(পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দুর্দান্ত অফিসার জ্ঞান লাহিড়ীর নাম সাধারণের কাছে ততটা না হলেও, সারা ভারতের পুলিশ বিভাগে আর অপরাধী জগতেও অতি-পরিচিত ছিল। পুলিশ বিভাগে সংক্ষেপে জেল (জে-এ) আর সমাজে বিরোধীদের কাছে GUN নামে তাঁর যে পরিচিতি ছিল, সেটাই তাঁর গোয়েন্দাজীবনের সাফল্য ও দুর্ধর্ষতা জানিয়ে দেয়।
এহেন একজন ব্যক্তি জীবনের মাঝখানেই হঠাৎ যখন স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। জ্ঞানবাবুর মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁর একটা ব্যক্তিগত ডায়েরি পাওয়া যায়। তাতে অবসরগ্রহণের যে কারণ লেখা ছিল, সেটা পুলিশ বিভাগকে আরও হতভম্ব করেছিল। সেই ডায়েরি থেকে তাঁরই ভাষায় উদ্ধৃত করছি। শুধুমাত্র বিশেষ কারণে জ্ঞানবাবুর বন্ধুর নামটি এখানে বদলে দেওয়া হয়েছে।)
কাগজে খবরটা বেরিয়েছে বেশ ফলাও করে। কারণ লেখা হয়েছে, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় যান্ত্রিক বিস্ফোরণ এবং তাতে দুর্বল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু। এবার আমি একদিক থেকে নিশ্চিন্ত। কিন্তু অন্য এক পাপবোধ আমার বুকে যেন মৃত্যুবাণের চেয়েও তীব্রভাবে বিধে যাচ্ছে সবসময়ে। তাই এই গোয়েন্দাজীবনের কাজ থেকে অবসর নিয়ে অন্য কোনও শান্ত কর্মজীবন বেছে নেব।
স্বাস্থ্যের কারণ অজুহাতটা উঁচু মহল থেকে আরম্ভ করে কেউই বিশ্বাস করবে না হয়তো। কিন্তু আসল কারণটা–সেটা লেখা থাক আমার এই ব্যক্তিগত ডায়েরিতেই।
তা-ও লিখব না ভেবেছিলাম। এই ডায়েরিতে অনেক কথাই লেখা আছে। অনেক অভিযানের কথা। খুন, চুরি, ডাকাতির কথা। কিন্তু এর কাছে তাদের অপরাধ তো সাধারণ স্তরের, ধরাছোঁয়ার মধ্যে! তাই ভেবেছিলাম, এই লেখা একদিন প্রকাশ হয়ে পড়লে হয়তো আবার কোনও বিকৃতমস্তিষ্ক প্রতিভাধর সেই অস্ত্রের অধিকারী হয়ে সমাজে বিপর্যয় আনবে। কিন্তু পরে ভাবলাম, বৃথা দুশ্চিন্তা। প্রকৃতির নিয়মেই তো এইসব অপরাধীর পতন ঘটে, হোক-না সে যত শক্তিরই অধিকারী। রামায়ণ-মহাভারত থেকে ইতিহাসের পাতায় তো শুধু সেই দৃষ্টান্ত। নইলে কেনই বা দুলাল পাত্র এত লোক থাকতে আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিল?
ঘটনাটা প্রথম থেকেই লিখে রাখি।
.
