কলরব করতে করতে একসঙ্গে চারটি মেয়ে ফুটপাথে নামল।
লম্বা বিনুনিটায় ঝাঁকুনি দিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় ইরা বললে, সাধলেই ওঁদের মান বাড়ে। চাই না আমরা প্রেসিডেন্ট। নিজেরাই সব করব আমরা। কবিকে শ্রদ্ধা জানানোই আসল, নৈবেদ্যের ওপর সন্দেশের মতো নাই-বা থাকল সভাপতি।
দলের নেত্রী শকুন্তলা বললে, এই চুপ চুপ–আস্তে। বাড়ি থেকে একটু দূরে সরেই বল কথাগুলো। শুনতে পাবেন যে ভদ্রলোক!
পান না শুনতে। ইরার স্বর আরও তীব্র হয়ে উঠল, নাহয় নামই হয়েছে একটু, কিন্তু লেখেন তো ভারি… আবার দেমাক কত। চেতলায় মিটিং, বেহালায় সভা, হাওড়ায় বক্তৃতা–সারা দেশ যেন ওঁরই আশায় মুখিয়ে বসে আছে!
দ্রুত জুতোর শব্দ তুলে চার জনে হাঁটতে লাগল পথ দিয়ে। চড়া রোদে সারা সকাল এমনিভাবে নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে প্রত্যেকেই যেমন ক্লান্ত, তেমনি বিরক্ত হয়ে উঠেছে। খিদের সঙ্গে ক্ষোভের যে উত্তাপটা এতক্ষণ ধরে সকলের মনে সঞ্চিত হচ্ছিল, ইরার মধ্যে দিয়ে সেটা বিদীর্ণ হয়ে পড়ল।
মাধবী বললে, তা ঠিক, কিন্তু একা এ ভদ্রলোককে দোষ দিয়ে লাভ কী? সবাই তো এক কথা বলছেন। প্রত্যেকেই দারুণ রকমের এনগেজড।
ইরা একটা ঝামটা মারল, এনগেজড না ছাই। এইসব বলেই নিজেদের দর চড়িয়ে রাখেন ওঁরা। লোকে দোরগোড়ায় এসে সাধবে, ওঁরা ওই সব ধুয়ো তুলে বোঝাতে চাইবেন যে, কী বিরাট ওঁদের চাহিদা! উচিত কী জানিস? কোনো সভায় কোনো সাহিত্যিককে না ডাকা। তাহলে নিজেরাই যেচে ছুটে আসতে পথ পাবেন না।
কিন্তু এ তো শুধু অক্ষম ক্রোধে গায়ের জ্বালাই মেটানো। সমস্যার সমাধান যে এতে ঘটবে সেকথা বাকি তিন জন ভালোই জানে—ইরাও যে জানে না এমন নয়। সাত দিন পরে বাইশে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণতিথি। একজন বেশ জাঁদরেল গোছের সভাপতি না থাকলে মুখ থাকবে না কলেজের মেয়েদের কাছে।
এমনিতেই এ নিয়ে তর্ক তুলেছিল অনেকে।
শান্তিনিকেতন থেকে ওঁরা তো বলেছেন যে কবির মৃত্যুদিনটায় এসব অনুষ্ঠান না করাই ভালো। ওটা নিছক পারিবারিক ব্যাপার, কিছু করতে হলে ওঁর আত্মীয় স্বজনদেরই…
বা রে, রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন বুঝি শুধু ওঁরাই? আর একজন কলকন্ঠে প্রতিবাদ করল, তিনি সারা দেশের আপনার জন। তাঁর ওপর ওঁদের যে-অধিকার, সে-অধিকার আমাদেরও।
বেশ, মেনে নিচ্ছি সেকথা। কিন্তু মৃত্যুতিথি হল দুঃখের দিন…
সঙ্গে সঙ্গে অপর পক্ষ থেকে তৈরি জবাব এল। কবির মৃত্যু নেই, তাঁকে নিয়ে কেউ কাঁদতে বসছে না। আসল কথা একটা উপলক্ষ্যকে নিয়ে আমরা তাঁকে স্মরণ করব। সেইটেই লাভ।
কিন্তু তার জন্যে সভা করার কী দরকার? শ্রদ্ধা নিয়ে মনে মনে স্মরণ করলেই তো হয়। কবি নিজেই বলে গেছেন :
যখন রবো না আমি মর্ত্যকায়ায়
তখন স্মরিতে যদি হয় মন,
ডেকো না ডেকো না সভা, এসো এ ছায়ায়–
থামো, থামো। কমন রুমের সমস্ত কলকোলাহল ছাপিয়ে ইরার তীক্ষ্ণ গলা মুখর হয়ে উঠল, শান্তিনিকেতনই ভারি মানছে কিনা সেকথা? আর কবি শালবনে পালাতে চাইলেই-বা আমরা ছাড়ব কেন! তিনি যখন আমাদেরই লোক, তখন আমাদের এটুকু উৎপাতও তাঁকে সইতেই হবে। বাজে কথা বন্ধ করো। চাঁদা দিতে চাও না, সেইটেই খুলে বলো।
কক্ষনো না। এসব বলা তোমার ভারি অন্যায়। এ পক্ষের মেয়েটির মুখ রাঙা হয়ে উঠল।
তারপরে যা শুরু হল, তাকে আর তর্ক বলা যায় না। ঝগড়ার উৎসাহে কোমর বেঁধে একটা টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গেল ইরা। তিরিশটি গলার ঐকতান বাজতে লাগল সপ্তমে। রণে ভঙ্গ দিয়ে দুটি মেয়ে ফোঁস ফোঁস করে কান্না জুড়ল।
ঠিক এই সময় সুপারিন্টেন্টে আরাধনাদি দেখা দিলেন দোরগোড়ায়।
এই মেয়েরা, কী হচ্ছে এসব? স্কুলের ছাত্রীদের মতো চ্যাঁচাচ্ছ সব, ওদিকে অন্য ক্লাস যে ডিসটার্বড় হচ্ছে তা জানো? আর ইরা, ফোর্থ ইয়ারে পড়ছ তুমি, কোন আক্কেলে টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছ শুনি? তোমাদেরও যদি এটুকু ডিসেন্সি না থাকে, ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েরা কী শিখবে তোমাদের কাছ থেকে?
শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল সাময়িকভাবে, ভোটের জোরে জিতেও গেল ইরারা। কিন্তু একটা প্রতিদ্বন্দ্বী দলও তৈরি হয়ে গেল কলেজের ভেতরে। অনুষ্ঠানে কোথাও এতটুকু ফাঁক থাকলে ঠাট্টার কিছু আর বাকি রাখবে না তারা।
আর প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে সকলের আগে দরকার বেশ একটা দামি সভাপতি।
এদিকে আয়োজনটা নেহাত মন্দ হয়নি। প্রথমে বেদমন্ত্র পড়বে থার্ড ইয়ার সংস্কৃত অনার্সের সুনেত্রা গোস্বামী। ভাটপাড়ার মেয়ে, আইএ-তে ফাস্ট হয়েছে সংস্কৃতে। গান গাইবে বেণু বোস আর শিখা চক্রবর্তী। দুজনেই রেডিয়ো আর্টিস্ট। সেতার বাজাবে ইরা সেন; গিটার–মুক্তি বিশ্বাস। নটীর পূজা-র ক্ষমো হে ক্ষমো গানটার সঙ্গে শ্ৰীমতীর নাচ খুব সময়োপযোগী হবে। নাচবে হিমানী গুপ্ত—অল বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন। রবীন্দ্রকাব্যে মৃত্যু কল্পনা বলে প্রবন্ধ পড়বে ফোর্থ ইয়ারের শকুন্তলা নিয়োগী—কলেজ ম্যাগাজিনের এডিটর, চমৎকার বাংলা লেখে। তা ছাড়া প্রিন্সিপালও কিছু বলতে রাজি হয়েছেন। বাংলার অধ্যাপক অসামান্য জনপ্রিয় সি সি বি-ও নিশ্চয়ই খুব ভালো একটা বক্তৃতা দেবেন।
সুতরাং বেশ ভালোই হয়েছে এদিকের ব্যবস্থাটা। এখন মানানসই গোছের একজন সভাপতি হলেই কোথাও কিছু আর বাকি থাকত না। কিন্তু সেইখানেই বেঁধেছে গন্ডগোল। পুরুত না থাকলে যেমন পুজোর সমস্ত সমারোহ ব্যর্থ, তেমনি দুর্দান্ত একজন সভাপতি না পেলে সবটারই অঙ্গহানি ঘটে যাবে।
নিরুপায়ভাবে পথ চলতে লাগল চার জনে।
অনেক ভেবেচিন্তে সন্ধ্যাই শেষপর্যন্ত নীরবতা ভাঙল।
তা হলে প্রিন্সিপালকেই সভাপতি করে…
থাম তুই, বকিসনি বোকার মতো। প্রিন্সিপাল তো বারোমাসই সভাপতি রয়েছেন। কিন্তু এমনই একটা অকেশনেও যদি বাইরের কাউকে না আনতে পারা যায়, তাহলে কী করে মুখ দেখাবি সবিতা ওদের কাছে? ইউনিয়নের আসছে ইলেকশনে কাউকে আর দাঁড়াতে হবে আমাদের ভেতর থেকে—সেটা যেন খেয়াল থাকে।
একটা ব্যবস্থা হবেই। শ্রান্তভাবে শকুন্তলা বললে, কাল একবার যেতে হবে সোমেন মিত্তিরের কাছে, নইলে চেপে ধরতে হবে ডক্টর তুষার দত্তকে।
কাল আবার কেন? বেরিয়েছি যখন, সেরে যাই আজকেই। সাউথেই তো থাকেন ওঁরা। মাধবী বললে।
না, এত বেলায় গিয়ে কাউকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া আমারও তাড়া আছে ভাই, বাড়ি ফিরতে হবে।
ইরা মুখ ভারী করে বললে, এই আজ-কাল করতে করতে ওঁরাও কোথাও এনগেজড হয়ে যাবেন শেষপর্যন্ত।
সে-ভার আমি নিচ্ছি। কালকের মধ্যে ব্যবস্থা আমি করে দেবই। কিন্তু এখন আর নয় ভাই, আমার বড্ড তাড়া আছে। ওই যে, বাসও আসছে।
আলোচনাটা মাঝপথে বন্ধ করে দিয়ে বাস স্টপের দিকে এগোল শকুন্তলা। অসন্তুষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে ইরা বিড়বিড় করে বকে চলল।
ছুটির দিনের বাস, তাতে বেলা বারোটার কাছাকাছি। ভিড় নেই বললেই চলে। অভ্যস্ত গলায় যাত্রীদের প্রলুব্ধ করার জন্যে কণ্ডাক্টর সমানে হেঁকে চলেছে, বাগবাজার-কাশীপুর বরানগর-খালি গাড়ি! খালি গাড়ি, বরানগর…
বরানগর। একটা সিকি এগিয়ে দিলে শকুন্তলা।
শ্রাবণের দুপুর, কিন্তু বর্ষণের বিষণ্ণ ছায়া আকাশের কোথাও নেই। শুধু অলস আশ্বিনের আভাস নিয়ে সিরাস মেঘের কয়েকটা শুভ্রোজ্জ্বল খন্ড ভেসে চলেছে দলছাড়া পাখির মতো। সূর্যের নিষ্ঠুর আলো থেকে থেকে শকুন্তলার মুখের ওপর এসে পড়তে লাগল। ওপাশের সিটে গিয়ে বসলেই হয়, কিন্তু সীমাহীন ক্লান্তিতে নিজের জায়গাটা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করল না আর। মাথার ওপর সারা সকালের রোদ জ্বলে গেছে, নাহয় পড়ক আরও দু-এক ঝলক।
বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরুর প্রয়াণতিথি। গান, নাচ, আবৃত্তি, প্রবন্ধ, বক্তৃতা—অনুষ্ঠানের কোথাও কোনো ত্রুটি থাকবে না নিশ্চয়। তা ছাড়া অক্লান্ত পরিশ্রম করছে ইরা, খেটে চলেছে জেদের মাথায়। যেন চ্যালেঞ্জ নিয়েছে সবিতার দলের। সেই ঝোঁকের মুখে এতক্ষণ শকুন্তলাও বিভ্রান্ত হয়েছিল, সারা সকালটা কেটে গেছে নেশার ঘোরে। কিন্তু এ রৌদ্রোজ্জ্বল বেলা বারোটার সময় বাসের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে বরানগর ফেরার মুখে নিজেকে এইবার ফিরে পেল শকুন্তলা।
বাইশে শ্রাবণ নয়, বরানগরের গলির ভেতরে ইট-বের-করা একতলা বাড়ি। পায়রার খোপের মতো দু-খানা ছাদফাটা ঘর-বর্ষায় বাক্স-বিছানা টানাটানি করতে হয় একোণে ওকোণে। ফুট কয়েক উঠোনের আধখানা জুড়ে আছে পাটভাঙা পুরোনো ইদারা আর বাসনমাজার ছাই। ইলেকট্রিক নেই, সন্ধ্যার পরে হ্যারিকেন লণ্ঠনের পোড়া কেরোসিনের গ্যাসের সঙ্গে মেশে পচা চুন-বালির একটা ভ্যাপসা গন্ধ—যেন দম আটকে আসে। আর সময় বুঝে ওদিকের পানাপুকুর আর সামনের বদ্ধজলের কাঁচা ড্রেন থেকে উঠে আসে লক্ষ লক্ষ মশা। পঁচিশ টাকায় কলকাতার কাছেপিঠে এর চাইতে ভালো আস্তানা মেলা দুর্লভ আজকাল।
আর সেখানে…
না, জোর করে চিন্তার মোড়টাকে ঘুরিয়ে আনল শকুন্তলা। বাইশে শ্রাবণ আসছে, রবীন্দ্রনাথ এই দিনে অস্তে নেমেছেন সন্ধ্যা-মেঘের তরণিতে সোনার মুকুট ভাসিয়ে দিয়ে। মরণমহেশ্বরের দেউলে বয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর প্রণাম। কিন্তু তাই বলে একেবারে বিদায় নিয়ে যাননিঃ আবার যদি ইচ্ছা করো, আবার আসি ফিরে—। এই কান্না-হাসির গঙ্গা-যমুনায় তাঁর ঘট ভরা তো শেষ হয়নি। নব নব জীবনের গন্ধ যাবো রেখে, নব নব বিকাশের বর্ণ যাবো এঁকে।
রবীন্দ্রনাথ। শকুন্তলা নিজের মনের মধ্যে খুঁজতে লাগল। ভালো করে সেখানে তাঁকে তো ধরা যাচ্ছে না। বারে বারে হারিয়ে যাচ্ছেন, লুকিয়ে যাচ্ছেন কেমন একটা ম্লান কুয়াশার অন্তরালে।
মনে হল একটা অস্বচ্ছ কাচের আবরণের ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বকবি। আবছাভাবে দেখা যায় তাঁকে। দেখতে পাওয়া যায় তাঁর পেছনে একটা আনীল আকাশ। শ্যামলী অরণ্যের ললাটে কৃষ্ণচূড়ার কুঙ্কুমচিহ্ন, অঞ্জনা নদীর কালো জলে ছায়া-ফেলে-যাওয়া বাণীবনের মরাল মিথুন। বিদ্যুতের ভুজঙ্গপ্রয়াতে মেঘ-মঙ্গলের শ্লোকধ্বনি ওঠে। বৈশাখের সূর্যমুখী দুপুরে কিরণের উজ্জ্বল তারাগুলো অদৃশ্য মিড়ে ঝিনঝিন করতে থাকে। হিমের অবগুণ্ঠন টেনে হেমন্তলক্ষী কাঁপন লাগা সন্ধ্যাতারার প্রদীপ হাতে পায়ে পায়ে ঝিঝির নূপুর বাজিয়ে চলে যান হিরণ্যশীর্ষ ধানখেতের ভেতর দিয়ে।
কিন্তু!
