১৫. ভোট হাঁকতে হাঁকতে সেই মিছিলটা

দাশুর মুখটাকে ওভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করে কেন দুখনবাবু?

কোদাল নেবার জন্য টেস্ট রিলিফের অফিস ঘরের একচালার কাছে দাশু এসে দাঁড়াতেই দুখনবাবুর চোখ দুটো কুঁচকে যায়। দাশুও যেন ভীরুর মত চমকে ওঠে আর মুখ ঘুরিয়ে। নেয়। কোদাল হাতে তুলে নিয়েই একটা দৌড় দিয়ে মাটিকাটা লাইনের দিকে চলে যায়।

মাটিকাটা ভিখমজুরদের দলের সঙ্গে নয়; একেবারে একলা হয়ে একটা টিলার পাশে কিংবা গড়হার ভিতরে নেমে মাটি কাটে দাশু। মাটি কাটতে কাটতে হঠাৎ আনমনা হয়ে যায়। দম টেনে নিয়ে নিজেরই বুকটার দিকে তাকায়। কোদাল ছেড়ে দিয়ে হাতের মুঠো দুটোকে চোখের সামনে তুলে নিয়ে দেখতে থাকে। হাতের মুঠোর উপর ফুঁ দেয়।

হাঁটু দুটোও অদ্ভুতভাবে কাঁপছে। ভয়ানক একটা রহস্য যেন দাশু কিষাণের রক্তমাংসের ভিতরে কিলবিল করছে। বিড় বিড় করে দাশুর ধুলোমাখা ঠোঁট দুটো–দা কিষাণের লেগে তোমার মনে আবার কোন্ দয়া ডাক দিলে গো কপালবাবা?

ধুলোর উপর শরীরটাকে লুটিয়ে দিয়ে বসে পড়ে দাশু। সত্যিই, যেন জঙ্গলের পাপিয়ার এত বিকট খুশির আবেগে ধূলিনি করে শরীর জুড়োতে চায় দাশু। মুঠো মুঠো ধুলো তুলে নিয়ে হাতে পায়ে ও হাঁটুর উপর, এমন কি মুখের উপরেও ছড়িয়ে দিতে থাকে।

সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত শরীরটাকে এই রকম বুলোমাখা করে যেন একটা প্রচণ্ড ছদ্মবেশ ধরে, নিজেরই চোখের সন্দেহম চাহনির কাছ থেকে নিজের চেহারাটাকে লুকিয়ে রেখে রোই কাজ করে যার দাশু।

গুনগড়ার শুকনো খটখটে আকাশে যেদিন ভাঙা-ভাঙা কালো মেঘের টুকরো ভেসে চলে গেল, সেদিন সন্ধ্যা হবার আগেই কোদাল থামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাও। আজ তো রোদের তেমন তেজ নেই, মেঘের ছায়াও ডাঙার উপর দিয়ে বার বার গড়িয়ে গিয়েছে, তবে পিঠের আর বুকের উপর অদ্ভুত একটা জ্বালা চনচন করে কেন?

কী আশ্চর্য, এই জালার সঙ্গে গা-ঢাকা দিয়ে দুঃসহ একটা পিপাসাও ছটফট করছে। দাশুর গতরের হাড়মাস যেন আর একলা হয়ে থাকা এই শূন্যতা সহ্য করতে চায় না। বুকটা মত্ত হয়ে একটা কোমলতর স্বাদ জড়িয়ে ধরতে চায়। মাটিকাটা লাইন থেকে হঠাৎ ছুটে চলে এসে, কোদাল জমা দিয়ে, শুধু আধা রোজের মজুরী নিয়ে ঘরে ফিরে যায় দাও।

দাশুর ঘর; তিন হাত উঁচু মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা অন্ধকার। দাশুর পাথুরে গতরটা যেন জ্বালাহরণ ছোঁয়ার লোভে লোভী হয়ে মেজের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিতে থাকে।

আঃ, কত ঠাণ্ডা এই ঘরের মাটি! দাশুর পিঠের আর বুকের জ্বালাটাকে একটা কনকনে ঠাণ্ডা আদরের ছোঁয়া বার বার জড়িয়ে ধরেছে। এই ঘরের মাটি এত ঠাণ্ডা হয়ে গেল কবে?

মাটিকাটা মেহনতের শরীরটার ক্লান্তিও ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকলেও দাশুর বুকের ভিতরে একটা ভীরু ভাবা দূরদূর করে। দাশুর হাতের শক্ত মুঠো ভেঙে দিয়ে কে যেন কোদাল কেড়ে নিতে চাইছে। থাম দাশু থাম, আর তোমার মেহনতে কাজ নাই।না না; এমন কথা বলো না, আমার হাতের কোদাল ছিনে নিও না, হে। আমি যে…।

ঘরের দরজার কাছে কে যেন খকখক করে কাশছে। চমকে ওঠে, চোখ মেলে দরজার দিকে তাকায় দাশু।

-কে বটে হে! চেঁচিয়ে ওঠে দাও।

-তুমি কি কবরের ভূত বটে হে? মাটিতে মুখ থুয়ে একা-একা কথা বল কেন? আগন্তুক লোকটা কড়া মেজাজের আওয়াজ তুলে ঘরের ভিতরে উঁকি দেয়।

উঠে বসে দাও। লোকটার দিকে ভাল করে তাকাতে গিয়ে আরও আশ্চর্য হয়ে যায়। লোকটার গায়ে কালো রঙের মোটা কাপড়ের জামা। জামার পকেট দুটো কাগজপত্রের ভারে ভারি হয়ে ঝুলছে। লোকটার কানে একটা পেনসিল গোঁজা।

পকেটের ভিতর থেকে একটা রসিদবই বের করে লোকটা বলে-তোমার নি বছরের চৌকিদারী খাজনা বাকি পড়েছে সরদার।

দাশুর স্তব্ধ চেহারার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে আর দুবার কেশে নিয়ে লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে!–দাও হে, তাড়াতাড়ি কর।

দাশু–কি দিব?

-খাজনার টাকা।

–টাকা নাই।

-তবে যে লুটিস হবে হে সরদার?

–হবে তো হবে।

–তোমার ঘরের চিজ-মাল যে তবে নীলামে চড়বে।

হেসে ফেলে দাশু–তাতে ডর নাই।

ভ্রূকুটি করে লোকটা।–ডর নাই কেন? ঘরে চিজ-মাল নাই বুঝি?

দাশু–একটা টাঙ্গি আছে।

লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে।–তাতে বোর্ডের কাছারি ডরবে না। তোমার ঘর ভেঙে, ছাপরের বাঁশ খাপরা আর খুঁটা টেনে নিয়ে…আর তোমার এ শালার পচা কাঠের দরজার চৌকাঠ আর কপাট খুলে নিয়ে…।

কাশতে থাকে লোকটা। কাশছে একটা প্রচণ্ড বিদ্রুপ। দাশুর চোখের ফ্যালফেলে চাহনি থরথর করে কাঁপতে শুরু করে।

লোকটা বলে—সব নীলাম হয়ে যাবে হে সরদার। ঘরের মজা আর নিতে হবে না।

–বড় ভাল কথা বলেছ গো বাবু। বলতে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। চোয়াল দুটো চড়চড় করে বেজে ওঠে। দাশুর মুখটাও অদ্ভুত রকমের কুৎসিত হয়ে হেসে ফেলে।

লোকটা আশ্চর্য হয়।–তুমি রাগ করে হাসছ মনে হয়?

দাশু–না, একটুকও রাগি নাই।

–নিশ্চয় রেগেছ।…সে ত হল…কিন্তু…আমি বলি।

–বল।

-জল খেতে আমাকে একটা টাকা দিয়ে দাও ব্য, তবে আর তোমার কোন ভাবনা নাই। আমি বন্দোবস্ত করে দিব, লুটিস হবে না। আরও এক সাল খাজনা না শুধে..।

-না। এক পয়সা দিব না। লোকটার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকায় দাশু।

লোকটা দু’পা পিছনে সরে গিয়ে পাল্টা জটি করে—আমাকে ডাঁটলে তুমি?

–দাশু–তুমি যাও।

রসিদ বই পকেটে পুরে নিয়ে লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে–আমাকে যাওয়ালে তুমিও যে যাবে।

দাশু—যাব।

–ঘরছাড়া বেইদা হতে হবে যে!

বেইদা হতে হবে? বাঃ, টিহাটিহাটিহা! কিন্তু না, সত্যিই মধুকুপির বিকালের আলোতে গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে কোন পাপিয়া ডেকে ওঠে নি। দাশু কিষাণের বুকের ভিতরে একটা অদ্ভুত অনুভবের শব্দ বেজে উঠেছে।

দেখতে পায় না দাশু, লোকটা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, আর, কখন্ চলে গেল। দাশুর চোখ দুটো অপলক হয়ে সামনের সড়কের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিকালের হাওয়া লেগে নিমগাছের পাতা দুলছে। দুলছে বাঁশঝাড়ের ছায়াটা।

দাশুর বুকের ভিতরেও একটা মিষ্টি বাতাস দুলছে। সেই বাতাসে ফিসফিস করে কথা বলছে একটা মুক্তির সুখ। সব গো, সব গেল। আর কোন বাধা নেই। মুরলী আর আসবে না, জমিও হবে না! এইবার ঘরও গেল। এইবার একটা অঘরা বেদে হয়ে যেতে হবে। তবে তুই এখন আয় না কেন সকালী!

সকাল সকালী! দাশুর বুকের ভিতরে যেন সকালীর উপোৰী ইচ্ছার একটা ছবি হেসেকেঁদে ছটফট করছে-তুমি কি আমাকে ভুলেই গেছ গো সরদার? নয়তো এতদিনের মধ্যে আমার কথা একবারও মনে পড়ে নাই কেন? জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এসে আমার মোয়া মুখে নিবে, সে সাধও কি নাশ হয়ে গিয়েছে?

না ভুলি নাই, ভুলবো কেন? কিন্তু আসবে কি সকালী? বড়কালুর মাথা ঘেঁষে সূর্য ড়ুবতে শুরু করছে। ঘরের দাওয়ার উপর চুপ করে বসে, যেন একটা আশার পাপিয়ার মিষ্টি ডাকের শব্দ শুনতে থাকে দাশু। বুকের ভিতরে একটা পুরনো অনুভবের স্বাদ মত্ত হয়ে উথলে উঠছে। শরীরের সব হামাস কী ভয়ানক ক্ষুধাতুর হয়ে ছটফট করছে।

সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। ঘরের ভিতরে ঢুকে, একবার উনানটার দিকে, আর, একবার মাটির সরার ভিতরে রাখা পাঁচ মুঠো মকাইয়ের দানার দিকে তাকায় দাশু। তারপর চুপ করে বসে থাকে।

কিন্তু দরজার কপাটের উপর ঠকঠক করে দুটো কঠোর শব্দের ঠোকর যেন আছড়ে পড়লো। চমকে ওঠে দাশু। একটা শব্দ যেন প্রচণ্ড এক আহ্বাদের বন্দুকের কুঁদোর আঘাতের শব্দ। আর একটা হলো, ছোট লাঠির আঘাতের শব্দ। দুটো ভিন্ন ভিন্ন গলার দু’রকম স্বরের হাঁকও শোনা যায়।

–দাশু দাগী ঘরে আছ? ঘড়ঘড়ে গলার স্বর।

–বাইরে এসো হে দাশু। মিনমিনে গলার স্বর।

জামকাঠের নড়বড়ে দরজার কপাট খুলে দিয়ে চৌকাঠে কাছে দাঁড়িয়ে থাকে দাও। রাতের পাখি ডাকছে, আকাশে অনেক তারাও ফুটেছে। গাঁয়ের আঁধার কুয়াশার সঙ্গে জড়াজড়ি শুরু করেছে। তবু বেশ ভাল করে দেখতে পায় দাশু, ছায়াময় একটা টাট্ট ঘোড়ার চেহারা দাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দাওর ঘরের একটা খুটিকে কামড় দিয়ে ধরে লেজ নাড়ছে। আর, দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ মুলী চৌধুরীজী ও রামাই দিগোয়ার।

চৌধুবীর পা টলছে। তবু রামাই-এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ঘড়ঘড়ে গলার স্বর যেন একটা ল গর্জন বমি করে চৌধুরী-কই, কই রে গাধার নাতি, বোতলটা কই রে?

–এই যে হুজুর! রামাই দিগোয়ারও ব্যস্ত ভাবে টলতে টলতে চেীধুরীর হাতের কাছে একটা বোতল এগিয়ে দেয়।

চৌধুরী-এঃ, তুই শালা নেশার কুম্ভীর বটে রে রামাই। কিছু আর রাখিস নাই মনে হয়।

রামাই–না জুর, বাপ কসম হুজুর, আমি শুধু বোতলের গলাটুকু নিয়েছি।

চৌধুরী ঘড়ঘড় করে হেসে আকুল হয়ে ওঠে।-মিছা বাপ বেচারার নামে কসম করিস কেন রামাই? কসম যদি করিস তবে…।

রামাই-বলেন হুজুর।

-চৌধুরী-তোর ঘরওয়ালীর যৈবনের নামে কসম কর না কেন?

মিনমিনে গলার স্বর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে রামাই-ঘরওয়ালীর যৈবনের কসম হুজুর, আমি বোতলের শুধু গলাটুকু নিয়েছি।

চৌধুরী খুশী হয়ে হাসে-বেশ; তোকে আর তবে গাধাকে নাতি বলবো না রামাই, তুই হলি রয়াল টাইগারের নাতি।

রামাই হাসে—এইবার দাশুকে কথাটা বলে দিয়ে…।

চৌধুরী–হ্যাঁ, এই দাশু দাগী, তুই আমাকে আজও এক পয়সা পুরবী দিস নাই; থানাতে হাজিরা দিস নাই। কিন্তু…সে জন্য ভাবিস না, কোন ডর নাই।

বোতলের সরাব হাঁ-করা মুখের ভিতরে ঢালতে থাকে চৌধুরী। বগবগ শব্দ করে সরাবের ধারা ঝড়ে পড়ে। একটা সেঁকুর তুলে নিয়ে চৌধুরী বলে-হা…তোকে আর টেস রিলিফে খাটতে হবে না দাও। আমি তোর ভাল রোজগারের কাজ বন্দোবস্ত করে দিব। বল, রাজি আছিস?

দাশু–ভাল রোজগারের কাজ?

চৌধুরী–হ্যাঁ, গোবিন্দপুরের পাঁচু দাগীকে বলেছি। ওর পার্টিতে তোকে ভর্তি করে নিবে পাঁচু।

চমকে ওঠে দাশু–সেটা কেমন কাজ বটে?

চৌধুরী হাসে-বাবুরবাজারের চকে রাতের বেলা যে মালের গাড়িগুলা থাকে, সেগুলার উপর একটু এথি-ওথি করতে হবে। একটা বস্তা চিনি সরাতে পারলেই তো দশটা টাকার হিস্যা হয়ে গেল। ভাবিস কেন?

হঠাৎ যেন বোবাও হয়ে যায় আর মরা গাছের ধড়ের মত নিথর হয়ে যায় দাশু। চৌধুরী বলে–হা…কিন্তু..মাগিটাকে আমার চাই।

কা’কে চাই? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

চৌধুরী–খবরদার, অমন করে চেঁচাবে না। আস্তে কথা বল।…হ্যাঁ, বেদেনী মাগিটাকে তুমি যখন রাখতে চাও, তখন রাখ। কিন্তু, আমি এসে ওকে মাঝে মাঝে গোবিন্দপুরে নিয়ে যাব। না হয় তো, মাঝে মাঝে একটা-দুটো রাত তোমার এখানেই থেকে…।

রামাই বলে–এ কথা আবার দাশুকে শুধান কেন হুজুর? এতে দাশুর কি কোন অসাধ আছে? হ্যাঁ কিনা দাশু?

একটা পাপিয়ার আর্তনাদ যেন দাশুর বুকের ভিতরে মাথা খুঁড়ে ছটফট করছে। কাঁদতে থাকে দাশু। জবাব দেয় না দাশু।

রামাইয়ের গলার স্বরে আবার মিনমিনে হাসির শব্দ উছলে ওঠে-আমরা সব খবর রাখি দাশু। বেদেনী সকালী তোমাকে বড় পিয়ার করে। অর্জুন সিং বলে, গোকুল সামন্ত বলে, তোমাকে মোয়া খাওয়াবার আশা নিয়ে মাগিটা গোবিন্দপুরের জেল ফটকের কাছে গিয়ে বসে থাকে।

চৌধুরী হাসে—এখন আর জেল ফটকের কাছে যায় না মাগি। সে খবর জেনেছে মাগি, দাশু ছাড়া পেয়েছে।

রামাই-কিন্তু ভাল চালাক বটে মাগিটা। পাঁচ গাঁ ঠুঁড়েও ওর কোন খোঁজ পাওয়া গেল।

চৌধুরী কিন্তু, কতদিন ছিপে থাকবে মাগি? নাগরের কাছে না এসে পারবে কেন?

