বাবুরবাজারের সেই চক, যেখানে সড়কের এক পাশে নিতাই মুদীর একটা দোকান ছিল, যে দোকানে, মুড়ি, মুড়কি, চিড়া, ছাতু, গুড় আর মাইয়ের খইয়ের মোয়া ঝুড়িভর্তি হয়ে সাজানো ছিল; আর, বাঁশের বাঁখারি দিয়ে তৈরী একটা ঝাপও ছিল।
সেই দোকান আজ আর নেই, যদিও সেই জায়গাটি আজও আছে; আর, ঠিক সেই জায়গাতে নতুন একটা চায়ের দোকান পিপাসী খরিদ্দারের ভিড়ে যেমন জমাট তেমনই মুখর হয়ে রয়েছে। নিতাই মুদির এই চায়ের দোকানের নাম প্রাণতোষ রেস্টুরেন্ট। তিন সারি বেঞ্চ, আর তিন সারি টেবিল। একটা কাচের আলমারিতে পাঁচটা বয়মের ভিতরে কেক বিস্কুট আর ডিম। আলমারির একটা তাকে ছোটবড় পাউরুটি থরে থরে সাজানো।
এই নিতাই মুদীর চেহারাটাও ঠিক সেই নিতাই মুদীর মত নয়। চিড়া-গুড়ের দোকানটা যেমন মরে গিয়ে আর প্রাণতোষ রেস্টুরেন্ট হয়ে নতুন জন্মলাভ করেছে, নিতাই মুদীর পুরনো চেহারাটাও যেন তেমনই নারে গিয়ে আবার নতুন হয়ে জন্ম নিয়েছে। নিতাই মুদির পরনে পায়জামা, গায়ে হাফ-হাতা কামিজ আর গলায় নকল রেশমের একটা চকচকে মাফলার। নিতাই মুদীর এক হাতের কনুয়ের কাছে পাঁচ ভরি সোনার একটা তাগা ঝকঝক করে; আর
এক হারে কজিতে ছোট একটা ঘড়িও ঝিকঝিক করে।
বাবুরবাজার চকের সেই চেহারাও মরে গিয়ে নতুন হয়ে জন্ম নিয়েছে। চকের চার রাস্তার মাথা নানারকমের দোকানবাড়ির ভিড়ে ভারি হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে একটা ব্যাঙ্কের শাখা অফিসের সাইনবোর্ডও দেখা যায়। তা ছাড়া, সরকারী গ্রামোন্নতির একটা ব্লক অফিস। চকের সড়কেব বুকটা পেট্রল গ্রীজ গীয়ার-অয়েল আর নানানরকম লুব্রিকেন্ট তেলের ছোপ আর ছাপে ভরে আছে। প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের মেঝে-ধোওয়া জল যখন চকের সড়কের উপর গড়িয়ে পড়ে, তখন চকের সড়কের বুকটা রামধনু রঙের শত শত আলপনায় ভরে যায়।
প্রতি আধ ঘন্টা অন্তর একটা না একটা সার্ভিস বাস, হয় এদিক থেকে, নয় ওদিক থেকে, যাত্রীর ভিড়ে ভরতি হয়ে চকের উপর এসে থামে আর চলে যায়। প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের বেঞ্চ পিপাসী খরিদ্দারের ভিড়ে ভরে উঠতেই মস্ত বড় ক্যানেস্তারা জলে ভরতি করে উনানের উপর চাপিয়ে দেয় রেস্টুরেন্টের বয়। আর, নিতাই মুদীও ব্যস্ত হয়ে এক-একটা পাউরুটিকে আদর করে আঁকড়ে ধরে ছুরি চালাতে থাকে।
প্রায় এক মাস হল, নিতাই মুদীর প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের চা-পাউরুটি আর ডিম-ভাজার বিক্রি প্রায় দশ গুণ বেড়ে গিয়েছে, কারণ, বাবুরবাজারের চকে এই এক মাস ধরে সত্যিই বাবুদের ভিড় থই থই করছে। কখনও বড় বড় মোটর ট্রাক ভরতি হয়ে, কখনও বা পায়ে হেঁটে মিছিল করে বাবুদের এক-একটা দল যখন-তখন ছুটে এসে চকের উপর থমকে দাঁড়ায়। ভোট দাও, ভোট দাও। বাবুদের ছোট ছোট ভিড় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাঁক ছাড়ে। কত রকমের আর কত রঙের ঝাণ্ডা! চকের সড়কের চারদিকের দোকানের দেয়াল পা থেকে মাথা পর্যন্ত বড় বড় ছাপা হরপের কত রকমের আশা দাবী আর প্রতিজ্ঞার কথায় ছেয়ে গিয়েছে। চকের কাছে যত আম বট নিম আর তেঁতুলের গাছ ছবিতে ছবিতে ভরে গিয়েছে।
বাবুরবাজার চকের উপর দাঁড়িয়ে আজও দক্ষিণের দিকে তাকালে কপালবাবার ঘন-সবুজ জঙ্গলটাকে আর মধুকুপির ঘোটকালু ও বড়কালুর নধর-নিটোল কালোকালো ধড় দুটোকে দেখা যায়। কিন্তু সেদিন এসে পড়তে বোধ হয় আর বেশি বাকি নেই, যেদিন সারি সারি কারখানার ইমারত, উঁচু উঁচু চিমনি আর কালো ধোঁয়ার গাঢ় আবরণে বাবুরবাজারের দক্ষিণের আকাশটাকে আর স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যাবে না। বাবুরবাজার থেকে শুরু হয়েছে নতুন নতুন কারখানার পত্তন। এই নতুন পত্তনের উল্লাস একেবারে ডরানির খাত পর্যন্ত না গড়িয়ে গিয়ে বোধ হয় থামবে না। সেন অ্যাণ্ড ওয়াল্টারের একটা নতুন উদ্যম এরই মধ্যে ডরানির বালুভরা বুকের এক পাশে বিরাট একটা পাম্প বসিয়ে দিনরাত ধকধক শব্দ করে জল টানতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ, সেন অ্যাণ্ড ওয়াল্টারের রেয়ার-আর্থ লেবরেটরি চালু হয়ে গিয়েছে। তারই কাছে একটা পাইপ ঢালাইয়ের কারখানাও প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে।
প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের বেঞ্চিতে পিপাসী খরিদ্দারের ভিড় যখন হালকা হয়, তখন হাফহাতা কামিজের বুকপকেট থেকে একটা রুমাল বের করে পাঁচ ভরি সোনার তাগাটাকে মুছতে মুছতে কথা বলে নিতাই মুদী-শুনছিস বেজা।
রেস্টুরেন্টের বয় ব্রজবিহারী উত্তর দেয়—হুঁ আজ্ঞা।
নিতাই-ভোটের গরম তো আর তিন মাস পরেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
–হুঁ আজও।
–কিন্তু আমার তো কিছু হল না রে বেজা। দেখছিস তো, এক মাস হল দোকানের বিক্রির অবস্থা কিরকম দাঁড়িয়েছে।
–কিরকমটি আজ্ঞা?
–একেবারে যা-দশা। শুধু লোকসান আর লোকসান।
–নোকসান কেনে হবেক?
–আরে হারে আজ্ঞা। প্রতিদিন পাঁচ-দশ টাকা করে লোকসান সহ্য করতে হচ্ছে।
–কিন্তুক, আমার মাসোহারা এইবার দু টাকা বেশি না করে দিলে চলবে না।
–কেন?
–আমার খাটুনি যে ডবলেরও বেশি হয়ে গেছে।
–তা তো হবেই; ওরকম হয়েই থাকে; বিশ্বাস না হয়, বড় বড় কোম্পানিতে গিয়ে, ওই সেন আণ্ড ওয়াল্টারের মজুরদের জিজ্ঞেসা কর গিয়ে।
–কি জিগেস করতে বলছেন?
–চাকর মজুরের মেহনত ডবল হয়, কিন্তু সেজন্যেই মাইনে বাড়ে না। মালিকের মুনাফা হলে মজুরের মাইনে বাড়বার নিয়ম নেই।
–কিন্তু মুনাফা হয় না কেন, আজ্ঞা?
হেসে ওঠে নিতাই মুদী-সেটা হলো কপাল। আমার কপাল আর তোর কপাল। নইলে, দেখ না কেন, ভোটের বাজারে কত বেটা কত হাজার মেরে নিচ্ছে, আর আমার দিন গেলে মাত্র দশটা টাকা…দশটা টাকা স্রেফ লোকসান হয়ে যাচ্ছে বেজা।..আরে, ওটা কে রে বেজা? সেই বাঘমারা খৃস্টানটা না?
উনানের উপর ক্যাননস্তারার জল টগবগ করে ফোটে; সেই ফুটন্ত জলের বাষ্পের উপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে সড়কের এক দিকে একটা নিমগাপ্পে গোড়ার দিকে তাকিয়ে বেজা বলেহ আজ্ঞা। পলুস হালদার বটে।
নিতাই-কিন্তু, বেটা এই সকালবেলাতে ওখানে বন্দুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?…দেখ কাণ্ড, বেটা এদিকেই যে আসছে..বেটা মাতাল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে যে..ওর পা দুটো যে টলছে রে বেজা, দেখছিস না?
-হঁ আজ্ঞা।
ভুল বোঝে নি নিতাই মুদী। সেই ভয়ানক বাঘিনীটার খোঁজে এই দিকে কতবার যাওয়াআসা করেছে পলুস হালদার। কিন্তু সে তত তিন-চার সাল আগের ব্যাপার। বাঘিনীটাকে দুই গুলিতে শেষ করে দিয়ে এই লোকটা থানা রেলকোম্পানি আর জমিদারবাবুদের কাছ থেকে অনেক ইনাম পেয়েছে। তবে আবার ঠিক সেইরকম একটা বাঘিন-মারা আক্রোশ কেন শিকারীটার চোখে ছটফট করছে? কি খুঁজছে পলুস হালদার?
হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে সাইকেলে উঠে আর চক পার হয়ে উধাও হয়ে গেল পলুস হালদার। আবার পাঁচ মিনিট পরেই ফিরে এসে চকের উপর একটা গাছের ছায়ার কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আবার, চকের পুবের সড়কটা ধরে বনবন করে সাইকেল চালিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। কিন্তু আবার, পাঁচ মিনিট পার না হতেই ফিরে এসে চকের বাসস্টপের কাছ থেকে একটু দূরে, প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে পলুস হালদার।
নিতাই মুদী বিড়বিড় করে—আমার যে কেমন সন্দেহ হচ্ছে, বেজা।
–কেনে আজ্ঞা?
–শিকারীটা ছুটোছুটি করছে কেন? কি মনে করেছে বেটা? এই চকের উপর দিয়ে এই সকালবেলাতে নতুন একটা বাঘিন পাস করবে?
বেজাও সন্দিগ্ধভাবে পলুসের সেই রুক্ষ্ম চেহারা আর মাতাল চোখের ছটফটে চাহনির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে—দুশমনের খোঁজ লিবে মনে হয়।
-দুশমন? ওর দুশমন আবার কে? এই বেটাই তো মধুকুপির দাশু কিষাণের দুশমন? তুই সে খবর জানিস তো বেজা?
-হুঁ আজ্ঞা; দাশুর ঘরণীকে ঘরের বার করে বিহা করেছে পলুস।
—তবে…তবে আবার…।
হঠাৎ কথা থামিয়ে দিয়ে, আস্তে আস্তে এগিয়ে যেয়ে পলুসের কাছে দাঁড়িয়ে একগাল হাসি হাসে নিতাই মুদী : এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন হালদার।
চমকে ওঠে পলুস; নিতাই মুদীর দিকে কটমট করে তাকায়। নিতাই বলে-দোকানে এসে বসো। চা-পাউরুটি খাও। চাও তত ডিমভাজা, কলিজার ঘুঘনি আর…!
পলুস বলে-একটা খোঁজ দিতে পারেন?
-কিসের খোজ?
—হারানগঞ্জের সিস্টার দিদি এই পথে গেছো কি?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো ঘন্টা দুই আগে ওই দোকানের দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে লেকচার দিলেন, তারপর ওইদিকে চলে গেলেন…।
পলুস–জানুনগড়ার দিকে বটে কি?
নিতাই-তাই তো মনে হয়।
পলুস জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে যেন আরও শক্ত হয়ে দাঁড়ায়? তবে ঠিক আছে। এই পথেই নিশ্চয় ফিরবেন সিস্টার দিদি।
নিতাই মুদীর সন্দিগ্ধ চোখ দুটো এইবার একটা অবুঝ ভয়ের আবেশে ফ্যালফ্যাল করতে থাকে। তারপর চমকে ওঠে। হারানগঞ্জের সিস্টার দিদি আসছে। প্রায় কাছে এসে পড়েছে। সেই নীল রঙের সাইকেলের ঘন্টি মিষ্টি শব্দ করে বাজছে। সেই নীল চোখ জ্বলজ্বল করে হাসছে।
একটা লাফ দিয়ে সড়কের ঠিক মাঝখানে এসে, আর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে সিস্টার দিদির পথ আটক করে পলুস হালদার। সিস্টার দিদির নীল চোখে ছোট ছোট একটা ভ্রূকুটি শিউরে ওঠে। কিন্তু সাইকেল থেকে নেমেই মিষ্টি করে হেসে ওঠেন সিস্টার দিদি-তুমি কবে ঘরে ফিরলে পলুস?
পলুস–অনেক দিন।
সিস্টার দিদি আশ্চর্য হন–অনেক দিন? তবে…তবে জোহানা কেন..।
পলুস হাসে-তবে জোহানা কেন আজও তোমার কনভেন্ট বাড়িতে থাকে দিদি? ঘরে যায় না কেন?
সিস্টার দিদি-আমি তো সেই কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি।
পলুসের চোখের তারা জ্বলে ওঠে-আমিই তোমাকে সেই কথা শুধাচ্ছি, তুমি জবাব দাও দিদি।
সিস্টার দিদি ভ্রূকুটি করেন—তুমি সরাব পান করেছ পলুস?
পলুস–মাপ কর দিদি, তুমি আমার চেয়েও কত ভাল সরাবীকে মাপ করে থাক, সে আমি জানি।
–তুমি জঙ্গলের মানুষের মত কথা বলবে না পলুস।
–কিছু বলতে চাই না দিদি; শুধু বিচার চাই।
–কিসের বিচার?
পকেটের ভিতর থেকে একটা কাগজ বের করে সিস্টার দিদির হাতের কাছে এগিয়ে দেয় পলুস-এটা কি বলে?
-কি?
–আদালতের নোটিশটা কি বলে, একবার পড় না কেন দিদি।
সিস্টার দিদি কাগজটাকে পড়তে গিয়েই চমকে ওঠেন। পড়া শেষ করে একেবারে নীরব হয়ে পলুসের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
পলুস—এইবার বল, দিদি। আমাকে ছাড়তে চায়, বিয়া রদ করাতে চায়, আদালতে দরখাস্ত করেছে জোহানা। এমনটি কেন হয়, দিদি?
উত্তর না দিয়ে আর আদালতের নোটিশটাকে পলুসের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে আনমনার মত অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন সিস্টার দিদি।
পলুস-তুমি বিচার কর দিদি। সিস্টার দিদি–জোহানা শিশু নহে; উহার এইসব ইচ্ছার বিচার আমার কাজ নহে।
–কিন্তু ঘরণীতে বড় ঘরের সাধ যাচে কেন? সাধ বাড়ে কেন? এমনটি হলে মানুষের ঘর বাঁচবে কিসে? চেঁচিয়ে ওঠে পলুস।
এরই মধ্যে ছোট একটা ভিড় এসে বাবুরবাজার চকের এই অদ্ভুত ঘটনাকে ঘিরে ফেলেছে। হারানগঞ্জের সিস্টার দিদিকে এরকম অপ্রতিভ ও অপ্রস্তুত হয়ে পথের উপর থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে কোনদিনও দেখা যায় নি। সিস্টার দিদির নীল চোখের জ্বলজ্বলে হাসি কোনদিন এরকম নিভু নিভু হয়ে যায় নি। এভাবে আনমনার মত আর ভয়-পাওয়া চাহনি নিয়ে সিস্টার দিদিকে তাকিয়ে থাকতেও কোনদিন কেউ দেখেনি।
–এমনটি কেন হয়? জবাব দাও দিদি।
সিস্টার দিদির গলার স্বর বিকল ঘন্টির আওয়াজের মত ঘড়ঘড় করে? জবাব জানি না।
-তাই বল দিদি! চেঁচিয়ে হেসে ওঠে পলুস। সাইকেল আর বন্দুকের সঙ্গে টলমলে রুক্ষ চেহারাটাকে সেই মুহূর্তে সড়কের একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সিস্টার দিদির পথ অবাধ করে দেয়। ছোট ভিড়টাও ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে। একটা অবুঝ বিস্ময়ের প্রশ্ন ভিড়ের মুখে মুখে বাজতে থাকে-কি বটে হে?…পলুস হালদার সিস্টার দিদিকে সঁটে কেন হে?…এ কেমন তামাসা বটে গো?…খাদের কলঘরের মিস্তিরীটা মস্করা করে হাসে কেন? আর সিস্টার দিদি এত ডরে ডরে তাকায় কেন?
