ঘণ্টাদা বললে, ভীষণ প্যাঁচে পড়ে গেছি রে, প্যালা। চোখে সর্ষের ফুল দেখছি আমি।
কী হল তোমার? সর্ষের চাষ করছ নাকি আজকাল? আমি উৎসাহিত হয়ে বললুম, তোমার অসাধ্য কাজ নেই। তুমি পাটের দালালি করেছ, ঝোলা গুড়ের ব্যবসা করছ, সিনেমার জনতার দৃশ্যে অভিনয় করেছ বাজি রেখে কাঁচা ডিম খেতে গিয়ে বমি করেছ, পোড়ো বাড়িতে ভূত দেখতে গিয়ে ভিরমি খেয়েছ। শেষকালে কি সর্ষের চাষ আরম্ভ করে দিলে?
–থাম, মেলা বকিসনি! নাকটাকে পান্তুয়ার মতো করে ঘণ্টাদা বললে, আমি মরছি নিজের জ্বালায়– উনি ইদিকে এলেন ইয়ার্কি দিতে। হয়েছে কী, জানিস? আজই খবর পেলুম, বিকেলের গাড়িতে কাশীর কালুকাকা আসছেন।
–সে তো খুবই ভালো কথা! আমি আরও উৎসাহ বোধ করলুম; কাশী থেকে যখন আসছেন, তখন নিশ্চয়ই কিছু চমচম আর গজা নিয়ে আসছেন। আমিও খাব, বিকেলে।
-সে গুড়ে বালি, বুঝলি, সে জ্যাগারিতে স্রেফ স্যাণ্ড।–ঘণ্টাদা কথাটার ইংরেজী অনুবাদ করে নিলে : কাশী থেকে গজা-চমচম নিশ্চয়ই আনবেন, কিন্তু সে আর হাওড়া পর্যন্ত পৌঁছবে না। মোগলসরাইয়ের আগেই কাবলুকাকা ওগুলোকে সাবাড় করে ফেলবেন। …গলা নামিয়ে ঘন্টাদা বললে, কাবলুকাকা ভীষণ খেতে ভালোবাসেন, জানিস? একটা আস্ত পাঁঠা খেয়ে নেন একেবারে।
ল্যাজ-ট্যাজ, শিং-টিং সুব্ধ?–আমি জানতে চাইলুম।
–চুপ কর বাজে বকিসনি।…আমাকে একটা ধমক দিয়ে ঘণ্টাদা বললে, তা কথাটা যে একেবারে মন্দ বলেছিস তা-ও নয়। কাবলুকাকা যা খাদক- পাঁঠার শিং তো দূরে থাক, বেঁধে দিলে গলার দড়িগাছটাও খান বোধ হয়। বিশ্বখাদক বুঝলি, প্যালা– বিশ্বখাদক। তিন দিন থাকবেন। আর এই তিন দিনের মধ্যে আমাকেও খেয়ে যাবেন এই তোকে বলে দিলাম।
সত্যি বলতে কি, কথাটা বিশ্বাস হল না। ঘণ্টাদার মতো অখাদ্য জীব আমি দেখিনি। কালোবাজার করে বেশ টাকা জমিয়েছে, কিন্তু একটা পয়সা খরচ করবে না। পাড়ার ছেলেরা একটা ভালো কাজে চাঁদা চাইতে গেলে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। বাজারে গিয়ে মরা মাছ কুড়িয়ে আনে, সস্তায় কেনে পচা আলু। কাবলুকাকা যতো দিকপাল খাইয়েই হোক, ঘণ্টাদাকে খাওয়া তাঁর পক্ষেও সম্ভব নয়।
ঘণ্টাদা বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
যাই দেখি, বাজারে। সের দুই মাংস, সের তিনেক মাছ আর সের খানেক ঘি কিনেআনিগে। এই তিন দিনে যদি আমার দুশো টাকা খসিয়ে না যান, তা হলে আমার নামে কুকুর পুষিস, প্যালা।
–তোমার নামে কুকুর পুষলে লজ্জায় সে বেচারা সুইসাইড করবে– আমি মনে-মনে বললুম। তারপর জিজ্ঞাসা করলুম, তা, তোমারই বা হল কী, ঘণ্টা? তুমিই বা খামকা কাবলুকাকার জন্যে এত অপব্যয় করছ কেন?
