গলির মুখ থেকেই হিমাংশু ঘোষালের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়ি থেকে ফেন গালতে গালতে সব কথাই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল গৌরী। ওই একটা গুণ আছে হিমাংশুর, কখনো আস্তে কথা বলতে পারে না। অত্যন্ত খুশি হয়ে যখন সে ঘরোয়া আলাপ শুরু করে, তখন এপাড়ার কোনো নতুন লোক তা শুনলে সন্দেহ করে একটা নরহত্যার জন্যেই বুঝি তৈরি হচ্ছে হিমাংশু।
রান্নাঘর থেকেও গৌরী বুঝতে পারল, গলির মুখে কানা চোখের মতো ঘষা আলোর গ্যাস পোস্টটার নীচে দাঁড়িয়ে পড়েছে হিমাংশু। চিৎকার করে আলাপ করছে কারও সঙ্গে।
আমার টাকা মেরে দেবে? হক্কের পাওনা ঠকিয়ে নেবে আমার? গলায় গামছা দিয়ে সব টাকা আদায় করে ছাড়ব, তবে আমার নাম হিমাংশু ঘোষাল।
গৌরী জাকুটি করল। রান্নাঘরের মেজেয় ছোটো-বড়ো অসংখ্য গর্ত। হাঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়া ফেন জমা হচ্ছে তাদের মধ্যে। এই দিনদুপুরেই প্রায়ান্ধকার ঘরের এখান-ওখান থেকে কয়েকটা আরশোলা উঁকি মারছিল। অর্থহীন বিদ্বেষে একটা খুন্তির ডগায় খানিক গরম ফেন তুলে নিয়ে গৌরী ছিটিয়ে দিলে তাদের দিকে। একটা আরশোলা চিত হয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে, অন্তিম যন্ত্রণায় পা ছুঁড়তে লাগল।
হাজার টাকা মাইনে পান। মোটরে চড়ে ঘুরে বেড়ান! ওঃ, ওরকম বড়ো সায়েব বিস্তর দেখা আছে আমার! আজ বারো বছর লোক চরিয়ে খাচ্ছি এই কলকাতা শহরে, ঘাড়ে ধরে যদি ও-টাকা আদায় করতে না পারি তাহলে…
তাহলে একটা ভয়ংকর কিছু করে ফেলবে হিমাংশু। কিন্তু কী করবে? গৌরী জানে হিমাংশুর দৌড় কতখানি। দাওয়ায় বসে বিড়ি টানতে টানতে গজগজ করবে, গালাগাল করবে, অশ্লীলতম ভাষা ব্যবহার করবে, তারপর একদিন সম্পূর্ণ ভুলে যাবে। ছাতাটা বগলে নিয়ে বেরুবার সময় গৌরীকে আশ্বাস দিয়ে বলবে, আড়াইশো টাকার ফ্ল্যাট, এক মাসের ভাড়া আমার কমিশন। যদি বাগাতে পারি, একটা মাস পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে চলে যাবে–কী বলিস?
স্ত্রীকে তুই বলেই সম্ভাষণ করে হিমাংশু। ওরা দুজন একই গ্রামের। দশ বছরের গৌরীর সঙ্গে সতেরো বছরের হিমাংশুর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আগেকার সম্ভাষণটাই চলছে এই চৌদ্দ বছর ধরে।
ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে রেখে উনুনে কড়াই চাপিয়ে দিলে। হিমাংশুর চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। হয়তো চাপা গলায় আলোচনা করছে, কী প্ল্যানে টাকাটা আদায় করা যায়। কিংবা হয়তো সঙ্গীর সঙ্গে কথা কইতে কইতে এগিয়ে গিয়েছে বড়ো রাস্তার দিকে।
কড়াই থেকে কয়েক বিন্দু গরম তেল হঠাৎ ছিটকে এসে হাতে লাগল। মুখ বিকৃত করে গৌরী নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল এক বার। রান্নার ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে-যাওয়া ইলেকট্রিক বালবটার লালচে ম্লান আলোতেও নিজের বাহুর দিকে তাকিয়ে পোড়ার যন্ত্রণা ভুলে গেল গৌরী, মুগ্ধদৃষ্টি কিছুক্ষণ থমকে রইল সেখানে। নিয়মিত সাবান পড়ে না, তিরতিরে কলের জলে স্নান পর্যন্ত হয় না ভালো করে, তবু পুষ্ট নিটোল হাতখানার দুধ আলতা রঙে এতটুকু মলিনতার ছায়া পড়েনি। একগাছা লাল কাচের চুড়ি আর একটি শাঁখাতেই সেই হাতখানা রাজরানির হাতের মতো দেখাচ্ছে।
শুধু গৌরীর চোখেই যে তা ধরা পড়েছে তা নয়। হিমাংশু নিজেই বলেছে কত বার।
