–এ লালগোলা লাইন মশাই, ডেঞ্জারাস চোরের জায়গা-বলতে বলতে ঢুকলে ভদ্রলোক। এক হাতে একটি ছোট অ্যাটাচি–এত ছোট যে পরামানিকের বাক্স বলে সন্দেহ হয়। আর-এক শতরঞ্জি জড়ানো একটি সংক্ষিপ্ত বিছানা।
লালগোলা লাইনের মহিমা আমি জানতাম। অনেক দিন এ-পথে আসিনি বলে, তবুও কথাটা মনে আনবর একটি সকরুণ কারণ কাছে। বছর পাঁচেক আগে একখানা সিল্কের চাদর আর খানকয়েক ধুতি-পাঞ্জাবি-সুদ্ধ একটি সুটকেস আমার এই লাইনেই মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে।
আজ হুঁশিয়ার হয়ে আছি। রানাঘাটের আগে নো ঘুম–নট কিচ্ছু। দুটো রক্ত-জলকরা ডিটেকটিভ উপন্যাস নিয়েছি সঙ্গে। মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়–এমনি একখানা ভুতুড়ে বিলিতি বইও হাতের কাছে রেখেছি। গোয়েন্দা যদি ঘুম তাড়াতে না পারে–ভূতের শরণ নেওয়া যাবে তখন।
আরও কী আশ্চর্য, বহরমপুরে আসতে না আসতেই সঙ্গী দুজনও নেমে গেলেন। এখন আমি একেবারে একা। বলতে গেলে, চোরের নির্বিঘ্ন শিকার হয়ে আছি। চারটে কড়া চুরুট বের করে একটা কোনায় ঠেসান দিয়ে বসলাম, তারপর গোয়েন্দা কাহিনী খুলে নিলাম। প্রথম অধ্যায়ের নামই ভয়ঙ্কর ঘাতক। বেশ জমে যাবে বলে মনে হচ্ছিল।
এমন সময় তিনি এলেন। আমার সহযাত্রী। আর গাড়িতে উঠেই মনে করিয়ে দিলেন। এ লালগোলা লাইন–ডেঞ্জারাস চোরের জায়গা।
মাঝখানের বেঞ্চটা ছেড়ে দিয়ে ওদিকের বেঞ্চিতে তিনি ছোট বিছানাটা ছড়িয়ে দিলেন। তারপর একটা কাঁচি সিগারেট ধরিয়ে ফসফস করে গোটাকয়েক টান দিয়ে বসে বসে রইলেন ঝিমন্ত বকের মতো। তারও পরে : কোথায় যাবেন, দাদা?
দাদা সম্ভাষণটা শুনলে আমার পিত্ত জ্বলে যায়। দুনিয়াসুদ্ধ লোককে ছোট ভাই বলে স্বীকার করতে আমার নিদারুণ আপত্তি আছে। ভ্রূ কুঁচকে আমি বললাম, কলকাতা।
–যাক বাঁচা গেল।-লোকটি শ্বাস ফেললেন : আমিও যাব কলকাতায়। দুজন থাকলে তবু খানিক ভরসা আছে। গাড়ি খালি দেখে প্রাণ চমকে উঠেছিল। এলাইনে ইন্টারক্লাশের টিকিট করাই ভুল মশাই–আরও এই ট্রেনে।
বললাম, তা বটে!
জুতো রেখেছেন কোথায়? ভদ্রলোক জানতে চাইলেন।
নীচে। পায়ের কাছেই আছে।
–ওটি করবেন না দাদা। বালিশের তলায় রাখুন–স্রেফ নিশ্চিন্দি।
–বলেন কী। পুরনো জুতো–তাও চুরি হবে নাকি?
-পুরনো জুতো কী বলছেন। ভাঙা খড়ম রেখে দিয়ে দেখুন না–তাও লোপাট হয়ে যাবে। এ-লাইনে চোরের ওই একটি গুণ আছে মশাই, কিছুতে অরুচি নেই। সিগারেটের একটা খালি খাপ ফেলে দিন, সকালে দেখবেন তাও হাওয়া। অভ্যেস রাখে আর কি বুঝলেন না? সামলান-জুতো সামলান। হোক পুরনো, তবুও মুচিকে বেচে দিলে কোন্–না ছগণ্ডা পয়সা আসবে।
–আপনি বুঝি এ-লাইন সম্বন্ধে খুব ওয়াকিবহাল?
–ওয়াকিবহাল মানে? গাঁজার কলকের মতো হাতের মুঠোয় সিগারেটটাকে ধরে চোঁ করে একটা টান দিলেন ভদ্রলোক : প্রায় ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলতে পারেন। প্রমাণ চান? এই দেখুন বলতে বলতে রোগা একখানা পা সটান আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
পা দেখে ডেলিপ্যাসেঞ্জার চেনা যায় এ-থিয়োরিটা জানা ছিল না। বোকা হয়ে বললাম, কী দেখব?
–জুতো-জুতো, দেখছেন তো, মিলিটারি বুট।
তাই তো। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষটি কাকের মতো কালো একখানা জীর্ণ-শীর্ণ পা, অথচ সে-পায়ে প্রকাণ্ড এক মিলিটারি বুট। সেই বুট-পরা বেড়ালের গল্পটা মনে পড়িয়ে দেয়।
ভদ্রলোক সগর্বে বললেন, নিন তো খুলে। এমন করে বেঁধেছি যে, আমাকে সুদ্ধ কিডন্যাপ না করলে জুতোটি নিতে হচ্ছে না।
–খুলবেন না?
–খেপেছেন?
–এইটে পরেই শোবেন?
–আলবাত। এলাইনে চলতে হয় বলে অভ্যেস করে নিয়েছি। বাড়িতে পর্যন্ত বুট পরে ঘুমুই। আমার স্ত্রী আগে আপত্তি করতেন, তাঁকেও একজোড়া করে দিয়েছি। এখন বেশ কমপ্রোমাইজ হয়ে গেছে। আজকাল বুট পরে ঠাকুরপুজো পর্যন্ত করেন–একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে নেন জুতোয়। বুট পরে ঠাকুরপুজো করছেন একটি ভদ্রমহিলা। ছবিটা কল্পনা করতে গিয়ে আমার বিষম লাগল। তবে, ভদ্রলোকের মুখে বিষাদের ছায়া পড়ল : এ-লাইনের চোর তো। অসাধ্য কিছুই নেই। একদিন যে খুলে নেবে না একথাও গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না।
বলেন কী, এমন?–আমি ডিটেকটিভ উপন্যাসটা নামিয়ে রাখলাম।
সত্যি কথা বললে ভাববেন গল্প করছি। সেদিন জঙ্গিপুরের এক জমিদার ভদ্রলোকের দাড়ি চুরি গেল মশাই এই ট্রেনে।
দাড়ি?–মনে হল, ভুল শুনছি।
–হ্যাঁ হ্যাঁ দাড়ি। নকল নয়, একেবারে ওরিজিন্যাল। মানে, ওঁর নিজের মুখের চামড়াতেই গজিয়েছিল সেটা। আর সে-একখানা কী দাড়ি মশাই! আজকাল থুতনির নীচে যে ছাগল-ব্র্যাণ্ড দেখা যায়–তা নয়। মানে, খাঁটি ঘি-দুধ খাওয়া দাড়ি-দালদা-ফালদার কোনও কারবার নেই। প্রায় হাতখানেক লম্বা–আর তেমনি ঘন। লোহার চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে হয়, সেলুলয়েডের দাঁত তাতে দন্তস্ফুট করতে পারে না। সে-দাড়ি নিয়ে গেল!
কী করে?
কামিয়ে। সকালে উঠে ভদ্রলোক দেখলেন, মুখ একেবারে পরিষ্কার। কোনও দাড়ি সেখানে কখনও গজিয়েছিল বলেই মনে হয় না।
–কিন্তু দাড়ি! দাড়ি নিয়ে কী করবে?
-বলেন কী!–ভদ্রলোক বিস্মিত হলেন : থিয়েটারওলারা তা লুফে নেবে। একটা হিস্টরিক্যাল মুঘল স্টোরির আগাগোড়া মেকআপ হয়ে যাবে এই একখানা দাড়িতে।
এবারে আমি হেসে ফেললাম।
বিশ্বাস করছেন না? সহযাত্রী উত্তেজিত হয়ে আর-একটা কাঁচি সিগারেট বের করলেন : আর্ট মশাই, সবটাই আর্ট। এরই নাম হাতের গুণ। পি.সি. সরকারের ম্যাজিক দেখেছেন? এও তাই। ভদ্রলোক হঠাৎ উঠে পড়লেন : দাঁড়ান দরজা-জানলাগুলো লক করি।
–সে কী করে হয়? রিজার্ভ-গাড়ি তো নয়। পথে অন্য প্যাসেঞ্জার এসে ধাক্কাধাক্কি করবে।
করুক না। করে করে হয়রান হয়ে অন্য গাড়িতে গিয়ে উঠবে। জায়গার তো অভাব নেই।
খুব মন দিয়ে দরজা-জানলাগুলো বন্ধ করতে লেগে গেলেন। ওঁর বুট-পরা পায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার রোমাঞ্চ হতে লাগল।
ফিরে এসে গেলেন নিজের বেঞ্চিতে। হাসলেন আত্মপ্রসাদের হাসি।
এবার নিশ্চিন্দি। কী বলেন?
আমি বললাম, যেরকম দুর্দান্ত চোরের গল্প বলছেন, কিছুতেই কি নিশ্চিন্ত হওয়ার জো আছে?
–তা যা বলেছেন! এ লালগোলা লাইনের চোর, সিগারেটে একটা টান দিয়ে আবার ঝিমন্ত বকের মতো খানিকটা চিন্তা করলেন ভদ্রলোক : ভালো মনে করিয়ে দিয়েছেন।
আবার উঠলেন : বাথরুমটা ম্যানেজ করা যাক।
বাথরুম?
হুঁ। ওটাও ওদের চলাচলের একটা রাস্তা কিনা–দিব্যি তলাটি খুলে আসেন, তারপর সেই পথেই আবার অন্তর্ধান। দেখেছেন? পকেট থেকে জড়ানো সুতোর দড়ি বের করলেন খানিকটা।
ওটা আবার কী?
–অ্যামেরিকান কর্ড। ডিসপোজালের জিনিস। হাতি পর্যন্ত বাঁধা যায় মশাই।
–ওটা দিয়ে কী করবেন?
–মেঝের বেঞ্চির সঙ্গে আর ওর লকের সঙ্গে বেঁধে রাখব। যদি কখনও যেতে চান, ফাঁসটা খুলে চলে যাবেন। কিন্তু ওর ভেতর থেকে কেউ যদি হাজার টানাটানিও করে, তা হলে খুলতে হচ্ছে না তাঁকে। স্যান্ডো কিংবা ভীম ভবানী হলেও না।
এবার আমি দস্তুরমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
সবরকম ব্যবস্থাই তো আপনার সঙ্গে দেখছি।
–কী করব, বলুন।–লকের সঙ্গে অ্যামেরিকান কর্ড বাঁধতে বাঁধতে বললেন : নেসেসিটি ইজ দি মাদার অব ইনভেনশন। জানেন তো! আজ আনতে ভুলে গেছি, আমার সঙ্গে ব্যাঙবাজনা পর্যন্ত থাকে।
ব্যাঙ-বাজনা? সে আবার কী?
–দেখেননি? ওই যে মাটির খুরির ওপরে পাতলা চামড়া দেওয়া, তার ওপরে দুটো কাঠি? দড়ি ধরে টানলেই প্যাং প্যাং করে বাজতে থাকে? মানে, ছেলেপুলেরা রাস্তা দিয়ে টানে।
বুঝেছি। কিন্তু কী হয় ও দিয়ে?
বড় সুটকেস-টুটকেস থাকলে–মানে যা মাথায় দিয়ে শোওয়া যায় না তার সঙ্গে বেঁধে রাখি। কেউ ধরে টান দিয়েছে কি ট্যাং ট্যাং করে সাড়া দিয়ে উঠবে। একবার চিংড়ি মাছ দিয়ে ঘন্ট খাব বলে দেশ থেকে এক মস্ত লাউ নিয়ে যাচ্ছিলাম কলকাতায়। মাঝরাতে সেই লাউ ধরে চোরে টান দিয়েছে। ভাগ্যিস ব্যাঙ বাজনা বাঁধা ছিল, ব্যস টের পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। আর চোরও তেমনি। যেন ইনভিজিবল ম্যান–সঙ্গে সঙ্গে গন উইথ দি উইণ্ড! দড়ি বাঁধা শেষ হল। ফিরে এসে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। সেই বুটসুদ্ধই।
-শোবেন না?
বললাম, না।
–জেগে-জেগে পাহারা দেবেন নাকি?–ভদ্রলোক হাসলেন!
–ঠিক পাহারা দেওয়া নয়,–মানে এখনও আমার ঘুম পায়নি।
তবে বসে থাকুন। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। কাল কলকাতায় পৌঁছেই আবার একরাশ কাজ।
–ভদ্রলোক একটা হাই তুললেন, মুখের কাছে তুড়ি বাজালেন। তারপর সোজা চিত হয়ে পড়লেন। ডিটেকটিভ বইটা পড়তে-পড়তে মাঝে মাঝে আমি শুনতে লাগলাম ব্যাঙ বাজনা বাজছে। মানে, নাক ডাকছে ওঁর।
আমি একটার পর একটা অধ্যায়ের রহস্যের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু নাক ডাকা জিনিসটা ছোঁয়াচে। ওঁর মুখটা বার বার খুলে বন্ধ হতে লাগল, আর শব্দ উঠতে লাগল ফোঁ—ফর-র—ফোঁ—ফর–র
আমি কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম সেদিকে। তারপর হিংসে হতে লাগল, তারও পরে মনে হতে লাগল, সব ব্যবস্থাই যখন উনি পাকা করেই রেখেছেন, তখন আমিও আর–জুতোটা একেবারে অন্ধকার তলার দিকে ঠেলে দিয়ে লম্বমান হয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দুটো জিনিস আবিষ্কার করলাম। প্রথমত ভদ্রলোক অদৃশ্য হয়েছেন– আমার সুটকেস, পুরনো জুতোজোড়া, এমনকি অ্যামেরিকান কর্ড পর্যন্ত কিছুই বাদ যায়নি। আর দ্বিতীয়ত–সেইটেই সবচেয়ে বিস্ময়কর!
যাওয়ার আগে, আমার অবিশ্বাস ভাঙবার জন্যেই কিনা কে জানে, ফেলে গেছেন নিজের ছোট অ্যাটাচিটা। সেইটে খুলে দেখলাম : আর কিছু নেই–একখানা চকচকে ক্ষুর। এখন আর আমার বিশ্বাস করতে বাধা নেই–এই ক্ষুরেই জঙ্গিপুরের সেই ভদ্রলোকের দাড়ি নিশ্চিহ্ন আর নিরুদ্দেশ হয়েছে।
লালগোলা লাইনের শ্রেষ্ঠ গুণীর সঙ্গে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে দেখা হয়েছে, আপাতত এইটেই আমার সান্ত্বনা।