নদীর ওপারে বড়ো জংশনটার পাশে মিলিটারি কলোনি। আগে প্রায় ষাট-সত্তর বিঘে জুড়ে ধু-ধু করত অনাবাদি জমি—প্রকৃতির অভিশাপ লাগা মরা মাটি। ধান-পাট দূরে থাক, একমুঠো কলাই বুনেও ওখান থেকে কেউ ঘরে তুলতে পারত না। তবু পৃথিবীতে যাদের প্রাণশক্তি সবচাইতে বেশি, সেই ঘাসের বিবর্ণ আর কুশের আগার মতো তীক্ষ্ণঅঙ্কুরগুলো ইতস্ততভাবে সমস্ত মাঠখানাকে আকীর্ণ করে রাখত। হাড়-বের-করা গোরুর পাল খিদের জ্বালায় ওখানে খাদ্যের সন্ধান করত। ধারালো ঘাসের আগায় মুখ কেটে গিয়ে টপ টপ করে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ত আর তৃষ্ণার্ত মাটি চোঁ চোঁ করে এক চুমুকে সেই রক্ত শুষে নিত।
সেই মাঠ। বিশ্বকর্মার হাতুড়ির ঘা পড়েছে। দেহাতি মানুষগুলো দূর থেকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। একপাল চখাচখির মতো সাদা সাদা তাঁবু আর খড়ের চালাগুলো যেন ঝাঁক বেঁধে আকাশ থেকে উড়ে পড়েছে ওখানে। রাত্রে বিদ্যুতের ঝলমলে আলো-মায়াপুরী।
ওদেরই দাবি। সামগ্রিক যুদ্ধের দাবি। রোজ পাঁচশো করে ডিম জোগাতে হবে। কোথায় পাওয়া যাবে এত ডিম? পেটের দায়ে তোক হাঁস-মুরগি বেচে খেয়েছে, তিনখানা গ্রাম ঘুরলে এক কুড়ি জোগাড় করা যায় না। মেজাজ যেদিন চড়ে যায় সেদিন প্যারিলাল ভাবে, মানুষ কেন ডিম পাড়তে পারে না? আর ঘোড়া? তা হলে পাঁচশোর জায়গায় পঞ্চাশটা দিয়েই ওদের রাক্ষুসে পেটগুলো ভরানো চলে।
বড়দিন আসছে, হ্যাপি নিউ ইয়ার। ক্রিসমাস কেক চাই, আর চাই নববর্ষের প্রীতিভোজ। সুতরাং ডিমের দাবি দাঁড়িয়েছে এক হাজারে। প্যারিলাল বিড়বিড় করে বকতে লাগল। ডিম যেন তার দিন-রাত্রের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে— আকাশে তারা নেই, শুধু রাশি রাশি জ্যোতির্ময় ডিম ওখানে আলোকবিস্তার করছে। মাটি দিয়ে মানুষ চলছে না, শুধু হাত-পাওয়ালা একদল ডিম মিলিটারি ভঙ্গিতে মার্চ করে চলেছে— রাইট-লেফট, অ্যাবাউট টার্ন, কুইক মার্চ।
খেপে গিয়ে প্যারিলাল হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। কী হয় একরাশ চিল-শকুনের ডিম সাপ্লাই দিলে? কামান আর বোমা যারা অক্লেশে হজম করতে পারে, শকুনের ডিম তো তাদের কাছে নস্যবিশেষ। কিন্তু তাই-বা পাওয়া যাবে কোথায়? রেললাইনের ধারে বসে যে-শকুন কাটাপড়া সাপ আর কুকুরের মাংস নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করত, কিংবা টেলিগ্রাফের তারে যেসব চিল নীচের জলা থেকে মাছের আশায় ধ্যানস্থ থাকত, মিলিটারি টার্গেট প্র্যাকটিসের চোটে তারা প্রায় নির্বংশ হয়েছে। এখন এই দুর্দান্ত দুঃসময়ে মানুষে যদি কিছু কিছু ডিম পাড়তে পারত, তাহলে এই মহাসংকট থেকে উদ্ধার পেত প্যারিলাল।
