হরিশপুরের রসিকতা

পৃথিবীর সব লোককেই বিশ্বাস করতে পারো, কিন্তু হরিশপুরের লোককে কখনও বিশ্বাস কোরো না। ভুলেও নয়।

না না–চুরি জোচ্চুরির ভিতরে তারা নেই। তারা কাউকে ঠকায় না। এই কলকাতা শহরে একজন পকেটমারও হরিশপুরের লোক নয়–একথাও আমি হলফ করে বলতে পারি। তারা কেউ বদমেজাজী নয়–গায়ে পড়ে কখনও ঝগড়া করে না। তাদের মিঠাইয়ের দোকানে তিনদিনের পচা সিঙাড়াকে কখনও হাতে গরম বলে চালিয়েও দেয় না। আসল কথা হল

কথাটা আর কিছু নয়। হরিশপুরের মানুষ একটু রসিক। খানিকটা বেশি মাত্রাতেই রসিক।

কী বলছ? রসিক মানুষকে তো ভালোই লাগে? হুঁ, আমারও লাগত একসময়। কিন্তু সেবার সেই বরযাত্রী যাওয়ার পর–আচ্ছা, খুলেই বলছি তা হলে।

আমরা চারজন একই অফিসে চাকরি করি। আমি, নিতাই, নেপাল আর বিষ্টুপদ। দারুণ বন্ধুত্ব আমাদের ভেতরে। একসঙ্গে পকৌড়ি কিনে খাই, সিনেমার টিকিট কিনি, মোহনবাগানের খেলা দেখতে যাই, মোহনবাগান জিতলে চারজনের ছাতা-জুতো হারিয়ে যায় আর মোহনবাগান গোল খেলে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে বসি।

আমাদের সেই বিষ্টুপদর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল হরিশপুরে।

তখন হরিশপুরের মহিমা কে জানত! আমরা তিন বন্ধুই খুশি হয়ে উঠলুম।

বিষ্টুপদ বললে, আমার বিয়েতে তোরা যাবি তো?

আমি, নিতাই আর নেপাল একসঙ্গে বললুম, নিশ্চয় নিশ্চয়! আমরা বরযাত্রী না গেলে তোর তো ভালো করেই বিয়েই হবে না!

কিন্তু বিয়ের দিন বিষ্টুপদর সঙ্গে বেরুনো গেল না। সরকারি অফিস–তায় অসম্ভব কাজের চাপ পড়েছে। বন্ধুর বিয়ের জন্যে ছুটি চাইতে গেলে পুরো একটা দিনের মাইনেই কেটে নেবে। তাই বরকে নিয়ে আসল দলটা দুপুরের দিকে রওনা হয়ে গেল–আমরা ঠিক করলুম অফিস ছুটি হলে সওয়া পাঁচটার ট্রেনেই বেরিয়ে পড়ব।

 

 

অবিশ্যি তাতে কোনও অসুবিধে ছিল না। হরিশপুর কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়। ছোট লাইনের যেসব গাড়ি ঝিমুতে ঝিমুতে টিকিস টিকিস করে চলে তারাও ঘণ্টা দেড়েকের ভেতরেই হরিশপুর পৌঁছে যায়। আমরা হিসেব করে দেখেছিলুম, বিকেলের গাড়িতে গেলেও সন্ধে সাতটার ভেতরে বিয়ে শুরু হওয়ার আগেই হরিশপুরে হাজির হতে পারব।

চারটে বাজতে না বাজতেই আমরা অফিস থেকে ছিটকে বেরুলুম। বন্ধুর বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছি, একটু সাজগোজ না হলেই বা চলে কী করে। আমি প্রাণপণে একটা শাদা জুতোকে রং করলুম, নেপাল তার খাড়া-খাড়া চুলগুলো আধঘণ্টা ধরে বাগাতে চেষ্টা করলে আর নিতাই নিজের পুরনো সিল্কের পাঞ্জাবিতে প্রায় এক শিশি সেন্ট ঢালল।