ভাগ্যিস দশ বছর বয়সেই তোকে বিয়ে করে ফেলেছিলুম। নইলে এই রূপ নিয়ে তুই কি ফিরেও তাকাতিস আমার দিকে? কপালে লাথি মেরে দিয়ে কোন জমিদারের ঘরে গিয়ে উঠতিস।
ঠিক কথা। সত্যিই কি দশ বছর বয়েসের গৌরীকে দেখে কেউ ভুলেও ভাবতে পারত যে, এই মেয়ের ভিতরে এত রূপ লুকিয়ে আছে? কেউ কি কল্পনাও করতে পারত লক্ষীছাড়া চেহারার একটা ছোট্ট পাড়াগেঁয়ে মেয়ের ভিতর থেকে একদিন বেরিয়ে আসবে ইন্দ্রাণী? এ যেন রূপকথার গল্পের ব্যাঙের হঠাৎ রাজকন্যা হয়ে যাওয়া। সেই রাজকন্যা, যে হাসলে মানিক ঝরে, কাঁদলে মুক্তো।
তখন গৌরী নিয়মিত বছরে চার মাস ম্যালেরিয়ায় ভুগত। কাঠির মতো হাত-পা, লালচে একরাশ জংলা চুল, মড়ার মাথার মতো মাংসহীন মুখ, কোটরে ডুবে-থাকা দুটো অন্ধকার চোখ, গায়ের ক্যাটকেটে সাদা রং দৃষ্টিকে যেন আঘাত করত। কুশ্রীতাকে সম্পূর্ণ করবার জন্যে গলায় দুলত ঘামের সবুজ কলঙ্ক-মাখানো দুটো আমার মাদুলি।
আর ইশকুল থেকে তাড়া-খাওয়া হিমাংশু তখন বাপের সঙ্গে যজমানির অ্যাপ্রেন্টিস খাটত।
একটু কুঁজো, সারা মুখে বসন্তের দাগ, নাকটা পাখির ঠোঁটের মতো লম্বা। মাথায় বেয়াড়া ধরনের টেড়ি, তারসঙ্গে আরও বিসদৃশ টিকি একটা। এমন বিকট বেসুরো গলায় গান গাইত যে, হরির লুটের কীর্তন থেকে পর্যন্ত তাকে বরবাদ করে দেওয়া হয়েছিল।
এই দুজনের যখন বিয়ে হল, তখন গ্রামের রসিকেরা মন্তব্য করেছিল, একেই বলে রাজযোটক। বাসরঘরে গৌরীর দূর-সম্পর্কের এক বউদি গান গেয়েছিলেন, আহা, কী-বা মানিয়েছে রে, যেন শ্যামের বামে রাইকিশোরী, আহা কী-বা মানিয়েছে রে!
কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই গৌরী একটু একটু করে ফুটে উঠতে লাগল। তখন দু একজনের মনে হল, মেয়েটা একেবারে ধূমাবতী নয়—একটু ছিরিছাঁদও আছে ওর ভিতরে। আর এরমধ্যে একদিন বাপের সঙ্গে ঝগড়া করল হিমাংশু; মাথার টিকিটাকে গোড়া থেকে ক্যাঁচ করে কেটে দিয়ে পৈতৃক উত্তরাধিকারের মূলোচ্ছেদ করল, তারপর স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হল কলকাতায়। দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়ির সমস্ত বিরক্তি আর বিতৃষ্ণার মধ্যেও জোর করে মাত্র আট মাস কাটিয়ে দিলে, তারপর আত্মীয়টির দৃষ্টান্তে ব্যবসায়ে নেমে পড়ল।
ব্যাবসা আর কিছু নয়, বিনা মূলধনে যা করা যায় তাই—দালালি। বাড়ি আর জমির দালালি।
খাটতে হয় বই কী। সকালেই বেরুতে হয় ছাতাটাকে বগলদাবা করে। তারপর মেটেবুরুজ থেকে বরানগর, বালি থেকে ব্যারাকপুর। কোথায় বাড়ি বিক্রি হচ্ছে, কোথায় তিন কাঠা দক্ষিণমুখো জমি সস্তায় পাওয়া যাবে, কোথায় তিনখানা নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে, সব কিছু খবর রাখতে হয় হিমাংশুকে।
বলতে গেলে, কলকাতা আর আশপাশের কুড়ি মাইলের মধ্যে যত জমি আর ঘরবাড়ি আছে, হিমাংশু তার জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া।
কী বললেন স্যার? হাজরা রোডের জমি? ওই যে ব্যারিস্টার ঘোষের লালরঙের বাড়িটার লাগোয়া? নেবেন না স্যার, কখনো নেবেন না। আপনি ভালোমানুষ বলেই বলছি, ও-জমিতে বিস্তর ফ্যাঁকড়া আছে, গাঁটের কড়ি দিয়ে কিনে শেষে বিশ্রী লিটিগেশনে পড়ে যাবেন। কী বললেন? সার্চ করবেন? অনর্থক আবার অ্যাটর্নিকে এককাঁড়ি পয়সা দেবেন তো? আমি বলছি… শুনুন, উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে জেঠামল ভোজমল মাড়োয়ারি…
কিংবা—
