পাইন আর দেওদারের ছায়াকুঞ্জের নীচে পাহাড়িদের গ্রাম।
নগাধিরাজের কোলে কোলে বিচ্ছিন্ন উপত্যকা। চারিদিকের দুর্গমতার মাঝখানে যেন প্রকৃতির সযত্নলালিত এক-একটি আশ্রয়। পাথরের সিঁড়ি কেটে যে-মানুষগুলো ওঠা-নামা করে, ঝোরা থেকে কলসি ভরে আনে, তাদের মুখ থেকে শুরু করে শরীরের সমস্ত পেশিগুলো পর্যন্ত যেন পাথরে তৈরি। পাহাড় ধসে, শাল-পাইন-দেওদারের বনকে উত্তাল উতরোল করে দিয়ে ঝড় আসে, বুনো জানোয়ার ঘুরে বেড়ায়, বেতবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ঝিমন্ত পাহাড়ি অজগর, তার মধ্যেই ওদের দিন কাটে। সুখে-দুঃখে, প্রেমে-বিরহে এবং সংঘাতে—জান্তব জীবন।
কিন্তু এমন যে মানুষগুলো, আজ তারাও ঘরের মধ্যে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে।
ডান দিকে উঁচু পাহাড়, তার মাথা হালকা তুষারে ধূসর। বাঁ-পাশে পাহাড়ের গা প্রায় খাড়াই হয়ে হাজার দেড় হাজার ফুট নীচে নেমে গেছে। সেখানে একটা রাক্ষুসে মাথার উচ্ছঙ্খল কোঁকড়ানো চুলের মতো কালো জঙ্গল—তরাইয়ের অরণ্যসীমা। আজ সেই তুষারধবল পাহাড়ের চুড়োর উপর একটা ঝাপসা কুয়াশা এসে জমেছে, সেটা যেন হারিয়ে গেছে দৃষ্টির আড়ালে। নীচে তরাইয়ের জঙ্গল দেখা যাচ্ছে না। খাড়াই পাহাড়ের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় খানিকটা সাদা ধোঁয়া যেন ঘূর্ণির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। থমথমে আকাশ, এক-একটা দমকা বাতাসে বৃষ্টির রেণু। আজ তুষার পড়বে। দুর্যোগের সম্ভাবনা যেন চারদিকে ঘনিয়ে রয়েছে।
নিতান্ত দায়ে না পড়লে এমন দিনে পাহাড়িরাও বাইরে বেরুতে চায় না। ঘরের ভেতরে বড়ো বড়ো শাল গাছের গুড়ি বা কুঁদো জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে আছে তারা। এবার অসময়ে বড়ো বেশি শীত পড়েছে, ধেনো মদ আর বিড়ির সঙ্গে সেই আলোচনাই চলছিল।
এমন সময় বাইরে শব্দ উঠল— ডুগ ডুগ ডুগ…
চঞ্চল হয়ে পাহাড়িরা কান পাতল। একি সত্যিই! কিন্তু না, ভুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। শীত-বাপে আচ্ছন্ন ভারী বাতাসের নীচে অবরুদ্ধ গলার আর্তনাদের মতো বাজতে লাগল ডুগ ডুগ ডুগ…
পাহাড়িদের মুখের রেখাগুলো বদলে গেল মুহূর্তে। ভয় আর সংশয় ফুটে উঠল স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ হয়ে। গুম্ফালামা। এদেশের দুর্বোধ্য রহস্য এবং দুর্বোধ্য ভয়। সে মানুষ কিংবা অপদেবতা অথবা আর কিছু, এ সম্বন্ধেই যথেষ্ট সন্দেহ তথা সংশয় আছে। তার আবির্ভাবের মধ্যে যেন অশরীরী কিছু-একটা প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে—কোনো দুর্যোগ, কোনো দুর্বিপাক।
ডুগ ডুগ ডুগ…
