চক্রব্যুহ

সরকার সেলাম–

বন্দিরা উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। এটা নিয়ম, শান্তি আর শৃঙ্খলার অপরিহার্য অনুশাসন। অবহেলা করলেই ওজনমাফিক পদাঘাত। উঠে দাঁড়াতে এতটুকু দেরি হলে মুখ-থুবড়ানো একটা আছাড় খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তার।

সরকার সেলাম—

হাতের পর হাত উঠে যাচ্ছে কপালে। যত বিদ্রোহীই হও, যত বাঁকাই হোক ঘাড়, এখানে এলে সব সিধে হয়ে যাবে। নৈতিক আরোগ্যশালায় মানুষের যাবতীয় ব্যাধির চিকিৎসা করা হয়। কেউ বাদ নেই রোগীর দলে। চোর, পকেটমার, লম্পট, আত্মহত্যাকামী, হত্যাকারী, বিনা টিকিটের যাত্রী, ভারত রক্ষা বিধান অমান্যে অপরাধী এবং দেশপ্রেমিক। ব্যাধিগুলি মানসিক হলেও শলাকা প্রয়োগটাই একটু বেশি। পুন্নাম, রৌরব এবং কুম্ভীপাকের ইহলৌকিক সংস্করণ। ইংরেজের জেলখানা থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীটা কেন যে স্বর্গপুরী হয়ে যায় না এইটেই আশ্চর্য!

এক দুই তিন চার…

গুনতি করে চলেছে ওয়ার্ডার। পাঁচ ছয় সাত…

কিন্তু আঠারো নম্বর? আঠারো নম্বর?

আঠারো নম্বর নেই, কোথাও নেই! চক্ষে বিশ্বাস করা যায় না, ব্যাপারটা স্বপ্ন হলেই ভালো হত। কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় নেই এবং এমন একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন স্বপ্নই হতে পারে না কখনো। ওয়ার্ডারের মাথায় নীল আকাশ ফুড়ে বাজ নেমে এল কড়াকড় শব্দে।

ঢন ঢন ঢন…

আর্ত চিৎকার করে পাগলাঘণ্টি বেজে উঠল। সমস্ত জেলখানা সমুদ্রের মতো মথিত হয়ে উঠল মুহূর্তে। সসাগরা পৃথিবী অর্থাৎ এসডিও থেকে টাউন দারোগা পর্যন্ত এক সুরে আর্তনাদ করে উঠল, আঠারো নম্বর?

কিন্তু কোথায় কে!

আঠারো নম্বর তখন একটা মরা নদীর পাশে পাশে গা-ঢাকা দিয়ে হেঁটে চলেছে। দু-পাশে ঘন বাঁশ আর আমের ছায়া। আসন্ন সন্ধ্যায় অমাবস্যা রাত্রির মতো সে-ছায়া কালো হয়ে গেছে। অন্ধকারে অন্য মানুষ তো দূরের কথা, নিজেকেই সে দেখতে পাচ্ছে না। তবু থেকে থেকে শঙ্কিত সংশয়ে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠছে তার, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

কেউ কি আসছে? কেউ কি দেখতে পাচ্ছে?

চমকে থেমে দাঁড়ায় আঠারো নম্বর। হৃৎপিন্ডে রক্ত যেন উছলে ওঠে, মনে হয় বুকের স্পন্দনটা এত জোরে বাজছে যে দু-মাইল দূর থেকেও লোকে তা শুনতে পাবে! পায়ের তলায় শুকনো পাতাগুলো এমনভাবে মচ মচ শব্দ করে কেন? নিজেই কি সে নিজের শত্রু হয়ে দাঁড়াল?

দপ দপ দপ…

নদীর ওপারে অত বড়ো কীসের আলো ওটা? জলটা মুহূর্তে ঝলসে উঠল খানিকটা তীব্র আগুনের আকস্মিক দীপ্তিসম্পাতে। নাঃ, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিতান্তই আলেয়া।

একটা আম গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে পলাতক বসে পড়ল। আর চলতে পারছে না সে। সমস্ত দিন পেটে কিছুই পড়েনি, নাড়িভুড়িগুলো খিদেয় একসঙ্গে জড়াজড়ি করছে জ্বলে যাচ্ছে। তা ছাড়া একেবার অক্ষতদেহও সে নয়। অত বড়ো পাঁচিলের উপর থেকে লাফ দিয়ে নীচের মোটা ডালটা ধরবার সময় পাঁজরে একটা চোট লেগেছিল, তীব্র যন্ত্রণা সেখানে টনটন করে উঠছে। জঙ্গলের পথ দিয়ে ছুটে আসবার সময় লাটা গাছের আঁচড়ে দু-পায়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে একেবারে। এখান-ওখান থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে ধুলোভরা পায়ের পাতার ওপর। পায়ের তলায় অনবরত খচ খচ করে বিধছে, অন্তত ডজন খানেক কাঁটা যে মাংসের ভেতরে ঢুকে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করছে তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।