মেজর সাহেব পিঠ চাপড়ে দিয়ে প্যারিলালকে যেন জল করে দিলে।
ট্রাই, ট্রাই গুড বয়, ট্রাই এগেন।
সাহেবের সামনে নিতান্তই ক্রাই করা যায় না, তাহলে কাপুরুষ বলে বাঙালি জাতির দুর্নাম হবে। ডিমের সন্ধানেই যাত্রা করতে হল।
শীতের বিকেল। সমস্ত আকাশটা যেন মূৰ্ছিত হয়ে আছে মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে। টিপটিপ করে মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়বার চেষ্টা করছে, আবার কনকনে হাওয়ায় জলের বিন্দুগুলো উড়ে যাচ্ছে দিগন্তে। পায়ের নীচে পাশাপড়া ঘাসে যেন তুলোর আঁশ জড়িয়ে রয়েছে। মনে হয় অসহ্য ঠাণ্ডায় শরীরের হাড়-মাংসগুলো সব আলাদা হয়ে যাবে।
পায়ে দুটো মোটা মোটা মোজা পরলে প্যারিলাল। দু-হাতে পুরু দস্তানা। মাফলারটাকে কানে আর গলায় শক্ত করে জড়িয়ে একটা গেরো বাঁধলে বুকের ওপর। তারপর গায়ে চড়াল ফিকে নীল রঙের মোটা ওভারকোটটা। ব্যাস, শীতের সাধ্য কি এইবারে তার কাছে ঘেঁষতে পারে।
ওভারকোটের ওপর সস্নেহে এক বার হাত বুলিয়ে নিলে প্যারিলাল। সত্যিই খাসা জিনিস। কাশ্মীরি ফার, যেমন মোলায়েম, তেমনি গরম। এক বার গায়ে ওঠাতে পারলে বাংলা দেশের শীত তো দূরের কথা, উত্তর মেরুতে গিয়ে অবধি নিশ্চিন্ত থাকা চলে। এই যুদ্ধের বাজারে দুশো টাকা ধরে দিলেও এখন এমন একটা কোট পাওয়া যাবে না। মিলিটারি মাল, একটু কাঁচা বা খেলো কারবার নেই কোনোখানে।
কোটটা পরতে পরতে প্যারিলালের মন অকারণেই অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল। জীবনে কোনো দুঃখই অবিমিশ্র নয়, সব কিছু বিড়ম্বনারই সান্ত্বনা আছে একটা। মেজর সাহেবের বিশ্বগ্রাসী ডিমের ক্ষুধা তাকে বিব্রত করে তোলে বটে, কিন্তু একথাটাও কোনোমতে ভুললে চলবে না যে, এই কোটটা তিনিই তাকে বকশিশ করেছেন। তাঁর কাছে প্যারিলালের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
কিন্তু কোথায় ডিম? আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যটা যদি এখন তার সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলে একটি মাত্র প্রার্থনাই তার করবার আছে। ঐশ্বর্য নয়, ধনসম্পত্তি নয়, চীন দেশের বোঁচা নাক রাজকন্যাও নয়–ডিম দাও প্রভু, ডিম দাও। জোগাড় করতে না পার, পেড়ে দাও। একটা নয়, দুটো নয়, এক কুড়ি নয়, পাঁচ কুড়িও নয়। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি, অবুদ অবুদ—এমন একটা ডিমের পাহাড় খাড়া করে দাও যে, তার চুড়োটা যেন মাউন্ট এভারেস্টের চুড়োকেও ছাড়িয়ে ওঠে। হায় আলাদিন! রক পাখির ডানার সঙ্গে সঙ্গে সে-দিনগুলোও উড়ে গেছে চিরকালের মতো!
