সেই কানে জড়ুলওলা লাল-টাই-পরা ভদ্রলোক বর্ধমান স্টেশনে চা খেতে নেমে যেতেই, ওপরের বাঙ্ক থেকে টুপ করে লাফিয়ে পড়লেন আর-এক ভদ্রলোক–যাঁর চুলগুলো খাড়া খাড়া, নাকের নীচে মাছিমার্কা গোঁফ আর হাওড়া থেকে যিনি সটান চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন।
মাছিমার্কা গোঁফ চট করে আমার পাশে এসে বসে পড়লেন। তার পরেই ফিসফিস করে বললেন, আপনি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন?
কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ি, ডন-বৈঠক করে থাকি, শার্লক হোমসের গোয়েন্দা গল্পগুলো আমার প্রায় মুখস্থ। আমি পছন্দ করব না অ্যাডভেঞ্চার?
কৌতূহলী হয়ে বললুম, ব্যাপার কী মশাই?
ব্যাপার?–প্ল্যাটফর্মের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে, বেশ করে দেখে-শুনে, মাছিমার্কা গোঁফ বললেন, ওই যে লোকটা কানে জড়ুল আর লাল রঙের টাই–এখুনি যে চা খেতে নেমে গেল-ওকে চেনেন?
না।
–ও হচ্ছে–মাছিমার্কা গোঁফ চোখের তারা দুটো কপালে তুলে বললেন, দুর্দান্ত ডাকাত আর ঘোরতর জালিয়াত। ওর নাম হচ্ছে ছেদীলাল খাঁ। ওকেই পাকড়াবার জন্যে আমি, মানে গোয়েন্দা-পুলিশের ইনসপেকটর গঙ্গারাম পাকড়াশী, এমনি ঘাপটি মেরে শুয়ে আছি।
অ্যাঁ।
গঙ্গারাম পাকড়াশী আবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, ওকে ধরতেই হবে। আপনি আর আমি। পাঁচশো টাকা রিওয়ার্ড পেয়ে যাবেন। রাজি আছেন?
শুনে আমার রোমাঞ্চ হল। উত্তেজনায় কান কটকট করতে লাগল।
বললুম, আলবাত।
তবে প্ল্যানটা শুনুন। চটপট বলে ফেলি। আমি এই সিটের তলায় লুকিয়ে থাকব। ট্রেন চলতে আরম্ভ করলে তলা থেকে ছেদীলালের পা ধরে হেঁইয়ো বলে টান লাগাব। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাবে কুমড়োর মতো। কিন্তু কী জানেন, লোকটার গায়ে ভীষণ জোর। একা হয়তো ধরে রাখতে পারব না। তখন আপনাকে সাহায্য করতে হবে। তার পর দুজনে মিলে ওকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলব, আর আসানসোল এলেই– বুঝলেন না?
বিলক্ষণ। আমার নাকের ডগাটা উৎসাহে এবার সুড়সুড় করতে লাগল। যেন একটা ডেয়ো পিঁপড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
–আজ ওকে পাকড়াতে না পারলে আমার পাকড়াশী-জন্মই বৃথা। ভারি ঘুঘু লোক মশাই, অনেক দিন থেকে জ্বালাচ্ছে। তা হলে আপনি রেডি?
