বলটুদা বললে, এই যে ঘোড়াটা দেখছিস, এর পূর্বপুরুষ কে– জানিস?
অন্য একটা ঘোড়া নিশ্চয়–আমি জবাব দিলাম।
বলটুদা বললে, তোর মুণ্ডু!
তবে কি ওর পূর্বপুরুষ হাতি? নাকি গণ্ডার? না বাঘ?
কিন্তু বাঘ বলে আমার নিজেরই খটকা লাগল : উঁহু, বাঘ জেব্রার পূর্বপুরুষ– জেব্রার গায়েই তো বাঘের মতো ডোরা আঁকা আছে।
আমি জানতে চাই প্যালা, তুই তোর গবেষণা বন্ধ কবি কিনা?
বলটুদা চটে উঠল : যা মনে আসছে তাই যে বলে যাচ্ছিস। আমি তোকে ঘোড়ার কথা জিজ্ঞেস করছিলুম–জেব্রা নিয়ে কে তোকে মাথা ঘামাতে বলেছে?
আমি কান-টান চুলকে বললাম, কী জানো বলটুদা, ঘোড়া-টোড়ার কথা ভাবলেই আমার সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়। ঘোড়া থেকে মনে পড়ে ঘোড়ার ডিমকে ঘোড়ার ডিম থেকে মনে পড়ে ডিমের ডালনাকে, তা থেকে মনে পড়ে ফুলকো লুচিকে।
উঃ, এ যে বকবক করে কানের পোকা বের করে দিলে। তোদের মতো পেটুকের সঙ্গে কথা কওয়াই ঝকমারি বলটুদা হাল ছেড়ে দিলে।
আর সঙ্গে সঙ্গেই বলটুদার ঘোড়াটা চিহিহি করে ডেকে উঠল। ঠিক মনে হল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার ভঙ্গিতে হি হি করে হাসছে। আচ্ছা বেয়াদব ঘোড়া তো।
বলটুদা বললে, দেখলি তো প্যালা– কেমন সমঝদার ঘোড়া? তোর ক্যাবলামি দেখে কেমন তোকে ভেংচে দিলে। তাই তো বলছিলুম- এর পূর্বপুরুষ হল চৈতক।
চৈতন?–আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, চৈতন তো হল বড়মামার বুড়ো চাকর। সে তো ধানবাদে থাকে, আর সন্ধে হলেই মামা হো–মামা হো, বলে গান গায়।
শুনে বলটুদা কটাং করে আমার মাথায় একটা গাঁট্টা মারলে। বললে, তুই একটা ছাগল। মামা হো নয় রে বেকুব, ওটা রামা হো। আর চৈতন নয়-চৈতক। তোর বড়মামার চাকর নয়–রানা প্রতাপ সিংহের ঘোড়া।
প্রতাপ সিঙ্গী,–ওহো, বুঝতে পেরেছি। আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ছোটকাকার বন্ধু। রেলে চাকরি করে। আমাকে একবার কেলনারের হোটেলে কাটলেট খাইয়েছিল।
কটাং করে আর একটা গাট্টা পড়ল আমার চাঁদির ওপর। বলটুদা তিনটে পোকা-খাওয়া দাঁত খিঁচিয়ে বললে, এঃ– এটার কেবল খাই-খাই। প্রতাপ সিঙ্গি নয় রে উজবুক রানা প্রতাপ সিং। চিতোরের মহারানা। ইতিহাস-টিতিহাস পড়িসনি?
বললাম, পড়ব না কেন? ওই তো–যাতে মহম্মদ ঘোরীর গল্প আছে। পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল, ঘোরী নাম হইল কেন? আমি লিখেছিলুম, তাঁহার একটি ঘড়ির দোকান ছিল বলিয়া। ইতিহাসের মাস্টার কেশববাবু সেইটে পড়ে আমাকে হাফডাউন করিয়ে দিয়েছিলেন। বলটুদা বললে ইসস–এটা যে জ্বালিয়ে খেলে। ইতিহাস-ভূগোল সব দেখছি পালাজ্বরের পিলে হয়ে এর পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে বসে আছে। ওই পিলেটায় একটু ঝাঁকুনি দেওয়া দরকার। এই প্যালা, ঘোড়ার চড়বি?