জানি, জানি স্যার, ছাতু চক্কোত্তি লেনের নতুন ফ্ল্যাট দুটোর কথা বলছেন তো? ওর আদত মালিক হচ্ছে হরেরাম গায়েন, ক্যানিং-এ মাছের আড়ত আছে। বাড়ির চার্জে আছে ওদের ম্যানেজার কিষ্টপদ সাউ। সে স্যার সাংঘাতিক লোক, একটি রাঘববোয়াল, তাকে বাগানো আপনার কাজ নয়। দেখাই করবে না হয়তো। তবে আমাকে ভার দিন, দেখবেন সব ম্যানেজ করে দেব। একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলব, কিষ্টদা ওবাড়ি আমার চাই-ই; ব্যাস, আর বলতে হবে না। আপনাদের আশীর্বাদে স্যার এই হিমাংশু ঘোষালের…।
সকলের এই আশীর্বাদ কুড়িয়ে বেড়ানো সহজ কাজ নয়। পার্টির বাড়িতে বাড়িতে ঘোরা আছে, অ্যাটর্নি আর উকিলের অফিসে দৌড়োদৌড়ি আছে। যে-পার্টির মন দ্বিধা-সন্দেহে দুলছে, দু-ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে তার মন-ভেজানোর দায়িত্ব আছে। একটা ট্রানজাকশনের সময় দুটো পার্টিকে অ্যাটর্নির অফিসে হাজির করা কিংবা সময়মতো কোর্টে এনে জড়ো করা— এসবও যেন হিমাংশুর পিতৃদায়ের মধ্যে পড়ে। এমনকী ঠিকমতো কোর্ট-ফি কেনা হয়েছে কি না, সেদিকেও তার লক্ষ রাখতে হয়। কাজ তাতেও ফুরোয় না, তারপর সর্বশেষে আছে কমিশনের টাকা আদায় করা।
কেউ কেউ পুরোটা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেয়, কেউ ছ-মাস ঘোরায়, কেউ কেউ একেবারেই ফাঁকি দেবার মতলব করে। তখন রাস্তার দাঁড়িয়ে মাজাভাঙা সাপের মতো ব্যর্থ আক্রোশে গর্জন করে হিমাংশু।
দেখে নেব, দেখে নেব। গলায় পা দিয়ে আমার পাওনা টাকা আদায় করে ছাড়ব, তবে আমার নাম…
পাওনা টাকা অনেকের কাছ থেকেই আদায় হয়নি, কিন্তু সেজন্যে নিজের নাম বদল করতে পারেনি হিমাংশু ঘোষাল। দিন কয়েক গালমন্দ করেছে, নিরুপায় অন্তর্জালায় বিড়ি পুড়িয়েছে একটার পর একটা, ব্যবহার করেছে অশ্লীলতম ভাষা, তারপর নিজেরই বিষযন্ত্রণায় নিতান্ত তুচ্ছ কারণেই গৌরীর গায়ে হাত তুলতে গিয়ে তার আশ্চর্য রূপের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। পরক্ষণেই ছাতাটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। বেলেঘাটায় একটা নতুন পার্টির সন্ধান মিলেছে, নষ্ট করবার মতো সময় তার নেই।
সেই সকাল আটটায় বেরিয়ে কখনো বেলা বারোটা-একটায় এসে একমুঠো খেয়ে যাওয়া। কোনো কোনো দিন তাও নয়, একেবারে সেই রাত সাড়ে এগারোটায় বাড়ি ফেরা। দিনের খাওয়াটা সস্তার হোটেলে কিংবা ডালপুরির দোকানে।
শনি-রবিবার নেই, ছুটিছাটা নেই, পুজো-পার্বণ নেই। এক-আধদিন অসুখবিসুখে না পড়লে বাঁধনিয়মে কোথাও ছেদ পড়ে না। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে কুঁকড়ে কদাকার চেহারা আরও কদাকার হয়েছে হিমাংশুর। নাকটা ঠোঁটের মতো বাঁক নিয়েছে, উঁচু উঁচু দাঁতে পানের ছোপ কালো হয়ে বসেছে, বসন্তচিহ্নিত মুখটার দিকে তাকালে যে-কেউ সন্দেহ করে—এই লোকটা যখন খুশি খুন করতে পারে। নুয়ে-পড়া ঘাড়টাকে এখন নির্ভুল একটা কুঁজের মতো দেখায়।
এত খাটে, তবু সংসার চলে না।
মাঝে মাঝে হিমাংশু সামান্য নেশা করে আসে, কিন্তু তাকে মাতাল বলা যায় না। সেটা বড়ো খরচ নয়। হিমাংশুকে আর একটা রোগে ধরেছে, সেটা রেসের।
মাঠের ভিতরে যায় না, বাইরেই জুয়ো খেলে। তবু সামান্য আয়ের একটা বড়ো অংশ ওইখানেই নিবেদন করে আসে হিমাংশু। যেদিন বেশি হারে সেদিন ওর মুখের গন্ধেই টের পায় গৌরী। আর অনেক রাত পর্যন্ত হিমাংশু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে— কতদিন মামাবাড়ি যাইনি, দাদুকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে।
