খড়গ

পাঁচ সের চুনের বায়না। ভোমরার হাতখানা একটু বেশি পরিমাণে ছুঁয়েই এক টাকার নোটখানা গুঁজে দিয়েছে হরিলাল। চমকে ভোমরা তিন-পা পিছিয়ে গেছে, নোটখানা উড়ে গেছে হাওয়ায়। মৃদু হেসে সেখানা কুড়িয়ে এনে চালের বাতায় রেখে দিয়েছে হরিলাল। তির্যক কটাক্ষ হেসে বলেছে, মনে থাকে যেন, সাত দিন পরেই কিন্তু বিয়ে।

হরিলাল গ্রামের তালুকদার। জমি আছে, পয়সা আছে, কারবার তো আছেই। যুদ্ধের বাজারে আরও কতদূর কী করেছে ভগবানই জানেন। সুতরাং কুড়ি টাকার চালের দিনেও সে ভালো করেই মেয়ের বিয়ে দিতে চায়। অনেক বরযাত্রী আসবে, গাঁয়ের বহু লোকের পাত পড়বে তার বাড়িতে। পাঁচ সের চুনের কমে এত বড় একটা ক্রিয়াকান্ড হওয়া শক্ত। সেরপ্রতি আট আনা দর সে দিতে চায়, সুতরাং ভোমরাকে একটু বেশি করে স্পর্শ করবার অধিকার তার নিশ্চয় আছে।

কিন্তু ভোমরা ছেলেমানুষ। অধিকার অনধিকারের ব্যাপারগুলো এখনও সে ভালো করে বুঝতে পারে না। হরিলালের লোলুপ চোখ আর অনুভূতিপ্রখর স্পর্শে তার সমস্ত শরীর শিরশির করে শিউরে উঠল। খেতু বাড়িতে নেই, দূরের ইষ্টিশনে সওয়ারি নামিয়ে দিতে গেছে। এমনসময় হরিলালের আবির্ভাবটা তার ভালো লাগল না। সংকীর্ণ জীর্ণ কাপড়ের প্রান্ত আকর্ষণ করে ঘোমটা দেবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করল।

হরিলাল চেহারায় খাটো। হালে ঠিক ব্রহ্মতালুর ওপরে চিকচিকে একটা টাক নিশানা দিয়েছে। মোটা আর ছোটো ছোটো হাত-পা। আঙুলগুলো সবসময় চঞ্চল, কখনো স্থির থাকতে পারে না। মনে হয় তারা যেন সদাসর্বদা কী-একটা আঁকড়ে ধরবার চেষ্টায় আছে। এক বার পেলে আর ছাড়বে না, লোলুপ মুষ্টির ভেতরে নিঃশেষে সেটাকে নিষ্পেষিত করে ফেলবে। এক হিসাবে অনুমানটা নির্ভুল। হরিলালের হাতের ভেতর যা এক বার এসে পড়েছে তাকে আর কখনো সে ছাড়েনি—খত নয়, জমি নয়, নারীও নয়।

হরিলাল চলে গেলে ভোমরা আরও কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এ গাঁয়ের অন্যান্য ভুইমালী মেয়েদের মতো চুন সেও তৈরি করে কিন্তু আর-সকলের মতো কখনো হাটে বিক্রি করতে যায় না। খেতুই যেতে দেয় না তাকে। ভোমরাকে বিয়ে করেছে এই সেদিন, এখনও নেশা কাটেনি। একহাট লোকের ক্ষুধিত দৃষ্টির সামনে বসে সে বেচাকেনা করবে, ভুইমালীর ছেলে খেতুও এটাকে বরদাস্ত করতে পারে না।

কিন্তু পাঁচ সের চুনের বায়না তাকে নিতেই হবে। ধানের দর এবারেও গত বৎসরের মতো বেড়ে চলেছে ধাপে ধাপে। এ জেলাটা পুরোপুরি দুর্ভিক্ষের এলাকায় পড়ে না, তবু ঘটিবাটি আর রুপোর খাড় বিক্রি করে গতবছর পেটের দাবি মেটাতে হয়েছে। খেতুর জমি নেই, আধিও নেই, সওয়ারি বয়ে দিন কাটে। গাড়িভাড়া পাঁচ থেকে দশ টাকায় উঠেছে বটে কিন্তু জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে পাঁচগুণ। যথাসর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে গেল বছর ওর বর্ষা কালের ধকল সামলে নিয়েছে, কিন্তু সে-দুর্দিন যদি এবারেও দেখা দেয় তাহলে প্রাণ বাঁচানোর কোনো পথই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সওয়ারি বয়ে খেতু যখন গ্রামের কাছাকাছি এসে পৌঁছোল, বেলা তখন দুপুর। শান দেওয়া ছুরির মতো রোদ ঝলকাচ্ছে মাথার ওপর। নির্মল আকাশে প্রখর রোদ যেন সমস্ত পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে—হঠাৎ তাকালে চোখে ধাঁধা লেগে যায়, মনে হয় পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি সবটা যেন জ্বলন্ত একটা কাঁসার পাত দিয়ে মোড়া। জ্যৈষ্ঠ শেষ হয়ে যায় অথচ মেঘের চিহ্ন নেই কোথাও। দূরে বাবলা গাছগুলোর অপ্রচুর পাতা রোদের তাপে ঝলসে ঝরে পড়েছে, যেন আগুনে পোড়া কতগুলো এলোমেলো ডালপালা শস্যহীন মাঠের মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে।

