী, অনপত্য জীবনের শূন্যতা ও বেদনা হতে মুক্ত হবার জন্য সন্তান লাভের কামনায় একদিন আমি ব্রত পালন করেছিলাম?

—হ্যাঁ, মনে আছে।

—ব্রত সাঙ্গ ক’রে গঙ্গাদ্বারে গিয়ে নির্ঝরস্নান সমাপনের পর বিস্মিত হয়ে দেখেছিলাম, এক কিশোর তপস্বী সেই প্রভাতের নবতপনের আলোকে আশ্ৰমতরুর পুষ্পিত শাখা স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে, আর যেন স্বপ্নস্নাত দৃষ্টি তুলে খগ মৃগ মধুপের খেলা দেখছে।

—কে সেই তপস্বী?

—এই অগস্ত্য। ‘গৃহী হও কুমার, প্রিয়াসেবিত হয়ে পুত্রলাভ কর, তবেই আমাদের অন্তরাত্মা পরিতৃপ্ত হবে।’ পিতৃগণের এই অনুরোধ স্বপ্নে শুনতে পেয়েছিল অগস্ত্য। ব্রত সমাপন ক’রে এবং নির্ঝরস্নানে পরিশুদ্ধ হয়ে সে প্রভাতে আশ্রমতরুর পুষ্পিত শাখা স্পর্শ ক’রে জীবন-সঙ্গিনীর আবির্ভাব কামনা করেছিল সেই কিশোর তপস্বী। চরাচরের সকল প্রাণের দেহশোভা হতে রূপ আহরণ ক’রে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হোক এক সকললোচনমনোহরা নারী। ভ্রমরের কৃষ্ণতা নিয়ে রচিত হোক তার দু’টি চক্ষু। মরালীর মৃদুল রম্যগতি, বনমৃগীর আয়ত নয়ন, জ্যোৎস্নাজীবিনী চকোরীর কোমল তনু, আর মেঘসন্দর্শনে স্খলিতবৰ্হ প্রচলাকীর নৃত্যভঙ্গিমা নিয়ে সুন্দরী শোভনা ও সুরুচিরা হয়ে উঠক সেই বরনারী। কিশোর তপস্বীর সেই কল্পনার পরিচয় পেয়ে ধন্য ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আমার সন্তানকামনা সফল করবার জন্য সেই ঋষির ভাষায় যেন মন্ত্রবাণী উচ্চারিত হয়ে উঠেছে। প্রার্থনা করেছিলাম, কিশোর তপস্বীর কল্পনা আমারই তনয়ারূপে আবির্ভূত হোক। কিশোর তপস্বী অগস্ত্যকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, যদি অনপত্য বিদর্ভরাজ কন্যালাভ করে, তবে সেই কন্যা অগস্ত্যেরই জীবনসঙ্গিনী হবে।

বিদর্ভরাজের ভাবাকুল কণ্ঠস্বরও আবার হঠাৎ বেদনাঘাতে বিচলিত হয়ে ওঠে— ঋষি অগস্ত্যের কল্পনা সত্য হয়েছে মহিষী, নিখিলের সকল প্রাণের দেহশোভা যেন রূপসার উপহার দিয়ে রূপোত্তমা লোপামুদ্রাকে নির্মাণ করেছে। ঋষি অগস্ত্যের আকাঙ্ক্ষিতা, ঋষি অগস্ত্যের কল্পনার পুষ্প, ঋষি অগস্ত্যের কামনাভাগিনী লোপামুদ্রাকে ঋষি অগস্ত্যেরই কাছে সম্প্রদানের জন্য প্রস্তুত হও মহিষী। আপত্তি করবার অধিকার আমাদের নেই।

 

 

ক্রন্দন করেন মহিষী—কিন্তু তোমার রত্নপ্রাসাদে লালিতা লোপামুদ্রা কি ঐ নিঃস্বের জীবনসঙ্গিনী হতে চাইবে?

