পর পর দুবার আই-এ ফেল করলে কার আর মেজাজ ভালো থাকে? তার ওপর বড়দা যখন বললেন, ওর আর পড়ে দরকার নেই–এবার গলির মোড়ে বিড়ির দোকান করে দেব, তখন ডাবু স্রেফ উড়ন-তুবড়ির মতো ছিটকে পড়ল বাড়ি থেকে।
ময়দানে বসে বসে যখন ভাবছে আত্মহত্যা করবে না সিনেমা দেখতে যাবে, ঠিক সেই সময় স্বামী ঘুর্ঘুরানন্দের আবির্ভাব।
ইয়া জটা, অ্যায়সা দাড়ি–চোখ দুটো লাট্টুর মত ঘুরছে। ডাবুর সামনে এসেই বাজখাঁই গলায় বললেন, এই ছোকরা, তোমার পকেটমে কেনা যায়?
আওয়াজ শুনেই ডাবু ভেবড়ে গেল। একটা চীনেবাদাম চিবুচ্ছিল, কটাৎ করে গলায় আটকে গেল সেটা। হুস করে বলে ফেলল, বারো আনা হ্যায়।
–তব ছ আনা দে দো।
–কেন?
-কেন আবার কেয়া! আমি ঘুর্ঘুরানন্দ হ্যায়। ছআনা দে দো। বহুত আচ্ছা উপদেশ দেগা–তোমার খুব ভালো হোগা।
উপদেশের আশায় নয়–ঘুর্ঘুরানন্দের চেহারা দেখেই ছআনা পয়সা পকেট থেকে বার করে দেয় ডাবু। না দিলে জোর করে হয়তো বারো আনাই কেড়ে নেবে। আরও এখন কাছাকাছি লোকজন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
ছআনা গুনে নিয়ে ঘুর্ঘুরানন্দ হাসলেন। তারপর তেমন বাজখাঁই গলায় বলেন, সব সময় হাসি মুখমে থাকে গা বুঝেছ? সদা হাস্যমুখে থাকিবে। দেখবে, সব ঠিক হো যায়ে গা।
এই বলেই সুড়ত করে কোনদিকে চলে গেলেন ঘুর্ঘুরানন্দ। সন্ধ্যার অন্ধকারে ডাবু সেটা ভালো করে ঠাহর করতে পারল না।
একবার মনে হল, লোকটা জোচ্চোর–একদম মাথায় চাঁটি বসিয়ে ছগণ্ডা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে গেল। তারপর ভাবল, কে জানে কোনও মহাপুরুষই হয়তো বা। ডাবুর মনের ব্যথার খবর পেয়ে তার সঙ্গে ছলনা করে গেলেন।
সে যাই হোক–উপদেশটা মেনেই চলা যাক না। সদা হাস্যমুখে থাকিবে। মন্দ কী? আই-এ ফেল করে তিনদিন তো সমানে কাঁদতেই হয়েছে–একদিন হেসেই দেখা যাক না, না হয়। কী থেকে যে কী হয়, কেউ বলতে পারে সে কথা?
চীনেবাদাম খেতে-খেতে ডাবু উঠে পড়ল। হাস্যমুখেই। এসপ্ল্যানেড গুমটির সামনে এসে ট্রামের জন্যে দাঁড়াতে হল ডাবুকে। শ্যামবাজারের গাড়ি ধরতে হবে তাকে। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুর্ঘুরানন্দের কথাই সে ভাবছে ঠিক এই সময় কাণ্ড হল একটা।
-কী মশাই, হাসছেন যে?
ডাবু চমকে ফিরে তাকাল। ঘাড়ে-গদানে ঠাসা প্রচণ্ড মোটা এক ভদ্রলোক তার সামনে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, একটা খইয়ের বস্তার একটা মাথা আর গোটাকয়েক হাত-পা গজিয়েছে। দুটো কুতকুতে চোখের দৃষ্টি ডাবুর ওপর ফেলে ঘ্যাঁসঘেঁসে গলায় ভদ্রলোক বললেন, হাসছেন কেন মশাই?
-এমনি।
–এমনি?–ভদ্রলোক প্রায় তেড়ে উঠলেন : তখন থেকে সমানে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন–বললেই হল, এমনি?
–আমি তো স্যার দেখতে পাইনি আপনাকে।
–দেখতে পাননি বটে? এই কলকাতা শহরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল দেখবার আগে লোকে আগে আমায় দেখতে পায়–আর আপনি পাননি! দেখুন মশাই–মোটা লোক দেখলে কক্ষনো হাসবেন না। মোটা হওয়ার যে কী দুঃখু–যে হয়েছে সেই জানে। তা ছাড়া সব দিন সমান যায় না মশাই। আজ আপনি শুটকী মাছের মতো রোগা আছেন, তাই ভারি ফুর্তি। কিন্তু দুদিন পরে আপনিই যে ট্যাপা মাছের মতো মোটা হয়ে যাবেন না–কে বলতে পারে?
বলছি, আপনাকে দেখে আমি হাসিনি
–হাসেননি মানে? এখনও তো হাসছেন। জানেন, আমি কী করতে পারি? চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারি–পুলিশ ডাকতে পারি–
–তাই ডাকুন বলতে বলতেই ডাবু সামনের ট্রামগাড়িটায় লাফিয়ে উঠে পড়ল।
সদা হাস্যমুখে থাকিবে–ঘুর্ঘরানন্দের উপদেশ। কিন্তু এই প্রথম থেকেই কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তা হোক। আজকের দিনটা সে পরীক্ষা করেই দেখবে।
পকেট হাতড়ে আবার সে গোটাকয়েক চীনেবাদাম বের করলে। ট্রাম চলছে আর সেই সঙ্গে চলছে বাদাম খাওয়া। ঘুর্ঘরানন্দের কথাটা ঘুরছে মাথার মধ্যে। এমন সময় সামনের সিটের লোকটি হাউ-মাউ করে উঠলেন।
–দাদা! ও–দাদা।
ডাবু খেয়াল করেনি প্রথমটায়। কিন্তু পরক্ষণেই ডাক এল, এবার রীতিমতো আর্তনাদ যেন।
–ও চীনেবাদাম-খাওয়া দাদা, শুনছেন?
ডাবু ফিরে তাকাল।
সামনের সিটে কালো লম্বা লোকটি প্রায় তেড়ে উঠেছেন ততক্ষণে।–বলি, আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে খুব যে হাসা হচ্ছে। না হয় চোখ দুটো আমার ট্যারাই আছে, তাতে হাসির কী পেলেন এত?
–আমি তো সে-জন্য হাসিনি।
তবে কী জন্যে? ল্যাম্পপোস্ট দেখে হাসছেন? ট্রামগাড়ি দেখে হাসছেন? না জুতোর দোকান দেখে হাসি পাচ্ছে আপনার? আমি দর্জিপাড়ার বেচু গড়গড়ি-বেশি চালাকি করবেন না আমার সঙ্গে।
-কেন খামকা চালাকি করতে যাব আপনার সঙ্গে? কী দায় আমার?
বটে। বটে।–বেচু গড়গড়ি প্রায় রুখে উঠলেন : তা হলে হাসছিলেন কেন আমার ট্যারা চোখ দেখে? ন্যাকা পেয়েছেন আমাকে?
কী মুস্কিল। ওটা আমার অভ্যেস।
অভ্যেস? এর পরে হয়তো আমার নাকটাকে খিমচে দিয়ে বলবেন, ওটাও আমার অভ্যেস। হয়তো কটাং করে কান কামড়ে দিয়ে বলবেন, ওটাও আপনার অভ্যেস! নইলে ঝটাং করে একটা ক্ষুর বের করে আমার চাঁদিটা চেঁছে দিয়ে বলবেন–ওটাও আপনার অভ্যেস? কী–তবুও হাসছেন? ভালো হবে না দাদা-ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমার ছোটমামা বকসিং লড়তে পারে-মনে থাকে যেন সেকথা। :
আহা যেতে দিন–যেতে দিন ট্রামের দু-চারজন এতক্ষণে মাঝখানে এসে পড়লেন।
–যেতে দেব কী।–বেচু গড়গড়ি আবার আর্তনাদ করে উঠলেন : ওই দেখুন না, এখনও হাসছে।
ডাবু কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় টামের দরজার গোড়ায় শোরগোল উঠল একটা।
পকেট মেরেছে-পকেট মেরেছে
হায় হায়! পাঁচশো টাকা নিয়ে গেছে আমার-পাঁচশো টাকা–একজন মারোয়াড়ী ভদ্রলোক ডুকরে উঠলেন।
ঝড়াং করে ট্রাম থেমে গেল।
কী করে নিলে মশাইকে– নিলে? কখন নিলে?
মারোয়াড়ী ভদ্রলোক হাত-পা ছুড়তে লাগলেন।
–নেবে আর কী করে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা তুলে নিয়েছে ব্যাগসুদ্ধ।
–কে নিলে তাই বলুন।
–কে নিলে তা জানতে পারলে আর চিল্লাব কেন মশাই? ক্যাঁক করে তক্ষুনি তো তার টুটিটা চেপে ধরব।–ভদ্রলোক হাহাকার করতে লাগলেন; রেসের মাঠে খেলতে গিয়ে মুফত রোজগার হয়েছিল টাকাটা-হায় হায়।
অধর্মের টাকা ও-ভাবেই যায়–কে একজন জুড়ে দিলে মাঝখানে।
হঠাৎ বেচু গড়গড়ি লাফিয়ে উঠলেন সিট ছেড়ে। ক্ষিপ্ত জিঘাংসা তাঁর ট্যারা চোখে।
-নির্ঘাত এই লোকটাই আপনার পকেট মেরেছে শেঠজী। তখন থেকে মিটমিট করে হাসছে সেইজন্যে।
ডাবু একেবারে আকাশ থেকে পড়ল : আমি?
তা ছাড়া কী? মনে ফুর্তি না থাকতে অমন খামকা হাসি পায় কারও। আর নগদ পাঁচশো টাকা হাতে পেলে মনে ফুর্তি বান ডেকে না যায়? বলুন স্যার আপনারাই বলুন।
–ঠিক ঠিক।
কষে লাগিয়ে দিন দু ঘা। পুলিশে দিন।
প্রায় মার মার করে সারা ট্রামের লোক ডাবুর দিকে ছুটে এল।
–দেখছেন, এখনও মুখে হাসি।
–নির্ঘাত পাকা পকেটমার
কিন্তু বাঁচিয়ে দিলেন মারোয়াড়ী ভদ্রলোক নিজেই।
হায় হায় মোশা, আপনারা কি পাগল হলেন? ওই ভদ্রলোক অত দূরে বসে আছেন, দশ গজ লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে আমার পকেট মারবেন নাকি?
-ঠিক ঠিক। তাও তো বটে।
–ওঁর হাতটা মেপে দেখুন না, কগজ লম্বা।
হায় হায়! মারোয়াড়ী ভদ্রলোক হাহাকার করতে লাগলেন : আমি টাকার শোকে মরছি, আর আপনারা পাগলামি শুরু করলেন।
-সত্যিই তো, কী পাগলামি করছেন আপনারা, এত দূর থেকে উনি কী করে পকেট পারবেন?–বেচু গড়গড়ি আর-একজনকে বললেন।
–আপনিই তো গোড়াতে বললেন মশাই সে-ভদ্রলোক খেপে উঠলেন।
বা রে, আমি তো ঠাট্টা করছিলাম।
–ঠাট্টা! এ কোন দিশি ঠাট্টা। সাদাসিধে একজন নিরীহ লোককে গাঁটকাটা বলা? ট্যারা লোকগুলোর বুদ্ধিই এমনি।
কী বললেন, ট্যারা।-বেচু গড়গড়ি চেঁচিয়ে উঠলেন : জানেন, আমি দর্জিপাড়ার লোক? জানেন, আমার ছোটমামা বকসিং করে।
ট্রামটা চলছিল, আবার কড়াং করে থেমে পড়ল। কণ্ডাক্টার ঘণ্টি মেরে দিয়েছে। মারোয়াড়ী ভদ্রলোকের হাহাকার, বেচুর আর্তনাদ–প্রলয় কাণ্ড শুরু হয়ে গেল।
কিন্তু আর নয়–ডাবু ভাবল : এই বেলাই মানে মানে গাড়ি থেকে নেমে পড়া ভালো।
সামনে ওয়েলিংটন স্কোয়ার। ট্রাম থেকে নেমে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল ডাবু। উঃ সদা হাস্যমুখে থাকাটা কী ভয়ঙ্কর! আধ ঘণ্টাও চেষ্টা করতে হয়নি এরই মধ্যে বারকয়েক ফাঁড়া কেটে গেল। আর-একটু হলে পকেটমার বলে ঠেঙিয়ে ঠোঙা করে দিত।
স্বামী ঘুর্ঘুরানন্দকে হাতের কাছে পেলে হয় একবার। আদত জোচ্চোর লোকটা। স্রেফ ভোগা দিয়ে ছআনা পয়সা মেরে দিলে। তিনদিন পাঁঠার ঘুগনি খাওয়াই বরবাদ।
ঘাসের ওপর বসে পড়তে যাবে, এমন সময় হাফশার্ট পরা বেঁটে লোকটা এগিয়ে এল। একেবারে পাশ ঘেঁষেই দাঁড়াল ডাবুর।
আমি গ্যাঁড়াতলার গাঁট্টালাল, আমাকেও আপনি জব্দ করেছেন স্যার।
–মানে? কী বলছ তুমি!
–কেন স্যার ছলনা করছেন? ওই মিটমিটে হাসি, পেছনে-পেছনে আসা, বুঝতে কি বাকি থাকে? যাক স্যার-ওটা চেপেই যান, পুলিশে আর খবর দেবেন না। আমি অর্ধেক শেয়ার দিচ্ছি আপনাকে।
বলেই, ডাবুর হাতের মধ্যে কী কতকগুলো কাগজ গুঁজে দিয়ে সুড়ৎ করে অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল হাফশার্ট পরা বেঁটে লোকটা। যেমন করে স্বামী ঘুর্ঘুরানন্দ মিলিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেইরকম।
কিন্তু হাতের কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে ডাবুর হাসি বন্ধ হয়ে গেল। মিটমিটে হাসি একদম বন্ধ হয়ে গেল এতক্ষণে। সেগুলো কাগজ নয়–একতাড়া দশ টাকার নোট।