সাহিত্যিক রামগতিবাবু কলকাতার বাইরে বেড়াতে এলেন।
কলকাতার গণ্ডগোলে ভদ্রলোকের যেন দম আটকে যাওয়ার জো হয়েছিল। লেখার তাগিদ, প্রকাশকের তাড়া, সভাসমিতির হাঙ্গামা উঃ। এর মধ্যে মানুষ বাঁচে কখনও। এইবারে নিশ্চিন্তে একটি মাস কাটিয়ে যাবেন এখানে। বেড়াবেন, ঘুমোবেন, নিজের হাতে বাজার করে ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়া করবেন আর সময় সুযোগ মতো মনের আনন্দে দুটো একটা গল্প কবিতা লিখবেন।
বাসাটিও পেয়েছেন বেশ মনের মতো। ছোট বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে লন আর ফুলের বাগান বড় বড় গোলাপ ফুটে বাগান যেন আলো হয়ে আছে। বসবার জন্যে পাথরের বেদী। সেখানে বসলে দূরে নীল পাহাড়ের সারি দেখা যায় তাদের কোলে মেঘ খেলে বেড়াচ্ছে আর ছোট্ট একটি নদী পাহাড়ের বুক চিরে রুপোর পৈতের মতো নেমে এসেছে।
বিকেলবেলা রামগতিবাবু লনের বেদীতে বসে এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দিয়েছেন আর পাহাড়ের শোভা দেখছেন, এমন সময় শুনতে পেলেন, আসতে পারি, স্যার?
রামগতিবাবু মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, বছর বাইশেকের একটি ছেলে। পরনে পাজামা, গায়ে ঝোলা আদ্দির পাঞ্জাবি, কাঁধে শাদা শাল। ঘাড়ের দু’পাশে বাবরি চুল, নাকের তলায় সরু একটি গোঁফের রেখা।
ছেলেটি আবার বললেন, আসব স্যার?
গেট পেরিয়ে ভেতরে যখন ঢুকেই পড়েছে তখন না আসতে বলার কোনও মানেই হয় না। রামগতিবাবু বললেন, আসুন–আসুন।
ছেলেটি এসেই তাঁর পায়ের ধুলো নিলে, তারপর হাতটা একবার জিভে ঠেকাল। গদগদ হয়ে বললে, কতদিন দূরের থেকে দেখেছি, আজ পদধূলি পেয়ে জীবন ধন্য হল।
–আপনি আমাকে চেনেন নাকি?
–বিলক্ষণ! ছেলেটি চোখ কপালে তুলল; দিকপাল লেখক রামগতি সমাজপতিকে বাংলাদেশে কে না চেনে। কাল যখন ট্রেন থেকে আপনি নামলেন, তখনই দেখেছি। কোথায় উঠেছেন খোঁজ নিয়ে আজ দেখা করতে এলাম। আমি স্যার, আপনার লেখার দারুণ ভক্ত। আপনার উপন্যাস পড়ে আমার মনে হয় আপনি বঙ্কিমের চাইতেও বড় লেখক, আপনার অনেক কবিতা স্যার, রবি ঠাকুরের চেয়েও ভালো।
রামগতিবাবু দারুণ খুশি হলেন– পত্রিকার সম্পাদক আর প্রকাশকেরা কথাটা শুনলে কাজ হত। একটু লজ্জাও পেলেন সেই সঙ্গে। বললেন, না না, অতটা বাড়িয়ে বলবেন না, আমি একজন সামান্য লেখক–
সামান্য! কী বলেন আপনি! আমার তো মনে হয় আপনাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত।
রামগতিবাবুর দীর্ঘশ্বাস পড়ল। হতচ্ছাড়া বাংলাদেশের লোক কি তা বোঝে! কখনও কখনও দু-একটা সমালোচক তাঁর বইয়ের এমন নিন্দে-মন্দ করে যে, মনের দুঃখে লেখা-টেখা ছেড়ে দিয়ে তাঁর সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছে করে। রামগতিবাবু বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন-বসুন। চা খাবেন একটু?