অনিবার্য আহ্বান। একে একে কুটিরের বাইরে সার দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। সামনে দাঁড়িয়ে গুম্ফালামা। নানা রঙের উলের টুকরো সেলাই-করা ছিন্নবিচ্ছিন্ন জরাজীর্ণ আলখাল্লা। দুই কানে দুটো প্রকান্ড রুপোর মাকড়ি-কুন্ডল। ঝুলে-পড়া মুখের চামড়া। শীতে, বৃষ্টিতে আর বয়সে ট্যান-করা সেই বেগুনি চামড়ায় অসংখ্য কিলবিলে রেখা। এক হাতে ডুগডুগি, তাতে তিন-চারটে নানা রঙের লাল-সবুজ-হলদে রঙের কাপড়ের টুকরো ঝুলছে। আর এক হাতে নরকরোটির ভিক্ষাপাত্র।
ঝাপসা ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে অমানুষিক মানুষ। পাথরের মতো ভাবের চিহ্নমাত্রহীন প্রকান্ড মুখে দুটো চোখ আগুনের টুকরোর মতো জ্বলছে, সে-চোখের দিকে তাকাবার মতো ধৃষ্টতা বা দুঃসাহস নেই কারও। নরকঙ্কালের ভিক্ষাপাত্র বাড়িয়ে দিয়ে সে মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রকান্ড কুকুর। ঝাঁকড়া লোমওয়ালা পাহাড়ি কুকুর নয়, নীচের থেকে সংগ্রহ করে আনা বাংলা কুকুর। সাদায়-লালে-মেশানো বাঘের মতো রং, বাঘের মতো তেজি আর ভয়ানক। শীতে তার গায়ের লোমগুলো সব কাঁটার মতো খাড়া হয়ে আছে, পিঠের ওপরে গোল-হয়ে-আসা লেজটা নড়ছে টুক টুক করে।
কোনোখানে কারও মুখে একটি কথা নেই। শুধু আস্তে আস্তে গুম্ফালামার করোটিপাত্র পূর্ণ হয়ে উঠল। তারপরে আবার ডুগ ডুগ ডুগ। ঘন-হয়ে-আসা কুয়াশায় শুধু দেখা গেল গুম্ফালামা আর তার কুকুরের প্রেতচ্ছায়াটা একটা উতরাইয়ের মাথায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
পাহাড়িরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
এই সময়ে গুম্ফালামা!
আর একজন ভয়ার্তমুখে বললে, নিশ্চয় ভয়ানক কিছু-একটা ঘটবে।
আচ্ছা, লোকটা সত্যি সত্যিই মানুষ তো?
সেকথায় কেউ জবাব দিলে না। জবাব কেউ জানত না।
কিন্তু ওরা যে যাই বলুক, গুম্ফালামা সত্যি সত্যিই মানুষ। তবে কতদিনের যে মানুষ সেকথা গুম্ফালামার নিজেরও স্মৃতি থেকে বোধ হয় মিলিয়ে গিয়েছে। ভাবলেশহীন মুখ, ভাবলেশবর্জিত মন। অতীতটা পাঁচ হাজার ফুট গভীর একটা খাদের মতো অন্ধকার, ভবিষ্যৎটা পাহাড়ের বুকে ঘনিয়ে-আসা সাদা কুয়াশার মতো অস্পষ্ট।
পাহাড় বেয়ে বেয়ে অনেকখানি উতরাইয়ের পথ উঠে একখানা প্রকান্ড গ্র্যানাইটের চাঙাড়ের ওপরে দাঁড়াল গুম্ফালামা। বহুদূরে আর বহু নীচে বোধ হয় বাতাসিয়া লুপ ঘুরে ঘুরে চলেছে দার্জিলিঙের রেলগাড়ি। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গুম গুম করে তার শব্দ উঠছে। বার কয়েক তীক্ষ্ণ বাঁশির সুর কানে ভেসে এল। অকারণে একটা তীক্ষ্ণ হিংসায় গুম্ফালামার মুখের মধ্যে দাঁতগুলো কড়াক্কড় করে বেজে উঠল।
কী ইচ্ছে করে? ইচ্ছে করে পাহাড়ি ঝরনার আঘাতে যেখানে প্রকান্ড প্রকান্ড পাথরের চাঙড় রেললাইনের মাথার ওপরে নিরবলম্বভাবে ঝুলে রয়েছে, ওরই একটাকে এক ধাক্কায় নামিয়ে নীচে আছড়ে ফেলে দিতে। আর পরক্ষণেই একটা ভয়ংকর শব্দ। ছোটো রেলগাড়িটা গুঁড়ো হয়ে গিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে হাজার হাজার ফুট গভীরতার মধ্যে গড়িয়ে পড়বে। শুধু মুহূর্তের জন্য শোনা যাবে মানুষের প্রবল আর্তনাদ, আর তারপরেই একেবারে সব ফাঁকা?
কিন্তু কেন?
গুম্ফালামা নিজেই জানে না। শুধু এইটুকুই জানে কাউকে তার প্রয়োজন নেই, তাকে দিয়েও কারও কোনো দরকার নেই। কতকাল ধরে সে একা, আশ্চর্যভাবে নিঃসঙ্গ। মানুষ তাকে দেখে ভয় পায়, তাকে দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠে। মাঝে মাঝে নিশীথ রাত্রে যখন পাহাড়িদের পাড়া থেকে ঝমর ঝর করে ঝাঁকড়ির শব্দ কানে আসে, ভূত আর অপদেবতা তাড়াবার জন্যে উদ্দাম চিৎকার করে ওরা, তখন গুম্ফালামার মনে হয় যেন ওই ঝাঁকড়ির শব্দ অশরীরী কাউকে তাড়া করে আসছে না—ছুটে আসছে তারই পেছনে পেছনে। মানুষ তার শত্রু।
গুম গুম শব্দ করে রেলগাড়ি চলেছে, ঘুরে ঘুরে চলেছে পাহাড়ের কোলে। কোথায় যায় রেলগাড়ি? সে কেমন দেশ? গুম্ফালামা মনে মনে ছবি দেখে বাঁধানো পথ, বড়ো বড়ো বাড়ি, বিজলির রোশনাই, মোটরের ভেঁপু। কোনোদিন কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের পথ বেয়েই সে ওখানে গিয়ে পৌঁছেছিল?
ঘর-র-র ঘেউ-উ-উ…
গুম্ফালামার পেছনে কুকুরটা হঠাৎ গজরে উঠল, চমক ভেঙে গেল মুহূর্তে। পাহাড় বেয়ে বিদ্যুৎগতিতে অজগর নেমে যাচ্ছে। বিরাট শরীর বয়ে চলেছে ঝড়ের মতো আলোড়ন জাগিয়ে, পাথরের টুকরো ছিটকে পড়ছে চারদিকে। কুকুরের ডাক সে শুনতে পেল কি না কে জানে, কিন্তু চক্ষের পলক পড়তে-না-পড়তেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
যেন গুম্ফালামারও মনের ভেতর দিয়ে অমনি করে সাপ নেমে গেল একটা। আকাশে মেঘের পরে মেঘ, সাদা কুয়াশা দমকা হাওয়ায় পাক খাচ্ছে, চোখে-মুখে লাগছে শীতের তীব্র চাবুক। লক্ষণ ভালো নয়, দুর্যোগের আসন্ন সম্ভাবনা দিকে দিকে।
পাহাড়ের চূড়া থেকে গুম্ফালামা যেখানে নেমে এল সেখানে সামনেই একটা কালো গর। এই গহ্বরে বা গুম্ফাতে বাস করে বলেই তার এই নামকরণ হয়েছে। বহুকাল আগে কোনো খেয়ালি পাহাড়ি ঝরনা নেমেছিল এই পথ দিয়ে, তারপর বহুকাল আগেই শুকিয়ে গিয়েছে। এই পাথরকাটা গুহাটা তারই গতিধারার চিহ্ন। কিন্তু ঝরনা এদিক দিয়ে আজকাল আর আসে না, শুধু গুম্ফালামার আশ্রয়টাই স্থায়ী হয়ে আছে।
গুহায় ঢুকে গুম্ফালামা প্রথমেই কাঠকুটরো দিয়ে খানিকটা আগুন জ্বালাল। গুহার শ্যাওলা সবুজ অসমতল গা থেকে কনকনে পাথুরে ঠাণ্ডা বেরুচ্ছে, মোটা কম্বলের ছেঁড়া ক্রুপের ভেতর দিয়ে ঠেলে উঠছে শীত। আগুনের আভায় দেখতে দেখতে গুহার সংক্ষিপ্ত পরিসরটা তীব্র রক্তোজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভেতরের ধোঁয়া বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘনীভূত কুয়াশার ন্যূহ ভেদ করতে। গুম্ফালামার রেখায়িত বেগুনি মুখখানায় লাল আলো পড়ে চিনা-ভাস্কর্যে-গড়া ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তির মতো দেখাতে লাগল।
ছেঁড়া কম্বলের ওপর ধ্যানস্থ হয়ে বসল গুম্ফালামা, পায়ের কাছে ঘন হয়ে বসল তার কুকুরটা। মাথার মধ্যে যেন এখনও রেলগাড়ির শব্দটা বেজে উঠছে গুম গুম করে। স্বপ্ন নয়। ওই দার্জিলিং শহর, ওখানকার আলো, ওখানকার পথ, মোটর সবই সে একদিন দেখেছিল বাস্তব চোখেই। তারপর…
তারপর মনটা উড়ে চলে গেল প্রায় ত্রিশ বছর আগেই। বেশ সুখেই ছিল, অনেক কষ্টে বিয়ে করেছিল বরাশ ফুলের মতো সুন্দরী একটা মেয়েকে। কী নাম? কী যেন নাম ছিল তার?
