লোহার ফটকের ওপারে দুটো করালদর্শন কুকুর। যে-দৃষ্টিতে তারা আমার দিকে তাকাচ্ছিল সেটা বন্ধুত্ববাচক নয়। এক-পা এগিয়ে আবার তিন-পা পেছিয়ে গেলাম।
ফটকের বাইরে অনিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। ফিরে যাব? শ্যামবাজার থেকে এতদূর পয়সা খরচ করে এসে দুটো কুকুরের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে যাব?
রায়বাহাদুর এইচ এল চ্যাটার্জি-ইনি-ই তো বটে। কিন্তু ডাকি কাকে? দরোয়ানের ঘরটা বন্ধ। ওদিকে বাগানের একপাশে যেখানে চমৎকার গ্র্যাণ্ডিফ্লোরা ফুটেছে, একটা মালী ঝাঁঝরি হাতে সেখানে কী-যেন কাজ করছিল। আমাকে এক বারও তার চোখে পড়েছিল কি না জানি না। না-পড়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু কী করি, চাকরির উমেদার। বহু কষ্টে পরিচয়পত্র মিলেছে একখানা, পিতৃবন্ধু বলে একটা কথাও শুনেছিলাম। রায়বাহাদুর একটা কলমের খোঁচা দিয়ে দিলেই হয়ে যেতে পারে চাকরিটা। কাজেই একসময়ে আমাকে দেখে হয়তো কারও কৌতূহল উদ্ৰিক্ত হয়ে উঠবে আপাতত সেই শুভ মুহূর্তেরই প্রতীক্ষা করা যাক। গেটের সামনে পায়চারি শুরু করে দিলাম।
প্রসারিত রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। মোটর-ট্রাম-মানুষের অবিচ্ছিন্ন স্রোতোধারা। মাথার ওপর এরোপ্লেনের পাখার শব্দ—জাপানি দস্যুর আক্রমণ আশঙ্কায় পাহারা দিচ্ছে। দি লায়ন হ্যাজ উইংস!
গর-র-র
পেছনে ক্রুদ্ধ গর্জন। চমকে তাকিয়ে দেখি একটা মহাকায় কুকুর চলে এসেছে একেবারে গেট পর্যন্ত। আর লোহার রেলিঙের ভেতর দিয়ে বাইরে বের করে দিচ্ছে ভোঁতা সিক্ত নাকটা। চোখ দুটোতে সোনালি আগুন জ্বলজ্বল করছে, ঝলসে উঠছে দুটো গিনির মতো। কয়েকটা হিংস্র দন্ত বিকাশ করে আবার বললে, গর-র-র–
লক্ষণ সুবিধের নয়। শকটং পঞ্চহস্তেন-শাস্ত্রকারেরা বোধ হয় কুকুরের মহিমা টের পাননি তখনও। গেটের সামনে থেকে আরও দু-পা দূরে এলাম। আশা ছাড়তে পারছি না। উমেদারের আশা অনন্ত।
একটু দূরে মনোহরপুকুর পার্ক। আপাতত মনোহর নয়, বুভুক্ষুর কলোনি বসেছে সেখানে। নগরীর নির্মল স্ফটিক জলে জোয়ারের টানে ভেসে আসা একরাশ দুর্গন্ধ আবর্জনা। চিৎকার করছে, কলহ করছে, পরস্পরের মাথা থেকে উকুন বাছছে, জানোয়ারের মতো ঝুঁকে পড়ে কালো জিভ দিয়ে খাচ্ছে হাইড্রেনের ময়লা জল। সহানুভূতি আসে না, বেদনা আসে না, শুধু একটা অহেতুক আশঙ্কায় মনটা শিউরে উঠে শিরশির করে। দেশজোড়া ক্ষুধা যেন মা কালীর মতো রসনা মেলে দিয়েছে, এ ক্ষুধার আগুন কবে নিভবে কে জানে। একমুঠো ভাত আর এক খাবলা বাজরাই কি যথেষ্ট এর পক্ষে? আরও বেশি, আরও বেশি, এমনকী রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই ছবির মতো বাড়িগুলো পর্যন্ত?