–আপনার এখানে চা খাব? এ তো স্যার, আমার স্বপ্নের অতীত। তবে দয়া করে আমাকে আর আপনি বলবেন না। আমার নাম ভজনলাল পতিতুণ্ডি– আপনি আমায় ভজু বলেই ডাকবেন।
রামগতিবাবু ভজুর জন্যে চা আনলেন। কিন্তু এমন ভক্তকে কি শুধু চা খাওয়ালেই চলে? চারখানা বিস্কুট আর ডবল ডিমের একটা ওমলেটও খাওয়াতে হল। দেখা গেল, ভজনলাল ভোজন আর ভক্তি কোনওটাতেই পেছপা নয়। বেশ চেটেপুটেই খেল। আর একটা ডবল ডিমের ওমলেট পেলেও তার আপত্তি হত না বলেই রামগতিবাবুর মনে হল। কিন্তু ভরসা করে গিন্নিকে সেকথা তিনি বলতে পারলেন না-হয়তো বা খ্যাঁক খ্যাঁক করে চেঁচিয়েই উঠবেন ভদ্রমহিলা।
খেয়ে-দেয়ে খুশি হয়ে ভজু হাত কচলাতে লাগল।
–আচ্ছা স্যার
–বলো!
আহ্লাদে গলায় ভজু বললেন, এত সব আইডিয়া আপনার মাথায় কী করে আসে? ওই যে আপনার ‘কে তুমি পথিক’ উপন্যাসের এক জায়গায় লিখেছেন– এমন সময় হুলো বেড়ালটার আর্তনাদ যেন নীরব তিমিরের বুকে হারকুন বিদ্ধ করল– কী অদ্ভুত সে-জায়গাটা! পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আচ্ছা, হারকুন মানে কী? তারপুন বোধ হয়?
রামগতিবাবু বললেন, না–না, তারপুন নয়! হারকুনও নয়। লিখেছি হারপুন। মানে একরকম বল্লম–তাই দিয়ে তিমিমাছ শিকার করে।
–তিমিমাছ–অ্যাাঁ? কী কাণ্ড!–ভজুর চোখ দুটো একসঙ্গে যেন নাকের ওপর লাফিয়ে ওঠে তারপরে তার দু’কানের দিকে দৌড়ে গেল; বুঝেছি এইবারে। তিমির থেকে একেবারে তিমি-মারা তারপুন। কী আশ্চর্য– একেই বলে কল্পনা! তারপুন! ওফ!
-ওটা তারপুন নয়, হারপুন।–রামগতিবাবু সংশোধনের প্রয়াসী হলেন।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ, হারপুন। আমি তো স্যার রাত্রে হুলো বেড়ালের ডাক শুনলে লাঠি নিয়ে তাড়া করি। আর আপনি কিনা একেবারে–ও! মানে, একেবারে হারতুন দিয়ে তিমিমাছ শিকার করে বসলেন।
হারতুন নয়–হারপুন।
–ঠিক ঠিক–হারপুন। আমি তো স্যার, কখনও তিমিমাছ শিকার করিনি আপনার মতো। জানব কী করে? উঃ–আপনি কিন্তু অসাধারণ লোক! তাই তো বলি, খালি খালি ঘরে বসে থাকলেই কি লেখক হওয়া যায়! ডালমুট চিবিয়ে আর চা খেয়ে কি কেউ অত ভালো-ভালো জিনিস লিখতে পারে। কারপুন দিয়ে তিমিমাছ শিকার করতে পারলে তবেই না–
কারপুন নয়, হারপুন।–এবার রামগতি একটু বিরক্ত হলেন।
-ঠিক ঠিক। সত্যি বলতে কি স্যার, আপনাকে দেখে আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। আপনি বড় লেখক তা জানতুম, কিন্তু তিমিমাছও মারতে পারেন তা কে ভেবেছিল? আচ্ছা স্যার, রবি ঠাকুর এত বড় কবি হলেন কী করে? উনিও বোধ হয় গণ্ডার জলহস্তী এই সব শিকার করতেন– তাই নয়?