একটা কাতর দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্যারিলাল বেরিয়ে এল।
শীতার্ত অনুর্বর মাঠ। ঘাসের তীক্ষ্ণ মুখ ঠাণ্ডায় যেন ছুরির ফলার মতো ধারালো হয়ে আছে। মানুষের খালি পা পড়লে কেটে ফেটে একশা হয়ে যাবে। তবু ওর ভেতর দিয়ে খালি পায়েই হেঁটে যায় মানুষ। তাদের পায়ের তলায় হুক ওয়ার্মের ক্ষতচিহ্ন, চামড়ার রং পোড়া কাঠের মতো কালো, নখগুলো যেন হাতুড়ি দিয়ে হেঁছে দিয়েছে কেউ। এই মাঠের ভেতর দিয়ে তারা হেঁটে যায়, ধারালো ঘাসের আগায় কালো রক্ত শুকিয়ে থাকে।
প্যারিলাল ওরই মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল। তার পায়ে দামি পেটেন্ট লেদারের জুতো, হাঁটু পর্যন্ত টানা পশমি মোজা। পুরু ওভারকোটটার গায়ে হিমের কণা জমছে। ওপরে মেঘলা আকাশটা থমথম করছে যেন ভেঙে পড়বার সূচনায়।
এক ফালি টানা পথ ধরে প্রায় মাইলটাক এগিয়ে এলে গ্রাম; অথবা আগে গ্রাম ছিল। মন্বন্তরের ঝাপটা এখনও মিলিয়ে যায়নি। ধসে-পড়া চালা, পোড়ো ভিটে। মরা মানুষের দীর্ঘশ্বাসেই যেন রাশি রাশি বাঁশের পাতা উড়ে পথটাকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে।
রজনি, ও রজনি! আছ নাকি বাড়িতে?
একটা ছোটো চালার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলে প্যারিলাল। মাটি দিয়ে মসৃণ করে লেপা পুরু দেওয়াল, তার ওপর গেরিমাটির রঙে আঁকা শঙ্খ-পদ্ম-লতা। একদিন সমৃদ্ধি যে ছিল সেকথাই ঘোষণা করছে প্রাণপণে। ওদিকে শণ-ঝরে-যাওয়া চালের ওপর দিয়ে আকাশ উঁকি মারছে আর সেই ফাঁকগুলোর ওপরে খানিকটা ধোঁয়া কিংবা কুয়াশা কুন্ডলী পাকাচ্ছে। ঘরের ধোঁয়াটা বাইরের ভারী হিমার্ত বাতাস ঠেলে বেরুতে পারছে না অথবা বাইরের কুয়াশা সবগুলো একসঙ্গে ভেতরে ঢোকবার জন্যে ঠাসাঠাসি করছে।
বলি, রজনি আছ নাকি?
ঠিকাদারবাবু ডাকছেন। ভেতর থেকে সারদার গলা।
আছি বাবু, আছি। সাড়া দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল বুড়ো রজনি। অনাহারশীর্ণ উদভ্রান্ত চেহারা। হলদে রঙের চোখ দুটো যেন ঘুরছে। থুতনির নীচে খানিকটা বিশৃঙ্খল পাকা দাড়ি, সারা গায়ে একটা শতচ্ছিন্ন ধোকড়া জড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। শীতটা সত্যিই বড়ো বেশি পড়েছে এবার। বুড়োর হাতের আঙুলগুলো কী অস্বাভাবিক নীল।
তারপরে, ভালো আছ তো? একটা চুরুট ধরাতে ধরাতে প্যারিলাল জিজ্ঞেস করল। এটা ভদ্রতার ব্যাপার, আলাপের ভূমিকা।
ভালো? রজনি হাসবার চেষ্টা করল, আমাদের আর ভালো। এখনও মরিনি এইটুকুই যা ভালো বলতে হবে।
ওসব কথা কেন ভাবছ? একটা পা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে প্যারিলাল চুরুটের ধোঁয়া রিং করতে লাগল। যুদ্ধ থেমে যাবে, আবার ফসল উঠবে, সুখশান্তিতে ভরে যাবে দেশ। প্যারিলালের কণ্ঠ যেন দেবদূতের মতো উদাত্ত, তখন আবার এই বাংলা হবে সোনার বাংলা। কথাগুলো প্যারিলালের নিজের কানেই যেন ভালো লাগতে লাগল, বাস্তবিক মাঝে মাঝে সরস্বতী এসে যেন বাণী দেন তার গলায়। একটা স্বর্গীয় দৃষ্টিনিক্ষেপ করে রজনিকে সে অভিভূত করে দেবার চেষ্টা করলে।
কিন্তু রজনি তবু হাসে। দাঁত-ঝরে-যাওয়া মাড়ির ভেতর দিয়ে খানিক কালো হাসি বেরিয়ে এল। সোনার বাংলা? কবে ছিল? বুকের রক্ত জল করে আর চোখের জল না ফেলে দু-মুঠো ভাত কোনোদিন জোটেনি—দশ বছর আগেও নয়। বেগার ছিল, থানার দারোগা ছিল, উচ্ছেদের নোটিশ ছিল। বাড়তির মধ্যে এবার দুঃখের পাত্র পূর্ণ করে দিয়ে দু-মুঠো ভাতও অদৃশ্য হয়েছে। সেই লজ্জা আর অপমান-মেশানো রাঙা বাগড়া চালের ভাত আর লাফা শাকের তেতো চচ্চড়ি, এই কি সোনার বাংলার রূপ? হয়তো হবে!