গৌরী সরে যায় সামনে থেকে। একতলা জীর্ণ বাড়িটার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ছোটো ছাতটায় উঠে আসে। খান তিনেক নীচু ছাতের পরেই সাদা রঙের বড়ো তেতলা বাড়ি একখানা। মল্লিকদের বাড়ি। দোতলার জানলায় আলো জ্বলছে। জানলার সামনে যে দাঁড়িয়ে, তাকে এখান থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তার সোনার চশমা চিকচিক করছে, সিগারেটের আগুনটা দীপিত হয়ে উঠছে থেকে থেকে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিমাংশুর কথা ভাবে গৌরী। দিনের পর দিন আরও স্থূল, আরও কর্কশ হয়ে উঠছে হিমাংশু। মধ্যে মধ্যে যখন সোহাগ করবার চেষ্টা করে, তখন ওর হাতের ছোঁয়ায় শরীর জ্বালা করতে থাকে। হিমাংশুর আঙুলগুলোকে একটা বিরাট মাকড়সার কতগুলো ক্লেদাক্ত পায়ের মতো মনে হয়। অন্ধকারেই নিজের নিটোল শুভ্র হাত দুখানি সে দেখতে পায়, সেই হাত দিয়ে তার নিজের গলাই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। কাঠের রেলিঙে ভর দিয়ে গৌরী দাঁড়িয়ে থাকে, বুকের ভেতর নিজের রক্তের কলধ্বনি শুনতে পায়।
দোতলার জানলায় আগুনের একটা ঝলক ফুটে ওঠে কয়েক মুহূর্তের জন্য। আর একটা সিগারেট ধরিয়েছে লোকটা। হঠাৎ গৌরীর মনে হয়–আলোর বিন্দু-ছড়ানো এই অন্ধকারটা একটা বিরাট জালের মতো তাকে জড়িয়ে ধরছে। অসহ্য গরম লাগতে থাকে, হাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, গৌরীর নিশ্বাস আটকে আসে। চঞ্চল হয়ে ফিরে আসে সিঁড়ির দিকে। নামতে নামতে মনে হয়–শ্যাওলায় শ্যাওলায় সিঁড়িটা ভরে গেছে, যেকোনো সময় পা পিছলে যেতে পারে।
ঘরের মেঝেতে তখন কুন্ডলী-পাকানো একটা কুকুরের মতো পড়ে আছে হিমাংশু। কোটরে-বসা চোখের কোনায় জলের দাগ। যে-দাদুকে সাত বছর বয়েসে শেষ বার দেখেছিল, তারই জন্যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বেশ আছি, গৌরী ভাবে। তক্তপোশের কোনায় বসে কিছুক্ষণ বিস্বাদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হিমাংশুর দিকে। পুরু কালো ঠোঁটের ফাঁকে পানের রংধরা দাঁতগুলো ভ্যাংচানির ভঙ্গিতে বেরিয়ে আছে। বেশ আছি, বার বার কথাটা মাথার ভিতরে ঘুরতে থাকে গৌরীর। নিজের হাতের মুঠো চোখের সামনে মেলে ধরে যেন ভাগ্যরেখাটাকে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। কিন্তু পরক্ষণেই সব গোলমাল হয়ে যায়। নরম গোল হাতখানিকে একটা ফুটন্ত পদ্মের মতো মনে হয়। দু-চোখ ভরে মুগ্ধতা নেমে আসে।
হিমাংশু নাক ডাকতে থাকে। মুখটা আরও খানিক ফাঁক হয়ে গেছে।
গৌরী চমকে উঠল। তরকারিটা প্রায় ধরে আসবার জো হয়েছে। আর দরজার কড়ায় পাগলের মতো ঝাঁকানি দিচ্ছে হিমাংশু। আধমরা আরশোলাটা চিত হয়ে পা নাড়তে নাড়তে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে সামনের দিকে।
উঠে গিয়ে গৌরী দরজা খুলে দিল।
ভিতরে পা দিয়েই খিচিয়ে উঠল হিমাংশু।
ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি এই সন্ধে বেলায়। সেই কখন থেকে কড়া নাড়ছি, শুনতে পাসনি?
ঘুমিয়ে পড়ব কী করে? রাস্তা থেকেই তো চ্যাঁচানি শুনছি।
হাতের ছাতাটা ধপাস করে ছুড়ে দিয়ে হিমাংশু দাওয়ার উপরে বসে পড়ল। বিড়ি ধরাল।
তারপর…
বড়োলোক! ওঃ! অমন বড়োলোক ঢের দেখেছে এই হিমাংশু ঘোষাল। নিজের মুখে বললে, টু পারসেন্ট। এখন কাজ মিটে গেলে বলছে এই একশো টাকা বকশিশ দিচ্ছি, মিষ্টি কিনে খাও। বখশিশ, আমি চাকর না দারোয়ান যে বখশিশ নেব? ওঃ, বড়োলোক!
বিড়িতে একটা হিংস্র টান দিয়ে পর পর কয়েকটা কদর্য কথা আউড়ে গেল হিমাংশু।
রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছিল গৌরী, কী মনে ফিরে এল।
একটা কথা বলব?
