প্রথমটায় ব্রজেন পাল রাজি হয়নি। কিন্তু নীলকণ্ঠ টাকার অঙ্কটা যত বেশি বাড়াতে লাগল, অন্ধকারে তত বেশি করে হিংস্র জানোয়ারের মতো জ্বলে উঠতে লাগল ব্ৰজেন পালের চোখ। তারপরে একসময়ে দেখা গেল তিনটে আগুন একসঙ্গে জ্বলছে। দুটো চোখ আর একটা বিড়ির রক্তদীপ্তি।
রাতটা যেমন অন্ধকার তেমনি থমথমে। সামনে তিনটে টানা রেললাইন পড়ে আছে। অন্ধকারে তাদের দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঘষা ইস্পাত ঝিকিয়ে উঠছে। আর রেলের যে-বাঁধটার ওপরে ওরা বসে আছে, তার তলা দিয়ে খরস্রোতে চলেছে বর্ষার জল। পাথরে পাথরে ঘা খেয়ে তা থেকে তীব্র একটা গর্জন উঠছে—আর সেই গর্জনের প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছে ব্ৰজেন পাল, শুনতে পাচ্ছে নিজের রক্তের মধ্যে। তা ছাড়া সমস্ত নীরব, সমস্ত নিঃসাড়। শুধু দূরের জংশন স্টেশনটা একরাশ লাল-সবুজ আলোর মালা দুলিয়ে জাগছে রাত্রির অতন্দ্র প্রহর।
হাতের বিড়িটা নীচের খরধারার ভেতরে ফেলে দিয়ে ব্রজেন পাল এক বার ঠোঁট দুটোকে চেটে নিলে। টাকার অঙ্কটা মগজের মধ্যে যেমন মদের নেশার মতো ঝিমঝিম করছে, তেমনি শুকিয়ে উঠেছে বুকের ভেতরটা। স্টেশনের একটা লাল সিগন্যালের দিকে চোখ রেখে ব্রজেন পাল বললে, কিন্তু দায়িত্বটা বুঝতে পারছেন তো? যদি ফাঁস হয়ে যায় তাহলে যথাসর্বস্ব তত যাবেই, বছর পাঁচেক শ্রীঘরবাসও করতে হবে নির্ঘাত।
আরে না না। এবারে বিড়ির বদলে পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স বের করলে নীলকণ্ঠ। পরম সমাদরে তারই একটা ব্রজেন পালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, দু-দিন ওখানে বন্ধ থাকলেই আর দেখতে হবে না। আপনার বন্দোবস্ত ঠিক আছে তো? তাহলেই হল।
ঘচ করে দেশলাই জ্বাললে নীলকণ্ঠ। তার আলোতে ব্রজেন পালের লোভাতুর ভীত মুখখানা মুহূর্তের জন্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। নীলকণ্ঠের মনে হল সে-মুখ যেমন বীভৎস, তেমনি ভয়ানক।
আমার বন্দোবস্ত? কর্কশভাবে ব্রজেন পাল হেসে উঠল, যেসব নমুনা আমার আছে, তাদের পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে আমারই মাথা বেঠিক হওয়ার জো হয়। আর এ তো মেয়েমানুষ। ওদেরই ক-টার সঙ্গে এক রাত একটা ঘরে পুরে রাখলেই আর দেখতে হবে না।
যাক, তাহলে ভাবনা নেই। নীলকণ্ঠের গলা প্রশান্ত আর নিরুদবিগ্ন শোনাল। আপনি কিছু ভয় পাবেন না ডাক্তারবাবু। অত বড়ো একটা সম্পত্তির ওয়ারিশন যদি হয়ে যেতে পারি তাহলে আপনাকেও যে ঠকাব না এ একেবারে পাকা কথা বলে দিচ্ছি।
তবু ব্ৰজেন ডাক্তারের সংশয় যাচ্ছে না। নীচে বাঁধের জলে গর্জন বাজছে, ওদিকে স্টেশনের আলোগুলো তেমনি তাকিয়ে আছে নিষ্পলক ভৌতিক দৃষ্টিতে। ওপরের মেঘে-ভরা আকাশটা যেন কালো মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো। একটা অশুভ এবং বিশ্রী ভীতিকর পরিবেশ। ব্রজেন পালের গায়ের রোমকূপগুলো শিরশির করতে লাগল। ঘামে ভিজে যেতে লাগল জামাটা।
অন্ধকারের ভেতরে একটা সাপের মতো নিঃসাড়ে এগিয়ে এল নীলকণ্ঠের ঠাণ্ডা হাতটা। আর সাপের ছোঁয়া লাগলে যেমন করে মানুষ আঁতকে ওঠে, ঠিক তেমনিভাবেই চমকে উঠল ব্ৰজেন ডাক্তার। কিন্তু এ সাপের ফণায় বিষ নেই, আছে একতাড়া নোট।
