ভুতুড়ে

আমি যতই বলি ভূত নেই, ওসব স্রেফ গাঁজার কলকে, কেষ্টা ততই চেঁচাতে থাকে।

–যেদিন ঘাড় মটকে দেবে, সেদিন টের পাবি, বুঝলি?

–আরে যাঃ যাঃ!…একটা চীনেবাদামের খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে আমি বললাম-রেখে দে তোর ভূত। আমার কাছে এসেই দেখুক না বাছাধন, আমি নিজেই তার ঘাড় মটকে দেব।

কেষ্টা চেঁচাতে লাগল–দেখা যাবে–দেখা যাবে। যেদিন আমগাছে এক ঠ্যাং আর দূরের তালগাছের মাথায় আর-একটা ঠ্যাং চাপিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে, সেদিন আর চ্যাঁ-ভ্যাঁ করতে হবে না, বুঝলি? এখন ঘুঘু দেখেছিস, তখন ফাঁদ দেখবি।

–ওসব নওগাঁ ব্র্যান্ড শিকেয় তুলে রাখ।…আমি সংক্ষেপে মন্তব্য করলাম।

কেষ্টা বললে তুই পাষণ্ড, তুই নাস্তিক।

আমি বললাম হতে পারে। তাই বলে তুই অমন ষণ্ডের মত চ্যাঁচাবি, এর মানে কী?

কেষ্টা রাগে ভোঁ-ভোঁ করতে করতে উঠে যাচ্ছিল, এমন সময় বাঞ্ছা কোত্থেকে এসে তার হাত চেপে ধরলে। বললে–আহাহা চটছিস কেন? সবাই তো প্যালা হতভাগার মত নাস্তিক নয়। আমি নিজে বলছি, স্বচক্ষে ভূত দেখেছি আমি।

 

 

সত্যি?–কেষ্টার হাসি গাল ছাপিয়ে কান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুল।

আমি বললাম–বাজে।

-বাজে! তবে শোন। শুনে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন কর। কিন্তু কেষ্টা, তার আগে কিছু খাওয়াতে হবে মাইরি। বড্ড খিদে পেয়েছে।

এমনিতে কেষ্টা হাড়-কেপ্পন। কাউকে এক পয়সা খাওয়ানো তো দূরের কথা, সব সময়েই পরস্মৈপদীর তালে আছে। কিন্তু ভূতের মহিমাই আলাদা। সঙ্গে সঙ্গে এক টাকার ফুলকপির সিঙাড়া আর ‘জলযোগ’-এর সন্দেশ চলে এল। সেগুলোর অদ্ধেকের ওপর একাই সাবাড় করে, বড় গোছের একটা ঢেকুর তুলে বাঞ্ছা বললে–তবে শোন :

বছর তিনেক আগের কথা।

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছি।

গ্রামটা হল কালনার কাছাকাছি, একেবারে গঙ্গার ধারে। খাসা জায়গা। যেমন খাওয়া-দাওয়া, তেমনি আরাম। দু মাসের মধ্যেই আমি মুটিয়ে গেলাম।

বেশ আছি, আরামে দিন কাটছে। এমন সময় এক অঘটন। পাশের বাড়ির হরিশ হালদার এক বর্ষার রাত্রিতে পটল তুলল।

লোকটা যতদিন বেঁচে ছিল, গ্রামসুদ্ধ লোকের হাড়-মাংস একেবারে ভাজা ভাজা করে রেখেছে। বাজখাঁই গলা, খিটখিটে মেজাজ। বাড়িতে কাক বসলে হার্টফেল করত, বেড়ালে কুকুরে পর্যন্ত বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষত না। বউটা আগেই মরেছিল, ছেলেটা কোথায় জব্বলপুরে না জামালপুরে যুদ্ধের চাকরি নিয়ে চম্পট দিয়েছিল। বাড়িতে বুড়ো একা থাকত। তার মস্ত একটা ফলের বাগান ছিল–সেইটাই পাহারা দিত।

 

 

এমন বিতিকিচ্ছি লোক যে বিতিকিচ্ছি সময়ে মারা যাবে তাতে সন্দেহ কী! সেদিন বেশ মিঠে মিঠে বৃষ্টি নেমেছে ঝিমঝিম করে, পেট ভরে মুগের ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে বিছানা নিয়েছি–এমন সময় ডাক এল মড়া পোড়াতে যেতে হবে।

