গোরু, ছাগল, ভেড়া–সবাই কান নাড়াতে পারে। কান নাড়ানোর সুবিধে কত! কান নেড়ে নেড়ে খুশি হওয়া যায়, মাছি-মশা তাড়ানো যায় কানের কাছে যদি বেয়াড়া সুরে কেউ গান গায়, তবে সেটাও তাড়ানো যায় খুব সম্ভব। কানের নিদারুণ কটকটানি নিয়ে বসে বসে প্যাঁচার মতো মুখ করে সেই কথাটাই ভাবছিলেন রসময়বাবু।
তিনি কান নাড়াতে পারেন না। পারেন না বলেই তখন থেকে একদল মশা তাঁর কানের কাছে সমানে ঘ্যানঘ্যান করছে। ঢুকে পড়ার তালও তাদের কারও কারও আছে বলে রসময়বাবুর সন্দেহ হয়। তা ছাড়া একটু আগেও তাঁর ভাগনে পঞ্চুলাল কানের কাছে ঝাড়া দু-ঘন্টা এমন পেশোয়ারী ঠুংরি শুনিয়েছে যে, এখনও তাঁর মাথার মধ্যে যেন করাত চলছে।
ছ্যাঃ–ছ্যাঃ! একেবারে মানুষ-মারা গান শিখেছে পঞ্চা! ছোঃ! আরে ধ্যেৎ–বলে ভীষণ বিরক্ত হয়ে রসময়বাবু একটা মশা মারতে গেলেন। আর এমন যাচ্ছেতাই ব্যাপার যে চড়টা চড়াং করে তার নিজের গালে গিয়েই পড়ল।
–ও! রসময়বাবু আর্তনাদ করলেন। নিজের হাতে নিজেকে ঠ্যাঙালে যে এমন খারাপ লাগে তা কে জানত। রসময়বাবু ডানহাতে আহত গালকে বাঁ হাত বুলিয়ে পরিচর্যা করতে লাগলেন, আর ভাবতে লাগলেন : আরে ছিঃ। কী ভয়ঙ্কর গানই তাঁকে শোনাল পঞ্চা।
পেশোয়ারী ঠুংরিই বটে। যেন দাড়িওলা এক পেল্লায় গান–তার হাতে ইয়া লাঠি, সেই লাঠি দিয়ে দমাদ্দম রসময়বাবুকে পিটিয়ে গেল। আগে যদি ঘুণাক্ষরেও জানতেন, তাহলে কি আমল দিতেন পঞ্চাকে? ভেবেছিলেন, পেশোয়ারী ঠুংরি পেশোয়ারী মেওয়ার মতোই বেশ সুস্বাদু হবে। কিন্তু সে যে পেশোয়ারী লাঠিও হতে পারে, সেটা বুঝলেন অনেক পরে।
তখন আর পঞ্চাকে কে ঠেকায়। সে তখন আকাশজোড়া হাঁ করে ‘খাজ্জা-গজ্জা রাওলপিণ্ডি–এ পিণ্ডি–পি–পিন—পিনডি–পিণ্ডিদান খাঁ-আঁ আঁ– এই সব গাইছে, তার সেই প্রচণ্ড রাগিণীর বন্যায় রসময়বাবু ভেসে গেলেন। তাঁর মাথা ঘুরতে লাগল, কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে পড়ে রইলেন।
পঞ্চার গান শেষ হল প্রায় দু’ঘন্টা পরে। যাওয়ার আগে পঞ্চুলাল বলে গেল : মামা, পরশু আবার আসব। আবার গান শোনাব তোমাকে।
রসময়বাবু সেই থেকে প্রায় পাথর হয়ে বসে আছেন। কান কটকট করছে, কানের কাছে মশারা গুঞ্জন করে বেড়াচ্ছে। পঞ্চা আবার পরশু আসবে! তাকে ঠেকানো যায় কী করে?
ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকলেন তাঁর বন্ধু জলধরবাবু।
–ওহে রসময়–কেমন আছ?
আনন্দে রসময় লাফিয়ে উঠলেন। জলধর তাঁর বহুকালের বন্ধু। এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়েছেন, কান ধরে পাশাপাশি গাধার টুপি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, এক সঙ্গে ফেল করেছেন, এক সঙ্গে আলুকাবলি কিনে দু’দিক থেকে পাতা চেটে খেয়েছেন। হঠাৎ সাত বছর পরে জলধরকে দেখে সাময়িকভাবে তিনি কানের ব্যথা-ট্যথা সব ভুলে গেলেন।
–আরে জলধর, এসো—এসো
বলবার দরকার ছিল না, তার আগেই জলধর এসে পড়েছিলেন। বন্ধুদের মধ্যে আলাপ শুরু হল।
–তোমার গোঁফগুলো তো অনেক পেকে গেছে হে।
–তোমার টাকও তো মাথা ছেয়ে ফেলেছে!
–বেশ আছ–অ্যাঁ!
–তুমিই বা মন্দ আছ কী–বলে জলধরের চোখ পড়ল রসময়ের দিকে : ও কী, অত কান চুলকোচ্ছ কেন? পোকা ঢুকেছে নাকি?