ময়লা গামছায় কপালের ঘাম মুছে প্রাণপণে শাটা হাঁকড়ালে খেতু। ডাঁ-ডাঁ-ডাঁহিন। অস্থিসার গোরুর পাতলা চামড়ার ওপর শাঁটার দগদগে রক্তচিহ্ন ফুটে উঠেছে একটার পর একটা। বাঁ-দিকের গোরুটার কাঁধের ওপর জোয়ালের ঘষায় অনেকখানি জায়গা নিয়ে ঘা হয়ে গেছে, সেখান থেকে এখন ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে রক্ত। ডাঁশের দল সেখানে পরমানন্দে ভোজের আসর বসিয়েছে, আর মর্মান্তিক যন্ত্রণায় গোরুটা এক-এক বার থমকে থেমে দাঁড়িয়ে পড়বার চেষ্টা করছে।

কিন্তু গোরর প্রতি দরদের চাইতে প্রয়োজনের তাগিদ অনেক বেশি। ভোর বেলা সওয়ারিকে ইংরেজবাজারের রেলগাড়িতে তুলে দিয়ে খেয়েছে চার পয়সার লাহরি, আর খেয়েছে টাঙ্গন নদীর একপেট জল। অসহ্য খিদেয় নাড়িভুড়িগুলো জড়াজড়ি করছে একসঙ্গে। রাত্রিজাগরণক্লান্ত চোখের পাতাদুটো অস্বাভাবিক ভারী হয়ে উঠেছে। আড়ষ্ট একটা আচ্ছন্নতায় শরীর ঢুলে পড়তে চাইছে, কিন্তু ডাঁশ তাড়াবার জন্যে ব্যর্থকাতর গোরুর লেজের ঘা চটাস চটাস করে চাবুকের মতো পায়ে লাগতেই চটকা ভেঙে যাচ্ছে। স্বপ্নের মতো মনে পড়ছে ঘরে ভোমরা ভাত বেড়ে নিয়ে তার প্রতীক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

ডাঁ-ডাঁ-ড্ডাঁহিন মহামাই—শাঁটা উদ্যত করেই খেতুর হাত নেমে এল আপনা থেকে। সত্যিই কষ্ট হয় গোরু দুটোর দিকে তাকালে, দু-বছর আগে কী চেহারা ছিল ওদের, আর কী হয়ে গেছে। খেতে পায় না। যে-গোরু আগে এক দমে পনেরো ক্রোশ পথ অক্লেশে পাড়ি দিয়ে যেত, তারা আজকাল তিন ক্রোশ রাস্তা না হাঁটতেই এমন করে ঝিমিয়ে আসে কেন তার খবর খেতুর চাইতে বেশি করে আর কে জানে!

সামনে তালদিঘি। আমের বন, মহুয়ার গাছ, তালের সারি। এতক্ষণে যেন চোখ জুড়িয়ে গেল। তালদিঘির কালো  জল অপরিসীম স্নিগ্ধতায় যেন ডাকছে হাতছানি দিয়ে; ঠিক যেন ভোমরার শান্ত দুটি কালো চোখের মতো। জল আর ছায়ার ছোঁয়ায় বাতাসের স্পর্শও মধুর আর শীতল হয়ে উঠেছে। এইখানে গাড়িটাকে খানিকক্ষণ জিরেন দিলে মন্দ হয় না। অন্তত বলদ দুটোকে একটু জল খাওয়ানো দরকার।

একপাশে মুচি পাড়া। এখানে এসে খেতু মাঝে মাঝে আড্ডা দিয়ে যায়, নীলাই মুচির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বহুকালের। এখানে এসে গাড়ি থামানোর পিছনে সে-আকর্ষণটাও আছে, অন্তত এক ছিলিম তামাক টেনে যাওয়া চলবে।

জোয়াল নামিয়ে প্রথমে বলদ দুটোকে ছেড়ে দিলে খেতু। তারপর বালতি করে জল নিয়ে এল তালদিঘি থেকে। গোরুগুলো এক নিশ্বাসে সে-জল নিঃশেষ করে দিলে। বুকের ভেতরটা তৃষ্ণায় যেন শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে ওদের। ততক্ষণ গাড়ির পেছন থেকে কয়েক আঁটি পোয়াল টেনে নামিয়েছে খেতু, কৃতজ্ঞ এবং বেদনার্ত চোখে তার দিকে এক বার চেয়ে অনিচ্ছুকভাবে ওরা চিবুতে শুরু করে দিলে। ভাবটা এই— শুকনো খড় যে এখন গলা দিয়ে নামতে চায় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল খেতুর। খইল, ভুসি, কলাই ডালের খিচুড়ি, সেসব এখন গতজন্মের স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষই না-খেয়ে মরে যাচ্ছে তো গোরু। আস্তে আস্তে সে এসে মুচিপাড়ায় পা দিলে।

ঘরের দাওয়াতেই নীলাই বসে আছে। মাথার চুলগুলো বড়ো বড়ো, চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত। বললে, মিতা যে, আয় আয়। তালদিঘির পাড়ে দেখলাম গাড়ি থামল একখানা। তোর গাড়ি যে বুঝতে পারিনি।

আশ্চর্য নিরুৎসুক কণ্ঠ নীলাইয়ের। কথা বলছে যেন নিজের সঙ্গে নিজের মনে মনেই। তার কথার কোনো লক্ষ্য বা উপলক্ষ্য নেই। সে খেতুর দিকে তাকিয়ে আছে কিংবা তার পেছনে তালদিঘির দিকে অথবা তারও পেছনে রৌদ্রঝকিত দিগন্তের দিকে, কিছুই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না যেন।

সবিস্ময়ে খেতু বললে, তোর কী হয়েছে মিতা?

