তৃণ

পর পর তিনখানা নৌকা সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘাটে এসে ভিড়ল। ঘস-স-স। কাদার পাড় ঠেকেছে আর তার সঙ্গে মাথা তুলে বাধা দিয়েছে ডুবে-যাওয়া ঘাসের বন।

ধাওয়াদের ডিঙি। সারাদিন বিলে মাছ ধরে এই সন্ধ্যায় ফিরল ঘরে। নৌকার খোলের ভেতর বন্দি চিতলের লেজের ঝাপট শোনা যাচ্ছে, জলের মধ্যে খলখল করছে বোয়ালের ছানা। জালের গায়ে গায়ে কাঁটাওয়ালা চাঁদা মাছগুলো রুপোর চাকতির মতো আটকে রয়েছে।

কাদার মধ্যে লগি পুঁততে পুঁততে সৈফুদ্দিন বললে, দিনের পর দিন হল কী বিলের! সারাদিন জাল ফেলেও পাঁচ সের মাছ পাওয়া যায় না, এবার যে না খেয়ে মরতে হবে রে।

হাঁটুজলে নেমে জয়নাল ডিঙিটাকে পাড়ে আনবার চেষ্টা করছিল। রুদ্ধশ্বাসে এবং রুদ্ধ আক্রোশে চাপা একটা গর্জন করলে সে। বললে ওই শালা বিনের দল। বারোমাস ভেসাল নামিয়ে চুনোপুঁটিগুলো অবধি সব সাবড়ে নিলে মাছ কি আশমান থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়বে না কি?

খোলের ভেতর হাতড়াতে হাতড়াতে সৈফুদ্দিন বললে, সত্যি। পশ্চিম থেকে এসে এই বিন আর মালারাই আমাদের রুজি মারবার মতলব করছে। ওদের না তাড়ালে আর…

কী করে তাড়াবে? কতগুলো করে টাকা জমা দেয় ওরা, ওরা হালিম শাহুর ধর্মপুকুর যে।

তৃতীয় নৌকার মাঝি বসির ধাওয়া কোনো কথা বললে না। বলবার কিছুই নেই। অভাব অভিযোগ প্রত্যেক দিনের দুঃখ দুর্গতি, এরজন্যে কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই কিছু। টাকায় এক সের চাল, লুঙ্গির দাম পাঁচ টাকা, আট গন্ডা পয়সা দিয়েও এক লাটিম জালের সুতো পাওয়া যায় না। বিলের মাছগুলো দিনের পর দিন ফুরিয়ে আসছে বিস্ময়করভাবে, সেও এই দুর্ভাগ্যেরই অংশমাত্র। আল্লা মালেক ছাড়া এরজন্যে দায়ী নয় কেউ। বিনেরা নয়, মালারা নয়, হাসানপুরের শাহুরাও নয়।

সামনে বিলের কালো জল। আকাশ-ভরা তারায় সে-জল ঝলমল করছে। অন্ধকারে উড়ছে ঘরে-ফেরা গাংশালিক। একটু দূরেই বানের জলে একটা মড়া ঘোড়া ভেসে এসেছে, দুর্গন্ধে বাতাস বিষাক্ত। সেটাকে নিয়ে কুকুরের কোলাহল।

ধাওয়ারা জাতিতে মুসলমান আর পেশায় জেলে। আদি নিবাস ছিল রাজশাহির চলন বিলের ধারে, কিন্তু জমিদার আর মহাজনের অত্যাচারে দিনাজপুর জেলার এই দক্ষিণাঞ্চলে এসে ঘর বেঁধেছে ওরা। মুসলমান সমাজে নাকি জাতিভেদ নেই, কিন্তু ধাওয়ারা প্রায় অস্পৃশ্যদের শামিল। নিষ্ঠাবান মুসলমানেরা ওদের জলপান করতে দ্বিধা বোধ করেন, অন্য সম্পর্ক তো দূরের কথা। মৃত্যুর পরেও সেই জাতিভেদের হাত থেকে নিস্তার নেই, সাধারণ কবরখানায় ওদের প্রবেশ নিষেধ। বিলের ধারে গ্রামের শেষপ্রান্তে ওদের গোরস্থান।

সম্প্রদায়টা যেমন নির্বিরোধ, তেমনি শান্তিপ্রিয়। সমাজ আর দারিদ্র্যের পেষণে প্রতিবাদের ক্ষীণতম ভাষাটুকুও কণ্ঠ থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। হাসানপুরের শাহু জমিদারেরা এই মধ্যবিংশ শতাব্দীতেও অষ্টাদশ শতকীয় ভঙ্গিতে জমিদারি করে চলেছে। ঘরে আগুন-দেওয়া কিংবা জোর করে মেয়ে টেনে নিয়ে যাওয়াটা আজকাল বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু তাই বলে ধরে ধরে বেগার খাটানোটা এখনও আছে অব্যাহতভাবে। যখন-তখন ঝুড়ি ভরে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে মাছ তুলে নিয়ে যাওয়াটা এখন তারা জমিদারির অধিকার বলে মনে করে।

কিছু বলবার জো নেই। জবাব আসে, বাইরে থেকে ব্যাবসা করতে এসে শালারা লাল হয়ে গেলি, দুটো মাছ নজর দিতে গা এমন করকর করে কেন?

লাল। লাল হওয়ার অর্থ যে কী, শাহুরা নিজেরাও যে তা না-জানে এমন নয়। বিন্নার ছাউনি-দেওয়া ঘর, বর্ষার জল আটকায় না। লজ্জা নিবারণের জন্যে দু-টুকরো ফতা জোটে

ঘরের মেয়েদের। মাছের সের এই যুদ্ধের বাজারের কল্যাণে দু-আনা থেকে আট-আনায় উঠেছে বটে, কিন্তু তা-ও বেশিরভাগ চলে যায় দেবতা এবং উপদেবতার উপচারে। ওদের অত্যাচারজর্জর কালো মুখের দিকে তাকিয়ে বরেন্দ্রভূমির মাটি ঘৃণায় আর অপমানে সত্যি লাল হয়ে যায়।

সৈফুদ্দিন তাড়া দিয়ে বললে, বসিরভাই চুপ করে বসে আছ যে! ঘরে যেতে হবে না?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসির উঠে দাঁড়াল। মাছ সেও বেশি পায়নি, বরং সবচাইতে কম পেয়েছে। ছেঁড়া জালটা সারানো যাচ্ছে না ক-দিন থেকেই, অথচ এক লাটিম সুতোর দাম কমসে কম আট গন্ডা পয়সা।

জালের সঙ্গে মাছগুলোকে জড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ল বসির। দু-চারজন খরিদ্দার খালুই নিয়ে বসে আছে বিকেল থেকেই। একটু পরেই আসবে থানার কনস্টেবল-দারোগার জন্যে দৈনন্দিন তোল নিয়ে যাবে। তারপর সকালে বন্দরের বাজার।

বিলের থেকে কয়েক পা উঠে এসেই লালু চৌকিদারের তরমুজের বাগান। অন্ধকারে ফণীমনসার বেড়াগুলো যেন কালো কালো গোখরো সাপের মতো ফণা তুলে রয়েছে। কিন্তু লালু চৌকিদারের বাগানে তরমুজ নেই। শুধু তরমুজ কেন, লালু চৌকিদারও নেই। গত বছর বর্ষার সময় দিগদিগন্ত-ছাওয়া বিলে মাছের সন্ধানে গিয়ে সে আর ফিরে আসেনি। কোথায় কোন অতলে দামঘাসের লতা বন্ধনে জড়িয়ে সে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সে-খবর কারও জানা নেই।

বসিরের মনটা ভারাতুর হয়ে উঠল। বিশ্বাস নেই বিলকে। মেঘ ওঠে না, অথচ খেপা হাওয়ায় বিল নাচতে শুরু করে দেয় আপন খেয়ালে। আধড়োবা শ্যাওড়া গাছের মাথায় আলাদ গোখুর কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে, বিন্নার শিষ দেখে যেখানে আধ হাত জল মনে হয়, সেখানে দশ হাত লগি থই পায় না। ভাসমান পোড়া কাঠের গুঁড়িটা কোন মুহূর্তে যে কুমির হয়ে উঠবে, আগে থেকে কেউ তা অনুমান করতে পারে না। বসিরের অত্যন্ত ভয় হয় মাঝে মাঝে। হয়তো এই বিল একদিন তাকেও…

অন্যমনস্ক চিন্তা চকিত হয়ে উঠল মুহূর্তে। ওরা ধাওয়া পাড়ার মাঝখানে এসে পড়েছে। একটা কেরোসিনের ডিবা হাতে করে রোসেনা সামনে এসে দাঁড়াল। বললে, পাইকার এসেছে।

পাইকার! বসিরের ভারাতুর মনটা বিরক্তিতে বিস্বাদ হয়ে গেল। মাছ কিনবার খরিদ্দার যারা ছিল তারা পছন্দমতো মাছ নিয়ে চলে গেল। নগদ দাম মিলল নামমাত্র। ধাওয়াদের কাছ থেকে নগদ পয়সা দিয়ে মাছ কিনতে গেলে ভদ্রলোকের চলে না। সাত দিন সতেরো বার হাঁটাহাঁটি করলে যে-যা-খুশি তুলে দেবে এই এখানকার রেওয়াজ। প্রতিবাদ নিষ্ফল, সে ঔদ্ধত্য হাসানপুরের শাহুরা ক্ষমা করবে না। বিদেশ থেকে এসে মাছের ব্যাবসা করে যারা লাল হয়ে যাচ্ছে, তাদের কাছে এটুকু উপকারও পাবে না দেশের লোক? বাড়াবাড়ি করে যদি, চালা উপড়ে বিদায় করতে কতক্ষণ?