নীলকণ্ঠ বললে, এখন এই দেড়শো রাখুন। কাজ হয়ে গেলে বাকিটা পাবেন। আর তা ছাড়া মাসে মাসে… অসমাপ্ত কথাটাকে সমাপ্ত করে দিয়ে একসারি ঝকঝকে দাঁতের ঝিলিক পাওয়া গেল।
হাতের মধ্যে পনেরোখানা নোটের স্পর্শ। কেমন গরম, যেন জীবন্ত। খসখস খচখচ শব্দে দুর্বোধ্য ভাষায় যেন কী-একটা তারা বলবার চেষ্টা করছে। যেন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অনেক ভবিষ্যতের, অনেক রোমাঞ্চকর সোনালি সম্ভাবনার। দূর সম্পর্কের বিধবা খুড়িমা বিমলা দেব্যাকে রাতারাতি পাগল করতে পারলে পনেরো হাজার টাকার ওয়ারিশ হবে নীলকণ্ঠ। আর সেদিন—সেদিন পরোপকারী ব্ৰজেন ডাক্তারও যে ফাঁকি পড়বে না, এ আশা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি সংগত। আর তা ছাড়া আইনের একটি দড়িতেই যখন দুজনেরই ভাগ্য বাঁধা পড়েছে, তখন আর…
প্রায় নিঃশব্দ গলায় ব্রজেন ডাক্তার বললে, রাজি।
আকাশে তারা নেই, শুধু স্তুপাকার নীরন্ধ্র মেঘ। দূরে স্টেশনের আলোগুলো তেমনি নিষ্পলক ভৌতিক চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। আর তেমনি করে বাঁধের খরস্রোতা বর্ষার জলের সঙ্গে ঐকতান মিলিয়ে ব্ৰজেন ডাক্তারের বুকের রক্তও গর্জন করতে লাগল।
কলকাতা থেকে মাইল পনেরো দূরে ব্রজেন ডাক্তারের উন্মাদ নিকেতন।
ক্যাম্বেল থেকে পাস করে কিছুদিন পসার জমাবার চেষ্টা করেছিল শ্রীরামপুরে, কিন্তু পসার জমল না। দেনার জ্বালায় ডিসপেন্সারি বিক্রি হয়ে গেল, মনের দুঃখে গভীর একটা সংসার বৈরাগ্য অবলম্বন করে সে নিরুদ্দেশযাত্রা করলে। কম্পাউণ্ডার হারাধন খবরের কাগজে বার কয়েক বিজ্ঞাপন দিয়েও যখন কোনো হদিশ পেলে না, তখন গোটা কয়েক আয়ুর্বেদীয় মহৌষধের শিশি সাজিয়ে সে ভৈষজ্যশাস্ত্রী হয়ে বসল।
ব্ৰজেন ডাক্তার ফিরল প্রায় এক বছর পরে। হরিদ্বার না লছমন ঝোলায় কোন এক ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষের সে সাক্ষাৎ পায়। বহুদিন তাঁর সেবা করায় তিনি তুষ্ট হয়ে যাবতীয় উন্মাদ রোগের দৈবচিকিৎসার পদ্ধতি ব্ৰজেন ডাক্তারকে বাতলে দিয়েছেন। তাঁরই উপদেশে এবং আদেশে শুধু মানবসমাজের কল্যাণের জন্যেই ব্রজেন ডাক্তার লোকালয়ে ফিরে এসেছে। কোনো লাভ না নিয়ে একমাত্র ওষুধ তৈরির খরচার বিনিময়েই নিঃস্বার্থ সেবাব্রতী ব্রজেন ডাক্তার এখানে উন্মাদ নিকেতনের প্রতিষ্ঠা করেছে।
তারপর আস্তে আস্তে পসার জমে উঠেছে। প্রথমে ছিল টালির ঘর, এখন সেখানে তুলেছে তিনখানা ছোটো ছোটো দালান। কোনোখানে রোগী রেখে যারা সুফল পায়নি, তারা এসে ব্ৰজেন ডাক্তারের দ্বারস্থ হয়েছে। চিকিৎসা কতদূর কী হয় তা জানে ব্ৰজেন ডাক্তার আর জানেন সেই ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষ। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের সেটা দ্রষ্টব্য নয়। একটা আশ্বাস দরকার, একটা অপ্রিয় কর্তব্যবুদ্ধিকে পরিতুষ্ট রাখা দরকার। মৃত্যুকে সহ্য করা যায়, সে চিহ্ন রাখে না। দু-দিন পরে আপনা থেকেই যায় বিস্মৃতিতে বিলীন হয়ে, নিছক একটা মনোবিলাসের মধ্যেই তার পরিসমাপ্তি। কিন্তু মৃত্যুর চাইতে যা ভয়ংকর, যা জীবনের একটা মর্মান্তিক বিদ্রূপ, তাকে সহ্য করা অসম্ভব। মানুষ পাগলকে গুলি করে মারতে পারবে না, গলা টিপে শেষ করে দিতে আইনের বাধা আছে, তাই তাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়।