তারপর হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরা।

প্রথমদিকে খুব ভিড় ছিল গাড়িতে। কেএকজন আমার শাদা জুতোটাকে মাড়িয়ে দিলে, নেপালের সিল্কের পাঞ্জাবিটার ভাঁজ-টাঁজ নষ্ট হয়ে গেল, একজন আবার নিতাইকে ঠাট্টা করে বললে, দাদা যেন গন্ধমাদন হয়ে চলেছেন। যাই হোক, হরিশপুরের গোটা তিনেক স্টেশন আগে গাড়িটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল, তখন আমরা তিনজনে ভালো করে বসতে পেলুম।

নিতাই বললে, এতক্ষণে একটু ভালো করে বসা গেলবাব্বাঃ! আমি বললুম, কতটুকুই বা বসা–এক্ষুনি তো নামতে হবে। নিতাই একটা হাই তুলে পাঞ্জাবিটা একবার শুকে নিলে। তারপর খুশি হয়ে বললে, নামলেই বাঁচি। যা খিদে পেয়েছে ভাই-কী বলব!

নেপাল নিজের খাড়া-খাড়া চুলে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললে, খিদে তো আমারও পেয়েছে। আমি যেন এখান থেকেই লুচিভাজার গন্ধ পাচ্ছি।

আমি বললাম, আমার নাকে মাংসের কালিয়ার গন্ধ আসছে।

নিতাই ভাবুক হয়ে উঠল। বেশ উদাস-উদাসচোখ করে বলে চলল, আর আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছি রাশি রাশি চপ ভাজা হচ্ছে বড়বড় থালায় সাজিয়ে রাখা হচ্ছে ভেটকির ফ্রাই

আমি আর নেপাল বললুম, আহা-আহা! আর বলিসনি।

আমাদের তোমরা পেটুক ভাবছ নিশ্চয়। কিন্তু আমরা কী করব বলল! তিনজনেই মেসে থাকি। বিউলির ডাল, পুঁই চচ্চড়ি আর শুকনো পোনামাছের টুকরো খেতে খেতে পেটে প্রায় চড়া পড়ে গেছে। তাই কিঞ্চিৎ খ্যাঁটের আশায় আমরা বেশ খানিকটা উত্তেজনা বোধ করছিলাম।

ঠিক সেই সময় বুড়ো ভদ্রলোকটি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন আপনারা?

 

 

কামরাতে আমরা তিনজন ছাড়া এই ভদ্রলোক হলেন চার নম্বরের যাত্রী। বেশ পাকা আমটির মতো ফরসা গোলগাল চেহারা, মুখে একজোড়া মানানসই কাঁচা-পাকা গোঁফ, মাথায় চকচকে টাক, দেখলেই ভক্তি আসে। সঙ্গে দুটি বিরাট সাইজের মুখ বাঁধা হাঁড়ি।

এতক্ষণ এক কোণায় বসে আমাদের লক্ষ্য করছিলেন। এইবারে প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

-কোথায় যাবেন?

আমরা এক সঙ্গেই বললুম, হরিশপুর।

বরযাত্রী বুঝি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ

।–বেশ, বেশ। হরিশপুর কদমতলায় জগদীশ চক্কোত্তির মেয়ের বিয়েয় যাচ্ছেন–তাই না?

আমরা অবাক হলুম একটু। নিতাই জিজ্ঞেস করলে, কী করে জানলেন?

ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, আমরা এ-তল্লাটের লোক–সব রকম খবরই রাখি। ছেলেটির নাম বিষ্টুপদ গোস্বামী নয় কি?