মাইলি।
হ্যাঁ, মাইলিই তো। গুম্ফালামার বুকের ভেতরেও যেন সামনেকার আগুনটার মতো পট পট শব্দে কী পুড়ে যেতে লাগল। সেই মাইলি। পাগলের মতো ভালো বেসেছিল, এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে পারত না তাকে। অথচ মাইলি—তার এত কামনার ধন—শেষপর্যন্ত রাত কাটাতে আরম্ভ করলে কুঁজো কালো একটা বাঙালির সঙ্গে।
তারও পর শানানো কুকরির ঝলক। হিমালয়ের বুকে মেঘভাঙা চাঁদের আলো ঘরে এসে পড়েছে কাচের জানলা দিয়ে। মাথাটা ধড় থেকে ছিটকে মেঝেয় আছড়ে পড়ল আর একটা প্রচন্ড আর্তনাদ করে মাইলি দৌড়ে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।
কতদিন? ত্রিশ বৎসর। কিন্তু এখনও ভয় কাটেনি। পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে রেলগাড়ি চলে, ওই গাড়ির যারা যাত্রী তারা যেন তাকে দেখলেই চিনে ফেলবে, ধরে নিয়ে সোজা লটকিয়ে দেবে ফাঁসিতে। আর মাইলি? মাইলি কী করে এখন? কার কোলে শুয়ে কাচের জানলার ভেতর দিয়ে দেখে সাদা পাহাড়ের চুড়োয় মেঘভাঙা চাঁদের আলো?
হঠাৎ চমকে উঠল গুম্ফালামা। পায়ের ওপরে একটা মাংসের উত্তপ্ত অনুভূতি, যেন সজীব দেহের ক্ষীণ কোমল হৃৎকম্পন। বুকের ভেতরে রক্ত ছলকে উঠল। ত্রিশ বছরের ওপার থেকে তার কোলের ভেতরে কে ফিরে এল? সেই বিশ্বাসঘাতিনী? ফুলের ভেতরে সেই সাপ?
কিন্তু কোথায় মাইলি? পায়ের মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে কুকুরটা ঘুমুচ্ছে। ওর জীবনের একমাত্র সঙ্গী—একমাত্র সহচর। মাইলির চাইতে অনেক বেশি বিশ্বস্ত, অনেক বেশি অন্তরঙ্গ। গুম্ফালামার নিভৃত নিঃসঙ্গতায় পৃথিবীর একমাত্র প্রেম।
ছোটো একটা মেটেপাত্রে সে মাধুকরীর চাল ক-টা চাপিয়ে দিলে। গনগনে আগুনের আঁচে টগবগ করে ফুটে উঠল ভাত। তাদের দুজনের খাদ্য, দুটি প্রাণীর সংসার। পায়ের কাছে ঘুমন্ত ক্ষুধার্ত কুকুরটা নড়েচড়ে মাথা খাড়া করে উঠে বসল।
পরদিন যখন গুম্ফালামা কম্বলের ভেতর থেকে মুখ বার করলে, গুহার মধ্যে তখনও অন্ধকার। কাঠের কুঁদোটা হালকা আগুনের আলোয় তখনও ঝকমক করছে। জমাট বেঁধে আছে ধোঁয়ার রাশি। নিশ্বাস টানতে কষ্ট হয়, ধোঁয়ায় যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে হৃৎপিন্ড।
বাইরে সোঁ সোঁ শব্দ। এদিকের ছেঁড়া কম্বলের পর্দাটা জোর হাওয়ায় দুলছে, আসছে বৃষ্টির ছাট। ঝড় চলছে। বেতবনের মধ্যে প্রচন্ড আলোড়ন, বাতাসে সাঁই সাঁই করে চাবুক পড়ছে একটা অকারণ আর নিষ্ফল আক্রোশে। শাল-পাইন-দেওদারের হাহাকার।
এক বার মুখ বার করেই সে চমকে মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিলে। তীব্র শীতের উত্তাল হাওয়ায় নাক-কান ছিঁড়ে যেন উড়ে যেতে চায়। গুরগুর করে বাজের ডাকের মতো একটা ভয়ংকর শব্দ—সমস্ত গুহাটা কেঁপে উঠল। কোথায় যেন পাথর খসে পড়েছে।
