নক্ৰচরিত

দরজায় ঠক ঠক করে তিন-চারটে টোকা পড়ল। খেয়োপাতায় কষ-কালির আঁচড় টানতে টানতে কুঞ্চিত করে মুখ তুলে তাকাল নিশিকান্ত কর্মকার। শব্দটার অর্থ সে বুঝতে পেরেছে।

বাইরে কালো রাত, তারস্বরে ঝিঝি ডাকছে আর ঘরে মিট মিট করে জ্বলছে কেরোসিনের আলো। বেশি তেল পুড়বার ভয়ে নিশি কখনো আলোটাকে বাড়াতে চায় না। আধা-অন্ধকারে কাজ করতে করতে শকুনের চাইতেও সুতীক্ষ্ণহয়ে উঠেছে  তার চোখের দৃষ্টি। খেরোখাতায় কষ-কালির লেখাগুলাকে সে পিঁপড়ের সারির মতো সাজিয়ে চলেছে—আজকের দিনের জমাখরচ।

ঠক ঠক ঠক। শব্দটা চেনা, তবু তবু কে জানে! নিশি কর্মকারের শকুনের মতো চোখ দুটোর ওপর সংশয়ের ছায়া এল ঘনিয়ে, কপালে দেখা দিল এলোমেলো সরীসৃপ রেখা। বাতির অস্পষ্ট আলোয় ঘরের কোণে বিলিতি লোহার সিন্দুকটার হাতল আর ভারী হবসের তালা দুটো ঝকঝক করে জ্বলছে। কাঁচা সোনায়, গয়নাতে, নোটে এবং নগদে প্রায় বিশ হাজার টাকা অলংকৃত করেছে ওই সিন্দুকটার জঠর।

কলম রেখে নিশি উঠে দাঁড়াল। লোকটা কুঁজো; বয়সের চাপে নয়, খাতা আর হাতুড়ির সংস্রবেই অকালে তার পিঠটা বেঁকে গিয়েছে ধনুকের মতো। অত্যন্ত সতর্ক হাতে দরজার ভারী খিলটা সরিয়ে দিলে সে।

ঘরে ঢুকল চার জন লোক। মুখ চেনা না থাকলে নিশি আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠত। তাদের কারও চেহারাই উজ্জ্বল দিবালোকে দেখবার বা দেখাবার মতো নয়। মালকোঁচা আটা, মুখের উপর চুন আর ভুসা কালির বর্ণবিন্যাস চালিয়ে বিকট চেহারাকে বিকটতর করে তুলেছে তারা। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। হাতে তাদের তেলপাকানো বাঁশের লাঠি, ক্ষুরের মতো ধারালো চকচকে দীর্ঘ হাঁসুয়া। একজনের মাথায় ভারী একটা টিনের ট্রাঙ্ক, আর একজনের হাতে একটা পুঁটলি শাড়ি দিয়ে বাঁধা।

নিঃশব্দে পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

ট্রাঙ্ক আর পুঁটলি সামনে নামিয়ে তারা শ্রান্তভাবে বসে পড়ল। চার মাইল পথ ছুটে আসতে হয়েছে, ক্লান্তিতে ভারী ভারী নিশ্বাস পড়ছে তাদের। আট-দশটা হাটের গাড়ি তাদের পিছনে পিছনে আসছিল, একটু হলেই ধরা পড়ে যাওয়া আশ্চর্য ছিল না। যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করে একজন পায়ের দিকে তাকাল। ইটের ঘা লেগে বেমালুম নখ উড়ে গেছে একটা। মাটি মেশানো কালো রক্ত সেখান থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়ছিল।

নিশি কর্মকার জিজ্ঞাসু চোখে এক বার ট্রাঙ্ক আর এক বার পুঁটলির দিকে তাকাল। আজকের শিকার?

হুঁ।

সোনাদানা মিলেছে?

খুলে দ্যাখো-না। গয়না যা পাওয়া গেছে তা ওই পুঁটলিটাতেই। আলোটা চড়িয়ে দিয়ে নিশি পুঁটলি খুলল। একরাশ সোনা-রুপোর গয়না চকিত  আলোর স্পর্শে ভয়াতুর চোখের মতো উঠল ঝিলিক দিয়ে। রুপোর মল, চুড়ি, ভারী টোড়া একছড়া, সোনার দু-ছড়া হার, বালা, আংটি একটা। পাথর-বসানো কানের দুল এক জোড়া, সেটা

স্পর্শ করেই নিশি চমকে হাত সরিয়ে নিলে। নরম একটা মাংসের টুকরো এখনও লেগে রয়েছে তাতে, আর সেইসঙ্গে আঠার মতো রক্ত। সময় সংক্ষেপ করবার জন্য কানসুদ্ধই দুল জোড়াকে ছিঁড়ে এনেছে ওরা।

ইস! খুন হয়েছে নাকি?

সবচাইতে যে মোটা আর জোয়ান সে-ই জবাব দিলে। কেউ না বলে দিলেও বুঝতে পারা যায় স্বতঃসিদ্ধ নিয়মমতোই সে এদের দলপতি। মোঙ্গলসুলভ খর্ব নাকের নীচে বিড়ালের মতো অল্প কয়েক গাছা লালচে গোঁফ খাড়া হয়ে রয়েছে, চোখ দুটো এত ঘোলাটে আর নিষ্প্রভ যে হলুদ-মাখানো বলে মনে হয়। সমস্ত শরীরটা তার গাঁটে গাঁটে পাকানো, যেন পেশি দিয়েই তৈরি সেটা। নাম তার মদন।

মদন তিনটে উঁচু উঁচু বেটপ আর নোংরা দাঁত বের করে হাসল।

না, খুন হয়নি। দিতে চায়নি, তাই কেড়ে আনতে হয়েছে।

দলের মধ্যে সবচাইতে ছোটো যোগী চুপ করে বসে ছিল। রাহাজানির কাজে এই বছরই সে হাতেখড়ি দিয়েছে। অন্ধকার রাত্রিতে অসহায় পথিকের আর্তনাদ এখনও তার বুকের মধ্যে ঢেউ জাগিয়ে তোলে। হাঁসুয়ার কোপ যখন হিংস্র একটা হাসির মতো মাথার ওপর ঝকমক করে ওঠে, তখন মৃত্যুভীতের বিস্ফারিত দৃষ্টি সে সহ্য করতে পারে না। তার স্নায়ু এখনও এই নিশাচরের জীবনটাকে সহজভাবে আয়ত্ত করে নিতে পারেনি।

যোগী বললে, উঃ, কীরকম কাঁদছিল মেয়েটা! ওভাবে কেড়ে না নিলেই…

মদন হো-হো করে হেসে উঠল।

এসব তোর কাজ নয়। ভুইমালীর নাম ডুবিয়েছিস তুই। কাল থেকে ঘরে চলে যা, ধামা কুলো তৈরি কর গে বরং। মেয়েমানুষের মন নিয়ে এসব জোয়ানের কাজ করা যায় না।

অপ্রতিভ যোগী নীরব হয়েই রইল। সে ভয় পায়নি, কিন্তু সংশয় দেখা দিয়েছে  তার মনে। জোয়ানের কাজ। জোয়ানের কাজ কি এইরকম! কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রহীন রাত ঘুটঘুট করছে চারদিকে। ফাঁকা মাঠের এখানে-ওখানে মিশকালো শ্যাওড়ার জঙ্গল, তার সর্বাঙ্গে অজস্র জোনাকি জ্বলছে ভূতের চোখের মতো। তারই মাঝখান দিয়ে গোরুর গাড়ির লিক, মাঝে মাঝে জল আর কাদা জমে রয়েছে তাতে। আর শ্যাওড়া গাছের ছায়ার নীচে নিজেদের প্রায় মিশিয়ে দিয়ে ওরা বসে আছে আকুল প্রতীক্ষায়, কখন একখানা সওয়ারি গাড়ি আসবে সেই পথ দিয়ে এগিয়ে। দূরে মাঠের মাঝখানে বড়ো একটা আলো দেখা দেয়, ওদের উদগ্র ধমনিতে নামে চঞ্চলতার জোয়ার। মদন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারের মধ্যেও যোগী দেখতে পায় তার চোখ বাঘের মতো পিঙ্গল লুব্ধ আলোয় ঝকে উঠেছে, আর হাতের মুঠোয় কাঁপছে হাঁসুয়ার ফলাটা। আলোটা আশাপ্রদভাবে দপ দপ করে খানিকটা এগিয়ে আসে, তারপরেই মরীচিকার বিভ্রম জাগিয়ে অন্ধকারের অথই সমুদ্রে তলিয়ে যায় কালো একটা বুদবুদের মতো। নাঃ, আলেয়া।

হতাশায় বেঢপ দাঁতগুলো দিয়ে নীচের ঠোঁটটাকে হিংস্রভাবে কামড়ে ধরে মদন। একটা অশ্রাব্য গালাগালি বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে।

আজ রাত্তিরটাই বৃথা গেল, এক শালা গাড়িরও কি আসতে নেই রে! ভগবানের এ কী অবিচার বল দেখি?

সত্যিই তো, ভগবানের এ কী অবিচার। যোগী বিস্মিত হয়ে ভাবে। আরও একটু বিবেচনা থাকা উচিত ছিল ভগবানের তরফ থেকে। এই যে সারাটা রাত তারা শিকারের সন্ধানে অতন্দ্র হয়ে বসে আছে, মাঠের যত মশা সুযোগ পেয়ে চারপাশ থেকে প্রাণপণে এসে ঘেঁকে ধরেছে তাদের, এত কষ্ট আর পরিশ্রমের কোনো পুরস্কারই কি নেই? ভারী ভারী গহনাপরা তিন চারটে মেয়েমানুষসুদ্ধ দু-একখানা গাড়ি এই রাত দেড়টার সময় তিনি তো ইচ্ছে করলেই পাঠিয়ে দিতে পারেন। জীব সৃষ্টি করেছেন অথচ তাদের আহার জোগাবার বেলায় এত কার্পণ্য কেন?

কিন্তু সাধনার সিদ্ধি আছেই। একখানা গাড়ি দেখা দেয় শেষপর্যন্ত। ফস করে একটা মশাল জ্বালিয়ে নেয় মদন, তারপর বিকট একটা চিৎকার করে ওরা আটকে দাঁড়ায় পথ। মশালের লাল আলোয় গোরুর বড়ো বড়ো চোখগুলো অদ্ভুত ভয়ার্ত মনে হয়। গাড়োয়ানটা লাফিয়ে পড়ে জঙ্গলের দিকে ছুটে পালায়, যাত্রীদের অসহায় কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে দিগদিগন্ত।

জোয়ানের কাজ! কথাটা যোগী ঠিক বুঝতে পারে না।

তার চেতনাকে সজাগ করে দিয়ে নিশি কর্মকার কথা কয়ে উঠল।

বারো ভরি রুপো।

আর সোনা? মদনের কণ্ঠস্বর উৎকণ্ঠিত শোনাল।

সোনা? সোনা কোথায়? কুড়িয়ে-বাড়িয়ে তিন ভরিও হবে না বোধ হয়।

বল কী? মদন চমকে উঠল, এই হার, চুড়ি…।

সব গিলটি।

গিলটি! মদন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল নিশি কর্মকারের মুখের দিকে। সে-মুখের একটি পেশিও কাঁপছে না, কেবল কপালের রেখাগুলো সরীসৃপের মতো সর্পিল হয়ে উঠেছে। মাত্র। তার মুখ দেখে একটি কথারও পাঠোদ্ধার করা যাবে না, আবিষ্কার করা যাবে না তার মনোজগতের এতটুকুও সংবাদ। অরণ্যের মতোই তার মন দুর্গম আর রহস্যময়, শুধু নিকেল ফ্রেম দেওয়া পুরু কাচের  চশমার ভেতর দিয়ে তার দৃষ্টি অসম্ভবরকম লোভাতুর হয়ে উঠেছে।

নিশি কর্মকার কুঞ্চিত করলে।

বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তা হলে তোমাদের মাল তোমরাই নিয়ে যাও, বদনামের মধ্যে আমি নেই।

মুহূর্তে মুষড়ে গেল মদন। নিশি কর্মকার রাগ করলে উপায়ান্তর নেই তাদের। এসব কাজে এমন বিশ্বাসযোগ্য হুঁশিয়ার লোক আর পাওয়া যাবে না। গোলাপাড়া হাটের সে জাঁদরেল মহাজন; শুধু সোনাদানা নয়, ধান-চালের আড়ত, কাটা কাপড়ের ব্যাবসা। গোলাপাড়া ইউনিয়ন বোর্ডের সে প্রেসিডেন্ট, সদর থেকে ছাপানো সব সরকারি খাম আসে তার নামে। তা ছাড়া হবিবগঞ্জ থানার দারোগা ইব্রাহিম মিয়াকে সে যে কী মন্ত্রে বশ করেছে কে জানে, পুলিশের হাঙ্গামা থেকে অন্তত নিশ্চিন্ত।

না না, তা বলিনি। তবে…

এর মধ্যে তবে নেই আর। চশমাটা খুলে নিশি একটা টিনের খাপে পুরল।

অধর্ম আমি কখনো করিনে, পরকাল বলে একটা জিনিস আছে তো। পৌনে দু-শোর বেশি কিছুতেই হয় না, তা আমি পুরোপুরি দু-শো টাকাই ধরে দিচ্ছি, নিয়ে যাও। দু-শো! চার জনের স্বরেই নৈরাশ্য ফুটে বেরোল। কলাইগঞ্জের সাহাদের গাড়ি ধরেছিল তারা। ঐশ্বর্যের দিক থেকে সাহারা বিখ্যাত ব্যক্তি, তাদের বাড়ির মেয়েদের গা থেকে মাত্র দু-শো টাকার গয়না বেরোল! ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কঠিন।

মদন একবার শেষ চেষ্টা করলে, অন্তত আড়াইশো…

আর এক পয়সাও পারব না। ইচ্ছে না হয় ঘুরিয়ে নিয়ে যাও, দেড়শোর বেশি যদি কেউ দিতে রাজি হয় তো আমার কান মলে দিয়ে।

তা কি হয়? অসহায় স্বরে মদন বললে, দাও, দুশোই দাও তবে।

এতক্ষণে নিশি কর্মকার হাসল।  তার হাসিটা সস্নেহ এবং স্বর্গীয়।

কেন এত অবিশ্বাস বলো তো? তোমাদের এত কষ্টের রোজগার, মিথ্যে প্রবঞ্চনা যদি করি তাহলে তা কি ধর্মে সইবে কখনো? তা ছাড়া পরলোকে জবাবদিহিও তো করতে হবে। যথা ধর্ম তথা জয়, অধর্মের রোজগার গোমাংস আর গোরক্ত।

বিরস মুখে টাকাগুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। অন্ধকারে মদনের কালিমাখা ভূতুড়ে মুখটা আরও কালো আর ভয়ানক হয়ে উঠেছে। চাপা দাঁতগুলো একবার সশব্দে কড়মড় করে উঠল তার। নিশি কর্মকারের রুদ্ধ দরজার দিকে সে এক বার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল।

বলে অধর্মের টাকা গোমাংস আর গোরক্ত! শালা বুড়ো শকুন কোথাকার! গিলটি আর আসল সোনা আমরা চিনতে পারি না। ইচ্ছে করছে লোহার বড়ো হাতুড়িটা তুলে মাথাটা ফাটিয়ে চৌচির করে দিই ওর। কিন্তু কী করব, ব্যাটা সরকারের পেয়ারের লোক, নইলে অ্যাদ্দিন…

মদনের কথার ভঙ্গিতে যোগীর হাসি এল। মদন বুনো ওল, কিন্তু নিশি বাঘা তেঁতুল।

আর ওরা বেরিয়ে গেলে আর এক বার লণ্ঠনের আলোটা চড়িয়ে দিয়ে নিশি কর্মকার গয়নাগুলোকে পরীক্ষা করলে। এখনও যেন নারীদেহের উত্তাপ আর স্কেদের গন্ধ সেগুলোতে জড়িয়ে রয়েছে। কম করেও হাজার টাকার জিনিস, সাহাদের নজরটা যে উঁচু আছে সেকথা মানতেই হবে। কিন্তু অধর্মের টাকা গোমাংস আর গোর। নিজের কথাটা মনে পড়তেই রেখাজটিল মুখে খানিকটা হাসি প্রকট হয়ে উঠল। অধর্মের সংজ্ঞা আলাদা বই কী। চোরের উপর বাটপাড়িকে কোনো আহাম্মকই অধর্ম বলবে না।

রাত্রে নিশির ভালো ঘুম হয় না। এই বহুবাঞ্ছিত অনিদ্রাটা অনেক আয়াস স্বীকার করে তবে আয়ত্ত করতে হয়েছে তাকে। বাতাসের সঙ্গে বাইরের গাছের পাতা খস খস করে নড়ে। আর বিছানার মধ্যে নিদ্রাহীন চোখ সজাগ হয়ে থাকে সন্দেহের প্রখরতায়। ঘাসবনের ভেতর দিয়ে সাপ চলে যায়, কান খাড়া করে সে অনুধাবন করে তার চলার ক্রমবিলীন শব্দটাকে। ঘরের মধ্যে তরল অন্ধকার, তবু তার ভেতর সে স্পষ্ট দেখতে পায় বড়ো লোহার সিন্দুকটার ঝকঝকে হাতল আর ভারী হবসের তালা দুটো সতর্ক প্রহরীর মতো জেগে রয়েছে। বুভুক্ষু ইঁদুরগুলো মখমলের মতো ছোটো ছোটো পা ফেলে ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু নিশি কর্মকারের ঘরে কুড়িয়ে খাওয়ার মতো এতটুকু উদবৃত্ত অপচয় খুঁজে পায় না তারা।

প্রহরে প্রহরে শিয়ালের জয়ধ্বনি চিহ্নিত করে রাত্রিকে। তারপর বাইরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসবার আগেই উঠে বসে নিশি কর্মকার। বৈষ্ণব মানুষ, মালা জপ শেষ করে জুড়ে দেয় বেসুরো গলায় কীর্তন। সমস্তটা দিন নানা বিষয়কর্মে সংসারের আবিলতার মধ্যে কাটাতে হয়, তাই ব্রাহ্মমুহূর্তে যতটুকু পারে পুণ্য অর্জন করে নেয় সে।

সকাল বেলা একধামা খই আর একথাবা আখের গুড় নিয়ে এসে দেখা দেয় বিশাখা নিশির সেবাদাসী।

বিশাখা নামটা তারই দেওয়া। ভেক নেবার আগে বিশাখা ছিল হাড়ির মেয়ে, নাম ছিল কষ্টবালা। কিন্তু গলায় তুলসীর মালা পরিয়ে তার সমস্ত কষ্ট দূর করে দিয়েছে বৈষ্ণবতিলক নিশি কর্মকার। আপাতত সে শ্রীরাধার অনুচারিণী এবং নিশির বৃন্দাবনলীলার লীলাসঙ্গিনী।

আজও সকালে নিয়মমতো খইয়ের ধামা হাতে বিশাখার আবির্ভাব হল।

বহুদিন পরে নিশি এক বার চোখ তুলে তাকাল বিশাখার দিকে। আজ প্রায় পাঁচ বৎসর ধরে সে এমন করে ওর মুখের দিকে তাকাতে ভুলে গিয়েছে। বার্ধক্য এসে ওকে সরিয়ে নিয়েছে তার জীবন থেকে; কিন্তু এই সকালে বিশাখা সদ্য স্নানের পর চন্দন সেবা করে এসেছে, তেল আর চন্দনের চমৎকার সুগন্ধের সঙ্গে খানিকটা প্রথম সূর্যের  আলো ওর মুখের ওপর পড়ে ঝলমল করে উঠল। তড়িৎচমকের মতো নিশির মনে হল, তারই বয়স বেড়েছে শুধু, তারই জীবনগ্রন্থির সমস্ত রস গেছে শুকিয়ে; কিন্তু যৌবনের ভরা লাবণ্যে বিশাখা এখনও টলমল করছে শতদল পদ্মের মতো। এত মধু, এত প্রচুর মাধুরী, আজ  তার এ আস্বাদন করবার অধিকার নেই, সামর্থ্যও নেই। সিন্দুকের জমানো সোনার তালগুলোর মতো রূপের এই প্রতিমাকে সে পাহারাই দিয়ে চলেছে, রাজভান্ডারে সে প্রহরী মাত্র। হাত বাড়িয়ে খইয়ের ধামাটা নেবার কথা তার মনেই রইল না।

আজ তোকে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে সখী।

সখী মুখ ঘুরিয়ে নিলে। নিশির স্তুতিবাক্যে তার দেহমনে আর আলোড়ন জাগে না আজকাল। বললে, বুড়ো বয়সে রস তো খুব উথলে উঠছে দেখছি।

বুড়ো!

তা বটে। সমস্ত শরীর দিয়ে সে আজ অনুভব করে তার শিরা-স্নায়ুগুলোর নিরুপায় পঙ্গুতা। অথচ এককালে গ্রামের কোন সুন্দরী মেয়েটাকে অন্তত সে দু-দিনের জন্যে আয়ত্ত করেনি? আর এই মুহূর্তে তার নিজের বিশাখাই তার ক্ষমতার বাইরে। অথচ এখন কী অপূর্বই-না দেখাচ্ছে বিশাখাকে! হাড়ির মেয়ে হলেও রংটা তার ফর্সা, প্রৌঢ় যৌবনে মুখোনা আজকাল দিব্যি ভারী আর গোলগাল হয়ে উঠেছে; পাকা সিঁদুরে-আমের মতো তার গালের রং, পানের রসে পাতলা ঠোঁট দুটি টুকটুক করছে। কপালে ছোটো একটা উলকির দাগ সমস্ত মুখোনার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে যেন। অদ্ভুত একটা উত্তেজনায় নিশির বুকের ঠাণ্ডা রক্ত যেন হঠাৎ শিউরে উঠল শিরশির করে।

এক বারটি কাছে আসবি বিশাখা?

বিশাখার চোখে সন্দেহের ছায়া পড়ল।

ব্যাপার কী, নেশাটেশা ধরেছ নাকি?

নেশা ধরিনি, নেশা লাগছে। নিশি বিগতযৌবনের মতো প্রগলভ হবার চেষ্টা করছে। কাল রাতে দু-ছড়া হার বাগিয়েছি। নিবি তার একগাছা?

বিশাখার চোখে সন্দেহ ঘনীভূত হল।

ওরে বাপ রে, এত কপাল! আমি বাঁচব তো?

কেন, কোনোদিন কিছু তোকে দিইনি বুঝি?

ক্রিং ক্রিং করে বাইরে সাইকেলের ঘণ্টা শোনা গেল, তারপরেই জুতোর মচ মচ শব্দ করতে করতে কে উঠে এল দাওয়ায়। ডাক শোনা গেল, কর্মকার বাড়ি আছ হে?

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো নিশি চমকে উঠল, ইব্রাহিম দারোগা এসেছে।

বিশাখার গৌর মুখে রঙিন আভা দেখা দিয়েছে। আচমকা হাওয়া লাগা দিঘির জলের মতো একটা চকিত-চাঞ্চল্য তার সর্বাঙ্গে লাবণ্যের ঢেউ খেলিয়ে গেল। ব্যাপারটা নতুন করে বোঝবার কিছু নেই, তবু একটা তীব্র ঈর্ষা এসে ক্ষণিকের জন্যে নিশিকে আচ্ছন্ন করে দিলে।

ওঃ তাই, আমি বুড়ো হয়ে গেছি! এই জন্যই আমাকে মনে ধরে না আর। নিশির মনের কথা বিশাখা বুঝতে পেরেছে। দরিদ্রের ব্যর্থ লোভ দেখে তার সহানুভূতি হয়। কিন্তু সহানুভূতি ছাড়া আর কী সম্ভব।

এত হিংসে কেন? এ নইলে আগেই যে হাতে দড়ি পড়ে যেত, সেটা খেয়াল নেই বুঝি?

