০৮. কাক ডাকে নি, ভোরও হয় নি

কাক ডাকে নি, ভোরও হয় নি, তবু বেশ ফিকে হয়ে গিয়েছে অন্ধকার। ডাঙ্গা পার হয়ে সড়কের উপর উঠতেই বুঝতে পারে দাশু, এই সড়কটাই সোজা ভুবনপুরে চলে গিয়েছে।

আকাশে মেঘ নেই, দু-তিনটে মরমর তারা ছাড়া আর কিছুই নেই। সড়কের জল আর কাদাকে জল আর কাদা বলে মনে হয়। আর, সড়কের এক পাশে একই জায়গায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে যে গাছ দুটো, সে গাছ দুটোকেও চেনা যায়।

দুটো লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে গাছের গায়ে হাত দেয় দাও। হ্যাঁ, যা ভেবে লাফিয়ে উঠেছে দাশুর ক্ষুধাকার প্রাণটা, দাশুর হাতে তারই ছোঁয়া লেগেছে। থোকা ড়ুমুর যেন থোকা থোকা আঁচিলের মত গাছ দুটোর গা ছেয়ে রয়েছে।

কোমরে জড়ানো গামছটাকে খুলে নিয়ে মাটির উপর ছড়িয়ে দেয় দাশু। ভোরের ভালুকের মত দু থাবা দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে ড়ুমুর ঝরাতে থাকে। ড়ুমুরের রাশ গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে আর কাঁধের উপর তুলে নিয়ে দৌড়ে হাঁটতে থাকে।

কাক যখন ডাকে, তখন মধুকুপির সেই মেটে ঘরের জাম কাঠের দরজার কাছে পৌঁছে যায় দাশু। কপাট খুলে দেয় মুরলী। ঘরে ঢুকেই গামছার গিট খুলে মেজের উপর ড়ুমুরের রাশ ছড়িয়ে দিয়ে দাশু একটা হাঁপ ছাড়তেই মুখ ফিরিয়ে নেয় মুরলী; আর খেজুর পাতা চাটাইয়ের উপর এলিয়ে শুয়ে পড়ে।

উনানের মুখে শুকনো বাঁশপাতা ঠেসে দিয়ে আগুন জ্বালে দাশু। জ্বলন্ত আগুনের আভা মুরলীর মুখের উপর ছটফট করে। মুরলীর চোখ দুটো মরমর তারার মত আস্তে আস্তে কাঁপে। তার সঙ্গে যেন একটা জ্বালাময় শ্লেষও কাঁপছে। আর কিছু নয়, গামছা দিয়ে জড়ানো ড়ুমুরের একটা বোঝা। রাতের বুকের ভিতর ঢুকে ডাকাতি করে কী অদ্ভুত ঐশ্বর্যের সম্ভার নিয়ে ঘরে ফিরেছে মধুকুপির দাশু কিষাণ! মুরলীর চোখের চাহনিতে একটা ক্লান্ত অভিশাপ হাসতে থাকে।

কিন্তু দাশুর হাত-পায়ের ব্যস্ততা সত্যিই একটা নেশার জ্বালায় দূরন্ত হয়ে উঠেছে। কাঁচা ড়ুমুরের রাশ যেন একরাশ প্রাণময় স্বাদুতার সম্ভার। দাশুর চোখের চাহনিতে লালা ঝরছে। হাঁড়ি ভরে ড়ুমুর সিদ্ধ করে দাশু। ড়ুমুরের জাউ কাঠি দিয়ে ঘাটে, তার আগে চারটে শুকনো লঙ্কা, চার চিমটি নুন আর গুঁড়ো হলুদ ছড়িয়ে দেয়।

মাটির তেলাই ড়ুমুরের জাউয়ে ভরে নিয়ে মুরলীর হাতের কাছে যখন এগিয়ে দেয় দাশু, তখন খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর উঠে বসে মুরলী। মধুকুপির কিষাণের অদ্ভুত রোজগারের উপহার সেই গরম জাউ স্পর্শ করতে গিয়ে হেসে ফেলে মুরলী : সারা রাত ধরে ভিখ মেগে শেষে এই চিজ নিয়ে এলে?

দাশু বলে–মধুকুপির কিষাণ ভিখ মাগে না।

মুরলী আবার হাসে। তবে কি করে? চুরি?

–না।

–তবে ডাকাতি?

–না। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

–তবে?

উত্তর দেয় না; উত্তর দিতে পারে না দাশু। মহেশ রাখালের মেয়ের কালো চোখের ওই অদ্ভুত চাহনি, কুঞ্চিত ঠোঁটের কুটিল হাসি আর এই কঠোর প্রশ্নের আঘাতে অভিভূত হয়ে শুধু বোবার মত তাকিয়ে থাকে। তারপর সরে যায়। জাউয়ের হাঁড়িটাকে হাতে নিয়ে বাইরের দাওয়ার উপর গিয়ে বসে।

দুরের পাকুড়বনের মাথার উপর দিয়ে ভোরের আলো গড়িয়ে এসে দাশুর মুখের উপর পড়ে। হাঁড়ির জাউ চেটেপুটে খেয়ে সেঁকুর তলে দাশু। হাত চাটে আর ঘটি তুলে ঢক ঢক করে জল খায়। মধুকুপির কিষাণের উপোষ করা আত্মাটা এতক্ষণে জ্বালা ভুলতে পেরেছে আর শান্ত হয়েছে।

ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে আর দাওয়ার কিনারায় বসে মুখ ঘোয় মুরলী। দাশুও মুখ ধোয়, জল ঢেলে হাত-পায়ের কাদা মুছতে থাকে। চড়ুয়ের ঝাক ঘরের চালার উপর বসে কিচিরমিচির করে। সকাল বেলার হাওয়ায় বাঁশঝাড়ের জটিল চেহারা দুলতে থাকে।

দাওয়ার উপর আবার স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে দাও। আর উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে না। ব্যস্ত হয়ে উঠবার সাধ ক্লান্ত হয়ে এসেছে। দাশু কিষাণের হাতে-পায়ে এমন অবসাদ কোনদিন দেখা দেয় নি। ঘরের ভিতরের দিকে তাকাতেও আর কোন ব্যাকুলতা নেই।

পলুস হালদারের নয়। এই দয়াতেও কী অদ্ভুত হিসাব। মুরলীকে মায়া করে বলে দাশুর বুকের কাছে বন্দুকের নলটাকে এগিয়ে নিয়ে এসেও গুলি মারে নি পলুস। শিকারী পলুসের স্বপ্নটা একটুও ভীরু নয়। দাশু কিষাণকে একটা দুর্বল কাঠবিড়ালীর চেয়েও দুর্বল বলে মনে করে পলুস। তাইতো অনায়াসে দাশুকে ছেড়ে দিতে পেরেছে।

–তুই মিছা কেন পলুসকে চোর বলেছিস মুরলী, ছি!–হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

কেঁপে ওঠে মুরলী : কি বললে?

দাশু–পলুস হালদারের বড় দয়া। তোর উপর কত মায়া। তাই আমাকেও মায়া করে।

দাশুর কাছে এগিয়ে এসে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় মুরলী : কে বললে? কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

দাশু সে-পলুসের সাথে দেখা হলো, পলুসই বললে।

মুরলীর নিরুত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু। মুরলীর কালো চোখের তারা দুটোর মধ্যে শুধু একটা দূরন্ত পিপাসার ছটফটানি দেখতে থাকে দাশু।

দাশু বলে-পলুসের সাথে যদি আবার দেখা হয়, তবে ওকে একটা কথা বলে দিব।

–কি কথা বলবে?

–বলবো, তোমাকে চোর বলে গালি দিয়ে মুরলীর বড় দুখ হয়েছে : ভুল করেছে মুরলী। তোমার কাছে মাপ চেয়েছে মুরলী।

-হ্যাঁ বলে দিও। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

দাশু আশ্চর্য হয়ে বলে-কেন মুরলী? বেচারা পলুসের উপর তোর এত রাগ কেন?

কথা বলে না মুরলী, দাওয়ার মাটির উপর বসে পড়ে, দু হাঁটুর উপর মাথাটা নামিয়ে দিয়ে চুপ হয়ে থাকে।

চেঁচিয়ে হেসে ওঠে দাশু। মুরলী মুখ তুলে তাকায় : কি হলো? হাসছো কেন?

দাশু—আজ আর খাটতে বের হব না।

মুরলী-কেন? তা হলে খাবে কি?

দাশু–খেতে ইচ্ছা নাই।

মুরলী—আমার তো ইচ্ছা আছে।

দাশু–সে তুই ভেবে দেখ।

মুরলী—আমাকে চলে যেতে বলছো?

দাশু–না।

মুরলী-তবে?

দাশু—এখানে থাকবি। আমি যেদিন খাব সেদিন খাবি। আমি যেদিন খা না, সেদিন তুইও খাবি না।

মুরলী-কেন?

দাশু–কিষাণের মাগ হলে এমনটি হবে; উপায় নাই।

মুরলী—তুমি মরবে, আর আমাকেও মরাবে, কেমন?