–অ্যাঁ।
বলি, ঘোড়ায় চড়বি?–বলটুদা আমায় উৎসাহ দিতে লাগল : ঘোড়ায় চড়লে কী কী উপকার হয় তা জানিস? শরীর শক্ত হয়–পালা জ্বর পালাতে পথ পায় না, পিলে ভ্যানিশ করে, রাত্তিরে নাক ডাকে না, চুল ওঠা বন্ধ থাকে, মস্তিষ্ক স্নিগ্ধ হয়– বিজ্ঞাপন যা-কিছু লেখা আছে সব পর পর আওড়াতে লাগল বলটুদা : দাঁতের মাড়ি শক্ত হয়, কাটা ছেঁড়া সত্বর শুকাইয়া যায়–মুখের ত্বক কোমল ও লাবণ্যযুক্ত হয়–জামাকাপড় ধবধবে শাদা হয়–
এবারে ব্যাপারটা আমার বাড়াবাড়ি মনে হল। বললাম, ধ্যাৎ-জামাকাপড় ধবধবে শাদা হবে কেন? ঘোড়া কি সাবান?
বলটুদা ভুরু কুঁচকে বললে, ওই তোর দোষ প্যালা,খালি গুরুজনের মুখে মুখে তক্কো করিস। বেশ একটা ফ্লো এসেছিল– গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছিলাম, দিলে বাগড়া দিয়ে। নে–ওঠ
–কোথায় উঠব?
ঘোড়ায়।
–আমি পারব না। ওসব আমার কাজ নয়।
-পারতেই হবে! বলটুদা চোখ পাকিয়ে বললে, না পারলে চলবে কেন শুনি? আমি দেড়শো টাকা দিয়ে ঘোড়া কিনেছি- শুধু বসে বসে ছোলা খাবে বলে?
–কিন্তু আমাকে কেন?–আমি কাতর হয়ে বললাম :–ও সব ঘোড়া-টোড়ার ব্যাপারে আমাকে টানা-হেঁচড়া করে তোমার লাভ কী? তোমার ইচ্ছে হয়–তুমি চড়ো, আমি চলি বলে সরে পড়বার জন্যে পা বাড়াচ্ছি, বলটুদা সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত চেপে ধরল।
–পালাচ্ছিস কোথায়? আমি তো চড়বই–তোকেও চড়তে হবে।
–পড়ে যাব যে?
–পড়বি কেন? আমার কোমর ধরে বসে থাকবি।
-যদি তুমিও পড়ে যাও?–আমার তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না– যদি আমাকে নিয়ে ধপাস করে রাম-আছাড় খাও একটা?
তা হলে তুইও খাবি। এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে নাকি? বলে বলটুদা আমায় হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল চৈতকের সেই বংশধর–মানে দেড়শো টাকা দামের সেই লাল ঘোড়াটার কাছে। সেটা তখন বাগানের বাইরে কী কতকগুলো ঝোপঝাড় চিবিয়ে খাচ্ছিল একমনে।
পা দিয়ে বলটুদা দিব্যি টকাৎ করে উঠে পড়ল। আমাকে বললে, ওঠ।
-কী করে উঠব?
হাত ধরে উঠে পড় আমার। বলে হাত বাড়িয়ে দিল বলটুদা। আমি বলটুদার হাত ধরতে গেছি, হঠাৎ কী মনে করে চৈতকের সেই বংশধর বোঁ করে এক পাক ঘুরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই আমি যেটা জাপটে ধরলাম, সেটা বলটুদার হাত নয় ঘোড়ার ল্যাজ।
চি-হি-হি-হেঁ হেঁ বলেই চৈতকসন্তান তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল।
সরে যা, সরে যা–বলটুদা চেঁচিয়ে উঠল : চাঁট মেরে দেবে এক্ষুনি!
সরে যাব মানে? তার আগেই এক লাফে বারান্দায়।
কিন্তু লাফিয়ে উঠেই ঘোড়াটার যে কী হল কে জানে। তারপরেই সোজা বন বন করে ঘুরতে লাগল লাট্টুর মতো। সে-ঘূর্ণি আর থামে না।
ঘোড়ার ওপর থেকে বলটুদা হাঁউমাউ ডাক ছাড়ল : প্যালা!
বারান্দার ওপর নিরাপদে দাঁড়িয়ে আমি জবাব দিলাম, বলো।
–ঘোড়াটা যে থামছে না!