কক্ষে প্রবেশ করে লোপা। বিদর্ভরাজ ও তাঁর মহিষীকে বিস্ময়ান্বিত ক’রে লোপা বলে—প্রতিশ্রুতি পালন করুন, পিতা।

বিদর্ভরাজ বলেন—তুমি জান, কিসের প্রতিশ্রুতি?

লোপামুদ্রা—হ্যাঁ, সবই শুনেছি পিতা, ঋষি অগস্ত্যের কাছে আপনার প্রতিশ্রুতি।

বিদর্ভরাজ—নিঃস্ব ঋষির জীবনসঙ্গিনী হবে তুমি?

লোপামুদ্রা বলে—হ্যাঁ, পিতা।

সম্প্রদত্তা লোপামুদ্রার আনন্দদীপ্ত আননের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হন বিদর্ভরাজ। বিস্মিত হন বিদর্ভরাজমহিষী। বিস্মিত হয় ধাত্রেয়িকা আর কিংকরীর দল। নিঃস্ব ঋষির বধূ হয়ে, এই রত্নময় প্রাসাদের স্নেহ হতে বঞ্চিত হয়ে এক পর্ণকুটীরের অভিমুখে এখনি চলে যাবে যে রত্নসুখিনী কন্যা, তার মুখের হাসি দেখে মনে হয়, যেন এক আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নলোকের আশ্রয় লাভের জন্য সে কন্যা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেন এক বিদ্যুল্লতা সূক্ষ্ম অংশুকবসনে সজ্জিত, মণিনূপুরে ঝংকৃত, কুঙ্কুমে রঞ্জিত আর সিতচন্দনে সুরভিত হয়ে পতিগৃহে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।

লতাগৃহের নিকটে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন ঋষি অগস্ত্য। বিদর্ভভবনের অশ্রুসিক্ত বেদনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লোপামুদ্রা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঋষি অগস্ত্যের সম্মুখে দাঁড়ায়। প্রণাম করে লোপা, সুস্বরে শিঞ্জিত হয় রত্নাভরণ, যেন এক সঙ্গীতঝংকার এসে মূর্তিমতী হয়ে অগস্ত্যের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে।

অগস্ত্য ডাকেন—লোপামুদ্রা!

সুস্মিত অধরপুটে সুষমা বিকশিত ক’রে অগস্ত্যের মুখের দিকে তাকায় লোপামুদ্রা। কিন্তু চমকে ওঠে, বিষণ্ণ আর বিস্মিত হয়। আকাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে আছেন অগস্ত্য, কিন্তু কই, ঋষির ঐ চক্ষুতে প্রণয়স্মিত কোন আনন্দ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না কেন? সেই খরপ্রভ শান্ত ও নির্বিকার দুটি চক্ষু, যেন পাষাণে রচিত দু’টি সুগঠিত অধর।

অগস্ত্য বলেন—সূক্ষ্ম অংশুকবসন মণিকণিকা আর রত্নজালে দেহ বিলসিত ক’রে কা’র গৃহজীবনের আনন্দ রচনা করতে চাও নারী?

 

 

লোপা বলে—বিদর্ভরাজতনয়া লোপার জীবনাধিক জীবনসঙ্গীর গৃহজীবন।

অগস্ত্য বলেন—কিন্তু এই আভরণ যে গর্হিত, বিলাসভার। ঋষিবনিতার অঙ্গে এই ধ্বনিমুখর ও মণিময় আভরণ পুণ্যক্ষয়কারী বিলাসসজ্জা মাত্র।

লোপা আর্তস্বরে বলে—বিলাসসজ্জা নয়, ঋষি।

অগস্ত্য—তবে কি?

