এবং কী পরিতাপ-বাড়িতে একটা রেডিয়ো নেই!
স্বামী তখন এক টাকার বাজার এনে নামিয়েছেন ঘরের দাওয়ায়। তিন ছটাক মাছ, প্রায় স্বচ্ছ একটি লাউয়ের ফালি, এক পোয়া আলু আর বাজারের বাইরে থেকে সস্তায় কেনা গোটা কয়েক অসুস্থ চেহারার বেগুন। উদবৃত্ত তিন পয়সায় কেনা বিড়ি থেকে একটা সবে ঠোঁটে দিতে যাচ্ছেন, এমন সময় স্ত্রীর আক্রমণে হকচকিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। এমন অদ্ভুত নিরীহ চোখ মেলে চেয়ে রইলেন যে, মনে হল হিব্রু ভাষা শুনছেন।
এখন? এখন কী? উত্তেজিত ভাষায় লতিকা জিজ্ঞেস করলেন, কী হবে এবার?
কীসের কী হবে? শিবদাসবাবু তখনও বিস্ময়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী!
লতিকা এবার গলা তুললেন। দোতলায় অহংকারে মটমট করা মোটা গিন্নিকে শোনাবার মতো করে স্বরগ্রাম ওপরে তুলে দিয়ে বললেন, উমা রেডিয়োতে প্রোগ্রাম পেয়েছে।
অ্যাঁ! পঁচানব্বই টাকা মাইনে আর পঁয়ত্রিশ টাকা ডিএ-র শিবদাসবাবু এমন একটা ধ্বনি তুললেন যে, সেটা আতঙ্ক না উল্লাস ভালো করে বোঝা গেল না।
এই দ্যাখো। সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি নামাঙ্কিত এবং সার্ভিস লেখা স্ট্যাম্প আটা মেটে রঙের খামখানা লতিকা এগিয়ে দিলেন স্বামীর দিকে। আবার দোতলার মোটা গিন্নির কানে মধুবৃষ্টি করে চড়া পর্দায় জানালেন, বারোই এপ্রিল। বেলা দুটোর সময়। পনেরো মিনিটের প্রোগ্রাম, পনেরো টাকা পাবে।
রাত দুটোর সময় হঠাৎ একখানা অনিশ্চিত এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম এলে যে-আতঙ্ক আর উত্তেজনা নিয়ে মানুষ খাম হেঁড়ে, তেমনিভাবেই কাঁপা হাতে ছাপানো ফর্মের ওপর টাইপ করা চিঠিখানা খুললেন শিবদাস। বাঁ-হাত দিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিলেন, তারপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেলেন। এক বার, দু-বার, তিন বার, চার বার।
না, কোনো ভুল নেই। উমা দত্ত, কেয়ার অব শিবনাথ দত্ত, সাতের পাঁচ পটলডাঙা লেন, কলকাতা-নয়। আর কেউ হতেই পারে না।
হঠাৎ যেন চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে যেতে চাইল শিবদাসের।
উমা? উমা কই?
উমা দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশেই। সুখে আর আনন্দে তার পাখির মতো উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেমন একটা লজ্জাও হচ্ছে এখন, পা জড়িয়ে যাচ্ছে যেন।
শিবদাস আবার ডাকলেন, উমা, উমা কোথায়?
উমা বেরিয়ে এল এবার। কালো রোগা চেহারার মেয়ে, বিয়ের বাজারে যারা প্রথম দৃষ্টিতেই বাতিল হয়ে যায়। সামনে এসে দাঁড়াল মাথা নীচু করে।
শিবদাস কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সত্যিই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যেতে চাইছে। কাল সন্ধে বেলাতেই কুড়ি বছরের এই কুদর্শনা অনূঢ়া মেয়েটির মৃত্যুকামনা করছিলেন শিবদাস। মাত্র সাড়ে সাত টাকা দিয়ে মাসের শেষ পাঁচ দিন কী করে চালাবেন তার সূক্ষ হিসেব করতে বসে উমার গলা সাধবার উৎপাতে হিংস্র হয়ে ভাবছিলেন, এক আছাড়ে ওর তানপুরাটা ভেঙে দেবেন কি না। কিন্তু এখন…
অনুতাপের একটা বোবা বেদনা শিবদাসের বুকের ভেতরে লতিয়ে লতিয়ে উঠতে লাগল। আশ্চর্য সুন্দরী মনে হল এই শীর্ণদেহিনী কুরূপা মেয়েটিকে। কালো? যদি দুখানা ভালো সাবানও কোনোদিন কিনে দিতে পারতেন তাহলে এই কালো থেকেই আলো ঠিকরে বেরোত। যদি পেট ভরে একমুঠো খেতে দিতে পারতেন, তাহলে এই কালো মেয়েই ফুটে উঠত কৃষ্ণকলির মতো।