বাতাসে একটা গন্ধের তরঙ্গ এল। না, বুভুক্ষুদের নোংরা গন্ধ নয়, গ্র্যাণ্ডিফ্লোরার উগ্রমধুর এক ঝলক সুরভি। অ্যাসফল্টের চওড়া রাস্তা, কালো মার্বেল-বাঁধানো সিঁড়ি, রঙিন কাচ দেওয়া জানালায় সিল্কের পর্দা, চীনামাটির টবে কম্পমান অর্কিড।
কাকে চাই আপনার?
মিষ্টি মধুর কণ্ঠ, ম্যাগনোলিয়ার গন্ধের সঙ্গে যেন তার মিল আছে। তাকিয়ে দেখি গেটের ওপারে কোথা থেকে একটি ষোড়শী এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসমুজ্জ্বল দীর্ঘকায়া একটি গৌরাঙ্গী মেয়ে। ট্রাউজারপরা, সঙ্গে ছোটো একটি সাইকেল। আবার প্রশ্ন হল, কী দরকার? —এই চুপ।
গর্জন বন্ধ করে শান্ত হয়ে দাঁড়াল কুকুরটা। মেয়েটির মুখের দিকে মুখ তুলে প্রসাদাকাক্ষীর মতো লুব্ধভাবে লেজ নাড়তে লাগল।
ভীত শুকনো গলায় বললুম, রায়বাহাদুর আছেন?
বাবা? হ্যাঁ আছেন বই কী।
একটু দেখা করা সম্ভব হবে?
আসুন।
লোহার ফটক খুলে গেল। অ্যাসফল্টের রাস্তায় এবার বিস্তৃত আমন্ত্রণ। উজ্জ্বল মসৃণ পথ —আমার তালি-দেওয়া জুতোটার চাইতে অনেক পরিষ্কার।
সবুজ পর্দা সরিয়ে ভেতরের কার্পেটে পা দিলাম। নীলরঙের একটু স্নিগ্ধ আলোয় ঘরটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সেটির ওপর পা তুলে আধশোয়া অবস্থায় এক ভদ্রলোক কী পড়ছিলেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই উঠে বসলেন।
নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পালা শেষ হল। ভদ্রলোক বললেন, বসুন। কী দরকার?
স্পন্দিত বুকে পরিচয়পত্রখানা বাড়িয়ে দিয়ে আসন নিলাম।
রায়বাহাদুর খামখানা খুলে মনোনিবেশ করলেন চিঠিতে, আর আমি মাঝে মাঝে ভীরু দৃষ্টিতে তাঁকে লক্ষ করতে লাগলাম। ভারী গোল একখানা মুখ, টকটকে ফর্সা ত্বকের ভেতর দিয়ে যেন রক্তকণিকা বাইরে ফুটে বেরিয়ে পড়ছে। ব্লাড প্রেশার কথাটার ডাক্তারি সংজ্ঞা জানি না, কিন্তু কথাটার বাংলা অর্থ যদি রক্তাধিক্য হয় তা হলে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ব্লাড প্রেশারে ভুগছেন।
নিঃশব্দ কয়েকটি মুহূর্ত। কোথায় একটি ঘড়ি টিক টিক করছে। হাওয়ায় উড়ছে রায়বাহাদুরের কিমানোর হাতাটা। বাঁ-হাতের অনামিকায় অমন জ্বলজ্বল করছে কী ওটা? হিরাই নিশ্চয়।
চিঠি পড়া শেষ করে রায়বাহাদুর আমার মুখের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি শান্ত আর উদার। অবচেতন মন থেকে কেমন একটা আশ্বাস যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, হয়তো হয়েও যেতে পারে চাকরিটা।
প্রমথর ছেলে তুমি? আরে তাহলে তো তুমি আমার নিজের লোক। তোমার বাবা আর আমি—ফরিদপুরে ঈশান ইশকুলে একসঙ্গেই পড়েছিলাম। প্রমথ, ওঃ! হি ওয়াজ এ নাইস বয়!