লোপা—ঋষিরই প্রণয়প্রীতা এক প্রেমিকা নারীর হৃদয়ের উৎসবসজ্জা।

অগস্ত্য বিস্ময় প্রকাশ করেন।—উৎসবসজ্জা? ঋষির জীবনে উৎসবের প্রয়োজন নেই, উৎসববিচক্ষণা রাজতনয়া।

লোপা—প্রয়োজন আছে স্বামী। আপনার জীবনে আপনারই এই প্রণয়ধন্যা নারীর স্মিতহাস্য প্রিয়বচন আর নয়নপ্রীতির প্রয়োজন আছে।

যেন জীবনের এক স্বপ্নভঙ্গ বেদনার বাষ্পাসারে অভিভূত হয় লোপামুদ্রার নয়ন। প্রেমিকের বিশালতৃষ্ণ সুস্মিত চক্ষুর সম্মুখে নয়, এক তপস্বীর খরপ্রভ দু’টি চক্ষুর সম্মুখে লোপামুদ্রা আজ দাঁড়িয়ে আছে, যে তপস্বীর জীবনে জীবনসঙ্গিনীর স্মিতহাস্য আর নয়নপ্রীতির কোন প্রয়োজন নেই।

ব্যথাবিহ্বল স্বরে লোপামুদ্রা বলে—প্রিয়সঙ্গবাসনায় অরণ্যের করেণুকাও পদ্মরেণুভূষিতা হয়ে উৎসব অন্বেষণ করে। তবে, আপনি আপনারই আকাঙ্ক্ষিতার কনককেয়ূর ও কবরীর মণিপ্রভা কেন সহ্য করতে পারবেন না ঋষি?

 

 

অগস্ত্য—আমি জানি রাজতনয়া, তোমার অধরও রত্নাভরণের শিঞ্জন শুনতে পায়, এবং শুনে সুস্মিত হয়।

লোপা—আপনারই অভ্যর্থনার জন্য স্বামী। রত্নাভরণের ঝংকার আর দীপ্তিকে নয়, আমার অনুরাগরঞ্জিত জীবনের স্মিতহাস্যকে রত্নাভরণে সাজিয়ে আপনাকে উপহার দিতে চাই। আমার এই স্বপ্ন ব্যর্থ ক’রে দেবেন না ঋষি।

অগস্ত্য বলেন—ঋষি অগস্ত্যের পুত্রের মাতা হবে তুমি, একমাত্র এই ব্রত গ্রহণ ক’রে আমার একমাত্র সংকল্প সত্য ক’রে তুলবে। এর জন্য তোমার কণ্ঠে রত্নমালিকার শোভা ধারণ করবার প্রয়োজন হয় না। নারীর কুঙ্কুমচিত্রিত চিবুক আর সিতচন্দনসিক্ত তনু চাই না। নারীর স্মিতহাস্য আর নয়নপ্রীতি চাই না। এই বিলাসসজ্জা বর্জন কর, আর চীরবাস বল্কল ও অজিন গ্রহণ ক’রে আমার কাছে এসে দাঁড়াও।

লোপামুদ্রার কণ্ঠে আর্তনাদ শিহরিত হয়—স্বামী!

অগস্ত্য—কি?

লোপমুদ্রা—তুচ্ছ রত্নাভরণ ঘৃণা করুন, কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু, আপনার জীবনের প্রণয়বিহ্বল কোন মধুর ক্ষণে আপনারই জীবনের সুখদুঃখভাগিনী এই নারীর অধরপুটে ধরা একটি ক্ষুদ্র স্মিতহাস্যও কি আপনার প্রয়োজন হবে না ঋষি?

অগস্ত্য—না, কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

অশ্রু গোপন করবার জন্য মুখ ফিরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে লোপামুদ্রা। হ্যাঁ, তার কল্পনার সেই মধুর আতঙ্কের আতঙ্কটুকুই শুধু সত্য হয়েছে, আর মিথ্যা হয়ে গিয়েছে সব মধুরতা। বিদর্ভরাজতনয়ার শুধু এই জীবন্ত দেহ নিয়ে গিয়ে তাঁর আশ্রমের পর্ণকুটীরে একটি সংকল্পের বস্তু ক’রে রাখতে চাইছেন ঋষি। কোথায় গেল সেই কিশোর ঋষির মন, নিখিল প্রাণের রূপ আহরণ ক’রে যে তার জীবনসঙ্গিনীর তনু নির্মাণ করতে চেয়েছিল একদিন? রূপ কামনা করেছিল যে, সে আজ রূপের হাসিটুকুও দেখতে চায় না। প্রেমিকের বিশালতৃষ্ণ ও সুস্মিত দু’টি চক্ষুর সম্মুখে এসে এক দিন ধন্য হবে লোপামুদ্রার জীবনের স্বপ্ন, এই কল্পনা কি ছলনা হয়ে মিলিয়ে গেল চিরকালের মত?