–থামবে কেন? ওর তেজ এসেছে যে! মহারানা প্রতাপের বংশধর কিনা!
–খালি পাঁইপাঁই করে পাক খাচ্ছে যে!
–তাই তো খাবে। পাঁই-পাঁই করে ঘুরবে বলেই তো ওর নাম ঘোড়া!
ইয়ার্কি রাখ প্যালা। বলটুদা তখন ঘোড়ার পিঠের উপর শুয়ে পড়ে দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরেছে : আমাকে ছিটকে ফেলে দেবে মনে হচ্ছে!
–তা হলে ছিটকে পড়েই যাও। আমি উপদেশ পাঠালাম।
ঠ্যাঙ ভেঙে যাবে যে। বলটুদার কাতর আর্তনাদ।
-দেড়শো টাকার ঘোড়া থেকে পড়ে কেবল ঠ্যাঙ ভাঙলেই চলবে কেন? মাথা না ভাঙলে কি তোমার প্রেসটিজ থাকবে? আমি জানিয়ে দিলাম। ঘোড়াটা সমানে বনবনিয়ে ঘুরেই চলেছে।
–ঘোড়া বোধ হয় লাট্টুর বংশধর রে প্যালা! বলটুদার ভগ্ন কণ্ঠ শোনা গেল।
–আমারও তাই মনে হচ্ছে। বলতে বলতেই দেখি ঘোড়াটা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। একেবারে স্ট্যাচু, নট নড়নচড়ন টকাস মার্বেল!
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম; বলটুদা, নেমে পড় শিগগির, এইটাই চান্স।
বলটুদা বোধ হয় নামতেও যাচ্ছিল, কিন্তু আর-একটা কাণ্ড হল তক্ষুনি। হঠাৎ ঘোড়াটা ভু-ভু খুরর-ঘুরর করে কেমন একটা বিটকেল আওয়াজ ছাড়লে। তারপরেই সামনের পা দুটো আকাশে তুলে দিয়ে মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। ঘোড়ার পিঠের ওপর ঠিক একটা ব্যাগের মতো ঝুলতে লাগল বলটুদা।
-প্যালারে–গেলাম!
–যাচ্ছ বলেই মনে হচ্ছে! মানে ঘোড়াটা বোধহয় উড়তে চেষ্টা করছে। তোমাকে নিয়ে বোধহয় আকাশে পাড়ি দেবার মতলব আছে ওর। ঘোড়ার হালচাল দেখে আমার সেইরকম সন্দেহ হল।
বলটুদা তারস্বরে বললে, ওর পেটের দু’পাশটা কীরকম ফুলে উঠেছে, আর বুড়ৎ বুড়ৎ করে শব্দ হচ্ছে।
–খুব সম্ভব পাখা বেরুচ্ছে ওখান দিয়ে। ওটা বোধহয় পক্ষিরাজের বংশধর।
–তা হতে পারে। বলটুদার গলা দিয়ে কান্নার মত আওয়াজ বেরুল : কিন্তু আমার এখন আকাশে ওড়বার ইচ্ছে নেই। একদম না।
–মানে ঘোড়াটা যে ঘুড়ি হয়ে উড়ে যায় তা তুমি চাও না। কিন্তু তুমি না চাইলেই কি ও ছাড়বে? ওর যেরকম তেজ এসেছে।
আর তক্ষুনি ঘোড়াটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফাতে আরম্ভ করল।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম : ক্যাঙারুর মতো লাফাচ্ছে যে!
বলটুদা গোঁ-গোঁ করছিল; কী বললে ঠিক বোঝা গেল না! কিন্তু আমার মনে হল ঘোড়া তা হলে নিশ্চয়ই ক্যাঙারুর বংশধর।
সার্কাসের খেল দেখানোর মতো টপাং টপাং করে হাত দশেক লাফিয়ে গেল ঘোড়া। তারপর বললে বিশ্বাস করবে না, নাচতে আরম্ভ করে দিলে।
ওঃ, সে কী নাচ! কখনও মনে হল রায়বেশে নাচছে, কখনও-বা উদয়শঙ্করকে একেবারে মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। কখনও চার-পা তুলে, কখনও দু-পা তুলে। সেই সঙ্গে চ্যাঁ-হ্যাঁ হ্যাঁ-হ্যাঁ-সে কী ঘোটকীয় রাগিণী। অমন নাচ-গান আমি জীবনে কোনওদিন। দেখিনি। আর ঘোড়ার পিঠের ওপর ঝুলন্ত বলটুদাকে নাচতে হচ্ছে সেইসঙ্গে।
ডাকলুম–বলটুদা!
