১২. আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে পলুস

আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে পলুস। পলুসের এই ঘরের জীবনটাকে যেন হেসে হেসে জাগিয়ে রেখে, আর হেসে হেসে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তর তর করে পার হয়ে যাচ্ছে দিনগুলি আর রাতগুলি। পুরো দুটো মাস পার হয়ে গেল, কিন্তু এই ঘরের ভিতরে আর কোন অভিমানের আর্তনাদ ফুঁপিয়ে ওঠে নি, কোন আক্ষেপ চিৎকার করে ওঠে নি, কোন আক্রোশ গর্জন করে ওঠে নি। পলুসের নিশ্বাসের সেই ভয়টাই যেন আশ্চর্য হয়ে মরে গিয়েছে।

কত শান্ত হয়ে গিয়েছে জোহানা। পলুসের সব ইচ্ছার শাসন একেবারে মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। এই দু মাসের মধ্যে ভুলেও একটা রাগের কথা বলে নি। ঝড় থেমে যাবার পর জঙ্গলের চেহারা যেমন বড় বেশি শান্ত হয়ে যায়, জোহানার চেহারাও সেই রকমের শান্ত। নতুন জীবনের ঘরে ঠাঁই নিতে এসে ওর বুকের ভিতরে একটা ভায়ের ঝড় উতলা হয়ে উঠেছিল। সেই ঝড় সামলে নিয়েছে জোহানা। জোহানা এখন হাসে, সব সময় হাসে। আতঙ্কিত হবার, রাগ করবার এবং আপত্তি করবার একটা ছুতোও খুঁজে পায় না পলুস।

মনে পড়ে পলুসের, সেই যেদিন পলুসের সঙ্গে প্রথম গির্জায় গিয়ে প্রেয়ার সেধে ঘরে ফিরে এল জোহানা, সেদিন লোহার উনানে খাদের কয়লার আগুন ধরিয়ে ভাত ডাল আর বড়ির তরকারি রান্না করবার পর শুধু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। অদ্ভুত রকমের উদাস হয়ে গিয়েছিল জোহানার মুখটা। মেঝের উপর হাতের আঙুল বুলিয়ে হাবিজাবি দাগ একে এঁকে কী যেন ভেবেছিল। ব্যস, তারপর আর নয়, আর কোনদিন জোহানাকে মুখভার করে বসে থাকতে দেখে নি পলুস। মাঝে মাঝে আনমনার মত বসে থাকে বটে; কিন্তু জোহানার এই আনমনা মুখটাও হাসতে থাকে।

এজরা ব্রাদার্সের কয়লাখাদের কলঘরের বড় মিস্তিরী পলুস হালদার রোজই সকালবেলা কাজে বের হবার জন্য যখন সাইকেলটার দিকে এগিয়ে যায়, তখন মুরলীও তার জীবনের একটা সাধের কাজে বের হবার জন্য আয়নার কাছে এগিয়ে সাজ করে। ভোর হতেই ঘুম থেকে উঠে যেন একটা উৎসাহের নেশায় চঞ্চল হয়ে রান্না করে মুরলী। ছুটে ছুটে ছটফট করে কাজ করে।

পলুস একদিন বলেছিল-বাঁধাটা তো তুমি একাই করলে, খাওয়াটা দুজনে একসাথে হতে পারে কি?

মুরলী হাসে? হলে ভাল হয়।

কোন আপত্তি করে নি মুরলী; পলুসের সঙ্গে এক থালাতে ভাত খেয়ে পলুসের সাধের দাবিটাকে হাসিয়ে দিয়েছে। পলুসের বুকের ভিতরে যে আশা বিষণ্ণ হয়ে মুষড়ে পড়েছিল সেই আশা যেন নীরবে কলরব করে একটা কৃতজ্ঞতার প্রেয়ার সেধে ফেলে, এই তো, ঠিক সুখ দিলেক গড বাবা। জোহানাও ভুল কথা বলে নাই; সুখ নিতে আর সুখ দিতে জানে জোহানা।

কয়লাখাদের কলঘরের বড় মিস্তিরী ভুবনপুরের দিকে চলে যায়; আর মুরলী চলে যায় হারানগঞ্জের সড়ক আর মেঠো পথ ধরে সেই দিকে, যেদিকে কনভেন্টের বাড়িটা বুড়ো বুড়ো বটের প্রকাণ্ড একটা কুঞ্জের পাশে লালরঙা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ কনভেন্ট বাড়ির কাছেই একটা বাড়ি, যেটা হল স্কুলবাড়ি। অনাথবাড়িটা আরও একটু দুরে; এবং আরও কিছু দুরে আসাইলাম। শুনেছে মুরলী, আসাইলামের কুষ্ঠীরাও সিস্টার দিদির দয়ায় ওষুধ পায় আর ভাত পায়। সিস্টার দিদির উপদেশ মেনে নিয়ে যারা ঈশাই মানে আর প্রেয়ার সাধে, তাদের রোগের জ্বালাও দূর হয়ে যায়।

মুরলীকে হেঁটে হেঁটে স্কুলবাড়িতে যেতে হয়। হেঁটে হেঁটে ফিরে আসতে হয়। ভুবনপুরের সড়ক ধরবার আগে এক-একদিন হঠাৎ সাইকেল থেকে নেমে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পলুস। মুখ তুলে যেন হারানগঞ্জের ডাঙার শোভা দেখবার জন্য পিপাসিতের মত তাকিয়ে থাকে। এক-একদিন দেখতে পায়, হ্যাঁ, ওই তো মেঠোপথ ধরে তরতর করে হেঁটে কনভেন্ট বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে জোহানা। বেচারা মোহানা!

মুরলীর সাধের কাজে যাওয়া-আসার দরকারে পলুসের কাছে মুরলীর যে দাবী ছিল, সেই দাবী সহ্য করা পলুসের পক্ষে সম্ভব হয় নি। গরুর গাড়ির ভাড়া; যেতে চার আনা আর। আসতে চার আনা। তার মানে মাসে পনের টাকা। আশি টাকা মাইনে থেকে পনের টাকা শুধু এরকম একটা সাধের কাজে খরচ করিয়ে দেওয়া যে উচিত হয় না, সেটা বুঝেছে মুরলী। পলুসের আপত্তির কথা শুনে শুধু দু চোখ অপলক করে পলুসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল মুরলী, তার পরেই হেসে উঠেছিল। কাচের বাটির শব্দের মত ঝনঝনে ঠাণ্ডা হাসি।

-হাসলে কেন জোহানা?

–হাসালে হাসবো না কেন?

–কিসে হাসালাম?

–ঘরণীকে সুখ দিবার লেগে পনেরটা টাকা হয় না কেন?

পলুসের চোখ যেন হঠাৎ একটা খোঁচা খেয়ে চমকে ওঠে, গলার স্বরও ভীরু হয়ে যায়? তা তুমি কি বুঝতে পার না?

–খুব বুঝি। হেসে ওঠে মুরলী।

–তবে আর রাগ কর কেন?

–হেই নাও! রাগ করব কেন? গো-গাড়ি না হবে তত না হবে; আমি পায়ে হেঁটে ইস্কুলে যাব।

সত্যিই তো, একটুও রাগ করে না জোহানা। স্বামীর জীবনের একটা অক্ষম অঙ্গীকারের মুখরতাকে কত সহজে ক্ষমা করে দিয়ে হেসে উঠেছে। কিন্তু আর একটা অঙ্গীকার; সেই অঙ্গীকারও এখনও পালন করতে পারে নি পলুস।

হেসে হেসে একদিন প্রশ্ন করে মুরলী-কই? বলেছিলে যে আরও দুটো সোনার মটরদানা দিবে, সে জিনিস আজও আনলে না কেন?

চমকে ওঠে পলুস : আর টাকা নাই। বকশিশগুলো পেতে দাও, তারপর…।

–কিসের বকশিশ?

–বাঘিনীটাকে মেরেছি; রেল কোম্পানি আর খাদের সাহেব যে বকশিশ দিবে, সেটা পেয়ে নিই, তারপর…।

–দেখ, রেল কোম্পানি আর খাদের সাহেবের দয়াতে যদি ঘরণীকে খুশী করতে পার।

মুরলীর মুখে হাসিটাকে সন্দেহ করতে চেষ্টা করেছে পলুস। মনে হয়েছে, জোহানার মনের একটা ভয়ানক ঠাট্টা কাচের বাটির মত ঝনঝন করে হাসছে। কিন্তু মুরলীই সেই মুহূর্তে পলুসের মনের এই সন্দেহের চেষ্টাটাকেও লজ্জা দিয়ে হাসিয়ে দিয়েছে : দুটা সোনার মটরদানা না পেলে জোহানা মরে যাবে না।

রবিবার গির্জা যাবার আনন্দটাও আর ব্যথিত হয় না। পলুসের ইচ্ছার শাসন মেনে নিয়েছে মুরলী।

পলুস বলেছে তুমি যদি আমার সাথে সাথে হেঁটে গির্জা যাও, তবে চল। না হয় তো, তুমি যাও, আমি যাব না।

পলুসের কথা শুনেছে, পলুসের মুখের দিকে তাকিয়ে আর জাকুটি করে নি মুরলী। শুধু কিছুক্ষণ চুপ করে চোখ বড় করে তাকিয়েছিল, আর, তার পরেই হেসে ফেলেছিল : তোমার সাথে সাথে যাব।

পলুস-আমার সাথে যাবে, আমার সাথে আসবে। পথের উপর মিছা থামাথামি করবে না।

মুরলী–হ্যাঁ গো; তোমার সাথে যাবে আর আসবে তোমার ঘরণী। পথের উপরে থামবে

না, আর ডাঙার ঘাসটার দিকেও তাকাবে না।

এর মধ্যে অনেকগুলি রবিবারে গির্জাতে যাবার দরকারও হয়েছে। পলুসের মনও একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছে। না, জোহানার মাথায় দোষ আর ক্ষেপে ওঠে না। ঘরণী যেমনটি করে, ঠিক তেমনটি পলুসের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে গির্জাতে যায় জোহানা। আর কেমন ভালটি হয়ে, পলুসেরই পাশে থেকে, এদিক-ওদিক কোন দিকে নজর না তুলে প্রেয়ার সাধে; আর পলুসেরই সাথে একটানা হেঁটে ঘরে ফিরে আসে।

হ্যাঁ, একটা রবিবারে ঘরে ফেরার সময় পলুসের মন আবার চমকে ওঠে, কারণ, পথের পাশে সাইকেল হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার রিচার্ড সরকার। কত বড় চোখ করে জোহানাকে দেখছে ডাগদরটা! কিন্তু…না…জোহানা ওর পানে একটিবারও নজর করলে না।

মুখ ফিরিয়ে নিয়ে রিচার্ড ডাক্তারের ছায়া মাড়িয়ে, পলুসেরই সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘরে ফিরে আসে মুরলী। পলুস হালদারের মাথার ভিতর থেকে যেন একটা দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণার ঘোর কেটে যায়। ইস্কুলে যায়, সিস্টার দিদির কাছে লেখা-পড়া শেখে; আর মেরিয়ার কাছে নিশ্চয় গানও শেখে জোহানা। না না, হিসাব নয়, জোহানার এসব সাধ ভাল সাধ বটে।

মাঝপথে সাইকেল থামিয়ে পলুসের আর ভাবনা করবার দরকার হয় না। ভাবনা করবার ইচ্ছা হয় না। ভাবনা করা উচিত নয়। পলুসের মুখটাও প্রসন্ন হয়ে হেসে ওঠে। আর, সেই মুহূর্তে একলাফ দিয়ে সাইকেলে উঠে ভুবনপুর সড়কের দিকে উধাও হয়ে যায় পলুস।

কয়লা-খাদের কলঘর থেকে কাজের ছুটির পর, সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে উঠবার আগেই পলুস হালদারের সাইকেল উদ্দাম হয়ে হারানগঞ্জের দিকে ছুটতে থাকে। পড়ন্ত রোদের রঙে লাল হয়ে গিয়েছে গির্জাবাড়ির চুড়া। ঘরে ফিরতেও আনন্দ আছে। কারণ ঘরে ফিরেই দেখতে পাবে পলুস, জোহানা আগেই ঘরে ফিরে এসে উনানের উপর ভারে হাঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছে; আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ফিতা হাতে নিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। বেশ সুন্দর কথা আর সুন্দর সুরের গান-দেখ মরিয়ম কাঁদে যীশুর কবরে।

কত তাড়াতাড়ি ভাল গান শিখে ফেলেছে জোহানা। তাড়াতাড়ি ভাল লিখাপড়াও শিখে ফেলেছে কি? হ্যাঁ, আজই পথে দেখা হতে সিস্টার দিদি হেসে হেসে বলেছে-জোহানা বহিন এইবার তোমাকে আশ্চর্য করে দিবে পলুস।

–কেন দিদি?

—আর একটা মাস সবুর কর, তারপর বুঝবে!

–কি বুঝতে হবে দিদি?

–তুমি কি দুটা দিন হারানগঞ্জের বাইরে গিয়ে থাকবে না?

–হ্যাঁ, থাকতে হবে দিদি; মাস পুরা হলে, বন্দুকের লাইসেনে সহি নিতে গোবিন্দপুরে গিয়ে তিন-চারটা দিন থাকতে হবে।

ঝিক করে হেসে ওঠে সিস্টার দিদির নীল চোখ : বেশ তো, কোন চিন্তা নাই। জোহানা বহিন তোমাকে চিঠি লিখবে।…এখন বুঝেছ পলুস?