রামাই-হ্যাঁ, সেই কথা দাশুকে বুঝিয়ে দেন হুজুর। যখনই মাগি আসবে, তখনই যেন ফাঁড়িতে আমার কাছে খবর দিতে ভুলে না যায় দাশু।

চৌধুরীর হাতের বন্দুকটা দুলে ওঠে। ইস, আর ভুল করলে শালা যে মরবে। তা হলে আমিও আবার ওকে তিন বছরের মেয়াদে জেলের ভাত খেতে রওনা করিয়ে দিব।

টাট্ট ঘোড়াটা মাড়ির মাংস’ উঁচিয়ে আর বড় বড় দাঁত দিয়ে চালার খুঁটো শক্ত করে কামড়ে ধরে বিচিত্র এক খুশির আবেগে চাটু ছুঁড়তে থাকে। চৌধুরী বলে-হা, তবে এই কথা, একেবারে পাকা কথা হয়ে গেল দাশু।

টলতে টলতে এগিয়ে যেয়ে টাট্টুর কাছে এসে, টাট্রর পিঠের জিনের উপর একটা চাপড় মেরে রেকাবে পা দেয় চৌধুরী। একটা লাফ দিয়ে টলমলে চেহারাটাকে টাট্টুর পিঠের উপর চড়িয়ে দিয়ে হাঁক দেয়—চল রামাই।

টাট্টুর গলার লাগাম-দড়ি হাতে তুলে নিয়ে রামাই দিগোয়ার দু পা এগিয়ে যায়।–চলেন হুজুর।

দাশুর কানের দু পাশ দিয়ে ঠাণ্ডা ঘামের ধারা ঝরে পড়তে থাকে। কিন্তু মুখ টিপে যেন একটা চাপা উল্লাসের হাসি হাসতে থাকে দাও। কোন ডর নাই সকালী; তোর বেদে হয়ে তোর সাথে যদি চলে যাব, গোবিন্দপুর থানার পিশাচটা তবে আর আমাদের পাত্তা পাবে কেন? সকালী তুই আয়।

–ও কি? ও কি? তোমার মুখে এসব কেমন দাগের চক্কর বটে দাশু? বলতে বলতে একটা লাফ দিয়ে উঠে এসে দাশুর সামনে আর দাশুর মুখের দিকে তীব্র একটা সন্দেহের আঙুল তুলে তাকিয়ে থাকে দুখনবাবু।

–কি বটে দুখনবাবু? ভয়ানক শূন্য ও উদাস এক জোড়া চোখের চাহনি তুলে দুখনবাবুর সন্দিগ্ধ চোখের চাহনির সামনে ভীরু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু।

চেঁচিয়ে ওঠে দুখনবাবু-গরলের দাগ বটে কি?

–না, না, দুখনবাবু। এত মিছা কথা বল কেন দুখনবাবু? তোমার চোখে গরল আছে বুঝি। বলতে বলতে একটা লাফ দিয়ে সরে যায় দাশু, আর কোদাল কাঁধে নিয়ে ছুটতে ছুটতে মাটিকাটা একটা গড়হার ভিতরে ঝাপ দিয়ে পড়ে। মধুকুপির সবচেয়ে বড় দেমাকী তেজী আর মজবুত কিযাণের পাথুরে গতরটা যেন প্রচণ্ড এক অপরাধের লজ্জায় মাটি-কাটা গড়হার মধ্যে লাফিয়ে পড়ে আর ধুলোমাখা হয়ে লুকিয়ে থাকতে চায়।

দুখনবাবু চিঙ্কার করে ছুটে আসে-খবরদার দাশু, তুমি আর এখানে মজুর খাটতে আসবে না; খবরদার, খবরদার, এখনই কোদাল জমা দিয়ে চলে যাও।

দুখনবাবুর মুখের দিকে এক জোড়া হতভম্ব চোখের চাহনি তুলে তাকিয়ে থাকে দাশু। যেন এক পরম ভবিতব্যের বাণী শুনছে দাশু কিষাণের আত্মাটা। দুখনবাবু বলে-এবার ছুটি নাও দাশু।

দাশু ফ্যালফ্যাল করে তাকায়–হ্যাঁ, ছুটি নিব।

দুখনবাবু-ঘরে যাও দাশু।

দাশু–হ্যাঁ ঘরে যাব।

দুখনবাবু-তোমার আর কোন কাজে দরকার নাই।

দাশু–দরকার নাই, ঠিক কথা।

কোদালটাকে দুখনবাবুর শক্ত ছায়াটার কাছে ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যায় দাশু।

ওই যে কপালবাবার সেই জঙ্গল, আর ওই সেই বেলগাছ। হনহন করে হাঁটতে থাকে দাশু।

হাতের সেই কোদালটাকে যেমন রাগ করে দুখনবাবুর চোখের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল দাশু, তেমনই রাগ করে শরীরটাকে কপালবাবার আসনের সামনে শুকনো পাতার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আর মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে পড়ে থাকে। কপালের রগ দগ দগ করে। পাজরের হাড়গুলি ফুলে ফুলে কাঁপে। বেলপাতা চিবানো বুজ লালারসের ধারা দু কষ বেয়ে ঝরে পড়ে। বল কপালবাবা, দাশু কিষাণের গতরে কোন্ গরলের কীট ঠাঁই নিলে? সেই গরল বটে কি? কোন কাজে দাশু কিষাণের কি আর দরকার নাই? ছুটি নিতে হবে কি?

মাটিতে কপাল ঘষে ছটফট করে দাশু–না না না। মিছা কথা বলেছে দুখনবাবু। দেখ না কেন গো কপালবাবা, এগুলা কি গরলের দাগ? ভেরেণ্ডার পাতা দিয়ে সেঁক দিলে কি দাগগুলা মুছে যাবে না?

কপালবাবার আসনের কাছ থেকে মাটি ছেড়ে যখন উঠে দাঁড়ায় দাশু, তখন জঙ্গলের হাওয়া উতলা হয়ে উঠেছে, আর বিকালের রোদও পাখির ডাকের সঙ্গে হুটোপুটি করে গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে।

ধুলোয় ভরা হাত-পা আর বুকটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করে দাও। ছলছলে চোখ দুটোও যেন আঠায় ভরে গিয়েছে। জোরে জোরে চোখ দুটোকে ঘষে নিতেই দেখতে পায় দাশু, হ্যাঁ, এখনও বেলা বেশ আছে। সড়ক ধরে এখনও অনেক লোক জানুনগড়ার ডাঙার দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ওপথের দিকে আর এগিয়ে যেতে চায় না দাশু। লোকের চোখের সন্দেহ থেকে আড়াল হয়ে এই চেহাবাটাকে যদি ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তবে সামনের মরা ক্ষেতের মাটি পার হয়ে ওই পলাশবনের ভিতর দিয়ে উরানির খাতের পাশে পাশে হেঁটে একেবারে লোহার পুলের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। তারপর সড়কটাকে কিছুক্ষণের জন্য ফাকা পাওয়া যাবে আৰ একটা ছুট দিয়ে ঘরে পোঁছে যেতেই বা কতক্ষণ লাগবে?

পলাশবনের মাথার উপর তিতিরের ঝক উড়ছে। মরাক্ষেতের শেষ আল পার হয়ে পলাশবনের ভিতরে ঢুকতেই ভেরেণ্ডার একটা ঝোপ দেখতে পায় দাশু। পটপট করে ভেরেণ্ডার পাতা ছিঁড়ে আর গামছায় বেঁধে নিয়ে আবার চলতে থাকে।

টিহা টিহা টিহা! সত্যিই একটা পাপিয়া ডেকে উঠেছে। দাও যেন একটা হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায়। এই তো এখানে! এখনও আছে। এটা যে সেই পাথরটা। পাথরের পাশে ওটা যে সেই এক-হাঁটু জলের দহটা!

হাঁডিয়ার পানসে গন্ধে বিবশ হয়ে একটা মাতাল পিপাসার বাতাসও বুঝি থমকে রয়েছে। দাশুর বুকের উপর একটা আদুড় কোমলতার পিছল স্পর্শ লুটিয়ে পড়ছে। সকালীর লাল চোখ দুটো যেন দুটো লাল ফুলের রক্তের অভিমান, আর ঠোঁট দুটো মাতোয়ালা পিপাসার দুটো কুঁড়ি। দাশু কিষাণের বুকের কাছে সাধের মরণ খুঁজছে সকালী।

নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও দাশুর প্রাণের ভিতরটা যেন মাতাল হয়ে দুলতে থাকে। ঠিক আছে; সব ঠিক আছে। দুখনবাবুর সন্দেহ মিথ্যা, দাশু কিষাণের ভয়গুলি মিথ্যা। দাশু কিষাণের গতরে গরল ঢুকে নাই। তা না হলে সকালীর ছোঁয়া নেবার জন্য প্রাণের ভিতর এত বড় পিয়াসের জোর উথলে ওঠে কেন? তুই আয় সকালী। তুই কবে আসবি সকালী?

দহের জলে সকালীর গায়ের গন্ধ আজও লুকিয়ে আছে বুঝি! দাশুর চোখ দুটো বিহুল হয়ে জলের দিকে তাকায়। কিন্তু চমকে ওঠে, চোখ বন্ধ করে, মাথার ঝাকড়া চুলের ঝুঁটি দুই হাতে মুঠো করে ধরে কাঁপতে থাকে দাশু জলের ভিতর থেকে যেন একটা লাসের ছবি ভেসে উঠেছে। ভুরু দুটো শীর্ণ হয়ে ঝুলে পড়েছে; নাকের ডগাটা ফাটা। কানের দোলকের মাংস ফুলে উঠেছে। মুখের উপর চাকা চাকা লালচে দাগ। আর চোখের পাতাগুলি ঝরে পড়ে গিয়েছে।

চোখ মেলে তাকায় দাশু। হাতের মুঠা দুটোকে চোখের সামনে এনে দেখতে থাকে। হ্যাঁ, ভাঙা চুলের গুঁড়োতে হাতের মুঠো ছেয়ে গিয়েছে; আঙুলের নখগুলিও কেঁচো মাটির ছোট ছোট টুকরোর মত কুঁকড়ে পাকিয়ে আর শুকিয়ে রয়েছে। আর, সারা গা জুড়ে যেন আঁশ ধরেছে; ফাটা ফাটা চামের চাকা চকচক করছে।

জলের উপর ঝাপ দিয়ে পড়ে দাশু। সারা শরীর জলে ড়ুবিয়ে দিয়ে আর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর করুণ আর্তনাদের মত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে-বাঃ, কপালবাবা। খুব দয়া, খুব দয়া; দাশু কিষাণের উপর তোমার দয়ার শেষ নাই।

এত ঠাণ্ডা যে ডরানির জল, সে ডরানির জল দাশু কিষাণের শরীরে আর ঠাণ্ডা ছোঁয়ার স্নেহ ছুঁইয়ে দিতে পারছে না। একটুও ঠাণ্ডা লাগে না এত ঠাণ্ডা জলে! দাশু কিষাণের এই জ্যান্ত শরীরের হাড়মাস নির্বোধ হয়ে গিয়েছে।

জল থেকে উঠে একটা গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর চুপ করে বসে থাকে দাশু। হ্যাঁ, পাপিয়াটা ডাকে; কিন্তু দাশুর কানে মিঠা শব্দের স্বাদ নেবার সেই জোর আর নেই। মনে হয় পাপিয়া নয়; একটা রাগী পাখির চিকার পলাশবনের বাতাসে ছুটোছুটি করছে। পলাশবনের বাতাসই বা কেমন? এত সুন্দর ফুরফুরে বাতাসের ছোঁয়া দাশুর আদুড় শরীরের উপব এসে লুটিয়ে পড়ছে; কিন্তু দাশুর শরীরে কোন স্নিগ্ধ অনুভবের সুখ ফুরফুর করে না।

একটা কাঠবিড়ালী; কখন এসে দাশু কিষাণের ছড়ানো পায়ের উপর এসে বসেছে, দেখতে পায় নি দাশু। কিন্তু দেখতে পেয়েই হো হো করে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে না। না, আর ভাবতে হবে না। কাঠবিড়ালীটা এত বড় একটা লেজের রোঁয়া বুলিয়ে দাশুর পায়ের উপর যে সুখের ছোঁয়া ঢেলে দিচ্ছে, সে সুখের স্বাদ পায় না দাশুর শক্ত শক্ত পা দুটো; পায়ের পাতা দুটোও বেঁকতে শুরু করেছে; আর হাঁটুতে কেমনতর একটা ব্যথা।

তবে আর কেন? ভেরেণ্ডার পাতাগুলি গামছার পুঁটলি থেকে খুলে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে একবার ড়ুকরে ওঠে দাশু। না, তুই আসিস না সকালী।

বিকালের আলো যখন একেবারে মরে যায়, আর পলাশবনে ছায়াগুলি অন্ধকারে কালো হয়ে উঠতে থাকে, তখন উঠে দাঁড়ায় দাশু! ফিসফিস করে হেসে যেন এক পরম অন্তিমের সঙ্গে কথা বলে।–আর মিছা কেন উঠাবসা করাও কপালবাবা? আর যে উঠবার কোন দরকারই নাই; আর যে কোথাও বসবারও দরকার নাই।

কানারানীও যে আজ আর নাই। থাকলে, আজ এই পলাশবনের জঙ্গলের আঁধারে কানারানীর চোখের সেই আগুন দেখতে পেলে কত খুশি হয়ে যেত দাশু। কানারানীর চোখের সামনে এই রোগের ধড়টাকে ফেলে দিয়ে হেসে উঠতো দাশুনে কানারানী, আমাকে ছুটি করে দে। দাশু কিষাণের এই ঘেয়ো গতরটাকে খেয়ে নিয়ে তুই সুখ কর।

আকাশে তারা দেখা যায় না কেন? তবে কি কালা বাদলে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে? ঝড়ো হাওয়ার গোঁ গোঁ শব্দ শুনে তাই মনে হয়। কে জানে ঝড়টা কোন্ দিকে চলে যাচ্ছে?

পলাশবনের ভিতর থেকে, ডরানির খাতের পাশে পাশে হেঁটে যখন ভোলা ডাঙার বুকের উপর পোঁছে যায় দাশু, তখন আকাশের রূপ দেখে আর আশ্চর্য হয়ে আরও একবার থমকে দাঁড়ায়। বিজলি হানছে আকাশটা, আর বড়কালুর পাথর যেন চমকে দিয়ে ঝলসে উঠছে। শিলা ঝববে কি? মেঘ গলবে কি? আর, পুরা তিন ঘন্টা ধরে জল র্যাবে কি মধুকুপির আকাশ?

-কানারানী নাই, কিন্তু ডরানি তো আছে। আবার বিড়বিড় করে দাশু।

ঝড়ের শব্দের সঙ্গে অনেক দুরে ডরানির বুকের একটা শব্দও গোঁ গোঁ করে উঠলো। দাশুর দুই পাটি সাদা দাঁতের হাসি যেন চমকে দিয়ে ধবধব করে।—ছুটি নিব, ছুটি নিব দাশু।

ডরানির পুলের কাছে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। কিন্তু আকাশছাওয়া কালা বাদল ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসতে থাকে; আর তারার ঝকও চিকচিকিয়ে ফুটে ওঠে। ঝড়ো হাওয়াটাও আর গোঁ গোঁ করে না, বিজলীর চমকানিও নেই। মধুকুপির

শুকনো মাটির উপর এক ফোঁটাও জল ঝরে পড়লো না।

–ডরানি তুই পাগল হবি কবে? আবার যেন পিপাসিতের মত ছটফট করে আর ফিসফিস করে একটা পরম লোভের সঙ্গে কথা বলে দাশু। তারপর চলতে থাকে।

পুরনো জামকাঠের দরজার একটা নড়বড়ে কপাট ঝড়ের চোট লেগে একেবারে কাত হয়ে ঝুলে পড়েছে। চালার বাতা একদিকে নেমে গিয়েছে। একটা খুঁটোর মাথা ফেটে গিয়েছে।

ঘরের ভিতরে ঢুকেই উনানের মুখে শুকনো পাতা গুঁজে দিয়ে আগুন ধরায় দাশু। সরা থেকে চারমুঠো মকাই-এর দানা আর গোটা দশেক ড়ুমুর হাঁড়িতে ফেলে দিয়ে তারপর জল ঢালতে গিয়ে প্রচণ্ড একটা লজ্জার আঘাতে স্তব্ধ হয়ে যায় দাশু কিষাণের হাত দুটো। হেসে ফেলে দাশু। আর মিছা কেন রাধা করাও কপালবাবা? এই চার মুঠো মকাই-ড়ুমুরের জাউ খাবে কে? তোমার দয়ার গরল গলিয়ে দিল যে গতর, সে গতরে খোরাক ঢেলে আর লাভ কি?