আচ্ছা, সত্যিই কি কিনু গোয়ালার গলির কোনো একতলা ঘরে কখনো বাস করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে? তাঁর হরিপদ কেরানির ভাগ্য ভালো বলতে হবে, অন্তত কখনো কখনো কান্তিবাবুর বাঁশির সুরে সে তমালের ছায়াঘেরা ধলেশ্বরী নদীর ধারে ঢাকাই শাড়িপরা মেয়েটির কাছে ফিরে যেতে পেরেছে। কিন্তু মশার গুঞ্জন থেমে গেলে শকুন্তলা বাঁশির সুর শুনতে পায় না, কানে আসে কাছের কোনো মদের দোকান থেকে মাতালের চিৎকার। শুনতে পায় বাবার গোঙানি, ছোটো বোনটার ঘুংরি কাশির বুকফাটা যন্ত্রণা।
ধলেশ্বরী নয়, একটা নদী তাদেরও ছিল— সুনন্দা। কবিতার মতো নাম, কবিতার মতো নদী। সুনন্দার দুধের মতো সাদা জলে জোয়ার-ভাটার ঢেউ খেলত, ঢেউ উঠত। হাওয়ালাগা সুপুরি আর নারকেলের বনে, ঢেউ দুলত পলিমাটিতে বুক সমান রূপশালি ধানে। কিন্তু স্বপ্নের পথ বেয়েও সে-সুনন্দার ধারে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। একটা লোহার প্রাচীর যেন চিরদিনের মতো তাকে আড়াল করে দিয়েছে—পাকিস্তান।
তা না হলে কলকাতার এই পঁচিশ টাকার ঘরে এসে এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার তো কোনো দরকার ছিল না। বেতো শরীর নিয়ে হুকো হাতে বাবার দিন কাটত চন্ডীমন্ডপে। ভাইবোনদের পক্ষে যথেষ্ট ছিল গ্রামের ইশকুল। তালের ডিঙি আর চক ভরা রাঙা শালুক; রাঙা কাঁকরের ফাঁকা পথের পাশে ফুল আর ঘাসের জমিতে আটা ব্রজমোহন কলেজেই যথেষ্ট বিদ্যালাভ হতে পারত শকুন্তলার। কলকাতার মেসে থেকে সোয়াশো টাকা মাইনের চাকুরে দাদার ঘাড়ের ওপর এমন করে এসে পড়ার কোনো প্রশ্নই কখনো ওঠেনি।
সেদিন অনেক কাছে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। থেকে থেকে কখন প্রসন্নমুখে পাশে এসে দাঁড়াতেন। তাঁরই দৃষ্টিদীপের আলোয় ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি জাগত আমি অন্ধকারের হৃদয়ফাটা আলোক জ্বল জ্বল। সন্ধ্যায় সুপুরিবনে যখন জোনাকির ঝাঁক জ্বলত, তখন কানে আসত তারই সুরেলা তীক্ষ্ণকণ্ঠধ্বনি— সজল সন্ধ্যায় তুমি এনেছিলে সখী, একটি কেতকী। নারকেলের পাতায় পাতায় ঝিলমিলে আলো পড়লে স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যেত অর্থহারা সুরের দেশে ফিরালে দিনে দিনে–
সে-সুনন্দা নেই, সেই অর্থহারা সুরের দেশও নেই। এখন কিনু গোয়ালার গলি, কিন্তু কর্নেটের সুর আসে না—হরিধ্বনি তুলে মড়া যায় বরানগরের শ্মশানঘাটে।
বিরানগর বাজার, বরানগর বাজার।
কনডাক্টরের গলার স্বর সব ছিন্নভিন্ন করে দিলে। চমকে তাকাল শকুন্তলা। ভাবনার ফাঁকে ফাঁকে কখন পার হয়ে গেছে নোংরা বাগবাজার, পাথর-ওঠা কাশীপুরের পথ। বরানগর বাজারের অপরিচ্ছন্ন তেমাথার সামনে এসে কখন ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলছে বাস।
মিনিট কয়েক দাঁড়াবে এখানে, টাইম নেবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিলে শকুন্তলা, নেমে এল বাস থেকে।
বাঁ-দিকের ঘিঞ্জি রাস্তাটা দিয়ে সে এগিয়ে চলল।
এত দূর থেকে ওই কলেজে পড়তে যাওয়া, যেমন কষ্ট হয় তেমনি সময়ও লাগে। কিন্তু একসঙ্গে এমন কনসেশন আর স্টাইপেণ্ড কলকাতার আর কোনো কলেজেই পাওয়া গেল না। তাই যাতায়াতে প্রায় দু-ঘণ্টা সময় নষ্ট হলেও উপায়ান্তর নেই কিছু। তবে একটা সুবিধে এই যে কলেজ সকালে। সে যখন বেরিয়ে পড়ে তখনও অধিকাংশ অফিসযাত্রীর চায়ের পেয়ালায় চুমুক পড়ে না। যখন ফেরে তখন উলটো স্রোতে হ্যাণ্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে চলে ডালহোউসি স্কোয়ারের বড়োবাবু-মেজোবাবু-জুনিয়ার গ্রেডের দল।
এইটুকুই যা বাঁচোয়া। কখনো কখনো ভয় করে, বিশেষ করে শীতের মেঘলা সকালে। যখন ঠাণ্ডায় চোখ-মুখ যেন ছিঁড়ে যেতে থাকে, হাতে-বোনা পশমি ব্লাউজটার ভেতরে শীতের কাঁপন ওঠে আর রাত্রি-জমে-থাকা একেবারে ফাঁকা বাসটার একা যাত্রী শকুন্তলা জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে, তখন। কিন্তু চারদিকের এত ভাবনা সঙ্গে সঙ্গে মনকে ঘিরে ধরে যে, একটু পরে নিজের জন্যে ভয় করতেও প্রায় ভুলে যায় শকুন্তলা। বাবা, ছোটো বোনেরা, ছোটোভাই, বড়দা। অভাব, দুশ্চিন্তা, লেগে-থাকা অসুখ। দাদার মাইনের টাকায় আর শকুন্তলার স্টাইপেণ্ডের উদবৃত্ত থেকে মাসের কুড়িটা দিন কোনোক্রমে টেনেটুনে চলে, কিন্তু বাকি দশটা দিন যে কীভাবে নাভিশ্বাস টেনে চালিয়ে যেতে হয়, সেটা ভাবতে গেলেও মাথা ঘুরতে থাকে। চারদিক থেকেই কালো রাত যেখানে ঘনিয়ে আছে, সেখানে একটা শীতের সকাল তার কতখানিই-বা ক্ষতি করতে পারে?
চলতে চলতে হঠাৎ থমকে থেমে পড়ল একসময়। অজিত নয়?
সন্দেহ কী, অজিতই বটে। আরও তিন-চারটি ছেলের সঙ্গে একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে, কী-একটা কথার ওপর অশ্লীলভাবে হাসছে হি-হি করে।
ঠিক সেই সময়ে চোখ তুলতেই অজিতও দেখতে পেল দিদিকে। চট করে হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা ফেলে দিল মাটিতে, নক্ষত্রবেগে অদৃশ্য হল পাশের একটা ছোট্ট গলির ভেতরে।
অজিতের সঙ্গীরা শকুন্তলাকে চেনে না, বুঝতেও পারল না কিছু। তারা সমস্বরে কোলাহল তুলে ডাকতে লাগল— পালালি কেন? এই শালা, এই অজিত, আরে শোন-না শালা…
শালাকে উচ্চারণ করল শ্লা।
রাস্তার মধ্যে কিছুক্ষণ শকুন্তলা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বারো বছরের ছেলে অজিত এর মধ্যেই এই স্তরে নেমেছে! যে-অজিত সেদিন পর্যন্ত তার কোলের কাছে শুয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে রূপকথা শুনত, গ্রামের স্কুলে শুধু পড়াশুনোয় নয়—স্বভাব-চরিত্রেও ছিল ফার্স্ট বয়, শহরের কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়ি ফিরলে দিদি কই মাছ ভালোবাসে বলে ছিপ নিয়ে ধ্যানে বসত পুকুরে, এ সেই অজিত! শুধু সিগারেট ধরেছে তা-ই নয়, যাদের সঙ্গে মিশেছে তারা সময়ে-অসময়ে শকুন্তলার দিকেও লক্ষ করে শিস টানে।
শুধু মাথার ওপরে সূর্যের জ্বালাই নয়, পায়ের তলাতেও যেন একটা আগুনের নদী পার হয়ে শকুন্তলা বাড়ি ফিরল। নাড়া দিলে কিনু গোয়ালার গলির ফাটধরা দরজার ক্ষয়ে-যাওয়া কড়াতে।
দশ বছরের বোন শান্তি দরজা খুলল। ছেঁড়া ফ্রক, ময়লা হাফ প্যান্ট। ছটো ছোটো দুটি হাতে মশলা বাটার পাকা জাফরানি রং। এই শান্তিকে দেখলে এখন কার মনে হবে দু-বছর
আগেও তাকে একটা টাটকা ফোঁটা গোলাপ ফুল বলে সম্ভাষণ করত লোকে?