ভাল কথা। কী সুন্দর আশ্বাসের কথা বলে আর হাসতে হাসতে চলে গেলেন সিস্টার দিদি।

রাতের রান্না আর খাওয়ার পালা শেষ হয়ে যাবার পর যখন ঘরের মেঝের উপর চাটাই পেতে, কেরোসিন তেলের ল্যাম্পের কাছে বই সেলেট আর খাতা ছড়িয়ে দিয়ে পড়তে বসে মুরলী, তখন চারপায়ার উপর বসে পলুস হালদার মুরলীরই কালো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হেসে ফেলে। সুখের হাসি, তৃপ্তির হাসি, আর, একটু গর্বের হাসিও বটে। পলুস হালদারকে চিঠি লিখে ধন্য হবার জন্য যেন একটা মানত করেছে জোহানা। তাই লেখাপড়া শিখছে। পলুসও তো কিছু লেখাপড়া জানে। জাহানার চিঠির সব ভাল কথা পড়ে ফেলতে পারবে পলুস।

–জোহানা! ডাক দেয় পলুস।

পড়ার বইয়ের দিকে চোখ রেখে উত্তর দেয় মুরলী–কি?

পলুস হাসে : চিঠিতে কি কথা লিখবে জোহানা?

চমকে উঠে মুরলী মুখ তুলে তাকায়। মুরলীর কালো চোখের তারা থরথর করে কেঁপে ওঠে–কিসের চিঠি?

পলুস-যে চিঠিটা তুমি লিখতে চাও।

মুরলী-কাকে চিঠি লিখবো? কি ভাবলে তুমি?

পলুস-আমাকে যে চিঠিটা লিখবে, যখন আমি গোবিন্দপুরে গিয়ে তিনটা দিন থাকবো।

একটা হাঁপ ছেড়ে নিয়ে হেসে ওঠে মুরলী : এই কথাটি বল না কেন? আমার চিঠি পেতে তোমার সাধ হয়েছে।

–আমার সাধ হবে না তো কার সাধ হবে?

–ভাল সাধ হয়েছে তোমার।

চমকে ওঠে পলস; চোখের দৃষ্টিও যেন হঠাৎ আঘাতে বিমূঢ় হয়ে ফ্যালফ্যাল করতে থাকে। পলুসের প্রাণের এত বড় একটা বিশ্বাসকে ঠাট্টা করে হেসে উঠেছে জোহানা। পলুসের মুখটা ব্যথিতভাবে বিড়বিড় করে-থাম জোহানা। তোমার এত হাসি আমার ভাল লাগে না।

মুরলী-আমাকে কি তুমি হাসতেও দিবে না? তবে তোমার ঘরে এলাম কেন?

একটু ব্যথিত না হয়ে, কোন অভিমা, একটুও বিষণ্ণ না হয়ে, এই অভিযোগের কথাগুলিকেও হেসে হেসে ছড়াতে থাকে মুরলী।

কী যেন বলতে চেষ্টা করে পলুস। কিন্তু বলতে পারে না। চারপায়ার উপর চুপ করে বসে সুখী জোহানার বেদনাহীন প্রাণের একটা শব্দ শুনছে পলুস, কিন্তু শুনে সুখী হতে পারছে না। যেন একটা ফঁকা প্রতিধ্বনি এই ঘরের ভিতরে হেসে হেসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর চেয়ে ভাল ছিল, জোহানা যদি একটু ঝগড়া করত, ভ্রূকুটি করে তাকাত, আর কেঁদে ফেলত।

বই পড়া শেষ না হতেই যখন হঠাৎ চমকে উঠে বুঝতে পারে মুরলী, হাত ধরেছে পলুস, তখন বই বন্ধ করে হেসে ওঠে মুরলী। পলুসের সেই ইচ্ছার কাছে সেই মুহূর্তে শরীরটাকে এগিয়ে দেয়। কয়লা-খাদের বয়লটের কলকজাও মাঝে মাঝে ভুল করে। কিন্তু পলুসের ঘরণী জোহানা যেন কলের চেয়েও নিখুঁত। কোনও ভুল করে না।

কী আশ্চর্য, পলুস হালদারের কাছে জোহানার এই অবাধ বাধ্যতাই যেন বিস্বাদ হয়ে একটা চরম অতৃপ্তির জ্বালা হয়ে উঠেছে। পলুসের ইচ্ছার নিশ্বাস যতই তপ্ত হয়ে উঠুক, সে নিশ্বাসের তপ্ততা মুরলীর মুখের উপর যতই নিবিড় হয়ে লুটিয়ে পড়ুক, মুরলীর ঠাণ্ডা মুখটা কিন্তু ঠাণ্ডা হাসির কলের মত শুধু হাসতে থাকে। সেই হাসি সহ্য করতে না পেরে পলুসের শরীরের রক্ত যেন তেতো হয়ে যায়।

আরও কতদিন পার হয়ে গেল। ডরানির স্রোতের শুরু যেখানে, সেখানে শালবনের মাথার উপর দিয়ে নতুন মাসের পাতা-ঝরানো ঠাণ্ডা হাওয়া দিনের বেলায় হুটোপুটি করে আর রাতের বেলায় কুয়াশায় ভিজে গিয়ে চুপ করে থাকে। আর, মুরলীর মুখের হাসিটাকে যেন ভয় করে করেই পলুস হালদারের প্রতিদিনের প্রাণটা হাঁপাতে থাকে। ভাল লাগে না; দুঃসহ বোধ হয়। সব চেয়ে দুঃসহ মনে হয় তখন, মুরলীর মুখটা পলুসের বুকের একটা দূরন্ত ইচ্ছার কাছে এসেও যখন হাসতে থাকে।

 

সে রাতে হারানগঞ্জের আকাশে চাঁদ ছিল। আর খোলা জানালা দিয়ে ঘরের বিছানার উপর চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। মুরলীর চোখের উপরে অনেকক্ষণ ধরে পলুসের যে চোখের চাহনি উপুড় হয়ে পড়েছিল, সেই চোখই হঠাৎ একটা দুঃসহ ক্ষোভের জ্বালায় জ্বলে ওঠে! ফুঁসে ওঠে পলুসের গলার স্বর : তুমি হাস কেন জোহানা? এখন কি হাসতে হয়? কোন মেয়েমানুষে কি এখন হাসে? মরদের মান নাশ কর কেন জোহানা?

মুরলী হাসে হাসি লাগে, তাই হাসি।

সর্বনাশ! ওই ঠাণ্ডা হাসি কী ভয়ানক একটা শীতলতার অভিশাপ! মুরলীর এই শান্ত ও ঠাণ্ডা হাসির অভিশাপ থেকে বাঁচবার জন্য পলুসের নিশ্বাসের আশা একটা নিবিড় বিহ্বল মুখের ছবিকে কল্পনায় টেনে এনে বুকের কাছে ধরে রাখে। যেন রাগ করে ফুঁপিয়ে রয়েছে সেই ছবির ঠোঁট দুটো, ব্যথার সুখে ভুরু দুটো কুঁচকে রয়েছে, পলুসের ইচ্ছার সব ব্যাকুলতা বরণ করবার জন্য কী সুন্দর গম্ভীর হয়ে রয়েছে সেই মুখ।

পলুসের বুকের কাছ থেকে যখন ছাড়া পেয়ে বিছানার এক পাশে সরে যায় মুরলী তখন মুরলীর সেই নীরব ঠাণ্ডা হাসিটা যেন একটা ধূর্ত ঝনঝনে আওয়াজ করে বেজে ওঠে।

-কি হলো? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে পলুস।

মরলী হাসে চোখ মুদে নিয়ে কাকে ভাবলে গো?

–কি? চেঁচিয়ে ওঠে পলুস।

মুরলী হাসতে হাসতে মুখ ফিরিয়ে নেয় : সকালীকে ভাবলে কি?

চমকে ওঠে, মাথা হেঁট করে, ভীরু বোবার মত তাকিয়ে থাকে পলুস। কী ভয়ানক জোহানার সন্দেহ, তার কী ভয়ানক সত্য এই সন্দেহ! পলুস হালদারের বুকের ভিতরে লুকানো অপবাধটা কত সহজে জোহানার চোখে ধরা পড়ে গেল।

–জোহানা: জোহানা! আতঙ্কিতের মত বার বার ডাকতে থাকে পলুস।

মুরলী বলে–আমি একটুও রাগ করি নাই। তুমি ঘুমাও।

–না ঘুমাব না; আমি জবাব নিয়ে ছাড়ব। বলতে বলতে যেন আগুনে পোড় প্রাণীর মত ছটফট করে মুরলীর একটা হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পলুস।

–হাত ছাড়। আমি রাগ করি নাই, তুমি রাগ কর কেন? বলতে বলতে মুরলীর শয়ান। চেহারাটা হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে বিছানার উপর উঠে বসে।

পলুস–তুমি আমাকে হেসে হেসে ঠকাবে কেন? এত বড় ঠগিন তুমি হবে কেন?

মুরলীর চোখ দুটো জ্বলে ওঠে : কাকে ঠগিন বলছো তুমি?

–তোমাকে।

–কে আমাকে ঠগিন করলে?

-কি বললে? জোহানার হাতটাকে পিয়ে দেবার জন্য পলুস হালদারের হাতের কজির হাড় কড়মড় করে বেজে ওঠে।

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী–হাত ভেঙে দিলেও আমি কাদবো না পলুস। আমি হাসবো। হেসে হেসে সিস্টার দিদিকে বলবো, এই দেখ দিদি, তোমার আদরের খিরিস্তান, তোমার পলুস ভাই আমার হাত ভেঙে দিলে।

মুরলীর হাত ছেড়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে পলুস।

নীরব ও স্তব্ধ পলুস হালদারের এই চেহারা যেন একটা জব্দ হিংস্রতার চেহারা। মুরলীর মুখের দিকে অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকে আর কটমট করে পলুস হালদারের যে চোখ দুটো, সেই চোখ দুটোও যেন এক জোড়া অসহায় ও অক্ষম আক্রোশের চোখ। আর, মুরলী যেন পরম নিশ্চিন্ততার সুখে, দুর্ভাবনাহীন একটা আমোদের আবেশে পলুস হালদারের সেই কটমটে চোখের করুণতার দিকে তাকিয়ে আছে। মুরলীর মনে কোন আতঙ্ক নেই; মুবলীর চেহারা স্তব্ধ হয়ে যায় নি। বেশ সুন্দর ছটফট করে দু হাত চালিয়ে ভাঙা খোঁপাটাকে পরিপাটি করে বাঁধতে থাকে আর হাসতে থাকে মুরলী।

অনেকদিন আগে, কয়লা-খাদের কলঘরে রাতের ডিউটি সেরে ভোরবেলায় হারানগঞ্জের ফেরবার সময় ভুবনপুর সড়কের ধারে পিয়াশালের ছোট্ট জঙ্গলটার দিকে তাকাতেই একটা মজার দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল পলুস হালদার। একটা গো-বাঘা হুঁড়ার সেদিন দুটো গাছের মাঝখানের ফাঁকের মধ্যে আটকে গিয়েছিল, আর মরা পিয়াশালের প্রকাণ্ড একটা ডাল হুঁড়ারের কোমরটাকে চাপা দিয়ে পড়েছিল। হুঁড়ারটা সেই চাপা পড়া কোমর নিয়ে একেবারে অনড় হয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল, এক পাও এগিয়ে যাবার সাধ্যি ছিল না। হুড়ারটার চোখের সামনে, ওর সেই হিংস্র মুখের কাছ থেকে মাত্র তিন হাত দূরে একটা খরগোশ একেবারে নিশ্চিন্ত মনের আরামে দুর্বা ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। হুঁড়ারটার সেই জব্দ মুখের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে খরগোশের লাল চোখ দুটোতে যেন একটা ধূর্ত আনন্দের হাসি টলমল করছিল।

মুরলীর মুখটাও ঠিক সেইরকম ধূর্ত আনন্দের হাসি হাসছে। চুপ করে বসে দেখতে থাকে পলুস; ঘর থেকে বের হয়ে ইদারার দিকে চলে গেল মুরলী; মুখ ধুয়ে আর জল নিয়ে ফিরে এল। দেয়ালের তাকের উপর থেকে থালা ডিশ আর বাটি নামাল। থালা ভরে ভাত, বাটি ভরে ডাল আর ডিশ ভরে শাক-মাংস নিয়ে মেঝের উপর বসে পড়ল মুরলী।

মটর শাক আর সরষের শাক দিয়ে হরিয়াল ঘুঘুর মাংস রান্না করেছে মুরলী। আজই সকালে একটা মান্‌ঝি ছোঁড়ার কাছ থেকে চার আনা দিয়ে ঘুঘুটা কিনেছিল পলুস। পলুসই মুরলীকে বলে গিয়েছিল-ইস্কুলবাড়ি থেকে আজ ফিরবে যখন, তখন বুড়া জুলিয়াসের ঘরে যেয়ে ওর ক্ষেতের মটর শাক আর সরষের শাক কিনে নিয়ে এসো জোহানা। এক আনাতে ঢের শাক হবে। ঘুঘুটার হাড়মাস ভাল করে ভেঁচে নিবে; নিমক ঝাল বেশি দিবে না। শাকমাস সিঝে যাবার পর কঁচা পেঁয়াজের কুচা ঢেলে দিবে।