হাঁড়িটাকে হাতের এক ঠেলা দিয়ে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে দাশু;–না, আর নয়, এইবার তুমি ছুটি নাও দাশু।

উনানের আগুনটা যেন একটা ধুনির আগুন, আর দাশু কিষাণ একটা ছাইমাখা ও মাথায় উদাসী সাধু। উনানের শুকনো পাতার আগুন থেকে গরম ছাই উড়ে এসে দাশুর চোখে-মুখে ছিটকে পড়ে। তবুও নড়ে না দাও।

হঠাৎ একটা কাক ডেকে উঠতেই চমকে ওঠে দাও। ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়। না, ভোর হয় নি; নিমগাছের কাক বোধহয় বাসার কাছে একটা হিংসুটে পেঁচার মুখ দেখতে পেয়ে সেই মাঝরাতে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ডেকে উঠেছে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আবার মধুকুপির সেই তারাছড়ানো আকাশের চারদিকে তৃষ্ণার্তের মত চোখ ঘুরিয়ে তাকাতে থাকে দাশু। ভোর তো হবে, কিন্তু কালা বাদল আবার দেখা দিবে কি? ভাদুয়া মেঘ গলবে কি? আর, উরানির জল পাগল হয়ে হুড়পা বান বহাবে কি?

দাশুর মনের আশাটা হিসাব করে করে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। হবে হবে; আজ না হয় কাল, কাল না হয় এক হপ্তা পরে, একদিন না একদিন পাগল হবে ডরানির জল। হুড়পা বানের ঢল আছাড় দিয়ে দিয়ে বড় বড় পাথরের চাঙ্গড় গুড়া করে দেবে। বড় বড় শালের খড় কুটোর মত ভেসে উধাও হয়ে যাবে। তার সাথে তুমিও ভেসে যাবে, তুমি বড় ভাল ছুটি নিতে পারবে দাশু। চিন্তা কর কেন?

কখন্ ভোর হয়েছে বুঝতে পারে নি দাশু। উনানের কাছে খেজুর পাতার চাটাই-এর উপর সেই ছাইছড়ানো উদাসী সাধুর মত চোখ-মুখ আর মাথা নিয়ে নিঝুম হয়ে তখনো বসে থাকে দাশু, যখন ভোরের কাক ডাক দিয়ে উড়তে শুরু করে দিয়েছে আর বড়কালুর মাথায় রোদ ছড়িয়ে পড়েছে।

বেশ চনচনে হয়ে সকালবেলার রোদ যখন মধুকুপির সব ডাঙায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন একটা জিপ গাড়ি ছুটে এসে ঠিক দাশু ঘরামির ঘরের সামনে সড়কের উপর নিমগাছের ছায়ার কাছে দাঁড়ায় আর জোরে হর্ন বাজাতে থাকে। কিন্তু জিপ গাড়ির এই হর্নের শব্দও বোধহয় শুনতে পায় নি, পৃথিবীর সব শব্দের সঙ্গে যেন আড়ি করে আর বধির হয়ে ঘরের ভিতরে বসে আছে দাও।

-ঘরে আছ কি হে দাশু? একেবারে দাওয়ার উপরে উঠে আর নড়বড়ে কপাটের কাছে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতর উঁকি দিয়ে যখন চেঁচিয়ে ওঠে নিতাই মুদী, তখন চমকে ওঠে দাশুকে বটে?

—আমি নিতাই।

–তুমি আবার এখানে আস কেন নিতাইদাদা?

–দরকার আছে রে ভাই।

–কার কাছে?

–তোমার কাছে।

–বল।

–তোমার ভোট চাই।

ঘরের ভিতরের আবছায়ার মধ্যে সুস্থির হয়ে বসে আর নিতাই মুদীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে দাও।

নিতাই মুদী বিরক্ত হয়ে বলে–হাস কেন দাশু? ভোট দিবে, তাতে আবার হাসি কিসের?

দাশু–কাকে ভোট দিব নিতাইদাদা? তোমাকে কি?

-আরে না। যাকে ভোট দেবে, সে মানুষ যে-সে মানুষ নয়। কিষাণদের দুঃখের কথা ভেবে দিনরাত কাঁদে যে, এমন একটি খাটি মানুষ।

-সে কে বটে?

–হারানগঞ্জের ডাক্তার রিচার্ড সরকার।…ব্যস, তুমি আর বোকার মত হাসাহাসি করবে না। এই নাও, একটা টাকা রাখ; ভোটের দিন সকালবেলা পেটভরে চিড়া-গুড় খেয়ে নিয়ে বাবুরবাজারে গিয়ে রিচার্ডবাবুর বাক্সে ভোটটা দিয়ে এস!

–না। টাকা নিব না।

–কেন?

–আমি ভোট দিব না।

–তবে মর। রাগ করে চেঁচিয়ে ওঠে নিতাই মুদী।

–ঠিক কথা; বড় ভাল কথা বলে দিলে নিতাইদাদা।

বলতে বলতে হেসে ফেলে দাশু। দাশুর সেই অদ্ভুত হাসির শব্দ শুনে ও ঘরের আবছায়ার ভিতরে লুকানো দাশুর মুখের হাসির সেই অদ্ভুত চেহারাটাকেও দেখতে পেয়ে হঠাৎ যেন ভয় পায় আর চমকে ওঠে নিতাই মুদী। তারপরেই দাওয়া থেকে নেমে হনহন করে হেঁটে জিপ গাড়িটার দিকে চলে যায়।

আবার কিছুক্ষণের নিঝুম ভাবনার আবেশ। তবু দাশুর সেই উদাসী মুখের উপর একটা কৌতুকের হাসি থমথম করতে থাকে। আর মিছা কেন দাশু কিষাণের ঘরের কাছে দরকারের হাঁক হাঁকে ওরা? ওরা বোঝে না কেন, দাশু কিষাণ আর নাই।

-দাশু একবার ঘরের বাইরে এসো হে। আবার একটা ডাক। দুখনবাবুর গলার স্বর চিনতে পারে দাশু। দুখনবাবু বেশ জোরে চেঁচিয়ে আর সড়কের উপরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিচ্ছে।

ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে যেয়ে উত্তর দেয় দাও। কি বটে দুখনবাবু?

দুখনবাবু–তোমার ভোট চাই দাও।

দাশু হেসে হেসে হাত নেড়ে ইসারায় জানায়–না।

দুখনবাবু ভ্রূকুটি করে তাকায়।–লালবাবুর লেগে ভোট চাই; না কর কেন?

দাশু–না।

দুখনবাবু–তোমার যে দুই টাকা দশ আনা চৌকিদারী খাজনা বাকি পড়েছে, সে খবর জান কি?

দাশু–জানি!

দুখনবাবু-চৌকিদারীর লোক যে আদায় হাসিল করতে তোমার ঘরের কপাট খুলতে আসবে, সেটা জান কি?

দাশু–আসুক না কেন।

দুখনবাবু–আমি বলি; দুই টাকা দশ আনা নাও, চৌকিদারী খাজনা শোধ করে দাও, আর খুশি হয়ে ভোটটি লালবাবুকে দিয়ে দাও।

দাশু–না দুখনবাবু।

দুখনবাবু-কেন? লালবাবুর মত মানুষকে ভোট দিবে না কেন?

দাশু–না। দুখনবাবু রাজা রামচন্দ্রের মত মানুষটাকে তুমি ভোট দিবে না?

দাশু চেঁচিয়ে ওঠে–না।

দুখনবাবু–তুমি মর।

দাশু-–আঃ, তুমি আজ বড় ভাল দয়ার কথাটি বলে ফেলেছ দুখনকাকা।

চমকে ওঠে দুখনবাবু; সড়কের উপরে দাঁড়িয়ে দুই চোখ কটমট করে দাশুর সেই কুৎসিত ফাটা ফাটা মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই যেন ভয়ে শিউরে উঠে আর জোরে জোরে হেঁটে চলে যায়।

দুখনবাবু চলে যেতেই ঘরের ভিতরে ঢুকে খেজুর পাতার চাটাই-এর উপর শান্তভাবে বসে, আর, যেন বুকের ভিতরের একটা অদ্ভুত হাসির সঙ্গে মনে মনে খেলা করতে থাকে দাশু। কিন্তু আবার কে যেন আসছে মনে হয়। সড়কের আর-এক দিক থেকে হন্তদন্ত খুশির ছায়ার মত লাফিয়ে লাফিয়ে দাশুরই ঘরের দাওয়ার দিকে এগিয়ে আসছে একটা লোক। গায়ে চাদর জড়িয়ে আর রোগা রোগা ধুলোমাখা পা ফেলে ফেলে লোকটা আসছে। এক দূর থেকে আসছে বলে মনে হয়।

–সরদার। দাওয়ার উপর উঠে আর ঘরের ভিতরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ডাক দেয় লোকটা।

-কে বটে? উত্তর দেয় দাশু।

–আমি কালু।

–কে?

–ভাল করে দেখে নাও সরদার। দেখ, চিনতে পার কিনা?

আশ্চর্য হয় দাও। তোমাকে গোবিন্দপুর থানার হাজতে দেখেছি কি?

কালু-হাঁ, সরদার। দাশু–কিন্তু তুমি মিছা আমার কাছে এসে…।

কালু হাসে–মিছা আসি নাই সরদার।

দাশু–তবে বল।

কালু-উস্তাদ বেচারার ফাঁসি হয়েছে।

–কে? কে? কার ফাঁসি হয়েছে? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

কালু-হাজারিবাগ জেলে উস্তাদ গুপী লোহারের ফাঁসি হয়ে গিয়েছে।

—ভঁইসাল ভাই! ড়ুকরে ওঠে দাশুর বুকের পাঁজর। কালু দাগীও করুণ ভাবে হাসো সরদার, তোমার ভঁইসাল ভাই আর নাই। কিন্তু…।

-কি?

চাদরের আড়াল থেকে ছোট একটি থলি বের করে কাল দাগী বলে—এতে পাঁচশত টাকা আছে সরদার।

-কিসের টাকা?

-তোমার হিস্যা। উস্তাদ বেচারা তোমার কথা ভুলে নাই। কয়েদ হবার আগে ওর একটা ভক্তের হাতে টাকাটা দিয়ে বলে গেল, যেন তোমার হিস্যার টাকাটা তোমাকে পৌছাই দেয়।

–ভক্তটা কে বটে?

–আমি বটি গো। তিন সাল কয়েদ খেটে ছাড়া পেলাম, তবে না তোমার ঠাঁই আসবার মওকা হলো …হাঁ…এখন…।

-কি?

কালু দাগীর চোখ দুটো চিকচিক করে এখন মনের সাধে জমি কর, নতুন ঘর কর আর মাগ ছেইলা নিয়ে সুখ কর সরদার। তোমাব ভঁইসাল ভাই যেমনটি বলে গেছে, তেমনটি কর।..ও কি? তুমি কাদ কেন সরদার?

দাশু–আমি টাকা নিব না কালু।

কালু-কেন সরদার?

দাশু–আর দরকার নাই।

-তুমি কি তবে…। বলতে বলতে আর কি-যেন সন্দেহ করতে করতে দাশুর মুখটাকে ভাল করে দেখতে চেষ্টা কবে কালু। সত্যিই কি ঘর ছেড়ে সাধু হয়ে চলে যাবে বেচারা সরদার? ধুনির ছাই গায়ে মেখে জপতপ করে নাকি সরদারটা? তা না হলে ওর মুখটা এমন উদাসপারা দেখায় কেন?

কালু দাগীর বিস্ময়ের প্রশ্নটাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে ওঠে দাশু–আমি ছুটি নিব কাল।

-অ্যাঁ? দাশুর মুখটাকে আরও ভাল করে দেখবার চেষ্টা করতে গিয়েই আর্তনাদ করে ওঠে কালু-তোমার এ কেমন দশা হলো সরদার।

দাশু–কপালবাবার দয়া বটে।

কালু—তবে বল সরদার, আমি কি করি?

দাশু–তুমি চলে যাও। কপালবাবা তোমাকে সুখে রাখবেন।

কালু–টাকাটা?

দাশু–যাকে দিবার মন করে তাকে দিয়ে দাও।

কালু–এ টাকা ফিরে নিয়ে যেতে বড় ডর লাগছে সরদার।

দাশু হাসে–না, কোন ডর নাই কালু।

টাকার থলিটা কোমরে গুঁজে আর চাদরটাকে গায়ে জড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কালু দাগী, তারপর যেন ভয় পেয়ে উসখুস করতে থাকে।

কালু দাগীর মূর্তিটা দাওয়া থেকে নেমে আবার সড়ক ধরে উধাও হয়ে যাবার পর দাশুর চোখের চাহনিটা চিকচিক করে হাসতে থাকে। আর দুখ করবার কিছু নাই। আর রাগ করবার কিছু নাই। ছুটি নেবাব আগে যেন বুক ভরে হাসবার আর খুশি হবার একটা পরব দেখা দিযেছে।

কিন্তু আর কত দেরি হবে? রানি তুই পাগল হবি কবে? দাশুর মনের ভিতরে শেষ লোভের আশাটা আবার গুনগুন করে উঠতেই দাশুর ঘরের দাওয়ার উপর অদ্ভুত একটা মিষ্টি হাসির শব্দ খিলখিল করে বেজে ওঠে।-সরদার!

খেজুর পাতার চাটাই-এর উপর বসে দরজার দিকে একটা করুণ চাহনি তুলে থাকে দাশু।

সকালী এসেছে। কী সুন্দর ঢলঢল করছে সকালীর মুখটা।

কে জানে কোন নদীর ঠাণ্ডা জলে চোখ ধুয়েছে সকালী? লাল চোখ নয়, কটকটে ছটফটে দূরন্ত চাহনিও নয়। সকালীর চোখের সাদা দুটো বড় বেশি সাদা হয়ে ধবধব করে; আর চোখের তারা দুটো কুচকুচে কালো হয় চিকচিক করে। যেন শেষ রাতের ঘুমের ঘোরে নতুন আশার স্বপ্ন দেখে হঠাৎ জেগে উঠেছে সকালী। আর, স্নান করে একেবারে স্নিগ্ধ হয়ে নিয়ে ভোরের হাওয়ার সঙ্গে তরতর করে হেঁটে মধুকুপির দাশু কিষাণের এই ঘরের দরজার কাছে পোঁছে গিয়েছে।

সকালীর খোঁপাটাও আর সেই রুক্ষ চুলের কুণ্ডলী নয়। তেলমাখনো চুলের খোঁপাটাও স্নিগ্ধ হয়ে চিকচিক করে। খোঁপাতে দুটো আধফোঁটা সাদা ফুলের কুঁ।ি পরিষ্কার ধবধবে সাদা একটা কালোপেড়ে শাড়ি পরেছে সকালী। এই স্নিগ্ধ চেহারার একটা লাজুক আবেশ সকালীর কোমরটাকে যেন অলস করে দিয়েছে, তাই শাড়ির আঁচলটাকে কোমরের চারদিকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছে। নতুন গামছা দিয়ে পোঁটলা করে বাঁধা ছোট্ট একটা উপহারের ভার আদর করে হাতে ধরে রেখেছে। দেখেই বুঝতে পারে দাশু, মকাই-এর খই-এর মোযয় হাতে নিয়ে সকালীর জীবনের আশা আজ দাশুর জীবনের এক দূরন্ত অঙ্গীকারের কাছে জবাব চাইতে এসেছে। দাশুর চোখ দুটো আরও করুণ হয়ে থরথর করে কাঁপে।

দরজার কাছে এগিয়ে এসে, দরজার পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে, যেন স্নিগ্ধ শরীরের সব অনুভবের আবেশ হেলিয়ে দিয়ে, ঘরের ভিতরে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা দাশুর আবছায়াময় মুর্তির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে সকালী-রাগ কর নাই তো সরদার?

দাশু–কার উপর রাগ করবো সকালী?

সকালী মাথা হেঁট করে।–আমার উপর।

দা-কেন?

 

সকালী–আসতে দেরি হলো বলে?

দাশু–না সকালী, একটুও রাগ করি নাই।

সকালী থানার মুন্সীটার জুলুমের ডরে আসতে পারি নাই সরদার।

দাশু—আজও না এলে ভাল হতো।

চমকে ওঠে সকালী-কেন?

দাশু–তুমি এই তল্লাটে আর থেকো না সকালী; দূরে চলে যাও।

সকালী-কেন?