নেপাল চোখ কপালে তুলে বললে, তা-ও জানেন দেখছি।

ভদ্রলোক গোঁফজোড়ায় বেশ একবার তা দিয়ে নিলেন। তারপর তেমনি শান্ত হাসি হেসে বললেন, বললুম যে আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক সব খবরই রাখতে হয়। এ তো আর কী বলে আপনাদের কলকাতার ব্যাপার নয় যে দোতলায় বিয়ে হলে একতলার লোককে নেমতন্ন করে না।

ট্রেন তখন আর একটা স্টেশন পার হয়েছে। এর পরেই হরিশপুর। ভদ্রলোক বেশ করে এক টিপ নস্যি নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তা নামবেন কোন স্টেশনে? খরিশপুরেই তো?

আমি বললুম, খরিশপুরে কেন? আমরা তো হরিশপুরে যাব।

–জানি–জানি। হরিশপুর কদমতলায়। সে তো খরিশপুর থেকেই কাছে হয়।

বলেন কী! হরিশপুরের কদমতলা খরিশপুরে যেতে যাবে কেন?

হাতের নস্যি ঝাড়তে ঝাড়তে ভদ্রলোক বললেন, হুঁ, এদিকে নতুন লোক কেউ এলে ওই ভুলটাই করে। নামে হরিশপুর কদমতলা হলে কী হয় হরিশপুর স্টেশন থেকে পাকা দুমাইল হাঁটতে হয়। আর খরিশপুর থেকে আধ মাইলও হবে না। মিথ্যে হরিশপুরে নেমে কষ্ট পাবেন কেন?

নিতাই আপত্তি করল কই, আমাদের তো কেউ সেকথা বলে দেয়নি।

 

 

বললুম তো, বাইরের লোক সবাই-ই ভুল করে। তা ইচ্ছে হলে আপনারা হরিশপুরেই নামতে পারেন–আমার তাতে কী বলবার আছে, বলুন।

নেপাল বললে, তা হলে বরং খরিশপুরেই নামব আমরা। যা খিদে পেয়েছে–এখন দু মাইল হাঁটতে গেলে পেটের নাড়িভুড়ি সব হজম হয়ে যাবে! কিন্তু খরিশপুর আবার কোথায়?

–বেশি দূর নয়–খরিশপুরের পরের স্টেশন। ভদ্রলোক হাসলেন–চলুন, আমিও খরিশপুরেই যাচ্ছি। রাস্তাটা দেখিয়ে দেব আপনাদের।

বেশ তো, বেশ তো!–আমরা দারুণ খুশি হলুম।

ট্রেন হরিশপুরে এল, দুমিনিট পরে ছেড়েও গেল। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বাঁ-দিকে একটা বাড়ির সামনে মস্ত চাঁদোয়া খাটানো, পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে, বিস্তর লোক আনাগোনা করছে সেখানে।

নেপাল ছটফট করে উঠল।

–ওই তো একটা বিয়েবাড়ি ওখানে।

ভদ্রলোক আর-এক টিপ নস্যি নিলেন। হেসে বললেন, ও অন্য বিয়ে। এখন তো মরশুম মশাই–চারদিকেই বিয়ে হচ্ছে।

–তা বটে, তা বটে!–নিতাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল–যা খিদে পাচ্ছে, ওখানে গিয়ে পাতা নিয়ে বসে পড়লেও হত।

 

 

ভদ্রলোক বললেন, তা মন্দ নয়। আমিও একবার ভুল করে আর-এক বিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছিলুম। সে যা কাণ্ড! বলে বেশ একটা মজার গল্প জুড়ে দিলেন। দেখলুম, লোকটি ভারি রসিক।

আমরা প্রাণ খুলে হাসছি, এমন সময় ঘটাং ঘটাং করে গাড়ি খরিশপুরে পৌঁছে গেল। হাঁড়ি দুটো তুলে নিয়ে ভদ্রলোক বলেন, নামুন–নামুন! গাড়ি এখানে এক মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না।