সত্যি, খুব সত্যি কথা। ইব্রাহিম দারোগার মতো মদহস্তী এই বাঁধনেই তো এমনভাবে বাঁধা পড়েছে! হিংসা করে কোনো লাভ নেই, শুধু বুকের ভেতর থেকে ঠেলে মস্তবড় একটা দীর্ঘনিশ্বাস এল বেরিয়ে।

ততক্ষণে ঘর থেকে দ্রুতচরণে অদৃশ্য হয়ে গেছে বিশাখা। মহামান্য অতিথি এবং মূল্যবান প্রেমিক। বাইরে তাকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা চলে না। খানিকটা মিষ্টি হাসি উপহার দিতে হবে তাকে। এক কাপ চা, এক খিলি পান। মাঝে মাঝে দারোগা রাতটাও কাটিয়ে যায় নিশির বাড়িতেই। গ্রামের সবাই ব্যাপারটা জানে, কিন্তু একটা কথা বলবার সাহস নেই তাদের। জলে বসতি করে কুমিরের সঙ্গে বিরোধ না করার প্রাজ্ঞতাটুকু অন্তত আশা করা যায় তাদের কাছ থেকে। গোলাপাড়া হাটের সবচেয়ে বড়ো মহাজন নিশি কর্মকার আর দারোগার প্রতাপ সম্বন্ধে কিছু না ভাবাই ভালো। যুদ্ধ বাঁধবার পর থেকে ভারতরক্ষা আইনের অস্ত্রশস্ত্রে সে আপাদমস্তক মন্ডিত হয়ে আছে।

ইব্রাহিম দারোগাকে কিছুটা অপ্রসন্ন মনে হল আজকে। তিন-চারটে ডাকাতি হয়েছে তার এলাকায়, অথচ কোনোটারই কোনো কিনারা হয়নি। ওপর থেকে সুপারিন্টেণ্ডেন্টের কড়া অর্ডার এসেছে, এভাবে চললে ট্রান্সফার করে দেওয়া আশ্চর্য নয়।

হাতের বেতটাকে জুতোর ওপর টুক টুক করে ঠুকতে লাগল ইব্রাহিম দারোগা।

একটু সামলে চালাও কর্মকার। তোমার জন্যে কি আমার চাকরিটা যাবে?

নিশির শকুনের মতো চোখ দুটো বিনয়ে কাতলা মাছের মতো নির্বোধ হয়ে এল। হুজুরের যেমন কথা।

না না, সত্যি। ওপর থেকে বড্ড তাগিদ দিচ্ছে। ফস করে তোমার নামটা বেরিয়ে পড়লে আর আটকাতে পারব না। ইনস্পেকটর ব্যাটাকে তো জান? শালা স্রেফ রাঘববোয়াল। ওর মুখটা বন্ধ না করলে আর…

নিশির মুখে হাসি দেখা দিল। কথাটার অর্থ সে বোঝে। সিন্দুকটা খুলে ছোটো একটা নোটের তাড়া সে দারোগার দিকে এগিয়ে দিলে। আর প্রাপ্তিমাত্রেই দারোগা অত্যন্ত সহজভাবেই নোটগুলো নিয়ে পুরল পকেটে, কালো চাপদাড়িমন্ডিত মুখোনা খুশিতে ভরে উঠেছে তার। লোকটার শরীরে বোধ হয় কিছুটা পাঠানের রক্ত আছে, সবটা মিলিয়ে একটা অমার্জিত আদিমতার আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু কোন পাষন্ড বলে যে, আজকাল রাজভক্তি লোপ পেয়ে গেছে বঙ্গদেশ থেকে? স্বদেশিওয়ালারা যত লম্ফঝম্পই করুক-না কেন, ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে নিশি কর্মকারের মতো বিবেচক আর বুদ্ধিমান লোক পাওয়া যাবে। এ নইলে আর পুলিশে চাকরি করে সুখ ছিল কী!

একখানা রুপোর ডিশে পান আর জর্দা নিয়ে ঘরে ঢুকল বিশাখা। আড়চোখে  তার দিকে এক বার তাকিয়ে একমুঠি পান আর ছটাক খানিক জর্দা হাঙরের মতো প্রকান্ড হাঁয়ের মধ্যে চালিয়ে দিলে দারোগা। পান খেয়ে খেয়ে দারোগার মুখটা কী অস্বাভাবিক লাল! হঠাৎ দেখলে মনে হয় লোকটা রক্ত খায় বুঝি।

হ্যাঁ, আর একটা কথা। চাল তো পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। তোমার আড়তে কিছু আছে। না কি? ওপরে একটা রিপোর্ট দিতে হবে।

চাল! আমার আড়তে! নিশি বিস্ময়ে হতবাক। কোথায় চাল! জ্যৈষ্ঠী মাসেই সব সাবাড় করে দিয়েছি। নিজের জন্যে সামান্য যা আছে তাতেই তো নতুন ধান ওঠা পর্যন্ত চলবে না, টান পড়ে যাবে।

কালো চাপদাড়ির ফাঁকে দারোগার জন্তুর মতো মুখে জন্তুর হাসি দেখা দিলে।

তুমি বাবা একটি সাক্ষাৎ ঘোড়েল, ছুঁড়ো কুমির। তোমার আড়ত সার্চ করলে যে এখুনি পাঁচশো মন চাল সিজ করা যায়, সে-খবর আমি পাইনি ভাবছ?

নিশি প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, হরে কৃষ্ণ! আমার আড়ত! এমন শত্রুতা আমার সঙ্গে কে করলে! আমার কি ধর্মভয় নেই একটা! পরলোকে জবাবদিহি তো করতে হবে।

ইব্রাহিম দারোগা সবিদ্রূপে বললে, থাক থাক, এই সক্কাল বেলা একরাশ মিথ্যের সঙ্গে ধর্ম বেচারাকে আর জড়াচ্ছ কেন? বিসমিল্লা বলে আমার দরগাতেই মুরগি জবাই করে দিয়ে, আমি বহাল তবিয়তে থাকলে তোমাকে ছোঁয় কে!

সেই ভরসাতেই তো আছি হুজুর।

চলি তাহলে। দারোগা উঠে দাঁড়াল। তারপর বিশাখার মুখের ওপর দৃষ্টিভোজনের মতো দুটো ক্ষুধার্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আজ বড় ব্যস্ত, কাল আসব।

ঝরঝরে একটা হারকিউলিস সাইকেলের আওয়াজ জেলা বোর্ডের বন্ধুর পথ বেয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেল।

দারোগা চলে গেলে নিশিকান্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। চাল, তা চাল তার কিছু আছে বই কী। ব্যাবসাবাণিজ্য করতে গেলে কোনো ব্যাটাই ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির হতে পারে না। তুমি যদি পরকে না ঠকাও, তাহলে পরে তোমার মাথায় আছড়ে কাঁঠাল ভাঙবে এই হচ্ছে দুনিয়ার নিয়ম। তবে দারোগা খাঁটি খবরটা পায়নি, পাঁচশো নয়, আটশো মন। বারো টাকা দরে কেনা, বর্ষার বাজারে অন্তত চল্লিশে ছাড়া চলবেই। দু-চার জন লোক তো এর মধ্যেই আনাগোনা শুরু করেছে, মিলিটারির কনট্র্যাক্ট নাকি পেয়েছে তারা। টাকার জন্যে আটকাবে, একরাশ ঝকঝকে তকতকে নতুন নোট দিয়ে যেকোনো দরেই কিনে নিতে রাজি হয়েছে। তবু বাজারের হালচাল আরও একটু দেখেশুনে নেওয়াটাই ভালো।

আপনার কাছেই যে এলাম কর্মকারমশাই।

গোলপাড়া হাটের তিন জন মহামান্য মহাজন এসে দর্শন দিয়েছে। মধুসূদন কুন্ডু, নিত্যানন্দ পোদ্দার আর জগন্নাথ চক্রবর্তী।

এসো এসো, তামাক খাও ভায়ারা। তারপর সবাই মিলে? ব্যাপারটা কী?

ব্যাপার আর কিছু নয় দাদা, হরিসভায় একটা অষ্টপ্রহরের বন্দোবস্ত করছি। শুনছি সত্যযুগ আসছে, কল্কি অবতার নামবেন মর্তে মহাপাপীদের বিনাশ করতে। দেশের যা অবস্থা হচ্ছে, তাতে নামকেত্তনটা…

নিশ্চয়, নিশ্চয়! কলির কলুষ দূর করতে ওর মতো জিনিস কি আর কিছু আছে। কলৌনাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব…

কাল সন্ধেয় তা হলে যেয়ো দাদা। কিছু চাঁদা দিতে হবে।

হরিসভায় অষ্টপ্রহর কীর্তনের বিপুল আয়োজন। আট-দশটা কাটা কলা গাছের ওপর মোমবাতি বসিয়ে আর লণ্ঠন ঝুলিয়ে তৈরি করা হয়েছে আসর। তলায় ছেড়া মাদুর পাতা, তার ওপর গাঁজার কলকে সাজিয়ে নিয়ে গোলাপাড়া হাটের মহাজনেরা জমিয়ে বসেছে। গাঁজার কলকের একটা অসামান্য মহিমা আছে–নেশাটা কিঞ্চিৎ ঘনীভূত হলে যুগপাবন কল্কি প্রভুর অবতরণটা মনশ্চক্ষেই দেখা যায়। পাপীতাপীর এবার পরিত্রাণ নেই বটে, কিন্তু নাম এবং নেশার গুণে গোলাপাড়া হাটের মহাজনেরা যে সত্যযুগ অলংকৃত করতে চলেছে, কোনো পাষন্ডই এ ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করতে পারে না।

আশপাশ থেকে একদল বোষ্টম-বোষ্টমি জড়ো হয়েছে। অষ্টপ্রহরের পরে বৈষ্ণবভোজনের ব্যবস্থা আছে। নেশায় রক্তাক্ত তাদের চোখ, আর ব্যভিচারে ম্লান পাড়ুর মুখ। যে-আলোচনা তাদের মধ্যে চলেছে, তা আর যা-ই হোক আধিভৌতিক বা আধ্যাত্মিক কিছু নয়। ওদিকে একপাশে তিনটে বড়ো বড়ো কাঠের গুঁড়ি আগুনে রক্তাভ হয়ে জ্বলছে, থেকে থেকে একজন ধূপ ছড়াচ্ছে তাতে—অষ্টপ্রহরের ধুনি। একটু দূরেই বড় একটা হাঁড়িতে খিচুড়ি চাপানো হয়েছে, বৈষ্ণবদের চোখ থেকে থেকে সেদিক থেকে ঘুরে আসছিল।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে… আসরের চারদিকে ঘিরে ঘিরে চলেছে। অসংলগ্ন কীর্তন। অল্পবিস্তর পা টলছে দু-একজনের। শুধু গাঁজা নয়, ভাবের সাগরে নিঃশেষে তলিয়ে যাওয়ার জন্যে কেউ কেউ তাড়িও টেনে এসেছে। একজন এমনভাবে খোলের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে যে, দেখে মনে হয় ওটা সে যেমন করে তোক ভাঙবেই—এই  তার স্থিরসংকল্প। আর একজন ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তান্ডব তালে আকাশের দিকে লক্ষপ্রদান করছে, যেন ওপর থেকে কী-একটা পেড়ে নামাবে, বোধ হয় ভক্তিবৃক্ষের মুক্তিফল।

নিশি কর্মকারের চোখ নিদ্রিত। সমস্ত দেহে তার কদম্বকেশরের মতো রোমাঞ্চ, অষ্টসাত্ত্বিক ভাব একে একে প্রকট হয়ে উঠছে বুঝি। গোটা সভার উপর দিয়েই যেন ভাবের ঘোর লেগেছে। পোড়া মোমবাতি, গাঁজা, ধুনো, পোড়া কাঠ আর অর্ধসিদ্ধ খিচুড়ির একটা মিশ্রিত গন্ধে যেন নিশ্বাস আটকে আসে। মোমবাতির আলোগুলো দু-একটা করে নিবতে নিবতে ক্রমশ ম্লানতর হয়ে আসছে; ধুনির আগুনের লাল আভা বোষ্টম-বোষ্টমিদের ব্যভিচারচিহ্নিত অপরিচ্ছন্ন মুখগুলোকে অদ্ভুতভাবে একাকার করে দিয়েছে। পেটভরে যারা তাড়ি টেনে এসেছিল, তাদেরই একজন নাচতে নাচতে ধড়াস করে আছড়ে পড়ল, দশা লেগেছে নিশ্চয়। ঊর্ধ্ববাহু লোকটির লক্ষপ্ৰদান আরও উদ্দাম হয়ে উঠেছে, একটুর জন্যে ফসকে যাচ্ছে ফলটা।

বাবু, বাবু, প্রিসিডেন্টবাবু।

সুর কেটে গেল। সাক্ষাৎ ভগ্নদূতের মতো ইউনিয়ন বোর্ডের চৌকিদার এসে দেখা দিয়েছে, নিশ্চয় জরুরি ব্যাপার আছে কিছু। নাঃ, প্রেসিডেন্টগিরি করা আর পোষাল না। নির্বিঘ্নে একটু ধর্মকর্ম করবারও জো যদি থাকে।

বাবু, বাবু, প্রিসিডেন্টবাবু। উঠে আসতে হবে বাবু। সরকারি কাজ।

সরকারি কাজ। নিশি একবার ক্ষুব্ধ দৃষ্টিটা আসরের ওপর বুলিয়ে নিলে।

কীর্তন চলতে থাকুক আপনাদের। আমি ঘুরে আসছি একটু।

বাইরে এসে নিশি জাকুটি করলে, কী রে, তোদের আর সময়-অসময় নেই নাকি। এই রাত বারোটায় এত তাগিদ কীসের?

চৌকিদারের কন্ঠে উত্তেজনা, মতি পালের বউ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে বাবু। একবার যেতে হবে।

আর মতি পাল?

সেটাও মরেছে।

আপদ গেছে। বিরক্তিতে নিশির মুখ কালো হয়ে উঠল। কিছু প্রাপ্তিযোগ আছে বটে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্যিই ঝকমারি। গ্রামে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কিংবা কেউ অপঘাতে মরলে ছুটতে হবে সেই মড়া দেখবার জন্যে, থানায় রিপোর্ট করতে হবে। এই রাত বারোটার সময় যখন কীর্তনের আসরে ভাবের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ নিজে এসে ভর করেছেন ভক্তের ওপর, আর নামগানে কলির কলুষ ধুয়ে-মুছে নির্মল হয়ে যাচ্ছে, তখন কোথায় কে মতি পালের বউ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে তাই দেখবার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান হতে হবে! হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।

বিরস মুখে নিশি বললে, চল তাহলে। কিন্তু বউটা নাহয় গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে, মতি পাল মরল কী করে?

বাঁচবে কী করে বাবু? সমবেদনা এবং ক্ষোভে চৌকিদারের স্বর রুদ্ধ হয়ে এল, না খেয়ে মরেছে। আগে ভিক্ষে করত, তিরিশ টাকা চালের বাজারে কে ভিক্ষে দেবে এখন? বউটাও আর পেটের জ্বালা সইতে পারেনি, তাই গলায় দড়ি দিয়েই ঝামেলা মিটিয়েছে।

হুঁ।

চৌকিদার উৎসাহিত হয়ে উঠল। শুধু এই একটা বাড়িই নয় বাবু। এরকম চললে দু-মাসে দেশ উজাড় হয়ে যাবে। যে-আগুন চারদিকে জ্বলছে, কারও রেহাই পাওয়ার জো আছে! দেখুন-না, দু-তিন দিনের মধ্যে আরও পাঁচ-সাতটা মরার খবর…

হয়েছে, থাম থাম। নিশি ধমকে থামিয়ে দিলে তাকে। এসব কথা ভালো লাগে না শুনতে। যারা মরছে, মরুক তারা। কাল পূর্ণ হলে মানুষকে মরতেই হবে, কেউ তো আর লোহা দিয়ে মাথা বাঁধিয়ে আসে না। না খেয়ে মরেছে, সে তত কৃতকর্মের ফল। পূর্বজন্মের দুষ্কৃতির দেনা এ জন্মে শোধ করতেই হবে—হুঁহুঁ, বিধাতার রাজ্যে অবিচার হওয়ার জো নেই।

কালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন পথ। দু-ধারে বাঁশের ঝাড় বাতাসে শব্দ করছে। সেই শব্দে নিশি চমকে গেল। মনে হল, সেই বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে এখুনি বেরিয়ে আসবে মাংস-চর্মহীন অস্থিময় কতগুলো ছায়ামূর্তি, তিলে তিলে যারা না খেয়ে শুকিয়ে মরেছে তাদের প্রেতদেহ। আচমকা একটা ভয়ে নিশ্বাস আটকে এল তার। মনে হল সেই মূর্তিগুলো আর্তনাদ করে উঠবে— আমাদের খাদ্য, আমাদের জীবন নিয়ে লোভের ভান্ডারে জমা করেছ তুমি। তোমার ক্ষমতা, তোমার খত, তোমার আইন আমাদের প্রতিহিংসার হাত থেকে বাঁচিয়েছে তোমাকে। কিন্তু এখন? এখন? এখন?

নিশি প্রাণপণে জপ করতে লাগল, হরের্নামৈব হরের্নামৈব হরের্নামৈব কেবলম, কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব…

মতি পালের বাড়ি। চারিদিকে নানা জাতের আবর্জনা। বৃষ্টির এক পশলা  জল পড়ে সে আবর্জনাগুলো আরও কদর্য হয়ে উঠেছে। ভাঙা চাল, বাঁশ খুঁটি খসে-পড়া দাওয়া। সারা বাড়ি ভরে একটা গুমোট ভ্যাপসা আবহাওয়া,  তার মাঝখানে যেন ঘন হয়ে রয়েছে বাসি মড়ার গন্ধ। নাকে কাপড় চেপে ধরে নিশি সন্তর্পণে এগোতে লাগল। কোথায় অষ্টপ্রহরের আসর, আর কোথায়…

মতি পাল বারান্দাতেই পড়ে আছে। পেটের জ্বালায় দাওয়া থেকে বুঝি খানিকটা মাটি কামড়ে খেয়েছিল, একরাশ কর্দমাক্ত বমি গালের দু-পাশে জমে রয়েছে। পুরো বত্রিশটা দাঁতই তার বেরিয়ে আছে, মরবার আগে কী-একটা অসীম কৌতুকে খানিকটা পৈশাচিক হাসি হেসেছিল বলে মনে হতে পারে। পেটটা লেপটে রয়েছে পিঠের সঙ্গে, কালো নগ্ন পা-দুটোকে দেখাচ্ছে অস্বাভাবিক দীর্ঘ—যেন ভূতের পা। আর সবচাইতে অমানুষিক তার চোখ, যেন ভেতর থেকে একটা প্রচন্ড ঠেলা লেগে বাইরে বেরিয়ে এসেছে তারা। একটা চোখের অর্ধেকটা খাওয়া, নিশ্চয়ই ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে।

সামনেই ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। আর তার মধ্যে…

চৌকিদারের লণ্ঠনের আলোটা সেখানে পড়বার অপেক্ষা মাত্র। অবর্ণনীয় একটা আতঙ্কে দাওয়া থেকে সোজা লাফ দিয়ে নিশি একেবারে হুড়মুড় করে চৌকিদারের ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল। মতি পালের বউ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। শেষ সম্বল ছিন্ন লজ্জাবাস দিয়েই গলায় ফাঁস পরিয়েছে। লণ্ঠনের আলোয় সেই সম্পূর্ণ উলঙ্গ অস্বাভাবিক নারীদেহটা একটা দানবীয় বিভীষিকা যেন।

কম্পিত গলায় নিশি বললে, হয়েছে, চল চল।

চৌকিদার বললে, লাশ দুটো কী হবে বাবু?

থানায় খবর দে, ওরা যা খুশি করুক। যত সব কর্মভোগ—হরে কৃষ্ণ!

আবার অন্ধকার, বাঁশঝাড়ের পথ, হাওয়ায় বাঁশবনের একটানা শব্দ ঘুণে-খাওয়া ছিদ্রপথে যেন পেতনির কান্না বাজছে। ভয়ে নিশি কর্মকারের কোনো দিকে চোখ তুলে চাইতে সাহস হল না। অসীম আতঙ্কে কেবলই মনে হতে লাগল সমস্ত বাঁশবনের পথজুড়ে অসংখ্য মড়া ছড়িয়ে রয়েছে, তাদের কালো কালো শুকনো পাগুলো যেন ভূতের পা। আর বাঁশের আগায় আগায় গলায় কাপড়ের ফাঁস পরিয়ে ঝুলে রয়েছে অগণ্য নারীদেহ। তাদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেহগুলো একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। চারদিকে কি আজ মৃত্যুর সভা বসেছে।

উত্তপ্ত কপাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়তে লাগল নিশির। এই মৃত্যু, এই অপঘাত, এদের জন্য দায়ী কে? দৈব?

হরিসভা পর্যন্ত এগিয়ে দেব বাবু?

চৌকিদারের প্রশ্নে একটা আকস্মিক প্রচন্ড কম্পন নিশির পা থেকে মাথা পর্যন্ত থরথর করে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে ওষ্ঠ লেহন করে সে বললে, না চল, বাড়িতেই পৌঁছে দিবি আমাকে। কাজ আছে।

হাটখোলা পেরিয়ে নিশি কর্মকারের বাড়ি। সামনে ছোটো একটা আমের বাগান, ভালো ভালো ফজলি আর ল্যাংড়া আমের কলম লাগিয়েছে সে। নিজের বাড়ি, চেনা পথ, তবুও নিশির ভয় করতে লাগল। আজকের রাত্রিটা বিচিত্র, আজ এই কৃষ্ণপক্ষের ঘন-অন্ধকারে সমস্ত পৃথিবীজুড়ে যেন মতি পালদের প্রেতমূর্তি উঠে এসেছে! আকাশ-বাতাস-অরণ্য যেন তাদের অশরীরী ভৌতিক নিশ্বাসে আকীর্ণ।

বাড়ির সামনে পৌঁছোতেই চোখে পড়ল দরজার গোড়ায় সেই ঝরঝরে হারকিউলিস সাইকেলটা। ইব্রাহিম দারোগা অভিসারে এসেছে। শোনা যায় দুটো বিবি আর তিনটে বাঁদি আছে লোকটার, কিন্তু আগুনে ঘৃতাহুতির মতোই তাতে তার নিবৃত্তি নেই—বিশ্বগ্রাসী লালসা যাকে বলে।

বিশাখার ঘরের দরজাটা বন্ধ, ভেতরে অন্ধকার। তার মাঝখান থেকে চাপা গলার ফিসফিস আওয়াজ কানে এল। ক্ষুব্ধ নিরাশ্বাসে একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল নিশির। তারও যৌবন একদিন ছিল…

নিজের ঘর থেকে লণ্ঠনটা বার করে সেটাকে সে জ্বালাল। তারপর লণ্ঠন হাতে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল তার গোলাঘরের দিকে। আটশো মন চাল সে মজুত করে রেখেছে। বর্ষার বাজারে চল্লিশ টাকা দরে এই চালটা ছেড়ে দিলে সে শুধু লাল নয়—রক্তের মতো টকটকে লাল হয়ে যাবে। যুদ্ধের দিনকাল—মন্বন্তর যাকে বলে। কিছু যদি করে নিতে হয় তো এই সুযোগ।

গোলাঘরের দরজাটা খুলতেই বাতির আলোয় আটশো মন চালের বিশাল শুভ্র স্থূপটা ঝকঝক করে উঠল। যেন একটা রুপোর পাহাড়। রুপোর পাহাড় বই কী। মনপ্রতি যদি আটাশ টাকা লাভ হয়, তাহলে আটশো মন—

হঠাৎ একটা পচা গন্ধ এল নাকে। এখানেও পচা গন্ধ!

ঘরের টিন দিয়ে চুইয়েছে বর্ষার জল। সেই  জলের স্পর্শে ওপরের চালগুলো পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে—কী বীভৎস গন্ধ! মানুষের খাদ্য—ম জননীর শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ, কী বিশ্রী বিকৃত রূপ তার।

অন্তত পঞ্চাশ-ষাট মন যে ন দেবায় ন ধর্মায় গেল কোনো সন্দেহ নেই তাতে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কাতর একটা খেদোক্তি, এই দুর্বৎসরে এমন অপচয়! বর্ষা পর্যন্ত বোধ হয় রাখা চলবে না। কালই মিস্ত্রি ডেকে ঘরটা সারিয়ে ফেলতে হবে, আর পচা চালগুলোও ফেলে দিতে হবে বাইরে, নইলে ওগুলোর সংস্রবে সব চালই নষ্ট হয়ে যাবে। ভাগ্যে সময় থাকতে  তার চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। হঠাৎ নিশির মনে হল, কেন কে জানে, অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে হল, ঠিক এইরকম একটা পচা গন্ধই সে পেয়েছিল আর একবার। শিবপুরের হাট থেকে সে ফিরছিল। চোখে পড়েছিল মাঠের মাঝখানে একটা গলিত গোরুর দেহ আগলে বসে আছে একটা ঘেয়ো কুকুর; চারদিক থেকে শকুনেরা উড়ে উড়ে সেই মড়াটাকে ঠোকর মারবার চেষ্টা করছে আর কুকুরটা অস্বাভাবিক প্রচন্ড চিৎকার করে ক্ষুধার্ত শকুনগুলোকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।


© 2024 পুরনো বই