এক
রামগর্জনবাবু দোকানে প্রথমে সিদ্ধিদাতা গণেশকে প্রণাম করলেন। তারপর চারদিকে গঙ্গাজল ছিটিয়ে মন্ত্রট আউড়ে, নিজের ক্যাশবাক্সটির সামনে এসে ভাবুকের মতো বসে পড়লেন।
এখনও ভোর হয়নি। মফস্বল শহরের ইলেকট্রিক আলোগুলো সবে নিবতে আরম্ভ করেছে। গঙ্গার দিকটায় আকাশে ফিকে লালচে রং। কাকেরা সবে বেরুতে আরম্ভ করেছে, রামগর্জনবাবুর টিনের চালে গোটাকতক শালিক পাখি ঘুম থেকে উঠেই ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে–ওই ওদের স্বভাব।
রামগর্জনের কর্মচারী বনোয়ারী একটা মস্ত গামলায় জিলিপির গোলা তৈরি করছে, ছটুলাল কচুরির ময়দা মাখছে। মস্ত মস্ত দুটো উনুন এখনও অল্প অল্প বেগুনে ধোঁয়া ছাড়ছে, একটু পরেই কয়লা গন-গন করে উঠবে, কচুরি আর জিলিপি ভাজা আরম্ভ হয়ে যাবে। রসগোল্লা, লেডিকেনি, চমচম আর সন্দেশ কাল রাতেই তৈরি হয়ে রয়েছে। ছটা বাজতে না বাজতেই খদ্দেরের আনাগোনা শুরু হবে। সকাল সাড়ে ছটার ট্রেনে যেসব যাত্রী নামবে তাদেরও অনেকেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে রামগর্জনের দোকানে এসে বসবে। তারপর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সমানে বেচা-কেনা।
রামগর্জনবাবুর জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার শহরের সব চেয়ে বড় মেঠাইয়ের দোকান। তাঁর মিঠাই লোকের আরও মিঠে লাগে তাঁর মধুর ব্যবহারে। বাপের আমলের ছোট ব্যবসাটিকে নিজের চেষ্টায় তিনি এত বড় করতে পেরেছেন, চমৎকার একটি দোতলা বাড়ি করেছেন। জমিজমা কিছু হয়েছে। তিনপুরুষ আগে তাঁরা উত্তর প্রদেশ থেকে এখানে এসেছিলেন। এখন আচার-ব্যবহার চাল-চলন আর কথাবার্তায় পুরো বাঙালী হয়ে গেছেন।
বাইরে থেকে দেখলে রামগর্জনের মতো সুখী আর কেউ নেই। নামে গর্জন থাকলে কী হয়–নেহাত গোবেচারি ভালো মানুষ তিনি। সবাই তাঁকে পছন্দ করে তাঁর মিঠাইকেও। এমন কি তাঁর চমচমে কামড় বসিয়ে কেউ যদি জিভের ওপর ডেয়ো পিঁপড়ের কামড় খায়, সেও তাঁর ওপর রাগ করে না। অথচ–
অথচ রামগর্জনবাবুর মনে সুখ নেই। একবিন্দুও নয়। তার কারণ তাঁর ছেলে রঘু। যার ভালো নাম রাঘবলাল রামগর্জন যাকে বলেন রাঘববোয়াল। একমাত্র ছেলে–একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়েই তাঁর যত অশান্তি।
ছেলেটার চাল-চলন যে নেহাত খারাপ, তা নয়। বরং নিতান্তই গোবেচারা। এত বেশি গোবেচারা যে ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে পর্যন্ত মুখ নিচু করে বসে থাকে।
এক-আধজন মাস্টার আছেন–তাঁরা কিছুতেই হাল ছাড়বার বান্দা নন। তাঁদেরই একজন হচ্ছেন গোপেশবাবু। তিনি রঘুর নীরবতা ভাঙবার পণ করে বসলেন। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, এই রোঘো শিগগির বল বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম কী?
এমন বিপদেও মানুষ পড়ে।
রঘু এর আগে একমনে একটা গুবরে পোকা লক্ষ করছিল। সেটা মিনিট কয়েক পরে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে। প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ছে আর গুরতর করে আওয়াজ ছাড়ছে। কতক্ষণে ওটা উবুর হতে পারবে এবং তারপর জানালা দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে যাবে রাঘবের সমস্ত মনোযোগটা সেদিকেই ছিল। এমন সময়ে বাংলা দেশের মুখ্যমন্ত্রী আচমকা তার ঘাড়ের ওপরে পড়ে সব গোলমাল করে দিলে।
এর মধ্যে গোপেশবাবু অক্লান্তভাবে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন এবং স্থির লক্ষ্যে এগোচ্ছেন লাস্ট বেঞ্চের দিকে। এবং তাঁর হাতে যে-ছড়িটি আছে, তারও হাবভাব অত্যন্ত সন্দেহজনক।
অগত্যা রঘুকে উঠে দাঁড়াতে হল।
শিগগির বল, বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম কী? গুবরে পোকার আশা ছেড়ে দিয়ে রঘু ফস করে বলে ফেলল : রাঘবলাল সিং।
ক্লাসে হাসির বোমা ফাটল, কিন্তু গোপেশবাবু হাসতে পারলেন না; তাঁর মুখের চেহারা দেখে একবার সন্দেহ হল, এক্ষুনি বুঝি কেঁদে ফেলবেন; কিন্তু তাও করলেন না, যেখানে ছিলেন সেইখানেই জমে রইলেন কিছুক্ষণ, হাত থেকে বেতটা পাশের ছেলেটার নাকের ওপর খটাস করে খসে পড়ল। সে কাঁউকাঁউ করে উঠতে গোপেশবাবু তাকে দুটো থাবড়া মেরে বসিয়ে দিলেন, তারপর করজোড়ে রঘুকে বললেন, আপনি যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সে তো জানতুম না স্যার! না জেনে কত বেয়াদবি করে ফেলেছি। নিজগুণে মার্জনা করবেন! সেই থেকে রঘু বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী।
আর মুখ্যমন্ত্রীকে পেলে কেউ কি ছাড়তে চায়, স্কুলও তাকে ছাড়েনি। পরপর দুবছর ক্লাস এইটেই রেখে দিয়েছে। ক্লাস টেন-এর ছেলেরা একবার টেবিলের ওপর তাকে বসিয়ে তার গলায় এক ছড়া মালা পরিয়েছিল, মানপত্রও দিয়েছিল একখানা। মানপত্রে একটা কাঁচকলা আঁকা ছিল আর মালার ভেতরে ছিল গোটা কয়েক বিছুটির পাতা–সেটা অবশ্য রঘু টের পেয়েছিল একটু পরেই।
তা, এসবের জন্য রামগর্জনবাবুর মন খারাপ হয় না। ছেলেটা একটু সাদাসিধে, পড়াশোনাতে মাথা নেই কিন্তু তাতে আসে যায় না কিছু। তাঁর মস্ত কারবার, বিশ্বাসী কর্মচারীও আছে–দুদিন সকালে বসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আস্তে আস্তে চালাক-চতুর হয়ে উঠবে। গোলমালটা সেখানে নয়। চলতি কথায় আছে, ময়রা সন্দেশ খায় না। ময়রা হয়তো খায় না, কিন্তু তাঁর ছেলে খায় কি না, প্রবাদে একথা বলা হয়নি। রঘু সন্দেশ খেয়ে থাকে। এবং প্রচুর পরিমাণে।
রামগর্জন কৃপণ নয়। মিঠাই মণ্ডা-দই ক্ষীর রঘু যথেষ্ট খেতে পায়। কিন্তু তার কিছুতেই তৃপ্তি নেই। এক সের রসগোল্লা খেয়ে সে আর-এক সের খাবার জন্যে তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত। একেই বলে আসলে গোল্লায় যাওয়া; শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প না পড়েও রামগর্জনবাবু সে কথা বুঝতে পারেন। কিন্তু একথাই বুঝতে পারেন না যে, অতটুকু পেটে অত খাবার সে রাখে কোথায়!
আরে–দোকানের খাবার যদি সব তুই-ই খাবি তা হলে ব্যবসা করবি কী করে? সব যদি তোরই পেটে যায়–খদ্দেররা কি কেবল শালপাতার ঠোঙা নিয়ে তোকে পয়সা দিয়ে যাবে? একটু রয়ে-সয়ে খা না বাপু! জীবনভোরই তো খেতে পাবি তা হলে! এসব কথা রঘুকে বুঝিয়েছেন তিনি অনেকবার। রঘুও বুঝেছে মাথা নেড়েছে সঙ্গে সঙ্গেই। ভাব দেখে মনে হয়েছে যে এরপর থেকে সে প্রত্যেকদিনই একাদশী করতে থাকবে। তারপরেই হয়তো রামগর্জন কোনও কাজে একটু উঠে গেছেন, আর তাঁর দোকানের কর্মচারীরা একটু অন্যমনস্ক হয়েছে, সেই ফাঁকে বিশেষ কিছু করেনি রঘু-ডজনখানেক চমচম কিংবা গোটা ষোলো পান্তুয়া দেখতে-দেখতে সাবাড় করে বসেছে।
একমাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলতে মায়া হয় রামগর্জনের। তবু কান শক্ত করে ধরে কড়া মোচড় লাগিয়েছেন একটা।
–এতক্ষণ ধরে কী বোঝালুম–অ্যাঁ! গড্ডর কাঁহাকা–হতচ্ছাড়া পেটুকদাস।
–কী করব বড্ডে খিদে পেয়েছিল যে!