কিন্তু ঠাণ্ডায় আর দাঁড়াতে পারছে না রজনি। মাঠের ওপার থেকে হাওয়া আসছে, হাড়ের ভেতর বাজছে ঝনঝনানি। গায়ের ধোকড়াটাও যেন বরফে তৈরি। অথচ সামনে দাঁড়িয়ে প্যারিলাল বক্তৃতা দিচ্ছে সোনার বাংলার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। চুরুটের ধোঁয়া চাকার মতো গোল হয়ে তার মাথার চারদিকে যেন স্বর্গীয় দীপ্তিমন্ডল সৃষ্টি করেছে। ফার কোটের রোঁয়ার ওপরে জমেছে হিমের কণা; চিকচিক করে জ্বলছে, যেন অশরীরী জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
তারপর, কিছু ডিমের জোগান দিতে হবে যে।
ডিম! ডিম এখন পাওয়া বেজায় শক্ত বাবু।
তা হলে তো চলবে না। স্বর্গদূত আবার একটা মহিমময় দৃষ্টি প্রক্ষেপ করে রজনিকে বশীভূত করবার চেষ্টা করলে, দামের জন্যে আটকে থাকবে না।
কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে? দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে বাজিয়ে রজনি বললে, আর যে শীত! ঘর থেকে বেরুতে গেলে হাত-পা যেন ফেটে যায়। বৃষ্টিও পড়ছে।
ওই তো, ওই তো। প্যারিলাল ভঙ্গি করল, গায়ে অত বড়ো একটা চটের ধোকড়া, আবার শীত কীসের রে? ব্যাটারা বাবুয়ানি করেই গেলি। নে, আড়াই টাকা করে ডজন পাবি। কাল অন্তত তিন ডজন জোগাড় রাখবি—যেখান থেকে হোক, যেমন করে হোক।
কোটের জ্যোতির্ময় রোঁয়াগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে যেন ধোঁকা লেগে যায় রজনির। শরীরের সমস্ত অঙ্গগুলো অসাড় হয়ে এসেছে, চোখের সামনে ঘুরছে ধোঁয়ার কুন্ডলী।
চেষ্টা করব বাবু।
চেষ্টা নয়, চাই-ই চাই। মনে থাকে যেন। ভারী জুতোর শব্দ করে প্যারিলাল চলে গেল।
ঘরের মধ্যে সারদা ছেলেমেয়ে নিয়ে বিব্রত হয়ে আছে। বছর আটেক ছেলেটার বয়েস–ম্যালেরিয়ায় চুষে নিংড়ে খেয়েছে তাকে। পেটের পিলেটা এমন ফুলেছে যে, আশঙ্কা হয় একদিন ওটা তাকে হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ক্যালশিয়ামের অভাবে অপুষ্ট হাড়গুলো প্যাঁকাটির মতো শীর্ণ, হঠাৎ একটুখানি ঘা লাগলে যেন মট করে ভেঙে যেতে পারে। একটা ছেড়া চট জড়িয়ে সেও থরথর করে কাঁপছে। মাঝে মাঝে মাটির একটা মালসা থেকে খানিক শুকনো ভাত থাবায় থাবায় মুখে পুরছে। ম্যালেরিয়ায় পথ্যই বটে।
কঙ্কালসার বুকের মধ্যে কাশছে মেয়েটা। মায়ের বুক শুকনো, চুষলে দুধ তো দূরে থাক, একবিন্দু রক্তও বেরিয়ে আসে না বোধ করি। ছেড়া কাপড়ের আঁচলে সারদার শীত কাটছে না, তবু গায়ের গরম দিয়ে সে কোনোমতে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে। রজনির পুত্রবধূ সারদা। ছেলে নিবারণ শহরে গেছে রিকশা টানতে। আধিতে যা পেয়েছিল তাতে দু দিনও পেট চলে না। তাই শহর তাকে টেনে নিয়ে গেছে আজ দু-মাস। এ পর্যন্ত কোনো খবর নেই।