শান্তি ফিসফিস করে বললে, আজ ছুটির দিনেও এত দেরি করে ফিরলি দিদি?
কাজ ছিল। হয়েছে কী?
বাবা ভয়ানক খেপে গেছেন। যাচ্ছেতাই বলে গালাগাল দিচ্ছেন তোকে।
দিন।
নিজেদের ঘরটার দিকে এগোল শকুন্তলা। নিজেদের ঘর, তারা চার জন থাকে এ ঘরে। সে, অজিত, শান্তি আর পাঁচ বছরের ছোটোবোন টুনু। আর একখানায় বাবা আর দাদা।
তক্তপোশের কারবার নেই, বিকেলে ঢালা বিছানা পড়ে মেঝের ওপর। এককোণে গোটা তিন-চার ট্রাঙ্ক আর টিনের সুটকেস। দেওয়ালে কী-একটা তেলকলের খেলো ক্যালেণ্ডার। দরজাটাকে বাঁচিয়ে এদিকে একটা নারকেলের দড়ি টানা—শাড়ি, জামা আর একরাশ ছেঁড়াখোঁড়া টুকিটাকির ভারে মেঝের প্রায় হাত খানেকের মধ্যে নেমে এসেছে। আর এক কোণে তিন টাকা দামের একটা প্যাকিং কাঠের শেলফে শকুন্তলার বই-খাতা; ফাঁকে ফাঁকে প্রায় লুকিয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বার্নার্ড শ এবং দেশি-বিদেশি আরও দু-চার জন। এ ই শকুন্তলার বিদ্যাবেদী, এইখানে বসেই সে বিএ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস অনার্স পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। উৎকর্ণ হয়ে থাকে সেই বাঁশি শোনবার জন্যে, যা তাকে সুরের ইন্দ্রধনুরথে রসের বৈকুণ্ঠলোকে নিয়ে যাবে।
অজিতের তিক্ত বিষাক্ত ব্যাপারটা নিয়ে মনের মধ্যে জ্বলতে জ্বলতে একটা ময়লা আধ ছেড়া শাড়ি জড়িয়ে নিলে শকুন্তলা, এ সপ্তাহে কলেজে যাওয়ার মতো একমাত্র কাপড়খানাকে সযত্নে ভাঁজ করে তুলে রাখতে রাখতে বাবার গালাগালির জন্যে তৈরি হতে লাগল। এসব এখন আর গায়ে লাগে না, অভ্যেস হয়ে গেছে।
বাতের যন্ত্রণায় বিকৃত মুখে কদর্য কটুভাষায় বাবা সুর ধরেন।
ধিঙ্গি ধেড়ে মেয়ে আমার কলেজে পড়েন! এদিকে সংসার ভেসে যায়, বুড়ো বাপটা মরে; মেয়ে আমার বিদ্যের জাহাজ হচ্ছেন! বুঝি বুঝি সব! পড়া তো নয়, নাচতে যাওয়া হয় কলেজে।
আশ্চর্য! সেই বাবা! গ্রামের লোকে বলত দেবতার মতো মানুষ। মা ছাড়া কোনোদিন ডাকেননি শকুন্তলাকে। বলতেন, ও আমার সাক্ষাৎ সরস্বতী। মা-মরা ছেলেমেয়েদের একেবারে আগলে রাখতেন বুক দিয়ে। এই দু-বছরের মধ্যে কী অদ্ভুতভাবে বদলে গেছেন।
একটা ভয়ংকর ইংরেজি গল্প কিছুদিন আগে পড়েছিল মনে আছে। একজন লোক একটু একটু করে তার আত্মাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল একটা ঘোড়ার মধ্যে, নিজে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বাবার সম্বন্ধেও তেমনি একটা সন্দেহ হয় তার। কোনদিন মরে ফুরিয়ে গেছেন, কার একটা হিংস্র প্রেতাত্মা এসে সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর ভেতরে।
কিন্তু গালাগালটা এখনও শোনা যাচ্ছে না কেন? সে ফিরেছে এটা বুঝতে তো বাকি থাকার কথা নয়। দরজার কড়া নড়েছে, শান্তি দোর খুলে দিয়েছে, জুতোর শব্দ উঠেছে, তবু বাবা এখনও নীরব কেন? ঘুমিয়ে পড়েছেন খুবসম্ভব। সারারাত বাতের জ্বালায় ছটফট করে হয়তো চোখ বুজেছেন একটুক্ষণের জন্যে। ছোটোবোন টুনুরও দেখা নেই, রাতভর হুপিং কাশি টেনে সেও বোধ হয় বাবার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে।
তবু বাঁচোয়া।
একদিন সহ্য করতে না পেরে বলে ফেলেছিল, বেশ তত বাবা, তোমার যদি পছন্দ না হয়, পড়াশুনো ছেড়েই দিচ্ছি আমি।
শুনে বাবা বিশ্রিভাবে মুখ ভেংচে উঠেছিলেন।
আহা, তা আর ছাড়বে না! তা নইলে আর এমন করে খাইয়ে-দাইয়ে তাল গাছ করে তুললাম কেন! পাস করে বেরুলে একটা চাকরিবাকরি হবে, দুটো পয়সা এনে দিতে পারবে। আপন সন্তান হয়ে বাপের এটুকু উপকার কোন দুঃখে করতে যাবে শুনি?
না, বাবার ওপর আর রাগ হয় না। বুঝতে পারে বাবাকে, বুঝতে পারে কোথায় তাঁর ব্যথা। এই পচা চুন-বালি আর আরশোলার গন্ধে ভরা দম-আটকানো ঘরের মধ্যেই বাঁধা পড়ে গেছে বাবার জীবন। সুনন্দার দুধের মতো জলে ঢেউ ওঠে না এখানে, সুপুরি নারকেলের বন দুলিয়ে ছুটে আসে না বুক-জুড়োনো হাওয়া। একটা করুণাহীন অন্ধকূপের মধ্যে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন বাবা। আর তারই মধ্যে একটুখানি অন্তত বাইরে বেরুতে পায় শকুন্তলা। পথে, কলেজে একটা বিস্তৃততর জীবনের ভেতরে ফেলতে পায় মুক্তির নিশ্বাস। বাবার যা কিছু হিংসা আর হিংস্রতার উৎস ওইখানে।
দিদি, খাবি আয়। শান্তি ডাকল।
না, আর বসিয়ে রাখা উচিত নয় বাচ্চাটাকে। বেলা একটা পার হয়ে গেছে। শান্তির শীর্ণ ক্ষুধিত মুখোনা দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠল।
সকালে শকুন্তলার কলেজ পড়াতে এই বাচ্চা মেয়েটার ওপরেই রান্নাবান্নার ভার। ন-টায় বড়দার অফিসের ভাত দিয়ে, দশটার মধ্যে বাবাকে খেতে দিতে হয়। বুড়ো মানুষ বাবা আজকাল একেবারে খিদে সইতে পারেন না। তারপর অজিত আর সে খেয়ে নিয়ে ছোটে ইশকুলে। শকুন্তলার খাবার ঢাকা দেওয়াই থাকে। টুনু কোনো কোনো দিন বাবার সঙ্গে খেয়ে নেয়, কোনো দিন-বা দিদির জন্যে অপেক্ষা করে।
অতটুকু মেয়ের ওপর বডড বেশি চাপ পড়ে সকালে। অবশ্য দুপুর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত জোয়ালটা শকুন্তলাই কাঁধে তুলে নেয়। তবুও… কিন্তু উপায় নেই, কী করা যায়!