সুতরাং, নীলকণ্ঠের দোষ নেই। খুড়িমা বিমলা দেব্যা অবশ্য পাগল নন, কিন্তু পাগল হলে কী ক্ষতি ছিল? অন্তত নীলকণ্ঠের সহজ বুদ্ধিতে তার জবাব মেলে না। নিঃসন্তান বিধবা মানুষ, অত বিষয়সম্পত্তি তাঁর কী প্রয়োজনে লাগবে? শুধু যখের মতো আগলে থাকা, শুধু নীলকণ্ঠের লোলুপ ভোগাতুর মনটাকে বিড়ম্বিত করা। একমুঠো আতপ চাল, একখানা সাদা থান আর দশ টাকা করে কাশীবাসের মাসোহারাই যথেষ্ট বিমলা দেব্যার পক্ষে। কিন্তু সেকথা বুঝবেন না বিমলা। তিনি আগলে রাখবেন, আঁকড়ে রাখবেন। যে-টাকা হাতে পেলে নীলকণ্ঠের এই উপবাসী দরিদ্র জীবন পৃথিবীর যা-কিছু উপভোগকে নিঃশেষে আয়ত্ত করতে পারে, সেই টাকা আটকে রাখবেন বিমলা, বন্দি করে রাখবেন—আর সেইসঙ্গে বঞ্চিত করে রাখবেন তৃষ্ণার্ত ক্ষুধাতুর নীলকণ্ঠকে।
যে-কারণে মানুষ পাগলকে খুন করে না, সেই কারণেই নীলকণ্ঠ একটা নিষ্ঠুর নির্মম থাবা বসিয়ে দেয়নি বিমলার গলায়, নিষ্পেষিত করে দেয়নি তাঁর কণ্ঠনালিকে, একটা দা-এর কোপ বসিয়ে দেয়নি তাঁর ঘাড়ে। কিন্তু পাগল হলে ক্ষতি কী? যে-জীবন নিরর্থক, ভাগাড়ের শকুনের মতো যা দিনরাত পাহারা দিয়েই চলেছে, তার পক্ষে পাগল হওয়াই স্বাভাবিক এবং সংগত।
অতএব বিমলার হাঁপানির জন্যে তারকেশ্বরে ধন্না দেওয়াটা অত্যন্ত দরকার। বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালে নীলকণ্ঠ। বিকাল বেলায় রওনা দিয়ে রাত প্রায় আটটার সময় ওরা দুজনে এসে নামল জংশন স্টেশনটাতে।
হাতের মালা জপ করতে করতে বিমলা বললেন, এ কোথায় এলাম নীলু?
সেকথার জবাব না দিয়ে নীলকণ্ঠ নিজেই কাঁধে তুলে নিলে বিমলার ভারী ট্রাঙ্কটা। বললে, চলো খুড়িমা।
কোথায় যেতে হবে? এ তো বাবার থান বলে মনে হচ্ছে না।
না, বাবার থান নয়। সকাল বেলায় এখান থেকে গাড়ি বদল করে তারকেশ্বরে যেতে হবে। চলো, ভালো ধর্মশালা আছে, রাতটা সেখানেই কাটিয়ে…
বিমলা বললেন, তা বেশ। কিন্তু আমি তো বাবা বিধবা মানুষ, ধর্মশালার আচার-বিচার…
সেসব তোমাকে ভাবতে হবে না খুড়িমা। আমি আছি কী করতে? নীলকণ্ঠ এমনভাবে একমুখ হাসলে যে বিমলার আর বলবার কিছু রইল না।
রেললাইন ছাড়িয়ে দুজনে মেঠোপথে নেমে পড়ল। আকাশ আজও অন্ধকার, দিগন্তে যে চাঁদ দেখা দিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই তা মেঘের অন্তরালে হারিয়ে গেছে। শুধুকতগুলো জ্বলজ্বলে তারা সংশয়াকুল চোখে দৃষ্টি ফেলছে পশ্চিমের দিকচক্র থেকে। দু-পাশের ডোবায় জমা বৃষ্টির জল থেকে উঠছে ব্যাঙের কোলাহল। পথের কাদায় বিমলার পা পিছলে যেতে লাগল।
হঠাৎ একটা সন্দেহে ভারী হয়ে উঠল বিমলার মন। নির্জন অন্ধকার পথ। চিৎকার করলেও কারও সাড়া পাওয়া যাবে না কোনোখানে। হাতের মালার ভেতরে বিমলার আঙুল আটকে গেল।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস নীলু? তোর মতলব কী?
এক মুহূর্তের জন্যে যেন পাথর হয়ে গেল নীলকণ্ঠ। বিমলা কি বুঝতে পেরেছেন সব? কিন্তু এক মুহূর্ত মাত্র, নিজেকে সামলে নিতে নীলকণ্ঠের সময় লাগল না।
কেন ভয় পাচ্ছ খুড়িমা, এসে পড়েছি। ওই যে আলো দেখতে পাচ্ছ না?
সত্যিই আলো দেখা গেল। অন্ধকার মাঠের ভেতরে ব্রজেন পালের উন্মাদ নিকেতনে আলো জ্বলছে। আগে থেকেই পাকা বন্দোবস্ত আছে নীলকণ্ঠের।
বিমলা আলো দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, ওইটেই কি ধর্মশালা নাকি?
