ঘুম থেকে উঠে ঘনশ্যাম ঘোড়ুই আবিষ্কার করল, জানালাটা খোলা যাচ্ছে না। জানালায় নতুন রং করা হয়েছিল, তার ওপর কাল রাত্তিতে গেছে ঝমঝম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে জানালার কাঠ কেঁপে উঠেছে তার কাঁচা রং–স্রেফ বজ্র আঁটুনি যাকে বলে।
প্রথমে জয় গুরু বলে ছিটকিনি ধরে টানতে লাগল, কিছুই হল না। তারপর জয় মা কালী বলে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হেঁচকা মারতে লাগল–ফল যথা পূর্বং। লাভের ভেতর পাঁকাটির মতো আঙুলগুলো খট খট করতে লাগল, হাতের তেলো লাল হয়ে ফোঁসকা পড়বার জো হল। গা দিয়ে কালঘাম ছুটে বেরুল। হাল ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে বসে হাঁপাতে লাগল ঘনশ্যাম।
আচ্ছা প্যাঁচে পড়া গেল এই সকালবেলায়। অথচ ঘরে এই একটি মাত্র জানালা খুলতে পারলে আলো বাতাস সব বন্ধ, তায় আবার বাইরে থমথমে মেঘ জমাট বেঁধে আছে।
বাড়িটা দোতলা। ঘনশ্যাম ঘোড়ই ঝোলা গুড় আর চিটে গুড়ের কারবারী, একতলায় তার দোকান গুদাম এইসব। দোতলায় এই একটি ঘর, তাতে তার শয়ন পর্ব চলে। কয়েকটা চিটে গুড়ের হাঁড়িও সাজানো আছে একদিকে। রান্নাবান্না, সময়মতো একলা বসে হিসেব-পত্তর মেলানো, সবই চলে ওই ঘরের ভেতর। অতএব সবেধন নীলমণি জানালাটাকে খুলতে না পারলে সারাদিন লণ্ঠন জ্বেলে রাখতে হবে। তাতে খামকা একরাশ কেরোসিন বরবাদ।
ঘনশ্যাম জবরদস্ত কৃপণ। স্ত্রী নেই, খুব সম্ভব কিপটেমির জ্বালায় সে বেচারা না খেয়ে মরেছে। একটা মাত্র জোয়ান ছেলে–সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যোগ দিয়েছে মিলিটারিতে। সেজন্য ঘনশ্যামের কোনও দুঃখ নেই। অনেক খরচা বেঁচে গেছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে। বাড়িতে একা। কর্মচারী বলতে আছে একজন মাত্র-জলধর জানা। কিন্তু সে থাকে মাইল দেড়েক দূরে। বেলা দশটা নাগাদ দোকানে আসবে। তার মানে আরও তিন ঘণ্টা ঘনশ্যামকে একা থাকতে হবে এবং তিন ঘণ্টা ধরে জানালাটাকে কিছুতেই বন্ধ রাখা যায় না।
কাজেই বাধ্য হয়ে পালোয়ান মতো কাউকে ডাকা দরকার। একটা কুলিটুলি হলেই সুবিধা। কিন্তু যাকেই ডাকা যায়–কম করে অন্তত চার আনা পয়সাও তাকে বকশিশ দিতে হবে। ভাবতেই ঘনশ্যামের মন খারাপ হয়ে গেল।
গুটি গুটি ব্যাজার মুখে রাস্তায় বেরুল ঘনশ্যাম। আর বেরুতেই সঙ্গে সঙ্গে খুশির হাসিতে তোবড়ানো মুখ ভরে উঠল তার। বরাত একেই বলে।
একটু দূরেই গান গাইতে গাইতে আসছে গঙ্গারাম। গঙ্গারাম হালদার। তার বিকট বাজখাই গানের তাড়ায় উর্বশ্বাসে গোটা তিনেক কুকুর ছুটে পালাল।
গঙ্গারামের মাথা মোটা, লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। বাপের অবস্থা তার ভালো, জমিজমা আছে। ছেলের মগজ নিরেট দেখে ধর্মের নামে ছেড়ে দিয়েছে তাকে।
লেখাপড়া নাই করুক, ডন-বৈঠক করে গঙ্গারাম শরীর বাগিয়েছে একখানা। তিনটে বাঘে তাকে খেয়ে শেষ করতে পারবে না। গলার আওয়াজে তার মেঘ ডাকে। পাড়ায় শখের যাত্রাটাত্রা হলে সে তাতে ভীম সাজে। পার্ট-টার্ট বিশেষ করতে হয় না, গদা ঘুরিয়ে গোটাকয়েক গর্জন করলেই আসরসুদ্ধ লোকের পিলে চমকে যায়।
ঘনশ্যাম গঙ্গারামকে দুচক্ষে দেখতে পারে না। কিন্তু আজ গঙ্গারামকে দেখবামাত্র তার প্রাণ-মন জুড়িয়ে গেল! ঝোলা গুড়ের চাইতেও মিঠে সুরে ডাকল : বাছা গঙ্গারাম!