ঘরে ঢুকে একটা বিড়ি ধরাল রজনি। ধোকড়ার নীচে পরলে ছেড়া জামাটা, তবু শীত কাটে।
এক মালসা আগুন করবি বউ? শীতে যে জমে গেলাম।
আগুন? কী দিয়ে জ্বালব? সারদা ঝলসে উঠল।
ওই তো খড়ি আছে, খুঁটে আছে।
খড়ি আছে, ঘুটে আছে। সারদা ভেংচে উঠল, শ্বশুরের সম্মান রাখবার মতো গলার আওয়াজটা তার নয়। দিনে সব পুড়িয়ে শেষ করে দিলে রাত্তিরে কী হবে তখন। বাচ্চাকাচ্চাগুলো একটাও বাঁচবে না।
দুর্বল স্থবির দেহে যতটা সম্ভব শিখায়িত হয়ে ওঠবার চেষ্টা করলে রজনি!
কেন, বসে বসে নবাবি না করলে চলে না? দুটো খড়ি কুড়িয়ে রাখতে পারিসনে হারামজাদি!
ভাঙা কাঁসরের মতো গলায় অদ্ভুত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল সারদা, যেন প্রেতিনির আর্তনাদ।
খড়ি! খড়ি আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়, তাই না! তুমি মরলে চিতেয় দেবার জন্য খড়ি কুড়িয়ে রাখব।
বটে, বটে!
অসহ্য ক্রোধে রজনি কাঁপতে লাগল, একটা-কিছু করে ফেলবে—একটা কোনো ভয়ানক কান্ড। কিন্তু কিছুই করলে না, শুধু ধোকড়াটা গায়ে জড়িয়ে শিথিল গতিতে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল।
এখন কোথায় চললে আবার?
মরতে। রজনি চলে গেল। দরজার ওপার থেকে বললে, চিতার কাঠ জোগাড় রাখিস।
বাইরে শীত পাথরের মতো পৃথিবীর বুকে চেপে বসেছে। মেঘলা আকাশে ধোঁয়ার মতো আরও মেঘ জমে উঠছে, পান্ডুর অন্ধকার যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আড়ষ্ট পায়ে রজনি এগিয়ে চলল, ফাটা পা থেকে রক্ত চুইটে চুইয়ে পড়তে লাগল ক্ষুধার্ত বন্ধ্যা মাটিতে।
রজনি ফিরল যখন, তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়েছে। সন্ধান বৃথা হয়নি। তিনখানা গ্রাম ঘুরে দু কুড়ি ডিম জোগাড় হয়েছে। ঠিকাদারবাবুর নামের মহিমা আছে। হাঁস-মুরগিগুলো পর্যন্ত খুশি হয়ে ডিম পাড়তে লেগে যায় যেন। ডজনপ্রতি তিন গন্ডা পয়সাও যদি প্যারিলাল তাকে কমিশন দেয়, তাহলে কমসে কম অন্তত দশ আনাতে এসে দাঁড়াত।
দশ আনা পয়সা, তিন-চারটি প্রাণীর এক বেলার খোরাক। প্যারিলালের অনুগ্রহ আছে। তার ওপরে, অস্বীকার করলে অধর্ম হবে। মাঝে মাঝে বাঁকা চোখে সারদার দিকে তাকায়, তা নইলে আপত্তি করবার বিশেষ কিছুই ছিল না।