চোখে জল আসছে নাকি? সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিলেন শিবদাস। ধরা গলায় বললেন, দে দে, শিগগির ডুপ্লিকেটটা সই করে দে। আমি এক্ষুনি রেজিষ্ট্রি করে দিয়ে আসি।
উমা মৃদুভাবে বললে, ব্যস্ত হচ্ছ কেন বাবা, সাত দিনের মধ্যে পাঠালেই তো…
না না, পোস্ট অফিসকে বিশ্বাস নেই। শিবদাস প্রগলভ হয়ে উঠলেন। ওরা বনগাঁর চিঠি বম্বেতে নিয়ে গিয়ে ডেলিভারি দেয়। দে শিগগির সই করে, আমি এখুনি রেজিস্টার্ড পোস্টে পাঠিয়ে দিয়ে আসছি। আর বসন্তকেও খবরটা দিয়ে আসি ওইসঙ্গে।
উমা চিঠিটা নিয়ে ঘরে ঢুকল। হাতের সইটা কেমন আঁকাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে তার। ডুপ্লিকেটটা ছিঁড়ে দিতেও মায়া লাগছে—মনে হচ্ছে কেমন অঙ্গহানি হয়ে যাবে এমন সুন্দর চিঠিটার।
আর, আর বসন্তদা! সবাই যখন ঠাট্টা করত, যখন পাড়ার তিন-চারটে ছেলে শুনিয়ে শুনিয়ে তার গানকে ভ্যাংচাত, তার ওপর মা-র অসীম বিশ্বাসও মধ্যে মধ্যে টলে উঠত যখন, তখন শুধু বসন্তদাই হাল ছাড়ত না। বলত, হবে—নিশ্চয়ই হবে তোমার। গান গলায় তোমার আছেই, কেবল তাকে আর একটু পথ করে দিতে হবে, সুরের ভেতর আরও একটু খেলতে দিতে হবে। নাও, ধরো তানপুরা। হ্যাঁ, খেয়াল আছে তো? এটা ঝাঁপতাল।
এক টুকরো চিঠিও লিখে দিলে কেমন হয় বসন্তদাকে? ছোট্ট একটুখানি চিঠি?
কিন্তু সময় পাওয়া গেল না। বাইরে থেকে শিবদাসের হাঁক এল, কই রে, এত দেরি হচ্ছে কেন? আমার যে আবার ওদিকে অফিসের বেলা হয়ে যাবে?
বসন্তদাকে চিঠি আর লেখা হল না।
শিবদাস বেরিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে। আর দোতলার মোটা গিন্নিকে শুনিয়ে শুনিয়ে লতিকা বলে চললেন, মেয়েটা রেডিয়োতে গান গাইবে, আর বাড়িতে একটা রেডিয়ো নেই! কত বার বলেছি, কেনো—কেনো একটা, তা এমন হাড়কেপ্পন কিছুতেই কিনলে না!
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কুঁকড়ে গেল উমা। মা যে কখনো বাবাকে রেডিয়ো কিনতে বলেছিলেন এবং একশো ত্রিশ টাকা রোজগারের বাবা ইচ্ছে করলেই যে একটা রেডিয়ো কিনতে পারেন, এমন আশ্চর্য খবর উমা এই প্রথম শুনল।
আঃ, চুপ করো মা।
বাজারের তরকারি ঝাঁকায় তুলতে তুলতে লতিকা ঝংকার দিয়ে উঠলেন, কেন চুপ করব? রেডিয়ো থাকলে কি আর ভাবনা ছিল? নিজের মেয়ের গান ঘরে বসেই শুনতে পেতাম। তা না-ই রইল। যারা রাতদিন বসে বসে রেডিয়ো বাজায় তাদের ক-জনের মেয়েই-বা প্রোগ্রাম পায় শুনি?
শেষের শব্দভেদী বাণটা দোতলার মোটা গিন্নির উদ্দেশ্যেই। কিন্তু ও-পক্ষ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মোটা গিন্নির নিশ্চয়ই মাথা ধরেছে এতক্ষণে এবং কপালে ওডিকোলনের পটি লাগিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
বসন্ত এল বিকেল বেলাতেই। একমুখ প্রসন্ন হাসি হেসে বললে, ভারি খুশি হয়েছি উমা।
উমা পায়ের ধুলো নিলে বসন্তের, সব আপনার জন্যেই বসন্তদা।
আমার জন্যে? না না। বসন্তের মুখে হাসিটা লেগেই রইল। তোমার নিজের ভেতরেই শক্তি ছিল। আজ হোক কাল হোক তোমার যা পাওনা সে তুমি পেতেই।
উমা বসন্তের দিকে তাকাল। সে নিজে কুরূপা, কিন্তু তার চাইতেও কুৎসিত আর কদাকার বসন্তের চেহারা। একটা চোখ একেবারে সাদা, সে-চোখে সে দেখতে পায় না। বাঁ-গালটা কী করে পুড়ে গিয়েছিল, খানিক চামড়া তাল-পাকানো কাগজের ভাঁজের মতো কুঁচকে আছে সেখানে। দু-হাতের অস্থিসার আঙুলগুলো সবসময়েই অল্প অল্প কাঁপে—কোনো স্নায়বিক ব্যাধি আছে নিশ্চয়।