বলটুদা সাড়া দিলে না; বোধহয় নাচের তালে মেতে উঠেছে। শুধু ওর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল-গ্যাঁ-গ্যাঁ-গ্যাঁ। ঘোড়াটার সঙ্গে গানের কোরাস ধরেছে মনে হল।
ঘোড়ার পূর্বপুরুষ খুব সম্ভব রায়বেশে নাচত–আমি বলটুদাকে জানাতে চেষ্টা করলাম।
উত্তরে বলটুদা বললে, গ্যাঁ-গ্যাঁ-গ্যাঁ। হয়তো হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।
–চ্যাঁহোঁ-চ্যাঁহো-হি-হি-হি ঘোড়াটা নাচতে লাগল। একবার সামনে আসে, একবার পিছিয়ে যায়। কখনও দুপা আকাশে তুলে হরি সংকর্তনের মতো নাচতে থাকে, মনে হয় এক্ষুনি গেয়ে উঠবে : লাগল হরির লুটের বাহার।
আবার তক্ষুনি সামনে পেছনে এমন করে দুলতে থাকে যে, যেন ও সাঁওতালী ঝুমুর দেখিয়ে দিচ্ছে।
প্রায় সাত-আট মিনিট নেচে ঘোড়াটা থামল। তারপর–তারপর সামনের দিকে গলা বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে শুরু করে দিলে।
হাসিই বটে। দাঁত-টাত বের করে নাকের ফুটোর ভেতর থেকে ধোঁয়াধোঁয়া মতন কী সব ছড়িয়ে দিয়ে হাঁঃ হাঁঃ হাঁঃ হাঁঃ শব্দে অট্টহাসি শুরু করে দিলে! সে-হাসি যে কী চিজ তা বলে বোঝানো শক্ত।
পণ্ডিতমশাই সামনে থাকলে সন্ধি করে বলতেন : ঘোড়াট্টহাস্য!
পরক্ষণেই একটি লাফ। রামলাফ বললেও কম বলা হয়। দশরথ লাফ বললেও ঠিক বলা হয় কিনা কে জানে? মাটি থেকে প্রায় হাত দশেক ওপরে উঠে গেল।
আমি ভাবলাম বুঝি উড়েই গেল এবার। কিন্তু ঘোড়া উড়ল না, উড়ল বলটুদা। কিন্তু বলটুদার তো আর পাখা নেই, বেশি দূর যাবে কী করে? হাত-পনেরো উড়ে গিয়ে, নেহাত কপাল জোরেই বলতে হবে, একেবারে বিচালির গাদায় গিয়ে ধরাশায়ী– মানে গাদাশায়ী হলে। আর ঘোড়া? সেই একটি লাফেই বাড়ির চৌহদ্দি পার হল। আবার লাফ- আধ মাইল দূরে চলে গেল। আর-এক লাফ।
তারপরেই ঘোড়া দিগন্তে বিলীন হল। হয়তো আকাশেই উড়ে গেল। ঠিক বলতে পারব না।
আমি বলটুদার কাছে ছুটে গেলাম। তারপরে যেতে হল ডাক্তারের কাছে।
দুদিন পরে হাত-পায়ে প্লাস্টার বেঁধে বলটুদা উঠে বসল। আমি খবর নিতে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, চৈতকের বংশধরের কোনও সন্ধান পেলে বলটুদা?
–চৈতকের না ছাই। ব্যাটা পালিয়েছে না আপদ গেছে। বলটুদা নাক-মুখ কুঁচকে বললে, জানিস প্যালা, আসলে ওটা সিদ্ধিখোরের বংশধর।
সিদ্ধিখোর।
নয়তো কী? বাগানের বাইরে ওই যে ঝোপঝাড়গুলো চিবুচ্ছিল– ওগুলো কিসের গাছ জানিস? ভাঙের। আর ওই খেয়েই তো
বলটুদা থামল। একটা বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার।