১১. আবার কি একটা হোঁচট খেয়েছে

আবার কি একটা হোঁচট খেয়েছে মুরলীর জীবনের আশা? তা না হলে, এত রাত হয়ে যাবার পরেও বিছানা থেকে উঠে বসতে আর উৎসবের খাবারগুলি খেতে চায় না কেন মুরলী?

যেন ওইসব বাহারদার খাবারের কোন স্বাদ নেই। এই ঘরের বাতাসেও কোন স্বাদ নেই। আর, এই বিছানাটারও কোন স্বাজ নেই। বিস্বাদ হয়ে গিয়েছে মুরলীর অতৃপ্ত শরীরটার রক্ত।

নতুন সুখের ঘরে এসে মুরলীর আশার প্রাণ যে বিহ্বলতা নিয়ে বুকের উপর পলুসের পিয়াস বরণ করেছে, কী আশ্চর্য, সেই বিহুলতাই হঠাৎ হতাশ হয়ে গিয়েছে। পলুসের পিয়াস যেন একটা অসার দৌরাত্ম্য, মুরলীর আশার নিঃশ্বাসকে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছে। দম বন্ধ করে যেন একটা উপদ্রবের লোলুপ চেষ্টাকে ঢোঁক গিলে কোন মতে সহ্য করেছে মুরলী; তারপর, পলুসের ক্লান্ত ও তৃপ্ত শরীরের অলস স্পর্শটাকে বেশ একটু কঠোরভাবে একহাতের ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে—ভাল সুখের ঘর বটে! ভাল মরদের ঘর বটে।

–কি হলো জোহানা?

–কিছু না।

বার বার অনুরোধ করে পলুস : এবার উঠে বসো জোহানা।

মুরলী–না।

পলুস-কেন?

মুরলী—ও খাওয়া তুমি খেয়ে নাও; আমার সাধ নাই।

পলুস—এটা কেমনতর রাগ বটে?

উত্তর দেয় না মুরলী। বিছানার এক পাশে, যেন পলুস হালদারের ছোঁয়া থেকে গতর বাঁচিয়ে চুপ করে কুঁকড়ে পাকিয়ে একটা আশাহত প্রাণের লাসের মত পড়ে থাকে।

আশ্চর্য হয়, ব্যথিত হয়, শেষ পর্যন্ত মনে মনে একটু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পলুস : তুমি যদি খাও, তবে আমি একাই খেয়ে নিব।

মুরলী–হ্যাঁ, একা খাবে না? একা খেতেই জান। তুমি তো আর মধুকুপির একটা কিষাণের মত…

পলুস ভ্রূকুটি করে-কি বললে?

ঘরের অন্ধকারে পলুসের ভ্রূকুটি মুরলীর চোখে পড়ে না। উত্তর দেয় না মুরলী।

পলুস–কথাটা কানে যায় নাই কি?

মুরলী-কি কথা?

পলুস–আমার কথা নয়, তুমি এখনই যে কথাটা বললে।

মুরলী–বললাম তো, মধুকুপির কিষাণেরা একা খেতে জানে না; ওরা গাঁওয়ার বটে।

আলো জ্বালে পলুস হালদার। খাবারও খায়। সবই দেখতে পায় মুরলী। কিন্তু মুরলীর সারা অন্তরাত্মা যেন একটা দুঃসহ বিস্বাদের ভারে ক্লিষ্ট হয়ে নতুন ঘরের বিছানার এক পাশে পড়ে থাকে।

আবার কখন ঘর আঁধার হয়ে গিয়েছে, জানে না মুরলী। ঘুম ভাঙে যখন, তখন মুরলীর গায়ের উপরে ঘুমন্ত পলুসের অলস একটা হাতের ভার ঘুমন্ত আদরের মত পড়ে ছিল। কিন্তু চমকে ওঠে মুরলী : কে? কে? তুমি কে বটে গো?

মুরলীর ভাঙা ঘুমের বিস্ময় হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পলুসের হাতটাকে একটা ঠেলা দিয়ে নামিয়ে দেয়।

জেগে ওঠে পলুস : কি হলো জোহানা? কিসের ডর?

মুরলী-আঁ…না, ডর নাই, কিন্তু তুমি এখানে কেন?

পলুস হাসে : আমি যে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।

মুরলী—তুমি আমাকে ছুঁবে না; দয়া কর পলুস।

পলুস-আমার যে তোমাকে আবার ছুঁতে সাধ হয়েছে জোহানা; আমার জোহানা।

মুরলী–না, না, না। তোমার মিছা আদরের জ্বালা ভাল লাগে না পলুস।

বলতে বলতে বিছানা থেকে নেমে যায় মুরলী। পলুস ব্রিতভাবে বলে–কি হলো?

মুরলী—আমি ভূঁইয়ের উপরে চাটাই পেতে শুয়ে থাকি।

পলুস-তোমার মাথায় কোন দোষ আছে নাকি?

মুরলী-আছে বুঝি?

পলুসের এতক্ষণের নিরেট ধীরতা এইবার একটা আক্রোশের ধমক হয়ে ফেটে পড়ে? কিষাণীর মত ভূঁইয়ের উপর শুতে সাধ হয়েছে বুঝি।

মুরলী-হয়েছে বুঝি।

পলুস–কিন্তু এটা কিষাণের ঘর নয়।

মুরলী–নয় বুঝি।

পলুস-তুমি কি আমার সাথে হাসি করছো জোহানা?

মুরলী-না পলুস। হাসি করবো কেন?

পলুস-তবে?

মুরলী-আমাকে ঘুমাতে দাও।

ঘরের মেঝের উপর চাটাই পাতে মুরলী। হঠাৎ ব্যাকুলভাবে এগিয়ে এসে মুরলীর হাত ধরে পলুস : আমি বুঝেছি।

–কি?

–তোমার মনে দুখ হয়েছে।

–কিসের দুখ?

–আমি তোমাকে আজ কিছু দিই নাই।

–কি বললে?

মুরলীর শুন্য গলায় হাত বুলিয়ে পলুস বলে-তোমার গলাটা খালি। একটা হাঁসুলিও নাই।

মুরলী হাসে : তাতে আমার গলার কোন দুখ নাই।

পলুস-আমি কালই গোবিন্দপুর বাজারে গিয়ে তোমার লেগে একটা চিজ কিনে নিয়ে আসবো।

মুরলী-দরকার নাই।

পলুস-আমি নিয়ে আসবোই। চাদির সুতলির মালা, তার সাথে তিনটা সোনার মটরদানা।

মুরলী হেসে ফেলে : ফাঁসি দিবে নাকি গো?

হেসে হেসেই পলুসের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সরে যায় মুরলী।

পলুস-বিছানাতে আসবে না?

মুরলী-না।

রাত আরও গভীর হয় যখন, তখন ভুইয়ের উপর ঘুমের ঘোরে অচেতন মুরলীও জানতে পারে না যে, মুরলীকে আবার বার বার ডেকে শেষে একবারে চুপ হয়ে গিয়েছে পলুস।

কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে মুরলী-ও কিসের আওয়াজ পলুস! হায় বাপ, এ কেমন আওয়াজ!

বিছানার উপর ধড়মড় করে উঠে বসে পলুস : ডর নাই জোহানা, ওটা নদীর সোতের আওয়াজ বটে।

মুরলী-কোন্ নদী?

পলুস–ডরানি।

আরও ভীরু হয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে মুরলীর গলার স্বর : এখানে আবার ডরানি আসে কেন পলুস?

পলুস—এই তো, হারানগঞ্জের ডাঙা পার হয়েছ কি শালের জঙ্গলটা ধরেছ; আর, তার পরেই ডরানির সোত। পৈছা হাওয়া ছাড়লেই সোরে আওয়াজ এদিক পানে ছুটে আসে।

মুরলীর বুকের পাঁজর একবার শিউরে উঠেই অলস হয়ে যায়। পৈছা হাওয়া যেন দূরের ডরানির ঠাণ্ডা স্রোতের বুরুঝুরু ঝরানির শব্দ তুলে নিয়ে এসে মুরলীর বুকের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে।

এই তো, ঘরের এই অন্ধকারটা যে সেই ঘরের অন্ধকারের মত গায়ের গায়ের গন্ধে ভরে যাচ্ছে। বাঁশঝাড়ের ধড়টা কটমট করে দুলছে মনে হয়। জামকাঠের কপাটটা কাঁপে। আখড়ার ঝুমুর থেমে এল বুঝি। এত রাতে মাদল বাজায় কোন্ কিষাণ? আর, কি আশ্চর্য…মুরলীর গা ঘেঁষে এই তো শুয়ে আছে সেই মরদ মানুষটি। শিলের পাটার মত সেই বুকটা।

–কি গো সরদার, মুরলীকে ছুঁতে আর সাধ হয় না কি?

–তোর সাধ হয় কিনা বল?

–কিসের সাধ?

–আমাকে ছুঁতে।

–কি বল সরদার? তোমার মত মরদের গতর যে সোনা বটে গো। তুমি না ছুঁলে যে মুরলীর হাড়মাস মিঠা হয়ে যায় না।

-তবে বল না কেন মুরলী?

–বলছি তো, এসো।

জোহানা! একটা একেবারে অচেনা ও অজানা ডাক রূঢ় আওয়াজের আঘাতের মত মুরলীর তন্দ্রাতুর শরীরের উতলা সাধের উপর যেন আছড়ে পড়েছে। ঘুম ভেঙে, ভুইয়ের চাটাই-এর উপর ধড়মড় করে উঠে বসে মুরলী।

পলুস হাসে-সকাল হয়ে এলো, জোহানা।

মুরলী-হলো তো…কিন্তু তুমি চেঁচালে কেন?

পলুস-আমি গোবিন্দপুর চললাম।

মুরলী-কেন?

পলুস-মনে নাই?

মুরলী-না।

পলুস-চাঁদির সুতলির মালা, আর তিনটা সোনার মটরদানা।

মুরলী-আমি ওসব চিজ নিব না পলুস।

পলুস–নিতে হবে। তোমাকে হাসতে হবে। তোমাকে দুখ দিবার লেগে আমি তোমাকে বিয়া করি নাই।

সাইকেলটাকে ঘরের ভিতর থেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে যায় পলুস হালদার।

 

ডরানির স্রোতের ঝুরুঝুরু ধরানির শব্দ আর শোনা যায় না। ভোরের আলো দেখে ভয় পেয়ে পৈছা হাওয়া কি মরে গেল? তা না হলে মুরলীর চোখে আর ঘুমের আবেশ লাগে না কেন? মুরলীর নিশ্বাসের শব্দই বা কেন মাঝে মাঝে থমকে যায়? আর, বার বার কেন চমকে উঠে, দু হাতে চোখ ঘষে, হাই তুলে ও গা-মোড়া দিয়ে শয়ান শরীরটাকে স্বপ্নে-পাওয়া একটা নেশার মিথ্যা আদর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসতে হয়?