দাশু–হ্যাঁ।

–কিন্তু আমার ছেইলাটা? সেটা মরবে কেন? চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী। মুরলীর চোখে সকালবেলার আলোর ছায়া আগুন হয়ে জ্বলতে থাকে।

–না না না। ছেইলাটা মরবে না। বলতে বলতে মাথা হেঁট করে আর ছটফট করতে থাকে দাশু। মুরলীর একটি প্রশ্নের আয়াতে দাও কিষাণের সব কথার কৌশল আহ্লাদ আর উল্লাস ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।

কে জানে কেন, মুরলীর চোখে সকালবেলার আলোর ছায়া আগুন হয়ে জ্বলতে জ্বলতেই হঠাৎ যেন ছাই হয়ে যায়, আর সেই ছাই ভিজেও যায়। ঝাপসা চোখ দুটো মুছে নিয়ে, দাশুর মাথায় হাত রেখে ডাক দেয় মুরলী—শুনছো?

–কথা বলিস না; তোর কথা শুনলে আমার কলিজাতে তরাস লাগে। মাথা সরিয়ে নেয়। দাশু।

মুরলীর গলার স্বর আরও কোমল হয়ে যায় : কেন? আমাকে ডর লাগে কি?

–হ্যাঁ।

–কেন গো? আমি কি তোমার দুশমন?

দাশু কিষাণের জীবনের সব আতঙ্কের জ্বালার উপর যেন বড়কালুর ঝরনার ঠাণ্ডা জলের ধারা ঝরে পড়েছে। একটা নতুন বিস্ময়ের আবেগে টলমল করে ওঠে দাশু কিষাণের বুক। মুখ তুলে, অদ্ভুত রকমের চোখ করে মুরলীর মুখের দিকে তাকায়।

মুরলী বলে-আমার কথা শুনবে?

দাশু–বল। মুরলী-তুমি একবার হারাণগঞ্জে যাও।

দাশু–কেন?

মুরলী-সিস্টার দিদির সাথে ভেট কর।

চমকে ওঠে দাশু–কেন?

মুরলী-তোমাকে ভাল কাজ পাইয়ে দিবে সিস্টার দিদি।

দাশু–ভাল কাজ?

মুরলী-হ্যাঁ, কলের কাজ। হারাণগঞ্জে, গোবিন্দপুরে, ভুবনপুরে কত নতুন কল হয়েছে, তুমি সে খবর জান না। কত কিষাণ কত ভাল কাজ নিয়ে সুখ করছে, সে কথা তুমি শুন নাই।

দাশু–সিস্টার দিদি আমাকে কেন কাজ দিবে? ওটা আমাকে কাজ দিবার কে?

মুরলী-আমি বলছি, দিবে। কিন্তু…।

দাশু–কি?

মুরলী—তুমি খিরিস্তান হবে।

-না। খবরদার, এমন কথা বলবি না। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। দাশুর নিঃশ্বাস রাগী সাপের মত হিসহিস করে শব্দ ছাড়ে।

মুরলী বলে-তোমার পায়ে পড়ি, আমার কথা শুন। আমার মাথার কিরা, তুমি একটু বুঝে দেখ।

–কি বুঝতে বলছিস?

–সেদিন আর নাই। গাঁয়ের মাটিতে সুখ নাই। খেটে মরবে, কিন্তু বাঁচতে পারবে না।

—আমাকে কলের কুলি হতে বলছিস?

–পরের জমির মনিষ হয়ে তোমার কি মানটা থাকছে, বল?

–কপালবাবা দয়া করলে নিজের জমি হবে না কেন? মনিষ হয়ে থাকবো কেন? নিজের জমির কিষাণ হব। একটু সবুর কর মুরলী। আমাকে একটু দম নিতে দে।

–হবে না। যত ইচ্ছে দম নাও, তবু কিছু হবে না। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

–কেন? দার চোখের তারা তীরের ফলার মত চিকচিক করে।

–তোমার কপালবাবা মরেছে।

–খবরদার! খিরিস্তানীর মত কথা বলবি কি আমি তোর…।

–টাঙ্গি মারবে? হেসে ফেলে মুরলী।

চুপ করে, হঠাৎ মেজাজের উত্তাপ সামলে নিয়ে আবার মাথা হেঁট করে দাও। মুরলী বলে-তবে আমাকে যেতে দাও।

দাশু গম্ভীরস্বরে বলে–না।

মুরলী-তবে খেতে দাও।

দাশু–দিব।

মুরলী—কি খেতে দিবে? জঙ্গলের ড়ুমুর?

দাশু কিষাণের পাথরের পাটার মত বুকটা হঠাৎ যেন চুপসে যায়। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলীবল, কি খেতে দিবে? কথা বল? কথা বলতে মধুকুপির কিষাণের এত ডর কিসের?

গেঁয়ো মধুকুপির একটা মূক ও বধির আত্মার উপর যেন তীর মেরে খেলা করছে মুরলী। হাত-পা গুটিয়ে একেবারে অনড় হয়ে বসে থাকে দাশু। কিন্তু একটু পরেই চমকে উঠতে হয়। নিকটেই সড়কটা গোঁ-গোঁ শব্দ করছে। তারপরে, একেবারে নতুন একটা উল্লাসের সাড়া যেন ধোঁয়া ছড়িয়ে ছুটতে ছুটতে দাশু কিষাণের ঘরের কাছে এসে থেমে যায়।

একটা মালবহা মোটর গাড়ি। সে গাড়ির চালা নেই। ঝুপঝাপ করে গাড়ির ভিতর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে এক-একটা মূর্তি। হাতে গাঁইতা; কালো কপনি পরা আর কানো ধুলোয় ভরা মাথা, এক-একটা চেহারা।

দাশু দাদা কবে ফিরে এলে হে! চেঁচিয়ে ওঠে সুরেন মান্‌ঝি।

এগিয়ে আসে সুরেন। মালকাটা মান্‌ঝির দল সড়কের উপর বসে জিরোতে থাকে; বিড়ি টেনে ধোঁয়া ছাড়ে আর গল্প করে।

সুরেন মানঝির চেহারার দিকে তাকাতে গিয়ে দাশু কিষাণের চোখের বিস্ময়টাও করুণ হয়ে যায়। এ কি চেহারা! কালো ধুলো মেখে গাঁইতা কাঁধে নিয়ে সুরেন মান্‌ঝি যেন শখের ডাকাত সেজেছে।

–কেমন আছ দাশু দাদা? সুরেন মান্‌ঝি এসে একগাল হাসি হেসে দাশুর চোখের সামনে দাঁড়ায়।

–তুমি কেমন আছ বল।

–সুখে আছি গো দাদা! কয় খাদে খাটি। ঈশান মোক্তারের জমিতে থুক ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছি; মালকাটার কাজ নিয়েছি!

–কেন? জঙ্গলের শাল ভেঙে…।

–হুর্‌র্‌, সেদিন আর নাই দাশু দাদা। টাঙ্গির দিন নাই।

–তবে কিসের দিনটা বটে? বলতে গিয়ে দাশুর গলার স্বর রুক্ষ হয়ে ওঠে।

চেঁচিয়ে হেসে ওঠে সুরেনঃ গাইতার দিন বটে। গাইতা মেরে এক টব কয়লা উঠাও, মজুরি এক টাকা দুই আনা। দুই টব উঠাও, কত হয় হিসাব করে বুঝে নাও।

অনেকক্ষণ ধরে দুই চোখ অপলক করে সুরেন মান্‌ঝির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু। যেন সব নিঃশ্বাসের জোর দিয়ে একটা সন্দেহ জয় করবার চেষ্টা করছে। এ কি বলছে সুরেন? সত্যিই কি কয়লাখাদের কাজে এত সুখ আছে?

কয়লার ধুলোতে পুরু আর কালো হয়ে গিয়েছে সুরেন মান্‌ঝির ধুতি। সেই ধুতিকে আবার একটা কালো গামছা দিয়ে শক্ত করে কোমরবাঁধা করেছে। গামছার পাকের ভিতর থেকে ছোট একটা ডিবে বের করে সুরেন, আর ডিবের ভিতর থেকে একটা সিগারেট বের করে দাশুর হাতের কাছে এগিয়ে দেয়? ধর দাশু দাদা। তুমি আগে পাঁচ ফুক দিয়ে নাও।

দাশু কিষাণের বুকের ক্লান্ত হাড়ের উপর একটা নতুন বিস্ময়ের চমক ঠোকাঠুকি করে বাজতে থাকে। প্রাণপণে হিসেব করতে চেষ্টা করে দাশু; তাই তো। দুই টব মাল উঠালে দুই টাকা চার আনা মজুরি পাওনা হয়। সুরেন মান্‌ঝির কথাগুলিও যে ভয়ানক এক মায়াময় প্রতিশ্রুজ্ঞি ডাকাত হয়ে দাশুর জীবনের অবসাদের উপর নতুন নেশার জ্বালা ছুঁড়ে মারছে। দিন দু টাকা চার আনা রোজগার হলে যে দাশু কিষাণের এই ঘরের প্রাণটা দু বেলা ভরপেট খাওয়ার আনন্দে আবার ঝুমুর গেয়ে উঠবে।

সুরের মান্‌ঝির উপহার, সেই সিগারেটে দুটো লম্বা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দাশু আনমনার মত বিড়বিড় করে কথা বলে কিন্তু, দিন দুই টব মাল উঠাতে পারা যাবে কি সুরেন? তোমরা কি পার?

হেসে উঠে সুরেন : তেমন তেমন দিন হলে তিন টব মাল উঠাতে পারি।

দাশু–কিন্তু, এখনই গেলে কি ওরা কাজ দিবে আমাকে?