হালিম শাহুর খাস বরকন্দাজ পিরু মিয়া। বেঁটেখাটো চেহারা। ধমক ছাড়া কথা বলে না। ডেকে আনতে বললে বেঁধে আনাটাই তার রীতি, বিশেষ করে ধাওয়াদের সম্পর্কে। সবচাইতে বড়ো বোয়ালটা জমিদারের নজরানা বলে সে কাঁধে তুলে নিলে।

নিরুপায় নৈরাশ্যে বসিরের বুকের মধ্যে জ্বালা করে উঠল। মাছটার ওপর অনেকখানি আশা ছিল তার—অন্তত দশ আনায় বিক্রি হত বাজারে। এক লাটিম জালের সুতো…

ওটাই নিয়ে যাবে পিরুভাই? ছোটো দেখে একটা…

পিরু থেমে দাঁড়াল। চোখ পাকিয়ে বললে, ছোটো দেখে কেন?

মাছ তো বেশি পড়েনি, তাই…

তাই বলে হুজুরের মান ইজ্জত সব যাবে না কি? শহর থেকে মৌলানাসাহেব এসেছেন তার খবর রাখিস?

কে মৌলানাসাহেব?

পিরু মিয়া বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত করে বললে, কে মৌলানাসাহেব! কোথাকার বেকুব লোক রে তুই? মস্তবড়ো আলেম, তিন-তিন বার হজ করে এসেছেন। কাল সকালে ওয়াজ হবে।

পিরু আর দাঁড়াল না।

চোখ ফেটে কান্না আসতে লাগল। সারাদিন মাথার উপরে ঝাঁঝাঁ করে জ্বলেছে ভাদ্রের রোদ। সেই কোন সকালে এক ছটাক পানতা ভাত আর তিন সের জল খেয়ে বেরিয়েছিল, খিদেয় সমস্ত শরীরটা এলিয়ে পড়তে চাইছে। হাতে-পায়ে কাঁটার আঁচড়গুলো জ্বলছে বিছুটির জ্বালার মতো; যেসব জায়গায় জোঁকে ধরেছিল, সেসব জায়গা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়াচ্ছে এখনও। অথচ সে প্রাণান্তিক পরিশ্রমের এই পারিশ্রমিক। মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দূরে রোহণপুর ইষ্টিশনে চলে যায় কুলি খাটতে, রোজগার যা-ই হোক, তার ওপরে কেউ তোলা বসাতে আসবে না।

একমুখ হাসি নিয়ে সামনে পাইকার দেখা দিলে। একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে লোকটার। হাজার গালিগালাজ করলেও তার সে-হাসির কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় না, ভেতরের কী-একটা অনুপ্রেরণায় সে যেন সবসময়েই চরিতার্থ হয়ে আছে। ধৈর্যের প্রতিমূর্তি পাইকার।

রহমতুল্লা কিংবা করমতুল্লা-জাতীয় কী-একটা নাম তার আছে, কিন্তু পাইকার নামেই তার প্রসিদ্ধি এবং পরিচিতি। ধানের সময় সে দালালি করতে আসে, পাটের মরসুমে তাকে ঘুরতে দেখা যায়, এমনকী সাগর দিঘির মেলায় খোপরাপটি বা গণিকাপল্লির বিলিবন্দোবস্ত করতেও সে হাঁটাহাঁটি করে বেড়ায়। এককথায় তাকে বলা যায় সর্ববিশারদ। কোথায় তার বাড়ি কেউ জানে না। জিজ্ঞাসা করলে অত্যন্ত হাসির সঙ্গে উড়িয়ে দেয় প্রশ্নটা। এদিককার ইতর-ভদ্র সম্প্রদায় তাকে শ্রদ্ধা করে, ভয়ও করে খানিকটা। তার কাছ থেকে শহরের নানারকম সংবাদ মেলে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নূতন পরওয়ানার সন্ধান সে রাখে। যুদ্ধের সব খবর সে মুখে মুখে শুনিয়ে দিতে পারে। আর জানে সিনেমার গান–মেরে ঝুলা ক্যায়সে ঝুলে।

পাইকার বললে, কী বসির ভাই, খবর সব ভালো তো!

দাওয়ার ওপর বসে পড়ে বসির বললে, আল্লা যেমন রেখেছেন।

পাইকার ভ্রুকুটি করে বললে, আল্লা! আল্লা কী করবেন? মানুষের বদমায়েশি সব। চাল ডাল-তেল-নুন-রেজগি আল্লা নিয়ে লুকিয়ে রেখেছেন, তাই না?

ক্লান্ত নির্বোধ দৃষ্টিতে বসির তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পাইকারের কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে না, কিন্তু মনের মধ্যে গিয়ে তলোয়ারের আগার মতো খোঁচা মারে। শিরায় শিরায় মাঝে মাঝে আগুন ধরে যায় যেন। মানুষ! মানুষের চাইতে বড়ো শত্ৰু মানুষের আর কে আছে!

পাইকার বললে, ইবলিশের বাচ্ছা সব। কথা নেই বার্তা নেই অতবড়ো মাছটা তুলে নিয়ে গেল! আর হালিম শাহু হরদম মদে ডুবে থেকে রাতারাতি পির হয়ে উঠেছে আজকে। ওর বাড়িতে বসে মৌলানাসাহেব ওয়াজ করবেন! মরি মরি!