আরে, করছি কি সাধে? কাবলুকাকার ছেলেপুলে নেই– বিষয়-সম্পত্তিও অঢেল। যদি উইল-টুইল করবার সময়!
আমি মাথা নাড়লুম : বিলক্ষণ!
তবে, এই তিন দিনেই আমাকে আদ্ধেক মেরে রেখে যাবেন। এমন করে খেয়ে যাবেন যে, আমার হার্টফেল হওয়াও অসম্ভব নয়। তখন কাবলুকাকার সম্পত্তি পেলেই কি আর না পেলেই বা কি। রাস্তায় একটা কাকের পালক পড়েছিল, সেটা তুলে নিয়ে কান চুলকোতে-চুলকোতে ঘণ্টাদা বললে, তা আমিও একটা প্যাঁচ কষেছি, বুঝলি? আমার বাড়িতে একখানা ঘোরতর ফিতের খাটিয়া আছে। তাতে অন্তত দুকোটি ছারপোকার বাস। তাইতেই কাবলুকাকাকে শুতে দেব। তারপর
–তারপর যদি চটে গিয়ে উইল-টুইল বদলে ফেলে তখন?
-না না, কাশীর লোক, অত ঘোরপ্যাঁচ বুঝবেন না। খেতে পেলেই খুশি। এদিকে আমি ভুরি-ভোজের ব্যবস্থা করব। খেয়ে কাবুলকাকা মশগুল হয়ে যাবেন, আবার ছারপোকার কামড়ে জেরবার হয়ে পালাতেও পথ পাবেন না–অ্যাঁ?
–তা বটে–তা বটে! ভেবেচিন্তে আমি মাথা নাড়লুম।
সেই কাকের পালকটা দিয়ে কান চুলকোতে-চুলকোতে ঘণ্টাদা বাজারে চলে গেল।
আমার দুর্দান্ত কৌতূহল হল। সেদিন সন্ধেবেলাতেই আমি সেই রোমাঞ্চকর কাবলুকাকাকে দেখতে পেলুম।
দোরগোড়ায় আলুর দমের মতো মুখ করে ঘণ্টাদা দাঁড়িয়েছিল। ঘরের ভেতরে আঙুল বাড়িয়ে বললে, ওই দ্যাখ। মানুষ নয় প্যালা,–মানুষ নয়। সাক্ষাৎ বক-রাক্ষস।
বক রাক্ষসটাকে দেখবার জন্যে আমি ঘরে পা দিলুম। একটা টেবিলের ওপরে প্রকাণ্ড একটা বারকোশ দেখা গেল, আর তার ওপর দেখা গেল শখানেক লুচি। আর কিছু না।
হঠাৎ লুচির স্তূপের ওপাশ থেকে প্রকাণ্ড একখানা হাত বেরিয়ে এসে খান-দশেক আন্দাজ একসঙ্গে তুলে নিলে। খচ খচ করে লুচি চিবোবার আওয়াজ পাওয়া গেল… কিন্তু তবু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না; ভৌতিক কাণ্ড নাকি?
আবার সেই প্রকাণ্ড হাতখানার আর্বিভাব এবং খান-পনেরো লুচির তিরোধান। তারপর লুচির পাহাড়টা একটু নীচের দিকে নামতে কাবলুকাকাকে দেখা গেল।
বাপ…কী চেহারা! ওজন বোধহয় মন চারেক হবে, মুখখানা একেবারে ঢাকাই জালা। চেহারা দেখে মনে হল, একটা আস্ত পাঁঠা তো তুচ্ছ ব্যাপার…নগদ একটা ঘোড়া খাওয়াও অসম্ভব নয়, কাবলুকাকার পক্ষে।
কিন্তু চেহারা অমন জগঝম্প হলে কী হয়…লোকটির মেজাজ ভালো। আমাকে দেখে একগাল হাসলেন।
–তুমি আবার কে হে? কোথায় থাকো?
আমার হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। কাবলুকাকার হাসি দেখে কেমন সাহস এল গায়ে। বললুম, আমার নাম প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে, আমি পটলডাঙায় থাকি।
ততক্ষণে ছোলার ডালের মতো মুখ করে ঘণ্টাদা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেখছে লুচির পরমাগতি। ওর একটা বুক-ভাঙা দীর্ঘশ্বাসও আমি শুনতে পেলুম।
কাবলুকাকা থাবা দিয়ে আধ সেরটাক কুমড়োর ছক্কা মুখে তুললেন। ঘণ্টাদার মুখটাও কুঁচকে-টুচকে প্রায় কুমড়োর ছক্কার মতো হয়ে গেল।
কাবলুকাকা ভরা-মুখে বললেন, তুমি এত রোগা কেন?
আজ্ঞে পালাজ্বরে ভুগি, আর বাসক পাতার রস খাই
–আরে দূর-দূর–পালাজ্বর! জুত মতো খেতে জানলে ও পালাজ্বর ল্যাজ তুলে পালাবে। শোনো, এক কাজ করবে। সকালে উঠে চা খাও? খেয়ো না আর। ওতে কোনও ফুড-ভ্যালু নেই– অনর্থক শরীর নষ্ট। তার চেয়ে ভোরে উঠেই একপো খাঁটি গাওয়া ঘি চোঁ-চোঁ করে খেয়ে নেবে।
এক পোয়া খাঁটি গাওয়া ঘি!– আমার চোখ কপালে চড়ল।
–এ আর বেশি কী? আমি তো আধসের করে খাই। ওরে ঘণ্টা, আমার ঘিয়ের ব্যবস্থা করে রাখিস কাল। মনে থাকবে?
ঘণ্টাদা মাথা নাড়ল। মনে থাকবে মানে? সারারাত বেচারার ঘুম হলে হয়।
–আর শোনন, দুবেলা দুটো করে মুরগির রোস্ট- সেরটাক দাদাখানি চালের ভাত আর দুসের করে দুধ খাবে। তুমি ছেলেমানুষ তাই লঘু পথ্য দিলুম। আমি ছটা করে মুরগি খাই, তিন সের চালের ভাত লাগে, আর ছসের করে দুধ খেয়ে থাকি। ঘণ্টা, মনে থাকবে তো?
ঘণ্টাদার হাত-পা কাঁপছিল। গলা দিয়ে কেমন একটা আওয়াজ বেরুল তার। ওর হয়ে আমিই জবাব দিলুম : নিশ্চয় থাকবে। হাজার বার থাকবে। ঘণ্টাদার মেমারি খুব ভালো।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে-আসতে ঘণ্টাদা ধরা গলায় আমায় বললে–কী রকম বুঝছিস, প্যালা?
-সঙিন।
-খাওয়ার যা লিস্টি দিচ্ছে, জগুবাবুর বাজারে কুলুবে না– গড়িয়াহাট মার্কেটে যেতে হবে। এই তিন দিনেই আমি ফতুর হব, প্যালা- আমায় রাস্তায় দাঁড়াতে হবে।
ইচ্ছে হল বলি, কালোবাজারি করে কয়েক লাখ টাকা তুমি জমিয়েছ, কাবলুকাকাই হচ্ছে তোমার আসল দাওয়াই। কিন্তু অনর্থক ঝগড়া করে কী হবে?
ঘণ্টাদা মুড়িঘণ্টর মতো মুখ করে বললে, তবে সেই দুর্ধর্ষ খাটখানা আছে, আর দুর্ধর্ষ ছারপোকা আছে। এখন ওরা যদি ম্যানেজ করতে পারে–তবেই।
–হ্যাঁ, আপাতত ওরাই তোমার ভরসা। বলে ঘণ্টাদার কাছ থেকে আমি বিদায় নিলুম।
সকালে উঠে সবে লজিকের বই খুলে বসেছি। কী যে মুস্কিল– ওই বারবারা সিলারেন্ট আমার কিছুতেই মনে থাকে না।
হঠাৎ দ্বারপ্রান্তে– ঘণ্টাদা।
ঘণ্টাদার মুখখানা তখন ডিমের কারির মতো হয়ে গেছে। কেঁদে ঘণ্টাদা বললে– প্যালা, সর্বনাশ হয়েছে। এবার আমার ফাঁসি হবে।
বলল কী? খাওয়ার বহর দেখে রেগেমেগে তুমি কাবলুকাকাকে খুন করে ফেলেছ নাকি?
–জানিস তো, আমি একটা আরশোলাও মারতে পারিনে।
তা হলে খামকা তোমার ফাঁসি হবে কেন?
বরাত প্যালা– স্রেফ বরাত। কাবলুকাকা মারা গেছেন।
–অ্যাঁ।
তা ছাড়া কী আর? ওই দু কোটি ছারপোকা, জানিস তো? ওদের হাতে কারও রক্ষা আছে? নির্ঘাত ওদের কামড়ে কাবলুকাকা পটল তুলে বসেছেন। এই দ্যাখ না– সকাল থেকে দুঘণ্টা দরজায় ধাক্কা দিয়েছি, জানলার ফাঁক দিয়ে পিচকিরি করে বরফ জল দিয়েছি। গায়ে, তবু নট নড়নচড়ন, কিসসু না।
–তবে পুলিশে খবর দাও!
–পুলিশ! ওরে বাবা! এমনিতেই ওরা দুবার আমার বাড়ি সার্চ করেছে, আমি নাকি চায়ের সঙ্গে চামড়ার কুঁচো মেশাই। এখনও ধরতে কিছু পারেনি বটে, কিন্তু নেকনজরটা তো আছে! নির্ঘাত বলবে, চক্রান্ত করে এই ভয়ঙ্কর খাটিয়ায় শুইয়ে আমি কাবলুকাকাকে খুন করিয়েছি। তখন ফাঁসি না হোক– বিশ বছর জেল আমার ঠেকায় কে?
তোমাকে জেলে রাখলে দুনিয়ার অনেক উপকার হবে আমি মনে-মনে বললুম। মুখে সাহস দিয়ে বললুম– চলো দেখি, যাই একবার। বুঝে আসি ব্যাপারটা।
যেতে যে আমার পা সরছে না, প্যালা।
–তবু যেতেই হবে। আমি কঠোর হয়ে বললুম- সেই ভয়াবহ খাটে শোয়াবার সময় মনে ছিল না? চলো বলছি– আমি প্রায় জোর করে ঘণ্টাদাকে টেনে নিয়ে গেলুম।
কিন্তু বসবার ঘরে ঢুকে আমরা ভূত দেখলুম।
ভূত নয়– সশরীরে কাবলুকাকা বসে। সামনে একটা কাচের গ্লাস– তাতে আধ সের আন্দাজ গাওয়া ঘি। একটু একটু করে পরম আরামে চুমুক দিচ্ছেন কাবলুকাকা।
আমাদের দেখেই তিনি হাসলেন। বললেন, এই যে ঘণ্টা–কোথায় গিয়েছিলি? আঃ কাল রাতে যা ঘুমিয়েছি– সুপার্ব। তাই উঠতে আজ একটু দেরিই হয়ে গেল।
ঘণ্টাদা একবার হাঁ করল। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরুল না তার।
কাবলুকাকা ঘিয়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে বললেন– চর্বি একটু বেশি হয়েছে শরীরে রাত্তিরে তাই ভালো ঘুম হয় না। কেমন গা জ্বালা করে। কিন্তু কাল সারারাত কারা যেন মোলায়েমভাবে গা চুলকে দিয়েছে। সে কী আরাম। এক বছরের মধ্যেও আমার এমন নিটোল ঘুম হয়নি। তাই উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল আজ। আমি ভাবছি কী জানিস ঘণ্টা– তিন দিন কেন, মাসখানেকই থেকে যাব তোর এখানে।
হঠাৎ গোঁ-গোঁ করে আওয়াজ। ঘণ্টাদা পপাত ধরণীতলে।
–কী হল? ঘণ্টার আবার মৃগী আছে নাকি?
আমি বললুম- মৃগী নয়। আপনি একমাস ওর কাছে থাকবেন জেনে আনন্দে মূর্ছা গেছে।