বেলেঘাটা সি আই টির ওদিকটায় তৈরি হচ্ছে নতুননতুন বড় রাস্তা আর খুব সুন্দর সব পার্ক। এখনও লোকের ভিড় নেই ওদিকে, তাই সন্ধের পর কোনও কোনও পার্কে ভারি নিরিবিলিতে বসা যায়। যারা ওদিকটা দেখোনি, তারা ভাবতেও পারবে না, এখনও কলকাতার পার্কে কী চমৎকার নির্জনতা আছে কোথাও কোথাও।
তায় শীতের সন্ধ্যা। প্রকাণ্ড পার্কের এক ধারে একটা বেঞ্চিতে একা বসে আছি। এমন সময়
এমন সময় যেন ঝুপ করে আকাশ থেকে পড়ল লোকটা।
বেঁটে কালো-কোলো চেহারা, গায়ে হাফ শার্ট, পরনে সরু প্যান্ট। কোত্থেকে এসে আমার পাশে বসে পড়ল ঝুপ করে। ডাকল : দাদা!
ভীষণ চমকে গেলুম আমি। গুণ্ডা-টুণ্ডা নয় তো? কাছাকাছি লোকজন তো কেউই নেই, ফস করে একখানা ছোরা বার করলেই তো গেছি।
বললুম, কোনও মতলব আছে নাকি? কিন্তু আমার পকেটে আছে নগদ বেয়াল্লিশ পয়সা আর হাতে এই যে ঘড়িটা রয়েছে, এটা ঠাকুর্দার আমলের। দিনে পাঁচ বার দম দিতে হয়, রোজ কুড়ি মিনিট করে শ্লো হয়, আর মাসে একবার করে অয়েল করাতে হয়।
লোকটা জিভ কাটল।
–ছি ছি দাদা, কী বলছেন? আমি ও-লাইনের লোক নই। আমি যা রোজগার করি, ট্রামে বাসে, টুক করে না জানিয়ে পকেট থেকে তুলে নিই। আপনার পকেটই যদি মারব, তা হলে আর পাশে এসে বসে ভাব জমাতে চাইব কেন?
বললুম, তা ঠিক। কিন্তু আমার পকেটে হাত ঢোকালে যা পাবে সে তো বলেই দিয়েছি। নিট বেয়াল্লিশ পয়সা, কয়েকটা সুপুরির কুচি আর একখানা ময়লা রুমাল। তোমার মজুরি পোষাবে না।
–দাদা, ভীষণ মনোকষ্ট হয়েছে। ও-লাইন ছেড়ে দেব।
–কেন, লোকে ধরে খুব ঠেঙিয়েছে নাকি?
আহা, ধরা পড়লে পিটুনি তো খেতেই হয়। ওতে কিছু লাগে না দাদা, গায়ের চামড়া পুরু হয়ে গেছে। আর দু-এক মাস জেল? সে তো নস্যি। বিনি পয়সায় একটু চেঞ্জে যাওয়া আর কী! মন্দ লাগে না, কী বলেন?
বললুম, ঠিক বলতে পারছি না। ওরকম চেঞ্জে আমি কখনও যাইনি, যেতেও চাই না। কিন্তু তোমার এত ব্যথা হল কেন হঠাৎ!
–দাদা, জীবনে অনেক দুঃখু আছে, যা একেবারে হৃদয় ভেঙে দেয়। প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে। না, আর এসব নয়। আমার মামার একটা রেস্টুরেন্ট আছে আসানসোলে, সেখানে গিয়েই বরং চপ কাটলেট আর পরোটা ভাজব।
–ভাজতে জানো নাকি ওসব?
জানতে আর কতক্ষণ? চক্ষের নিমেষে কলম ব্যাগ লোপাট করতে পারি, আর কাটলেট ভাজতে পারব না?
–আলবাত পারবে। চক্ষের পলকে খেয়েও ফেলতে পারবে খান কয়েক, তোমার মামা টেরও পাবে না।
-ঠাট্টা করবেন না দাদা, মনে বড় ব্যথা। আজ কী হয়েছে জানেন?
পকেট থেকে একটা সুপুরির কুচি বের করে মুখে পুরে বললুম, বেশ–বলো।
বিকেল থেকে অসম্ভব কষ্টে আছি। ভাবছি কাকে প্রাণের কথা বলি। এই পার্কে এসে আপনাকে দেখলুম, বেশ সদাশয় ভদ্রলোক মনে হল। তাই এলুম আপনার কাছেই।
খুশি হয়ে বললাম, অতি উত্তম। ভনিতা রেখে এবারে বলে যাও।
–দাদা– বলেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়লুম, ঠ্যাঙানি খেলুম, থানায় নিয়ে গেল–সেসব সয়ে যায়। কিন্তু কেউ যদি পকেটমারকে আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়ে লুচি-মাংস আর কোকাকোলা খাইয়ে দেয় তা হলে কেমন লাগে?
আমি বললুম, ভালোই লাগে। খারাপ লাগবে কেন?
–উহুঁ, সবটা শুনুন। আজ শেয়ালদার মোড়ে তাক করে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মোটাসোটা আধবুড়ো এক ভদ্রলোক এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। কানে কানে চুপিচুপি বললেন, তোমার সঙ্গে দুটো গোপন কথা আছে।
আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, কে মশাই, আপনাকে তো আমি চিনি না। তিনি বললেন, আমি তোমায় চিনি। তুমি পকেট মেরে বেড়াও। শেয়ালদা থেকে পার্ক সাকাস আর শ্যামবাজারের চৌরাস্তা পর্যন্ত তোমার এরিয়া।
আমি আরও ঘাবড়ালুম : আপনি পুলিশ নাকি স্যার?
তিনি বললেন, পুলিশ। পুলিশ-টুলিশ আবার কী, ওসব আমি পছন্দ করি না। আমি একজন মানুষ, তুমিও একজন মানুষ। তাই মানুষ হিসেবে তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই। চলো ওই সামনের হোটেলে।
বলে, আমার হাত ধরে প্রায় টেনেই সামনের একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন। তারপর বেশ করে আমাকে লুচি-মাংস আর ঠাণ্ডা একটা কোকাকোলা খাইয়ে দিলেন।
আমি বললুম, এতে তোমার মনে ব্যথা পাওয়ার কী আছে? পরের পয়সায় খেলে তো মন। আরও ভালো হয়ে যায় হে।
–আহা, শুনুন না সবটা। তারপর ভদ্রলোক বললেন, এবার তোমাকে কাজের কথা বলি। আমি এই ছমাস ধরে তোমায় ওয়াচ করছি। কোথায় থাক, কোথায় যাও–কবার পকেট মারলে, কবার থানায় গেলে সব দেখেছি। তুমি টেরও পাওনি, আমি নিয়মিত ফলো করেছি তোমাকে।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, কেন স্যার? আপনার কি কাজকর্ম নেই?
তিনি বললেন, না। আমি রিটায়ার করেছি, আমার ছেলেরা চাকরি-টাকরি করে, সংসার চলে যায়। তাই ভেবেছি, এখন কিছু পরোপকার করব। দু-একজনকে আমি উদ্ধার করব, অন্ধকার থেকে আলোয় আনব। একদিন তুমি যখন ধরা পড়ে বৌবাজারে পিটুনি খেতে-খেতে সড়াক করে একটা গলি দিয়ে পালালে–সেদিনই চিনে রেখেছি তোমায়। রোজ ওয়াচ করেছি। তারপর আজ ধরেছি এসে। তোমাকে আমি ত্রাণ করব, অন্ধকার থেকে আলোয় আনব। একজনকেও যদি সৎপথে আনতে পারি, তবে এই নশ্বর জীবন ধন্য। শোনো, আজ থেকে আমি তোমার গুরু।
গুরু। আমি চমকে বললুম, আমার গুরু তো স্যার কলাবাগানের গ্যাঁড়া মিঞা।
উঁহু, ওসব পকেটমারা গুরুতে চলবে না। আসল গুরু। গীতায় শ্রীভগবান কী বলেছেন, জানো? সদ্গুরু দরকার। তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন, উঁহু, ওসব সংস্কৃত-টংস্কৃত তুমি বুঝবে না। মানে-গুরুর কাছে উপদেশ নেবে; সেবা করবে, জিজ্ঞেস করবে। তুমি গোরুর সেবা করতে পারো? বিচুলি কাটতে পারো? গোবর সাফ করতে পারো? তা হলে চলো আমার বাড়িতে। আমার তিনটে গোরু আছে, সেবা করবে।
বললুম, না স্যার, গোরুর সেবা আমার আসে না। আমাকে ছাড়ুন, আমি যাই।
কপাৎ করে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, যাবে কী হে, এখুনি যেতে দিচ্ছে কে তোমায়? আর একটা কোকাকোলা খাবে নাকি?
দারুণ জোর ভদ্রলোকের গায়ে, বোধহয় মুগুর-টুগুর ভাঁজতেন, হাত ছাড়াতে পারলুম না। বললুম, না স্যার, আর কোকাকোলা নয়। খুব হয়েছে।
ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে, খেয়ো না। কিন্তু আর আমাকে স্যার বলবে না, গুরুদেব বলবে। এই লুচি-মাংস খাইয়ে আজ থেকে তোমায় দীক্ষা দিলুম। তুমি আমার শিষ্য। তোমার বস্তির ঘর পিছে পিছে গিয়ে আমি চিনে রেখেছি, তুমি যদি আমার গোরুর সেবা না করতে চাও, কোরো না। আমি নিজেই কাল থেকে রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় তোমার কাছে যাব, তোমাকে উপদেশ দেব দুঘণ্টা ধরে। তুমি আমার পা টিপবে–হাওয়া করবে, উপদেশ শুনবে, আর মানুষ হয়ে যাবে।
শুনে আমার দম আটকাবার জো। বললুম, কালকের কথা কাল। আজ ছেড়ে দিন স্যার, বাড়ি যাই। খিদে পেয়েছে।
খিদে পেয়েছে? এখুনি যে লুচি-মাংস খেলে? আরও খাবে? আচ্ছা–এই বয়—
তাড়াতাড়ি বললুম, না স্যার, ভুল হয়েছিল। খিদে পায়নি, পেট কামড়াচ্ছে।
–পেট কামড়াচ্ছে? ও কিছু না। সদুপদেশ শোনো, কোথায় মিলিয়ে যাবে ওসব। দীক্ষার দিনে কিছু উপদেশ নিতে হয়। তা হলে প্রথমেই বোঝা দরকার : তুমি কে? তুমি মানুষ। মানুষ কে? নারায়ণ। তা হলে সব মানুষই নারায়ণ। তুমি এক নারায়ণ হয়ে আর এক নারায়ণের পকেট মারবে? ভগবান কি নিজের পকেট নিজে কাটেন? শুনেছ কখনও? নিশ্চয় শোনননি। তা হলে জীবাত্মা আর পরমাত্মার তত্ত্ব তোমায় গোড়াতে বুঝতে হয়। জীবাত্মা কী? না–আমাদের শরীরে
বলব কী দাদা-বিকেল চারটে থেকে সাড়ে ছটা অবধি আমার কানের কাছে যেন কামান দাগতে লাগলেন আমার মাথা ঘুরতে লাগল, কান বোঁ বোঁ করতে লাগল, কেঁদে ফেললুম, বারবার বলতে চাইলুম, থামুন থামুন কে থামে। শেষকালে আমি ভিরমি গেলুম।
–ভিরমি গেলে?
আর কেউ হলে বেঘোরে মারা যেত দাদা, আমি পকেটমার বলে সামলে গেছি। উনিই মাথায় জল-টল দিয়ে চাঙ্গা করলেন আমায়। বললেন, ঠিক আছে, আজ এই পর্যন্তই। কিন্তু কাল ভোরেই আমি তোমার বাসায় যাচ্ছি। একটা কুশাসন রেডি রেখো, তাইতে বসে উপদেশ দেব। সাত দিনের মধ্যেই দেখবে তোমার আত্মার কী উন্নতি হচ্ছে।
কিন্তু সাত দিন। অত দেরি হবে না স্যার, কাল ভোরে যদি এসে পৌঁছে যান–আসবেনই-তা হলে সকাল সাতটার মধ্যেই আমার আত্মার উন্নতি কমপ্লিট প্রাণ দেহ ছেড়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যাবে। একবার ভেবেছিলাম বাসা বদলাই, কিন্তু গুরুদেবের যে রোখ দেখলুম কলকাতার যেখানে যাব, সেখানেই খুঁজে বের করবেন, আর বলতে থাকবেন : জীবাত্মার পর পরমাত্মা-কিনা ব্ৰহ্ম! না স্যার, আর নয়–আজ রাত্রেই আমি চলে যাব আসানসোলে, কাল থেকে মামার দোকানে কাটলেটই ভাজব।
শুনে আমি বললাম, তা ভেবে দেখতে গেলে উনি তো ভালোই চান। এই সব পকেট-মারা চুরি-চামারি-এতে করে তোমার আত্মা তো
আত্মা পর্যন্ত বলার ওয়াস্তা। চোখ দুটো গোল করে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল তখুনি।
–অ্যাঁ দাদা, আপনিও। আর আপনাকে আমি সদাশয় ভেবেছিলাম।
বলেই টেনে দৌড়। প্রায় ত্রিশ মাইল স্পিডে। একলাফে পার্কের রেলিং পেরিয়ে হাওয়া।
তা মন্দ না–আমি ভাবলুম। এই রেটে যদি ছুটতে পারে, তা হলে ট্রেনের দরকার হবে আর, ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে আসানসোলে।