তবু তার আজকের এই সৌভাগ্য বসন্তের জন্যই। বসন্তই তার গানকে জাতে তুলে দিয়েছে।
শিবদাসবাবুর বাড়িতে বসন্ত প্রথম এসেছিল কী-একটা দূরতম আত্মীয়তার সূত্রে; আর দেখেই আঁতকে উঠেছিল উমা।
মা গো, কী বিশ্রী চেহারা লোকটার! যেন তাল গাছ থেকে নেমে এসেছে।
শিবদাস বলেছিলেন, না না, ছেলেটা খুব ভালো আর খুব বড়ো গাইয়ে।
গাইয়ে! সে-পরিচয় পেতেও দেরি হয়নি। অদ্ভুত ভাঙা গলা—গান গাইলে মনে হয় গোঙানি। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সেদিন সামনে থেকে পালিয়ে গিয়েছিল উমা।
তারপর আস্তে আস্তে ওই কদাকার মূর্তি আর বিকৃত কণ্ঠস্বরের আড়াল সরিয়ে আর একজন বসন্ত আত্মপ্রকাশ করল। কী বিচিত্র জীবন এই মানুষটার! কবচকুন্ডলের মতো অপরূপ সুরেলা গলা নিয়েই জন্মেছিল। নিজের সুরই কস্তুরী হরিণের মতো দিশেহারা করল তাকে। স্কুলের মাইনের টাকা নিয়ে উঠে পড়ল লখনউয়ের গাড়িতে, সেখান থেকে দিল্লি। বারো বছর পরে ফিরল কলকাতায়, তখন সে দস্তুরমতে ওস্তাদ।
পেছনে জোর ছিল না তাই রেডিয়ো-রেকর্ডে সুযোগ পেল না। শুরু করল গানের টিউশন। হাওড়া থেকে বেলেঘাটা, শ্যামবাজার থেকে বালিগঞ্জ। তারও পরে মেনিনজাইটিস। একটা চোখ সাদা হয়ে গেল, গলা থেকে নিশ্চিহ্ন হল গান।
গান গেল কিন্তু সুর রয়ে গেল। কাটা হাতে আর তুলি উঠল না, কিন্তু মনে রইল রঙের মেলা। টিউশনের বাজার কেড়ে নিলে অন্তঃসারহীন সুকণ্ঠের দল। বারো বছরের সঞ্চয় নিয়ে রত্নভান্ডারে যখের মতো পড়ে রইল বসন্ত।
শুধু রাজা লেনের বস্তির ঘরে যারা তার সন্ধান রাখত—তারাই দু-চার জন এল এগিয়ে। অদ্ভুত বিকৃত গলায় বসন্ত তাদের হাতে তুলে দেয় সুরের চাবি, মণিভান্ডার থেকে যা পারে তারা কুড়িয়ে নেয় দু-হাতে। আর এল উমা। শুধু দূরতম আত্মীয়তার সূত্রেই নয়, উমার গানে বসন্ত জাতশিল্পীর সন্ধান পেল।
চার বছর ধরে বসন্ত ইস্পাতে শান দিয়েছে; শ্রান্তিহীন চেষ্টায় সোনার তারের মতো উজ্জ্বল আর মসৃণ করে দিয়েছে উমার গলা। শিবদাসবাবুর মুখ এক-এক সময় বিকৃত হয়ে উঠেছে, কেবল পয়সা দিতে লাগে না বলেই সহ্য করে গেছেন কোনোমতে। কখনো কখনো লতিকা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছেন, এখন তোর ওই হা-হা-হা-হা বন্ধ কর বাপু, কান যে ঝালাপালা হয়ে গেল! সকালে রেওয়াজ শুরু করলেই পাড়ার কয়েক জন রসিক ছেলে শেয়াল ডেকে উঠেছে একসঙ্গে। দোতলার মোটা গিন্নির গর্জন শোনা গেছে, আর তো এ জ্বালা সহ্য হয়, কর্পোরেশনে একটা খবর দিলে হয়। সকাল-সন্ধে ওই মড়াকান্না শুনতে শুনতে পাড়ার কাক-চিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে সিঁটিয়ে গেল যে!
তবু উমা থামেনি, বসন্তই থামতে দেয়নি তাকে। পাড়ার ছেলেদের উৎপাতে এক-এক দিন কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে উমা, বলেছে, আপনি মিথ্যেই চেষ্টা করছেন বসন্তদা, আমার কিছু হবে না। উত্তরে কদাকার মুখে সস্নেহ হাসি হেসেছে বসন্ত, তোমার যদি না হয়, তাহলে কারও হবে না উমা। অনেক তপস্যা না করলে দেবতা প্রসন্ন হন না। সরস্বতীর বর পেতে গেলে তোমায় আরও কিছুদিন কষ্ট করতে হবে বই কী।
সেই তপস্যার আজ প্রথম ফল। রেডিয়োতে প্রথম প্রোগ্রাম। বসন্তের জিত হয়েছে। আজকে।
উমা তাকিয়ে রইল বসন্তের দিকে। যেমনভাবে সকালে শিবদাস আবিষ্কার করেছিলেন, তেমনি করে সেও যেন দেখতে পেল। ভারি সুন্দর, ভারি স্নিগ্ধ বসন্তদার মুখখানা।
লতিকা ঘরে ঢুকলেন। এই যে বসন্ত, কখন এলে? উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, শুনেছ তো খবর? দেখেছ চিঠিখানা?