রান্নাঘরে এল শকুন্তলা। দুজনের ভাত বেড়ে নিয়ে ক্ষুধিত কাতর মুখে অপেক্ষা করছে শান্তি।
খেতে বসে শকুন্তলা জিজ্ঞেস করলে, টুনু খায়নি?
অনেকক্ষণ। ছোড়দা সেই এগারোটার সময় কোথায় চলে গেল। বাবা বারণ করলেন, শুনল না। বললে, কোন এক বন্ধুর বাড়িতে পড়তে যাচ্ছে।
হুঁ! শকুন্তলা চুপ করে রইল। সকালের কড়কড়ে শুকনো ভাতগুলো যেন আটকে যাচ্ছে তালুতে।
হাতের ভেতর কতগুলো ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল শান্তি, তারপর চুপি চুপি বললে, ছোড়দা বোধ হয় আজকাল পয়সা চুরি করে দিদি!
গেলাসের গায়ে হাতটা শক্ত হয়ে আটকে গেল শকুন্তলার, তাই নাকি?
সকালে বড়দা খুব হইচই করছিল। পকেটে নাকি ছ-আনা খুচরো ছিল, পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বাভাবিক–খুব স্বাভাবিক। এই অন্ধকূপে, এই হীনতার ভেতরে এ ছাড়া কী আর করতে পারত অজিত? নিজের চোখেই তাকে দেখেছে কতগুলো বখাটে রকবাজ ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে।
হুঁ! এবারও সংক্ষিপ্ত জবাব দিলে শকুন্তলা।
আর একটা কী বলি বলি করে কিছুক্ষণ দ্বিধা করলে শান্তি। তারপর ছোড়দা খুব খারাপ হয়ে গেছে দিদি!
শকুন্তলা চোখ তুলে তাকাল।
ক্লাস এইটের লীলা বলছিল, ছোড়দা নাকি কাল ওদের দেওয়ালে একটা চক দিয়ে কীসব যাচ্ছেতাই কথা…
চুপ কর। আচমকা সমস্ত জ্বালা দিয়ে শকুন্তলা নির্দোষ শান্তির ওপরেই অসহ্য ক্রোধে বিদীর্ণ হয়ে পড়ল। অত কথায় তোর কাজ কী? কাল যে তোদের পরীক্ষার প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল—দেয়নি?
শান্তি পাথর হয়ে গেল। যে-গ্রাসটা মুখে তুলতে যাচ্ছিল, নামিয়ে ফেলল থালার ওপর।
জবাব দিচ্ছিস না যে? দেয়নি প্রোগ্রেস রিপোর্ট?
দিয়েছে। ফিসফিসে গলায় শান্তি জবাব দিলে।
কোথায় সেটা?
অঙ্কে আর ইংরেজিতে ফেল করেছি দিদি। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল শান্তি। সারাদিনের ক্লান্ত অভুক্ত মেয়েটার বেড়ে-নেওয়া ভাতের ওপর টপ টপ করে পড়তে লাগল চোখের জল।
নিজের এই নিষ্ঠুরতায় বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে ছিঁড়ে গেল শকুন্তলার। চারদিকের আঘাত খেয়ে খেয়ে প্রতিঘাত তো দিতেই হবে একজনকে। এমন একজন—যে তার চাইতেও দুর্বল, তার চাইতেও অসহায়। শান্তি!
থালা ছেড়ে উঠে গেল শকুন্তলা।
কিন্তু সাত দিন পরে বাইশে শ্রাবণ। বাবা আর টুনু ঘুম থেকে ওঠার আগে, দাদা অফিস থেকে ফেরার আগে, অজিতের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত তার হাতে কিছুক্ষণ সময় আছে। রবীন্দ্র-কাব্যে মৃত্যুকল্পনা প্রবন্ধটা তাকে আরম্ভ করে দিতেই হবে, লিটারারি সোসাইটির সেক্রেটারির মান থাকবে না তা নইলে।
ততক্ষণ চোখের জল শান্তিরই পড়তে থাকুক।
শেষপর্যন্ত ডক্টর তুষার দত্তকেই রাজি করানো গেল।
সবিতার দল ইতিমধ্যেই কী করে খবর পেয়েছে সভাপতি জোটেনি। চারদিকে দস্তুরমতো প্রোপাগাণ্ডা জুড়ে দিয়েছিল তাই নিয়ে। হঠাৎ খবরটা পেয়ে দমে গেল তারা।
আশেপাশে আরাধনাদি কোথাও আছেন কি না ভালো করে দেখে নিয়ে আর এক বার কোমর বেঁধে কমন রুমের টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গেল ইরা।
দেখো আসছে পঁচিশে বৈশাখে কী করি! একজন দুজন নয়, তিন-তিন জন সভাপতি নিয়ে আসব, প্রেসিডিয়াম করে তুলব একেবারে। সেইসঙ্গে দুজন প্রধান অতিথি।
তখন তো কলেজ বন্ধ থাকবে। একজন ভুল শুধরে দিলে।
একবার থতমত খেয়েই ইরা নিজেকে সামলে নিলে। থাকলেই-বা কলেজ বন্ধ। তোমরা তো আর ঘরে বন্ধ থাকবে না। এদিকে দিনরাত রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ কর, অথচ ছুটির দিনে একটা ফাংশন করতে গেলে সব ভক্তি উবে যাবে বুঝি?
সবিতার দল থেকে একজন টিপ্পনী কাটল, আচ্ছা, দেখা যাবে সামারের ছুটিতে তোমার চুলের ডগাটুকুও দেখতে পাওয়া যায় কি না? নিজেও তো ঊর্ধ্বশ্বাসে সিমলা পাহাড়ে মামারবাড়িতে ছোট!
ইরা আবার ঝগড়া বাঁধাতে যাচ্ছিল, শকুন্তলা এসে পড়ল মাঝখানে।
চুপ কর ইরা। ওসব বাজে তর্ক করে লাভ নেই। চল, প্রিন্সিপালের সঙ্গে এক বার কথা বলে আসি। আর তিন দিন বাদে তো ফাংশন। অন্তত দুটো দিন লাস্ট পিরিয়ডটা আমাদের অফ করে না দিলে ভারি অসুবিধা হচ্ছে নাচ আর গানের রিহার্সালে।
সত্যি, কাজের আর অন্ত নেই। যেটুকু সময় কলেজে থাকে যেন নিশ্বাস ফেলারও সময় পায় না শকুন্তলা। মেয়েরা সব যেন কী! পান থেকে চুনটি খসলে অভিমান করে বসে। হিমানী বশ মানে তো শিখার রাগ পড়ে না, বেণুকে যদি-বা বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করা গেল তো মুক্তিকে ডেকে পাওয়া যায় না। মুখরা আর প্রখরা ইরা সঙ্গে না থাকলে শকুন্তলার সাধ্যও ছিল না এদের সামলে রাখা। জোর করে তাকে লিটারারি সেক্রেটারি আর কলেজ
ম্যাগাজিনের এডিটার করে দেওয়া ইরারই কীর্তি। এই দুঃসময়ে সে-ই সঙ্গে সঙ্গে আছে বিশ্বস্ত সেনাপতির মতো। বলতে গেলে ডক্টর দত্তকে ধমকে রাজি করিয়েছে একরকম।
ডক্টর দত্ত জানিয়েছিলেন, ওইদিন তাঁর একটা আর্ট কনফারেন্স আছে।
শুনেই হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা জুড়ে দিয়েছিল ইরা।
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ওয়ার্ক করেছেন আপনি, একজন এডুকেশনিস্টও বটে। স্টুডেন্টদের এটুকু দাবিও যদি আপনারা মেনে নিতে না পারেন তা হলে কোথায় আমরা যাব বলুন তো?
এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চাইতে সভাপতি হওয়াটাই সহজ বলে মনে হয়েছে ডক্টর দত্তের। হেসে বলেছেন, আচ্ছা, এক ঘণ্টা স্পেয়ার করতে পারি আমি।
ওতেই যথেষ্ট হবে। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে এসেছে ওরা। পথে বেরিয়ে ইরা বলেছে, এক ঘণ্টা! ফাংশন হতেই দেড় ঘণ্টা, তার পরে তো প্রেসিডেন্টের অ্যাড্রেস! দু ঘণ্টার আগে পালান কী করে দেখব।
কিন্তু থেকে থেকে ক্লান্ত লাগে শকুন্তলার। এখানে উৎসাহ, আয়োজন, চঞ্চলতা—আর একটা পৃথিবী। এখানে গন্ধধূপ জ্বলবে, রবীন্দ্রনাথের আলোকমূর্তির গলায় দুলবে ফুলের মালা, একটা স্বপ্নিল নীলিম আলোয় ভরে যাবে ঘর, তানপুরার ব্যথিত মূৰ্ছনার সঙ্গে বেণু বোসের ভাবগম্ভীর মধুমতী গলায় গান উঠবে–সমুখে শান্তি পারাবার। চারদিকে অনুভব করা যাবে কবিগুরুর শুচিস্মিত আবির্ভাব। সমস্ত মন এক মুহূর্তে দেওয়ালের আড়াল ভেঙে বেরিয়ে যাবে, পৌঁছুবে সেখানে—শান্তি-সাগরের তরঙ্গ দোলায় দোলায় যেখানে একটি শ্বেতপদ্ম বিকশিত হয়ে উঠছে আর তার ওপরে ধ্যানাসীন হয়ে আছে সুন্দরের জ্যোতি স্বরূপ।
আর সেদিন বরানগরের একতলা ইট-বের-করা বাড়িতে নতুন একটা কুকীর্তির কাহিনি শোনা যাবে অজিতের। আরও কুশ্রী গলায় অবিশ্রাম গালাগালি দিয়ে যাবেন বাতে পঙ্গু অক্ষম বাবা। কাশির ধমকে হৃৎপিন্ডটা ছিঁড়ে যেতে চাইবে টুনুর, গোগ্রাসে গিলে একশো পঁচিশ টাকায় চাকরিতে ছুটবে বড়দা, মুখের ভাত চোখের জলে ভেসে যাবে শান্তির।
পিছন থেকে ইরা বলল, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল দেখে আসি কেমন তৈরি হয়েছে হিমানীর নাচটা।
ক্ষমোহে ক্ষমো—নমো হে নমো-রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে একটা আকুল আর্তি যেন বুকের ভেতর থেকে বিদীর্ণ হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় শকুন্তলার। ক্ষমা করো কবিগুরু, ক্ষমা করো আমাকে। তোমার কিনু গোয়ালার গলিতেই বাসা বেঁধেছি, কিন্তু এখনও তো বাঁশির ডাক শুনতে পেলাম না!
ঘুমের মধ্যে টুনু থেকে থেকে কেশে উঠছে। রাত্রেই বাড়ে উপদ্রবটা। সারারাত কী অসহ্য কষ্টেই যে কাটে মেয়েটার। তবু আজ দশ দিনের মধ্যে কোথা থেকে দাদার বিনা পয়সার চেয়ে আনা কয়েক পুরিয়া হোমিয়োপ্যাথি ছাড়া আর কোনো ওষুধই পড়ল না। কালকের হাঙ্গামাটা চুকিয়ে ফেলতে পারলে যেমন করে হোক নিজেই একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে শকুন্তলা।
সন্ধে বেলা বাবার কাছে ঘা-কয়েক খড়মপেটা খেয়েছে অজিত। ঘণ্টা খানেক হাউমাউ করে, ভাতের প্রতি অসহযোগ জানিয়ে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। ওর জন্যে ভাবনা নেই, বড়দা এসে কান ধরে টান দিলেই সুড়সুড় করে খেতে বসবে। বাবা ওঘরে এখনও ঘুমোননি, গজগজ করে অশ্রান্ত কণ্ঠে গালাগাল দিয়ে চলেছেন। পৃথিবীর কাউকে, কোনো কিছুকে একবিন্দু ক্ষমা নেই তাঁর। বাবার গালাগালিগুলো আজকাল আর কান পেতে শোনারও দরকার হয় না, একেবারে মুখস্থ হয়ে গেছে সমস্ত।
কিন্তু এখনও কেন ফিরছে না দাদা? রাত তো দশটার কাছাকাছি।
প্রবন্ধটা শেষ করে ক্লান্তির একটা হাই তুলল শকুন্তলা। মন্দ দাঁড়ায়নি, লিখে নিজেরই তৃপ্তিবোধ হচ্ছে। অনেক খুঁজে খুঁজে উদ্ধৃতি দিয়েছে ইংরেজ কবিদের। রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় মৃত্যুর স্বরূপ ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে নিজেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে বার বার। কলমের মুখে সমস্ত আবেগ ঢেলে দিয়ে লিখেছে, মনের অন্ধকার খনির ভেতর থেকে এক-একটা জ্বলজ্বলে হিরার খন্ডের মতো চুনে চুনে এনেছে শব্দ। লিটারারি সোসাইটির সেক্রেটারির অযোগ্য হয়নি লেখাটা।
শিল্পগুলো পর পর সাজাতে সাজাতে শকুন্তলা শান্তির দিকে তাকাল। লণ্ঠনের এপাশে উবু হয়ে বসে ঘুমে জড়োজড়ো চোখে শ্লেটের ওপর প্রশ্নের অঙ্ক কষছে শান্তি।
শকুন্তলা বললে, শুয়ে পড় শান্তি। আর অঙ্ক কষতে হবে না এখন।
থাক, বড়দা আসুক।
কখন আসবে তার তো ঠিক নেই। তুই শো গে যা।
ঘুম-ভরা চোখ দুটোকে দু-হাতের পিঠে ডলে নিয়ে শান্তি সোজা হয়ে বসল।
বড়দা আজকাল বড় রাত করে ফেরেনা দিদি?
হুঁ। অফিসের পরে কী-একটা ব্যাবসার কাজে ছুটোছুটি করে, তাইতেই রাত হয়।
ও। শান্তি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু ছোড়দা বলছিল… কথাটা শেষ করার আগেই সে থেমে গেল।
কী বলছিল অজিত? একটা আকস্মিক সন্দেহে মুহূর্তের মধ্যে শকুন্তলা সংকীর্ণ হয়ে উঠল।
ভীত ম্লান মুখে শান্তি বললে, শুনলে রাগ করবে তুমি।
রাগ করব না, বল।
ছোড়দা বলছিল একটা ঢোঁক গিলল শান্তি, বড়দার ব্যাবসা না হাতি। ছোড়দা নাকি নিজের চোখে দেখেছে আলমবাজারের কী-একটা আড্ডায় বড়দা সন্ধের পর জুয়ো খেলে,
মদও…
অজিত! প্রেতিনির মতো তীক্ষ্ণ গলায় প্রায় ককিয়ে উঠল শকুন্তলা। অজিত সাড়া দিলে না, নড়ল না পর্যন্ত; যেন মড়ার মতো অঘোর ঘুমে মগ্ন।
অজিত! আর এক বার তেমনি অস্বাভাবিক তীব্র স্বরে শকুন্তলা বিস্ফোরিত হয়ে পড়ল।
কিন্তু অজিত সাড়া দেওয়ার আগেই নাড়া খেল দরজার কড়া। ঝনঝন করে একেবারে ভেঙে ফেলতে চাইল ক্ষয়ে-যাওয়া দরজাটাকে।
এত রাতে বাড়িতে ডাকাত পড়ল নাকি? বাবা খনখন করে উঠলেন।
বড়দা এসেছে। ছুটে দরজা খুলতে গেল শান্তি। হুড়কোর আওয়াজ এল, আওয়াজ এল পাল্লা দুটোকে সজোরে আছড়ে ফেলার; এল ধপ ধপ করে কয়েকটা জুতোর অসংলগ্ন ভারী ভারী শব্দ, তারপরেই কুয়োতলার বালতিটাকে নিয়ে সবেগে কেউ উঠোনের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল।
ও মা গো! শান্তির আর্তনাদ বাজল পাড়া কাঁপিয়ে। ছুটে বেরুল শকুন্তলা, খোঁড়া পা নিয়ে টলতে টলতে বেরুলেন বাবা।
দুটো লণ্ঠনের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল উঠোনের ওপরে লম্বা হয়ে পড়েছে রণজিৎ। বমি করে ভাসিয়ে দিচ্ছে সব। মদ আর একরাশ অজীর্ণ খাদ্যের টুকরোর অল্প গন্ধে আবিল হয়ে গেছে চারদিক।
রণজিৎ! রণজিৎ! কী হল? কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসতে লাগলেন বাবা।
কিছু হয়নি দাদার। নীচের ঠোঁটটাকে কামড়ে ধরে রক্তাক্ত করে দিতে চাইল শকুন্তলা, দাদা মদ খেয়েছে!