অহস্য ক্লান্তিতে পা ভেঙে সে বসে পড়ল মাটিতে। পিপাসায় বুকের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে আর সামনে তারার আলোয় দীপ্তি পাচ্ছে রুদ্ধস্রোতা নদীর কালো জল। সে-জল থেকে দুর্গন্ধ আসছে পচা পাতার, জমাট শ্যাওলার, রাশীকৃত পাঁকের। তবু ওই জলটা তাকে হাত বাড়িয়ে আকর্ষণ করতে লাগল। সমস্ত তৃষ্ণার্ত শিরা-স্নায়ুগুলো যেন একসঙ্গে কোলাহল করে বলতে লাগল–চলো, চলো জুড়িয়ে দাও আমাদের। জ্বলে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি আমরা। চলো, চলো…

কিন্তু উঠতে গিয়েও আঠারো নম্বর উঠতে পারল না। অত্যন্ত গভীর অবসাদ। জল সে খাবে, তার আগে এক বার বুক ভরে অনুভব করে নেবে তার মুক্তিকে। দীর্ঘ দেড় বছর পরে ফিরে-পাওয়া তার স্বাধীন জীবনানন্দকে।

তারায় ভরা আকাশটার দিকে সে এক বার তাকাল। অপরিসীম–অপর্যাপ্ত। কোনোখানে এতটুকু ছেদ পড়েনি, কোনোখানে নিষেধের প্রাকার তুলে সেই নীলিমাকে কেউ খন্ডিত করে দেয়নি। জেলখানার প্রাচীরের ভেতর দিয়ে যে-আকাশ সে দেখত—তা যেন তারই মতো বন্দি। সেখানে এক টুকরো মেঘ দেখা দিয়েই পালিয়ে যেত, ফটিক জল পাখি নতুন বর্ষার আনন্দে নেচে যেত শুধু একটি মাত্র মুহূর্তের জন্য। ষাঁড়ের কুঁজের মতো ঢেউ-খেলানো পাঁচিলের ওপারে মর্মরিত ছোটো একটি নারিকেল কুঞ্জের এক ছোপ সবুজ ছাড়া বিশাল পৃথিবীর মহারণ্যের কোনো সংবাদই পাওয়া যেত না।

আর এই তো দিগন্ত। বন্দি চোখকে মুক্তি দাও—পাঠিয়ে দাও দূরেদূরান্তে। বৃত্তাকার চক্ৰবালে, মাঠের শেষে, বহুদূরের নাম-না-জানা গ্রামের সীমানায়। উড়ে চলে যাও শরতের আকাশের সোনা-ঝরানো আলো পাখায় মেখে নেওয়া নীলকণ্ঠ পাখির সঙ্গে সঙ্গে। নদীর চর পেরিয়ে কাশের বনে, কাশের বনের ওপারে তাল আর খেজুরের বীথিতে, তারপরে আরও দূরে। আকাশের শেষ নেই, অরণ্যের শেষ নেই, দিক প্রান্তরের শেষ নেই, জনপদের ইয়ত্তা নেই এবং মহাপৃথিবীর সীমানা নেই।

আর মানুষ। শাসন আর ভয়। প্রতি মুহূর্তে শৃঙ্খলের পেষণ। দুর্বাক। পায়ের বেড়িতে ঝনঝন শব্দ তুলে সরকার সেলাম।

কিন্তু এখানে বহুধা আর বহুব্যাপ্ত জীবন। হাটে বাজারে, খেয়ানৌকোয়, যাত্রা আর জারি গানের আসরে। এখানে বিয়েতে সানাইয়ের সুর লাগে; এখানের বোধনের ঢাক বাজে-বাঁশি বাজে। এখানে মানুষ হাসে, মানুষ কাঁদে। মানুষ ভালোবাসে, মানুষ অপমান করে। কত বিরাট—কত বন্ধনহীন। ঘর এখানে ডাকে, আবার দিগন্ত এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

বুক ভরে প্রকান্ড একটা নিশ্বাস নিলে সে। ফাযন এসেছে, আমের বনে ধরেছে মুকুল। বাতাসে ভাসছে মধুর আর মদির গন্ধ। শুকনো পাতার ওপর ঝিরঝির করে চুইয়ে পড়ছে মধু—শব্দ হচ্ছে টুপ-টুপ-টুপ। আঠায় পায়ের তলাটা চটচট করছে।

মরা নদীর ওপর থেকে বাতাস আসছে। হোক দুর্গন্ধ—তবু মুক্ত বাতাস, তবুও মুক্তির বার্তা। মনে হল যেন এতদিন পরে ওর ফাঁকা আর ফাঁপা ফুসফুসটা পরিপূর্ণ হয়ে গেল। যেন শিরার মধ্যে অচল হয়ে থেমে যাওয়া রক্ত আবার পূর্ণ তেজে বইতে শুরু করেছে।