দাশু–থানার মুন্সীটা তোমাব দুশমন বটে।

সকালী আবার মাথা হেঁট করে হাসে-সে কথা আর বল কেন সরদার? বাবা বড়পাহাড়ী জানে, দানোটার মতলব এই দুটা বছর আমার পিছু নিয়ে আমাকে কী মরণজ্বালা দিলে! এই তল্লাট ছেড়ে রামগড়ে চলে যেতে হয়েছিল সরদার।

দাশু–ভাল করেছিলে, আবার চলে যাও।

সকালীর স্নিগ্ধ চোখের কালো তারা দুটো হঠাৎ সন্দিগ্ধ হয়ে ছটফট করে ওঠে।–আমাকে যাও যাও কর কেন সরদার?

দাশু—আমাকে মাপ কর, আমি বেদে হতে পারব না।

সকালীর স্নিগ্ধ চোখ জলে ভরে গিয়ে ছলছল করে। জোরে একটা হাঁপ ছাড়ে সকালী। তারপর সেই ছলছলে চোখ দুটোকেই অদ্ভুতভাবে হাসিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলে–না সরদার, তোমার বেদে হয়ে কাজ নাই। আমিও তোমাকে ঘরছাড়া বেদে করে নিয়ে যেতে আসি নাই।

–কি বললে? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

সকালী-কিষাণ মানুষ কিষাণ হয়ে থাকবে, কিষাণ হয়ে বাঁচবে, বেদে হবে কেন?

–সকালী! দাশুর গলার স্বর একটা বিস্ময়ের বেদনা সহ্য কবতে না পেরে ড়ুকরে ওঠে।

–সকালী-ঘর কর সরদার। ঘরণী কর।

দাশু চেঁচিয়ে ওঠে-বেদেনী কালী আবার এমন কথা বলে কেন?

আঁচল তুলে চোখ মুছে নিয়ে যেন অতৃপ্ত জীবনের একটা দূরন্ত ক্লান্তি মুছে ফেলতে চেষ্টা করে আর ফিসফিস করে সকালীনা দার, বেদেনী হতে আর সাধ নাই।

দাশু–মরদের ঘর করবার সাধ হয়েছে কি?

সকালী–হ্যাঁ সরদার। তোমারই ঘর করবে সকালী।

–চুপ সকালী, চুপ। চেঁচিয়ে ওঠে দাও।

সকালী–মিছা চুপ করতে বলল না সরদার। সকালীকে তোমার ঘরে রাখ সরদার।

বলতে বলতে সকালীর এতক্ষণের শান্ত চেহারাটা দুর্বার এক আশার আবেগে টলমল করে ওঠে। ঘরের দরজার উপর যেন এখনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে সকালীর শরীরটা।

খেজুর পাতার চাটাই-এর উপর থেকে এক লাফ দিয়ে উঠে একেবারে দরজার কাছে এসে, শক্ত করে একটা কপাট আঁকড়ে ধরে, আর একেবারে সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাও। দাশুর চোখ-মুখ আর হাত-পায়ের উপর সকালবেলার আলোর আভাও যেন একটা দূরন্ত কৌতুকের ঝলকের মত ছড়িয়ে পড়ে।

দাশুর মুখের দিকে তাকায় সকালী। সেই মুহূর্তে দু পা পিছিয়ে যায় আর চেঁচিয়ে ওঠে এ কি! তোমার যে কুট হয়েছে সরদার।

তীব্র, তীক্ষ্ণ ও করুণ একটা হাহাকার; সকালীর আর্তব শিউরে শিউরে বাজতে থাকে। ডরানির জলের কাছে ভোরবেলার সারসী মানকি ছোঁড়াদের তীরের আঘাতে বিদ্ধ হয়ে যেরকমের যন্ত্রণার রব ঘড়ে, ঠিক সেইরকমের একটা যন্ত্রণার রব। চোখের উপর আঁচল চাপা দেয়, আবার আঁচল সরিয়ে নিয়ে দাশুর মুখের দিকে তাকায় সকালী। চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে সকালী।-তুমি আবার আমাকে ঠকালে সরদার! ছিয়া ছিয়া ছিয়া!

দাশু—আমাকে মাপ কর।

সকালী–না, কভি না।

চোখের উপর আবার আঁচল চাপা দেয় সকালী। দরজার পাশে মাটির দেয়ালের উপর কপাল ঠেকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

বোবার মত শুধু চুপ করে একঠায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে দাশু। সকালীর অভিমানের আক্রোশও আস্তে আস্তে ক্লান্ত হতে থাকে। সকালীর বুকের ভিতর থেকে একটা অসহায় বিলাপের গুঞ্জন বের হয়ে গুগুন্ করে।-ছিয়া ছিয়া! আমি কার লেগে এত সাধ করে নতুন গামছায় বাঁধা করে মোয়া নিয়ে এলাম?

আরও কিছুক্ষণ তেমনই মাটির দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে আর গুনগুন করে কাঁদবার পর জোরে একটা হাঁপ ছাড়ে সকালী। আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মোছে আর একেবারে শান্ত হয়ে যায়। দরজার কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে মোয়র পোঁটলাটা রেখে দিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয় সকালী। সড়কের দিকে তাকায়।

দাশু বলে–তোমার সাধের চিজ এখানে আর রাখ কেন? নিয়ে যাও।

দাশুর মুখের দিকে না তাকিয়ে, আর গলার স্বর একটু রূঢ় করে নিয়ে যেন ধিকার দেয় সকালী-ফিরিয়ে নিয়ে যেয়ে কোন লাভ?

দা-রেখে গেলেই বা তোমার কোন লাভ?

সকালী—তুমি দয়া করে খাবে, এই লাভ।

দাশু–না।

মুখ ফিরিয়ে দাশুর মুখের দিকে কটমট করে তাকায় সকাল-সকালীর ছোঁয়া মিঠাই খেতে আজও ঘিন্না লাগে বুঝি?

দাশু–একটুকও ঘিন্না করে না সকালী। কিন্তু, তুমি এই চিজ নিয়ে যাও।

ঝামটা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সকালী–নিয়ে গিয়ে কি হবে? কাউয়াতে খাবে কি?

দাশু হাসে–না ডরানির জলে ফেলে দিলে কাউয়াতে খাবে কেন?

–ডরানির জলে? ভ্রূকুটি করে কুটে কিষাণের এই বিচিত্র হাসির রহস্য বুঝতে চেষ্টা করে সকালী। দাশুর হাসিটা যেন একটা ভয়ানক কৌতুকের সঙ্কেত। তা না হলে সে কেন দাশু?

–ডরানির জলে ফেলে দিব কেন? দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গিয়ে সকালীর চোখ দুটো যেন একটা নতুন সন্দেহের বেদনায় কাঁপতে থাকে।

দাশু হাসেডরানির জল বড় ঠাণ্ডা বটে, আর দাশু কিষাণের গতরে বড় জ্বালা বটে।

–সরদার। ফুঁপিয়ে ওঠে সকালী।

—তুমি মিছা কাঁদ কেন? ফিসফিস করে দাশু।

মিছা কান্না? দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আর শান্ত হয়ে কি-যেন ভাবতে থাকে সকালী। মধুকুপির যে কিষাণের বুকের ছোঁয়া এত ভাল লেগেছিল, সেই কিষাণের জীবনটাকেও কুষ্ঠরোগের একটা লাস মনে করে পালিয়ে যাচ্ছে সকালী?

-আমি যাব না সরদার! অদ্ভুত এক জেদের মূর্তি ধরে চেঁচিয়ে ওঠে সকালী।

দাও ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে–কি? কেন যাবে না?

সকালী—আমি তোমার ঘরে ঠাঁই নিব।

দাশু–ক্ষেপীর মত কথা বল কেন সকালী? কুটিয়া মানুষের ঘরে থাকতে তোমার যে…।

সকালী-আমার একটুও দুখ হবে না সরদার।

দাশু–কিন্তু আমার এই ঘর যে ঘর নয়। এই ঘর নিলাম হয়ে যাবে।

সকাল-যাক না কেন? ভিন গাঁয়ের ভিন ঘরে থাকবো।

দাশু–আমার এই গতরে যে খাটাখাটিও আর চলবে না।

সকালী-আমার গতর কি নাই? আমি খাটবো। আমি তোমার ভাত দিব। চাও তো, আমি তোমাকে…।

দাশু–কি?

সকালীর চোখে অদ্ভুত এক ইচ্ছার জেদ জ্বলজ্বল করতে থাকে।-চাও তো আমি তোমাকে ছেইলা দিব। তোমার কুটিয়া গতরকে একটুক ঘিন্না করবেনা সকালী।

চমকে ওঠে দাশু; দাশুর শরীরের জ্বালার উপর যেন হঠাৎ ঠাণ্ডা বৃষ্টির ধারা ঝরে পড়েছে। নিঃশ্বাসের বাতাসে সান্ত্বনা, আর রক্তের ভিতরে শান্তি। হিসাব জানে না, একটুকও হিসাব জানে না সকালী; শুধু মায়া করতে চায়, আর কিছু চায় না, এমন মানুষও দুনিয়াতে আছে। হে কপালবাবা, ছুটি নিতে যে ইচ্ছা করে না।

–সকালী! আস্তে আস্তে ডাকে দাশু।

–চিন্তা কর কেন সরদার? যেন বুকের সব নিঃশ্বাসের আবেগ ঢেলে দিয়ে নিবিড় স্বরে দাশুর জীবনটাকে আশ্বাস দেয় সকালীবাবা বড়পাহাড়ী দয়া করেন, তোমার রোগ সেরে যাবে সরদার।

হ্যাঁ, বিশ্বাস হয়, কোন চিন্তা করতে আর ইচ্ছা হয় না। সকালী জল ঢেলে দিয়ে ধুয়ে মুছে দিলে গরল চলে যাবে। আবার টাঙি কুদালি হাতে নিতে পারা যাবে। আবার ক্ষেতজোত হবে, নিশ্চয় হবে। ক্ষেতের মাটির ঢেলা ভাঙবে দাশু, ছিটাই বুনাই করবে সকালী। পাঁচ বিঘা মাটির ক্ষেত আর গুলঞ্চের বেড়া, হে কপালবাবা! আকাশে ভাদুয়া মেঘ গলছে, ঝিরঝির ঝরানি শুরু হয়ে গিয়েছে। চল সকালী চল। কাঁধের উপর ছেইলাটা, বুকের উপর মাদলটা, পাশে পাশে সকালী।

-খাও সরদার। ডাক শুনে চমকে ওঠে দাশু। হ্যাঁ দাশুর জীবনের দরজার কাছে এসেই গিয়েছে আর বসে পড়েছে সকালী। নতুন গামছার পোঁটলা খুলে মকাই-এর খই-এর মোয়া বের করেছে।

দরজার চৌকাঠের কাছে মেজের মাটির উপর বসে পড়ে দাশু, আর মকাই-এর খই-এর মোয়র দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়।

কেঁপে ওঠে হাতটা। তার পরেই কেঁপে ওঠে দাশু কিষাণের সেই অদ্ভুত চোখ, যে চোখ থেকে পাতা ঝরে গিয়েছে আর ময়ুরের চোখের মত সাদা দাগের চক্কর চোখের কোলে ফুটে উঠেছে। কি-যেন দেখতে পেয়েছে দাশু।

দাওয়ার সামনে যে ছোট নিমগাছটা, তারই ধড়ের আড়াল থেকে একটা বন্দুকের নল আস্তে আস্তে উঁকি দিয়ে কাঁপছে। দূরন্ত শিকারলোভীর মত সকালীর পিঠটার দিকে তাক করে নিয়ে একেবারে সুস্থির হয়ে গেল বন্দুকের নলটা।

–খবরদার, পলুস হালদার! হুংকার দিয়ে লাফিয়ে ওঠে দাশু। দরজার বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সকালীকে আড়াল করে, বুক চেতিয়ে আর দুই হাত তুলে দাঁড়ায় দাশু। চমকে ওঠে সকালী, উঠে দাঁড়ায়, আর দাশুর পিঠের পিছনে নরম ছায়ার মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

-তুমি সরে যাও সরদার। নিমগাছের আড়াল থেকে যেন হোঁচট-খাওয়া মানুষের মত একটা যন্ত্রণাক্ত চেহারা নিয়ে, চিৎকার করে আর লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে পলুস হালদার।

–কভি না। গর্জন করে ওঠে দাশু।

—শুধু একটা টোটা আছে সরদার। আমার কথা শুন; তুমি সরে যাও।

–বেশ তো; আমারও একটা বুক আছে। যদি সাধ হয়, তবে আমার বুকের উপর টোটা খালাস করে নাও।

-তুমি সরে যাও সরদার। দাশুর পিঠের পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে ছটফট কবে ওঠে সকালী, আর চোখ দুটো ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে।–খিরিস্তানের দুকের জোর কত, আমাকে বুঝে নিতে দাও সরদার।

-না, কভি না। দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে সকালীকে আড়াল করে রাখে দাও।–মারতে হলে আমাকে মেরে চলে যাক্ শিকারীটা।

দাঁতে দাঁত ঘষে চেঁচিয়ে ওঠে সকালী-তোমাকে মারবে এই শিকারীটাঃ ইঃ, আমি যে তবে ওর টুটি ছিঁড়ে লেহু পিয়ে নিব।

পলুস হালদারের গায়ে শুধু একটা ময়লা গেঞ্জি, পরনে একটা কালিঝুলি মাখা নীল রঙের পেন্টালুন। মাথাটা উসকো-খুসকো; যেন অনেকক্ষণ ধরে দু হাতে মাথার চুলের খুঁটি টানাটানি করেছে পলুস।

বন্দুকটাকে এক হাতে আঁকড়ে ধরে, আর এক হাতে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে জোরে একটা শাস ছাড়ে পলুস। তারপর একেবারে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে দাশুর আর সকালীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হেসে ফেলে পলুস। কিছুক্ষণ আনমনার মত মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পরেই বন্দুকের নলটাকে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে, নলের মুখটাকে নিজের বুকের উপর শক্ত করে চেপে ধরে।

এক লাফ দিয়ে নিমগাছের দিকে এগিয়ে যেয়ে পলুসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাশু; বন্দুকটাকে যেন থাবা মেরে আঁকড়ে ধরে আর একটা ঝাকুনি দিয়ে পলুসের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়।

পলুসের গম্ভীর করুণ হতাশ আর ব্যথিত মুখটা আবার অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকে।–তুমি বাধা দাও কেন সরদার? একটা টোটা আছে, খালাস করতে দাও।

–না, কভি না। তুমি কার উপর রাগ করে নিজেকে নাশ করতে চাও হালদার?

পলুস—একটু আগে শুধালে বলতাম, ওর উপর রাগ করে। শুকনো চোখের ভুরু টান করে সকালীকে দেখিয়ে দেয় পলুস।

দাশুর মুখটা হঠাৎ করুণ হয়ে যায়।

পলুস–কিন্তু না, সকালীর উপর আর রাগ নাই। যার উপর রাগ হয়, তাকেই নাশ করতে চাই সরদার; তুমি বাধা দিও না।

দাশুর হাত থেকে বন্দুকটা কাড়তে চেষ্টা করে পলুস। হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–না, কভি না। ছিছিনি করো না; আমার কুটিয়া হাতে জোর নাই হালদার। তুমি থাম হালদার।

ছিনাছিনি থামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পলুস; তারপর দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন ভয়ানক এক অভিমানের হাসি হাসতে থাকে। তোমার কুটিয়া হাতে বড় জবর জোর আছে সরদার। তুমি কী ভয়ানক ছিনে নিতে পার!

দাশু–কি বললে?

কোন উত্তর না দিয়ে আবার মাটির দিকে আনমনার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পলুস। টপ টপ করে দুটো বড় বড় জলের ফোঁটা পলুসের চোখ থেকে ঝরে পড়ে।

দাশু আশ্চর্য হয়—এ কি হালদার?

চাপা গলায় ফুঁপিয়ে ওঠে পলুস হালদার-সকালী!