আমি বিনয়ে মাথা নত করে রইলাম।
তোমার বাবা যখন রেজিগনেশন দেয়, সে-খবর আমি পেয়েছিলাম। ছোটোবেলা থেকেই ও খুব স্পিরিটেড, অন্যায় কখনো সইতে পারত না। নইলে এত সহজে অমন চাকরি ছেড়ে দিলে! অ্যান একসেপশনাল বয় হি ওয়াজ।
নিরুত্তর হয়ে থাকা ছাড়া আর কী করা যায়। পিতৃ-প্রশংসায় বিনীত হয়ে থাকাই উচিত ভক্ত সন্তানের।
তারপর? চাকরি পাচ্ছ না যুদ্ধের বাজারে? এমএ পাস করে কেরানিগিরির উমেদারি করছ? বি এ ম্যান ইয়াং ফ্রেণ্ড, বেরিয়ে পড়ো অ্যাডভেঞ্চারে। চাকরি নাও অ্যাক্টিভ সার্ভিসে, ভিড়ে পড়ো নেভিতে।
বললাম, নানারকম অসুবিধে আছে, অনেককে দেখাশোনা করতে হয়। তা ছাড়া একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে…
অনিশ্চিত! তীক্ষ্ণহয়ে উঠল রায়বাহাদুরের দৃষ্টি। জীবনটাই তো অনিশ্চিত হে ছোকরা। আমিও একদিন নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম অনিশ্চিয়তার মধ্যে। সিঙ্গাপুরে কাটিয়েছি দশ বৎসর, ভেসে গেছি হাওয়াই, ম্যানিলা, তাহিতি, ফিলিপাইন, মিকাদোর দেশে জাপানে। পৃথিবীটাকে চোখ মেলে না দেখলে বাঁচবার অর্থ নেই কোনো।
তা বটে। আমি ক্লিষ্টভাবে হাসলাম। রায়বাহাদুরের কথাগুলো ভালো, অত্যন্ত মূল্যবান। অ্যাডভেঞ্চার নেই বলেই তো বাঙালির সমস্ত প্রতিভা ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু ভালো কথা জানলেই কি ভালো হওয়া যায়? যুদ্ধকে ভয় করি আমি, সাইরেনের শব্দে আমার বুকের ভেতরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। ইউ-বোট বিঘ্নিত ফেনিল সমুদ্রে নিরুদ্দেশযাত্রা আমাকে কবিকল্পনায় উদবুদ্ধ করে তোলে না। তা ছাড়া পৈত্রিক অর্থে প্রশান্ত মহাসাগরের স্বপ্নরাজ্যে ভেসে-বেড়ানো, আর বোমারু ইগলের মৃত্যুচঞ্চর তলায় দূরবিনের শানিত চোখ মেলে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট নিয়ে প্রতীক্ষা করা—আমার সন্দেহ হয় এ দুটোর মধ্যে অনেকখানি অসংগত ব্যবধান আছে।
পাইপে আগুন ধরিয়ে রায়বাহাদুর বললেন, কত জায়গাতে ঘুরেছি আমি। হাওয়াইয়ের সেই হুলহুলা ড্যান্স, স্টিভেনশন ব্যালেন্টাইনের প্রবালদ্বীপের দেশ, ফিলিপাইনের জাদুবিদ্যা। বিচিত্র সব কালেকশন আমার, দেখবে?
কালেকশন দেখবার মতো মনের অবস্থা নয়। পঁচিশ টাকার প্রাইভেট টিউশন আছে একটা, এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে সেই উদ্দেশ্যে। কিন্তু পিতৃবন্ধু রায়বাহাদুরকে চটানো চলে না, তাঁর কলমের একটা আঁচড়েই হয়ে যেতে পারে চাকরিটা।
উঠে জোরালো একটা ইলেকট্রিকের আলো জ্বালনের রায়বাহাদুর। তারপর ঘরের এক কোণের একটা লোহার আলমারি খুললেন তিনি। তাঁর ড্রয়ার থেকে বেরিয়ে এল কালো ভেলভেটের একটা বাক্স, সেটা এনে রাখলেন আমার সামনে। ঢাকনাটা খুলে বললেন, দেখছ?
দেখলাম, কিন্তু এ কী কালেকশন। কতগুলো ছোটো-বড়ো হাড়ের টুকরো। প্রত্যেকটার সঙ্গে একখানি করে নম্বরের ছোটো লেবেল ঝুলছে। আশ্বর্য হয়ে বললাম, হাড় নাকি এগুলো?
হ্যাঁ, হাড় বই কী। আমার মুখোমুখি হয়ে বসলেন রায়বাহাদুর, কিন্তু সাধারণ হাড় নয়। এদের প্রত্যেকের বিস্তৃত পরিচয় আছে, অমানুষিক সব গুণ আছে। সমস্ত প্যাসিফিক ঘুরে
আমি এদের সংগ্রহ করেছি। কিন্তু ওয়ান মিনিট প্লিজ, সুষি মাদার?
সুষি ঘরে ঢুকল। সেই মেয়েটি।
ডাকছ বাপি?
আমাদের চা?
বলছি এখুনি। নাচের ভঙ্গিতে সমস্ত তনু দেহটিতে একটা দোলা দিয়ে সুষি বেরিয়ে গেল।
রায়বাহাদুর আবার আমার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন। তারপর দামি দুর্লভ একখন্ড হিরার মতো পরম যত্নে এক টুকরো হাড় তুলে আনলেন বাক্স থেকে।
বলতে পার, কীসের হাড় এটা? নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছুর। ভয়ে ভয়ে বললাম, গরিলা?
ননসেন্স! রায়বাহাদুর প্রচন্ড একটা ধমক লাগালেন আমাকে, প্রশান্ত মহাসাগরে গরিলা থাকে শুনেছ কখনো? এটা রোডেশিয়ানের স্বজাতীয় কোনো আদিমানবের চোয়ালের হাড়।
রোডেশিয়ান?
হ্যাঁ, রোডেশিয়ান। রায়বাহাদুর স্পষ্ট অপ্রসন্ন হয়ে উঠলেন। রোডেশিয়ানের নাম জান? অর্ধেক, অর্ধেক গরিলা, মাত্র কয়েকশো বছর আগেও পৃথিবীতে অস্তিত্ব ছিল তাদের।
বোকার মতো বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি বই কী। অবচেতন মনের কাছে সুরটা যেন বাজল মোসাহেবির মতো। কিন্তু উমেদারি করতে হলে মোসাহেবি তো অপরিহার্য।
এটা সেই রোডেশিয়ান ক্লাসের কোনো জীবের হাড়, মানুষেরও বলতে পারো। কোথায় পেয়েছি জান? মিণ্ডানাও দ্বীপে কাটাবাটু বলে জায়গা আছে একটা। তারই কাছাকাছি একটা গাঁয়ের সর্দারের কাছ থেকে এই হাড় কিনেছিলাম। কত দাম দিয়ে কিনেছিলাম বলতে পারবে?