আজ আর বাইরে বেরুনো অসম্ভব।
ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে সে চুপ করে বসে রইল।
কুকুরটা উঠে বসল। ধনুকের মতো পিঠটাকে বাঁকিয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিলে বার কয়েক। ভোঁতা নাকটা দিয়ে তার কম্বল-জড়ানো হাঁটুটা খুঁকে নিলে দু-তিন বার, কুঁই কুঁই করে একটা অব্যক্ত শব্দ করতে লাগল। কালকের খাবার দুজনের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না, তার খিদে পেয়েছে।
খিদের আগুন জ্বলছে গুম্ফালামার পেটের ভেতরেও। কিন্তু উপায় নেই। বাইরে প্রলয় চলেছে—আদিম হিমালয়ের বুকে আদিম হিংস্রতার আক্রোশ। যেন হাজার হাজার পাহাড়ি অজগর একসঙ্গে ফুসে উঠছে, তাদের বিষবাষ্প উড়ে চলেছে ঝড় হয়ে।
সুতরাং বেরুবার উপায় নেই। হয় ঝড়ে উড়িয়ে নেবে, নইলে হয়তো মাথার ওপরে গাছ উপড়ে পড়বে। উঁচু পাহাড়ের তুষারমন্ডিত চুড়োয় যে শুভ্রতার স্তূপ জমে আছে—একটা বিরাট ভাঙনের মধ্যে সেই শিলাপ নেমে এসে দুর্বিপাকও ঘটিয়ে দিতে পারে।
আস্তে আস্তে গুম্ফালামা কুকুরটার মাথায় থাবড়া দিতে লাগল।
চুপ লালু, চুপ। আজ আর কারও উপায় নেই দেখছিস না? তোরও না, আমারও না। মিছিমিছি কেঁদে কী করবি?
কুকুরটা কী বুঝল সেই জানে। কিন্তু আবার পায়ের কাছে চুপ করে শুয়ে পড়ল। এমন বিশ্বস্ত, এত সহজে খুশি হয়ে গেল। অথচ মাইলি খুশি হয়নি কেন? সে তো সব দিয়েছিল, তার যতটুকু সাধ্য সব। কিন্তু মানুষ পোষ মানে না। সাপের মতো তার স্বভাব।
বাইরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গুহার মধ্যে কুদোর আগুনটা নিবে আসছে। শুধু জ্বলজ্বল করছে দু-জোড়া চোখ। মানুষের নয়, জানোয়ারের মতো নীলাভ আর পিঙ্গল।
পেটের মধ্যে অসহ্য ক্ষুধা নিয়ে দুটি প্রাণীর একটা দিন কেটে গেল।
আবার রাত শেষ হল, কিন্তু সূর্য উঠল না। আজ আরও বেশি অন্ধকার, বাইরে আরও বেশি ঝড়ের দাপট। মড়মড় করে গাছ ভাঙার শব্দ আসছে, গুরগুর করে পাথর নামছে ভূমিকম্প জাগিয়ে। গুহার শ্যাওলা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে জল, সে-জল গায়ে লাগলে ঠাণ্ডায় ফোসকা পড়ে যায়।
কুকুর আর মানুষ কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে একসঙ্গে। জন্তু আর জান্তব জীবন! খিদের কষ্ট সয়, কিন্তু অসহ্য শীত যেন হাড়ের পাঁজরাগুলোকে ঝম ঝমর করে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে। সবচাইতে বিপদের কথা এই, সঞ্চিত শুকনো কাঠগুলো সব ফুরিয়ে গেছে, নিভে গেছে কুঁদোর আগুন। গুহার ভেতরে যেন তুষার মেরুর তুহিনতা এসে জমাট বাঁধছে।
দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে বাজছে।
লালু, লালু।
লালু জবাব দিলে, কুঁই কুঁই।
বল তো কী করি?