চেঁচিয়ে ওঠে সুরেন–এখনই দিবে। রোজ নতুন মালকাটা ভর্তি করছে কোম্পানি। তুমি ভাবছো কেন?

দাশু—আগাম কিছু দিবে কি কোম্পানি?

সুরেন–না, আগাম নিবার দরকার হয় না দাশু দাদা। হপ্তা পুরা হয়েছে কি পুরা সাতটি দিনের মজুরি হিসাব করে হাতে হাতে নগদ নগদ দিয়ে দিবে খাজাঞ্চি।

দাশু–কিন্তু আমার যে সাতটা দিনেরও খোরাক নাই সুরেন। আমি যাব কেমন করে, বল?

সুরেন মান্‌ঝির চোখ দুটো হঠাৎ একটু বিষয় আর একটু বিস্মিতও হয়? এমন দশাটা তোমার কেন হলো দাশু দাদা?

দাশু–কপালবাবা জানে।

সুরেন চুপ করে কি-যেন ভাবে, তারপর নিজের মনের আবেগে চেঁচিয়ে ওঠে—হুর্‌র্‌, ওসব ভাবনা এখন রাখা…সরদারিনের হাতে কত টাকা তুমি দিয়ে যেতে চাও?

নিজের কোমরের গামছায় হাত দেয় সুরেন। তারপর এগিয়ে যেয়ে সব মাজির কাছ থেকে একটা-দুটো করে সিকি আধুলি বা টাকা তসীল করে। তখনি ফিরে এসে দাশুর হাতের কাছে এক মুঠো টাকা-সিকি-আধুলি তুলে দিয়ে সুরেন বলে এই নাও দশ টাকা। হপ্তা পেলে শুধে দিও।

টাকা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ হতভম্বের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। কেউ যেন হঠাৎ এসে দাশু কিষাণের প্রাণটাকে এই মধুকুপির মাটির বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একটা প্রকাণ্ড কালো কবরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। দাশু কিষাণের আত্মার অহঙ্কার এতদিনে মাথা নিচু করে আর হাত পেতে যেন ঘুস নিচ্ছে। কিষাণের জীবন কয়লা-খাদের মালকাটা হয়ে গাঁইতা হাতে তুলে নেবে। দাশুর বুকের ভিতরে যে সত্যিই একটা যন্ত্রণার কান্না ছটফট করে উঠতে চাইছে। চোখের কোণের জল মোছে দাশু।

সুরেন মান্‌ঝি চেঁচিয়ে ওঠে? হেই দেখ! এটা আবার কি শুরু করলে? কাদ কেন?

জামকাঠের দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে সব কথাই শুনছিল যে মুরলী, সেই মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে সুরেন মান্‌ঝি এইবার চেঁচিয়ে হেসে ওঠে? হেই দেখ, সরদারিন হাসে আর সরদার কাঁদে; এমনটি তো কভি দেখি নাই।

ঠিক কথা। মুরলীর মুখের উপর ছোট একটা হাসির ছায়া এতক্ষণ ধরে কেজানে কিসের জন্য সিরসির করে কাপছিল। মধুকুপির কিষাণ এতদিন মাটির লোভ ছেড়ে দিয়ে খাদের কাজে নেমে যেতে বাধ্য হল। হার মেনেছে দাশু। তাই বোধহয় হেসে উঠেছে মুরলী। সুরেন মান্‌ঝির কথায় চমকে ওঠে দরজার আড়ালে সরে যায় মুরলী। এগিয়ে আসে দাশু।

মুরলীর হাতের কাছে টাকা রেখে দিয়ে দাশু বলে–চললাম।

মুরলী গম্ভীর হয়—কেন চললে?

দাশু–তোর লেগে। আর ছেইলাটার লেগে।

মুরলী-কি বলছো তুমি?

দাশু–তুই ঘরে থাক্। হপ্তা পরে ঘর ফিরবো।

মুরলী-হপ্তা পরে আবার চলে যাবে তো?

দাশু–হ্যাঁ।

মুরলী-এন দশাকে কি ঘর করা বলে? মাগে-মরদে এমন ঘর করে?

দাশু—আগে তুই বেঁচে থাকবি, তবে তো তোর সাথে ঘর করবো।

মুরলী ছিঃ!

দাশু–কি?

মুরলী-মানুষে এমন করে গাইও পুষে না; কিন্তু মধুকুপির কিষাণ শুধু খোরাক দিয়ে মাগ পুষতে চায়।

দাশু—তুই বিশ্বাস কর মুরলী।

মুরলী-আবার কি বিশ্বাস করতে বলছো?

দাশু–আমি মালকাটা হয়ে মরবো না, আমি মধুকুপির মাটি ছেড়ে দিব না, কভি না।

মুরলী ভ্রূকুটি করে : পাগলপারা কথা বল কেন?

দাশু–না। আমি টাকার লেগে যাচ্ছি। টাকা জমাবো। ফিরে আসবো। জমি কিনবো। তুই বিশ্বাস কর। আউশ আমন ফলাবো; রবি করবো। পাঁচ বিঘা কেন, দশ বিঘা জমি নিয়ে ছিটাই রোপাই করবো। তুই দেখে নিবি।

-বেশ, দেখে নিব। খুব জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে চুপ করে মুরলী, আর মুখ ঘুরিয়ে নিয়েই কেঁদে ফেলে। কী কঠোর দাশু কিনেরই এই জেদ! এখনও মুরলীর মুক্তির আশা বিনাশ করবার আশায় মাতাল হয়ে রয়েছে কিষাণের প্রাণ।

সড়কের উপর দাঁড়িয়ে থাকা নীরব ট্রাকটা জোরে হর্ন বাজায়। সুরেন মান্‌ঝি ডাক দেয় চলে এসো দাও দাদা।

ট্রাকের উপর মালকাটা মান্‌ঝিরদের গাঁইতাগুলি বড় বড় লোহার নখের মত হেলে দুলে চিকচিক করছে। ঘর ছেড়ে আস্তে আস্তে হেঁটে ট্রাকের দিকে চলে যায় দাশু।

শুনতে পায় দাও ঘরের ভিতরে গুনগুন করে কাঁদছে মুরলী। শব্দটা শুনগুন করে গাওয়া গানের শব্দের মত। যেন মুরলীর অদৃষ্টেরই আক্ষেপের গুঞ্জন। পাঁচ বছর আগে, দড়িবাধা কোমর নিয়ে পুলিসের পিছু পিছু চলে যাবার সময়েও দাশু কিষাণের পায়ের জোর এত নরম হয়ে যায় নি।

 

এজরা ব্রাদার্সের কলিয়ারি। মধুকুপির এত কাছে এই পাঁচ বছরের মধ্যে এরকম একটা কালিমাময় রাজ্য গড়ে উঠেছে, কল্পনা করতে পারে নি দাও। দু ক্রোশ দূর থেকে যে খাদের চিমনির বোয়াকে কালো মেঘের গুঁড়ো বলে মনে হয়, আজ একেবারে সেই চিমনির কাছে দাড়িয়ে দেখতে থাকে দাশু, কী ভয়ানক কালো হার মত ধোয়া উগরে চলেছে চিমনিটা। চারদিকে কী অদ্ভুত ব্যস্ততা! কত রকমের শব্দ আর কত ঘরবাড়ি! একদিকে সারি সারি কয়লার পাহাড় দেখা যায়। সুরেন মান্‌ঝি বলে-ওটা ডিপো বটে।

কয়লা খাদে কাজ চলছে দিনরাত। লোয়ার মধুকুপির সীম, সত্তর পুট পুরু কয়লার স্তর, হাই গ্রেড কয়লার এক বিরাট ভাণ্ডার হাতের কাছে পেয়েছে এজরা ব্রাদার্স। যেমন ব্যাঙ্কার্স অর্ডার, তেমনই লোকো অর্ডার; কোম্পানির অফিসের খাতাপত্রও প্রচুর প্রফিটের আশা ও উন্মাদনায় চঞ্চল হয়ে রয়েছে। নতুন নতুন ম্যাপ নিয়ে ম্যানেজার সর্বক্ষণ ব্যস্ত। কম্পাস বাবুও ব্যস্ত। ওভারম্যান আর সর্দার দিনের শিট সেরে আবার রাতের শিফটে যাবার জন্য

তৈরি হয়।

নিকটেই লোডিং স্টেশন। ওয়ে ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি চল্লিশ-টনী জাহাজী ওয়াগন। দিনরাত ওয়াগনে কয়লা লোড করছে রেজিং ঠিকাদারের কুলির দল। তাড়া দেয় ওয়াগনের পাইলট, আর এক ঘণ্টাও ওয়াগন আটক করে রাখা সম্ভব নয়। লোডিং বাবু, রেজিং ঠিকাদার আর পাইলটের সঙ্গে তর্কাতর্কি চলে! তারপর কে জানে কেমন করে হঠাৎ একটা নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

এজরা ব্রাদার্সের কয়লা খাদ; একটা পিট আর দুটো ইনক্লাইন। ধাওড়ার দিকে যেতে যেতে সুরেন মান্‌ঝি বলে-হেই দেখ দাশু দাদা, ওটা ড়ুলি খাদ বটে।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে দাশু; খাদের মুখের ভিতর থেকে রাঁধা লোহার ড়ুলি উঠছে আর নামছে। নামছে মানুষ, উঠছে কয়লা। কিরকম অদ্ভুত ফেস-ফেস আর ধপ শব্দ ছাড়ছে ড়ুলি খাদের মুখের কাছে একটা কলঘর। নীল রঙের পায়জামা পরা আর মাথায় কালো কাপড়ের ফেটি বাঁধা এক-একটা লোক কলঘরের কাছে ঘুরে বেড়ায়। সুরেন মান্‌ঝি বলে-ওরা খালাসী বটে; কেউ পঞ্চাশ, কেউ ষাট, কেউ আশি টাকা মাইনা পায়। ওরাও একদিন তোমার আমার মত দেহাতী মনিষ ছিল।

আর একটুও দুরে, পর পর দুটো খাদের মুখের ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসছে কয়লার সারি সারি চলন্ত স্তুপ। সুরেন মান্‌ঝি বলে—ঐ দুটো সিঁড়ি খাদ বটে। মাল নিয়ে টবগাড়ি কেমন উঠছে দেখ।

ডিপোর কাছে গুঁড়ো কয়লার বিরাট আকারের এক-একটা ঢিবির কোলের উপর কালো কালো খরগোশের মত হুটোপুটি করছে কারা?