উমা হাসল, চিঠি আর কী করে দেখবেন মা? তুমিই তো ওটা হাতে করে এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছ! লতিকা লজ্জা পেলেন, খামখানা বাড়িয়ে দিলেন বসন্তের দিকে। স্বল্পশিক্ষিত বসন্ত ঠোঁট বিড়বিড় করে ইংরেজি শব্দে হোঁচট খেতে খেতে কোনোমতে পড়ে ফেলল চিঠিটা। সাদা চোখটা পর্যন্ত যেন খুশিতে জ্বলে উঠল তার।
লতিকা উমার কথারই প্রতিধ্বনি করলেন, সবই তোমার জন্যে বাবা। তুমি এমন করে লেগে না থাকলে কিছুতেই কিছু হত না। শেষপর্যন্ত মেয়েটা তবু তোমার মুখ রেখেছে। তা একটু বসো তুমি—আমি চা করে দিই, দুটো মিষ্টিও আনাই তোমার জন্যে।
বসন্ত কুণ্ঠিত হয়ে বললে, থাক থাক, আপনি বিব্রত হবেন না। আমার গ্যাসট্রিক গোলমাল
আছে, বাজারের খাবার সহ্য হবে না। তার চাইতে উমার প্রোগ্রামটা ভালো করে হয়ে যাক–আমি এসে ওর রান্না পেট ভরে খেয়ে যাব।
সে তো খাবেই, নিশ্চয়ই খাবে। আনন্দে প্রায় তরল হয়ে গেলেন লতিকা, তোমাকে খাইয়েই তো পুণ্যি। তোমার জন্যেই তো ও আজ দশজনের একজন হতে পেরেছে।
বসন্ত হাসল, না মাসিমা, দশজনের একজন হতে এখনও কিছু দেরি আছে ওর। এ তো সবে শুরু। এখনও অনেক খাটতে হবে, বিস্তর তপস্যা করতে হবে।
লতিকা কী বলতে চাইছিলেন, কিন্তু থেমে গেলেন। সকালে একতরফা বাণবর্ষণ করেছিলেন, এবার ও-পক্ষ থেকে তির আসতে শুরু হয়েছে।
মোটা গিন্নির কলেজে-পড়া গোলগাল মেয়ে রুনকি সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আকাশকে কথা শোনাতে লাগল, ভারি তো পনেরো মিনিটের প্রোগ্রাম, তায় আবার দুপুরে। দুপুর বেলা তো ঝড়তি-পড়তি গাইয়েদের ওরা প্রোগ্রাম দেয়, পানওয়ালা আর রাস্তার ঝাঁকামুটে ছাড়া সে-গান কেউ তো শোনে না।
সারাদিনের পর এতক্ষণে মোটা গিন্নির দরাজ গলা গমগম করে উঠল, তারই চোটে তো সারাদিন কাড়া-নাকাড়া বাজছে। কাল থেকে রাস্তায় বোধ হয় পোস্টার পড়বে।
ঝগড়ার উৎসাহে লতিকার দুই চোখ দপ করে জ্বলে উঠল।
শুনলে বসন্ত, নিজের কানেই তো শুনলে? স্বরগ্রাম এক পর্দা চড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই, হিংসায় বুকের ভেতরটা একেবারে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে, তাই…
বসন্ত বাধা দিলে। শান্ত হাসি হেসে বললে, কেন ওসবে কান দিচ্ছেন মাসিমা! ওসব কথার উত্তর ঝগড়া করে দেওয়া যাবে না, উমা সত্যিকারের বড়ো গাইয়ে হয়ে তবেই ওর জবাব দেবে। আপনি আমার জন্যে চা আনবেন বলেছিলেন, নিয়ে আসুন।
আজ সেইদিন, সেই বারোই এপ্রিল।
বাড়িতে একটা রেডিয়ো নেই—সেই দুঃখে মরমে মরে যাচ্ছিলেন লতিকা। হঠাৎ কোথা থেকে বসন্ত এসে হাজির। শরীর ঘামে-ভেঝা, বগলে লোকাল সেট রেডিয়ো একটা।
উমা বললে, এ কী বসন্তদা! এ আবার কোত্থেকে আনলেন? কপালের ঘাম মুছে বসন্ত বললে, আমার এক বন্ধুর দোকান থেকে চেয়ে এনেছি। মাসিমার এত শখ তোমার গান শোনার, অথচ শুনতে পাবেন না—তাও কি হয়!
লতিকা উল্লসিত হয়ে বললেন, তা বেশ করেছ বাবা, খুব ভালো করেছ। পরের বাড়িতে কার কাছে শুনতে যাব? কত ঠ্যাকার করবে ঠিক নেই। বেশ হয়েছে। এখন তুমিই একটু ঠিকঠাক করে দাও, আমরা তো ওর কিছুই জানিনে।
ঘরের ভেতরেই এরিয়াল খাঁটিয়ে দিলে বসন্ত। উমা পুরানো টিপয়টা নিয়ে এল, তার ওপরে সাদা ঢাকনিও পেতে দিল একটা। সাদা প্লাস্টিকের ছোট্ট রেডিয়োটা খুশিতে ঝকমক করতে লাগল।
খুট করে সুইচ খুলে দিলে বসন্ত। অজানা গায়কের আধুনিক গান ঢেউয়ের মতো ভেঙে পড়ল ঘরের মধ্যে।
মুগ্ধ হয়ে লতিকা বললেন, কী মিষ্টি আওজায়—কী পষ্ট! এর কত দাম হবে বসন্ত?