নিশ্চয়। শেয়ালের মতো শব্দ করে নীলকণ্ঠ হেসে উঠল, ধর্মশালা বই কী। চমৎকার জায়গা। ওখানে এক বার ঢুকলে তুমি আর বেরুতে চাইবে না।
বিমলার সর্বাঙ্গে চমক লাগল। পথের মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, যেন এই মুহূর্তে তাঁর বুকের ভেতর থেকে একটা উদ্দাম ভয়ংকর চিৎকার বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বিমলা কিছু করবার আগেই একটা লণ্ঠন হাতে করে এগিয়ে এল ব্রজেন ডাক্তার। একগাল আপ্যায়নের হাসি হেসে বললে, এই যে, আসুন আসুন!
ব্ৰজেন ডাক্তার বললে, চলুন, তাহলে আপনার শোবার বন্দোবস্ত করে দিই। ভয় নেই, কোনো কষ্ট হবে না।
বিমলা সংশয়গ্রস্ত হয়ে বললেন, কিন্তু নীলু?
উনি পুরুষ, ওঁর ব্যবস্থা আলাদা। চলুন। সামনে এটা অন্ধকার ঘর। বাইরে থেকে একটা লণ্ঠন নিয়ে ব্রজেন ডাক্তার বিমলার হাতে তুলে দিলে। বললে, সব ঠিক করা আছে, গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
লণ্ঠন নিয়ে বিমলা ঘরে ঢুকলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, শিকল পড়ল খুট করে।
শিকল তোলবার শব্দ বিমলা হয়তো শুনতে পেতেন, কিন্তু শুনতে তিনি পেলেন না। লণ্ঠনের আলোয় সমস্ত ঘরটা ভালো করে আভাসিত হয়ে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই এমন একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল যে, বিমলার হৃৎস্পন্দন যেন ত্রস্ত হয়ে থেমে দাঁড়াল।
টাকা দাও, টাকা দাও বলছি। নইলে আমি মাথা খুঁড়ে রক্তগঙ্গা হয়ে মরব।
একখানা লম্বা ঘর। তার দরজা-জানলা সব বন্ধ-করা। বাতাসের অভাবে যেন নিশ্বাস আটকে আসে। একটা চাপা ভ্যাপসা গরম, তার ভেতরে জমাট হয়ে আছে তীব্র দুর্গন্ধ–বমির গন্ধ। ঘরের তিন দিকে তিনটি তক্তাপোশ, তার বালিশ-বিছানা মেঝেতে পাকার হয়ে পড়ে আছে। আর সেখানে একটি মানুষ!
একটি মানুষ! এক লহমার মধ্যেই বিমলা সংবিৎ ফিরে পেলেন। ছুটে পালাতে চাইলেন বাইরে। কিন্তু দরজা বন্ধ—ভালো করেই বন্ধ। নুনের গুণ জানে ব্রজেন ডাক্তার।
বিমলা চিৎকার করে বললেন, দরজা খুলে দাও—শিগগির খুলে দাও। এ আমি কোথায় এলাম? শুনছ? দরজা বন্ধ করে দিলে কেন? খুলে দাও।
বাইরে থেকে সাড়া এল না, কিন্তু সমস্ত ঘরটা সজীব হয়ে উঠল। হি-হি-হি করে একটা প্রচন্ড কৌতুকের হাসিতে বিমলার কণ্ঠস্বর তলিয়ে গেল।
কে হাসছে? অমন করে কে হাসছে?
যে হাসছে সে একটি মেয়ে। তার সমস্ত কপালটা তাজা রক্তে রাঙা, তার গাল মুখ বেয়ে টপ টপ করে রক্ত বুকের ওপরে গড়িয়ে পড়ছে। চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা যায় না সারা গায়ে অমন রক্তস্রোত নিয়ে কেউ অমন করে হাসতে পারে কখনো। ভ্যাপসা বন্ধ ঘরে বমি আর নোংরার দুর্গন্ধের মধ্যে লণ্ঠনের অস্বচ্ছ একটা রহস্যময় আলোর একটা ভয়ংকর বিভীষিকা।
ভয় পাচ্ছ? কেন ভয় পাচ্ছ? টাকা দেবে না? তাহলে আমি মাথা খুঁড়ে মরব, ঠিক মাথা খুঁড়ে মরব। মেয়েটা সেই রক্তাক্ত মাথাটা তেমনি করে দেওয়ালের গায়ে ঠুকতে লাগল, সাদা চুনের গায়ে জ্বলজ্বল করতে লাগল এলোমেলো রক্তের ছোপ।
ভাঙা-গলায় আর্তনাদ করে প্রাণপণে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন বিমলা। খুলে দাও। ওগো কে আছ, খুলে দাও। এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলে?