সুরেন মান্‌ঝি হাসে-পাথর বাছাই করছে ছোড়ারা। এক মণ বাছলে একটা ছোঁড়া দশ আনা মজুরি মারে। ভাবছো কেন?

দাউ দাউ করে পুড়ছে ছোট ছোট কয়লার পাহাড়। দাশুর চোখের বিমূঢ়তাও যেন সেই জ্বালার হল্কা লেগে দপ দপ করতে থাকে।

সুরেন মান্‌ঝি বলে রাঙী কয়লা জ্বলছে দেখ, দাশু দাদা।

–কেন জ্বলছে সুরেন?

সুরেন-জলের দাগে দাগী রাঙী কয়লা জ্বলায়ে নরম কোক তৈয়ার হচ্ছে।

দু পাশে কয়লার ধুলো বড় বড় ঢিবি করে সাজানো। চলতে চলতে দাশুর মাথার চুল আর ভুরুর উপর কয়লার ধুলোর প্রলেপ কখন্ কখন্ পুরু হয়ে জমে গিয়েছে তাও বুঝতে পারে নি দাশু।

হঠাৎ একটা টিবি যেন খিল খিল করে হেসে ওঠে : হেই মান্‌ঝি, ভাল মানুষটিকে কোথা থেকে নিয়ে এলে?

সুরেন মান্‌ঝি হেসে হেসে ধমক দেয়—তাতে তোদিগের চোখ ফাটে কেন?

আবার এক ঝলক হাসি খিল খিল করে : মানুষটি বড় উদাস বটে: দেহাতী বটে কি?

সুরেন বলে–হ্যাঁ।

চোখ মুছে নিয়ে দেখতে থাকে দাশু, একদল মেয়ে ঝুড়ি হাতে নিয়ে কয়লার ধুলোর উপর পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে। যেন গুঁড়ো কয়লা দিয়ে তৈরী এক একটা চটুল মেয়েচেহারা সব লজ্জা এলোমেলো করে দিয়ে ঢলাঢলি করছে আর হাসছে।

–এরা কে বটে সুরেন?

–এরা ময়লা কামিন বটে। টালিতে কয়লাগুঁড়ো বোঝাই করে। এরাও রোজ মজুরি পায় বারো আনা। ভাবছো কেন?

এটা খুব লম্বা ও টানা একচালার কাছে এসে থামে সুরেন মান্‌ঝি। দেখতে পায় দাও, এক এক জায়গায় কালো কালো পিণ্ডের মত মানুষের ধড় জড়ো হয়ে রয়েছে। ঘুমোচ্ছ মালকাটার দল।

সুরেন বলে—এটা আমাদিগের ধাওড়া বটে। কাচা ধাওড়া। কোম্পানি বলেছে, পাকা ধাওড়া জলদি বানিয়ে দিবে। তখন মানঝিন আর ছেইলাগুলোকে আর গায়ে রাখবে না।

চমকে ওঠে দাশু? কেন সুরেন? এই কালা কয়লার নরকের মধ্যে ঘরের মানুষগুলাকে আনবে কেন?

সুরেন হাসে : নরক বলো না দাশু দাদা। যেখানে দানাপানি সেখানে ঘর।…হাঁ চল, তোমাকে এখনি ভর্তি করিয়ে দিয়ে গাঁই পাইয়ে দিব।

সুরেন মান্‌ঝির পিছু পিছু হেঁটে ঠিকাদারের অফিসঘরের কাছে এসে দাঁড়ায় দাশু। দাঁড়িয়ে আছে আরও প্রায় বিশ জন দেহাতী। দুটো ভীত চোখের করুণ দৃষ্টির সব বেদনা নিয়ে দেখতে থাকে, আর বুঝতেও পারে দাশু, এতগুলি মানুষ বোধহয় তারই মত দুর্ভাগ্যের যন্ত্রণায় গাঁয়ের ঠাণ্ডা মাটি, গাছের ছায়া, কাদার গন্ধ আর সবুজ ঘাসের ছোঁয়া থেকে তাড়িত হয়ে এই কয়লার কালো গহ্বরের কাছে আত্মদান করতে এসেছে।

অফিস-ঘরের সামনে মুড়ি আর গুড় ঝুরিতে সাজিয়ে নিয়ে দোকান করেছে একটা লোক। দুই ঠোঙা মুড়ি আর দুই ঢেলা গুড় কিনে হাঁক দেয় সুরেন—চটপট খেয়ে নাও, দাশু দাদা।

তারপর আর বেশি দেরি হয় না। এক ঘটি জল খেয়েই তৈরি হয় সুরেন, সুরেনের সঙ্গে অফিস-ঘরের ভিতরে ঢুকে নাম লেখায় দাশু। মধুকুপির দাশু কিষাণ যেন এক নিমেষের অদৃষ্টের নতুন লিখনের কৌতুকে এজরা ব্রাদার্সের মালকাটা হয়ে যায়। একটা ঢিবরি, এক ছটাক কেরোসিন তেল আর গাঁইতা হাতে তুলে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকায় দাও।

ওভারম্যান হাঁক দেয় ব্যস, আর দেরি কেন? সরদার ডাক দেয়—সব হাজির হ্যায়?

হ্যাঁ, সবাই হাজির আছে। সরদারের পিছু পিছু মালকাটা দলের সঙ্গে নতুন মালকাটা দাশু কিষাণের মূর্তিও চলতে থাকে।

সুরেন বলে-হা, বেশ ফুর্তি নিয়ে কাজে লেগে যাও, দাশু দাদা।

দাশু–কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রে ভাই?

সুরেন-ড়ুলি খাদে নয়, সিঁড়ি খাদে। তড়বড় করে নেমে যাও, ঝপাঝপ গাঁইতা মার, টব ভর্তি কর। ব্যস ভাবছে কেন?

কেরোসিনের টিরি হাতে ঝুলিয়ে আর গাইতা কাঁধে নিয়ে মালকাটা দলের হল্লা হাসির সঙ্গে একটা নীরব গম্ভীরতার মত হেঁটে হেঁটে যখন সিড়ি খাদের মুখের কাছে এসে থামে দাশু, তখন কেঁপে ওঠে বুকটা। গাঁইতা ঢিবরি ফেলে দিয়ে সেই মুহূর্তে পালিয়ে যাবার জন্য পা দুটো ছটফট করে ওঠে। যেন হাঁ করে রয়েছে একটা ঘুটঘুটে কালো আর অন্ধ দানোর প্রকাণ্ড মুখ। কে জানে, কত নীচে কোন্ ভয়ানক অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছে এই মরণের সুড়ঙ্গ! যে মাটির উপরটা এত সুন্দর, সে মাটির ভিতরটা এত কুৎসিত, কোনদিন কল্পনা করতে পারে নি দাও। কিন্তু কি আশ্চর্য, সুরেন মানঝি বলেছে, এই কুৎসিত সুড়ঙ্গের ভিতরে নাকি পয়সা ছড়ানো আছে।

ঢিবরি জ্বালে মালকাটার দল। দাশুও কাঁপা হাতে ঢিবরি জ্বালে। তারপর, আবার চলতে শুরু করে। ডাইনে বাঁয়ে আর মাথার উপর কালো কালো কাটাছটা নিরেট পাথর; তার উপর নিজেরই প্রকাও কালো ছায়ার বিরাট পা দুটোর দিক তাকালে ভয় পায় দাশু; একটা দানব যেন দাওর পাশে পাশে হেঁটে চলেছে।

মোটা তারের কাছি, যেটা সুড়ঙ্গের ভিতরে গড়িয়ে গিয়েছে, তারই উপর ঝন্ঝন একটা শব্দ যেন নেচে নেচে বাজতে শুরু করে। আর, অনেক দূরের প্রতিধ্বনির মত একটা ঘণ্টার শব্দও শোনা যায়। সরদার হাঁক দেয়-খবরদার!

অতল থেকে কয়লা বোঝাই গাড়ি উঠছে। হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসছে ঘড়াং ঘড়াং প্রবল শব্দে এক একটা জন্তু। হাবিস শুরু করেছে নীচের টালোয়ান। মালকাটার দলের সঙ্গে দাশুও সুড়ঙ্গের পাশ ঘেঁষে চলতে থাকে, নীচের দিকে, আরও কালো এক ভয়ানক রহস্যের দিকে!