না, রবীন্দ্রনাথ কখনও গণ্ডার বা জলহস্তী শিকার করেননি। রামগতিবাবু গম্ভীর।
–তা হলে কি ঘোড়া শিকার করতেন? তাই বোধ হয় ‘ঘোড়া’ বলে একখানা কবিতার বই লিখেছিলেন। কিন্তু ঘোড়া কি কেউ শিকার করে?– ভজনলাল দারুণ ভাবে চিন্তা করতে লাগল; ঘোড়া শিকার করবার জিনিস নয়। বাঘ-সিঙ্গির মতো কাউকে তো কখনও কামড়েছে বলে শুনিনি। তাহলে খামকা ঘোড়া শিকার করে
রামগতিবাবু আরও বিরক্ত হলেন : আঃ, কী যে বকো–
–অ্যাঁ, কী বললেন? বক?–ঘোড়া নয়? রবীন্দ্রনাথ বক মারতেন?
-তোমার মাথায় কিছু নেই!–এতক্ষণে রামগতিবাবু ধৈর্য হারালেন, চা আর ওমলেট নেহাতই বাজে খরচ হয়েছে বলে মনে হল তাঁর : রবীন্দ্রনাথ বক মারতেন কে বলেছে তোমায়? তাঁর বইটার নাম ‘ঘোড়া’ নয়–গোরা। সেটা কবিতার বই নয়, উপন্যাস। আচ্ছা, তুমি এখন আসতে পারো।
-যাব স্যার? যেতে বলছেন?–এই সাহিত্যিক সদালাপ এমনভাবে বাধা পড়ায় ভজু ব্যথা পেল : আপনি আমায় যেতেই বলছেন তবে?
হুঁ, যেতেই বলছি তোমায়। দয়া করে আমায় রেহাই দাও এখন।
–ওঃ, লিখতে বসবেন বুঝি? তৈরি করবেন বাংলা সাহিত্যের আর-একখানা অ্যাটম বোমা? এ-বইতে তারকুন দিয়ে কী মারবেন স্যার? হাতি? ভজু তখনও কৌতূহলী।
–সিংহ-সিংহ মারব।–এবার সিংহের মতো গর্জন শোনা গেল রামগতিবাবুর।
ভজু তিন পা পেছিয়ে গেল। আর একবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে পায়ের ধুলো জিভে ঠেকাবার মতলব বোধহয় তার ছিল, কিন্তু সাহস পেল না। গুটি গুটি এগিয়ে গেল গেটের দিকে।
–আর জেনে যাও–তারপুন নয়, হারপুন।
–হ্যাঁ–তারপুন নয় হারপুন, হারপুন-ভজনলাল অদৃশ্য হল।
–বিকেলটাই বরবাদ করে দিয়ে গেল হতচ্ছাড়া। রামগতিবাবু স্বগতোক্তি করলেন : চা আর ওমলেটের পয়সাটা আদায় করে নিতে পারলে ঠিক হত। ভক্ত না ঘোড়ার ডিম :হুঁঃ।
.
রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। গিন্নি স্টোভে মাংস রান্না করছেন, পাশের ঘর থেকে তার মনোরম গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে রামগতিবাবুর ভাব এসে গেল। চাদর দিয়ে বেশ করে কানটান ঢেকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখতে বসলেন :
ঝম ঝম করছে রাত আর ঝিমঝিম করছে তারা,
বাইরে নেড়ী কুকুর শেয়ালকে লাগাচ্ছে তাড়া।
এই রাতে সাহারা মরুভূমিতে নেমেছে ধূসর হিম,
আর তিনজন বেদুইন হুঁকো টানতে টানতে খুঁজছে
কয়েকটি উটপাখির ডিম
বেশ জমাট করে এই পর্যন্ত লিখেছেন, হঠাৎ ভাবটা কড়াৎ করে ঘুড়ির মতো কেটে গেল। বাইরে কে যেন খটাং করে কড়া নাড়ল।
আঃ, এই রাতে– এমন শীতের ভেতর কে জ্বালাতে এল? সেই ভজনলালটা নয় তো? রামগতিবাবু ভুরু কোঁচকালেন।
আবার খট-খট-খটাং
বিকটরকম দাঁত খিঁচিয়ে রামগতিবাবু দরজা খুলে দিলেন। ভজু এলে এবারে তাকে ঘাড়ধাক্কা দেবেন নির্ঘাত।
কিন্তু ভজু নয়। মাথায় চকচকে টাক, কান-পর্যন্ত-তুলে-দেওয়া মোটা পাকা মিলিটারি গোঁফ, গায়ে ওভারকোট, হাতে চুরুট, বদমেজাজী চেহারার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।
ভদ্রলোক ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন, ইভনিং। একটু বেশি রাতে ডিসটার্ব করলুম বলে কিছু মনে করবেন না।- রামগতিবাবুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললেন, আপনারই নাম রামগতি সমাজপতি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো
–আমি জে. কে. ঘোষ, কর্নেল ঘোষ বলে লোকে আমাকে জানে। মিলিটারিতে ছিলুম থার্টি ইয়ার্স। এখন রিটায়ার্ড।
-ওঃ, আসুন আসুন। নমস্কার। ভেতরে আসুন।
ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক ধপাৎ করে একখানা চেয়ারে দেহরক্ষা করলেন। চেয়ারটা মটমটিয়ে উঠল। মোটা চুরুটটা থেকে একরাশ বিচ্ছিরি ধোঁয়া রামগতিবাবুর মুখের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে কর্নেল ঘোষ গাঁ-গাঁ করে বললেন, ক্লাবে শুনে এলুম আপনি নাকি খুব বড় শিকারি। হাতি-গণ্ডার-সিংহ এইসব শিকার করে থাকেন। আমিও আফ্রিকায় ছিলুম, কেনিয়ায় কঙ্গোতে। শিকারি হিসেবে জে. কে. ঘোষের কিছু নামও ছিল। তাই ভাবলুম যিনি রাশি রাশি হাতি-গণ্ডার শিকার করে থাকেন, সেই বীরপুরুষকে একবার দেখে আসা দরকার।
রামগতিবাবু হাঁ করে রইলেন কিছুক্ষণ।
-কিন্তু আমি তো হাতি-গণ্ডার
কর্নেল ঘোষ মিলিটারি গোঁফে তা দিয়ে বললেন, শিকার করেননি– করতে পারেন না। এই গোলগাল নন্দদুলাল চেহারা ভূঁড়ি-ভর্তি চর্বি আপনি করবেন শিকার। ছোঁ। শিকারির চেহারা কখনও এইরকম হয় না।
রামগতিবাবু বিব্রত হয়ে বললেন, কী জ্বালা! আপনাকে কে বলেছে আমি শিকার
-শাট আপ! কর্নেল ঘোষ চোখ পাকিয়ে বললেন, চালিয়াতির আর জায়গা পাননি। আমি কর্নেল জে. কে. ঘোষ–আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছেন! জীবনে কোনওদিন রাইফেল ধরেছেন আপনি? ধরতে জানেন? আই ডোন্ট বিলিভ ইট! দেখি আপনার হাত
রামগতিবাবু হাঁ-হাঁ করে উঠতে গিয়ে হাহাকার করে উঠলেন। ততক্ষণ কর্নেল ঘোষ তাঁর ডান হাত পাঞ্জায় ধরে একটি চাপ দিয়েছেন আর হাতের আঙুলগুলো এক সঙ্গে মটমট করে উঠেছে।
–ছাড়ুন–ছাড়ুন–মরে গেলুম–উহুহু ই-হি-হি
–হুঁ, মারাই যাবেন এরপর। শিকারির আঙুল। ছোঃ–একতাল কাদা। আপনাদের মতো বাজে লোকদের জন্যে খাঁটি শিকারিদের বদনাম। ফের যদি এসব গুলবাজি করেন তা হলে এরপর এসে দুটো হাতই ভেঙে দিয়ে যাব। রাবিশ।
কর্নেল ঘোষ উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কা দিয়ে চেয়ারটা ফেলে দিয়ে ধড়াস করে দরজাটা আছড়ে বেরিয়ে গেলেন।
ততক্ষণে মাংস রান্না ফেলে গিন্নি ছুটে এসেছেন।
কী হল গো? এত গণ্ডগোল কিসের।
–একটা খুনে লোক এসে বোধহয় আঙুলগুলো ভেঙেই দিয়ে গেল গিন্নি উহুহু
গিন্নি চেঁচিয়ে উঠলেন; ওমা গো–কী হবে গো! থানা-পুলিশ-খুন
–দুত্তোর থানা-পুলিশ। রামগতিবাবু বিকট মুখ ভ্যাংচালেন : থানা-পুলিশ কী করবে মিলিটারির কাছে। ই-হি-হি-এই শীতের ব্যথা! তুমি শিগগির এক প্যান গরম জল করে আনো–শিগগির
.
সকালে উঠে গোঁজ হয়ে রামগতিবাবু ভাবতে লাগলেন, এ সব ভজার জন্যে। সে-ই যা-তা রটিয়েছে তাঁর নামে। রাত দুটো পর্যন্ত সেঁক দিয়ে এখন আঙুলের ব্যাথাটা কমেছে বটে, কিন্তু মনের ভেতরে আগুন জ্বলছে সমানে। ভজাকে একবার সামনে পেলে–
কিন্তু সামনে যখন পাওয়া যাচ্ছে না– তখন মন খারাপ করে বসে থেকে আর কী হবে। আর সেই কালান্তক কর্নেল ঘোষকে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে কোথাও পেতে চান না তিনি। পাওয়ার কোনও দরকার বোধ করছেন না রামগতিবাবু।
দূরে সকালের পাহাড়ি নদীটা ঝিলমিল করছিল। আরও খানিকক্ষণ ব্যাজার হয়ে বসে থেকে ভাবলেন নদীর ধার থেকে একটু বেড়িয়ে আসবেন। কালকে সেই উটের ডিম নিয়ে কবিতাটা বেশ জমাট হয়ে উঠেছিল, সেটার বারোটা বেজে গেছে। ভাবলেন, নদীর ধার থেকে একটু মুড নিয়ে আসবেন।
নিরিবিলি পাহাড়ি পথের ধার বেয়ে চলেছেন। দুধারে শাদা শাদা পাহাড়ি ফুলে গাছগুলো ছেয়ে আছে, পাখি-টাখি ডাকছে– রামগতিবাবুর গলায় খুসখুস করতে লাগল। সবে গুনগুন করে গানের একটা কলি ধরেছেন এমন সময় কে যেন বললে, এই যে।
ভজনলাল নাকি? দারুণ চমকে উঠে দেখলেন, ভজনলাল নয়। রোগা লম্বা চেহারার এক ভদ্রলোক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, হাতে ছড়ি।
ভদ্রলোক আবার বললেন, এই যে, আপনিই বোধ হয় রামগতিবাবু?
সন্দিগ্ধ হয়ে রামগতি থেমে দাঁড়ালেন।
–হ্যাঁ। কী বলতে চান বলুন।
–আমি এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার। জুলজিতে এমএসসি। আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই। আপনারা ছাইপাঁশ নভেল লেখেন– কিন্তু লেখাপড়ার ধার দিয়েও যান না কোনওদিন। আপনাকে কে বলেছে তুরপুন বিঁধিয়ে হাঙর শিকার করা যায়?