কিন্তু দশ আনা পয়সা। তারজন্যে অনেকখানি খেসারত দিতে হয়েছে। পা দুটো জমে অসাড় হয়ে আছে, শুধু ফাটা জায়গাগুলো থেকে এক-একটা তীব্র জ্বালা বিদ্যুৎচমকের মতো শিউরে দিচ্ছে সমস্ত শরীরকে। ঠাণ্ডায় নাক দিয়ে জল পড়ে মুখটাকে ভাসিয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে চোখের জলও হয়তো মিশে রয়েছে খানিকটা।
ঘরে ঢুকেই কিন্তু মনটা খুশি হয়ে উঠল।
গনগনে আগুন জ্বালিয়েছে সারদা। বাইরের জগতের শীতজৰ্জর নিষ্ঠুরতার হাত থেকে যেন স্বর্গলোকে প্রবেশ। একটু আগেকার কুশ্রী কলহের কথা মনেও রইল না। লোভীর মতো আগুনের পাশে বসে পা দুটোকে মেলে দিলে রক্তিম শিখাগুলোর ওপরে।
টকটকে লাল আগুন—রক্তের মতো রং। মানুষের বুক থেকে যে-রক্ত শুকিয়ে গেছে তা রূপায়িত হয়েছে আগুনে। সমস্ত ঘরটা লাল ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। সারদার মুখটাকে দেখাচ্ছে অদ্ভুত আর অপরিচিত। পা দুটোকে আগুনের ওপর ধরে দিয়ে চুপ করে বসে রইল রজনি। অন্য সময় হলে পুড়ে ফোসকা পড়ে যেত, কিন্তু এখন এত বড়ো আগুনটাকেও যেন মনে হচ্ছে যথেষ্ট গরম নয়।
সারদা জিজ্ঞেস করল আস্তে আস্তে, পেলে ডিম?
হ্যাঁ, দু-কুড়ি। ভালো করে রেখে দে, সকালে ঠিকাদারকে দিতে হবে। দশ আনা পয়সা মিলবে।
ম্যালেরিয়াজীর্ণ ছেলেটা এক কোণ থেকে ঘ্যানঘ্যান করে উঠল, মা, আমি ডিম খাব।
খবরদার, খবরদার! রজনি হঠাৎ বাঘের মতো গর্জে উঠেছে, ডিম খাবে! একটা ডিম ছুঁয়েছিস কি মাথা দুখানা করে দেব।
ছেলেটার ঘ্যানঘ্যানানি তবু থামে না। অসুখে ভুগে ভুগে অসম্ভব লোভ বেড়ে গেছে। চোখ দুটো জ্বলছে ক্ষুধার্ত শেয়ালের মতো।
মা, আঁমি ডিঁম খাঁ—ব…
সারদা ছেলেকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে এল সস্নেহে। না বাবা, ডিম খায় না। গরিবের ডিম খেতে নেই।
রজনি চুপ করে রইল। মনটা ভারী হয়ে গেছে। গরিবের ডিম খেতে নেই। শুধু ডিম? কিছুই খেতে নেই। গরিব যদি খেতে পায় তাহলে পৃথিবী চলবে কেমন করে? সব ওলটপালট আর বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে যে।
ছেলেটা তবু কাঁদছে। রজনির হাত নিশপিশ করে, একটা-কিছু করতে চায়। ইচ্ছে করে গলা টিপে ওটাকে থামিয়ে দেয় একেবারে। খেতে চায়, কেন খেতে চায়? কার কাছে খেতে চায়? শুকিয়ে মরে যেতে পারে নিঃশব্দে? নিজেও বাঁচে, পৃথিবীরও হাড় জুড়িয়ে যায়।
একটা মালসায় করে খানিকটা কড়কড়ে ভাত আর শাকচচ্চড়ি নিয়ে এল সারদা, খেয়ে নাও।
ঠাণ্ডা আধপচা ভাত, তেতো শাকের ঘণ্ট। গলা দিয়ে একগ্রাস নামে তো পেটের ভেতর থেকে শীতের প্রচন্ড শিহরণ উঠে মাথা পর্যন্ত ঝাঁকিয়ে দেয়—দাঁতে দাঁতে খট খট করে বাজতে থাকে। কেন কে জানে, ডিমগুলোর ওপরে দুর্দান্ত একটা লোভ এসে রজনির মনকেও আচ্ছন্ন করে দিলে। কতদিন সে ডিম খায়নি।
কিন্তু না। ঠিকাদারবাবুর জোগান। সাহেবদের নতুন বছর আসছে, তাদের উৎসব হবে, খানাপিনা হবে। ওদিকে দৃষ্টি দিলেও মহাপাতক। থাবায় থাবায় অখাদ্য ভাতগুলো গলার মধ্যে ঠেলে দিতে লাগল রজনি। অসহ্য শীতে পেটটা মোচড় দিচ্ছে, ঠেলে বমি উঠে আসছে যেন।
ছেলেটি আবার প্যানপ্যান করে উঠল, ডিম… কোথা থেকে কী হয়। রজনির মাথার মধ্যে রক্ত চড়ে গেল। ভাতের মালসাটাকে ছুড়ে ফেলে দিল দূরে, তারপর বিদ্যুতের মতো দাঁড়িয়ে উঠল। নিজের অতৃপ্ত লোভের জ্বালাটা বিস্ফোরকের মতো ফেটে পড়েছে, একটা অবলম্বন পেয়েছে সে।
দাঁতে দাঁতে পিষে রজনি বললে, ফের ডিম? আজ তোকে খুন করে ফেলব।
মুহূর্তে একটা হ্যাঁচকা টানে রজনি ছেলেটাকে কাছে টেনে নিয়ে এল, তারপর নীল একটা হিমার্ত থাবা ছেলেটার গলায় বসিয়ে দিলে নির্মমভাবে। মেরে ফেলবে।
আর্তকণ্ঠে সারদা চিৎকার করে উঠল, কী করছ?
লাল আগুনে রজনির চোখ ভয়ংকর দেখাচ্ছে। আগুনের চাইতেও বেশি করে জ্বলছে সেটা। শেষ করে দেব।
ছাড়ো, ছাড়ো, মরে যাবে যে।
মরুক।
কঠিন হাতের চাপে ছেলেটার চোখ বেরিয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো ছুটে এল সারদা, ঘরের কোণ থেকে লোহার শাবলটা তুলে নিয়ে প্রাণপণে ঘা বসাল রজনির মাথায়। অস্ফুট একটা কাতর আর্তনাদ। ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে রজনি তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ল, ছিটকে পড়ল আগুনের ওপর। সমস্ত ঘরময় আগুন ফুলঝুরির মতো ছড়িয়ে গেল।
সারদা দাঁড়িয়ে রইল বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে। কী করবে কিছু বুঝতে পারছে না। ছেলেটা নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে মাটিতে, আর আগুনের শয্যায় মাথা রেখে তেমনি নিঃসাড় হয়ে শুয়ে আছে রজনি। গায়ের ধোকড়াটা জ্বলে উঠেছে। মরা সাপ পুড়বার সময় যেমন অন্তিম আক্ষেপে মোচড় দেয় শরীরটাকে, তেমনিভাবে একটা অসহায় চেষ্টা করেই রজনি স্থির হয়ে গেল। সারদা হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, রজনির দাড়িটা পুড়ছে—ফটাস করে একটা শব্দ হয়ে খইয়ের মতো ফুটে উঠেই গলে গেল তার বিস্ফারিত ডান চোখটা। মানুষপোড়া গন্ধ কী বিশ্রী। মাঠের ওপারে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে প্যারিলাল দেখতে লাগল— সমস্ত গ্রামটা জ্বলছে, এই দারুণ শীতে আগুন পোয়াচ্ছে যেন! আর এত দূরে দাঁড়িয়েও হঠাৎ তার অত্যন্ত গরম লাগতে লাগল, কাশ্মীরি ফারের কোটটা বড়ো বেশি গরম।