–ডাইনে ঘুরে। হাঁক দেয় সরদার।

একটা ছোট সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকে মাথা হেঁট করে কুঁজো হয়ে মালকাটার দলের সঙ্গে এগিয়ে যেতে থাকে দাশু। পায়ের তলায় পচুপ করে কাদা। সরদার বলে–ভয় নাই, আর গ্যাস নাই; ধুর কয়লার উপর জল মেরে পাথরের গুঁড়া বিছাই করা হয়েছে।

-আবার ডাইনে ঘুরে, পৈছা সুঁদ।

ডাইনে ঘুরে আরও কুঁজো হয়ে হাঁটতে থাকে মালকাটার দল আর দাশু।

–ব্যস। সরদারের হাঁকের সঙ্গে সঙ্গে সবাই থমকে দাঁড়ায়।

কয়লা আর কয়লা, স্তরে স্তরে দাঁড়িয়ে আছে কয়লার নিরেট কালো শরীর। কয়লার খাজের গায়ে ঢিবরি ঝুলিয়ে দিয়ে জিরোতে থাকে মালকাটার দল। একটু দূরে শাবল মেরে কয়লার গায়ে বিধ দিয়ে বারুদ ঠাসছে চারজন মালকাটা। বেঁটে লাঠি আর সেটি ল্যাম্প হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ওভারম্যান, পরনে খাঁকি হাফপ্যান্ট, গায়ে গেঞ্জি আর মাথার প্রকাণ্ড টাকে কালো ধুলোর আবরণ।

–আওয়াজ হবে। তৈয়ার হও। হাঁক দেয় সরদার!

শিথিলভাবে গাইতার গায়ে হাত ঠেকিয়ে দিয়ে তৈরি হয় পুরনো মালকাটার দল। আর, নতুন মালকাটা দাশু যেন একটা বিভীষিকার সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে ভয়ে আক্রোশে হিংস্র হয়ে গাইতাটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।

বারুদ ফাটে। নিরেট কয়লার বুকটা প্রচণ্ড আর্তনাদ তুলে ফাটা-ফাটা হয়ে যায়।

–কাজ শুরু করো গতি। হাঁক দেয় সরদার।

গাইতা হাতে তুলে ফাটল-ধরা কয়লার বুকের উপর লাফিয়ে পড়ে দাশু।

 

ডরানির বানের জল নেমে গিয়েছে। আবার শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছে মধুকুপির ডাঙা। বানভাসি পলি দশ দিনের রোদেই শুকিয়ে ধুলো হয়ে গিয়েছে; ছোট ছোট ঝড়ো হাওয়ার ফুঙ্কারে সেই ধুলোও সারা দুপুর ধরে ডাঙার বুকের উপর ছোট ছোট ঘুরনি ছুটিয়ে নেচে বেড়ায়।

ডরানির স্রোতের হাঁটুজল আবার ছলছল করে, আর সেই স্রোত পার হয়ে ঈশান মোক্তারের খাটালের গরু আবার ঘাসের গন্ধ খুঁজতে খুঁজতে পলাশবনের ছায়ার দিকে চরতে চলে যায়। কারণ, আর একটা আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পেরেছে মধুকুপির প্রাণ। বাঘিন কানারানী আর এই তল্লাটে নেই। বাবুরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ এ-গাঁয়ে আর ও-গাঁয়ে ঘুরে আবার জানান দিয়ে চলে গিয়েছে, এইবার একটু হেটে ছুটে, একটু ঘরের বার আর গায়ের বার হয়ে কাজ করতে থাক সবাই। আর ডর নাই।

সড়কের উপর দিয়ে গো-গাড়ির যাওয়া-আসার সাড়াও শোনা যায়। এমন কি, সন্ধ্যা পার হয়ে যাবার পরেও। জামুনগড়ার কাঠুরিয়ারা জানতে পেরেছে, এই পথে বাঘের ডর আর নেই। থানা বলেছে, বাঘটা এ বছর একটু আগেভাগে, শীত দেখা দেবার অনেক আগেই চলে গেল। গোবিন্দপুর থানার সব ভাড়াটে শিকারী মাচান তুলে দিয়ে আবার যে-যার ঘরে ফিরে গিয়েছে।

কিন্তু আর-একটা ভয়, যে-ভয়ের জন্য ঈশান মোক্তারের কুঠি রাতের বেলায় নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে পারে না। বাবুরবাজারের ধানের পাইকার আর ইঁটের ঠিকাদারও সন্ধ্যার পর থেকে আতঙ্কিত বুক আর ঘুমহারা চোখ নিয়ে রাত কাটায়। গোবিন্দপুর থানার বড়বাবু আর ছোটবাবুর তর্কাতর্কিও যখন-তখন আরও তীব্র ও আরও মুখর হয়ে উঠতে থাকে।

এই আতঙ্কের নাম গুপী লোহার। কোন সন্দেহ নেই, বড়কালু ওয়েস্ট নামে নতুন রেলহেডের স্টোর ইয়ার্ডের ভিতর যে খুনের কাণ্ড ঘুমন্ত ঠিকাদারের লাল কম্বলটাকে রক্তে চুবিয়ে দিল আর টাকার থলি নিয়ে সরে পড়ল, সেই খুন গুপী লোহারেরই হাতের একটা ভয়ানক হেঁসোর শাণিত হিংসার কাজ। বাবুরবাজারে প্রতিদিন দু-চারটা ধানের গাড়ি এসে জমা হলেও কোন পাইকার আসে না।

মধুকুপির আতঙ্ক বলতে শুধু এই কুঠির আতঙ্ক। কারণ, গুপী লোহার যে মধুকুপির কোন মনিষের মেটে ঘরের ভিতরে উঁকি দিতেও আসতে পারে না, এই সহজ ও সরল সত্য কে না বুঝতে পারে? সিন্দুক নামে একটা বস্তু, ও তার ভিতরে নগদ টাকা নামে আর-একটি বস্তু শুধু এই কুঠি ছাড়া মধুকুপির আর কারও ঘরে নেই, থাকতেও পারে না। আজকাল বড় গুমস্তা দুখন বাবুর টাকার বাক্সটাও ঈশান মোক্তারের এই কুঠির সিন্দুকটার ভিতরে থাকে।

তাই আতঙ্কিত কুঠি শেষ পর্যন্ত তারই অনুগ্রহের শরণ নিয়েছে, যার ইচ্ছায় আর ইঙ্গিতে গোবিন্দপুর থানার বড়বাবু আর ছোটবাবুর বিচার-বিবেচনা, এমন কি ছুটি নেবার চেষ্টাও ওঠাবসা করে। পুলিশ মুন্সী চৌধুরীজীর আশ্বাস পেয়েছে ঈশান মোক্তারের কুঠি। কুছ ডর নেই। আমি সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, কুঠিতে ডাকা মারবার কোনও মওকা পাবে না খুনেরা পাপী গুপী লোহার।

বাবু দুখন সিংয়ের বাড়ির সামনে পিপুলতলার ছায়ার ছোট একটি টাট্টুঘোড়া আজ সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়ার একটা পা একটা খুঁটোর সঙ্গে বাঁধা দড়ির প্রান্ত দিয়ে বাঁধা। ঘোড়ার সামনে ঘাসের সুপ। লেজের ঝালর দুলিয়ে গায়ের মাছি তাড়ায় আর ঘাস খায় চৌধুরীর ঘোড়া। আর, বনচণ্ডীর ঘোট দেউলের পাশে রক্তজবার গা ঘেঁষে একটা খাটিয়া পাতা হয়েছে। তার উপর বসে আছে চৌধুরী। রামাই দিগোয়ার মাটির উপর উবু হয়ে বসে চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

ঈশান মোক্তারের কুঠি আজ চৌধুরীকে খুশি করার ব্রত পালন করেছে। কুঠি পাঠিয়েছে, মস্ত বড় কাঠের থালার উপর সাজানো পরোটার দুটি স্তুপ আর এক হাঁড়ি অড়হরের ডাল। পিতলের একটি ডেকচি, আর ভিতরে কালো পাঁঠার মাংস, বিনা পেঁয়াজে রাঁধা। একটি নতুন গামছ; গামছার এক কোণে দশ টাকার নোেট গেরো দিয়ে বাঁধা।

জাতপঞ্চের বড় বুড়া রতনকে ডেকে এনে চৌধুরীর সামনে হাজির করেছে রামাই দিগোয়ার।

চৌধুরী বলেছে কুঠি পাহারার জন্য বিশজন বেগার চাই। যেখান থেকে পার, যেমন করে পার সন্ধ্যা হবার আগেই তোক নিয়ে এসে জমায়েত করে ফেল। তা না হলে আমি সবার আগে তোমাকে চালান দিব বুড়া।

রতন-বেগার খাটতে বলছেন কেন বাবু? কিছু পয়সা দিবার আজ্ঞা করেন।

–চুপ। একটা পয়সাও না। সরকারী কাজে বেগার খাটতে হবেই। পিতল বাঁধানো লাঠিটাকে মাটিতে ঠুকে চৌধুরী গর্জন করে উঠতেই বড় বুড়া রন চুপ করে চলে গিয়েছে।

সারা দুপুর আর বিকাল পিপুলের ছায়ায় খাটিয়ার উপর ঘুমিয়ে পার করে দেবার পর সন্ধ্যা দেখা দিতেই আবার ব্যস্ত হয়ে হাঁকডাক করে চৌধুরী। লোক নিয়ে আসে বড় বুড়া রতন। কুঠির জন্য বিশজন মানুষ পাহারায় লাগিয়ে দিয়েই চৌধুরী একটা হাঁপ ছাড়ে। এইবার গলাটা একটু ভিজাতে চাই রামাই; বন্দোবস্ত কর দেখি।

আগেই বন্দোবস্ত করে রেখেছিল বাবু দুখন সিং। দুখন সিংয়ের চাকর দুটি মহুয়া সরাবের বোতল আর সরা ভর্তি ভোলাভাজা নিয়ে এসে চৌধুরীর হাতের কাছে রাখে।

টিম টিম করে আলো জ্বলে। চৌধুরীর গলা ভিজে যাবার পর এতক্ষণের গম্ভীর মুখটাও নতুন রকমের মেজাজে প্রসন্ন হয়ে ওঠে।

–নে রামাই। এটাতে পোয়াভর আর এটাতে ছটাকভর আছে। বোতল দুটোকে রামাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে চৌধুরী বলে-তাড়াতাড়ি পিয়ে নে রামাই; তারপর চল, একটা রাউণ্ড দিয়ে আসি।

বলতে বলতে অদ্ভুতভাবে হাসির ভেঁকুর তুলতে থাকে চৌধুরী। তিন চুমুকে বোতল খালি করে আর গলা ভিজিয়ে রামাই বলে-হুজুর আজ ফাঁড়িতে ফিরবেন কি?