ঘরের ভিতরে আবছা আঁধার, কিন্তু বাইরে পাখি ডাকে। তবু খুব বুঝতে পারা যায় আর এই আবছা আঁধারেই চিনতে পারা যায়, এই ঘর পলুসের ঘর বটে।

–তুমি চলে গেলে কিগো? ভেজানো দরজার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী। ব্যস্তভাবে এগিয়ে গিয়ে কপাট খুলে পথের দিকে তাকায়।

ভোরের আলোর ঝলক মুরলীর চোখের উপর লুটিয়ে পড়ে। ধাঁধিয়ে যায় চোখ; সঙ্গে সঙ্গে মুরলীর প্রাণটাও যেন ধাধিয়ে যায়। কি হল? কোথায় গেল পলুস? যেন রাতের মুরলীকে ভয় পেয়ে ভোর হতে না হতেই পালিয়ে গেল বেচারা।

রাতের আঁধারে যেন জংলা বিষের গন্ধ আছে। সেই গন্ধে মুরলীর বুকের বাতাসও জংলা হয়ে যায়। তা না হলে পলুসের মত মানুষকে একটা অবহেলার ঠেলা দিয়ে বুকের কাছে থেকে সরিয়ে দিল কেন মুরলী? ছিয়া ছিয়া, এ কেমন ভুল!

পথের উপরে রোদ ঝলমল করে আর দেখতে পাওয়া যায়, অনেক দূরের সেই পিয়ালবনের গা ঘেঁষে ডাইনে বেঁকে গিয়েছে পথটা, তারপরেই বড় সড়ক। মনে পড়ে মুরলীর, গোবিন্দপুরে গিয়েছে পলুস, মুরলীরই মুখের সেই হাসির জন্য চাদির সুতলির মালা আর সোনার মটরদানা আনতে, যে হাসি দেখতে না পেয়ে বড় দুখ পেয়েছে বেচারা। কেন হাসবো না পলুস? আমি যে হেসে আর বেঁচে থাকবার লেগে তোমার কাছে এসেছি। আমি যে তোমারই জোহানা বটি গো।

মুরলীর প্রাণের একটা উতলা আক্ষেপ যেন কাতর অনুনয়ের মত মুরলীর মুখে বিড়বিড় করে।-তুমি সিস্টার দিদির বিচার মেনে নিবে। আমার ছেইলা তোমারই ঘরে থাকবে পলুস। আমার লেগে তোমার কত মায়া!

মুরলীর বুক ঠেলে কৃতজ্ঞতার যত ব্যাকুল কথা উথলে ওঠে। রাগ হয় এই গতরটারই উপর। একটা বোকা ভীরু আর জংলী গতর। কে বললে, পলুসের ছোঁয়া পেলে জোহানার এই শরীরের হাড়মাস মিঠা হয়ে যাবে না?

মিথ্যে নয়, পলুস হালদারের হাত ধরবার জন্য, পলুসের বুকের উপর লুটিয়ে পড়বার জন্য ভোরের আলোয় বিহুল মুরলীর এই শরীরের হাড়মাসের পিয়াস যেন এখনই সিক্ত হয়ে উঠেছে। কখন ফিরে আসবে পলুস?

ছোট্ট কালো কুকুরটা বড় বড় রোঁয়ায় ভরা শরীর; কোথা থেকে ছুটে এসে মুরলীর গায়ের উপর লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুকুরটাকে দু হাতে সাপটে ধরে বুকের উপর তুলে নেয় মুরলী।

কুকুরটার মুখ এক হাতে টিপে, জোরে একটা আদরের ঝাকুনি দিয়ে হেসে ওঠে মুরলী : ভাল লোভী বটে এটা! হিংসা করবি না তো রে কুটু? সেটাকে ভাই বলে বুঝতে পারবি কি? চুমা নিতে চাস তো এখনই বলে দে।

ছোট্ট কালো রোয়াভরা নরম দেহ কুকুরটার মুখের উপর গাল ঠেকিয়ে দিয়ে সারা শরীরটাকে দোলাতে থাকে মুরলী।

টুং করে একটি মিষ্টি শব্দের শিহর মুরলীর কানের কাছে চমকে ওঠে। সাইকেলের ঘণ্টির আওয়াজ। মুরলীও চমকে ওঠে, মুখ ফিরিয়ে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে মুরলীর মুখের হাসিটাও যেন রঙিন ফোয়ারার মত উথলে ওঠে। সিস্টার দিদি এসেছে।

সাচ্চা দেবী বটে সিস্টার দিদি। যেন মুরলীর জীবনের একটা গোপন মানতের ভাষা, আর মুরলীর সুখ ও আশার একটা ভয়ের আর্তনাদ শুনতে পেয়ে নিজেই ছুটে এসেছে সিস্টার দিদি।

-জোহানা বহিন, ভাল আছ? সিস্টার দিদির নীল চোখে স্নেহময় হাসির আভা ভোরের আলোর চেয়েও সুন্দর হয়ে ঝলমল করে।

-আমি তোমার ঠাঁই যাব ভেবেছিলাম, সিস্টার দিদি। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

-কেন বহিন? বলতে বলতে এগিয়ে এসে আর সাইকেলটাকে ঘরের দেয়ালের গায়ে হেলিয়ে দিয়ে বারান্দার উপর ওঠেন সিস্টার দিদি।

ছুটে গিয়ে ঘরের ভিতর থেকে ছোট একটা চারপায়া নিয়ে এসে সিস্টার দিদির সামনে রেখে দিয়ে হাঁপ ছাড়ে মুরলী? বসো দিদি।

সিস্টার দিদি-হ্যাঁ, বল, আমার ঠাঁই কেন যাবে ভেবেছিলে?

কেঁপে ওঠে মুরলীর চোখ। মাথা হেঁট করে। ধপ করে মেঝের উপর বসে পড়ে মুরলী। তারপর সারা শরীর কুঁকড়ে নিয়ে সিস্টার দিদির কোলের উপর মাথা পেতে দেয়। মুরলীর মাথায় হাত বুলিয়ে সিস্টার দিদি মিগ্ধ স্বরে হাসেন : বল জোহানা।

মুরলী—আমার পেটে ছেইলা আছে দিদি।

চমকে ওঠেন সিস্টার দিদি-লর্ড!

-দিদি! ফুঁপিয়ে ওঠে মুরলী।

–বুঝলাম, তুমি আমার উপদেশ মান নাই জোহানা। সিস্টার দিদির গম্ভীর গলার স্বর যেন একটা গম্ভীর ভর্ৎসনা।

মুরলী-ভুল হয়েছে দিদি। সিস্টার দিদি-হ্যাঁ, খুব ভুল। পরের সন্তান পেটে নিয়ে পলুসের ঘরে এসেছ তুমি। তুমি পলুসকে বিপদে ফেলেছে জোহানা।

-বিপদ কেন হবে দিদি?

–পলুস যদি বিপদ মনে করে, তবে বিপদ নিশ্চয়।

–তুমি পলুসকে বুঝিয়ে দিলে কোন বিপদ হবে না, দিদি।

–পলুস কি বলে?

–সে চায় না। আমার এই ছেইলাকে পরের ছেইলা মনে করে পলুস।

হেসে ফেলেন সিস্টার দিদি : পলুস ঠিক মনে করেছে।

–তুমি বলে দিলে পলুস মেনে নিবে।

–কি বলবো?

–আমার ছেইলা আমার কাছে থাকবে।

–আমি পলুসের উপর অবিচার করতে পারি না জোহানা। ওকে তুমি বিয়ে করো পলুসের ইচ্ছা যদি না থাকে, তবে পরের সন্তান ওর ঘরে তুমি রাখবে কেন? পলুসকে তুমি অকারণে শাস্তি দিবে কেন? এতটা অধিকার তোমার নাই জোহানা।

–কিন্তু আমার উপর অবিচার কর কেন, দিদি?

–না, তোমার উপরেও অবিচার করতে চাই না। সেই কথাই বলছি, শুন।

–বল দিদি। সিস্টার দিদির হাঁটুর উপর চোখ ঘষে মুরলী।

–তিন-চারটি মাস পরে তুমি আমার অনাথবাড়িতে চলে আসবে।

–না দিদি। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী। তীব্র করুণ ও ভীরু একটা আর্তনাদ; যেন জীবনের আশার পথে একটা রক্তলোলুপ বাঘের ছায়া দেখতে পেয়েছে মুরলী। মুরলীর পেটের ছেইলাকে খেতে চায় ওই বাঘ।

–হ্যাঁ বহিন, ইউ মাস্ট। সিস্টার দিদির গলার স্বর একেবারে শান্ত ও অবিচল।

মুরলীর মাথাটা একবার কেঁপে উঠেই স্তব্ধ হয়ে যায়; আর একেবারে অলস হয়ে একটা নির্জীব পাথরের ঢেলার মত সিস্টার দিদির হাঁটুর উপর পড়ে থাকে।

–আমি তোমাকে উত্তম উপদেশ দিলাম, তোমারই জীবনের সুখ আর শান্তির জন্য। তুমি বুঝে দেখ জোহানা। সিস্টার দিদির গলার স্বরে যেন একটা সান্ত্বনার সাড়া ফুটে ওঠে।

মুখ তোলে মুরলী। সিস্টার দিদির মুখের দিকে একজোড়া অবুঝ চোখের কাতর দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে ছটফট করতে থাকে।

সিস্টার দিদি আবার গম্ভীর হন : তুমি আমার কথা বুঝতে পার নাই মনে হয়।

–বুঝি নাই দিদি।

–তবে, তুমি বল। আমি কি করতে পারি?

–তুমি যা বলবে দিদি, তাই হবে।

–অনাথবাড়িতে যাবে? কিছুদিন থাকলেই মন অনাথ হবে। তুমি সংসার চাইলে পাবে?

–যাব।

–অনাথবাড়িতে ছেইলা রেখে দিয়ে আবার স্বামীর ঘরে চলে আসবে?

–হ্যাঁ, দিদি।…কিন্তু।

–কি?

–ছেইলাটার কি হবে?

–অনাথবাড়িতেই থাকবে, বড় হবে।

–ভাল কথা দিদি, কিন্তু আরও ভাল হয়, যদি তুমি ছেইলাটাকে…।

-কি?

-একটুক বড় করে নিয়ে ওকে ওর বাপের কাছে দিয়ে দাও।

-নো, নেভার। তুমি খুব অধম কথা বলছে জোহানা। আমার অনাথবাড়ি ধর্মবাড়ি আছে, হাসপাতাল নহে। ধমক দিয়ে উঠে দাঁড়ান সিস্টার দিদি।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মুরলী। সিস্টার দিদির কথাগুলিকে একটা ভয়ানক রাগী রহস্যের গর্জন বলে মনে হয়। বুঝতে পারে না মুরলী, সিস্টার দিদির মত এত শান্ত ও এত মায়ার মানুষ এই সামান্য আবেদনের উপর এত রাগ করে কেন।

–সিস্টার দিদি! আস্তে আস্তে ডাক দেয় মুরলী।

সিস্টার দিদি–না বহিন। খিরিস্তান হয়েও তোমার মনে ধরমের গরব নাই; এ বড় দুঃখের কথা বহিন। তুমি তোমার সেই ধরমহীন পুরাতন স্বামীর জন্য এখনও দরদ কর।

–না দিদি।

–নিশ্চয়। তা না হলে, তুমি কেন আমাকে অখিরিস্তানের ছেইলার ধাই হতে বলছো, জোহানা?

–তবে কি উপায় হবে, বল দিদি।

–তোমার ছেইলা অনাথবাড়িতে থাকবে, খিরিস্তান হবে। তা না হলে মানুষ হবে কেমন করে?