আমার? অত্যন্ত শূন্য খানিকটা হাসি হাসল নীলাই, আমার কিছু হয়নি।

কিছু হয়নি তো অমন করে বসে আছিস কেন?

নীলাই আবার তেমনিভাবে তাকাল খেতুর দিকে, অথবা খেতুর ভেতর দিয়ে লক্ষ্যহীন সীমাহীন অনিশ্চিত কোনো একটা দিগন্তের দিকে। বললে, ঘরে একরত্তি চামড়া নেই, কাল থেকে হাঁড়ি চড়েনি। বউকে পাড়ায় পাঠিয়েছি চালের চেষ্টায়, আর বসে বসে ভাবছি মানুষ না হয়ে যদি গোরু ঘোড়া হতাম তাহলে মাঠের ঘাসপাতা খেয়েও বেঁচে থাকা চলত।

এক ছিলিম তামাক চাইবার কথা খেতুর আর মনে পড়ল না। তার ঘরে আজও খাবার আছে, কিন্তু দু-দিন পরে তার অবস্থাও যে এমন দাঁড়াবে না কে বলতে পারে! ধানের দর তো বেড়েই চলেছে। নীলাইয়ের পাশে বসতে তার ভয় করতে লাগল। কী অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে নীলাই, যেন মরা মানুষের চোখ। সে-চোখ দুটো ক্রমাগত বলছে…

খেতু দাঁড়িয়ে উঠল। কোনো কথা তার মনে এল না—একটা সান্ত্বনা নয়, একটা আশ্বাসের বাণীও নয়। অত্যন্ত অসংলগ্নভাবে বললে, আমি যাই।

যাবি? দুটো টাকা দিয়ে যা মিতা। সওয়ারি বয়ে এলি, ভাড়ার টাকা নিশ্চয় পেয়েছিস। কাল শোধ দিয়ে দেব, আজই কিছু চামড়া আসবার কথা আছে।

চামড়া আসবে কি না অথবা কাল টাকা সে সত্যিই শোধ দেবে কি না সে-জিজ্ঞাসা খেতুর মনে হল না। আপাতত যেন এই লোকটার হাত থেকে সে নিষ্কৃতি চায়। ট্যাঁক থেকে দুটো টাকা বের করে নীলাইয়ের হাতে তুলে দিলে খেতু।

কালো কালো ময়লা দাঁত বের করে নীলাই খানিকটা নির্জীব হাসি হাসল। বললে, বাঁচালি মিতা। কাল ঠিক শোধ দিয়ে দেব কিন্তু।

দিঘির পাড়ে দুটো বলদ কার? তোর বুঝি?

হ্যাঁ, আমার।

ইস, কী চেহারা ও-দুটোর! নীলাইয়ের ধোঁয়াটে মৃত চোখ দুটো যেন পলকে জীবন্ত হয়ে উঠল। ওরা তো আর বেশিদিন বাঁচবে না। যদি মরে যায়, চামড়া দুটো আমাকে দিস তাহলে। ভুলে যাসনি যেন। দিবি তো?

মুহূর্তের মধ্যে ক্রোধে আর আতঙ্কে খেতুর সমস্ত শরীরটা শক্ত হয়ে উঠল। ইচ্ছে হল, যে টাকা দুটো দিয়েছিল, থাবা দিয়ে তা নীলাইয়ের হাত থেকে কেড়ে নেয় আর শাঁটা দিয়ে সপসপ করে ঘা-কতক বসিয়ে দেয় অলক্ষুণে লোকটার মুখের ওপর।

কিন্তু খেতু কিছুই করল না। সোজা শনশন করে হেঁটে এল, জোয়ালে জুড়ে দিল গোরু। নীলাইয়ের চোখের আওতা থেকে পালাতে হবে, যত তাড়াতাড়ি হোক, যেমন করে হোক। বলদ দুটো হাঁটতে চায় না, থেমে থেমে দাঁড়ায়। কাঁচা মাটির পথের ধারে যে অপরিপূর্ণ বিবর্ণ ঘাস উঠেছে, কালো কালো শীর্ণ আর লম্বা জিভ মেলে সেগুলো খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু খেতুর এবার আর রাগ হল না, বিরক্তি হল না এতটুকুও। কী চেহারা হয়ে গেছে এমন নতুন আর জোয়ান গোরুর, ওদের দিকে তাকাতেও ভয় করে এখন। হয়তো এক বার হাঁটু ভেঙে পড়লে আর উঠতেই পারবে না। হাতের উদ্যত শাঁটা পাশে নামিয়ে সে পরমযত্নে গোরুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, কোমল শান্ত গলায় আদর করতে লাগল, লক্ষী আমার, সোনা আমার।

যেমন করে হোক মন খানেক খইল এবার জোগাড় করতেই হবে।

বাড়ির দরজায় ফিরে সে শিকপায়া মেরে গাড়ি থামাল। আর ওদিকের ডোবার ঘাট থেকে ভিজে কাপড়ে সামনে এসে দাঁড়াল ভোমরা।

অপ্রসন্নতায় ভারী হয়ে উঠল খেতুর মন। বিশ্বাস নেই ভোমরার রূপকে। ভিজে কাপড়ের নেপথ্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে অপরূপ দেহকান্তি—যার চোখে পড়বে, সঙ্গে সঙ্গে তারই নেশা ধরে যাবে।

এখন আবার চান করলি যে? এই অবেলায়?