–খিদে! তোর হয়েছে সেই গাঁয়ের গোবকের দশা!বাপের মুখ থেকে শোনা একটা হিন্দী বচন আওড়ান রামগর্জন যে খায়–ও লালায়! বলি পেটে কী আছে? জালা না সিন্দুক?
রঘু জবাব দেয় না, ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে যেমন, তেমনি পরমহংস হয়েই বসে থাকে।
–এরপরে তুই আমাকে খাবি, বুঝেছিস? তুই তো রাঘব নোস–রাঘব বোয়াল! আমাকে খেয়েই তোর লালচ শান্ত হবে।
রঘু একবার বাপের দিকে তাকিয়ে দেখে। খুব সম্ভব ভাবে, তার বাবা যদি একটা প্রকাণ্ড পান্তুয়া হত, তা হলে এ-অনুরোধ করবার একেবারেই দরকার হত না। অনেক আগেই সে–
রামগর্জনবাবু কপাল থাবড়ে বললেন, বরাত, বরাত! নইলে এমন পেটুক এসেও মিঠাইওলার ঘরে জন্মায়!
আজও রামগর্জন দোকানে বসে নিজের দুঃখের কথাই চিন্তা করছিলেন। ছেলেটার এই খাই-খাই রোগ কী করে বন্ধ করা যায়? আর চুরি করে খাওয়া? ছানার সঙ্গে খানিকটা বাঘা ওল মিশিয়ে সন্দেশ খাইয়ে দেখবেন নাকি? উহুঁ, ওতে সুবিধে হবে না। যে রাক্ষস বাঘা ওল-টোল সব হয়তো অম্লান মুখে হজম করে বসবে। আর তা না হলে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হবে এবং তাঁকেই ছুটতে হবে।
.
একটু একটু করে সকাল হল। রাশি রাশি গরম গরম জিলিপি পড়ল রসের ভিতর, জমল কচুরি আর নিমকির ভূপ। বোঁদে চড়ল। দোকানে খদ্দেরের ভিড় শুরু হয়ে গেল।
মনটা শান্ত করে রামগর্জন পয়সা গুনতে আরম্ভ করলেন। আপাতত ছেলের চিন্তাটা ধামাচাপা পড়ল।
এমন সময় ভঁক ভঁক করে একখানা মোটর গাড়ি এসে থামল তাঁর দোকানের সামনে। নেমে এলেন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান গৌরহরিবাবু। গায়ে গরদের পাঞ্জাবি–গলায় সিল্কের চাঁদর। একখানা ঝানদার লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে দোকানে এসে ঢুকলেন।
রামগর্জন দাঁড়িয়ে উঠলেন : আসুন স্যার আসুন! বসুন।
গৌরহরি বললেন, বসবার সময় নেই। আমার মেয়ে-জামাই এসেছে সাড়ে ছটার ট্রেনে, গাড়িতে বসে আছে তারা। তোমাকে যে আড়াই সের স্পেশ্যাল ছানার জিলিপি তৈরি করতে বলেছিলুম, সেটা–
–হ্যাঁ স্যার কাল রাতেই রেডি করে রেখেছি। দিচ্ছি এখুনি।
স্পেশ্যাল অর্ডারের আলমারিটা খুললেন রামগর্জন!
এর চাবি তাঁর ঘুনসিতেই থাকে।
কিন্তু খুলে যা দেখলেন–তাতে তাঁরই চোখ ছানাবড়া নয়, একেবারে ছানার জিলিপি হয়ে গেল।
অত বড় হাঁড়িটা প্রায় সাফ। তলায় খানতিনেক পড়ে আছে ধ্বংসাবশেষের মতো!
–কী হল হে?
তিনটে খাবি খেয়ে রামগর্জন বললেন, আপনি যান স্যার একটু পরেই আমি তোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
গৌরহরি চলে গেলেন। আর সেইখানে কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন রামগর্জন। ব্যাপারটা চক্ষের নিমেষে বুঝতে পেরেছেন। কাল রাত্রে যখন ঘুমিয়েছেন, তখন তাঁর কোমর থেকে চাবি খুলে এনে বন্ধ দোকানের ভেতরে বসে নিঃশব্দে ওগুলো সাবাড় করেছে রঘু। রাতের বেলা ছানার জিলিপির পাশে সে অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরঘুর করছিল বটে।
অনেক হয়েছে–আর নয়। আর ছেলেকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। এইবার একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।
দোকানের পেছনেই বাড়ি। একলাফে বাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন। কুড়িয়ে নিলেন একটা বাঁশের লাঠি। এতদিন পরে সত্যিকারের রামগর্জন ছাড়লেন একখানা।
–কোথায় রঘুয়া? কোথায় সেই রাক্ষস–সে রাঘববোয়াল? আমি আজ ওকে খুন করব–জরুর উসকো জান লে লেগা!
রামগর্জনের স্ত্রী ছুটে এলেন। ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া?
–হুয়া আমার মাথামুণ্ডু! আজ তোমার ছেলের ভুড়ি ফাঁসিয়ে না দিই তো আমি রামগর্জন সিং-ই না। কোথায় সেই বদমাস–বেল্লিক পেটুকদাস।
গৌরহরিবাবুর মোটর দোকানের সামনে থামতে দেখেই দু-একটা কিল-থাপ্পড়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল রাঘবলাল। কিন্তু বাপের এই রুদ্রমূর্তি সে কল্পনাও করেনি। অতএব বাপের লাঠি ঘাড়ে পড়বার আগেই যঃ পলায়তে সঃ জীবতি! তড়াক করে সে বড় রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল, তারপর টেনে দৌড়।
–কাঁহা ভাগবি? আজ তোমার মুণ্ডু ছাতু করে তবে আমি বলে রামগর্জন ছেলেকে তাড়া করলেন। প্রায় ধরেই ফেলেছেন এবং লাঠির একটা ঘা বসিয়ে দিতে যাচ্ছেন ছেলের পিঠে–এমন সময় কোত্থেকে দুটো ষাঁড় গুঁতোগুতি করতে করতে দুজনের মাঝখানে এসে পড়ল। রামগর্জন থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, আর
আর এক জোড়া যুযুৎসু ষাঁড়ের ভেতর দিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, রঘুর মাথার টিকিটি বাতাসে নাচতে নাচতে অনেক দূরে মিলিয়ে গেল–মিলিয়ে গেল তাঁর লাঠির আওতার বাইরে–অনেক দূরে।
.
দুই
ইস্ কয়েকটা ছানার জিলিপির লোভে শেষ পর্যন্ত কী ল্যাঠাতেই পড়া গেল। বাবা যে এমন খেপে যাবে সেকথা কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল রঘু!
চিরকালই সে আদুরে ছেলে। চড়-চাপড় কখনও সখনও দুটো-চারটে না খেয়েছে তা নয়, মিঠাই খেয়েছে অনেক বেশি। ছানার জিলিপি খাওয়ার সময় জানত দু-এক ঘা পিঠে পড়বেই, আর পিঠে এক-আধটু না সইলে পেটের তোয়াজই বা করা যায় কী করে?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাঠি! আর ওই রকম গাঁটেগাঁটে পাকানো রাম-লাঠি! ওর এক-এক ঘা জুত-মতো পড়লেই আর দেখতে হবে না, রঘু স্রেফ ছাতুনা না, হালুয়া হয়ে যাবে! হালুয়া খেতে ভালোই কিন্তু হালুয়া হওয়া যে মোটেই ভালো নয়, এটুকু বোঝবার মতো বুদ্ধি রঘুর আছে।
না হয় খেয়েইছে ডজন-দুই ছানার জিলিপি। পরের তোতা নয়, বাপের দোকানেরই তো জিনিস। তারই জন্যে এত লাঞ্ছনা? বাপ রামগর্জনের এমনি রামগর্জন? আর এই পিলে-চমকানো পেল্লায় কোঁতকা নিয়ে তাড়া করা? তার গোলগাল ভালোমানুষ চেহারার বাপের প্রাণ যে এমন পাষাণের মতো কঠিন–সে কথা কে কবে চিন্তা করেছিল!
কিন্তু আপাতত রঘুকেই চিন্তা করতে হচ্ছে। আর সেটা চলছে স্টেশনের সাইডিঙে একটা মালগাড়ির তলায় ঘাপটি মেরে বসে। বাপের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার জন্য আপাতত এ-ছাড়া ভালো জায়গা আর সে খুঁজে পায়নি।
সেই পালিয়ে এসেছে সকালবেলা, এখন রোদ হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। এর মধ্যে। বার-পাঁচেক খাওয়া হয়ে যায়, কিন্তু রঘুর মুখে এক ফোঁটা জল পড়েনি। একে পেটুক মানুষ, তায় দারুণ খিদে পেয়েছে–পেটের নাড়িগুলো ত্রাহি ত্রাহি করে ডাক ছাড়ছে। কিন্তু রঘুর বেরুবার সাহস নেই। স্টেশনের সবাই তাকে চেনে, এতক্ষণে তার খোঁজও পড়েছে নিশ্চয়। বেরুলেই কেউ না কেউ ক্যাঁক করে গলাটা পাকড়ে বাপের কাছে নিয়ে যাবে তাকে। আর তারপর–তারপর–সেই লাঠি! রামলাঠি!