মদ! বাবা দু-পা পিছিয়ে গেলেন, তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, হারামজাদা! শুয়োর…
রণজিৎ আস্তে আস্তে মাথা তুলল খানিকটা, জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, খামোখা চ্যাঁচাচ্ছ। কেন? মদ খাই, জুয়া খেলি—যা খুশি করি, তোমাদের টাকা তো এনে দিয়েছি! অনিশ্চিত হাতে বুকপকেটের ভেতর থেকে কী কতকগুলো টেনে বার করে সে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল, তারপর আবার নিজের বমির ওপরেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
টাকা! ক্ষুধার্ত জন্তুর মতো উচ্চারণ করলেন বাবা।
টাকাই বটে। একরাশ দশ টাকার নোট কাগজের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে উঠোনময়। বাবার কোটরে-বসা অদৃশ্য চোখ দুটো জ্বলে উঠল দুখানা নতুন সিকির মতো। আর এক বার বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন, হারামজাদা! শুয়োরের বাচ্চা! তারপর না, তারপর স্বপ্ন দেখল না শকুন্তলা, বেতো শরীরে প্রাণপণে নত হয়ে উঠোন থেকে নোটগুলো থাবা দিয়ে তুলে নিচ্ছেন বাবা, লণ্ঠনের আলোয় তাঁর পাকা চুলগুলো রুপোর তারের মত ঝকঝক করছে।
খিক খিক করে অশ্লীল হাসির আওয়াজ এল একটা। পাথরের মূর্তি শকুন্তলা যেন হাতুড়ির ঘা খেয়ে নিজের চেতনাটা কুড়িয়ে পেল।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অজিত হাসছে।
আমি তখনি বলেছিলাম…
কুয়োতলা থেকে আধখানা ইট কুড়িয়ে অজিতের দিকে ছুড়ে মারল শকুন্তলা। লাগল না, পুরোনো দেওয়াল থেকে একরাশ চুন-বালিই ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল শুধু। এক লাফে ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হল অজিত।
সনাতনম এনম আহুর…
বেদমন্ত্র পড়ছে সুনেত্রা গোস্বামী, গম্ভীর মন্ত্রধ্বনিতে সমস্ত সভাটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। চন্দন, ফুল আর ধূপের গন্ধে পূজামন্ডপের পবিত্রতা আকীর্ণ হয়ে গেছে। বড় ফোটোখানার ভেতরে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের। যেন বেদমন্ত্রের প্রতিটি উদাত্ত অনুদাত্তের আহ্বান একটু একটু করে জ্যোতির্বলয় বিকীর্ণ করে দিচ্ছে তাঁর চারদিকে।
চোখ বুজে বসে আছেন সভাপতি, চোখ বুজে বসে আছেন সভার সকলে। এমনকী সবিতার দলও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল শকুন্তলা। বরানগরের বাসা মুছে গেছে, মুছে গেছে কাল রাত্রির সমস্ত দুঃস্বপ্ন; ধুয়ে নির্মল হয়ে গেছে বিনিদ্র প্রহরগুলির সেই পঙ্কন! রবীন্দ্রনাথের দুটি উজ্জ্বল স্নিগ্ধ চোখ থেকে যেন করুণার অমৃতধারা এনে ধন্য করে দিচ্ছে তাকে। শকুন্তলার মনে হতে লাগল ওই গন্ধধূপের ধোঁয়ার মতো তার সমস্ত অস্তিত্বও অমনি বায়বীয় হয়ে যাক, মিলিয়ে যাক জীবনের যা-কিছু ভার আর যত কিছু তুচ্ছতা। অমনি শূন্যময় হয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবমূর্তির পায়ে সে নিঃশেষিত করে দিক তার নিবেদিত প্রণাম।
শকুন্তলাদি। মাধবী এসে স্পর্শ করল তাকে।
বিরক্ত হয়ে শকুন্তলা ফিরে তাকাল।
কী হল আবার?
এক বার মেক-আপ রুমে এসো। ওরা ডাকছে।
আঃ, একটা মুহূর্ত এরা শান্তি দেবে না! শকুন্তলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, চল।
কমন রুমেই মেক-আপ চলছে। ফুলের গয়না সর্বাঙ্গে পরে শ্রীমতীর ভূমিকায় তৈরি হয়েছে হিমানী গুপ্ত। সুন্দরী মেয়েটিকে অপরূপ লাগছে দেখতে। মুগ্ধ হয়ে গেল শকুন্তলা।
বাঃ! বেশ হয়েছে।
কর্ণ-কুন্তী সংবাদের কর্ণ ইরা। নাকের নীচে ক্রেপের গোঁফটা চেপে ধরে হেসে অস্থির হয়ে উঠল।
এই, আমাকে দেখছিস না? কেমন গোঁফটা লাগিয়েছি বল তো? একেবারে মহাবীর কর্ণ বলে মনে হচ্ছে না?
চুপ চুপ, শুনতে পাবে ওখানে।
সুপারিন্টেন্টে আরাধনাদি মেক-আপের চার্জে। অমন ভারিক্কি মানুষ প্রসন্ন হাসিতে মুখ আলো করে বললেন, কেমন শকুন্তলা, ঠিক হয়েছে সব?
চমৎকার হয়েছে!
ইরা আবার ফিরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর মুখভঙ্গি করে দেখতে লাগল ক্রেপের গোঁফটায় তাকে কেমন মানিয়েছে।
একটু হেসে শকুন্তলা হলঘরে ফিরে এল।
একটার পর একটা প্রোগ্রাম হয়ে চলল স্টেজের ওপর। চমৎকার উতরে যাচ্ছে সবগুলো। সবিতার দলের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না একটুও। অসীম আত্মপ্রসাদে আর গভীর তৃপ্তিতে দেওয়ালের কোণে নিজের জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে রইল শকুন্তলা। তার প্রবন্ধটা পড়া হয়ে গেছে সকলের আগেই–সভাপতি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, সাধু সাধু। প্রিন্সিপাল তার দিকে সস্নেহ-চোখে তাকিয়েছিলেন, এমনকী সি সি বি পর্যন্ত বলেছেন চমৎকার। কোথাও আর ক্ষোভ নেই শকুন্তলার, এতটুকু গ্লানি অবশিষ্ট নেই কোনোখানে। বরানগরের বাসা অনেক দূরে পড়ে থাকুক, আপাতত নিজের মধ্যে সে চরিতার্থ হয়ে গেছে। হলের আলো নিবিয়ে অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছে, লাল-নীল-হলুদ-সবুজ ফোকাসের সঙ্গে স্টেজের ওপর নাচ শুরু হয়েছে হিমানীর। নেপথ্য থেকে মৃদু অর্কেস্ট্রার সঙ্গে বেণু বোসের মধুক্ষরা গলা মাইকের মধ্য দিয়ে নিঝরিত হয়ে পড়ছে :
আমার সকল দেহের আকুল রবে
মন্ত্রহারা তোমার স্তবে
ডাইনে-বামে ছন্দ নামে
নব জনমের মাঝে–
তোমার বন্দনা মোর ভঙ্গীতে আজ
সঙ্গীতে বিরাজে–
চমৎকার নাচছে হিমানী। নাচের প্রতিটি ছন্দে, প্রতিটি মুদ্রায় তার সর্বাঙ্গ যেন দীপ্ত হয়ে উঠছে ঘনসারপ্পদিত্তেন দীপেন তমধংসিনা।
ওই নাচের তালে তালে, ওই প্রতিটি আভরণ ছুড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শকুন্তলার যেন নিজেকেও ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করল—তোমার পায়ে মোর সাধনা মরে যেন লাজে!