১৫ মার্চ, শনিবার। সন্ধে প্রায় সাতটা।
একটা বিখ্যাত খুনের কেসের প্রায় সুরাহা করে এসে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছি। কিছুক্ষণ। এমন সময় বেহারা এসে একটা স্লিপ দিয়ে গেল। জনৈক দুলাল পাত্র আমার দর্শনপ্রার্থী। সাধারণত আমার সঙ্গে অপরিচিত লোকের দেখা করার ব্যাপারে একটু কড়াকড়ি রক্ষা করা হয়। কার্যোপলক্ষ্যে শত্রু আমার অনেক। তাই ঘরে ঢোকার আগে যন্ত্রের সাহায্যে দেখে নেওয়া হয় তাদের কাছে কোনও অস্ত্র আছে কি না। তা ছাড়া ডিপার্টমেন্টের লোক ছাড়া সাধারণত কেউ ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার কাছে আসেও না। কারণ আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই।
কিন্তু দুলাল পাত্র এসেছে এখানকার ধনী ব্যবসায়ী এবং এককালের খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক নির্মাল্য সিংহরায়ের কাছ থেকে। শুধু তা-ই নয়, নির্মাল্য আমার কৈশোরের বন্ধু ও সহপাঠী।
মনে পড়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার দিনগুলোর কথা। আধময়লা ইস্তিরিবিহীন জামাকাপড় পরে নির্মাল্য কলেজে আসত। একমাথা চুল প্রায়ই আঁচড়াতে ভুলে যেত। পরীক্ষায় অঙ্কে যে ছেলে প্রায়ই পুরো নম্বর পেত, সে-ই আবার পয়সার হিসেব রাখতে না পেরে দোকান-বাজারে ঠকে বেড়াত। সেই নির্মাল্যই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে বিলেতে পাড়ি দিল, তখন আমরা বলাবলি করতাম, ওখানে ভুল করে শুধু গেঞ্জি গায়ে কলেজে হাজির হলেই চিত্তির। আর্কিমিডিসের সময় ওসব চলত।
এত আত্মভোলা লোক হলে কী হবে, কেউ তাকে ঠকিয়েছে জানলে নির্মাল্য খেপে লাল হয়ে যেত। চোর-ডাকাত-পকেটমার সবাইকেই সে অহরহ ফাঁসি দিত। আমরা বলতাম, ভাগ্যিস তুই জজ হবি না।
একবার তাদের বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তায় একটা মোটা লোককে দেখিয়ে আমাকে বলেছিল, চিনির ব্ল্যাক করে লোকটা লাল হয়েছে। একদিন ছাদের ওপর থেকে দেব ওর মাথায় কনসেনট্রেটেড নাইট্রিক অ্যাসিড ঢেলে। আমি উত্তর দিলাম, দিয়েই দেখ-না। লোকে তোকেই ধরবে। লোকটার কালোবাজারি করার কোনও প্রমাণ দেখাতে পারবি? তোর প্রমাণ হাতেনাতে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, সেই তো হয়েছে মুশকিল। আড়াল থেকে মৃত্যুবাণ যদি মারা যেত।
হেসে উত্তর দিলাম, ওসব বাচ্চাদের মনোভাব। গায়ের জোরে কারও সঙ্গে না পারলে তারা ভাবে, আহা, আমার যদি কোনও অলৌকিক শক্তি থাকত! ঠিক অরণ্যদেবের মতন।
কর্মজীবনে আমার আর নির্মাল্যর পথ দু-দিকে চলে গেল। বৈজ্ঞানিক নির্মাল্যর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকলেও ব্যবসায়ী নির্মাল্যর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ অনেক কমে গেল। তার মতো আত্মভোলা লোক ব্যাবসার ক্ষেত্রে নাম করেছে, এতে বেশ অবাক হলেও তার ওপর রাগও হয়েছিল। আমার বিশ্বাস ছিল, বিজ্ঞানে সে বিশ্বজোড়া নাম পেত। আমার দেশের সম্মান বাড়ত। আজ হঠাৎ নির্মাল্য আমার কাছে লোক পাঠিয়েছে শুনে তখনই তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলাম।
দুলাল পাত্র লোকটা–লোকটা না বলে ছেলেটা বললেই বোধহয় ঠিক হয়–তার নামের মতোই নিরীহ আর শান্ত। বয়স কুড়ির কমই হবে। ধুতির ওপর ফুলহাতা শার্ট। চুলের প্রচুর তেল কপালের কিছুটাও তৈলাক্ত করেছে। চোখের মধ্যে সারল্য আছে, একেবারে বুদ্ধিহীন সারল্যও নয়। তবে যাকে বলে স্মার্টনেস, সেটা স্বাভাবিকভাবেই অনুপস্থিত। দেখেই বোঝা যায়, শহরের জলে তার গ্রাম্যতা এখনও ধুয়ে যায়নি।
ঘরে ঢুকেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার, নির্মাল্যর খবর কী?