কিন্তু আর চিন্তা করে না, এবং আর বিলম্ব করে না লোপা। খুলে ফেলে সকল রত্নাভরণ, মুছে ফেলে চিবুকের চিত্রিত কুঙ্কুমবিন্দু। বিদর্ভরাজভবনে করুণ বিলাপের রোল বেজে ওঠে। চীরবাস বল্কল আর অজিন ধারণ ক’রে ঋষির সহচরী হয়ে চলে যায় লোপামুদ্রা।

পুণ্যপ্রদা ভাগীরথী যেন নভস্তলে পবনধূত পতাকার মত শোভমান। ভাগীরথীর শীকরনির্ঝর শিখর হতে শিখরান্তরে ঝরে পড়ছে। সলিলধারা যেন নাগবধূর মত শিলাতলের অন্তরালে লুকিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে। গঙ্গাদ্বারের রমণীয় এই শৈলপ্রস্থে অগস্ত্যের আশ্রমে প্রতি প্রভাতে খগ মৃগ মধুপের আনন্দ জাগে। সকলিকা সহকারলতা বায়ুভরে আন্দোলিত হয়। উৎপলকেশরের সুরভিত রেণু গায়ে মেখে গুঞ্জন করে ভৃঙ্গ। শিশিরস্নাত নবীন শাদ্বলে বিম্বিত হয় নবমিহিরের রশ্মিরেখা। গলিত গৈরিকের অলক্তকে রঞ্জিত হয় পুষ্পিত লতাকুঞ্জের পদতলভূমি। সুন্দর হয়ে সেজে ওঠে আশ্রমের তরু লতা ও পল্লব। শুধু অগস্ত্যবধূ লোপা সুন্দর হয়ে সেজে ওঠে না।

যেন বল্কলিতা সৌদামিনী! অগস্ত্যবধূ লোপামুদ্রা শুধু স্বামী-নির্দেশিত গৃহকর্ম ও ব্রত পালন করে। ঋষি অগস্ত্যও তাঁর প্রতিদিনের পূজা ধ্যান ব্রত ও তপশ্চর্যার এক কঠিন শান্ত ও শুচিতানিষ্ঠ জীবন যাপন করেন। সন্ধ্যারাগে অরুণিত আশ্ৰমভূমির উপান্তে বেনুকিশলয় মুখে নিয়ে নর্মবিহ্বল মৃগদম্পতি ছুটাছুটি করে। জ্যোৎস্না যামিনীর কিরণসুধা পান করার জন্য শাল্মলীর কোরক উন্মুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু স্মিতহাস্য অধরদ্যুতি আর নয়নপ্রীতির কোন উৎসব নেই আশ্রমের শুধু দু’টি মানুষের জীবনে, ঋষি অগস্ত্য ও অগস্ত্যবধূ লোপামুদ্রা।