–এখুনি। আমার তো ইচ্ছে করছিল, নেমে গিয়ে প্ল্যাটফর্মেই ছেদীলালকে ল্যাং মেরে ফেলে দিই।
তবে কথা রইল। এই বলেই একটা চমৎকার কাণ্ড করলেন গঙ্গারাম। পুলিশের লোক তো, ওঁদের কারবারই আলাদা। ওর নিজের সুটকেস আর বালিশ বাঙ্কের ওপর লম্বালম্বি সাজিয়ে তার ওপর চাদরটা এমনভাবে টেনে দিলেন যে ঠিক যেন মনে হল, গঙ্গারামই চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছেন। তার পরেই চট করে ঢুকে গেলেন সিটের তলায়।
বাইরে জুতোর শব্দ। আমার বুকের ভেতরটা আঁকুপাঁকু করে উঠল। দরজা খুলে এসে ঢুকল দুর্দান্ত ডাকাত আর দুর্ধর্ষ জালিয়াত ছেদীলাল খাঁ।
কুট করে আমার পায়ে একটা চিমটি পড়ল। চমকে উঠতে গিয়েও আমি সামলে নিলুম। বুঝলুম, পাকড়াশী আমায় হুঁশিয়ার থাকতে বলছেন। কিন্তু অত জোরে চিমটি না কাটলেও ক্ষতি ছিল না, পা-টা জ্বালা করতে লাগল। পুলিশের কারবারই আলাদা।
ছেদীলাল এসে ধুপ করে আমার পাশে বসে পড়ল। দিব্যি ভাললামানুষ চেহারা–যেন ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না। পরমানন্দে পান চিবুচ্ছে। আমি মনে মনে বললুম, চিবোও, যত খুশি পান চিবোও। এতক্ষণ ঘুঘু দেখছ–একটু পরেই ফাঁদ দেখতে পাবে।
ছেদীলাল জিজ্ঞেস করলে, আপনি কোথায় যাবেন?
বললুম, পাটনা। আপনি?
–আসানসোল নামব।
–অঃ! মনে মনে বললুম, তোমাকে আর কষ্ট করে নামতে হবে না, আমরাই হাত-পা বেঁধে নামিয়ে দেব এখন।
ছেদীলাল কানের জড়ুলটাকে একবার চুলকে নিলে। লাল রঙের টাইটাকে বারকয়েক নাড়াচাড়া করে গঙ্গারামের চাদরের দিকে তাকিয়ে রইল ছেদীলাল।
–ও ভদ্রলোক খুব ঘুমোচ্ছেন দেখছি।
–হুঁ। মনে মনে বললুম, কেমন ঘুমোচ্ছেন, একটু পরেই টের পাবে।
–সেই হাওড়া থেকে সমানে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন!
তাই তো দেখছি।
কারও কারও ট্রেনে উঠলেই বেয়াড়া রকম ঘুম পায়। সে বেলা আটটাই হোক আর সন্ধে ছ’টাই হোক। বলে বিচ্ছিরি রকম খ্যাঁক-খ্যাঁক আওয়াজ করে হাসতে লাগল ছেদীলাল।
আমার গা জ্বালা করতে লাগল। ইচ্ছে হল, এখুনি ক্যাঁক করে টুঁটি চেপে ধরি ছেদীলালের, একেবারে ছেদন করে ফেলি ওকে। কিন্তু গঙ্গারাম রেডি না হলে তো কিছু করা যায় না। নামকরা ডাকাত–গায়ে ভীষণ জোর, ছোরা-পিস্তল কী সঙ্গে আছে কে জানে!
বর্ধমান ছেড়ে ট্রেন ছুটল। মেল গাড়ি। অন্ধকার ফুঁড়ে উড়ে চলেছে তীরের মতো। হঠাৎ কে যেন একমুঠো আলো আমাদের গাড়ির ওপর ছুঁড়ে মারল–ছিটকে বেরিয়ে গেল একটা স্টেশন।
আমার হাতের বইটার ওপর চোখ পড়ল ছেদীলালের।
–ওটা কী পড়ছেন?
বললুম, গোয়েন্দা-উপন্যাস।
–আপনি বুঝি খুব ডিটেকটিভ বই পড়েন?
— পড়ি।
–ডিটেকটিভ হতে ইচ্ছে করে?–ছেদীলাল আর-একটা পান মুখে পুরে দিয়ে, জিভে খানিকটা চুন লাগিয়ে, কেমন একগাল হেসে বললে, ইচ্ছে করে চোর-ডাকাত ধরতে?