না, রঘু যাবে না। তারও মনে দারুণ ধিক্কার এসে গেছে। ছি-ছি, কয়েকটা ছানার জিলিপির জন্যে কেন এত লাঞ্ছনা! ভাই নেই, বোন নেই–একমাত্র ছেলে সে, তার সঙ্গে এমন নৃশংস ব্যবহার! বেশ, সেও আর বাড়ি ফিরবে না। কলকাতায় চলে যাবে, সেখানে রোজগার করবে, তারপর সেও একটা মিঠাইয়ের দোকান দেবে। যত ইচ্ছে খাবে, যা খুশি বিক্রি করবে। তখন হায় হায় করতে থাকবেন রামগর্জন, বুঝবেন রাঘবলালও নেহাত তুচ্ছ করবার ছেলে নয়।
রঘু সেই মালগাড়ির তলায় বসে সারা দুপুর এইসব কঠিন প্রতিজ্ঞা করছিল আর দেখছিল একটু দূরে পাথরের ভেতর থেকে ড্যাবডেবে চোখ মেলে একটা কটকটে ব্যাঙ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকটা ঢিল মেরে ব্যাঙটাকে তাড়িয়ে দিয়ে রঘুর মনটা শান্ত হল। তারপর গাড়ির তলায় ঠাণ্ডা ছায়ায় বেশ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। এলোমেলো ভাবনায় দুপুর গড়িয়ে গেল, সামনে দিয়ে কুলি আর পয়েন্টসম্যানরা আসা-যাওয়া করল, ঝমঝম করে অনেকগুলি ট্রেন এল আর গেল! তারপরেই দেখা দিল প্রচণ্ড খিদে।
কলকাতায় যাওয়ার প্রতিজ্ঞা বুঝি আর টেকে না; মা-র কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে। ধোঁয়ানো গরম ভাতের ওপর খাঁটি ঘিয়ের গন্ধ, ঘন অড়হড়ের ডাল, ভাজা-ভুজি, আলুর দম, চাটনি, ক্ষীরের বাটি–তার সঙ্গে চারটি টাটকা মিষ্টি। বুকের ভেতর আঁকুপাঁকু করে, পেটটা চোঁ চোঁ করতে থাকে। রঘু ভাবে, বাবার রাগ নিশ্চয় এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, মা বসে বসে। তার জন্যে চোখের জল ফেলছেন। বেরুবে? দেখবে নাকি একটুখানি এগিয়ে?
কিন্তু–বাবার হাতের সেই লাঠি! সেই বাঘা হুঙ্কার! সে-যাত্ৰা নয় ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্যে প্রাণ বেঁচেছে, কিন্তু এবার যদি বাবা টিকিটা একবার চেপে ধরতে পারে–
ভাবতেই প্রাণ শুকিয়ে এল।
এদিকে কী খিদেই যে পেয়েছে। সেই কটকটে ব্যাঙটাকে ধরতে পারলেও চিবিয়ে খায় এমন মনের অবস্থা! আর তো সহ্য করা যায় না!
বাইরে রোদ লাল হয়ে এসেছে–রঘুর চোখের সামনে সার বাঁধা রেললাইনের ওপর দিয়ে লম্বা লম্বা ছায়া নামছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। তারপর রাত আটটার সময় কলকাতা যাওয়ার গাড়িটা এলে টুক করে বেরিয়ে রঘু চেপে বসবে তাতে। কিংবা রঘু ভাবতে লাগল, সেই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকেও এগোনো যেতে পারে। খিড়কির দরজা দিয়ে যদি একবার ভেতরে ঢোকা যায়, একবার যদি মার আঁচলের তলায় আশ্রয় নেওয়া যা,–তা হলে—
কিন্তু তারও তো দেরি আছে। এতক্ষণ থাকা যায় কী করে? রঘু কি এই মারাত্মক খিদেতেই মারা পড়বে নাকি শেষপর্যন্ত।
যা হওয়ার হোক–বাড়ির দিকেই যাই–এমনি একটা প্রায় ঠিক করে ফেলেছিল রঘু। ঠিক সেই সময়
যে-মালগাড়ির তলায় সে শুয়েছিল, তার থেকে হাত চারেক দূরে দুটো লম্বা কালো পা দেখা গেল। একবারের জন্যে রঘুর বুক ধড়ফড় করে উঠল। বাবা নাকি? খোঁজ পেয়ে ধরতে এসেছে তাকে? পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে সটকান দিতে যাবে, এমন সময় পায়ের মালিক ঝুপ করে সেখানে বসে পড়ল। আর বেশ দরাজ গলায় গান ধরলে :
আরে ভজো ভেইয়া কৌশল্যানন্দনকো
ভজো সিয়া রামকো—
না–বাবা নয়। লোকটাকে রঘু চেনে। এই স্টেশনেরই বুড়ো কুলি চম্পতিয়া।
চম্পতিয়া তাকে দেখতে পায়নি বলেই মনে হল। মালগাড়ির তলায় কালো ছায়ার ভেতর লুকিয়ে থেকে লক্ষ করতে লাগল রাঘবলাল। তার আরও মনে পড়ল চম্পতিয়া ডান চোখে দেখতে পায় না। দিনের আলোতেই হাত চার-পাঁচের বেশি তার নজরে আসে না। সুতরাং রঘুকে সে যে দেখতে পাবে এমন সম্ভাবনা বিশেষ নেই।
আরে ভজো ভেইয়া রাবণসুদন,
ভজো রঘু রাইকো—
রঘু রাইকে ভজন না-হয় করুক, কিন্তু এখানে বসে বসে কী করছে চম্পতিয়া? এতক্ষণে সব দেখতে পেল রঘু। তাকেই ভজন করুক আর শ্রীরামচন্দ্রজীকেই করুক, সামনে যা করছে তা ভোজনের আয়োজন। একটা পেতলের থালায় ছাতু ঢেলেছে লোটা থেকে জল দিয়ে পাকাচ্ছে মস্ত এক গোলা। কাঁচা লঙ্কা আছে, লবণ আছে, দুটো বড় বড় কলাও রেখেছে। পাশে।
ছাতু অবশ্য রাঘবলালকে বিশেষ খেতে হয় না, কিন্তু চম্পতিয়ার খাওয়ার ব্যবস্থা দেখে তার জিভে জল এসে গেল! ইস্! ও-থেকে একটুখানি ছাতু যদি সে পেত। পেটের ভেতরে আগুন জ্বলছে, আর মাত্র হাত কয়েক দূরেই এমন জবরদস্ত খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। কাঁচা লঙ্কা আর ছোলার ছাতুর গন্ধও এত মিষ্টি লাগে!
একটা দমকা হাওয়া এল সেই সময়। বোধহয় ভগবানই পাঠালেন।
–আরে হাঁ-হাঁ-হাঁ—
চম্পতিয়া চেপে ধরবার আগেই তার কাঁধের গামছাটা হাত-দশেক উড়ে গেল। আর চম্পতিয়া ছুটল সেই পলাতক গামছার সন্ধানে। নাউ অর নেভার–ক্লাস এইটে তিন বছর আটকে থাকা রঘুর এই ইংরেজী বচনটা জানা। সঙ্গে সঙ্গেই সে এগিয়ে গেল থালাটার দিকে, মালগাড়ির তলা থেকে হাত বাড়াল তারপর সেই আধসের ছাতুর তাল পেতলের থালাটা থেকে অদৃশ্য হল। বিলীন হল চোখের পলকেই।
গামছা কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে এসেই মুখ হাঁ হল চম্পতিয়ার।
–আরে ই ক্যা হো? ছাতুয়া কিধর গৈল বানু? কুত্তা লে গৈল ক্যা?
কিন্তু কাছাকাছি কোনও কুকুরের চিহ্ন পাওয়া গেল না। আর চোখের দৃষ্টি কম বলেই চস্পতিয়া দেখতে পেল না, রাঘবলাল ততক্ষণে সেই ছাতুর তাল নিয়ে পেছনের একটা মালগাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
–রাম রাম! ইয়ে তো জিন মালুম হোতা। ব্যস—চম্পতিয়া আর দাঁড়াল না, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল স্টেশনের দিকে।
আর তখন আধখোলা বিচালিতে অর্ধেক-বোঝাই একটা মালগাড়িতে চেপে বসেছে রাঘবলাল। আর বিচালির মধ্যে লুকিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে ছাতুর তালটা সে সাবাড় করছে।
যাক–এতক্ষণে পেটটা একটু ঠাণ্ডা হল।
পেট কেবল ঠাণ্ডাই হল না, পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠল। রঘু আর বসতে পারল না–বিচালির মধ্যেই দিব্যি আরাম করে শুয়ে পড়ল। আস্তে-আস্তে ঘুমে জড়িয়ে এল চোখ।
আবার যখন ঘুম ভাঙল–
মনে হল, স্বপ্ন দেখছে। হু-হুঁ করে হাওয়া লাগছে গায়ে, কালো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একটা ছুটন্ত ট্রেনের ভোলা গাড়িতে সে কাত হয়ে শুয়ে আছে। দু-পাশে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে অন্ধকার বন জঙ্গল, মাথার ওপর রাশি রাশি তারার দিকে ইঞ্জিনটা মুঠো মুঠো আগুনের ফুলকি ছুঁড়ে দিচ্ছে, ঝড়াং ঝড়াং করে বিকট আওয়াজ উঠছে ট্রেনের লোহা-লক্কড়ে আর–
আর কে যেন একটা কড়কড়ে লম্বা জিভ দিয়ে এক মনে তার পিঠটা চেটে চলেছে।
.