ছেলেটা যেন চমকে উঠল। তারপর ভীতভাবে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। আমি তার এই হাবভাবে একটু ঘাবড়ে গেলাম। তবে কি নির্মাল্যর কোনও বিপদ ঘটেছে?
দরজার পাশে দাঁড়ানো প্রহরীকে সরে যেতে দেখে দুলাল বলল, আমাকে সে গোপনে কিছু কথা বলতে চায়। কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবু বললাম, সে স্বচ্ছন্দে এখানেই সে কথা বলতে পারে। অভ্যাসবশত আমার আঙুলের চাপে টেবিলের তলায় ফিট-করা টেপরেকর্ডারটাও চলতে শুরু করল।
দুলাল যা বলল, তা অবিশ্বাস্য আর হাস্যকর মনে হলেও সুদূর অতীত ছাত্রজীবনের একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে সবই শুনে গেলাম।
দুলাল বলল, সে নির্মাল্যর ইউরেকা ল্যাবরেটরি ইন্সট্রুমেন্টস-এর একজন কর্মচারী। নির্মাল্যর বাড়ির তলাতেই অফিস। সে সব সময়ের জন্যে ওই বাড়িতেই থাকে। তারা ওসব যন্ত্রপাতি তৈরি করে না। দেশ-বিদেশ থেকে এনে সাপ্লাই দেয়। এই কাজে লাভ আছে ঠিকই, কিন্তু নির্মাল্যবাবুর আসল টাকা তাতে আসেনি। তিনি তন্ত্রসাধনা করে বাণ মারতে পারেন।
তাদের গ্রামে নাকি এরকম একজন লোক ছিল, ঠাকুমার কাছে শুনেছে। যার নামে মন্ত্র পড়ে বাণ মারবে, সে যেখানেই থাকুক-না কেন, রাত না পোয়াতেই মুখে রক্ত উঠে মরে যেত। দিল্লিতে এক বিখ্যাত নেতা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যায়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক নেতাকে তার আগে নির্মাল্যবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে দেখা গিয়েছিল। কিছু দিন আগেও একজন বিখ্যাত অভিনেতা মারা যাওয়ার আগে আর-একজন মাঝারি অভিনেতাকে নির্মাল্যবাবুর কাছে আসা-যাওয়া করতে দেখা যায়। এখন সেই মেজো অভিনেতাই সেই বিখ্যাত অভিনেতার জায়গা দখল করে নিয়েছে। এরকম কতকগুলো ঘটনার কথা দুলাল বলল।
দুলাল অনেকদিন ধরেই আঁচ করেছিল। কিন্তু তার বিশ্বাস হত না যে, তার মনিবের মতো অত অমায়িক সম্ভ্রান্ত লোক এ কাজ করতে পারেন। কিন্তু সে এবার নিশ্চিত। গতকালই একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, আরেকজন ব্যবসায়ীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। নির্মাল্যবাবু বেশি টাকা দাবি করাতে ব্যবসায়ীটি জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল। সেই সময় দুলাল কী কাজে ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন তার দিকে নির্মাল্যবাবু যেভাবে তাকিয়েছিলেন, তাতে তার ভেতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। ব্যবসায়ীটি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল। না হয়ে উপায় কী? নইলে তাকেই যে মরতে হবে।