চৌধুরী হাসে : তুই জানিস। যদি জায়গা করে দিস তবে আর ফিরবো কেন?

হেসে ওঠে রামাই : তবে চলেন হুজুর।

আর দেরি হয় না। পিপুলতলার অন্ধকার থেকে টলমল করে হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে আসে দুটি ছায়ামূর্তি। ঘোড়ার উপরে চৌধুরী, আর ঘোড়ার মুখের লাগামের কড়া ধরে রামাই দিগোয়ার। খুট্‌ খুট্‌, ঠুক্ ঠুক্‌, ঘোড়ার খুরের নাল সড়কের বুকের উপর ছোট ছোট শব্দ শিউরে দিয়ে আস্তে আস্তে চলতে থাকে। সেই সঙ্গে ছোট ছোট হাসির ভেঁকুরও বাজে। মাঝে মাঝে নেশাতুর নিঃশ্বাসের বাতাসও যেন তপ্ত হয়ে ফোস ফোস শব্দ করে ওঠে; মধুকুপির এই সন্ধ্যার ঠাণ্ডা অন্ধকারের গা শুঁকে শুঁকে একটা নরম-গরম মাংসল স্বাদুতা খুঁজে বেড়াচ্ছে দুটি টলমল খুশির ক্ষুধা।

সড়ক থেকে নেমে মেঠো পথ ধরে কিছু দূর এগিয়ে যায় এই ছায়াময় অভিযান। রাংচিতার ঝোপের উপর জোনাকি জ্বলে; তারই গা ঘেঁষে ছোট একটা মাটির ঘর।

গলা ফাটিয়ে হাঁক দেয় রামাই-খবরদার!

রামাইয়ের এই হাঁকের মধ্যে যেন একটা বিভীষিকা আছে। রাংচিতার জোনাকির দল কেঁপে ওঠে; আর কেঁপে ওঠে মাটির ঘরের ভিতরে লুকিয়ে আর ঘুমিয়ে পড়ে থাকা একটা প্রাণ।

ঘরের দরজার কাছে এসে আর একবার গলা কাঁপিয়ে হাঁক দেয় রামাই-মিঠুয়া ঘাসী আওয়াজ দাও।

ঘরের ভিতরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে একটা মেয়েমানুষ; যেন মেয়েমানুষটার বুকের সব পাঁজর ভয় পেয়ে একসঙ্গে আর্তনাদ করে ফেটে গিয়েছে।

রামাই দিগোয়ার হাসের বাইরে বের হয়ে এসে কথা বল, তেতরি।

দরজা খুলে বের হয়ে আসে তেতরি ঘাসিন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চেঁচাতে থাকে : তুই আবার মানুষটার নাম ধরে হাঁক দিলি কেন রামাই?

রামাই হাসে—তাতে ভয় পাস কেন?

তেতরি গুনগুন করে কাদেমরা মানুষের নাম ধরে হাঁক দিলে যে বড় ডর লাগে। তুই এটা বুঝিস না কেন? তোকে কত বললাম, কত পুরবী দিলাম, তবু তুই মানলি না রামাই!

চৌধুরী-কি বটে রামাই? মাগি কাঁদে কেন?

রামাই হাসে : ওর মরা মরদের নাম হেঁকেছি বলে ভয় পেয়ে কাঁদছে। কিন্তু আমার দোষ নাই হুজুর। থানাতে দাগীর খাতায় ওর মরদ মিয়া ঘাসীর নাম লিখা আছে।

চৌধুরী হাসে-তুই কেন মিছা এত রস করিস রামাই? যখন জানিস যে লোকটা নাই, তখন ওর নাম হেঁকে লাভ কি?

রামাই–থানা যদি নামটা না কাটে, তবে আমি বা কেন…।

চৌধুরী–ওসব কথা এখন রাখ রামাই। এখানে এলি কেন বল?

রামাই ফিসফিস করে? তেতরির ঘরে থাকবেন কি হুজুর?

চৌধুরী—নাঃ।

রামাই-তবে চলেন হুজুর।

আবার খুট খুট, ঠুক্‌ ঠুক্‌। ঘোড়ার ঘুরের নাল পথের কাঁকর পাথরের উপর দিয়ে ছোট ছোট চোরা শব্দের টোকা মেরে মেরে চলতে থাকে। সড়ক ধরে অনেক দূর এগিয়ে আসার পর আবার মেঠো পথে নেমে দুরের একটা ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে চৌধুরী আর রামাই দিগোয়ারের অভিযান।

পাকুড়তলার কাছে পোঁছেই একটা কুঁড়ে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে রামাই-খবরদার! ভরত শিয়ালগীর আওয়াজ দাও।

ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ দেয় একটা উগ্র কণ্ঠস্বর। চিৎকার করে রামাইয়ের নামে অভিশাপ বর্ষণ করে পল্টনী দিদি-মর মর মর, মুখপোড়া খালভরা। তোর ঘরে জোড়া মড়া মরে না কেন? তোর মাগ দশবার রাঁড় হয় না কেন?

সেই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমানুষের কান্নার করুণ শব্দ মেশামেশি হয়ে অদ্ভুত এক বিলোপের মত বাজতে থাকে।

হি-হি করে গলা কাঁপিয়ে হাসতে থাকে রামাই। চৌধুরী বলে—এটা যে একটা ক্ষেপী শিয়ালী বটে, রামাই?

রামাই-হ্যাঁ, হুজুর। কিন্তু জিনিসটা ভাল। মাগি লড়াইয়ের সময় অনেক সলজারের অনেক পয়সা খেয়েছে, কিন্তু এখন তালপাখা বেচে আর কাদে; আর নিজেরেই ভুখা পেটটাকে গালি গিয়ে চিল্লাচিল্লি করে।

গলা কেশে নিয়ে বদ্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে আবার চেঁচিয়ে রুক্ষ স্বরে ধমক দেয় রামাই—গালি দিবি না পল্টনী; খবরদার! বের হয়ে এসে মুন্সীজীকে সেলাম দে।

পল্টনীর চিৎকার হঠাৎ ভয়ে রুদ্ধ হয়ে যায়। কাঁপতে কাঁপতে একটা ঢিবরি জ্বালে পল্টনী। তার পরেই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়েই কাঁদতে থাকে। আপনি এই কশাইটাকে একটুক বলে দেন হুজুর; ও যেন আর মানুষটার নাম ধরে হাঁক না দেয়।

চৌধুরী-কেন?

পল্টনী কপালবাবা দয়া করে মানুষটাকে কবেই নিয়ে গিয়েছে হুজুর। মিছা সেই মানুষটার নাম হেঁকে এই কশাইটা মজা করে কেন?

রামাই-দাগীর খাতায় ভরতের নাম লিখা আছে; আমি কি করবো বল?

চৌধুরীর মুখেও বিচিত্র কৌতুকের হাসি মিটমিট করে : বেশ বেশ, বলে দিচ্ছি, আর তোর মরদের নাম হাঁকবে না রামাই।

কথা শেষ করে আর ঘরের ভিতর উঁকি দিতে গিয়েই চমকে ওঠে চৌধুরী-তোর ঘরের ভিতর ওদুটা কেমন জানোয়ার বটে রে পল্টনী?

পল্টনী দিদির দুই ছেলে, ধবধবে ফরসা আর নীলচে চোখ, কটা আর মোটা, ঘরের ভিতরে একগাদা ছেঁড়া কাথার উপর বসে ঠক্ঠক্ করে কাঁপছে। চৌধুরীর চোখের বিস্ময়কে

আরও চমকে দিয়ে হাসতে থাকে রামাই-ও দুটো সলজারের দয়া বটে।

রামাইয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে পল্টনী—তাতে তোর চোখ পুড়ে কেন রে ডাইনের বেটা?

-চুপ। ধমক দেয় চৌধুরী।

পল্টনীও মাটির উপর ধপ করে বসে পড়ে আর কপালে হাত দিয়ে গুনগুন করে কাদতে থাকে? ধমক দিলে আমি মানবো কেন হুজুর! আমার কটা আর মোটার উপর ডাইনের নজর পড়েছে হুজুর। একবার দেখেন হুজুর, আমার কটা আর মোটার হাড়মাসের কী দশা হয়েছে।

কটা আর মোটা; একটা সাত বছর, আর একটা ছ বছর বয়সের ধবধবে সাদা ও রোগা জিরজিরে অপার্থিব প্রাণী। চৌধুরীর সেই বিস্মিত চাহনির রকম দেখে যেন আরও আতঙ্কিত হয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে কটা আর মোটা।

–মরে গেলাম গো মা। চেঁচিয়ে ওঠে কটা।

–তুই এখানকে আয় গো মা। ফোঁপাতে থাকে মোটা।

–চল রামাই। বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে চৌধুরী।

চৌধুরীর কাছে এগিয়ে এসে, আর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে রামাই : পল্টনীর ঘরে থাকেন না কেন, হুজুর।

–না। ভাল জায়গা থাকে তো চল, নয় তো ফাঁড়ি ফিরে চল।

মাথা চুলকোয় রামাই; কি যেন ভাবে। তারপর, যেন একটা নতুন আবিষ্কারের আনন্দে হঠাৎ ছটফট করে ওঠে : ভাল জায়গা আছে হুজুর। সেটাও দাগর ঘর বটে। কিন্তু…।

চৌধুরী—কি?

রামাই-দাগীটা যদি ঘরে না থাকে, তবে…তবেও একটুক বুঝে সুঝে কাজ নিতে হবে, হুজুর।

খুট খুট, ঠক্ ঠুক্‌! টাট্টু ঘোড়ার খুরের নাল আবার পাকা সড়কের উপর দিয়ে ছোট ছোট শব্দ বাজিয়ে চলতে থাকে।

খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে হয় না। কয়েকটা নিমগাছ, আর একটা বাঁশঝাড় যেখানে পখের দু পাশে দাঁড়িয়ে রাতের বাতাসে গা দুলিয়ে অন্ধকার নাড়ছে, সেখানে এসেই হাঁক ছাড়ে রামাই-খবরদার!

চৌধুরীর নেশার আবেশ একটা বিপুল আশার চমক সহ্য করতে গিয়ে কেঁপে ওঠে ও হাঁ গাঁ রামাই। বড় ভাল জায়গাতে এসেছিস।

রামাই হাঁক দেয়-দাশু ঘরামি আওয়াজ দাও।

কোন আওয়াজ নেই। একটা নীরব ও নিস্তব্ধ মাটির ঘর; জামকাঠের জীর্ণ কপাট ভিতর থেকে বন্ধ। এই ঘরের সামনে এসে এই প্রথম হাঁক দিল রামাই। এই পাঁচ বছর ধরে এই ঘরের ভিতরে একটা সুন্দর চেহারার মেয়েমানুষ একলা পড়েছিল; তবু কোন রাতে এই ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াবার সাহস পায় নি রামাই। কিন্তু আজ যে কোন সন্দেহ নেই, এই ঘর দাশু ঘরামি নামে এক দাগীর ঘর। আজ অনায়াসে এই ঘরের দরজার উপর লাঠির বাড়ি মারতে পারে; দাগীর ঘুম ভাঙিয়ে দাগীকে ঘরের বাইরে আনতে পারে রামাই। আর দাগীর কোন ভুলের আঁচ পেলে জোর গলায় পরবী দাবিও করতে পারে।

–সরদার ঘরে আছ কি নাই? আবার ডাক দেয় রামাই।

কোন সাড়া শোনা যায় না। ঘরের ভিতর একটা বাতিও জ্বলে ওঠে না।

নিরুত্তর ঘরটার উপর যেন একটা আক্রোশ নিয়ে আবার হাঁক দেয় রামাই-সরদারিন কি নাই?

কপাটের উপর রামাইয়ের টাঙ্গির হাতলের বাড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে আছড়ে পড়তে থাকে।

রামাই বলে-আওয়াজ দাও সরদারিন।

-কে বট? ঘরের ভিতর থেকে একটা ভীত কণ্ঠস্বর ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে প্রশ্ন করে।

–আমি রামাই দিগোয়ার।

–তুমি এখানে আস কেন?

দাগীর হাজিরা নিতে এসেছি। তোমার মরদ দাশু ঘরামিকে দেখতে চাই।

–সে নাই।

–কোথায় গেল?

–কয়লা খাদে।

–তবে তুমি বের হয়ে এসো।

–না।

–খবরদার। মুন্সীজী দাঁড়িয়ে আছে। জলদি বের হয়ে এস।

–না।

–তোমার বয়ান নেবেন মুন্সীজী।

–আমি কিছু বলতে পারবো না।

–বলতে হবে।

–না।

-আমরা তোমার বাপের বাড়ির মানুষ নই গো সরদারিন; আমরা থানার মানুষ। যা বলছি, চুপচাপ শুন আর মেনে নাও।

দাগীর ঘরটা এইবার কোন উত্তরই না দিয়ে একেবারে নীরব হয়ে যায়।

জামকাঠের কপাটের উপর মুখ রেখে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে রামাই ও বাতিটা জ্বাল সরদারিন। একবারটি বের হয়ে এসো। মুন্সীজীর কাছে একটুক বসো। একটু হেসে কথা বল। মুন্সীজী তোমার উপর বড় খুশি হবেন।

দাগীর ঘরটা তবু যেন একটা বধির কবরের মত নীরব হয়ে থাকে। ঘরের ভিতরে বাতি জ্বলে না; কোন সাড়াও শোনা যায় না।

দরজার দিকে এইবার আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে স্বয়ং চৌধুরী। নেশাক্রান্ত নিঃশ্বাসের জ্বালাটা আহত অজগরের মত ফুসে ওঠে : একটা লাথি মেরে দরজাটাকে ভেঙ্গে ফেল রামাই। তারপর দেখি, সরদারিনের গতর ভাল, না, গমর ভাল?

জামকাঠের যে জীর্ণ কপাট বাচ্চা-নেকড়ের থাবার আঘাত সহ্য করতে গিয়ে নড়বড় করে, সে কপাট ভেঙে দু টুকরো করে ফেলতে কতটুকুই বা জোরের দরকার।

কিন্তু আর কোন জোরের দরকার হয় না। ঘরের ভিতরে রেড়ির তেলের মেটে বাতির আলো জ্বলে ওঠে, আর সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় কপাট। দরজার চৌকাঠের কাছে বাতিটাকে রেখে দিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় মুরলী।

মুরলীর আদুরে শরীরের উপর শুধু দেড় হাত বহরের একটা মোটা খেয়রা শাড়ির আবরণ; এক পাক দিয়ে জড়ানো একটা বিচিত্র শিথিলতা। রেড়ির তেলের মেটে বাতির শিখাটা নেচে নেচে জ্বলে, সেই সঙ্গে মুরলীর মুখের উপর একটা অদ্ভুত হাসির শিখাও যেন জ্বলে জ্বলে নাচে। দেড় বোতল সরাবের নেশায় টলমল চৌধুরীর নতুন পিপাসার সব আক্রোশের উপর যেন একটা বিস্ময়ের কুহক ছড়িয়ে দিয়েছে মুরলীর এই মূর্তি; চৌধুরীর চোখে পলক পড়ে না। রামাই দিগোয়ারও কথা বলতে ভুলে যায়।

কথা বলে মুরলী। আস্তে ঘাড় দুলিয়ে সড়কের অন্ধকারের দিকে একবার তাকায়, তারপর মুখ ফিরিয়ে আর ভুরু বাঁকা করে বাতিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দূর আকাশের তারার মত একটা মিটিমিটি হাসি মুখের উপর ফুটিয়ে তুলে চৌধুরীর মুখের দিকে তাকায়। কি যেন শুনলাম, কি যেন দেখবে বলে তুমি এখনি কসম খেলে চৌধুরীজী?

চৌধুরী-অ্যাঁ? অ্যাঁ? কিসের কসম?

মুরলী-কি দেখবার ইচ্ছা হয়েছে? আমার গমর ভাল, না, গতর ভাল?

গলা কাশে মুরলী, রামাই দিগোয়ার ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আর, সরু কোমরের উপর যেন একটা মত্ত ঝুমুরের ঢং হঠাৎ মোচড় দিয়ে দুলিয়ে ও খিলখিল করে হেসে ওঠে মুরলী : আমার গতর ভাল, গমরও ভাল। কিন্তু…।

চৌধুরী বিড়বিড় করে : রাগ করো না সরদারিন।

মুরলী-কেন রাগ করবো না বল? যে লোক মেয়েমানুষের সাথে কথা বলতে জানে না, মেয়েমানুষের মন বুঝে না, সে লোক এখানে আসে কেন?

চৌধুরীর গলার স্বর আরও মৃদু হয়ে যেন অনুনয় করে? ওসব কথা ভুলে যাও। তুমি এখন খুশি হয়ে দুটা কথা বল।

হেসে ছটফট করে দু পা পিছনে সরে গিয়ে ভাঙা খোঁপাটাকে শক্ত করে জড়িয়ে বাঁধতে চেষ্টা করে মুরলী খুশি কর, তবে তো খুশি হব।

চৌধুরী–কি চাও বল?

মুরলী-সরাব কই? শাড়ি কই?

চৌধুরী কুণ্ঠিতভাবে হাসে : সব দিব। সব দিব।

মুরলী-দেবতার নামে কিরা করে বল।

চৌধুরী–হে বৈকুণ্ঠনাথ, হে বিষ্ণু ভগবান, কিরা করে বলছি।

আবার ভুরু বাঁকিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে হেসে ওঠে মুরলী : তোমার চৌধুরিনের দোহাই?