আঠারো নম্বর উঠে দাঁড়াল। নিঝুম নিঃশব্দ পৃথিবী, শুধু টুপ-টুপ করে মৌঝরানির শব্দ। এখানে কেউ আর তাকে খুঁজে পাবে না, তার পেছনে পেছনে এতদূরে অন্তত ছুটে আসেনি কেউ। কিন্তু সরকারের শাসন-লোহার বেড়ি এখনও পায়ের গিঁটে খট খট করে বাজছে। সরকারি ডোরাকাটা ফতুয়া আর জাঙিয়া এখনও লজ্জানিবারণ করছে তার। এই রাজকীয় দাক্ষিণ্য থেকে আগে তাকে মুক্তি পেতে হবে।

কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই পায়ে ঠক করে কী-একটা ঠেকল তার। শুধু ঠেকল না, খানিকটা গড়িয়েও গেল যেন। কৌতূহলভরে সেটাকে তুলে নিতে গিয়েই সে আর্তনাদ করে সভয়ে পিছিয়ে গেল। একটা নরমুন্ড। বেশিদিনের পুরোনো নয়, এখনও তার সঙ্গে শুকনো ক্লেদ আর কয়েকগুচ্ছ চুল জড়িয়ে রয়েছে!

একী ব্যাপার! অন্ধকারের মধ্যে ঝাপসা দৃষ্টিতেও যেন সে স্পষ্ট দেখতে পেল শুধু একটা নয়, পাঁচটা-ছয়টা-সাতটা-আটটা… অগুনতি মানুষের মাথা তার সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। দেড় বছরের মধ্যে এই বহুপরিচিত আমবাগানটা এমনভাবে শ্মশান হয়ে গেল কী করে?

মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে গেল সব। আমের মুকুলের গন্ধ, তারায় ভরা আকাশ, মরা নদীর ঠাণ্ডা জল। মনে হল এখানে যেন থমথম করছে মৃত্যুর বিভীষিকা। ঊর্ধ্বশ্বাসে আমবাগান থেকে ছুটে পালাল আঠারো নম্বর। জীবিতেরা নয়, এখানে মৃতের দল তার পিছনে পিছনে তাড়া করে আসছে।

নিস্তারণ লোহারের কামারশালা গ্রামের একান্তে।

ছোটো চালাঘর। সামনের দরজাটা এত ছোটো যে প্রায় হাঁটু ভেঙে ঢুকতে হয় তার ভেতরে। পয়সার অভাবেও বটে, আর খানিকটা ইচ্ছে করেও বটে—ঘরের দরজাটা নিস্তারণ ছোটোই রেখেছে। ঢোকবার সময় শত্রু অর্থাৎ পুলিশকে যাতে অনেকক্ষণ দ্বিধা করতে হয় এবং সেই ফাঁকে দরকারি দু-চারটে জিনিস সে নিরাপদে হাতসাফাই করে ফেলতে পারে। পুলিশের গভীর সন্দেহ তার ওপরে। সে নাকি লোহার ছাঁচ তৈরি করে দিয়ে স্বদেশি টাকা প্রসারের ব্যাপারে সহায়তা করে থাকে।

নিস্তারণ অবশ্য সেজন্যে গর্বিত। এদিক থেকে স্বদেশি বাবুদের সঙ্গে এক-জাতীয় একাত্মতা অনুভব করে সে। তোমরা দিশি খদ্দর পর, তোমরা বিলিতিকে বাদ দিতে চাও, তোমরা বোমা তৈরি করে রাতারাতি স্বাধীনতা আনতে চাও। সেদিক থেকে আমিই-বা কম কী। আমিও স্বদেশি জিনিস তৈরি করছি; বিদেশিকে প্রাণে না মেরে তার পকেট মারছি, হরে দরে দুটোই এককথা। তা ছাড়া রোমাঞ্চ এবং উত্তেজনা আমার ক্ষেত্রেও একেবারেই কম নয়।

আর নিস্তারণ নিজেও ছোটোখাটো মানুষ। ভেতরে ঢুকতে এর চাইতে বড়ো দরজা তার দরকার হয় না। কৈফিয়ত হিসেবে এইটুকু বললেই তার যথেষ্ট।

সেই ছোটো দরজাটার ঝাঁপ খোলা। আর তাই থেকে এক টুকরো লাল আলো বাইরে দপ করে ঝলকে পড়ছে আবার নিবে যাচ্ছে। দশ-বারোটা মহিষের নিশ্বাস টানবার মতো শব্দ উঠছে একসঙ্গে—হাপর। ঝনঝন করে ভেতরে হাতুড়ির ঘা পড়ছে আর খোলা দরজার পাশে আগুনের ফুলকি উড়ে উড়ে এসে বাইরের জোনাকির ঝাঁকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

নিস্তার দা, নিস্তার দা!