বসন্ত বললে, কত আর? শ-খানেক হবে বোধ হয়।
শ-খানেক! লতিকা নিভে গেলেন।
চৌকির কোনায় বসে গানটা শুনতে লাগল উমা। আধুনিক গান গাইছে। এরাও প্রোগ্রাম পায়! গলায় কাজ নেই, একটু চড়ায় তুললেই বেসুরো হয়ে যাচ্ছে, অথচ এরাই নিয়মিত গান গেয়ে চলেছে—বাঁধা আর্টিস্ট! আর উমা…।
উমা জানে, তার গলাকে সোনার সুতোর মতো মেজে দিয়েছে বসন্ত। সুর তার ওপরে আলোর মতো ঝলমল করে ওঠে। এবারে দেশের মানুষ তার পরিচয় পাবে। এতদিন যা অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল, তা এইবার ফুলের মতো ফুটে উঠবে সকলের সামনে। তারপর… তারপর একদিন লোকে তারও গানের জন্যে প্রতীক্ষা করে থাকবে সেটের পাশে। উত্তেজিত হয়ে বলবে, আজকের প্রোগ্রাম মিস করা চলবে না—উমা দত্তের গান আছে সাড়ে ছটায়। তারও ছবি ছাপা হবে প্রোগ্রামের বইয়ের মলাটে। ডাক আসবে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে, নতুন রেকর্ডের তালিকায় তার নাম থাকবে সকলের ওপরে। নানা জলসা থেকে লোক আসবে, আসবে অসংখ্য ভক্তের চিঠি।
উমা! বসন্ত ডাকল। সুর কেটে গেল, ভেঙে গেল স্বপ্ন। আধুনিক গান তখন থেমে গেছে, কে যেন সেতারে সারং বাজাতে শুরু করেছে। এই সকাল বেলায় সারং! আশ্চর্য, এরাও প্রোগ্রাম পায়।
উমা! আবার ডাকল বসন্ত। পটলডাঙা লেনের এক-তলা ঘরের ম্লান আলোয় কেমন বীভৎস দেখাল বসন্তকে। একটা চোখ সাদা—যেন চোখের ওপর পাথরের পরকলা পরা। কপালের বাঁ-পাশে পোড়া চামড়াটা কুঁচকে রয়েছে, কতকগুলো কালো কালো ক্রিমি যেন জড়াজড়ি করছে একসঙ্গে। আর একটু সুন্দর হলে কী ক্ষতি ছিল বসন্তদার!
ভেবেই লজ্জিত হল উমা। সুরের জগতে সম্রাট বসন্তদা। দুর্ভাগ্য তার গলা থেকে গান কেড়ে নিয়েছে, তবু অফুরন্ত রত্নের ভান্ডার তার কাছে। তা থেকে কতটুকুই-বা নিতে পেরেছে সে আজ পর্যন্ত?
কী বলছিলেন বসন্তদা?
এসো, গান দুটো আর এক বার মহলা দেওয়া যাক।
উমা বললে, আর কী হবে? এতদিন ধরে যা হওয়ার সে তো হয়েইছে, এখন আর…।
লতিকা ধমক দিলেন, থাম থাম, বেশি বখামি করতে হবে না। বসন্ত বলছে—আর এক বার ঠিক করে নে। আজ ভালো গেয়ে ওদের খুশি করতে পারলে তবে তো ওরা আবার প্রোগ্রাম দেবে।
আচ্ছা, বসুন বসন্তদা। আমি আপনার জন্যে চা করে আনি। উমা উঠে দাঁড়াল।
লতিকা বিরক্ত হয়ে উঠলেন, হয়েছে হয়েছে, তোমায় আর কাজ দেখাতে হবে না এখন। এক পেয়ালা চা আমিই এনে দিতে পারব। তুই যা, ভুলটুল থাকলে এইবেলা ঠিক করে নে।
একটা মৃদু উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে উমার সকালটা বয়ে গেল। অডিশন দেওয়ার সময়েই বুকে থরহরি জেগেছিল, এখন কী হবে? সে তো শুধু মাইকের সামনেই গাইছে না, বিদ্যুতের স্রোত বেয়ে তার গান পৌঁছুবে হাজার হাজার মানুষের কাছে। কত গুণী-জ্ঞানী আছে তাদের মধ্যে, কত সমঝদার আছে তাদের দলে। সেই অসংখ্য অগণিত শ্রোতাকে সে কি খুশি করতে পারবে? যদি ঘাবড়ে যায়, যদি তাল কাটে, যদি বেসুরো হয়ে যায়? কাল রাত পর্যন্ত যেটা তাকে মাদকতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, মায়ের হাতে হাতে জীর্ণ হয়ে যাওয়া চিঠিখানাকে সকলের অগোচরে আর এক বার লুকিয়ে পড়বার সময় যে-ঢেউ দুলেছিল বুকের ভেতর, হঠাৎ তারা সব কেমন যেন স্তিমিত হয়ে এসেছে।
পারবে তো, পারবে তো উমা?