আমি খপ করে বাঞ্ছার কথায় বাধা দিয়ে বললাম–ওসব পুরনো গল্প। পত্রিকার পাতায় গণ্ডা গণ্ডা ওরকম গল্প বেরিয়ে গেছে।

বাঞ্ছা ভ্রূকুটি করে বললে–আরে আগে শোন না বাপু। পরে যত খুশি বকরবকর করিস।

কেষ্টা বললে–ঠিক!…তারপর এমন চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকাল যে বামুন হলে নির্ঘাত ভস্ম করে ফেলত।

বাঞ্ছা বলে চলল কী আর করি! বেরুতেই হল। পাশের বাড়িতে একটা লোক মরে পড়ে থাকবে এটা তো কোনও কাজের কথা নয়। যতই খিটখিটে বদখত লোক হোক না কেন, মানুষ হিসাবে একটা কর্তব্য আছে তো।

বেরিয়ে দেখি, আমরা মাত্র চারজন। ডাকাডাকি করেও কারও সাড়া মেলেনি–কেউ কাঁপা গলায় বলেছে জ্বর হয়েছে, কেউ কাতরাতে কাতরাতে জবাব দিয়েছে, কান কটকট করছে। কাজেই আমাদের চারজনকেই কাঁধ দিতে হল। দুজনের দুহাতে দুটো লণ্ঠন ঝুলতে ঝুলতে চলল, আর কাঁধে দুলতে দুলতে চলল মড়া।

মুখুজ্যেদের নরেশ আক্ষেপ করে বললে, জ্যান্তে বুড়ো জ্বালিয়ে মেরেছে, মরেও একখানা খেল দেখিয়ে গেল।

কিন্তু কী আর করা যাবে, উপায় তো নেই। সেই টিপিটিপি বৃষ্টি আর শনশনে হাওয়ায় বর্ষা-পিছল রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। চারদিকে কালির মতো অন্ধকার–গাছপালাগুলো সেই অন্ধকারে এক-একটা অতিকায় দৈত্য-দানার মতো মাথা নাড়ছে। বিদ্যুতের চমকানিতে চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পথ ভুল করে পাশের খানার মধ্যে গিয়ে পড়ছি আমরা। বৃষ্টির ছাটে চটচট করে ফাটছে লণ্ঠনের চিমনি। পা পিছলে যেতে চাইছে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাঁপটা লেগে চোখ জ্বালা করছে। ভোগান্তি আর কাকে বলে?

 

 

বল হরি, হরি বল–চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে চললাম চারজনে। কাঁধের ওপর বুড়ো যেন পরম আনন্দে দোল খাচ্ছে। আমার সন্দেহ হল, এখন হয়তো মড়ার মুখের কাপড় সরালে দেখা যাবে, আমাদের দুর্গতিতে মিটিমিটি হাসছে হাড়-জ্বালানো লোকটা। মনে মনে অভিসম্পাত করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম।

হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি, শুধু আমরা চারজনেই নই; বুড়োর দুটো বাগদী প্রজাও ছিল। তারা তো আর বামুনের মড়াকে কাঁধ দিতে পারবে না, তাই তারা কুড়ল কাঁধে আসছিল পিছনে পিছনে– কাঠ কেটে আনবে।

সে যাই হোক, শ্মশানে তো পৌঁছানো গেল। শ্মশান ঠিক গাঁয়ের নীচে নয়–বেশ খানিকটা দূরে। আশেপাশে বাড়ি-ঘর কিছু নেই–অনেকটা পর্যন্ত ন্যাড়া মাঠের ভেতরে এলোমেলো বাবলার বন। সেখানে একখানা টিনের চালাঘর–অবশ্য চারদিকে তার দেওয়াল-ফেয়ালের কোনও বালাই নেই–একেবারে ফাঁকা। এইটেই শ্মশান-যাত্রীদের বসবার জায়গা।