বলতে বলতে সরল গ্রাম্য তরুণ দুলাল পাত্রর ভিতু-ভিতু চোখ দুটো যেন উত্তেজনায় চকচক করে উঠল। দুলালের দৃঢ় বিশ্বাস, এবার তাকে মরতে হবে। আমিও তাকে রক্ষা করতে পারব না। মরার আগে তাই সে এই ছদ্মবেশী খুনির কথা আমাকে জানিয়ে যেতে চায়। আমার নাম সে শুনেছে। সে আশা করে, আমি যদি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারি।
দুলালকে বাড়ি ফিরতে বলে আমি টেপটা আরেকবার শুনলাম। সত্যিই কি নির্মাল্য অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করেছে কোনও তন্ত্রসাধনা করে? কিন্তু সে তো এসব জিনিস একেবারে বিশ্বাস করত না। হয়তো সবই দুলালের গ্রাম্য কুসংস্কার।
হয়তো অন্য কাজের মধ্যে এই অলৌকিক ব্যাপারের কথা ভুলে যেতাম, যদি না পরদিনই কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাতেই বিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রভুদয়াল পোদ্দারের আকস্মিক মৃত্যুর খবরের সঙ্গে সঙ্গে সেই কাগজেরই শেষ পৃষ্ঠায় ঘটনা দুর্ঘটনা শিরোনামে ছোট্ট একটা খবর দেখতাম। দুলাল পাত্র নামে এক তরুণের ট্রাম-রাস্তায় হঠাৎ হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার খবরটাও অন্যান্য সংবাদের মধ্যে নগণ্য মনে হলেও আমার কাছে অসামান্য। একই নামের দু-জন লোক থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্থানটি আমার বাড়ির কাছাকাছি, সময়টাও আমার সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার কিছু পরেই।
অফিসে ফোন করে মৃতের পরিচয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলাম।
এবারে আমার কর্মপন্থা স্থির করে ফেললাম। কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম নানা জায়গায়। তথ্য যা সংগ্রহ হল তা মোটামুটি সন্তোষজনক। দিল্লি আইবি-র মি, ভাটিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজনৈতিক নেতার কাছে যে ব্যক্তির আসা-যাওয়া ছিল, তার একটা বর্ণনা গেলাম। তবে মি. ভাটিয়া জানালেন, আমার সন্দেহভাজন ব্যক্তির একটা ফোটো পাঠালে তিনি এ ব্যাপারে সঠিক খবর জানাতে পারবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই সাদা পোশাকে বন্ধুগৃহ অভিমুখে যাত্রা করলাম।
মস্ত বাড়ি। গেটে দারোয়ান থেকে অন্য কাজের লোকজনে বাড়ি ভরতি। নির্মাল্য বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে প্রথমে কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু সে ক্ষণিকের। পরমুহূর্তেই মুখের ভাব বদলে ফেলে কণ্ঠস্বরে উল্লাস এনে বলল, আরে, গ্যানা যে! চিনতেই পারিনি প্রথমে। আয় আয়। তুই তো এখন পুলিশের বিরাট মাথা। তোর নাম প্রায়ই দেখি কাগজেটাগজে।