ধমক খাওয়ার ভয়ে স্পষ্ট উত্তর দিতে সাহস হল না। বললাম, অনেক দাম হবে নিশ্চয়।
নিশ্চয়। পাঁচ হাজার টাকা।
পাঁচ হাজার টাকা! রায়বাহাদুরের হাতের তেলোয় ওই বস্তুটির দিকে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। ইঞ্চি তিনেক লম্বা, চ্যাপটা আকৃতির ছুরির ফলার মতো দেখতে। বিবর্ণ হয়ে যাওয়ায় হরিদ্রাভ রং ধরেছে—রায়বাহাদুরের বিকটকায় কুকুরগুলোর নোংরা দাঁতের মতো।
খুব বেশি মনে হচ্ছে? মোটেই নয়। এর ইতিহাস শুনলে তুমি…
দূর থেকে একটা তীব্র কোলাহলে বাকি কথাগুলো উড়ে গেল মুহূর্তে। বাইরের পথে ট্রামের শব্দ, ঘরের ঘড়িটার টিক টিক করে ছন্দবদ্ধ সুরঝংকার, সব কিছুকে ছাড়িয়ে সেই কোলাহল কানে এসে আঘাত করে। কিন্তু কলরবটা অপরিচিত নয়, কোনো অজ্ঞাত কারণে ক্ষুধার্ত জনতার সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে।
রায়বাহাদুরের মুখ অপ্রসন্ন হয়ে উঠল, পার্কের ওই ডেসটিচ্যুটগুলোর জ্বালায় রাতে আর ঘুমানো যায় না। বোধ হয় খাবারদাবার কিছু মিলেছে তাই এই চিৎকার। খেতে না পেলে চিৎকার করবে, খেতে পেলেও তাই।
সবুজ পর্দা সরিয়ে একটা ট্রে নিয়ে বেয়ারা ঘরে ঢুকল। চা, খাবার। পিতৃদেবের বন্ধুত্বটা রায়বাহাদুর সত্যি সত্যিই মনে করে রেখেছেন দেখা যাচ্ছে। এ যাত্রা বোধ হয় হয়েই যাবে চাকরিটা।
রায়বাহাদুর বললেন, নাও।
বিনা বাক্যব্যয়ে একটা প্লেট কাছে কেটে নিলাম। খিদেও পেয়েছে বিলক্ষণ। বেলা এগারোটায় মেস থেকে খেয়ে বেরিয়েছি, বেলা সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে এখন। এর মধ্যে এক কাপ চা খাইনি, একটা সিগারেট পর্যন্ত নয়।
দূরে আবার সেই বুভুক্ষুদের চিৎকার—ডাস্টবিন উলটে ফেলে দিয়ে যেমন করে সচিৎকারে ঝগড়া করে কুকুরের দল। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি ওরা গোগ্রাসে গিলছে, খিচুড়ির ড্যালা গলায় আটকে চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে, অথচ আরও পাওয়ার জন্যে অবরুদ্ধ সুরে আর্তনাদ করছে। আর আমরা এখানে চা খাচ্ছি কত মার্জিত, কত সংযত আর ভদ্রভাবে। মুখটা সিকি ইঞ্চি ফাঁক করে দাঁতের কোণে কেক কাটছি। উদ্দেশ্যটা যেন খাওয়া নয়, ঘাসের শিষ চিবানোর মতো দাঁতের একটুখানি বিলাসিতা মাত্র। চায়ের কাপে এমনভাবে চুমুক দিচ্ছি যে, এতটুকু শব্দ হচ্ছে না—ঠোঁটের আগায় আলগাভাবে চুম্বনের মতো একটু ছোঁয়াচ লাগছে। গপ গপ করে গেলা, হুসহাস করে শব্দ করা জীবনের সমস্ত এস্থেটিক আনন্দ তাতে বিস্বাদ হয়ে যায়। খাওয়াটা যেমন স্কুল, তেমনি গ্রাম্য হয়ে ওঠে।
মুখ থেকে চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রায়বাহাদুর বললেন, হ্যাঁ, কী বলছিলাম? এই হাড়খানা। বড়ো বিচিত্রভাবে সংগ্রহ করেছিলাম এটাকে। ওখানকার সর্দার এখানাকে পরত মুকুটে। কারণ যার মাথায় এই হাড় থাকবে সে হবে যুদ্ধে অজেয়, শত্রুর হাজার অস্ত্রাঘাতও তার কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না। ওদের কোনো এক জাদুকর পুরোহিত একে মন্ত্রসিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। অনেক কষ্টে আমি এটাকে জোগাড় করি—কিউরিয়োর অপূর্ব নমুনা হিসেবে। ওয়েল ইয়ং ম্যান, জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস কর তুমি?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে ঘরের মধ্যে। মনোহরপুকুর পার্ক থেকে অবিচ্ছিন্ন চিৎকার। জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করি বই কী। শস্যশ্যামল লক্ষীর ভান্ডার বাংলা! হরিবর্মদেব, শশাঙ্ক, নরেন্দ্রের তলোয়ার-ঝলসিত বাংলা। কার মন্ত্রবলে সেই বাংলা থেকে উঠে এল এই প্রেতের দল? মাঠভরা ফসল কার মন্ত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে মিলিয়ে গেল? একটি কণাও পড়ে রইল না কোনোখানে। জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস না করে উপায় কী?
