০২. দাশু ঘরামির ঘর

দাশু ঘরামির ঘর। সেই পাঁচ হাত উঁচু মাটির দেয়াল, খাপরার চালা, আর পুরনো জাকাঠের একটা দরজা। পাঁচ বছর আগে সেদিন কোমরে দড়ি বাঁধা দাশু ঘরামি পুলিসের সঙ্গে চলতে চলতে অনেক দূর গিয়েও একবার থমকে দাঁড়িয়ে পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল। হ্যাঁ, তখনও এই দরজার কাছে একঠায় দাঁড়িয়ে ছিল মুরলী। ওই সেই কপাট, যার গায়ের উপর কতবার নেকড়ের আঁচড় পড়েছে। আর, শব্দ শুনে ভয় পেয়ে দাশুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে মুরলী।

আর সেই দেড় বিঘে জমি? সেটা কোথায় গেল? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু; দেখতে দেখতে দুই চোখ কাঁপিয়ে একটা জ্বালা ফুটতে থাকে। দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যেন বুক চিরে হাঁ করে পড়ে আছে সেই দেড় বিঘে জমি। সারি সারি কতগুলি গর্ত। গর্তের মধ্যে ছোট ছোট ঝোপ, বোধহয় শিয়ালকাঁটার বোপ। আর ইঁটের পাঁজার যত টুকরো টুকরো হাড়পোড়, গুঁড়ো গুঁড়ো ঝামা আর ঝুনো ছড়িয়ে পড়ে আছে।

বদলে গিয়েছে মধুকুপি। দাশু ঘরামির জেলখাটা শক্ত শরীরের পাঁজরগুলি যেন হাঁ করে তাকিয়ে ধুকতে থাকে। তার পরেই চমকে ওঠে দাশু। ঘরের ভিতর আলো জ্বলছে মনে হয়। জেগে আছে মুরলী? একটা শব্দও শোনা যায়, ঘরঘর ঘরঘর অদ্ভুত শব্দ। এত রাত্রে কোন্ শব্দের সঙ্গে খেলা করছে মুরলী? কিসের এত আহ্লাদ?

হাত তুলে দরজার কপাট কাঁপিয়ে একটা ধাক্কা দেয় দাশু : আমি এসেছি মুরলী। দরজা খোল।

খুলে যায় দরজার কপাট। কিন্তু ঘরের ভিতরে ঢুকেই একেবারে স্তব্ধ হয়ে যোবার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দাশু। মুরলীর কপালে কাঁচপোকার টিপ নেই, যদিও মুখ টিপে হাসছে মুরলী।

দাশু ঘরামির সাধের মুরলী নয়। পাঁচবছর ধরে জেলের জীবনে রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে মুরলীর যে চেহারাটা মনে পড়েছে, সে চেহারা নয়। হারানগঞ্জের গির্জাবাড়ির মেয়েদের মত ঢং করে শাড়ি পরেছে মুরলী। গায়ে নতুন রকমের জামা, ঈশানবাবুর মেয়েরা যেরকমের জামা গায়ে দেয়। মুরলীর পায়ে চটিজুতা। আর, বিছানাটা যেন বাইজী-নাচের বড়বাবুর বসবার আসর; মোটা নরম হতাশকের উপর সাদা ধবধবে চাদর আর মোটা মোটা বালিশ। কাঠের দুটো চারপায়াও আছে ঘরের ভিতরে। তার একটার উপর ছোট একটা কল। এই কলটাই বুঝি এতক্ষণ ধরে ঘরঘর করছিল!

তাই তো, সবচেয়ে বেশি বদলে গিয়েছে দাশু ঘরামির ঘরণী মুরলী। ডরানির স্রোতের উপর নতুন পুল দেখে আশ্চর্য হয়েছিল দাশু। কিন্তু কী ভয়ানক আশ্চর্যের জিনিস সেই মুরলীর এই চেহারা! দাশু ঘরামির চোখের ফ্যালফ্যালে বিস্ময় আস্তে আস্তে কটকট করে জ্বলতে থাকে। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–বেঁচে আছিস মুরলী?

মুরলী হাসে : দেখতেই পাচ্ছ।

হাতের পুঁটলিটাকে একটা আছাড় দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দাশু। ফুলেল তেলের আর আলতার শিশি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তেল আর আলতার ধারা মিশে গিয়ে গাঢ় রক্তের ধারার মত ঘরের মেজের উপর গড়াতে থাকে।

–কি হলো? ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করে মুরলী।

–তোর কি হল, সেটা আগে বল।

–আমার আর কি হবে? যা দেখছো তাই। বেঁচে আছি।

–কিন্তু তুই কি আছিস?

–আছি।

–না, হতে পারে না। তুই গিয়েছিস।

–গালি দিও না।

–গালি তো ভাল। এখনও যে টাঙ্গি হাতে তুলি নাই সেটা তোর বাপ মহেশ রাখালের কপালের জোর।

–কি বললে?

–ঠিক বলেছি।

–তোমার চোখ নাই।

–চোখ আছে, খুব ভাল চোখ আছে, সবই দেখছি।

দাশুর চোখের চেহারা দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠে মুরলী। হ্যাঁ, কটকট করে তাকিয়ে মুরলীর শরীরটাকে যেন তন্নতন্ন করে দেখছে দাশু। আর, দাউ দাউ করে জ্বলছে চোখভরা সন্দেহ।

–আমি এখনি এই ঘরে আগুন লাগাবো। তোর ওই সাধের কল আছাড় মেরে ভাঙবো। কিন্তু তার আগে…

 

 

ক্ষেপা নেকড়ের মত একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে এক হাতে মুরলীর শাড়ির আঁচলশক্ত করে চেপে ধরে দাশু ও তার আগে আমি দেখবো।

মুরলী বলে–কি দেখবে?

দাশ–দেখবো, সব দেখবো। এত ফুলেছিস কেন? তোর কোমর এত মোটা হলো কেন? তোর পেটে…।

মুরলী–সাবধান বলছি।

মুরলীর শাড়ির আঁচলটাকে দুহাতের আক্রোশ দিয়ে হিংস্রভাবে ধরে নিয়ে জোরে একটা টান দেয় দাশু। মুরলীও দু হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে মেজের উপর বসে পড়ে।

–তুই নষ্ট হয়েছিস। গর্জন করে দাশু।

–তুমি পাগল হয়েছ! দাশু ঘরামির মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে উত্তর দেয় মুরলী।

–আমি পাগল হই নাই, কিন্তু তুই খুব চালাক হয়েছিস।

মুরলীর সেই একজোড়া বেহায়া চোখের দিকে জখমী জানোয়ারের মত হিংস্রভাবে তাকিয়ে আর দাঁত দিয়ে পিষে পিষে কথা বলে দাশু। চোখে পড়ে, মুরলীর খোঁপাটা লাল ফিতে দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, তার মধ্যে আবার ছোট ছোট বেলকুঁড়ি কাটা গাঁথা রয়েছে।

এক হাত ছুঁড়ে দিয়ে, যেন থাবা দিয়ে মুরলীর খোঁপাটাকে চেপে ধরে দাশু। খোঁপা ভেঙে যায়, বেলকুঁড়ি কাটা ঝরে পড়ে। তারপর একটা লাফ দিয়ে সরে এসে ঘরের দেয়ালের খোপে হাত দিয়ে কি-যেন খোঁজে দাশু। আবার সরে গিয়ে চালার গোঁজের ভিতর হাত চালিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

 

 

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় মুরলী। ভাঙা খোঁপাকে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে আর চোখের চাহনিকেও অদ্ভুত এক দুঃসাহসে শক্ত করে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।–টাঙ্গি খুঁজছো?

দাশু–হ্যাঁ।

মুরলী–কেন?

দাশু–তোকে বলি দিব।

মুরলী–হোই দেখ, ঝুড়িটার পিছনে তোমার টাঙ্গি।

টাঙ্গি হাতে তুলে নেবার জন্য এগিয়ে যেতে গিয়েই হঠাৎ যেন চমকে ওঠে দাশু। থমকে দাঁড়ায়, মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে—এত ডাঁট কেন রে মাগি?

মুরলী-কেন ডাঁট হবে না? আমি তোমার পল্টনী দিদি নই।

দাশু ঘরামির হাতের দুঃসাহস যেন আঁতকে ওঠে। মুরলী যেন পাথুরে ঢেলার মত শক্ত একটা ধিক্কার ছুঁড়ে মেরেছে, সঙ্গে সঙ্গে জব্দ হয়ে গিয়েছে দাশু ঘরামির পাগলাটে সন্দেহ।

পল্টনী দিদি নই? কি বলতে চায় মুরলী? সারা মধুকুপির মধ্যে শুধু এক পল্টনী দিদির ঘরে এইরকম শখের বিছানা আছে। এইরকম নরম তোশক, মোটা মোটা বালিশ, আর নকশাদার চাদর। এখান থেকে আধ ক্রোশও হবে না, মাঠান কুলের ছোট জঙ্গলটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে এক বুড়ো পাকুড়ের ছায়ার কাছে পল্টনী দিদির ঘর। ওই ঘর একটা জাতছাড়া ঘর। গ্রেপ্তার হয়ে দড়িবাঁধা কোমর নিয়ে ভেলকিওয়ালার বাঁদরের মত পুলিসের সঙ্গে পথ হেঁটে চলে যাবার সময়, সেই পাঁচ বছর আগের এক সকালবেলাতে দেখতে পেয়েছিল দাশু, পল্টনী দিদি তার ঘরের দরজার সামনে বসে তালপাতার পাখা বাঁধছে। আর, পল্টনী দিদির গোরা-গোরা চেহারার সেই দোগলা ছেলে দুটো—সেই মোটা আর কটা, ছাগলছানার সঙ্গে খেলা করছে।

 

 

তা হলে পল্টনী দিদিও আছে? চলে যায় নি, মরেও যায় নি পল্টনী দিদি।

দশ বছর আগে পাঁকুড়তলার ওই নারীকে কেউ পল্টনী দিদি বলে ডাকত না। ওই ঘরের কাছে আরও তিন-চারটে ঘর ছিল। চার ঘর শিয়ালগীরভূতন, লেদু, লকাই আর ভরত; শিয়াল মেরে, শিয়ালের চাম বেচে, আর মাগ-ছেলে সবাই মিলে হাঁড়িয়া খেয়ে দিনরাত নেশা করে বেশ সুখেই ওরা থাকত। রোজই সন্ধ্যা হলে যখন কুলের জঙ্গলের আশেপাশে হুয়া হুয়া শিয়ালের ডাক বেজে উঠত, তখন এই ঘরের ভিতরে বসে হেসে হেসে কত ঢলাঢলি করেছে দাশু আর মুরলী। কী সুন্দর শিয়াল ডাকছে ভরত আর ভুতন!

মুরলী হেসে হেসে দাশুর অনুমানের ভুল শুধরে দিত, ভরত আর ভুতন নয়, ভরত আর বাতাসী।

ভরতের বউ সেই বাতাসীর পুরনো নাম মুছে গিয়েছে। সেই বাতাসীই হল আজকের মধুকুপের পল্টনী দিদি।

ঠিক সেই লড়াইয়ের সময়, গাঁয়ের লোকের মনের ভুলে একবার দু মাসের মধ্যেও একটা পূজা পায় নি কপালবাবা। এমন কি, জেঠুয়া অমাবস্যায় কপালবাবার আসনের কাছে যে একটি ডাগর সাদা ছাগ বলি দেবার নিয়ম ছিল, তাও ভুলে গিয়েছিল সবাই। বড় ব্যস্ত ছিল সবাই। লড়াইয়ের মাল চালানের যত ঠিকাদার এসে গাঁয়ের মানুষের হাতে হাতে দাদন ছড়িয়ে দিয়েছিল। এত পয়সা জীবনে দেখে নি মধুকুপি। শুধু ডরানির বালু তুলে গো-গাড়ি বোঝাই কর আর বাবুরবাজারে ঠিকাদারের মোটর ট্রাকের কাছে ফেলে দিয়ে এস। দিনে এস, রাতে এস। কোন অসুবিধা নেই। ঠিকাদারের লোক নগদ নগদ ঢোলাই মিটিয়ে দেয়।

সেই সময় ভয়ানক রাগ করেছিল কপালবাবা। আর, এক মাসের মধ্যে মধুকুপির পঞ্চাশেরও বেশি মানুষের প্রাণ কলেরায় শেষ হয়ে গেল। ছেলে বুড়ো জোয়ান, মাগি আর মরদ, সব লাস ওই ডরানির জলে ফেলে দিতে হয়েছিল। কিছু ভেসে গিয়েছিল, কিছু শেয়ালে খেয়েছিল, খুঁজলে বোধহয় উরানির বালুর কোন গর্তে আজও দু-একটা খুলি পাওয়া যাবে।

 

 

সেই কলেরাতে শেষ হয়ে গেল ওই চার-ঘর শিয়ালগীরের সংসার। শুধু রইল বাতাসী। ভরতের রাঁড়ি বউ বাতাসী।

কপালবাবার রাগ শান্ত হল তখন, যখন ডরানির ভাদুরে ঢলে ভাঙার সব কোদো ধান ভেসে গেল, আর কুলের জঙ্গলে সব লা-এর ফেকড়ি পচে গেল। আর, শুরু হল লাল কাকরের সড়ক দিয়ে গোরা পল্টনের যাওয়া-আসা; গান গেয়ে, শিশ বাজিয়ে, সড়কের ধুলো উড়িয়ে দিনরাত ছুটে যায় আর আসে, আসে আর চলে যায় পল্টনের গাড়ি। একদিন এই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার শুনতে পেয়েছিল দাশু–গোরা পড়েছে, গোরা পড়েছে, বাতাসী দিদির ঘরে গোরা পড়েছে।

গাঁয়ের তিন-চারটে গরু-চরানী মেয়ে চিল্কার করতে করতে ছুটে চলে যেতেই টাঙ্গি হাতে তুলে নিয়েছিল দাশু। দাশু ঘরামি ছাড়া সেসময় মধুকুপির ঘরে ও ক্ষেতে কোন পুরুষও বোধহয় ছিল না। যাই হোক, শেষে কিন্তু টাঙ্গিটাকে অলসভাবে কাঁধের উপর রেখে আর হেটমাথা হয়ে দাশুকে আস্তে আস্তে হেঁটে আবার ফিরে আসতে হয়েছিল।

–কি হলো? আতঙ্কিত চোখ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল মুরলী।

–সলজারের হাত ধরে বাতাসী হাসছে। ড়ুবেছে, মরেছে, নরকে গিয়েছে বাতাসী। বলতে বলতে টাঙ্গিটাকে উঠানের একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল দাশু।

যে বাতাসীকে, যে কলঙ্কিনীকে পল্টনী দিদি নাম দিয়েছে গাঁয়ের লোক, তার ঘরের সুখের চেহারাটা দু-তিন মাসের মধ্যেই কেমনতর পাল্টে গিয়েছিল, তা-ও কারও অজানা নয়। একবার দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, মস্ত বড় একটা ঘাগরা পরে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পল্টনী দিদি। ঘরের দাওয়ায় বসে মাঝে মাঝে গানের একটা কলও বাজাত।

কোন লজ্জা নেই, কোন আক্ষেপ নেই; পল্টনের গাড়ি সড়কের উপর থামলেই ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে এসে ফিক করে হেসে উঠত পল্টনী দিদির। তিনটে বছর যেতে না যেতেই দুটো ছেলে হল পল্টনী দিদি। সোনা রঙের চুল, ধবধবে ফরসা, আর কটা চোখ দুটো ছেলে। পল্টনী দিদির প্রাণটাও যেন আহ্বাদে মুখর হয়ে ছেলে দুটোকে দুটো আদুরে নাম দিয়েছিল-মোটা আর কটা।

গরু-চরানী মেয়েরা পাকুড়তলার কাছ দিয়ে যেতে যেতে কতবার তাকিয়ে দেখেছে, ঘরের দাওয়ার উপর শখের বিছানা পেতে শুয়ে আছে পল্টনী দিদি। আর মোটা ও কটাকে বুকের উপর চড়িয়ে ছড়া গাইছে।

গরু-চরানী মেয়েরা চেঁচিয়ে গালি দিত-মর মর মাগি সলজারভাতারী বিস্কুটখাগী। কপালবাবা তোকে নেয় না কেনে?

পল্টনী দিদি উঠে বসত, আর গরু-চরানী মেয়েদের মনকে রাগকে আরও জ্বালিয়ে দিয়ে ফিক করে হাসত।

এহেন পল্টনী দিদির নাম করে মুরলী এখন যে ধিক্কার দিয়ে দাশু ঘরামির সন্দেহটাকে চমকে দিয়েছে, সেই ধিক্কারের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করতে গিয়ে দাশু ঘরামির পাগলাটে চোখ হঠাৎ নরম হয়ে ফ্যালফ্যাল করে।

মুরলীর শাড়িটা কোমর থেকে প্রায় খসে পড়ে গিয়েছে। দেখতে পায় দাশু, শাড়িব আড়ালে একটা সায়াও আছে। মুরলীর সায়াটার দিকে অপলক চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে দাশু; চোখের কোণে একটা সন্দেহের বেদনা আবার ঝিকঝিক করে জ্বলতে থাকে।

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী-আমি তেতরি ঘাসিন নই।

আবার চমকে ওঠে দাশু, কারণ, মুরলী আবার মধুকুপির একটা কলঙ্কের নাম করে দাশু ঘরামির গেঁয়ো অহংকারের উপর যেন আর-এক ঠাট্টার পাথর ছুঁড়ে মেরেছে।

মিঠুয়া ঘাসীর বউ সেই তেতরি ঘাসিনও বেঁচে আছে তা হলে! মনে পড়ে দাশুর, গ্রেপ্তার হয়ে এই গাঁ থেকে চলে যাবার সময় বাবুরবাজারের দিকে যেতে যেতে হলুদ রঙের ডাকবাংলাটার কাছে এসে পৌঁছতেই তেতরি ঘাসিনকে দেখতে পেয়েছিল দাশু। ঘাসের বোঝা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তেতরি। ছোট ময়লা একটা ছেঁড়া শাড়ি গায়ে জড়ানো। একটা গামছা কোমরে জড়িয়ে হেঁড়া-হেঁড়া শাড়ির ফাঁকগুলিকে ঢাকা দিয়েছে তেতরি। তেতরি উল্কিকাটা গলা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ভুলে যায় নি দাও, সেদিন দাশুর কোমরে দড়ি বাঁধা দেখে চমকে উঠেছিল, আর হাত তুলে চোখের জলও মুছেছিল তেতরি ঘাসিন।

 

 

শুধু কপালবাবার জঙ্গল নয়, পাঁচ ক্রোশ দূরে ওই যেখানে ডরানি এসে মস্ত বড় একটা ঝরনা হয়ে দামোদরের বুকে আছাড় খেয়ে পড়েছে, সেই চিত্রপুরের জঙ্গলেরও বুকের ভিতরের সব খবর রাখত তেতরির স্বামী মিঠয়া ঘাসী। গোবিন্দপুরের বাবুরা জানত, হারাণগঞ্জের গালাকুঠির সাহেবরা জানত, এদিকের আর ওদিকের সব থানা আর সব ডাকবাংলা জানত, মধুকুপির মিঠুয়া ঘাসীর মত ওস্তাদ খোজি এই তল্লাটে আর-কেউ নেই। জঙ্গলের কোথায় কোন্ ঘাসের ভিড়ে সম্বর চরে বেড়ায়, নতুন ভালুক এসে ডেরা নিয়েছে কোন্ মহুয়ার কাছে, কোথায় কোন্ জলার কাছে নোনা মাটি চাটতে আসে ডোরাকাটা বাঘ; কত শিকারীকে খোজ দিয়েছে আর ঠিক ঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে মাচান বাঁধবার ঠিক জায়গাটি বুঝিয়ে দিয়েছে মিয়া। মিঠুয়া যেন জঙ্গলের বাতাস শুঁকে জানোয়ারের গায়ের গন্ধ বুঝতে পারত; ভালুক না সোনাচিতা? নেকড়ে না বনবিড়াল? ছড়া লতার চেহারা দেখে, চিবানো পাতার চেহারা দেখে বলে দিত মিয়া, এটা বড় হরিণ নয়; ছাগলা হরিণ।

সেই মিয়াকে শেষ দেখতে পেয়েছিল গাঁয়ের লোেক, দাশু ঘরামিও দেখেছিল, বড়দিনের সময় রাতের বেলায় পুলিস সাহেবকে কপালবাবার জঙ্গলে শিকার খেলাতে নিয়ে গিয়ে সকালবেলা জঙ্গল থেকে যখন বের হয়ে এল মিয়া। জ্যান্ত মিঠুয়া নয়, মরা মিঠুয়া। চারজন সাঁওতাল কুলি, যারা পুলিস সাহেবের তাঁবু বয়ে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে গিয়েছিল, তারাই লতা দিয়ে বাঁধা মিঠুয়ার রক্তমাখা লাস কঁচা বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে গোবিন্দপুর থানার দিকে চলে গেল। হ্যাঁ, সেই ভালুকটার লাসও ছিল, পুলিস সাহেবের গুলি খেয়ে মরার আগে মিয়া ঘাসীর মাথার খুলি একটি থাবা দিয়ে চিরে আঁচড়ে একেবারে নামিয়ে দিয়েছিল।

তেতরি ঘাসিনের সেদিনের চেহারাটাও মনে পড়ে। সাঁওতালদের কাঁধের কাঁচা বাঁশে ঝোলানো মিঠয়ার সেই লাসের পাশে পাশে হেঁটে, গুন গুন করে কাঁদতে কাঁদতে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল তেতরি। গাঁয়ের লোকই শেষে বাধা দিয়ে তেতরিকে থামিয়েছিল : আর মিছা কেন যাচ্ছিস তেতরি? এবার ঘরে ফিরে যা।

সেদিন ডরানির স্রোতের কাছে গিয়ে হাত দুটোকে পাথরের উপর আছড়ে আছড়ে গালার মোটা মোটা বালা দুটোকে ভেঙে আর স্নান করে ঘরে ফিরেছিল মিঠুয়া ঘাসীর রাঁড়ি বউ তেতরি।

 

 

তারপর ওই হলুদ রঙের ডাকবাংলার দাবী মেটাতে গিয়ে নিশির ডাকের মত এক-একটা ডাক শুনতে শুনতে তেতরি ঘাসিন কবে আর কেমন করে বদলে গেল, সে খবরও গাঁয়ের লোকের টের পেতে বেশি দেরি হয় নি। ওই ডাকবাংলাতে কত শখের টুরিস্ট আসে, তদন্তের অফিসার আসে, কলকাতা থেকে শিকারী আসে। ডেকচি-ভরা মুরগীর কারি আর বোতল-ভরা মদ সামনে রেখেও ডাকবাংলার রাতের অতিথি উকট ক্ষুধায় ছটফট করে। খানসামাকে কাছে ডেকে এনে ফিস ফিস করে : আর একটা জিনিস চাই যে খানসামা। পাওয়া যাবে?

–চেষ্টা করলে পাওয়া যেতে পারে হুজুর।

–ভাল বকশিশ দেব, চেষ্টা কর।

–বহুৎ আচ্ছা হুজুর।

—দেখো, জিনিসটা যেন ভাল হয়।

–নিশ্চয় হুজুর।

খানসামার সাইকেল ছুটে চলে যায়, আর তেতরি ঘাসিনের ঘরের দরজার কাছে এসে ঘন্টি বাজিয়ে ডাকবাংলার রাতের বকশিশের আহ্বান শুনিয়ে দিয়ে যায়। দরজার কপাটে শিকল তুলে দিয়ে রওনা হয় তেতরি। গায়ে জ্বর থাকলেও এক ক্রোশ পথ হেঁটে সেই ভয়ানক অভিসারে যেতে হয়। গাঁয়ের কে না জানে, সারা মাসের মধ্যে অন্তত তিন-চারটে দিন এইভাবে রাতের বেলা ঘর থেকে বের হয়ে ডাকবাংলার এক-একটা মাতাল লালসার ছোবল খেয়ে শরীরটাকে বিষিয়ে ঘরে ফেরে তেতরি। দেখেছে গাঁয়ের লোক, ডাকবাংলার বকশিশের আহ্বানে ঘর থেকে চলে যাবার সময় কেমনতর সাজ করে তেতরি ঘাসিন। একটি লাল রঙের সায়া পরে।

দাশু ঘরামির ঘরের ভিতরে রেড়ির তেলের মেটে প্রদীপ মিটমিট করে। লুটিয়ে-পড়া শাড়িটাকে হাতে তুলে নিয়ে আবার গায়ে জড়াতে থাকে মুরলী। মুরলীর লাল সায়াটা দোলে। দাশু ঘরামির চোখের সন্দেহ নতুন বিস্ময়ে দুলতে থাকে; না না না, সেরকম কিছু নয়। তেতরি ঘাসিনের যে লাল সায়াতে ঘৃণার দাগ লেগে থাকে, যে সায়াকে ছাই-কাচা করেও ঘরের বেড়ার উপর মেলে দিতে লজ্জা পায় তেতরি, মুরলীর এই সায়া সেরকম সায়া নয়।

ঘরের চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে দাশু। ঝুড়িতে মকাইয়ের দানা আছে, মাটিরে সেই সরাগুলিও আছে। এই সব পুরনোর মধ্যে একেবারে নতুন ও দুর্লভ একটা নতুন জিনিসও আছে। সরার মধ্যে কয়েকটা আলু।

শাড়িটাকে শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মুরলী তেমনই অদ্ভুত এক অহংকারের আবেগে বলে ওঠে-আমি ফুলকি মাসি নই।

আর-এক ধিক্কার! মধুকুপির আর-একটা কলঙ্কের কাহিনীকে খুঁচিয়ে দিয়ে দাশু ঘরামিকে ভয়ানক একটা ঠাট্টা করেছে মুরলী।

তেজ-মরা সাপের মত মাথাটাকে আস্তে আস্তে ঢুলিয়ে তারপর কাত করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে দা। সেই ফুলকি মাসিও আছে তা হলে; দাশু ঘরামির সৎভাইয়ের আপন মাসি, সেই ফুলকি। ঈশান মোক্তারের ঘরে বাতি জ্বালতে যায়, যে ফুলকি। ঈশান মোক্তারও নিশ্চয় আজও আদালতের ছুটির দিনে মধুকুপিতে তার সম্পত্তির চেহারা দেখতে আর হিসেব নিতে, বকেয়া খাজনা তসীল করতে, পরবের ভেট নিতে, আর ফসলের ভাগ নিতে আসেন।

ঈশান মোক্তারের একটা কুঠি আছে মধুকুপিতে, সেই কুঠির কাছে পঞ্চাশ জোড়া বলদের একটা খাটাল আছে। এটাও ঈশান মোক্তারের সম্পত্তি। সেই খাটালের চারদিকে সারি সারি খড়ের মাচান, মাচানের ফাঁকে ফাঁকে এদিকে-ওদিকে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকে যেসব গোগাড়ি, সেগুলিও ঈশান মোক্তারের সম্পত্তি। যেমন ঈশান মোক্তারের জমিতে, তেমনি ঈশান মাক্তারের এই সব গো-গাড়িতে মধুকুপির গাঁয়ের মানুষ মনিষ খাটে। অনেকে আবার আধিয়া খাটে। ঈশান মোক্তারের জমিতে নিজের বীজ লাঙ্গলে ক্ষেত করলে যেমন মকাই কুরথি কোদো আর অড়হরের আধ ভাগ, তার গো-গাড়িতে খাটলে তেমনই ঢোলাই মজুরির আধ ভাগ তাকে দিতে হয়। ঈশান মোক্তারের বড় গোমস্তা দুখন গুরুজী আর দুজন মুহুরি খাতা হাতে নিয়ে কুঠির দাওয়ার উপর বসে হিসাব লেখে আর চিঠা ছাড়ে।

বছরের যে কটা দিন মধুকুপির কুঠিতে এসে ঠাঁই নেন ঈশান মোক্তার, সেই ক’টা দিন ফুলকি মাসির জীবনটাও একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ফুলকির স্বামী, সেই বেকুব খোঁড়াটা, সেই তিনকড়িও ব্যস্ত হয়ে ওঠে। নিজেই ড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঈশান মোক্তারের কুঠিতে যায়, দণ্ডবৎ করে, তারপর ঈশান মোক্তারেব দয়াব উপহার চাল ডাল আলু আর মাটির খুরিতে দুচার ছিটে নারকেল তেলও নিয়ে, আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরে ফিরে আসে।

ফুলকির জন্য কুঠির ভাণ্ডার থেকে মাসোয়ারী সিধা বরাদ্দ করা আছে। তা ছাড়া এক বিঘা বেলে জমি ফুলকিকে খয়রাত করেছেন ঈশান মোক্তার। বছরের অন্তত বিশটা দিন, রুক্ষ চুলের বোঝা খুলে মেলে দিয়ে নারকেল তেল মাখে ফুলকি। তারপর রান্না করে, খিচুড়ি আর আলু-হলুদ। সারা মধুকুপির মধ্যে একমাত্র ফুলকি মাসি ছাড়া আর কোন কিষাণ-কিষাণীর জীবনে আলু খাওয়ার সৌভাগ্য এখনও হয় নি। গোবিন্দপুরের গোল আলু অনেকে শুধু চোখে দেখেছে এই মাত্র।

ঠিক যখন সন্ধ্যা হয়, ওদিকে ঈশান মোর যখন তার কুঠির একটি ঘরের নিরালায় মাদুরের উপর গড়িয়ে পড়েন, এদিকে ফুলকি মাসি তখন হেসে হেসে তিনকড়ি খোঁড়ার হাতের কাছে খৈনির ডিবা এগিয়ে দিয়ে বলে-যাই, মোক্তারের ঘরে বাতি জ্বেলে আসি।

গাঁয়ের চোখ অন্ধ নয়; গাঁয়ের বুদ্ধিশুদ্ধিও বেকুব তিনকড়ির মত খোঁড়া হয়ে যায় নি। অনেক রাত করে যখন কুঠি থেকে ঘরে ফেরে ফুলকি, তখন গায়ের কেউ না কেউ দেখে ফেলে, পা টলছে ফুলকির।