গঙ্গারাম বললে, কী বলছেন ঘনু জ্যাঠা?
–আমার ঘরের জানালাটা শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে, বাবা, কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। একটু যদি টেনে খুলে দাও
সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গারাম উৎসাহিত হয়ে উঠল; এ আর শক্ত কথা কী জ্যাঠা, এখুনি খুলে দিচ্ছি। জানালা তো জানালা, তোমার বাড়ির সব দরজা কবজাসুদ্ধ টেনে খুলে বের করে দেব।
না-না-না–ঘনশ্যাম আঁতকে উঠল : দরজা-টরজা সব ঠিক আছে, তোমায় কিছু করতে হবে না। শুধু জানালাটা খুলে দিলেই হবে।
–এ তো এক মিনিটের কাজ। চলুন।
কিন্তুদেখা গেল, জানালা অত সহজেই খোলবার পাত্র নয়। দাঁত কিড়মিড় করে মারো জোয়ান হেঁইয়ো। বলে ডাকাত-পড়া হাঁক ছেড়ে পনেরো মিনিট সবরকম কসরত করে গঙ্গারামও ঘোল খেয়ে গেল। ঝপাৎ করে বসে পড়ল মেজের উপর, ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাতে লাগল।
–অনেক জানালা দেখেছি মশাই, কিন্তু এমন বিদঘুঁটে বিচ্ছিরি জানালা তো কখনও দেখিনি।
-বাবা গঙ্গারাম, তুমিও পারলে না।–ঘনশ্যাম কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল : তা হলে কি ও জানালাটা আর কোনওদিন খোলা যাবে না? চিরদিনই বন্ধ হয়েই থাকবে?
গঙ্গারামের আত্মসম্মানে ঘা লাগল।
বন্ধ থাকবে–থাকলেই হল? ইয়ার্কি নাকি? জানালা না খুলে যদি আর বাড়ি ফিরি তা হলে আমার নাম গঙ্গারামই নয়। গঙ্গারামই গোঁ গোঁ করতে লাগল। তারপর মিনিটখানেক চোখ পাকিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল : আচ্ছা, এবার–এগেন!
বলেই কাঠের চেয়ারটা হড়হড়িয়ে টেনে নিয়ে গেল। বললে–জানালার মাথার দিকটা হাতে পাচ্ছি না। ওইখানেই আটকে আছে মনে হচ্ছে। এবার মাথাটা ধরে টেনে দেখব।
চেয়ারের ওপর ব্যস্ত হয়ে দাঁড়াতেই–খটাং। বাপস বলে চেঁচিয়ে উঠল গঙ্গারাম।
ব্যাপার আর কিছুই নয়। জানালার ঠিক ওপরেই দেওয়াল-ঘড়ি, তার তলার দিকের ফুলো অংশটা গঙ্গারামের মাথায় লেগেছে।
–এমন বাজে জায়গায় ঘড়ি রাখেন, আক্কেল-পছন্দ নেই আপনার? মাথায় হাত বুলিয়ে গঙ্গারাম বললে, আমার চাঁদি একেবারে ফুটো করে দিয়েছে। নিন–ধরুন–