চমকে ওঠে দাশু। পলুসের সজল চোখের চাহনিটা যেন দাশু কিষাণের এই কুষ্ঠগ্রস্ত জীবনের এক নতুন অহংকারের কাছে নিঃসহায় এক প্রার্থীর আবেদ। কি-যেন বলতে চায় পলুস, কিও স্পষ্ট করে বলতে পারছে না, আর মাথাটা বার বার হেঁট হয়ে যাচ্ছে।

মুখ ফিরিয়ে সকালীর দিকে একবার তাকায় দাও। দাশুর ঘরের দাওয়ার উপর দরজার কাছে চুপ করে বসে আছে সকাণী! ঢলল করছে সকালীর সুন্দর মুখটা। তেলচিকণ খোঁপাতে সাদা ফুলের আধফোঁটা কুঁড়ি দুটোও মুহির হয়ে রয়েছে। সকালীর নাম করে পলুস হালদারের বুকের ভিতর থেকে যে অভিমান উথলে উঠেছে, তার শব্দ শুনতে পায় নি সকালী। দাশু কিষাণের ঘরের দরজার মাটি আঁকড়ে একেবারে শান্ত কঠোর ও নির্বিকার একটা মূর্তি ধরে বসে আছে।

পুলস হালদারের মুখের দিকে তাকিয়ে কি-যেন ভাবে দাশু। বুকটা একবার ধড়ফড় করে ওঠে। তার পরেই দাশু কিষাণের সেই রোগের দেহটা যেন লোহার মূর্তির মত কঠিন হয়ে যায়। ফিসফিস করে দাশু–সকালীকে ঘরে নিয়ে যেতে চাও, হালদার?

পলুস–হ্যাঁ সরদার। কিন্তু যাবে কি সকালী?

হেসে ফেলে দাশু।–নিশ্চয় যাবে।

আস্তে আস্তে হেঁটে, ঘরের দাওয়ার উপর উঠে, দরজার কাছে এসে, আর, চুপ করে সকালীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দাও।

সকালী বলে—কি বটে সরদার? খিরিস্তানটা যায় না কেন?

দাও হাসে-যাবে, যাবে, কিন্তু একা যাবে না।

সকালী ভ্রূকুটি করে।–কি?

দাশু—তোমাকে নিয়ে যাবে।

সকালী-মিছা কথা।

দাশু–মিছা কথা নয়।

সকালী-কিন্তু আমি যাব কেন?

দাশু–যাওয়া ভাল।

সকালীর চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে।-এমন কথা বলতে তোমার লাজ লাগে না? তুমি কোন্ সাধে এমন কথা বল?

দাশু–তোমার ভাল হবে, সেই সাধে বলি।

-তুমি ঠগ বট সরদার। তুমি পাথর বট সরদার। তোমার মনেও এত গরল ছিল! হায় বাবা বড়পাহাড়ী! মাথা হেঁট করে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকে সকালী।

দাশু বলে-পলুস হালদার কাঁদছে।

চমকে ওঠে সকালী।–আঁ? কেন কাঁদলে? কার লেগে কাঁদলে?

দাশু–তোমার লেগে।

আবার মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকে সকালী।

দাশু–যাও সকালী।

সকালী—তুমি যেতে বল?

দাশু–হ্যাঁ।

সকালী—একটুক ভেবে নিয়ে বল।

দাশু–খুব ভেবে নিয়ে, খুশি হয়ে বলছি।

দাশুর মুখের দিকে অপলক চোখে কিছুক্ষণ অকিয়ে থেকে ফিসফিস করে সকালী-তুমি কেন খুশি হও সরদার?

দাশু–তোমাকে ভাবতে যে আমার বড় মায়া লাগে। তুমি যে…।

সকালী–ব্যস, আর বতে হবে না সরদার। বুঝলাম।

তেলচিকণ চুলের খোঁপাটাকে খুলে নিয়ে শক্ত করে আবার জড়িয়ে বাঁধে সকালী। শাড়ির আচলটাকে টানাটানি করে গুছিয়ে নিয়ে মাথার উপর টেনে দিয়ে, চুপ করে দুই হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে বসে থাকে।

দাশু হেসে হেসে আর চেঁচিয়ে ডাক দেয়–হালদার!

মুখ তুলে তাকায় পলুস–কি বটে?

দাশু–ওখানে দিককানা ভূতের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এখানে এসো, হালারিনকে হাত ধরে ডেকে নিয়ে যাও। তা না হলে যাবে কেন বেচারা?

এগিয়ে আসে পুলস। সকালীর হাত ধরে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় সকালী।

দূরের আকাশের এক কোণে কালা বাদল ঘনিয়েছে মনে হয়। ডাঙার উপর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের একটা আঁধিও দৌড়ে চলে গেল। দাশুর চোখ দুটো পিপাসীর চোখের মত দুরের আকাশের সেই মেঘে ভরাট চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে হাঁক দিতে থাকে দাশু।-না, আর দেরি করবে না, হালদার। সিধা ভুবনপুরের সড়ক ধরে চলে যাও। যদি জিরাতে হয় তবে নিরসাচটিতে একটা ঘণ্টা জিরিয়ে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করে নিও। তারপর মোটর বাস ধরে…হা, এখন কোথায় যাবে হালদার।

পলুস বলে-কারাসগড় যাব সরদার। রেল কোম্পানীর কারখানায় কাজ পেয়েছি।

দাশু–ভাল ভাল, খুব ভাল বটে হালদার। কপালবাবা তোমাদিগে সুখে রাখেন।

পলুসের পাশে পাশে হেঁটে সড়কের উপরে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়ায় সকালী। তারপর চলতে থাকে। ঘরের দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে আর নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে দাও।

দূরের আকাশে বিদ্যুৎ ঝিলিক দেয়; আর দাশুর চোখে সেই ঝিলিকের ছবি ঝিলিক দিয়ে হেসে ওঠে। বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে বিপুল এক স্বস্তিময় আরামের শ্বাস ছাড়ে দাও। আঃ, কপালবাবার দয়াতেও কত মজা! কোথা থেকে চলে এল বেচারা পলুস হালদার; সকালীকে হাত ধরে আর মায়া করে নিয়ে চলে গেল। ভাল হলো, বড় ভাল হলো। . ছুটি নেবার জন্য তৈরি হয়েও ভুল করে এখটু জিরিয়ে নেবার জন্য লোভ করেছিল দাশু। বেচারী সকালীর বোকা মনটাকে মিছা অভিমানে ভুলিয়ে দিয়ে সকালীর বুকের একটা ভয়ানক মায়ার জেদ ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল। সকালীর অসহায় ভাগ্যটাকে চুরি করতে চেয়েছিল দাশু। এই কুটিয়া গতরের ছায়া আর ছোঁয়া দিয়ে সকালীর খোঁপার সাদা ফুলের কুঁড়ির সব সাধ কালো করে দিতে চেয়েছিল। ছিয়া ছিয়া। মধুকুপির দাশু কিষাণেরও মনে এমন ভুল হয়?

–মন ভুল করেছিল বটে, কিন্তু কপালটা ভুল করে নাই দাশু! দাওয়ার উপর নিজেরই ছায়াটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলে দাশু আর চোখের চাহনিও প্রসন্ন হয়ে ওঠে। বেঁচে গিয়েছে সকালী; সুখের ঘরে চলে গিয়েছে। দাশুর মুক্তির পথে আর কোন বাধা নেই। কোন লোভের কাটা নেই; কোন মায়ার বেড়া নেই।

ক্যা ক্যা ক্যার্‌র্‌—একটা রাম শালিকের আতঙ্কের কর্কশ স্বর। হিংসুটে বিড়ালের চেহারা চোখে পড়লে ঠিক এইরকম আতঙ্কের কর্কশ রব ছাড়ে শালিকগুলি। দেখতে পায় দাশু, নিমের ডালে বসে শালিকটা দাশুরই দিকে তাকিয়ে এই অদ্ভুত আতঙ্কের কর্কশ বিলাপ ছাড়ছে আর কাঁপছে।

-আমাকে এত ডর কেন রে? হেসে ফেলে দাও। শালিকটার আতঙ্কের রব আরও কর্কশ হয়ে বেজে ওঠে। সত্যিই ভয় পেয়েছে শালিকটা। শালিকটা যেন দাশুর এই স্তব্ধ অস্তিত্বটাকে সহ্য করতে পারছে না। দাওকে মধুকুপির সেই দূরন্ত মাটিকাটা অহংকারের কিষাণ বলে চিনতেও পারছে না।

মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আর তেমনি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে দাশু। চোখে পড়ে, একটু দূরে দেড় বিঘা চাকরানের বুকটা যেখানে প্রকাণ্ড গর্ত হয়ে, পুরনো বঁটখোলাৰ যত ঝামা আর ঝুনোর হাড়গোড় নিয়ে হাঁ করে পড়ে আছে, সেখানে শিয়ালকাটার ঝোপের ভিতর থেকে সত্যিই একটা শিয়ালের মুখ উঁকি দিয়ে দাশুর দিকে তাকিয়ে আছে।

–তুই আবার কি ভাবছিস রে? বিড়বিড় করে দাশু।

শিয়ালটার মুখটা যেন একটা অভিযোগের মুখ। যে মানুষের জীবনে আর কোন কাজ নেই, সাধ নেই, আশা নেই, সে মানুষ এখনও এমন করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? কিংবা, দাশু কিষাণের এই ঘেয়ো চেহারাটাকে জীবন্ত মানুষের চেহারা নয় বলে সন্দেহ করছে শিয়ালটা?

একটা ভীমরুল। ভীমরুলটা যেন একটা রাগের গুঞ্জন তুলে দাশুর বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। উড়ে উড়ে ঘুরছে আর বার বার তেড়ে আসছে ভীমরুলটা।

–তুই আবার রাগিস কেন? কি শুধাতে চাস? বিড়বিড় করতে করতে দু পা এগিয়ে যেয়ে দাওয়ার একটা খুঁটো ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু।

-যাও যাও, মিছা আর হেথা দাঁড়িয়ে থাক কেন দাশু?

–হ্যাঁ, যেতে তো হবে; কিন্তু দাশুকে তোমাদিগের এত ঘিন্না কেন? কি পাপ করেছে দাশু কিষাণ?

–বুঝে দেখ।

-কি আর বুঝতে বল হে? শুধু নতুন হতে পারি নাই, এই পাপ করেছি। আর কোন পাপ করি নাই।

চালার বাতার একটা কাঠের গায়ে হঠাৎ ঠোকর লেগে ভীমরুলের ধড়টা ঝুপ করে মাটির উপর পড়ে, ছটফট করে, তারপরেই উড়ে উধাও হয়ে যায়।

ঘরের ভিতরে ঢুকে গামছাটাকে হাতে নিয়ে আবার বাইরে এসে দাঁড়ায় দাশু কালা বাদলের ঘোর তখনও দূরের আকাশের এক কোণে কালো হয়ে আছে। গামছাটাকে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নড়বড়ে জামকাঠের একটা কপাটকে যেন খিমছে ধরে দাশু। না, আর তোকে ঠেলা দিব না; এই ঘর আর বন্ধ করতে হবে না। তোকে খোলা রেখে দিয়ে চলে যাব। চৌকিদারীর পিয়াদা আর আদালতের বাবু এসে যদি নিলাম হেঁকে তোকে হেয় তো ছুঁবে। তুলে নিয়ে যায় তো নিয়ে যাবে। আমি আর তোকে ছুঁতে আসবো না।

ছটফট করে দাওয়া থেকে একটা লাফ দিয়ে নেমে নীচের ঘেসো মাটির উপর দাঁড়ায় দাশু। কিন্তু বুকের ভিতরে ভয়ানক একটা শূন্যতা ছটফটিয়ে ওঠে। বড় বিস্বাদ হয়ে গেল মুক্তির আনন্দ!

–হায় রে ঘর! হায়রে মধুকুপির মাটি!

–ছিয়া দাশু, মিছা আবার মনটাকে দুখাও কেন?

–কেন দুখাবে না বল? আমি কারও সুখ নাশ করি নাই; আমি কোন কসুর করি নাই; তবে আমার গতরে গরল ঢুকে কেন? আমার কুট হয় কেন?

–আঃ, আবার কেন ভুল কথা বল দাশু?

–না, আমি আজ জবাব নিয়ে যেতে চাই।

–জবাব কেউ দিবে না হে। কপালবাবাও দিবে না।

–তবে বল না কেন, কপালবাবার দয়াতে বিচার নাই।

–ছিয়া ছিয়া, এমন কথা বলতে নাই। কপালবাবার দয়াতে বড় ভাল বিচার আছে দাও।

–আমার সব সুখ নাশ হলো, এটাকে ভাল বিচার বল?

–তবে তুমি বল, কেমন বিচার?

–বড় মজার বিচার বটে।

–তবে তাই বটে।

–তাই বল না কেন? ঘেসো মাটির দিকে তাকিয়ে একটা অবুঝ বিস্ময়ের জ্বালা চোখে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। ছুটি নেবার উল্লাসটা মনমরা হয়ে বুকের ভিতর কাতাতে শুরু করেছে। এক মুঠো অবহেলার ধুলির মত ঝড়ের বাতাসে উড়ে গিয়ে ডরানির জলে পড়ে যাওয়া, বাস্, তারপর দাশু কিষাণের কোন চিহ্ন থাকবে না। বাঃ, কী মজাদার সাজা!

না, ভাল লাগে না। চোখের সামনের এইসব আলো-ছায়া দেখতে একটুও ভাল লাগে। দাশুর জন্য মায়া করে একটা পাখিও ডাকে না, একটা পাতাও কাঁপে না। দাশুর কথা ভেবে কোথাও কারও চোখ ভিজে না। বাঃ, কী সাজাদার মজা।

বুকের ভিতরে কলিজাটা যেন ফোঁপাতে শুরু করেছে। নিজেরই এই কুটিয়া শরীরটাকে আদর করে কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে করে। ত্রিশ বছর বয়সের কঠোর ধড়টা যেন এইটুকু একটা শিশুর নরম শরীর হয়ে যেতে চায়।

বিষুয়া পরবের সময় গোবিন্দপুর থেকে মেলা দেখে গাঁয়ে ফিরতে গিয়ে পথ চলতে চলতে বাপের কাছছাড়া হয়ে পিছিয়ে পড়েছে দাশু। বাপকে দেখতে না পেয়ে চেঁচিয়ে কেঁদেও উঠেছে। পথের ভিড়ের মানুষগুলি শুধাচ্ছে, তোমার কোন গাঁয়ে ধর, কার ছেইলা তুমি?

–কুথাকে গেলি রে বাপ। চেঁচিয়ে ডাক দিতে দিতে ছুটে আসছে দাশুর বাপ।এই তো আমি, কাঁদিস কেনে বাপ, কোন উর নাই বাপ। বলতে বলতে ছোট্ট ছাগলের বাচ্চার মত দাশুর সেই ছোট্ট নরম শরীরটা কাঁধের উপর তুলে নিয়ে পথ হাঁটতে থাকে দাশুর বাপ। দাশুর ধুলোমাখা পা দুটো বাপের কাঁধের দু পাশ থেকে ঝুলে বাপের বুকের উপর দুলতে থাকে। দাশুর সেই ধুলোমাখা পায়ে কত আদর করে হাত বোলাতে থাকে দাশুর বাপ।

দাশুর বুকের ভিতর থেকে যেন একটা মায়ার স্বর ড়ুকরে ওঠে।-তুই কোথায় আছিস রে বাপ?

কী আশ্চর্য, আজ দাশুর বুকটা যে ঠিক ওর বাপের গলার স্বর নিয়ে নিজের ছেলেটাকে ডেকে ফেলেছে। হ্যাঁ, বড় মিঠা ডাক, বড় মিঠা বাতাস। বড়কালুর বহেড়ার জঙ্গলের মাথা নড়ছে, ঝড়ের শব্দ শোনা যায়। কী মিঠা আওয়াজ। হাঁ, ওটা যে আমারই ছেইলা বটে। ডাগরটি হবে, জোয়ান হবে, বিয়া করবে, আমার পুতবহু যেন চাদপারা মুখটি হয় কপালবাবা।

কি যেন ভাবে আর হঠাৎ থর থর করে কেঁপে ওঠে দাশু।–ছেলাটা আছে তো?

আছে, নিশ্চয় আছে। মুরলীর কোলের আদরের কাছে আছে। ছেইলার লেগে মুরলীর মনে বড় মায়া ছিল। ছেইলাকে বাঁচিয়ে রাখবে বলেই না কিষাণের ঘরের দুখকে ঘিন্না করে পালিয়ে গেল মুরলী?

ছেইলাটাকে একবার দেখতে হবে। চল দাশু চল; আর দেরি কর কেন? হোই দেখ, আকাশে কালা বাদল জোর করেছে! জোর বৃষ্টি হবে। ডরানিতে হুড়পা বান ডাকবে।

ঢের দূর নয় হারানগঞ্জ। দৌড়ে দৌড়ে চললো চার ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়।

দৌড় দিয়ে সড়কের উপরে উঠতে গিয়েই থমকে দাঁড়ায় দাশু।–হেই দাশু; থাম হে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে রামাই দিগোয়ার।

কাছ এগিয়ে এসেই চমকে ওঠে রামাই–হেই দেখ, দাগীটার কুট হলো কবে?

সড়কের সেই দুরে বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু, যেখানে ডরানির লোহার পুলটা দেখা যায়, যেখান থেকে সড়কটা সোজা একটানা বাবুরবাজার চলে গিয়েছে। বাবুরবাজার থেকে সড়র ধরে সোজা হাঁটা দিলে হারানগঞ্জ পৌঁছে যেতেই বা কত সময় লাগবে? বড় জোর দেড় ঘণ্টা।

রামাই হঠাৎ সন্দিগ্ধ হয়ে দাশুর ঘরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে।-সকালীর খবর বল দাশু। ঘরে আছে কি নাই?

দাশু–নাই।

রামাই–ঢের চালাকি চলবে না দাশু। আমি দেখেছি, চৌধুরীজী দেখেছে, সকালী আজ সোহাগের খাকিটির মত সেজে নিয়ে ইদিক পানে এসেছে। তোমার কাছে আসে নাই কি?

–হ্যাঁ, এসেছিল।

–তবে, গেল কোথায়?

–ওর মরদের ঘরে চলে গেল।

–বেইদানী মাগির মরদটা আবার কে বটে?

–পলুস হালদার।

–আঁ? খিরিস্তান শিকারীটা?

–হ্যাঁ।

–কিন্তু, তুমি মাগিকে যেতে দিলে কেন? কি কথা ছিল মনে নাই?

–মনে ছিল।

–তবে?

দাশু সে-মনে ছিল, তাই না ওকে মরদের ঘরে যাওয়া করিয়ে দিলাম।

রামাই-এর চোয়াল দুটো রাগ করে চড়চড় করে বেজে ওঠে।-তুই কি আমার মাগের বড় ভাই বটিস রে দাগী? আমার সাথে রস করে কথা বলছিস।…তুই শালা সকালীকে কেন যেতে দিলি, বল?

দাশু–-তোমার সাথে কথা বলতে আমার আর সাধ নাই রামাই, তুমি যাও।

–চৌধুরীজীর মত মানুষের সাধে দাগা দিয়ে তুই কি পার পাবি রে দাগী? চেঁচিয়ে ওঠে রামাই।

উত্তর দেয় না দাশু।

রামাই আবার চেঁচিয়ে ওঠে—তোকে এখনি বুঝিয়ে দিব রে ঠগ। চল এখনই আমার সাথে চল।

দাশু মাথা নাড়ে।–না।

রামাই—চৌধুরীজীর কাছে গিয়ে জবাব দিবে চল, কেন তুমি সকালীকে চলে যেতে দিলে?

দাশু বলে—জবাব তো তোমাকে বলেই দিয়েছি। তুমি যাও।

রামাই-আবার পাঁচ বছর কয়েদ খাটতে সাধ হয়েছে কি?

দাশু হাসে–না।

রামাই-কিন্তু খাটতে হবে। চৌধুরীজীকে এখনই খবর দিব। ফাঁড়িতে আমারই ঘরে বসে আছে চৌধুরীজী। এখনই ঘোড়া ছুট করিয়ে যমের পারা এসে তোকে গেরেপ্তার করবে। ভেবে দেখ দাশু, ভাল কথা বলি, আমার সাথে চল।

দাশু–না।

রামাই–পালাবি ভেবেছিস?

উত্তর দেয় না দাশু।

–কোন শালার বাপ তোকে পালাতে দিবে? বলতে বলতে দৌড় দেয় রামাই দিগোয়ার। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে দেখতে থাকে দাও। নীল রঙের উর্দিপরা একটা ক্ষেপা জানোয়ারের মত রামাই দিগোয়ার সড়ক ধরে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে ছুটে চলেছে। এখনই খবর পাবে চৌধুরী; এখনই টাট্টুঘোড়ার সওয়ার হয়ে তড়বড় করে ছুটে আসবে একটা প্রতিহিংসার অপদেবতা। চৌধুরীর হাতের পিতলবধানো লাঠি, পিঠে ঝোলানো বন্দুক, ঝোলার ভিতরের হাতকড়া আর দড়ি; দাশুর মুক্তি পাওয়া ভাগ্যটাকে আবার মাঝপথ থেকে বাঁধাছাদা করে হাজত-ঘরের দিকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবার জন্য একটা বিভীষিকার দূত ছুটে আসবে। ছেইলার মুখ দেখবার যে সাধ, আর ডরানির জলের ঢলে কুটিয়া গতর উৎসর্গ করে দেবার যে সাধ দাশুর বুকের ভিতরে উতলা হয়ে উঠেছে, সে সাধ বিফল করে দেবার জন্য একটা অভিশাপ হন্তদন্ত হয়ে তেড়ে আসবে।

না, আর ধরা দিব না। দাশুর বুকের ভিতরেও একটা প্রতিজ্ঞা যেন চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু বাবুরবাজার হয়ে, গোবিন্দপুর সড়ক ধরে হারানগঞ্জের দিকে ছুটে চলে যেতে পারা যাবে না। ওই পথে চৌধুরীর ক্ষেপা আক্রোশ ট্রাটুঘোড়া ছুটিয়ে এসে পলাতক দাশুকে আটক করে ধরতে পারে।

খানাপিনার সেই জঙ্গল, যে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কোন ডহর নেই। মুলি বাঁশ, খেজুর, শাল আর কাটাকরঞ্জা; সেই সঙ্গে ফণী-মনসা ও আলকুশীর ঝোপে ভরাট হয়ে আছে খানাপিনার যে জঙ্গল, সে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কেউটের ছোব। আর পোবাঘা উঁড়ারের কামড় এড়িয়ে যদি এগিয়ে যেতে পারা যায়, তবে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে একেবারে গোবিন্দপুর সড়কে পৌঁছে যাওয়া যাবে। তারপর হারানগঞ্জ, যে হারানগঞ্জের ডাক্তার রিচার্ডবাবুর বাড়ির বাগানে দাশুর ছেইলার হাত ধরে হেসে হেসে ঘুরে বেড়ায় মুরলী।

দুরের সড়কের পাশে বাবলার সারির মাথার উপরে ধুলো উড়ছে। মনে হয় দাশুর, একটা ছুটন্ত টাট্টুঘোড়ার তড়বড়ে খুরের শব্দ ডরানির লোহার পুলের গায়ের উপর আছড়ে পড়ছে। পুলিশের চৌধুরীই ছুটে আসছে বুঝি!

লাফ দিয়ে সরে যায় দাও। সড়ক থেকে নেমে, পাকুড়তলায় ছায়া ধরে ছুটতে ছুটতে, নেড়া কাকুড়ে ডাঙাটাও এক দৌড়ে পার হয়ে গিয়ে খানাপিনার জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পড়ে দাশু। আলকুশির ঝোপ ঠেলে, উই-এর টিবি মাড়িয়ে, আর মুলি বাঁশের ধড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে থাকে।

এগিয়ে যায়, আর মাথার উপরে আকাশটার দিকে মাঝে মাঝে তাকায়। যা, ঝিলিক হানছে পুবের আকাশকোণের মেঘ; দিক ভুল হবার ভয় নেই।

হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাসের একটা ঝড় যখন দাশুর হাঁপধরা বুকের উপর এসে লুটিয়ে পড়ে, তখন বুঝতে পারে, সোজা তাকিয়ে দেখতেও পায় দাশু, খানাপিনার জঙ্গলের শেষ খেজুরের ভিড় পার হয়ে একটা খোলা ডাঙার কাছে চলে এসেছে। গোবিন্দপুরের সড়ক দেখা যায়। সড়ক ধরে ছুটে চলেছে ঝালদা যাবার মোটরবাস।

গামছা দিয়ে মাথা আর মুখের খানিকটা ঢেকে নিয়ে, সড়কের দিকে একজোড়া সন্দেহের চোখ আর সতর্ক চাহনি তুলে তাকিয়ে থাকে দাশু। টাট্টুঘোড়ার সওয়ার হয়ে ছুটোছুটি করছে

তো কোন অভিশাপ?

না, কোন ছুটন্ত টাট্টুঘোড়ার শব্দ তড়বড় করে বাজে না। এখন এই সড়কে উঠে সোজা পূর্ব দিকে হাঁটা দিলে হারানগঞ্জের পথ পাওয়া যাবে, গির্জাবাড়ির চূড়াটাও দেখা যাবে।

ডাঙাটাও এক দৌড়ে পার হয়ে সড়কে উঠেই হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় দাও। অনেক মানুষের একটা ভিড় একেবারে কাছে এসে পড়েছে। ভিড়ের সঙ্গে পুলিসের লালপাগড়িও দেখা যায়।

লাঠি কাঁধে নিয়ে তিনজন পুলিশ ভিড়ের আগে আগে আসছে। দুটো গো-গাড়ির চাকার ককানির পিছু পিছু ভিড়ের সোরগোলও ছটফট করতে করতে এগিয়ে আসছে। সড়কের কিনারায় একটা গাছের গা ঘেঁষে প্রায় গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। বুকটা থর থর করে। এত পুলিশ যখন, তখন চৌধুরীও কি নাই?

ও কি? কার নাম করে চেঁচিয়ে উঠছে আর কথা বলছে ভিডের মানুষগুলি?

চমকে ওঠে দাশু। ভিড়টা যেন একটা বিস্ময়ের মিছিলের মত ছটফট করে দাশুর ভীরু চোখের চাহনির একেবারে কাছে এসে পড়ে।

–চৌধুরী মরলে। চৌধুরীকে কাটলে। টাঙ্গি দিয়ে দুটা কোপ দিল রামাই-এর মাগ মঙ্গলী; বাস্! চৌধুরীর ধড় আর মুড়া দুই ঠাঁই হয়ে গেল।

এ কি কথা বলে ওরা? গামছাটাকে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে সড়কের কিনারা থেকে সরে এসে ভিড়ের কাছে দাঁড়ায় দাশু। ভিড়ের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। ভিড়ের সোরগোলের ভাষা শুতে থাকে।

–হুঁ হে, মঙ্গলীর ইজ্জত নাশ করতে চেয়েছিল মাতোয়াল চৌধুরীটা। এমন পিশাচকে কাটবে নাই কেনে মঙ্গলী?

-চুপ কর, চুপ কর! হাঁক ছাড়ে একটা পুলিশ।

-ঢের দিনের পাপের বিচার এক দিনেই হয় হে। সাদা চুলে ভরা মাথা দুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো যে বুড়োটা, তার কাছে এগিয়ে এসে ফিস ফিস করে দাশু–কি ব্যাপার বটে, কাকা?

বুড়ো বলে-রামাই দিগোয়ার চৌধুরীটাকে ঘরে বসা করাই ভিন গাঁয়ে দাগীর খবর করতে গিয়েছিল। চৌধুরীটা রামাই-এর মাগের হাত চেপে ধরলেক; তখন রামাই-এর মাগ টাঙ্গি লিয়ে এইসে…। হোই দেখ না কেনে, কেমন ডাঁট করে বসে আছে মঙ্গলী।

আগে আগে চলেছে যে গো-গাড়িটা, তারই ভিতরে গদির উপর চুপ করে শক্ত হয়ে বসে আছে রামাই-এর মাগ মঙ্গলী। মঙ্গলীর কোমরে দড়ি। একটা পুলিশ সেই দড়ি টানা হাতে ধরে নিয়ে গো-গাড়ির পিছু পিছু হেঁটে চলেছে। মঙ্গলীর মাথার চুল ক্ষেপীর মাথার চুলের মত ছন্নছাড়া ও এলোমেলো হয়ে মুখের চারদিকে লুটিয়ে রয়েছে। তারই মধ্যে দেখা যায়, নিথর হয়ে রয়েছে মঙ্গলীর এক জোড়া শান্ত চোখ।

–রামাই দিগোয়ার ঘরে ফিরে এসে চৌধুরীর মুড়াটার দিকে একবার লজর করে নিয়ে সেই যে ভাগলেক আর উয়ার পাত্তা নাই। হেই দেখ না কেনে…। বুড়া মাহাতে হাত তুলে পরের গো-গাড়িটা দেখিয়ে দিতে গিয়ে মুখ টিপে হেসে ফেলে।

গো-গাড়ির ভিতরে চৌধুরীর লাস খড় দিয়ে ঢাকা। শুধু পায়ের পাতা দুটো বের হয়ে আছে। চৌধুরীর লাসের ঠিক বুকটার উপর রক্তাক্ত কম্বলে জড়ানো একটা বস্তু পড়ে আছে। কম্বলের পোটলাটা বেশ খানিকটা ফাঁক হয়েও আছে। সেই ফাঁক দিয়ে চৌধুরীর নাকটা আর কর্কশ গোঁপের একটা গোছা উঁকি দিয়ে রয়েছে।

মুখ ফিরিয়ে নেয় দাশু। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিড়টা তেমনই বিস্ময়ের মিছিলের মত বিচিত্র হাঁকডাক আর চিৎকারে মুখর হয়ে গোবিন্দপুর থানার দিকে যাবার জন্য সোজা সড়ক ধরে এগিয়ে যেতে থাকে।

আর কতদূর? আর বেশিদূর নয়। এখান থেকে আস্তে আস্তে হাঁটা দিলে হারানগঞ্জে পৌঁছে যেতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে এগিয়ে যেতে পারা যাবে। হ্যাঁ, পাঁচ বছরের জন্য আবার কয়েদ হবার বিভীষিকা দাশুর ভাগ্যের পিছনে আর ধাওয়া করে ছুটে আসছে না। আস্তে আস্তে হাঁটা দিলেও চলবে।

ভিড়ের সোরগোল আর শোনা যায় না। জোরে একটা হাঁপ ছাড়ে দাশু। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাতে গিয়েই দেখতে পায়, হারানগঞ্জের গির্জাবাড়ির চূড়ার উপর দিয়ে বড় সুন্দর বিজলীর চমক ছটফটিয়ে উঠলো।

চলতে থাকে দাশু।

নীরব সড়কের এক কিনারা ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে দাশু। হারানগঞ্জের গির্জার সেই শান্ত ও সুন্দর চেহারাটাও দাশুর ব্যাকুল চোখের ধেয়ো চাহনির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে। আর সের দূর নয় হারানগঞ্জ।

জেলা বোর্ডের রাস্তাটা এসে গোবিন্দপুর রোডের গা ছুঁয়েছে যেখানে, সেখানে এসে পৌঁছতেই একবার থমকে দাঁড়ায় দাশু। একটা বুড়ো বট ছি। এখানে সেটা আর নেই। নতুন একটা ইমারত দেখা যায়। ইমারতের গায়ে নানা রঙের ছবির বাহার, মাথার উপরে একটা চোঙা; চোঙার মুখ থেকে কলের গানের ঝমঝমে আওয়াজ উথলে পড়ছে।

যেন ঝমঝমে হল্লার একটা নতুন জগৎ। কত মানুষ এসে ভিড় করেছে। হাসছে, কথা বলছে, হাঁকডাক করছে, ছটফটিয়ে ছুটোছুটি করছে। পয়সা দিয়ে মজা কিনবার বাজার বটে কি? তাই তো মনে হয়। কলে: ছবির হাসা কাদা দেবার আর শুনবার জন্য কত মানুষ ভিড় করেছে।

পথ চলতে থাকে দাশু। কিন্তু পথটা আর নির্জন হয় না, নীরবও হয় না। দেখতে পায় দাশু, ছোট ছোট হল্লার উৎসব দাশুর আগুপিছু হেঁটে হেঁটে চলেছে। ছোট ছোট ভিড় কথা বলছে, হাসছে, হাঁকডাক করছে আর চলছে। এরা যায় কোথায়? কালীথানের মেলা কি শুরু হয়ে গেল?

দাশুর পিছন থেকে একটা লোক রাগ করে চেঁচিয়ে ওঠে–তুমি আমাদিগে এমন দয়াটি না করলেই ভাল করতে হে সরদার?

মুখ ফিরিয়ে তাকায় দাশু। লোকটা বলে এই রোগের শরীর নিয়ে তুমি আবার সভার ভিড়ে যাও কেন?

–কিসের সভা?

–ভোটের সভা।

–কোথায়?