যা বলে রেখেছিল পলুস, তাই করেছে মুরলী। শাক-মাসের যেমনটি স্বাদ চেয়েছিল পলুস, ঠিক তেমনটিই স্বাদ ধরেছে গরম-গরম শাক মাস। চুপ করে বসে দেখতে থাকে পলুস, পিয়াশালের জঙ্গলের সেই খরগোশটার মত নিরাতঙ্ক মনের একটা সুখের ঝেকে পেটভরে ভাত ডাল আর শাক-মাস খেয়ে নিল মুরলী। পলুসের উপর অভিমান করে উপপাসী থাকবে আর পেটের ক্ষুধাটাকে দুখাবে, এই জোহানা সেই জোহানা নয়। গতরের উপর বড় দরদ জোহানার। পেটটার উপর বড় মায়া। পেটের ভিতরের একটা মায়াকে বড় যত্ন করে খাইয়ে বাঁচিয়ে আর পুষে রাখছে জোহানা।

মুরলীর নামে যদি পাল্টা একটা অভিযোগ করে সিস্টার দিদির কাছে বলতে পারা যেত জোহানা আমার ঘরের সুখ নাশ করছে দিদি, তবে কি একটা বিচার করত না, আর মুরলীকে একটা ধমক দিয়ে সাবধান করে দিত না সিস্টার দিদি? কিন্তু…ভাবতে গিয়ে ভয় পায় পলুস হালদার, মুরলীর নামে কি অভিযোেগ করবে পলুস? মুরলী শুধু হাসে, এই অভিযোগের কথা

শুনলে সিস্টার দিদি যে নিজেই হেসে ফেলবে, আর পলুসকেই ধমক দিয়ে সাবধান করে দেবে? তোমার কি মাথা খারাপ হলো পলুস; বেচারা জোহানা যে এত হাসে, সে তো সুখের কথা বটে।

আর, মুরলী যদি ঐ ভয়ানক ঠাণ্ডা হাসির নেশায় খিলখিল করে হেসে সিস্টার দিদির কাছে পলুসেরই বুকের ভিতরের একটা গোপন অপরাধের কথা শুনিয়ে দেয়, তবে? সিস্টার দিদির নীল চোখ দপ করে আগুন হয়ে জ্বলে উঠবে। কেন পলুস? খিরিস্তান হয়েও তোমার মনে আজও জংলী পাপ লুকিয়ে থাকে কেন? জোহানার স্বামী হয়েও তুমি মনে মনে এখনও সকালীর মুখটাকে ভাব কেন? ছিঃ পলুস, ছিঃ!

না, উপায় নেই, সিস্টার দিদির কাছে পাল্টা অভিযোগ করবার কিছু নেই। বরং মুরলীই অভিযোগ করতে পারে-দেখ দিদি, আমি তোমার পলুস ভাইয়ের সব কথা আর সব ইচ্ছা মেনে চলি, দাসীর মত খাটি আর ভালমানুষের মত হাসি; আমি কোন্ দোষ করলাম দিদি?

কল্পনায় দেখতে পায় পলুস আর চোখ দুটো ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে। জোহানার মাথাটাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আদর করছে সিস্টার দিদি, আর পলুসের দিকে ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে–আমার জোহানা বহিনকে দুখ দিলে তোমার ভাল হবে না পলুস। মনে রেখো, আমি তোমাকে কয়লা খাদের কলঘরে চাকরি পাইয়ে দিয়েছি।

মেঝের উপর আর চাটাই পাতে না মুরলী। আবার খোঁপা ভেঙে চুল এলো করে দিয়ে বিছানার উপর লুটিয়ে পড়ে। ঘরণী যেমনটি করে, ঠিক তেমনটি; মুরলীর আচরণে কোন ভুল নেই, কোন খুঁত নেই। শুনলে সিস্টার দিদি যে আশ্চর্য হয়ে উঠবে, জোহানা বহিন কোন দোষ করে না, এটা কি দোষ বটে পলুস? তোমার বুদ্ধি কি খারাপ হয়ে গেল পলুস?

কিন্তু পলুসের স্তব্ধ শরীরটা মাঝে মাঝে কাঁপে, আর বুকের ভিতরে একটা বিমূঢ় বেদনা থেকে থেকে গুমরে ওঠে।-তুমি বিশ্বাস কর দিদি, তোমার জোহানা বহিনই ঠাণ্ডা হাসি হেসে আমার কলিজার সব জোর খারাপ করে দিচ্ছে। জোহানার গতর বড় ঠগ গতর। কত ঠাণ্ডা ওর শ্বাস, কত শক্ত ওর ঠোঁট দুটা। জোহানার চোখ দুটা এত হাসে বলেই যে আমার মন দুখায়, আর জংলী সকালীর চোখ দুটা মনে পড়ে যায়। আমাকে যে পাপী করে দিলে তোমারই জোহানা বহিনের হাসিটা।

ঘুমিয়ে পড়েছে মুরলী। চুপ করে বসে মুরলীর মুখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকে পলুস। মুরলীর শিথিল শাড়িটাও যেন ঘুমের ঘোরে এলিয়ে পড়ে আছে। হা, কি ভয়ানক ঠগ গতর, কত স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মুরলীর সরু কোমরের খাজ নতুন রক্তমাংসের আহ্বাদে ভরাট হয়ে গিয়েছে।

জ্বলতে থাকে পলুসের নিশ্বাসের বাতাস। এতদিনে একটা ভয়ানক বেহায়া রহস্যের অর্থ বুঝতে পেরেছে পলুস হালদার। যে মানুষের হাতটাকে পিষে দেবার জন্য কড়কড় করে বেজে ওঠে পলুসের কজির হাড়, সেই মানুষ তবুও কেন এই ঘরের দরজার কপাট আর ঘর ছেড়ে চলে যায় না? সে মানুষ হেসে ওঠে কেন? পলুসের এই ঘরের সব শাসন এত সহজে মাথা পেতে নিয়ে এত শান্ত হয়ে থাকে কেন সেই মানুষ?

কি ভেবেছে জোহানা? অনাথবাড়িতে না গিয়ে ওর পেটের ছেইলাকে এই ঘরের ভিতরেই রাখতে আর বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে বলে ভরসা করছে? তাই কি এই ঘরের হুকুমের প্রতি এত বাধ্যতা? তাই কি ভুলেও একবার অনাথবাড়ি যাবার নাম করে না?

মুরলীর পেটের দিকে তাকিয়ে পলুস হালদারের চোখ দুটোও হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে। বিষ আছে জোহানার পেটে। ওই বিষ আছে বলেই জোহানার গতরটা এমন ঠগ হয়েছে। তাই পলুসের ছোঁয়াকে একটা অসার কৌতুকের ছোঁয়া বলে মনে করে জোহানা, আর মুখ টিপে ঠাণ্ডা হাসি হাসে।

জোহানার এই শরীরকে পলুসের স্পর্শ না করাই উচিত ছিল। এই ঘরটাও বোধহয় পলুসের বৃথা উল্লাসের রকম-সকম দেখে মুখ টিপে হেসেছে, আর ঠাট্টা করেছে। এমন জোহানাকে ছুঁয়ে লাভ কি পলুস? এমন জোহানার গতর বুকের কাছে টেনে নিয়ে যতই আদর কর না কেন, তাতে তোমার ছেইলা তো আসবে না পলুস। যে আসবে, সে হলো একটা কিষাণের ছেইলা।

প্রহরের পর প্রহর রাতের আঁধার পান করে যেন নেশা করেছে হারানগঞ্জের ডাঙার যত ঝোপঝাপের ঝিঁঝিঁ। বাতাস উতলা হলেও ঝিঁঝিঁর স্বর নেতিয়ে পড়েছে। পলুস ডাকে জোহানা!

ধড়ফড় করে উঠে বসে মুরলী : কি? সকাল হয়েছে কি?

পলুস–সকাল হবে এখনই।

মুরলী-বেশ তো।

পলুস-না, বেশ নয়। তুমি আজ আর ইস্কুলবাড়ি যাবে না।

মুরলী আশ্চর্য হয়ে তাকায় : কেন?

পলুস-তুমি আজ অনাথবাড়ির হাসপাতালে যাবে।

মুরলীর কালো চোখের তারা দুটো জ্বলে জ্বলে হাসতে থাকে? এত তাড়াতাড়ি কর কেন পলুস? মেরিয়া বলেছে, আর এক মাস পরে….

পলুস-না, আজ তোমাকে যেতে হবে।

–কেন?

–তোমার মতলব ভাল নয়।

–কিসে বুঝলে?

–আমি সব বুঝি জোহানা। চিৎকার করে ওঠে পলুস : তুমি আমার এই ঘর থেকেই তোমার পেটের বিষ খালাস করতে চাও।

–বিষ?

–হ্যাঁ বিষ বটে। তুমি ভেবেছ, দিনগুলো হেসে হেসে পার করে দিবে, অনাথবাড়ির হাসপাতালে যাবে না, আর আমার ঘরের ভিতরে বসে কিষাণের ছেইলার নাডি ছুঁয়ে ছলকাদা কেঁদে আমাকে ভুলাবে। সে হবে না, কভি হবে না জোহানা।

মুরলীর চোখের তারা এইবার ধিক ধিক করে হাসে : না পলুস। তুমি বড় ভুল ভাবলে পলুস। জোহানা আর কভি তোমার কাছে কাঁদবে না, তোমার কাছে মাপ মাগবে না।

–তবে আর কথা বল কেন?

–শুধাই, এত তাড়াতাড়ি কর কেন?

–আমার মনে ডর আছে।

–কিসের ডর?

–না, ডর নয়। আমার ঘিন্না লাগে।

–কাকে ঘিন্না লাগে?

–তোমার ঠগ গতরকে।

–ঠগ গতর বল কেন?

–তোমার এই গতর ছুঁলে আমার এই ছেইলা আসবে না; কিন্তু আমি যে আমার ছেইলা পেতে চাই জোহানা। বলতে বলতে পলুসের চোখ দুটো যেন ক্ষুধাকাতর পাগলের চোখের মত ছটফট করে জ্বলতে থাকে।

–এই তোমার ডর! হেসে ওঠে মুরলী। সে হাসির শব্দ যেন একটা ঠাণ্ডা কৌতুকের প্রেতের মত শরীরহীন প্রতিধ্বনি হয়ে পলুস হালদারের ঘরের বাতাসে ঢলে ঢলে গড়াতে থাকে।

ঝিঁঝিঁর ডাক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘরের জানালার ফাঁকের উপর বাইরের আকাশের আভাস হেসে উঠেছে। পলুস হালদারের মুখের দিকে তাকিয়ে বড় সুন্দর শান্ত হাসি হাসে মুরলী ও তোমার বড় ভাল সাধ হয়েছে পলুস। কিন্তু…।

–কি?

–হাসপাতাল যদি এখনই আমাকে নিতে না চায়? যদি একটা মাস পরে আসতে বলে?

–সে আমি মানবো না।

–তোমার হাসপাতাল নয় পলুস। সিস্টার দিদির হাসপাতাল।

–তুমি আমাকে মিছা ভূলাবার ছল করো না। তোমাকে আজ হতে হাসপাতালে থাকা করাবো আমি।

-তবে যে টাকা লাগবে পলুস। মেরিয়া বলেছে, আগে ভাগে ভর্তি হলে মাসে মাসে পঞ্চাশ টাকা লাগে।

–টাকা দিব।

মুরলীর চোখ দুটো আশ্চর্য হয়ে হাসতে হাসতে যেন বড় হয়ে ওঠে : কয়লাখাদের বড় মিস্তিরী কত টাকা পায়? মাসোহারা অনেক বেড়েছে কি?

ভ্রূকুটি করে পলুস। যেন একটা জ্বালাময় হুংকার কোনমতে চেপে রেখে, আস্তে আস্তে আর শক্ত করে চিবিয়ে কথা বলে পলুড়ুমুরের জাউ খেয়ে কাঁদতে যে কিষাণী, সে আবার এমন কথা শুধায় কেন?