মুহূর্তে পাশের তক্তাপোশের তলা থেকে একখানা হাত বেরিয়ে এল। একখানা সাদা হাত, তাতে একপর্দা পাতলা চামড়া আর কয়েকখানা হাড়ের টুকরো ছাড়া কিছু নেই। লণ্ঠনের আলোয় তক্তাপোশের নীচে কিছু দেখা যায় না, মনে হয় যেন কোনো একটা দেহহীন
অশরীরী একটা অমানুষিক হাত লোলুপভাবে বিমলার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিমলা চমকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সরে যেতে পারলেন না। অস্থিসর্বস্ব সেই কঙ্কাল হাতখানা চকিতে বিমলার চুলের গোছা আঁকড়ে ধরে ফেলেছে—টান দিয়েছে দানবীয় শক্তিতে। মাথা ঘুরে বিমলা সোজা মেঝের ওপরে পড়ে গেলেন, মুখ দিয়ে শুধু একটা গোঙানির শব্দ বেরুতে লাগল।
তক্তাপোশের তলায় কে যেন দাঁতে দাঁত কড়মড় করছে।
রাক্ষুসি, ডাইনি। সোয়ামিকে খেয়েছিস, আমার বারো বছরের মেয়েটাকে চিবিয়ে খেয়েছিস, আবার আমাকেও খেতে এলি। আজ আমি তোকেই চিবিয়ে খাব।
শেষ শক্তিতে একটা ঝটকা দিয়ে বিমলা উঠে বসলেন। দম আটকে আসছে, চোখে ধোঁয়া দেখছেন, লণ্ঠনের আলোয় ভৌতিক ঘরটা যেন দৃষ্টির সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথার ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা, ওই সাদা কঙ্কাল হাতটা একগুচ্ছ চুল আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে সমস্ত মেঝেটা হাতড়ে বেড়াচ্ছে—যেন বিমলাকেই খুঁজছে।
খোলো, খোলো-দরজা খোলো। ওগো কে আছ—বাঁচাও?
কিন্তু গলার স্বর তলিয়ে যাচ্ছে। রক্তাক্ত মাথা আর মুখ নিয়ে সেই মেয়েটা হাসছে। নিজের রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার মুখে, সেই রক্ত সে জিভ দিয়ে চেটে চেটে খাচ্ছে আর জানোয়ারের মতো একরাশ ধারালো দাঁত বের করে হেসে চলেছে অনবরত। মেঝের ওপর একখানা কঙ্কাল হাত অবিশ্রান্ত কী যেন খুঁজছে।
আতঙ্কের যতটুকু বাকি ছিল এবারে তাও পূর্ণ হয়ে উঠল।
অন্ধকার কোনা থেকে বিদ্যুৎচমকের মতো একটা মূর্তি লণ্ঠনের আলোয় যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি নারীমূর্তি। গায়ের রং পাথরের মতো কুচকুচে কালো। বুকের ওপর উজ্জ্বল একটা শুকনো ক্ষতচিহ্ন।
আগুনের মতো দুটো চোখ বিমলার দিকে ফেলে বললে, এই মড়া এনেছিস? আমি রক্ষাচন্ডী, মড়া খাব। কড়মড় করে মড়ার মাথা কাঁচা চিবিয়ে খেতে বড্ড ভালো লাগে, তুই মড়া আনিসনি?
পায়ের তলা থেকে সমস্ত পৃথিবী সরে যাচ্ছে।
কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও? জটাবাঁধা একরাশ চুলে ঝাঁকুনি দিয়ে সেই উলঙ্গ মূর্তিটা গর্জন করে উঠল, তবে দেখবি? দ্যাখ, দ্যাখ।
বিমলা দেখলেন সেই বিকট মুখখানা থেকে আধ হাত লম্বা একখানা লকলকে কালো জিভ বেরিয়ে এল। আর জিভটা দুলতে দুলতে ক্রমেই তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, যেন–যেন…
শেষ বার আর্তনাদ করে দরজার গায়ে হেলে পড়লেন বিমলা। নিজের রক্ত চাটতে চাটতে সেই মেয়েটা তখনও হাসছে, তখনও কঙ্কাল হাতখানা জোঁকের মতো কতকগুলো আঙুল জড়িয়ে মেঝের ওপরে কী খুঁজে বেড়াচ্ছে।
বাইরের ঘরে তখন মদের বোতল খুলে বসেছে ব্ৰজেন ডাক্তার আর নীলকণ্ঠ।
আকাশে বর্ষার মেঘ গুম গুম করে ডাকছে। দুর্যোগের আশঙ্কায় পৃথিবী নিস্পন্দ। লোকালয়ের সীমা থেকে বহুদূরে এই উন্মাদ আশ্রমে অন্ধকারের প্রেতছায়া।
রক্তের মধ্যে নাচছে মদের চমচমে নেশা, বুকের মধ্যে আনন্দ-আকাঙ্ক্ষার জোয়ার। পনেরো হাজার টাকার সম্পত্তির স্বর্ণদীপ্তি ছায়া ফেলছে নীলকণ্ঠের চেতনায়, ফেলছে ব্ৰজেন ডাক্তারের মনে।
আবেগে নীলকণ্ঠ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। ডাক্তারের একখানা হাত জড়িয়ে ধরে বললে, আর-জন্মে তুমি আমার কী ছিলে ব্রাদার? বাবা না বাবার শালা?