–পোকা নয়–গান।
–গান? জলধর উঁচু হয়ে বসলেন : গান কী হে? গান মানে বন্দুক নাকি? জলধরের মুখে অবিশ্বাসের ছায়া পড়ল : তোমার কানের ফুটো অবিশ্যি খুবই বড় লাঠি ফাটি হয়তো ঢুকতেও পারে, কিন্তু বন্দুক! উঁহু, বন্দুক অসম্ভব। এটা বাড়াবাড়ি।
বন্দুক কে বলেছে? রসময় ব্যাজার হয়ে বললেন : বন্দুক ঢুকবে কেন? ঢুকতে দেবই বা কেন? সঙ্গীত-সঙ্গীত ঢুকে বসেছে।
কে ঢোকালে? জলধরকে কৌতূহলী মনে হল।
–কে আর ঢোকাবে? আমার ভাগনে পঞ্চা। কী যে পেশোয়রী ঠুংরি শুনিয়ে গেল–
–পেশোয়ারী ঠুংরি! জলধরের গোঁফ নেচে উঠল : ফুঃ!-ও আবার গান নাকি? আসল গান হচ্ছে আফগানী ধামার! হ্যাঁ–গানের মতো গান! শুনলে আর জীবনে ভুলতে পারবে না। তোমাকে চুপি চুপি বলি, এই সাত বছর আমি আফগানী ধামারের চর্চা করেছি। শুনবে?
রসময় হাঁ-হাঁ করে ওঠবার আগেই জলধর ঘরজোড়া হাঁ করে আফগানী ধামার ধরলেন।
উঃ–সে কী গান! আর কী গলা! রসময়ের মনে হল তাঁর দম ফেটে যাবে। বারোটা গাধা পামা গাধা গাইলেও শুনতে এমন জবরদস্ত হয় না। পঞ্চুলাল তো এর কাছে নস্যি।
রসময় তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন।
বিরক্ত হয়ে গান থামিয়ে জলধর বললেন, আঃ–লাফাচ্ছ কেন? এইজন্যেই কাউকে আমি গান শোনাতে চাইনে। কিছু বোঝে না–খালি লাফালাফি আর চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেয়।
–সেজন্যে নয়। আমি ভাবছিলাম, পঞ্চা তোমার গান শুনলে কী খুশিই যে হত। সে দুঃখ করছিল, এত গান শুনলাম, কিন্তু ভালো আফগানী ধামার আর শুনতে পাই না আজকাল। সেরকম গুণীই আর এ দেশে নেই।
–কে বলে নেই? এই আমিই তো রয়েছি। জলধরের গোঁফ ফুলে উঠল : কোথায় থাকে তোমার পঞ্চা? কী তার ঠিকানা?
ওষুধ তবে ধরেছে। পরম পুলকে রসময় বললেন, যাবে তার কাছে? তা হলে এখুনি যাও ভাই। আহা–তার বড় কষ্ট! আফগানী ধামার শুনতে না পেয়ে সে মরমে মরে রয়েছে। তার ঠিকানা হল আটান্ন বাই আটান্ন ধোবাতলা লেন–
–আমি তবে এখুনি চললাম বলেই তীরবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন জলধর।
জলধর বেরিয়ে যেতেই পরম আনন্দে আধঘন্টা ধরে হাসলেন রসময়। এই ঠিক হয়েছে। একেই বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা ভোলা। যেমন পঞ্চুলাল, তেমনি জলধর। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কইবে না–দুজনেই দুজনকে গান শোনাতে চাইবে। তারপর?
তারপর জলধরের গানে পঞ্চুলালের ভূত পালাবে–পঞ্চুলালের গান শুনে জলধরের গান বন্ধ হয়ে যাবে। এই হচ্ছে মোক্ষম দাওয়াই।
কথাটা ভেবে এত ভালো লাগল যে, কানের ব্যথা ভুলে গিয়ে রসময়ের নাচতে ইচ্ছে করল। চাকর দুটো রেকাবি করে খাবার আনল–একটা জলধরের জন্যে। মনের আনন্দে রসময় দুটো রেকাবিই একা সাবাড় করলেন–এমনকি রসগোল্লার একটুখানি রস অবধি চেটে নিলেন জিভ দিয়ে।
আসল ঘটনা ঘটল দুদিন পরে।
রসময় প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন গানের কথা। হঠাৎ ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল পঞ্চুলাল, আর তার সঙ্গে জলধর।
রসময় কিছু বলবার আগেই পঞ্চুলাল বললে, মামা, জলধরমামাকে সঙ্গে করে আনলাম।
জলধর হেসে বললেন, হ্যাঁ, একসঙ্গেই এলাম। তোমার ভাগনেটি ভারি খাসা ছেলে হে রসময়। খুব জমিয়ে নিলে আমার সঙ্গে। আমরা ঠিক করেছি–পেশোয়ারী ঠুংরি আর আফগানী ধামার মিলিয়ে দুজনে একসঙ্গে ‘ডুয়েট’–মানে দ্বৈত-সঙ্গীত গাইব এর পর থেকে। তুমিই আমাদের যোগাযোগ ঘটিয়েছিলে–তাই প্রথমে তোমাকেই শোনাতে চাই।
–অ্যাঁ।
রসময়ের চোখ দুটো কপালে ওঠবার আগেই জলধর ঘরজোড়া হাঁ করলেন। পঞ্চা কানে হাত দিয়ে চোখে বুজে চিৎকার জুড়ল : ধামা ধামা ধামার পিণ্ডি এ পিণ্ডি–পিণ্ডি–পিণ্ডিদান খাঁ-আ-আ
দ্বৈত সঙ্গীত নয়–দৈত্য-সঙ্গীত। একা পঞ্চায় রক্ষা নেই জলধর দোসর। রসময় বারকয়েক কেবল বললেন : ওঁ—ওঁ–ওঁ–তারপর সোজা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ফিট হয়ে গেলেন।