বিছানা থেকে নেমে জানালা খোলে মুরলী। বাইরের আকাশের এক ঝলক আভা ঘরের ভিতর এক ঝলক হাসির মত লুটিয়ে পড়ে। ছটফট করে ঘরের ভিতরে ঘুরতে থাকে মুরলী। বই আর খাতা একটা ঝুলির মধ্যে ভরে। আলনার শাড়ি জামা আর সায়া ধরে টান দেয়। ঝটপট চোখমুখ ধুয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।

-চল পলুস, চল। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী। মুরলীর মুখটা ক্ষেপী হাসুনির মুখের মত অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকে। মুরলীর ছটফটে শরীরটা ক্ষেপী নাচুনির শরীরের মত অদ্ভুতভাবে দুলতে থাকে।

অদ্ভুতভাবে ছুটে ছুটে চলতেও থাকে মুরলী, পিছনে পলুস। অনাথবাড়ির হাসপাতালের কাছে যখন দুজনে পোঁছে যায়, তখন সকালবেলার রোদও বেশ তপ্ত হয়ে উঠেছে।

অনাথবাড়ির সেই হাস্পাতাল, যে হাসপাতালে দাইয়ের কাজ করে জনের মা আনিয়া বুড়ি। হাসপাতালের বারান্দায় বেঞ্চির উপর চুপ করে বসে থাকে মুরলী। বারান্দার উপর আস্তে আস্তে হেঁটে পায়চারি করে পলুস। তারপর সাইকেল চুটিয়ে আসাইলামর অফিসে গিয়ে পনের মিনিটের মধ্যে ফিরে আসে; হাতে একটা চিঠি।

সিস্টার দিদির চিঠি নিয়ে এসেছে পলুস। সিস্টার দিদি হেসে হেসে স্নেহা স্বরে বলেছে–হ্যাঁ পলুস, ডাক্তার যদি বলে যে জোহানার এখনই ভর্তি হওয়া ভাল, তবে এখনই ভর্তি হবে জোহানা। টাকা লাগবে না। আমি চিঠিতে এই কথা লিখে দিলাম।

সেই চিঠি মুরলীর হাতে তুলে দেয় পলুস। চিঠিটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভর্তি হবার প্রতীক্ষায় বসে থাকে মুরলী।

জনের মা আনিয়া বুড়ি এসে বলে-ভাবনা করবে না জোহানা। এখনই তোমার ডাগদারি হয়ে যাবে। তারপর গড বাবার দয়া…ভাবনা করবে না জোহানা।

বুঝতে পারে নি মুরলী, কখন চোখ দুটো একটা অলস স্বপ্নের ভারে ছোট হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শাড়ির আঁচলের খুট দুই নরম ঠোঁটের একটা শক্ত যন্ত্রণা দিয়ে কামড়ে ধরে নিজেরই এই অপেক্ষার নিঃশ্বাসের শব্দগুলিকে শুনতে থাকে মুরলী। চোখ মেলে তাকিয়েও যেন দেখতে পায় না মুরলী, পলুস হালদারের শক্ত ছায়াটা কেমন করে চলন্ত প্রহরীর মত ওরই চোখের সামনে আনাগোনা করছে।

জনের মা আনিয়া বুড়ি হঠাৎ এসে আদর করে মুরলীর হাত ধরে চেঁচিয়ে ওঠে : চল জোহানা।

থমকে দাঁড়ায় পলুস হালদার। জনের মা আনিয়া বুড়ির সঙ্গে হেঁটে হেঁটে বারান্দার শেষ দিকে ছোট ঘরটার কাছে এগিয়ে যেয়ে যখন দাঁড়িয়ে পড়ে মুরলী, আর ঠেলা দিয়ে দরজা খোলে আনিয়া বুড়ি, তখন বুঝতে পারে পলুস, এইবার জোহানার উপর একটা ডাক্তারী কাজ হবে, আর ভর্তি হয়ে যাবে জোহানা। দেখতে পেয়েছে পলুস, ঘরের ভিতরে মস্ত বড় একটা টেবিল; সেই টেবিলের উপর একটা বালিশও আছে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে পলুস, সিস্টার দিদির চিঠিটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লো জোহানা। আর, জনের মা আনিয়া বুড়ি জোহানার ঝুলিটাকে হাতে নিয়ে…কে জানে কোন্ ঘরের দিকে চলে গেল।

চমকে ওঠে পলুস হালদার। পলুস হালদারের চোখ আর কান শিউরে দিয়ে এক জোড়া চকচকে জুতোর শব্দ পলুসেরই ছায়া মাড়িয়ে চলে গেল। গটমট করে হেঁটে এগিয়ে যেয়ে, ছোট ঘরের ভিতরে ঢুকেই দরজার কপাট বন্ধ করে দিল ডাক্তার রিচার্ড সরকার।

বারান্দার উপর এক ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে পলুস। গলায় জড়ানো রামধনু রঙের রুমাল ঘামে ভিজে যায়। চোখ দুটো কেঁপে কেঁপে ক্লান্ত হয়। বন্ধ নিশ্বাস বুকের ভিতরে যেন দুম দুম শব্দ করে কিল মারে।

ছোট একটা ঘর, সে ঘরের ভিতরে একটা ভয়ানক নীরবতার মধ্যে শুধু দুটি মানুষ; জোহানা আর রিচার্ড সরকার। এ কি হল? জোহানার ঠগ গতরটাকে চিনতে আর বুঝতে এত দেরি করে কেন ডাক্তাটা এত কি দেখবার আছে? ওই ভয়ানক ডাক্তারী চোখ দুটোর সব দেখা এখনো শেষ হয় না কেন? জোহানাও কি এখনও লাজ পেয়ে গতর ঢাকে নাই? ওরা দুজনে কি গায়ে গায়ে ছোঁয়াছুঁয়ি করে সুখ-দুখের কথা বলাবলি শুরু করে দিল?

ঘরের দরজা খুলে যায়। তেমনই গটমট করে হেঁটে, ডাক্তারী সরঞ্জামের ব্যাগ এক হাতে ঝুলিয়ে, আর গলার টাই ফুরফুরিয়ে চলে গেল ডাক্তার রিচার্ড সরকার।

আর, আস্তে আস্তে হেঁটে, যেন একটা সুখী শরীরের আলস্যের ভার টানতে টানতে পলুসের সামনে এসে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী–ও পলুস।

–কি? বলতে গিয়ে পলুসের ঠোঁট দুটো ভীরু হয়ে বিড়বিড় করে।

–তুমি এখন ঘরে যাও পলুস।

–তুমি কি যাবে না?

–হে গড! কলকল করে হেসে ওঠে মুরলী–তুমি এ কেমন কথা বলছো? আমি ঘরে যাব কেন?

–তুমি যে বললে, তাড়াতাড়ি নাই। একমাস দেরি আছে।

–হ্যাঁ, ঠিক বলেছি।

–তবে এখন ঘর চল না কেন?

–না পলুস।

–কেন জোহানা?

–ডাক্তার বললে।

–কি বললে ডাক্তার?

–আমার এখনই হাসপাতালে থাকা ভাল।

–কেন এমন কথা বলে ডাক্তার। ভ্রূকুটি করে, আর, যেন একটা চিৎকার চাপতে চেষ্টা করে পলুস।

মুরলী হাসে ও সে কথা আমাকে শুধাও কেন? ডাক্তরটাকে শুধালেই পার।

জনের মা আনিয়া বুড়ি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে যেন আদরের আবেগে চেঁচাতে থাকে— জোহানা, জোহানা বহিন, তোমার বড় ভাল ঠাঁই হয়েছে বহিন। চল বহিন।

মুরলীর হাত ধরে টান দেয় আনিয়া বুড়ি। আনিয়া বুড়ির সঙ্গে চলতে থাকে মুরলী। জোহানার মুখের সেই ঠান্ডা হাসিটা আরও ঝিকমিক করে। আনিয়া বুড়ির হাত ধরে একটা নতুন আহ্বাদের জগতের দিকে চলে যাচ্ছে জোহানা। শুনতেও পাওয়া যায়, আনিয়া বুড়ি কী ভয়ানক মুখর হয়ে বকবক করতে করতে চলে যাচ্ছে : গড বাবা দয়া করেন, গড বাবা দয়া করেন।

আর দেরি করে না পলুস। বারান্দা থেকে নেমে, সাইকেলটাকে হাতের কাছে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে, সড়কের দিকে এগিয়ে যায়।

অনেক দূরে, ভুবনপুর খাদের কলঘরের চিমনি থেকে কালো ধোঁয়ার ফোয়ারা উথলে উঠে ভুবনপুরের আকাশের রোদটাকে কালো করে দিচ্ছে। সেই দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই সাইকেলের উপর লাফ দিয়ে উঠে বসে পলুস আর উধাও হয়ে যায়।

 

অনাথবাড়ির ছোট হাসপাতালের ছোট একটা ঘরে ছোট একটা খাটিয়া। বালিশ আছে, দুটো কম্বল আছে, আর একটা চাদরও আছে। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে নিকটে একটা তাল গাছ দেখা যায়; অনেক রাতে তালের মাথার উপর একটা মাদি শকুন মাঝে মাঝে পাখা ধড়ফড়িয়ে ছটফট করে। কিন্তু দুপুর বেলা রোদের তাতে যখন তালের মাথায়ও ঝলসে যেতে থাকে, তখন ডানা ছড়িয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকে মাদি শকুনটা। রোদে ভাজা-ভাজা হয়ে যায় শকুনটা, তবু নড়ে না। শকুনটার ডিম ফুটেছে কি ফুটে নাই, কে জানে? বুঝতে পারে না মুরলী। শুধু উদাসভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকে।

লিখতে আর পড়তে কখনও মন লাগে, কখনও লাগে না। কিন্তু কিছুই ভাল লাগে না। মুরলীর গতর ছুঁয়ে নিজের ছেইলা পেতে চায় পলুস, কিন্তু পলুসের ছায়ার কাছে এগিয়ে যেতেও যে মুরলীর মন ঘৃণা বোধ করে, দুঃসহ জ্বালায় ভরা একটা ঘৃণা। মুরলীর ছেইলাকে অনাথবাড়ির অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায় যে, তাকে ছেইলা দিবার জন্য এই শরীরটা ছেড়ে দেবার আগে বিষ খেয়ে মরে যাওয়াও ভাল।

কিন্তু মরতে যে একটুও ইচ্ছে করে না। অথচ পলুসের ওই ঘরের আশ্রয় ছাড়া যে আর কোন আশ্রয়ও নেই। হাসপাতাল থেকে পলুস হালদারের ঘরে ফিরে যাবার পর, পলুস হালদারের সেই হিংস্র আহ্বাদের দাবী মুরলীর শরীরটাকে ক্ষুধাতুর জন্তুর মত আঁকড়ে ধরতে চাইবে। এই ভয়। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে দিনের পর দিন শুধু এই ভয় সহ্য করতে গিয়ে দিন দিন হতাশ হতে হয়। মুরলীর নিঃশ্বাস জ্বলতে থাকে। সে অভিশাপ সহ্য করতে পারবে না মুরলী।

এখনও দরকার আছে, তাই পলুসের ঘরটা চাই, পলুসের টাকাও চাই; কিন্তু পলুসকে চাই না। পলুস যেন মুরলীর গা ছুঁতে না পারে; এমন উপায় কি হয় না?

যারা বিনা টাকাতে এই হাসপাতালে ভর্তি হয় আর এইরকম ঘরে থাকে, তারা সকালে উঠেই নিজের হাতে ঘর ঝাট দেয় আর বিছানার চাদর নিজের হাতেই সাবান দিয়ে কাচে। দেখতে পায় মুরলী, পাশের ঘরে যে মোটাসোটা বহুড়িটা থাকে, একমাসেরও বেশি হল যার একটা সুন্দর মোটাসোটা বাচ্চাও হয়ে গিয়েছে, তার ঘরে দুটো দাই দিনরাত খাটে। বহুড়িটাকে কোন বাবুর বহুড়ি বলে মনে হয়। বহুড়িটার গায়ে কতরকমের গয়না! খাটের উপর বসে পানের ডাবর হাতের কাছে নিয়ে পান সাজে আর খায়, সব সময় হাসে। হাসপাতালের ভাত মুখে দেয় না, ছোয়ও না। রোজই দু বেলা একটা লোক এসে বহুড়িটার ঘরে নানারকম ভাল ভাল খাবার পোঁছে দিয়ে যায়।

এই বহুড়িটাই একদিন মুরলীকে জিজ্ঞেস করে-তুমি নিজে খাট কেন গো বহিন? তুমি কি খয়রাতী বট?

মুরলী হাসে-হ্যাঁ গো দিদি।

–টাকা দিতে পারে না কি তোমার সোয়ামি?

–না।

–কেন? কি কাজ করে তোমায় সোয়ামি?

–কয়লা-খাদের কলঘরে কাজ করে।

–মিস্তিরী বটে কি?

–হ্যাঁ।

–নাম কি?

–পলুস হালদার।…কিন্তু তুমি নাম শুধাও কেন দিদি?

গায়ের গয়না দুলিয়ে হাসতে থাকে বহুড়িটা—ওই কয়লা-খাদ যে আমার খাদ বটে।

মুরলী আশ্চর্য হয় : তোর খাদ কেন হবে? ওটা সাহেবের খাদ!

–হ্যাঁ গো বহিন, সাহেবেরই খাদ বটে; কিন্তু খাদের সব টাকা যার জিম্মায় থাকে, সে মানুষটা যে আমারই…।

–তোমার সোয়ামি?

–ছিঃ, সোয়ামি কেন হবে ওই মুখপোড়া?

মুরলীর বুক দুরুদুরু করে ও তোমাকে যে কেমনটি মনে হয় দিদি।

-কেমনটি মনে হয়? করালী খান্দের খাজাঞ্চিটা আমার কে বটে, বল দেখি বহিন? পান মুখে দিয়ে ঢলে ঢলে হাসতে থাকে মেয়েলোকটা।

-আমার বলতে ডর হয় দিদি। সত্যিই ভীরুর মত চোখ করে মেয়েলোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মুরী।

মেয়েলোকটা বলে-হ্যাঁ, এক সালও হয় নাই। খাজাঞ্চিটা আমাকে ঝরিয়া থেকে আনা করিয়ে ওর ঘরে রেখেছে। লোকটা কিন্তু ভাল বটে বহিন; বড় ভাল ভেড়াটি বটে। ওর সব  টাকা আমি ছিনে নিই, তবু রাগ করে না।

মুরলী বাবুটার ঘরে আর কেউ নাই?

–বাবুটার আর-একটা ঘর আছে, সেথা ওর মাগছেইলা থাকে। মাগকে দশটা টাকা পাঠাবে যদি, তবে আমাকেই হাত ধরে সাধে বাবুটা, তুমি দয়া কর বিজু, দয়া করে দশটা টাকা দাও। বড় ভাল ভেড়া বটে। ঝরিয়ার বিজু বাঈ-এর মত রাখনি পেলে কে না ভেড়া হবে গো?