তোমার শালা। বলে নিজের রসিকতায় ব্রজেন ডাক্তার হেসে উঠল। কিন্তু তার কথা সে রাখলে। সাত দিন পরে যখন নীলকণ্ঠ গ্রামে ফিরল, তখন অবাকবিস্ময়ে সকলে শুনতে পেল, তারকেশ্বরে যাবার পথে বিমলার মাথা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়—একবারে উন্মাদ পাগল। তাই কর্তব্যপরায়ণ নীলকণ্ঠ তাকে এখানে না এনে সোজা উন্মাদ নিকেতনে জমা দিয়ে এসেছে।
কুটিল সন্দেহে এক বার নীলকণ্ঠের মুখের দিকে তাকিয়ে গাঁয়ের লোকে বললে, আ…হা! চুক চুক।
তারপরে পথ পরিষ্কার। দিন কয়েক আদালত-কাছারি, উকিলের পরামর্শ সব সহজ হয়ে গেল। কোনো ক্ষোভ নেই নীলকণ্ঠের, কোনো অতৃপ্তি নেই। শুধু একমাত্র আশঙ্কা বিমলা হঠাৎ কবে ভালো হয়ে যান, হঠাৎ কোন দিন বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো…
কিন্তু ভরসা আছে ব্ৰজেন ডাক্তার। দুঃসময়ের বন্ধু, দুর্দিনের কান্ডারি। যতদিন সে বেঁচে আছে ততদিন ভাবনা নেই। তবু মনটা যেমন উৎকর্ণ, তেমনি উৎকণ্ঠ হয়ে থাকে। নীলকন্ঠের আজকাল ভয় করে—একটা অদ্ভুত অস্বাভাবিক ভয়। কালো মেঘের মতো ঘন সংশয়ে চেতনা আকীর্ণ হয়ে থাকে। রাত্রে ঘুমের মধ্যে মনে হয় বহুদূরে অন্ধকারে কারা যেন পাগলের মতো অস্বাভাবিক গলায় চিৎকার করছে। মুখের ওপর হঠাৎ যেন কার একটা উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ছে,–কার? বিমলার? বাইরে অন্ধকারে শুকনো পাতার ওপরে কী চলাফেরা করছে,–শেয়াল না পুলিশ?
ঘুমের ঝোঁকটা ভেঙে যায়। চমকে বিছানার ওপরে উঠে বসে নীলকণ্ঠ। মাথার ভেতরে রক্ত দাপাদাপি করে, মাতালের মতো লাফাতে থাকে শিরাগুলো। ঘরে অন্ধকার, বাইরে অন্ধকার। জানলার কাছ থেকে কে সরে গেল? ব্রজেন ডাক্তারের ওপর বিশ্বাস রাখতে ভরসা হয় না, যদি কখনো মদের ঝোঁকে…
ঘরের এককোণে মালসা থেকে আগুন নিয়ে নিজেই হুঁকোটা ধরায় নীলকণ্ঠ। এত রাত্রে চাকরকে ডাকতে ইচ্ছে করে না—কেমন ভয় করে, কেমন সংশয় জাগে। ঘরে লোহার সিন্দুক, কোমরে চাবির তাড়া। যেকোনো অসতর্ক মুহূর্তে ওই চাকরটাই হয়তো গলাটা টিপে ধরতে পারে। বিশ্বাস নেই কাউকে, পৃথিবীর কাউকে না—ব্রজেন ডাক্তারকেও নয়।
কে?
নীলকণ্ঠ চমকে উঠল। বারান্দায় জুতোর শব্দ।
কে? কে ওখানে?
আমি।
আমি কে? প্রায় বিকৃত গলায় ঘর-ফাটানো চিৎকার উঠল।
আমি সিতিকণ্ঠ।
ঠক করে হাতের হুঁকোটা রেখে বিদ্যুৎগতিতে নীলকণ্ঠ দাঁড়িয়ে পড়ল। ধড়াস করে খুলে ফেললে দরজাটা, হাতের লণ্ঠনটার তেজ বাড়িয়ে দিলে।
এত রাত্তিরে বাইরে কী করছ?
আঠারো বছরের ছেলে সিতিকণ্ঠ বাপের মুখের দিকে বিহ্বলচোখে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। অপরাধীর মতো জবাব দিলে, ঘরে বডড গরম, একটু হাওয়া…
ঘরে বড় গরম! বিশ্রীভাবে মুখটাকে ভেংচে উঠল নীলকণ্ঠ, তাই দুপুররাতে বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছ? তুমি জমিদারের ছেলে, তাই না? টাকার গরমটা আজকাল বুঝি একটু বেশি ঠেকছে?