সিস্টার দিদির সাইকেল-চড়া মূর্তিটা ততক্ষণে হারানগঞ্জের সড়ক ধরে অনেক দুরে চলে গিয়েছে। সিস্টার দিদির মাথায় সাদা চুলের খোঁপা রুপোর সুতোর স্তবকের মত কাঁপতে কাঁপতে আর সকালবেলার আলোতে চিকচিক করতে করতে চলে যাচ্ছে। সেই দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই সাইকেলের উপর লাফ দিয়ে উঠে বসে পলুস হালদার।
সিস্টার দিদির পিছু ধাওয়া করবে বুঝি মিস্তিরীটা!
না; সোজা ভুবনপুর রোডের গাছের ছায়ার ভিতর দিয়ে যেন খাঁচাছাড়া চিতাবাঘের মত একটা ছুটন্ত আহ্লাদের আবেগে সাইকেল চালিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে পলুস হালদার। নিতাই মুদী ঠোঁট পাকিয়ে হাসে : বড় জব্দ হয়েছে বেটা!
পর মুহূর্তেই চেঁচিয়ে ওঠে নিতাই-জল চাপা, শিগগির, এক ক্যানেস্তারা জল উনানে চাপিয়ে দে বেজা। গোবিন্দপুরের মেল বাস এসে পড়েছে।
একটা ভোটর মিছিলও এসে পড়েছে। গোবিন্দপুর স্কুলের ছেলেরা আছে, অনেকগুলি ছোকরা বাবুও আছে; বিশ-পঁচিশটা ঝাণ্ডাও দুলছে।
ভোট দাও! ভোট দাও! পাঁচ মিনিট ধরে চড়া গলার হাঁক ছাড়বার পর মিছিলের বুকের ভিতর থেকে একটা হারমনিয়মের পাতলা ও মিঠা স্বরের আওয়াজ উথলে ওঠে। একসঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইতে থাকে মিছিলের ছেলেরা আর বাবুরা।
দেশের মুক্তি হয়ে গেল যদি, মাটির মুক্তি চাই। শুন হে কিষাণভাই। তোমার সুখেতে সকলের সুখ, এ কথাটি জানা চাই। মাটির মানুষ কেউ হয় যদি, সে মানুষ তুমি ভাই। এ মাটি তোমার মাটি, জেনে নাও খাঁটি, মোরা তোমাদের সুখ চাই।
প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের মালিক নিতাই মুদী চুপ করে দাঁড়িয়ে আজকের বিক্রির আশা আর আনন্দটাকে কল্পনায় হিসাব করতে থাকে। মিছিলের হাঁক লেকচার আর গান কোনমতে একবার শেষ হলেই হয়। ওই মিছিলটাই তখন ব্যাকুল হয়ে প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের ভিতরে হুড়মুড় করে ঢুকবে। কাচের আলমারির ভিতরে সাজানো পাঁউরুটির স্তুপ আর ডিমভরা বয়ম দুটোর দিকে তাকিয়ে হিসেব করে নিতাই, সব ফুরিয়ে যাবে নিশ্চয়। এত বড় মিছিল অনেক দিন পরে এসেছে।
মেল বাস থেকে যে পাঁচজন যাত্রী নেমেছে, তাদের মধ্যে চারজন এদিকেই আসছে; কিন্তু একটা যাত্রী…আরে, ওটা কে রে বেজা? ওটাকে যে মধুকুপির সেই দাগী দাশু বলে মনে হয়।
হ্যাঁ, সেই দাশু ঘরামি। গাড়ি থেকে নেমে এমন সুন্দর প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টর দিকে না তাকিয়ে মিছিলটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে দাও।
মিছিলটার কাছাকাছি এসে পথের একপাশে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দাশু। হাতে ছোট একটা কম্বলের পোঁটলা; গায়ে নতুন গেঞ্জি আর পরনে একটা নতুন কোরা ধুতি। গোবিন্দপুর জেল থেকে ছাড়া-পাওয়া দাশু কিষাণের আত্মাটা যেন বাবুরবাজারের চকে নেমেই একটা সুন্দর কুহকের শোভা আর শব্দের স্বাদে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে। গান গাইছে মিছিলটা; আর শুনতে শুনতে দাশু কিষাণের চোখ দুটো চিকচিক করে উঠছে।
গান থামল। মিছিলের জমাট ভিড়টাও ভেঙে এলোমেলো হয়ে প্রাণতোষ রেস্টুরেন্টের দিকে ছুটে এল। যা ভেবেছিল নিতাই মুদী, তাই হল। রেস্টুরেন্টের সব রুটি, সব বিস্কুট, আর সব ডিম শেষ হয়ে গেল। মিছিলের ছেলেরা আর বাবুরা আবার ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে সড়কের উপরে গিয়ে দাঁড়ায়; হাঁক ছেড়ে রঘুনাথপুরের দিকে চলে যায়।
টাকা-পয়সা গেঁজের ভিতরে ভরে নিয়ে আর কোমরে গুঁজে আবার যখন রুমাল দিয়ে সোনার গা মুছতে থাকে নিতাই, তখন আবার চোখে পড়ে, কী আশ্চর্য, মধুকুপির সেই দাগী দাশু যে চকের সড়কের একপাশে ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
-ওহে দাশু! চেঁচিয়ে ডাক দেয় নিতাই।
চমকে ওঠে দাশু; নিতাই মুদীকে চিনতে না পেরে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।
নিতাই—তুই তো মধুকুপির দাশু; আমাকে চিনতে পোর এত দেরি হয় কেন রে?
এইবার চিনতে পারে দাশু; আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এসে বিড়বিড় করে-এ সব কি বটে নিতাই দাদা?
-এটা আমার দোকান।
–বড় ভাল দোকান; কিন্তু সে কথা শুধাচ্ছি না।
–কি শুধাচ্ছিস?
–ওরা যে গীত গেয়ে গেল, সেটা কি বটে?
–ভোটের গীত।
–সে তো জানি; কিন্তু…।
–কিন্তু আবার কি?
-কিষাণদিগের জমি হবে আর সুখ হবে, মাটির মালিক হবে কিষাণ। এমন কথা বলে কেন ওরা? হবে কি, নিতাই দাদা?
-হবে বইকি। তোমাদেরই তো রাজত্ব হবে দাশু। সরকার আইন করেছে, জমিদারের জমি কেড়ে নিয়ে তোমাদের দেবে। আর আমরা শুধু চায়ের জল গরম করে করে…।
দাশু–তুমি মজা করছে না তো, নিতাই দাদা?
নিতাই-তুমি কি আমার ইয়ে যে, তোমার সঙ্গে রস করবো আমি?
দাশুর চোখ দুটো জলে ভরে গিয়ে ছলছল করে ওঠে। নিতাই মুদীও চমকে ওঠে-এ কি, তোকে আমি কি এমন খারাপ কথা বললাম যে, কেঁদে ফেললি দাশু?
-খারাপ কথা নয়। এমন ভাল কথা কভি শুনি নাই।
নিতাই মুদী গম্ভীর হয়ে বিড়বিড় করে-হা, আমিও আমার এই পঞ্চাশ বছর বয়সে এমন অদ্ভুত কথা শুনি নি। সদরে গিয়ে এম-এল-এ বাবুকে জিজ্ঞাসা করেছি; সেটেলমেন্টের কাছারিতে গিয়ে খবর নিয়েছি। সকলেই তো ওই একই কথা বলছে। যারা জমি চষবে, তাদেরই জনি হবে; আইনও নাকি প্রায় হয়েই গিয়েছে।
হেসে ওঠে দাশুর ছলছল চোখ দুটা–ভাল সুখের খবর বটে।
ডিবে থেকে সিগারেট বের করে হেসে ওঠে নিতাই? কিন্তু সত্যি একটা মজার খবর আছে দাশু। শুনলে খুশী হবি।
–বলেন।
–শিকারীটা জব্দ হয়েছে।
–কে? পলুস হালদার?
–হ্যাঁ রে, সেই পলুস হালদার, তোর সেই দুশমনটা।
–কি হয়েছে?
-যাকে তোর কাছ থেকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিল, সে আবার ওকেই ছেড়েছে।
–ঠিক কথা বল, নিতাই দাদা। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।
-ঠিক বলেছি, দাশু। এসব কথা মিথ্যে করে বলবো কেন? কিন্তু তুই কি…! তোর তিন বছরের মেয়াদ পুরো হয়েছে কি? না, জেল থেকে ভেগে এলি?
দাশু হাসে–না; কপালবাবার দয়াতে কিছু আগেই ছাড়া পেয়েছি।
-কেন?
-জেলের কম্বলের গুদামে আগুন লেগেছিল। আমিই সে আগুন ঠাণ্ডা করেছিলাম। তাই এক মাসের মেয়াদ মাপ হয়ে গেল।
-ইনাম পাস নি?
–পাঁচ টাকা পেয়েছি।
–তবে তোত এখন পেট ভরে রুটি আর ডিম-ভাজা খেতে পারিস।
—ছিয়া ছিয়া!
ভ্রূকুটি করে নিতাই-তার মানে?
দাশু হাসে-ওসব চিজ মুখে নিতে বড় লাজ লাগে। হ্যাঁ…চার আনার চিড়া-গুড় দিবেন কি?
নিতাই–না। এসব চিজ আমি রাখি না।
দাশুর দিকে আর হৃক্ষেপ না করে চকের দিকে তাকায় নিতাই মুদী। তখনই চেঁচিয়ে ওঠে—জল চাপা, জল চাপিয়ে দে বেজা; ঝালদার বাস এসে পড়েছে।
আর, দাশু ঘরামির পাথুরে ছাঁদের চেহারাটাও যেন নেচে ওঠে। একটা লাফ দিয়ে উঠে যায় দাও। চক পার হয়ে চলতে চলতে দূরের আকাশের দিকে তাকায়। হ্যাঁ, ওই তো কপালবাবার জঙ্গল; ওই তো মধুকুপির ছছাটকালু আর বড়কালু। বুকের ভিতরেও যে সত্যিই মাদলের বোল বাজছে-মুরলী, মুরলী!
জমি আসবে, মুরলীও আসবে! হে কপালবাবা, কত ভাল বিচার তোমার। কলঘরের মিস্তিরীর ঘর থেকে কে জানে কেমন কান্না নিয়ে আবার ছুটে আসছে মুরলী। মুরলীর কোলেতে ছেইলাটা আছে তো কপালবাবা?
কিন্তু তার আগে যে জমি পাওয়া চাই। পাঁচ বিঘা দো-আঁশ কানালীর জমি। সরওজা বুনে দিলে দুই মাসের মধ্যে হলদে ফুলে ছেলে যাবে ক্ষেত। গুলঞ্চের বেড়াতেও ফুল ধরে যাবে নাকি?
মধুকুপির দিকে অনেক দূরে এগিয়ে আসার পর যখন উরানির জল দেখা যায়, তখন দাশুর শুকনো গলার পিপাসাটা যেন আপনিই ভিজে যায়। আট আনা খরচ করে বাবুরবাজারের ভাটিতে বসে হাঁড়িয়া খাওয়ার সাধ ছিল; কিন্তু জমি আর মুরলীর মুক্তির খবর শুনে বুকের ভিতরটা আশায় মাতাল হয়ে হাঁড়িয়ার নেশা নেবার ইচ্ছাটাকেও ভুলিয়ে দিয়েছে।
লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে থাকে দাশু। গাঁয়ে পোঁছে গিয়ে জাম কাঠের সেই জীর্ণ দরজার কপাটের গায়ে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে, বড় বুড়া রতনের কাছে গিয়ে একটা বিপুল খুশির হাঁক ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠবে দাশু–তোমরা কি শুন নাই বড় বুড়া, জমি আসবে, মুরলীও আসবে? কপালবাবার কাছে সাদা ছাগ বলি দাও।
আর কতদূর?
আর বেশি দূর নয়। বাবুরবাজারের পুলিস ফড়িটা ছাড়িয়ে মধুকুপির অনেক কাছে চলে এসেছে দাশু। ফুরফুরে বাতাসের ছোঁয়া এইবার দাশুর চোখে-মুখে আর মাথার উপর যেন একটা ফুরফুরে মিষ্টি গন্ধের ছোঁয়া ছড়িয়ে দিতে থাকে। মহুয়াতে ফুল ধরেছে বুঝি।
কিন্তু দল বেঁধে ওরা কারা হনহন করে গাঁয়ের দিক থেকে এই দিকে হেঁটে আসছে? হাতে ছোট ছোট ঝুলি আর লাঠি; মাথার উপর ছোট ছোট বোঝা, দলটা যেন কারও উপর রাগ করে ছুটে আসছে।
দলটা কাছে এগিয়ে আসতেই দলের সবার আগের মানুষের মুখটাকে চিনতে পারে দাশু, সুরেন মান্ঝির মুখ। কিন্তু সুরেনের গম্ভীর মুখে যেন একটা গম্ভীর আক্রোশ থমথম করছে।
–কি বটে সুরেন? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।
–গাঁয়ে ফিরেছিলাম, কিন্তু আবার গা ছেড়ে চললাম দাদাদা। চেঁচিয়ে ওঠে সুরেন।
দাশু আশ্চর্য হয়? কেন গাঁয়ে ফিরে এলে, আবার কেনই বা চলে যাও?
–কয়লা-খাদে ছাঁটাই হল। কত মালকাটা গায়ে ফিরে গেল। আমরাও এলাম। কিন্তু…।
দাশুর প্রাণের ভিতরটা যেন হো-হো করে খুশির উচ্ছ্বাসে হেসে ওঠে। কয়লাঁ-খাদ কত সুখের ঠাই, কত বড় গলা করে এই সুরেনই না কথাটা বলেছিল। খাদের কয়লা আজ ওদের সুখের আশাকে কালো করে দিয়েছে। কাজ নাই। ভুখা পেট নিয়ে আবার মধুকুপির মাটিতে ফিরে আসতে হয়েছে।
দাশু হাসে! কিন্তু, কি বটে সুরেন? আবার কোথায় চললে?
–সদরে যাব।
–কেন?
–দিনমজুরী করবো।
–ছিয়া সুরেন!
সুরেনের চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে : ছিয়া তোমার গাঁ।
–কেন? দাশুর গলার স্বর গরগর করে।
সুরেন বলে-তোমার সাথে আমার ঝগড়া নাই দাশুদাদা; ওসব কথা ছেড়ে দাও, আর পার তো আমার একটা উপকার কর।
দাশুর গলার স্বর যেন লজ্জিত হয়ে আর হঠাৎ-মায়ার আবেশে নিবিড় হয়ে যায়? বল কেন সুরেন?
–আমি দুই দিন খাই নাই।
–কেন? কেন? দাশুর গলার স্বর ফুঁপিয়ে ওঠে।
সুরেন—সেকথা আর শুধাও কেন? এখন পার যদি তবে আমাকে পাচটা টাকা ধার দাও।
-পাঁচ টাকা! চমকে ওঠে দাশু। কি ভয়ানক হিসেব করে টাকা চেয়েছে সুরেন! সুরেনের দাবীটা যে দাশুর অদৃষ্টের শেষ সম্বল লুঠ করে নিতে চায়।
সুরেন বলে—একদিন আমিও তোমাকে দশ টাকা ধার করে দিয়েছিলাম দাশু দাদা, সে কথা ভুলে যাও কেন?
না, ভুলতে পারে না দাশু; এই সুরেন মান্ঝি সেদিন দশ টাকা ধার দিয়েছিল বলে দাশুর মুরলী সেদিন ভাত খেতে পেয়ে বেঁচে গিয়েছিল, আর মুরলীর পেটের ছেইলাটা, দাশুর জীবনের মায়াময় সাধটা ও হঠাৎ-মরণ থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
—এই নাও। কোমরের ধুতির গোঁজের ভিতর পাঁচটা টাকা বের করে সুরেনের হাতের কাছে এগিয়ে দেয় দাশু। আশ্চর্য হয়ে দাশুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সুরেন। তারপর চলতে থাকে।
মান্ঝিদের দলটা হনহন করে হেঁটে গাঁ-ছাড়া আক্রোশের মত দূরে চলে যায়। দাশুও একটা করুণ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মধুকুপির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
ডরানির বালুভরা বুকের উপর বড় দেহটা এইবার বেশ স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাজ্জব বটে! দহের কিনারায় বক বসে নেই কেন? দহের জল চিকচিক করে না কেন? ওই তো ডরানির সেই দহ, যার জলে মৌরলা আর কুরচিবাটা মাছে ঝাক ছটফট করে খেলা করত। ক্ষেতের কাজ সেরে ঘরে ফিরে যাবার সময় ওই দহের জল গামছা-ঘঁকা করে কতবার মৌরলা আর তিতপুঁটি তুলেছে দাশু। সেই দহের জল দেখা যায় না। অন্ধের চোখের কোটরের মত শুকনো হয়ে পড়ে আছে ডরানির বড় দহ। তবে কি গত শাওনেও আকাশটা শুধু মরা মেঘে ছেয়েছে আর খরাতে পুড়েছে? ডরানির বুকে ভাদুয়া ঢল নামে নাই কি?