হাপরের দীর্ঘশ্বাসে নিস্তারণ শুনতে পেল না। আবার দরজায় টোকা দিয়ে তীব্র চাপা স্বরে সে ডাক দিলে, নিস্তারণ দা আছ?

বাইরে লাল আগুনের যে আভা পড়ছিল, এক বার দপ করে উঠেই নিবে গেল সেটা। ঝনাৎ করে একটা প্রচন্ড শব্দ করেই বন্ধ হল হাতুড়ি। শেষ ঝাঁক জ্বলন্ত লৌহকণার জোনাকি এসে অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সদাসন্দিগ্ধ নিস্তারণের ঘর স্তব্ধ হয়ে গেল একটা রহস্যময় নীরবতায়।

নিস্তার দা, ঘরে আছ কি?

কে? লোহার হাতুড়িটা শক্ত করে বাগিয়ে ধরে মিশকালো রঙের প্রৌঢ় বেঁটে জোয়ানটা তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করলে, এত রাত্রে কে ডাকছে?

আমি বাঞ্ছা।

বা–ঞ্ছা?

যেন ঘরের মধ্যে বোমা ফেটেছে একটা, নিস্তারণ থ মেরে রইল এক মুহূর্ত। গলার স্বরটা চিনেছে, তবু শেষপর্যন্ত না আঁচালে বিশ্বাস নেই।

বাঞ্ছা! কোন বাঞ্ছা?

আমাকে চিনতে পারছ না গো? সোনাডাঙার বাঞ্ছা হাড়ি?

দরজার পথে নিস্তারণ লোহার এসে দাঁড়াল। সাড়ে তিন হাত মিশকালো মানুষ, হাত দুটো প্রায় হাঁটুতে গিয়ে ঠেকে। গায়ে জামা নেই—হাপরের আবছা আলোয় দেখা যায় সাপের পাকের মতো যেন তার সারা গায়ে মাংসপেশি আবর্তিত হয়ে খাচ্ছে। মুখের ওপর ধবধবে সাদা এক জোড়া গোঁফ গায়ের ঘোর কালো রঙের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে ছন্দ মিলিয়েছে।

তুই কোত্থেকে এলি এ সময়ে?

আস্তে, চেঁচিয়ো না। আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো-না এক বার।

তাই তো। পায়ে বেড়ি, গায়ে সরকারি জাঙিয়া। পলাতকের ক্লান্ত দুর্গম পথ তার শরীরের সর্বত্র প্রত্যক্ষ প্রকট চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

কী সর্বনাশ, তুই ফাটক থেকে পালিয়েছিস নাকি?

পালালাম তো। কদ্দিন আর ভালো লাগে বলো। তিন বছর মেয়াদ হয়েছিল। দেড় বছর খেটেছি, আর থাকতে ইচ্ছে করল না।

পালিয়ে এলি কী করে?

বাঞ্ছা দু-তিনটে পোকাধরা দাঁত বের করে আপ্যায়নের হাসি হাসল এইবারে। বললে, যেমন করে পালাতে হয় তেমনি করেই। পাঁচিল টপকে, মাঠ-ঘাট বন-জঙ্গল দিয়ে।

আয় আয়, ভেতরে আয়। কেউ আবার টপ করে দেখে ফেলবে। নিস্তারণ হাত ধরে তাকে কামারশালার ভেতরে টেনে নিয়ে এল। পেছনে ছোটো ঝাপটা ধড়াস করে দিলে আটকে।

ঘরের মধ্যে পোড়া কাঠকয়লার গন্ধ, পোড়া লোহার গন্ধ, হাপরের পুরোনো চামড়ার গন্ধ। একপাশে একটা লণ্ঠন মিটমিট করছে। আগুনের মধ্যে পুড়ে গনগন করছে লোহা। ছোটো ঘর, কোনোখানে একটি জানলা নেই, কোথাও এতটুকু আলো আসবার অনাবশ্যক পথ রাখেনি নিস্তারণ। একটা গুমোট গরমে হঠাৎ যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল বাঞ্ছার।

নাও আগে বেড়িটার একটা ব্যবস্থা করে দেখি নিস্তার দা। ভদ্দরলোক না হতে পারলে আর ভালো লাগছে না।

ছেনি দিয়ে বেড়ি কাটতে কাটতে নিস্তারণ বললে, পালিয়ে তো এলি, এখন থাকবি কী করে।

সে ভাবতে হবে না, একটা ব্যবস্থা করে নেবই।

কট। বেড়িটা দু-খানা হয়ে নীচে পড়ে গেল। শৃঙ্খলের অবসান। বাঞ্ছা নিজের পায়েই এক বার হাত বুলিয়ে নিলে।

নাঃ, কোনোখানে কিছু বাজছে না। দু-পা হেঁটে দেখল সারাক্ষণের সে গুরুভারটা দূর হয়ে গেছে। আঃ! কী আশ্চর্য একটা মুক্তির অনুভূতি।

