ইনসপেকটর রাজেশবাবু এসে দেখলেন, নন্দবাবুর হাত-পা-মুখ কষে কাপড় দিয়ে বাঁধা। চোখের তারা কপালে তুলে তিনি গোঁ গোঁ করছেন।
সঙ্গের কনস্টেবল তাঁর বাঁধন খুলে দিল। নন্দবাবু তখনও কথা বলতে পারছেন না–হাঁপাচ্ছেন।
রাজেশবাবু একটু জিরিয়ে নেবার সময় দিলেন। ঢকঢক করে পুরো এক ঘটি জল খেয়ে নন্দবাবু ধাতস্থ হলেন একটু। তারপর হঠাৎ গেঙিয়ে উঠলেন, আমার ভাই মুকুন্দ? তার–তার কী হয়েছে?
একটু বিষণ্ণ মুখে রাজেশবাবু বললেন, আপনাকে দুঃসংবাদ দিচ্ছি, কিছু মনে করবেন না–তিনি খুন হয়েছেন। তাঁর বুকে ছোরা বেঁধানো।
অ্যাঁ!–একটা চিৎকার করে নন্দবাবু অজ্ঞান হয়ে গেলেন!
কিন্তু বেশিক্ষণ পুলিশের সামনে অজ্ঞান হয়ে থাকা যায় না, কাজেই উঠে বসতে হল একটু পরে। রাজেশবাবু পকেট থেকে নোটবই আর পেন্সিল বের করলেন।
দেখুন, লোক ধরবার সময় পরে অনেক পাবেন। কিন্তু হত্যাকারীকে আগে ধরবার চেষ্টা করা দরকার। সুতরাং দয়া করে আমাদের একটু সাহায্য করুন।
ধরা গলায় নন্দবাবু বললেন, বলুন।
আপনি তো পাটের দালালি করেন, আর আপনার ছোট ভাই মুকুন্দবাবু?
ওর একটা জুয়েলারি দোকান আছে রাধাবাজারে। মাঝে-মাঝে দুএকটা হীরে-টিরে সঙ্গে করে বাড়িতে আনত–কী সব পরীক্ষা করত এনে। আমি অনেকবার বলেছি মুকুন্দ, বাড়িতে আমরা দুভাই মোটে থাকি, ওসব সর্বনেশে জিনিস আনিসনি, তা বলতে বলতে নন্দবাবু আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন : আমি বুঝেছি, কালও ওই রকম একটা কিছু বাড়িতে এনেছিল, আর কেউ তাকে ফলো করে
বাধা দিয়ে রাজেশবাবু বললেন, তাই সম্ভব? কিন্তু ওসব পরে হবে। তার আগে বলুন, কাল রাত্রে কী হয়েছিল।
তখন রাত সাড়ে নটা। খেয়ে-দেয়ে আমরা দুভাই শুতে গেলাম। আমরা বরাবরই তাড়াতাড়ি শুই, ভোরে উঠি।
বাড়িতে আর কে থাকে?
কেউ না। আমরা ব্যাচেলর।
থানায় যে-খবর দিয়ে এল–দরজা হাট করে খোলা, আপনি মুখ বাঁধা পড়ে, আপনার ভাই খুন হয়েছেন–আপনাদের সেই চাকরটি কোথায় থাকে?
খ্যাংরাপটিতে। আমাদের রান্নাবান্না করে দিয়ে, নটার মধ্যেই ও খেয়ে বাড়ি চলে যায়। আমি কাল ঠিক নটায় ও চলে গেলে সদর বন্ধ করেছি।
ঠিক নটা? খেয়াল থাকল কী করে?
তখুনি কোথায় একটা পেটা ঘড়িতে নটা বাজছিল।
ঠিক আছে। তারপর বলুন।
তখন দশটা-সাড়ে দশটার বেশি নয়। আমার ঘুম এসেছিল। হঠাৎ পাশে মুকুন্দর ঘর থেকে যেন একটা ধ্বস্তাধ্বস্তি-গোঁ গোঁ আওয়াজ কানে এল। উঠে আলো জ্বালাতে গেলাম জ্বলল না, মেন অফ করে দিয়েছে কেউ। দিনকাল তো জানেন, যখন-তখন কারেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। আমার বালিশের নীচে ছোট্ট একটা দু-সেলের টর্চ থাকে, সেইটে জ্বেলে আমি মুকুন্দর ঘরের দিকে ছুটে গেলাম।
একটু দাঁড়ান। মুকুন্দবাবুর ঘরের দরজা খোলা ছিল?
বরাবরই থাকে। আমরা দুভাই-ই দরজা খুলে ঘুমোই।
মারাত্মক অভ্যেস, এ কাজ কখনও করা উচিত নয়। সে যাক, তারপরে কী দেখলেন?
টর্চ ফেলে দেখি, একটা ঘুসকো জোয়ান লোক মুকুন্দর বুকে চেপে বসেছে, সে গোঁ গোঁ করছে। আমি কিছু করবার আগেই অন্ধকারে কারা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, হাত-মুখ বেঁধে ফেলল, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। যখন জ্ঞান হল, কত রাত জানি না। টের পেলাম বারান্দায় পড়ে আছি। উঠতে পারলাম না, কিছু করতেও পারলাম না–ছটফট করলাম সমানে। আবার জ্ঞান হারালাম। সকালে কখন যে বনমালী, মানে আমাদের চাকরটা এসেছে, সব দেখেছে, আপনাদের খবর দিয়েছে
ভালো কথা, আপনার টর্চ কী হল?
ধ্বস্তাধ্বস্তির সময় আমার হাত থেকে ঠিকরে পড়ে গিয়েছিল জ্বলন্ত টর্চটা। ওই ঘরেই কোথাও আছে নিশ্চয়।
হাঁ, সেটাকে আমারা ও-ঘরের একটা কোণায় পেয়েছি। এখন আর দুএকটা কথার জবাব দিন। বাইরে থেকে আপনাদের বাড়িতে লোক ঢুকল কী করে? সদর তো আপনি নিজের হাতেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ওরা নয় খুলেই বেরিয়ে গেছে, কিন্তু ঢুকল কোন্ রাস্তা দিয়ে?
পাশেই তো কানাগলি। বাড়ির রেন-ওয়াটার পাইপ সেখানে। সেটা বেয়ে লোকটা ছাতে উঠেছে। ছাতের দরজা বন্ধ করা হয়নি। আমরাও তো ঘর খুলেই রাখি।
ঠিক। তাহলে মুকুন্দবাবু হীরে এনেছিলেন কাল?
সেই রকমই বলছিল। কোন্ রানীর হীরে–খুব দামী, যাচাই করতে দিয়েছিল। বোধহয় সেই লোভেই
হ্যাঁ, সেই লোভেই।–মৃদু হেসে রাজেশবাবু বললেন, সেই লোভেই নিজের ভাইকে আপনি খুন করেছেন নন্দবাবু। তারপর চাকর বনমালীকে দিয়ে হাত-মুখ বাঁধিয়ে নিতে বেশি অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
নন্দবাবুর মুখটা ঝুলে পড়ল। হঠাৎ তারপরেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেব : কী বলছেন আপনি পাগলের মতো? নিজের ভাই মুকুন্দকে আমি খুন করব?
লোভ নন্দবাবু, লোভ। মানুষ পশু হয়ে যায়। কিন্তু নিজেকে নিজেই ধরিয়ে দিয়েছেন আপনি। টর্চের কায়দা না করলেই পারতেন।
অ্যাঁ?-নন্দবাবু হাঁ করে রইলেন।
নন্দবাবু, ঘটনাটা রাত সাড়ে দশটার। বেলা সাড়ে সাতটা এখন। আপনার টর্চ এখনও পুরো তেজে জ্বলছে। কোনও ছোট্ট দুসেলের টর্চে অমন অলৌকিক ব্যাটারি থাকে না নন্দবাবু। অতএব দয়া করে উঠুন এবং থানায় চলুন। আপনার বনমালীকেও সহযাত্রী করতে হচ্ছে, কারণ সেও আপনার সহযোগী– হীরে বিক্রির ভাগ সেও পেত নিশ্চয়ই।
মাথায় শিকড়-পড়া সাপের মতো নন্দবাবুর ঘাড় নুয়ে এল।