ডরানির ছুটকো স্রোতের উপর লোহাবাঁধানো সেই পুলটা। কত রোগা হয়ে গিয়েছে স্রোতটা। এ কি? কপালবাবার জঙ্গলটার এমন দশা কেন? জঙ্গলের চেহারা থেকে ব বুজ যেন মরমর হয়ে ঝরে পড়েছে; জঙ্গলের ছায়াও আর ঠিক সেই রকমটি কালোকালো নয়। মনে হয়, আরও আধ ক্রোশ দূরে সরে গিয়েছে কপালবাবার জঙ্গল।
আর, ওই তো মধুকুপি। মানঝিপাড়ার ঘরগুলি দেখা যায়। জাহিরথানের কাছে রিঠাগাছের যে ভিড়টা ছিল, সেটাও দেখা যায়। কিন্তু কেমন যেন মর-মর চেহারা। জাহিরথানের কাছে গাঁয়ের মুখিয়া রতনের গরু-ঘরের যে একচালাটি ছিল, সেটা নেই কেন? সেখানে তিনটে খুঁটো দাঁড়িয়ে আছে কেন? রতনের গরু দুটো কি মরে গিয়েছে?
বাবু দুখন সিংহের বাড়ির চালার টিন রোদ লেগে ঝকমক করে; আর ঈশান মোক্তারের কুঠি ও ভাণ্ডারের গা টাটকা চুনকামের আনন্দে ধবধব করে। ওরা ভাল আছে, বেশ সুখে আছে মনে হয়। কিন্তু কিষাণ মনিষদের ঘরগুলি শুকনো জঞ্জালের মত দেখায় কেন? ঘরে কি মানুষ থাকে না? চালার খড় যেন খাবলা দিয়ে কেউ তুলে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। মাটির দেয়ালে ঘা হয়ে ধুলো ঝরছে। কিষাণের ঘরের মাগ আর বেটিগুলা কি সব পালিয়ে গিয়ে খাদের ময়লাকামিন হয়ে গিয়েছে? মাটির দেয়ালে কাদা গোবর নিকায় না কেন ওরা?
মধুকুপির ধানক্ষেত। চোখ পড়তেই ভয় পেয়ে চমকে ওঠে দাশুর চোখ। ধানক্ষেতের শুকনো খটখটে মাটির উপর যে আগাছা হলদে হয়ে মরে পড়ে আছে, সে আগাছা সত্যিই আগাছা নয়। রোপাইরা ধানের দেড় হাত ফুরতি যেন একটা সর্বনাশের বিষের জ্বালায় মরে গিয়ে আর একেবারে খড় হয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে। মরাধানের এই খড়ে কোন স্বাদ
নেই বুঝি, তা না হলে গরুতে এখনো এগুলোকে সাবাড় করে নি কেন?
চলতে চলতে পুবের ডাঙার ঢালুটা শেষ দিকে মাটির উপর একটা সবুজ শোভার দিকে চোখ পড়তেই দাশু কিষাণের চোখের চাহনি মিন্ধ হয়ে ওঠে। ওই ভিজা জমিটা যে বড় ভাল দো-আঁশ কানালি বটে। ঈশান মোজরের কুঠি ওই জমিতে প্রতি বছর পঞ্চাশ মনিষের মেহনত লাগিয়ে যে আউশ আর আমন তোলে, তাতেই যে ভাণ্ডারের প্রায় অর্ধেক ধানে ধানে ভরে যায়।
না, মরে নি মধুকুপির মাটি। মধুকুপির মাটির প্রাণের জোর নিজের চোখে একবার দেখে নিয়ে মনের দুঃসহ সন্দেহটাকে মিথ্যে করে দেবার জন্য পুবের ভাঙ্গার ঢালুর দিকে ছুটে যায় দাশু। কিন্তু ক্ষেতের কাছে এসে একটা আলোর উপর দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। এইবার চোখে পড়েছে দাশুর; এই সবুজ ধানক্ষেতও একটা জঞ্জালের শ্মশান। ধানের কাঁচা শিষ উঁষ হয়ে গিয়েছে। মাজরা লেদা আর শুয়া–পোকা পোকা পোকা-ধানের দুশমনের ক্ষুধা মধুকুপির ক্ষেতের আনন্দ লুটপাট করে খেয়েছে। ধানের পাতায় ঘা; শিরকাঠি এরই মধ্যে কুটো হয়ে গিয়েছে। হে কপালবাবা, গাঁয়ের মাটিকে এমন সাজা দাও কেন? কিষাণেরা বাঁচবে কেমন করে? ছেইলা কোলে নিয়ে মুরলী যদি গাঁয়ে ফিরে এসে গাঁয়ের মাটির এমন দশাটি দেখে, তবে সে যে আবার ডরাবে আর চলে যাবে গো কপালবাবা!
ফিরে গিয়ে আবার সড়ক ধরে চলতে থাকে দাশু। দাশুর ভয়-পাওয়া চোখ দুটো এইবার আস্তে আস্তে করুণ হয়ে ছলছল করতে থাকে। বুকের ভিতরে একটা অভিমান গুনগুন করে কাঁদছে, যেন মধুকুপির মরামাটির কান্না শুনতে পেয়েছে দাশু। মধুকুপির মাটির জন্য এই দুনিয়ার কারও মনে কোন মায়া নেই। আকাশের হাতিয়া তারাও বোধহয় মধুকুপির মাটিকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তা না হলে, এত ভাল মাটি একটু জল পায় না কেন? আর…মনে করতে পারে দাশু, এই তো কিছুক্ষণ আগে বাবুরবাজারের ফাঁড়ি পার হয়ে এইদিকে আসতে আসতে মাঝপথে একজায়গায় দাঁড়িয়ে মাটি-চালানী কোম্পানিটার যে কাণ্ডকারখানা নিজের চোখে দেখতে পেয়েছে। ডরানির বালুভরা বুকের উপর বিধ দিয়ে কোম্পানির কলটা কত জল তুলে একটা নালার ভিতরে গড়িয়ে দিচ্ছে। কারখানাটার দিকে কলকল করে কী সুন্দর জলের ঢল নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। কে জানে, এত জল নিয়ে কার কপালে ঢালবে ওরা? শুধু মধুকুপির মাটি জল বিনা পিয়াসে জ্বালায় জ্বলে আর মরে।
বাঁশঝাড়ের কটকট শব্দময় দোলানির ছায়া পার হয়ে একটা ঘরের কাছে জীর্ণ জামকাঠের দরজার সামনে থমকে দাঁড়ায় দাশু। বুকের ভিতরে অভিমানের গুঞ্জনটা এইবার তীব্র একটা আর্তনাদ হয়ে বেজে ওঠে।-আঃ, এ তোমার কেমন দয়া বটে কপালবাবা!
দরজার একটা কপাট কাত হয়ে ঝুলে রয়েছে। দরজার দু পাশের দেয়ালে শিয়ালের উৎপাতের চিহ্ন। দাশুর জীবনের একটা স্বপ্নালু আদরের ছবিকে একলা পেয়ে কেউ যেন আঁচড়ে কামড়ে আর তছনছ করে চলে গিয়েছে। দেয়ালের দু জায়গায় দুটো বড় গর্ত। হায় রে কিষাণের ঘর! ঘরের এমন দশা দেখলে যে আবার ঘিন্না করে চলে যাবে মুরলী।
আস্তে আস্তে হাত তুলে দরজার একটা কপাট ঠেলে দিয়ে ঘরের ভিতরের শূন্যতার দিকে কিছুক্ষণ নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে দাশু। তারপর ফুঁপিয়ে ওঠে। না, তুই আয় মুরলী। ছেইলাটাকে কোলে নিয়ে এখনই চলে আয় না কেন? এ ঘরের এমন দশা আর ঢের দিন থাকবে না। আমি যদি হবে, তবে সবই যে হবে। ঘরটাকে নতুন মাটি দিয়ে ভাল করে নিতে কতদিন লাগে?
ঘরের ভিতরে ঢুকে চোখ মোছে দাশু। এইবার দেখতে পায়, মেঝের উপর মাটি কামড়ে পড়ে আছে মরচে-পড়া টাঙ্গিটা। দাশুর সারা জীবনের মেহনতের সঙ্গী সেই চকচকে টাঙ্গিটাও যেন এই তিন বছরের অবহেলার দুঃখে মরমর হয়ে গিয়েছে।
টাঙ্গিটাকে তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে দাওয়ার উপর বসে দাশু। একটা নুড়ি তুলে নিয়ে এসে টাঙ্গিটাকে ঘষে ঘষে মরচে ছাড়াতে থাকে। দাশুর কপালের রগ ফুলে ফুলে নাচতে থাকে। যেন হঠাৎ আবার এক দূরন্ত আশার প্রেরণা পেয়ে দাশু কিষাণের প্রাণ আবার একটা জেদ ধরতে শুরু করে দিয়েছে। জমি যখন পাওয়া যাবে, তখন আর এত উর কিসের? নুড়ি দিয়ে ঘষে ঘষে যেন কঠোর একটা অদৃষ্টের মরচে ছাড়াতে থাকে দাও।
এখন শুধু একটা কাজ চাই। টাঙ্গিটাকে কোলের উপর শুইয়ে রেখে সড়কের নিমের ছায়াটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দাশু। ঈশান মোক্তারের মনিষ হয়ে খাটতে ইচ্ছা করে না; বড় গুমস্তা, সেই জাদটা, দুখনবাবু যার নাম, সে কি দাশু কিষাণকে মধুকুপির কোন ক্ষেতের মাটি আর ছুঁতে দিবে? কভি না। সুরেন মান্ঝির মত রাগ করে গাঁ ছেড়ে সদরপানে দিনমজুরী খাটতে যাওয়াও চলে না। চলে যেয়ে লাভ নেই। না, কিষাণ মানুষ কুলি হবে কেন? খাদের কাজেও ঠোকর আছে। ছাঁটাইয়ের মার খেয়ে আবার ভুখা কুকুরের মত গাঁয়ের পানে ফিরে আসতে হয়।
কিন্তু কাজ কই? দাশু কিষাণের পাথুরের বুকের সব আশা আর দুঃসাহস আবার ভীরু হয়ে দূরদূর করে কাঁপতে থাকে। এত ভাল মধুকুপির মাটিতে কাজ নেই কেন গো কপালবাবা? গোবিন্দপুর জেলখানার এতটুকু ক্ষেত আর বাগিচা যদি এত দিতে পারে, তবে…।
কি ভেবে ছটফট করে উঠে দাঁড়ায় দাশু। কাজ আছে নিশ্চয়। তা না হলে বড় বুড়া রতন আর সনাতন লাইয়া বেঁচে আছে ও গায়েতেই আছে কেমন করে?
কিন্তু ওরা আছে কি? গাঁয়ের মুখিয়া রতনও কি সুরেন মান্ঝির মত গাঁয়ের মাটিকে ঘিন্না করে চলে গিয়েছে?
গাঁয়ের কিষাণগুলো সত্যিই আছে কি নাই? ভয়ানক সন্দেহের ধুলো যেন দাশুর ফ্যালফ্যালে চোখের উপর ছিটকে পড়ছে। সত্যিই তো, এখন পর্যন্ত এই পথ দিয়ে গাঁয়ে একটা মানুষকেও যেতে দেখা গেল না। মহুয়াতে নতুন ফুল ধরেছে, এখন তো আখড়াতে মাদলের বোল আর ঝুমুরের গান বেজে ওঠবার সময়। কিন্তু কই, মাদলের শব্দ দুরে থাকুক, গাঁয়ের কোন দিক থেকে মানুষের হাঁকডাকের একটা ছোট শব্দও শোনা যায় না।
এ কেমন রহস্য! এ আবার তোমার কোন রাগের খেলা গো কপালবাবা? জাতপঞ্চ কি আর নাই? গরুচরানী জগমোতি কালিমণি আর বুধনিও কি নাই? গত কমে কি ওরা খোঁপাতে ফুল ঠাসে নাই, হলুদে ছোপানো শাড়ি পরে নাই, আর মহুয়ার নেশাতে মাতোয়ালা হয়ে সারা রাত নাচে নাই?
দাওয়া থেকে নেমে দৌড়ে দৌড়ে চলতে থাকে দাশু। আর, রতনের ঘরের কাছে এসে চেঁচিয়ে ওঠে-কোথায় গেলে গো কাকা?
কোন সাড়া নেই। রতনের ঘরের দরজায় হুড়কো টানা রয়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে দমশুর চোখের আতঙ্ক ছলছল করতে থাকে। বুড়ার যে ছোট ছোট দুটো নাতিও ছিল; ওরা ঘরে নাই কেন?
একটু দূরে ভেরেণ্ডার বেড়া দিয়ে ঘো যে ঘরের দরজার কাছে একটা ছাগল বাঁধা রয়েছে, সেটা হল সনান লাইয়ার ঘর। চেঁচিয়ে ডাক দেয় দাশুসনাতন হে!
ছাগলটার পিঠের কাছে সাদা চুলের জঞ্জালে ছাওয়া একটা মাথা ঠকঠক করে নড়ে ওঠে। সনাতনের মা বটে কি?
হ্যাঁ, তাই; দাশু কাছে এসে দাঁড়াতেই সনাতনের মা বলে—ওরা ঘরে নাই গো।
–কেন?
–উয়ারা খাটতে গেছে।
–কোথায় গেল?
–হোই জামুনগড়ার ডাঙা পানে।
—গাঁয়ের সব মানুষ গেছে কি?
–হ্যাঁ গো; সেকথা আর শুধাও কেনে? আমার দাদুয়াটাও গেল।
–সে কি গো দাদী। সনাতনের ছেইলাটাও যায় কেন? ওটা তো একটা বাচ্চা বটে গো।
–হ্যাঁ গো, সাত বছর বয়স হলে উয়ার।
সনাতনের সাত বছর বয়সের বাচ্চা ছেলেটাও জামুনগড়ার ডাঙাতে খাটতে চলে গিয়েছে। এ কি অদ্ভুত কথা বলছে দাদী বুড়ী? গাঁয়ের সব বুড়ো জোয়ান আর বাচ্চা গিয়ে কাজের উৎসবে ঝাপ দিয়ে পড়েছে, তবে বুড়ীর গলার স্বরে ক্ষীণ হাহাকারের মত একটা আওয়াজ মিছা ঠক্ঠক্ করে কেন?
দাশু বলে-গাঁয়ের বেটিগুলাও গেছে কি?
-হ্যাঁ গো। সনাতনের মা’র মাথাটা কেঁপে কেঁপে আবার সাদা চুলের জঞ্জাল কাপাতে থাকে সব সব; বউ বিটি বহিন, সব গেছে।
এক মুঠা ভেজা ছোলা মুখের ভিতর ফেলে দিয়ে সনাতনের মা বলে-সাঁঝের পর উয়ারা গাঁয়ে ফিরবেক।
এ কেমন কাজ? দাশুর বুকের ভিতর থেকে একটা খুশির চিৎকার ঠিকরে বের হতে চায়। সারা গাঁয়ের মানুষ খাটবার কাজ পেয়ে গেল; তুমি কত দয়া জান, তোমার পাও লাগি কপালবাবা!
আর এক মুহূর্তও দেরি করে না দাশু। মধুকুপির পিপুলের ছায়ার কাছে এসে পোঁছতেও দেরি হয় না। তারপর ডরানির স্রোতের লোহা বাঁধানো পু; তার একটু দুরে এগিয়ে যেতেই জামুনগড়ার সড়ক। সেই সড়ক ধরে ছুটে ছুটে চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় দাশু; আর, আবার একটা ভীরু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে, ফ্যালফ্যালে চাহনি তুলে সামনের ডাঙাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কাছেই ডাঙার উপরে টিনের একটা চালার নীচে ছোট একটা টেবিল; সেই টেবিলের উপর একটা বাক্স। টেবিলের কাছে একটা চেয়ারের উপর উবু হয়ে বসে হাসছে যে লোকটা, তাকে দেখা মাত্র চিনতে পারে দাশু। বাবু দুখন সিং। মস্ত বড় একটা খাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে বাবুটা, তারই সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে মধুকুপির দুখনবাবু।
আর, একটু দুরে ডাঙার বুকের উপর ধুলো উড়ছে। মাটি কাটছে সবাই; বুড়ো, আধবুড়ো, জোয়ান আর আধজোয়ান। ঝুড়ি ভর্তি মাটি মাথায় তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছে আর এগিয়ে যাচ্ছে যারা, তাদের ধুলোমাখা চেহারাগুলিকেও চিনতে পারে দাও। মধুকুপির কিষাণের ঘরের যত বউ বেটি আর বহিন। বাচ্চা ছেলেগুলিও ছোট ছোট ঝুড়ি মাথায় নিয়ে কিলবিল করছে। ডাঙার উপর দিয়ে এক সারি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা দড়ির লাইন এঁকেবেঁকে অনেকদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে; মাটিবহা মেয়েরা আর বাচ্চারা ঝুপঝাপ করে লাইনের পাশে মাটি ফেলছে।
আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় দাশু; টিনের একচালার কাছে এসে দাঁড়ায়। বাবু দুখন সিং ভুরু পাকিয়ে হেসে ওঠেকবে ছাড়া পেলে হে, দাশু? কোদাল নিবে নাকি হে? না, নগদ টাকায় জমি কিনে নিয়ে জোত করবে?
দাশু বিড় বিড় করে—এটা কিসের কাজ বটে?
দুখনবাবু-টেস রিলিফ বটে?
দাশুর চোখ দুটো আরও বেশি ফ্যালফ্যাল করে-সেটা কি বটে?
দুখন সিং-সরকার খয়রাতী করছে; তুমি ভিখমজর হয়ে খাটবে, এই কাজ।
বাবু ভদ্রলোক খাতাটাকে বুকের উপর চেপে ধরে আর দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মায়াময় আক্ষেপের হাসি হাসেন-বাস্তবিক, এদিকের জংলী গাঁয়ের মানুষগুলো কী সরল!