একদিন নির্ঝরসলিলে স্নান সমাপন ক’রে আশ্রমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলেন অগস্ত্য, পুষ্পিত তরুশাখা স্পর্শ ক’রে অপলক নয়নে নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে আছে লোপামুদ্রা। যেন স্বপ্নায়িত ও সুদূরিত এক কামনার দিকে তাকিয়ে নারীর দু’টি ভ্রমরকৃষ্ণ নয়ন মুগ্ধ হয়ে রয়েছে। নিজেরই অন্তরে অদ্ভুত এক চাঞ্চল্য অনুভব করেন কঠোরতাপস অগস্ত্য। মনে পড়ে, একদিন তিনিও এইভাবে পুষ্পিত তরুশাখা স্পর্শ ক’রে জীবনসঙ্গিনীর আবির্ভাব কামনা করেছিলেন। গৃহী হও কুমার, পুত্রলাভ কর কুমার, স্বৰ্গত পিতৃগণের সেই অনুরোধ যেন ঋষি অগস্ত্যের হৃৎপিণ্ডে সুস্বরমধুর কলরোলের মত বেজে ওঠে।

অগস্ত্য ডাকেন—লোপা!

চমকিত হয়ে তাকায় লোপামুদ্রা, কিন্তু শান্তস্বরে প্রত্যুত্তর দেয়—আদেশ করুন।

নিকটে এগিয়ে এসে অগস্ত্য বলেন—আমার ইচ্ছা, তুমি এই তরুশাখার মত বাৎসল্যে পুষ্পিত হও।

লোপা—আপনার ইচ্ছা সত্য হোক।

ব্যথিতভাবে তাকিয়ে ঋষি অগস্ত্য বলেন—এ কেমন আচরণ লোপা? আমার হৃদয়ের এই মধুর অশান্ততার আবেদন শুনে কি এতই শান্তস্বরে উত্তর দিতে হয়? কোন বিস্ময় আর কোন আনন্দ কি আমার এই আহ্বানে নেই?

লোপা—আমি আপনার আদেশের দাসী। আপনার ইচ্ছার কাছে সর্বক্ষণ সমর্পিতা হয়ে আছি। আপনি ব্যথিত হবেন না ঋষি; আদেশের দাসী কখনও বক্ষে বিস্ময় ও নয়নে আনন্দ নিয়ে আপনার কাছে প্রগল্ভা হতে পারে না, সে দুঃসাহস তার নেই।

অগস্ত্য—ভুল করো না লোপা। পুষ্পিত হবার আগ্রহে ব্রততী যেমন বিহ্বল হয়ে সমীরণের উল্লাস আপন বক্ষে গ্রহণ করে, তেমনি তুমিও তোমার ঐ শান্ত অধরপুট স্মিতহাস্যে বিহ্বল ক’রে তোমার স্বামীকে আজ গ্রহণ কর।

লোপামুদ্রা—পারি না ঋষি।

আহত ব্যথিতের মত আর্তনাদ করেন অগস্ত্য—লোপা, সুন্দরদেহিনী লোপা!

লোপা—আপনার সংকল্পে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হয়েই রয়েছে আপনার লোপামুদ্রার সুন্দর দেহ।

অগস্ত্য—এই নিষ্ঠুরতা পরিহার কর অগস্ত্যবাঞ্ছিতা লোপা। শুধু ক্ষণতরে ঐ সুন্দর অধর স্মিতহাস্যে মায়াময় ক’রে অগস্ত্যের শুষ্ক কঠোর ও তপঃক্লিষ্ট জীবনে এই কামনাস্মিত লগ্নের প্রথম সঞ্চার সুতৃপ্ত কর।

লোপা—নারীর তুচ্ছ একটি স্মিতহাস্যের জন্য এত ব্যাকুলতা কেন ঋষি।

অগস্ত্য—জানি না লোপা, শুধু বুঝেছি, আমার বক্ষের নিঃশ্বাস আজ প্রিয়া লোপামুদ্রার ওষ্ঠচ্ছুরিত একটি স্মিতহাস্যের জন্য তৃষ্ণায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে, চৈত্র মলয় যেন কুসুমকুঞ্জের সুরভি পান করার জন্য অকস্মাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে।

লোপা বলে—পারব না ঋষি।

অগস্ত্য—কেন?

লোপা—বল্কলিতাদেহা এই রাজতনয়ার কাছ থেকে স্মিতহাস্য আশা করবেন না।

চমকে ওঠেন অগস্ত্য—তবে?