তিন
আতঙ্কে হাউ-মাউ করে উঠল রাঘব। কালো অন্ধকারে ছিটকে চলেছে বন-জঙ্গল, হাওয়ায় উড়ছে অসংখ্য আগুনের ফুলকি, শব্দ হচ্ছে ঝড়াং ঝং ঝনাৎ ঝনাৎ। এ যেন ট্রেনের আওয়াজ! রঘু কি তবে রেলগাড়িতে বসে আছে নাকি? আর বসে আছে একটা খোলা কামরায়–বাতাস তাকে যখন খুশি উড়িয়ে নিতে পারে?
এ কী সর্বনাশ! রাঘব কি স্বপ্ন দেখছে নাকি?
কোথায় তাদের বাড়ি–দোতলার ঘরের নরম বিছানাটি। মা যে পরিপাটি করে মশারি খুঁজে দেন, কোনও কোনও দিন মাথায় হাত দিয়ে ঘুম পাড়ান, গরম লাগলে পাখার বাতাস করেন। তার বদলে এ কী কাণ্ড! জিন-পরীর খেল নাকি? তখন সব মনে পড়ল। সেই কালান্তক ছানার জিলিপি, রামগর্জনের হাতের সেই রামলাঠি, মালগাড়ির তলায় লুকিয়ে থাকা, চম্পতিয়ার ছাতুর তাল লোপাট করা। আর তারপর–ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেই ফাঁকে মালগাড়িটা টেনে নিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে? কাশী–কনৌজ—এলাহাবাদ–কলকাতা যেখানে খুশি চলে যেতে পারে এ-গাড়ি। তখন কী করবে রাঘব? বাবা নেই, মা নেই, বাবার দোকানের মেঠাই নেই–একেবারে যে বেঘোরে মারা যাবে রাঘবলাল!
আমায় মাপ করো বাবা, আর কোনওদিন আমি চুরি করে খাব না রঘু ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। আর ঠিক তখন তার কানের কাছে ভোঁস ভোঁস করে কে যেন গরম গরম নিঃশ্বাস ফেলল–আর লম্বা একটা খরখরে জিভ দিয়ে চকাত চকাত করে ঘাড়ের উপর চেটে দিলে।
–ওরে বাবা। পেত্নীতে চেটে চেটে রক্ত খাচ্ছে নাকি? রাঘবলাল চেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল আর সেই সময় ট্রেন ঝড়াং ঝাং করে একটা বাঁক নিতেই আবার উল্টে পড়ল সেই গাদা করা খড়ের ভেতর।
আর পড়েই দেখতে পেলে—
পেত্নী নয়–আট-দশটা গোরু। এতক্ষণে রাঘবলাল বুঝল, নেহাত একটা গোরুর মতোই সে গোরুদের গাড়িতে উঠে পডেছে–এই বিচালিগুলো তাদেরই খাদ্য। আর বিচালির মধ্যে রাঘবলাল আবিষ্কার করে অপত্য স্নেহে তারা তার গা চেটে দিচ্ছে।
হায় ভগবান, এ কী ল্যাঠা!
রাঘবলাল একটু সরে বসল। বেশি দূর সরতে ভরসা হয় না–তা হলে সোজা গাড়ি থেকে একেবারে চাকার তলায়। তার ওপর যা হাওয়া! আশ্বিনের রাত–দস্তুরমতো শীত করছে তার। গায়ে একটা গেঞ্জি ছাড়া কিছুই নেই। রাঘব কোঁচার খুট জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল বিচালির ভেতর।
কিন্তু পৃথিবীর সব জিনিসকে ঠেকানো যায়–একমাত্র গোরুকে ছাড়া। গোরা যে কী ভয়ানক দুরন্ত আর দুর্ধর্ষ হতে পারে, রাঘব তা আগেও অনেকবার দেখেছে। একবার বাজারে ঢুকে পড়েছে তো এক খাবলায় এক ঝুড়ি লাউডগা মুখে তুলে নেবে, দোকানে গলা বাড়িয়ে চালে ডালে যাতে যাতেই মুখ দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে সের-তিনেক সাফ! যতই লাঠিপেটা করো, চোখ বুজে ঠায় চিবুতে থাকবে–যেন বিয়েবাড়ির ভোজ পেয়ে পরম আরামে নেমন্তন্ন খাচ্ছে। আর যখন শিং নেড়ে তাড়া করে আসে তখন তো কথাই নেই কাউকে না কাউকে গুঁতিয়ে তবে তার গোঁ থামবে। এই গোঁয়ের জন্যেই বোধহয় গোরুকে গো বলা হয়ে থাকে।
সুতরাং রাঘবও পালাতে পারল না।
একটা বড় বড় শিংওলা গোরু সমানে তার কান চাটতে লাগল। রাঘব দু-একবার ভাঙা গলায় বললে, হেই-হেই। জোরে বলতে সাহস হল না, পাছে এক গুতোয় তাকে সোজা গাড়ির তলায় ফেলে দেয়।
অবশ্য তাকে তোবার রাইট গোরুদের আছে–ষোলো আনাই আছে। কারণ মানুষের রিজার্ভ কামরার মতো এ-গাড়িও গোরুদের রিজার্ভ করা। রাঘবলাল নিতান্তই অনধিকার প্রবেশ করেছে এখানে। তারা যদি হটো-হটো রিজার্ভ যায়, দুসরা ডিব্বামে চলা যাও-বলে চাঁদা করে তাকে গুতিয়ে দেয়, তা হলে সে তো আর কোথাও নেই। তার ওপর। রাঘবলাল স্রেফ বিনা টিকিটের যাত্রী। সুতরাং গোরুকে কর্ণগোচর করে, অর্থাৎ কর্ণে গোরুকে চরতে দিয়ে সে ঝিম মেরে বসে রইল।
কিন্তু এ-গাড়ি কি আর থামবে না? সেই যে তখন থেকে চলছে–সেচলার যেন আর বিরাম নেই। অন্ধকার ছুটছে, গাছপালা ছুটছে, আগুনের ফুলকির ঝড় উঠছে, গুমগুম করে পেরিয়ে যাচ্ছে রেলের পুল, দু-একটা ছোট-ছোট আলো দেখা দিয়েই ঘুরপাক খেয়ে কোথাও মিলিয়ে যাচ্ছে। পর-পর তিন-চারটি স্টেশন চলেও গেল কিন্তু মালগাড়ি একটানা ছুটছেই আর ছুটছেই। তার থামবার কোনও লক্ষণ নেই–কোথাও যে আদৌ থামবে, এমনও মনে হচ্ছে না।
যদি না থামে? যদি একটানা চলতে চলতে দিল্লি-আগ্রা-মোরাদাবাদ-বোম্বাই সব পেরিয়ে যেখানে খুশি চলে যায়? তা হলে? তা হলে কেমন করে দেশে ফিরবে রাঘবলাল? বাবার দোকানের রসগোল্লা-চমচম-বেদে-জিলিপিসন্দেশ-মনোহ-খাস্তা কচুরিগরম সিঙারা-মতিচুর সে কি আর খেতে পাবে কোনওদিন? আর কি কোনও আশা আছে?
রাঘবলাল অঝোরে কাঁদতে লাগল।
বাবা, তোমার কাছে মাফ চাইছি। তুমি এসে এখান থেকে আমায় নিয়ে যাও। যত খুশি লাঠিপেটা কর, আমার কোনও আপত্তি নেই। এই গোরুদের গাড়ি থেকে–এই চলতি ট্রেন থেকে আমায় উদ্ধার করো।
এদিকে গোরুর জিভ ঘাড় থেকে গলায় নামল। প্রথম-প্রথম যত বিশ্রী বোধ হচ্ছিল এখন আর তেমন লাগছে না। বরং বেশ একটুখানি আমেজ হচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতেই কখন তার চোখ বুজে এল, তারপর এক ফাঁকে বিচালির গাদার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
.
আবার যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখল, ট্রেন থেমেছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটেছে, পাশে বন-জঙ্গলের মাথার ওপর রোদের লাল আভা একটুখানি লেগেছে কেবল। রেললাইনের দুধারে গাছপালার ওপর পাখিরা কিচির-মিচির করছে।
রাঘব তাকিয়ে দেখল, স্টেশন নেই। বুঝল, সিগন্যাল ডাউন হয়নি, গাড়ি কোনও স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রাঘবের মনে হল এই সব চাইতে ভাল সুযোগ। স্টেশনে নামলেই তো টিকেট চাইবে, গোরুদের রিজার্ভ গাড়িতে চেপে এসেছে বলে ডবল ভাড়াই চাইবে কি না কে জানে? তার চাইতে এই বেলাই সোজা চম্পট দেওয়া ভালো। যা ভাবা সেই কাজ। চারদিকে বেশ করে দেখে নিয়ে সে টুপ করে একটা লাফ দিয়ে নীচে পড়ল। নুড়িগুলোতে একটু চোট লাগল বটে, কিন্তু সেটা এমন কিছু বেশি নয়। তারপরেই টেনে দৌড়। চোখের পলকে তারের বেড়া টপকে একেবারে রেললাইনের বিপজ্জনক সীমানার বাইরে।
গাড়ি থেকে একটা গোর ডাকল : হাম্বা! যেন বললে, কোথা যাস বাবা, ফিরে আয়।
কিন্তু রাঘব আর ফিরল না। চক্ষের পলকে কাঁটাগাছের ঝোঁপ, রেলের শুকনো নয়ানজুলি, টেলিগ্রাফের পোস্ট-সব পার হয়ে একটা পায়ে-চলা সরু পথ ধরে সে ছুটতে। লাগল। গাড়ির ইঞ্জিনের ভোঁ শুনল, একবার দেখল ট্রেনটা আস্তে-আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, দু-তিনটে গোরু যেন কান তুলে এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে, থাকুক তাকিয়ে রাঘব। আর ওদের গ্রাহ্য করে না।
রাঘব ছুটল–প্রায় মাইলখানেক দমবন্ধ করে ছুটল। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গায়।
এ সে কোথায় এল!