মুরলী–কিন্তু একদিন যদি তোমাকে…।

বিজু বাঈ-এর চোখ দুটো যেন একটা ঠাট্টার রসে চিকচিক করে ওঠে : খেদিয়ে দেয় যদি? দেয় তো দিবে।

মুরলী-তোমার এই ছেইলার দশা কি হবে?

বিজু বাঈ-আমার ছেইলার দশা আবার কি হবে? আমার কাছে থাকবে। বড়টি হবে। আমার যা টাকা আছে তাতে…।

মুরলী–কি?

বিজু বাঈ-তাতে আমার ছেইলা একদিন একটা রাজপুত কি বামনের বেটিকে বিয়া করে ঘরে নিয়ে আসবে। টাকাতে কি না হয় বহিন?

বিজু বাঈ-এর হাসির শব্দ শুনতে শুনতে, আর বিজু বাঈ-এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুরলীর মুখটা যেমন করুণ তেমনই উদাস হয়ে যায়।

বিজু বাঈ বলে—তুমি মুখটাকে কালা কর কেন বহিন? কি হয়েছে তোমার?

উত্তর দেয় না মুরলী।

পানের পিক গিলে আর দোক্তার ঝাজে নাক কান লাল করে নিয়ে বিজু বাঈ আবার হাসে : ভাবনা কর কেন?

মুরলী—আমার যে ভাবতে হয় দিদি। তুমিও ছেইলা নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে, কিন্তু আমি শুধু ওই ঝোলাটা হাতে নিয়ে ফিরে যাব।

বিজু বাঈ-এর লাল নাক আর কান যেন হঠাৎ-আতঙ্কে শিউরে ওঠে : না না; এমন কথা ভাব কেন বহিন? মা কালী দয়া করবে, তোমার পেটের সব বিপদ নাশ হয়ে যাবে। সুন্দর ছেইলা হবে তোমার।

মুরলী-কিন্তু সে সুন্দর ছেইলাটাকে ঘরে নিয়ে যাবার উপায় নাই।

–কে এমন কুমটি দিলে?

–হুকুম দিলে আমার ঘরের মানুষ।

–মানুষটা ক্ষেপা বটে কি?

-একটুকুও ক্ষেপা নয়। বড় ভাল হিসাব জানে।

–হিসাব কেন? তোমার ছেইলা কি ওর ছেইলা নয়?

–না, আমার আগের সোয়ামির ছেইলা।

–তাই বল না কেন? ভাতারে রাগ করেছে? বিজু বাঈ-এর আতঙ্কিত মুখটা এইবার একটা আক্রোশের জ্বালায় কুৎসিত হয়ে যেন মুরলীকেই ধিক্কার দিতে থাকে? ভাতারগুলো যে এমন া হয়, আগে বুঝ নাই কেন? ভাতার কর কেন?

মুরলী ভ্রূকুটি করে? তুমি এ সব কথা আমাকে বলবে না।

বিহু বাঈ মুখ বেঁকিয়ে হাসে? কেন বলবো না গো? সোয়ামিগুলা ছুঁচা বটে যে গো! মাগের পেটের হিসাব নিবার লেগে কিচকিচ করে। ভাতারের চেয়ে ভেড়ারা ঢের ভাল।

মুরলী-কেন ভাল?

বিজু বাঈ-মাগির পেটের হিসাব নিবার লেগে কিচকিচ করে না ভেড়ারা। ভুবনপুর একদিন যাবে তো দেখতে পাবে, আমার এই ছেইলাকে কোলে নিয়ে কত আদর খাটছে খাজাঞ্চিটা।

মুরলী-বাবুটা ওর নিজের ছেইলাকে কোলে নিয়ে আদর খাটবে, তাতে আর…।

হি হি! হি হি! হাসতে হাসতে এলিয়ে পড়ে বিজু বাঈ। বিজু বাঈ-এর বাজুবন্ধের সোনার ঝালরও যেন একটা দূরস্ত কৌতুকের আমোদে নীরব হি হি হাসি হেসে কাঁপতে থাকে। বিজু বাঈ বলে—এটা খাজাঞ্চির ছেইলা নয় বহিন; এটা একটা ঠিকাদারের ছেইলা। খাজাঞ্চিটা সবই জানে।

মুরলীর হতভম্ব মুখটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তীব্র একটা চাহনি হেনে তাকিয়ে থাকে বিজু বাঈ। তারপর ফিসফিস করে বলে-তোমার যদি ঘরে ফিরে যেতে মন না করে, তবে বল বহিন। আমি তোমার…।

বিজু বাঈ-এর মুখের দিকে মুরলীও তীব্র একটা চাহনি ছড়িয়ে দিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে। তার পরেই মুখ নামিয়ে নিয়ে দেয়ালের গায়ে নখের দাগ বোলাতে থাকে। মুরলীর জীবনের একটা আশা যেন একটা সুযোগ পেয়ে এইবার ভয়ানক কঠোর হয়ে উঠেছে আর হিসাব করছে।

মুরলী বলে-তুমি আমার মতলবের একটা কথা আগে শুনবে কি?

–বল।

—তোমার বাবুটাকে বলে কলঘরের বড় মিস্তিরীকে বদলি করিয়ে দিতে পার?

আর একটা পান মুখের ভিতরে পুরে দিয়ে বিজু বাঈ ফিসফিস করে–খুব পারি। খাদের। মানিজারবাবু খাজাঞ্চিটাকে খুব মানে।

মুরলী-তবে তাই কর।

বিজু বাই যেন ফোঁসফোঁস করে হাসে : তবে তাই মনে রেখ বহিন, আমাকে খবর দিলেই…।

বিজু বাঈ-এর ঘরের দরজার কাছ থেকে ছুটে এসে নিজের ঘরের ভিতরে ঢুকেই হাঁপাতে থাকে মুরলী। মুরলীর নিঃশ্বাসের শব্দ যেন বিজু বাঈ-এর হাসির শব্দের মত ফেঁসফোঁস করতে থাকে। মুরলীর মনের একটা আক্রোশের হিসাব এতক্ষণে তৃপ্ত হয়েছে।

কিন্তু আর ভয় নেই। বিজু বাঈ নামে ওই ভয়ানক হাসির মেয়েমানুষটা যদি সত্যিই দয়া করে, তবে পলুসের স্পর্শের ভয় থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে মুরলীর জীবন।

কিন্তু, তারপর?

ডাক্তার রিচার্ড সরকারের চোখ দুটো এমন উদাস রকমের চোখ কেন? যেদিন প্রথম ডাক্তারী হল, সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আরও তিনবার মুরলীর এই শরীর চোখে দেখে চলে গিয়েছে রিচার্ড। মুরলীর কোমরে দুবার সুই দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রিচার্ডের ঠাণ্ডা চোখ দুটো ভুলেও একবার আশ্চর্য হয়ে যায় নি। মুরলীর বুকের দিকে তাকিয়েও মুরলীর বুকের বিচলিত শিহরটা দেখতে পায় নি বোধ হয়। আর মুরলীর চোখের দিকে তাকিয়ে মুরলীর চোখের আশাটাকে একটুও বুঝতে পারে নি।

না, রিচার্ডের উপর রাগ করবার কোন দরকার হয় না। এই মুরলীকে দেখে আশ্চর্য হবে কেন রিচার্ডের মত মানুষ? রিচার্ডের বাড়ির ফটকে কী সুন্দর ফুলের বাহার রঙিন হয়ে রয়েছে! রিচার্ডের মনের ভিতরেও ফুলের বাগান আছে। শুধু এই সুন্দর গতরটা ছাড়া মুরলীর জীবনের আর কোন্ সুন্দর আছে, যার জন্য লুব্ধ হবে রিচার্ডের মত মানুষের মন?

রিচার্ডের বাড়ির চেহারাটা বার বার মনে পড়ে। বাড়িটা এখান থেকে খুব কাছে, কিন্তু মুরলীর জীবন থেকে অনেক দূরে। কে জানে, গড বাবা দয়া করবে কি? রিচার্ডের মত মানুষ একদিন মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হবে কি?

অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে নিকটের তাল গাছটাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু…এ কি? এত বেশি ছটফট করে পাখা ধড়ফড় করছে কেন মাদি শকুনটা? শকুনের বাসাতে এমন করুণ কান্নার মত শব্দ বেজে ওঠে কেন? কাঁদছে কি শকুনের ঘ?

ধড়ফড় করে মুরলীর বুকটা। মুরলীর সারা শরীর জুড়ে যেন একটা যন্ত্রণার আবেশ কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। পেটটা ছিঁড়ে যাবে বুঝি। কোমরটা যেন একটা মাতাল বেদনার রসে ভার হয়ে গিয়ে থরথর করছে। ভিজে যাচ্ছে মুরলীর সায়া। দরজার কাছে এসে, শক্ত করে কপাটটাকে আঁকড়ে ধরে, চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী–আনিয়া দিদি গো!

জনের মা আনিয়া বুড়ি ছুটে এসে হাত ধরে বলে-গড বাবা দয়া করেন। ডর নাই বহিন।

মুরলীর একটা হাত সস্নেহে ও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মুরলীকে একটা বড় ঘরের দিকে নিয়ে যায় আনিয়া বুড়ি।

 

কথা ছিল, আর সাত দিন পরেই হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি চলে যাবে মুরলী। কিন্তু বুকের কাছে ভোয়ালের উপর শোয়ানো একটা বাচ্চা মানুষের তুলতুলে দুটো পিপাসী ঠোঁটের কাঁপুনির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই জনের মা আনিয়া বুড়ির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মুরলী ও আর দুটা দিন থাকি না কেন আনিয়া দিদি?

আনিয়া বুড়ি বলে-মিছা আর থাক কেন বহিন?

এর পরেও আরও সাতটা দিন পার হয়ে যায়। সকাল হতেই মুরলীর ঘরের ভিতরে ঢুকে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় বড়দিদি, হাসপাতালের মেট্রন। বড়দিদির কালো মুখে সাদা দাঁতের হাসি ঝকঝক করে। কোমরে শক্ত করে একটা তোয়ালে জড়ানো আছে। বড়দিদির মোটা মোটা হাত দুটোও যেন একটা লোভনীয় বস্তুকে ছোঁ মেরে আঁকড়ে ধরবার জন্য আস্তে আস্তে দুলছে।

মুরলী বলে—আর কটা দিন থাকি না কেন বড়দিদি?

বড়দিদি কি-যেন ভাবেন, তারপর আবার হাসতে হাসতে চলে যান।

কিন্তু সন্ধ্যা হতেই ঘরের ভিতর এসে ঢুকলেন সিস্টার দিদি : না জোহানা বহিন; আর তোমার এখানে থাকা উচিত হবে না। আমি পলুসকে খবর দিয়েছি।

মুরলী কাঁপতে কাঁপতে বলেকি খবর দিলে দিদি?

সিস্টার দিদি–পলুস গো-গাড়ি নিয়ে সকালবেলাতেই এখানে আসবে, আর তোমাকে নিয়ে যাবে।

মুরলীর মাথায় হাত বুলিয়ে, মুরলীর থুতনি টিপে আদর করে, ব্যস্তভাবে যখন চলে গেলেন সিস্টার দিদি, তখন মুরলীর সেই ছোট ঘরের জানালার কপাটে একটা দূরন্ত হাওয়ার ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ে।

হ্যাঁ, ঝড় শুরু হয়েছে। হারানগঞ্জের আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে; একটাও তারা দেখা যায় না। তালগাছের মাথা থেকে শিশু-শকুনের কান্নার স্বর ঝড়ের বাতাসের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ছুটে এসে মুরলীর কানের ভিতর বিধতে থাকে।

-এটা যে এখনো কাছে আছে গো, আমার বুক ছুঁয়ে পড়ে আছে গো। কাল সকালে আর থাকবে না।

বাচ্চাটার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে মুরলী। কপালের উপর জোরে জোরে চাপড় মারে, আর চুলের গোছা খিমছে ধরে : ছিনে নিবে, ছিনে নিয়ে চলে যাবে ডাইনের বেটিরা!

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মুরলী। জানালা দিয়ে বাইরে ঝড়ো অন্ধকারের ভয়াল চেহারাটার দিকে তাকায়। তারপর, ঘরের মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে বিড়বিড় করতে থাকে–এ কেমন সুখের নরক গো কপালবাবা! ছিয়া ছিয়া ছিয়া!

উঠে দাঁড়ায় মুরলী। ঘরের দরজার কপাট ভেজিয়ে দিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে আসে। হাতের এক টানে পটপট করে গায়ের জামার বোতামগুলিকে ছিঁড়ে আগা করে দিয়ে নিজেরই বুকের অদ্ভুত চেহারাটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। কী ভয়ানক মায়ার জলে ফুলে আর ফেঁপে ভেজা-ভেজা হয়ে রয়েছে, টনটন করছে বুকটা! বাচ্চাটার ঘুমন্ত মুখের কাছে বুক এগিয়ে দিয়ে, আর, এক হাতে নিজেরই এলোমেলো চুলের গোছা খিমছে ধরে একেবারে নিঝুম হয়ে যায় মুরলী।

দূর দূর দূর! যেন একটা স্বপ্নের ঘোরে বিড়বিড় করতে করতে উঠে বসে মুরলী। দূর দূর! যেমন তোমার গড বাবা, তেমনই তোমার কপালবাবা; সব মিছা, সব ঠগ।

ঘুম-ভাঙা ভেজা চোখ দু হাত দিয়ে ঘষে ঘষে আবার ছটফট করে মুরলী। ভাল অনাথবাড়ি করেছে সিস্টার দিদি, বাঘিন কানারানীটার মত মানুষখাগী একটা অনাথবাড়ি। এমন অনাথবাড়ি ডরানির জলে ভেসে যায় না কেন?

মেঝের উপর বসে, খাটিয়ার গায়ে কপাল ঠেকিয়ে দিয়ে আর চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে মুরলী। চোখ দুটা যে জ্বলছে গো কপালবাবা, ঘুমাতে পারা যাবে কি? বুকটা যে জ্বলে গেল গড বাবা! একটুক জল খেতে দিবে কি? আনিয়া দিদি কোথা গেলে গো?

আবার উঠে দাঁড়ায় মুরলী। ঘরের দরজার কপাট খুলে ডাক দেয় মুরলী—আনিয়া দিদি গো।

কোন সাড়া শোনা যায় না। আনিয়া দিদি ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। অনেক রাত হল বুঝি। কেউ জেগে নাই বুঝি। হাসপাতালের ফটকের কপাটে কি তালা লাগায় ওরা?

চোরের মত সতর্ক ও তীক্ষ্ণ চোখের চাউনি তুলে চারদিকে তাকায় মুরলী। না, কেউ জেগে নেই। নিকটেও কেউ নেই। পাশের ঘরের দরজায় তালা। কবেই চলে গিয়েছে বিজু বাঈ।

রাতের এই আঁধারটা বড় ভাল। ডাকাতেরা আর চোরেরা বড় ভালবাসে এমন আঁধার। লুঠ করে নিয়ে পালিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। কেউ দেখবে না।

কোথায় যাব গো! মুরলীর বুকের ভিতরে একটা অসহায় প্রশ্নের শব্দ যেন হাহাকার ছড়াতে থাকে। হারানগঞ্জের এই আমের বাগিচা পার হয়ে, সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে ভুবনপুর পোঁছে যেতে কত সময় লাগে গো কপালবাবা? ভুবনপুর থেকে সকালবেলাতেই একটা মোটর গাড়ি ছাড়ে, বাবুবাজারের দোকানীদের নিয়ে যায় সেই গাড়ি। বাবুরবাজার থেকে হাঁটা দিলে মধুকুপির ডাঙর মাটি ধরে ফেলতেই বা কত সময় লাগবে? কিষাণের ঘরটা আছে কি? আছে নিশ্চয়। কিষাণটা ছেইলার লেগে ভাবছে আর কাঁদছে যে গো!

লোভী চোরের মত একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে বাচ্চাটাকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে নেয় আর বুকের কাছে তুলে ধরে মুরলী। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়। পা দিয়ে দরজার কপাট ঠেলা দিয়ে দরজা ভেজিয়ে দেয়। বারান্দা পার হয়ে এসে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ায়। ফটকের দিকে তাকায়।

-হায় রে গড বাবা। হায় রে তোমার দয়া। বলতে বলতে কাঁপতে থাকে মুরলী।

ভোর হয়ে গিয়েছে। বাইরের আকাশ ফর্সা হয়ে গিয়েছে। হাসপাতালের দারোয়ান, আনিয়া বুড়ির বড় ছেলে জন গুনগুন করে গান গেয়ে ফটকের কাছে ঘুরঘুর করছে।

একটা দৌড় দিয়ে ফিরে এসে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে মুরলী। বাচ্চাটাকে বিছানার উপর শুইয়ে দেয়, তারপর মেঝের উপর বসে আর খাটিয়ার গায়ে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে পড়ে থাকে।

ঝড় নেই, ভোরের বাতাস বড় মৃদু হয়ে গিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ে মুরলী।

খোলা জানালা দিয়ে মুরলীর ঘুমন্ত মুখটার উপর যখন রোদের ঝলক এসে লুটিয়ে পড়ে, তখন আবার একটা নতুন শব্দ শুনে চমকে ওঠে মুরলীর বুকের পাঁজর। চোখ মেলে তাকায় মুরলী। হ্যাঁ, শুনতে পায় মুরলী, ঠিকই, কতগুলি দূরন্ত ও নির্মম পায়ের শব্দ এই ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে।

উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে এগিয়ে যায় মুরলী। দেখতেও পায়, কালো মুখে সাদা দাঁতের হাসি ঝিকমিকিয়ে, গটমট করে জুতোর শব্দ বাড়িয়ে ঘরের দিকে আসছে বড় দিদি। পিছনে আনিয়া বুড়ি। মুরলীর ছেইলা এখনই অনাথবাড়িতে চালান হবে। আর দেরি নেই।

বিছানার কাছে এগিয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে বাচ্চাটার মুখ ঢেকে দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে মুরলী। আর, একবারও ফিরে তাকায় না। ঝোলাটাকে হাতে নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায়।

ফটক পার হয়ে সড়কের উপর এসে দাঁড়াতেই দেখতে পায় মুরলী, ব্যস্তভাবে হেঁটে এগিয়ে আসছে পলুস। পলুসের পিছু পিছু একটা গো-গাড়িও আসছে।

গো-গাড়ির দিকে ছুটে যায় মুরলী। আর, যেন বনবিড়ালীর মত লঘু শরীরের ফুর্তির আবেগে একটা লাফ দিয়ে উঠে গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। দেখতে পেয়ে হেসে ওঠে পলুস হালদারের চোখ। সেই ভয়ানক বোঝার ভার খালাস করে দিয়ে কত হাল্কা হয়ে গিয়েছে জোহানা! কী সুন্দর দুলে উঠল জোহানার সরু কোমরটা!

আগে আগে গো-গাড়িটা চলে। পিছনে গলুস। পলুসের মুখের দিকে একটা ভ্রক্ষেপও করতে ভুলে গিয়েছে মুরলী। গাড়ির ভিতরে খড়ের গদির উপর বসে, দু হাতে দু হাঁটু জড়িয়ে আর মাথা হেঁট করে, মুরলী একেবারে নীরব হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু পলুসের কপালটা বার বার রাগ করে কুঁচকে উঠতে থাকে। পলুস ডাকে—জোহানা!

উত্তর দেয় না মুরলী।

পলুসের গলার স্বর গো-গাড়ির চাকার শব্দের মত কর্কশ হয়ে ক্যাচক্যাচ করে ওঠে। কথাটা শুনলে কি জোহানা?

পলুসের গলার স্বরের এই কর্কশ শব্দটা হঠাৎ একটা আতঙ্কের ডাক হয়ে কেঁপে ওঠে? এ কি? তোমার এ কি হলো জোহানা?

কথা বলে না মুরলী। গাড়ির ছইয়ের গায়ে এলিয়ে পড়েছে মুরলী। চোখ বন্ধ। মাথাটা কাত হয়ে ঝুলছে।

-থাম হে গাড়িয়াল। চেঁচিয়ে ওঠে পলুস। গরুর নাকের দড়ি ধরে আচমকা টান দেয় গাড়িয়াল। গো-গাড়িটাও আচমকা থেমে যায়।

ফ্যালফ্যাল করে পলুস হালদারের চোখ দুটো। কী অদ্ভুত কাণ্ড। গাড়িটা যে ডাক্তার রিচার্ড সরকারের বাড়ির ঠিক ফটকের কাছে এসে থেমে গিয়েছে। ফটকের লতার ফুলগুলি দুলছে। ফুলগুলির সুবাসও ভুরভুর করছে। আর, পলুসের আতঙ্কের ডাক শুনতে পেয়ে ব্যস্তভাবে বাড়ির বারান্দা থেকে নেমে এইদিকেই ছুটে আসছে ডাগদরটা!

বাঃ, বড় ভাল সময় ভেবে রেখেছিল জোহানা, তা না হলে ঠিক এখানেই এসে জোহানা বেহুঁশ হয় কেন? বাঃ, বেশ মূৰ্ছ! ঠগ মূৰ্ছা বটে কি? হ্যাঁ, কেমন বেলাজ হয়ে জোহানার গতরটা ঢুলছে! বুকের উপর কাপড় নাই। বুকের জামাটাও ভিজা! ডাগদরটা যে এসে যাবে এখনই।

রিচার্ড সরকার কাছে এগিয়ে এসে গাড়ির ভিতরে উঁকি দেয়; সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক দয়ালু স্বরে আক্ষেপ করে ওঠে : আঁ? জোহানা হালদার বলে মনে হচ্ছে।

পলুস বলে-হ্যাঁ।

বাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে রিচার্ড-জলদি এক ঘটি জল নিয়ে এস দাই।

দাইটা এক ঘটি জল হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। কিন্তু ডাক্তারের মায়াময় ব্যাকুলতা আর তর সইতে পারছে না। রিচার্ড সরকারের হাত দুটো এত বিচিত্র আদরের কায়দাও জানে! এক হাতে মুরলীর থুতনি ছুঁয়ে মুরলীর ঝুলে-পড়া মাথাটাকে তুলে ধরে; আর এক হাত দিয়ে মুরলীর চোখের উপরে ছড়িয়ে-পড়া চুলের একটা গোছা সরিয়ে দিয়ে মুরলীর মুখের বেদনার রহস্যটাকে যেন মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে রিচার্ড। মুরলীর চোখের পাতা ফাঁক করে কালো চোখের মণিটাকেও যেন লোভীর মত একবার দেখে নিল রিচার্ড।

যেন একটা বিকট তামাশা! পলুস হালদারের স্তব্ধ চোখ দুটো দুঃসহ আতঙ্ক সহ্য করতে গিয়ে বার বার শিউরে উঠতে থাকে। ডাগদরটা জোহানাকে এখনই বুকে চেপে ধরবে মনে হয়।

জলের ঘটি হাতে নিয়ে দাইটাও কাছে এসে দাঁড়ায়। মুরলীর চোখে-মুখে বার বার জল ছিটিয়ে দিয়ে রিচার্ড ডাক্তার মুরলীর মুখের দিকে আবার চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ডাগদরটা জোহানার এই ভিজা মুখটাকে রুমাল দিয়ে এখনই আদর করে বার বার মুছে দিবে বুঝি, আর…।

-জোহানা! চেঁচিয়ে ওঠে পলুস।

রিচার্ড বলে—আঃ, একটু আস্তে ডাক দিন; চেঁচিয়ে কোন লাভ নেই।

কিন্তু পলুস হালদারের এই রূঢ় চিৎকারের শব্দটা সার্থক হয়। সত্যিই মুরলীর চোখের পাতা আস্তে আস্তে নড়তে থাকে। চোখ মেলে একটা লক্ষ্যহীন উদাস সাদাটে দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকে মুরলী।

রিচার্ড আস্তে আস্তে ডাকে-শুনছেন? বলুন…কিসের কষ্ট? মাথা ঘুরছে কি?

মুরলীর ভেজা মুখটা বিড় বিড় করে? বড় জ্বালা গো দিদি।

রিচার্ড-জ্বালা? কোথায় জ্বালা?

আস্তে আস্তে মুখটাকে এদিকে-ওদিকে ঘুরিয়ে, তারপর হেঁট মাথা হয়ে নিজেরই বুকের জামাটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে মুরলী ভিজে গেল যদি, তবে আবার জ্বলে কেন?

দাইটা চট করে হাতের এক টানে মুরলীর শাড়ির আঁচলটাকে নামিয়ে মুরলীর বুকের উপর ছড়িয়ে দেয়।

পলুস হালদারের দিকে তাকিয়ে রিচার্ড বলে—এখনও পুরো হুঁশ হয় নি।

পলুসের চোখ দুটো কুঁচকে ওঠে : হয় না কেন?

রিচার্ড—কি বললেন?

পলুস-হুঁশ পুরা হতে কত সময় নিবে?

রিচার্ড-কত আর সময় নেবে? বড়জোর আর দশ-পনের মিনিট। কিন্তু…তারপর একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার।

পলুস-ঠিক আছে।

রিচার্ড–না, ঠিক নেই। এখানে রাস্তার ওপর একটা গো-গাড়ির ভিতরে পড়ে না থেকে, আমার ঘরের ভিতরে কিছুক্ষণ বসে থাকলে আপনার…উনি আপনারই স্ত্রী নিশ্চয়?

পলুস–হ্যাঁ।

রিচার্ড-উনি এখন কিছুক্ষণ আমার ঘরে বসে জিরিয়ে নিন; একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে আরও ভাল হয়। তারপর…।

পলুসের কোন প্রশ্ন বা উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে রিচার্ড সরকারের ইচ্ছাটাও যেন একটা মায়াময় ব্যস্ততায় ছটফট করে ওঠে। দাইটার দিকে তাকিয়ে আদেশ করে রিচার্ড-হাত ধরে খুব সাবধানে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে ঘরের ভিতরে নিয়ে যাও। সোফার ওপর শুইয়ে দাও…একটু বাতাস করো…ঘুমোতে চাইলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিও..আর ঘুম ভাঙ্গলেই এক গেলাস গরম দুধ খেতে দিও.আমি চলি।

সড়কের উপরে একটা লোক, নিশ্চয় রিচার্ড ডাক্তারের চাকর হবে লোকটা, একটা সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। রিচার্ড ডাক্তার ব্যস্তভাবে গটমট করে হেঁটে সাইকেলটার দিকে এগিয়ে যায়। একটা স্বস্তির হাঁপ ছেড়ে এতক্ষণে বুঝতে পারে পলুস, রিচার্ড ডাক্তার কাজে বের হয়ে যাচ্ছে। জোহানাকে নিয়ে আদরের ঘাঁটাঘাঁটি করবার আর কোন ইচ্ছা রিচার্ড ডাক্তারের নেই।

না, রিচার্ড ডাক্তারের কোন দোষ নেই। একটা দুঃখী মেয়েমানুষের উপর একটা দয়া করেছে রিচার্ড ডাক্তার। দয়া করা যে ওর বরাজের কাজ বটে। ডাগদরটার হাতের আদরে কোন মতলব নাই।

দাইটার কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে হেঁটে রিচার্ডের বাড়ির ফটকের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মুরলী।

রিচার্ড বলে-আস্তে দাই, খুব আস্তে।

সেই মুহূর্তে চমকে ওঠে পলুস। কী আশ্চর্য আর কী ভয়ান: চতুর মতলবে মাতাল হয়ে টলে উঠেছে জোহানার শরীরটা! দাইটা জোহানাকে আর ধরে রাখতে পারছে না। জোহানার মাথাটা আবার কাত হয়ে হেলে পড়েছে। এই মুহূর্তে এই সড়কের উপর লুটিয়ে পড়বে জোহানা।

এক লাফে এগিয়ে এসেই জোহানাকে ধরে ফেলে রিচার্ড সরকার। পলুস হালদারের স্তব্ধ চোখ দুটো আবার সেই সন্দেহের জ্বালা সহ্য করতে থাকে। জোহানার শরীরের চতুর কষ্ট যেন রিচার্ড ডাক্তারের হাত দুটোকে কাছে পাওয়ার জন্য আবার নতুন একটা কায়দা করে আরও ভয়ানক একটা ঢং ধরেছে। ঠিকই, জোহানার মতলব জয়ী হয়েছে। এক হাতে জোহানার একটা হাত শক্ত করে ধরে, আর এক হাতে জোহানার কাঁধটাকে জড়িয়ে ধরেছে রিচার্ড। চেঁচিয়ে উঠেছে রিচার্ড-শিগগির আসুন আপনি, কি-যেন আপনার নাম?

রিচার্ড আবার ডাক দেয় শিগগির এখানে আসুন পসবাবু।

কিন্তু দয়ালু রিচার্ডের এই ডাক যেন একটা করুণাময় বিদ্রুপের আহ্বান। জোহানাকে বুকের কাছে ধরে রেখে রিচার্ড সরকার জোহানারই স্বামীকে কাছে ডেকে একটা অদৃষ্টের দৃশ্য দু চোখ ভরে দেখে নিতে বলছে। ব্যস্ত হয় না পলুস। সড়কের কাকরের দিকে তাকিয়ে, আস্তে আস্তে হেঁটে রিচার্ড আর মুরলীর সেই ছায়া দুটোর কাছে এসে দাঁড়ায়, যে ছায়া দুটো জড়জড়ি করে এরই মধ্যে একেবারে মিলে-মিশে এক হয়ে গিয়েছে।

রিচার্ড বলে-চিন্তা করবেন না। ভয়ের কিছু নেই।

মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক দেয় রিচার্ড-শুনছেন?

মুরলীর চোখ দুটো যেন ঘুমের আবেশে ছোট হয়ে গিয়েছে। ভুরু টান করে তাকাতে চেষ্টা করে মুরলী। জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ফিস ফিস করে? আর দুটা দিন থাকি না কেন দিদি…।

পলুসের দিকে মুখ ফিরিয়ে রিচার্ড বলে—আপনি ধরুন।…নিন, তাড়াতাড়ি করুন।

পলুসের হাত দুটো যেন কলের মত আপনি নড়ে ওঠে; আর, পলুসের সেই এগিয়েদেওয়া হাতের উপর মুরলীকে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিয়ে রিচার্ডও একটা হাঁপ ছেড়ে নিয়ে বলে–নিন, কোলে তুলে নিয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে আসুন।

মুরলীর বিবশ শরীর পলুসের হাতের উপরেও তেমনই বিবশ হয়ে এলিয়ে পড়ে যায়। মুরলীকে দু হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পলুস হালদারের মন আবার আশ্চর্য হয়। এ কি? সত্যিই যে বেহুঁশ হয়েছে বেচারা জোহানা। মিছা এতক্ষণ ধরে জোহানার ভয়ানক একটা কষ্টকেই ভয়ানক একটা মতলবের চালাকি মনে করে নিজেকে মিছা কষ্ট দিয়েছে পলুস। পলুসের বুকের কাছে মুরলীর মাথাটা হেলে পড়েছে। কিন্তু…কই…জোহানা তো কোন কায়দা করে পলুসের বুকের কাছ থেকে মাথাটাকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে না। ছিয়া, ছিয়া, বড় ভুল রাগ করা হয়েছে। ছলছল করে পলুসের চোখ। ক্ষেপা মানুযেও বোধ হয় এমন ভুল করে না, এত রাগ করে নিজের ঘরণীর মনকে এত সন্দেহ করে না। এই তো সেই মানুষ, যে মানুষ বাঘিনের ভয়ে মরমর হয়ে ভুবনপুরের সড়কের পাশে ডাঙার উপর একদিন পড়েছিল। আর, পলুস হালদার ছুটে এসে যাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়েছিল।

পলুসের জীবনেরও একটা মর-মর বিশ্বাস এইবার নতুন বাতাস পেয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মুরলীর বিবশ শরীরের ভার আড়াআড়ি করে দুটো শক্ত হাতের উপর শুইয়ে দিয়ে মুরলীকে বুকের উপর তুলে ধরে পলুস। বুকের কাছে ফিরে-পাওয়া একটা সুস্বপ্নের স্বাদ অনুভব করে পলুস। রিচার্ড সরকারের পিছু পিছু আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে। রিচার্ডের যত দয়ালু উদ্বেগ আর মায়াময় ব্যস্ততার আশ্রয় নিতে একটুও খারাপ লাগে না। ফটকটা পার হবার সময় লতার পাতার উপর থেকে অনেকগুলি রঙিন ফড়িং উড়ে এসে মুরলীর ভাঙা খোঁপাটার উপর বসবার জন্য ফরফর করে; লতার একটা ফুল মুরলীর মাথাটাকে ছুঁয়েও দিল। মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে পলুসের মনটা নীরবে প্রার্থনা করতে থাকে-দয়া করেন গড় বাবা; আমার জোহানার যেন হুঁশ হয়ে যায়!

ঘরের ভিতরে একটা সোফার উপর মুরলীকে শুইয়ে দেয় পলুস। দাইটা পাখা হাতে নিয়ে মুরলীর মাথার কাছে বসে। রিচার্ড সরকার হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই পলুস হালদারের দিকে তাকায়; আস্তে আস্তে কথা বলে—আমি চললাম। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। এই ধরুন, আর একটা ঘণ্টার মধ্যে, একটু ঘুম হলেই উনি সুস্থ হয়ে যাবেন। তারপর ওঁকে নিয়ে যাবেন। আপনি ততক্ষণ বাইরের বারান্দায় কিংবা বাগানে একটু ঘুরে ফিরে…।

চলে যায় রিচার্ড ডাক্তার। পলুসও ঘর ছেড়ে বাইরে এসে বারান্দার উপর যেন নিশ্চিন্ত কৃতজ্ঞতার মূর্তির মত চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে, সাইকেলে চড়ে চলে যাচ্ছে রিচার্ড ডাক্তার। কত মান, কত টাকা! তবু মনে কত দয়া! পলুস হালদারের মত মানুষের ঘরণীকে দয়া করে রিচার্ড ডাক্তার। করবে না কেন? বড় মানুষ যদি ভাল মানুষ হয় তবে সে যে দাইদাসীদিগেও দয়া করে।

–আমাকে দয়া করেন গো বাবু। সড়কের উপরে গো-গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয় গাড়িয়াল।

তাই তো, গাড়িয়াল বেচারা আর কতক্ষণ অপেক্ষায় থাকবে?

ঘরের ভিতর থেকে দাইটা বের হয়ে এসে বলে-গাড়িটাকে চলে যেতে বল পলুসবাবু।

পলুস-কেন গো? ওর কি হুঁশ হয় নাই?

–হইছে, কিন্তু একটুকু নিঁদ না নিয়ে যাবে কেন? ডাগদরের কথাটি মানতে হবে।

পলুস হাসে-তবে তো তুমি ওকে গরম দুধও খাইয়ে ছাড়বে।

-হঁ গো বাবু।

–তবে তো…।

–তুমি একবার ঘুরে ঘুরে এসো বাপ। মিছা কেন এত সময় এখানে পড়ে থাকবে?

–আমি একবার খাদ ঘুরে আসি না কেন?

–এইসো।

চলে যায় পলুস। আর, মাত্র দুটি ঘণ্টা ঘুমের পর মুরলীর শয়ান শরীরটার সব আলস্য যেন ভয় পেয়ে রিচার্ড সরকারের সেই সুন্দর সাজানো ঘরের একটি সোফার উপর ছটফট করে জেগে ওঠে। জোরে জোরে দু হাত দিয়ে চোখ ঘষে আর দেখতে থাকে মুরলী।

ঘরের ভিতরে ঢুকে দাইটা চেঁচিয়ে হেসে ওঠে ৷ পলুসবাবু চলে গেল, সে ফিরে এসে তোমাকে ঘরে নিয়ে যাবে।

–কোথায় গেল পলুস?

–খাদে গেল।

–এখানে পলুস আমাকে নিয়ে এল কেন?

দাইটা হাসে : পলুস লিয়ে আসে নাই গো, তুমি এইসেছো।

থরথর করে কাঁপতে থাকে মুরলী : এ ঘর যে ডাগদর রিচার্ডবাবুর ঘর মনে হয়।

–হঁ গো।

–আমি এখানে কেন আসবো? আমি কি ক্ষেপী?

–তুমি বেহুশ হয়েছিলে গো।

এইবার দাইটার কথার হেঁয়ালি আর ওই হাসির অর্থ বুঝতে পারে মুরলী। হ্যাঁ, গোগাড়ির ভিতরে বসে থাকতে থাকতেই মাথার ভিতরটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, আর কলিজার ভিতর থেকে যেন এক ঝলক মিষ্টি ব্যথার জল উথলে উঠে বুকের জামাটাকে ভিজিয়ে দিল! তারপর…পলুস রাগ করে ধমক দিলে, রিচার্ডবাবুও এসে ডাক দিলে…তারপর…।

দাইটা বলে-ডাগদরবাবু বলে গেল, তুমি এখন জিরিয়ে লিবে, তবে ঘরকে যাবে।

মুরলীর কালো চোখের সব আতঙ্কিত বিস্ময় হঠাৎ বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিয়ে হেসে ওঠে? এই কথাটি না বলে মিছা ভুল কথা বলে আমাকে ডরাও কেন?

ঘরের চারদিকের যত আসবাব, দেয়ালের যত ছবি, জানালার আর দরজার যত রঙিন পর্দা আর…আরও কত সুশ্রী বিচিত্রতার সম্ভার নিয়ে রিচার্ড ডাক্তারের এই ঘরের অহংকার কী সুন্দর সুখের হাসি হাসছে!

কিন্তু ও কে? ও যে ঠোঁট দুটোকে মিষ্টি করে শিউরে নিয়ে, আর চোখের তারা দুটোকেও হাসিয়ে নিয়ে সোজা মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মুরলীর মুখটা করুণ হয়ে যায় ও ও কে বটে গো দাই?

–কে?

–ওই যে। ছোট একটা ভীরু ভ্রূকুটি তুলে যাকে দেখিয়ে দেয় মুলী, সে হল একটা ছবি। বেশ বড় একটা ছবি। ছবির সোনা রঙের ফ্রেম আর পুরু কাচ ঝকঝক করে। সেই সঙ্গে ঝকঝক করে ছবির মুখটা।

সাদা শাড়িতে সেজেছে ছবির সেই নারী, জামাটাও সাদা। জামার হাতের কিনারায় নীল সুতোর জাল। খোঁপাতে সাদা ফুল। গলায় একটা সোনার হার, তার সঙ্গে এক টুকরো ঝকঝকে সাদা পাথর দুলছে। সিস্টার দিদির পায়ে যে রকম জুতো, সেই রকমের জুতো। হাতে একটা বই। পায়ের উপর পা তুলে একটা সোফার উপরে বসে আছে সেই নারী। তার শাড়িটা ভাজে ভাজে ফুলে ফেঁপে পায়ের উপর লুটিয়ে রয়েছে। পড়তে পারে মুরলী, ছবির পায়ের কাছে নাম লেখা আছে-স্টিফানা মাধবী সরকার।

–কে বটে গো দাই? প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

দাই বলে রিচার্ডবাবুর ঘরণী।

মুরলীর বুকটা যেন একটা নির্মম ঠাট্টার আঘাত পেয়ে গুমরে ওঠে। আস্তে আস্তে মাথা হেঁট করে মুরলী। ভয়ে ভয়ে বিড় বিড় করে রিচার্ডবাবুর ঘরণী কোথায় গেল?

বুকের উপর দু হাত দিয়ে ক্রশ বানায় আর ঝুঁকে পড়ে দাইটা ও দুখের কথা কেন আর বলা করাও? বেচারা কবেই মাটি নিয়েছে।

মুরলীর চোখে আবার তীব্র ও তীক্ষ্ণ একটা দীপ্তির বিদ্যুৎ হেসে ওঠে? কবে? দাই-এই তো, তিন সাল হলো। মুরলী—আবার বিয়া করে নাই কেন রিচার্ডবাবু? দাইটা চোখ বড় করে : বলো না, বলল না, এমন কথা বলতে নাই।

–কেন?