ঝিনুক কুড়তে গিয়েছিলাম।

ঝিনুক কুড়তে! খেতুর কপাল উঠল রেখাসংকুল হয়ে, আরও বেশি অস্বস্তিতে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আজকে ঝিনুক দিয়ে কী হবে?

হরিলাল টাকা দিয়ে গেছে। পাঁচ সের চুনের বায়না।

হরিলাল। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বিরক্তি ঝিমিয়ে পড়ল, ধুলোপড়া-খাওয়া সাপের মতো মাথা নত করল যা-কিছু উত্তেজনা। নামটার যাদু আছে। হরিলাল দাস এ গ্রামের শুধু মোড়ল নয়, মন্ডলেশ্বর; মহারাজ চক্রবর্তী বললেও অত্যুক্তি হবে না কথাটা। উপকার কী করে বলা শক্ত, তবে অপকারের ক্ষমতা যে তার সীমানাহীন এ সম্বন্ধে কোনো প্রমাণপ্রয়োগই দরকার হয় না। এহেন হরিলাল ঘটা করে মেয়ের বিয়ে দেবে, উপচার অনুষ্ঠানে এতটুকুও ফাঁক রাখবে না কোথাও। পাঁচ সের চুনের বায়না না নিয়ে উপায় কী।

ও। কিন্তু তুই যে খেটে মরে যাবি বউ।

ভোমরা মৃদু হাসল, বিস্বাদ নিরানন্দ হাসি। তারপর কাপড় ছাড়বার জন্যে চলে গেল ঘরের ভেতর। অসীম ক্লান্তিতে দাওয়ার একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়ল খেতু।

খিদেয় মরে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি দুটি খেতে দে ভোমরা।

একটা মাটির ঘটিতে করে  জল আর কচুপাতায় খানিকটা নুন এনে ভোমরা রাখল খেতুর পাশে। সেদিকে তাকিয়ে আপনা থেকেই খেতুর দীর্ঘশ্বাস পড়ল। কাঁসা আর পিতল যা ছিল সব বন্ধক গেছে, ঘরের লক্ষী আর কোনোদিন ঘরে ফিরবে না।

ওদিকে রান্নাঘরের ঝাঁপ খুলেই ভোমরা থেমে দাঁড়াল, আর নড়ে না।

কী রে, হল কী?

কী জবাব দেবে ভোমরা? পেছন দিকের জিরজিরে বেড়া ফাঁক করে কখন ঘরে ঢুকেছিল কুকুর। হাঁড়ি-কলসি সব ভেঙে একাকার করে দিয়েছে, রাশি রাশি ভাত আর ডাল ছড়িয়ে রয়েছে ঘরময়। ডাল-মেশানো কর্দমাক্ত মাটিতে এখনও ফুটে রয়েছে কুকুরের নোংরা পায়ের এলোমেলো থাবার দাগ। ঝিনুক আনতে যখন সে বিলের দিকে গিয়েছিল, সেই ফাঁকেই কখন…

ব্যাপারটা দেখে খেতুও স্তব্ধ হয়ে রইল। দোষ নেই কারোরই—পাঁচ সের চুনের বায়না দিয়ে গেছে হরিলাল। ভোমরাকে কষে একটা লাথি মারবার জন্যে হিংস্র একটা পা তুলেই নামিয়ে নিলে খেতু। এক মুহূর্ত জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললে, বেশ।

বিবর্ণ পাড়ুর মুখে ভোমরা বললে, তুমি বসো, আমি আবার চারটি…

থাক থাক, চাল সস্তা নয় অত। কত লোক না খেয়ে মরে যাচ্ছে, খবর রাখিস তার?

মনের সামনে নীলাই এসে দেখা দিল। মড়ার মতো দুটো দৃষ্টিহীন চোখ, অথচ অদ্ভুত দূরপ্রসারী দৃষ্টি মেলে যেন কিছু-একটা বলার চেষ্টা করছে। যেন তার সর্বাঙ্গ ঘিরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটা অশুভ অভিশাপের ইঙ্গিত। এ কি সেইজন্যেই?

ট্যাঁকে টাকা আছে তিনটে, তাড়ির দোকানও ভোলা আছে এখনও—যেখানে সমস্ত ক্ষুধা তৃষ্ণার নির্বাণ, যেখানে অনায়াসে সমস্ত শ্রান্তি-ক্লান্তিকে ভুলে থাকা চলে। হনহন করে খেতু বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

ঘরের খুঁটি ধরে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে রইল ভোমরা। সারাদিন তার পেটেও কিছুই পড়েনি। নদীর ধারের গরম বালিতে পায়ের নীচে ফোসকা পড়ে যায়, বিলের ওপরে রৌদ্রতপ্ত আকাশ যেন হাড়-মাংস একসঙ্গে সেদ্ধ করতে থাকে। খেতুর জন্যে নাহয় তাড়ির দোকান খোলা আছে, কিন্তু তার? ভোমরার চোখ ফেটে জল নয়— মনে হল টপ টপ করে কয়েক বিন্দু টাটকা রক্ত গড়িয়ে পড়বে।

উঠোনে স্তুপাকার ঝিনুক। খানিকটা স্যাঁৎসেঁতে আঁশটে গন্ধ খালি ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।