গ্রাম নেই–মানুষজনের চিহ্ন নেই–এ যে অথই জঙ্গল। দুধারে সারি সারি ঝাঁকড়া গাছ, প্রথম ভোরের আলো এখনও ঢুকতে পারেনি তাদের ভেতরে। পায়ে-চলা পথটা ভিজে ভিজে মাটির ভেতর মুছে গেছে, চারদিকে থমথমে ছায়া। শুধু মাথার ওপরে অসংখ্য পাখির চিৎকার। এ কোথায় এল রাঘব! এখানে যে তাকে বাঘে-ভাল্লুকে ধরে খাবে!
এর চাইতে যে রেলগাড়িও ভাল ছিল।
যে-পথ দিয়ে এসেছে, ভাবল সে পথেই ফিরে যায়। কিন্তু কোথায় পথ? চারদিকেই যে ঘন কালো জঙ্গল!
এখন–এখন কী হবে?
রাঘবলাল আবার ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল।
–তু কোন্ হো?
নিদারুণ চমকে রাঘব একটা লাফ মারল।
আর সেই সময় কার একটা লোহার থাবার মতো হাত শক্ত করে কাঁধটা চেপে ধরল তার।
আর একেবারে হাঁড়িচাঁচার গলার মতো কর্কশ আওয়াজ তুলে কে জিজ্ঞেস করলে, আরে রোতা কেঁউ (কাঁদছিস কেন?)? তু কোন হো (তুই কে?)?
রাঘব তাকিয়ে দেখল, মানুষই বটে, কিন্তু কী রকম মানুষ! প্রকাণ্ড মাথায় আরও প্রকাণ্ড পাগড়ি, কান পর্যন্ত মোটা গোঁফ–দুটো লাল টকটকে বিকট চোখ মেলে ঠিক বাঘের মতোই তাকিয়ে আছে তার দিকে।
.
চার
দারুণ ভয়ে রঘু মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, সেই ভয়ঙ্কর লোকটা লোহার মতো শক্ত হাতে তার ঘাড় চেপে ধরে বললে, এই, খাড়া রহো!
খাড়া দাঁড়িয়ে থাকার জো রঘুর ছিল না। মনে হচ্ছিল, তার পা দুটো স্রেফ শোলার মতো হালকা হয়ে হাওয়ায় ভাসছে। আসলে রঘু হাওয়াতেই ভাসছিল। সেই ভয়ঙ্কর লোকটা তাকে মাটি থেকে তুলে ধরে বেড়ালছানার মতো শূন্যে দোলাচ্ছিল।
রঘু কেবল বলতে পারল : আঁ–আঁ–আঁ–
আঁ-আঁ? আচ্ছা চল আমার সঙ্গে। পিছে বোঝা যাবে।
লোকটা রঘুর ঘাড় ছেড়ে দিলে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা কাটা কুমড়োর মতো ধপাৎ করে স্যাঁতসেঁতে মাটির ওপর আছড়ে পড়ল রঘু।
সেই লোকটা তখন লাল-লাল চোখ দুটো পাকিয়ে, করাতকলে কাঠ-চেরাইয়ের মতো বিকট আওয়াজ তুলে হা হা করে হেসে উঠল। আর সেই হাসির আওয়াজে রঘুর সামনে বিশ্বসংসার লুপ্ত হয়ে গেল।
যখন জ্ঞান হল, তখন রঘুর মাথার ভেতরটা ঠিক চরকির মতো ঘুরছে। কিছুক্ষণ ধরে একরাশ সর্ষের ফুলের মতো কী কতগুলো তার সামনে নাচতে থাকল, মনে হল, একটা মাকড়সার জাল হাওয়ায় দুলছে আর তার ভেতর থেকে কয়েক জোড়া পাকানো চোখ কটকট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
রঘু উঠে বসল।
একটা স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে সে পড়ে ছিল এতক্ষণ। দেখল, কেমন করে যেন একটা পুরনো পোড়ো বাড়িতে এসে পড়েছে সে। সামনে একটা জানালা দিয়ে রোদ আসছে, সেই রোদ পড়ে একটা মাকড়সার জাল জ্বলজ্বল করছে, তার মধ্যে মস্ত কালো মাকড়সাটা কদাকার পা নেড়ে চলে বেড়াচ্ছে। ইট-বেরকরা দেওয়ালগুলোতে কোথাও চুনের আস্তর নেই–একটা ভ্যাপসা ভিজে গন্ধ উঠছে, হাওয়ার ধাক্কায় জানলার আধভাঙা পাল্লা ক্যাঁচ ক্যাচ করে শব্দ তুলছে। ঘরটা বেশ বড়। তারই একটা দিকে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে আছে। সে। একটু দূরে গোটাতিনেক খাঁটিয়ার ওপর ময়লা বিছানা গোটানো রয়েছে, লোটা আছে গোটা চারেক, দেওয়ালে হেলান দেওয়ানো রয়েছে মোটামোটা বাঁশের লাঠি আর সড়কি বল্লম। দুটো দরজা–একটা সামনের দেওয়ালের গায়ে, সেটা বন্ধ আছে। বোধহয় পাশের ঘরের দরজা। আর একটা দরজা তার ডানদিকে, সেটা ভোলা,-জানালা দিয়ে বাতাস এসে সেই পথে হু-হুঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। গাছপালার শব্দ আসছে, শোনা যাচ্ছে পাখির ডাক।
রঘুর ইচ্ছে করল, খোলা দরজাটা দিয়ে এক ছুটে বাইরে পালিয়ে যায় সে। তার মন বলছিল, বাবু রাঘবলাল, এ-জায়গাটা একদম ভালো নয়। যদি প্রাণ বাঁচাতে চাও, তা হলে তিন লাফে উধাও হও এখান থেকে। কিন্তু ইচ্ছে সত্ত্বেও সে পালাতে পারল না। একে তো ভয়ে, ক্লান্তিতে সারা শরীর অসাড় হয়ে গেছে, তার ওপর সেই প্রচণ্ড খিদে। চম্পতিয়ার ছাতুর তাল কখন যে হোমিওপ্যাথিক বড়ি হয়ে তার পেটের অতলে অদৃশ্য হয়েছে, তা সে নিজেও জানে না। রাঘব বুঝতে পারল, সেই লাল-লাল চোখওলা বিকট চেহারার লোকটাই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। লোকটার কথা মনে পড়তেই তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভয়ে ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল। কিন্তু তখুনি পেটের আগুন-জ্বলা খিদেটা চাঁই চাঁই করে বলে উঠল : পাহাড় খাই, গাছ খাই, লোহা-লক্কড় যা পাই তাই খাই।
এনেছে যখন, তখন ভূত হোক, যা-ই হোক, কিছু নিশ্চয় তাকে খেতে দেবেই। আর, কিছু খেতে পেলে এমনিতেই যখন সে মারা যাবে, তখন খেয়ে-দেয়ে মরাই ভাল। কিন্তু যদি সত্যিই লোকটা রাক্ষস হয়? যদি তাকে একটা কাঁচা নরমুণ্ড এনে খেতে দেয়? কিংবা যদি সত্যিই তার মুণ্ডুটাই কচমচ করে–খোলা দরজার একটা পাটি বাতাসে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল সেটা। আর বিষম ভয়ে ওরে বাবা বলে রঘু একটা লাফ মারল।
এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বুদ্ধু কাঁহাকা।
রাঘবলাল দেখল, এবার যে ঘরে ঢুকেছে তাকে দেখে ঠিক রাক্ষস বলে বোধ হচ্ছে না। তার চাইতে বয়সে একটু বড়, কালো মিশমিশে একটি ছেলে। অসম্ভব জোয়ান, চওড়া বুক, লোহার শাবলের মতো দুখানা লম্বা লম্বা হাত। ইচ্ছে হলে এ-ও এক আছাড়ে তাকে চাপাটি বানিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু ছেলেটা হাসছে, কালো মুখের ভেতর চকচক করছে শাদা দাঁতের সারি।
–আরে, এত ডর খাচ্ছিস কেন? আমি তোর সঙ্গে গল্প করতে এলুম।
রঘু এবার ভয় পেল না বটে, কিন্তু বেশি ভরসাও পেল না। টুক করে আবার নিজের জায়গাতে বসে পড়ল, আর ছেলেটা তার মুখোমুখি বসল একটা খাঁটিয়ার ওপর।
–আমি কোথায় এসেছি?–এতক্ষণে সাহস করে জিজ্ঞেস করল রাঘবলাল।
–কোথায় এসেছিস? ছেলেটা আবার হাসল, তা ভালো জায়গাতেই ভিড়েছিস এসে। এর নাম বলরামপুরের শালবন। সহজে কেউ এ বনের ত্রিসীমানা মাড়ায় না।
–তবে তোমরা কেন এখানে থাকো?
–কেন থাকি? জানতে পারবি একটু পরেই। তারপর আগে তোর কথা শুনি। কে তুই?
–আমি রাঘবলাল সিং। সবাই রঘু বলে ডাকে।
–আমিও রঘুই বলব। তোর কে কে আছে?
–বাবা-মা সবাই। আমি আবার তাদের কাছে ফিরে যাব। বলতে বলতে রঘুর চোখে জল এসে গেল।আমি কিরিয়া করে বলছি, আর কখনও আমি ছানার জিলিপি চুরি করে খাব না।
–চুরি করে খেয়েছিলি?
–সেজন্যেই তো! বাবা মস্ত একটা লাঠি তেড়ে এল। তারপর—
ছেলেটা বললে, হুঁ, বলে যা।
চোখের জল মুছতে মুছতে রঘু নিজের করুণ কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলে।
শুনতে শুনতে ছেলেটা হাসছিল, শেষ পর্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বললে, কাজ ভালো করিসনি। বাপ-মাকে ছেড়ে পালিয়ে আসা খুব খারাপ। আমিও তাই করেছিলাম, তারপর–
–তুমিও পালিয়েছিলে! রঘু কৌতূহলে সোজা হয়ে উঠে বসল।
ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, এখন থাক এসব কথা। তুই তো কাল থেকে ভুখা আছিস দেখছি। কিছু খাবি?
–খিদেয় মরে যাচ্ছি ভাই!
–তবে বোস, আমি খাবার নিয়ে আসি। কিন্তু খবর্দার, ঘর থেকে বেরুবি না। ভারি মুস্কিলে পড়বি তা হলে।
ছেলেটা বেরিয়ে গেল।
হাঁ করে বসে রইল রঘু। মুস্কিল? সেই ভয়ঙ্কর লোকটা কে? গেলই বা কোথায়? বলরামপুরের শালবনের মানে কী? কেন লোকে এর ত্রিসীমানায় পা দেয় না? এই ছেলেটাকে দেখে তো ভয়ের কিছু মনে হল না তার। তবে ঘরের বাইরে যেতে বারণ করছে। কেন? কী আছে বাইরে? জিন-পরী? বাঘ-ভাল্লুক?
রঘু দেখতে লাগল, সামনে মাকড়সার জালে রোদ পড়ে রুপোর তারের মতো ঝিলমিল করছে। আর সেই বিকট কালো মাকড়সাটা যেন কুতকুতে চোখ মেলে চেয়ে আছে তার দিকেই। হাওয়ার ধাক্কায় জানালার ভাঙা পাল্লাটা ক্যাঁচক্যাঁচ করে শব্দ করছে সমানে।
মনের মধ্যে কে যেন ডেকে বললে, এখন পালাও রাঘবলাল, এখনও সময় আছে। কিন্তু পালাবার সাধ্য কী? ছেলেটা খাবার আনতে গেছে, না-খেয়ে এক পা-ও সে নড়তে পারবে না। তারপর ঘরের বাইরে ভূতপেত্নী, সাপবাঘ কী যে থাবা পেতে বসে আছে কে জানে! রঘু ঘামতে লাগল।
ছেলেটা ফিরে এল। একটা কলাই করা থালায় কয়েকটা লাড়ু, গোটা চারেক কলা আর পেতলের গ্লাসে এক গ্লাস দুধ।
বললে–খা লে। আমার খাবারটা তোকে দিচ্ছি।
–সে কি! তুমি কী খাবেলাড়ুতে হাত দিয়েও রাঘবলাল হাত গুটিয়ে নিলে।
–আমার জন্যে তোকে ভাবতে হবে না; আমার দুসরা ব্যবস্থা আছে। তুই খা!
আর বলতে হল না। রাঘব বাঘের মতো খাবারগুলোর ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।
খাওয়া শেষ করে দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়েছে, এমন সময়–
আরে বাঃ বাঃ চিড়িয়া যে দানাপানি খাচ্ছে দেখছি।
বিষম চমকে উঠে রঘু দরজার দিকে তাকাল। তিনটে গুণ্ডা জোয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে। সকলের সামনে সেই লোকটা–যে ঘরের ভেতরে রঘুর টুটি চেপে ধরেছিল।
লোকটা সেই করাত-চেরা আওয়াজে আবার ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। বললে, লে–লে শেষ খাওয়াটা খা লে! তারপর তোকে সাবাড় করব।
রঘু ভয়ে পাথর হয়ে গেল।
ছেলেটা বললে, কেন মিছে ছোট বাচ্চাটাকে ভয় দেখাচ্ছ চাচা?
–মিছে ভয় দেখাচ্ছি?–লোকটার অট্টহাসিতে রঘুর মাথা ঘুরে গেল, ওটা বাচ্চা ছেলে নয়, কেউটের বাচ্চা। খুদে গোয়েন্দা! নইলে এই বলরামপুরের শালবনে এসে ঢোকে? আজই সন্ধেয় ওকে কালীর পায়ে বলি দেব; তবে আমার নাম বৃন্দা সিং—হাঁ।
রঘুর হাত থেকে ঠকাৎ করে গ্লাসটা খসে পড়ল, দুধের ঢেউ বয়ে চলল মেঝেতে।
.
পাঁচ
রঘু হাউমাউ করে কান্না জুড়েছিল, ঘরঘরে গলায় বৃন্দা সিং জোরালো ধমক দিলে একটা।
–এই রোও মৎ!
রঘুর কান্নাটা গলায় এসে কোঁৎ করে থেমে গেল।
–খাড়া হো যাও।
রঘু দাঁড়াল। কেমন করে দাঁড়াল জানে না, শুধু চোখের সামনে সেই মাকড়সার জালটা যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল।
–নাম কী? ঘর কাঁহা?
রঘু জড়িয়ে জড়িয়ে কী যেন বললে, কেউ তা বুঝতে পারল না। বৃন্দা সিং চোখ পাকিয়ে আবার বিকট গলায় ধমক দিলে : সাফ সাফ বলল, নেহি তো–বিরাশি সিক্কা নয়, একশো চৌষট্টি সিক্কার একটি চড় আকাশে উঠল। সেটা গালে পড়লে রঘু সেই চম্পতিয়ার ছাতুর গোলার মতো তাল পাকিয়ে যেত সঙ্গেসঙ্গে।
রঘুর গলা দিয়ে কেবল ক্যাঁ করে একটা আওয়াজ বেরুল। আর তক্ষুনি আড়াল করে দাঁড়াল সেই কালো ছেলেটা–যার নাম মুরলী।
মুরলী বললে, কেন ঝুটমুট ওকে ভেবড়ে দিচ্ছ চাচা? আমি সব বলছি। ছানার জিলিপি চুরি করে খাওয়া, তারপর বাপের ঠ্যাঙার ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালানো–ট্রেনে উঠে ভোরবেলা লাফিয়ে নেমে পড়ারাঘবের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী সব বলে গেল মুরলী। আর তাই শুনে হা-হা করে হাসতে-হাসতে পেটে হাত চেপে বসে পড়ল বৃন্দা সিং। সঙ্গের বাকি তিনটে জোয়ানও সে-হাসিতে যোগ দিলে, আর, মনে হলো, বলরামপুরের জঙ্গলে যেন হাজার খানেক করাত একসঙ্গে কাঠ চিরছে।
হাসি থামলে বৃন্দা সিং বললে, আঁ এইসা বাত? ওরে বুদ্ধ রঘুয়া, খাওয়ার জন্য বাঁচতে নেই বাঁচার জন্যেই খেতে হয়। যাই হোক, আমার পাল্লায় যখন এসে পড়েছিস, তখন তোকে শিখিয়ে দেব সত্যিকারের বাঁচা কাকে বলে। কুস্তি লড়বি, লাঠি খেলবি, বন্দুক ছুঁড়বি। ঘি আর মেঠাই খেয়ে পেটে যে থলথলে চর্বি জমেছে–এক মাসের মধ্যে লোপাট হয়ে যাবে ওসব। ছাতি চওড়া হবে-সত্যিকারের জোয়ান করে তুলব। এই মুরলী তোর দেখাশোনা করবে–আর কিষণলাল তোকে মানুষ করার ভার নেবে। কিন্তু খবদ্দার। পালাবার চেষ্টা করেছিস তো মরেছিস! কালী মাইজীর কাছে নিয়ে তোকে বলি দেব–মনে থাকে যেন।
কথাগুলো রঘু যে সব শুনতে পেল তা নয়। কিন্তু যা শুনল তা-ই যথেষ্ট। আর-একবার কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃন্দা সিং ওর চোখের দিকে তাকাতেই সেকান্নাটা কোঁৎ করে গলা বেয়ে পেটের ভিতরে নেমে গেল তার।
বৃন্দা সিং বললে, আমি এখন যাচ্ছি, বিকেলে ফিরে আসব। কিষণলাল, তুমি এক্ষুনি একে তালিম লাগাও, আমি এসে খবর নেব, কতদূর এগোল।
এই বলে বাকি দুজন সঙ্গীকে নিয়ে নাগরা জুতো মচমচিয়ে বেরিয়ে গেল বৃন্দা সিং। সামনে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কোথায় যে মিলিয়ে গেল কে জানে?
রঘু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছি, কিন্তু আশা মরীচিকা। সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা লম্বা জোয়ান এগিয়ে এল তার দিকে। গায়ের রংটা ফসার দিকে। মাথায় ছোট-ছোট লালচে চুল–রোদ পড়ে তামার কুচির মতো জ্বলছে, বাঁ দিকের ভুরুর নীচ থেকে একটা পুরনো কাটা দাগ ধনুকের মতো বেঁকে নেমে এসেছে ঠোঁট পর্যন্ত। চোখ দুটো ট্যারা। মালকোঁচা করে পরা কাপড়, গায়ে ফতুয়া, দু-হাতে দুটো লোহার বালা। সব মিলে ভয়ঙ্কর লোকটাকে আরও বিকট দেখাচ্ছে। এ-ই কিষণলাল।
কিষণলাল ট্যারা চোখে খানিকক্ষণ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল–অর্থাৎ বেশ করে লক্ষ করল রঘুকে। তারপর বললে, আও।
রঘু মুরলীর পেছনে কাঠ হয়ে রইল, এক পা নড়ল না। কিষণলাল আবার মোটা গলায় বললে, এই রঘুয়া, চলা আও।
মুরলী কানে কানে বললে, চলা যাও–ডরো মৎ।
বলির পাঁঠার মতো মুরলীর আড়াল থেকে বেরুল রাঘবলাল। কিষণলাল খপ করে তার হাতটা চেপে ধরল। আঙুল তো নয়–যেন লোহার আংটা! রঘুর হাতের হাড় মড়মড় করে উঠল।
কিষণলাল তাকে টানতে টানতে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল। কিষণলালের সঙ্গে যেতে যেতে রঘু দেখল, একটা মস্ত পুরনো বাড়ির অর্ধেকটা ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে–তৈরি হয়েছে কতগুলো মাটির পাঁজা তার ওপর ঘাস আর বনতুলসীর জঙ্গল গজিয়েছে। মাত্র খান তিন-চার ঘর কোনওমতে দাঁড়িয়ে আছে, একটু-আধটু সারিয়ে-সুরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেইটেই এদের আস্তানা। পুরনো চুন-সুরকি আর গাছপালার গন্ধে ভরে আছে বাতাস। বাড়িটার সামনে আর দুধারে একটু ফাঁকা জায়গা–কেটে সাফ করা হয়েছে মনে হয়। তা ছাড়া চারদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। শালগাছ তো আছেই, কয়েকটা শিমুল গাছ ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। আরও কী কী গাছ রয়েছে রঘু চিনতে পারল না। বনের ভেতর দিয়ে কয়েকটা ছোট-ছোট পায়ে-চলা কোথায় যে চলে গেছে কে জানে?
সেই ফাঁকা জায়গার খানিকটা অংশ বেশ করে কোপানো রঘু বুঝল এখানে কুস্তি হয়। তারই কাছাকাছি একটা গাছতলায় কিষণলাল রঘুকে এনে দাঁড় করাল। বললে, খাড়া রহে।
রঘু দাঁড়িয়ে রইল।
–ইধার উধার ভাগো মৎ।
রঘু মাথা নেড়ে জানালো,–সে ভাগবে না।
–আমি এখুনি আসছি–বটে চট করে কিষণলাল আবার সেই ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। রঘু দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল চারদিকে। চোখে পড়ল, খানিক দূরে একটা শালগাছের ওপর থেকে তিনটে বানর একমনে তাকে দেখছে। একটা আবার চোখ পিটপিট করে তাকে ভেংচে দিলে।
ভ্যাংচাক যত খুশি। অন্য জায়গা হলে রঘু এতক্ষণে দু-চারটে ঢিল ছুঁড়ে দিত, কিন্তু বিপাকে পড়লে সবই সইতে হয়। রঘু মুখ হাঁড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল।
কিণষলাল ফিরে এল। তার দু হাতে দুটো লাঠি। একটা প্রকাণ্ড, আর-একটা তার চাইতে একটু ছোট। মতলব কী? ওই লাঠি দুটো দিয়ে ঠ্যাঙাবে নাকি তাকে? কিন্তু দুটোর দরকার কী, একটার এক ঘা খেলেই তো রঘু চিরকালের মতো ঠাণ্ডা।
কিন্তু কিষণলাল তাকে ঠ্যাঙাল না। সামনে এসে ছোট লাঠিটা তার দিকে এগিয়ে ধরল।
–নে।
রঘুকে নিতে হল।
লাঠি খেলেছিস কোনওদিন?
–না।
–কুস্তি করেছিস?
–না।
–হুঁ! তাই এই বয়সেই পেটে অমন করে চর্বি গজিয়েছে, বুকটা হয়েছে পায়রার মতো। তিনদিনে আমি তোকে ঠিক করে দিচ্ছি। এবার লাঠিটা ধর।
রঘু লাঠির গোড়াটা ধরল।
–বেকুব কাঁহাকা? ও-ভাবে নয়। দেড় হাত বাদ দিয়ে তারপর দু পাশে মুঠো করে ধর। ধরেছিস? এইবারে লাঠি তোল!–তোল বললেই তোলা যায় নাকি? একটা বাঁশের লাঠির যে এমন নিদারুণ ওজন হতে পারে, রঘু সেটা এই প্রথম বুঝতে পারল। যেন ভীমের গদা তুলেছে এমনি মনে হল, টনটনিয়ে উঠল হাতের কবজি।
–ঠিক হ্যায়! এইবার লাগা আমার লাঠির সঙ্গে। আওর জোরসে! খালি ঘি-মিঠাই খাস, একটু তাগদ নেই শরীরে? হুঁ–ঠিক হয়েছে। কারও মাথায় মারতে হলে কিংবা কেউ মাথায় মারতে এলে–এমনি করে মারবি। এইভাবে আটকে দিবি। একেই বলে শির-সমঝা?
আর সমঝা! এক শিরের ধাক্কাতেই রঘুর শির ঝনঝন করছে তখন! আর কী এই লাঠিটা। রঘুর কাঁধ থেকে হাত দুটো ছিঁড়ে পড়বার জো হল।
কিষণলাল বললে, লাঠি ফেক–
লাঠি ফেক, কথাটার মানে হল, লাঠিটা এগিয়ে নিয়ে ধরে ছোড়বার ভঙ্গিতে জোরে তার মাথাটা মাটিতে ঠেকানো। কিন্তু ফে কথাটার অর্থ রঘু সোজাসুজি বুঝে নিল। তৎক্ষণাৎ হাত থেকে ছুঁড়ে দিলে লাঠিটা, আর সেটা সোজা গিয়ে ধাঁই করে কিষণলালের হাঁটুর ওপর পড়ল।
–আরে বাপ, মার দিয়া! বলে হাহাকার করে উঠল কিষণলাল। হাঁটু চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল কিছুক্ষণ, বিশ্রী মুখ করে চোট-খাওয়া জায়গাটা ডলাই-মলাই করল, তারপর উঠে দাঁড়াল। তখন তার দাঁত কড়কড় করছে, তার কটা চুলে রোদ পড়ে তামার কুচির মতো জ্বলছে আর দুটো ট্যারা চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।
–উল্লু-ভাল্লু—গড্ডর–খড্ডর কাঁহাকা—
উল্ল, ভাল্লু, গড্ডর–এ-সবের মানে বোঝা যায়, কিন্তু খচ্চর যে কী ব্যাপার সেইটেই বুঝতে চেষ্টা করছিল রঘু। তার আগেই বাঘের মতো তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিষণলাল। দুটো লম্বা-লম্বা হাতে স্রেফ একটা বেড়াল-ছানার মতো মাটি তুলে নিলে, তারপর সোজা ছুঁড়ে দিলে ওপর দিকে।
কাঁউ কাঁউ করে একটা আওয়াজ বেরুল রঘুর গলা দিয়ে। আর পরক্ষণেই টের পেল মাটি থেকে হাত-সাতেক ওপরে একটা গাছের ডালে সে সওয়ার হয়েছে। তখুনি নীচে পড়ে যাচ্ছিল, প্রাণপণে ডালটাকে চেপে ধরে তার ওপর শুয়ে পড়ল।
নীচে থেকে হা-হা করে হেসে উঠল কিষণলাল। বললে, আব রহো, হঁয়াই রহো।
তা ছাড়া আর কী করতে পারে রঘু? জীবনে সে কোনওদিন গাছে চড়েনি–এমনকি ঘুড়ি ধরবার লোভেও নয়। চিরকালই সে বাপ-মায়ের আদরের দুলাল, ননীর পুতুল। এই ডাল থেকে কেমন করে যে মাটিতে নামবে সেটা ভাবতেই মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল তার।
আর তখন—
পাতার আড়াল থেকে হাজারখানেক লাল পিঁপড়ে বেরিয়ে সবেগে তাকে আক্রমণ করল। তাদের নিজস্ব দুর্গে এই অনধিকারীর প্রবেশ তারা কোনওমতেই সহ্য করতে রাজি নয়।
.