বুকের ভিতরের সব নিশ্বাস ফুঁপিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে মুরলী : তাই ভাল দিদি।

হেসে ওঠে সিস্টার দিদির স্নেহাক্ত নীল চোখ : সুখী হও জোহানা। তোমার কোন ভাবনা করবার দরকার হয় না।

মুরলীর কাছে এগিয়ে আসেন সিস্টার দিদি। মুরলীর মাথায় আবার হাত বোলাতে থাকেন : তুমি ভুলে যাও কেন জোহানা, তুমি নতুন হয়ে গিয়েছ? পুরানা জীবনের সহিত তোমার আর কোন সম্পর্ক নাই। আছে কি?

–না দিদি।

–তবে আর পুরানা ঘরের কথা মনে কর কেন? মায়া কর কেন?

–না দিদি, মায়া আর করবো কোন্ সাধে?

–ঠিক বুঝেছ জোহানা। তোমার যা কিছু পেতে সাধ হবে, সব এই ঘরেই পাবে। এই ঘর সুখী খিরিস্তানের ঘর।

–হ্যাঁ দিদি।

–আচ্ছা, আমি এবার চলি বহিন…হ্যাঁ, পলুস কোথায়?

–গোবিন্দপুরে গেল।

–কেন?

হঠাৎ লজ্জা পেয়ে মাথা হেঁট করে মুরলী।

সিস্টার দিদি-কি জোহানা? পলুস আজই গোবিন্দপুরে গেল কেন?

মুরলী চিজ সওদা করতে।

সিস্টার দিদি-কি চিজ?

মুরলী-চাঁদের সুতলির মালা আর সোনার মটরদানা।

ঝিক করে সুন্দর এক খুশির হাসি চমকে ওঠে সিস্টার দিদির মুখে : তোমার সৌভাগ্য জোহানা; কত ভাল স্বামী তোমার। আমার কাছে না এলে কি এই সুখ পেতে বহিন?

মুরলী—একটা কথা কি তোমার মনে আছে, দিদি?

-কি?

-তুমি আমাকে লিখা-পড়া শিখাবে বলেছিলে।

–মনে আছে বহিন। কিন্তু তুমি কি এখনও চাও?

–চাই দিদি।

–তবে আমার কনভেন্টের স্কুলে ভর্তি হও।

–স্কুল যে বড় দূর বটে দিদি।

–পলুসকে বল, তোমার জন্য গো-গাড়ি ঠিক করে দেবে যেতে চার আনা আসতে চার আনা, রোজ আট আনা গো-গাড়ির ভাড়া দিবে।

-কে দিবে?

-দিবে তোমার পলুস। আবার কে? তোমার সাধ মিটাবে, তোমার সব সুখ এনে দিবে পলুস। তা না হলে তোমাকে ঘরণী করেছে কেন পলুস?

হেসে ওঠেন সিস্টার দিদি; আর, মুরলীর গম্ভীর মুখটাকে যেন একটা প্রবল স্নেহাক্ত আশ্বাসের আবেগ দিয়ে হাসিয়ে দেবার জন্য মুরলীর থুতনি টিপে ধরেন : এইবার হাস বহিন। হাস..আমি বলছি হাস—এক দুই তিন… হ্যাঁ।

হেসে ফেলে মুরলী; এই হাসি একেবারে নতুন হাসি। জীবনের যত পুরনো মায়ার বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেয়ে হেসে উঠেছে মুরলীর প্রাণ। ঝকঝকে তকতকে শান্ত ঠাণ্ডা নিথর হাসি।

চলে যান সিস্টার দিদি।

কিন্তু ঘরে ফিরতে আর কত দেরি করবে পলুস?

দুপুর হয়ে যাবার পর একবার ঘরের জানালা খুলে বাইরের মাঠের দিকে তাকিয়েই জানালা বন্ধ করে দেয় মুরলী। রোদের জ্বালায় মাঠটা পুড়ছে না হাসছে, বোঝা যায় না।

কিন্তু আর দেরি করে না মুরলী। বালতি হাতে নিয়ে নিকটের ইদারার কাছে এগিয়ে যায়। জল তোলে। মান করে। তারপর, নিজেরই ভেজা শরীরের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে আর ভেজাশাড়ির শব্দ শুনতে শুনতে ঘরে ফিরে আসে। রঙিন শাড়ি, জামা আর সায়াতে সুন্দর করে সেজে নিয়ে আয়নার দিকে তাকায় মুরলী। আর, খুশি হয়ে নিজেরই নরম ঠোঁটের নতুন হাসিটাকে দেখতে থাকে। ঝকঝকে তকতকে হাসি। মুরলীর নতুন জীবনের হাসি; যে হাসি পলুসের এই তকতকে ঝকঝকে ঘরের শোভার সঙ্গে বড় সুন্দর মানায়।

পলুসের ফিরে আসতে আরও দেরি হবে বলে মনে হয়। কিন্তু মুরলী আর দেরি করে না। এগিয়ে যেয়ে দেয়ালের তাকের উপর থেকে থালা গেলাস আর বাটি নামিয়ে নিয়ে মেঝের উপর রাখে। এই ঘরে দুখ পেতে আসে নাই মুরলী। মিছা ক্ষুধা পুষে রেখে কষ্ট পাওয়া উচিত নয়।

কবুতরের তরকারি, পলুস বেচারা কত সাধ করে নিজের হাতে বেঁধেছে। চিনেমাটির সাদা থালার উপর কবুতরের তরকারি ঢেলে নেয় মুরলী। পাউরুটি ছিড়তেও দেরি করে না।

খাওয়া শেষ হবার পর, নতুন জীবনের স্নিগ্ধ ও তৃপ্ত শরীরটাকে নরম বিছানার উপর এলিয়ে দিতেও দেরি করে না মুরলী।

কিন্তু ঘুমিয়ে পড়তে দেরি করে মুরলী; সিস্টার দিদির হাসির ঝঙ্কার এখনও মুরলীর কানের ভিতরে বেজে চলেছে। মুরলীর চোখ দুটো অপলক হয়ে যেন এই নতুন জীবনের অনুভবগুলির জন্য অপলক শ্রদ্ধার মত জেগে থাকে। আর নরম ঠোঁটের উপর ছড়িয়ে থাকে সেই ঝকঝকে তকতকে ঠাণ্ডা হাসি।

ঘরের দরজার কাছে আগন্তুক পায়ের শব্দ শোনা যায়। শোনা যায়, একটা সাইকেলের ধড় যেন হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ঝনঝন করে বেজে উঠেছে। আস্তে আস্তে দরজার দিকে মুখ ফেরায় মুরলী।

হ্যাঁ, পলুস ফিরে এসেছে।

ঘরে ঢুকেই একটু আশ্চর্য হয়ে থমকে দাঁড়ায় পলুস। পরে উদ্বিগ্ন মুখটা হাসতে চেষ্টা করেও হেসে ওঠবার জোর পায় না : কি বটে জোহানা?

মুরলী-কি?

পলুস-তুমি হাসছে মনে হয়।

মুরলী–হ্যাঁ।…তুমিই যে বলেছ, আমাকে হাসতে হবে।

পলুস-কিন্তু এ কেমন হাসি বটে? তোমার কি…।

মুরলী–না গো, আমার মাথা খারাপ হয় নাই।

পলুস-সেকথা নয়; তোমার কি…।

মুরলী–না গো, আমার অসুখ করে নাই।

পলস-তবে কেন…।

মুরলী চেঁচিয়ে হেসে ওঠে-কি পলুস?

পলুস হাসে-এটা মিঠা হাসি, মিঠা ছুরি?

আরও জোরে চেঁচিয়ে হেসে ওঠে, আর বিছানার উপর উঠে বসে মুরলী সিস্টার দিদি এসেছিল।

–কি বললে সিস্টার দিদি?

–তুমি যা বলেছ, তাই বললে।

–কি বলেছি আমি?

–আমার ছেইলাটা অনাথবাড়িতে থাকবে।…বড় ভাল কথা বলেছিলে পলুস, আমি বুঝি নাই। আমার ছেইলা অনাথবাড়িতে থাকবে, তোমার মত ভাল খিরিস্তান হবে; আমার কিছু ভাবনা নাই। সিস্টার দিদির বড় দয়া।..কই, আমার লেগে কি চিজ নিয়ে এসেছ দেখি?

কাগজে মোড়া একটা জিনিস পকেটের ভিতর থেকে বের করে পলুস। খুশির আবেগে চঞ্চল হয়ে একটা ছোঁ মেরে পলুসের হাত থেকে কাগজের মোড়কটা তুলে নিয়েই আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় মুরলী।

আস্তে আস্তে যেন হাঁপাতে হাঁপাতে কথা বলে পলুস চিজটার দাম নিল আশি টাকা দশ আনা।

পলুসের কথা বোধ হয় শুনতেই পায়না মুরলী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রূপোর সুতলির চকচকে হার গলায় পরতে থাকে। হারের সঙ্গে তিনটে সোনার মটরদানা দুলছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে গলার এই নতুন গৌরবের রূপ দেখতে দেখতে মুরলীর কালো চোখের চাহনি ছটফট করে ও আরও দুটা দানা হলে ভাল হতো পলুস।

পলুস-হ্যাঁ, ভাল হতো।

মুরলী দিবে কি?

পলুস-দিব।

আয়নার কাছ থেকে সরে এসে আবার বিছানার উপর বসে মুরলী আমি সিস্টার দিদির ইস্কুলে যাব, পলুস।

-কেন?

–লিখা-পড়া শিখতে।

–কিন্তু, ইস্কুল যে অনেক দূর বটে।

–গো-গাড়িতে যাব। রোজ আট আনা ভাড়া লাগবে।

–মাসে যে পনের টাকা লাগবে।

–লাগুক না কেন?…হ্যাঁ, আমার সিলাই কলটা মেরিয়ার কাছে পড়ে আছে। ওটা আনিয়ে দাও।

-দিব।

জানালা খুলে দিয়ে বাইরের পথ, মাঠ আর আকাশের দিকে তাকিয়ে কি-যেন ভাবতে থাকে মুরলী। নিকটে ও দুরে ছোট ছোট বসতির ঘরগুলির দিকেও তাকায়। গির্জার চূড়াটাকেও একটা সুন্দর দূরের ছবির মত দেখতে পাওয়া যায়।

-চল পলুস। যেন একটা দুর্বার খুশির আবেগে চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

–কোথায় যাবে?

-চল, তোমার হারানগঞ্জের খিরিস্তানদিগের ঘর দেখে আসি। আর্থারবাবুর ঘরণী দেখতে কেমনটি গো?

–বেশ তো, দেখে এসো একদিন।

–এখনই চল।

–আমি যে এখনও খাই নাই।

–খেয়ে নাও।

–তুমি খেয়ে নিয়েছ মনে হয়।

–হ্যাঁ।

ছানার উপর গড়িয়ে পড়ে মুরলী। আর পলুস হালদার যেন একটা অনিচ্ছার ক্লান্ত মূর্তির মত আস্তে আস্তে হেঁটে ইদারার দিকে চলে যায়। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে এসে ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে মুরলীর মুখের দিকে আবার কি-যেন আশা করে তাকিয়ে থাকে পলুস।

মুরলী-খেয়ে নাও পলুস। মিছা দেরি কর কেন?