কী ধরতে বলছে সেটা বোঝবার আগেই কেলেঙ্কারি ঘটে গেল একটা। গঙ্গারাম পত্রপাঠ উপড়ে আনল ঘড়িটাকে। আর ঘনশ্যাম হাঁ হাঁ করে ওঠবার আগেই ধাঁই করে পড়ে গেল মেজেতে। ঝনঝনাৎ আওয়াজ তুলে ঘড়ির বারোটা বাজল।
ঘনশ্যাম আর্তনাদ করে উঠল : এ কী করলি, ওরে হতভাগা এ কী করলি! চল্লিশ বছরের পুরনো বাবার আমলের এমন জাপানী ঘড়িটা–
–আপনাকে ধরতে বললুম। ধরলেন না কেন?–গঙ্গারাম বিকট গলায় ধমক দিলে : নিজের দোষেই ঘড়ি গেছে আপনার। এমন বেয়াড়া জায়গায় ওটাকে রাখলেনই বা কেন? এখন বেশি চেঁচামেচি করবেন না, কাজ করতে দিন।
হায় হায়–অমন ঘড়িটা
–শাটাপ! গঙ্গারাম হুঙ্কার করল : ডিসটার্ব করবেন না বলে দিচ্ছি।
হুঙ্কার শুনে ঘনশ্যাম থমকে গেল। গঙ্গারাম তখন জানালার মাথাটা ধরে দারুণভাবে টানাটানি করছে। চেয়ারটা মড়মড় করে উঠল।
করুণ গলায় ঘনশ্যাম বললে, বাবা গঙ্গারাম, আমি বলছিলাম, জানালা খোলবার দরকার নেই, ওটা বরং বন্ধই থাক। তুমি তো বিস্তর পরিশ্রম করলে, এবার বাড়ি যাও।
বাড়ি যাব? জানালা না খুলেই? চেয়ার থেকে নেমে পড়ে গঙ্গারাম বললে, সে-পাত্র আমাকে পাওনি। এবার আমি বুদ্ধি পেয়ে গেছি। পেছন থেকে ধাক্কা দিলেই জানালা খুলে যাবে।
–কিন্তু দোতলার জানালা যে! ধাক্কা দেবে আকাশ থেকে নাকি?
–আকাশ থেকে কেন? মইয়ে চেপে!
মই? মই আমি কোথায় পাব?
–মই আছে। ওপাশে রামকানাই কাকার বাড়িতে। নিয়ে আসছি।
-রামকানাই?–ঘনশ্যাম বিষম খেল : রামকানাইয়ের সঙ্গে আমার যে দুবছর মুখ দেখাদেখি বন্ধ, দারুণ ঝগড়া। কখনও মই দেবে না।
–দেয় কিনা দেখছি বলে গঙ্গারাম টুক করে একটা পেতলের ঘটি তুলে নিয়ে বললে–এইটে জামিন রেখে নিয়ে আসব।
–আহা-হা, করছ কী! অনেক দাম ও-ঘটিটার। ওহে ও গঙ্গারাম
আর গঙ্গারাম! তিন লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। যাবার সময় বলে গেল, ঘরটা ততক্ষণ সাফ করে ফেলুন আপনি। বিস্তর ভাঙা কাচ, পায়ে ফুটলে মারা পড়বেন।
ঘর সাফ করা মাথায় রইল, ঘনশ্যামও ছুটে বেরুল পিছনে। কিন্তু গঙ্গারামকে ঠেকায় কার সাধ্যি! ঠিক তিন মিনিটের মধ্যেই ঘটি জামিন রেখে সে মই নিয়ে এল রামকানাইয়ের কাছ থেকে।
কাতর স্বরে ঘনশ্যাম বললে, দোহাই বাবা গঙ্গারাম, জানালা যেমন আছে থাক, তুমি মই ফেরত দিয়ে আমার ঘটি নিয়ে এসো।
আনবখন। ঘটি তো পালাচ্ছে না। আপনি একটু চুপ করে থাকুন না ঘনুজ্যাঠা–দেখুন না আমি কথাটা শেষ হল না। তার আগেই মচমচমড়াৎ!