–পাহাড়তলীতে।

দাশু হাসে-রাগ করবে না বাপ, আমি তোমাদিগের সভার ভিড়ে যাব না।

নতুন রেল লাইনের পাশে পাশে গড়িয়ে এসে একটা নতুন সড়ক যেখানে গোবিন্দপুর রোড ছুঁয়েছে, সেখানে এসে আবার থমকে দাঁড়ায় দাশু। সড়কটা ঝালদার দিক থেকে এসেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এত শব্দ করে কেন, আর এত ধুলো উড়ায় কেন নতুন সভুকটা? কত রকমের শব্দ হু হু করে, গোঁ-গোঁ করে, হা-হা করে ছুটে আসছে।

ছুটে এল আর চলে গেল বড়-বড় মোটরগাড়ির মিছিল। মিলিটারির কামানগাড়ি, একটা দুটো নয়, দশটা বিশটা নয়, অনেক অনেক। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আর তাক করে গলা উঁচিয়ে রয়েছে কামানগুলি।

ধুলোর ঝাপটা সহ্য করবার জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু, আর শুনতেও পায়, পথের লোকগুলি হাততালি দিয়ে হল্লা করে উঠেছে,এরা কাশ্মীরে গিয়েছিল হে। এক সাল হলো এরা লাইনে ছিল; এইবার জিরাবার ছুটি মিলেছে, তাই রাঁচির পল্টনবারিকে ফিরে চলেছে।

হাঁটতে থাকে দাশু। কিন্তু সড়কের শব্দের উৎসব যেন ফুরাতে চায় না। বড় বড় মোটর লরিতে বোঝাই হয়ে লোহা-লক্কড়ের এক একটা ছোট ছোট পাহাড় ছুটে চলে গেল। পথের লোক বলে-ভুবনপুরের নতুন সীসাগালাই কারখানার মাল গেল হে।

চলতে থাকে দাশু। সড়কেরই পাশের মাঠে এক জায়গায় অনেক তাঁবু পড়েছে। তাবুর বাইরে ছোট ছোট বাক্সের উপর বসে বাবুরা পেয়ালা হাতে নিয়ে চা খাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে। পথের ভিড় বলাবলি করে—এরা ধানবাদের খাদের ইস্কুল থেকে এসেছে হে। তামার পাথরের খোঁজ নিতে এসেছে ভুবনপুর হতে শুরু করে মধুকুপি, সব মাটি এরা জরিপ করবে।

এগিয়ে যায় দাও।

না, আর এই সড়ক ধরে এগিয়ে যেতে হবে না। এইবার সামনের মোড়ের কাছে পৌঁছে ডাইনের সড়ক ধরতে হবে। হারানগঞ্জ এসে গিয়েছে। গির্জাটা কত কাছে এসে পড়েছে।

এই তো হারানগঞ্জের কবরথান। আর ঢের দূর নয় রিচার্ড ডাক্তারের ফুলবাড়ি। পথের পাশের ঐ লাল রঙের বাড়িটার ফটকের কাছে যে ছোট রাস্তাটা বাঁয়ে চলে গিয়েছে, সেই রাস্তায় আরও কিছু দূর এগিয়ে গেলেই..1

কিন্তু ফটকের কাছে এসেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় দাশু। বাঁয়ের সেই ছোট রাস্তা ধরে আবার একটা মিছিল হাঁক দিতে দিতে ঝাণ্ডা দুলিয়ে এগিয়ে আসছে।

কিন্তু মিছিলটার জন্য নয়। মিছিলটাই কোন বাধা নয়, বিস্ময়ও নয়। মিছিলটার দিকে আর তাকায়ও না দাশু। ফটকের কাছে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিস্ময়ের দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে দাশু।

রোদ নেই, মেঘে ছাওয়া আকাশ। তবু, ছোট্ট একটা রঙিন ছাতা মাথার উপর মেলে দিয়ে যেন ঝলমলে হাসির এক শ্যামলী রূপসী দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলা দিনের ময়লা আভা ছাতার রঙিন কাপড় ছুঁয়ে আর রঙিন আভাটি হয়ে রূপসীর মুখের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।

মিছিলটার দিকে তাকিয়ে আছে আর হাসছে রূপসী। নমনরম ঠোঁট দুটোকে যেন গরব করে ফুলিয়ে ফুলিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসছে। শাড়ির আঁচল ফুরফুর করে উড়ছে। গলার সোনার হার দুলছে। সোনার হারের পাথরে আর কালো চোখের তারা দুটোতে একই রকমের হাসি ঝিকমিক করে জ্বলছে।

শ্যামলী রূপসীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরতার এক শুভ্রা মূর্তি। তার ধবধবে সাদা চুলের খোপা এই মেঘলা দিনের ময়লা আভাতেও চিকচিক করে। লাল মুখে কী সুন্দর হাসি। নীল চোখে কী সুন্দর আলো! বাঁশ আর শালপাতা দিয়ে তৈরি একটা দেহাতী ছপিছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বুড়ো বয়সের এক মেম।

ওরা দুজনে হেসে হেসে মিছিল দেখছে। আর, দাও ওদেরই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মিছিলটা ডাক্তার রিচার্ড সরকারকে ভোট দেবার জন্য হাঁক দিয়ে আবেদন করছে। আর, ওরা দুজনে যেন প্রাণের খুশীতে বিভোর হয়ে মিছিলের হকের শব্দ শুনছে।

চলে গেল মিছিলটা। চলন্ত মিছিলের দিকে এক হাত তুলে রুমাল দোলাতে দোলাতে হেসে ওঠে মুরলী, আর-এক হাতে রঙি ছাতা কাত করে মুখের উপর রঙিন আভা ধরে রাখে। তার পরেই বাস্ত হয়ে ওঠে-চল দিদি।

–চল জোহানা। বলতে বলতে এক পা এগিয়ে যেয়েই চমকে ওঠেন সিস্টারদিদি।–মার্সি! মার্সি!

–কি বটে দিদি? চমকে ওঠে মুরলী।

–লেপার বটে। মানুষটার কুষ্ঠ হয়েছে। সিস্টারদিদির চোখ দুটো মায়াময় বেদনায় করুণ হয়ে দাশুর কুটিয়ার গতরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মুরলীও তাকায়। সেই মুহূর্তে রঙিন ছাতা দিয়ে মুখটা আড়াল করে দু পা পিছিয়ে সরে যায় মুরলী। রঙিন ছাতা থরথর করে কাঁপতে থাকে।

দাশুর কাছে এগিয়ে আসেন সিস্টারদিদি।–কোন চিন্তা নাই। কোন ডর নাই। তোমার রোগ আরাম হয়ে যেতে পারে।

–তুমি কি সিস্টারদিদি? সিস্টারদিদির মুখের দিকে অকিয়ে দাশুর চোখের ঘেয়ো চাহনি যেন মুগ্ধ হয়ে ছলছল করতে থাকে।

সিস্টারদিদির নীল চোখ দুটো একটু আশ্চর্য হয়ে কেঁপে ওঠে।-কেন, তুমি কি আমাকে আগে কখনো দেখ নাই?

–না।

–আশ্চর্যের কথা! যা-ই হোক, তুমি বিশ্বাস কর, তোমার রোগ সেরে যাবে।

যেন সান্ত্বনার দেবী কথা বলছেন। কী মিঠা কথা, কী মিঠা চাহনি! দাশুর কুটিয়া শরীরের উপর যেন আরামের ওষুধ ঝরে পড়ছে। সিস্টারদিদির হাত দুটো যেন মায়া করবার জন্য ছটফট করছে; দাশুর গায়ে এখনই বুঝি হাত বুলিয়ে দেবে সিস্টারদিদি।

সিস্টারদিদি–আমার আসাইলামে তোমাকে ভর্তি করে নিব। তুমি খাওয়া পাবে, কাপড় পাবে, বিছানা পাবে, ওষুধ পাবে, আর আমার সেবা পাবে।

হাত তুলে চোখ দুটো মুছতে চেষ্টা করে দাশু।–এত দয়া কেন দিদি?

সিস্টারদিদি-ভুল কথা বল কেন ম্যান? আমার দয়া নয়। তোমার আমার পরম পিতা যিনি, তাঁর দয়া।

বড় ভাল কথা বটে, দিদি। মাথা হেঁট করে সিস্টারদিদির পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে দাও।

এখন দেখলে তো দাশু? বুঝে দেখ, সিস্টারদিদিকে কত ভুল বুঝেছিলে। সিস্টারদিদির দয়ার রকমটি দেখ। সিস্টারদিদির মনে কোন হিসাব নাই। শুধু মায়ার লেগে মায়া করে সিস্টারদিদি।

এমন শান্তির ঠাঁই পেলে কে না জিরাবে বল? ছিয়া ছিয়া, মিছা রাগ করে মরণ চাও কেন, বল? হ্যাঁ দাও, এত ভাল জিরাবার ঠাঁই আর কোথাও পাবে না। রাজি হয়ে যাও দাও।

মুখ তুলে সিস্টারদিদির মুখের দিকে আবার তাকায় দাশু।

সিস্টারদিদি-বিশ্বাস করে একবার প্রেয়ার সাধলেই তোমার সব দুখের অবসান হয়ে যাবে। প্রেয়ারের চেয়ে মহৎ ওষুধ নাই।

চমকে ওঠে দাশু।–কিসের প্রেয়ার দিদি?

সিস্টারদিদি।–প্রেয়ার, প্রার্থনা। আসাইলামে রোজ দুইবার প্রার্থনা হয়। যারা ঈশাই মানে আর প্রার্থনা করে, তাদের উপর পরমপিতা বিশেষ দয়া করেন।

দাশু–আমাকে কি তুমি ঈশাই মানতে বলছো, দিদি।

সিস্টারদিদি-হ্যাঁ, তোমার মঙ্গলের জন্য বলছি।

দাশুর চোখের তারা দুটো জ্বলে জ্বলে হাসতে থাকে–না দিদি।

–কি বললে? দুই চোখের চাহনি টান করে কথা বলেন সিস্টারদিদি।

–আমাকে খিরিস্তান হতে বলো না।

–কিন্তু খিরিস্তান না হলে আমি তোমাকে আসাইলামে ঠাঁই দিব কেমন করে?

–দিবে না তত দিও না।

–বহুৎ আচ্ছা! কিন্তু আমি তোমার সেবা ছেড়ে দিতে চাই না। সপ্তাহে একটিবার যদি আসাইলামের হাসপাতালের বাহির দরজায় এসে দাঁড়াও, তবে ওষুধ পাবে। তাতে যদি বাঁচ তো বাঁচবে।

–না।

–কি? ভ্রূকুটি করেন সিস্টারদিদি।

–তোমর ওষুধ নিতে আমার সাধ নাই।

সিস্টারদিদির নীল চোখের চাহনি কাঁপতে থাকে। তা হলে এই রোগের গরলে তোমার দেহ যে গলে যাবে।

–যাক না কেন?

–রোগে র নাই?

–না।

–কেন?

–এই রোগ রোগ নয়।

–তবে কি?

–কপালবাবার খেলা।

–কার খেলা? সিস্টারদিদির চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে।

দাশু শান্তভাবে হাসেকপালবাবার খেলা বটে গো, দিদি।

সিস্টারদিদি–কে সে?

কপালের মাঝখানে হাতের একটা ভোতা আঙ্গুল চেপে ধরে হাসতে থাকে দাশু—এই!

–যাও! চেঁচিয়ে ওঠেন আর মুখ ফিরিয়ে নেন সিস্টারদিদি।

দাশু–যাব দিদি, যাব। তোমার হারানগঞ্জে ঠাঁই নিতে আমি আসি নাই।

সিস্টারদিদি-ভিখ মাগতে এসেছ বোধহয়?

দাশু–না।

সিস্টারদিদি-তবে কেন এসেছ?

দাশু–আমার ছেইলাকে দেখতে এসেছি।

–তোমার ছেলে? ওয়েল..তোমাকে পাগল বলে মনে হয়।

–পাগল মনে কর যদি, তবে কর। কিন্তু আমার ছেইলা এখানে আছে।

–কোথায় আছে?

–ওই যে, ওর কাছে আছে।

কার কাছে? দাশুর হাতের ইঙ্গিতটার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন সিস্টারদিদি। পাগলটা হাত তুলে জোহানাকে দেখিয়ে দিয়ে মুখ টিপে হাসছে। কিন্তু, কী আশ্চর্য জোহানার রঙিন ছাতাটা থরথর করে কাঁপছে। ছাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে আছে কেন জোহানা?

–জোহানা? লোকটা এমন মিথ্যা কথা বলে কেন? চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়ে সিস্টারদিদির গলার স্বর ভীরু হয়ে ফিসফিস করে।

ছাতার আড়ালে তেমনি মুখ লুকিয়ে রেখে যেন রঙিন রাগের নাগিনীর মত হিসহিস করে ওঠে মুরলী মিথ্যা কথা নয়; ভুলে যাও কেন, দিদি?

সিস্টারদিদি-এই কি তোমার সেই…।

মুরলী-হ্যাঁ।

দাশুর গলার স্বর একেবারে নরম হয়ে গিয়ে যেন আবেদন করে—ওকে বল দিদি, এখনি আমার ছেইলাকে নিয়ে এসে আমার নজরের কাছে একবার রাখুক।

রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সিস্টারদিদি শান্ত স্বরে বলেন-তোমার ছেলে এখন ঈশ্বরের ছেলে হয়ে গিয়েছে, তাকে দেখে তোমার লাভ কি?

–কি বললে দিদি? আমার ছেইলা কি তবে আর নাই?

–আছে আছে; অনাথবাড়ির দয়াতে মায়াতে আর আদরে সে ছেলে খুব ভাল আছে।

–অনাথবাড়িতে? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

–হ্যাঁ। মৃদু স্বরে উত্তর দেন সিস্টারদিদি।

হেসে ফেলে দাও তোমার বহিনকে তুমি এটা কেমন সুখ দিলে দিদি?

–কি বললে?

—পেটের হেইলাকে কোলে নিতে পারলে না যে, সে মানুষ কেমন সুখের মানুষ বটে?

সিস্টারদিদি—বাস্‌, তুমি এখন যাও।

—আমার ছেইলাকে দেখাও, তবে যাব।

সিস্টারদিদি-ওই দেখ।

লাল রঙের যে বাড়িটার ফটকের কাছে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কথা বলছেন সিস্টারদিদি, সেই বাড়িটার বারান্দার দিকে হাত তুলে দাশুকে কি যেন দেখতে বলেন।

–কি দেখতে বলছে দিদি? আশ্চর্য হয়ে বাড়ির বারান্দার দিকে তাকায় দাও। দেখতে থাকে দাশু, ভাল করে হাঁটতে পারে না আর হামা দেয়, এমন বয়সের ছেলেমেয়ে বারান্দার সেই লিখা-পড়ার ঠাই-এর কাছে কিলবিল করছে। একটা বুড়ি মানুষ বারান্দার এক কোণে বসে, মাথার সাদা চুলের ঝুটি মেলে দিয়ে আর চোখ বন্ধ করে তুলছে।

বারান্দার উপর একদল ছোট ছোট ছেলে আর মেয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে। একটি ডাগর মেয়ে খড়ি হাতে নিয়ে একটা কালো তক্তার উপর কি-যেন দাগছে আর বলছে, সঙ্গে সঙ্গে গলা মিলিয়ে সুর করে চেঁচিয়ে উঠছে ছোট-ছোট ছেলেমেয়ের দল।

কালো তক্তার উপর খড়ি দিয়ে আঁক দেগে হাঁক দিল ডাগর মেয়েটি।নয়ের পিঠে নয় এল এল।

ছোট-ছোট ছেলেমেয়ের দল সুর করে চেঁচিয়ে ওঠে-নিরানব্বই বল বল।

ডাগর মেয়েটি বেণী দুলিয়ে কালো তক্তার উপর আবার খড়ির দাগ দেগে দুলতে থাকে : দশের পিঠে শুন্য এল।

ছেলেমেয়ের দল ছটফট করে চেঁচিয়ে ওঠে–এক শত বল বল।

–শতকিয়া খতম বল। খড়ি ফেলে দিয়ে হাত তুলে হাঁক দেয় ডাগর মেয়েটি।

শতকিয়া খতম! শতকিয়া খতম! কলকল করে আর লাফিয়ে বারান্দা থেকে নেমে বাগিচার চারদিকে ছুটোছুটি করতে থাকে ছেলেমেয়ের দল। গায়ে সাদা কাপড়ের হাতকাটা জামা, আর পরনে কালো কাপড়ের জাঙ্গিয়া, অনাথবাড়ির আদরে পোষা এক দল খুশির খরগোশ ছুটোছুটি করছে।

—এইবার যাও। দাশুর হতভম্ব চোখের দিকে তাকিয়ে আবার হাঁক দেন সিস্টারদিদি।

দাশু–কেন যাব? আমার ছেইলা কই?

সিস্টারদিদি-ওদেরই মধ্যে আছে। যাকে খুশি তাকে তোমার ছেলে বলে ভেবে নাও, আর খুশি হয়ে চলে যাও।

–না, সে হয় না।

–কেন? ওদের দেখতে কি ভাল লাগে না?

–খুব ভাল লাগে। বেঁচে থাকুক ওরা। কিন্তু…।

–আবার কিন্তু কিসের? তোমাকে বড় জেদী মানুষ বলে মনে হয়। বিরক্ত হয়ে ধমক দেন সিস্টারদিদি।

দাশু–ধমক দিও না দিদি। আমার হাড়মাসে জন্ম নিলে যে, তাকে আমি একবার দেখে নিয়ে চলে যেতে চাই। তুমি মানা করবার কে?