নিস্তারণের ঘরে বসে যে ছোটো ছেলেটা হাপর টানছিল, সে-ই একটা গাঁজার কলকে এগিয়ে দিলে। হলদে রঙের ন্যাকড়াটা জড়াতে জড়াতে নিস্তারণ বললে, দিবি নাকি একটান।

নাঃ। বাঞ্ছা হাসল, এবার ওসব ছেড়েই দেব ভাবছি।

উঁঃ? নিস্তারণ সাদা-কালো জ্বর নীচে চোখ দুটোকে বার কয়েক নাচিয়ে নিলে। দেখছি এবারে জেল খেটে তুই সত্যিই মানুষ হয়ে এলি।

বাঞ্ছা এবারেও নিরুত্তরে হাসল।

তাহলে সিঁদকাঠির আর দরকার হবে না?

বোধ হয় না।

যাক বাঁচলি তাহলে। একমুখ ধোঁয়া ছড়িয়ে নিস্তারণ বলল, কিন্তু এখন কী করবি? পুলিশ তো ফেউয়ের মতো পিছনে লেগেছে, ধরলে পাক্কা পাঁচটি বছর ঠুকে দেবে।

বাঞ্ছা বললে, তাই ভাবছি। এখন যাচ্ছি বউয়ের কাছে—শ্বশুরবাড়িতে। রাতারাতি ওকে তুলে নিয়ে অসমের দিকে চলে যাব। ওদিকে তো শুনেছি যুদ্ধ হচ্ছে, ঢের কুলি খাটছে, তাদের সঙ্গেই…

কুঞ্চিত মুখে নিস্তারণ চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। থেকে থেকে হাপরের আগুনের এক একটা লাল আভা তার মুখের ওপর এসে পড়তে লাগল।

জেলেই বোধ হয় ভালো ছিলি বাঞ্ছা!

কেন? বাঞ্ছা বিস্মিত দৃষ্টিতে নিস্তারণের রহস্যমন্ডিত মুখের দিকে তাকাল।

না, সে থাক।

বাঞ্ছা উদবেগ বোধ করতে লাগল। নিস্তারণের কথার মধ্যে কেমন একটা সুর আছে, নিহিত আছে এমন একটা ইঙ্গিত যাতে সমস্ত মন সংশয়ে আচ্ছন্ন করে তোলে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিস্তারণের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললে, নিস্তার দা।

কী বলছিলি?

শেখ বাড়ির আমবাগানে অত মড়ার হাড় কেন?

নিস্তারণ মুখের পাশে গাঁজার ধোঁয়ার কুন্ডলী রচনা করতে লাগল–মানুষ মরেছে।

অত মানুষ! কী হয়ে মরল?

কী হবে আবার, মরতে হয় তাই মরেছে। সে যাক। তুই রাত্তিরটা এখানেই থাকবি না। চলে যাবি বউয়ের কাছে?

চলেই যাই। বাঞ্ছার মুখে একসঙ্গে উৎকণ্ঠা আর অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছে। আমার যেন কীরকম লাগছে নিস্তার দা। এই দেড় বছরে দেশটা এত বেশি বদলে গেল নাকি?

সবই তো বদলায়। পৃথিবী যে বদলাল তাতে আর আশ্চর্য কী।

আবার খানিকটা নীরবতা। হাপরের হাওয়ায় আগুন চমকে উঠছে। নিস্তারণের মুখের ওপর খেলা করে যাচ্ছে হিংস্র একটা আরক্ত আভা।

নিস্তারণ বললে, থাক, ওসব কথা থাক। যাবি তো সরকারি কাপড়চোপড় বদলে যা। একটা ছেঁড়া ধুতি দিয়ে দিই বরং। ও-বেশে রাস্তায় বেরুলে তো রক্ষা থাকবে না।

রাত বাড়ছে। অন্ধকার মেঠোপথ দিয়ে এগিয়ে চলল বাঞ্ছা। তারায়-ভরা মুক্ত আকাশের আশীর্বাদ, তমসাবিকীর্ণ বিস্তীর্ণ পৃথিবীর আহ্বান। রাত্রির পাখি ডাকছে, শিরশির করে বয়ে যাচ্ছে হাওয়া। কারণে অকারণে কুকুর ডেকে উঠছে, দূরদূরান্ত থেকে তার উত্তর আসছে।

মুক্তি। পায়ে বেড়ি নেই, আঁটোসাঁটো জাঙিয়া নেই। ষাঁড়ের কুঁজের মতো ঢেউ-খেলানো প্রাচীরের আড়ালে অবরুদ্ধ জগৎ। সেলের ভিতর থেকে খুনি আসামিট থেকে থেকে পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে। পাথর ভাঙতে ভাঙতে শিস দিয়ে একটা অশ্লীল গান গেয়ে ওঠে একজন। হঠাৎ আসে ভোজপুরি ওয়ার্ডারটা। যমদূতের মতো চেহারা, সিদ্ধির নেশায় দুটো টকটকে রাঙা চোখ। বাপবাপান্ত ছাড়া আর কোনো সম্ভাষণই জানে না সে।

অ্যাও শালা-ক্যা হোতা হ্যায়?

ক্যা হোতা হ্যায় জমাদারজি?

আর জমাদারজি। লাথিটা ঠিক জুতমাফিক এসে পড়েছে। পাথরের ওপর পড়েছে মুখটা, ঠোঁটটা ঘেঁচে গেছে খানিক। দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত পড়ছে।

তবু সে-অবস্থায়ও হাসতে হয়।

সমস্ত মুখটা রক্তে রাঙা হয়ে গেছে। দুই কষে রক্ত, তবু একটা বিগলিত চরিতার্থ হাসি। যেন জমাদার লাথি মারেনি, পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়েছে মাত্র।

কসুর মাপ করো জমাদারজি।

সরকার সেলাম…

নকিবের হুঙ্কার। এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত—আর্যাবর্ত-দাক্ষিণাত্য নিনাদিত রাজকীয় ঘোষণা। যে যে-অবস্থায় আছ উঠে দাঁড়াও, সেলাম ঠোকো।

বীভৎস জীবন। নরক। অমানুষিক দুঃস্বপ্ন। তারায় ভরা আকাশের নীচে আর মেঠো আলোর পথ দিয়ে চলতে চলতে সেটাকে অবিশ্বাস্য আর অসম্ভব ঘটনা বলে মনে হয়।

মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে আছে গ্রামগুলো। নীড় স্বপ্ন দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে গড়া মানুষের ঘর। এখানে দুঃখ নিজের, ব্যথাও নিজের। প্রতি মুহূর্তে দুঃসহ অপমানের পীড়ন নেই। বাঞ্ছা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে লাগল। অত্যন্ত খিদে পেয়েছে—মাথা ঘুরছে। ইচ্ছে করছে প্রতি মুহূর্তে পথের ওপর লুটিয়ে পড়তে, বুকের মধ্যে খানিকটা অবাধ বাতাস টেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে।

কিন্তু না, থামলে চলবে না। এখনও সামনে অনেক পথ বাকি—অনেক গ্রাম, অনেক মাঠ, দু-খানা হাটখোলা। একদিন এক রাত্রির রাস্তা। আর নিস্তারণ লোক ভালো, আসবার সময় আট গন্ডা পয়সা দিয়ে দিয়েছে সঙ্গে; ওই দিয়েই যা হয় খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।

বাঞ্ছা জোর করে শক্তি সংহত করে নিলে শরীরে, দৃঢ় আর দ্রুতপায়ে চলতে শুরু করে দিলে। মাঠের হাওয়ায় পাঁজরের টনটনে ব্যথাটা জুড়িয়ে আসছে, পায়ের তলায় কাঁটার তীক্ষ্ণখোঁচাগুলো তেমন করে আর বিঁধছে না। কিন্তু গ্রামগুলো এমন ঘুমন্ত কেন! একটা গানের কলি, জারি গানের একটি সুরও কোনোখান থেকে ভেসে আসছে না কেন! শুধু শেয়াল-কুকুর ছাড়া দেশে আর মানুষ নেই নাকি! দূরে দূরে আলেয়া ছাড়া লণ্ঠন হাতে একটা লোকও চলছে না। দেড় বছরে বাংলাদেশ কি এতই ঘুমকাতুরে হয়ে গেল!

এক দিন, এক রাত। সন্ধ্যা ঘোর হয়ে আসছে। বাঞ্ছা এসে দাঁড়াল মঙ্গলবাড়ির মাঠের ধারে।

ওই তো গ্রাম। ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা পার হলেই বদন চৌকিদারের ঘর। তার শালা। কিন্তু এতক্ষণে বাঞ্ছার মনটা ভরে উঠল সংশয়ে। যাবে কি যাবে না।

পথে আসতে আসতে অনেক জিনিসই তার নজরে পড়েছে। নতুন রাস্তা হয়েছে যেখানে সেখানে, ঝকঝকে তকতকে পাথর-ফেলা রাস্তা। মাঝে মাঝে নতুন নতুন গ্রাম বসেছে। বড়ো বড়ো আটচালা, এক ইটের কোঠাঘর, টিউবওয়েল। প্রকান্ড প্রকান্ড মোটর সেইসব নতুন রাস্তা ধরে নতুন গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে। মিলিটারি কলোনি।

এই কি তার চেনা দেশ? দেড় বছর আগেকার দেশ? এখানকার মানুষগুলো কেমন করে কথা বলে! দু-পয়সা দামের জিনিস বারো পয়সা। তার দিকে ফিরেও কেউ তাকায় না। সকলের চোখ মাটির দিকে আর হলদে রঙের কুর্তিপরা সাদা-কালো মিলিটারিদের দিকে। সে যেন এখানে অনাবশ্যক, যেন বিদেশে এসে পড়েছে কোথাও।

চেহারা বদলেছে পৃথিবীর, চেহারা বদলেছে মঙ্গলবাড়ির। এখানেও মাঠের মধ্যে নতুন মিলিটারি উপনিবেশ। বিকৃত কণ্ঠের গান ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। দৈত্যের মতো বড়ো বড়ো চোখের আগুন ছড়িয়ে পেট্রোলের গন্ধে চারদিক ভরিয়ে দিয়ে ছুটছে মোটর, যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ওই গ্রামে, ওই তেঁতুল গাছের ছায়ার নীচে বদন চৌকিদারের ঘরটা এখনও কি টিকে আছে? মল্লী কি বেঁচে আছে এখনও?

একটা অনিশ্চিত সন্দেহে বাঞ্ছার হাত-পা কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতরটা শুকিয়ে আসতে লাগল। যদি মল্লী মরে গিয়ে থাকে? যদি পথে-ঘাটে ছড়ানো অসংখ্য নরমুন্ড আর শুকনো পাঁজরের মধ্যে মিলিয়ে থাকে সেও? এই দেড় বছরের মধ্যে যে বাংলাদেশে মন্বন্তর বয়ে গেছে সে-খবর জানতে পেরেছে বাঞ্ছা। কে আছে আর কে যে নেই আজ তা অনুমান করাও শক্ত।

বাঞ্ছা অন্ধকারময় মঙ্গলবাড়ির দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে সে, যাবে ওখানে? এতক্ষণে নিস্তারণের কথার অর্থটা তার কাছে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। এমনভাবে না পালিয়ে জেলে থাকলেই ভালো করতিস বাঞ্ছা।

কিন্তু কতদিন মল্লীকে দেখেনি সে। তার মল্লী–সপ্তদশী সুন্দরী মল্লী। হালকা, চটুল। বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরলে সাপের মতো পিছলে যায়। মল্লীকে বিয়ে করে নেশা ধরে গিয়েছিল তার, বাইরে বেরোনোর বদ অভ্যাসগুলো একরকম ভুলেই গিয়েছিল। প্রদীপের আলোয় নির্জন ঘরে মল্লীর সেই চোখ, সেই খিলখিল করে হাসি!

বাঞ্ছার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। না না, মরতেই পারে না মল্লী। এমন সুন্দর! এমন অপরূপ! আত্মবিস্মৃতের মতো সে এগিয়ে চলল।

বদনের ঘর তেঁতুল গাছের ছায়ায় ঠিক আছে। কোথাও এতটুকু রূপান্তর নেই তার। বরং বাড়িটার শ্রী ফিরেছে আগেকার চাইতে। বাইরে নতুন দাওয়া, তাতে শালের খুঁটি, কয়েকটা ছোটো-বড়ো কাঠ আর বেতের বসবার আসন। বোঝা যাচ্ছে আগের চাইতে সামাজিক হয়েছে বদন।

কী বলে ডাক দেবে ভাবতে ভাবতে সামনের দরজাটা খুলে গেল আর সামনে এসে দাঁড়াল একটি মেয়ে। হাতে তার প্রদীপ। মুহূর্তে বাঞ্ছা বিমূঢ় আর আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সুন্দরী তরুণী মেয়ে। রঙিন শাড়িপরা—মুখে প্রসাধনের চিহ্ন, যেন রূপকথার রাজকন্যার মতো

সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাঞ্ছা কী বলবে ভেবে পেল না, শুধু গলা দিয়ে একটা অব্যক্ত অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল।

মেয়েটি চমকে গেল। হাতের প্রদীপটা তুলে ধরে বললে, কে?

আ—আমি। বাঞ্ছার স্বর জড়িয়ে আসতে লাগল।

আমি কে? মেয়েটির গলার সুর কঠিন।

আমি, আমি বাঞ্ছা। আমাকে চিনতে পারছিস না মল্লী?

অ্যাঃ!

মল্লী পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল, তার হাত কাঁপতে লাগল, কাঁপতে লাগল তার হাতের প্রদীপের শিখাটা। যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে দুজনে। বিমূঢ় বিহ্বল বাঞ্ছা ভাবতে লাগল–মল্লী কি জানতে পেরেছিল আজ সে আসবে। তারই জন্যে প্রতীক্ষা করছিল এমনভাবে, তাকে বুকের ভিতরে টেনে নেবে বলে? কিন্তু মল্লীর চোখ-মুখ দেখে তা তো মনে হওয়ার উপায় নেই।

আর মল্লীর যেন বাকরোধ হয়ে গেছে। স্বামীকে দেখছে না—দেখছে একটা প্রেতমূর্তি। মুখের ওপর ভয় আর সংকোচের ছায়া নিবিড় হয়ে নেমে এল তার।

মল্লীর ঠোঁটই আগে নড়ে উঠল।

ভিতরে এসো।

ঘরে ঢুকে মল্লীও দরজা বন্ধ করে দিলে। কিন্তু বাঞ্ছার আর বাকস্ফুর্তি নেই। এ কার ঘর! খাটের ওপরে পুরু করে বিছানা পাতা, তাতে ধবধবে চাদর। একটা ছোটো টেবিলে এক টিন সিগারেট, দেশলাই। পেটমোটা রুপোর সিল-করা বোতল, গেলাস। বাঞ্ছা স্বপ্ন দেখছে না কি?

এ ঘর তোমার?

হ্যাঁ আমার।

কিন্তু এসব পেলে কোথায়? কী এ-সমস্ত?

সেকথার কোনো জবাব দিলে না মল্লী। বললে, পরশু রাতে তুমি পালিয়েছ শহরের জেল থেকে?

হুঁ।

এখানে খবর এসেছে। দাদার মতিগতি খারাপ, তোমাকে দেখলেই ধরিয়ে দেবে। এখনি পালাও।

ধরিয়ে দেবে! পালাব? কেন?

কেন? মল্লী হাসল, হাসিটা কান্না না একটা বীভৎস মুখভঙ্গি! বুঝতে পারছ না এখনও? দেখে আসনি মিলিটারিদের আস্তানা? ঘরের চেহারা দেখছ না? বুঝতে পার না এত বড়ো আকালে আমরা বেঁচে আছি কী করে—রাজার হালে আছি?

রূপকথার গল্পে ডাইনির চুলের ছোঁয়ায় পাথর হয়ে গিয়েছিল রাজপুত্র। বাঞ্ছার গায়েও যেন সেই ডাইনির সাপের মতো চুলের ছোবল লেগেছে এসে। পায়ের থেকে মাথা পর্যন্ত যেন হিম হয়ে আসছে তার—যেন জমে যাচ্ছে। শুধু বিহ্বল দৃষ্টিতে সে দেখছে কী চমৎকার সাজানো ঘরখানা। রাজবাড়ির মতো বিছানা, রাজকন্যার মতো সেজেছে মল্লী। তার গায়ের থেকে আসছে পাউডারের গন্ধ। টেবিলে দেশলাই, সিগারেট, মদের বোতল, গ্লাস। যুদ্ধার্থী বীরের জন্য প্রেমমাল্য নিয়ে প্রতীক্ষা করছে বীরভোগ্যা সুন্দরী নারী।

বাইরে নাগরা জুতোর শব্দ। মল্লীর মুখ পাংশু হয়ে গেল।

হাঁক দিলে বদন চৌকিদার, মল্লী!

পান্ডুর মুখে মল্লী জবাব দিলে, উ?

ঘরে লোক আছে?

হুঁ। এক মুহূর্ত বাঞ্ছার বলির পশুর মতো চেহারাটার দিকে তাকাল সে। তারপর জবাব দিলে, সায়েব এসেছে।

আচ্ছা।

পায়ের নাগরা জুতো মচমচিয়ে বদন বেরিয়ে গেল।

আজ আর মল্লীর পরিচয় বাঞ্ছার স্ত্রী হিসেবে নয়। মিলিটারিদের গণিকা সে-বদনের উপজীবিকা, স্বাচ্ছন্দ্য, সচ্ছলতা। এত বড়ো পৃথিবী— মুক্ত পৃথিবী—তারায় ভরা আকাশ, নিঃসীম দিগদিগন্ত, কিন্তু বাঞ্ছার স্থান কোথায়? আশ্রয় কোথায়? চারদিক থেকে কঠিন ফাঁসির দড়ি তার গলায় আটকে পড়বার জন্য এগিয়ে আসছে। চারদিকের পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে আসছে, জেলখানার ষাঁড়ের কুঁজতোলা পাঁচিলের চাইতেও আরও—আরও—আরও সংকীর্ণ।

অন্ধকারের মধ্যে মাঠ ভেঙে ছুটেছে বাঞ্ছা। কে যেন তাকে পেছনে পেছনে তাড়া করে আসছে। পুলিশ নয়, চৌকিদার নয়। তারায় ভরা আকাশ, সীমাহীন পৃথিবী, অসীম মুক্তিই আজ তাকে গ্রাস করতে চায়—হত্যা করতে চায়।

থানায় গিয়ে ধরা দেবে সে। বলবে দয়া করো, দয়া করো আমাকে। জেলে পাঠিয়ে দাও। পাঁচ বছর নয়, দশ বছর নয়—যাবজ্জীবন। দ্বীপান্তর। কালাপানির ওপারে যেখানে সমুদ্র, যেখানে এত বড়ড়া পৃথিবীটা কারও শক্ত হাতের মুঠির মতো ছোটো হয়ে গেছে।


© 2024 পুরনো বই