লোপা—চাই রত্নাভরণ। যদি কনককেয়ূরে স্বর্ণকাঞ্চীদামে আর মণিনূপুরে আমাকে সাজিয়ে দিতে পারেন, তবেই আপনার লোপামুদ্রা স্মিতহাস্যে সুন্দরতরা হয়ে আপনার এই প্রণয়াসঙ্গের আহ্বানে সাড়া দিতে পারবে। যদি না পারেন, তবে লোপামুদ্রা নামে এই নারীকে শুধু পাবেন, কিন্তু সে নারীর অধরের স্মিতহাস্য পাবেন না।

স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন ঋষি অগস্ত্য। তারপর শান্তস্বরে বলেন— রত্নাভরণ এত ভালবাস লোপা?

উত্তর দেয় না লোপামুদ্রা।

কিন্তু, ঋষি অগস্ত্যের মনে আর কোন ক্ষোভ জাগে না। নীরবে শুধু লোপার মুখের দিকে যেন সমদুঃখভাগী বান্ধবের মত ব্যথিত দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন অগস্ত্য। মিথ্যা বলেনি লোপা, নিঃস্ব ঋষির নিরাভরণ গৃহজীবনের ক্লেশ ও রিক্ততা সহ্য করতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে এই সুখাভিলাষিণী সুন্দরী নারীর ঐ শশিকলার মত অধরের চন্দ্রিকা।

অগস্ত্য বলেন—তোমার অভিলষিত রত্নাভরণ পাবে লোপা। প্রতীক্ষা কর। আমি আমার যশ মান এবং তপস্যার পুণ্য ক্ষয় ক’রেও তোমার জন্য রত্নাভরণ সংগ্রহ ক’রে নিয়ে আসছি।

অপরাহ্ণের আকাশ রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। আশ্রমে ফিরে এসেছেন অগস্ত্য। এবং নিয়ে এসেছেন অজস্র রত্নাভরণ।

প্রার্থী হয়ে নৃপ শ্রুতর্বার নিকটে গিয়েছিলেন অগস্ত্য। প্রার্থনা পূর্ণ করেননি শ্রুতর্বা। বিমুখ হয়ে নৃপ ব্ৰধশ্মের ভবনদ্বারে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলেন নৃপ ব্ৰধশ্ম। তারপর প্রত্যাখ্যান করলেন নৃপ ত্রসদস্যু। অবশেষে দানবপতি ইল্বলের নিকট হতে অজস্র রত্ন কাঞ্চন ও মণিযুত আভরণ নিয়ে ফিরে এসেছেন অগস্ত্য। সহাস্যে লোপামুদ্রার দিকে তাকিয়ে বলেন—এই নাও আর সুখী হও লোপা, রত্নাভরণের শিঞ্জন শুনে তোমার অধরদ্যুতি চমকিত হোক। আমি যাই।

লোপা আর্তনাদ করে ওঠে—কোথায় যাবেন স্বামী?

শ্রান্ত ও ক্লান্ত স্বরে, এবং মৃদুহাস্যে যেন তাঁর অন্তরের এক বিষণ্ণ বেদনাকে লুকিয়ে রেখে অগস্ত্য উত্তর দেন—আশ্রমনির্ঝরের তটে, তোমারই রচিত মল্লীবিতানের নিভৃতে, তোমারই প্রতীক্ষায়।

চলে গেলেন ঋষি অগস্ত্য এবং আশ্রমনির্ঝরের নিকটে এসে দাঁড়াতেই বুঝতে পারেন দুর্বহ এক বেদনা যেন তাঁর অন্তরের গভীরে পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। এই মল্লীবিতান লোপামুদ্রারই রচনা। কিন্তু মনে হয়, এই মল্লীবিতানের সৌরভ ও শোভা যেন প্রাণ হারিয়েছে। জীবনের সঙ্গিনীকে প্রণয়োৎসবে আহ্বান করেছেন অগস্ত্য, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় এই মল্লীবিতানের পুষ্পে ও লতায় যখন চন্দ্রলেখার হাস্যজ্যোতি লুটিয়ে পড়বে, তখন তার সম্মুখে উপস্থিত হবে যে নারী, সে নারী শুধু রত্নাভরণ ভালবাসে। নিঃস্ব ঋষির অনুরাগের আহ্বানে নয়, ঋষির দুরায়াসপ্রাপ্ত রত্ন-কাঞ্চনের স্পর্শ পেয়ে সে নারীর অধরজ্যোৎস্না জেগে উঠবে।