লোকটার সাহস দ্যাখো একবার। যেন ইয়ার্কি দিচ্ছে আমার সঙ্গে। দাঁড়াও, ধরতে ইচ্ছে করে কি না দেখিয়ে দেব একটু পরেই।
-সুবিধে পেলে ধরব বইকি। খপাত করে চেপে ধরব।
-এই তো আজকালকার ইয়ংম্যানের মতো কথা! ছেদীলাল জানলা দিয়ে খানিক পানের পিক বাইরে ফেলে বললে, শুনে ভারি খুশি হলুম।
আমার এত রাগ হল যে ওকে ভেংচি কাটতে ইচ্ছে করল। দাঁড়াও, দাঁড়াও কত খুশি হতে পারো দেখিয়ে দিচ্ছি খানিক বাদেই।
অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ট্রেন উড়ে চলেছে। আবার একমুঠো আলো ছুঁড়ে দিয়ে আর একটা স্টেশন মিলিয়ে গেল। ছেদীলাল আমার পাশে বসে নিবিষ্ট মনে পান চিবুচ্ছে। আমার কান আবার কটকট করে উঠল, সুড়সুড় করতে লাগল নাকের ডগা। এত দেরি করছেন কেন গঙ্গারাম? ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি ভদ্রলোক?
আমার কেমন খটকা লাগল। যেই ছেদীলাল বাইরে পিক ফেলার জন্যে মুখ বাড়িয়েছে, আমি টুপ করে সিটের তলায় পায়ের একটা গুঁতো দিলুম। অমনি কোঁক করে আওয়াজ।
ছেদীলাল চমকে উঠল।
-কীসের আওয়াজ বলুন তো?
কী সর্বনাশ! টের পেয়ে গেল নাকি? আমি অমনি তাড়াতাড়ি করে বললুম না না, কোথায় আওয়াজ?
–ওই যে কোঁক করে শব্দ হল?–ছেদীলালের দু চোখে গভীর সন্দেহ।
বললুম, না না, ও কিছু না। আমি একটা হেঁচকি তুলেছি কেবল।
–তাই বলুন! ছেদীলাল একটু চুপ করে থেকে আবার সামনের বাঙ্কের দিকে তাকাল।
খুব নিঃসাড় হয়ে ঘুমুচ্ছেন তো ভদ্রলোক!
–তা ঘুমুচ্ছেন।
–এমন ঘুম কি ভালো? একটু নিঃশ্বাস পর্যন্ত পড়ছে না-দেখেছেন? মারা গেলেন না তো?
–খামকা মারা যাবেন কেন? হঠাৎ মারা গিয়ে ওঁরই বা লাভ কী? আমার ভারি অস্বস্তি বোধ হল।
কার কীসে লাভ কিছুই বলা যায় না। একটু দেখতে হচ্ছে যে! বলেই ছেদীলাল উঠে দাঁড়াতে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ে আবার সেই কটাং করে চিমটি! রাম-চিমটি যাকে বলে! আমি আর্তনাদ করে উঠলুম। আর ছেদীলাল এমন চমকাল যে গলায় পান আটকে বিষম খেয়ে গেল একেবারে।
–অমন চ্যাঁচালেন যে?
–পায়ে বাত আছে কিনা। হাঁটুতে কটাং করে লাগল, তাই
–এই অল্প বয়সে বাত? লক্ষণ খারাপ। বলে আমার দিকে যেন কেমন করে তাকাল ছেদীলাল। তারপর বললে, উঁহু, বাঙ্কের ভদ্রলোককে একবার দেখতেই হচ্ছে। এমনভাবে মড়ার মতো ঘুমুনো কোনও কাজের কথাই নয়।
বলে, ছেদীলাল যেই দাঁড়াতে যাবে, তক্ষুনি সেই রোমাঞ্চকর কাণ্ডটা ঘটল। সিটের তলা থেকে সড়াক করে দুটো সাঁড়াশির মতো বেরিয়ে এল পাকড়াশীর হাত, পটাং করে পাকড়ে ধরল ছেদীলালের পা। সঙ্গে সঙ্গে ছেদীলাল ধড়াম করে মেজেতে ফ্ল্যাট।
তার পরেই গঙ্গারাম একেবারে ছেদীলালের বুকের ওপর। আর ছেদীলাল প্রাণপণে পা ছুঁড়তে লাগল। আমি লাফিয়ে উঠে ছেদীলালের ঠ্যাং চেপে ধরতে যাব সঙ্গে সঙ্গে, কী কায়দায় ছেদীলাল শুশুকের মতো উলটে গেল। আর গঙ্গারাম তার পেটের তলায়।