আর দেরি করে না পলুস। বিছানা থেকে নামবে না মুরলী; পলুসের খাবার নিজের হাতে সাজিয়ে দিতে মুরলীর প্রাণে কোন ব্যস্ততা নেই। তাকের উপর রাখা পাউরুটি আর বাটির কবুতরের তরকারি একটা থালাতে ফেলে দিয়ে চুপ করে খেতে থাকে পলুস।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন চুল আঁচড়ায় মুরলী, তখন ঢকঢক করে এক ঘটি জল খেয়ে নিয়ে জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ে পলুস হালদার : চল জোহানা।

 

ছোট ছোট ঘর, লাল খাপরার চালা। হারানগঞ্জের ডাঙার বুকের উপর এদিকে-ওদিকে ছকের ছবির মত সাজানো এক একটা বসতির কাছে পলুস আর মুরলীকে এগিয়ে আসতে দেখেই ঘরের মানুষগুলি হেসে হেসে আর হল্লা করে পথের উপর ছুটে আসে। মেয়েরা চেঁচিয়ে ওঠে—হোই দেখ, পলুস আর পলুসের ঘরণী জোহানা আসছে।

-হেই মা, পলুসের ঘরণীর রূপটা দেখ না কেন মা? চেঁচিয়ে ওঠে আর্থারবাবুর মেয়েটা।

আর্থারবাবুর বউ হাসে-আমি দেখছি; তুই দেখে নে।

পলুসের পাশে দাঁড়িয়ে, আর মুখের সেই সুন্দর তকতকে ঝকঝকে হাসির শিহরটুকু ফুটিয়ে রেখে খিরিস্তান ভাই আর বহিনদের ছটফটে উল্লাসের মুখগুলিকে দেখতে থাকে মুরলী। মুরলীর বুকের ভিতরটাও যেন একটা নতুন গরবের স্বাদে ভরে যায়।

পলুসের একটা হাত শক্ত করে ধরে মুরলী। এগিয়ে যায় পলুস আর মুরলী। ভাবতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় মুরলীর মন। পলুসের পাশে মুরলী, আর মুরলীর পাশে পলুস, যেন সারা হারানগঞ্জের আত্মা খুশি হয়ে আর মুখর হয়ে এই মিলনের ছবিকে আশীর্বাদ করছে।

জনের মা, বুড়ি আনিয়া, মুরলীর হাতে একগাদা ফুল তুলে দিল : গড বাবা দয়া করেন; সুখে থাক গো বহিন।

আরও এগিয়ে যায় পলুস আর মুরলী। বিকালের সূর্য বড় তাড়াতাড়ি লাল হয়ে গির্জার চূড়ার পিছনে নেমে পড়ছে। বড় সড়কের দু’পাশের আমগাছের মাথার উপর হুটোপুটি করে কাক আর কবুতর।

পলুস বলে—আর কত ঘুরবে জোহানা? এক ক্রোশ তো হাঁটা হলো।

-এটা কার ঘর বটে পলুস সড়কেরই এক পাশে একটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে, আর, যেন একটা বিস্ময়ের চমক লেগে মুগ্ধ হয়ে যায় মুরলী।

-এটা রিচার্ড সরকারের বাড়ি বটে।

–দাওয়ার উপর বসে আছে যে, সে কে বটে?

–রিচার্ডবাবু।

–বাবুটা এখানে থাকে কেন?

–রিচার্ডবাবু ডাক্তার বটে।

–খিরিস্তান বটে কি?

–হ্যাঁ।

–কিন্তু…খিরিস্তান যদি হবে, তবে…।

–কি?

–তবে তোমাকে আমাকে দেখেও আসে না কেন? কথা বলে না কেন?

হেসে ফেলে পলুস ও ডাক্তার রিচার্ডবাবু আমাদিগে দেখে ছুটে আসবে না।

–কেন না?

-রিচার্ডবাবু আমাদিগের আর্থারবাবুর মত ত্রিশ টাকার মাস্টারবাবু নয় জোহানা, কলঘরের মিস্তিরীও নয়। রিচার্ডবাবুর কত নাম, কত মান, কত টাকা!

ধবধবে সাদা একটা ছোট বাংলো বাড়ি। কাছে দাঁড়িয়ে দেখলেও ছবি বলে ভুল হয়। লাল টালির চালার উপর সবুজ লতা ছড়িয়ে আছে। লতার ফুলগুলি নীল। বাড়ির দরজায় আর জানলায় রঙিন রেশমি কাপড়ের ঝালর উড়ছে। বাড়ির চারদিকে ইঁটের খাটো দেয়াল আর ফুলের কেয়ারি। ছোট একটা ফটক, ফটকের মাথার উপর লতার বিতান। বাড়ির বারান্দার উপরে একটি চেয়ারের উপর বসে খবরের কাগজ পড়ছে ডাক্তার রিচার্ড সরকার।

দেখতে পায় মুরলী; রিচার্ডবাবু মানুষটাও জোয়ান বটে। চোখে চশমা আছে। পায়ে জুতোমোজাও আছে।

পেন্টালুনের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে নিয়ে রিচার্ড সরকারও একবার পথের দিকে তাকায়। তারপরেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে খবরের কাগজ পড়তে থাকে।

পলুস বলে-চল জোহানা।

মুরলী চলতে চলতে বলে বাবুটা কি গির্জায় যায় না?

পলুস-যায়।

মুরলী-আঁধার হয়ে এল।

পলুস-হ্যাঁ।

হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুরলীর একটা হাত ধরতে গিয়ে চমকে ওঠে পলুস। পলুসের হাতটাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে মুরলী।

পলুস কি বটে, জোহানা?

মুরলী কিছু না। আমি কানা নই, হাত ধরতে হবে না।

ঘরে ফেরবার পথের উপর সন্ধ্যার আঁধার ঘন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। পথের দু পাশের গাছগুলি যেন কতগুলি ঘন ছায়ার ধড়। আর, পলুস হালদার যেন একটা লঘু আবছায়া।

মুরলীর সঙ্গেই হেঁটে চলেছে পলুস; আর পলুসের দু পায়ের শক্ত চামড়ার জুত মচমচ শব্দ করে বেজেও চলেছে। কিন্তু পলুস যেন মুরলীর চোখেই পড়ছে না। যেন একলা হয়ে একটা অচেনা পথে হেঁটে চলেছে মুরলী।

একটাও কথা বলে না মুরলী, ভুলেও একবার পলুসের গা ছুঁয়ে ফেলে না। এই তো, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, বিকালের আলোতে পথ হাঁটবার সময় আর্থারবাবুর মেয়ের চোখের সামনে যে পলুসের হাত ধরতে গিয়ে মুরলীর প্রাণটা গর্বে ভরে গিয়েছিল, সেই পলুস যেন সন্ধ্যার আঁধারের ছোঁয়া লাগতেই ছোট্ট একটা ছায়া হয়ে গেল, এইটুকু একটা মরদের ছায়া। পলুসের হাতটা মুরলীর হাত স্পর্শ করবার চেষ্টা করতেই হঠাৎ ছটফটিয়ে সরে গিয়েছে মুরলীর হাত।

পলুসও কোন কথা বলে না। ভাবতে গিয়ে শুধু আশ্চর্য হয় পলুস, মিথ্যা নয় বোধহয়, জোহানার মাথায় দোষ আছে। কে জানে দিনের বেলাতে যে মানুষ এত হাসে, রাত এলেই সে মানুষ এত রাগে কেন? কিংবা হতে পারে, এটা জোহানার গতরের আর গমরের রীত বটে।

কিন্তু এ কেমন রীত? অভূত। পথ চলতে চলতে পাশের মুরলীর ঘয়াময় চেহারাটার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে পলুস। গায়ের কাপড়ে আগুন লাগলেও কোন মেয়ে বোষ হয় এতটা বেলাজ হয়ে যেতে পারে না; কিন্তু শরীরের সব লাজ একেবারে খুলে মেলে ও আলুথালু করে দিয়ে হেঁটে চলেছে জোহানা। খোঁপাটা ভেঙে গিয়েছে, কাধ পিঠ আর বুকের উপর ছড়িয়ে পড়েছে চুল। শাড়িটাকে কোমর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, আর গুটিয়ে পাকিয়ে এক হাতে চেপে রেখেছে। সায়াটাও যেন জোহানার এই পথ-চলার উদ্দামতার একটা বাধা; এক হাতে সায়াটাকে তুলে ধরে রেখেছে। ভেবেছে কি জোহানা? হারানগঞ্জের এই রাতের আঁধারও একটা জঙ্গল? এই সড়কটা কি গাঁয়ের ক্ষেত? আর, সময়টা কি ভূঁইমানতের লজ্জাহীন লগন?

ভাগ্য ভাল, ঘরে ফেরবার পথে কোন সাইকেলের আলো বা পথচারীর লণ্ঠন, কিংবা কোন ছোকরার টর্চ ছুটে আসে নি। কিন্তু ঘরে ফিরে এসেই বা কি হল?

আলো জ্বালে পলুস হালদার। কিন্তু কথা বলে না মুরলী। যেমন পলুসের মুখের দিকে তাকায় না মুরলী, তেমনই নিজের সাজ-হারানো এই আলুথালু বেলাজ চেহারার দিকেও তাকাতে ভুলে যায়।

পলুস বলে-তুমি একটুক ঠিক হয়ে নাও, জোহানা।

মুরলী–কি?

পলুস-আর্থারবাবুর মেয়ে, কিংবা জনের মা, না হয় তত আর কেউ এখনই এখানে এসে যেতে পারে। তোমাকে এমনটি উদাস দেখলে ওরা যে তোমাকে ক্ষেপী মনে করে ভরাবে। শাড়িটা পরে নিয়ে ঠিক হয়ে বসো জোহানা।

চমকে ওঠে না, ব্যস্ত হয়ে ওঠে না, লজ্জা পেয়ে শিউরে ওঠে না মুরলী। কিন্তু আস্তে আস্তে শিথিল হাত দুটোকে নেড়ে চেড়ে যেন আনমনা চিন্তার আবেশে অলস হয়ে যাওয়া শরীরটাকে শাড়ি দিয়ে জড়াবার চেষ্টা করে।

পলুস বলে—এইবার রাঁধতে হয়, জোহানা।

পলুসের মুখের দিকে তাকায় মুরলী; কিন্তু মুরলীর চোখে কোন আগ্রহের সাড়া নেই। পলুসের কথাটা শুনতে পেয়েছে, এই মাত্র।

–শুনলে কি জোহানা? চেঁচিয়ে ওঠে পলুস।

–শুনেছি। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী? কিন্তু আমাকে রাধতে বল কেন?

পলুসের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে তোমার ঘরে তুমি রাঁধবে না তো কে রাঁধবে?

–ভাল আমার ঘর! বিড় বিড় করে মুরলী।

–কি বললে? প্রশ্ন করতে গিয়ে পলুসের স্বরটাও দপদপ করে জ্বলে!

মুরলী মুখ ফেরায় : তোমার লোহার উনান আর তোমার খাদের কয়লা; তুমি জান কেমন করে আগুন জ্বালতে হয়। আমি জানি না।

হেসে ফেলে পলুস-সে কথাটা বল; মিছা ঘরের দোষ দাও কেন?

উনানে আগুন ধরায় পলুস। রান্নাও শুরু করে পলুস। ফেন-ভাত, কুরথির ডাল, আর মশলা দিয়ে ডিম। চামচে ভরে ঘি নিয়ে, সেই ঘি এলাচ-দারুচিনির সঙ্গে ফুটিয়ে কুরথির ডালে ছেকা দেয়। পলুসের ঘরের বাতাস আবার স্বাদু গন্ধের বাষ্পে ভরে উঠে থমথম করে। কিন্তু ততক্ষণে বিছানার উপর এলিয়ে পড়েছে আর ঘুমিয়ে পড়েছে মুরলী।

সেই মুহূর্তে ঘরের খোলা দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে হেসে ওঠে জনের মা আনিয়া বুড়ি ও দেখতে এলাম পলুস, তোমার ঘরণী কেমনটি রাঁধে আর কি রাঁধলে?