বসির চমকে উঠল।

ওসব কথা বোলো না পাইকার! জমিদারের গাঁয়ে থাকি! যদি শোনে তাহলে…

ওই জন্যেই তো জাহান্নামে গেলে।

বসির চুপ করে রইল। পাইকার সত্যিই তার হিতাকাঙ্ক্ষী। দুঃসময়ে কত যে সাহায্য করে বলবার নয়। এ-গাঁয়ে ও-গাঁয়ে যাওয়ার পথে যখন-তখন তার আতিথ্য নেয়, আর সেইসঙ্গে আনে চাল-ডাল-তেল, প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি। এমনকী রোসেনার জন্যে রঙিন শাড়ি পর্যন্ত। বসিরের ঘরে আসবার পরে রোসেনা যে দু-একখানা শাড়ি পড়েছে সে কেবল পাইকারের অনুগ্রহে। তা ছাড়া ছিন্ন মলিন দু-টুকরা ফতাই তার সম্বল।

কিন্তু ঠিক এই জিনিসটাই বসির যেন কেমন বরদাস্ত করতে পারে না। রোসেনা তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। রূপ এবং যৌবনের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এমন একটি মেয়ে ধাওয়া পাড়ায় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর বসির নিজে কুৎসিত, অত্যন্ত কুৎসিত। বয়স তার যৌবনের সীমা ডিঙিয়ে গেছে অনেক দিন। সর্বাঙ্গে পড়েছে দারিদ্র আর ম্যালেরিয়ার দন্তচিহ্ন। কিন্তু তার সঙ্গে রোসেনার মন মরে যায়নি। চুলের কাঁটার প্রতি লোভ আছে, বন্দরের সরকারি ডাক্তারবাবুর কলেজে-পড়া মেয়ে মাঝে মাঝে যখন গ্রামে বেড়াতে আসে, তখন তার রংবেরঙের শাড়ির দিকে তাকিয়ে লোলুপ হয়ে ওঠে রোসেনার চোখ। তার গা থেকে আসা পাউডারের গন্ধ রোসেনাকে কোন একটা অনাস্বাদিত অপরিচিত জগতের সন্ধান এনে দেয়। ইউনিয়ন বোর্ডের ইদারায় জল আনতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রোসেনা। সারাদিন মাছ ধরে বসির যে এখন ঘরে ফিরবে সেকথা তার মনেও থাকে না।

এসব কথা বসির জানে, ভালো করেই জানে। রোসেনাকে সে খুশি করতে পারেনি। সেইজন্যেই পাইকারের প্রতি একটা তীব্র বিদ্বেষ এবং সন্দেহে মনটা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তার। কেন সে এত অনুগ্রহ করে তাকে, কী এত স্বার্থ তার? বসিরের ভাঙা ঘরে রাত কাটাবার জন্যেই-বা তার এ-জাতীয় আগ্রহ কেন? তা ছাড়া পাইকারের চেহারা দেখতে সত্যিই ভালো, ফর্সা রং, ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি পরে, সিল্কের লুঙ্গি। মিহি আর মিষ্টি গানের গলা, কখনো কখনো একটা বাঁশি বের করে তাতে ফু দেয়। দরজার পাশে ঠুন ঠুন করে ওঠে রোসেনার হাতের কাচের চুড়ি।

কালো মুখখানা আরও কালো করে এক বার জিজ্ঞেস করেছিল রোসেনাকে, যখন-তখন দরজার পাশে অমন করে দাঁড়াস কেন বল দেখি?

রোসেনা জবাব দিয়েছিল, কোথায় যাব শুনি? তোমার সাতমহলা বাড়ির কোন মহলে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকব?

বসির আর কিছু বলতে পারেনি। সাতমহলা বাড়ি—তা বটে। খোঁচা দিতে পারে বই কী রোসেনা। একটা ভাঙা ঘর, এক টুকরো দাওয়া। ছয়টি ঋতু, আলো বাতাস আর বৃষ্টির অধিকার। বর্ষার রাত্রিতে ময়লা চটের বিছানা নিয়ে খুঁজে বেড়াতে হয় কোন দিকটাতে জল পড়ে কম। ঝুলধরা ঘরের চালে কাচপোকা উড়ে বেড়ায় মাকড়সা শিকারের সন্ধানে। এখানে ওখানে ছোটো-বড়ো গর্ত, এক দিক বুজিয়ে দিলে উঁকি মারে আরেক দিক থেকে। সাপ কিংবা ইঁদুরের আস্তানা কে বলবে।

তারপর থেকে সে রোসেনাকে কোনো কথা বলেনি। নিজের দীনতায়—নিজের সর্বাঙ্গীণ দীনতায় বসির নীরব হয়ে গেছে। ঘোমটা টেনে রোসেনা পাইকারের সামনে ভাত বেড়ে দেয়, এগিয়ে দেয় পান। পাইকারের অপাঙ্গ দৃষ্টিতে কিছু-একটা প্রকট হয়ে ওঠে! দাঁতের উপর দাঁত কঠিন হয়ে চেপে বসে বসিরের।