স্বগতোক্তিতে ছেদ পড়ায় হিমাংশু বিরক্ত হল। ভুরু কুঁচকে বললে, তোর আবার কী হল?
পরকে তো এত বাড়ি আর জমির ব্যবস্থা করে দিচ্ছ, নিজের জন্যে কিছু করতে পার না?
হিমাংশু হাতের বিড়িটা ছুড়ে দিলে। সেটা চৌবাচ্চার জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল। কর্কশ স্বরে বলল, আরে, চেষ্টা কি আর করছি না? ঝোপ বুঝে একখানা কোপ যখন মারব, তখন বুঝতে পারবি। নিউ আলিপুরে কিংবা পার্ক সার্কাসে…
ছুরির ধারের মতো খানিকটা তীক্ষ্ণ বঙ্কিম হাসি গৌরীর ঠোঁটের ওপর দিয়ে খেলে গেল।
রাজপ্রাসাদের কথা এখন থাক, একটা ভালো বাসার ব্যবস্থাও কি করতে পার না?
কেন, এ বাসাটাই-বা এমন মন্দ কী? তোর বুঝি দোতলার ঘর নইলে ঘুম হচ্ছে না? বাড়িটা একতলা, পুরোনোও বটে, কিন্তু সুবিধেটা দেখছিস না? একেবার সব আলাদা—মায় ছাত পর্যন্ত। কোথাও কোনো ঝক্কিঝামেলা নেই, অন্য ভাড়াটের সঙ্গে জল-চানের ঘর নিয়ে ঝগড়া করতে হয় না। এসব বুঝি তোর পছন্দ নয়? সাময়িকভাবে মনের তিক্ত যন্ত্রণাটাকে ভুলে গিয়ে রসিকতার চেষ্টা করল হিমাংশু, মেয়েমানুষ তো—স্বভাব যাবে কোথায়? ব্যাঙের মতো গলা ফুলিয়ে কারুর সঙ্গে ঝগড়া করতে না পারলে ভাত হজম হবে কেন?
সেজন্যে নয়। গৌরী আস্তে আস্তে বললে, ছাতগুলো সব গায়ে-লাগা, যেকোনো সময় চোর আসতে পারে।
চোর! হিমাংশু আরও সরস হয়ে উঠল, আরে আমার বাসায় একাদশী করতে আসবে এমন বেকুব চোর কলকাতা শহরে নেই। তোর গায়ে তো কয়েক গাছা গালার চুড়ি আছে— বোধ হয় পয়সা চারেক দাম হবে। তবে হ্যাঁ… হিমাংশু হা-হা করে হেসে উঠল। তোকে যদি কেউ চুরি করতে আসে সেটা আলাদা কথা। লাখ টাকাতেও তোর দাম হয় না। দালালির কাজে কলকাতা শহরে কত বড়লোকের বাড়িতেই তো যাই… লুব্ধ চোখ মেলে স্ত্রীকে লেহন করতে লাগল হিমাংশু, সত্যি বলছি, তোর মতো রূপসি বউ কারুর ঘরে দেখিনে।
অকারণে একরাশ রক্ত জমা হল গৌরীর মুখে, খানিকটা তপ্ত বাষ্পের মতো কী যেন কুন্ডলী পাকিয়ে উঠতে লাগল মাথার ভেতরে। নিজের হৃৎপিন্ডে ঝড়ের আওয়াজ শুনতে পেল গৌরী।
মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছিল রান্নাঘরের দিকে, হিমাংশু তাকে ডাকল, শোন!
গৌরী ফিরে দাঁড়াল। বারান্দার মিটমিটে আলোটা নয়, গৌরীর চোখে-মুখে, তার সর্বাঙ্গে আরও কিছু ছড়িয়ে পড়েছে। এই কানাগলির ভেতরেও এক টুকরো আকাশ আছে, চাঁদ উঠেছে সেখানে। তারই জ্যোৎস্নায় গৌরী স্নান করছে। ডুরে শাড়ির আবরণে ঢাকা রুপোর মূর্তির মতো দেখাল গৌরীকে, তার নিখুঁত সুন্দর কপালের উপর যেন মণির মতো কী-একটা জ্বলছে বলে মনে হল। কিছুক্ষণ হিমাংশুর চোখের পলক পড়ল না।
গা-ভরতি গয়না নইলে তোকে মানায় না গৌরী—একেবারে মানায় না! অভিভূত বিহ্বল-গলায় হিমাংশু বললে, গয়না পরবার জন্যেই যেন জন্মেছিলি তুই। সামনের ট্রানজাকশনের টাকাটা যদি পাই, সত্যি বলছি…
জ্যোৎস্নার আলোয় হিমাংশু গৌরীকে এক চোখ দিয়ে দেখছিল, হিমাংশুকে গৌরী দেখছিল আর এক চোখে। পিঠে কুঁজ নিয়ে বসে থাকা হিমাংশুকে অদ্ভুত জান্তব দেখাচ্ছে। এখন। আরও কুৎসিত, আরও কদাকার মনে হচ্ছে।
হিমাংশুর কথার শেষটুকু শোনবার জন্যে গৌরী আর অপেক্ষা করল না। এগিয়ে গেল রান্নাঘরে।
সেদিন অনেক রাত্রে, সারাদিনের অসহ্য ক্লান্তির পরে হিমাংশু মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়লে গৌরী দরজা খুলে ছাদে উঠে এল। তখন চাঁদ আরও আশ্চর্য রূপ নিয়েছে, জ্যোৎস্না আরও উজ্জ্বল হয়ে রেণু রেণু সোনা বৃষ্টি করে চলেছে। গৌরীর শরীরে সেই সোনা ঝরে পড়তে লাগল। গালার চুড়িপরা নিরাভরণ হাত দুটির উপর বার বার গৌরীর চোখ পড়তে লাগল, না দেখেও সে অনুভব করতে লাগল—তার দীর্ঘ শুভ্র গ্রীবাকে এই আলোয় কী করুণ আর নিরাভরণ মনে হচ্ছে!