বললাম, হ্যাঁ, ইয়ে—কতরকম ব্যাপারই তো আছে, বিজ্ঞান দিয়ে তার…
দেয়ার ইউ আর… দু-নম্বরের হাড়খানা হাতে তুলে রায়বাহাদুর বললেন, আমিও সেই কথাই বলছি। স্টিভেনশনের সেইসব গল্পগুলো পড়নি? দেখতে দেখতে একটা সাধারণ মানুষ সাড়ে তিনশো হাত লম্বা হয়ে ওঠে, বড়ো বড়ো পা ফেলে পার হয়ে যায় সমুদ্র, আর জলের তলায় নিমজ্জিত সব নাবিকদের কঙ্কালগুলো সেই অতিকায় পায়ের চাপে গুড়িয়ে যায় মড়মড় করে। তাহিতির আকাশে ঝড়ের কালো মেঘ রক্তের মতো রাঙা হয়ে ওঠে, খ্যাপা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের হলকা বয়ে যায়, আকাশ থেকে যে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে, তা জল নয়, টকটকে তাজা রক্তের ফোঁটা। আর কেমন করে হয় জান? এইরকম, ঠিক এমনি একখানা হাড়ের গুণে।
ভীত শঙ্কিত দৃষ্টিতে আমি সেই হাড়ের দিকে তাকালাম। অন্য সময় হলে এসব কথা গঞ্জিকার মহিমাপ্রসূত মনে হত, কিন্তু সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন এই সমস্ত কাহিনির জন্যেই প্রস্তুত হয়ে আছে। ঘরের মধ্যে জ্বলছে জোরালো বিদ্যুতের আলো। গ্রাণ্ডিফ্লোরা আর রায়বাহাদুরের পাইপ থেকে কড়া তামাকের গন্ধ। হাওয়ায় জানালার নীল পর্দাগুলো প্রশান্ত মহাসাগরের নীল তরঙ্গমালার মতো দোল খাচ্ছে। রায়বাহাদুরকে মনে হল যেন অপরিচিত দেশের সেই অদ্ভুতকর্মা যাদুকর, তাঁর হাতের হাড়ে মুহূর্তে ভেলকি লাগতে পারে।
পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় পুজো করে কুমারী মেয়েকে বলি দেয় ওরা। তারপর তাকে পুড়িয়ে হাড়গুলো যা থাকে তা মাটির তলায় পুঁতে দেয়। সাত বছর পরে মহাসমারোহে সে হাড় তুলে আনা হয়, ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। সে-হাড় যে জলের তলা থেকে তুলে আনতে পারে সে-ই হয় এই জাদুবিদ্যার মালিক। যত প্রেতাত্মা সব তার অনুচর হয় তখন, সে যা খুশি তাই করতে পারে। তাল তাল পাথর তার ক্ষমতায় সোনা হয়ে যায়, তার আদেশে লতাপাতাগুলো অজগর সাপ হয়ে ফণা তুলতে পারে।
আমি বসে রইলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত। রায়বাহাদুরের চোখ দুটো জ্বলছে, হাতের হিরাটা জ্বলছে, জ্বলছে বলি-দেওয়া সেই কুমারী মেয়ের হাড়খানা, নীল পর্দাগুলো জ্বলছে, আগুনের মতো জ্বলছে অতি তীব্র শক্তির বৈদ্যুতিক আলোটা। সমস্ত ঘরটা যেন জ্বলন্ত। আর সেই জ্বলন্ত ঘরের মাঝখানে মিলিয়ে যাচ্ছে ম্যাগনোলিয়ার গন্ধ, পাইপের তামাকের গন্ধ, ভেলভেটের বাক্স থেকে উঠে আসা কী-একটা ঔষধ-গন্ধ। মনে হল যেন আমার সামনে একটা আগুনের কুন্ড জ্বলছে, তার লকলকে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে একতাল কাঁচা মাংস। তামাটে ধোঁয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে দগ্ধ মেদ আর চুলের অত্যুগ্র দুর্গন্ধ, যেন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
চাট্টি ভাত দাও মা, একটুখানি ফেন।
মোহ ভেঙে গেল মুহূর্তে। তাহিতি দ্বীপে মানুষ পুড়ছে না, পুড়ছে কলকাতায়। বুভুক্ষার লেলিহান শিখায়। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে বিরাম নেই ট্রাফিকের। ট্রাম চলছে, মোটর চলছে, চলছে স্বপ্নসম লোকযাত্রা। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে ওই চিৎকার এসে ঘা দিচ্ছে কানে। কী অস্বাভাবিক গলার জোর, কী দানবীয় আর্তনদ! মরবার আগে মানুষের গলার স্বর কি ওইরকম গগনভেদী হয়ে ওঠে!
রায়বাহাদুর আবার কুঞ্চিত করলেন বিরক্তিতে। শব্দটা তাঁরও কানে এসেছে। বড়ো বেশি প্রত্যক্ষ, বড়ো বেশি বাস্তব। মানুষের ক্ষুধাটা বড়ো বেশি নগ্ন। এক মুহূর্ত ভুলে যাওয়ার জো নেই, তলিয়ে যাওয়ার উপায় নেই কোথাও। কোথায় তাহিতি-ম্যানিলাহনোলুলুর জাদুরাজ্য, আর কোথায়…
কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল তাঁর দরজায় দুটো করালদর্শন এবং করালদশন কুকুর। নতুন গিনির মত ঝকঝকে পিঙ্গল চোখ মেলে তারা পাহারা দিচ্ছে, কোনো অনাহূত রবাহুতের সাধ্য নেই তাদের সতর্ক প্রহরী এড়িয়ে এ রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করে। এ জাদুমন্ত্রের দেশ। বাইরের পৃথিবীতে যত ক্ষুধাই উত্তাল হয়ে উঠুক-না কেন, এখানকার ফুলের গন্ধ, রায়বাহাদুরের হাতের জ্বলজ্বলে হিরাখানা অথবা নীল পর্দার গায়ে বিদ্যুতের আলো কোনোখানে তার এতটুকুও বৈলক্ষণ দেখা দেবে না।
এই হাড়গুলো আমার বহু যত্নের কালেকশন। অনেক আছে, প্রত্যেকটারই এইরকম সমস্ত গুণ। প্যাসিফিক ঘুরবার সময় এগুলো সংগ্রহ করাই হবি ছিল আমার। ভাবছি এই নিয়ে বই লিখব একখানা।
কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। কেবলই মনে হচ্ছে একটা অমানুষিক গন্ধ আসছে নাকে, আগুনের গন্ধ, পোড়া মাংসের গন্ধ। পালাতে পারলে যেন বেঁচে যাই। কিন্তু চাকরিটা! রায়বাহাদুরের কলমের এক আঁচড়, মাত্র একটি আঁচড়েই সেটা হয়ে যেতে পারে।
হাড় জোগাড় করেছি, কিন্তু মন্ত্রগুলো পাইনি। সেগুলো অনধিকারীকে শেখায় না ওরা। যদি পাওয়া যেত… রায়বাহাদুর হাসলেন, যদি পাওয়া যেত তাহলে এতদিনে কত কী অঘটন ঘটিয়ে বসতাম কে জানে। হয়তো সমস্ত পৃথিবীর চেহারাই বদলে যেত মন্ত্রবলে। আর এই যে ছোট্ট দাঁতটা দেখছ, এটা…।
অস্থিরাজ্য থেকে যখন মুক্তি পেলাম, রাত তখন ন-টার কাছাকাছি।
উপসংহারে রায়বাহাদুর বললেন, ইয়াং ম্যান, কেন পঞ্চাশ-ষাট টাকার চাকরির জন্য ঘোরাঘুরি করছ? বি কারেজিয়াস। ভাগ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো, নাম লেখাও অ্যাকটিভ সার্ভিসে। সামনে পড়ে রয়েছে সমুদ্র, পড়ে রয়েছে পৃথিবী। কেরানিগিরি করে কী হবে?