পাইকার বললে, আমার কথা শোনো। লাহিড়িবাবুদের জমিদারিতে চলে যাও। ওখানেও এমনি বিল। বড়ো বিল, কৃষ্ণকালীর বিল। ওই বিন শালারা ওদেশে গিয়ে হানা দেয়নি এখনও। তা ছাড়া বাবুরাও লোক ভালো, কোনোরকম জোরজুলুম…

দীর্ঘ প্রসারিত দৃষ্টিতে বসির তাকিয়ে রইল পাইকারের মুখের দিকে। এমন প্রস্তাব আরও অনেক বার করেছে পাইকার। কিন্তু বিশ্বাস হয় না লোকটাকে। ভুলিয়ে নিয়ে কোন আঘাটায় ভিড়িয়ে দেবে কে জানে। হয়তো নাম লিখিয়ে দেবে পল্টনের দলে। লোকে বলে পাইকারের অসাধ্য কাজ নেই।

ওসব বলে লাভ নেই পাইকার। ভিটে ছেড়ে আমি নড়ব না কোথাও। না খেয়ে মরলেও নয়।

পাইকারের চোখে দেখা দিল নীরব অনুকম্পা, মুখের ওপর ফুটল সূক্ষ একটা হাসির রেখা। বেশ, তাই থাকো। কিন্তু আল্লাকে দোষ দিয়ো না।

পরদিন সকালে পাইকারই বসিরকে টেনে নিয়ে গেল মৌলানাসাহেবের দরবারে। তিন তিন বার হজ করে এসেছেন তিনি, সাতটা জেলা ঘুরেও এত বড়ো আলেম তোক আর পাওয়া যাবে না। হালিম শাহুর বাড়ির সামনেই বসেছে দরবার। কাঠের একখানা ছোটো জলচৌকিতে আসন নিয়েছে মৌলানাসাহেব। টকটকে ফর্সা রং, গোল মুখখানা থেকে রক্ত যেন ফেটে বেরিয়ে পড়ছে। সমবেত জনতার দিকে মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ আর রূঢ় দৃষ্টিক্ষেপণ করে একনিষ্ঠভাবে মালা জপ করে চলেছেন তিনি। তাঁর পাশেই বসেছে হালিম শাহু ধাওয়া পাড়ার অধীশ্বর, এখানকার জমিদার। মৌলানাসাহেবের সহচর্যে নিজেকে যতটা সম্ভব ধর্মপ্রাণ আর সৌম্যদর্শন করবার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু তার আরক্ত চোখ আর জড়ানো কথার ভঙ্গি থেকে অনায়াসে বোঝা যায় যে, এই সাতসকালেই অন্তত একটি বোতল সে পান করে এসেছে।

হালিম শাহুই অভ্যর্থনা জানায় তার স্বভাবসিদ্ধ মধুর ভাষায়।

কী রে ব্যাটা, তুই কী মনে করে?

তীক্ষ্ণআর রুক্ষদৃষ্টি রুক্ষতর করে মৌলানাসাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, কে এ?

ধাওয়া। বসির ধাওয়া। বিলে মাছ ধরে।

ধাওয়া? ঘৃণায় মৌলানাসাহেবের ফর্সা টুকটুকে মুখখানা বেগুনি হয়ে গেল। মোছলমানের ব্যাটা হয়ে জেলের কাজ করিস? মরে যে তুই দোজখে যাবি।

বসির মাথানত করে রইল। লজ্জায় এবং আতঙ্কে মৌলানাসাহেবের কড়া মুখের দিকে সে তাকাতে পারল না। বললে, কী করব জনাব, পেটের দায়ে…

পেটের দায়ে! তাই বলে কাফের হয়ে যাবি? কাচ্ছু ধরিস?

জালে পড়ে মাঝে মাঝে। কিন্তু বেচি না জনাব, বিলিয়ে দিই।

হুঁঃ, বিলিয়ে দিস না আরও কিছু! তোবা তোবা। মুখ দেখলেও গুনাহ হয় তাদের। বাইশ বাজারে নিয়ে গিয়ে তোকে পয়জার মারা উচিত।

বড়ো বোয়ালটার কথা বসিরের মনে এল, কিন্তু বলবার সাহস হল না।

ফিরে এসে সারাদিন চুপ করে বসে রইল বসির। সমাজ তাদের চায় না, ধর্ম তাদের অস্বীকার করে, দুঃখ আর দুর্গতির কালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন প্রত্যেক দিনের জীবন। কোনোখানে কিছুমাত্র মর্যাদা নেই, মূল্য নেই এতটুকুও। কাফেরের কাজ করে, মাছ ধরে বিক্রি করে বাজারে। সেই অপরাধে জমায়েতের নামাজের সময় সকলের পেছনে চোরের মতো গিয়ে দাঁড়ায়, মসজেদে ঢুকতে গেলে ইমামসাহেবের চোখ-মুখ ঘৃণায় কুঞ্চিত আর কুটিল হয়ে ওঠে।

রোসেনা জিজ্ঞাসা করলে, মাছ মারতে যাবে না?