আমি ছেদীলালকে গাঁট্টা মারতে যাচ্ছি–গঙ্গারাম সঙ্গে সঙ্গে তাকে পটকে দিয়ে ওপরে উঠে পড়লেন। যেই গঙ্গারামকে সাহায্য করতে যাবসঙ্গে সঙ্গে ছেদীলাল আবার তাঁর ওপর চড়ে বসল।
কিছুই করতে পারছি না। কেবল অবাক হয়ে দেখছি, দুজনে কুমড়োর মতো গড়িয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ ছেদীলাল গ্যাঙাতে গ্যাঙাতে বললে, হেলপ হেলপ–
তারপর দুজনে একসঙ্গে চেঁচাতে আর কুস্তি করতে লাগল। কে যে কী বলছে আমি ভালো করে বুঝতেই পারছিলুম না। শুধু কানে আসছে; জাপটে ধরুন স্যার–চেন টানুন–হেলপ-হেলপ–
হেলপ! কী ভাবে হেলপ করি? সাত-পাঁচ ভেবে নিজের অ্যাটাচি কেসটাই তুলে নিলুম। তার পরে ‘জয় মা কালী’ বলে ধাঁ করে সেটাকে চালিয়ে দিলুম ছেদীলালের মাথায়।
কিন্তু ততক্ষণে ছেদীলালকে পটকে গঙ্গারাম ওপরে উঠে বসেছেন। সুটকেসের ঘা একেবারে গিয়ে লাগল গঙ্গারামের চাঁদির ওপর। আর আঁক করে একটা আওয়াজ তুলে গঙ্গারাম মেজেতে শিবনেত্র হয়ে পড়ে গেলেন। একদম অজ্ঞান।
সর্বনাশ। এ কী করলুম? ছেদীলালকে মারতে গিয়ে ঠাণ্ডা করে দিলুম গঙ্গারামকে?
ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে ছেদীলাল। জামা ধুলোমাখা, টাইটা ছিঁড়ে গেছে; কানের জড়ুলের পাশ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। বিধ্বস্ত হয়েও জয়গর্বে দন্তবিকাশ করছে সে।
সুটকেস দিয়ে ছেদীলালকে এক ঘা বসাব ভাবছি, হঠাৎ ছেদীলাল আমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিলে।
শাবাশ ছোকরা, মোক্ষম ঘা মেরেছ। দুর্দান্ত ডাকাত ছেদীলাল ছোরা বার করতে যাচ্ছিল, আর-একটু হলেই ঘ্যাঁচ করে বসিয়ে দিত। এইবার তোমার বিছানার দড়িটা দাও দিকি, ছেদীলালকে বেঁধে ফেলি।
আমার হাত থেকে সুটকেসটা পড়ে গেল।
-কে ছেদীলাল? কার কথা বলছেন আপনি?
–কে আবার? এই মুখে মাছিমার্কা গোঁফ, খাড়া-খাড়া চুল, ছেদীলাল ছাড়া আর কে? এই ট্রেনে পালাচ্ছে জানতুম কিন্তু এই গাড়িতেই আছে ঠিক বুঝতে পারিনি। অবশ্যি চাদর-ঢাকা-দেওয়া দেখে আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল। যাই হোক, তোমার সাহায্য না পেলে ওকে ধরতে পারতুম না–পালটা আমাকেই খুন করে ফেলত। পাঁচশো টাকা রিওয়ার্ড পাইয়ে দেব তোমায় নির্ঘাত।
বলে, দড়ি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাছিমার্কা গোঁফকে বাঁধতে লেগে গেলেন।
আমি বারকয়েক খাবি খেয়ে বললুম, আপনি? আপনি কে?
–আমি? ডিটেকটিভ ইনসপেকটর গঙ্গারাম পাকড়াশী। কানে-জড়ুল আর লাল-টাই লোকটি হেসে বললেন।
ট্রেন আসানসোলে পৌঁছুল। পকেট থেকে পুলিশি হুইসল বার করে বাজালেন ভদ্রলোক। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন কনস্টেবল ছুটে এল কোথা থেকে।
আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। পুলিশের কারবারই আলাদা।