–ঘরণীকে আজও ভুলে নাই রিচার্ডবাবু। উয়াকে ছাড়া…।

ছবির দিকে ইঙ্গিত করে দাইটা বলে—উয়াকে ছাড়া আর কোন ভালমানুষের বিটিকে ভাবে না, কখনো ভাববেক নাই রিচার্ডবাবু।

স্টিফানা মাধবী সরকার। দেয়ালে টাঙানো প্রকাণ্ড রঙিন ছবিটার দিকে অপলক চোখ নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মুরলী।

দাই বলে-হেই যে বাজা, সে বাজা কত ভাল বাজাতে রিচার্ডবাবুর এই ঘরণী। বাবুকে রোজ রোজ কত ভাল গীত শুনাতো বেচারা। দেখ কেনে, ঘরের আসবাবের যত রংদার ঢাকা, সব ওই ঘরণীর হাতের কাজ বটে। হায় গড, এমন মানুষ মাটি লেয় কেনে?

সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় মুরলী। দাইটা চেঁচিয়ে ওঠে।গরম দুধ না খেয়ে…।

মুরলী হাসে–না গো। আমি এখন ঘর যাই।

দাই–বাবু আমাকে ডাঁটবেক যে গো।

মুরলী হাসে : তুমি আমাকে দুষে দিও।

দাই-কিন্তুক পলুসবাবু যে তুমাকে লিতে আসবে।

মুরলীর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে? আসুক না কেন, ওকে যা ইচ্ছা হয় বলে দিও।

পলুস হালদারের এই ঘর যেন মুরলীর জীবনের একটা ক্ষণকালের সাজঘর। এই ঘরের বাইরে এমন একটা ঠাঁই আছে, যেখানে গিয়ে মুরলীকে নতুন একটা রূপ নিয়ে কারও চোখের পিপাসা জয় করবার কঠোর পরীক্ষা স্বীকার করে নিতে হবে। শুধু চেহারাটাকে নয়; মুরলী যেন ওর প্রাণটাকেও নতুন করে সাজাতে চায়।

মুরলীর প্রাণের যা কিছু কাজ, তার সবই এই ঘরের বাইরের কাজ। স্কুল আছে; কনভেন্টে গিয়ে মেরিয়ার কাছে বসে সেলাই শেখার কাজ আছে। নিজের সেলাইয়ের কলটাকে মেরিয়ার কাছেই রেখে দিয়েছে মুরলী। এরই মধ্যে তিন রকমের ছাঁটকাট শিখে নিয়ে নিজেরই গায়ের শোভার জন্য তিনটে শখের ব্লাউজ তৈরী করেছে।

মেরিয়ার চেয়েও ভাল গাইতে পারে লুসিয়া দিদি, কনভেন্টের স্কুলের বড় টিচার। লুসিয়া দিদির বাড়িতে যে পিয়ানো বাজনাটা আছে, সেটা গির্জাঘরের পিয়ানোর চেয়েও দেখতে ভাল। লুসিয়া দিদি বলেছে-তুমি যদি ঠিক ঠিক রোজ সন্ধ্যায় একটিবার এসে পিয়ানোতে হাত সাধতে পার জোহানা, তবে তিন মাসের মধ্যে তুমি তিনটা প্রেয়ার গাইতে আর বাজাতে শিখে ফেলবে।

তাই আর ঠিক সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরে আসতে পারে না মুরলী। ফিরতে রাত হয়ে যায়। আর পলুসও রাত দশটা পর্যন্ত একা একা ঘরের শূন্যতা সহ্য করতে গিয়ে যেন হাঁপাতে থাকে; মুরলী ঘরে ফেরামাত্র রাগ করে চেঁচিয়ে ওঠে পলুস-তুমি একটুক বুঝে চল জোহানা।

-কি বুঝতে বলছো?

–লিখা-পড়া শিখতে হলে এমন ক্ষেপীটি হতে হবে কেন?

হেসে ফেলে আর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় মুরলী। আর পলুস হালদারের চোখ দুটো মুরলীর সেই চেহারার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে কুঁচকে যেতে থাকে।

ডরানি স্রোতের ওপারে পিয়ালের জঙ্গলের মধ্যে একটা বনবিড়াল আছে। অনেকবার দেখেছে পলুস, রঙিন রোঁয়ায় ভরা ইয়া মোটা একটা লেজ পিঠের উপর ফেলে দিয়ে স্রোতের ধারে বসে থাকে বনবিড়ালটা। কেন বসে থাকে, তা-ও জানে পলুস। স্রোত পার হয়ে এপারে এসে জোলাদের বস্তির মুর্গী চুরি করে খেতে চায় বনবিড়ালটা, কিন্তু স্রোতের জল পার হবার সাধ্যি নেই। তাই একটা উপায় বের করে নিয়েছে ধূর্ত বনবিড়াল। ওপারের বেনা ঘাসের বন থেকে বের হয়ে যখন ভুবনপুরের চাষীদের মহিষগুলি সাঁতার দিয়ে স্রোত পার হয়ে এপারে আসে, তখন একটা মোষের পিঠের উপর ঝাঁপ দিয়ে চড়ে বসে বনবিড়ালটা; আর এপারে এসেই এক ছুট দিয়ে কচু ও ওলের বাদাড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে।

জোহানার প্রাণও কি সেই বনবিড়ালটার প্রাণের মত চালাক বটে? সন্দেহ হয়, আর এই সন্দেহ সহ্য করতে গিয়ে পলুসের বুকের হাড় কটকট করে বাজে। জোহানাও একটা স্রোতের বাধা পার হয়ে ওপারে চলে যাবার মতলব ধরেছে। তাই এই ঘরের আশ্রয় আজও ছেড়ে দিতে পারছে না জোহানা। আশি টাকা মাইনের মিস্তিরীর সাহায্য এখনও তুচ্ছ করতে পারছে না। কিন্তু পলুস হালদারকেও কি ভুবনপুরের বোকা মহিষের মত শুধু একটা সাহায্যের প্রাণী বলে মনে করে জোহানা?

–জোহানা? চেঁচিয়ে ওঠে পলুস।

–কি বটে? ছোট একটা ভ্রূকুটি করে হাসতে থাকে মুরলী।

পলুস-তোমার আর ইস্কুলে যেয়ে কাজ নাই।

মুরলী-কেন?

পলুস–না; তোমার এত লিখা-পড়া করবার দরকার নাই। তোমার আর গানাবাজা শিখতে হবে না। মেরিয়ার সাথে এত হাসাহাসি করে কাজ নাই। এত পাউডার দিয়ে মুখ মেজে লাভ কি? এ ঘরের মানুষের এত ঠাটে কাজ কি?

মুরলী ঠোঁট কুঁচকে হাসে-তুমি যে আমাকে কিষাণীর মত একটা গাওয়ারিন হতে বলছো।

পলুস-হতে দোষ কি? কিষাণীরা কি মানুষ নয়?

শাড়ির আঁচল তুলে মুখের একটা উজ্জ্বল হাসির শব্দ চাপা দেয় মুরলী-তবে..তবে মিছা কেন…।

পলুস-কি?

মুরলী-বেচারী সকালীকে ছাড়লে?

শিউরে ওঠে পলুস। পলুসের কলিজার গায়ে যেন একটা ছুরির খোঁচা লেগেছে। একটা টোক গিলে, বুকের ভিতরে গুমরে ওঠা একটা হাহাকারের শব্দ গিলে নেয় পলুস। একটা লাফ দিয়ে উঠে এসে মুরলীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে।-তোমার চালাকি আর চলতে দিব না।

–কিসের চালাকি?

–বুঝে দেখ।

–বুঝিয়ে দাও।

–আমি তোমাকে ঘরের আয়না করে রাখবার লেগে বিয়া করি নাই। আমার ছেইলা চাই। কটমট করে তাকায় মুরলী-আমার গতর তোমার হুকুমের দাসী নয়।

–হ্যাঁ, দাসী বটে। তোমার ফাকি আমি আর মানবো না। বিয়া করলে যাকে, তার ছুঁয়া তোমাকে নিতে হবে। আজই নিতে হবে।

পলুসের চাহনির রকম দেখে ভয় পায় মুরলী; পলুসের মুখের ভাষায় ওর যে দাবী দূরন্ত হয়ে উঠেছে, সে দাবী তুচ্ছ করবার অধিকার নেই মুরলীর। পলুস হালদার ছুটে গিয়ে যদি সিস্টার দিদির কাছে নালিশ করে বসে-দেখ দিদি, তোমার জোহানা বহিন ওর মরদের পিয়াস মিটাতে চায় না, মরদকে ছেইলা দিতে চায় না, তবে যে সিস্টার দিদি নিজেই ছুটে এসে জোহানাকে ধমক দিয়ে ধরম করম বুঝিয়ে দেবে; সিস্টার দিদির নীল চোখের রাগও জ্বলজ্বল করবে-ছিঃ, জোহানা বহিন, আমার খিরিস্তান ভাই পলুসকে দুখ দিলে তোমার ভাল হবে না।

ভুল হয়েছে। পলুসের মুখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে পলুসকে তুচ্ছ করবার জোর এখনও মুরলীর জীবনে আসে নি। দেরি আছে এখনও। কে জানে কত দেরি? ততদিন পলুসের এই ঘরের আশ্রয় মেনে নিতেই হবে। কিন্তু পলুসের ছোঁয়া? না, কভি না; যেমন করেই হোক, পলুসের এই দূরন্ত ইচ্ছার সাহসটাকে জব্দ করে দুরে সরিয়ে রাখতে হবে। কয়লা-খাদের কলঘরের মিস্তিরীকে কি ভেড়াটি করে দিতে পারা যায় না?

মুরলীর কটমটে চাহনি হঠাৎ একটা অভিমানের চাহনির মত ভঙ্গি ধরে করুণ হয়ে যায়। পলুসের চোখের হিংস্র ঘোলাটে চাহনিও মুরলীর এই অভিমানের চেহারাটার দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চর্য হয়। জোহানার মুখটাকে দুখিনীর মুখ বলে মনে হয়। কিসের দুখ? কেন ছলছল করে বেচারা জোহানার চোখ?

–কি বটে জোহানা? গলার স্বর মৃদু করে একটা সান্ত্বনার কথা বলতে চায় পলুস।

মুরলী বলে—তোমার লাজ লাগে না পলুস? ঘরণীর সুখের সাধ মিটাতে পার না, দাসী বলে হাঁক দিয়ে ঘরণীর গতর ছুঁতে চাও…ছিয়া ছিয়া!

পলুস-তোমাকে আমি কোন্ দুখটা দিলাম?

মুরলী-কোন্ দুখটা না দিলে? কটা শাড়ি দিলে? কেমন খাওয়া খাওয়ালে? কোন্ সোনার জিনিসটা আনলে? ঘরণীকে খুশী করে ঘরণীর গতর ছুঁতে চায়, এমন মরদ কেমন মরদ বটে?

হেসে ফেলে পলুস : তাই বল না কেন?

মুরলীর অভিমানও এইবার যেন দূরন্ত হয়ে ওঠে : তাই তো বলছি। তাই শুনে নাও। আমার খুশি পুরা না হলে আমি তোমার ছুঁয়া নিব না। কভি না। মেরে ফেললেও না।

পলুস বলে-শুনলাম জোহানা। কিন্তু…।

ব্যস্ত হয়ে ওঠে মুরলী-না, আর তোমার কিন্তুতে কাজ নাই। আমি ইস্কুলে চললাম; আজ আমার লেগে আসমানী রঙের পাঁচ গজ রেশমী কাপড় নিয়ে আসবে।

চমকে ওঠে পলুস : পাঁচ গজ কেন? বিশ টাকা লাগবে যে!

মুরলী হাসে? হ্যাঁ, পাঁচ গজ চাই। দুটা কুঁচিদার সায়া পাঁচ গজের কম কাপড়ে হবে না।

–রেশমী কাপড়ের সায়া? পলুসের গলার স্বরে যেন একটা ভয়-পাওয়া বিস্ময় চমকে ওঠে।

মুরলী মুখ টিপে অদ্ভুত একটা লাজুক হাসি হাসে? হা গো ভালমানুষ! মেরিয়া বলেছে…।

পলুস–কি?

মুরলী-বলেছে, জোহানা বহিনের মত নরম কোমরের মানুষ মোটিয়া কাপড়ের সায়া পরে কেন? পলুস ভাই কি কঞ্জুস বটে, না রেশমী কাপড় চোখে দেখে নাই?

পলুসের চোখে তবু সেই আতঙ্ক আর সেই বিষয় বিস্ময় সিরসির করে। ভয় পেয়েছে। আশি টাকা মাইনের মিস্তিরী।

পলুসের এই ভীরু চোখের করুণতার দিকে তাকিয়ে মুরলীর চোখ দুটো খুশি হয়ে ধিকধিক করে হাসতে থাকে। মুরলীর প্রাণও যে চায়; এই রকম ভয় পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যাক কলঘরের মিস্তিরীর আহ্লাদ। মুরলীকে খুশি করবার আশা যেন অভিশাপ হয়ে পলুসের আশি টাকা মাইনের জীবনের সব মুরোদ চুরমার করে দেয়। মুরলীর খুশির দাবী মেটাতে গিয়ে রিক্ত নিঃস্ব ও ভিক্ষুক হয়ে যেদিন ফুঁপিয়ে উঠবে পলুস, না জোহানা, আর টাকা নাই; সেদিন মুরলীও মনের সুখে ধিক্কার দিয়ে হেসে উঠবে, তবে আর জোহানার গতর ছুঁতে সাধ কর কেন?


© 2024 পুরনো বই