বসন্তদা বলেছেন কোনো ভয় নেই। কিন্তু ভরসাই-বা কোথায়? তখন তো বসন্তদা সামনে থাকবে না! অভয় দিয়ে বলবে না—ঠিক হচ্ছে, গেয়ে যাও! সব অপরিচিত, সবাই অনাত্মীয়। স্নেহের চোখ দিয়ে তারা কেউ তাকে দেখবে না—যাচাই করে নেবে। উমার হাত-পা যেন হিম হয়ে আসতে চাইল। হঠাৎ মনে হল রেডিয়ো-প্রোগ্রাম তার দরকার নেই। একটা ঝড় বৃষ্টি-সাইক্লোন কিছু হোক, ট্রাফিক বন্ধ হয়ে যাক কলকাতার, উমাকে যেন রেডিয়ো স্টেশনে যেতে না হয়।
কিন্তু কিছুই হল না। চৈত্র মাসের তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল আকাশে জেগে রইল খুরধার সূর্য, ঘড়ির কাঁটা চলল লাফে লাফে, তারপর যথাসময়ে এল বসন্ত।
একটা পনেরো এখন, রেডি তো উমা?
সাড়ে বারোটা থেকেই লতিকা উমাকে কাপড় পরিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। একটা থেকেই অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন, কেন এখনও আসছে না বসন্ত! আর রেডিয়োর সামনে বসে গান খবর সব শুনছিলেন কান পেতে। সঙ্গে সঙ্গেই তাড়া লাগালেন তিনি।
নে নে, তাড়াতাড়ি ওঠ। ও কী, তানপুরো পড়ে রইল যে! তুমি ওকে একটু উৎসাহ দিয়ে বাবা বসন্ত। যেরকম ভয় পাচ্ছে…
বসন্ত তার কুৎসিত মুখে খানিকটা সুন্দর হাসি হাসল, কোনো ভাবনা নেই মাসিমা, দেখবেন ও ভালোই গাইবে। মাকে একটা প্রণাম করে নাও উমা।
দুরুদুরু বুকে বসন্তের সঙ্গে বেরোল উমা। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে লতিকা বলতে লাগলেন, দুর্গা-দুর্গা! আহা, উমা আজ প্রথম রেডিয়োতে গাইবে, ওর বাবা কেবল শুনতে পেল না। কী যে পোড়া অফিস—একটা দিনও ছাই ছুটি দেবে না!
ওপর থেকে দোতলার মোটা গিন্নির একটা চাপা হাসি যেন শোনা গেল। এক বার অগ্নিদৃষ্টি তুলে লতিকা অলক্ষ্য মেঘনাদকে খুঁজলেন, তারপর ঘরে এসে রেডিয়োটাকে পুরোদমে খুলে দিয়ে বসে রইলেন ব্যাকুল প্রতীক্ষায়।
কিছুতেই রেডিয়ো স্টেশনের ভেতরে ঢুকল না বসন্ত। চোরের মতো দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।
আপনি আসবেন না বসন্তদা?
না না, আমি এখানেই থাকি।
আমার যে বড়ো ভয় করছে! উমার ঠোঁট কাঁপতে লাগল।
কিছু ভাবনা নেই, চলে যাও ভেতরে।
অগত্যা এগিয়ে গেল উমা। যেতে যেতে বার কয়েক করুণ চোখে ফিরে তাকাল। মাথা নেড়ে নিঃশব্দে উৎসাহ পাঠাল বসন্ত।
মাথার ওপর চৈত্রের রোদ জ্বলছে। পথে গলে যাচ্ছে পিচ। হাই কোর্ট যাত্রী লক্ষীছাড়া চেহারার ট্রামগুলো কর্কশ শব্দ তুলে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে। বসন্ত হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে ফেলল এক বার। এখনও কুড়ি মিনিট দেরি।
দু-পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল লালদিঘির রেলিঙের পাশে। টেলিফোনের নতুন সাদা বিশাল বাড়িটা রোদে অদ্ভুতভাবে ঝকঝক করছে, কাচের জানলাগুলো থেকে যেন ঠিকরে পড়ছে হিরের ধার। চারিদিকে অবিশ্রাম ক্লান্ত কর্মযাত্রা। বসন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল, এরই ভেতরে নিরুদবিগ্ন চিত্তে প্রায় ন্যাড়া একটা গাছের ডালে এক জোড়া কাক নিবিষ্ট মনে বাসা বাঁধছে।
উমার চাইতেও চঞ্চল হয়ে উঠেছে বসন্ত। ঘড়ির কাঁটা যত এগোচ্ছে, রক্তের মধ্যে ততই ঝড়ের মতো শনশনানি উঠছে একটা। ধুলোপড়া ময়লা রেলিংটাকে সে মুঠো করে চেপে ধরল। তার হাঁটু দুটো কাঁপছে।
মাথার ওপর গাছের একটা হালকা ছায়া আছে বটে, তবু কী অসহ্য তাপ ঠিকরে আসছে। তার ভেতর থেকে! একটা বিড়ি ধরিয়েই ফেলে দিল বসন্ত-বিশ্রী তেতো লাগছে মুখটা। পকেটে হাত দিতে একটা এলাচের খোসা পাওয়া গেল, নির্মমভাবে সেইটেকেই চিবুতে লাগল চুয়িং গামের মতো।
একটা সাতান্ন–একটা আটান্ন–
ঠিক রেডিয়ো স্টেশনের সামনেই একটা পানের দোকানে রেডিয়ো সেট দেখেছে বসন্ত। একটু আগেও সেটা বাজছিল। ঘর্মাক্ত দেহে সেই দিকেই চলল পায়ে পায়ে।
হৃৎপিন্ডে শীত ধরিয়ে দেওয়া একটা ঘোষণা। তারপর বাজনা। তারপর…
গান গাইছে উমা। হ্যাঁ, উমাই। সেই চেনা গলা, সোনার তারের মতো যাকে মেজে মেজে মসৃণ করে দিয়েছে। সেই সুর, যে-সুর দিনের পর দিন শিখিয়েছে একনিষ্ঠভাবে। পারবে তো উমা?