রাত্রেই আবার সব সহজ হয়ে গেল। তাড়ির নেশা অদ্ভুতভাবে বদলে দিয়েছে খেতুকে। স্নেহ আর আবেগে সমস্ত মনটা কোমল আর আবেশবিহ্বল হয়ে উঠেছে। সোহাগে সোহাগে ভোমরাকে অস্থির করে দিয়ে জড়িত গলায় বললে, রাগ করিসনি বউ, রাগ করিসনি। তোকে কত ভালোবাসি আমি।

পরের দিন বেলা উঠবার আগেই বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া করে বেরোল খেতু। রোহনপুরের হাটে কিছু মাল পৌঁছে দিতে হবে। মনপ্রতি বারো আনা দর ধরে দিয়েছে মহাজন। আধ সের চালের ভাত খেয়ে পরম পরিতৃপ্তিতে একটা বিড়ি ধরাল, তারপর অনেকক্ষণ ধরে সপ্রেম চোখে তাকিয়ে দেখল ভোমরাকে।

তোর জন্যে হাট থেকে কাপড় কিনে আনব বউ।

ভোমরা মৃদু ক্লান্ত রেখায় হাসল। কালকের জের আজও শরীরের ওপর থেকে মেটেনি।

কোনোখানে যেন আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই এতটুকুও।

ফিরবে কখন?

ভোরের আগেই। সাঁঝ রাত্তিতে ওখান থেকে গাড়ি জুড়ে দিলে এই ক-কোশ হাঁটা আর কতক্ষণ। তুই কিন্তু তাই বলে রাত জেগে বসে থাকিসনে।

খেতু গাড়ি নিয়ে চলে গেল। রান্নাঘরের ভাঙা জায়গাটা পিঁড়ি আর ইট দিয়ে বন্ধ করে ভাতের হাঁড়িটা শিকেয় তুলে রেখে ভোমরাও উঠোনে এসে দাঁড়াল। আরও অন্তত দু-তিন সাজি ঝিনুক দরকার। কাল থেকেই পোড়ানো শুরু করতে হবে।

খেতু বাড়িতে আছিস?

হরিলালের গলা। ভোমরা ত্রস্ত হয়ে ঘোমটা টেনে দেওয়ার আগেই হরিলাল বাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। খেতু নেই বাড়িতে?

ভোমরা মাথা নেড়ে জানালে, না। হরিলাল কিন্তু চলে গেল না। নিজেই একটা চৌপাই টেনে নিয়ে জাঁকিয়ে বসল ঘরের দাওয়াতে। চুনের কথা ভুলে যাসনি তো?

না।

ভুলিসনি। তোর ওপর ভরসা করে বসে আছি। বিয়ের দিনে যাবি কিন্তু আমার বাড়িতে। খেটেখুটে আর খেয়ে-দেয়ে আসবি।

ভয় আর অস্বস্তিতে ভোমরা চঞ্চল হয়ে উঠল। হরিলাল বড়ো বেশি তীব্র আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ওর দিকে। গলার স্বরে বড়ো বেশি কোমলতার আমেজ লেগেছে। পুরুষের ওই চোখ আর কণ্ঠস্বরের অর্থ বুঝতে এক মূহূর্তের বেশি সময় লাগে না মেয়েদের। সঙ্গে সঙ্গে কী-একটা বোগাযোগে ভোমরার অপাঙ্গ চোখ গিয়ে পড়ল হরিলালের হাতের ওপর। মোটা মোটাআঙুলগুলো যেন কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরতে চায়, নির্মমভাবে নিষ্পেষিত করে ফেলতে চায় তাকে।

একটা পান খাওয়াতে পারিস খেতুর বউ?

না চাপা শক্ত গলায় ভোমরা জবাব দিলে, পান নেই।

হরিলাল মৃদু হাসল, চোখ দুটো ঝলক দিয়ে উঠল এক মুহূর্তের জন্যে। তৈলাক্ত গোলাকার গালের ওপর দুটো বৃত্ত ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। মুখে সামনের পাটিতে একটা তীক্ষ্ণধার গজদন্ত চকিতের জন্যে আত্মপ্রকাশ করলে।

তবে থাক, পানের দরকার নেই।

হরিলালের হাতখানা কঠোরভাবে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল। খেতুকে বলে দিস ঋণ সালিশির মামলাটায় ওর জন্যে বোধ হয় কিছু করা যাবে না।

ভোমরার বুকের ভেতর ধড়াস করে যেন ভারী একখানা পাথর এসে পড়ল। হরিলালের হাতে শানিত খঙ্গ হত্যার উল্লাসে ঝকঝক করে উঠেছে। রামসই ঋণ সালিশি বোর্ডের সে প্রতিপত্তিশালী সদস্য, চেয়ারম্যান তার খাতক। আর বলদ কিনবার জন্যে ইদ্রিস মিয়ার কাছ থেকে যে বাহান্ন টাকা ধার করেছিল খেতু, সে-মামলা এখনও ঝুলে রয়েছে রামসই ঋণ সালিশি বোর্ডেই। হরিলালের একটি মাত্র ইঙ্গিতে বলদ দুটি বিক্রি করে দিয়ে কালকেই হয়তো কিস্তি শোধ করতে হবে খেতুকে। আরও কত কী হতে পারে একমাত্র হরিলালই তা

জানে।

বসুন, পান দিচ্ছি।

হরিলাল আবার হাসল। বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ, একটি মাত্র অস্ত্র দেখিয়েই জয়লাভ। এমন অসংখ্য অগণ্য অস্ত্র আছে হরিলালের, যা খেতু কোনোদিন কল্পনাও করতে পারে না।

নাঃ থাক। আমারও কাজ আছে, উঠতে হবে। খেতু বাড়ি আসবে কখন?

