ক্ষত

পাবলিক লাইব্রেরি থেকে আনা, পাতা মুড়িবেন না ছাপ মারা এবং পাতায় পাতায় মোড়া জীর্ণ বাংলা উপন্যাসখানা পড়বার চেষ্টা করছিল সিতাংশু। রাত এগারোটার কাছাকাছি, অসহ্য গরম। জানালা দিয়ে বাতাস আসছিল না তা নয়, কিন্তু তাতে আগুনের ছোঁয়া। দিনে দুর্দান্ত গরম থাকলেও সন্ধ্যার পরেই নাকি সাঁওতাল পরগনার সুশীতল বাতাস বইতে থাকে, এমনই একটা জনশ্রুতি তার শোনা ছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, রাত তিনটের আগে সেই বিখ্যাত শীতল হাওয়াটি প্রবাহিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

বইটি প্রেমের উপন্যাস এবং শুরু হয়েছে পাইনবনের ভিতরে একটি আঁকাবাঁকা পথের উপর। কুয়াশা কেটে গিয়ে পাইনের ঊর্ধ্বমুখী কণ্টকপত্রে সোনালি রোদ পড়েছে, দু-ধারে বরাশ ফুল ফুটেছে রাশি রাশি, আর ওভারকোটের পকেটে হাত দিয়ে একটি মেয়ে আশ্চর্য গভীর চোখ মেলে দূরের নীল পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক সেই সময়…।

ঠিক সেই সময়েই বিরক্ত হয়ে সিতাংশু পর পর কয়েকটা পাতা উলটে গেল। এই দুর্ধর্ষ গরম, ইলেকট্রিকবিহীন এই বাড়ি, নিঃসঙ্গ এই জীবন, এর ভিতরে শীতল পাহাড়ের কবোষ্ণ রোমান্স তার কল্পকামনা অনেকটা মেটাতে পারত; কিন্তু সিতাংশুর প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হল। কেন এমন বাজে বই লেখা হয়, কেই-বা সেটা ছাপে; এবং যদিই-বা সেটা ছাপা হয়, তাহলে পাতাগুলো দিয়ে মুড়ির ঠোঙা তৈরি না-করে পাঠককে যন্ত্রণা দেবার জন্যে লাইব্রেরিতে রাখা হয় কেন? এই ধরনের গোটা কয়েক আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা তার মনের ভিতর ঘুরপাক খেয়ে গেল।

কিন্তু লাইব্রেরির বইয়ের আরও একটা আকর্ষণ আছে, সে হল অনাহূত টীকাকারদের মন্তব্য। বাঁধাইয়ের দু-ধারের সাদা পাতায়, বইয়ের মার্জিনে রসিক পাঠকদের নানারকম স্বতোৎসারিত উচ্ছাস। যেমন— বাঃ, বেশ বেশ। একেই বলে খাঁটি প্রেম, একসেলেন্ট কিংবা মণিকার এইরূপে চিন্তা করা অন্যায়। হিন্দু নারী হইয়া সে পরপুরুষের… ইত্যাদি ইত্যাদি। তা ছাড়া কাঁচা হাতের কিছু কিছু অশ্লীল মন্তব্যও থাকে। আর বই যদি পাঠকের ভালো না-লাগে, তাহলে লেখকের উদ্দেশে যেসব মন্তব্য বর্ষণ করা হয়, ভদ্রলোক সেগুলো জানতে পারেন না বলেই আত্মহত্যা করেন না।

অতএব সিতাংশুও কালিদাস ছেড়ে মল্লিনাথ পড়া শুরু করল। একটি নয়, অন্তত পেনসিলে আর কালির লেখা গুটি সাতেক মল্লিনাথের সন্ধান পাওয়া গেল। কাছাকাছি কোনো হ্যাণ্ড রাইটিং এক্সপার্ট থাকলে সঠিক সংখ্যাটা বলতে পারতেন।

কিন্তু তাই-বা ভালো লাগে কতক্ষণ। গরম, কদর্য গরম! হাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জানালার বাইরে কালো ব্রোকেডের পর্দার মতো টানা অন্ধকার, তার ভিতর দিয়ে দু-তিনটে ইউক্যালিপ্টাসের বাকলহীন শুভ্রতা অতিকায় কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে। মিউনিসিপ্যালিটির একটা কেরোসিনের আলো জানালার প্রায় মুখোমুখি ছিল, সেটা সন্ধ্যা না লাগতেই নিবে গিয়েছে। ঘরের দেওয়ালে লণ্ঠনের আলোয় নিজের যে-ছায়াটা পড়েছে, সেটাকে পর্যন্ত সিতাংশুর অসহ্য বোধ হতে লাগল। ওটা যেন তার মনের ছায়া—বিকৃত, অর্থহীন, অশোভন, অশালীন। বাইরের অন্ধকারে গিয়ে ওটা দাঁড়ালেই ভালো হত, তার প্রত্যেকটা অঙ্গভঙ্গিকে এমনভাবে ক্যারিকেচার করবার প্রয়োজন ছিল না।

ঘাম ঝরছে না, সারা শরীর যেন জ্বালা করছে। এক বার স্নান করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু ঠিক নাটকীয়ভাবে সেই সময় শব্দটা শুনল সিতাংশু। পরিষ্কার শুনতে পেল। ইদারার গায়ে দড়ি ঘষার খসখস আওয়াজ, বাঁশের একটা মৃদু গোঙানি আর ছলাৎ ছলাৎ করে জলের কলধ্বনি।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল সিতাংশু। লণ্ঠনটা কমিয়ে দিয়ে পা টিপে টিপে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর কপাটটা ইঞ্চি তিনেক ফাঁক করে তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে দিলে সামনের দিকে।

বাড়ি যতই ছোটো হোক, তারের বেড়া-ঘেরা কম্পাউণ্ডটা অনেকখানি। সিতাংশুর ঘর থেকে প্রায় চল্লিশ গজ দূরে তার ইঁদারা। এই অন্ধকারে একটি ঝাঁকড়া পিপুল গাছ আরও অন্ধকার ছড়িয়েছে তার উপর। তবু স্পষ্ট দেখলে সিতাংশু, কে একজন ইদারা থেকে জল তুলছে। বালতি উপরে টানার সঙ্গে সঙ্গে তার নুয়ে-পড়া শরীরটা সোজা হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে।