দেওয়ালে মই রেখে উঠতে চেষ্টা করছিল গঙ্গারাম সামলে নিলে কোনওমতে।
মই গেল! ঘনশ্যাম গগনভেদী হাহাকার করে উঠল; তাহলে আমার ঘটিটা
-ঘটিও গেল। তাতে আর কী হয়েছে। একটা পুরনো ঘটি গেল। তিনটে নতুন কিনতে পারবেন।
ঘনশ্যামকে সান্ত্বনা দিয়ে গঙ্গারাম বললে কিন্তু ব্যাপারটা কী জানেন ঘনু জ্যাঠা-জানালা ওই ভেতর থেকেই খুলতে হবে।
না, জানালা খুলতে হবে না! ঘনশ্যাম তারস্বরে বললে, জানালা আমি কিছুতেই খুলব। কোনওদিন খুলব না, কাউকে খুলতে দেব না, তুমি এখন যাও, দয়া করে যাও–আমাকে রেহাই দাও।
জানালা আমি খুবই খুলে যাব না। হুঁ হুঁ, এ আমার ভীমের প্রতিজ্ঞা!–গঙ্গারাম তার আটচল্লিশ ইঞ্চি বুক দুহাতে থাবড়ে নিলে একবার! জানালা খুলবে, তবে আমি নড়ব এখান থেকে। কিন্তু খুলতে হবে ভেতর থেকেই। শুধু একগাছা দড়ি যদি পাই
দড়িটড়ি নেই। আকাশ মেঘে অন্ধকার করে এসেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তুমি বাড়ি যাও গঙ্গারাম!
–ছোঃ বজ্রবিদ্যুৎ! ও সবে আমার কী হবে?
গঙ্গারাম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল : যদি কেবল একগাছা দড়ি পাই ইয়াঃ, ওই তো দড়ি।–
আরে-আরে–আরে—
ঘনশ্যাম চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু তার আগেই দরজার সামনে বাঁধা তার গোরুর গলা থেকে দড়ি খুলে ফেলল গঙ্গারাম।
–আরে গোরুটা বড্ড পাজি, একবার ছুটলে আর ধরা যায় না ওটা
ঘনশ্যামের চিৎকারেই কিনা কে জানে
দড়ি খোলা পাওয়ামাত্র গোক প্রাণপণে ছুটল। চার পা তুলে চক্ষের পলকে উধাও হয়ে গেল মাঠের দিকে।
ধরো-ধরো, গোরু ধরো আগে
চোখ পাকিয়ে এবার আকাশ ফাটানো হাঁক ছাড়ল গঙ্গারাম।
-গোরু ধরবেন আপনি; আমি কেন? আমি তো জানালা খুলব। লুক হিয়ার ঘনু জ্যাঠা, আমার কাজে সমানে বাধা দিচ্ছেন আপনি। ফের যদি একটাও কথা বলেন–সামনের এই ভরা পুকুর দেখতে পাচ্ছেন? ঠ্যাং ধরে সোজা ওর ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দেব।
–আমি পথে বসলাম–ভাঙা গলায় এই কথা বলে ঘনশ্যাম রাস্তার মধ্যে বসে পড়ল।
কিন্তু বসেও কি থাকবার জো আছে? গঙ্গারাম দড়ি নিয়ে দোতলায় চড়েছে। কাজেই ঘনশ্যামকেও রুদ্ধশ্বাসে পিছু নিতে হল।
তড়িৎকর্মা গঙ্গারাম এবার জানালার কড়ার সঙ্গে গোরুর দড়ি বেঁধে ফেলল শক্ত করে।
–এইবার, এইবার যাবে কোথায়? মারো টান-টানো–আরো জোর ঘোঁ—ঘোঁ–ঘোৎ..টান–টান—টা–কড়াৎ..
শেষ কড়াৎটা দড়ি ছেঁড়বার শব্দ।
শুধু দড়িই ছিঁড়ল না–চিত হয়ে ছিটকে পড়ল গঙ্গারাম। পড়ল ঘনশ্যামের ওপর। ঘনশ্যাম পড়ল কোনায় থরেথরে সাজানো চিটে গুড়ের হাঁড়ির ওপর। একসঙ্গে চারটে হাঁড়ি ভাঙল, চিটে গুড় মেখে ভূত হয়ে ভালো করে উঠে বসবার আগেই
বাইরে মেঘে থমথম আকাশ থেকে ছুটে এল ঝোড়ো বাতাস। এল বোধহয় সওর মাইল স্পিডে।
আর এতক্ষণে বন্ধ জানালাটা সেই হাওয়ার ধাক্কায় বাজের মতো শব্দ করে খুলে গেল।