ভোররাতে।

হরিলাল এগিয়ে এল অসংকোচে এবং নির্ভয়ে। বিস্তারিত ভূমিকা বা ভণিতা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক এখন—সে কাজের মানুষ। নীরব আর নির্জন বাড়ি। ঝাঁঝাঁ রোদে ঝিমিয়ে পড়েছে সমস্ত। পেছনের আম গাছে একটা পাখি ডাকছে, বউ কথা কও।

লোলুপ আর কঠিন মুষ্টি একখানা মাংসাশী থাবার মতো ভোমরার হাত আঁকড়ে ধরলে। মট করে উঠল একগাছা কাচের চুড়ি, দু-টুকরো হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। চাপা রুদ্ধ গলায় হরিলাল বললে, সন্ধের পরে আমি আসব। কোনো ভয় নেই তোর।

ভোমরার সর্বাঙ্গে যেন একটা বিষধর সাপ পাকে পাকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরেছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, মুখ দিয়ে কথা ফুটতে চায় না। শুধু তার আতঙ্কবিহ্বল মুখের ওপর সাপের প্রসারিত ফণা দুলছে, লাল টকটকে চোখ দুটো জ্বলছে, যেন আগুনের বিন্দু। কিন্তু চোখ সাপের নয়, হরিলালের।

কোনো ভাবনা নেই। টাকাপয়সা-কাপড়-চুড়ি যা চাস। কিন্তু সন্ধের পরে আমি আসব।

ভোমরার মুখ দিয়ে কথা ফুটল না।

না-ফুটল, কী আসে-যায় তাতে। নিপুণ ঘাতক হরিলাল, তার অস্ত্রের আঘাত অব্যর্থ আর অনিবার্য। বাহান্ন টাকার মামলাটা ভুলে থাকা এত সহজ নয় খেতুর পক্ষে। আরও একটু প্যাঁচ কষালে খেতুই উপযাচক হয়ে ভোমরাকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে যাবে। এমন সে অনেক দেখেছে। কিন্তু কী দরকার অতটা করে। হাঙ্গামা তার ভালো লাগে না। সকলের সঙ্গে যথাসম্ভব ভালো ব্যবহার করতেই সে ভালোবাসে—লোক একেবারে খারাপ নয় হরিলাল।

একখানা বড়ো মাঠ পেরোলেই সামনে মুচিপাড়া। আকাশের রোদ যেন আগুনের মতো গলে গলে পড়ছে। ময়লা গামছায় খেতু কপালটা মুছে ফেললে। চারিদিকের মাঠে-ঘাটে চলেছে অদৃশ্য অগ্নিযজ্ঞ। এখনও মেঘ দেখা দিল না, বৃষ্টি নামল না এক পশলা! কবে যে লাঙল পড়বে মাঠে! ধান রোয়ার সময় চলে গেল, অসময়ে বৃষ্টি পড়লে ফসল বুনেই-বা কী লাভ। ধানে ঝুলন লাগবে না, হাজা ধরে শুকিয়ে যাবে সমস্ত।

কেমন একটা অশুভ আশঙ্কায় মনটা ভারী হয়ে উঠল খেতুর। পথের পাশে আলের ওপর সাদা ধবধবে একটা নরকঙ্কাল; দৃষ্টিহীন চোখের কালো গহ্বরের ভেতর দিয়ে ওর দিকে যেন প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে আছে। কোনো গোরস্থান থেকে শেয়াল টেনে এনেছে নিশ্চয়ই।

ডাঁ-ডাঁ-ড্ডাঁহিন।

গোরুর লেজে মোচড় লাগল, আকস্মিকভাবে ছুটতে শুরু করলে গাড়িটা। বাঁ-দিকের বলদটার রক্তাক্ত কাঁধের ওপর ডাঁশগুলো ভনভন করে উড়তে লাগল।

মুচিপাড়ার সামনে আসতেই মনে পড়ে গেল টাকা দুটোর কথা। আজকেই শোধ দেবার কথা বলেছিল নীলাই। কিন্তু নীলাইয়ের সেই মুখোনা কল্পনা করতেই গায়ের মধ্যে কেমন করে উঠল। কালকের দিনটা কি সেইজন্যই কাটল অনাহারে।

হাঁক দিতেই নীলাই বেরিয়ে এল ঘর থেকে। খুশি হয়ে বললে, মিতা যে! কোথায় চললি আবার?