দোতলা বাড়ির জানলায় আবার সিগারেটের আগুন জ্বলল। জ্যোৎস্নার ভিতরে অস্বাভাবিক লাল দেখাল সেটাকে, আলোর শরীরে দপ দপ করতে লাগল রক্তবিন্দুর মতো।
আর হিমাংশু স্বপ্ন দেখতে লাগল, রেসকোর্সের মাঠে একটা কালো ঘোড়া সকলকে পিছনে ফেলে তিরের মতো ছুটে চলেছে, তার পিঠে জকি হয়ে বসে আছে সেই নতুন পার্টিটা, যে তাকে তিন পার্সেন্ট কমিশন দিতে রাজি হয়েছে।
ইদানীং ফিরতে প্রায়ই বেশি রাত হয়। তার উপরে আজ শনিবার ছিল, বিকেলে রেসের
মাঠে গিয়েছিল হিমাংশু। গোটা চল্লিশেক টাকা ছিল সঙ্গে, তার প্রায় সবটাই গেছে। বিস্বাদ বিরক্ত মনটাকে সামান্য একটু রাঙা করে অল্প অল্প টলতে টলতে হিমাংশু যখন বাড়ি ফিরল, রাত তখন একটার কাছাকাছি।
গৌরী জেগেই ছিল। দরজা খুলে দিলে কড়ায় হাত পড়তেই। হিমাংশু হাতের ছাতাটা উঠোনেই ছুড়ে দিয়ে রকের উপর বসে পড়ল।
দুত্তোর, দিনটাই খারাপ। রাস্তায় বেরিয়ে যে কার মুখ দেখেছিলুম প্রথমে!
গৌরী বললে, ওঠো, হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও।
খেতে ইচ্ছে করছে না, একরাশ তেলেভাজা এখনও যেন আটকে আছে গলায়। হিমাংশু হেঁচকি তুলল একটা, তা ছাড়া সমস্ত মনমেজাজই খিচড়ে রয়েছে। কী যে বাজে টিপস দিলে—টাকাগুলো একেবারে বরবাদ হয়ে গেল। সব জোচ্চোর বুঝলি? সব জোচ্চোর। দুনিয়ায় ভালো লোকের জায়গা নেই!
নেশা-জড়ানো চোখ তুলে সমর্থনের আসায় গৌরীর দিকে তাকাল হিমাংশু, আর দেখতে পেল এতক্ষণ পরে।
শুক্লপক্ষ ঘুরে এসেছে আবার। সেদিনের মতো চাঁদ উঁকি দিয়েছে এই জীর্ণ বিবর্ণ বাড়ির কয়েক ইঞ্চি আকাশে-ত্রয়োদশীর চাঁদ। আর গৌরীর শঙ্খগ্রীবায় কী যেন ঝিকমিক করে জ্বলছে, চাঁদমালার মতো জ্বলছে।
গলায় ওটা কী পরেছিস তুই? হার পেলি কোথায়?
মুহূর্তের জন্যে চুপ করে রইল গৌরী, মুহূর্তের জন্যে তাকে পাথরের একটা মূর্তির মতো দেখাল। তারপর একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে বললে, ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনেছি পাঁচ সিকে দিয়ে!
ওঃ, নকল সোনার গয়না? গিলটির? হিমাংশু উঠে দাঁড়াল, দেখি?
গৌরী স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। হিমাংশুর কদাকার হাতের আঙুলগুলো তার গলা স্পর্শ করল, ভয়ে শিউরে উঠল গৌরী; এক বারের জন্যে মনে হল ওই আঙুলগুলো এখুনি তার গলার নরম মাংসের মধ্যে সাঁড়াশির মতো চেপে বসবে। চোখের পাতাদুটো তার বন্ধ হয়ে এল।
হিমাংশু বললে, বেড়ে মানিয়েছে হারছড়া। দূর থেকে বোঝাই যায় না, তবে হাত দিয়ে দেখলে টের পাওয়া যায় বই কী। খাঁটি সোনা লালচে হয় না, আর একটু সাদাটে হয়।
গৌরী প্রায় নিঃশব্দ গলায় বললে, খাঁটি সোনা বুঝি তুমি হাত দিয়ে দেখলেই টের পাও?