–ভাল বাতি জ্বালছিস ফুলকি! একদিন ঠাট্টা করেছিল নটবর।

–এ মাগিকে কপালবাবা মরাবে কবে? গালি দিয়েছিল হরিশ।

কিন্তু গাঁয়ের এই সব ভীরু-ভীরু ধমক ঠাট্টা আর ধিক্কারকে একটুও ডরায় নি ফুলকি। দাশু ঘরামির ফুলকি মাসি আজও হলুদ-ছোপানো কাপড় পরে, রিঠার জলে গা মাজে, আর গালার রসে নখ রাঙায়।

–আমি ঝালদার মহেশ রাখালের বেটি। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী। মুরলীর দু চোখের তারায় অদ্ভুত এক দেমাকের তেজ ধিকধিক করে। কাত মাথা তুলে মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দাও।

–মহেশ রাখালের আর দুটা বেটি কেন মরেছে, ভুলে গেছ কি? কটকট করে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করে মুরলী।

জানে দাশু; মনে পড়তেই দাশু ঘরামির চোখে যেন একটা শ্রদ্ধার ব্যথা টলমল করে ওঠে। মুরলীর আরও দুটা বোন ছিল। একটা মুরলীর বড়, আর একটা মুরলীর ছোট-কুসুম আর কালিন্দী; ওরা দেখতে মুরলীর চেয়েও সুন্দর ছিল। দুজনের বিয়েও হয়েছিল।

কুসুম মরেছে গলায় দড়ি দিয়ে, এই পৃথিবীর একটা কুৎসিত মামলার লজ্জা ও যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে। সেই মামলার আসামী ছিল চিত্রপুর জঙ্গলের চারটে গার্ড। একদিন দুপুরে জঙ্গলের মহুয়া কুড়াতে গিয়ে যেন চারটে অজগরের লোভের সামনে পড়ে গাভিন হরিণীর মত কুসুমের শরীরটাও আতঙ্কে অসাড় হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, ঠিকই, সেই সময় কুসুমের পেটের ভিতরেও একটা নতুন প্রাণের পিণ্ড ধুকপুক করেছিল। কিন্তু জঙ্গলের চারটে গার্ড কোন বাধা মানে নি, মিনতি শশানে নি। কুসুমের আতঙ্কিত শরীরটাকে লুঠপাট করে তৃপ্ত হয়েছিল চারটে লোভের অজগর। থানায় এজাহার দিয়েছিল কুসুন, আদালতের আসামীর কাঠগড়ায় সেই চারটে পাপীকে দেখতেও পেয়েছিল; কিন্তু তাতে কুসুমের গায়ের জ্বালা বোধহয় মেটে নি। তাই, শেষে গলায় দড়ি দিয়ে…।

কালিন্দীর জীবনের মামলাটা একটু অন্য রকমের; মরে যাবার পর মামলা। কালিন্দী দেখে যেতে পারে নি, কিন্তু ঝালদার মানুষ দেখেছিল; আসামীটা গ্রেপ্তার হ’ল, চালান হ’ল আর চার মাসের মামলার পর ছাড়া পেয়ে চলেও গেল। বেশ টাকাপয়সা ছিল সেই আসামীর, এক ছোকরা কারবারী, ধুরকুণ্ডার ভাটিখানার ঠিকা নিয়েছিল যে ছোকরা। একজোড়া সোনার চুড়ি নিয়ে কালিন্দীর ঘরে ঢুকেছিল সেই ছোকরা। কিন্তু কিছুতেই রাজি হয় নি কালিন্দী, তাই সেই ছোকরার হাতের ছুরিতে খুন হয়েছিল কালিন্দী। লোকে বলে, মহেশ রাখালের বেটিগুলার তেজ আছে।

–মহেশ রাখালের বেটিরা পরের মরদানির থুতু গিলে না, পরের ছেইলা পেটে নেয় না। চোখ বড় করে কি দেখছো তুমি? কি ভাবছো তুমি?

মুরলীর দেমাক-ভরা কথার শব্দে কুণ্ঠিত হয়ে দাশু ঘরামির চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হয়ে যায়। হাত তুলে চোখ মোছে দাশু আর দেখতে পায়, কই? মুরলীর সেই পাঁচ বছরের আগের চেহারা তো একটুও ফোলে নি। শাড়ির আঁচল দিয়ে কোমরটাকে শক্ত করে জড়িয়েছে মুরলী, কত সরু কোমরটা। এক হাতে এক পাক দিয়ে জড়িয়ে ধরা যায়। মিথ্যে নয় মুরলীর অভিযোগ। সত্যিই দাশুর চোখ দুটো হঠাৎ যেন অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

–মুরলী! আস্তে আস্তে আদরের সুরে ডাক দেয় দাশু আর হাসতে চেষ্টা করে।

মুরলীর শক্ত চেহারাটাও এতক্ষণে একটু বিচলিত হয়। ঘরের কোণ থেকে খেজুর পাতার একটা চাটাই তুলে নিয়ে এসে মেজের উপর পাতে মুরলী; অভিমানের স্বরে গলা কাঁপিয়ে বিড় বিড় করে, পাঁচটা বছর পর ঘরে ফিরে এসে নিজের মাগকে এমন করে গালি দিতে নাই।

খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর বসে এবার নিজেকেই গাল দেয় দাশু–হা, জেলের ভাত খেয়ে মাথাটা যেন পাগলা কুত্তার মাথার মত…।

হেসে ফেলে মুরলী। দাশুও হেসে হেসে এইবার আসল বিস্ময়ের কথাটাকে শান্তভাবে বলে-কিন্তু, বুঝতে পারি না, তুই কেমন করে…।

মুরলী হাসে-কি?

দাশু–তুই বেশ সুখে আছিস মনে হয়।

মুরলী–হ্যাঁ, কেন থাকবো না? সুখের কাজে খাটছি। পনর টাকা, বিশ টাকা কামাচ্ছি।

দাশু ঘরামির চোখের বিস্ময় আবার চমকে ওঠে : কি করে? কেমন করে?

-হোই দেখ। হাত তুলে চার-পায়ার উপর রাখা সেলাইয়ের ছোট কলটাকে দেখিয়ে দেয় মুরলী।

দাশু বোকার মত তাকায় : ওটা তো একটা খেলার কল বটে। পল্টনীর ঘরেও একটা গানের কল আছে।

হেসে হেসে যেন গড়িয়ে পড়তে চায় মুরলী : গানের কল নয়, খেলার কল নয়, এটা একটা কাজের কল গো।

চার-পায়ার কাছে একটা কাপড়ের পুঁটলি পড়ে ছিল। হাত বাড়িয়ে পুঁটলিটাকে কাছে টেনে আনে মুরলী। পুঁটলিটাকে খুলে ফেলতেই দাশুর চোখ দুটো অপলক হয়ে, যেন আরও দুর্বোধ একটা বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কাপড়ের উপর নক্সার বাহার, এসব কি রে মুরলী?

-এর নাম লেস।

–কে দিলে?

–আমি বানিয়েছি।

–তুই?

–হ্যাঁ।

–কেমন করে?

–এই কলটা চালায়ে গো।

–কল চালাতে কে শিখালে?

–সিস্টার দিদি।

—সে আবার কে বটে?

–হারানগঞ্জের গির্জাবাড়ির মেম।

–তুই গির্জাবাড়ি যাস? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

–না, সিস্টার দিদি এখানে আসে।

–এখানে আসে?

–হ্যাঁ গো, এখানে বসে কত শোলোক গেয়েছে সিস্টার দিদি।

–খিরিস্তানী শোলোক?

–হ্যাঁ।

–তুই কি খিরিস্তান হয়েছিস? দাশু ঘরামির গলা কাঁপিয়ে একটা আর্তনাদ ঠিকরে বের হয়।

মুরলী হাসে–না।

মুরলীর সুড়োল হাতটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দুটো সন্দেহ-ভরা চোখ দিয়ে কি-যেন খুঁজতে থাকে দাশু। তারপরেই যেন ড়ুকরে ওঠে ও হাতে টিকা দেগেছিস?

–হ্যাঁ।

–কেন? তোকে তো আর আমার মত জেলে গিয়ে কয়েদী হতে হয় নাই।

–সিস্টার দিদি বললে।

–হাসপাতালের ওযুধও খেয়েছিস?

–মুরলী হাসে একবার খেয়েছি বটে।

–এই সব শাড়িজামা পরতে, আর…।

–সব, সব, সব সিস্টার দিদি শিখালে।

–এই সব নক্সা-টক্সা…।

-সব, সব, সিস্টার দিদির লোক এসে সব কিনে নিয়ে যায়।

–কলটা পেলি কোথা থেকে?

–সিস্টার দিদি ধারে পাইয়ে দিলে।

–ধারের টাকা শুধবি কেমন করে?

–শুধে দিয়েছি।

–এক-একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে যেন দাশুর বুকের এক-একটা পাঁজর ফেটে গিয়ে আর্তনাদ করছে। আর, প্রশ্নের উত্তর শুনতে শুনতে ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে বুকের নিঃশ্বাস। কী ভয়ানক বদলে গিয়েছে মুরলী!

আস্তে আস্তে গলা কাঁপিয়ে আবার প্রশ্ন করে দাশু–তোর কি খিরিস্তান হবার সাধ হয়েছে?

মুরলী-হলে ভাল হয়।

আর চেঁচিয়ে উঠতে পারে না দাশু। বুকের ভিতরের সব নিঃশ্বাস ভীরু হয়ে গিয়েছে। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে দাশু কপালবাবাকে কি তোর একটুকও ডর লাগে না?

মুরলী হেসে ফেলে ও ভরাবো কেন গো? কি পাপ করেছি যে ডরাবো?

মুরলীর মনে আবার একটা সন্দেহ চমকে ওঠে : তুই কি লিখাপড়াও শিখেছিস?

মুরলী–না; সিস্টার দিদি বলেছে, এইবার শিখাবে।

যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে দাশুর কলিজার ধুকধুক শব্দ। মুরলীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে ভয় করে। একান্ন টাকা পণ দিয়ে কিনে আনা মহেশ রাখালের মেয়ে নয়। ছোট একটা গামছা কোমরে জড়িয়ে, আদুড় গায়ে, দাশুর বুকের উপর লুটিয়ে পড়ত যে নারী, সে নারী নয়। মুরলীর প্রাণটাই মেমসাহেব হয়ে গিয়েছে। এই মেটে ঘরের ভিতরে শাড়ি-জামা গায়ে দিয়ে একটা শৌখিন অহংকার বসে আছে। গোবর-ঘাঁটা হাত ধুয়ে ফেললেও মুরলীর সে হাতে যে মিষ্টি গন্ধ মাখা হয়ে থাকত, ওই টিকা-দাগা আর কল-চালানো হাতে সে মিষ্টি গন্ধ মরেই গিয়েছে।

ফুলেল তেল আর আলতার ধারা গাঢ় রক্তের ধারার মত ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে পুলিশ এসে ঘরে ঢুকলে সন্দেহ করবে, একটা খুন হয়েছে বোধহয়। হ্যাঁ, দাশুর পাঁচ বছরের উপপাসী একটা আশা খুন হয়ে গিয়েছে। এই মুরলীকে ছুঁতে ইচ্ছা করে না, ছুঁতে ভয় করে। মুরলীর সরু কোমরটাকে দেখেও কোন লাভ হয় না, সাহসও হয় না; ওটা যে একটা বাবুমানুষের বউয়ের কোমর; একটা দেশী মেমসাহেবের কোমর। এখন মনে পড়ে, বুঝতেও পারে দাশু, ঠিকই বলেছিল নিতাই মুদি-ঠকবি। ঠকেছে দাশু; দাশুর বউ মুরলী জাতের বাইরে অনেক দুরে আর অনেক উপরে চলে গিয়েছে। দাশু ঘরামির চাষাড়ে হাতের যে-কোন ইচ্ছাকে এখন অনায়াসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে মুরলী। লোকের চোখে দাশুকে মুরলীর চাকর বলে বোধ হবে; আর মুরলীও…।

সত্যিই কি তাই ভাবছে মুরলী? দাশুকে ঘরের মরদ বলে মনে করতে পারছে না? দেখতে পায় দাশু, মুরলী চুপকরে চোখ দুটোকে ভয়ানক উদাস করে দিয়ে কি-যেন ভাবছে। আর, মাঝে মাঝে নতুন গেঞ্জি গায়ে দেওয়া দাশুর রুক্ষ ও শক্ত চেহারাটাকে চোখের কোণ দিয়ে দেখছে।

দাশু বলে–কি ভাবছিস?

মুরলী কিছু না। তুমি এবার কিছু খেয়ে নাও আর শুয়ে পড়।

দাশুর ঘাড়ের রগগুলি যেন হঠাৎ আহত হয়ে দপদপ করে? কোন্ ঠাঁই শুব?

–এই তো চাটাই বিছিয়ে দিয়েছি।

–আর তুই বুঝি বিছানায় শুবি?

উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ যেন ভাষা হারিয়ে বিড়বিড় করে মুরলী : তা তুমি যদি রাগ কর, তবে নাই বা বিছানায় শুলাম।

–কিন্তু শুবি কোন্ ঠাই? মাটিতে?

–সে যেথা পারি এক ঠাঁই শুয়ে নিব আমি।

–আমার ঠাঁই শুবি না?

উত্তর না দিয়ে চুপ করে আর মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে মুরলী। দাশু বলে–আমাকে ছুঁতে তোর আর সাধ নাই মুরলী, বটে কি না?

আবার ভয়ে ভয়ে বিড়বিড় করে মুরলী-সাধ কেন হবে না? কিন্তু আজ নয়।

দাশু–আজ নয় কেন?

মুরলী-সিস্টার দিদি বলেছে।

দাশু–কি বলেছে?

মুরলী-তুমি কলে কাজ নিবে, ভাল মানুষ হবে, খিরিস্তান হবে, তারপর।

মধুকুপির কিষাণ দাশুর মাথার উপর যেন একটা চাবুক আছড়ে পড়েছে। জ্বলে যাচ্ছে মাথাটা। মুরলীর কাছে আজ অমানুষ হয়ে গিয়েছে মধুকুপির সবচেয়ে তেজী দেমাকী আর মজবুত কিষাণ এই দাশু ঘরামি। দাশু আজ মুরলীর জীবন ও যৌবনের মরদ নয়; একটা মনিষ মাত্র।

খেজুর-পাতার চাটাই ছেড়ে একটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় দাশু। চমকে ওঠে মুরলী : কি হলো?