হিংস্র ক্রোধে দাঁতে দাঁত চাপল সিতাংশু। এই ব্যাপার! এই জন্যেই অতখানি টলটলে জল দু-দিনের ভিতরেই বালিতে ভরে উঠছে। সন্দেহ একটু ছিলই, এইবার বোঝা গেল সব। জল চুরি হচ্ছে।

একটা বিশ্রী উপন্যাস। কুৎসিত গরম। নিঃসঙ্গ নির্বাসিতের মতো জীবন। ইলেকট্রিকের আলোহীন ঘরে নিজের ছায়ার ভ্যাংচানি। তার ওপর চুরি? সিতাংশুর মাথায় আগুন জ্বলল।

দরজা বন্ধ করে সে ঘরে ফিরে এল। কী করা যায়? তাড়া করলে তারের বেড়া ডিঙিয়ে পালাবে, ধরা যাবে না। অসম্ভব আশায় চারদিকে এক বার সে তাকিয়ে দেখল—কোনো মিরাকলে একটা বন্দুক যদি এই মুহূর্তে হাতের কাছে পাওয়া যায়, তাহলে আর ভাবনার কিছু থাকে না। কিন্তু বন্দুকের বদলে পাওয়া গেল একটা মশারির স্ট্যাণ্ড।

আর দেরি করা যায় না। জলের বালতি নিয়ে এক বার তারের বেড়া টপকে চলে গেলে আইনত সিতাংশুর আর কিছুই বলবার নেই। সুতরাং যা করতে হয় এক্ষুনি।

মশারির স্ট্যাটা শক্ত করে ধরে পিছন দিয়ে ঘুরে সিতাংশু দারার দিকে এগোতে চেষ্টা করল। চোর তখন নিবিষ্টচিত্তে জল তুলছে। জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ সিতাংশুর জ্বালাধরা রোমকূপগুলোকে পুড়িয়ে দিতে লাগল। তারপর যখন আর এগোনো চলে না, যখন প্রায় দশ-বারো গজের মধ্যে এসে পড়েছে, যখন আর এক-পা বাড়ালেই চোর তাকে দেখতে পাবে, তখন হাতের ডাণ্ডাটা সে ছুড়ে মারল সবেগে।

নির্ভুল লক্ষ্যভেদ! একটা মৃদু আর্তনাদ করে চোর মাটিতে ঘুরে পড়ল।

কিন্তু সিতাংশুর হাত-পা জমে গিয়েছে তৎক্ষণাৎ। গরম, বিরক্তি আর ক্রোধে অতখানি অন্ধ না-হলে আরও আগেই সে বুঝতে পারত। একটি মেয়ে।

কী সর্বনাশ! রোম্যান্টিক উপন্যাসের পাতা থেকে একেবারে নারীহত্যায়!

কে বলে পশ্চিমের গরমে ঘাম হয় না? মুহূর্তে ঘেমে উঠল সিতাংশু, ভিজে গেল গেঞ্জি, জিভটা চলে যেতে চাইল গলার ভিতর, মাথাটা একেবারে ফাঁপা হয়ে গেল। এইবার?

মেয়েটা নড়ে উঠল। উঠে বসতে চেষ্টা করছে। যাক—একেবারে খুন হয়নি তাহলে, বেঁচে আছে এখনও! সন্তর্পণে কাছে এগোল সিতাংশু।

এক টুকরো চাঁদ উঁকি দিয়েছে আকাশে। পিপুল গাছের পাতার ভিতর দিয়ে স্নান খানিকটা আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। চিনতে পেরেছে সিতাংশু। পিছনের বাড়িতে পোস্ট অফিসের যে নতুন ভদ্রলোকটি এসেছেন তাঁরই কেউ হবে। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়নি, কিন্তু মেয়েটিকে কয়েক দিনই চোখে পড়েছে।

সিতাংশু সামনে আসতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। চাঁদের আলোতেও দেখা গেল, তার কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। আর সেইসঙ্গে শোনা গেল ফোঁপানো কান্নার স্বর, এক বালতি জল নিতে এসেছিলুম আপনার ইদারা থেকে, সেজন্যে এমন করে আমায় মারলেন?

আগেই মরমে মরে গিয়েছিল সিতাংশু, এবার মিশে গেল মাটিতে।

আমায় ক্ষমা করবেন। মানে, আমি ভেবেছিলুম…

কী ভেবেছিলেন? কান্নার ভিতর থেকে এবার ঝাঁঝ বেরিয়ে এল। কোনো পুরুষমানুষ? যে-ই হোক-না, এক ফোঁটা জলের জন্যে তাকে আপনি খুন করতে চাইবেন? আপনি না ভদ্রলোক?

গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা খুব গুরুতর হয়নি। ভরসা পেয়ে রাগ হল সিতাংশুর। এক ফোঁটা জলই বটে! এদিককার সমস্ত হাঁদারাই প্রায় শুকিয়ে মরুভূমি, সিকি মাইল রাস্তা পেরিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির একটা টিউবওয়েল ভরসা। তার হাঁদারায় যে দু-চার বালতি জল আছে, তা-ও এভাবে লুট হতে থাকলে মাথায় খুন চাপা অন্যায় নয়।

কিন্তু সেকথা বলল না সিতাংশু।

এসে চাইলেই পারতেন।

চাইলেই যেন দিতেন আপনি।

স্পষ্ট পরিষ্কার কথা। না, দিত না সিতাংশু। এই দুঃসময়ে অতখানি উদারতা তার নেই— কোনো মহিলা সম্পর্কেও না। বিব্রত হয়ে সিতাংশু বললে, থাক ও-সব কথা। আপনার কপালটা কেটে গিয়েছে মনে হচ্ছে। দাঁড়ান, আয়োডিন এনে দিচ্ছি।

খুব হয়েছে, আর উপকার করতে হবে না। কপাল ফাটিয়ে দিয়ে জলের দাম তো আদায় করলেন। কী করব এখন? জলটা নিয়ে যাব না আবার ঢেলে দেব ইদারায়?

