দুখীরাম গরিব ভিখিরি।
বয়েস বেশি নয়, জোয়ানই বলা চলে তাকে। কিন্তু তার মা নেই, বাপ নেই, ভাই নেই, বোন নেই, এক কথায় বিশ্বসংসারে কেউ নেই। তাতেও দুখীরামের দুঃখ ছিল না, খেটেখুটে, পেটের ভাতের যোগাড়টা সে করতে পারত। কিন্তু একটা পা আবার তার খোঁড়া। কাজেই ভিক্ষে ছাড়া তার আর গতিই নেই।
দুপুরের চড়া রোদ্দুরে পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় দুখীরাম ভিক্ষে করে ফিরছিল। দারুণ গরম বাতাসে যেন আগুন ছুটছে। দুখীরাম আর চলতে পারল না, পথের ধারে মস্ত একটা অশথগাছ গোল করে ঠাণ্ডা ছায়া ছড়িয়েছে, হাতের লাঠিটা পাশে রেখে সেখানেই শুয়ে পড়ল সে।
ঘুম ভাঙল তার বিকেলে। উঠতে গিয়ে দেখল, লাঠিটা নেই। সে ঘুমুচ্ছে দেখে, কোনও দুষ্টু লোক মজা করবার জন্যে লাঠিটা নিয়ে কোথাও ফেলে দিয়েছে। গরিব ভিখিরির ভাঙা লাঠি চুরি করবে, এমন চোর অবশ্য বিশ্বসংসারে নেই।
কিন্তু লাঠি চুরিই যাক আর কেউ ফেলেই দিক, দুখীরামের অবস্থা সঙ্গিন। লাঠি ছাড়া দুপা হাঁটাই তার পক্ষে মুশকিল। এখন সে ভিক্ষেয় বেরুবে কী করে আর কেমন করেই বা বাড়িতে ফিরে যাবে? তার নিজের কুঁড়েঘরটাও যে এখান থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে।
একে তো সারাটা দিন ভিক্ষে-শিক্ষে করে বিশেষ কিছুই হয়নি, পেটে খিদের আগুন জ্বলছে, তার ভেতরে এই বিপদ। দুখীরাম আর সইতে পারল না। ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল
তখন হঠাৎ একটা শব্দ শুনল সে : ঠপাস। মনে হল, তার পিছনেই ওপর থেকে কী একটা পড়ল।
চমকে তাকিয়ে দুখীরাম দেখলে, একখানা লাঠি। যেসব লাঠি হাতে করে বাবুরা বেড়াতে বেরোয়, ঠিক সেই রকম দেখতে, তবু একেবারে সেরকমটি নয়। কালো কুচকুচে লাঠিটার রঙ, গোটা কয়েক গাঁট আছে তাতে; হাতলের গায়ে রঙিন। কাঁচের ছোট-ছোট দুটো চোখ বসানো–হঠাৎ দেখলে মনে হয় চোখ দুটো মিটমিট করে তাকাচ্ছে।
দুখীরাম ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল।
এ কার লাঠি? কাছাকাছি লোকজন কেউই তো নেই। অশথগাছটা থেকেই ওটা পড়ল মনে হচ্ছে, কিন্তু অশথগাছে লাঠি গজায় একথা কে কবে শুনেছে? কাকে অবশ্য গেরস্থ বাড়ি থেকে মুখে করে এটা-ওটা নিয়ে আসে, কিন্তু এত বড় একটা লাঠি বয়ে আনতে গেলে একটা নয়, অন্তত ডজন তিনেক কাক দরকার। এক হনুমানবাঁদরের কীর্তি হতে পারে, কিন্তু এ-তল্লাটে তো ওসব কিছুই নেই।
তবে এ লাঠি কার?
দুখীরাম কিছুক্ষণ দ্বিধা করল। তারপর ভাবল, যারই হোক আমি তো এখন কুড়িয়ে নিই। একটা লাঠি আমার নেহাতই দরকার, নইলে এক পা-ও আমি হাঁটতে পারছি না। পরে গাঁয়ের ভেতর জিজ্ঞেস করে মালিককে ওটা ফেরত দেব। কিছু বকশিশও মিলে যাবে নিশ্চয়।
দুখীরাম লাঠিটার দিকে হাত বাড়াল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হল, সে হাত দিয়ে চেপে ধরবার আগেই লাঠিখানা তার মুঠোর মধ্যে এসে ঢুকল। যেন ওটা জীবন্ত, সে কখন ওকে ডাকবে, তারই জন্যে অপেক্ষা করছিল।
দুখীরামের সারা শরীর শিউরে উঠল। কিন্তু আদৌ তার ভয় করল না। লাঠিটাকে হাতে নেওয়া মাত্র যেন সে কেমন জোর পেল গায়ে, পেটে খিদে-তেষ্টা সত্ত্বেও ভারি স্ফূর্তি হল তার মনে। দুখীরাম লাঠিটায় ভর দিয়ে উঠে পড়ল, চলতে লাগল গ্রামের দিকে।
খাসা লাঠি। যেমন হালকা তেমনি শক্ত। দুখীরামের ওটা নিয়ে চলতে এত আরাম লাগল যে, সে যে খোঁড়া, সেকথা বেমালুম ভুলেই গেল সে।
পথের ধারে প্রাণকেষ্ট হালদারের বাড়ি। লোকটা ভারি খারাপ। একটা বিতিকিচ্ছিরি খেকি কুকুর সে পোষে, আর রাস্তায় গরিব-দুঃখী দেখলেই তার দিকে কুকরটাকে লেলিয়ে দেয়।
ব্যাপারটা জানত বলেই, ভয়েভয়ে দূর দিয়ে চলে যাচ্ছিল দুখীরাম। প্রাণকেষ্ট বাড়ির সামনে একটা খাঁটিয়ায় বসে বিড়ি টানছিল..সে ঠিক দেখতে পেল দুখীরামকে। শয়তানির হাসিতে প্রাণকেষ্টর মুখ ভরে উঠল।
খোক্কোস, লে–লে—ছো–ছো
খোক্কোস হল প্রাণকেষ্টর সেই বিটকেল খেকি কুকুরটার নাম। সে মনিবের খাঁটিয়ার তলায় বসে কটাং কটাং করে এঁটুলি কামড়াচ্ছিল, শুনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপরেই–ঘু-উ-উ-খ্যা, খ্যা, খ্যা, বলে সোজা তাড়া করল দুখীরামকে।
দুখীরামের প্রাণ উড়ে গেল। খোঁড়া পা নিয়ে সে যে কোন দিকে পালাবে ঠিক করতে পারল না। খোক্কোস তার সামনে গিয়ে সমানে খ্যাঁক খ্যাঁক করতে লাগল আর দুখীরামের দুর্গতি দেখে খাঁটিয়ার ওপর কুটপাট হতে লাগল প্রাণকেষ্ট।
কিন্তু হাসি তার বেশিক্ষণ রইল না।
হঠাৎ ঝাঁ করে দুখীরামের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল লাঠিটা। তারপরেই ধপাং ধপাং। কুকুরের পিঠে সে-লাঠির ঘা কতক পড়তেই কাঁই কাঁই করে খোক্কোস ল্যাজ গুটিয়ে ছুট লাগাল, বোধহয় এক ছুটে মাইল তিনেক পেরিয়ে গেল সে।
এবার লাঠি গিয়ে নামল প্রাণকেষ্টর পিঠে। সে কী মার! বাপরে মা রে করে চ্যাঁচাতে-চাঁচাতে প্রাণকেষ্টর দাঁতকপাটি লেগে গেল। আর সেই মুহূর্তে যেন শূন্য থেকে শোনা গেল কার গম্ভীর গলা : এ হল জগন্নাথের ঠ্যাঙা। যে সব বদমাশ লোক অকারণ পরকে কষ্ট দেয়, এ হল তাদেরই দাওয়াই।
আর প্রাণকেষ্টকে শায়েস্তা করা লাঠি সুড়ৎ করে ফিরে এল দুখীরামের হাতে।
দুখীরাম হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। কী যে ঘটল, সে তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারল না। শুধু দেখতে পেল, ত্রিসীমানায় খেকির কোনও চিহ্ন নেই আর প্রাণকেষ্ট তখনও বাপ রে–মা রেগেলুম রে বলে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাচ্ছে।
দুখীরাম আবার এগিয়ে চলল।
এতক্ষণে বুঝতে পারল সে নিজে চলছে না, লাঠিটাই যেন তাকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেদিকে সে যেতে চাইছিল, সেদিকে যেতে পারল না–তার বদলে লাঠি তাকে পাশের গ্রামের দিকে নিয়ে চলল। দুখীরাম কিছু ভাবতে পারছিল না, তার মনে হচ্ছিল, যেন স্বপ্নের ঘোরে সে পথ চলছে।
চলতে চলতে বেলা গড়িয়ে এল, মাঠের ওপারে সূর্য ডুবল, অন্ধকার নামল। দুখীরাম ভাবছিল, অনেক আগেই তার কুঁড়েতে ফেরা উচিত ছিল, রাত হয়ে গেলে এতটা পথ সে হাঁটবে কী করে! কিন্তু নিজের ইচ্ছায় সে কিছুই করতে পারছে না লাঠিটাই তাকে যেখানে খুশি নিয়ে যাচ্ছে।
পাশের গ্রাম মদনপুর, আর গ্রামে ঢুকতেই যার মস্ত বাড়ি, তার নাম বদন মণ্ডল। বদন মস্ত মহাজন। দারুণ বড় লোক, তার বাড়িতে নাকি টাকা-পয়সায় ছাতা পড়ে। কিন্তু হলে কী হয়, তার মতো নিষ্ঠুর লোভী ভূ-ভারতে নেই। কী করে দেনার দায়ে গরিবের ভিটে-মাটিটুকু পর্যন্ত কিনে নেবে, এই তার রাত-দিনের চিন্তা।
আজ বদনের বাড়িতে দারুণ ভোজের আয়োজন। কী যেন একটা মামলায় সে জিতেছে, তাই বিরাট রকম খাওয়াদাওয়ার যোগাড় করছে সে। বিস্তর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন জড়ো হয়েছে, পেট্রোম্যাকস জ্বলছে, মাছ-মাংস-পোলাওয়ের গন্ধে চারদিক ভরে উঠেছে। দুখীরামের পেটের খিদেটা সে-গন্ধে আবার চাড়া দিয়ে উঠল।
ভোজের আসরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল দুখীরাম। হাত পেতে করুণ গলায় বললে, বাবু গরিবকে যদি দয়া করে দুটো খেতে দেন
চোখ পাকিয়ে বদন মণ্ডল চেঁচিয়ে উঠল : আঃ, এ-অযাত্রাটা আবার এখন কোথা থেকে এল। এই, কে আছিস?
সারাদিন খেতে পাইনি বাবু-দয়া করুন বাবু
বদন মণ্ডল চাকরগুলোকে ধমকে বললে, চুপ করে দেখছিস কী সব? ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দেনা ভিখিরিটাকে। আপদগুলো হাড় জ্বালিয়ে খেলে।
মারমার করে ছুটে এল চাকরেরা। আর
আর তক্ষুনি দুখীরামের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল লাঠিটা।
তারপরে কী যে হল কেউ জানে না! চারদিকে শুধু গেলুম রে রব, দমাদম, ধপাধপ, ঝনাঝন আওয়াজ। যেন প্রলয়কাণ্ড চলতে লাগল। আলোগুলো ভেঙে গুড়োগঁড়ো, বাসনপত্র তছনছ, খাবার-দাবার ধুলোকাদায় মাখামাখি–অতিথি, ঠাকুর, বাড়ির লোকজন ঠ্যাঙানি খেয়ে কে যে কোন দিকে ছুটে পালালো বোঝাই গেল না।
সব চেয়ে বেশি লাঠি পড়ল বদন মণ্ডলের পিঠে–সেটা বলাই বাহুল্য। আর শূন্য থেকে মোটা গম্ভীর গলায় কে যেন বললে, যারা লোভী, যারা নিষ্ঠুর, গরিবকে যারা খেতে দেয় না, জগন্নাথের ঠ্যাঙা এই ভাবেই তাদের শায়েস্তা করে থাকে।
.
এক বছর কেটে গেছে। দুখীরাম এখন বদন মণ্ডলের জামাই। তার হাতের ঠ্যাঙার গুণ দেখে মণ্ডল বুঝেছে, খোঁড়া আর গরিব হলে কী হয়, দুখীরাম আসলে একটি সাংঘাতিক লোক-তাকে দিয়ে অনেক কাজ হবে। তাই নিজের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দুখীরামকে ঘর-জামাই করে রেখে দিয়েছে।
রাজার হালে আছে দুখীরাম, মাংস-মাছ, দুধ-ঘি, মিঠাই-মোণ্ডা খেয়ে হাতির মতো মোটা হচ্ছে। সে যে কোনও দিন রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াত, সেকথা তার মনেও পড়ে না। তার চাল-চলনই আলাদা এখন।
সেদিন দুপুরে রুপোর থালায় ভাত খাচ্ছে দুখীরাম, পাতে তার মস্ত একটা রুইমাছের মুড়ো। শাশুড়ি পাখা হাতে তাকে বাতাস করছেন। এমন সময় কী করে অন্দরের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল এক ভিখিরি বউ, সঙ্গে তার হাড় জিরজিরে তিন-চারটে ছেলেমেয়ে।
কঙ্কালসার হাত বাড়িয়ে ভিখিরিবউ বললে, দুটি খেতে পাই মা?
চাকরবাকর হইচই করে উঠল :বেরো–বেরো—
ভিখিরি বউ কেঁদে কেঁদে বললে, আমি কিছু চাইনে মা-বাচ্চাগুলো খিদেয় মরে গেল, যদি
এবার বেজায় রেগে দুখীরাম বললে, কী জ্বালা, এসব ভিখিরির জন্যে কি একমুঠো ভাতও শান্তিতে খাওয়া যাবে না? করছিস কী সব–মেরে তাড়িয়ে দে না
দরজার কোনায় দাঁড়িয়েছিল দুখীরামের লাঠিটা। হঠাৎ যেন হাওয়ায় উড়ে এল সেটা।
তারপরেই দমাদম—ধপাধপ–ঝনাঝন। কোথায় গেল রুপোর থালা, কোথায় গেল মাছের মুড়ো–কোথায় বা উবে গেলেন শাশুড়ি! তিন ঘা ঠ্যাঙানি খেয়েই চিত হয়ে পড়ল দুখীরাম।
শুন্য থেকে আবার সেই মোটা গম্ভীর স্বর শোনা গেল : শিক্ষা পেয়েও যারা তা ভুলে যায়, জগন্নাথের ঠ্যাঙা এমনিভাবেই তাদের তা মনে করিয়ে দেয়। জ্ঞান হয়ে দুখীরাম দেখলে, সে সেই অশথতলায় পড়ে আছে, গায়ে তার ভিখিরির সেই ছেঁড়া পোশাক, পাশে তার সেই পুরনো অষ্টাবক্র লাঠিটা।