যেন বিষন্ন এক তন্দ্রার মধ্যে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন অগস্ত্য, কিন্তু চক্ষু উন্মীলন ক’রেও অসহায় সন্ত্রস্তের মত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। সন্ধ্যাকাশের বুকে ক্ষীণ হিমকররেখা হেসে উঠেছে। লোপার আসবার সময় হয়েছে। মিলনলগ্নের ইঙ্গিত জানিয়ে উড়ে বেড়ায় মল্লীবিতানের প্রজাপতি।

কিন্তু কল্পনা করতেই অন্তরের গভীরে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের দংশন অনুভব করেন অগস্ত্য। যেন তাঁর প্রণয়োৎসুক জীবনের অপমান রত্নাভরণে ঝংকৃত হয়ে তাঁর বক্ষের দিকে এগিয়ে আসছে। আসছে এক রত্নপ্রেমিকা নারী। কি মূল্য আছে ঐ স্মিতহাস্যের? সে হাসি তো লোপা নামে প্রেমিকার মুখের হাসি নয়, এক রত্নশিলার হাসি।

কিন্তু কে এই নারী? অকস্মাৎ চমকে উঠলেন অগস্ত্য এবং দেখলেন, যেন সুধারসে তরঙ্গিত নয়ন, মদাবেশবিহ্বলা এক নারী অনাবরণ অঙ্গশোভার জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত হয়ে তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বর্ণমঞ্জীর নেই, রত্নমেখলা নেই। নেই কনককেয়েূর আর ইন্দ্রনীলমণিহার।

বিস্মিত অগস্ত্য প্রশ্ন করেন—কে তুমি?

নারী বলে—চেয়ে দেখ কে আমি।

দেখতে পান অগস্ত্য, যেন স্নিগ্ধ চন্দ্রাংশুবিস্পর্ধী এক স্মিতহাস্যজ্যোতি শরীরিণী হয়ে, সকল কান্তি কল্লোলিত ক’রে, আর উচ্ছল যৌবনসম্ভার শুধু একটি বল্কলে বলয়িত ক’রে তাঁরই বক্ষোলগ্ন হবার কামনায় নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে।

অগস্ত্যের কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ধ্বনিত হয়—তুমি লোপামুদ্রা!

—হ্যাঁ, আমি তোমারই বল্কল উপহারে ধন্যা লোপামুদ্রা।

—কই তোমার রত্নাভরণ?

—পড়ে আছে তোমার পর্ণকুটীরের দ্বারে।

—কেন?

—আমি রত্নপ্রেমিকা নই ঋষি।

বিস্ময়বিহ্বল নেত্রে তাকিয়ে থাকেন অগস্ত্য। লোপা বলে—আমার ওষ্ঠপুটের স্মিতহাস্য দেখবার জন্য যে ঋষির হৃদয় আজ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, আমি তাঁরই প্রেমিকা। এতদিন সেই প্রেমিকের প্রতীক্ষায় ছিলাম। আজ পেয়েছি তাঁর হৃদয়, এবং তাঁর সেই হৃদয়ই হলো ঋষিবধূ লোপার জীবনের একমাত্র অলংকার।

অগস্ত্য ডাকেন—প্রিয়া লোপা!

দেখতে পায় লোপা, এক প্রেমিকের বিশালতৃষ্ণ ও সুস্মিত দু’টি চক্ষু তাকে আহ্বান করছে।


© 2024 পুরনো বই