দাশু বলে—তুই থাক্‌, আমিই যাই।

–কোথায় যাবে? মুরলীও আতঙ্কিত হয়ে দাঁড়ায়।

–দাশু ঘরামি আর তোর সোয়ামী নয়।

বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে দরজার কপাটে হাত দেয় দাশু। এক টান দিয়ে কপাটের হুড়কো নামিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে-মহেশ রাখালের বেটি মুরলীও আর দাশু ঘরামির মাগ নয়।

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী—যেও না, থাম, কথা শুন।

আহত জানোয়ারের মত ছটফট করে একটা লাফ দিয়ে দরজা পার হয়ে চলে যায় দাশু।

ছুটে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দেয় মুরলী-যেও না, তোমার পায়ে পড়ি, এত রাতে ঘর ছেড়ে যেও না।

মধুকুপির মাটিতে শেষ রাতের চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। দাশুর টুকরো হালকা ছায়া হয়ে বাইরের বাতাসে মিশে যাবার জন্যে ছুটে বের হয়ে যায়।

সেই মুহূর্তে শব্দ করে শিউরে ওঠে সড়কের পাশে বাঁশঝাড়ের শুকনো পাতা। আর, একটা প্রকাণ্ড কালোছায়ার পিণ্ড বাঁশঝাড়ের ভিতর থেকে লাফ দিয়ে সড়কের ধূলোর উপর এসে দাঁড়ায়। জ্বলজ্বল করে এক জোড়া সবুজ আগুনের চোখ। একটা গোটা চোখ, আর একটা নিভু নিভু চোখ।

–কানারানী! কানারানী! চিৎকার করে দরজার কপাটে মাথা ঠুকতে থাকে মুরলী। দেখতে পেয়েছে মুরলী, দাশুর সেই ছায়ামূর্তির একেবারে সামনে, মাত্র দশ হাত দূরে পথ আটক করে কানারানীর দু চোখের রক্তলোলুপ আশা জ্বলজ্বল করছে।

–এসো, এসো, জলদি ফিরে এসো গো! তোমার সামনে যে যম সঁড়িয়ে আছে গো। কেঁদে চেঁচিয়ে উতলা হয়ে ডাকতে থাকে মুরলী।

কিন্তু এক পাও নড়ে না দাশু। মধুকুপির একটা চাষাড়ে অভিমান যেন ইচ্ছে করে কানারানীর থাবার কাছে লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত হবার জন্য একটা প্রতিজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মুরলীর চোখ দুটোও হঠাৎ যেন এক নতুন আক্রোশে দপ করে জ্বলে ওঠে। ছুটে এগিয়ে যায় মুরলী। মুরলীর শাড়িটা কাটার ঝোপে ফেসে গিয়ে ঝোপের গায়ে আটকে যায়। খোঁপা ভেঙে গিয়ে চুলগুলিও এলোমলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। দাশুর একটা হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মুরলী।

সবুজ চোখের আগুন দুলিয়ে একটা লাফ দিয়ে পিছনে সরে যায় কানারানী, তারপর অলসভাবে একটা হাই তুলে আবার সেই জ্বলন্ত চাহনি একেবারে সুস্থির করে সোজা তাকিয়ে থাকে।

দাশুকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে ঘরের দরজার কাছে এসেই একটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয় মুরলী; হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার কপাট বন্ধ করে দিয়ে দাশুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে।

রেড়ির তেলের ছোট বাতিটার বুকেও যেন একটা আতঙ্কের শিহর ছুটে এসে লাগে। গরম রেড়ির তেল ফুট করে একটা শব্দ ছাড়ে। নিভে যায় বাতিটা। আতঙ্কিত মুরলীও যেন আর্ত শরীরের সব ঠক ঠক কাঁপুনিদাশুর বুকের উপর ঢেলে দিয়ে ফিসফিস করে ও তোমার হাত দুটো কই গো? আমাকে জড়িয়ে ধরছো না কেন?

দাশু ঘরামির বুকে আতঙ্ক নেই। হাত দুটোও উদাস ও অঙ্গ। মুরলীর এই আবেদন একটা চালাক কুম মাত্র। সায়া-পরা আর জামা–গায়ে-দেওয়া একটা অচেনা মেয়েমানুষ দাশু ঘরামির চাষাড়ে হাত দুটোকে শুধু একটা দরকারের কাজে খাটিয়ে নেবার চেষ্টা করছে।

বুঝতে পারে না মুরলী, কানারানী এখনও পথের উপর দাঁড়িয়ে আছে, না, চলে গিয়েছে। কে জানে, হয়তো আরও কাছে এগিয়ে এসেছে কানারানী। রাক্ষুসে ক্ষুধার প্রকাণ্ড একটা হাঁ এই জামকাঠের জীর্ণ কপাটের কাছে থাবা পেতে বসে আছে। কিংবা সেই কর্কশ গোঁপের কাটাকাটা রোঁয়া বুলিয়ে কপাটটাকে শুকছে। এক জোড়া চোখের একটা চোখ কটকট করে জ্বলে, আর একটা চোখ নিভু নিভু বাতির মত জ্বলে। উঃ, কী ভয়ানক ধূর্ত কানারানীর রাতের বেলার এই মুখটা!

-আমি যে পড়ে যাব গো! দাশু কানের কাছে আবার কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে মুরলীর আতঙ্কিত প্রাণের একটা দুঃসহ অভিযোগ। মুরলীর নিঃশ্বাসের শব্দে যেন একটা রাগ ফিসফিস করে।

দাশু আস্তে আস্তে বলে-বসে পড় না কেন?

মুরলীকে বসে পড়তে বলতে পারে; মুরলীকে অনায়াসে বুকের কাছ থেকে নামিয়ে দিতে একটু আপত্তি নেই দাশু ঘরামির? পাঁচ বছর জেল খেটে মাথাটাকে কী ভয়ানক খারাপ করে এসেছে দাশু। মুরলীর আতঙ্কিত শরীরটা এইবার যেন অভিমানের জ্বালায় ছটফট করে আরও জোরে দাশুকে আঁকড়ে ধরে। আর দাশুর কানের কাছে তপ্ত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে একটা ধিক্কারও দেয় : তুমি এমন কশাই হয়ে গেলে কেন গো?

ধিক্কারটা যেন বাঘিনী কানারানীর ভয়ে মুরলীর প্রাণের একটা বাজে অভিযোগের কাতর বিলাপ। কোন অর্থ হয় না। দাশুর হাত দুটো মুরলীকে জড়িয়ে ধরতে পারবে কেন? এমনটা আশা করে কেন মুরলী? এর মধ্যে কশাইপনা কোথায়? কশাই হয়েছিল দাশু, যখন টাঙ্গি হাতে তুলে নেবার জন্য লাফালাফি করেছিল।

কিন্তু চমকে ওঠে দাশু। কাঁধের উপর যেন গরম জলের ছোঁয়া লেগেছে। ভিজে গিয়েছে দাশু ঘরামির গায়ের নতুন গেঞ্জির সুতো।

-এ কি? তুই কাদলি কেন? দাশু ঘরামির হাত দুটো যেন হঠাৎ-মায়ায় চমকে ওঠে আর মুরলীর নরম শরীরটাকে বুকের উপর শক্ত করে সাপটে ধরে।

আস্তে আস্তে, এক একটা নিঃশ্বাসের শব্দের সঙ্গে ছন্দ রেখে মুরলীর ভয়াতুর শরীরের কাঁপুনিও শান্ত হয়ে আসতে থাকে। দাশুর দুই শক্ত হাতের বাঁধনে বাঁধা হয়ে যেন ঘুমিয়ে পড়তে চায় মুরলী। দাশু বলে-ডর কেন? কিসের ডর?

সত্যিই ডর নেই। কপাটের ওপারে কানারানী দাঁড়িয়ে থাকলেও মুরলীর মনে আর কোন ডর নেই। মুরলীর শরীরটা যেন নতুন নির্ভয়ের সুখে একেবারে জমাট হয়ে দাশুর বুকের উপর পড়ে থাকতে পারছে। সেই ভয়াতুর ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের শিহরও একেবারে মরে গিয়েছে।

–তোর গা-টা এত গরম কেন? জ্বর হয় নাই তো? হঠাৎ উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করে দাশু।

মুরলী বলে–হ্যাঁ, জ্বর বটে।

দাশু–-কেন জ্বর হলো?

মুরলী—জান না?

দাশু–না।

মুরলী—বোকা বটে তুমি।

মিলনের আগে দাশুর আবদারে মুরলী পুরানো পোশাক পরে নাচ দেখায়-গান শোনায়।

না, বোকা নয় দাশু। পাঁচ বছর ধরে জেলের কয়েদী জীবনের কম্বলের উপর রাত কাটিয়ে মুরলীর শরীরের সেই মিষ্টি জ্বরের স্বাদ ভুলে যেতে পারে নি দাশু। ভুলে যাওয়া দূরে থাকুক, মুরলীর গায়ের এই জ্বর-জ্বর উষ্ণতার স্বাদটিকে যে ঘুমের মধ্যেও ভোগ করেছে দাশু। কিন্তু আজ বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। মুরলীর গায়ের এই জ্বর সেই জ্বর নয়। বাঘিনী কানারানীর ভয়ে ভীতু হয়ে আর ঘাবড়ে গিয়ে দাশুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে মুরলী। এই জ্বর শুধু একটা ভয়ের জ্বর।

মুরলীর মাথার এলোমেলো চুলগুলি দাশুর মুখের কাছেই ছড়িয়ে রয়েছে। মুরলীর চুলে নতুন তেলের গন্ধ; অচেনা গন্ধ। এই গন্ধও একটা ঠাট্টা; দাশুর জীবনের ভয়ানক নতুন ব্যথাটাকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে; পর হয়ে গিয়েছে মুরলী। মুরলীর মাথার কাছ থেকে মুখটাকে সরিয়ে নিয়ে শুকনো একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে দাশু।

ঘামে ভিজেছে, একটু সেঁতসেঁতে হয়েছে মুরলীর হাত দুটো। পিছল সাপের মত আস্তে আস্তে গা-মোড়া দিয়ে মুরলী হঠাৎ বলে ওঠে—ছাড়।

ছেড়ে দেয় দাশু। আর, নিজের অপমানিত হাত দুটোকে যেন একটা কামড় দিয়ে আরও শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে। মুরলীর চোখের জলকে বিশ্বাস করে মায়া করতে গিয়ে দাশুর প্রাণ আবার একটা ঘৃণার মার খেয়েছে। দরজার দিকে তাকায় দাশু। এখনি, কপাটের হুড়কো একটানে নামিয়ে দিয়ে…।

এ কি! চমকে ওঠে দাশু। বুকের উপর এ কোন স্পর্শের স্বাদ ঝাঁপিয়ে পড়ল! এ যে সেই মুরলীর গায়ের নরমনরম স্বাদ! শাড়িতে জামাতে আর সায়াতে সাজানো নকল মুরলী নয়। গামছা গায়ে জড়ানো লাজুক মুরলীও নয়। যেন পাঁচ বছরের অদেখার সব রাগ একেবারে আদুড় হয়ে দাশু ঘরামির বুকের উপর লুটিয়ে পড়েছে।

দাশুর বুকের উপর ছোট্ট একটা দাঁত-ফোঁটানো কামড়ের জ্বালা চিন্ করে শিউরে ওঠে। মুরলীর সেই পুরনো অভ্যাস। দাশুর শরীরের সব রক্তের স্বাদও সেই মুহূর্তে মিষ্টি হয়ে যায়। মুরলীর মাথার উপর মুখটা নামিয়ে দিতেই দাশুর সব উদ্বেগ মিটে যায়। সেই মুরলী, মুরলীর ঘামে-ভেজা কপালে সেই পুরনো গন্ধ। দাশুর নিঃশ্বাসও মুরলীর চুলের সেই বুনো ছড়াছড়ির মধ্যে লুটিয়ে পড়বার জন্য ছটফট করে ওঠে। মুরলীর চোখ-মুখ-কপাল আর ঘাড় শুঁকে শুঁকে অতীতের একটা আদুরে গন্ধকে খুঁজতে থাকে দাশু।

মুরলী বলে-এসো।

দাশুর হাত ধরে টান দেয় মুরলী। দাশুর হাতের সব কুণ্ঠা সেই মুহূর্তে ঝরে পড়ে যায়। এই মুরলীকে বুঝতে কি-ভয়ানক ভুল করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল একটা বোকা সন্দেহের মন!

এক হাতের এক পাক দিয়ে মুরলীর কোমরটা জড়িয়ে ধরতেই মনে পড়ে যায় দাশুর; পাঁচ-পাঁচটা করম পার হয়ে গিয়েছে, এই কোমরে আঁচল জড়িয়ে কত ঝুমুর নেচেছে মুরলী, কিন্তু মুরলীর এই সরু কোমরের দোলানি চোখে দেখতে পায় নি দাশু। শুধু জেলের বাগানে কাজ করতে করতে জাগা চোখের স্বপ্নে মুরলীর নাচ দেখেছে।

বিছানাটার কাছে এগিয়ে যেতেও আর কোন কুণ্ঠা নেই। মুরলী যেন পাঁচ বছরে ধরে একটা মানত করে দাশুর জন্যই একটা আদরের সিংহাসন তৈরি করে রেখেছে।

রাতটা বড় স্তব্ধ। বাইরের বাঁশের ঝাড়েও কোন পাগলা হাওয়া হুটোপুটি করে না। চালার গায়ে ছোট ছোট ফুটো আর ফাটলগুলি খুশি হয়ে হাসছে মনে হয়; বাইরের ফিকে চাঁদের আলো চালার ফুটো-ফাটল দিয়ে ছুঁয়ে পড়তে চেষ্টা করছে। মুরলী বলে–বেশ তো পাগল হয়েছে, তবে আর কেন…।

আর একটা মুহূর্তও দেরি করতে চায় না মুরলী। আর দেরি করলে হয়তো কাক ডেকে উঠবে, ভোর হয়ে যাবে, মুরলীর মানত নষ্ট হয়ে যাবে।

দাশু বলে-তুই বা কি কম পাগল?

মুরলী বলে–চুপ।

অনেকক্ষণ পরে যখন ঘরের চালার ফুটো-ফাটল দিয়ে বাইরের আলোর চোরা হাসির ঝরানি বন্ধ হয়ে যায়, তখন ডাক দেয় দাশুকথা বল মুরলী।

মুরলী বলে—চুপ।

দাশু হাসে–আবার চুপ হতে বলছিস কেন?

মুরলী-হ্যাঁ আবার।

আপত্তি করে না দাশু। মুরলীর পাগল ইচ্ছার রকম দেখে দাশুর শক্ত চেহারার স্নায়ু ও শোণিতের ভিতরে যেন নতুন করে মত্ততার ঝুমুর বাজতে শুরু করে। বেশ তো! কি ভেবেছে মুরলী? মধুকুপির জোয়ান কিষাণ দাশু ঘরামির উপপাসী লোভের জোর পরীক্ষা করে দেখতে চায়? তবে দেখুক মুরলী, বুঝুক মুরলী, এই দাশু সেই পাঁচ বছর আগেরই দাও। পাঁচ বছর জেল খেটেও দাশু ঘরামির রক্ত একটুও শুকিয়ে যায় নি।

তারপর…মুরলীর দুই চোখের উপর যখন নিবিড় ক্লান্তির সুখ ঘুমভারে অলস হয়ে যায়, ঠিক তখন রাতের মধুকুপির নিরেট স্তব্ধতাকে হঠাৎ আহত করে অনেক দূরে একটা আতঙ্কের শব্দ চাপা হুল্লোড়ের মত বেজে ওঠে। শব্দটা আসছে মান্‌ঝিদের পাড়ার দিক থেকে। একসঙ্গে এক শো টিনের উপর ঠেঙার বাড়ি মেরে হৈ-হৈ করছে মান্‌ঝিরা।

দাশু বলে-শুনছিস?

মুরলী–কি?

দাশু–কানারানী ভেগেছে।

আনমনার মত আর আধ-ঘুমে জড়ানো স্বরে বিড়বিড় করে মুরলী-কেন?