আমরা চটপট নেমে পড়লুম।

ছোট্ট স্টেশন। ঘন হয়ে অন্ধকার নেমেছে ঝিঁঝি ডাকছে ঝাঁ ঝাঁ করে। দূরে কাছে কয়েকটা মিটমিটে আলো–স্টেশনের পাশেই গোটা দুই দোকান দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, স্টেশন থেকে বেরিয়েই দুটো পিপুলগাছের তলা দিয়ে যে রাস্তাটা বাঁ-দিকে গেছে-তাই ধরে এগোবেন। খানিক দূর গেলেই একটু জংলা মনে হবে পথটা-তাতে ঘাবড়ে যাবেন না। তারপরেই একটা ছোট নালা বাঁশের পুল রয়েছে–সেটা পেরুলেই

স্টেশনমাস্টার টিকিটের জন্যে এগিয়ে এলেন। তারপর ভদ্রলোককে দেখে একগাল হেসে অভ্যর্থনা করলেন।

-মুখুজ্যেমশাই আজ এখানে যে?

হুঁ একটু কাজে আসতে হল। শুনুন, এঁরা তিনজন কলকাতা থেকে আসছেন, খরিশপুরের বদলে ভুলে হরিশপুরের টিকিট কেটেছেন। বাড়তি কিছু দিতে হবে নাকি?

–ঠিক আছে–ঠিক আছে-রেল স্টেশনমাস্টার আমাদের টিকিট নিয়ে চলে গেলেন। আমরা মুখুজ্যেমশায়ের ওপর আরও খানিকটা কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলুম।

নিতাই জিজ্ঞেস করলে, আপনি কোথায় যাবেন?

-আমি? আমিও যাব ওই দিকটাতেই। তবে একটু দেরি হবে আমার। দশ-বারো মিনিটের ভেতরেই উল্টো দিকের একটা গাড়ি আসছে। তাতে আমার এক বন্ধুর আসবার কথা। সে-ও এদিকে নতুন লোক, একেবারে তাকে সঙ্গে নিয়েই যাব। কিন্তু আপনারা আর দেরি করবেন না-এগোন।

না, দেরি করা চলবে না, পেটে আগুন জ্বলছে-নেপাল আগেভাগেই পা বাড়াল। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ আর নমস্কার জানিয়ে আমরা দুজনেই নেপালের পেছনে চলতে শুরু করে দিলুম।

ভদ্রলোক ডেকে বললেন, কিছু অসুবিধে হবে না–এগিয়ে যান

–আচ্ছা–আচ্ছা

পিপুলগাছটার তলা দিয়ে বাঁয়ের রাস্তায় আমরা চলতে শুরু করলুম। দু-ধারে ছোট বড় কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ল বটে, কিন্তু কোনওটাকেই বিয়েবাড়ি বলে মনে হল না। খিদের তাড়ায় হনহন করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। মাটির পথ-অন্ধকারে একটু অসুবিধেও হচ্ছিল। কিন্তু আধ মাইলের তো ঝামেলা–দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাব।

কিন্তু কোথায় সেই আধ মাইল?

একটু পরেই দুপাশে শুরু হয়ে গেল ঘন জঙ্গল। এত অন্ধকার যে, চোখ আর চলতে চায়। চারপাশে খালি অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে আর মাথার ওপর ঘনিয়ে এসেছে নিবিড় কালো মেঘ। আমি একবার পা পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নিলুম-নিতাই একটা হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

–এই ন্যাপলা ব্যাপারটা কী বল তো? এ কীরকম বিয়েবাড়ির রাস্তা? নেপাল মোটা মানুষ হলে কী হয়–খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সে চিরকালই অত্যন্ত উৎসাহিত আর দারুণ রকম তৎপর।

 

 