পারছে, চমৎকার পারছে! প্রথম মিনিট খানেক যেন একটু আড়ষ্ট লাগছিল, এখন ঝলকে ঝলকে আলোর মতো বেরিয়ে আসছে গান। কিন্তু ক-জন শুনছে কান পেতে! বসন্ত এক বার প্রাকুটি করে তাকাল চারদিকে। ঝরঝরে ট্রামগুলো অসহ্য আওয়াজ তুলে ছুটে চলেছে, পথ চলতি মানুষগুলো এক বারও থেমে দাঁড়াচ্ছে না উমার গানের আকর্ষণে। এমনকী হতভাগা পানওয়ালাটা পর্যন্ত শুনছে না গানটা—একজন খরিদ্দারের সঙ্গে গল্প করছে সমানে।
বেরসিক! ক্রুদ্ধভাবে স্বগতোক্তি করল বসন্ত। সত্যিই খুব ভালো গাইছে উমা, এত ভালো এর আগে যেন ও কখনো গায়নি। কিন্তু এমন দুম দুম করে কেন তবলা পিটছে তবলচিটা? যেন জয়ঢাক বাজাচ্ছে—খারাপ করে দিচ্ছে গানটাকে।
নির্ভুল সুরের পরিক্রমা শেষ করে উমা এসে থামল। বেশ গেয়েছে—খাসা! আবার একটা ঘোষণা। এবার দ্রুতলয়ের গান। অনেক সহজ, অনেক স্বাভাবিক হয়েছে উমা, যেন অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছে।
একটা ছোকরা তাল দিতে দিতে চলে গেল। কথার ফাঁকে ফাঁকে পানওয়ালার মাথা দুলছে
আস্তে আস্তে।
বসন্ত বলে ফেলল, বাঃ, বেশ হচ্ছে!
পানওয়ালা ফিরে তাকাল, কিছু বলছেন বাবু?
লজ্জিত হয়ে বসন্ত বললে, না না, ও কিছু না।
গান শেষ হল। চমৎকার উতরে গেছে উমা। প্রথম দিনেই সচরাচর এত ভালো গাইতে শোনা যায় না। আনন্দে গৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে অভিনন্দন জানাবার জন্যে বসন্ত গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।
পাঁচ মিনিট। দশ মিনিট। বারো মিনিট।
মাথার ওপরে চৈত্রের সূর্য। পথে পিচ গলছে। পানওয়ালার রেডিয়ো থেকে রুক্ষ গলায় পল্লি-সংগীত ভেসে আসছে—ঝুমুর গাইছে। বসন্তের অসহ্য বোধ হল। ওর নাম ঝুমুর নয়, ঝুমুরের ক্যারিকেচার। ওর চাইতে অনেক অনেক ভালো ঝুমুর আসে উমার গলায়।
ট্রামের শব্দ। বাসের ভেঁপু। পোড়া তেলের কটু গন্ধ তপ্ত হাওয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া মোটর। লক্ষ লক্ষ ধারালো লোহার শিকের মতো রোদের ছোঁয়া। এখনও কেন আসছে না উমা?
উমা এল আরও দশ মিনিট পরে, শার্টের তলায় বসন্তের গেঞ্জিটা যখন ভিজে জবজবে হয়ে গেছে, তখন।
কিন্তু একা এল না। সঙ্গে বেরিয়ে এল আর একজন। এই মানুষটিকে অনেক বার দেখেছে বসন্ত। গানের জলসায়, অসংখ্য পত্রপত্রিকার পাতায়।
সিতাংশু চ্যাটার্জি। দুর্দান্ত আধুনিক গাইয়ে। বাংলা দেশ পাগল হয়ে থাকে সিতাংশুর নামে। উমা খুশিতে ঝলমল করতে করতে আসছে তার সঙ্গে। তার হাতে সবুজ রঙের ভাঁজ-করা চেকটা।
উমার দৃষ্টি তখন সুদর্শন দীর্ঘকায় সিতাংশুর মুখের দিকে। অল্প অল্প স্নিগ্ধ প্রশ্রয়ের হাসি হাসছে সিতাংশু। উচ্ছল গলায় উমা বলছে, সত্যি ডুয়েট রেকর্ড করবেন আমার সঙ্গে সত্যিই?
আর কি দাঁড়ায় বসন্ত? আর কি দাঁড়াতে পারে? একটা চোখ সাদা, কপালে খানিক পোড়া কোঁকড়ানো চামড়া, বিশ্রী ভাঙাগলার স্বর। সিতাংশুর সামনে দাঁড়াবার সাহস আছে নাকি বসন্তের?
চট করে সামনের হাই কোর্টের ট্রামটাতেই উঠে পড়ল বসন্ত, উমা দেখবার আগেই। এই নিয়ে তিন জন। মনে মনে জানত, ঠিকই জানত এবারেও এমনই একটা-কিছু নিশ্চয় ঘটবে। কিন্তু আজ দুপুরের রোদের শলায় যেন বিষ মেশানো ছিল। ইডেনগার্ডেনের শ্যাওলাভরা বদ্ধ জলটার পাশে মরা ঘাসের মধ্যে পা ছড়িয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সেই বিষের জ্বালায় জ্বলল বসন্ত। অনেকক্ষণ ধরে।
তারপর বিকেলের গাড়িতে চলে গেল দেশে। বর্ধমানের দূর গ্রামের একটা ভাঙা বাড়িতে কিছুদিন মুখ খুঁজড়ে পড়ে থাকবার জন্যে।
পালাটা বসন্ত শেষ করতেই চেয়েছিল। কিন্তু উমাই যে তাকে থামতে দেবে না কে জানত সেকথা?
এক মাস পরে রাজা লেনের সেই খোলর ঘরে দুপুরের ঝিমুনিটা হঠাৎ কেটে গেল বসন্তের। উমাই ডাকছে। কোনো ভুল নেই।
ধড়মড় করে উঠে বসন্ত দরজা খুলে দিলে, এ কী, উমা!
অল্প অল্প হাঁপাচ্ছিল উমা। রেডিয়োটা নামিয়ে রাখল বসন্তের তক্তপোশের কোনায়। মস্তবড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, এটা ফেরত দিতে এলাম।
কেমন অপ্রতিভ আর অপ্রস্তুত হয়ে গেল বসন্ত। সংকোচে কুঁকড়ে গেল।
তুমি আবার কষ্ট করে আনতে গেলে কেন? আমিই তো যেতাম।
না, আপনি যেতেন না। শীর্ণ হাসি হাসল উমা, আজ এক মাসের মধ্যেও যাননি।
বসন্ত ঢোক গিলল, শরীর খারাপ হয়েছিল, দেশে গিয়েছিলাম।
কৈফিয়ত দিতে হবে না বসন্তদা, আমি জানি। এবার বিনা নিমন্ত্রণেই উমা বসন্তের তক্তপোশের কোনায় বসে পড়ল। আর একটা খবর আছে। আসছে মাসে ফের প্রোগ্রাম দিয়েছে রেডিয়োতে। সেই মেটে রঙের লেফাফা উমা বের করে আনল। এবার দুটো সিটিং। দশ আর পনেরো—মোট পঁচিশ মিনিট।
ভালোই তো! বসন্ত খুশি টেনে আনতে চাইল গলায়, দেখি—দেখি!
দেখে কী হবে? উমা খামটা সরিয়ে নিলে, বাবা-মার হাতে পড়বার আগেই এটা তোমার কাছে আমি নিয়ে এলাম বসন্তদা। ভেবে দেখলাম, এ প্রোগ্রাম আমি নেব না। আরও অনেক শিখতে হবে আমাকে অনেক বাকি এখনও। এসব থাক এখন।
ছি ছি, করছ কী!
কিন্তু বাধা দেওয়ার সময় পেল না বসন্ত। তার আগেই টুকরো টুকরো করে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল উমা। অসহ্য বিস্ময়ে বসন্তের একটা মাত্র চোখে আর পলক পড়ল না। মুখ দিয়ে যান্ত্রিক শব্দ বেরিয়ে এল–কী করলে উমা, এ কী করলে।
ঘরের বিষণ্ণ ছায়ায় এক বারের জন্যে বসন্তের মুখখানা অদ্ভুত কুৎসিত লাগল উমার, হঠাৎ যেন বসন্তকে একটা একচক্ষু দানবের মতো মনে হল। ছেঁড়া চিঠির টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে নাড়ি-ঘেঁড়া যন্ত্রণা আর্তনাদ করে উঠল বুকের মধ্যে।
তারপর আবার শীর্ণ হাসি হেসে উমা বললে, এই ভালো হল বসন্তদা। এখনও তো আমার অনেক শেখা বাকি আছে, ব্যস্ত হয়ে কী লাভ?