গৌরীর মুখের ওপর একরাশ অল্প গন্ধ ছড়িয়ে হা-হা করে হেসে উঠল হিমাংশু, পাই বই কী। নাহয় তোকে সোনাদানা কিনেই দিতে পারি না, তাই বলে খাঁটি-নকল চিনতে পারব না? আজ বারো বছর ধরে কলকাতা শহর চরিয়ে খাচ্ছি রে, হিমাংশু ঘোষালের অত সহজে ভুল হয় না।
গৌরী বললে, থাক ওসব, খাবে এসো।
গৌরী ঘুমিয়ে পড়লেও আজ রাত্রে হিমাংশুর ঘুম এল না। নেশাটা যতই ফিকে হয়ে আসতে লাগল, ততই তার প্রতিক্রিয়াটা তীব্র তীক্ষ্ণবেদনার মতো তাকে যন্ত্রণা দিতে লাগল। ওই গিলটির নকল হারছড়াই কী আশ্চর্য মানিয়েছে গৌরীর গলায়! বালিশের পাশে একখানা হাত এলিয়ে আছে, একগাছা লাল চুড়িতে কী দীনতা ফুটে উঠেছে তাতে! ভারি অন্যায় হয়ে গেছে হিমাংশু ভাবল। যে-করেই হোক কয়েকখানা গয়না গৌরীকে তার গুড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। সোনা ছাড়া এমন সোনার প্রতিমাকে কি মানায়!
চমৎকার দেখাচ্ছে হারছড়া। তবুও গিলটির হার। দু-দিন পরেই ময়লা হয়ে যাবে, বিবর্ণ পিতলের রং ধরবে। ও শুধু গৌরীর আত্মবঞ্চনাই নয়, ওর মধ্যে কেবল গৌরীর ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষার বেদনাই মিশে নেই, ও হিমাংশুরও চরম লজ্জা, তার অক্ষম পৌরুষের অবমাননা।
হারটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হিমাংশুর রক্তে সাপের জ্বালা ধরল। একে একে মনে পড়তে লাগল কারা তাকে ঠকিয়েছে তার দালালির পাওনায়, কার কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত নিজের পুরো টাকাটা সে আদায় করতে পারেনি। হিংস্রচিত্তে হিমাংশু ভাবতে লাগল। এবার তারও সময় এসেছে। তাকেও বাঁকা রাস্তাই ধরতে হবে। সোজা পথে চলবার চেষ্টা করে সবাই ফাঁকি দিয়েছে, সেও অন্য উপায় দেখবে।
বারো বছর কলকাতা শহরে দালালি করছে হিমাংশু ঘোষাল। কিছুই তার অজানা নয়।
গৌরীর গলার হারছড়া ঝিকমিক করে জ্বলছে, একরাশ আলোর কাঁটা এসে তার চোখকে বিদ্ধ করে লাগল। হিমাংশু উঠে পড়ল, নিবিয়ে দিলে ঘরের আলোটা।
আর একরাশ স্তব্ধ অপরিচ্ছন্ন অন্ধকারে হিমাংশুর উত্তপ্ত উত্তেজিত মস্তিষ্কের মধ্যে কতগুলো সরীসৃপ কিলবিল করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ওই গিলটির হারটা যেন এক মুহূর্তে তার মনের ভেতরে একটা সাপের ঝাঁপির ঢাকনা খুলে দিয়েছে।
কিন্তু সাপের ঝাঁপির ঢাকনা খুললে কী হয়, সবাই ওস্তাদ সাপুড়ে নয়। অন্তত হিমাংশু ঘোষাল তো নয়ই। সাপ খেলাতে গিয়ে প্রথম চোটে তার নিজের হাতেই ছোবল লাগল।
টাকা পেয়েছিল বই কী হিমাংশু—একশো টাকা। কিন্তু একশো টাকাতেই কি আর এক ছড়া হার হয়? আর হলেও সরু সুতোর মতো হারে গৌরীকে কি মানাতে পারে? হাতেও কিছু চাই, অন্তত চারগাছা চুড়ি।
তার উপরে দিনটা শনিবার ছিল। অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে দুর্জয় দুরাশা হিমাংশুকে আকর্ষণ করতে লাগল। জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় যেখানে একশো টাকা কয়েক মিনিটে তিনশো টাকায় পরিণত হয়ে যায়—হিমাংশু সেই ঐন্দ্রজালিক জগতের দিকেই পা বাড়াল।
কিন্তু একশো টাকা তিনশো হল না। বনমানুষের হাড়ের উলটো ভেলকিতে পকেটে সাত আনা পয়সা নিয়ে রাত বারোটায় গলিতে পা দিলে হিমাংশু।
ওরা ওঁত পেতেই ছিল। তিন জন লোক, তাদের দুজন গুণ্ডা গোছের।
বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল হিমাংশুর ওপরে। নিশ্বাস একেবারে আটকে না দিয়ে যতখানি গলা টিপে ধরা যায়, সেই নিপুণ কৌশলে হিমাংশুকে তারা আয়ত্ত করল। তারপর আত্মীয়তার সম্ভাষণ জানিয়ে বললে, ফোর টুয়েন্টির আর জায়গা পাসনি? টাকা বার কর।
চোখের তারা কপালে তুলে হিমাংশু গোঁ-গোঁ করতে লাগল। ওই অবস্থাতেই হিমাংশুর গালে আর একজন প্রচন্ড একটা চড় বসিয়ে দিল।
জাল মালিক সাজিয়ে ভুয়ো ফ্ল্যাটের টাকা আগাম নেবে? আমার টাকাটা হজম করা এত সোজা?
যে গলা টিপে ধরেছিল সে গোটা কয়েক ঝাঁকুনি দিলে হিমাংশুকে–যেমন করে বেড়াল মুখের দুরকে ঝাঁকুনি দেয়। টাকা বের কর বলছি, খুন করে ফেলব নইলে।
তৃতীয় জন ততক্ষণে পকেট হাতড়ে যা-কিছু সব বের করে ফেলেছে। খুচরো পয়সা ক-টা, ময়লা রুমাল, পুরোনো নোটবই আর ক্লিপ-লাগানো পেনসিলটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মাটিতে।
হিমাংশুর কুঁজের ওপর কিল বসিয়ে দিয়ে তিক্ত ক্রোধে সে গর্জন করে উঠল, কিচ্ছু নেই, সব গিলে খেয়েছে!
গলা টিপে বের করব। আর এক বার ঝাঁকুনি পড়ল।
হিমাংশু সমানে গোঁ-গোঁ করতে লাগল।
তার আগেই বেরিয়ে এসেছিল গৌরী। এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে।
গলা থেকে এক টানে হারছড়া খুলে নিয়ে এগিয়ে এল এবারে।
আমার স্বামী কত টাকা ঠকিয়েছেন আপনাদের?
লোক তিনটে চমকে উঠল। ফিরে তাকাল একসঙ্গে। গ্যাসের মরা আলোয় এই মাঝরাতের নির্জন গলিতে এমন আশ্চর্য একটি রূপসি মেয়ের আবির্ভাব স্বপ্নের মতো মনে হল তাদের।
যে গলা চেপে ধরেছিল, তার হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেল। ধুপ করে গলির স্যাঁতসেঁতে কালো মাটির উপরে বসে পড়ল হিমাংশু।
তিন জোড়া চোখ মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল গৌরীর দিকে।
কত টাকা নিয়েছেন উনি?
যে চড় বসিয়েছিল, সে একটা ঢোঁক গিলে বললে, একশো, একশো টাকা।
হারসুদ্ধ হাতখানা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে গৌরী বললে, এটা নিয়ে ওঁকে ছেড়ে দিন। এর দাম একশো টাকার বেশিই হবে।
গৌরীর দিকে চোখ রেখেই হারছড়া নিলে লোকটা। তারপর আচ্ছন্নের মতই তিন জন। নিঃশব্দে গলি পার হয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে চলে গেল। একটা কথাও বলতে পারল না। হয়তো তখনও সমস্ত জিনিসটা ওরা বিশ্বাস করতে পারছিল না। এমন অপূর্ব, এমন অবিশ্বাস্য স্বপ্নের জালটাকে ছিড়তে চাইছিল না কথার আঘাত দিয়ে।
হিমাংশুকে মাটি থেকে টেনে তুলল গৌরী, একরকম ধরেই নিয়ে এল বাড়ির মধ্যে। হিমাংশুর গোঙানি থেমে গেছে তখন, চাপা গলায় কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
হিমাংসুকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে গৌরী তার মাথাটা টেনে নিলে কোলের মধ্যে।
ভয় নেই তোমার, ওরা চলে গেছে।
হিমাংশু অবরুদ্ধ গলায় বললে, আমার জন্যে তো তোর সব গেল গৌরী, গিলটির হারছড়াও গেল। কিন্তু ওরা তো অত কাঁচা নয়, একটু পরেই টের পাবে, তখন তো ফিরে আসবে আবার।
দাঁতে দাঁতে চেপে গৌরী আবার বললে, আসে তো দেখা যাবে। তোমার ভয় নেই, আমি আছি।
হিমাংশু ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। পিঠের কুঁজটা ওঠা-পড়া করতে লাগল ঢেউয়ের মতো।
তুই আমাকে এত ভালোবাসিস গৌরী, আমি তোকে কিছুই দিতে পারলুম না, কিছুই না! গৌরীর দাঁতের চাপ ঠোঁটে এসে পড়ল, রক্ত গড়িয়ে পড়তে চাইল ঠোঁট দিয়ে। হারটা গিলটির নয়, কিন্তু যে-ভালোবাসার ভিতরে নিজেকে অসহায় শিশুর মতো ছেড়ে দিয়ে। হিমাংশু এমন করে কাঁদছে, তার গিলটিকরা নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে গৌরীর চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল।