গোপেশ্বরবাবু পাগল হয়ে গেলেন।
পাগল হওয়ার পাত্র তিনি নন– বলাই বাহুল্য। খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক, বেজায় হিসেবি। আর এতই হিসেবি যে বাড়ির চাকর বাজার করে এনে পাঁচ পয়সার হিসেব ভালো করে দিতে পারেনি বলে তার মাস-মাইনের তিন টাকা কেটে তাকে তাড়িয়ে দিলেন তিনি।
যেমন অগাধ টাকা, তেমনি কৃপণ। একজোড়া জুতোয় পাঁচ বছর চলে, একটি জামায় এক বছর। ছেলে সস্তায় একটা গোটা ইলিশ কিনে এনেছিল বলে রেগে আগুন।
অ্যা– একটা আস্ত ইলিশ। পাঁচ টাকা দিয়ে। তুই তো আমায় ফতুর করবি দেখছি। বেরো– এক্ষুনি বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে
চটবার কথাই। যে বাড়িতে হপ্তায় একদিন দুশো গ্রাম কুচো চিংড়ি আসে, সেখানে একটা গোটা ইলিশ! ছেলে রেগেমেগে মিলিটারিতে চাকরি নিয়ে হায়দ্রাবাদে রওনা হল। গোপেশবাবু বললেন, বাঁচা গেল।
এহেন গোপেশবাবু পাগল হয়ে গেলেন। কিন্তু কেন গেলেন, সেইটেই বলি।
সেদিন বেলা এগারোটা নাগাদ তিনি বাইরের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। কাগজটা পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে-আনা- নিজে অবশ্যই তিনি পয়সা দিয়ে কাগজ কেনেন না।
এমন সময় একটি লোক। গায়ে ময়লা হাফশার্ট, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পরনে হাঁটু পর্যন্ত ছোট ধুতি এবং পায়ে জুতো নেই। রং ঘোর কালো, রোগা চেহারা।
দেখেই গোপেশবাবু বুঝে নিলেন।
মাপ করো বাবা, এখানে কিছু হবে না।
লোকটি বললে, ভয় পাবেন না সাহায্য চাইতে আসিনি।
তবে কী জন্যে? চাকরি? আমার বাড়িতে কাজের লোক দরকার নেই এখন।
আজ্ঞে, আমি চাকরি চাই না।
তবে।–আশ্চর্য হয়ে গোপেশবাবু বললেন, আমাকে দেখতে এসেছ নাকি?
লোকটি ফিক করে হাসল : আজ্ঞে, দেখবার মতো লোক তো আপনি বটেই। করতেন ফুটপাথে আলু বিক্রি এখন সাতখানা বাড়ির মালিক। একেই বলে চলে কর্মবীর! আপনার মতো লোককে দেখলেও তো পুণ্যি হয়।
গোপেশবাবু ভাবলেন, খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু ফুটপাথে আলু বিক্রির কথাটা মনে করিয়ে দেওয়া তাঁর ভালো লাগল না।
বললেন, ঠিক আছে- ঠিক আছে দর্শন তো হল। এবার কেটে পড়ো।
সে বললে, জলেই জল বাধে টাকাই টাকা আনে। একখানা লটারির টিকিট কিনবেন স্যার! আপনি কপালে লোক, নির্ঘাত পেয়ে যাবেন।
লটারির টিকিট। শুনেই গোপেশবাবু শক্ত হলেন। তিনি এসবে বিশ্বাস করেন না। আর কোনও কারণ নয়, তাঁর ধারণা– ওগুলো স্রেফ ধাপ্পাবাজি। ওদের সব নিজেদের লোকের সঙ্গে সাঁট থাকে তাদেরই দিয়ে দেয়। আর যত বোকারা আশায়-আশায় টিকিট কিনে টাকা নষ্ট করে।
অ, তুমি বুঝি লটারির এজেন্ট? দোকান বসিয়ে কুলোয় না- তাই বাড়ি বাড়ি হানা দাও? যাও যাও ও-সবের মধ্যে আমি নেই।
না স্যার আমি এজেন্ট নই। কাল এক টাকা দিয়ে একটা কিনেছি। কিন্তু বেকার লোক স্যার আজ দেখছি এ-বেলা যে দুখানা রুটি কিনে খাব, তারও সংস্থান নেই। সেই টিকিটটা আপনাকে বেচতে চাই– পকেট থেকে একটা টিকিট বের করল :একস-৫৮৮
লটারির টিকিট? আমি কিনব না–বেরোও।
স্যার, রাস্তার গনৎকার বলেছিল, এটা লাকি নাম্বার লাগবার চানস আছে। আপনি কপালে লোক, পেয়ে যাবেন। নিয়ে নিন। একসফাইভ এইট এইট
রাস্তার গনৎকার? জোচ্চোর।
স্যার, অত অবিশ্বাস করতে নেই। কিসে যে কী হয় বলা যায় না। নিতান্তই খিদের জ্বালায় এটা আপনাকে বেচতে এসেছি। বেশ– এক টাকা না দেন, বারো আনাই দিন।
বেরোও।
আজ্ঞে, আট আনা? ছআনা? অন্তত চার আনাই দিন তা হলে খিদেয় ভারি কষ্ট পাচ্ছি স্যার
গেট আউট গেট আউট।
ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করলেন গোপেশবাবু। লোকটা হকচকিয়ে নেমে গেল রাস্তায়।
ঠিক সতেরো দিন পর। ঠিক বেলা এগারোটা। পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে-আনা কাগজটা পড়তে পড়তে
হঠাৎ প্রবল একটি লাফ।
সেই লটারির ড্র। এবং প্রথম প্রাইজ তিন লক্ষ টাকা একস ফাইভ এইট এইট জিরো সেভেন। অবশ্য, ফাইভ এইট এইট পর্যন্ত শুনেছিলেন গোপেশবাবু লোকটাকে আর পাত্তাই দেননি।
কিন্তু কে বলতে পারে যে, তারপরে জিরো সেভেন ছিল না। আর রাস্তার গনৎকার বলেছিল, লাকি নাম্বার। লোকটা বলেছিল, আপনি কপালে লোক পেয়ে যাবেন।
গেল–গেল–গেল আমার তিন লক্ষ টাকা ডুকরে কেঁদে উঠলেন গোপেশবাবু।
দৌড়ে এল বাড়িসুদ্ধ লোক। চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে রাস্তায় বেরুলেন গোপেশবাবু ধরো-খোঁজো সেই লোকটাকে খাকী হাফ শার্ট রং কালো-রোগা–খেতে পায় না
— কিন্তু পনেরো দিন আগে যে এসেছিল আজ আর কে ধরবে তাকে কলকাতার রাস্তায়? বরং গোপেশবাবুকেই জাপটে ধরতে হল সবাইকে, নইলে একটা ডবল-ডেকারের তলায় চাপা পড়তেন ভদ্রলোক।
মুখে ফেনা তুলে চ্যাঁচাচ্ছেন তখনও : ধরো লোকটাকে আমার তিন লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল।
এখন গোপেশবাবু বদ্ধ পাগল। মানে– দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় তাঁকে।