ক্লান্ত নিরাশ গলায় বললাম, তা বটে, কিন্তু চাকরিটা পেলে…
ওই চাকরি চাকরি করেই উচ্ছন্নে গেল দেশটা। রায়বাহাদুর উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন, তুমি প্রমথর ছেলে। তোমার বাবা হোয়াট এ প্লেনড্ডি বয় হি ওয়াজ। বাপের নাম রাখতে হবে তোমাকে। একটা নগণ্য কলমপেষার চাকরির মধ্যে নিজের সমস্ত ফিউচারকে নষ্ট করে দিয়ো না। আই উইশ ইউ অল সাকসেস ইন লাইফ। আচ্ছা, গুড নাইট।
নমস্কার
ব্ল্যাক আউটের আলোহীন পথ। উপদেশের বোঝা ঘাড়ে করে ভারী পায়ে চললাম এগিয়ে। টিউশনিতে আজ আর যাওয়া হল না। ছাত্রের বাবা মহাজন লোক, পাইপয়সা বাজে খরচ করেন না। এক দিনের মাইনে কেটে নেওয়া বিচিত্র নয়।
সামনে ডাস্টবিন। পাশের অবগুণ্ঠিত ল্যাম্পপোস্ট থেকে একটা ছোটো আলোকচক্র পড়েছে তার ওপর। তিন-চার জন অমানুষিক মানুষ তার ভেতর হাত ডুবিয়ে খুঁজছে খাদ্য। একটু দূরেই একটা কঙ্কালসার কুকুরের ছায়ামূর্তি, নতুন প্রতিযোগীদের কাছে ভিড়বার ভরসা পাচ্ছে না। কাঠির মতো হাত-পা আর বেলুনের মতো পেটওয়ালা একটা ছোটো ছেলে দু হাতে কী চুষছে প্রাণপণে। হাড়? হ্যাঁ, হাড়ই তো।
আমি থমকে থেমে দাঁড়ালাম। কোথায় একটা সাদৃশ্যবোধ। সেই বলি-দেওয়া কুমারী মেয়ের হাড়খানার মতোই দেখতে। যার গুণে তাহিতির আকাশে রুধিরাক্ত মেঘ ভেসে ওঠে, ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ঝাপটা বয়ে যায়, ঝরঝর করে ঝরে তাজা রক্তের বৃষ্টি। কলকাতার আকাশেও কি মেঘ করেছে! ভালো করে তারাগুলোকে দেখতে পাচ্ছি না। ওই কালো আকাশের রং আগুনের মতো লাল হয়ে উঠবে কবে, এই ল্যাগনোলিয়ার গন্ধজড়িত মিঠে হাওয়ায় ঝোড়ো আগুনের ঝলক লকলক করে বয়ে যাবে কবে?
হাড় ওরা পেয়েছে, কেবল মন্ত্র পাওয়াটাই বাকি।