নীলকণ্ঠের মুখের ভাব দেখলে মনে হয়, যেকোনো সময় একটা প্রকান্ড চড় সে বসিয়ে দিতে পারে। এক-পা এক-পা করে পিছোতে লাগল সিতিকণ্ঠ।
জমিদারের ছেলে! বিকটভাবে নীলকণ্ঠ বলে চলল, সম্পত্তির মালিক হবে! সে-গুড়ে বালি, সে-গুড়ে বালি। আমি শিগগির মরব না, আমি পাগলও নই, বুঝেছ? যদি কোনো মতলব থাকে সেসব ছাড়ো, যাও, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। বুঝেছ? এক্ষুনি যাও।
পরক্ষণেই বেগে ঘরে ঢুকে পড়ল নীলকণ্ঠ। দড়াম করে সশব্দে আটকে দিলে হুড়কোটা। দরজাটা খুব শক্ত করে বন্ধ করা চাই—আরও শক্ত করে। কাল থেকে ভেতরেও একটা তালা লাগাবার বন্দোবস্ত করবে সে।
অথচ দিনের বেলা কোনো গোলমাল নেই। ভোর হওয়ার আগেই নীলকণ্ঠ বাইরে বেরিয়ে আসে। হাত-মুখ ধোয়, চা খায়, তারপর ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে বেরিয়ে যায় খামারে। এখন খন্দের সময়, আদায় তহশিলের দিন। নিজে ভালো করে দেখাশোনা না করলে চলে না।
আশ্চর্য, প্রজাদের কাছে নীলকণ্ঠ যেন মাটির মানুষ। এত বড়ো সম্পত্তির মালিক, দশখানা গাঁয়ের ভেতরে একটা জাঁদরেল জমিদার; কিন্তু কোনো অহমিকা নেই। মাঠে যেখানে ফসল কাটা হচ্ছে সেখানে ঘোড়া বেঁধে একটা বাবলা গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে। প্রজাদের সঙ্গে তামাক খায়, গল্প করে।
অত্যন্ত ঘরোয়া গল্প। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ।
কী রে, তোর ছেলে কেমন? জ্বর ছেড়েছে? যদি না ছাড়ে আমার ওখানে পাঠিয়ে দিস, ভালো হোমোপ্যাথিক ওষুধ দেব—একেবারে সেরে যাবে। হ্যাঁ, এবার তোদের গাঁয়ে একটা কুয়ো করে দেব। ভারি জলের কষ্ট তাই না? কিন্তু দেখছিস তো যুদ্ধের বাজার—চুন-সুরকি কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, নইলে…
প্রজারা খুশি হয়, কৃতজ্ঞ হয়, আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। নীলকণ্ঠকে সাক্ষাৎ দেবতা বলে মনে হয় যেন। দরকার হলে খাজনাপত্তরও মাপ পাওয়া যায় তার কাছে। তার দয়া আছে, বিবেচনা আছে।
নীলকণ্ঠ দুলে দুলে হাসে, স্নেহভরে তাকায় আর দা-কাটা তামাক টানে তারিয়ে তারিয়ে। বাবলা গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় খোলা মাঠের মধ্যে মনটাও যেন খুলে গেছে।
খুড়িঠাকরুনের আমলে কেমন ছিলি তাই বল?
বারে বারে নীলকণ্ঠ এই প্রশ্ন করে। কী জবাব পেলে সে খুশি হয় প্রজারাও তা জানে। উঃ, সেকথা বলবেন না বাবু! একেবারে সাক্ষাৎ যখ। একটি পয়সা রেয়াত করতেন না, বুকে হাঁটু দাবিয়ে আদায় করতেন।
এই দ্যাখ, এই দ্যাখ। তেমনি দুলে দুলে হাসে নীলকণ্ঠ, এ না হলে অমন হয়? এ হল পাপের প্রাচিত্তির, বুঝলি? রাইয়ত বলে কি মানুষ নয় তারা? ধর্ম জেগে আছেন না? তিনিই বিচার করেন।
প্রজারা সায় দেয়।
তাই ধর্মস্থানে গিয়েই একেবারে বেহেড পাগল। এ বাবা ধর্মের কল, বাতাসে নড়বে; এর ওপরে কোনো কথা আছে নাকি? বল, তোরাই বল-না? বল সত্য কি না?
সত্যিই তো। কোনো ভুল নেই, সন্দেহ নেই কারও। তবু বারে বারে জিজ্ঞাসা করে নীলকণ্ঠ, ঘুরে ঘুরে ওই একটা কথাকেই যাচাই করতে চায়, প্রমাণ করতে চায়। শুধু বাইরের পৃথিবী নয়, যেন নিজের মনের কাছেও সে আশ্বাস খোঁজে। ধর্মের কল বই কী। কত প্রজাকেই যে বিমলা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছন্ন করেছেন! নীলকণ্ঠ কে? শুধু নিমিত্ত মাত্র।
বেলা দুপুর গড়িয়ে গেলে সে ফিরে বাড়ির দিকে রওনা হয়। খর-রৌদ্রে ঘোড়াটা ভালো করে চলতে পারে না, চষা জমির শুকনো মাটির ডেলাগুলোতে বারে বারে হোঁচট খায়। রোদের তাতে চাঁদি গরম হয়ে ওঠে, বুকের ভেতরটা জ্বালা করে। সত্যিই তো, এ বিমলার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। সবাই একথা মেনে নিয়েছে, তবু নিজেকে কেন মানাতে পারে না নীলকণ্ঠ? যেন চারদিকের আগুনঝরা ধু-ধু প্রান্তরের মতো তারও মনের ভেতরে কী পুড়ে যায়। কোথায় যেন সুর মিলছে না, কোথায় যেন বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। রাত্রে ঘুমুতে পারে না, দূরে কে চিৎকার করে, মুখের ওপরে কে গরম নিশ্বাস ফেলে, গভীর অন্ধকারে সন্দেহজনক পা ফেলে হাঁটে সিতিকণ্ঠ, নিভাননীর টাকার খাঁই আর মেটে না।
কেমন সন্দেহ হয়। ব্ৰজেন ডাক্তার মদের সঙ্গে তাকেও কিছু খাইয়ে দেয়নি তো? বিশ্বাস নেই, কিছুই বিশ্বাস নেই। জ্বলন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হয় নীলকণ্ঠের। চিৎকার করে বলতে চায়, না না, দোষ নেই, কারও দোষ নেই। আমি কিছু করিনি, আমাকে নিষ্কৃতি দাও।
হঠাৎ ঘোড়ার পিঠে একটা হিংস্র চাবুক পড়ে। বনবাদার ভেঙে পাগলের মতো ছুটতে শুরু করে ঘোড়াটা, যেন একমাত্র সে-ই নীলকণ্ঠকে বুঝতে পেরেছে।
সন্ধ্যায় সামনে এসে দাঁড়াল নিভাননী।
শুনছ? এ মাসে আরও কিছু টাকা চাই যে। নীলকণ্ঠ চমকে উঠল। থাবা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে নিলে সিন্দুকের চাবিটা।
কী বিরক্ত করতে এলে কাজের সময়?
বাপু, যাচ্ছি আমি এক্ষুনি। ভয় নেই, তোমার সিন্দুকের চাবি আমি কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলব না। আরও ক-টা টাকা দিতে হবে আমাকে।
কেন? সন্দিগ্ধ কুটিল দৃষ্টিতে তাকাল নীলকণ্ঠ।
যা দিয়েছ ওতে সংসারের খরচ চলবে না।
চলবে না? হঠাৎ নীলকণ্ঠ যেন ফেটে পড়ল, কেন, মতবলটা কী? যা পার এই বেলা গুছিয়ে নিচ্ছ বুঝি? তারপর সময় পেলেই মায়ে-ব্যাটায় মিলে আমার গলায় ছুরি চালাবে?
উপসংহারে কদর্য খানিকটা গালাগালি। ডাক-চিৎকার ছেড়ে কেঁদে উঠল নিভাননী, ছুটে এল সিতিকণ্ঠ।
বাবা, কী হচ্ছে?
চোপ রও শুয়ার-কা বাচ্চা! জমিদার হবে, জমিদারের মা হবে! খুন করেঙ্গা। দোনোকে জান লে লেঙ্গা!
কী করছ বাবা? তোমার কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
কী, কী বললি? মুহূর্তে নীলকণ্ঠ নীল হয়ে গেল। এই ভয়ানক অনিবার্য কথাটার জন্যেই সে আশঙ্কা করছিল এতদিন—প্রতীক্ষা করছিল। একদিন নীলকন্ঠের সুযোগ এসেছিল, আজ সিতিকণ্ঠের। পৃথিবীতে একা ব্ৰজেন ডাক্তার নেই, অনেকে আছে—অনেক আছে সেই পাগলাগারদের দুঃস্বপ্ন। যেমন করে বিমলার চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল, মুখের দু পাশ দিয়ে থুতু গড়িয়ে পড়ছিল, কুকুরের মতো শব্দ করে তিনি নীলকণ্ঠকে কামড়ে দিতে এসেছিলেন, তেমনি করে নীলকণ্ঠও কি…
একটা নিমেষে একটা খন্ডপ্রলয় ঘটে গেল।
দেওয়ালে-ঝোলানো পাঁঠাবলির রামদাখানা সিতিকণ্ঠের কান ঘেঁষে যেন হাওয়ায় উড়ে গেল, ঝনাৎ করে বারান্দা থেকে একটা সিমেন্ট উঠিয়ে নিয়ে আছড়ে পড়ল উঠোনে। একটুর জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল মৃত্যু।
থরথর করে কাঁপতে লাগল সিতিকণ্ঠ। নিভাননী অচেতনের মতো বসে পড়ল মেঝের ওপর।
পাগল! একেবারে পাগল! বেঁধে ফেলা দরকার।
এবারে নীলকণ্ঠ আর নড়তে পারল না। সমস্ত শক্তি যেন ওই রামদাখানা ছুড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। আর উপায় নেই, আর রক্ষা নেই। এবারে সিতিকষ্ঠের দিন এসেছে। এখন অমনি করেই তার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসবে, তারও মুখ দিয়ে থুতু গড়িয়ে পড়বে, একটা কুকুরের মতো সেও…
হাত দুটো সিতিকণ্ঠের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নীলকণ্ঠ হঠাৎ হো-হো করে হাসতে শুরু করে
দিলে। দমকে দমকে হাসির ধাক্কায় গাল বেয়ে ফেনা গড়াতে লাগল।
বাঁধো, বাঁধো আমাকে। আমি সত্যিই পাগল, একেবারে উন্মাদ পাগল।