চমকে ওঠে পলুস, আর মনে মনে নিজেরই একটা সৌভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায়। মান বেঁচেছে পলুসের; পলুসের এই ঘরের মান বেঁচে গিয়েছে। ভাগ্যিস রান্নাটা হয়ে গিয়েছে, আর ভাগ্যিস মুরলী ঘুমিয়ে পড়েছে।

জনের মা আনিয়া বুড়ির দুটো জ্বলজ্বলে কৌতূহলের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে পলুস : এই তো, কত কি রাঁধলে, তারপর ঘুমিয়ে পড়লে বেচারা। জ্বর হয়েছে; তবুও রাঁধলে, আমার মানা শুনলে না।

জনের মা—আহা, জ্বর কেন হলো গো? আহা, বড় ভাল রাঁধে তোমার ঘরণী। এত সুবাস কি এই কুরথি ডালের সুবাস বটে পলুস?

পলুস-হ্যাঁ গো দিদি।

জনের মা-আহা, গড বাবা করেন, জোহানার হাত মিঠা হয়ে থাকুক।

ধড়ফড় করে উঠে বসে মুরলী। জনের মা বলে-ভাবনা নাই জোহানা; জ্বর সেরে যাবে।

চলে গেল জনের মা।

পলুস হাসে বুড়ি জেনে গেল, তুমি বেঁধেছ।

মুরলী—তুমি বলেছ?

পলুস-হ্যাঁ।

মুরলী-তাতে কার মান বাড়লে?

পলুস-তোমার।

মুরলী—ভাল মান বটে।

পলুসের চোখ আবার কেঁপে ওঠে। জোহানার প্রাণের সেই জংলী নেশার রাগটা যেন এখনও ক্ষেপী হয়ে নিজেরই জীবনের এই নতুন ঘরের সুখ আর মানের উপর ঢিল ছুঁড়েই চলেছে।

চেঁচিয়ে ওঠে পলুস কিন্তু খাওয়ার চিজগুলা ভাল বটে। একবার দেখে নাও। এ খাওয়া কখনো খেয়েছ কিনা ভেবে দেখ।

কথাটা মিথ্যে নয়, একেবারে খাঁটি সত্য। ঝালদার মহেশ রাখালের বেটি মুরলী, মধুকুপির দাশু কিষাণের ঘরণী মুরলী জীবনে এমন স্বাদের খাবার কোনদিন খেতে পায় নি। কলঘরের মিস্তিরি, আশি টাকা মাইনের পলুস হালদারের এই ঝকঝকে তকতকে ঘরের অহংকার কিষাণী মুরলীর জীবনের সেই রিক্ততাকে যেন একটা কঠোর ঠাট্টার বাড়ি মেরেছে।

মাথা হেঁট করে মুরলী। চোখ দুটো জলে ভিজে যায়। কিষাণী মুরলীর দীন জীবনের সেই রিক্ততার স্মৃতিটাই বোধহয় কেঁদে ফেলেছে। কিন্তু শুখা মরিচ দিয়ে সিঝানো ড়ুমুরের জাউ, আর মাইয়ের দানা; স্বাদ ছিল না কি? ভাল লাগে নাই কি?

মুরলী বলে—আমি খাব না পলুস। তুমি খেয়ে নাও।

পলুসের মুখটা ধীরে ধীরে কঠোর হয়ে উঠতে থাকে। দুই চোখের উপরে একটা সন্দেহের ছায়াও কাঁপে। পলুসের এই ঘরের রাতের জীবনের সব সুখ মিথ্যে করে দিয়ে জোহানা যেন ওরই জীবনের একটা ভয়ানক অভিমানের শোধ তুলছে।

–এই ঘর কি তোমার ভাল লাগছে না জোহানা? দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে পলুস। কিন্তু উত্তর দেয় না মুরলী।

–আমি জানি, কেন এই ঘর তোমার ভাল লাগছে না; আবার চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে পলুস। পলুসের চোখে যেন তীক্ষ্ণ একটা হিসাবের শাণিত আভা জ্বলজ্বল করে।

স্তব্ধ হয়ে বসে শুধু শুনতে থাকে মুরলী। মুরলীর কাছে এগিয়ে এসে মুরলীর নীরব মুখটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকে পলুস।-এ ঘরের ভাত খেতে মনে সাধ লাগে না, এ ঘরের বিছানায় শুতে সাধ লাগে না, মাটিতে চাটাই পেতে গতর ঢেলে দিয়ে ঘুমিয়ে আর মরে যেতে সাধ হয়; বটে কিনা জোহানা?

মুরলীর হেঁট মাথাটাকে এক হাতে আস্তে একটা ঠেলা দিয়ে গরগর করে পলুস-আমার ছোঁয়া নিতে ভাল লাগে না, নিলেও ভাল লাগে না; নয় কি জোহানা?

যেন বুঝতে পেরেছে পলুস, পলুসের পিয়াস বুকের উপর বরণ করেও কেন তৃপ্তিহীন বিস্বাদের জ্বালায় ক্ষুব্ধ হয়ে এই ঘরটাকে ধিক্কার দেয় জোহানা। পলুস হালদারের চোখে যেন একটা ক্রুর কৌতুকের অভিসন্ধি হাসতে থাকে।

উত্তর দিতে চায় না মুরলী; কিন্তু পলুস হালদার এখনই সেই উত্তর জোহানার এই সুন্দর গতরের রক্তমাংসের কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে বুঝে ফেলতে চায়, কেন এই ঘরের সুখকে সুখ বলে মনে করতে পারছে না জোহানা।

–জোহানা। মুরলীর কাছে এগিয়ে যেয়ে আর চোখের সেই ক্রুর কৌতুকের তীক্ষ্ণ হাসিটাকে যেন একটা ধূর্ত মৃদুতা দিয়ে ঢেকে মুরলীর হাত ধরে পলুস।

হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে মুরলী; কিন্তু পলুসের হাত যেন প্রচণ্ড আগ্রহে কঠোর হয়ে মুরলীর হাতটাকে আঁকড়ে ধরে, আহত হরিণের বেদনা-দূরন্ত শরীরটাকে জব্দ করবার জন্য শিকারীর হাত যেমন কঠোর হয়ে হরিণের শিংটাকে মুচড়ে দেয় আর আঁকড়ে ধরে থাকে। ভয় পেয়ে চমকে ওঠে মুরলী : হাতটা ভেঙে দিতে সাধ হয়েছে কি?

পলুস—তোমার ছেইলাটা যদি অনাথবাড়িতে না যায়, এখানেই থাকে, তবে…তবে বড় ভাল হয় না কি জোহানা?

–বড় ভাল হয় পলুস। গড বাবা তোমাকে অনেক দয়া করবে পলুস। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

পলুস হাসে সে কথাটি ভাবছি; তোমার ছেইলা এই ঘরেই থেকে যাক না কেন?

পলুরে বুকের উপর মাথা এলিয়ে দেয় মুরলী ও হাতটা ছাড় পলুস।

পলুসের মুখের হাসি উগ্র হয়ে ওঠে? কেন জোহানা?

মুরলী ও আঃ, ছাড় পলুস, ব্যথা লাগছে, এমন করে ঘরণীর হাত ধরতে নাই।

মুরলীর হাত ছেড়ে দেয় পলুস। মুরলীও দু হাতে পলুসের গলা জড়িয়ে ধরে একটা ইচ্ছার আবেশে বিহ্বল হয়ে পলুসের বুকের উপর মাথা গুঁজে দেয়।

পলুসের বুকের উপর ছোট্ট একটা দাঁত-ফোঁটান মিষ্টি কামড়ের জ্বালা চিন করে ফুটে ওঠে। চমকে ওঠে পলুসঃ কি বটে জোহানা?

-চুপ কর পলুস।

রাতটাও চুপ হয়ে যায়। রাতটা আরও নিঝুম হয়ে যায় যখন, তখন বিছানার কোমলতার উপর লুটিয়ে পড়ে থাকে পলুস আর পলুসের ঘরণী জোহানা। পলুসের একটা হাতও নিবিড় তৃপ্তিতে অলস মুরলীর কোমরের উপর পড়ে থাকে; আর পলুসের সেই হাত নরম করে ধরে রাখে মুরলী। মুরলীর সেই কঠোর অভিমানের শরীরটা নির্ভয় হয়ে পলুসের উষ্ণ নিশ্বাসের আদরে গলে গিয়েছে। হাড়মাস মিঠা হয়ে গিয়েছে। পুরুষ বটে পলস; কত সহজে মুরলীর ইচ্ছাটাকে সুখের জলে চুবিয়ে দিল পলুস। পলুসের কানের কাছে একটা সফল স্বপ্নের আনন্দ ফিসফিস করে শুনিয়ে দেয় মুরলী : হ্যাঁ পলুস, এ ঘর আমার মরদের ঘর বটে। আমার ছেইলার বাপ বটে তুমি!

মুরলীর হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসে পলুস; তারপর একটা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। যেন পলুসের গায়ে ভয়ানক এক অপমানের জ্বালা লেগেছে। মুরলীর এই তৃপ্তির ভাষা যে মধুকুপির কিষাণীর রাতের গতরের বুনো আহ্বাদের একটা চিকার। পলুসের কাছ থেকে নয়, জোহানার পেটের ছেইলাকে নিজের ছেইলা বলে মেনে নিয়ে আদরের ঘরে ঠাঁই দিতে রাজি হয়েছে যে, তার কাছে থেকে কত সহজে সুখ নিয়ে খুশি হয়ে গেল জোহানার গা-গর আর প্রাণ! ওর নামটা জোহানা, প্রাণটা মুরলী।

পরীক্ষা করে যা বুঝতে চেয়েছিল পলুস, তা খুব ভাল করেই বোঝা হয়ে গেল। ভাল হল। জোহানাকে চিনতে পারা গেল। এইবার জোহানাও ভাল করে চিনে ফেলুক আর বুঝে ফেলুক, পলুস হালদারের এই ঘর খিরিস্তানের পরিষ্কার ভালবাসার ঘর; এখানে কপটতা করে সেরে যাবার সুযোগ নেই।

মুরলীও একটু আশ্চর্য হয়ে উঠে বসে।-তুমি সরে গেলে কেন?

পলুস—এখনও খাই নাই; খেতে হবে কি না?

মুরলী—আমিও তো খাব।

পলুস-সে তুমি খেয়ে নিও, যখন তোমার খেতে সাধ হবে।

মুরলীর চোখ দুটো হঠাৎ ভীরু হয়ে তাকিয়ে থাকে। এমন কথা ঘরণীকে বলতে নাই।

ভাতের থালা আর ডালের বাটি হাতের কাছে টেনে নিয়ে হাসতে থাকে পলুস, আর হাসিটাও এইবার একটা সার্থক কৌতুকের আমোদে কুৎসিৎ হয়ে কাঁপতে থাকে। ভাল ঘরণী তুমি!

-কি বললে? চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

পলুস-পরের ছেইলা নিয়ে আমার ঘরে সুখ করবে যে, সে আমার ঘরণী হবে কেন?