আমাকে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকে বোতাম টিপে বেয়ারাকে ডেকে কফির অর্ডার দিল। নির্মাল্য যে বৈজ্ঞানিক, তার নিদর্শন এই বৈঠকখানাতে সে রেখেছে। দেয়ালে গ্যালিলিও, আইনস্টাইন, কুরি থেকে জগদীশচন্দ্র সকলের ফোটো টাঙানো। দরজার ওপরে ফ্রেমে বাঁধানো লেখা–Cogito crgo sum–এই তিনটে শব্দ। মানে জিজ্ঞেস করলে নির্মাল্য হেসে বলল, ওটা একজন বৈজ্ঞানিকের উক্তি। অর্থ–আমি চিন্তা করছি, সুতরাং আমি আছি।
সব দেখে-শুনে মনে হল, বৈজ্ঞানিক নির্মাল্যর চেয়ে ব্যবসায়ী নির্মাল্য অনেক স্মার্ট। টেবিলের ওপর একটা বড় অ্যালবাম। উলটিয়ে দেখতে লাগলাম। নির্মাল্যর জীবনের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনার ছবি। হঠাৎ একটা মতলব মাথার মধ্যে খেলে গেল। কথাবার্তার ফাঁকে ওর একটা সিঙ্গল ফোটো নির্মাল্যর অজ্ঞাতসারেই খুলে নিলাম। মি. ভাটিয়াকে একটা ফোটো পাঠানো নিতান্তই দরকার। হঠাৎ নির্মাল্যর ফোটো চেয়ে এখুনি তার মনে কোনও সন্দেহের সৃষ্টি করার ইচ্ছে আমার ছিল না।
নির্মাল্য বিয়ে-থা করেনি। দুলাল পাত্র বলেছিল, যারা বাণ মারে, সেইসব গুনিন বিয়ে থা করে না। করলে নিজের পরিবারে মৃত লোকদের অভিশাপ ফিরে আসে। এসব কথা ভাবছি, এমন সময় ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে উঠতেই নির্মাল্য উঠে গিয়ে ধরল। কোনও এক প্রমথর সঙ্গে কথা বলল। কথা বলতে বলতে আড়চোখে আমার দিকে একবার তাকাল, তারপর পরে হবে বলে রিসিভার রেখে দিল। আমার কাছে এসে বলল, কী খবর বল।
আমি কৌশলে কাজের দিকে এগোলাম। নির্মাল্যর মতো ব্যোমভোলা লোক রাতারাতি এরকম ব্যবসায়ী হয়ে উঠল কী করে, সে বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতেই সে গম্ভীর হয়ে বলল, তুই কি ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করছিস?
আমার গোয়েন্দাগিরি আরও গভীর ব্যাপারে। সে কথা তাকে সোজাসুজি বুঝতে না দিয়ে বললাম, সেসব কথা মনে পড়ে তোর? চোর-ডাকাত-কালোবাজারিদের মৃত্যুবাণ মেরে শাস্তি দেবার কথা?
আমার কথায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল নির্মাল্য। তার মুখটা যেন ফ্যাক্যাশে দেখাল।
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে চললাম, প্রভুদয়াল পোদ্দারের মতো যদি চোরছ্যাঁচড়গুলো হার্টফেল করে মরত, তবে দেশে কত শান্তি হত, তা-ই না?
নির্মাল্য শক্ত হয়ে গেল। তারপর একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করে বলল, তুই কী বলতে চাস?