ঠিক তারই নীচে একটা বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গার জলে। মস্ত সিঁড়ি, প্রায় খান পনেরো পৈঠে, এখন বর্ষার জলে তিন-চারখানা মাত্র জেগে রয়েছে। ভাঙাচুরা অবস্থা–যেখানে সেখানে বড় বড় ফাটল, ইট বেরিয়ে পড়েছে। আমরা ওই সিঁড়ির ওপরেই মড়াটাকে নামালাম। এমনভাবে রাখলাম যাতে মড়ার পা দুটো ডুবানো থাকে গঙ্গার জলে। বুড়োর গঙ্গাযাত্রাও হবে, তা ছাড়া এ-সুবিধেও আছে যে কাউকে আর ছুঁয়ে বসে থাকতে হবে না।

মড়া নামিয়ে আমরা গিয়ে বসলাম চালাটার নীচে। বাগদীরা কাঠের ব্যবস্থা করুক, তারপর চিতা সাজানো যাবে। বসে বসে গল্প জুড়ে দিলাম আমরা।

চারদিকে ঘন অন্ধকার। হাওয়ায় হাওয়ায় বাবলাবনের মাতামাতি। এখানে ওখানে শেয়ালের চোখ ঝলমল করছে সবুজ রঙের হিংস্র আলোর মতো। সে-চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কখনও বা ভয় ধরে যাচ্ছিল আমাদের–ভূত নয় তো!

 

 

লণ্ঠন দুটোর গায়ে কালি পড়েছে, অল্প অল্প আলো গিয়ে পড়েছে ঘাটে নামানো মড়াটার ওপরে। কথার ফাঁকে ফাঁকে মড়ার দিকে নজর রাখছি আমরা। শেয়ালে-টেয়ালে এসে টেনে না নেয় সে-সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।

কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল ছিল না, হঠাৎ ভীতস্বরে নরেশ বললে, মড়াটা একটু নড়ল না?

আমরা বললাম, ধ্যাৎ–তোর চোখের ভুল।

খানিক পরে আবার পটলা বললে, মড়াটা সত্যিই কিন্তু নড়ে উঠেছে।

আমাদের ভেতরে সবচেয়ে সাহসী ছিল কানু। যেমন বুকের ছাতি তেমনি বেপরোয়া। কানু আশ্বাস দিয়ে বললে, ও কিছু না–জলের ঢেউয়ে নড়ে থাকবে।

আবার মিনিট কয়েক কাটতে না কাটতে আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর যেন ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল। কোনও ভুল নেই লণ্ঠনের অল্প অল্প আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মড়াটা সত্যি সত্যিই একটু একটু করে জলের দিকে নেমে যাচ্ছে।

–ও কী! ও কী!

আমি, নরেশ আর পটলা একসঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠলাম।

কানু সোজা দাঁড়িয়ে উঠল। ধমক দিয়ে বললে, দুত্তোর, ভিতুর ডিম সব। পেছল সিঁড়ি, তাই গড়িয়ে পড়ছে নীচের দিকে। দাঁড়া, আমি তুলে নিয়ে আসি।

মড়া তখনও নামছে, হাঁটু পর্যন্ত তার নেমে গেছে গঙ্গায়! কানু গিয়ে বাঁশের মাচাটা ধরে টান দিলে। কিন্তু কী সাংঘাতিক! কানুর টানকে অস্বীকার করেও মড়াটা আরও নীচে নেমে গেল!

 

 

গোঁয়ার-গোবিন্দ কানু এবার দুহাতে মড়াটাকে জাপটে ধরলে। কিন্তু আশ্চর্য কানু রাখতে পারলে না! দু’ধাপ পিছলে সে-সুদ্ধ গিয়ে কোমর-জলে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সাহস উবে গেল তার। এবার কানু আকুল হয়ে চিৎকার করে উঠল, ওরে তোরা ছুটে আয়, মড়া আমাকে সুদ্ধ নিয়ে যাচ্ছে!