–তোমার পায়ে পড়ি পলুস, এমন কথা বলল না। কেঁদে ফেলে মুরলী।

পলুসঠিক কথা বলছি; তুমি যেমন হিসাব করে সুখ নিবে, আমিও তেমন হিসাব করে সুখ নিব। আমি তোমাকে ঠকাবো না, তুমিও আমাকে ঠকাবে না জোহানা।

–আমি তোমাকে কখনো ঠকাব না, পলুস।

–ভাল কথা; তবে আমার ঘরে কিষাণের ছেইলাকে রাখতে সাধ করো না।

–কিন্তু তুমি যে আমাকে সকালে পলুস…তুমি যে বললে, আমার ছেইলা এখানে থাকবে। বিমূঢ়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মুরলী।

খাওয়া থামিয়ে মুরলীর দিকে তাকিয়ে এইবার চেঁচিয়ে হেসে ওঠে পলুসতোমাকে ঠকাই নাই জোহানা। একটুক মজা করে শুধু বুঝে নিলাম, তুমি আমাকে কেমনটি ঠকাও আর মনে মনে…।

–কি? মুরলীর কালো চোখের তারায় যেন জঙ্গলের আগুনের জ্বালা ঝিলিক দিয়ে ফুটে ওঠে।

পলুস বলে-তুমি তোমার ছেইলার বাপের কাছ থেকে সুখ নিতে চাও, আমার থেকে নিতে চাও না। তুমি তোমার ছেইলার বাপকে সুখ দিতে চাও, আমাকে দিতে চাও না।

নীরব হয়ে যায় মুরলী।

এক ঘটি জল ঢক ঢক করে খেয়ে আরও ভয়ানক একটা সন্দেহের ঢেঁকুর তোলে পলুস : তুমি আমাকে ছুঁয়ে থেকেও মনে মনে তোমার ছেইলার বাপের মরদানি নিয়ে সুখ কর। তোমার গতর বড় চালাক বটে জোহানা। ও চালাকি এ ঘরে চালাতে চেয়েছ কি ঠকেছ! আমি হিসাব জানি। মধুকুপির একটা কিষাণীর চেয়েও ভাল হিসাব জানি। আমার নাম পলুস হালদার।

বিছানা থেকে নামে মুরলী। ঝকঝকে ও তকতকে এই ঘরের দরজার দিকে অপলক চোখ তুলে আর নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে নিয়ে ঘরের কোণের দিকে তাকায় মুরলী। চাটাইটা তুলে নিয়ে এসে মেঝের উপর পাতে। আর, বিষমাখা তীরের বিধ লাগা জানোয়ারের মত মুখ থুবড়ে গড়িয়ে পড়ে। ছোট একটা আর্তনাদও মুরলীর ঠোঁট কাঁপিয়ে শিউরে ওঠে। হে কপালবাবা!

-খবরদার জোহানা। চেঁচিয়ে ওঠে পলুস? এটা খিরিস্তানের ঘর বটে, এখানে জংলী ধরমের ডাক ডেকে পাপ করবে না, খবরদার।

না, আর কোন আর্তনাদ করে না মুরলী। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে পলুসও বিছানার উপর গড়িয়ে পড়ে।

হারানগঞ্জের ডাঙার ঝোপেঝাপে ঝিঁঝিঁ ডাকে। বিছানার উপর শুয়ে বারবার চোখ চেপে ধরে পলুস; ঘুমটা এসে এসেও যেন ঝিঁঝিঁর ডাকের শব্দে চমকে ওঠে আর পালিয়ে যায়।

হায়, হায়, এ কেমন ঝিঁঝিঁর ডাক! কুলডিহার ডাঙাতেও রাতের ঝিঁঝিঁ এখন ডাকে নাকি? মাটি কেটে গঞ্জ থেকে গাঁয়ে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় নাকি? সেই ঝিঁঝিঁর গান

শুনতে বড় ভাল লাগে যে!

হ্যাঁ বাবা বড়পাহাড়ী। বড় ভাল তোমার দয়া! তুমি আঁধার পথের সাদা ফুল। পথ ঠাহর হয়; পথ হাঁটতে কোন ডর নাই।

দূর দূর দূর, হেই হেই হা, দুর্‌র্‌! পাথরের উপর কোদাল ঠুকে চেঁচিয়ে উঠলেই ছটফট করে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায় পথের হুঁড়ার আর ভালুক।

তিতির মিতির ধিপাং ধিতির; তিতির বোলে না গো! কেনে নয়ান ছিপে যাস গো! বাঁশি শুনে হাস গো! তিতির মিরি হা!

চেঁচিয়ে গান গেয়ে ঘরের দরজার কাঁচা বাঁশের ঝাপ ধরে একটা টান দিতেই ঘরের ভিতরের বাতিটা হেসে ওঠে। তার চেয়ে ভাল হাসি হাসে সকালী।

–এ কি সকালী? তুই এখনো ঘুমাস নাই কেন? এখনো খাস নাই বুঝি।

সকালী হাসে : তুমি এসে খাওয়াবে, তবে তো খাব।

–ঘরে কিছু নাই বুঝি?

–না।

–নাই তো নাই, এইবার খেয়ে নে।

–কি?

–এই যে গঞ্জ থেকে নিয়ে এলাম; মুড়ি আছে, গাজর আছে, নিমক আছে।

কোচড় থেকে ছোট সওদার সম্ভার একটা বাঁশের ডালাব উপর উপুড় করে ঢেলে দেয় পলুস। সকালী বলে—তুমি খেয়ে নাও।

–না, তুই আগে না খেলে আমি খেতে পারবো না।

–কেন গো?

ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ ছটফট করে হাত বাড়িয়ে কি-যেন ধরতে চেষ্টা করে আর ফুঁপিয়ে ওঠে পলুসহায় বাবা বড়পাহাড়ী!

মেঝের চাটাই-এর উপর ধড়ফড় করে উঠে বসে আর হেসে ওঠে মুরলী কি বটে পলুস?

-কি জোহানা?

–ছিয়া ছিয়া! কার নাম ধরলে?

–কার নাম?

আবার হেসে ওঠে মুরলী-ঘুমাও পলুস। গড বাবা দয়া করেন, ভাল করে ঘুমিয়ে নাও।

–তুমি কি এখনও খাও নাই, জোহানা?

–না।

–খাবে না?

–না।

চুপ করে পলুস হালদার। আলো জ্বালতে ইচ্ছা করে। জোহানাকে হাত ধরে সেধে খাওয়াতে ইচ্ছা করে। কিন্তু রাতটা যেন একেবারে নীরব হয়ে গেল। ঝিঁঝিঁর ডাক আর নেই।

পৈঁছা হাওয়াটা মেতে উঠলো বোধহয়। ডরানির স্রোতের ঝুরঝুর ঝরানির শব্দ ভেসে আসছে। ঘুমিয়ে পড়েছে মুরলী। কী আরামের ঘুম। মুরলীর নিশ্বাসের শব্দটা যেন আখড়ার নাচুনি মেয়ের ক্লান্ত বুকের শব্দের মত তালে তালে দুলছে।

কি যেন বলছে জোহানা। পলুসের কান দুটো উৎসুক হয়ে ওঠে। ঘুমন্ত জোহানার নিশ্বাস যেন ফিসফিস করে থেমে-থেমে হেসে উঠছে।-ক্ষেতের মাটিতে…জাদু চালতে…হবেক কি?

আরও সতর্ক হয়ে আর নিশ্বাস বন্ধ করে একটা চোরা রহস্যের ভাষা ধরবার জন্য কান পেতে থাকে পলুস। হ্যাঁ, আবার ফিসফিস করে উঠেছে জোহানা : তবে এসো সরদার…বড় ভাল আঁধার হয়েছে সরদার।

জোহানার স্বপ্নের প্রলাপ; জোহানার প্রাণটা এখন ওর সেই জংলী স্বামীর হাত ধরে ভূঁইমানতের বীভৎস উৎসবের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে উলঙ্গ মিলনের সুখ চাইছে। এমন জোহানাকে আর কতদিন সহ্য করা যাবে? জোহানাই বা এই ঘর কতদিন সহ্য করতে পারবে? ছেইলা নিয়ে আবার কিষাণের ঘরে পালিয়ে যাবে না কি?

মাথা টিপে, চোখ বন্ধ করে আর স্তব্ধ হয়ে বসে যেন এই সন্দেহের জ্বালাটাকে নিঝুম করে দিতে চেষ্টা করে পলুস। নিজেরই বুকের টিপ টিপ শব্দ শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যায়।

এখান থেকে অনেক দুরে, যেখানে উরানির স্রোতের শব্দ নেই, কিন্তু ঘন মহুয়াবনের ঝড়ের শব্দ আছে, সেই কুলডিহার একটা কুঁড়ে ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এক ঘটি জল চাইতে গিয়েও বুকটা টিপ টিপ করে।

-ঘরে আসে না, ঘরণীর লেগে মায়া নাই যার, ঘরণীর গতর ছুঁতে ঘিন্না করে যে, খিরিস্তান আবার ঘরের জল খেতে চায় কেন?

–দিবে না?

–না।

–তুমি খিরিস্তান হবে না?

–না।

—তবে মর।

–আমিও বড়পাহাড়ীর কাছে তোমার মরণ মানত করলাম। দেখে নিব আমি, তুমি কাকে নিয়ে কত সুখ সেধে ঘর কর।

কী ভয়ানক হিংস্র হয়ে কালীর চোখ দুটো জ্বলছে! ভয় পেয়ে বিড়বিড় করে পলুসএমন কথা বলতে নাই সকালী।

–বড়পাহাড়ীকে এত ডর কেনে গো খিরিস্তান? হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে হিংস্র হাসি হাসতে থাকে সকালী।

–না না না…। বিড়বিড় করে যেন একটা বোবা বেদনার পিণ্ড উগরে ফেলতে চেষ্টা করে পলুস।

–পলুস, ও পলুস! একটা ঘুম-ভাঙানো শব্দের আঘাত পেয়ে চমকে জেগে ওঠে পলুস।

মুরলী বলে কিসের ডর পলুস? গোঙ্গার মত চেঁচিয়ে উঠলে কেন?