আমি পকেট থেকে ক্যাসেট বার করে বোতাম টিপতেই দুলালের কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল। নির্মাল্য হতভম্ব হয়ে শুনল। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, দুলাল তবে তোর কাছেই গিয়েছিল। আমি আন্দাজ করেছিলাম ওরকম। কিন্তু এসব একেবারে আজগুবি কথা। সকলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গিয়েছে, সে তো ডাক্তাররাই বলেছে। ওর কথা কোনও সভ্যজগতের আদালতেই টিকবে না।
আমি বললাম, এই টেপের কপি লালবাজারে আছে। তা ছাড়া এই ক-দিনে তোর বাড়িতে কয়েকটা টেলিফোন আসে, সেগুলোও ট্যাপ করে রেকর্ড করা হয়েছে। কোনও এক প্রমথ তোর জন্যে নানা অর্ডার নিয়ে আসে। যন্ত্রপাতির অর্ডার নয়, মানুষ মারার অর্ডার। নীলমাধব সেন নামে সম্পত্তির আরেক ভাগীদারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার জন্যে একজন তোকে প্রচুর টাকা দেবে বলেছে। তার নাম, টাকার পরিমাণ সবই রেকর্ড করা হয়েছে।
নির্মাল্য টলোমলোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাঃ, বেশ আটঘাট বেঁধে নেমেছিস তো বন্ধুর উপকারে। ঠিক আছে। আয়, তোকে দেখাচ্ছি আমার তন্ত্রসাধনা। এ ঘরে আয়।
পাশের ঘরে ঢোকার সময় দেয়ালে লাল আলো জ্বলে উঠতেই নির্মাল্য বলল, তোর পকেটে কিছু ধাতব জিনিস আছে। ওগুলো ওই ড্রয়ারে রেখে আয়। ভয় নেই। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সব তোকে ফেরত দেওয়া হবে। ঘাবড়াসনে।
মনে মনে হাসলাম। জ্ঞান লাহিড়ী ভয় কাকে বলে জানে না। তা ছাড়া আমি এক ঘণ্টার মধ্যে এ বাড়ি থেকে না বেরোলেই পুলিশে ঘিরে ফেলবে এ বাড়ি। নির্দ্বিধায় পকেট থেকে রিভলভার আর ছোট্ট টেপরেকর্ডার বার করে ড্রয়ারে রাখলাম। নির্মাল্যর পেছন পেছন একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকলাম। আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ক্লিক করে শব্দ হল। ঠিক যেন কেউ ক্যামেরায় ছবি তুলল।
টেবিলের ওপর একটা বাক্সের মতো যন্ত্র। সেটাকে দেখিয়ে নির্মাল্য বলল, এই আমার মৃত্যুবাণ। দুলাল ভুল বলেছিল। বৈজ্ঞানিক নির্মাল্য সিংহরায় ওসব তন্ত্রসাধনার তোয়াক্কা করে না, তার মাথার মধ্যে এই পদার্থ থাকতে। বলে সে নিজের মাথায় দু-বার টোকা দিল।
তারপর সুইচ টিপে বাক্সটার গায়ে একটা আলো জ্বেলে বলল, এ জগতে একটা আশ্চর্য জিনিস হচ্ছে, কোনও দুটো মানুষের চেহারা, তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের হাতের, পায়ের ছাপ কখনও হুবহু একরকম হয় না। অনেক সময় আশ্চর্যরকম মিল দেখা যায়– বিশেষ করে যমজ ভাই বা বোনের চেহারায়। কিন্তু অবিকল একরকম নয়। সে শুধু সিনেমার গল্পেই হয়। যে মানুষকে মৃত্যুবাণ মারব, তার একটা ফোটো জোগাড় করে খোপে ভরতে হবে। ফোটোতে মানুষের দেহের প্রতিফলিত আলো মুদ্রিত থাকে। পরপর ছ-টা ফোটো একসঙ্গে রাখা যায় অনেকটা রিভলভারের কার্তুজের মতন, তা-ই না?