লালু শীতে যেন আরও ছোটো হয়ে গিয়ে গুম্ফালামার কম্বলের মধ্যে মাথা লুকোবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু না, আর পারা যায় না। খাবার না হোক, কিছু কাঠের জোগাড় করতেই হবে। সমস্ত শরীরের জড়তাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গুম্ফালামা উঠে বসল, হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল গুহার বাইরে।
ওই বেরিয়ে আসা পর্যন্তই। তীক্ষ্ণহাওয়ায় ছুটে এল হাজারে হাজারে উড়ন্ত তরোয়াল, যেন সজোরে গুম্ফালামার মুখের ওপর আঘাত করে গেল। মনে হল নাক-মুখগুলো সব একসঙ্গে ফেটে গিয়ে টপ টপ করে রক্ত পড়তে শুরু করবে।
ভয়াতুর জানোয়ারের মতো ভেতরে পালিয়ে আসতে পথ পেল না গুম্ফালামা। ভেতরের শীতে হাড়-পাঁজরায় ঝাঁকুনি দিচ্ছে, কিন্তু বাইরের শীত মুহূর্তে একেবারে পাথর করে দেবে।
আবার কম্বলের মধ্যে এসে চুপ করে বসে পড়ল গুম্ফালামা। নাক-কান যেন আগুনে পোড়ার মতো জ্বলে যাচ্ছে। কম্বলের ধারালো কর্কশ রোঁয়াগুলো ঘষে ঘষে মুখটাকে গরম করবার চেষ্টা করতে লাগল। এ কী হচ্ছে? বাইরের ঝড় কি আর থামবে না। আজ পঁচিশ বছরের মধ্যে এমন দুর্যোগ আর তার চোখে পড়েনি। মনে হল পৃথিবী আর তাকে বাঁচতে দেবে না, চারদিকের হিমশীতল শিলাস্তূপের মধ্যে সেও জমে পাথর হয়ে যাবে।
লাল্লু আরও ছোটো হয়ে ক্রমে কম্বলের মধ্যে বেশি করে ঢোকবার চেষ্টা করছে। থাবা দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে, তার নখের ধারালো আঁচড় গুম্ফালামার পায়ে এসে লাগল। যেন কম্বলের ভেতর থেকে তাকে আশ্রয়চ্যুত করে নিজেই সেখানে অধিকারবিস্তার করতে চায়। হঠাৎ গুম্ফালামার মনে হল পৃথিবীসুদ্ধ সবাই লোভী, সবাই স্বার্থপর। আজ দার্জিলিং শহরে যারা দামি দামি পোশাকে আর লেপ-কম্বলের মধ্যে সর্বাঙ্গ ঢেকে ভালো ঘরের মধ্যে আরামে বসে আছে, যাদের চুলোয় গনগন করছে কাঠকয়লার চমৎকার আগুন, চা আর কফির চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে যাদের শিরায় শিরায় জীবনবিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, সেই মানুষেরা, সেই মাইলি, কিংবা পাহাড়িদের পাড়ায় ঘরের ভেতর শালের কুঁদো জ্বেলে পচাইয়ের জ্বলন্ত নেশায় শরীরকে যারা গরম রাখছে, তারা সবাই একদলের, তারা সকলে সমানভাবে তার সঙ্গে শত্রুতা করছে। এমনকী কুকুরটাও।
লালু একটা অব্যক্ত শব্দ করে কম্বলের মধ্যে ঢোকবার চেষ্টা করছে। ছেঁড়া কম্বল একজনের পক্ষেই যথেষ্ট নয়। অত বড়ো একটা কুকুরকে তার ভেতরে আশ্রয় দিলে নিজেরই আত্মরক্ষার উপায় থাকবে না। জীবনে মাইলি যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, আজ কুকুরটাও কি তাই করতে চায়?