শকুন্তলাদি! এইসময় আবার ডাকতে এল সন্ধ্যা।
সবসময়ে কেন বিরক্ত করিস বল তো? নাচটা দেখতে দে-না একটু। ক্রুদ্ধ শকুন্তলা তর্জন তুলল ফিসফিস করে।
বা রে! কানে কানে সন্ধ্যা বললে, খাবার আনা হয়নি যে এখনও। দশটা টাকা দাও শিগগির, একটু পরেই তো চলে যাবেন প্রেসিডেন্ট।
উঃ, জ্বালিয়ে মারলি।
হল থেকে বেরিয়ে আলোকিত করিডোরে এসে দাঁড়াল শকুন্তলা। ব্যাগ খুলল।
কিন্তু একী!
চাঁদার অবশিষ্ট অন্তত কুড়ি টাকা ছিল ব্যাগে, অন্তত আজ দুপুর পর্যন্তও ছিল। একটা টাকাও নেই সেখানে। শুধু মাঝখানে আনা আটেক খুচরো পয়সা পড়ে আছে। বাসে আসার সময় ব্যাগের এ পকেটটা সে দেখেনি, শুধু খুচরো থেকে বাসভাড়াটা বের করে দিয়েছিল খালি।
কোথায় গেল টাকা?
বেণু বোসের গান যেন একরাশ ঝিঝির ডাকের মধ্যে মিলিয়ে গেল। হলঘর, রবীন্দ্রনাথ, হিমানীর নাচের ছন্দ—এক মুহূর্তে তলিয়ে গেল। মনে হল কালো অন্ধকার থেকে বরানগরের বাসার পচা দুর্গন্ধটা তার চারপাশে পাক খেয়ে যাচ্ছে, কানে আসছে মাতালের কতগুলো অবোধ্য কুৎসিত চিৎকার।
খাবার, প্রেসিডেন্টের ট্যাক্সিভাড়া, খুচরো খরচ…
অজিত। দুপুর বেলা এক বার চোরের মত এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। শকুন্তলা তখন খেতে বসেছে। হ্যাঁ, অজিত—সন্দেহমাত্র নেই। দাদা যদি জুয়ো খেলে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতে পারে, বাবা যদি সেই ক্লেদাক্ত নোটগুলোকে অমন লোলুপ হয়ে কুড়িয়ে নিতে পারেন, তাহলে তাহলে অজিতের কী দোষ?
কিন্তু কী বলবে শকুন্তলা? কী কৈফিয়ত দেবে? কোন লজ্জায় বলবে চাঁদার টাকা তার নিজেরই ভাই…
বাবা-দাদা-অজিত! কেউ বাদ নেই—কেউ না। সবাই যখন পঙ্কের মধ্যে ডুবে গেছে, তখন সে কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকবে একটা শুকনো ডাঙার ওপরে? সেও চোর, ও-টাকা সে-ই চুরি করেছে।
মাথার মধ্যে রক্ত ঘুরতে লাগল, আগুন জ্বলতে লাগল সারা শরীরে। যেন দুটো চোখ অন্ধ হয়ে গেল শকুন্তলার। যেন মৃত্যুর একটা পিছল সিঁড়ি হাতড়ে হাতড়ে অন্ধের মতো সে নেমে চলল পাতালের দিকে।
কমন রুমে একা এসে দাঁড়াল শকুন্তলা। কেউ কোথাও নেই। শূন্য ঘরে একটা আলো জ্বলছে, আর গোল বড়ো টেবিলটার ওপর পড়ে আছে একখানি সঞ্চয়িতা, কয়েকটা শাড়ি-জামা, জোড়া তিনেক চশমা, গোটা দুই রিস্টওয়াচ আর লাল-সাদা-সবুজ-খয়েরি একরাশ মেয়েদের ব্যাগ।
না, কোথাও কেউ নেই। হিমানীর নাচ দেখতে সবাই উইংসের ধারে ভিড় জমিয়েছে, এমনকী আরাধনাদিও। এক মুহূর্ত আর অপেক্ষা করল না শকুন্তলা। চকিতের মধ্যে তুলে নিলে পাইথন লেদারের একটা সৌখিন ব্যাগ। জিনিসটা চেনা-বেণু বোসের। লাখপতির মেয়ে বেণু বোস, তিন রকমের মোটরে চড়ে কলেজে আসে। তার ব্যাগে কুড়িটা টাকা হাত দিলেই তুলে নেওয়া যাবে, বেণু হয়তো কোনোদিন টেরও পাবে না।
অনুমান ভুল হল না। মেয়েলি প্রসাধনের সুগন্ধিভরা ব্যাগটার ভেতর থেকে দুখানা সুরভিত নোট বের করে নিয়ে সেটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখল শকুন্তলা। হাত কাঁপল না, পা কাঁপল না এক বার। তারপর তেমনিভাবেই বেরিয়ে এল কমন রুম থেকে।
ছায়াবাজির মতো কখন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। ডক্টর দত্ত অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বলে গেলেন। তার একটা শব্দও ভালো করে বুঝতে পারল না শকুন্তলা, একটা কথার অর্থবোধ করতে পারল না। শুধু নোট দুটোর উগ্র সুগন্ধ তার মস্তিষ্কের ভেতর বিধতে লাগল একরাশ কাঁটার মতো।
দুধের মতো শুভ্র সন্দেশ—পরিপাটি খাবার। চুরির একবিন্দু ময়লা তাতে লাগেনি। তবু এক টুকরো সন্দেশ ভেঙে মুখে দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন সভাপতি।
বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ করে ভেঙে পড়ল শকুন্তলার। গন্ধ পেয়েছেন না কি! চুরি করা নোটের গন্ধ।
সভাপতি বললেন, চমৎকার অনুষ্ঠান হয়েছে, ভারি আনন্দ পেলাম। আসি তা হলে নমস্কার।
আর এক বার, আর এক বার চোরের মতো ফিরে এল শকুন্তলা। ফিরে এল হলঘরে। কেউ নেই। বেণু বোসের মোটর কখন চলে গেছে, মেয়েরা এতক্ষণে পৌঁছে গেছে যে-যার বাড়িতে। শুধু তারই যাওয়া হয়নি এখনও, অর্ধেক পথ থেকে ফিরে এসেছে।
শূন্য হলঘরে এখনও আলো জ্বলছে, বেয়ারারা চাবি বন্ধ করে যায়নি। বেদির ওপর রবীন্দ্রনাথের মালা-চন্দনভূষিত চিত্রমূর্তি। একটা ধূপকাঠির শেষ প্রান্তটুকু তখনও জ্বলছে, একটা প্রদীপের বুক জ্বলছে তখনও।
কান্নার বেগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে শকুন্তলা ছবির সামনে লুটিয়ে পড়ল।
তুমি দেবতা, তুমি মহাকবি। মানুষের প্রেমে তোমার চোখের জল ঢেলে পৃথিবীকে তুমি ধন্য করে গেছ। তুমিই বলো আমার কতখানি অপরাধ? বাবা-দাদা-অজিত-আমি আজ তোমার মৃত্যুতিথিতেও কেন এমন করে পাপের অন্ধকারে তলিয়ে চলেছি? তুমিই তার জবাব দাও।