এই বলে নির্মাল্য আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, যার ফোটো আগে পোরা হবে, সে আগে মরবে। এখন মাত্র একটা ফোটো ভরা আছে, সেটা নীলমাধব সেনের। আমার এজেন্ট প্রমথই এটা জোগাড় করে এনেছে শরিকের কাছ থেকে। এরপর কার ফোটো ভরব, সেটা… কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই নির্মাল্য স্থিরচোখে আমার দিকে চেয়ে থাকল।
হঠাৎ যেন সংবিৎ পেয়ে আবার বলতে লাগল, এটা আমার এক আশ্চর্য আবিষ্কার। অথচ, এটার কথা প্রকাশ করলে লোকের কাছে আমার পরিচয় হবে অপরাধী। আবার দেখ, অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমার মতো অস্ত্র–যা একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে মারে–সেগুলোর আবিষ্কর্তারা মহান বিজ্ঞানী।
যন্ত্রটার ওপর হাত বুলিয়ে নির্মাল্য আবার বলতে লাগল, এই যন্ত্রটার প্রোগ্রাম করা আছে আমার মস্তিষ্কের চিন্তাকোশের সঙ্গে। যখন ভেতরের ফোটোতে এই লাল আলো পড়বে, সেই সময় আমি এই ছোট্ট আয়নাটার ওপর তাকিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দিতে বলব। সঙ্গে সঙ্গে সেই চিন্তা, শক্তি লক্ষ্যস্থলে ছুটে গিয়ে সেই আদেশ পালন করবে। আর সেই অদৃশ্য মৃত্যুবাণে বিদ্ধ হয়ে গাছের পাকা ফলটির মতন শিকার যেখানে ছিল, সেখানেই টুপ করে লুটিয়ে পড়বে।
এই আদেশ কত দ্রুত লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাবে, জানতে চাস? টেলিপ্যাথির গতি জানিস? না জানলে মহাভারত পড়িস। ছদ্মবেশী যম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করলেন, জগতে সবচেয়ে দ্রুতগামী কী? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, মন। আমাদের জানা সবচেয়ে দ্রুতগতি হচ্ছে আলো বা বিদ্যুতের গতি। মনের গতি হয়তো তার চেয়েও বেশি। এই দেখ, নীলমাধব সেন কুপোকাত?
বলেই একটা সুইচ টিপে লাল আলোটা জ্বালিয়েই নিবিয়ে দিল। একটু পরে নিজের পোষা কুকুরের দিকে লোকে যেমন মমতার দৃষ্টিতে তাকায়, সেইভাবে যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কী জানিস? এই যন্ত্র অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ আগেই বলেছি, এটাকে প্রোগ্রাম বা টিউন করেছি আমার চিন্তাতরঙ্গের সঙ্গে। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এটার ভেতরে একটা স্পার্ক হয়ে কনট্রোল ইউনিট পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তাই আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় মাঝে মাঝে গন্ডগোল করতে পারে ভেবে গার্ড ইউনিটটা চালু রেখে তবে শুতে যাই।
কিছুক্ষণ পরে আমি হতবুদ্ধির মতো নির্মাল্যর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। আসার সময় ড্রয়ারে আমার রিভলভার আর টেপরেকর্ডার পেলাম না। নির্মাল্য বলল, ওগুলো তার চাকর বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়েছে। ওখানেই আমাকে ফেরত দেবে। সত্যিই, বাড়ির বাইরে আসতেই অটুট অবস্থায় সেগুলো ফেরত পেলাম।
নির্মাল্যর চোখের দৃষ্টির অর্থ আমার অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তার কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে লোভ বড় হয়ে উঠেছে। আমার কাছেও সেই ভুয়ো বন্ধুত্বের চেয়ে সমাজের মঙ্গল বড়।
আমি জেনেছিলাম, নির্মাল্যর পরের শিকার আমিই। আমার অজ্ঞাতসারে আমার ফোটো তোলা হয়ে গিয়েছিল। সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি বাড়ি ফেরার পরেই সেটাই যন্ত্রে ভরবে নির্মাল্য। কিন্তু তার আগেই আমি আমার কৌশল লাগিয়েছি। নির্মাল্য যত বড় বৈজ্ঞানিকই হোক, আমার নিখুঁত সাফাইয়ের কাজ সে-ও ধরতে পারবে না। আমার কাজের খাতিরেই এটা শিখতে হয়েছে আমাকে। তাই যন্ত্র দেখবার ছলে একসময়ে পকেট থেকে নির্মাল্যর ফোটোটা বার করে যন্ত্রে ভরে দিয়েছি। মি. ভাটিয়ার জন্যে যেটা সংগ্রহ করেছিলাম, সেটা যে এভাবে কাজে লেগে যাবে, সেটা আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবতে পারিনি। আমায় মৃত্যুবাণ মারবার অনেক আগেই যন্ত্রটা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতো নিজের সৃষ্টিকর্তাকে মেরে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
[সন্দেশ, পৌষ ১৩৮৮]