সিতাংশু অপ্রস্তুত হল। আশ্চর্যও হল সেইসঙ্গে। একটুও আত্মসম্মান নেই মেয়েটার, এত কান্ডের পরেও ভুলতে পারেনি জলের কথাটা।

ছি ছি, কী যে বলেন! চলুন আমিই পৌঁছে দিয়ে আসছি জলটা।

কোথা থেকে এসে পড়ল টর্চের আলো। চমকে তাকাল দুজনেই।

পোস্ট অফিসের সেই ভদ্রলোক। পিছনের বাড়ির নতুন ভাড়াটে।

কী হয়েছে বুলু? টর্চের আলোয় বুলুর কপালের রক্ত একরাশ সিঁদুরের মতো ঝকঝক করে উঠল। কী করেছিস আবার?

সিতাংশু পাথর হয়ে গেল। আর বুলুই জবাব দিলে।

অন্ধকারে হাঁদারার ওপর পড়ে গিয়েছিলুম কাকা। ইনি ছুটে এসে…

তারের বেড়া টপকে ভিতরে এলেন ভদ্রলোক।

তোকে হাজার বার বারণ করলুম এত রাতে জলের দরকার নেই, তবু হতভাগা মেয়ের কানে গেল না। তোর জন্যে শেষে একটা কেলেঙ্কারিতে পড়ব এ আমি ঠিক জানি। নে চল। বালতি তুলে নিয়ে ভদ্রলোক সিতাংশুর দিকে তাকালেন, কিছু মনে করবেন না মশাই, এই মেয়েটার জ্বালায় আমার একদন্ড স্বস্তি নেই। কপালে যে আমার কত দুঃখ আছে সে কেবল আমিই জানি। আপনার ঘুম নষ্ট হল, অপরাধ নেবেন না।

সিতাংশু কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সুযোগ পেল না। বিহ্বলতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে-না উঠতেই কাকা-ভাইঝি তারের বেড়া পার হয়ে চলে গিয়েছেন। ফিকে চাঁদের আলোয় দুটো অবাস্তব ছায়ামূর্তি।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নীচু হয়ে মশারির স্ট্যাটা তুলে নিল সিতাংশু। এটা কি চোখে পড়েনি ভদ্রলোকের? না-পড়া অসম্ভব। অসহ্য গরম নিঃসঙ্গ ঘরটার দিকে যেতে যেতে সিতাংশু নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে চাইল, কে ভালো অভিনয় করেছে? বুলু না তার কাকা?

সারাটা রাত আর ভালো করে ঘুম এল না, কাটল অস্বস্তিভরা তন্দ্রার ভিতর। চোখ কচলাতে কচলাতে সিতাংশু যখন বারান্দায় এসে দাঁড়াল, তখন তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল রোদে চারদিক ভরে উঠেছিল। রাস্তার ওপারে ইউক্যালিপ্টাসের সারি পেরিয়ে কাঁকর-মেশানেনা ঢেউ-খেলানো মাঠ, তার ভিতরে একটা খাপছাড়া সাদা বাড়ি রোদে জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে। দূরের রুক্ষ পাহাড়টা পড়ে আছে অপরিচ্ছন্ন বন্য মহিষের মতো, তার পত্রহীন গাছপালা আর বড়ো বড়ো ন্যাড়া পাথর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকেও।

সব শ্রীহীন, সব কিছু আগুন দিয়ে ঝলসানো। মেঘনা-পাড়ের সিতাংশু বিরস বিতৃষ্ণ মুখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মনে পড়ল, একদিনের ছুটি নিয়ে তার ছোকরা চাকর ধনিয়া নিজের গাঁওমে গিয়েছিল, আজ চতুর্থ দিনেও সে ফেরেনি। গ্রামে যাওয়া খুবসম্ভব বাজে কথা —বেশি মাইনেতে আর কোথাও কাজে লেগেছে। ওর দোষ নেই। ভদ্রলোকেই যদি জল চুরি করতে পারে…

মেঘনা-পাড়ের সিতাংশু সেনগুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাহারা মরুভূমি নয়, বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে একশো মাইলের মধ্যেই যে জল চুরি করবার দরকার হয়, মেঘনার কালো অথই জলের দিকে তাকিয়ে সেকথা কে ভাবতে পারত!

কিন্তু ও-সব তত্ত্বচিন্তা এখন থাক। আপাতত সিতাংশুকে নিজের হাতে চা করতে হবে, রান্নার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। তবু তো আজ বাজারে যাওয়ার সমস্যা নেই, কাল অফিস থেকে ফেরবার সময় বুদ্ধি করে আলু আর ডিম নিয়ে এসেছিল। নাঃ, আর দেরি করা চলে না।

মুখ ধুতে ইদারার পাড়ে আসতেই চোখে পড়ল তিন-চার ফোঁটা রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। আত্মগ্লানিতে সিতাংশু সেদিকে আর তাকাতে পারল না। মেয়েটিকে এক বার একা পাওয়া দরকার, ভালো করে ক্ষমা চাইতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় যাবে নাকি ও বাড়িতে? কিন্তু আলাপ-পরিচয়টাই যখন হয়ে ওঠেনি এ পর্যন্ত, তখন…।

অন্যমনস্কভাবে ইদারায় বালতি নামিয়েছিল, অন্যমনস্ক হয়েই টেনে তুলল। আর তৎক্ষণাৎ সমস্ত অনুতাপ মুছে গেল, পা থেকে জ্বলে উঠল মাথা পর্যন্ত। অর্ধেক জল, অর্ধেক বালি।

আরও অর্ধেক শুকিয়ে গিয়েছে ইদারা, কাল ওভাবে চুরি না-হলে আজকের দিনটা কুলিয়ে যেত। চাকরটা থাকলেও-বা কথা ছিল, এখন তাকেই গিয়ে সিকি মাইল দূরের টিউবওয়েল থেকে জল আনতে হবে। আর যা ভিড় সেখানে!

দুত্তোর!

কুঁজোর জলে চা খাওয়া কোনোরকমে চলতে পারে। স্নানের আশা নেই। অফিস যাওয়ার পথে খাওয়ার জন্যে ঢুকতে হবে হোটেলে। সিতাংশুর মনে হতে লাগল, মশারির স্ট্যাণ্ড দিয়ে ঘা কয়েক ওই ভদ্রলোককেই বসিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। সবই জানতেন, অথচ কেমন ন্যাকামি করে গেলেন। আর মেয়েটা—সেই বুলু! অবশ্য রক্তপাত না-হলেই খুশি হত সিতাংশু; কিন্তু ডাণ্ডার ঘা তার যে একেবারেই পাওনা ছিল না, এই মুহূর্তে সে তা ভাবতে পারল না।

অফিস থেকে বেরিয়ে, রাস্তায় চা খেয়ে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আবার সেই ঘর, সেই গরম, লণ্ঠনের আলোয় নিজের কদাকার ছায়া আর সেই বাংলা উপন্যাসটা। লণ্ঠনটা জ্বালাতে জ্বালাতে সিতাংশুর মনে হল— তারপর আরও অনেক রাতে ইঁদারার থেকে আবার কেউ হয়তো জল চুরি করতে আসবে, যদিও আজ বালতি ভরে বালিই উঠবে কেবল। কিন্তু কে আসবে? বুলু? না, বুলু আর আসবে না।

যদি বুলুই আসে? একটা অসম্ভব কল্পনায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল সিতাংশু। তা হলে আজ কী করবে সিতাংশু? দূর থেকে দেখা, পিপুল পাতায় জ্যোৎস্নায় আধখানা দেখা আর একটি ছোটো টর্চের আলো এক ঝলক দেখা বুলুর মুখের সামনে আজ লণ্ঠনটা তুলে ধরবে সে।

দেখবে কাল রাতে কতখানি ক্ষত সে মেয়েটির কপালে এঁকে দিতে পেরেছে—কতটা লিখে দিতে পেরেছে নিজের স্বাক্ষর।

আসতে পারি?

বুলু নয়, তার কাকা। সেই অনেক রাতের প্রত্যাশিত সময়টির অনেক আগেই এসে পড়েছেন তিনি।

সিতাংশু চমকে মাথা তুলে বললে, আসুন।

বুলুকে লণ্ঠনের আলোয় দেখতে চেয়েছিল সিতাংশু, দেখল তার কাকাকে। বছর পঁয়তাল্লিশেক বয়স হবে। শক্ত ভারী গোছের বেঁটে মানুষ। কপাল থেকে মাথার আধখানা পর্যন্ত মসৃণ টাক। সিতাংশুর জারুল কাঠের চেয়ারটায় সশব্দে আসন নিলেন।

আলাপ করতে এলুম। আমার নাম বিরাজমোহন মল্লিক। আপনি?

সিতাংশু সেনগুপ্ত।

দেশ?

সিতাংশুকে বলতে হল।

তাই বলুন! আমাদের ইস্টবেঙ্গলের লোক। চেহারা দেখে আমারও তাই মনে হয়েছিল।

পূর্ববঙ্গত্ব এমনভাবে তার শরীরে লেখা আছে, এ খবরটা এতদিন সিতাংশুর জানা ছিল না। মৃদু রেখায় হাসল সে।

তা একা আছেন এখানে? ফ্যামিলি কোথায়?

মা-বাবা কলকাতায় থাকেন।

ওয়াইফ?

বাঙালির স্ত্রীকে বাংলা ভাষায় ওয়াইফ বললে ভারি কুশ্রী শোনায় সিতাংশুর কানে। তবু এবারেও সে অল্প একটু হাসল। বললে, তাঁকে এখনও জোটাতে পারিনি।

বলেন কী, ব্যাচেলর! বিরাজবাবু বিস্মিত হলেন, তিরিশ তো পেরিয়ে গেছেন বোধ হয়।

হ্যাঁ, বছর দুই হল।

তবু এখনও বিয়ে করেননি! বুড়ো বয়সে যে ছেলের রোজগার খেয়ে যেতে পারবেন না!

সেই দুশ্চিন্তায় সিতাংশুর রাতে ঘুম হচ্ছিল না। তবু এবারে ভদ্রতার হাসি হাসতে হল।

বাবা-মাই বা কী বলে চুপ করে আছেন। বিরাজবাবু স্বগতোক্তি করলেন, বিমর্ষভাবে চুপ করে রইলেন কয়েক সেকেণ্ড। তারপর এলেন অন্য প্রসঙ্গে।

কিন্তু এই জলের কষ্ট তো আর সহ্য হয় না মশাই। মরুভূমিতে এলুম নাকি?

সেইরকমই তো মনে হচ্ছে।

মিউনিসিপ্যালিটিতে কড়া করে একখানা দরখাস্ত দিলে কেমন হয়?

আসছে বছর গ্রীষ্মকালে সে-দরখাস্ত নিয়ে ওঁরা আলোচনা করবেন।

যা বলেছেন! সক্ষোভে বিরাজবাবু মাথা নাড়লেন, স্বাধীনতার পরেও এরা যে-তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেল। এদেশের উন্নতি হতে মশাই আরও পাঁচশো বছর।

তারপর আধ ঘণ্টার মতো নির্বাক শ্রোতার ভূমিকায় নিঃশব্দে বসে রইল সিতাংশু। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা যা বলবার থাকে, বিরাজবাবু কিছুই তার বাদ দিলেন না। গোটা তিনেক সিগারেট খেলেন এবং সামনে অ্যাশট্রে থাকতেও ছাই ঝাড়লেন মেঝের উপর। আর সিতাংশু কালকের মতো নিজের ছায়া দেখতে লাগল লণ্ঠনের আলোয়। কান পেতে শুনতে লাগল বাইরে মাঠের ভিতর দিয়ে হু-হু করে বয়ে যাচ্ছে হাওয়া, আর ইউক্যালিপ্টাসের পাতাগুলো ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে তাতে।

শেষপর্যন্ত বিরাজবাবু উঠলেন।

একটা লোকই তাহলে রাখা যাক, কী বলেন? দু-বেলা টিউব-ওয়েল থেকে আমাদের দু বাসায় জল দেবে। টাকাটা দেওয়া যাবে ভাগাভাগি করে।

সে তো বেশ কথা!

দেখি তবে চেষ্টা করে। দরজার দিকে পা বাড়িয়েছেন বিরাজবাবু, সেই মুহূর্তেই প্রায় মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল সিতাংশুর।

আপনার ভাইঝি কাল পড়ে গিয়েছিলেন, কেমন আছেন আজ?

অদ্ভুত দৃষ্টিতে বিরাজবাবু সিতাংশুর দিকে তাকালেন। লণ্ঠনের আলোয় মেক-আপ করা অভিনেতার মতো দেখাল তাঁকে।

কে, বুলু? বুলু ঠিক আছে। সাংঘাতিক মেয়ে মশাই, অল্পে ওর কিছু হয় না। মাটিতে পুঁতে দিলে কাঁটাগাছ হয়ে বেরুবে।

বিরাজবাবু বেরিয়ে গেলেন।

আজও রাত বারোটা পর্যন্ত একা ঘরে ছটফট করল সিতাংশু। সেই বাংলা উপন্যাসখানার পাতা ওলটাল, রসিক পাঠকদের টীকাটিপ্পনীগুলো পড়বার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আজ আর অক্ষম বিরক্তিতে নয়—সেই অসম্ভব দুরাশায় সে কান পেতে বসে রইল। কয়েক বার উঠে গেল জ্যোৎস্নার জাফরিকাটা পিপুল গাছটার তলায়। বুলু আজ আর আসবে না সে জানে; তবু এই রাত, এই গরম আর উত্তেজিত স্নায়ুর একটা বিচিত্র কুহকে সিতাংশু রাত আড়াইটে পর্যন্ত প্রতীক্ষায় জেগে রইল। তারপর বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেল, ক্লান্ত অবসাদে ঝিমিয়ে এল শরীর, আর ঘুমের ঘোরে সিতাংশু স্বপ্ন দেখল… মেঘনার কালো জলের ওপর দিয়ে গেরিমাটির বন্যা ছুটে চলেছে।

বুলু এল না।

সে-রাতে নয়, তার পরের রাতে নয়, তার পরের রাতেও নয়। সিতাংশু কেমন একটা দুর্বোধ্য যন্ত্রণায় পীড়িত হতে লাগল। আশ্চর্যভাবে লুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। যখন তাকে দেখার কোনো কৌতূহল ছিল না, তখন কত বার পিছনের বাড়ির বারান্দায়, খোলা জমিটুকুতে কতভাবে তাকে সে দেখেছে। সেদিন সে বুলুকে মনে রাখতে চেষ্টা করেনি— দরকারও ছিল না। সেই আধখানা দেখা, ঝিলিমিলি জ্যোৎস্নায় এক টুকরো দেখা আর বিরাজবাবুর টর্চের আলোয় রক্তের সিঁদুর-মাখানো একটুখানি শুভ্র ললাট, এর বেশি আর কিছু মনে আনতে পারে না সিতাংশু। সে শুধু এক বার দিনের আলোয় দেখতে চায় বুলুকে, দেখতে চায় তার কপালে…

দেখা হয় বিরাজবাবুর সঙ্গে। বাজারে, অফিসের পথে।

জল পাচ্ছেন ঠিকমতো?

পাচ্ছি।

জষ্টি মাস পার হয়ে গেল মশাই, এখনও বৃষ্টি নেই এক ফোঁটা। কী করা যায় বলুন তো।

কী আর করা যেতে পারে। আকাশের উদ্দেশে বৃষ্টির জন্যে একখানা দরখাস্ত লেখা যেতে পারে—এমনই একটা জবাব আসে ঠোঁটের কোনায়। কিন্তু বিরাজবাবুকে সত্যিই ও-কথা বলা যায় না।

আর জিজ্ঞাসা করা যায় না বুলুর কথা। খবরের কাগজ চাইবার কিংবা বাড়িতে ডিকশনারি আছে কি না জানবার যেকোনো একটা উপলক্ষ্য নিয়ে বিরাজবাবুর বাসায় এক বার যে যাওয়া যায় না তা-ও নয়। কিন্তু কিছুতেই পেরে ওঠে না সিতাংশু। নিজের এই ছেলেমানুষি কৌতূহলের উগ্রতা তাকে যত বেশি পীড়ন করে, ততখানিই লজ্জা দেয়।

কেন যে বুলুর ক্ষতচিহ্নিত কপালটাকে এক বার দেখবার জন্যে এই পাগলামি তাকে পেয়ে বসেছে, সিতাংশু নিজের কাছেই তার কোনো কৈফিয়ত খুঁজে পায় না। বুলুর কাছে ক্ষমা চাইবে এক বার? বলবে, আমাকে যত বড়ো পাষন্ড ভেবেছেন আমি তা নই। কোনো মেয়ের গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, ছেলেবেলার সীমা পার হয়ে নিজের ছোটোভাইকে পর্যন্ত কোনোদিন একটা চড়চাপড়ও মারিনি। আর বুলুর কপালের দিকে তাকিয়ে নিজের অপরাধের সে পরিমাপ করতে চায়। জেনে নিতে চায় কোনো বড়ো ক্ষতি সে করেনি, ছোট্ট একটুখানি দাগ, দু-দিন পরেই মিলিয়ে যাবে?

ঠিক কী বলতে চায় সিতাংশু জানে না। কেবল অর্থহীন মনোযন্ত্রণার পীড়ন। ভূতের মতো ভাবনাটা তার ওপর চেপে বসেছে, নিজেকে কিছুতেই ছাড়াতে পারে না তার হাত থেকে।

কিন্তু শেষপর্যন্ত বুলুও এল।

আজও ঠিক তেমনি উত্তপ্ত সন্ধ্যা। লণ্ঠনের আলোয় নিজের বিকৃত ছায়া দেখতে দেখতে খেপে গিয়ে সিতাংশু বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছিল। তারপর ইজিচেয়ার পেতে চুপ করে বসে ছিল জানলার কাছে। বাইরে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে ছিল বল্কলবিহীন ইউক্যালিপ্টাসের সারি, যেন কোনো নিভন্ত চিতা থেকে উঠে আসা বাতাস ঝরঝরিয়ে তাদের পাতা ঝরাচ্ছিল।

আসব?

দরজার ফ্রেমে একটি মেয়ের ছায়াশরীর। সিতাংশুর সমস্ত সত্তা একটা নিঃশব্দ চিৎকারে ভরে উঠল। বুলু! বুলু ছাড়া আর কেউ নয়—কেউ হতেই পারে না। তবু জিজ্ঞাসা করলে, কে?

আমি বুলু। একটা চাপা হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল, আপনার জল চুরি করতে এসেছিলুম।

আর লজ্জা দেবেন না। উদগ্র আহ্বানে সিতাংশুর শিরাগুলো টান টান হয়ে উঠল। বসুন আলোটা জ্বালি।

আলো জ্বালবার দরকার নেই, খামোখা রাস্তার লোকের চোখে পড়বে। শুধু একটা কথা বলতে এলুম। বলেই চলে যাব।

চেষ্টা করেও সিতাংশু গলার কাঁপন থামাতে পারল না। বললে, কিন্তু আপনাকে আমারও বলবার কিছু আছে। সেদিন যে অন্যায় আমি করে ফেলেছি…

অন্যায় আপনি করেননি। আমার যা পাওনা তাই-ই পেয়েছি। আমি সত্যি সত্যিই চোর।

ছি ছি, কী যে বলেন! আবছা অন্ধকারেও হাতজোড় করল সিতাংশু, আপনি জানেন না, আমি যে সেই থেকে কী লজ্জায়…

দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল ছায়ারূপিণী বুলু। যেন অনেক দূর থেকে অথচ স্পষ্ট সুরেলা গলায় বললে, আগে আমার কয়েকটা কথা শুনুন, তারপরে লজ্জা পাবেন। আমি আজ আপনার কাছে কেন এসেছি জানেন? আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে যে-দুঃখ আপনি পেয়েছেন, সেই দুঃখ থেকে আপনাকে মুক্তি দেব বলে। এ ছাড়া কাল আমি চলে যাব এখান থেকে, যাওয়ার আগে আপনাকে সামনে রেখে নিজের কথাগুলো বলে যাব। ইচ্ছে হলে শুনতে পারেন, নাও শুনতে পারেন।

আস্তে আস্তে এগিয়ে টেবিলের পাশটিতে বসে পড়ল বুলু। আর কেমন থমকে গেল সিতাংশু, মুহূর্তে বুলু যেন তাকে অনেকখানি দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। বিহ্বলভাবে বললে, আপনি যে কী বলছেন, আমি…

এখুনি বুঝতে পারবেন। আপনার ইদারা থেকে দু-বালতি জল নিতে এসেছিলুম, সেটা বড়ো কথা নয়। শুনুন, আমি চোর হয়েই জন্মেছি। হাতের সামনে কোনো জিনিস দেখলে আমি আর লোভ সামলাতে পারি না। সে টাকা হোক, পেনসিল হোক, একটা ফুলই হোক। ছেলেবেলা থেকে পাড়ার কোনো মেয়ে আমার সঙ্গে খেলত না, কোনো বাড়িতে ঢুকলেই আমাকে তারা তাড়িয়ে দিত। মেয়েদের বইখাতা চুরির জন্যে ইশকুল থেকে বার বার আমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে, শেষে অসহ্য হয়ে বিদায় করেছে। আমার দু-বছর বয়েসে মা মারা যান। দেবীর মতো পবিত্র ছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন স্কুলের হেডমাস্টার, সারাজীবন সততারই সাধনা করেছেন। অথচ আমি…

বুলু থামল, কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে গলা। সান্ত্বনা দেওয়া উচিত ছিল সিতাংশুর, ভাষা খুঁজে পেল না।

বুলু বলে চলল, দশ বছর বয়সে বাবা আমায় ছেড়ে গেলেন, এলুম কাকার কাছে। কাকা আমার স্বভাব বদলাবার অনেক চেষ্টা করেছেন, চাবুক দিয়ে মেরেছেন, সারা পিঠে আমার দাগ পড়ে গিয়েছে, অথচ কিছুতেই আমি পারি না। না খেতে দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রেখেছেন, বেরিয়েই আমি তখুনি ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে কমলালেবু চুরি করেছি।

সিতাংশু একটা অস্ফুট আর্তনাদ করল। বুলু উঠে দাঁড়াল, সরে গিয়ে সিলুয়েত ছবির মতো ঠাঁই নিলে দরজার ফ্রেমে।

ভয় পাচ্ছেন, না? কান্না-মেশানো হাসির আওয়াজ এল বুলুর, সত্যি ভয় আপনি পেতে পারেন। আমি এক্ষুনি আপনার টেবিল থেকে ঘড়ি কিংবা কলম যাহোক একটা তুলে নিতে পারি। হাত আমার এমনই রপ্ত হয়ে গেছে যে, আপনি টেরও পাবেন না।

নার্ভাসভাবে গলাটা এক বার পরিষ্কার করে নিলে সিতাংশু। ছেলেমানুষের মতো বললে, কিন্তু আমি তবুও কিছুতেই…

বিশ্বাস করতে পারেন না, না? অনেকেই পারে না। ভালো করে আমাকে যদি দেখেন আপনি, স্বীকার করবেন আমি সুন্দরী। রূপটা আমার গুড কণ্ডাক্টের সার্টিফিকেট। কিন্তু আমাকে যারা চিনেছে, তারা কখনো ভুল করবে না।

সিতাংশু আবার গলাটা পরিষ্কার করে নিলে। কিন্তু এবার আর কথা বেরুল না মুখ দিয়ে।

বুলু বলে চলল, আমি জানি এ আমার রোগ। কাকাকে কত বার বলেছি আমার চিকিৎসা করাও আমি সেরে যাব, এ আমি আর সইতে পারছি না। কাকা বলেন, মারই হচ্ছে এ রোগের ওষুধ। তোর বিয়ে দিতে পারব বলে আশা নেই, তবে কোনোদিন যদি দিতেই পারি, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বেশ করে ঠ্যাঙানি খেলেই রোগ পালাতে পথ পাবে না।

আচ্ছন্নভাবে বসে রইল সিতাংশু। বাইরে মাঠের ভিতর থেকে হাওয়ার গোঙানি ভেসে এল।

বাইশ বছর বয়স হল আমার, এ যন্ত্রণা আমি আর বইতে পারব না। তাই ভেবেছি কাল ভোরের ট্রেনে কলকাতায় চলে যাব। কাকা যেতে দেবেন না, টাকাও দেবেন না, পালিয়েই যেতে হবে আমাকে। গিয়ে আমি ডাক্তার দেখাব, ভালো হতে, বাঁচতে চেষ্টা করব। শুধু যাওয়ার আগে আপনাকে বলতে এসেছি, অন্যায় আপনি করেননি, চোরকে তার পাওনা শাস্তিই দিয়েছিলেন।

পরক্ষণেই দরজার ফ্রেম থেকে মিলিয়ে গেল বুলু। একটা লঘু পায়ের শব্দ নেমে গেল অন্ধকারে।

স্বপ্ন, মায়া, মতিভ্রম! চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে চেষ্টা করল সিতাংশু-পারল না, কিছুতেই পারল না। কে যেন হিপনোটাইজ করে তাকে নিশ্চল স্থবিরে পরিণত করে দিয়েছে।

একটা দমকা হাওয়ায় ইউক্যালিপ্টাসের কয়েকটা ঝরা পাতা এসে সিতাংশুর গায়ে-মাথায় ছড়িয়ে পড়ল।

সিতাংশুর ঘোর ভাঙল পরদিন।

আজ আর উজ্জ্বলন্ত সকাল নয়। এতদিনের অগ্নিদহনের পর পৃথিবীর প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে। আকাশ মেঘে অন্ধকার—বায়ু বহত পুরবৈয়া। ঝিমঝিম বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। নামুক, আকাশ উজাড় করে নেমে আসুক। মরা মাটিতে নতুন অঙ্কুর মাথা তুলুক, শুকনো ইদারাগুলো জলে ভরে উঠুক, আর বুলু…

আর বুলু। স্বপ্ন-মায়া-মতিভ্রম। একটা অবিশ্বাস্য কাহিনি। বিচিত্র বিকৃতির নাগপাশে পাকে পাকে জড়ানো—তিলে তিলে মরে যাচ্ছে সে। আজ সকালের ট্রেনেই তার কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার কথা। বাঁচুক, বেঁচে উঠুক বুলু। প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করল সিতাংশু, এই বন্ধন থেকে সে মুক্তি পাক, এই অভিশাপের গন্ডি পার হয়ে সূর্যস্নাত জীবনের মধ্যে তার উত্তরণ ঘটুক।

ভয় পাচ্ছেন? জানেন, এক্ষুনি আপনার টেবিল থেকে ঘড়ি, কলম যাহোক কিছু… কথাটা কানের মধ্যে বেজে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের দিকে তাকাল সিতাংশু। ঘড়ি, কলম, চশমা সব ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাগ? মানিব্যাগটা?

কালকে পাওয়া মাইনের দু-শো পঁচিশ টাকা আছে ব্যাগে। পুরো দু-শো পঁচিশ টাকা। একটা পয়সাও খরচ হয়নি।

পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিল সিতাংশু। নেই। টেবিলের টানায়? সেখানেও নেই। না, বালিশের নীচেও না।

মুহূর্তে চোখে অন্ধকার। একটু আগেকার প্রার্থনা বীভৎস অভিসম্পাত হয়ে এগিয়ে এল গলায়। হিপনোটিজম-ই বটে। সেইজন্যে বুলু আলো জ্বালাতে বারণ করেছিল আর উত্তপ্ত বিচিত্র সন্ধ্যার বিহ্বলতার সুযোগে সিতাংশুর নির্বোধ আচ্ছন্নতাকে আরও ঘনীভূত করে দিয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে সে সরে পড়েছে। সিতাংশু ছুটল বিরাজবাবুর বাসায়।

শুধু আপনার ব্যাগ নিয়েছে? জান্তব চিৎকারে বিরাজবাবু ফেটে পড়লেন, আমার কী সর্বনাশ করেছে জানেন? গিন্নির চার ভরির হার, ছ-গাছা চুড়ি, সব নিয়ে শেষরাত্রে সরে পড়েছে।

সংশয়ের শেষটুকুও মুছে গেল।

কী করা যায় বিরাজবাবু?

থানায় চলুন। আর কী করবার আছে? বেঁটে ভারী চেহারার বিরাজবাবুকে নরখাদকের মতো দেখাতে লাগল। ক্রিমিনাল মশাই-বর্ন ক্রিমিনাল! ওই লজ্জাতেই দাদা অসময়ে মারা গেলেন। বিস্তর শাসন করেছি মশাই, চাবকে চামড়া তুলে দিয়েছি, দেওয়ালে ঠুকে ঠুকে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি, তবু স্বভাব ছাড়ানো গেল না। মেয়েছেলে, তায় আমাদের বংশের। কী করে যে এমন হল ভাবতেই পারা যায় না। চলুন থানায়, ও-মেয়ের জেলখাটাই দরকার।

ঘরের ভিতর বিরাজবাবুর স্ত্রীর ইনিয়েবিনিয়ে কান্না, দুধ দিয়ে আমি কালসাপ পুষেছিলুম! আমার সর্বনাশ করে গেল…

বিরাজবাবু আরও খেপে গেলেন। হাত ধরে টানতে লাগলেন সিতাংশুর।

চলুন চলুন, আর দেরি করবেন না। এখনও বোধ হয় জসিডি পেরুতে পারেনি।

বুলু ফিরল সন্ধার পর। পুলিশ তাকে ফিরিয়ে এনেছে আসানসোল থেকে।

কিন্তু ততক্ষণে সিতাংশুর মনের আগুনটা নিবে গিয়েছে। সারাদিনের অশ্রান্ত বৃষ্টিতে পৃথিবীর মাটি স্নিগ্ধ হয়েছে, সুগন্ধ শীতল ভিজে বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিয়েছে। আর চুপচাপ বসে বসে সিতাংশু ভাবছিল, কী দরকার ছিল দু-শো পঁচিশ টাকার জন্যে অতখানি পাগলামি করবার? বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে যাহোক করে এ মাসটা তার চলে যেত। কিছু ধারও হয়তো হত, সেটা শোধ দেওয়া যেত আস্তে আস্তে। কেন সে করতে গেল এসব? হয়তো বুলু সত্যিই যাবে সাইকোলজিস্টের কাছে, এই টাকাটা দিয়ে নিজের চিকিৎসা করাবে, সুস্থ স্বাভাবিক-সুন্দর হয়ে উঠবে। বুলুকে মেরে যে-পাপ করেছিল, এই টাকায় তার প্রায়শ্চিত্ত হবে খানিকটা। কেন এতটা হীন হয়ে গেল সিতাংশু, কালকের সেই অভিশপ্ত বুলুকে সে ভুলে গেল কী করে?

এমন সময় প্রায় নাচতে নাচতে এলেন বিরাজবাবু।

চলুন, চলুন। শ্রীমতী পৌঁছেছেন।

ধড়ফড় করে উঠে বসল সিতাংশু, কোথায়?

হাজতে।

বুকের ভিতর হাতুড়ি পড়ল একটা। কালো হয়ে গেল মুখ।

মাপ করবেন, আমি পারব না।

পারবেন না কী? যেতেই হবে। খবর পাঠিয়েছে থানা থেকে।

আমার শরীর খারাপ।

নিষ্ঠুর হাসি হাসলেন বিরাজবাবু।

আপনি ইয়ং ম্যান, ওসব সেন্টিমেন্ট আমি বুঝি। কিন্তু আমার অনেক বয়েস হয়েছে মশাই। উঠুন, চলুন শিগগির।

একটা মৃতদেহের মতো সিতাংশুকে টেনে তুললেন রিকশায়। তারপর থানাতে।

থানাসুদ্ধ লোকের কৌতুকভরা চোখের সামনে একটা টুলে বসে আছে বুলু। রুক্ষ চুল, ভাষাহীন চোখ। সামনের দেওয়ালের দিকে স্থিরদৃষ্টি। আজ সারাদিন সে স্নান করেনি, খেতে পায়নি।

চোরের মতো এক বার বুলুর দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ পিছনে সরে গেল সিতাংশু, লুকিয়ে পড়তে চাইল। এইবার বুলুকে সে সম্পূর্ণ দেখছে—দেখছে কপালে এক ইঞ্চি লম্বা কাটা দাগটা এখনও শুকোয়নি। সিতাংশুর স্বাক্ষর।

কিন্তু সম্পূর্ণ কি দেখেছে সিতাংশু? না, দেখবার সাহস নেই। সাহস নেই বুলুর আরক্ত ভাষাহীন চোখের দিকে সে তাকায়।

দারোগা বললেন, এই দেখুন গয়না। হার, চুড়ি…

বিরাজবাবু প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন সেগুলোর উপর। বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ সবই আমার স্ত্রীর।

বুলু কথা বললে এইবার। সেই শান্ত সুরেলা গলা। যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।

না, কাকিমার গয়না আমি নিইনি। ওসব আমার মায়ের জিনিস। কাকিমার কাছে ছিল।

মায়ের জিনিস? বীভৎসভাবে বিরাজবাবু ভেংচে উঠলেন, চোপরাও হারামজাদি। চোর!

বুলু আবার শান্ত গলায় বললে, আমি জানি, ওসবই আমার মায়ের। কাকিমার কোনো জিনিসই আমি ছুঁইনি।

বিরাজবাবু বুলুর উদ্দেশে প্রকান্ড একটা চড় তুলেছিলেন, দারোগা তাঁকে ধমক দিলেন, থামুন, আপনার স্ত্রী এসে গয়না শনাক্ত করবেন, আপনি গন্ডগোল করবেন না। তারপর সিতাংশুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, শ-খানেক ক্যাশ টাকা পেয়েছি, কিন্তু আপনার ব্যাগ পাওয়া যায়নি।

বিরাজবাবু বললেন, ব্যাগটা রেখে দেবে ওকি অমন কাঁচা চোর নাকি? আপনি ওকে চেনেন না স্যার! ও যে…

আঃ। দারোগা আবার ধমক দিলেন একটা।

বুলুর উদাস বিষণ্ণ স্বর শোনা গেল, আমি ওঁর ব্যাগ নিইনি। আমার নিজের চুড়ি বিক্রি করে…

বিরাজবাবু আবার ভেংচে উঠলেন, ওরে আমার সত্যবাদী যুধিষ্ঠির রে! নিজের চুড়ি বেচে উনি…

আর নয়। এর পরে আর কোনোমতেই দাঁড়ানো চলে না। চোরের মতো নিঃশব্দে পালিয়ে এল সিতাংশু। শুধু পথে আসতে আসতে বার বার মনে হল, আজ সারাদিন বুলুর খাওয়া হয়নি।

ব্যাগটা কিন্তু পাওয়া গেল। অফিসের ড্রয়ারেই রেখে এসেছিল।

এ সন্দেহও সিতাংশুর মনে জাগতে পারত। কিন্তু সন্ধ্যায় এসে যদি অমনভাবে নিজের কথা না বলত বুলু, যদি বিরাজবাবুর বাড়ি থেকে গয়নাগুলো সে না নিত, যদি সত্যিই সে কলকাতায় পালাতে না চাইত, তাহলে…

ব্যাগটাকে তৎক্ষণাৎ পকেটে লুকিয়ে ফেলল সিতাংশু। এখন থানায় যাওয়া যায়? বলা যায়, বুলু তার টাকা নেয়নি? ভুল করে সে মিথ্যে এজাহার দিয়েছিল?

কিন্তু আর কি সম্ভব? তাতে নিজের ওপরেই বিপদ টেনে আনা হবে। কেন তুমি এমন কাজ করলে? কেন একজন নির্দোষকে মিথ্যে নালিশ করে…।

নাঃ, সে মনের জোর নেই সিতাংশুর। তা ছাড়া এই হয়তো ভালো হল। জেলেই যাক বুলু। পাক দুঃখ, পাক লজ্জা। হয়তো এ থেকেই বুলু ভালো হয়ে উঠবে। যে সহজ-স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের মধ্যে সে যেতে চেয়েছিল, হয়তো তারই প্রস্তুতি হবে এখান থেকে।

বাইরে বৃষ্টি। দগ্ধ মাঠে নতুন অঙ্কুর। ইদারায় নতুন জল। বুলুর চোখেও কি বর্ষা নেমেছে এখন?

আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাল—একটা রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নের মতো। আর তখনই দেখতে পেল সিতাংশু বুলুর জীবনের দিগদিগন্ত জুড়ে অমনি একটা ক্ষতের স্বাক্ষর এঁকে দিয়েছে সে।


© 2024 পুরনো বই