অসহ্য ক্রোধে পা তুলে গুম্ফালামা একটা লাথি বসিয়ে দিলে কুকুরটার পেটে। ঘ্যাঁক করে কাতর একটা শব্দ। দু-হাত দূরে ছিটকে পড়ল লাল্লু।
আয়, আয় এদিকে। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করতে লাগল গুম্ফালামা, খুন করে দেব একদম।
লালু উঠে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে শোনা যাচ্ছে তার বড়ো নিশ্বাসের শব্দ।
বাইরে ঝড় চলেছে। সামনে হয়তো-বা আরও প্রবল বেগে। এই গুহার বাইরে যে-পৃথিবী ছিল, নিরবচ্ছিন্ন তুষারঝড়ের মধ্যে সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। হাঁটু পর্যন্ত জমে পাথর হয়ে উঠেছে যেন। কম্বলের খসখসে রোঁয়া ঘষে ঘষে গায়ের ছাল উঠে যাচ্ছে, কিন্তু এতটুকু উত্তাপও সঞ্চারিত হচ্ছে না শরীরের মধ্যে। গুহার গা বেয়ে আরও বেশি করে চুইয়ে পড়ছে বরফগলা জল। গুম্ফালামা মরে যাচ্ছে, গুম্ফালামা জমে যাচ্ছে। এতদিন পরে সত্যিই মরে যাচ্ছে গুম্ফালামা—এই ষাট বছর পরে। মরতে দুঃখ ছিল না, কিন্তু এই সময়ে যদি মাইলিকে হাতের কাছে পাওয়া যেত…
যেন ঝিমিয়ে পড়ছিল, যেন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পায়ে তীব্র আঁচড় লাগল, শানিত ধারালো নখের আঁচড়। গুম্ফালামার চমক ভাঙল। লালু ঢোকার চেষ্টা করছে, প্রাণপণে ঢোকবার চেষ্টা করছে। এই কম্বলে দুজনের জায়গা হবে না—হয় জন্তুর অথবা জান্তব মানুষের।
লালু!
প্রচন্ড বেগে ধমক দিলে গুম্ফালামা। কিন্তু চিরকালের আজ্ঞাবহ লাল্লু আজ তার আদেশ শুনল না। যেমন করে হোক সে ঢুকবেই।
আবার একটা প্রচন্ড লাথি, আবার কুকুরটা ছিটকে পড়ল তিন হাত দূরে। কিন্তু এবারে আর কাতর আর্তনাদ নয়। লাল্লু স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার পিঙ্গল চোখ দুটো বাঘের মতো ঝিকিয়ে উঠল নির্মম হিংসায়। যেমন করে পাহাড়ি অজগরকে দেখে সে গজরে উঠেছিল, তেমনিভাবেই তার গলা দিয়ে এবার গর্জন উঠতে লাগল। গরর-র-র
গুম্ফালামা সোজা উঠে বসল এবারে। লাল্লুকে সে বুঝতে পেরেছে। প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ আর নেই, এবারে দুজনে দুজনার প্রতিদ্বন্দ্বী। কুকুরটার মধ্যে জেগে উঠেছে তার আদিম পাশব হিংস্রতা। যেমন করে পাহাড়ি অজগরের ওপর সে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে চায়, ঠিক তেমনি করে যেন তারও ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মারো কিংবা মরো।
অন্ধকারেও গুম্ফালামা যেন দেখতে পেল, কুকুরটার লেজ নড়ছে, কান খাড়া হয়ে উঠেছে; উত্তেজিত নিশ্বাস পড়ছে, চোখ দুটোতে আগুন জ্বলছে। গুম্ফালামার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। বাঘের মতো তেজি কুকুর, ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে তাকে।
গরর-র-র!
আর সময় নেই। বিদ্যুদবেগে গুম্ফালামা হাতের কাছ থেকে ভারী একটা পাথর তুলে নিলে, প্রাণপণ বলে ছুড়ে মারল কুকুরের মাথায়। একটা কাতর আর্তনাদ করে কুকুরটা পড়ে গেল মাটিতে। গুম্ফালামার শীতার্ত শরীরে যেন আগুন বয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তে উঠে পড়ল সে, লাথির পর লাথি মেরে গুহার বাইরে ঠেলে দিলে কুকুরটাকে। বাইরে ঝড়ের তরোয়াল তেমনি উড়ে চলেছে, কিন্তু এবারে আর সে মুখের ওপর তার তীক্ষ্ণ স্পর্শ অনুভব করতে পারল না। দু-হাতে মাথার ওপর কুকুরটাকে তুলে ধরে সে ছুড়ে গড়িয়ে দিলে ঢালু পাহাড়ের গায়ে, যেখানে হাজার দেড় হাজার ফুট নীচে তরাইয়ের ঘন অরণ্য আবর্তিত বৃষ্টির কুয়াশায় দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে গিয়েছে।
তারপরে এক ঘণ্টা সময়ও কাটল না। খেয়ালি পাহাড়ি ঝড় আপন খেয়ালেই থেমে গেল আকস্মিকভাবে। পাহাড়ের মাথা থেকে মেঘের জাল সরিয়ে দিয়ে হেসে উঠল দ্বিপ্রহরের সূর্য। তার উষ্ণ মধুর আলো গুম্ফালামার গুহার মাথায় শান্ত ভালোবাসার মতো ছড়িয়ে পড়ল।
আর সেই সূর্যের দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গুম্ফালামা। কানের কুন্ডলে আর রেখাসংকুল বেগুনি মুখের ওপর আলো ঝিকিয়ে উঠতে লাগল। কী করল, এ সে কী করল?