পলুস একটা স্বস্তির হাঁপ ছাড়ে : না, কিছু না।

পৈছা হাওয়া কি মরে গেল? রাত ভোর হতে আর কত বাকি? চুপ করে বিছানার উপর বসে আবার ঘুমন্ত মুরলীর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে থাকে পলুস।

আবার চমকে ওঠে পলুস। সাবধানে কান পাতে।

–জোহানা। আস্তে আস্তে ডাকে পলুস।

বিড়বিড় করে মুরলী-নাও সিস্টার দিদি…আমার কলিজা নাও…ডাইনে নজর দিবে না তো…ঢের আদর হবে তো…তবে নাও…তোমাদিগের ধরম বড় ভাল বটে গো দিদি।

শান্ত হয়ে যায় পলুদের প্রাণের এতক্ষণের জ্বালা। না, চলে যাবে না জোহানা। চলে যেতে কোন সাধ নেই জোহানার।

 

জানে না পলুস, কখন ভোর হল, পাখি ডাকল আর হারানগঞ্জের ডাঙার উপর ছকের ছবির মত ছড়ানো যত ঘরের লাল খাপরার চালার উপর কাঁচা রোদের আলো হেসে হেসে লাল হয়ে গেল। ঘুমিয়ে আছে পলুস। পলুসের স্বপ্নে আর কোন আর্তনাদ নেই। পলুসের বুকটা সব উদ্বেগ থেকে মুক্ত হয়ে নাকডাকা আরামের শব্দের সঙ্গে উঠছে আর নামছে।

কিন্তু মুরলী জানে, কখন কেমন করে হারানগঞ্জের কালো রাতের শেষ আঁধার আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেল, পাখি ডাকল আর পূবের আকাশটা লাল হয়ে হেসে উঠল। ভোর হবার আগেই মেঝের চাটাইয়ের উপরে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেছে মুরলী, আর দু হাতে চোখ মুছে নিয়ে, ব্যস্তভাবে দরজা খুলে বাইরের বারান্দার উপর এসে দাঁড়িয়েছে। যেন মুরলীর স্বপ্নের মধ্যেই অনেকক্ষণ ধরে ভোরের আলো দেখবার জন্য একটা পিপাসা ছটফট করছিল।

ছোট্ট কালো কুকুরটা, রোয়ায় ভরা নরম তুলতুলে কুটু, একটা লাফ দিয়ে মুরলীর গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুকুরটার নখের সঙ্গে মুরলীর শাড়ির আঁচলও জড়িয়ে যায়। আঁচলটাকে আস্তে আস্তে সেই আবদেরে নখরবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কুকুরটাকে একটা ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দেয় মুরলী।

কিন্তু ভোরের আলোর আভা মুরলীর মুখের উপর যখন ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তখনই হেসে ওঠে না মুরলী। মুখ ঘুরিয়ে আর ঘুম-ভাঙা চোখের চাহনিটাকে বড় সড়কের আমের সারি ছাড়িয়ে আরও দূরে ছড়িয়ে দিয়ে যখন গির্জার চূড়াটাকে স্পষ্ট দেখতে পায় মুরলী, তখন মুরলীর কালো চোখের আঁধারের উপর যেন হঠাৎ ভোর হয়ে যায়, চোখের তারা দুটো খুশির ঝিলিক দিয়ে চমকে ওঠে, আর আভাময় মুখটা হেসে ঢলঢল করতে থাকে।

আজ রবিবার। আর কিছুক্ষণ পরেই গির্জার ঘণ্টার সেই ডিং ডাং শব্দের সুরেলা শিহর বাতাসে ভেসে ভেসে ডাঙার এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে যাবে। হারানগঞ্জের ভালমানুষেরা প্রেয়ার সাধবার জন্য দলে দলে চারদিকের যত সড়ক আর মেঠো পথের উপর দিয়ে গির্জাবাড়ির দিকে চলতে শুরু করবে।

আর দেরি করে না মুরলী। ইদারা থেকে জল তুলে নিয়ে এসে মুখ ধুয়ে আর চুল ভিজিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পলুসই মুরলীর জন্য যে শাড়িটা কিনে এনে রেখেছে, সাদা গোলাপের কুঁড়ির মত দেখতে রেশমী বুটি বসানো লাল রঙের যে ফিনফিনে শাড়িটা, সেই শাড়ি গায়ে জড়ায়।

খোঁপা বাঁধতে গিয়ে সাদা সিঁথিটার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে মুরলী। ভাল, খুব ভাল; সিস্টার-দিদি বলেছে, সিঁথিটা এইরকমটি থাকবে; রঙ দিবার দরকার নাই।

কিন্তু মেরিয়া যে বলেছে, সিঁথিতে রঙ নাই বা দাগলে জোহানা, কিন্তু তোমার যে নরম নরম ওঠ দুটা…।

মনে পড়তেই মুরলীর মুখের হাসি রঙিন হয়ে ওঠে। মুরলীর ঠোঁট দুটোকে লোভীর মত টিপে টিপে আদর করে মেরিয়া বলেছিল—এ দুটা রঙাতে হবে জোহানা।

–লাজ লাগে মেরিয়া।

–রাখ তোমার লাজ। ওঠ না রঙালে মরদে লুভাবে কেন?

মেরিয়ার সেই মিষ্টি হাসির ধমকটাও যেন কানে শুনতে পায় মুরলী, মনেও পড়ে যায়; বিয়ের দিনে মেরিয়া যে জিনিসটা মুরলীকে উপহার দিয়েছে, সেটা মুরলীর তোরঙ্গের মধ্যেই আছে। ছোট একটা শিশি, তার মধ্যে গালার রসের মত নরম একটা জিনিস, ঠোঁট লালচে করার রঙ।

তোরঙ্গ থেকে শিশিটা বের করে নিয়ে হেসে হেসে দুই ঠোঁটের উপর একটা নতুন আশার টকটকে লাল প্রলেপ ছড়াতে থাকে মুরলী।

-পলুস পলুস!

মুরলীর গলার স্বর সকালবেলার পাখির ডাকের মত একটা মিষ্টি কলরব হয়ে বেজে ওঠে। চমকে জেগে ওঠে পলুস।

ডিং ডাং, ডিং ডাং, গির্জার ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। চেঁচিয়ে হেসে ওঠে মুরলী-তুমি কেমন খিরিস্তান বটে গো!

–কি বটে? আশ্চর্য হয়ে মুরলীর রঙিন ঠোঁটের দিকে তাকায় আর চোখ ঘষে পলুস।

–আজ যে রবিবার বটে। গির্জা যেতে হবে না?

পলুসের চোখ যেন একটা অবুঝ বিস্ময় সহ্য করতে গিয়ে অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ কোন জোহানা? রাতের বেলা যে জোহানার বুকের ভিতর থেকে ভয়ানক একটা নিঃশ্বাসের বেদনা ড়ুকরে উঠেছিল, ভুল করে কপালবাবার নাম হেঁকেছিল যে জোহানা, সেই জোহানা রাতের আঁধার মরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন নতুন করে বেঁচে উঠেছে। কী সুন্দর সেজেছে জোহানা। গির্জাতে গিয়ে প্রেয়ার সাধবার জন্য ছটফট করছে খিরিস্তানী জোহানার নতুন জীবনের বিশ্বাস।

হ্যাঁ, গির্জা যেতে হবে। পলুসের জীবনে গির্জা যাবার আনন্দটাও যে নতুন হয়ে দেখা দিল। আজ আর একা নয়, পরের সঙ্গেও নয়; নিজের ঘরণী এই জোহানাকে সঙ্গে নিয়ে সকালবেলার আলোর ভিতর দিয়ে মেঠোপথ আর সড়ক ধরে ধরে গির্জাবাড়ির দিকে চলে যাবে পলুস। রাতটা যেন কতগুলি মিথ্যা ভয় সন্দেহ আর ঘৃণার উপদ্রব ঘটিয়ে পলুস আর জোহানার জীবনের মিল ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে একটা ভয়ানক ঠাট্টার খেলা খেলেছিল।

পলুস বলে—ভাবতে বড় দুঃখ লাগছে জোহানা…।

মুরলী-কি আবার ভাবতে লাগলে তুমি?

পলুস-ভাবছি, রাতের বেলাটা কেন তুমি ভুল কথা বলে আর ভুল রাগ রেগে, আমাকে দুখ দাও।

মুরলী হাসে আর ভুল হবে না। তুমি দেখে নিও।

পলুসও হাসে: ঠিক বটে তো?

মুরলী-খুব ঠিক।

পলুস–কি ঠিক?

মুরলী-তুমি যেমনটি চাও।

পলুস-সেটা কি বটে, বুঝেছ কি?

মুরলী-তুমি তো বুঝিয়ে দিয়েছ।

পলুস–কি?

হেসে ফেলে মুরলী : হিসাব করে দিব আর নিব।

চমকে ওঠে পলুস-হা…ঠিক…কিন্তু…।

মুরলী–নাও, আর দেরি করো না।

আর দেরি করে না পলুস। হাতমুখ ধুয়ে আর সাজ সেরে নিয়ে মুরলীকে ডাক দিতে গিয়েই বুঝতে পারে পলুস, মুরলী ঘরের ভিতরে নেই। ঘরের বাইরে এসে দেখতে পায় পলুস, মুরলী একেবারে সড়কের উপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আর দুরের গির্জাবাড়ির চূড়ার দিকে পপাসিতের চোখের মত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।

-চল। পলুস কাছে এসে ডাক দিতেই যেন তরতর করে এগিয়ে যায় মুরলী।

পলুসের মুখের হাসি হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে যায়। সকালবেলার রোদে ঝাজ নেই, বাতাসটাও ঠাণ্ড; কিন্তু পথ হাঁটতে ক্লান্তি বোধ করে পলুস। গির্জা যাবার আনন্দটাই নেতিয়ে পড়তে থাকে। কারণ, পলুসের পাশে পাশে নয়, পলুসের আগে আগে, যেন আবার একটা সাধের আবেগে একলা হয়ে হেঁটে চলেছে মুরলী।

পলুসের বুকের ভিতরে ছোট একটা অভিমানের নিশ্বাস হাঁসফাস করে। শুধাতে ইচ্ছে করে, আমিই যদি না দেখতে পেলাম, তবে কার লেগে ঠোঁট দুটা রঙালে জোহানা? আগে আগে চল কেন?

গির্জাবাড়ির ফটকের কাছে পোঁছে যাবার পর আরও একবার আশ্চর্য হয় পলুস। জোহানা পিছুপানে একটিবারও তাকালো না। গির্জাঘরের ভিতরে উধাও হয়ে গেল।

প্রেয়ার শেষে ভাল মানুষেরা গির্জাঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে আবার যে-যার ঘরের পথের দিকে যখন এগিয়ে যেতে থাকে, তখন পলুসও ভিড়ের ভিতর থেকে বের হয়ে মুরলীর আনমনা ও একলা চেহারাটার কাছে এগিয়ে এসে বলে–চল।

মুরলী বলে—একটুক থাম; মেরিয়ার সাথে দুটা ভাল কথা না বলে চলে গেলে মেরিয়া রাগ করবে।

পলস-মেরিয়া?

মুরলী-গির্জা-ঘরে আছে, এখনই আসবে। কিন্তু…।

পলুস–কি?

পলুসের মুখের দিকে তাকিয়ে মুরলী হাসে-মেরিয়ার সাথে আমার ভাল কথা হবে, তুমি হেথা থাক কেন?

গির্জাবাড়ির সামনে সড়কের উপরে একটা গাছের ছায়ায় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল পলুস আর মুরলী, সেখান থেকে সরে গিয়ে একটু দুরে সড়কেরই পাশের ল্যাম্পের খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় পলুস; আর মুরলীর দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাতে গিয়ে হাসতে চেষ্টা করে। মুরলীও পলুসের দিকে তাকিয়ে আর মুখ টিপে হাসতে থাকে।

দেখতে পায় পলুস, জোহানার মুখটেপা হাসিটা হঠাৎ চমকে উঠল। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গির্জাবাড়ির ফটকের দিকে তাকিয়ে কি-যেন দেখছে জোহানা। দেখতে দেখতে জোহানার চোখের তারা দুটো যেন দূরন্ত হয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। জোহানার নরম ঠোঁটের লাল রঙের প্রলেপ যেন ভিজে গিয়ে চকচক করছে। কি দেখছে, কাকে দেখছে জোহানা? মেরিয়া আসছে কি?