রামগতিবাবুর মাথার ভেতর ধাঁ করে জ্বলে উঠল। আবার সেই ভজা। ভজাই তাঁকে পাগল করে দেবে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে রামগতিবাবু বললেন, আমি কখনও এসব কথা বলিনি।
–আলবাত বলেছেন! শহরসুদ্ধ লোককে বলে বেড়িয়েছেন। এই সব যা-তা লিখেই ছেলেপুলের মাথা খান–তারা গোল্লায় যায়। হেডমাস্টার বেতের লাঠিটা ঠুকলেন রাস্তার ওপর : হাঙর সম্বন্ধে কোনও আইডিয়া আছে আপনার? কোনওদিন দেখেছেন হাঙর?
–আগে দেখিনি। এখানে এসে দেখছি। চারদিকেই দেখতে পাচ্ছি তাদের। আপনারা সবাই হচ্ছেন এক-একটা নাদাপেটা ভেটকিমুখো হাঙর। রামগতিবাবু জবাব দিলেন।
হেডমাস্টার বললেন, ইমপসিবল। মানুষ কখনও হাঙর হয় না। হাঙরের নাদাপেট হতেই পারে না। হাঙর ভেটকিমুখো হয় না–হয় গ্রপার! গ্ৰপারকে অবশ্য নাদা পেটা ভেটকিমুখো বলা যেতে পারে। আপনি মাছ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।
জানি না তো বয়েই গেল বলে হনহন করে রামগতিবাবু এগিয়ে গেলেন। পেছন থেকে হেডমাস্টার চিৎকার করে বললেন, আপনি আমার ছাত্র হলে টেস্টে কিছুতেই অ্যালাউ করতুম না।
কোনওদিকে না তাকিয়ে রামগতিবাবু এবার সোজা নদীর ধারে চলে এলেন। খাসা জায়গাটি। পাথরের ওপর দিয়ে ফেনা তুলে নীল জল নেচে চলেছে। দিব্যি হাওয়া দিচ্ছে ঝিরঝির করছে পাহাড়ি ঝাউয়ের পাতা। কিন্তু মনে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না। এমন মনোমত জায়গা– বসে বসে নিশ্চিন্তে দু’খানা উপন্যাস আর দশ ডজন কবিতা লেখা যেত কিন্তু ভজার জ্বালাতেই তাঁকে এখান থেকে পালাতে হবে মনে হচ্ছে। যা নয় তা রটিয়ে বেড়াচ্ছে– লোকে বোধ হয় পাগল বলছে তাঁকে। এরকম মারাত্মক ভক্তও লোকের জোটে–ওঃ!
.
তবু নদীর ধারে বসে থেকে মনটা শান্ত হল। তারপর এদিক-ওদিক ঘুরে বস্তি থেকে শস্তায় একজোড়া মুরগি কিনে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন বলতে কী, বেশ ভালোই লাগছিল রামগতিবাবুর।
কিন্তু ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ রইল না। এক পেয়ালা চা খেয়ে কালকের কবিতাটা নিয়ে কেবল বসেছেন, আর লিখেছেন :
সেই সব ডিম যা স্বপ্ন দেখছিল বালির তলায়
ভাবছিল কবে ঘোড়া হয়ে উড়ে যাবে দিগন্ত সীমায়
ঠিক তক্ষুনি কে ডাকল : রামগতিবাবু।
নিশ্চয় ভজু! খাতা রেখে তেড়ে বেরিয়ে গেলেন রামগতিবাবু, কিন্তু এবারেও–এবারেও ভজনলাল নয়।
–আমি থানা থেকে আসছি।
বলবার দরকার ছিল না, চেহারা দেখেই সেটা মালুম হচ্ছিল রামগতির।
–আমার-আমার কাছে কী দরকার?
–আপনি আজ সকালে সাংচু নদীর ধারে গিয়েছিলেন?
রামগতি ঢোক গিললেন।
–তা গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়াতে যে কোনও দোষ
–থামুন। সেখানে আপনি কুরপুন না তুরপুন দিয়ে মাছ মেরেছেন কেন?
থানার লোকটির স্বর এবার গুরুগম্ভীর।
-মাছ মেরেছি? রামগতি আকাশ থেকে পড়লেন।
-হ্যাঁ, মেরেছেন। কী বলে– কী বলে কী একটা কারপুন না চারপুন দিয়ে আপনি সব জায়গায় মাছ মেরে বেড়ান- এ কথা সবাই জানে। কেন মেরেছেন মাছ? জানেন, ওটা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে? জানেন, বিনা পারমিশনে ওখানে মাছ মারলে ফাইন হয়?