বসির ক্লিষ্টকণ্ঠে বললে, আজ আর বেরোতে পারব না। বড়ো খারাপ লাগছে শরীরটা।

রোসেনা এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু কাল চলবে কী করে?

চলবে না। মাদুরটা এনে পেতে দে তুই, আমি শুয়ে থাকব একটু।

পাইকার নীরবে লক্ষ করতে লাগল সমস্ত ব্যাপারটা। তারপর একসময় অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে কাছে এসে বসল।

সেইজন্যই বলছিলুম, চলে যাও-না এখান থেকে। মোছলমান যেখানে মোছলমানের ওপর এত জুলুম করে, সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে কীসের জন্যে?

বসির তেমনি দীর্ঘায়ত নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

এর চাইতে হিন্দুর গাঁও ভালো। তারা যাই করুক, ধর্মের ওপরে জুলুম করে না। মোছলমানের বাচ্ছা হয়ে এই বেইজ্জত সহ্য করে পড়ে থাকবে তুমি?

মোছলমানের বাচ্ছা! টগবগ করে উঠল রক্ত! চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠল, ধক ধক করে জ্বলে উঠল চোখ। পাইকারের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসির বললে, তাই যাব, আজই চলে যাব।

অত্যন্ত স্নেহভরে পাইকার তার হাত চেপে ধরলে। বললে, না না, অত ব্যস্ত হতে কে বলেছে। ভেবে দ্যাখোনা দু-চার দিন।

কিন্তু দু-চার-দিন ভেবে দেখবার আর দরকার হল না।

সন্ধ্যার দিকে আবির্ভাব ঘটল পিরু মিয়ার। অসুস্থ মলিন রাত্রি দারিদ্র্যজীর্ণ পাড়াটার ওপরে ছায়া বিছিয়েছে। অন্ধকারে এখানে-ওখানে ঝুলছে ছেঁড়া জাল, মাছের আঁশটে গন্ধ। ভিজে কাঠ আর পোড়া পাতার ধোঁয়ায় অন্ধকারটা যেন কঠিন আর শরীরময় হয়ে উঠেছে। ধাওয়া পাড়ায় সন্ধ্যায় হাঁড়ি চড়েছে। হোগলার বেড়ার ফাঁকে দেখা দিচ্ছে রেড়ির তেলের টিমটিমে আলো।

পিরু হাঁক দিলে, বসির আছিস?

বসির উঠে বসল। ভারী আর আড়ষ্ট শরীরের ভেতর স্তিমিত হৃৎপিন্ড দুটো চমকে উঠল তার। বললে, কী মতলবে? তোলা নিতে এসেছ? কিন্তু জাল আজকে ফাঁকা, বলে দিয়ো তোমার শাহুকে।

পিরু মিয়া থমকে দাঁড়াল। যতটা না অপমান বোধ করলে, বিস্ময় বোধ করলে তার চাইতে অনেক বেশি।

খুব যে হাঁকডাক দেখছি। রাতারাতি নবাবি পেলি নাকি! কিন্তু মাছের কথা নয়, জরুরি ব্যাপার আছে।

কী জরুরি ব্যাপার? ভিটেয় লাঙল দিয়ে সরষে বুনবার মতলব আছে? পিরু মিয়া বিস্ফারিত চোখে বললে, দরকার হলে তা তো করতেই হবে। কিন্তু না শুনেই যে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাচ্ছিস, হয়েছে কী তোর? ভয় নেই, খুব সুখবর! হুজুর মেহেরবানি করেছেন তাকে।

আমাকে?

হ্যাঁ তোকেই। গলার স্বর নামিয়ে আনল পিরু মিয়া, তীক্ষ্ণদৃষ্টিটা এক বার চালিয়ে দিলে হোগলার বেড়ার ফাঁকে, রোসেনাকে চকিতের জন্যে চোখে পড়ে কি না। তারপর এক নিশ্বাসে বলে গেল, তোর বিবি তো খুব খুবসুরত। খেতে-পরতে দিতে পারিসনে, ছেড়ে দে ওটাকে। হুজুরের নজর পড়েছে, তিনি বলেছেন…

শা–লা! বসিরের গলা বিদীর্ণ করে বেরিয়ে এল একটা অমানুষিক চিৎকার।

চমকে তিন-পা সরে গেল পিরু মিয়া। এঃ, মেজাজ দ্যাখো-না। ইজ্জতে ঘা লেগেছে নাকি সাহেবের? অমন কত গন্ডা… কানের ওপর দিয়ে সাঁ করে বিদ্যুতের মতো একটা দা বেরিয়ে গেল, একটু হলেই সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেত পিরুর মাথাটাকেও। আতঙ্কে আর্তনাদ করে পিরু মিয়া পাশের বাড়ির দাওয়ায় গিয়ে উঠে দাঁড়াল। মুহূর্তে সমস্ত ধাওয়া পাড়াটা এসে জড়ো হয়ে গেল বসিরের ঘরের সামনে। ভয়ালমূর্তিতে দাঁড়িয়ে গর্জন করছে সে। তার চোখ দুটোর দৃষ্টি উন্মাদের মতে, তার কালো শীর্ণ দেহটা জিঘাংসার প্রতিরূপ যেন। শয়তান, হারামির বাচ্ছা…