মুখ ঘুরিয়ে গির্জাঘরের ফটকের দিকে তাকায় পলুস। দেখতে পায় পলুস, ফটকের দিক থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে এদিকেই আসছে রিচার্ড সরকার। সাহেবী সাজে সাজা রিচার্ড সরকারের গলার টাই ফুরফুর করে উড়ছে। রোদ লেগে ঝকঝক করছে রিচার্ডের পায়ের জুতোর পালিশ।

সড়কের উপর উঠে গাছের ছায়ার কাছে এগিয়ে এসেই রিচার্ড সরকার আনমনার মত একবার থমকে দাঁড়ায়। মুরলীর মুখের দিকে তাকায়।

মাথা হেঁট করে মুরলী। ফিনফিনে শাড়ির আঁচলটা হাতে তুলে নিয়ে যেন সারা শরীরের একটা দুর্বহ অস্বস্তির শিহর ঢাকতে চেষ্টা করে।

চোখের চশমা খুলে হাতে তুলে নিয়ে রিচার্ড সরকারও যেন একটা চকিত বিস্ময়ের আবেগ সামলাবার জন্য চশমার কাচ মুছতে থাকে। মুরলীর সেই রঙিন ঠোঁটের শোভাটাকে যেন দেখবার চেষ্টা করছে রিচার্ড সরকারের চোখ। মুখ তোলে মুরলী; রিচার্ড সরকারের দিকে তাকায়। ব্যস্তভাবে চলে যায় রিচার্ড সরকার।

দেখতে পায় পলুস, কবরথানের ফটকের কাছে এগিয়ে যেয়ে কাঠের গুমটির ভিতর থেকে সাইকেলটাকে বের করল রিচার্ড ডাক্তার; আর সেদিকেই ছুটে চলে গেল, যেদিকে আর কিছুদূর এগিয়ে গেলে জেলাবোর্ডের সড়কটা পড়ে; তারপর আর কতই বা দূরে রিচার্ড ডাক্তারের সেই ফুলবাড়ির মত দেখতে সুন্দর বাড়িটা?

মুরলীও এইবার ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তরতর করে হেঁটে পলুসের কাছে এগিয়ে এসে ডাক দেয় মুরলী-চল।

পলুসের চোখ দুটো কুঁচকে গিয়ে একটা বিস্ময়ের জ্বালা চাপতে চেষ্টা করে। পলস বলে–দেখা হলো?

মুরলী-হ্যাঁ।

কুটি করে পলুস : কার সাথে দেখা হলো?

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী-না না, দেখা হয় নাই। কারও সাথে দেখা হয় নাই। মেরিয়া আসে নাই।

পলুস-সে তো দেখলাম। কিন্তু তুমি এখনই ঘরে যেতে চাও কেন?

মুরলী-হেথা আর থাকতে হবে কেন? কি দরকার?

পলুস-মেরিয়ার সাথে দুটা ভাল কথা বলবে কে?

হেসে ফেলে মুরলী : হায় গড! ভুলে গেলাম কেন? আর একটুক থাক পলুস। আমি মেরিয়ার কাছে যাই। ওকে একবার শুধিয়ে আসি।

পলুস–কি শুধাবে।

ভ্রূকুটি করে মুরলী-তুমি কি দারোগা বট? মিছা এত কথা শুধাও কেন?

পলুস বলে-হোই দেখ, মেরিয়া তোমাকে খুঁজছে।

মুখ ফিরিয়ে গির্জাবাড়ির ফটকের দিকে তাকায় মুরলী। আর দেখতে পায়, সত্যিই মেরিয়া যেন রাগ করে আর ব্যস্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে।

-মেরিয়া বহিন গো! হাত তুলে হাঁক দিয়ে মেরিয়ার কাচ্ছে যাবার জন্য যেন ছটফটিয়ে ওঠে মুরলী।

মুরলীর একটা হাত চেপে ধরে পলুস : মেরিয়াকে কি শুধাতে চাও? পলুসের চোখের চাহনি মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ভয়ানক সন্দেহের জবাব খুঁজছে; কাঁপছে চোখ দুটো।

দপ করে জ্বলে ওঠে মুরলীর চোখ ও ছিয়া ছিয়া!

-কিসের ছিয়া! কাকে ছিয়া করছো তুমি?

মুরলী ছিয়া করছি তোমাকে, খিরিস্তান হয়েও যে মানুষ গাওয়ার কিষাণের মত ঘরণীর মনকে…।

পলুস–কি?

মুরলী–বুঝতে পারে না।…এ কেমন হাত ধরার রীত?

পলুসের যতের মুঠো থেকে হাত ছড়িয়ে নিয়ে মুরলী বলে-চল, ঘরে যাই।

পলুরে মুখের আর কোন কথা শোনবার জন্য এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না মুরলী। সড়ক ধরে এগিয়ে যায়।

আগে আগে মুরলী; পিছনে পলুস। যেন পলুসকে পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যাবার জন্য মুরলীর প্রাণের অভিমানে একটা নতুন নেশার জ্বালা লেগেছে। গির্জাবাড়ি যাবার সময় মুরলীর প্রাণটা যে উৎসাহে হেসে হেসে পলুসের আগে আগে ছুটেছিল, ঘরে ফেরবার পথে সেই উৎসাহটাই যেন রাগ করে জ্বলছে।

–জোহানা! মুরলীর পিছু পিছু হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে বার বার একটা চাপা আক্রোশের ডাক ডাকে পলুস। ঠাট্টার ভাষাও মাঝে মাঝে রাগী ধিক্কারের মত বেজে ওঠেঠোঁটের লাল কাকে দেখাতে চাও জোহানা? আগে আগে চল কেন?

কিন্তু মুখ ফিরিয়ে তাকায়ও না মুরলী; মেরিয়ার উপহারের রঙ দিয়ে যে ঠোঁট রঙিন করেছে মুরলী, সেই ঠোঁট যেন নতুন স্বাদে ভিজে গিয়েছে। একটা নতুন আশার ছোঁয়া হঠাৎ এসে মুরলীর ঠোঁট এঁটো করে দিয়েছে। পলুস হালদার ধমক দিলেই মুরলীর রঙিন ঠোঁটের এই স্বপ্নময় স্বাদ ঝরে পড়ে যাবে কেন?

ঘরে ফিরে এসেও যখন পলুসের সঙ্গে একটা কথাও বলতে ভুলে যায় মুরলী, তখন পলুস হালদার চুপ করে চারপায়ার উপর বসে থাকে। এই দিনের আলোতেও ভয়ানক একটা অন্ধকারের ঘোের দেখতে পাচ্ছে পলুস। জোহানার মাথার দোষে শুধু এই ঘরের রাতের জীবন নয়, দিনের জীবনও বিষিয়ে যাবে। আজ থেকে তারই শুরু দেখা দিল বোধহয়।

জোহানা কি রাঁধতে রাজি হবে? দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের রোদের দিকে তাকিয়ে যেন স্বপ্ন দেখছে জোহানা। এমন মানুষকে অনুরোধ করতেও যে ইচ্ছে হয় না। বরং মনে হয়, এই মুহূর্তে একটা লাফ দিয়ে উঠে, এই অলস অস্বস্তির ভার থেকে মনটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে, ওই উনান আর ওই সব থালা বাটি আর ডেকচি আছাড় দিয়ে গুঁড়ো করে দিতে পারলেই ভাল হত।

পলুস ডাকে-জোহানা?

মুরলী-কি?

পলুস—আমাকে বলতে হবে, তুমি মেরিয়াকে কি শুধাতে চাও?

পলুসের কাছে এগিয়ে এসে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় মুরলী : শুধাতে চাই, ভাল লিখাপড়া শিখতে কতদিন লাগে?

পলুস–আর কি শুধাতে চাও?

মুরলী-লুসিয়া দিদি যে বাজনা বাজিয়ে ধরমের গান করে, সে বাজনা শিখতে কত দিন লাগে?

পলুসের গলার স্বর যেন একটা ক্ষীণ হাহাকারের মত বেজে ওঠে। আর কি শুধাতে চাও?

মুরলীর নরম ঠোঁটও কুঁকড়ে কুটিল হয়ে অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকে। আর যদি কিছু মনে নেয় তো শুধাবো।

কী প্রচণ্ড সাধের কথা বলছে জোহানা। কত বড় স্বপ্নের কথা! কলঘরের বড় মিক্তিরীর ঘর এত বড় সাধ আর স্বপ্নের মানুষকে সুখ দিয়ে ধরে রাখবার জোর পাবে কোথায়? জোহানাকে যে সত্যিই অনেক দূরে এগিয়ে যাবার আর বড় হয়ে যাবার নেশায় পেয়েছে।

পলুস করুণভাবে হাসে-তোমার এত সব সাধ কি সত্যি সাধ বটে জোহানা?

মুরলী-সাধ না তো কি বটে?

পলুস-হিসাব বটে।

মুরলী ভ্রূকুটি করে : হিসাব হবে কেন?

পলুস–হ্যাঁ জোহানা।

মুরলী-তাতে তুমি চোখ মুখ তিতা কর কেন? তুমিই বা কি কম হিসাব জান।

পলুস-আমি কবে হিসাব করলাম?

মুরলী-মনে নাই কি?

পলস–না।

মুরলী-মধুকুপির কিষাণের ঘরের দরজার কাছে এসে জল চেয়েছিল কে?

চমকে ওঠে পলুস : আমার পিয়াসকে হিসাব বলছে কেন?

মুরলী হেসে ফেলেঃ তোমার পিয়াস লাগে নাই পলু, তবু জল চেয়েছিলে। হ্যাঁ কি না?

শুকনো, ভীরু ও বেদনার্ত একটা মুখ নিয়ে বিড়বিড় করে পলুস–হ্যাঁ।

কলকল করে হেসে ওঠে মুরলী-কিষাণের ঘরণীর মন নিবার মতলব করে বেশ তো হিসাব করতে পেরেছিলে।

পলুস–কিন্তু তুমি তো জল দিয়েছিলে।

মুরলী—কেন দিয়েছিলাম? জান না?

পলুস-না।

মুরলী-খিরিস্তান শিকারীকে মন দিবার সাধ হয়েছিল।

পলুস—তুমি হেসেছিলে যে, সেটাও কি…।

মুরলী-হ্যাঁ গো, মিছা কথা বলবো কেন, সেটাও হিসাব বটে।

মাথা হেঁট করে আর এক হাতে কপাল টিপে যেন মাথার ভিতরের একটা কামড়ের জ্বালা সহ্য করতে চেষ্টা করে পলুস। আস্তে আস্তে বলে-তুমি যে আজ এত ভাল সেজে নিয়ে গির্জা গেলে, সেটাও কি তোমার হিসাব?

–রাঁধতে হবে না বুঝি! ভঙ্গী করে আর মিষ্টি ধমকের ঝংকার দিয়ে পলুস হালদারের প্রশ্নটাকে সরিয়ে দিয়ে উনানের কাছে এগিয়ে যায় মুরলী।

–গোবিন্দপুর বাজারে আবার যেতে হবে কিনা? আবার চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

–কেন?

—আরও দুটো সোনার মটরদানা আনতে হবে কিনা? না, জোহানাকে দিয়ে সস্তার দাসীর মত শুধু রাঁধিয়ে নিতে চাও? বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে পলুসের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে মুরলী।

সেই হাসি; ঝকঝকে তকতকে ঠাণ্ডা হাসি। মুরলীর সেই হাসি সহ্য করতে গিয়ে বার বার ভয় পেয়ে শিউরে ওঠে পলুস হালদারের চোখ।


© 2024 পুরনো বই