মাল নামাতে যাব, রোহনপুরে। টাকা দুটো দিবি বলেছিলি।

টাকা? সে হবে। আয় বোস, তামাক টেনে যা এক ছিলিম।

নীলাইয়ের চেহারায় অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ছে আজকে। কথার ভঙ্গিতে আবার যেন পুরোনো মিতাকে খুঁজে পাওয়া গেল। হয়তো চামড়া পেয়েছে কিছু অথবা সেই দুটো টাকাই এমন রূপান্তর ঘটিয়েছে তার। কিন্তু কারণ যা-ই হোক, মনের ওপর থেকে মস্ত একটা ভার যেন নেমে গেল খেতুর।

কিন্তু এখন গাড়ি বাঁধতে পারব না। মাল আছে সঙ্গে।

রেখে দে তোর মাল। নীলাই ভঙ্গি করলে, আধ ঘণ্টা বসে গেলে এমন কী হবে! যা রোদ্দুর, গোরু দুটোকেও একটু জিরোন দে বরং। কালকে তুই এলি অথচ তোকে একটু তামাক খাওয়াতে পারলাম না, ভারি খুঁতখুঁত করছে মনটা।

সত্যিই অসম্ভব রোদ। বেলাটা একটু ঠাণ্ডা না হলে গাড়ি হাঁকানো শক্ত। বলদগুলোর ভারী ভারী নিশ্বাস পড়ছে, দেখলেও কষ্ট হয়। তা ছাড়া কী চমৎকার নীলাইয়ের ঘরের দাওয়াটা। মহুয়া গাছের ছায়া পড়েছে, ঝিরঝির করে গান গাইছে পাতা। তালদিঘি থেকে ভিজে হাওয়া উঠে আসছে। শুধু বসা নয়, খানিকটা গড়িয়ে নিতেও ইচ্ছে করে। বলদ দুটোকে ছেড়ে দিয়ে খেতু এসে বসল।

পেলি চামড়া?

নাঃ! নীলাইয়ের বুকের ভেতর থেকে ঝোড়ো হাওয়ার মতো শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, আজ এল না ব্যাপারীরা। এবার কপালে কী আছে কে জানে। সকালে ঘোষগাঁয়ে ঢোল বাজিয়ে এলাম, আট গন্ডা পয়সা দিলে। কিন্তু এভাবে ক-দিন চলবে। আচ্ছা, যুদ্ধ কবে থামবে বলতে পারিস?

মহুয়ার ঝিরঝিরে হাওয়াটা বড়ো আরাম বুলিয়ে দিচ্ছে শরীরে। চোখে যেন ঘুম জড়িয়ে ধরে। কিন্তু নীলাইয়ের কথাগুলো এই নিশ্চিন্ত প্রশান্তির মাঝখানে সাঁওতালি তিরের মতো এসে বেঁধে, বিষ বর্ষণ করে। মনে পড়ে যায় ওর মামাতো ভাই বিষ্ণুকে বুনো শুয়োরে গুতিয়ে মেরেছিল, পেটের চামড়া ছিঁড়ে নাড়িভুড়িগুলো ঝুলে পড়েছিল বাইরে। চৌকিদার আলি মহম্মদকে ডাকাতেরা ধরে জবাই করে দিয়েছিল, রক্তাক্ত গলাটা আধ হাত ফাঁক হয়েছিল একটা রাক্ষুসে হাঁ-এর মতো। নীলাইয়ের সর্বাঙ্গ ঘিরে যেন যত অপঘাত, যত অপমৃত্যু আর যত অভিশাপ এসে প্রেতের মতো ছায়া ফেলেছে।

যুদ্ধ কবে থামবে ভগবান জানেন!

তা বটে। ভগবান জানেন— ভগবান! হিংস্রভাবে কথাটার প্রতিধ্বনি করলে নীলাই। ঘরের ভেতর থেকে তামাক সেজে নিয়ে এল ওর বউ। চকিতের জন্যে মিতানের সরু সরু পা দুটো চোখে পড়ল খেতুর। কী অসম্ভব রোগা, এত রোগা হয়ে গেছে বউটা! মুখের দিকে তাকাতে ভরসা হয় না, অকারণে চেতনাকে চমকে দিয়ে মনে হল মুখে হয়তো সেই মড়ার খুলিটার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। ভোমরা এখনও তাজা আছে, এখনও যৌবনের ঐশ্বর্যে টলমল করছে সে। কিন্তু…

দা-কাটা তামাকের উগ্র গন্ধটা লোভনীয়। কিন্তু হুকোতে একটা টান দিয়েই খেতু সেটা বাড়িয়ে দিলে নীলাইয়ের দিকে।

না মিতা, খা তুই। কিছু ভালো লাগছে না আমার।

ভালো লাগছে না কারোরই। ভালো লাগবার কথাও নয়। অন্যমনস্কভাবে নীলাই কলকেটাকে উবুড় করে দিলে। তারপর তাকিয়ে রইল দূরে খেতুর অস্থিসার বলদ দুটোর দিকে। যা চেহারা ওদের, বেশিদিন আর বাঁচবে না। ওই দুটো গোরুর চামড়া পেলে…

খেতু বললে, নাঃ, উঠি এবার। চার ক্রোশ ঘাঁটা যেতে হবে।

বস, মিতা, বস। এত তাড়া কীসের? তুই তো সুখী মানুষ, একদন্ড নয় এখানে বসেই যা। ঘরে ঠাণ্ডা আছে, গলাটা একটু ভিজিয়ে যাবি নাকি?

ঠাণ্ডা? তাড়ি? মুহূর্তে সমস্ত মনটা নেচে উঠল। কিন্তু তাড়ির নেশায় ধরলে সব কাজ একেবারে পন্ড। বহু টাকার মাল রয়েছে গাড়িতে। রাতবিরেতে সাঁওতাল পাড়ার পথঘাট আজকাল একেবারেই ভালো নয়। অভাবের তাড়নায় লোকগুলো খেপে রয়েছে হন্যে কুকুরের মতো। কায়দায় পেলে লুটেপুটে নেওয়া আদৌ অসম্ভব নয়।

এত গরমে একটুখানি ঠাণ্ডা পেলে তো বেঁচে যাই। কিন্তু নেশা ধরে গেলে সব মাটি হয়ে যাবে রে। পথ ভারি খারাপ আজকাল।

একটুখানি গলা ভিজিয়ে যাবি, নেশা হবে কেন।

তা, তা মন্দ নয় কথাটা। সলোভে খেতু চাটল ঠোঁট দুটো।

মাটির ভাঁড়ে করে এল গাঁজিয়ে-ওঠা তালের রস। আর কটুগন্ধী সেই অম্লমধুর অমৃত পেটে পড়তেই খেতু ভুলে গেল সমস্ত। রোহনপুরের ইস্টিশন, মাল বোঝাই গাড়ি, রাত্রির অন্ধকারে শঙ্কাসংকুল সাঁওতাল পাড়া-কোনো কিছুই আর মনে রইল না। ভাঁড়ের পর ভাঁড় উজাড় করে নেশায় আর ক্লান্তিতে খেতুর সর্বাঙ্গ ঝিমিয়ে এল অতি গভীর অবসাদে। কী ঠাণ্ডা ছায়া পড়েছে নীলাইয়ের দাওয়ায়, আর কী মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে মহুয়ার কচি কোমল পাতাগুলো।

তারপরে বেলা গড়িয়ে এল, সূর্য নামল পশ্চিমের দিগন্তে। মহুয়া পাতার ফাঁক দিয়ে বিকেলের রাঙা আলো বাঁকা হয়ে খেতুর মুখের ওপরে এসে পড়তেই যেন আচমকা ভেঙে গেল ঘুমটা। ধড়মড় করে উঠে বসল খেতু। তাই তো, বেলা একেবারে নেমে পড়েছে যে। রাতদুপুরের আগে আর ইস্টিশনে পৌঁছোনো চলবে না।

সামনে বসে নির্বিকার মুখে বিড়ি খাচ্ছে নীলাই।

ইস! কী ঘুমটাই ঘুমোলি মিতা। বেলা একবারে কাবার।

হাত-পা কাঁপছে, মাথাটার ভার যেন বইতে পারা যায় না। হঠাৎ নীলাইয়ের ওপর একটা বিজাতীয় ক্রোধে খেতুর মনটা বিষাক্ত হয়ে উঠল।

তুই তো আমাকে এই ফ্যাসাদে ফেললি। কতদূরে যেতে হবে এই রাত্তিরে—দ্যাখ তো। ও কী!

ভয়ে বিস্ময়ে খেতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল আর পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠল নীলাইয়ের মুখ—বলদ দুটো এমন করছে কেন?

দ্রুত পায়ে খেতু ছুটে এল বলদের কাছে। একটা তখন হাত-পা ছড়িয়ে নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে, দুটো চোখের ওপর নেমেছে সাদা পর্দা। সারা গায়ে ভনভন করে উড়ছে মাছি। আর একটা অন্তিম চেষ্টায় আকাশের দিকে মুখ তুলে নিশ্বাস টানছে, জিভ বেরিয়ে এসেছে, কালো দীর্ঘায়ত চোখের কোনায় টলমল করছে অশ্রুর বিন্দু।

আমার বলদ মরে গেল! আর্ত কণ্ঠে চিৎকার করে খেতু আছড়ে পড়ল বলদের গায়ে। চর্মসার প্রকান্ড পাঁজরার হাড়গুলো মটমট করে উঠল বুকের চাপে।

নীলাই নিরাসক্ত গলায় বললে, যে গরম, সর্দি-গরমি…

সর্দি-গরমি? ছিলে-ছেড়া ধনুকের মতো খেতু বিদ্যুদবেগে দাঁড়াল সোজা হয়ে।

সামনে একটা মাটির পাত্রে ভুসি-মেশানো হলুদ রঙের খানিকটা দুর্গন্ধ জল। এই  জল কে খেতে দিয়েছিল বলদকে, কে দিয়েছিল!

সর্দি-গরমি? শালা, চামড়ার লোভে আমার গোরুকে বিষ খাইয়েছিস, বিষ খাইয়েছিস তুই। শালা গো-হত্যাকারী, আমি খুন করব, খুন করে ফেলব তোকে। খেতুর গলা চিরে আকাশের বাজ গর্জে উঠল, আজ যদি তোর রক্ত না দেখি তা হলে ভুইমালীর বাচ্চা নই আমি।

বেলা গড়িয়ে এল, সন্ধ্যার ঘন ছায়া নিঃশব্দে নামল মাটিতে। কালো রাত্রির ভেতরে গা ঢাকা দিয়ে হরিলাল খেতুর দরজায় এসে দাঁড়াল। হরিলাল জানে ভোমরা তাকে ফেরাতে পারবে না, নিজেকে বাঁচাতে পারবে না তার কঠিন মুষ্টির নিষ্ঠুর নিষ্পেষণ থেকে। তার হাতে যে-খড়ঙ্গ উদ্যত হয়ে আছে, খেতুকে বধ করতে তার একটি মাত্র আঘাতই যথেষ্ট।

অন্ধকারের বুক বিদীর্ণ করে বহু দূরে উত্তরের আকাশটা বিচিত্র রক্তিম ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যেন ছড়িয়ে পড়ল সদ্যোনিহত একটা মানুষের টাটকা রক্ত। কোথাও আগুন লেগেছে নিশ্চয়।


© 2024 পুরনো বই