রামগতিবাবু হাহাকার করে উঠলেন : কখনও না–আমি মাছ মারিনি। বস্তি থেকে দুটো মুরগি কিনেছি কেবল। বিশ্বাস না হয়–
লোকটি বললেন– হুম! বিশ্বাসটা কাল কোর্টে গিয়ে করাবেন। বেলা ঠিক সাড়ে দশটায়। এই নিন সমন। মাছ না মুরগি কালকেই বোঝা যাবে সেটা।
সমন তো সমন! সেইটে হাতে করে দাঁড়িয়ে রইলেন রামগতিবাবু। একেবারে নিটোল একটি উটপাখির ডিমের মতোই।
পঁচিশ টাকা ফাইন হয়ে গেল।
আর ফাইন দিয়েই বাসায় ফিরলেন রামগতিবাবু। তক্ষুনি কুলি ডাকলেন, বিছানা বাঁধলেন, তারপর গিন্নির গালাগাল শুনতে শুনতে সোজা স্টেশনে। এখানে আর একদিনও তিনি থাকবেন না–এক মুহূর্তও নয়! দুদিনেই এই! চারদিন পরে তো তা হলে ফাঁসি যেতে হবে।
ট্রেন ছাড়ে ছাড়ে, ঠিক সেই সময় কোত্থেকে ভজু এসে হাজির। সেই ভজনলাল পতিতুণ্ডি। সেই শাল কাঁধে, সেই নাকের নীচে সরু গোঁফের রেখা, সেই গোঁফের তলায় বিগলিত হাসি।
এ কী স্যার চলে যাচ্ছেন? এত তাড়াতাড়ি?–ভজনলালের গলায় মর্মান্তিক ব্যথা : দুদিন আপনাকে কাছে পেতে-না-পেতেই হারালুম!
রামগতিবাবুর গিন্নি ঘোমটার আড়াল থেকে গজরাচ্ছিলেন : আ মর মুখপোড়া লক্ষ্মীছাড়া কোথাকার! কিন্তু রামগতি গজরালেন না, হুঙ্কার ছাড়লেন না কিছুই বললেন না। কেবল দার্শনিকের মতো বললেন, কপাল!
ট্রেনের বাঁশি বাজল!
ভজু ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল।
-স্যার, আপনার কলকাতার ঠিকানাটা? কলকাতায় গেলে দেখা করব।
আরও শান্ত হয়ে গেলেন রামগতিবাবু : জানলা দিয়ে মাথাটা বাড়িয়ে দাও–বলছি।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে।
জানালায় মাথা গলিয়ে ভজু সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে : ঠিকানা ঠিকানা?
–এই যে।
দুদিনের বহুযত্নে সঞ্চয়, বহু আকাঙক্ষার ফল, অনেকদিন মাসল কন্ট্রোলের পরিণাম ভজুর গালের ওপর নামল। একটি–একটিমাত্র চড়। কিন্তু কী সে চড়! এক ডজন বোমা ফাটার আওয়াজকেও ছাপিয়ে উঠল তার আওয়াজ!
ভজনলাল গালে হাত দিয়ে সোজা প্লাটফর্মের ওপর বসে পড়ল।
ট্রেন চলেছে। ডিসট্যান্ট সিগন্যাল পেরিয়ে এল। আঙুলের ব্যাথাটা আর নেই– পঁচিশটা টাকার ক্ষতিপূরণ চড়টাতে হয়ে গেছে বলেই মনে হল। আর এই দুদিন ধরে, বুকের ভেতর, তারপুন–না হারপুন–না কারপুন কী-একটা সেই-যে সমানে বিঁধছিল, সেটারও কোনও চিহ্ন এখন খুঁজে পাচ্ছেন না রামগতিবাবু।