ততক্ষণে বুকে আমাদের আর রক্ত নেই, তা জল হয়ে গেছে। আমরা চিৎকার করে বললাম, মড়া ছেড়ে দাও

কানু বললে, পারছি না—

আমরা ছুটে গেলাম–চেপে ধরলাম কানুকে।

তারপরে যা শুরু হল, সেকথা ভাবতে আজও আতঙ্কে মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে।

ওই হাড্ডিসার মড়াটার গায়ে সে কী অমানুষিক শক্তি। একদিকে আমরা চারজন, অন্যদিকে মড়া একা–আমাদের সকলকে অনায়াসে তুচ্ছ করে সে জলের মধ্যে টেনে নিয়ে চলল! ঠাণ্ডাজল আমাদের কোমর ছাপিয়ে পেট পর্যন্ত উঠল, তারপর এসে পৌঁছুল বুক পর্যন্ত। তারপর–তারপর আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি–আর আমাদের আশা নেই–এই মড়া আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে, চলেছে গঙ্গার অতল জলে, সেখানে

আশ্চর্য একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা! সমস্ত জ্ঞানগম্যি যেন লোপ পেয়ে গেছে আমাদের। একটা আচ্ছন্নতার ঘোরে, যেন মরিয়া হয়ে মড়ার সঙ্গে টাগ-অব-ওয়ার চালিয়ে চলেছি আমরা। অথচ বেশ বুঝতে পারছি, আমাদের জয়ের কোনও আশা নেই, অপদেবতার অমানুষিক শক্তির কাছে আমাদের সমস্ত চেষ্টাই নিরর্থক।

আর সবচাইতে ভয়ানক-মড়া ছেড়ে দিয়ে যে উঠে আসব সে-ক্ষমতা আমাদের নেই। কানু মড়াকে ছাড়তে পারছে না–আমরা ছাড়তে পারছি না কানুকে। যেন কী একটা মন্ত্রবলে সে আমাদের তার শরীরের সঙ্গে আটকে নিয়েছে–যেন হিপনোটাইজ করে ফেলেছে সকলকে।

 

 

বুক-জল ক্রমশ গলা-জলে পৌঁছেছে, আর দেরি নেই মৃত্যুর। চারদিকে গঙ্গার অন্ধকার কালো জলে যেন শুনতে পাচ্ছি শয়তানের হাসির খিল-খিল শব্দ। গঙ্গার অতল জল–সেখান থেকে প্রেতপুরীর অন্ধকার জগৎ! এই মড়াটা তারই দিকে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে!

শেষবারের মতো আমরা সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠলাম।

ঠিক এমন সময় কাঠের বোঝা নিয়ে আসছিল বাগদীরা। আমাদের চিৎকার শুনে তারা এসে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। ছিলাম চারজন, হলাম ছয়জন। পূর্ণোদ্যমে চলতে লাগল সে অমানুষিক টাগ-অব-ওয়ার!

তারপর–

তারপর আস্তে আস্তে থেমে দাঁড়াল মড়া। আস্তে আস্তে আমরা জয়লাভ করতে লাগলাম। ক্রমশ মড়া আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এসে পৌঁছতে লাগল। তখনও তার প্রচণ্ড টান আছে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম ঘাটের দিকে। গলা-জল থেকে বুক-জলে, সেখান থেকে কোমর-জলে, সেখান থেকে হাঁটুজলে, তারপর

ওদিকের টানটা ঝড়াং করে ছেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ছিটকে এল ওপরে আর আমরা ছয়জন হুড়মুড় করে এ ওর ঘাড়ে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেলাম।

আর ভুস্—স-স—

ঠিক তৎক্ষণাৎ ঘাটের ওপর জলের মধ্যে দেখা দিলে

বাঞ্ছা থামল।

আমরা রুদ্ধশ্বাসে শুনে যাচ্ছি এই অতি ভয়ঙ্কর কাহিনী। একসঙ্গে বলে উঠলাম কী ভেসে উঠল?

ধীরে সুস্থে বাঞ্ছা বললে–আর কী? প্রায় দেড়মন।

কী দেড়মন?–আকুল স্বরে কেষ্টা প্রশ্ন করলে।

–আমাদের কালনার গঙ্গার বিখ্যাত অতিকায় কচ্ছপ। সেই ব্যাটাই—

আমি হো-হো করে হেসে উঠলাম।

কেষ্টা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল; মিথ্যেবাদী–জোচ্চোর!

বাঞ্ছা বললে হতে পারি। কিন্তু আজ বেড়ে খাইয়েছিস কেষ্টা, ভূতের জয় জয়কার হোক তোর।

নিরুত্তরে কেষ্টা হনহন করে নেমে গেল রাস্তায়।


© 2024 পুরনো বই