মধুকুপি ও আশেপাশের আরও দশটা গাঁয়ের সব আউশ আর আমন অজন্মাতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই দুখনবাবু বার বার সদরের দৌড়াদৌড়ি করে, ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করে, আরও অনেক রকমের চেষ্টা করে এই টেস্ট রিলিফ মঞ্জুর করাতে পেরেছে। হাতে কাজ নেই, ঘরে এক দানা চাল নেই, এহেন দুখীদের কাজ দিয়ে বাঁচাবার জন্য সরকার জানুনগড়ার ডাঙার বুকের উপর দিয়ে এই সড়ক টানবার অর্ডার দিয়েছে। সড়কটা জামুনগড়ার পুবের দিকে এক ক্রোশ এগিয়ে যেয়ে সীতাপুর রোডের সঙ্গে মিশে যাবে। বাবু দুখন সিং এই টেস্ট রিলিফের ঠিকা নিয়ে পে-মাস্টার হয়েছে। বাবু ভদ্রলোকটি হলেন রিলিফের ইনস্পেক্টর। বুড়ো আর জোয়ান মাটিকাটার রোজানা মজুরি আট আনা। মাটিবহা মেয়ের মজুরি ছয় আনা। বাচ্চারা পায় চার আনা।
টেস্ট রিলিফের অফিসে এই একচালার কাছে একটা দোকানও বসে গিয়েছে। চাল, মাষকলাই, মকাই, নুন আর শুকনো মরিচ। এই দোকানের মালিক বাবু দুখন সিং। দুখনবাবুর চাকর দাঁড়িপাল্লা আর বাটখারা সামনে রেখে সারাদিন ঝিমোয় আর বিড়ি টানে। সন্ধ্যা হবার কিছু আগে মাটি-কাটা আর মাটিবহা মানুষের দল যখন এসে ভিড় করে দুখনবাবুর কাছ থেকে মজুরি নিতে থাকে, তখন ব্যস্ত হয়ে ওঠে দুখনবাবুর দোকানের চাকর। নগদ নগদ পয়সা দিয়ে চাল মকাই আর নুন মরিচ কিনে, আর পুঁটলি করে বেঁধে নিয়ে যখন সবাই চলে যায়, তখন চাকরটার মত দোকানটাও আবার ঝিমিয়ে পড়ে।
তারপর হিসেব হয়। পে-মাস্টার দুখন সিং হিসেব করে রিলিফের ইনস্পেক্টরের বখরা মিটিয়ে দেয়। হাজিরাখাতার একগাদা ভুয়া নামের তালিকায় সই দেবার আগে অন্তত বিশটা টাকা হাতে না নিয়ে ছাড়েন না ইনস্পেক্টর। আবার, হাজির মজুরদের রোজানা রেট মাথাপ্রতি দু আনা বাড়িয়ে খাতায় লিখে নিয়ে যখন আবার হিসেব করে ফেলে দুখনবাবু তখন সই দেবার আগে আবার বিশটা টাকা পে-মাস্টার দুখনবাবুর হাত থেকে নিজের হাতে তুলে নেন ইনস্পেক্টর। এই ইনস্পেক্টর সাধাসিধা সরল গেঁয়ো মানুষদের খুব পছন্দ করেন। কয়লা-খাদে কাজ করে বড় চালাক হয়ে গিয়েছে; সেই সুরেন মানঝির মত সন্দেহের মানুষ যেন এখানে আর না আসে। কী ভয়ানক হাঙ্গামা করে আর মজুরির হিসাব নিয়ে উৎপাত করে শেষে ভালয় ভালয় বিদায় নিয়েছে লোকটা। আট আনা হাতে নিয়ে দশ আনার প্রাপ্তি স্বীকার করে না, টিপ সই দিতে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, এই কিষাণ বেচারা বোধহয় সেরকম ধূর্ত মানুষ নয়।
দাশুর দিকে তাকিয়ে ইনস্পেক্টর বলেন-কোদাল চাও তত বল।
উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। বাবু দুখন সিংয়ের কথাগুলি, আর এই বাবু ভদ্রলোকের মুখের হাসি যেন একটা নির্দয় ঠাট্টার মাতলামি। মধুকুপির কিষাণকে ভিখমজুর হয়ে আট আনা রোজানায় মাটি কাটতে বলছে কি-ভয়ানক একটা বাচাল অপমান।
–কি হে সরদার? কাজ নিতে এত ভাবনা কিসের? আবার হাঁক পাড়েন ইনস্পেক্টর।
তবু বোবার মত শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। ভিখমজুরের কাজ; কাজটা যেন কয়লার ধুলোর চেয়েও কালো ময়লার ধুলোতে ঢাকা আরও ভয়ানক একটা কাজ। কিন্তু… দাশুর বধির আত্মা যেন হঠাৎ চমকে ওঠে; কোমরের কাছে ধুতির শুন্য গোজায় হাত দিয়ে কাঁপতে থাকে; সেই পাঁচটা টাকাও নেই। সারাদিনের না-খাওয়া পেটটাও কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। এক বেলার মজুর যদি চার আনা হয়, তবে তো এক সের মাইয়ের দানা হয়। হায় কপালবাবা!
-দেন তবে একটা কোদাল। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। বাবু দুখন সিংয়ের ভুরু দুটো কুঁকড়ে যায়; চেঁচিয়ে হেসে ওঠে দুখনবাবু। আর, কোদালটা হাতে নিয়ে মাটি কাটা লাইনের দিকে দৌড়তে থাকে দাও।
কাকে যেন খুঁজতে থাকে দাশু। দাশুর চোখে-মুখে ভয়ানক একটা অভিমানের জ্বালা। ছোট ছোট এক-একটা ধুলোমাখা ভিড়ের কাছে এসে একবার থমকে দাঁড়ায়, তারপরেই দৌড়তে থাকে দাশু। সব ভিখমজুর! দুখনবাবুর জাতপঞ্চ যে এত যত্ন করে জাত ভাগ করেছিল, কোথায় সেই ভাগ? জাতিয়া খাদিয়া আর কুঁকড়াশি, সবই যে এক ধুলোয় ঢাকা পড়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।
লাইনের একেবারে শেষ মুখে, যেখানে রোদের জ্বালায় পিঠ পুড়িয়ে একটা মাটির টিলার গায়ে ঝুপঝাপ কোদালের কোপ মারছে একটা জীর্ণশীর্ণ বুড়ো শরীর, তারই কাছে এসে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–গাঁয়ের মুখিয়া হয়ে তুমি এমন পাপ কর কেন গো, কাকা?
চমকে ওঠে বড় বুড়া রতন। কোদাল থামিয়ে আর হাঁপাতে হাঁপাতে দাশুর মুখের দিকে করুণভাবে তাকায়।
দাশু বলে–তুমি ভিখমজুর হও কেন? তোমার কি একটুও মানে লাগে না কাকা?
বড় বুড়া রতন ধুঁকতে ধুকতে বলে—মানে লাগে হে, কিন্তু পেট মানে না।
দাশুর মাথাটা কেঁপে ওঠে; তার পরেই একেবারে হেঁট হয়ে ঝুলে পড়ে। বড় বুড়ার কথাগুলি যেন একটা ভয়ানক কঠোর কোদালের কোপের মত দাশুর গাওয়ার অহংকারের উপর আছড়ে পড়েছে। সেই অহংকার একটা ভয়াল যন্ত্রণায় কেঁপে উঠছে। পেট মানে না; ঠিক কথা। তাই না কিষাণের প্রাণ বুড়া খরগোশটার মত মরা ঘাসের শিকড় খুঁড়ে খাওয়ার জন্য গর্ত ছেড়ে আর মরণ-বিধেরও তাড়া সহ্য করে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। তা না হলে দাশু কিষাণ আজ দুখনবাবুর মত মানুষের মুখের ওই ঠাট্টার ভাষা আর হাসি সহ্য করে কোদাল হাতে তুলে নেয় কেন, আর ভিখমজুর হয়ে মাটি কাটতে রাজী হয়ে যায় কেন? হায় কপালবাবা, কিষাণের গতরে হাত-পা ও মাথার সাথে একটা পেট আবার দিলে কেন? পেট যদি দিলে তবে আবার ভুক দিলে কেন?
দাশুর হেঁট মাথাটা রোদের তাপে তপ্ত হয়ে যখন আবার কেঁপে ওঠে, তখন চোখে পড়ে দাশুর, মাটির টিলার ওদিক থেকে এক জোড়া ধুলোমাখা ভুরুর নিচে এক জোড়া শুকনো চোখের দৃষ্টি দাশুরই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
সনাতন! চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। কত রোগা হয়ে গিয়েছে সনাতন! সনাতনের গলাটা যেন শুকনো মাংসের দড়ি দিয়ে জড়ানো একটা হাড়। ছোট্ট এক ফালি কাপড়কে লেংটির মত পরে আর কোদাল হাতে নিয়ে দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে সনাতন; সনাতনের হাসিটা যেন ধুকছে। হায় কপালবাবা জাতের লাইয়াও লেংটি পরে আর ভিখমজুরদের হয়? করমের দিনে সনাতনের ওই শরীরটা যে মাদল বুকে নিয়ে বনময়ুরের মত দুলে দুলে আখড়ার মাতাল ঝুমুরের আনন্দকে আরও মাতাল করে দুলিয়ে দিত।
সনাতন হাসে–হ্যাঁ দাশু, পেট মানে না, তা না হলে তুমিই বা এখানে আস কেন?
ঝুপ ঝুপ ঝুপ! জানুনগড়ার ডাঙায় বুকের উপর দড়ির লাইনের পাশে ভিখমজুরের কোদাল আছড়ে পড়ছে আর উঠছে। উড়ন্ত ধুলোরও একটা লাইন এঁকেবেঁকে অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়ে গড়িয়ে বাতাসে ভাসছে। কোদাল চালিয়ে মাটি কাটছে রতন আর সনাতন; রতনের বুড়ো পিঠের চাম রোদের তাপে পুড়ছে, জোয়ান সনাতনের গলার শুকনো মাংসের দড়িতে মাটির ধুলো ঘামে ভিজে গিয়ে কাদা হয়ে যাচ্ছে। চুপ করে দাড়িয়ে দেখতে থাকে দাশু দাশুর চোখ দুটো যেন ভয় পেয়ে একেবারে সাড়াহীন আর বোধহীন মুখতার দুটো ঢেলা হয়ে গিয়েছে।
–ও কে বটে? দাশুর চোখ দুটো যেন হঠাৎ একটু বোধ ফিরে পেয়ে চমকে ওঠে। মাটির টিলার আর-এক পাশ থেকে উঁকি দিয়ে দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কার চোখ? এই চোখ দুটোকেও দুটো নির্বোধ বেদনার চোখ বলে মনে হয়।
–জটা রাখাল বটে কি হে? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।
জটা জবাব দেয়—জটা রাখালের প্রেত বটে!
তাই তো মনে হয়। বাবু দুখন সিংয়ের দয়ার জল খেয়ে খেয়ে কত মোটা হয়ে গিয়েছিল জটা রাখালের চেহারা। সেই চেহারা মরা-শালের মত শুকনো খটখটে হয়ে গিয়েছে। দুখনবাবুর মতলবের সাথী হয়ে নতুন জাতপঞ্চ করেছিল, জাতিয়া হয়েছিল; আর বনচণ্ডীর ভক্ত হয়ে বামন মেনেছিল যে জটা রাখাল, তার আবার এমন দশাটি হয় কেন? এই জটা রাখালই তো সেই নতুন পঞ্চের মানুষ, যে পঞ্চ একটা বড়াইয়ের নিয়ম করেছিল, ভাতভাইয়ারীতে খাদিয়া আর কুঁকড়াশিদের সাথে এক ঠাঁই বসবে না জাতিয়ারা। ঈশান মোক্তারের জমিতে মনিষ খেটে বড় সুখে থাকবে ওরা, সে আশা আজ ভিখমজুর হয়ে যায় কেন? দাশুর ঠোঁট দুটো কঠোর ঠাট্টার হাসি হাসতে গিয়ে কুঁকড়ে যায়।
–কথা বল না কেন জটা? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।
জটা বলে–কোন কথা নাই দাশু।
দাশু হাসে-তুমিও সিংহ হয়েছিলে কি?
জটা–হ্যাঁ।
দাশু–পৈতা নিয়েছিলে কি?
জটা–হ্যাঁ।
দাশু–বনচণ্ডীকে তুষেছিলে কি?
জটা–হ্যাঁ।
দাশু–তবে?
জটা-তবে আর কি বটে?
দাশু–শুধাই, তোমার কি হলো?
জটা–সবই হলো। আমার গতি হলো, অনেক পুণ্য হলো জনম নিতে আর হবে না।
যেন একটা দুঃসহ আক্রোশের গর্জন চেপে বিড় বিড় করে আর ঝুপ ঝপ করে কোদাল চালিয়ে মাটি কাটতে থাকে জটা রাখাল। দাশুর ঠোঁটের উপর কুঁকড়ে-ওঠা ঠাট্টার হাসিটা ব্যথা পেয়ে ছিঁড়ে যায়। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। চোগে পড়েছে দাশুর, জটা রাখালের সেই মোটাসোটা পেটের চেহারাটা কি-ভয়ানক চুপসে গিয়ে কতটুকু হয়ে গিয়েছে।
দাশু বলে-আমার কথা শুনে কি দুখ পেলে জটা?
জটা-না।
দাশু–ঈশান মোক্তারের জমিতে মনিষ না খেটে তুমি এখানে খাট কেন?
জটা—ওরা এখন আর জমিতে মনিষ খাটাবে না।
দাশু–কেন?
জটা-খরার ভয়ে। ছিটাই করলেও বীজ কলাবে না; ওদের লোকসান হবে। ভাদুয়া জল যদি বর্ষায় তবে আমাদিগে আবার কাজ দিবে; তার আগে দিবে না।
চোখ তুলে জ্বলন্ত আকাশটার দিকে তাকাতে গিয়ে দাশুর চোখও যেন জ্বলতে থাকে। ডরানির বুকটাকেও শুকনো খটখটে করে দিয়েছে এই দয়াহীন আকাশটা।
হেসে ওঠে জটা রাখাল। হাসির শব্দটা আর্তনাদের মত।
দাশু বলে–কি বটে জটা? হাস কেন?
জটা বলে—ওরা এখন কি বলে জান?
দাশু–কি বলে?
জটা—ওরা এখন বলে, নাও না, কত জমি নিতে চাও। নিজের বীজ আর নিজের হাল নিয়ে ভাগজোত কর।
বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে দাশু। জটা বলে কিছু বুঝলে কি দাও?
দাশু–না।
জটা-ওরা বড় ভাল হিসাব জানে। খরাতে যখন মাটি মরে, তখন ভাগজোত নিতে সাধে; আর যখন শাওনের জলে মাটিতে রস লাগে, তখন বলে এক সের চাল রোজানা নিয়ে মনিষ খাট। ওরা…ওরা ঠগ বটে, প্রেত বটে, কিষাণের সুখের দুশমন বটে।
বলতে বলতে একটা দূরন্ত আক্রোশের স্বর দাঁতে দাঁতে পিষে দিতে দিতে চেঁচিয়ে ওঠে জটা এমন গাঁয়ের মাটিতে থুক ফেলে আমিও সুরেন মান্ঝির মত চলে যাব। জটার চোপসানো পেটটা থরথর করে কাঁপতে থাকে।
বড় বুড়া রতনের গলার স্বর শোনা যায়-থাম জটা। চুপচাপ কাজ কর।…তুমিও কাজ কর না কেন দাশু? এখনও শুধু কুদালি হাতে নিয়ে খাড়া আছ কেন? আধা মজুরি নিবারও কি ইচ্ছা নাই?
তাই তো! এখনও শুধু কোদাল ছুঁয়ে মধুকুপির গাওয়ার অভিমানের যত জ্বালা আর জ্বালাতনের কথা বলে বলে আর শুনে শুনে ছটফট করছে দাশু। কিন্তু এগিয়ে আসছে একটা বাবু; ওর হাতে আলকাতরার দাগ আঁকা ছোট একটা বাঁশ। মাপের বাঁশ বটে কি? হ্যাঁ, কাটা মাটির মাপ নিতে আসছে মাপবাবু। দশ হাত চৌকা হবে আর এক হাত গভীর হবে কাটা মাটির গড়হা, তবে তো আধা মজুরি মিলবে।
চেঁচিয়ে ওঠে মাপবাবু কী রে, কোন্ রসের কথা বটে রে! কাজ করিস না কেন?
ঝুপ ঝুপ ঝুপ! দাশুর কোদালও মাটির উপর আছড়ে পড়ে শব্দ করতে থাকে।
জীর্ণ জামকাঠের দরজার ঝুলে-পড়া কপাটটা আবার সোজা করে তুলে চৌকাঠের খুঁটোর সঙ্গে চোপের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে বসিয়ে দিয়েছে দাশু। দরজার দু পাশের দেয়ালে যেখানে শিয়ালের আঁচড়ের উৎপাতে মাটি ঝরে পড়ে গিয়ে বড় বড় দুটো ফুটো হয়ে গিয়েছিল, সেখানে আবার নতুন কাদা ভরে দিয়েছে।
একটা একটা দিন পার হতে হতে দুটো মাস পার হয়ে গেল। জামুনগড়ার ডাঙাতে দুই বেলার মাটিকাটা মেহনতের জীবন, যেন শুধু পুড়ে পুড়ে বেঁচে থাকার জীবন। সন্ধ্যা হলে মধুকুপির দিকে ফিরে যাবার সময় যখন কপালবাবার জঙ্গলের দিক থেকে পচা পাতার গন্ধ নিয়ে এক-একটা হাওয়া শনশন করে ছুটে আসে, শুধু তখন যেন শরীরের, সেই সঙ্গে মনের ভিতরেও সারাদিনের প্রদাহটা একটু জুড়িয়ে যায়।
টেস্ট রিলিফের অফিসে একচালার পাশে দুখনবাবুর সেই দোকান থেকে যেদিন শুধু এক সের বা দেড় সের ভেজা ছোলা কিনে আর গামছায় বেঁধে নিয়ে ঘরে ফেরে দাশু, সেদিন ঘরের ভিতরে আর উনান জ্বালতে হয় না। কিন্তু যেদিন সাধ করে চাল কিনে নিয়ে আসে, সেদিন উনান জ্বালতে হয়।
কিন্তু এই সাধ, এই ভাত রাঁধাই যে একটা জ্বালা। হাঁড়ি হাতে নিয়ে সোজা হেঁটে একেবারে ডরানির বুকের উপর অন্ধকারে ঢাকা বালিয়াড়ির কাছে এগিয়ে যেতে হয়। ভেজা বালু খুঁজতে গিয়ে আরও অনেকক্ষণ ধরে এদিক-ওদিক হাঁটতে হয়। তারপর ব্যাঙের লাফালাফির শব্দ শুনে ছোট একটা দহের কাছে এগিয়ে যেয়ে হাঁড়িতে জল ভরতে হয়। তারপর আবার ঘরে ফিরে এসে, উনানে শুকনো পাতার আগুন জ্বেলে…হায় কপালবাবা! উনানে শুকনো পাতার আগুন দাউ দাউ করে কাঁপে। দাশুর ঘরের ভিতরে যেন ভয়ানক একটা শূন্যতা দাউ দাউ করে কাঁপছে। দাশুর পাথুরে ছাঁদের কঠিন শরীর সব মেহনত সহ্য করতে পারে; কিন্তু সহ্য করতে পারে না শুধু এই উনান-জ্বালা আর ভাত রাঁধা মেহনত। হাঁড়িতে চাল ছাড়তে গিয়ে দাশুর হাতটাই যেন ফুঁপিয়ে কেঁপে ওঠে। এমন ভাতে পেট ভরে কিন্তু মন ভরে না। এমন ভাতে কোন স্বাদ নেই। মুরলীর হাতে এই হাঁড়িতে চাল ছাড়া হত, তাই না সে ভাতে এত স্বাদ হত।
কাঁসার একটা থালি। থালিটাকে ধুতে হয়। কিন্তু হাত দুটো যে আবার ফুঁপিয়ে কেঁপে ওঠে। এটা যে সেই থালিটা বটে গো কপালবাবা, যে থালিতে কত ভাত ঢেলেছে মুরলী আর দাশু কিষাণের মুখের দিকে তাকিয়ে কত হাসি হেসেছে। মুরলী, তুই আয়! এসে আবার একটুক দুখ কর না কেন? তারপর জমি যখন হবে, তখন…।
খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর যখন দাশু কিষাণের ভিখমজুরি-খাটা শরীরটা ঘুমের ভারে অলস হয়ে পড়ে থাকে, তখনও দাশুর বুকের ভিতরটা যেন বিড়বিড় করে-মুরলী, তুই আয়।
যেদিন চার আনার ভাজা ছোলার সঙ্গে চার আনার হাঁড়িয়ার নেশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে দাশু সেদিন মাঝরাতের প্রহর শেষ না হতেই দাশুর নিঝুম বুকের একটা স্বপ্ন যেন চিৎকার করে ওঠে—ছেইলাটাকে একবার নিয়ে আয় না কেন মুরলী!
রাতশেষের ঘুম যেন একটা সান্ত্বনায় স্নিগ্ধ হয়ে যায়। নতুন মাটির ঘর হল, পাঁচ বিঘা জমি হল। ক্ষেত ঘিরে গুলঞ্চের বেড়াতে ফুল ধরল। ক্ষেতের ধানের শিসের উপর তিতলি ফড়িং উড়ে বেড়ায়। চল মুরলী, একবারটি আখড়াতে যাই।
জিত হয়েছে দাশুর। কিষাণের প্রতিজ্ঞা জয়ী হয়েছে। জমির সুখে মজবুত হয়ে কিষাণের হাত এইবার একটা লুঠেরা ডাকাতের হাত কড়কড় করে ভেঙে দিয়েছে আর মুরলীকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে বুকে চেপে ধরেছে। তারপর বুকের কাছে মাদলটা, কাঁধের উপর ছেইলাটা, পাশে পাশে মুরলী।
না, ধিতাং ধিতাং নয়, ঘড়াং ঘড়াং; দাশুর স্বপ্নের ঘোর পিষে দিয়ে ভয়ানক কর্কশ একটা শব্দ বেজে বেজে চলে গেল। জীর্ণ জামকাঠের দরজাটা কাঁপছে। চালার বাতা থেকে ঝুরঝুর করে ঘুণের ধুলো ঝরে পড়ছে।
ঘুম-ভাঙা চোখ দু হাতে চেপে আর ধড়ফড় করে খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর উঠে বসে দাশু। শুনতে পায় দাশু; সড়কের উপর দিয়ে ঘড়াং ঘড়াং শব্দ করে যেন একটা
অতিকায় লোহার জানোয়ার প্রচণ্ড হাগোড় বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে।
ঠিকই সন্দেহ করেছে দাশু। ঘরের বাইরে এসে আর ব্যস্তভাবে হেঁটে একেবারে সড়কের কাছে এসে দেখতে থাকে দাশু; কিন্তু দেখে কিছু বুঝতে পারে না। শুধু মনে হয়, ঘড়াং ঘড়াং করে কলকজা দিয়ে গড়া একটা রহস্য হামা দিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে।
–এটা কি বটে গো? চেঁচিয়ে হাঁক দেয় দাশু।
–এটা ট্রাকটু বটে গো। লাঙ্গলগাড়ি বটে।
যে লোকটা উত্তর দেয়, তার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে দাশুর বুকটা ভয়ানক এক বিস্ময়ের বেদনায় জ্বলে ওঠে। উত্তর দিয়েছে যে, সে হল সনাতন। গাঁয়ের লাইয়া সনাতন। মধুকুপির বেটিবহিনের বিয়াতে আর পূজা-পরবে ও উৎসবের আরম্ভে মাটির উপর জল ছিটিয়ে মাঙ্গলিক কাজ করবে যে, জীবনের এতটা কাল এই কাজ করে এসেছে যে, সেই সনাতন।
ট্রাকটরের উপর চাকা ধরে বসে আছে যে গম্ভীর একটা লোক, তারই পিছনে চাকরের মত ভঙ্গী নিয়ে উবু হয়ে বসে আছে সনাতন। খাকি কামিজ আর খাকি প্যান্ট পরেছে সনাতন। সনাতনের মাথায় কালিঝুলি মাখা এক টুকরো কাপড় ফেটির মত জড়ানো। এখন বুঝতে পারে দাও, কেন এই দশ দিনের মধ্যে জামুনগড়ার ডাঙায় সনাতনকে মাটি কাটতে দেখতে পাওয়া যায় নি। কিন্তু…।
–কিন্তু তুমি এটার সাথে কেন সনাতন? দাশুর গলার স্বর গরগর করে।
সনাতন হাসে-আমি খালাসী বটি দাও। ত্রিশ টাকা মাসোহারা, তা ছাড়া খোরাকিও দিবে।
–তুমি চললে কোন্ নরকে? আবার চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।
সনাতন বলে রামগড়ে চললাম। এটা রামগড়ের সরকারী খামারের লাঙ্গলগাড়ি বটে।
ঘড়াং ঘড়াং, ঘড়াং ঘড়াং, মধুকুপির সড়কের বুকে কর্কশ উল্লাসে ঠোকর দিতে দিতে লাঙ্গল-গাড়ির দাঁতাল চাকা গড়িয়ে যেতে থাকে। সে শব্দ শুনতে শুনতে দাশুর কানে তালা ধরে যায়। দাশুর প্রাণটাও যেন বধির হয়ে আর নিঝুম হয়ে যায়। সড়কের ধারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু।
ঢিপ ঢিপ শব্দ করে বেজে চলেছে দাশুর হৃৎপিণ্ডটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আর এই টিপ টিপ শব্দ শুনতে শুনতে দাশুর প্রাণের জোরও যেন ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ছে। চোখ দুটো ভিজে আঠা-আঠা হয়ে গিয়েছে। মধুকুপীর ভোরের আকাশটাকে ভাল করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। শরীরের যত হাতের গাঁটে অদ্ভুত একটা ব্যথা সুড় সুড় করছে। জ্বর হয়েছে বোধ হয়। তা না হলে মাথার ভিতরে এত তাত কেন? ঘাড়টা কাঁপে কেন? জিভে জল নেই মনে হয় কেন? গলার ভিতরে একগাদা তেতো কফ আটকে আছে কেন? তোমার পাও লাগি কপালবাবা, দাশু কিষাণের এই পাথরখানা শক্ত গতরে রোগবালাই দিও না। হাঁপাতে থাকে দাশু।
হ্যাঁ, জ্বর হয়েছে। নিঃশ্বাসের বাতাস গরম হয়ে জ্বলছে। জ্বলুক, সেজন্য কোন চিন্তা নেই। এক হাঁড়ি জলে দশটা বহেড়া সিদ্ধ করে নিয়ে সেই জল ঢক ঢক করে খেয়ে একটা ঘুম দিলেই জ্বর ছেড়ে যাবে। কিন্তু, এখনই যে জামুনগড়ার ডাঙায় মাটি কাটতে যেতে হবে।
–চললাম দাশু। কর্কশ স্বরের একটা আচমকা আওয়াজ; যেন পটকার শব্দের মত একটা আছাড় খাওয়া আক্ষেপের শব্দ। আনমনা দাশুর কান দুটো আবার চমকে ওঠে। আর, একটা কাক নিমগাছের ডালে বসে গলা ফোলানো স্বরে ক ক করে ডাকে।
দাশুর একেবারে কাছে এসে ডাক দিয়েছে জটা রাখাল। জটা রাখালের এক হাতে একটা পুঁটলি, আর, এক হাতে লাঠি। জটা রাখালের চোপসানো পেটটা শক্ত করে একটা ছেঁড়া গামছা দিয়ে বাঁধা।
–কি বটে জটা? তুমি আবার কোথায় চললে? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে দাশু।
জটা বলে–জানি না দাশু।
দাশুজান না, তবে গাঁ ছেড়ে যাও কেন?
জটা-গাঁয়ে থাকলে মরণ হবে গো দাদা।
চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–কেন মরণ হবে? তুমি কি শুন নাই যে কিষাণদিগে জমি দিবে সরকার?
হেসে ওঠে জটা—শুনেছি, আমাদিগের মরণ হবার পর দিবে।..আচ্ছা…কপালবাবা তোমাকে সুখে রাখেন, আমি এখন চলি।
হন হন করে হেঁটে চলে গেল জটা রাখাল। আর, দাশুর বুকের ভিতরে একটা হাহাকার যেন দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। কী ভয়ানক অবিশ্বাসের হাসি হেসে দাশুর আশার লোভটাকে নিষ্ঠুর ঠাট্টায় আহত করে চলে গেল জটা। যে আশায় আশ্বস্ত হয়ে এই দু মাস ধরে ভিখমজুরির দুঃখ আর অপমান সহ্য করেছে দাশু, সে আশা কি একটা মিছা লোভের মিছা পিয়াস? ওটা কি শুধু ভোটের বাবুদের একটা গীতের কথা বটে? কিষাণে তবে জমি পাবে না?
দাশুর বুকের ভিতরে আহত আশার জ্বালা ছটফট করতে থাকে। তবে কি মুরলী আসবে? তবে কি মুরলী ফিরে এসেও আবার কেঁদে চলে যাবে? হাত বাড়িয়ে মুরলীর কোল থেকে ছেইলাকে নিতে গেলে মুরলী কি তবে দাশুর সেই লোলুপ হাতটাকে একটা ঘৃণার ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দেবে? না গো মধুকুপির কিষাণ, যে ছেইলাকে বাঁচাবার জোর নাই তোমার, সেই ছেইলাকে কোলে নিবার হক নাই তোমার।
আহত আশার জ্বালার সঙ্গে যেন দাও কিষাণের টাঙ্গি আর মাদলও জ্বলছে। গুলঞ্চের ফুলগুলি জ্বলছে। জ্বলছে ধানের শিস। জ্বলছে ঝুমুরের গীত আর নাচ। হাঁড়ির মহুয়াজলের মাতাল রসের স্বাদও জ্বলছে। আপন মাগ, আপন ছেইলা, আপন ঘর, আপন গাঁ-সব জ্বলছে।
শুকনো ও নেড়া যত ফাটা-মাটির ক্ষেত মাড়িয়ে আহত জানোয়ারের মত ছটফটিয়ে দৌড়তে থাকে দাশু; বড় বুড়া রতনের ঘরের দরজার কাছে এসে বুক-ফাটা চিকার ছাড়ে।–তুমিও কি বিশ্বাস কর না কাকা? কিষাণে কি জমি পাবে না?
গাঁয়ের মুখিয়া রতনের জিরজিরে চেহারার মত রতনের যে মাটির ঘরটা বুড়িয়ে জিরজিরে হয়ে গিয়েছে, তারই সামনের আঙিনার একদিকে রিঠাগাছের ভিড়ের কাছে অনেক মানুষের ভিড়। উবু হয়ে বসে আছে অনেকগুলি শুকনো, ক্লান্ত ও উদাস আশা। তার মধ্যে রতনের জিরজিরে চেহারাটাও কুঁকড়ে পাকিয়ে আর ছোট্ট একটা ভীরু শিশুর মত বোবা হয়ে বসে আছে।
জাতপঞ্চের সভা নয়; জরীপের একটা বাবু এসেছে। তাই ছুটে এসেছে মধুকুপির যত বুড়ো আধবুড়ো আর জোয়ান ভিখমজুর। কি বলে জরীপের বাবুটা?
ভিড়টা যেন আস্তে আস্তে হাঁপাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি হাঁপাচ্ছে তারাই, যারা টেস্ট রিলিফের মাটিকাটা মেহনতের কোদাল ফেলে রেখে দিয়ে দু দিনের জন্য রামগড়ের দিকে চলে গিয়েছিল। ত্রিশ টাকা মাসোহারা পাওয়া যাবে, আর উর্দি পরে ও কপালে তোয়ালের ফেট্টি বেঁধে লাঙলগাড়িতে খালাসী কাটবার কাজ মিলবে; চল হে চল। মস্ত বড় একটা আশার আহ্বাদে যেন মাতাল হয়ে ওরা গা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু সরকারী অফিসের হাসি ঠাট্টা ও তাড়া খেয়ে ফিরে এসেছে। কাজ নাই, একটার বেশি খালাসীর দরকার নাই। বড় ভাল কপাল করেছিল সনাতন, শুধু ওরই কাজ হল।
কিন্তু ওরা যে বললে, সবুর কর না কেন, কিষাণদিগের জমি দিবে সরকার। তাই কি জরীপের বাবুটা এসে গেল হে? চল হে চল; খবর পাওয়া মাত্র সবাই ছুটে এসেছে।
নতুন করে জমির শুমারী শুরু হয়েছে। চারদিকের দশটার মৌজার যত জমির দাগ আর খতিয়ানের মাপ নম্বর ও চৌহদ্দির হিসাবে ভরা নথিপত্রের একটা বোঝা গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে আর দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বসে আছে জরীপের বাবু।
বাবুটার চেহারাও কেমনতর একটা উদাস চেহারা। বাবুটা বোধ হয় মধুকুপির মনিষজীবনের এই শুকনো ক্লান্ত ও উদাস চেহারা দেখে খুব হতাশ হয়ে গিয়েছে।
হতাশ হবারই কথা। বাবুটা বলেছে, দাও, দুটা শসা আর এক ঢেলা গুড়, আর পোয়াটাক সরু চিড়া দাও; জলখাবার পর্ব তোমাদেরই গাঁয়ে সেরে নিই; বেলাও যে অনেক হলো! কিন্তু বাবুটার এই সামান্য তুষ্টির রসদও যোগাতে পারে নি গাঁয়ের মুখিয়া রতন।
রোদের তাতে রিঠাগাছের ছায়াও গরম গয়ে গিয়েছে। জরীপের বাবুটার গলা ঘামে ভিজে গিয়েছে। গায়ের জামাটা খুলে নিয়ে আর ভঁজ করে কোলের উপর রেখে দিয়ে সামনের ভিড়ের মুখগুলির দিকে শুধু চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে জরীপের বাবু।
মনিষগুলির চোখের চাহনি অদ্ভুত। একটা চোখ জ্বলে, একটা চোখ মিটমিট করে। যেন এক চোখে আশা আর এক চোখে হতাশা। ধুকপুকে নিঃশ্বাসের শব্দেও যেন দু রকমের সুর। বিশ্বাস আর অবিশ্বাস একসঙ্গে কাঁপে হাঁফায় আর হাঁসফাঁস করে।
চেঁচিয়ে ওঠে জরীপের বাবু-আর আমি এখানে সময় নষ্ট করতে চাই না। যদি থাকে তো তাড়াতাড়ি দেখাও।
বড় বুড়া রতন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় : কি দেখতে চাও বাবু?
–পরচা, কবুলিয়ত, পাট্টা, চিঠা কিংবা হুকুমনামা।
রতন-না গো বাবু। ওসব কিছু নাই।
–কারও কি কিছু নাই? একটু-আধটু মোকরবী, লাখরাজ, ঘাটোয়ারী, নয়াবাদী, দিগোয়ারী, কিংবা মেয়াদী জমা?
রতন–না, কিছু নাই।
-সবাই কি লেংটা? কোন হতচ্ছাড়ার কি দুই বিঘা চাকরাণও নাই?
হঠাৎ রিঠাগাছের ছায়ার আড়াল থেকে যেন একটা গম্ভীর আক্রোশের ভাষা গর গর। করতে করতে ছুটে আসে-ছিল গো বাবু।
উবু হয়ে বসে থাকা ভিড়ের ছায়া ডিঙিয়ে দাশুর রুক্ষ মূর্তিটা তিনটে লাফ দিয়ে জরীপের বাবুর চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়।
–কে তুমি? কে তুমি? ভয় পেয়ে চমকে ওঠে জরীপের বাবু। গামছা বাঁধা নথিপত্রের বোঝাটা বুকের উপর সাপটে ধরে কাঁপতে থাকে।
-তুমি কে বট? জরীপের বাবুটার সেই আতঙ্কিত চেহারার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে দাশু। বাবুটার ঘামে ভেজা মুখটা দুখী মানুষের মুখ বলে মনে হয়; মাথার চুল বেশ সাদা হয়ে গিয়েছে। গলার চামও শুকিয়ে ঢিলে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এটা তো সেই..ইটখোলার ঠিকাদার সেই রায়বাবুর সরকারবাবুটাও বটে কি?
দাশুর চোখ দুটোও অপলক হয়ে থরথর করতে থাকে। চিনতে পেরেছে দাশু! লোকটার ঘাড়ের কাছে যেখানে দাশু কিষাণের সেই ভয়ানক রাগী টাঙ্গির কোপ পড়ে রক্ত ঝরিয়েছিল, সেখানে শুকনো মাংসের একটা ঢেলা উঁচু হয়ে রয়েছে। পুরনো ক্ষতের দাগটা বাবুটার ঘাড়ের সব চামড়াকে যেন টেনে নিয়ে কুঁচকে দিয়েছে। বোধ হয় আর ঘাড় টান করে তাকাতে পারে
বাবুটা; তাই মাথাটাকে কেমনতর একটু হেলিয়ে দিয়ে আর টেরা মানুষের মত তেরছা চাহনি তুলে দাশুর মুখের দিকে তাকাতে চেষ্টা করছে।
দাশু বলে-তুমি তো সেই সরকারবাবু।
-আমি চললাম; আমি চললাম; এখানে আমার আর কাজ নাই। জরীপের বাবুর সন্ত্রস্ত চেহারা ছটফট করে, আর রতনের মুখের দিকে বার বার করুণভাবে তাকায়।
-আমার কথাটা শুন, বাবু। দাশুর গলার স্বর কোমল অনুরোধের স্বরের মত মৃদু হয়ে যায়।
সরকারবাবু তবু আতঙ্কিতের মত চেঁচিয়ে ওঠেনা হে, আর কিছু শোনবার দরকার নাই। আমি জানতাম না যে, তুমি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে জানলে আমি এখানে আসতাম না।
দাশু হাসে-আমাকে এত ডর কেন বাবু?
দাশুর মুখের সেই অদ্ভুত হাসির দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়েই একটা লাফ দিয়ে সরে যায় জরীপের বাবু। দাশুও একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে যেযে জরীপের বাবুর পথরোধ করে।
–দাশু দাশু দাশু! ও কি কর দাশু! চেঁচিয়ে ওঠে রতন; ভয় পেয়ে হল্লা করে ওঠে এতক্ষণের শান্ত ও নীরব ভিড়টা। আর জরীপের বাবুও তার সাদা মাথা ও ঘানে ভেজা রোগা গলাটা দুলিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে—আমাকে মেরে তোমার কোন লাভ নেই; বুড়ো বয়সে একটা চাকরি পেয়েছি…আমি শুধু চাকরি করতে এসেছি।
দশটা মৌজার যত আবাদী অনাবাদী আর পতিত মাটির দাগ ও খতিয়ানের গামছা বাঁধা হিসাবের বোঝা বুকের উপর আঁকড়ে ধরে কাঁপতে থাকে জরীপের বাবু-আমি কারও জমি ছিনতে আসি নি…ওরে, আমারও জমি নেই।
চমকে ওঠে দাশু। আর, সরকারবাবুও ঘাড় টান করে, মাথা তুলে আর সোজা তাকিয়ে দাশুর মুখটাকে দেখতে থাকে। মধুকুপির সেই ভয়ানক টাঙ্গিবাজ কিষাণটা কাঁদছে। চোখের উপর বাঘের থাবার মত শক্ত দুটো মুঠো চেপে চেপে অদ্ভুত একটা কান্নার জলের ফোয়ারা চাপতে চেষ্টা করছে দাশু।
দাশু বলেতুমি আমাকে মাপ কর বাবু!
–অ্যাঁ? কি বললে? মাপ করবো আমি? আচ্ছা…মাপ করলাম।
দাশু–তুমি একটু খুশী হয়ে বস বাবু।
হেসে ফেলে জরীপের বাবু-হা, তুমি যখন খুশী হতে বলছো, তখন আর খুশী না হয়ে…।
বলতে বলতে আবার চারপায়ার উপর বসে পড়ে জরীপের বাবু নথিপত্রের গামছা বাঁধা বোঝাটাকে ঝুপ করে মাটির উপর ফেলে দিয়ে একটা হাঁপও ছাড়ে। তার পরেই রিঠা গাছের ছায়ার দিকে তাকিয়ে জরীপের বাবুর চোখ দুটো যেন বুড়ো ভিক্ষুকের চোখের মত উদাস হয়ে যায়। সারাটা জীবন শুধু জমির নথি ঘাটলাম; কত ফৌজদারী করে কত রায়বাবুকে জমি পাইয়ে দিলাম; কিন্তু কই, আমার তো কিছু হলো না হে; আমার এ-জীবনে আর কিছু হবে না হে।
দাশু–কিন্তু আমাদিগের কিছু হবে কি?
–কি?
দাশু–জমি।
–অ্যাঁ?
চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–কিষাণে জমি পাবে কি?
বল বাবু, বল। চেঁচিয়ে ওঠে মধুকুপির শুকনো ক্লান্ত ও উদাস মনিষের ভিড় রামগড়ের সরকারী চাষ অফিসের বাবুরা বলছে, ভোটের বাবুরা গীত গেয়ে গেয়ে বলছে, কিষাণে জমি পাবে। সরকার কিষাণদিগে জমি দিবে। ঠিক কথা বটে কি, বাবু?
জরীপের বাবুর চোখ দুটো ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে।
–বল বাবু, বল। আবার বেজে ওঠে একগাদা ক্লান্ত আশার আর্তনাদ।
জরীপের বাবু কপালের ঘাম মুছে নিয়ে আস্তে আস্তে বলে—যারা টাকা দিয়ে জমি কিনবে…।
–না না না; যাদিগের টাকা নাই; আমাদিগের মত মনিষদিগে জমি দিবে কি সরকার?
জরীপের বাবু বিব্রত হয়ে বিড় বিড় করে দিতে পারে। কিন্তু…।
দাশুর চোখের তারা দুটো চিকচিকিয়ে ছটফট করে আবার কিন্তু কেন গো বাবু? দিতে যদি পারে, তবে দিয়ে দিবে বল। বল বাবু, বল।
জরীপের বাবু-হা দিতে পারে; কিন্তু দিলে কিভাবে দেবে জান?
দাশু–জানি না, তুমি বল।
–কারও নামে জমির দাগ হবে না। পরচা পাট্টা হবে না। আল বেঁধে দিয়ে আর হাল কাঁধে নিয়ে তুমি যে সেঁটে ঘেঁটে বলবে, এটা আমার জমি, সেটি হবে না।
দাশুর চিকচিকিয়ে চোখ হঠাৎ শুকিয়ে যায়-কেমনটি হবে তবে?
—মিলতি জোত হবে।
দাশুর বুকের ভিতরটা যেন গরগর করে বেজে ওঠে-মিলতি জোত?
—হ্যাঁ।
দাশু—সেটা কেমন জোত ঘটে?
-মিলতি মেহনতের জোত। বিশ-পঁচিশ কিষাণে মিলে এক জমিতে হাল চালাবে; ছিটাই বুনাই আর রোপাই করবে। ফসলেরও বাঁটাই হবে। যার যেমন মেহনত, তার তেমন ভাগ।
দাশু–কিন্তু আমার জমি।
–আরে না; তোমার জমি বলে কোন জমি থাকবে না। তোমার জমি সবার জমি; সবার জমি তোমার জমি।
দাশ-জমিও কি কয়লা-খাদের মত মিলতি মেহনতের নরক হবে বাবু? বলতে বলতে দাশুর চোখ থেকে যেন একটা জ্বালা ঠিকরে বের হতে থাকে।
জরীপের বাবু আশ্চর্য হয়ে তাকায়-তুমি মিছিমিছি কার ওপর এত রাগ করছে হে?
নিজেরই কপালের উপর শক্ত হাতের মুঠো দিয়ে একটা চাপড় মেরে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–এটার উপর।
বড় বুড়া রতন বিড় বিড় করে-চুপ কর দাশু।
দাশু তবু চিৎকার করে কেন চুপ করবো কাকা? জরীপের বাবু কি বলছে, তুমি কি শুনছে না?
রতন—শুনেছি, যা হবে, তাই বলছে বাবু; তুমি মিছা রাগ কর কেন?
দাশু–তবে বল না কেন, মিলতি জোতের মত, মাগও মিলতি মাগ হবে; ছেইলাও তাই হবে। কে কার মাগ, কে কার ছেইলা কার কোন্ ঘর, কিছুই ঠিক থাকবে না। সব মিলতি মজার নরক হয়ে যাবে।
রতন-হবে যদি, তবে হতে দাও না কেন। তুমি মিছা চেঁচাও কেন?
দাশু–না হবে না, হতে দিব না কাকা। দাশুর চোখের চাহনি পাগল মাতালের চাহনির মত লাল হয়ে ধকধক করে।
হেসে ওঠে জরীপের বাবু, হেসে ওঠে মনিষদের ভিড়। দাশুর কানের কাছে পৃথিবীর সব আলো-ছায়া যেন ভয়ঙ্কর ঠাট্টার হাসি ঝরিয়ে কাঁপতে থাকে। হায় হায়; হাসে কেন এরা?
দাশুর হৃৎপিণ্ডের স্বপ্নটা একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে। আপন জমি নেই, গুলঞ্চের বেড়াও নেই; তবে আর রইল কি? হায় কপালবাবা, তবে আর থাকে কি? তা হলে যে ডরানির স্রোতের জল শুধু জল, বড়কালু শুধু একটা পাহাড়? হরতকীর জঙ্গলের ছায়া শুধু একটা ছায়া? তা হলে বেলতলার কপালবাবাও যে শুধু একটা পাথর হয়ে যায়।
—মিলতি জোতে বড় লাভ আছে হে! জরীপের বাবুটা একটা সান্ত্বনার হাসি হাসে।
-কোন্ লাভ বটে গো বাবু? বলতে গিয়ে দাশুর লাল চোখের জ্বালা আরও জ্বালাময় হয়ে কাঁপতে থাকে।
–অনেক সুবিধা আছে। চাষ করতে সুবিধা আছে; ফলনও ভাল হয়। একা মেহনতে তুমি যত ফসল পাবে, মিলতি মেহনতে তার দুইগুণ ফসল তোমার ভাগে পড়বে।
–বড় ভাল, বড় ভাল হিসাব! দাশুর গলার স্বরটা যেন ধিক্কার দিয়ে বেজে ওঠে।
শুধু হিসাব আর হিসাব। সুখের হিসাব আর সুবিধার হিসাব! মায়ার হিসাব নয়। শুধু মাথাতে ভাল লাগলেই হবে, বুকে ভাল লাগুক বা নাই লাগুক। হায় রে কিষাণের প্রাণ!
আস্তে আস্তে অলস হয়ে মাটির উপর বসে পড়ে দাও; আর দুই হাঁটুর উপর মাথাটাকে পেতে দিয়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।
জরীপের বাবু বলে–একটা ভাল কথা বললাম বটে; কিন্তু কবে যে এই মিলতি জোরে সুখ তোমাদের ভাগ্যে…।
বড় বুড়া রতন হাসে-আমার কোন চিন্তা নাই বাবু। সে সুখ দেখবার লেগে আমি বেঁচে থাকবো না। কিন্তু এরা…আমার জাতের এই বেচারারা তো সুখ পাবে। বলতে বলতে মনিষদের মুখগুলির দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে মধুকুপির মুখিয়া, জাতপঞ্চের বড় বুড়া রতন।
মনিষরা বলে-আঃ, তুমি কাঁদ কেন বড় বুড়া?
রতনের জিরজিরে পাজরগুলি যেন উতলা হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁপতে থাকে। আমার পঞ্চ নাই, মান নাই, ভাত নাই, জোর নাই; আমার মত মুখিয়া তোমাদিগের কোন সাধে কাজ দিলে নাই।
পুরনো মধুকুপির মর-মর প্রাণটা এইবার যেন শেষ অভিমান ড়ুকরে দিয়ে মরে যাবে। বড় বুড়া রতনের পাঁজরগুলি কি-ভয়ানক নেচে নেচে কাঁপছে!
একটা লাফ দিয়ে উঠে এসে বড় বুড়া রতনের জিরজিরে শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দাশুকাকা গো!
রতনের শুকনো ঠোঁটে একটা করুণ হাসির ছায়া সিরসির করে? এখনই আমি মরবো না দাশু। কিন্তু…।
দাশু–কি বটে কাকা?
রতন-তুমি একটুক হাস।
দাশু–কেন কাকা?
রতন-যা হলো, তা হলো, যা হবার তা হবে। মিছা মন দুখিয়ে লাভ নাই।
জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে হেসে ফেলে দাশু : হ্যাঁ গো কাকা। আর মিছা মন দুখাবার দরকার নাই।
জরীপের বাবু বলে—আমি চলি।
মনিষদের ভিড়টাও কলরব করে ওঠে-চল হে, চল।
আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মনিষদের ভিড়টা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এখনও পুরা একটা বেলা আছে। জামুনগড়ার ডাঙাতে টেস রিলিফের কাজে ভিখমজুর খাটলে আধা রোজের মজুরী হবে। চল হে, চল।
দাশু বলে—আমিও চলি, কাকা।
রিঠাগাছের ছায়ার ভিড়ও এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে আস্তে আস্তে দুলতে থাকে। এক ঝাঁক লটকন পায়রা উড়ে এসে রিঠাগাছের মাথার উপর পাখা ফরফরিয়ে হুটোপুটি করতে থাকে। পায়রার ডানা-খসা ছোট ছোট পালকগুলি দমকা হাওয়ার ঝাপটা লেগে বাতাসে ছুটতে থাকে। আর, পাথরের পাটার মত মজবুত যার বুকের পাটা, মধুকুপির সেই দাশু কিষাণ যেন এতদিনে ওই বুকের সব নিঃশ্বাসের জোর হারিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলতে থাকে।
ওরা বলছে, আপন জমি না হোক, তবু মিলতি জোতে ওদের খুব সুখ হবে। হোক, হোক, তাই যেন হয় কপালবাবা। যেন মধুকুপির বাতাসের সঙ্গে কথা বলে বলে পথ চলতে থাকে দাও।
বাঁশঝাড়ের ধড় হাওয়ার ঝাপটা লেগে ছটফট করছে, আর যেন একটা হায় হায় শব্দ বাতাসের বুকে আছড়ে পড়ছে। পুরনো জামকাঠের দরজার কপাটে হাত রেখে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–তবে আর মুরলী আসবে কেন? এসে কাজ কি?