সিস্টারদিদির কানের কাছে ফিসফিস করে কি-যেন বলে মুরলী। আর সিস্টারদিদিও অনাথবাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে ডাক দেন-আনিয়া বহিন।

বারান্দার কোণ থেকে জনের মা আনিয়া বুড়ির ঢুলে পড়া মাথাটা হঠাৎ চমকে ওঠে। হস্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে জনের মা আনিয়া বুড়ি-কি বটে? কি আজ্ঞা হয় দিদি?

সিস্টারদিদি-জোহানার যে ছেলে অনাথবাড়িতে আছে, সেই ছেলেকে….

আনিয়া বুড়ি মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক উল্লাসের জ্বালায় যেন নাচতে থাকে—হুঁ হুঁ  দিদি, বড়টি হয়েছে সেই ছেইলা। জোহানা বহিন কি ছেইলার মুখ দেখবে, দিদি?

মুখ ফিরিয়ে নেয় মুরলী। সিস্টারদিদি গম্ভীর হয়ে বলেন-সেই ছেলেকে একবার নিয়ে এস।

নাচতে নাচতে চলে যায় জনের মা আনিয়া বুড়ি। অনাথবাড়ির বাগিচায় খরগোশের পালের মত হুটোপুটি করছে যারা, তাদেরই ভিতর থেকে একটা ছোট্ট মানুষকে খপ করে ধরে আর কোলে তুলে নিয়ে আবার নাচের ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে ফটকের কাছে ছুটে এসে বিড় বিড় করে-গড বাবা দয়া করেন।

কিন্তু হঠাৎ ভয় পেয়ে আর রাগ করে চেঁচিয়ে ওঠে আনিয়া বুড়ি-হায় গড, কুটিয়াটা এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন গো?

গায়ের কাপড়ের আঁচল দিয়ে ছেলেটাকে ঢেকে এক লাফ দিয়ে সরে গিয়ে পথের পাশের একটা কচি কদম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে আনিয়া বুড়ি।

এক-পা দু-পা করে কচি কদমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে দাশু। সিস্টারদিদি চেঁচিয়ে ওঠেন-সাবধান, তোমার এই রোগের দেহ নিয়ে তুমি লিটল বাবার কাছে যাবে না।

দাশু–না, খুব কাছে যাব না দিদি। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখবো। কিন্তু, ছেইলার মুখ ঢাকা দেয় কেন বুড়িটা?

সিস্টারদিদির ইসারা পেয়ে আনিয়া বুড়ি ছেলেটার মাথা থেকে আঁচলের ঢাকা সরিয়ে দেয়। বছ আড়াই বয়স, মোটা-সোটা ফোলা-ফোলা গাল, মাথাটা কোঁকড়া চুলে ঠাসা, ছেলেটা আনিয়ার কোল থেকে নেমে যাবার জন্য ছটফট করে হাত-পা ছুঁড়তে থাকে।

–বাপার কেমন সুন্দর দাঁত হয়েছে গো! মাথা ঝেকে হিহি করে হাসতে থাকে দাশু–কিন্তু বাপাকে সুখে রাখবে কি কপালবাবা? দুই চোখ চিকচিকিয়ে আর ঠোঁট কাঁপিয়ে বিড়বিড় করে দাশু।

সিস্টারদিদি–ব্যস, নো মোর, তুমি সর, তুমি যাও।

দাশু হাসে।–বাপা বড় ভাল চুমা দিতে জানে মনে হয়।

আনিয়া বুড়ি ভয় পেয়ে জকুটি করে জানে তো, কিন্তু তাতে তোমার কি? তুমি সর না কেন?

দাশু–বাপা একবার চুমা দিক না কেন?

–হেই! গর্জন করে ওঠে আনিয়া বুড়ি।

দাশু হাসে।আমাকে নয় গো। এই গাছটাকে চুমা দিক বাপা।

আনিয়া বুড়ি ভ্রূকুটি করে।–তামাসা বটে কি? কি ভেবেছ তুমি?

দাশু–তামাসা নয় বুড়ি মা দেখতে সাধ হয়, বাপা কেমনটি চুমা দিতে শিখলে।

আনিয়া বুড়ির কাকাল কাঁপিয়ে দিয়ে ছেলেটা আবার ছটফটিয়ে ওঠে। যেন একটা দূরন্ত আহাদের খেলার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছে ছেলেটা। মাথা হেলিয়ে কচি কদমের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে দিয়ে হাসতে থাকে।

নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে দাশু। কচি কদমের গায়ে ছেলেটার মুখের লালা লেগে ছোট্ট একটা ভেজা-ভেজা ছাপ ফুটে উঠেছে। সেই ছাপের দিকে তাকিয়ে পিপাসিতের মত ছটফট করে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–তুমি এখন সর বুড়ি মা, জলদি সরে যাও।

আনিয়া বুড়ি সরে যায়। ছেলেটাকে কোলের উপর শক্ত করে চেপে ধরে একটা দৌড় দেয়। অনাথবাড়ির একটা ঘরের কাছে এসে ছেলেটাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে হাঁপ ছাড়ে আর হাঁপাতে থাকে আনিয়া বুড়ি।

আর, কচি কদমটার গায়ের উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে দাও। দু হাতে গাছটাকে জড়িয়ে ধরে, ছেলেটার লালায় ভেজা ছাপের উপর মুখটাকে চেপে ধরে আর চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকে।

সিস্টারদিদির চোখ দুটোও চমকে চমকে কাঁপে। লোকটা কেঁপে কেঁপে কাঁদছে? না, হাসছে? ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

কী ভয়ানক কালো হয়ে গিয়েছে হারানগঞ্জ! আকাশ জুড়ে কালো মেঘ নিরেট হয়ে গিয়েছে। জোর হাওয়া ছুটতে শুরু করেছে। আকাশের সব দিকে লিকলিকে বিদ্যুতের সাপ ঝিলিক দিয়ে খেলছে। ডাঙার ওপারে অনেক দূরে, শালবনের উতলা চেহারার পিছনে ডরানির স্রোতটাও গোমরাতে শুরু করে দিয়েছে।

–চল জোহানা, চল। দিশেহারা পলাতক মানুষের মত হঠাৎ ভয় পেয়ে আর ব্যস্ত হয়ে ডাক দেন সিস্টারদিদি।

-চল দিদি, চল। মুরলীর গম্ভীর মুখটা যেন একটা আতঙ্কের রব ছেড়ে কাঁপতে থাকে।

আকাশ-জোড়া কালা বাদলের দিকে তাকিয়ে আর একেবারে নীরব হয়ে ওঠে দাশু। ঝুরঝুর করে বৃষ্টি ঝরে পড়ে।

অনাথবাড়ির ছেলেমেয়ের দল বাগিচা থেকে ছুটে গিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে। ফটক পার হয়ে অনাথবাড়ির বারান্দার দিকে ছুটে চলে যান সিস্টারদিদি। শন্ শন্ করে একটা ক্ষেপা হাওয়ার ঝাপ্টা এসে মুরলীর রঙিন ছাতার উপর আছড়ে পড়ে। কিন্তু এগিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় মুরলী।

যার মুখটা না দেখবার জন্য এতক্ষণ ধরে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছিল মুরলী, সেই লোকটা মুরলীরই পাশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল।

একটা কথাও বলল না, মুরলীর চোখের এত কাছে এসেও একবার থমকে দাঁড়াল না। কিন্তু মুরলীর মুখটার দিকেও কি একবার তাকায় নি? তাকায় নি বোধহয়। তা না হলে এত সহজে একেবারে উদাসী সাধুর মত চুপ করে চলে যায় কেমন করে?

কতদূর গিয়েছে? মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ পিছন দিকে তাকায় মুরলী। আর, তাকাতে গিয়েই ডাক দিয়ে ফেলে-শুনছে।

মুখ ফিরিয়ে তাকায় দাশু কুরু কুরু বৃষ্টির ধারা যেন একটা ঝাপসা পর্দা। মুরলীর মুখটাকে স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু আবার শুনতে পায় দাশু, যেন ঝালদার মহেশ রাখালের বেটির গলার স্বর ব্যাকুল হয়ে ডাকছে-শুনছো!

হ্যাঁ, মুরলীই ডাকছে। ওই তো দাড়িয়ে আছে মুরলী। ঝড়ের হাওয়ার মধ্যে কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে, সেই পুরনো গলার স্বর উতলা করে দিয়ে ডাকছে। কিন্তু ডাকে কেন মুরলী? এটা আবার তোমার দয়ার কোন মজা বটে কপালবাবা? মুরলী কি দাশু কিষাণকে ওর রংদার ছাতার তলে ঠাঁই নিতে ডাকছে?

–একটা কথা বলতে চাই; শুনে যাও। বুরু বুরু বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে যেন গলার স্বরের একটা মিঠা মায়া মিশিয়ে দিয়ে, যেন দাশুর অভিমান ভাঙবার জন্য আবার ডাক দিয়েছে মুরলী।

–কি কথা? বলতে গিয়ে দাশুর পা দুটো টলমল করে ওঠে।

মুরলী-ভাল কথা বলতে চাই, কাছে এসে শুন।

ভাল কথা! দাশু কিষাণের প্রাণের অস্তিমটাকে কাছে ডেকে নিয়ে ভাল কথা বলতে চায় নতুন সুখের রূপসী মুরলী? কিন্তু মুরলীর মুখে ভালকথা শুনতে পেলে দাশুর জীবনে আবার যে জিরোর সাধ হেসে উঠবে।

তা খারাপ কিসের দাশু? মুরলী যদি মায়া করে বলে, তুমি যেও না, তবে যেয়ে কাজ কি? মুরলীর কাছে আর ঠাঁই হবে না। নাই হোক, মুরলীর ভাল কথার মায়ার কাছে এসে ঠাঁই নাও না কেন, বেঁচে থাক না কেন? বুঝতে পার না কেন, মুরলী তোমাকে আজও ভুলে নাই?

আস্তে আস্তে হেঁটে মুবলীক কাছে এসে দাঁড়ায় দাশু–কি ভাল কথা বলতে চাও?

মুরলী-তোমার ভালর লেগে বলছি।

দাশু–বল।

রঙিন ছাতার হাতলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে মুরলী—তোমার মরণ ভাল।

–হ্যাঁ, বড় ভাল কথা বটে। হেসে ফেলে দাও।

যেমন বড় বড় শিলা, তেমনই জলের মোটা মোটা ধারা; আর, তেমনি শনশনে ঝড়ের বাতাস। হারানগঞ্জের ডাঙর উপর যেন আকাশভাঙা একটা ভয়ানক আক্রোশ লুটিয়ে পড়তে শুরু করেছে। ভাঙার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–ও কিসের আওয়াজ? ডরানির জলের আওয়াজ বটে কি?

মুরলী বলে-হ্যাঁ।

সড়ক ছেড়ে দিয়ে একটা দৌড় দিয়ে ডাঙার উপর নেমে পড়ে দাশু। তার পরেই না, আর স্পষ্ট করে কিছু দেখা যায় না। একটা ছুটন্ত তৃষ্ণা যেন খরবৃষ্টির ধারার ভিতর দিয়ে গলে গলে ক্ষয় হতে হতে ডরানির ক্ষেপা জলের দিকে ছুটে চলে গেল।

আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে যেয়ে অনাথবাড়ির বারান্দার উপর উঠে সিস্টারদিদির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী।

ঝাপসা হয়ে গিয়েছে হারানগঞ্জ। গিজার চূড়া আর দেখতে পাওয়া যায় না। অনাথবাড়ির বারান্দার উপরে দাড়িয়ে জলবাতাসে ক্ষেপা শব্দ আর বাজের শব্দ শুনতে শুনতে বধির হয়ে গিয়েছে কান, তা না হলে শুনতে পেতেন সিস্টারদিদি, মুরীও শুনতে পেত, তিন ঘণ্টার মধ্যে তিনবার কাতর-স্বরে চেঁচিয়ে হাঁক দিয়েছে জনের মা আনিয়া বুড়ি-তোমরা ঘরের ভিতরে গিয়ে বস না কেন জোহানা বহিন।

এই বধিরতা ভাঙে তখন, যখন জনের মা আনিয়া বুড়ির গলার স্বর দুজনের একেবারে কাছে এসে হেসে ওঠে-গড বাবা দয়া করেন। ভাবি নাই, এত জলদি এমন পাগলা বাদল ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

ঝড় থেমেছে, বৃষ্টিও নেই। কী আশ্চর্য, হারানগঞ্জের ভেজা ডাঙার উপর মরা বিকালের শেষ রোদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আর, আকাশের উত্তর-দক্ষিণ জুড়ে ঝলমলে একটা রামধনু ফুটে উঠেছে।

ডাঙার শেষে শালবনের আড়ালে ডরানির ক্ষেপা জলের গুঁড়ো উপরে ভেসে উঠে শালবনের মাথার উপরে সাদা ধোঁয়ার মত থমকে রয়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলেন সিস্টারদিদি-লোকটা তোমাকে কি কোন কথা বলে গেল, জোহানা?

ঝলমলে রামধনুটার দিকে অপলক গম্ভীর চোখের চাহনি তুলে ধরে মুরলীও আস্তে আস্তে বলে–না দিদি, আমি ওকে একটা ভাল কথা বলে দিলাম।

সিস্টারদিদি-ভাল কথা?

মুরলী-হ্যাঁ।

সিস্টারদিদি-কি কথা?

মুরলী-বলে দিলাম, তোমার মরণ ভাল।

চমকে ওঠেন সিস্টারদিদি-তাই কি লোকটা ক্ষেপার মত ছুটে চলে গেল?

মুরলী-হ্যাঁ।

সিস্টারদিদি-কোথায় গেল?

মুখ ফিরিয়ে, সিস্টারদিদির মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে আর নরম ঠোঁট দুটোকে কুঁকড়ে দিয়ে কথা বলে মুরলী-সে কথা মিছা আর শুধাও কেন দিদি?

-জোহানা! সিস্টারদিদির গলার স্বর শিউরে ওঠে।

মুরলী-হা দিদি, লোকটা মরণ নিতে ডরানির ক্ষেপা জলের কাছে ছুটে চলে গেল। ও আর এখন তোমার দুনিয়াতে নাই।

ওঃ, ওঃ ওঃ! ভয়ানক ভীরু একটা আর্তনাদের শিহর চাপতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে কথা বলেন সিস্টারদিদি।-তুমি ভয়ানক ভুল কথা বলেছ জোহানা।

–সিস্টারদিদি! চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী। মুরলীর কালো চোখ দুটো হঠাৎ সাদা হয়ে যায়।

সিস্টারদিদির চোখে ছোট একটা জকুটি শিউরে ওঠে।-আমাকে আবার কি বলতে চাও?

মুরলী বলতে চাই, তুমি তো ওকে আগেই মেরে রেখেছিলে, আমি শুধু ওর লাস গুম করে দিলাম।

–কি বললে, জোহানা? সিস্টারদিদির সাদা চুলের খোঁপা কাঁপতে থাকে।

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী-তুমি ওকে তোমার সাধের আসাইলামে ঠাঁই দিতে পারলে না কেন?

সিস্টারদিদি-জানি না।

মুরলী–খুব জান, জবাব দাও দিদি।

সিস্টারদিদি–না।

মুরলী–না বললে চলবে না, দিদি। আমি আজ তোমার জবাব না নিয়ে…

ডিং ডাং! ডিং ডাং। গির্জার ঘণ্টা বাজতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ চুপ হয়ে যায় মুরলী। সিস্টারদিদির কাছ থেকে জবাব নেবার আর উপায় নেই। সিস্টারদিদির মাথাটা ঝুকে পড়েছে, বুকের ওপর দুহাত ভাজ করে ক্রশ ধরেছে, আর মনে মনে প্রেয়ার সাধতে শুরু করেছেন।

আজ আর তবে গির্জা যাবেন না সিস্টারদিদি। রঙিন ছাতাটা হাতে নিয়ে, বারান্দা থেকে নেমে আর দুলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে সড়কের উপরে উঠেই থমকে দাঁড়ায় মুরলী। মুরলীর দুই চোখ যেন কাচের তৈরী দুটো চমৎকার চোখ, চিকচিক করে হাসতে থাকে। বোধহয় দেখতে পেয়েছে মুরলী, রিচার্ড সরকারের জন্য ভোট হাঁকতে হাঁকতে সেই মিছিলটা আবার এদিকেই ফিরে আসছে।


© 2024 পুরনো বই