চৌধুরী এইবার চেঁচিয়ে হেসে ওঠে, আর চোখের চাহনিটাও টলমল করে : আরে হ্যাঁ, তাই বটে। তুমি বড় বেশি নখড়া জানিস সরদারিন।

মুরলী—আমিও কিরা করলাম।

চৌধুরী-কিসের কিরা?

আঁচল তুলে মুখ চাপা দিয়ে হেসে ওঠে মুরলী : সব দিব।

ব্যস্তভাবে ডাকে চৌধুরী রামাই।

রামাই-হুজুর।

চৌধুরী-তুই এখন তবে…।

রামাই-আমি ঈশান মোক্তারের কুঠিতে চললাম হুজুর। আপনি এখানে থাকেন।

আবার হেসে ওঠে মুরলী : আজ নয় চৌধুরীজী।

চমকে ওঠে চৌধুরী ও অ্যাঁ, কি বটে? কি বললে সরদারিন?

মুরলী-আজ নয়; এখানেও নয়। আমাকে নিয়ে যেতে হবে।

চৌধুরী বিড়বিড় করে নিয়ে যেতে হবে?

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী : হ্যাঁ, যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যাব। আমাকে ঘর দিবে, শাড়ি দিবে, সরাব দিবে, সুখে রাখবে। মেয়েমানুষের মন বুঝতে পার না, কথা বল কেন?

চৌধুরী ডাক দেয়-রামাই।

রামাই–বলেন হুজুর।

চৌধুরী-সরদারিন ভাল কথা বলছে।

রামাই-খুব ভাল কথা। এমন গতর, এমন সুরত, আর এমন মিঠা রংঢং, এই মানুষ কিষাণের ঘরে থাকবে কেন? কোন্ সুখে? দাগীর মাগ হয়ে এর কোন্ ইজ্জতটি হবে?

চৌধুরী-তবে গোবিন্দ বাবুর বাজারে একটা ঘর নিতে হয়।

রামাই-ভাল হয় হুজুর।

মুরলীর দিকে দু পা এগিয়ে আসে চৌধুরী : বল, কবে যাবি সরদারিন?

দু পা পিছিয়ে সরে যায় মুরলী? অমন কুম করলে যাব না। ডর দেখালে যাব না।

চৌধুরী বিচলিত হয়? না না, কুম করছি না, ডর দেখাচ্ছি না। আমি তোকে সাধছি।

যেন রূপের গমরে আর অভিমানে ফুঁপিয়ে ওঠে মুরলী : আমাকে পায়ে ধরে সেধে নিয়ে যাবে, তবে যাব। তা না হলে যাব না, মেরে ফেললেও না।

ঝুঁকতে ঝুঁকতে আরও এক পা এগিয়ে যেয়ে মাটির উপর উবু হয়ে বসে পড়ে চৌধুরী; আর ব্যাকুলভাবে হাত দুটোকে ছুঁড়ে দিয়ে মুরলীর দু পায়ের পাতা ছুঁয়ে ফেলে? আমি সাধছি, সরদারিন।

আবার হেসে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সরে যায় মুরলী ও ঢের হয়েছে। এবার ঘরে যাও, আর…।

চৌধুরী–বল।

মুরলী—একটা খবর দিয়ে ঝালদা থেকে আমার বাপকে নিয়ে এসো।

চৌধুরী-শুনে নে রামাই।

মুরলী-আমার বাপ, মহেশ রাখাল।

এইবার সত্যিই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে মুরলী : বুড়া বাপের সাথে একবার দেখা না করে আমি যাব না, কভি না।

রামাই–কাঁদ কেন? আমি বলছি, কালই তোমার বাপকে ঝালদা থেকে ডেকে এনে…।

চৌধুরী-সে তো হলো, তারপর?

মুরলীর চোখমুখ আবার প্রসন্ন হয়ে ওঠে, আর ঠোঁটের ফাঁকের সুক্ষ্ম হাসিটাও দূরের তারার আলোর মত আবার মিটমিট করে কাঁপে : তারপর আর কি? তোমরা খবর দিও, কবে যেতে হবে।

রামাই বলে–ব্যস, এখন চলেন হুজুর।

মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে ডাকে চৌধুরী-সরদারিন! তোর ভাল গমর তো দেখলাম, কিন্তু…

মুরলী–কি?

চৌধুরী—কিন্তু তোর এত ভাল গতর, কানে কানে একটা কথা বলতে চাই শুনবি?

চেঁচিয়ে হেসে ওঠে মুরলী? আর কোন কথা বললে আমি আবার কেঁদে ফেলবো গো বাবু। আজ আর কিছু শুনবো না।

ছুটে গিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয় মুরলী। রেড়ির তেলের মেটে বাতিটাও এক ফুঙ্কারে নিভে যায়।

খুট খুট, ঠুক ঠুক, টাট্ট ঘোড়ার খুরের নাল সড়কের বুকের উপর টোকা দিতে দিতে চলে যাচ্ছে। সে শব্দ শুনতে শুনতে খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর যেন আছাড় খেয়ে পড়ে মুরলী, আর মেঝের মাটির উপর কপালটাকে ঘষে ঘষে ছটফট করতে থাকে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা শরীর একটা যন্ত্রণার জ্বালায় জ্বলছে।

পুরনো জামকাঠের এই নড়বড়ে কপাট, আর এই মাটির ঘর; দাশু ঘরামি নামে একটা দাগীর ঘর। বাইরের অন্ধকার থেকে যে-কোন সাপ আর বাঘ এই ঘরের ভিতরে ঢুকে দাগীর মাগের মাংস গিলে খাবার জন্য হাঁ করবে। অসহ্য। এই মুহূর্তে এই ঘরের মাটির উপর থুতু ফেলে দিয়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে।

না, এখনই চলে যাওয়া যায় না। খবর পেয়ে ঝালদা থেকে চলে আসুক বুড়া মহেশ রাখাল। তারপর আর এক মুহূর্ত দেরি করবে না মুরলী। বাঁচতে হবে, পেটের ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে; কয়লাখাদের মালকাটা হপ্তা পরে ঘরে ফিরে এসে দেখুক, ভাত নাই, মান নাই আর কোন সুখের আশা নাই যে ঘরে, সে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে মুরলী।

স্তব্ধ রাতের বাতাসে অনেক দূর থেকে কলের বাঁশির ক্ষীণস্বরের কাপুনি ভেসে আসছে। কয়লাখাদের কাজের বাঁশিটা আজ এই রাতে কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদছে কেন বোঝা যায় না। খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে চোখ বুজতে গিয়ে চোখের উপর একটা আতঙ্কের ছবি দেখে আবার ছটফট করে মুরলী। কী ভয়ানক ছবি! কালো লেংটি পরা, সারা গায়ে কয়লার ধুলো, চোখের চারদিকে ঘামে ভেজা কয়লাগুঁড়ো কাদা হয়ে রয়েছে, আর কাঁধে একটা গাঁইতা; একটা ভয়ানক জীব এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিচ্ছে-কপাট খোল মুরলী।

মুরলীর বুকের পাঁজরগুলি একটা প্রচণ্ড শাস্তির রূপ দেখে শব্দ করে চমকে ওঠে। কানের কাছে একটা ঠাট্টার হাসিও বাজছে। হাসিটা পলুস হালদারের হাসি ও কি মুরলী? আমাকে চোর বলে গালি দিয়ে ভাগিয়ে দিলে, তবে এখন কাঁদ কেন? এখন হাস না কেন? সুখ কর না কেন?

খেজুরপাতার চাটাই ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মুরলী। বাতি জ্বালে। খাটিয়ার তলা থেকে টিনের তোরঙ্গটাকে টেনে আনে। দেড় হাত বহরের মোটা খেরো শাড়িটাকে এক টানে নামিয়ে ফেলে। নীল রঙের শাড়ি, মোলায়েম আর মিহি জমিন! গোলাপী রঙের ব্লাউজ। লেসের ঝালর লাগানো সায়া। জীবনের সব চেয়ে বড় সাধের ইচ্ছার অভিসারে এখনি যেন ছুটে চলে যেতে চায় মুরলী।

সিস্টার দিদি যেমনটি সাজ করতে শিখিয়ে দিয়েছেন, নিজের হাতে মুরলীকে যে সাজে কবার সাজিয়েছে, সেই সাজে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে আয়নাটাকেও মুখের কাছে তুলে ধরে মুরলী। চিরুনি চালায়, নতুন করে খোঁপা বাঁধে। গোটানো বিছানাটাকে ঘরের এক কোণ থেকে তুলে নিয়ে এসে খাটিয়ার উপর পাতে। নরম তুলোর তোশক বালিশ আর চাদর। সেলাই কলটাকেও আবার হাতের কাছে টেনে নেয়। গাঁটরি করে বাঁধা লেসগুলিকেও হাতের কাছে রাখে।

ঘর ঘর, ঘর ঘর–কল চালিয়ে কাপড়ের টুকরোর উপর সুতোর নকশা আঁকে মুরলী; গেঁয়ো মধুকুপির যত দীনতা আর হীনতার বিরুদ্ধে গর গর করে যেন নতুন আক্রোশের গান গাইছে মুরলীর প্রাণের ফিরে পাওয়া একটা সাধ।


© 2024 পুরনো বই