নেপাল বলে, দাঁড়াসনি, চল–চল। মোটে তো আধমাইল যেতে হবে।

–আধ মাইল! আধ মাইল কাকে বলে আমি জানিনে?–নিতাই চটে গেল : সেই তখন থেকে হাঁটছি বাড়ি নেই, ঘর নেই–কেবল শাঁ শাঁ করছে অন্ধকার জঙ্গল–যেন আফ্রিকার বনের ভেতর দিয়ে চলেছি। নিশ্চয় রাস্তা ভুল হয়েছে।

নেপাল বললে, রাস্তা ভুল হবে কেন? ভদ্রলোক যেভাবে বলে দিয়েছেন–সেই ডিরেকশনেই তো চলেছি। আর কোনও রাস্তা তো এদিকে দেখিনি।

নিতাই গোঁ গোঁ করে বললে, দুত্তোর ডিরেকশন! যা জঙ্গল চারদিকে বিয়ে বাড়িতে ভোজ খাওয়ার আগে বাঘেই আমাদের ভোজে লাগাবে মনে হচ্ছে।

আমি বললাম, পাড়াগাঁয়ের রাস্তা একটু জংলা হয়ই। আর একটু এগিয়ে দেখা যাক না। কিন্তু বেশি দূর এগোতে হল না। হঠাৎ রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল। তারপরেই দেখা গেল, ঢালু পাড়ির নীচে খানিকটা জলের রেখা। আর একধারে ভূতুড়ে চেহারা নিয়ে একটা বাঁশের পুল দাঁড়িয়ে।

নেপাল খুশি হয়ে বললে, ব্যস–এই তো এসে গেছি। এই সেই নালা, আর এই পুলটা পেরোলেই

নিতাই বললে, নালা? এ তো দস্তুরমতো নদী দেখছি।

আরে এসব দেশে নদীটাকেই নালা বলে। পাড়াগাঁয়ে তোক তো! চল, চল, খিদেয় দাঁড়াতে পারছি না।

নেপাল বাঁশের পুলটার দিকে পা বাড়াল।

আর ঠিক তক্ষুনি চারদিক ঝলসে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাল-কড়কড় করে ডেকে উঠল মেঘ। সেই বিদ্যুতের আলোয় সব স্পষ্ট দেখতে পেলুম আমরা। নীচে ছোট একটা নদীই বটে। বাঁশের পুলটা তার আধখানা পর্যন্ত গিয়ে ভেঙে পড়েছে। অন্তত পাঁচ বছরের ভেতর তার ওপর দিয়ে কেউ পার হয়নি। আমরা সেই পুলে উঠে একটু এগোলেই সোজা নদীতে গিয়ে পড়তুম। ওপারে অথই জঙ্গল–যেটুকু দেখতে পেলুম তাতে মনে হল শুধু বাঘ কেন, ওখানে হাতি, গণ্ডার, ভালুক–অজগর সব কিছু থাকা সম্ভব।

আবার বিদ্যুতের চমক আর মেঘের ডাক। আর নদীর এপারে এবার যা আমরা দেখতে পেলুম, তাতে আমাদের চোখ সোজা কপালে উঠে গেল। ভাঙা কলসি, কয়লা ছাই আর কয়েকটা আধপোড়া বাঁশ। একটা দড়ির খাঁটিয়া তাদের মাঝখানে আকাশে চার পা তুলে উটে পড়ে আছে।

আমি বললুম, শ্মশান।

ওপারের নিবিড় জঙ্গল থেকে হু-উ-উ করে একটা শেয়াল ডেকে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে এপারে ওপারে ডাইনে বাঁয়ে–আন্দাজ শখানেক শেয়াল একসঙ্গে সাড়া তুলল–হুঁয়াহুয়া–কেইসা হুয়া?