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে রাত নেমে এল। প্রগাঢ় শান্তির মধ্যে সমস্ত ধাওয়া পাড়াটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল নিবিড়তম সুপ্তির স্নেহচ্ছায়ায়। সারাদিন পরিশ্রম, বেঁচে থাকার দুঃসাধ্য সাধনা, তার ভেতরে যা-কিছু সান্ত্বনা এইটুকুই। ভোরের রঙে আকাশ ফিকে হয়ে উঠবার আগেই খানিকটা নুন-পানতা গিলে বেরিয়ে পড়তে হবে জীবিকার সন্ধানে।

বিলের দিক থেকে হু-হু করে আসছে রাত্রির বাতাস। সেই বাতাসে ভেসে-আসা মরা ঘোড়াটার গন্ধ। লালু চৌকিদারের তরমুজ খেতে মনসা কাঁটাগুলো খরখর করে শব্দ করছে। বিলের তলায় দামঘাসের স্নেহালিঙ্গন থেকে এই রাতে লালু চৌকিদার মাঝে মাঝে উঠে আসে কি? ঠিক ঘরের পেছনেই কি তার ডাক শোনা যায়–ঘুমের মানুষ, হো ঘুমের মানুষ, জা–গো…

বিলের ওপারে উঠল কৃষ্ণা পঞ্চমীর চাঁদ। কুঞ্চিত কালো জলে কলমির ফুলগুলো হাওয়ায় দুলছে। মাথার ওপরে বুনোহাঁসের পাখা জ্যোৎস্নার রং মেখে ভেসে চলে গেল।

বসির, রোসেনা আর পাইকার এসে দাঁড়াল বিলের ঘাটে। সঙ্গে করে নেওয়ার মতো বিশেষ কিছু নেই। একটা ছিন্ন মলিন বিছানা, একটা বদনা, দুটো কলসি, একটা কড়াই আর এক ছড়া জাল। পাইকারের কথাই সত্যি। সন্ধ্যার ব্যাপারের পরে এ-গ্রামে থাকবার আর অধিকার নেই ওদের। হালিম সাহুর ঊনবিংশ শতকীয় রাজ্যে এ অপরাধ চূড়ান্ত। হয়তো জেল খাটতে হবে, হয়তো সর্বগ্রাসী দাবানলের সহস্র শিখার মাঝখানে শুকনো তৃণখন্ড…

রোসেনা কাঁদছিল। কিন্তু বসির একটা কথাও বললে না, একটি দীর্ঘশ্বাসও নেমে এল না তার। মোছলমানের বাচ্ছা। শিরায় শিরায় হিংস্র রক্ত তখনও ফেনিয়ে উঠছিল। একটুর জন্য ফসকে গেল হাঁসুয়াটা। পিরু মিয়ার মাথাটাকে নামিয়ে দিতে পারলে কিছুমাত্র ক্ষোভ থাকত না আর।

এক বার পিছন ফিরে তাকাল বসির। দুই পুরুষ আগে চলন বিলের পাড় থেকে জমিদারের অত্যাচারে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। আজ আবার তারই পুনরাভিনয় চলছে। সমাজ ওদের আশ্রয় দেয় না, ধর্মের ছত্রছায়া ওদের জন্যে নয়। ঢেউয়ের মুখে মুখে দ্বীপহীন কুলহীন ওরা জীবনের অতল সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়, চারদিক থেকে হিংস্র জন্তুর করাল মুখ জেগে ওঠে ওদের গ্রাস করবার জন্যে। মহামানবের মহাসাগরে ওরা ক্ষণবুদবুদ।

ধাওয়া পাড়া ঘুমিয়ে আছে শান্তিতে। শান্তি নয়, নেশার আচ্ছন্নতা। এ স্বপ্ন কতক্ষণ থাকবে? আজ যে-দুর্ভাগ্যের দন্ড ওদের মাথার ওপরে নেমে এসেছিল, কাল আবার সেটা কাকে অনুগ্রহ করবে কে জানে। হয়তো ঘুমের ঘোরে ওরা স্বপ্ন দেখছে যুদ্ধ গেছে থেমে, খেতে দুলছে সোনার শিষ, মাছের ভারে জাল ছিঁড়ে পড়বার উপক্রম করছে, রোসেনার গায়ে উঠেছে রুপোর গয়না, পরনে রঙিন ডুবেশাড়ি। হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা কই মাছগুলো হয়তো এমনি করেই সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে।

বসির ঠেলে নৌকাটাকে বেশি জলে নামিয়ে নিলে, তারপর কালো জল ঠেলে এগিয়ে চলল ডিঙি। ছল-ছল-ছলাৎ। দাঁড়ের মুখে সাদা সাদা ফেনার ফুল জ্যোৎস্নায় জ্বলে উঠছে। দূরে মিলিয়ে এল হাসানপুরের বন্দর, ধাওয়া পাড়া আর লালু চৌকিদারের কাঁটাওয়ালা ফণীমনসার খেত। এখানে-ওখানে বিনেদের ভেসাল মাথা উঁচু করে রয়েছে, দূর থেকে মনে হয় চাঁদের আলোয় লম্বা লম্বা ঠ্যাং ডুবিয়ে অতিকায় কতগুলো বক দাঁড়িয়ে আছে যেন। এই বিন—এরাই ওদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। বসির নিরুদ্ধ আক্রোশে দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করলে এক বার।

রোসেনা চুপ করে বসে আছে কাপড়ের একটা ছোটো পুঁটলির মতো। সেদিকে এক বার অপাঙ্গে তাকিয়ে নিয়ে পাইকার বললে, মন খুব খারাপ করছে, না বসির ভাই?

মন খারাপ? নাঃ। দাঁড় টানতে টানতে চাপা স্বরে জবাব দিলে বসির, কার জন্যে খারাপ করবে মন, কীসের জন্যে? মাটিতে যাদের শিকড় নেই, হাওয়ায় উড়ে-যাওয়া শিমুল তুলোর মতো যাদের জীবন, কীসের মোহ তাদের? চলন বিল, হাসানপুর, সেখান থেকে লাহিড়িবাবুদের জমিদারি; কিন্তু সেখানেও আসবে দমকা হাওয়া, আবার এমনি করেই…

বিলের এখানে-ওখানে ছোটো-বড়ো চর, কর্দমাক্ত মাটি আর শণের জঙ্গল সেখানে মাথা তুলে রয়েছে। দিনের বেলা ঘুরে বেড়ায় কাদাখোঁচা আর গাংশালিক। সেইসব চরের পাশ দিয়ে ছোটো-বড়ো নালার মতো রন্ধ্রপথে জল বেরিয়ে গেছে। পথ সংক্ষেপ করবার জন্যে লগির খোঁচা দিয়ে বসির নৌকাটাকে তারই একটা নালার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে।

ঘ্যাস করে আটকে গেল ডিঙি। তলায় কী-একটা বাধা দিয়েছে। জ্যোৎস্নায় দেখা গেল একটা মাছ ধরবার খাঁচা, এদেশি ভাষায় ডারকিনা। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শোনা গেল ডারকিনার ভেতরে প্রচন্ড একটা ছপছপ আওয়াজ, নিশ্চয় কোনো বড়ো মাছ আটকে পড়েছে। বিলের বড়ো বড়ো বোয়াল আর কালবোস এসময়ে প্রায়ই ধরা পরে ডারকিনায়। বসির বললে, মস্ত মাছ আছে।

পাইকার জিজ্ঞেস করলে, তুলে নেবে না কি?

এক মুহূর্ত চিন্তা করলে বসির। পরের জিনিস তুলে নেওয়ার অর্থই চুরি করা। কিন্তু কী হবে চুরি করলে? যারা তার মুখের ভাত থেকে ঘরের ইজ্জত পর্যন্ত চুরি করতে চায়, তাদের জন্যে কী অত ভালো-মন্দের বিচার করা? রক্ত আবার গরম হয়ে উঠল।

তুমি নৌকাটা একটু হটিয়ে নাও পাইকার। আমি তুলে আনি মাছটাকে।

পাইকারের চোখ চকচক করে উঠল। অবগুণ্ঠিতা রোসেনা চুপ করে বসে আছে, তার মুখ দেখা যায় না। সুডোল হাতের ওপর কাচের চুড়িগুলোতে জ্যোৎস্না জ্বলছে। পাইকারের চিন্তায় যেন ঝোড়ো হাওয়ার তান্ডব চলছিল।

বসির ঝুপ করে নেমে পড়ল জলে। আর সেই মুহূর্তেই লগির একটা খোঁচ দিয়ে পাইকার নৌকাটাকে নালা ছাড়িয়ে প্রায় বিলের মুখে সরিয়ে নিয়ে এল।

হঠাৎ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল বসির। মাছ নয় পাইকার, মস্তবড় সাপ। আমাকে কামড়ে দিয়েছে। সব জ্বলে গেল পাইকার, নিশ্চয় আলাদ গোখুর।

নিরুত্তরে পাইকার নৌকাটাকে আরও দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

বসির চিৎকার করতে লাগল, পাইকার, শরীর জ্বলে গেল পাইকার, তুলে নাও আমাকে। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না পাইকার।

রোসেনা কেঁদে উঠল, পাইকার, পাইকার।

নৌকাটা তখন বিলের অথই জলের মধ্যে এসে পড়েছে। দামঘাসের আগাগুলো মাথা তুলে আছে, হাওয়ায় দুলছে গোখরো সাপের কিলবিলে একরাশ ছানার মতো। বিলের জল ঝলমল করছে—যেন বাঘের চোখ। পাইকার শান্তস্বরে বললে, কেঁদে আর কী করবে বিবিজান, মানুষ তো আর চিরকাল বাঁচে না।


© 2024 পুরনো বই