ঘরের ভিতরে খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর একটা হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ে দাশু। আর মাথাটা নামিয়ে হাঁটুর উপর চোখ দুটোকে চেপে রেখে মিথ্যা আশার স্বপ্নটাকে ঘষে ঘষে মুছে ফেলতে চেষ্টা করে।
আপন জমি হবে না। গুলঞ্চের বেড়া দিয়ে আপন জমির অহংকার ঘিরে দেওয়া যাবে। হাত ধরে মুরলীকে বুকের কাছে টেনে এনে চেঁচিয়ে উঠতে পারা যাবে না, হেই দেখ মুরলী, আমার মাটির জাদু দেখ; কেমন সুন্দর জিরার ফলন হয়েছে। সোনার দানার মত জিরা।
হাঁটুটা চোখের জলে ভিজে গিয়ে চবচব করে। ফিসফিস করে যেন ঘরের শূন্যতার কাছে আবেদন করে দাশু–না, তুই আসিস না মুরলী।
ঝুপ ঝুপ ঝুপ! বাঘের থাবার মত দুটো শক্ত হাতের মুঠো দিয়ে কোদালের হাতল আঁকড়ে ধরে জামনগড়ার ডাঙায় টেস্ট রিলিফের কাজে নতুন সড়কের জন্য মাটি কাটে দাশু। আধা সকাল আর পুরো দুপুর ও বিকাল, ভিখমজুর দাশুর জীবনটা যেন ধুলামাখা হয়ে খাটতে থাকে, যতক্ষণ না ছোটকালুর মাথার আড়ালে সূর্য ড়ুবে যায়।
কিন্তু কি আশ্চর্য, দাশু কিষাণের এমন পাথুরে ছাঁদের বুকটাও হাঁপায়; বাঘের থাবার মত শক্ত হাতের মুঠো দুটোও ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝে আলগা হয়ে যায়; আর কোদালটাও হঠাৎ উদাস হয়ে গিয়ে কোপ পাড়তে ভুল করে ফেলে।
সন্ধ্যা হলে দুখনবাবুর খাতায় টিপ সই দিয়ে মজুরী নিয়ে, আর আধসের মাইয়ের দানা গামছায় বেঁধে নিয়ে, ঘরে ফেরার সময় ডরানির একটা ছোট দহের জলে স্নান করে ধুলোর আবরণ ধুয়ে ফেলতে গিয়ে হ্যাঁক করে চমকে ওঠে শরীরটা; আঃ, উরানির জল কত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে গো!
-মুরলী তুই আসিস না! তিন হাত উঁচু মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা শূন্যতার মধ্যে খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর যতক্ষণ জেগে বসে থাকে দাশু, এতক্ষণ দাশুর বুকের ভিতর থেকে একটা ভাবনার ভয় বার বার উথলে ওঠে আর বিড়বিড় করে বাজে।
কিন্তু মুরলী যেন দাশুর স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে ঝগড়া করে। কেন গো সরদার? এত উদাস কেন তুমি? মুরলীকে ঘরে নিতে মন করে না, এ তোমার কেমনতর মন?
–না, আর আমার সাধ নাই মুরলী।
–কেন?
–আমার জমি নাই। আমার জমি হবে না; কেউ আমাকে জমি দিবে না।
–কিন্তু ওরা যে বলছে…।
–কি?
–একটুক সবুর কর না কেন, জমি দিবে সরকার।
–না না না; দিবে না। আবার আমাকে ওসব গীতের কথা বিশ্বাস করতে বলিস না
মুরলী।
-বিশ্বাস কর না কেন সরদার?
–না মুরলী; আর বিশ্বাস করতে মন করে না।
–মিলতি জোতের জমি তো পাবে।
–দূর দূর দূর! মধুকুপির দাশ কভি মিলতি জোতের চাষী হবে না।
-মিলতি জোতে কত ভাল ফলান হবে সরদার? ধান বল, সরগুজা বল আর সজি বল, কত ভাল হিস্যা হবে তোমার। মাগ-ছেইলা নিয়ে ভরপেট খাওয়ার সুখ যে হবে সরদার। একটু ভেবে দেখ সরদার।
–না না না। এমনতর নতুন সুখে আমার সাধ নাই। আমার বড় ডর লাগে আর ঘিন্না করে মুরলী। মিলতি জোতের চাষী হলে আমার ঘর ধাওড়া হয়ে যাবে; আমার সব সাধের উপর মিলতির মার পড়বে। আমার মাগ আর আমার ছেইলাও মিলতির হিস্যা হয়ে যাবে।
–হয়ে যাক না কেন? নতুন সুখে মিছা এত ডর কেন তোমার?
কটমট করে জ্বলতে থাকে দাশুর স্বপ্নের চোখ। কি-ভয়ানক বেলাজ হয়ে মুরলীর কালো চোখ দুটো নতুন সুখের পিপাসায় ধন্য হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–না, কভি না; তোর ওই চোখ দুটাকে দেখতেও আমার ডর লাগে। তুই আসিস না; যদি আসিস, তবে শুনে নে মুরলী, মধুকৃপির গাওয়ার কিষাণ তোর মতন অমন নতুন সুখের ক্ষেপীকে ঘরে নিবে না।
ধড়মড় করে বুকটা, চমকে ওঠে দাশু। দু হাত দিয়ে ঘুম-ভাঙা চোখ দুটোকে ঘষতে থাকে। চোখ দুটো হঠাৎ ভিজেও যায়।
সত্যিই দাশুর বুকের ভিতরে যেন একটা ভয়ের ছায়া ছমছম করে, আর হাহাকার সুবোধ ঘোষ বিড়বিড় করে। এ কেমন নতুন সুখের ঠেলা এলো গো কপালবাবা!
জরু গরু ধান, সত্যিই কি সব মিলতি আদরের সওদা হয়ে যাবে? আপন ঘর আর আপন গাঁ বলতে কি কিছু থাকবে না? মধুকুপির মাটিতে জলেতে আর ছায়াতে কি একটুকু বেশি মিঠা স্বাদ আর পাওয়া যাবে না? মরেই যাবে গাওয়ার মধুকুপির পুরনো প্রাণটা? মায়াতে কেউ কারও আপন হবে না, শুধু সুখেতে আপন হবে? না, তোর আর এসে কাজ নাই মুরলী। এলে তোর আবার বড় দুখ হবে। দাশু কিষাণের বুকে আর আশা নাই, জোর নাই, সাধ নাই।
মাথাটা পুড়ছে। মুখের উপরেও যেন কতগুলি ফোস্কা জ্বলছে। কেন গো, কেন গো কপালবাবা? বিড়বিড় করতে করতে আবার ঘুম ভেঙে যেতেই বুঝতে পারে দাশু, ঘরের কপাট বন্ধ না করে একেবারে দরজার কাছে মাটির উপর শুয়ে পড়েছিল। সেইভাবে সারাটা রাত পার হয়ে গিয়েছে।
হ্যাঁ, বেশ বেলা হয়েছে। আধা সকাল পার হয়ে গিয়েছে। মধুকুপির শুকনো আকাশের সূর্য এরই মধ্যে গরম রোদ ঢেলে দিয়ে মধুকুপির মাটিকে তাতাতে শুরু করে দিয়েছে। সেই রোদ দরজা পার হয়ে ভিতরে ঢুকে দাশুর মাথা ও মুখের উপরেও পড়েছে।
পিপাসী কাকের দল ডরানির জল খোঁজবার জন্য অদ্ভুত লোভের ডাক ডেকে উড়ে চলেছে। উঠে দাঁড়ায় দাশু। জামুনগড়ার ডাঙাতে মাটি কেটে আধা রোজের মজুরী পাওয়ার সময় এখনও আছে। হ্যাঁ, যেতেই হবে আর খাটতেই হবে। একটা একলা রক্তমাংসের অস্তিত্ব এখনও ক্ষুধার্ত হয়, খোরাক চায়।
ঠিক আছে; ঠিক আছে; তুমি যেমনটি চাও তেমনটি হবে কপালবাবা! দাওয়া থেকে নেমে হন হন করে হাঁটতে থাকে দাশু–কিন্তু তোমার পায়ে পড়ি কপালবাবা, মুরলী যেন আর না আসে। আর, বুকের ভিতরের এই শব্দটাকেও মেরে দাও। মুরলী মুরলী! ভিখমজুরের মনে মিছা আর ওই শব্দটা বাজে কেন?
টেস্ট রিলিফের অফিসের একচালার কাছে এসে কোদাল হাতে তুলে নিতেই একচালাটা যেন অদ্ভুত শব্দ করে হেসে ওঠে। চমকে ওঠে আর দেখে আশ্চর্য হয় দাশু; হেসে উঠেছে বাবু দুখন সিং।
দাশু গম্ভীর হয়ে আর ছোট একটা ভ্রুকুটি করে তাকায়-হাস কেন দুখনবাবু?
দুখনবাবু–হারানগঞ্জের কোন খবর রাখ কি দাশু?
দাশু–হারানগঞ্জের খবরে আমার কোন্ দরকারটি বটে?
দুখনবাবু–না, দরকার নাই বটে; কিন্তু…তবু…একটুক জানতে শুনতে ইচ্ছা হয় না কি? দাশু–কি জানতে আর শুনতে ইচ্ছা হবে বল?
দুখনবাবু-তোমার ঘরণী যে ছিল, সিঁদূর মাটি করে দিয়ে তোমার ঘর ছাড়লে মহেশ রাখালের যে বেটি…।
কোদালের হাতল শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আর দু চোখের চাহনিতে একটা ভয়াতুর বিস্ময় কাঁপিয়ে দুখনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দাও। দুখনবাবু বলে-মহেশ রাখালের খিরিস্তানী বেটির সাথে কার বিয়া হবে জান?
দাশু–বিয়া হয়েছিল, সে বিয়া রদ হয়েছে; শিকারীটার ঘর ছেড়েছে মহেশ রাখালের বেটি।
দুখনবাবু–কিন্তু আবার বিয়া হবে। অজিই হবে।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দাও। দুখনবাবু আবার হেসে ফেলে–বড় তাজ্জব বটে দাশু। হারানগঞ্জের ডাক্তার রিচার্ডবাবুর সাথে আজ মহেশ রাখালের খিরিস্তানী বেটির বিয়া হবে।
–রিচার্ডবাবু! চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। যে দাশু কিষাণের প্রাণটা অতল বিস্ময়ের একটা দহের জলের মধ্যে পড়ে আর একটা চুবানি খেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছে। বিচাঙলাবু, সেই সাহেবপানা মানুষটি; কত মান, কত টাকা, কত সুন্দর একটি ফুলবাড়িতে থাকে, সেই মানুষ! নতুন সাধের আর নতুন সুখের মানুষ; তারই বুকের উপর মাথা রেখে আজ মুরলী সুখী হবে যাবে, দাশু কিষাণের সেই মুরলী?
দাশুর ফ্যালফ্যালে চোখের চাহনি শিউরে ওঠে, বুকের ভিতরে কলিজটা নাই বোধ হয়। তা না হলে বুকটা এই ফাকা আর ফাঁপা লাগে কেন?
আস্তে আস্তে অদ্ভুত একটা হাসি দাশুর ঠোঁট দুটোকে কুঁকড়ে দিয়ে কাঁপতে থাকে। জোরে একটা শ্বাস ছাড়ে দাশু; তারপরেই চেঁচিয়ে হেসে ওঠে।-বড় ভাল হলো দুখনবাবু; বড় ভাল খবর শুলে তুমি।
আর বলতে হবে না, মুরলী তুই আসিস না! দাশুর বুক এতদিনের একটা মিথ্যা জল্পনার ভার থেকে ছাড়া পেয়ে একেবারে খালি হয়ে গেল। কত ভাল হিসাব জানে শুরলী; কত বড় সুখের ঘরে চলে গেল মুরলী। বাঃ মুরলী, তুই জাদু জানিস।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে আর হেঁটমাথা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। তারপর কোদালের হাতলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আর কাঁধে তুলে নেয়।
রিচার্ড সরকার আর জোহানা সরকার। দুজনে একটা একটা মস্ত বড় ফুলের তোড়া বুকের উপর জড়িয়ে ধরে, আর প্রায় কাঁধে কাঁধে ছোঁয়াছুঁয়ি করে যখন গির্জাঘরের ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে আলোকিত পুলপিটের দিকে পুলকিত হাসির ছটা ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে, তখন বিয়ের শেষ অনুষ্ঠানও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গির্জার ঘরভরা ভিড়ের গলায় একটা গম্ভীর প্রার্থনার কোরাস গম গম করতে থাকে। সিস্টারদিদি তার আগেই তার গম্ভীর ব্লেসিং গম্ভীর গলায় পাঠ করেছেন।
গির্জাবাড়ির ফটকের সামনে চারটে মোটরগাড়ি। এর মধ্যে দুটি গাড়িতে রিচার্ডের রাঁচির বন্ধুর দল এসেছে। ডাক্তার বন্ধু, উকীল বন্ধু আর ইঞ্জিনীয়ার বন্ধু। আর দুটি গাড়ি হলো রিচার্ডের দুই বউদির গাড়ি। মিসেস বিশ্বাস এসেছেন দুমকা থেকে; আর মিসেস রাজা এসেছেন আদ্রা থেকে।
গির্জাঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে রিচার্ড সরকার আর জোহানা সরকার যখন হাত ধরাধরি করে দুটি সুখী জীবনের উৎফুল্ল মিলনের ছবির মত ফটকের কাছে এসে দাঁড়ায়, তখন চার মোটরগাড়ির চার জোড়া হেডলাইটও উল্লাসের ঝলক তুলে জ্বলে ওঠে।
চলতে শুরু করে চারটে গাড়ি। হারানগঞ্জের শুভ সন্ধ্যায় উৎসব যেন অজস্র হাসি আর কলরবের সম্ভার নিয়ে গির্জাবাড়ির ফটক থেকে প্রায় একসঙ্গে একটা ছুটন্ত আমাদের মত উধাও হয়ে যায়। প্রথম গাড়িতে রিচার্ড ও মুরলী। দ্বিতীয় গাড়িতে রিচার্ডের দুই বউদি ও আরো দুজন, যে দুজনকে মাথার দিব্যি দিয়ে নিমন্ত্রণ করেছে মুরলী; লুসিয়াদিদি আর মেরিয়া। আজ রাতে মুরলীকে নতুন জীবনের বাড়িতে হাজার লজ্জার মধ্যে ফেলে রেখে দিয়ে চলে আসতে পারবে না লুসিয়াদিদি আর মেরিয়া। আজ রাতটা ওখানে থাকতেই হবে।
দুই বউদিও হেসে হেসে বলেছেন, চল মেরিয়া, চল লুসিয়া, শুভরাত্রির মজা যদি তোমরা না দেখবে তো দেখবে কে? আমরা তো গুরুজন।
চার মোটরগাড়ি এসে রিচার্ড সরকারের বাড়ির ফটকের কাছে থামে। বুড়ি দাইটা বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এসে রিচার্ড আর মুরলীর মুখের দিকে তাকায় ও চেঁচিয়ে গান গেয়ে ওঠে। রিচার্ড সরকারের বাড়ির বাগানে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে, আর লতার তোরণের ভিতরেও রঙিন আলো জ্বলে; লাল-নীল আর বেগুনি রঙের আলো।
রাঁচির বন্ধুর দল হঠাৎ একটা খুশির আবেগে হাততালি দিয়ে আর হুল্লোড় করে হাসতে থাকে। কারণ, গাড়ি থেকে নামবার সময় মুরলীর কোমরটা এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে রিচার্ড; আর মুরলীও মাথাটাকে একেবারে রিচার্ডের বুকের উপর এলিয়ে দিয়েছে।
দুই বউদি, মিসেস বিশ্বাস ও মিসেস রাজা যেন একটা বিস্ময়ের হাসি চাপতে গিয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকেন। আর লুসিয়াদিদি ও মেরিয়া একটু লজ্জা পেয়ে হাসি লুকোতে চেষ্টা করে।
রাঁচির বন্ধুর দল আজ রাতেই চলে যাবে। রিচার্ডের বাড়ির সামনে ছোট লনের উপর চেয়ার-টেবিল পেতে যে ভোজের আসর করা হয়েছিল, সেই ভোজের সুস্বাদু আমোদও কাটা-চামচের আর সেঁকুরের শব্দে ও কাঁচের গেলাসের ঝনঝনানিতে মেতে ওঠে।
শুভরাত্রি জানিয়ে বন্ধুরা যখন বিদায় নেয়, তখন মুরলীর কালো চোখ থেকে অদ্ভুত এক জ্বলজ্বলে হাসি ঝলক দিয়ে উথলে উঠতে থাকে। যেন একটা বিস্ময়বিবশ সৌভাগ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে মুরলী। বন্ধুরা উপহার দিয়ে চলে গিয়েছে; টেবিলটা ভরে গিয়ে উপহারের সম্ভার উপচে পড়ছে।
রিচার্ড সরকারের বাড়ির যে-ঘরের ভিতরে চিনেমাটির প্রকাণ্ড দুটো ফুলদানিতে হলদে গোলাপের দুটো হোড়া থেকে মিষ্টি গন্ধ ভুর ভুর করে উড়ছে, সেই ঘরে মেহগনির একটা পালঙ্কের উপর এক হাত পুরু গদি; সেই গদির উপর পাতা যে নরম বিছানা, তার উপর আবার ফিনফিনে সিল্কের একটি রঙিন চাদর। মৃদু বাতাসের ছোঁয়া লেগে জলচুড়ির মত কুঁচকে গিয়ে সিল্কের চাদরটা কাঁপছে।
হারানগঞ্জের রাত নীরব হয়ে গেলেও আর রিচার্ডের বাড়ির ফটক বন্ধ হয়ে গেলেও এই ঘরের ভিতর মিষ্টি মিষ্টি কথার কলরব বাজতে থাকে। মিসেস বিশ্বাস ও মিসেস রাজা, রিচার্ড সরকারের যে দুই বউদি সকাল হলেই চলে যাবেন, তারা হঠাৎ দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রায় একসঙ্গে হেসে ওঠেন-রাত যে একটা হতে চললো।
ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ায় দুই বউদি। লুসিয়াদিদি আর মেরিয়াও ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ায়। মিসেস বিশ্বাস বলেনচল মেরিয়া, আমরা আর এখানে থেকে বেচারাদের শত্রুতা করি কেন?
মিসেস রাজা বলেন—চল লুসিয়া, রাত একটা বাজতে চললো, এখন শুভরাত্রি না হলে আর কখন হবে?
রিচার্ডের উৎফুল্ল মুখের সিগারেটও ফুরফুরে ধোঁয়া ছড়াতে থাকে। মুরলী কিন্তু মাথা হেঁট করে নরম ঠোঁটের একটা লাজুক উত্তাপের শিহর লুকিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে।
দেয়ালের ঘড়িটা যখন টুং করে রাত একটার সঙ্কেত শিউরে দিয়ে বেজে ওঠে, তখন মুরলীর বুকের ভিতরে একটা বিপুল আশার পিপাসাও শিউরে ওঠে। দেখতে পায় মুরলী, ঘরের দরজা বন্ধ করছে রিচার্ড। মুরলীর বুকের ভিতরে যেন একটা ঝর্ণার শব্দ কলকল করে বাজে; খোঁপাটা কেঁপে ওঠে, মুখটা লালচে হয়ে থমথম করে আর গায়ের জামা সায়া ও শাড়ির আঁটসাট বাঁধনগুলিও যেন হাঁসফাস করে।
গলার টাই খুলে আয়নার হুকের উপর রেখে দিয়ে আবার সিগারেট ধরাচ্ছে যে মানুষটা, তারই মুখের দিকে তাকিয়ে মুরলীর চোখ দুটো মুগ্ধ হয়ে কাঁপতে থাকে। মুরলীর স্বামী রিচার্ড সরকার। রাঁচির বন্ধুরাও কতবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মুরলীকে মিসেস সরকার বলে ডেকেছে।
রিচার্ড সরকারের এই ঘর মুরলীর জীবনের ঘর। মুরলীর ভাগ্যটা এতদিনে যত দীনতা হীনতার ছোঁয়া আর বাঘডাকা রাত্রির ভয় থেকে মুক্ত হয়ে এক ফুলবাড়ির শুভরাত্রির কোলে পৌঁছে গিয়েছে।
মুরলীর কাছে এগিয়ে আসে রিচার্ড। আস্তে আস্তে ডাকে–জোহানা।
মুরলী–কি?
কোন কথা না বলে মুরলীর সাজানো রাঙানো সুন্দর চেহারাটাকে দুহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নেয় রিচার্ড। কী প্রচণ্ড আগ্রহের স্পর্শ। মুরলীর বুকটাও অদ্ভুত এক অনুভবের সুখে ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। রিচার্ডের প্রাণের সব লোভ যে এখনই উছলে উঠে মুরলীর শরীরের সব লজ্জা ভিজিয়ে ভাসিয়ে একটা দূরন্ত উৎসব শুরু করে দেবে।
মুরলীর কপালের উপর রিচার্ডের নিঃশ্বাসের বাতাস ঝরে পড়ছে। এই বাতাসে যেন হলদে গোলাপের চেয়েও নিবিড় গন্ধের পরাগ আছে। চোখ বন্ধ করে, সারা শরীর আর প্রাণটাকেও চরম ইচ্ছার নেশায় বিভোর করে দিয়ে, রিচার্ডের বুকের ছোঁয়ার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী। মনের ভিতর গুণ গুণ করে একটা আশার গান। হে গড, কত দয়া তোমার! আমার স্বামী আমার এই রিচার্ডকে যে মরদানির দেবতা বলে মনে হয়।
রিচার্ড আস্তে আস্তে ফিস ফিস করে ডাকে-জোহানা।
মুরলী-কি?
রিচার্ড—তুমি কি জান যে…।
মুরলী-কি?
রিচার্ডের গলার স্বর হঠাৎ একটু বিচলিত হয়ে কাঁপতে থাকে-আমার দুই বউদি আর তোমার ওই লুসিয়াদিদি ও মেরিয়া, ওরা এখন কি করছে জান?
মুরলী-না।
রিচার্ড—এই ঘরের ভিতরে উঁকি দেবার জন্য জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
চমকে ওঠে মুরলী। আর সত্যিই দেখতে পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়, দুটো জানালা একেবারে খোলা হয়ে রিচার্ড ও মুরলীর জীবনের এই শুভরাত্রির ছবিটাকে বাইরের চোখে ধরা পড়িয়ে দেবার জন্য ধূর্ত মতলবের মত চুপ করে রয়েছে।
মুরলী বলে—জানালা দুটো বন্ধ করে দাও।
রিচার্ড বলে–না জোহানা।
মুরলী-তবে আলো নিভিয়ে দাও।
রিচার্ড-না জোহানা।
রিচার্ডের গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে ছটফট করে ওঠে মুরলীর লজ্জিত শরীরটা–তবে?
রিচার্ড-ওরা জানতে চায় জোহানা, একেবারে চোখে দেখে নিয়ে বুঝতে চায় যে, আমি সত্যিই তোমার স্বামী হতে পেরেছি।
আশ্চর্য হয় মুরলী-কি বলছে, ঠিক বুঝতে পারছি না।
রিচার্ড-আমার দুই বউদির মনে একটা সন্দেহ আছে! তাছাড়া, আমার মনে হয়, তোমার লুসিয়াদিদি আর মেরিয়ার মনেও একটা সন্দেহ আছে যে…।
মুরলী–কি সন্দেহ?
রিচার্ড–ওদের ধারণা, কোন মেয়ের স্বামী হবার মত শরীর আমার নেই।
মুরলী ভ্রূকুটি করে–ছিঃ, ওদের সন্দেহ নরকে যাক; তুমি ওদের সন্দেহের পরোয়া করবে কেন?
রিচার্ড—ওদের সন্দেহ ভেঙে দিতে চাই জোহানা, সেজন্যে তোমাকে যদি একটু…।
মুরলীর চোখ দুটো যেন রিচার্ডের সুন্দর পৌরুষের এই ভয়ানক অপবাদের উপর একটা আক্রোশ নিয়ে জ্বলতে থাকে। মুরলীর রঙিন নরম ঠোঁট যেন রাগ করে আর ফুলে ফুলে কাঁপতে থাকে। ধবধবে সাদা দাঁতের কামড় বসিয়ে দিয়ে ঠোঁটটাকে শক্ত করে চেপে ধরে মুরলী। আর রিচার্ডের একটা হাত টেনে নিয়ে নিজেরই কোমরে জড়িয়ে দিয়ে ফিস ফিস করে মুবলী–! হ্যাঁ রিচার্ড; একটু কেন, আমি একেবারে বেহায়া হয়ে যেতেও রাজি আছি।…এস।
রিচার্ড–জোহান।
মুরলী-যারা দেখবে, তারাই যদি লজ্জা না পায়, তবে আমাদের কোন্ লজ্জা?
রিচার্ড আবার ডাকে—একটা কথা শোন জোহানা।
মুরলী–কি বল?
রিচার্ড–ওদের সন্দেহ মিথ্যে নয়।
–কি? চেঁচিয়ে উঠেই মুখটাকে রিচার্ডের বুকের উপর আছড়ে দিয়ে সোলো হয়ে যায় মুরলী রিচার্ডের বুকের হাডে যেন জটিল একটা গিট আছে। সেই গিট ঠেকিব লেগে মুরলীর কপালটা জ্বলতে থাকে।
মুরগীর মাথায় হাত বুলিয়ে নিবিড় আদরের সুরে আর অবাধ হাসি হেসে আবার ডাক দেয় রিচার্ড-জোহান।
মুখ তোলে মুরলী; মুরলীর চোখ থেকে যেন মরা আগুনের ছাই ঠিকরে পড়ছে।–রিচার্ড!
–কি?
–তুমি কি-ভয়ানক ফাঁকির পিশাচ।
–তাতে কথা বল।
–কেন?
–ওরা শুনে ফেলবে; ওরা জানালার আড়ালে কান পেতে আছে।
–ওরা কেন সন্দেহ করে যে, তোমার শরীরে দোষ আছে?
–মারা যাবার আগে এই সন্দেহ রটিয়ে দিয়ে গিয়েছে স্টিফানা।
–কি বললে?
–তোমার লুসিয়াদিদির কাছে, তোমার মেরিযার কাছে, আর আমাব দুই বউদির কাছে বোকা স্টিফানা রাগ করে যেসব কথা বলত…।
–সব কথা?
–বোকা সিফানা কত বার বোস বলে ফেলেছে, আমার স্বামী থেকেও স্বামী নেই, আমার ছেলে হবে না, তবে আর আমার বেঁচে থেকে লাভ কি? স্টিফানা শেষ পর্যন্ত…।
-কি?
-বউদি আর তোমার লুসিয়াদিদি ও মেরিয়া, ওরা সন্দেহ করে যে, স্টিফানা ইচ্ছে করে মরেছে।
-তার মানে?
–আত্মহত্যা করেছে।
–ওদের সন্দেহ কি মিথ্যা? স্পষ্ট করে বল রিচার্ড।
–মিথ্যে নয় জোহানা। বোকা স্টিফান শেষে রাগ করে একেবারে পাগল হয়ে গিয়ে বিষ খেয়েছিল।
মুরলীর নিঃশ্বাসের শব্দ এইবার যেন সাপের রাগের শব্দের মত হিস হিস করে ওঠে।–হোনাও আত্মহত্যা করবে। তোমাকে ক্ষমা করতে পারবে না জোহানা।
রিচার্ড হাসে–ছিঃ জোহানা; তুমি তো ঠিকানার মত বোকা নও, পাগল নও।
জোহানা–কিন্তু আমি কি মেয়েমানুষ নই?
রিচার্ড হাসে–তুমি চমৎকার বুদ্ধিমতী মেয়েমানুষ। তা না হলে মধুকুপি নামে একটা জংলি গায়ের ঘর থেকে বের হয়ে…।
–চুপ কর। ফুঁপিয়ে ওঠে মুরলী।
রিচার্ড হাসে–আমি জানি, তুমি খুব খুশি হবে, যদি এই বাড়িটা আমি তোমার নামে লিখে দিই।
চমকে ওঠে মুরলী। রিচার্ড বলে-তাছাড়া কিছু নগদ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়ে তোমারই হাতে দিয়ে দিতে চাই।
মুরলী–কত টাকা?
রিচার্ড হাসে–ধর, অন্তত দশ হাজার টাকা।
মুরলী হাসে-তাতে তোমার লাভ?
রিচার্ড–আমার লাভ এই যে, তাহলে তুমি স্টিফানার মত কাণ্ড করবে না। তুমি আমার মান রাখবে।
মুরলী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়-তোমার মান যদি তুমিই রাখতে না জান, তবে আমি কি করে রাখব বল?
রিচার্ড হাসে-সে কথাই তোমার কানে কানে বলতে চাই। শুধু আমার মানের কথা নয়, তোমারও মানের কথা।
জোহানা–বল।
জোহানার কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে কথা বলে রিচার্ড। শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকে মুরলী। রিচার্ডের নিঃশ্বাসের বাতাস যেন একটা শিশু সরীসৃপের স্পর্শের মত মুরলীর প্রাণের উপর সিরসির করছে।
রিচার্ডের কাছ থেকে সরে গিয়ে আর বিছানার উপর বসে অনেকক্ষণ ধরে চোখের উপর রুমাল চেপে রাখে মুরলী। কী অদ্ভুত অভিনয় করতে বলছে রিচার্ড! মুরলীকে কী চমৎকার ফকির জাদুকরী বলে মনে করেছে রিচার্ড। একটা ঘোর মিথ্যার কালো ছবিকে খাঁটি সত্যের রঙিন ছবির মত ফুটিয়ে তুলে রিচার্ড সরকারের মান রাখতে হবে। দুই বউদি, আর লুসিয়াদিদি ও মেরিয়ার সন্দেহ আজ মিথ্যে হয়ে যাবে। আজ নিজের চোখে দেখতে পেয়ে ওরা বুঝতে পারবে যে, রিচার্ড সরকার সত্যিই পুরুষের মত পুরুষ, পাগল স্টিফানা মিছিমিছি একটা অপবাদ রটিয়ে শেষে নিজেরই আক্ষেপের জ্বালায় আত্মহত্যা করেছিল।
মুরলীর কাছে এগিয়ে এসে ডাক দেয় রিচার্ড-কি জোহানা?
রিচার্ডের এই ডাক অনুরোধের ডাক নয়; রিচার্ডের গলার স্বর অনুতাপের স্বর নয়। রিচার্ডের চোখের চাহনি অপরাধীর চাহনিও নয়। একটা মূর্তিমান শান্তকঠোর বুদ্ধির ডাক দাবি আর চাহনি।
শ্রান্ত ক্লান্ত ও অবসন্নের মত হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে আর ধরা গলায় বিড় বিড় করে মুরলী। লোকে না হয় জানল যে, তুমি বড় ভাল স্বামী; আর আমি বড় সুখী স্ত্রী, কিন্তু তাতে আমাদের কোন্ সুখ হবে?
-চুপ, বাজে কথা বলো না; নয়তো খুব আস্তে কথা বল। আস্তে আস্তে অদ্ভুতভাবে হেসে, যেন একটা রুষ্ট ধমকের স্বর চেপে দিয়ে কথা বলে রিচার্ড।
-কিন্তু…। আস্তে কথা বলতে গিয়ে মুরলীর কালো চোখের চাহনি ভীরু হয়ে নেতিয়ে পড়ে।
রিচার্ড-আর কোন কিন্তু নেই। লোকে যা জানল, তাই তো আসল কথা। ভিতরে আমরা যা-ই বই না কেন, তাতে কি আসে যায়? লোককে জানানো চাই যে, আমরা খাটি সুখের স্বামী-স্ত্রী। ব্যস, তাহলেই হয়ে গেল।
রিচার্ড সরকারের স্ত্রী জোহানা সরকার; এই নাম আর এই পরিচয়ের গৌরব থেকে পালিয়ে যাবার আর উপায় নেই। কিন্তু উপায় থাকলেও পালিয়ে গিয়ে লাভ কি? না, এই ভাল, খুব ভাল।
খোঁপা খুলে বিনুনিটা দুলিয়ে দিয়ে মুরলীও দুলে ওঠে। রিচার্ডও কাছে এগিয়ে এসে মুরলীর হাত ধরতেই মুরলীর ঠোঁট দুটো কুঁকড়ে গিয়ে হেসে ওঠে।
রিচার্ড-হাসবে না জোহানা; এ সময় হাসতে নেই। ওরা তাহলে ভূল বুঝবে!
হ্যাঁ, রিচার্ড সরকারের পৌরুষের অপবাদ মিথ্যে করে দেবার জন্য মুরলীকে এখন চোখের চাহনিতে নিবিড় অনুভবের আবেশ ফুটিয়ে তুলতে হবে। মুরলীর নবম ঠোঁট পিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁপবে। রিচার্ডের গলাটাকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দূরন্ত তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়তে হবে।
একটুও ভুল হয় না মুরলীর। রিচার্ড সরকারের বৃথা পৌরুমের সেই আলিঙ্গন আর মিহা উদ্দামতা বরণ করে মুরলীর রক্তমাংসের সব পিপানা যেন ধন্য হয়ে যেতে থাকে। রিচাঙের কপালের উপর যখন এই কপট উৎসবের শ্রান্তি বড় বড় ঘামের ফোঁটা হয়ে যাবার কুচির মত জ্বলতে থাকে, তখন মুরলীও হাঁপ ছেড়ে, রিচার্ডের মাথা আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে, আর গলার স্বর কলকলিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।-আঃ, তুমি পুরুষ বটে রিচার্ড। তুমি আমার ভাগ্য বটে রিচার্ড।
সেই মুহূর্তে জানালার কাছ থেকে বাইরের বারান্দার অন্ধকারে যেন কতগুলি খুশির হাসি পলাতক নুপুরের শব্দের মত ছুটোছুটি করে পালিয়ে যায়। তার মধ্যে একটা শব্দকে চিনে ফেলতেও পারে মুরলী, ওটা নিশ্চয় মেরিয়ার হাসির শব্দ।
হারানগঞ্জের ডাঙার অন্ধকারে সাঁতার দিয়ে একটা পশ্চিমা হাওয়া হু-হু করে ছুটে এসে খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে চীনেমাটির ফুলদানির ফুল কাপাতে থাকে। হে গড! আবার পৈছ হাওয়া ছুটে আসে কেন? হাওয়ার সাথে উরানির স্রোতের শব্দটাও ভাসে কেন?
জানালার কাছে এগিয়ে এসে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে চেষ্টা করে মুরলী। কিন্তু চমকে ওঠে; আবার মেরিয়ার সেই খুশির হাসির শব্দ চকিত ঝংকারের মত বারান্দার কিনারা দিয়ে যেন ছুটে চলে গেল।
ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসেই মেরিয়ার হাত ধরে ফেলে মুরলী।–কি বটে মেরিয়া?
মেরিয়া হাসে-খুব বটে! আর, কথা বল কেন?
কথা শেষ করেই মুরলীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মুরলীর কোমরে জোরে একটা চিমটি কাটে মেরিয়া।
–উঃ, চমকে ওঠে, আর হেসে ফেলে মুরলী।
মেরিয়া–উঃ কর কেন?
মুরলী-কলকল করে হেসে ওঠে-কোমরে ব্যথা; সত্যিই খুব ব্যথা। কিন্তু বেশ মজার ব্যথা বটে, মেরিয়া।