যেন আমাদের ঠাট্টা করছে।

-ওরে বাবা রে—

যে-পথ দিয়ে এসেছিল, সেই পথ দিয়েই নিতাই প্রাণপণে ছুট লাগাল–আমরাও তার পেছনে পেছনে। আর চারদিক থেকে শেয়ালেরা সমস্বরে বলতে লাগল : মজা হুয়া-আচ্ছা হুয়াহুয়াহুয়া।

এর মধ্যে আবার ঝমাঝম করে বৃষ্টি নামল।

গর্তে পা পড়ে নিতাই ধপাৎ করে একটা আছাড় খেল, তার ওপর উবুড় হয়ে পড়ল নেপাল এবং সেই সঙ্গে আমাকেও টেনে নামাল। পাঁচ মিনিট জলে কাদায় জড়াজড়ি করে যখন আমরা দাঁড়ালুম, তখন নিতাইয়ের সিল্কের পাঞ্জাবির আধখানা আমার হাতে আর আমার শাদা জুতোটার একটা কোথাও খুঁজে পেলুম না।

কিন্তু উঠে দাঁড়িয়েই নিতাই আবার বসে পড়ল।

কী হল রে?

–পা মচকে গেছে হাঁটতে পারছি না আর। ওফ! বৃষ্টিটা যেমন হঠাৎ এসেছিল–তেমনি ছেড়ে গেল। মাঝখান থেকে আমাদের দুঃখের বোঝাটা বাড়িয়ে গেল খানিকটা। আর আমরা সেই জঙ্গলের ভেতরে, জলকাদায় বসে পনেরো মিনিট ধরে নিতাইয়ের পা দলাই-মলাই করতে লাগলুম।

নিতাই শেষ পর্যন্ত আমাদের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে পড়ল। তারপর হাঁটতে লাগল নেংচে নেংচে।

–এই ন্যাপলাটার বুদ্ধিতে পড়েই

নেপাল ফোঁস করে উঠল : আমি কী করব? সেই ভদ্রলোক যেমন বলেছিলেন

ভদ্রলোক!–নিতাই বিকট রকম মুখ ভ্যাংচাল : একটা মিথ্যেবাদী–লায়ার–জোচ্চোর–।

 

 

আরও কী সব গাল দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কোত্থেকে তিন চারটে টর্চের আলো পড়ল আমাদের গায়ে। দেখি আট-দশজন লোক হাতে তাদের লাঠি আর বল্লম। কী সর্বনাশ-ডাকাত নাকি?

কারা আপনারা!কড়া গলায় কে জানতে চাইল।

আমরা–আমরা বিদেশী লোক!–আমি হাউমাউ করে বললুম : আমরা বরযাত্রী কলকাতা থেকে আসছি হরিশপুর কদমতলায় যাব। আমাদের

বরযাত্রী! হরিশপুর কদমতলা-লোকগুলো একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল : তা বেশ–গল্পটা শুনতে ভালোই। চলুন–আপনাদের অভ্যর্থনা করতেই আমরা এসেছি। বিয়েবাড়িতেই নিয়ে যাব।

তার মানে?–অভ্যর্থনাটা ঠিক সুবিধেমতো মনে হল না।

–আমরা গ্রামের ডিফেন্স পার্টি। তিনজন বিদেশী লোক এই দুর্যোগের রাতে শ্মশানের জঙ্গলে কেন ঘুরছিলেন তার একটা ভালো কৈফিয়ৎ দিতে হবে। থানায় চলুন

–থানা!-নেপাল হাহাকার করে উঠল :বরযাত্রীকে থানায় নেবেন মানে?

কারণ, থানাই তাদের জায়গা। আর একটাও কথা নয়, চলুন।

অগত্যা থানাতেই টেনে নিয়ে গেল।

খরিশপুরের দারোগা আমাদের কাহিনী শুনে হেসে অস্থির।

–আহা, হরিশপুর কদমতলার বরযাত্রী না হলে পাঁচ মাইল উজিয়ে খরিশপুরে কেন আসবে? হরিশপুর স্টেশনের পাশেই কদমতলা–সে সব ফেলে খরিশপুরের শ্মশানে না গেলে বরযাত্রী কিসের?–তারপর চোখ কটমট করে বললেন, ছোরা-বোমা–সিঁদকাঠি এ-সব কোথায়?

–খবরদার, ভদ্রলোককে অপমান করবেন না। আমরা প্রতিবাদ করলুম।

 

 

ভদ্রলোক!-দারোগা নাকটা শিকেয় তুললেন : এরকম কজন ভদ্রলোককে তিন মাস আগেই চুরির দায়ে আমরা চালান করেছি। তাদের জেল হয়ে গেছে। তোমরাও থাকো আজ হাজতে। কাল সকালে তোমাদের ওস্তাদি আমি দেখে নেব।

দয়া করে যদি হরিশপুর জগদীশ চক্রবর্তীর বাড়িতে একটা খবর পাঠান

–দেখা যাবে কাল বলে দারোগা সোজা আমাদের হাজতে চালান করলেন। সারারাত ভিজে কাপড়-জামায়, খিদেয় লজ্জায় আর ভয়ে আমাদের কী ভাবে যে কাটল, তা বোধহয় না বললেও চলে। নিতাই একটা কুটকুটে কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকল, নেপাল দুহাতে মুখ ঢেকে কুঁইকুঁই করে একটানা কেঁদে চলল আর আমি সারা রাত ধরে অন্তত হাজার খানেক মশা মারলুম।

সকালে উঠে তিনজনে জড়াজড়ি করে বসে আছি আর ভাবছি, এর পরে কপালে কী আছে–এমন সময়–হাজতের দরজা খুলে দারোগা, বিষ্টুপদ আর

আর সেই ভদ্রলোক! সেই মুখুজ্যে মশাই–সেই গোলগাল লোকটি, পাকা আমের মতো চেহারা, কাঁচা-পাকা গোঁফ যিনি আমাদের হরিশপুর কদমতলার সোজা রাস্তাটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

আমরা তিনজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম : এই যে জোচ্চোর মিথ্যাবাদী—পাষণ্ড–ভণ্ড

বিষ্টুপদ বললে, আরে, কাকে কী বলছিস! উনি যে আমার খুড়শ্বশুর হন সম্পর্কে। সকালে চৌকিদার গিয়ে খবর দিতে–উনিই তো আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলেন! আর তোদের চেহারার বর্ণনা দিয়ে বললেন, এই রকম তিনজন লোক কাল সন্ধের ট্রেনে বলাবলি করছিল, তারা হরিশপুরে বরযাত্রী যাচ্ছে। আর তাতেই তো আঁচ করলুম, তোরা ভুল করে

 

 

আমরা আবার চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম–ভদ্রলোক একগাল হাসলেন। একেবারে নির্লিপ্ত অহিংস হাসি।

বরযাত্রীদের নিয়ে একটু রসিকতা করেছিলুম মশাই, তারপর উল্টো ট্রেনটায় হরিশপুরে চলে এসেছিলুম। ভেবেছিলুম, একটু বাদে আপনারাও এসে যাবেন। কিন্তু এভাবে হাজতবাস করতে হবে সেটা ভাবিনি। এখন দয়া করে হরিশপুরে চলুন, চা-জলখাবার–গরম পোলাও-মাংস সব তৈরি।

কিন্তু সে-মাংস-পোলাওয়ের আকর্ষণে আমরা আর হরিশপুরে যাইনি। সোজা কলকাতায় ফিরে এসেছিলুম। আর হরিশপুরে বিয়ে করার জন্যে বিষ্টুপদর সঙ্গে আমাদের চিরকালের মতোই বন্ধু-বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। ওকেও কি বিশ্বাস আছে আর? সেই কালান্তক শ্বশুরবাড়ি থেকে কোন্ মারাত্মক রসিকতা আমদানি করে আমাদের একদম ফাঁসিয়ে দেবে কে জানে!


© 2024 পুরনো বই