দাশু হাসে–খুব খুশি কানারানী।

মুরলী—কেন গো? গা-মোড়া দিয়ে দাশুর হাত ধরে আদুরের স্বরে প্রশ্ন করে মুরলী।

দাশু হেসে ওঠে–বুঝলি না।

মুরলী–না।

দাশু–তোর আমার নতুন বিয়া দিতে কানারানী এসেছিল।

আবার একটা আর্তনাদের হুল্লোড়। একসঙ্গে ছটফট করে এক পাল গরু ডাকতে শুরু করেছে। গাঁ-গাঁ করে যেন লাফালাফি করছে, ছুটছে মুখ থুবড়ে পড়ছে, এক গাদা ভীরু করুণ। আর আলুথালু শব্দ।

–শুনছিস মুবলী? দাশু ডাকে।

মুরলী–কি?

দাশু–ঈশান মোক্তারের গরুগুলার খবর নিচ্ছে কানারানী।

মুরলী শক্ত করে দাশুর একটা হাত আঁকড়ে ধরে।

দাশু–ডর লাগছে কি? মুরলী?

মুরলী–না, চুপ কর।

–কি বললি?

–ঠিক বলছি।

–সত্যি তো?

–হ্যাঁ।

দাশু ঘরামির শক্ত বুকের পাঁজরগুলিকে যেন আবার সোনার কাঠি ছুঁইয়ে অভ্যর্থনা করেছে মুরলী। বোধহয় মুরলীর প্রাণের একটা দীর্ঘ অপেক্ষার পিপাসা বার বার উতলা হয়ে উঠছে। তাই দাশুকে এক অফুরান উপহারের দেবতা বলে মনে করে বার বার আকুল হয়ে ডাকছে। বেশ ভো, দাশুর প্রাণেও কোন অনিচ্ছা নেই, শরীরেও ক্লান্তি নেই।

একটা কাকের ডাক শোনা গেল যখন, তখন দাশুর ঘুম-জড়ানো চোখের ক্লান্তিটা একটা চমক লেগে টলমল করে ওঠে। মধুকুপির আকাশটাই যেন হঠাৎ হাঁক দিয়ে একটা প্রচণ্ড গম্ভীর প্রতিধ্বনি গড়িয়ে দিয়েছে। নিশ্চয় বড় কালুর মাথার উপরে উঠে ডাক ছেড়েছে কানারানী। বড়কালুর পাথর কাঁপে, সেই সঙ্গে সারা মধুকুপির বাতাসও কাঁপে। কানারানীর গর্জনের রেশ গড়িয়ে গড়িয়ে কপালবাবার জঙ্গলের বাতাসে মিশে যায়।

দাশু ডাকে—নিঁদ গেলি নাকি?

মুরলী না। এবার নিঁদ যাব।

দাশু–কানারানীর হাঁক শুনেছিস?

মুরলী–শুনেছি।

দাশু–শুনেছিস তো, বুঝেছিস কিছু?

মুরলী–বুঝেছি; খুব খুশি হয়েছে কানারানী।

দাশু–কেন খুশি হয়েছে?

হেসে ফেলে মুরলী–তোমার মুরলীর পেটে ছেইলা এসে গেল তাই।

দাশুর বুকের ভিতরে যেন একটা রঙীন আশার উল্লাস লাফিয়ে ওঠে। কপালবাবার কাছে অনেকবার অনেক মানত করেও হতাশ হয়ে গিয়েছিল মুরলীর যে সাধ, সে সাধ এতদিনে সফল হবে তবে? চেঁচিয়ে ওঠে দাশুএ কি কথা বললি মুরলী? কেমন করে বুঝলি?

মুরলী-তোমার মুরলীর হাড়মাস এত মিঠা হয়ে আর কোনদিনও গলে নাই। বুঝতে পিরবো না কেন গো?

মুরলীর মাথাটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে দাও; মুরলী হাসে ও দেখো, যেন আবার টাঙ্গি হাতে নিয়ে তেড়ে এসো না।

দাশু রাগ করে : ছি, কেন আবাব ওসব রাগের কথা বলছিস?

মুরলী-আর রাগ করবে না তো?

দাশু–কেন রাগ করবো?

মুরলী-যদি মুরলী সরদারিনের কোমর মোটা হয়?

হবে তো, একশোবার হবে। মুরলীর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বোলায় দাশু।

ঘুমিয়ে পড়ে মুরলী। মুরলীর মুখটাকে একবার ভাল করে দেখার চেষ্টা করে দাশু, আর, আবছা অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পায়, মুখভরা হাসি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মুরলী।

জেগে থাকতে চেষ্টা করে দাশু, কারণ মুরলীর মুখটাকে বার বার দেখে নিজেরই জীবনের একটা তৃপ্তির পূর্ণতা বার বার প্রাণের ভিতরে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে। মুরলীর ছেইলা হবে; কপালবাবার কাছে সাদা ছাগ বলি দেবে দাশু। একটা দিনও ঘরে বসে না থেকে, গো-গাড়ি হাঁকিয়ে তোক আর মাঠান কুলের জঙ্গলটায় লা-পোকার উঁটি ভাঙবার ঠিকা নিয়ে হোক, কিছু টাকা দুতিন মাসের মধ্যে যোগাড় করতেই হবে।

না হয়, ঈশান মোক্তারের কুঠিতে গিয়ে নতুন করে একটা চিঠা নিতে হবে। ডরানির ওপারে বিঘা পাঁচেক, অন্তত বিঘা তিনেক দো-আঁশ যদি ভাগজোত করতে পাওয়া যায়, তবে ছয় মাসের মধ্যে একটা ফসল তুলতে পারা যাবে। কে জানে, আজকাল সরু ধানের কী দর দিচ্ছে মানপুরের পাইকারেরা?

কিন্তু ভাগজোতে পেট ভরুক বা না ভরুক, মনটা যে একটুও ভরে না। ফলন শেষ হয়, ফসল তোলা হয়, ব্যস, জমিটা আবার পর হয়ে যায়। আবার ঈশান মোক্তারের কুঠিতে গিয়ে নতুন করে চিঠার জন্য হাত পাততে হয়। আবার চিঠা না পেলে ঐ জমিতে হাল ছোঁয়াবার উপায় থাকে না।

কোর্ফা হলে তবু মনটা যেন একটুখানি ভরে। জমিটাকে একটু আপন-আপন মনে হয়। ডরানির এপাশে ঈশান মোক্তারের তিন বিঘা ঢালু গরঞ্জি; ওপাশে আছে দো-আঁশের কানালি। ভাল ধান ফলে, ঝাজলি আর কালিশ। কিন্তু অন্তত পঞ্চাশটা টাকা সেলামি না দিলে ঈশান মোক্তার কি দাশুকে কোফা করে নিতে রাজি হবেন?

কিন্তু সুরেন মান্‌ঝির মুখের সেই যন্ত্রণার ছবিটাও মনে পড়ে। পর পর দু বছরের সাজা দিতে কামাই করেছিল ঈশান মোক্তারের কোফা রায়ত সুরেন। সালিয়ানাও বাকি পড়েছিল। মুহুরিটা একদিন এসে সুরেনের ঘরের আঙ্গিনায় উঠে দাঁতমুখ খিচিয়ে গর্জে উঠেছিল—বেটিটা তত বেশ ডাগর হয়েছে, সেটাকে ভাড়া খাটিয়ে টাকা আনিস না কেন, আর সাঁজা উসুল করিস না কেন সুরেন?

টাঙ্গি হাতে নিয়ে মুহুরর দিকে তেড়ে গিয়েছিল সুরেন।

তার পরেই নোটিস হল। ক্ষেতি-খামার করবার সাধ এ জন্মের মত ছেড়ে দিয়ে সেই যে মনিষ হয়ে গেল সুরেন, তার পর থেকে সে শুধু কপালবাবার জঙ্গলের মরা শাল কুড়োয়।

না, কোফা হলেও কোন সুখ নেই। তাতেও নোটিশের ভয় আছে সালিয়ানা জমা দিতে একটু দেরি হলেই জমির আলের উপর গিয়ে দাঁড়াবারও অধিকার থাকবে না, এমন অভিশাপের মধ্যে ক্ষেতি-খামার করতে না যাওয়াই ভাল।

বিঘা দুয়েক জমি কি কিনতে পারা যায় না? দাশুর ক্লান্ত চোখের পাতায় পাতায় যেন একটা পুরনো স্বপ্নের সাধ ঝির ঝির করে। জমি পেতে হবে। দো-আঁশ হোক, বেলে হোক, এঁটেল বা মেটেল হোক, জমি চাই। গুলঞ্চের বেড়া হলে ভাল হয়। জিরে বুনতে পারা যাবে, সোনার দানার মত জিরে। আখ না হোক, সরগুজা হবে। হলদে ফুলে ছেয়ে যাবে পৌরুষের ক্ষেত। ক্ষেতের বেড়ার কাছে ছুটোছুটি করে চোর খরগোশ ধরে ফেলবে মুরলী, আর খরগোশটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠবে।

না, খরগোশ কেন? খরগোশ কোলে নিয়ে হাসবার আর দরকার হবে না মুরলীর। দাশু ঘরামির স্বপ্নাতুর চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছে, খরগোশেরই মত তুলতুলে নরম একটি জিনিসকে, দাশুর ছেইলাকে কোলে নিয়ে হাসছে মুরলী।

আরও কত কী না ভাবতে ইচ্ছা করে। নতুন মাদল কিনতে হবে। করম নাচবে মুরলী। ভাদুরে বৃষ্টি নামবে আর থামবে। ছোটকালুর মাথার উপর আকাশের এপার ওপার জুড়ে রামধনু ফুটবে। দাশুর কাঁধের উপর ছেইলাটা, বুকের কাছে মাদলটা, আর পাশে পাশে মুরলী। সরগুজা-ক্ষেতের বেড়ার কিনারা দিয়ে সরু ঘেসো পথ ধরে আখড়ার দিকে যেতে যেতে দাশুর মাদল বাজবে–ধিতাং ধিতাং–

খট্‌ খট্‌ খট্‌! যেন দাশু ঘরামির স্বপ্নের উপরে শক্ত শব্দের আঘাত। খট খট খটকী কর্কশ শব্দ! ধড়ফড় করে জেগে উঠেই চোখ মোছে আর গভীর ঘুমে অলস মুরলীর শরীরটাকে একটা ঠেলা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–ওঠ, জলদি ওঠ মুরলী।

চোখ মেলে চমকে ওঠে মুরলী : কি হলো?

–কপাট টুকছে কে!

–কে? কে? আতঙ্কিত হয়ে বিছানার উপর উঠে বসে মুরলী। চালার ফুটো দিয়ে সকালবেলার রোদ ঘরের ভিতরে চুইয়ে পড়েছে। নিজের চেহারাটা চোখ পড়তেই পোড়াসাপের মত ছটফটিয়ে ওঠে মুরলী। ছিঃ, কী বেলাজ বুনো চেহারা! মাদি হরিণের মত একেবারে নিরাবরণ একটা শরীর হয়ে এ কোন্ জঙ্গলের ঘাসের উপর একটা জংলী ইচ্ছার গা ঘেষে শুয়ে আছে মুরলী? এ ভুল কখন হল? কেন হল? পাঁচ বছর কয়েদ খেটে ঘরে ফিরে আসা এই মানুষটা কি মুরলীকে ধুতরা খাইয়ে বেহুস করে দিয়েছিল?

মুরলীর একটা হাত ধরতে চেষ্টা করে দাশু, আর কথা বলতে গিয়ে গলার স্বরটাও ভীরু হয়ে যায়, পুলিস এসেছে।

মুরলী-তোমার কপাল এসেছে।

বলতে বলতে দাশুর হাতটাকে যেন একটা কঠোর তুচ্ছতার আঘাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায় মুরলী, সায়াটাকে হাতে তুলে নেয়, শাড়ি খুঁজতে থাকে।

মুরলীর চোখ মুখের নিষ্ঠুরতা দেখে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে দাশু : তুই এত রাগলি কেন মুরলী? গোবিন্দপুর থানাতে হাজিরা না দিয়ে সোজা ঘরকে চলে এলাম, তাই খবর নিতে পুলিস এসেছে।

সায়া শাড়ি জামা দিয়ে শরীরটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে, চিরুনি হাতে নিয়ে চটপট করে চুল আঁচড়ে নিয়ে, আর চটি পায়ে দিয়ে, একটা ভয়ানক জাদুবেলার বিস্ময়কেও হার মানিয়ে দিয়ে কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে একেবারে বদলে যায় মুরলী। মুরলীর চোখ দুটো যেন রাগ সহ্য করতে গিয়ে জ্বলছে। সারা মুখটাই শক্ত হয়ে গিয়েছে। দাশুর সেই বোকার মত তাকিয়ে থাকা চোখ আর হতভম্ব বুকের পাজরগুলির উপরে যেন আরও একটা আঘাত দেবার জন্য চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী বিছানা থেকে নেমে বসো।

-কেন? দাশুর চোখ দুটোও দ দ করে।

-সিস্টার দিদি এসেছে। বলতে বলতে ছুটে গিয়ে ঘরের দরজার হুড়কো নামিয়ে দিয়ে কপাট খোলে মুরলী।

কিন্তু চৌকাঠ পার হয়ে ঘরের বাইরে দু পা এগিয়ে যেয়েই হঠাৎ যেন পাল্টা একটা ধাক্কা খেয়ে নি পা পিছিয়ে এসে আবার ঘরের ভিতরে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী।

–কি হলো? প্রশ্ন করতে গিয়ে দাশুর মুখটা হিংস্র হয়ে কেঁপে ওঠে।

যেন শুনতেই পায় নি মুরলী; মুখ তুলে দরজার বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে এক ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে।

–দেখি তোর সিস্টার দিদির মুখটা কেমন? বাঘিনের মত, না ডাইনের মত? বলতে গিয়ে আস্তে আস্তে দাঁতে দাঁত ঘষে দাশু।

দাশুর কথাগুলি, এত তপ্ত রুক্ষ ও স্পষ্ট একটা ধিক্কার, তাও যেন শুনতে পায় নি মুরলী। ঘরের ভিতরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের একটা বিস্ময়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। নড়ে না, চোখ ফেরায় না মুরলী।

ঘরের ভিতর থেকে রাগী বনশুয়োরের মত একটা ছুটন্ত আক্রোশ হয়ে দরজার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা মুরলীর চেহারাটার পাশ কাটিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় দাশু।

চমকে ওঠে, অপ্রস্তুত হয়, দু পা পিছিয়ে দাঁড়ায় দাশু। একটা লোক যেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে ভদরলোক বলে মনে হয়। গায়ে কামিজ আছে, পরনে ছোট পেন্টালুন আছে; হাতে একটা বন্দুক আছে, আর কোমরবন্ধে বন্দুকের গুলি সাজানো আছে।

-কে বটেন আপনি? প্রশ্ন করে দাশু।

লোকটা হেসে ফেলে : তুমি কে বট, সেটা আগে বল।

–আমি এই গাঁয়ের কিষাণ।

–কিন্তু কেমন কিষাণ?

-সরদার কিষাণ।

লোকটা এইবার আরও জোরে হো-হো করে হেসে ওঠে। তাই বল। ভূমিজ বট?

–হ্যাঁ, তাতে হয়েছে কি?

–রাগছো কেন সরদার, আমি তোমার জাতের নিন্দা করছি না।

বন্দুকটাকে চালার খুঁটির গায়ে হেলিয়ে দিয়ে পেন্টালুনের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে লোকটা। মুরলীর মুখের দিকে বার বার তাকায়। তারপর দাশুর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। সরদারিনকে বড় লাজুক মনে হয়।

দাশু–এখানে আপনার কি কাজটা আছে বলবেন?

লোকটা গম্ভীর হয়-হা কাজ আছে, অনেক কাজ।

দাশু–কি কাজ?

লোকটা–আগে আমার নামটা জেনে নাও।

দাশু–বলেন।

-আমার নাম পলুস হালদার। আমি খিরিস্তান। তোমার সরদারিন যদি এক ঘটি জল খেতে দেয়, তবে আমি এখনি সেই জল ঢক ঢক করে খেয়ে নিব।

মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে পলুস হালদার। দাশুর বুকের হাড়েও খট করে একটা বিস্ময়ের আঘাত বেজে ওঠে। দেখতে পেয়েছে দাশু মুরলীর গম্ভীর মুখে ঝিক করে একটা মিষ্টি খুশির ছায়া শিউরে উঠেছে।

সত্যিই ব্যস্ত হয়ে উঠল মুরলী। সত্যিই ঘরের ভিতর থেকে এক ঘটি জল নিয়ে বাইরে এসে পলুস হালদারের হাতের কাছে তুলে ধরল।

নিশ্চয়ই খুব পিপাসিত হয়েছিল পলুস হালদার। ঘটি হাতে তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে জল খায় পলুস। তারপর একটা তৃপ্তির চেঁকুর তুলে শান্ত চোখে দাশুর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে? কিন্তু বুঝতে পারছি না সরদার, তোমরা বাঁচলে কি করে?

–কি বলছেন আপনি?

–বাঘিনটা শুধু একটা শাড়ি টেনে নিয়ে চলে গেল, এটা কেমন করে হয়?

দেখতে পায় দাশু, হ্যাঁ, কাল রাতের মুরলীর গায়ে নীল রঙের শাড়িটা বাঁশঝাড়ের কাছে। ময়না কাটার গায়ে ফেঁসে গিয়ে আটকে রয়েছে। সকালের আলোতে আর ফুরফুরে বাতাসে শাড়িটা নিশানের মত উড়ছে।

দাশু বলে–আপনার কাজের কথাটা বলবেন?

পলুস হালদার-তাই তো বলছি। আমার বিশ্বাস, ওই বাঘিন আবার এখানে আসবে।

দাশুর ঘরের দাওয়ার চারদিকের ধুলোর দিকে তাকিয়ে, পথের পাশের মাটির উপর একএকটা অদ্ভুত আঁচড়ের দাগের দিকে তাকিয়ে, আর বাঁশঝাড়ের গোড়ার কাছে ছন্নছাড়া হুটোপুটির চিহ্নগুলির দিকে তাকিয়ে পলুস হালদার বলে-উঃ, তোমরা খুব বেঁচে গিয়েছ সরদার। কিন্তু কেন বাঁচলে বুঝতে পারছি না।

দাশু বলে-বুঝে কাজ নাই।

পলুস দালদার–আমি বুঝবার কাজে এসেছি সরদার। ভোর হতেই মাচান থেকে নেমে, সেই ডরানির পুল থেকে আরও আধ ক্রোশ দূর থেকে, বাঘিনটার পায়ের দাগ ধরে ধরে ঠিক জায়গাটিতে এসেছি। আজ রাতে আমি এখানে মাচান বাঁধবো।

চমকে ওঠে দাশু। পলুস হালদারের দিকে ভ্রূকুটি করে তাকায়-না, এখানে আপনি শিকার খেলবার মজা নিতে সাধ করবেন না।

–কেন?

–কেন আবার কি? ওসব এখানে চলবে না।

–আমি সরকারী হুকুমে বাঘিনটাকে শিকার কবতে এসেছি। তুমি বাধা দিবার কে?

–আমি বাধা দিব না তো কে দিবে? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

পলুস হালদার তবু শান্তভাবে একটু সমীহ করে বলে—তুমি ভুল করছো সরদার। থানা যদি জানতে পারে যে, তুমি মানুষখাগী বাঘিনটাকে মেরে ফেলতে বাধা দিয়েছ, তবে…কি হবে জান?

দাশু–যা হবার হবে।

পলুস হালদার হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে মুরলীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে-তুমি কি বল সরদারিন?

মুরলী বলে—আপনি রাগ করবেন না।

মুরলীর মুখের দিকে কটমট করে তাকায় দাশু। শিকারী পলুস হালদারের ওই কামিজ আর পেন্টালুন পরা চেহারার গর্বটাকে যেন মিষ্টি মিষ্টি নরম কথা বলে তোয়াজ করছে মুরলী। কী ভয়ানক বেহায়া হয়ে উঠেছে মুরলীর মুখটা!

শিকারী পলুস হালদারের চেহারাটাও যেন এক মুহূর্তের মধ্যে, মুরলীর ওই সুন্দর মুখের একটি মিষ্টি অনুরোধের মায়াতেই নরম হয়ে যায়। বন্দুকটাকে আবার হাতে তুলে নেয় পলুস হালদার। রুমাল দিয়ে মুখ মোছে। দাশুর মত একটা কিষাণ মনিষের ধমক-ধামক বই এক মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গিয়ে পলুস হালদারের প্রাণটা যেন হেসে উঠেছে। দাশুর দিকে একটা ভ্রক্ষেপ করতেও ভুলে যায় পলুস হালদার। মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে, বোধহয় আরও গভীর একটা আশ্বাসের সঙ্কেত আশা করে পলুস হালদার বলে—তাই হবে সরদারিন, আমি রাগ করলাম না।

মুরলী হাসে-যেন থানাতে গিয়ে সরদারের নামে…।

পলুস হালদার-না না না, তুমি কিছু ভেবো না সরদারিন। আমি নালিশ করবো না। কিন্তু…।

মুরলী–কি?

পলুস হালদার—তোমাকে দেখে কেমন যেন মনে হয়। তুমি কি ঠিক-ঠিক…।

মুরলীর মুখটা হঠাৎ-ভয়ে শিউরে ওঠে—আমাকে আবার কেন মিছিমিছি..কি ঠাহর করছেন?

পলুস হালদার—তুমি কি এই সরদারের ঘরণী?

মুরলী মাথা হেঁট করে-হ্যাঁ।

পলুস কিন্তু তোমাকে দেখে যে খিরিস্তানী বলে মনে হয়।

মুরলী-না, আমি খিরিস্তানী নই।

পলুস-তবে তুমি কেমন করে ঠিক গড বাবার মেয়েটির মত এমন সুন্দরটি হয়ে…!

মুরলী-সিস্টার দিদির দয়া।

–হারানগঞ্জের সিস্টার দিদি? বলতে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে পলুস হালদার; যেন খাকি কামিজের আড়ালে শিকারী পলুস হালদারের বুকের একটা আশা চেঁচিয়ে উঠেছে।

মুরলীরও চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা মায়াময় হাসি নিবিড় হয়ে ওঠে। মুরলী বলে–হ্যাঁ।

–আসি সরদারিন। মুরলীর মুখের দিকে আরও একবার তাকিয়ে, আর, একেবারে শান্ত ও প্রসন্ন একটা মূর্তি নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যায় পলুস হালদার।

চালার খুঁটো ধরে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী। দাশুও আস্তে আস্তে, যেন পা দিয়ে মাটির উপর শক্ত থাবা রেখে রেখে মুরলীর কাছে এগিয়ে এসে বুকের ভিতরের একটা বদ্ধ জ্বালাকে বাইরে আছড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে-মুরলী।

–কি?

–কানারানী নয়; তোর সিস্টার দিদিই মানুষখাগী বাঘিন বটে।

কোন উত্তর না দিয়ে তেমনি মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী। যেন মধুকুপির একটা মনিষের এই অসার গর্জন তুচ্ছ করে নিজের ভাবনার সঙ্গে কথা বলছে মুরলী।

দাশু বলে—আমিও তোর সিস্টার দিদিকে দেখে নিব।

মুখ তোলে মুরলী। দাশুর মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে, একটা কটকটে কঠোর চাহনি ছড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে–তোমার সাধ্যি নাই।

-কি বললি? বলতে গিয়ে দাশুর শক্ত হাত দুটো; মাটি-কোপানো কাঠ কাটা, চালা ছাওয়া আর গো-গাড়ি হাঁকানো জীবনের কঠিন দুটো পেশীময় শক্ত হাত থর থর করে কেঁপে ওঠে। কিন্তু…ব্যস, তারপরেই যেন অলস হয়ে নেতিয়ে পড়ে। এই হাতে টাঙ্গি তোলবার আর সাহস নেই। এই মুরলীর প্রাণ দাশু ঘরামির টাঙ্গির চেয়েও বেশি ধারালো। এই মুরলী দাশু ঘরামির মুরলী নয়; কেউ নয়। মুরলীকে দেখতে ভয় করে।

সরে যায় দাশু। পথের দিকে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে দেখতে থাকে, এখন কোন দিকে চলে গেলে ভাল হয়? কোন্ দিকের পথটা ফাকা?

গাঁয়ের লোকের সঙ্গে দেখা হবে না, অথচ কপালবাবার জঙ্গলের দিকে চলে যেতে পারা যাবে, এমন একটা পথ কি পাওয়া যাবে না? কুলের জঙ্গলটাকে ডাইনে রেখে ঘেসো পথে এগিয়ে গেলে পল্টনী দিদির ঘরটা চোখে পড়বে না। তারপর একটা ঢালু আছে, ডরানির স্রোত পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়েছে সেই ঢালু। কাঁটানটের জঙ্গলের ছাওয়া সেই ঢালু দিয়ে কেউ পথ হাঁটে না। ওই পথ ধরে একটা ক্রোশ এগিয়ে গেলেই তো কপালবাবার আসনের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়।

সকালবেলার আলোতে ঝলমল করে মধুকুপির পাঁচ বছর আগের সেই চেহারা। শালবনের সেই সবুজ, কাঁকুরে ডাঙ্গার সেই লাল, বেলে ঢালুর সেই সাদা, পলিমাখা দোআঁশের সেই ভেজা-ভেজা কালো। বড়কালুর বুকের সেই ঝরনার জলো দাগটাও চিকচিক করে, শুকিয়ে একেবারে খটখটে হয়ে যায় নি। পাথুরে টিলাগুলিও ঠিক সেই পাঁচ বছর আগের মতই ছড়িয়ে গড়িয়ে, বাবলার আর খেজুরের ঝোপঝাপ গায়ে জড়িয়ে, মধুকুপির পুবের আকাশ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সাবাই ঘাসের জঙ্গলটাও বাতাসে দুলছে। এর মধ্যে ক্ষতের মত দগদগ করে শুধু একটা জায়গা, রায়বাবুর ইঁটখোলার শ্মশানটা।

ইটখোলার দিকে নয়, দাশু ঘরামির হতাশ ও উদাস চোখ দুটো যেন ক্লান্ত হয়ে মধুকুপির আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা সান্ত্বনা খুঁজতে থাকে। এই আকাশে হাতিয়া তারা নিশ্চয় ঠিক সময়ে দেখা দেয়, আর ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরিয়ে মধুকুপির মাটির পিপাসা মিটিয়ে দেয়। কিন্তু…চমকে ওঠে দাশু। বুম বুম বুম! উত্তর দিকের আকাশটা যেন গম্ভীর আক্রোশের তিনটে শব্দ গড়িয়ে দিয়ে মধুকুপির বাতাস কাঁপিয়ে দিল।

জানে না দাশু; এখানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জানবারও কোন উপায় নেই, বড়কালুর পশ্চিমে সেই ঘন শালবনের ভিড়কে প্রকাণ্ড এক-একটা খাবলার জোরে উপড়ে আর সরিয়ে দিয়ে বড় বড় কয়লার খাদ তৈরি হয়ে গিয়েছে। বড় বড় পোখরিয়া খাদ। কালো ধুলোর এক একটা দহ, যার তলায় এক একটা লাইন বেঁধে কিলবিল করে মানুষ। গাইতা শাবল হাতে নিয়ে কাজ করে মালকাটার দল। কয়লার নিরেট চাপের গায়ে বিধ দিয়ে বারুদ ঠাসছে সর্দার, জ্বলছে ফিউজ, আর, তারপরেই বুম্ করে একটা প্রচণ্ড আওয়াজের বিস্ফোরণ। সঙ্গে সঙ্গে এক শশা ফাটলে ফাটা হয়ে, নড়ে চিরে আলগা হয়ে যাচ্ছে নিরেট কয়লার স্তুপ।

শুধু পোখরিয়া খাদ নয়, এজরা ব্রাদার্সের আরও তিনটে কলিয়ারী চালু হয়েছে, আরও ক্রোশখানেক দূরে; একটা পিট আর দুটো ইনক্লাইন। কাল রাতের বেলায় চাঁদের আলোতে অনেক দুরে যে মস্ত উঁচু একটা চিমনির গল। আবছা ছবির মত দেখতে পেয়েছিল দাশু, এখন সেই চিমনির গলাটাকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। এইবার বুঝতে পারে দাশু, ওটা মেঘ নয়, ওটা চিমনির ধোঁয়া। কিন্তু জানে না দাশু, সুরেন মান্‌ঝি আজকাল আর কপালবাবার জঙ্গলে মরা শাল কুড়োয় না। সুরেন মান্‌ঝি আজ এজরা ব্রাদার্সের ওই কলিয়ারির মালকাটা।

মধুকুপির পুবের আকাশ কিন্তু শান্ত; যদিও এই সকালবেলার রোদেই একটু বেশি তেতেছে বলে মনে হয়। রাতের বেলা ডরানির স্রোতের নতুন পুলের কাছে দাঁড়িয়ে, ওই পুবের ডাঙ্গার দিকে তাকিয়ে অনেক দুরে কয়েকটা নতুন ইমারতের ছায়া-ছায়া চেহারা দেখেছিল দাশু। এখন স্পষ্ট দেখা যায়। যেন ডাঙ্গা আর আকাশের ছোঁয়াছুঁয়ির মাঝখানে ছবির মত আঁকা একটা নতুন জীবনের বসতি। দাশু ঘরামির চোখে অদ্ভুত একটা আতঙ্ক কাঁপতে থাকে।

পুবের আকাশটাও বেজে ওঠে। বাঁশির শব্দের মত শব্দ, গম্ভীর অথচ মিষ্টি। সে শব্দ এক ক্রোশের বাতাসে পাড়ি দিয়ে মধুকুপির কানের কাছে এসে বাজছে।

জানে না দাশু, এই বাঁশির শব্দ নতুন কাজের মানুষকে কাজ করতে ডাকছে। অনেক দুরের ইমারতগুলি হলো সেন এণ্ড ওয়াল্টারের মাটিচালান কোম্পানির লেবরেটরি, অফিসবাড়ি, কুলি-ধাওড়া আর বাবু-কোয়ার্টার। এক হাজার বিঘা জমি লীজ নিয়েছে সেন এণ্ড ওয়াল্টার। সকাল ছটা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত এক হাজার মজুর খাটে। কোদালের ক্ষান্তি নেই, টবের শ্রান্তি নেই। মোটর ট্রাকে বোঝাই হয়ে দূরের কুমারটুবির দিকে চলে যায় সিলিকা স্যাণ্ড। ধুরকুণ্ডার দিকে চালান হয় ফেলম্পার, আর কেওলিন চালান হয় কলকাতায়। জানে না দাশু–হরিশ, নটবর ও নিধিরাম আজকাল আর পালকি বইতে গোবিন্দপুরে যায় না। ওরা সেন এণ্ড ওয়াল্টারের খনিতে কাজ করে দিন এক টাকা দু আনা রেটে মজুরি পায়।

মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায় দাশু। তবে আর বাকি রইল কোন্ দিকটা? পশ্চিমটা? ছোটকালু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে যেদিকে, সেই দিকটা? কিন্তু ছোটকালুর পাহাড়ে ধড়টাও গুন্ গুন্ শব্দ করছে মনে হয়।

জানে না দাশু, ছোটকালুর ওই পাহাড়ে ধড়ের ঠিক পিছনে, যেখান থেকে মহুয়ার জঙ্গল আর উইঢিবির ভিড় ক্রোশের পর ক্রোশ আরও এগিয়ে যেয়ে একেবারে বাঘমুণ্ডি রেঞ্জের সঙ্গে মিশেছে, সেখান দিয়ে একটা নতুন রেললাইন এঁকেবেঁকে আরও কিছুদূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছে। আরও এগিয়ে যাবে রেললাইন। খেলারির সিমেন্ট তাড়াতাড়ি রামগড়ে পৌঁছে দিতে হলে, লোহারডাগার বক্সাইট আরও তাড়াতাড়ি মুরির অ্যালুমিনিয়াম কারখানার কাছে এনে ঢেলে দিতে হলে, এই নতুন রেললাইনকে আরও বিশ মাইল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে। তাই নতুন রেললাইন তৈরী হচ্ছে। সারাদিন কাজ চলে। পোড়া ডিজেলের ধোঁয়া ছড়িয়ে গো-গোঁ করে মাটি খোঁড়ে প্রকাণ্ড দুটো ইউক্লিড, মাটি চৌরস করে ক্যাটারপিলারের খাঁজকাটা চাকার দাঁত। ওয়াগন বোঝাই হয়ে রেল আসে, স্লিপার আসে, ইস্পাতের দড়ির বড় বড় রীল আসে, আর আসে সিগন্যালের খুঁটি। ছোটকালুর ওপারে, ছোটকালুরই ছায়ার কাছে শান্টিং ইয়ার্ড। শান্ট করে ইঞ্জিন, নতুন লাইন গুর্‌ গুর্‌ শব্দ করে কাঁপে।

মহুয়ার জঙ্গল ছিঁড়ে-খুঁড়ে দশ বিঘা জায়গা জুড়ে রেলওয়ের স্টোর ছড়িয়ে আছে। ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে সরঞ্জামে ভরা সারি সারি ওয়াগন। জানে না দাশু, আজকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওয়াগনের লোডিং আর আনলোডিং-এ কাজ করে হরিপদ; কপালবাবার জঙ্গলে সে আর মৌচাক ভাঙ্গতে যায় না।

তবে কি শুধু একটি দিকের আকাশ পুরনো নধুকুপির শান্তিব ছায়া নিয়ে আজ বেঁচে আছে? ঐ দক্ষিণের দিকটা?

হ্যাঁ, দক্ষিণের দিকে তাকালে কপালবাবার জঙ্গলের ছায়াঘন চেহারা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। কপালবাবার জঙ্গল, অনেক ঠাঁই জুড়ে অনেক ঝরনার শব্দ বুকের ভিতর লুকিয়ে, অনেক পাহাড়কে চারদিক থেকে পাক দিয়ে দিয়ে বন্দী করে রেখে, ক্রোশের পর ক্রোশ এক-একটা নতুন নাম নিয়ে রাঁচি জেলার সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। থানা বলে, প্রতি বছর শীতকালে বাঘিন কানারানী কপালবাবার এই জঙ্গল থেকে সরে গিয়ে, রাঁচির পাহাড়ী ঘাটগুলিকেও পার হয়ে, একেবারে পালামৌয়ের রিজার্ভ জঙ্গলের গভীরে গিয়ে লুকিয়ে থাকে।

ঘরের দাওয়ার কাছে একঠায় দাঁড়িয়ে কপালবাবার জঙ্গলের দিকে অপলক চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে দাশু। কপালবাবার জঙ্গল আছে ঠিকই, কিন্তু কপালবাবা আছে কি? দাশুর চোখ দুটো কটকট করে, বুকটা হাঁসফ্টস কবে। মনের ভিতরটা যেন আর্তনাদ করে–কপালবাবা তুমি আছ, কি আছ নাই? মরেছ, কি মর নাই?

যেন একটা শেষদেখার আক্রোশ নিয়ে মুরলীর মুখের দিকে একবার তাকায় দাশু। দাওয়ার খুঁটির কাছে উবু হয়ে বসে আর হাঁটুর উপর মুখটা পেতে দিয়ে চুপ করে বসে আছে মুরলী। মাটির উপর নখ দিয়ে হাবিজাবি আঁকছে আর কি-যেন ভাবছে। মনে হয়, একটা দূরন্ত ভাবনার সুখে নির্লজ্জ হয়ে নতুন সৌভাগ্যের হিসেব করছে মুরলী। ওকি? মুরলীর চোখে জল কেন? কিন্তু দাশু ঘরামির সন্দেহের হিসাবেও আর ভুল হয় না। মুরলীর ওই চোখের জল জলই নয়।

একবার দাশু ঘরামির এই মজবুত শরীরের একটা কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলেছিল মুরলী। কাঁকড়া বিছার কামড়ে বিষিয়ে ফুলে গিয়েছিল দাশুর শরীরটা। দাশুর গায়ে হাত বোলাতে গিয়ে জলে ভরে গিয়েছিল মুরলীর চোখ। কিন্তু মুরলীর এই চোখ সেই চোখের মত নয়, আর দাশুর গায়ে হাত বোলাবার জন্য মুরলীর মনে আজ আর কোন সাধও নেই।

একবার মুরলীর নিজেরই একটা অসুখ হয়েছিল। একমাস ধরে জ্বরে আর বুকের ব্যথায় কষ্ট পেয়েছিল। দাঁড়াতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল।-আমার মরণ এসেছে গো। বলতে গিয়ে মুরলীর চোখ জলে ভরে উঠেছিল।

না, সে রকমের দুখিনীর চোখও নয়। সিস্টার দিদির দয়া পেয়েছে যে, পলুস হালদারের পিপাসা মেটাতে গিয়ে হেসে উঠেছে যে, দাশু ঘরামির ঘর করবার সাধ শেষ করে দেবার ইচ্ছে হয়েছে যার, তারই চোখ দুটো নতুন ঢং করে জল ঝরিয়ে হাসছে।

কিন্তু মুরলীর চোখের এত কাছে মাটির উপর আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে দাশু ঘরামির পা দুটো পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। জ্বলতে শুরু করেই দিয়েছে। এখনি ছুটে গিয়ে কপালবাবার আসনের কাছে আছড়ে না পড়া পর্যন্ত এই জ্বালা বোধহয় শান্ত হবে না।

কিন্তু চমকে ওঠে দাশু। দাশু ঘরামির পায়ের জ্বালার উপর এক ঝলক ঠাণ্ডা জল হঠাৎ শব্দ করে ছড়িয়ে পড়েছে।

পলুস হালদারের পিপাসা মিটিয়ে দিয়েছিল যে ঘটিটা, সেই ঘটি হাতে নিয়ে দাও ঘরামির পায়ের উপর হঠাৎ জল ঢেলে দিয়েছে মুরলী। মনটা বিশ্বাস করতে না চাইলেও দাশুর চোখ দুটো অস্বীকার করতে পারে না, সত্যি মুরলী জল ঢেলেছে। কী আশ্চর্য, অনেকদিন আগের একটি সন্ধ্যার উৎসবের ছবি আবার এই সময়ে দাশু ঘরামির আজকের এই আশাহীন জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ লগ্নে হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে কেন? সেদিন ঢোল বেজেছিল, মহেশ রাখাল কেঁদেছিল, ঝালদার এক কুটিরের আঙ্গিনায় হাঁড়ি হাঁড়ি মহুয়া-মদের নেশায় ভাইয়ারি মেতে উঠেছিল। গাঁও-পঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে মুরলীর মাথায় সিঁদূর দিয়েছিল দাশু। সিঁদূরদানের পর এক ঘটি জল দাশুর পায়ের উপর ঢেলে দিয়ে মুখ টিপে লাজুক হাসি লুকিয়েছিল যে মুরলী, সে মুরলী কি সত্যিই মরে যায় নি?

দাশু–বলে কি হলো?

মুরলী বলে—জানি না।

দাশু–তবে?…

–এসো তবে। ঘরে চল। ডাক দেয় মুরলী। আর দাশুও যেন একটা জাদূর আবেদনে মুগ্ধ হয়ে মুরলীর পিছু হেঁটে ঘরের ভিতর ঢোকে।

–বসো! মুরলীর একটি অনুরোধের শব্দেই মুগ্ধ মানুষের মত অবশ হয়ে ঘরের মেঝেতে খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর বসে পড়ে দাশু।

মুরলী বলে—একটা কথাও বলবে না। বড় বড় চোখ করে তাকাবে না। চুপচাপ খেয়ে নাও।

দাশুর হাতের কাছে বাঁশের ডালা ভরে মাইয়ের খই, দু ঢেলা গুড়, একটা শশা আর এক ঘটি জল রেখে দিয়ে মুরলী নিজেও মেজের উপর পা ছড়িয়ে বসে।

কয়েদ খেটে পাঁচ বছর পরে ঘরে ফিরে এসে দাশুর পেটের ক্ষুধাটাও যেন এইবার পুরনো স্বাদের মধুরতায় ভরে যায়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই প্রথম খাবারের চেহারা দেখতে পেয়েছে দাশু। পাঁচ বছর পরে এই প্রথম মধুকুপির মাইয়ের খই মুখে দিল দাশু। জেলের ভাত খাওয়া জীবনের সব বিস্বাদগুলিকে এখন একটা মিথ্যা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। মধুকুপির মাটিতে যে শসা ফলে, সেই শসা; মধুকুপির মাটিতে যে আখ ফলে, সেই আখেরই গুড়। দাশুর পেট ভরছে, সেই সঙ্গে বুকটাও অগাধ তৃপ্তিতে ভরে যাচ্ছে। ঘটি তুলে ঢকঢক করে জল খায় আর ঢেকুর ছাড়ে দাশু।

চোখ তুলে মুরলীর দিকে তাকাতেই হেসে ওঠে দাশুর চোখ : তুই কি আমার খাওয়া দেখছিস, না, আমাকে দেখছিস?

দাশুর প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠে মুরলীর শান্ত দুটি চোখ। ঠিক ধরতে পেরেছে দাশু। পাঁচ বছর কয়েদের খাটুনিতেও একটুও কাবু আর একটুও কাহিল হয়ে যায় নি মুরলীর জীবনের মরদ সঙ্গী দাশু ঘরামির ওই শরীর, শরীরের ওই পাথুরে ছদ। দাশুর পিঠের দাঁড়া যেন একটা গভীর খাদের ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে। বুকের পাটা যেন দুটো চাকা চাকা পাথর দিয়ে গড়া। কপালের বাঁ দিকে ছোট্ট একটা রগ কুঁকড়ে আছে। হেসে ফেললেই কোমরটা লিকলিক করে দোলে, সেই সঙ্গে নাভিটাও শিউরে উঠে আরও গভীর হয়ে যায়। ভুলে যাবে কেমন করে মুরলী, মধুকুপির এই মানুষটারই গা ঘেঁষে মুরলীর জীবনের আট বছরের কত কামনা কতবার কত সুখের আবেশে গলে গিয়েছে?

মুরলী হাসে? তোমাকেই দেখছি, দেখতে মানা আছে কি?

দাশুও হাসে? তোর মরদকে তুই দেখবি, মানা করবে কে?

পা ছড়িয়ে অলস হয়ে বসে থাকা মুরলীর সেই খুশি শরীরটা হঠাৎ ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে। মুখের হাসি মিলিয়ে যায় আর পা গুটিয়ে আবার হাঁটুর উপর মাথা রেখে শরীরটাকে আবার শক্ত করে চেপে রাখতে চায়।

হঠাৎ মনে পড়েছে মুরলীর, সত্যিই যে মানা করেছে একজন। মুরলীকে এই পাঁচ বছরের সব দুঃখের অভিশাপ থেকে বাঁচিয়ে, বরং আরও সুন্দর করে হাসিয়ে সাজিয়ে রেখেছে যে, সেই সিস্টার দিদির মানা আছে। সিস্টার দিদির কাছে যে শপথ করেছে মুরলী। না কখনো ভুল করবো না সিস্টার দিদি। আগে আমার মরদ ভাল মানুষ হবে, কলে কাজ নিবে, খিরিস্তান হবে, তারপর। তার আগে নয়। তার আগে মরদের পা ছোঁব না, কোমরও ধরবো না।

কিন্তু মহেশ রাখালের মেয়ের শক্ত প্রাণটা যে কাল রাতে হঠাৎ পাগল হয়ে গেল, আর এই শপথটাকেই একটা মাতাল খেলার আনন্দে ছিঁড়ে-খুঁড়ে শেষ করে দিল। সিস্টার দিদিকে মিথ্যে কথা বলতে বুকটা যে কেঁপে উঠবে। আর, সত্য কথা বললে যে আর মুখ দেখাবার অধিকার থাকবে না।

দাশু বলে–করম নাচবার সময় আমার কথা তোর মনে পড়ে নাই?

মুরলী—আমি করম নাচি নাই।

–কেন?

–সিস্টার দিদি মানা করেছে।

–আবার কেন ওর নাম করছিস? ওর কথা ছেড়ে দে।

–ছাড়বো কেন? সিস্টার দিদি দয়া না করলে মুবলী যে ম যেত।

–মিছা কথা বকিস না মুরলী, কপালবাবার দয়া থাকলে কে তোকে মরাতে পারে?

চুপ করে মুরলী আবার আনমনার মত তাকিয়ে যেন একটা আনদুনিয়ার কথা ভাবতে থাকে। আর, ঘরের এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে একটা নতুন রকমের লাজুক হাসি মুখের উপর ছড়িয়ে কি-যেন খুঁজতে থাকে দাশু। দেখতে পেয়ে খুশি হয় দাশু, হ্যাঁ, ঘরের এক কোণে বিড়ের উপর বসানো সেই ছোট হাঁড়িটা আজও আছে। দাশুর জীবনের অনেক সন্ধ্যার আনন্দের বন্ধু ওই হাঁড়ির ভিতরে মধুকুপির মহুয়ার মাতাল রস আজও টলমল করছে।

দাশু বলে—হাঁড়িটাকে কাছে নিয়ে আয়। জেলের ভিতরে পাঁচ-পাঁচটা বছর এই হাঁড়িটাকে ভেবে ভেবে বুকটা যে কি তরাস ভুগছে, তুই বুঝতে পারবি না।

শুকনো চোখে ছোট একটা তুচ্ছতার ভ্রূকুটি পাকিয়ে নিয়ে মুরলী বলে—ও হাঁড়িতে কিছু নাই। কিছু থাকে না।

-কেন, তুই কি পরবের দিনেও হাঁড়িয়া খাস নাই?

–না।

–কেন?

–সিস্টার দিদির মানা আছে।

–তোর সিস্টার দিদি মানা করে কেন? খিরিস্তানীরা কি বোতলা সরাব খেয়ে নেশা করে না? লিলে লিলে করে নাচে না?

–জানি না।

–তা জানবি কেন? সিস্টার দিদির মিছা কথাও তোর ভাল লাগে?

বোধহয় দেখতে পায় নি দাশু, মুরলীর চোখের তারা দুটো আবার কেমন করে হঠাৎ ছটফটিয়ে উঠে আবার শান্ত হয়ে গেল। ঘরের আর-এক দিকের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু, আর চোখ দুটোও করুণ হয়ে যায়। দেয়ালের গায়ে মাদলটা ঝুলছে। কিন্তু শুকিয়ে চিমসে হয়ে গিয়েছে। মধুকুপির আকাশের মেঘকে, মধুকুপির ক্ষেতের ধানের শিষকে, মধুকুপির জীবনের কত আনন্দকে নাচিয়ে মাতাল করে দিয়েছে এই মাদলের বোল। মহুয়ার নতুন ফুলের গন্ধকে এই মাদলটাই যে ডেকে ডেকে বরণ করেছে। সে জিনিসটার এমন দশা!

মাদলটাকে নামিয়ে এনে ধূলো ঝাড়তে থাকে দশু। ফুঁ দেয়, হাত দিয়ে ঘষে, টোকা মারে : ইস, এটাকে যে একেবারে মেরেই রেখেছিস।

মুরলী রাগ করে আমাকে বকছো কেন? আমি কি পুরুষ বটি যে, তোমার মাদল নিয়ে ধিতাং ধিতাং করবো।

দাশু শুকনো মুখে হাসে: তা করতে বলছে কে? কিন্তু, এটাকে মাঝে মাঝে একটুক মুছমাছ করে আর আগুনে সেঁকে রাখতে পারতিস তো?

উত্তর দেয় না মুরলী। মনে পড়ে মুরলীর, সিস্টার দিদি যেদিন প্রথম এসে নতুন আশার রঙ ধরিয়ে দিয়ে গেল, সেদিন যে ভয় করেছিল মুরলী, সেই ভয়ই সত্য হয়ে উঠেছে। মানুষটা পাঁচ বছর পর ঘরে ফিরে এসে আবার সেই পুরনো আহাদগুলিকেই খুঁজছে। আদুড়গা হয়ে কোমরে গামছা বেঁধে হাঁড়িয়া খেয়ে চোখ লাল করে, মাদল পিটে পিটে নাচবার জন্য আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এই মানুষটার জীবনের সাধ।

মুরলীর চোখের দৃষ্টিটা হঠাৎ যেন সব তৃপ্তি হারিয়ে বিস্বাদ হয়ে যায়। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার হেঁট মাথা হয়ে ঘরের মেটে মেঝের উপর নখের দাগ আঁকতে থাকে মুরলী। মুরলীর মন যেন এই ঘরের দরজা থেকে সরে গিয়ে বাইরের একটা নতুন ভাষা, নতুন হাসি আর নতুন আহ্বানের মায়ার কাছে বসে সত্যিই হিসেব করছে।

আসি সরদারিন! খিরিস্তান পলুস হালদার কী সুন্দর নরম সুরে কথা বলে! কী চমৎকার তাকায়! গায়ে কামিজ, পরনে পেন্টালুন, পায়ে বুটজুতো, হাতে বন্দুক ওই পলুস হালদার হারানগঞ্জের সিস্টার দিদিকে নিশ্চয় খুব ভক্তি করে। নিশ্চয় হারানগঞ্জের গির্জাবাড়ির কাছে, সেই ছোট ছোট বাংলাঘরের একটি ঘরে থাকে পলুস হালদার। নিশ্চয় কলে কাজ করে পলুস হালদার। সাইকেল চড়ে কাজের কারখানায় চলে যায়, আর সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে এসে গির্জাবাড়িতে প্রেয়ার সাধতে যায়। সিস্টার দিদি বলেন, একবার প্রেয়ার সাধলে সব পাপতাপ মুছে যাবে বহিন, তোমার জীবন সুখে ভরে যাবে।

আবার কবে আসবে পলুস হালদার? সত্যিই আসবে কি? বলীর নিঝুম চোখের উপর কত স্পষ্ট একটা ছবি ছটফট করে। পকেট থেকে রুমাল বের করেছে পলুস হালদার, আর মুরলীর ভীরুচোখের জল মুছে দেবার জন্য সেই রুমাল হাতে তুলে নিয়ে…।

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী : শুনছো?

চমকে ওঠে দাশু : কি?

মুরলী–তুমি কবে কলে কাজ নিবে বল?

দাশু ভ্রূকুটি করে ও কলে কাজ নিব কেন? গাঁয়ের জমি কি মরে গেছে?

মুরলী–কি বললে?

দাশু–ঈশান মোক্তারের চিঠা নিব; ভাগজ্যোত করব।

মুরলী–তাতে পেট ভরবে? কত মকাই আর কত ধান ভাগে পড়বে?

দাশু–পেট ভরবে না জানি। তাই ভেবেছি, কপালবাবার জঙ্গলের মরা শালও ভাঙবো।

মুরলী ঠিকাদারের দস্তুরি, জঙ্গল পুলিসের জলপানি, আর ঈশান মোক্তারের গো-গাড়ির ভাগ দিয়ে তোমার কাঠবেচা পয়সার কটা পয়সা বাঁচবে?

দাশুর চোখ দুটো হঠাৎ উদাস হয়ে যায়। মুরলীর আতঙ্ক একটুও মিথ্যে আতঙ্ক নয়। কিন্তু…কিন্তু জিউজান দিয়ে খাটলে কি কিছু টাকা জমানো যাবে না? আর, বিঘা দুই জমি

কি…।

দাশু বলে—ভাবিস না মুরলী, একটুক সবুর কর।

মুরলী কি করতে চাও?

দাশু–সব্জী ফলাবো। আমি একলা খেটে জেলখানার দুই বিঘা জমি কুপিয়ে কত সব্জী ফলিয়েছিলাম, তুই জানিস না।

মুরলী–কিন্তু দুই বিঘা জমি তোমাকে দিবে কে?

আবার সেই ভয়ঙ্কর সত্য, মধুকুপির মনিষজীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে মুরলী। জমি দিবে কে? জমি কিনবার টাকা কই? টাকা জমবে কেমন করে? জিউ জান ভিড়িয়ে দিয়ে খাটলেও যে টাকা জমে না।

দাশুর উদাস চোখ দুটো হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে, আর এই দুর্ভাবনার প্রশ্নগুলিকে যেন একটি বিশ্বাসের জোরে হাসিয়ে দেবার জন্য হেসে ওঠে দা : কপালবাবার দয়া থাকলে পেয়ে যাব, ভাবিস না।

মুরলী ভ্রূকুটি করে তাকায়। তারপর কি হবে?

দাশু–কপি ফলাবো, আলু ফলাবো। ভাদুই সবজিও ফলাবো। আমি কোপাই করবো, তুই ঢেলা ভাঙ্গবি। আমি ছিটাই করবো, তুই বুনবি; ক্ষেতটাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়ে…।

দাশুর কথাগুলি যেন দাশুর সেই পুরনো স্বপ্নের আবোল-তাবোল বোল। শুকনো চোখে দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুরলী বলে–না। তুমি কলে কাজ নিবে। একটা-দুটা বছর কাজ শিখবে। সিস্টার দিদি বলেছে, তোমাকে সাহেবের খাদের কলঘরের মিস্তিরি করে দিবে। তিন কুড়ি, চার কুড়ি টাকা মাহিনা পাবে। আর আমি…।

হেসে ফেলে মুখে আঁচল চাপা দেয় মুরলী, যেন মুরলীর বুকের ভিতরে জোর করে চেপে রাখা একটা নতুন স্বপ্ন হঠাৎ এই মুখরতার সুযোগ পেয়ে হেসে উঠেছে।

দাশু–কি বটে?

মুরলী হাসে।–কি আবার বটে? আমি সিস্টার দিদির ইস্কুলে পড়তে যাব।

দাশুর পাঁজর টনটন করে? ওসব কথা ছেড়ে দে। কী পাপ করেছিস যে সিস্টার দিদির ইস্কুলে পড়বি?

কটমট করে তাকায় মুরলী? তবে কি আমি তোমার কামিন হয়ে খেটে খেটে গতর বুড়ো করে দিব?

-ছি, এমন মিছা কথাটি কেন বলিস মুরলী? নিজের মরদের সাথে কাজ করলে মেয়েমানুষ কি কামিন হয়ে যায়?

মুরলীর হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে কি-যেন ভাবে দাশু। তারপর আদরের সুরে ডাক দেয়-মুরলী! তুই ভাবিস না। কিছু ভাবিস না। আমি নিতাই মুদির ঠিকা জঙ্গলে খয়ের করবো। গাছ ভাঙ্গবো আমি, ছিলবো আমি, তুই জ্বাল দিবি। দিনে খাটবো, রেতে খাইবো। পঞ্চাশ টাকা হবেই বে মুরলী। তোর হাঁসুলী হবে, আমার নতুন মাদল হবে, আর…!

–না। দাশুর স্বপ্নাতুর মুখরতার বিরুদ্ধে একটা কঠোর আপত্তি হেঁকে বাধা দেয় মুরলী : না, তুমি কলঘরে কাজ করতে যাবে, আমি নতুন ঘরে বসে রাঁধবো। রূপার হাঁসুলী নয়, তুমি সোনার দানার মালা কিনে দিবে। পরবের দিনে তুমি নতুন শাড়ি এনে দিবে।

–না, না, তুই পাগল হয়েছিস মুরলী। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–নতুন ঘরে নয়, তুই এই ঘরে থাকবি।

–আমি এই ঘরে থাকতে পারবো না।

–তোকে এই ঘরেই থাকতে হবে রে মহেশ রাখালের বেটি।

–না।

–হ্যাঁ। সোনার দানার মালা পরতে যদি সাধ হয়, তবে এই ঘরে থেকেই সাধ কর না কেন?

–না।

–কেন না? কুলের জঙ্গলে লা-পোকার উঁটি ভাঙবার ঠিকা নিব আমি। আমি ভাঙ্গবো, তুই কুড়াবি। আমি বোঝা বাঁধবো, তুই বোঝা মাথায় নিবি। ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডারে পৌঁছে দিয়ে আসবি। তুই পয়সা পাবি, আমি পয়সা পাব। সুখ হবে, এই ঘরে থেকেই অনেক সুখ হব।

–তোমার কপাল হবে! গেঁয়ো মধুকুপির একটা অসার দুর্বল আর মূখ স্তুতিকে যেন একটা ধিক্কার দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মুরলী।

–কি ভেবেছিস তুই? বলতে বলতে এগিয়ে আসে দাশু।

সরে যায় মুরলী। দাশুর মনিষজীবনের এই অসার অহংকারের ছায়াটাকে আর সহ্য করতে ইচ্ছে করে না। দাশুর মুখের দিকে ছোট একটা ভ্রূকুটি হেনে আর রঙীন শাড়ির আঁচলটাকে দাঁত দিয়ে চেপে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেয়ে দরজার চৌকাঠের উপর পা রেখে সামনের সড়কের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

দাশু বলে-পথের দিকে মিছা তাকাস কেন? শিকারীটা নাই।

চমকে ওঠে মুরলী। আস্তে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে দাশু ঘরামির হিংসুটে মুখটার দিকে কটমট করে তাকায়।

দাশু–কি বলছিস বল? মহেশ রাখালের বেটি যদি এক বাপের বেটি হয়ে থাকে, তবে বলুক, এই ঘরে থাকতে ঘিন্না লাগছে?

মুরলী–হ্যাঁ।

কেঁপে ওঠে দাশু। দাশু কিষাণের জীবনের সব মরদানির অহংকার, স্বামিপনার সব দুঃসাহস যেন বজ্রপাতে আহত বড়কালুর পাথুরে ঢিবির মত ফেটে খানখান হয়ে যায়। বড়কালুর ভেজা ঘাস বাজের আগুনের জ্বালা লেগে যেমন করে পোড়ে আর ধোঁয়া ছড়ায়, দাশুর জীবনের স্বপ্ন আর আশাগুলিও তেমনি করে পুড়ে যাচ্ছে আর ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।

দাশু বলে, বলতে গিয়ে অলস অসহায় ও ভীরু একটা অবসাদের মধ্যে যেন নেতিয়ে পড়ে দাশুর গলার স্বর-তবে আর দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

মুরলী–চলে যেতে বলছো?

দাশু–হ্যাঁ।

সেই মুহূর্তে রঙীন শাড়ির আঁচলটাকে আরও শক্ত করে কামড়ে ধরে মুরলী। সড়কটার দিকে একবার তাকায়। পুরনো জামকাঠের জীর্ণ কপাটের ছোঁয়া থেকে শরীরটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছটফট করে ছুটে চলে যায়।

চুপ করে বসে, প্রাণহীন অসাড় একটা দেহ নিয়ে শুধু তাকিয়ে দেখতে থাকে দাশু। একটা মাছি উড়ে এসে দাশুর চোখের কাছে ভনভন করতে থাকে। দাশুর এই অসাড় চোখ দুটোকে বোধহয় মরা মানুষের চোখ বলে ভুল করে মাছিটা।

হঠাৎ দাশুর সেই মড়াটে চেহারা যেন নতুন রক্তের ঝলক লেগে তপ্ত হয়ে ওঠে। হাত দুটো কাঁপতে থাকে। কি যেন মনে পড়ে গিয়েছে দাশুর। টাঙ্গি টাঙ্গি টাঙ্গি! দাশুর হাত দুটো যেন এক প্রচণ্ড গর্বের দুঃসাহসে বেপরোয়া হয়ে সেই মুহূর্তে ঘরের চালার গোঁজ থেকে টাঙ্গিটাকে টেনে হাতে তুলে নিয়ে মুরলীর দিকে ছুটে যায়। মহেশ রাখালের বেটি যে দাশুর জীবনের একটা সাধের আশাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

মূরলীর পথ আটক করে দাঁড়ায় দাশু : আমার ছেইলাকে পেটে নিয়ে কোন্ নরকে পালিয়ে যাচ্ছিস রে মাগি?

–কি বললে? থরথর করে কাঁপতে থাকে মুরলী।

–আমার ছেইলা! চিৎকার করে দাশু।

বুনো মধুকুপির একটা প্রচণ্ড দাবি গর্জন করে মুরলীর পথ আটক করেছে। কিন্তু মুরলীর শরীরের সব রক্তমাংস যে জানে, মুরলীর কোমরের একটা নিবিড় ব্যথাও যে বিশ্বাস করে, একটুও মিথ্যে নয় এই দাবি। দাশু ঘরামির ছেইলাকে যেন ভয়ানক ধূর্ত আর লোভী চোরের মত পেটের কোটরের ভিতর লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে মুরলী।

মুরলীর চোখ দুটো কেঁপে ওঠে। রঙীন শাড়িতে জড়ানো শরীরটা কুঁকড়ে যায়। মাথাটাও কাঁপতে কাঁপতে হেঁট হয়ে যায়। আস্তে আস্তে হেঁটে আর ফিরে এসে আবার ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে মুরলী।


© 2024 পুরনো বই