আজ সে নিঃসঙ্গ। এতদিন পরে বিরাট পৃথিবীতে সে নিঃসঙ্গ।
পাহাড়ের টিলায় উঠে গুম্ফালামা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। দূরে বাতাসিয়া লুপে রেলগাড়ির গর্জন শোনা যাচ্ছে। গুম গুম গুম। সূর্যের আলোয় স্নান করছে পৃথিবী, পাহাড়ের চূড়ায় জ্বলছে যেন সোনার মুকুট।
বুকের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। লালু—লালু! লালু তো মাইলি নয়। তার জীবনের একমাত্র আশ্রয়, একমাত্র সান্ত্বনা। সে এ কী করল?
লাল্লু!
কাতর আহ্বান পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল। কিন্তু লালু এল না, চিরদিনের বিশ্বস্ত কুকুর আজ আর সাড়া দিলে না মনিবের ডাকে। শুধু দূর বস্তিতে পাহাড়িরা শুনতে পেল দিকে দিকে একটা অমানুষিক কণ্ঠস্বর বাজছে–লাল্লু…লাল্প!
অতলস্পর্শ পাহাড়ের খাড়াই, তার নীচে তরাইয়ের কালো বন। সূর্যের আলোয় ভিজে বন জ্বলে উঠছে। গুম্ফালামা স্থির অনিমেষ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। ওখান দিয়েই লাল্লুকে গড়িয়ে দিয়েছে—গড়িয়ে দিয়েছে নীচে। কিন্তু লাল্লু কি সত্যিই মরে গিয়েছে? না না, বিশ্বাস হয় না।
সূর্যের আলোয় পাথর গরম হয়ে উঠছে। খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে গুম্ফালামা অভ্যস্ত পদক্ষেপে নীচে নামতে লাগল—পাথর আঁকড়ে, গাছের শিকড় ধরে। তার মন বলছে লালু মরেনি, ওইখানেই আছে, ওই জঙ্গলেই আছে। শুধু পাহাড় বেয়ে তার কাছে উঠে আসতে পারছে না।
ভৌ উ-উ!
নীচে থেকে কুকুরের ডাক হাওয়ায় ভেসে এল। গুম্ফালামার রক্ত চমকে উছলে উঠল। তরাইয়ের জঙ্গলে কুকুর ডাকছে! নিশ্চয় তারই লালু।
ভৌ-উ-উ!
তরতর করে পাহাড় বেয়ে গুম্ফালামা নীচে নামতে লাগল।
তরাইয়ের বৃষ্টিভেজা বনে তখন সন্ধ্যার গ্লানিমা। গুম্ফালামা শুনতে পেল কুকুর ডাকছে অবিচ্ছিন্ন উৎসাহে। ভৌ-উ-উ। তার লালু, তার লাল্লু কাঁদছে। কাছে আসতে চায়, আশ্রয় নিতে চায়। এবার আর লালুকে আঘাত করবে না সে, লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দেবে না। কম্বলের উত্তাপে তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে রেখে দেবে। লালু মাইলি নয়। তার শেষজীবনের সান্ত্বনা, তার অবলম্বন।
সন্ধান ব্যর্থ হল না। তবে একটা কুকুর নয়—একপাল।
পরদিন বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় একদল পাহাড়ি দেখতে পেল গুম্ফালামার ছেঁড়া পোশাকের টুকরো আর একরাশ রক্তমাথা হাড়। তাকে বনকুকুরেরা খেয়ে ফেলছে।