ছয়
কিষণলাল আবার গলা ফাটিয়ে হাসল কিছুক্ষণ।
— হো–হো, দেখো দেখো। পেরকা উপর বান্দর কেইসে বৈঠা হ্যা।
পের অর্থাৎ গাছের ওপর বাঁদর বসে আছে। কিন্তু রাঘবলাল আর সত্যিই কিছু বানর নয় তা হলে লাফে লাফে এ-ডাল থেকে ও-ডালে সে হাওয়া হয়ে যেতে পারত। তার বদলে চোখ কপালে তুলে সে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে রইল, আর দলে-দলে লাল পিঁপড়ে এসে–বাবা রে–মা রে গেলুম রে–
গোলমাল শুনে মুরলী বেরিয়ে এসেছিল। এই ছেলেটাকে রঘুর ভালো মনে হয়েছিল, ভেবেছিল, বিপদে-আপদে অন্তত মুরলীর কাছে আশ্রয় পাবে সে। কিন্তু এ কী বিশ্বাসঘাতকতা! সংসারে কাউকে যে চেনবার জো নেই! মুরলীও হাসছে। কালো মুখের ভেতর থেকে সাদা সাদা দাঁত বের করে সমানে হেসে চলেছে। রঘু আর্তনাদ করে উঠল : এই ভাই মুরলী, চুট্টি (পিঁপড়ে) আমাকে খেয়ে ফেললে!
–তো উতরো না। নেমে এস।
–কেমন করে নামব?
–কোশিস কর।
কী করে কোশিস করে রঘু? একেবারে ননীর পুতুল। খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, মোটা হয়েছে, আর পনেরো বছর বয়সেও প্যাঁচার ডাকে ভয় পেয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরেছে। গাছ থেকে নামা কি তার কাজ?
–উতরো–উতরো বলে কিষণলাল তার লম্বা লাঠিটা দিয়ে একটা খোঁচা লাগিয়ে দিল রঘুর পেটে। রঘু গোঁ গোঁ করে উঠল।
একেবারে দুমুখো আক্রমণ! গাছে লাল পিঁপড়ের ব্যাটেলিয়ান, তলা থেকে লাঠির গুঁত। আর ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল, মাথার একটু ওপরে গোটা-চারেক বাঁদর তাকে ভেংচি কাটছে। তাদের ভাবভঙ্গি সন্দেহজনক। ওই চারটিতে মিলে যদি খ্যাঁচখ্যাঁচিয়ে তাকে আঁচড়ে দেয়, তা হলে গায়ের ছাল-চামড়া বলে কিছু আর থাকবে না।
হে মা কালী! হে বাবা হনুমানজী! এই দুঃসময়ে রাঘবলালকে বাঁচাও।
এর মধ্যে একটা লাল পিঁপড়ে কুটুস করে রাঘবের কানের গোড়ায় কামড়ে দিয়েছে আর কিষণলাল আবার ক্যাঁক করে লাগিয়েছে লাঠির গুঁতো। আর তো পারা যায় না।
–উতরো না! একটু নীচে নামোডাল ধরে ঝুলে পড়ো!-মুরলী উপদেশ দিতে লাগল।
তা ছাড়া আর উপায় নেই। চেষ্টা তাকে করতেই হবে। প্রাণ দিয়ে টানাটানি পড়েছে। এখন।
প্রায় দশমিনিট ধস্তাধস্তির পর–ঝপাং।
রঘু ঠিক মাটিতে নামল না–পড়ল। তারপরে আরও মিনিট দশেক নাচানাচি করতে হল প্রাণপণে। মানে, ইচ্ছে করেই নাচল না, ওই পিঁপড়েরাই নাচিয়ে ছাড়ল তাকে। মুরলী এগিয়ে এসে কিছু পিঁপড়ে ছাড়িয়ে দিলে গা থেকে। তখন বে-দম হয়ে রাঘবলাল বসে পড়ল গাছতলায়, গায়ের চামড়া ছড়ে গেছে এখানে-ওখানে, পিঁপড়ের কামড়ে চাকা-চাকা হয়ে ফুলে উঠেছে, আর বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা কামারশালার হাপরের মতো ওঠাপড়া করছে। হায়রে ছানার জিলিপি! তোর জন্যে এত দুর্ভোগ সইতে হবে সেকথা কি রাঘবলাল স্বপ্নেও ভেবেছিল। কিন্তু বসে বসে দুঃখ করবার জো নেই। কিষণলাল এক হ্যাঁচকা টানে তাকে তুলে ফেললে।
–আও, লাঠি ধরো।
কিছুতেই নিস্তার নেই। আবার সেই কালান্তক লাঠি খেলা। ওঃ!
.
দেখতে-দেখতে কুড়িবাইশটা দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রাঘবলাল অনেক দেখেছে, ঠেকেছে, অনেক শিখেছে। বুঝেছে এ বড় কঠিন ঠাঁই। এখানে মা নেই, বাবা নেই, দোকানের চাকর ছোট্ট–যে লুকিয়ে-চুরিয়ে তাকে এটা-ওটা মিঠাই খাওয়াত, সেও নেই। এমন কি স্কুলের সেই বন্ধুরাও নয়–যারা ঠাট্টা করে মানপত্র দিলেও নিরীহ, শান্ত রাঘবলালকে বেশ ভালোইবাসত। ননী, ছানা ঘি-ভাত এসবের কোনও পাটই নেই এখানে।
বৃন্দা সিং তো আছেই, তা ছাড়া আছে আরও দশ বারোজন মানুষসকলেই যেন বাঘের দোসর!
ভোরে উঠে কাঁচা ছোলা খেতে হয়, কুস্তি লড়তে হয়, লাঠি-সড়কি-তলোয়ারের খেলা শিখতে হয়। বন্দুক ছোঁড়াও শিখতে হবে এর পর। আর খাওয়া শুকনো শুকনো বড়বড় রুটি, কিছু ডাল-তরকারি আর দুধ। ট্যাঁ-ফোঁ করবার জো নেই–যে-কেউ এসে ধাঁ করে। এমন এক-একটি পেল্লায় চড় কষিয়ে দেয় যে আধঘণ্টা ধরে মাথা-ফাথা বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে থাকে। প্রথম দিনে ছোলা খেতে রাজি হয়নি বলে একজন তো তাকে ঠ্যাং ধরে গদার মতো শূন্যে তুলেছিল, একটা আছাড় দিলেই একদম ঠাণ্ডা। ভাগ্যিস মুরলী হাঁ-হাঁ করে এসে পড়েছিল, নইলে সেই দিনই রাঘবলালের হয়ে যেত।
এই বাইশ দিনে অনেকটা অভ্যেস হয়ে এসেছে। ছোলা চিবুতে ভালো না লাগলেও খুব যে খারাপ লাগে তা-ও নয়। রুটি আর তরকারি এখন গোগ্রাসেই খায়-তবে গরম ঘি-ঢালা ভাতের মতো অত বেশি খেতে পারে না। খাওয়ার পরেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না, চোখে। ঝিমুনি ধরে না। মনে হয় অনেকখানি সে দৌড়ে আসতে পারে, লাফালাফি করতে পারে অনেক দূর পর্যন্ত।
শরীরটা বেশ ঝরঝরে হয়ে গেছে। ভুঁড়ি-টুঁড়িগুলো এর মধ্যে যেন চুপসে কোথায় চলে গেছে। এখন লাঠির ভারে কবজি আর ছিঁড়ে আসতে চায় না। রাঘব মাথার ওপর বনবনিয়ে ঘুরোতে পারে সেটাকে। প্যাঁচার ডাকে ভয় পাওয়া দূরে থাক, রাত্রে যখন ঘরের আশপাশ থেকে উ কা হু–উ কা হু বলে শেয়ালরা গলা ছেড়ে কী যেন জিজ্ঞেস করতে থাকে, তখন রাঘবলাল অঘোরে ঘুমোয়।
আগের সেই ভিতু, বোকা আর পেটুক রাঘবলাল অনেকটাই বদলে গেছে। এমন কি বাবা-মা বাড়ির জন্যে মধ্যে-মধ্যে খুব কান্না পেলেও এখানে সে যে খুব খারাপ আছে তা নয়। মুরলী তাকে খুব ভালোবাসে, কিষণলাল কখনও কখনও পিঠ চাপড়ে দেয়, বৃন্দা সিং-ও আর তেমন কটমট করে তার দিকে তাকায় না। আসল ভয় সেখানে নয়। রাঘবলাল জেনেছে, এরা ডাকাত। নানা জায়গায় ডাকাতি করে পুলিশের তাড়া খেতে খেতে এখন কিছুদিনের জন্য এই বলরামপুরের জঙ্গলে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। কী একটা মতলব নিয়ে কিছুদিন চুপচাপ করে রয়েছে কোনও একটা বড়গোছের কাণ্ড ঘটিয়ে এখান থেকে পালাবে। দিনের বেলা ওদের কেউ-কেউ গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর গেরুয়া পরে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরোয়–দুরের গঞ্জে যায়, দরকারি জিনিসপত্র কিনে-কেটে আনে। আর মাঝরাতে বৃন্দা সিংয়ের ঘরে বসে ফিসফিস করে কী সব আলোচনা করে। সে আলোচনা, রাঘবলাল তো দূরে থাক, মুরলীরও শোনবার জো নেই।
আর এই জন্যেই রাঘবলালের ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে, শেষ পর্যন্ত সে কিনা ডাকাতের দলে গিয়ে ভিড়ল! যে-ডাকাতরা মানুষ খুন করে, লুটতরাজ করে, ধরা পড়লে ফাঁসিতে কিংবা জেলে যায় তাদের সঙ্গে মিশে তাকে কাটাতে হচ্ছে! পারলে এই মুহূর্তে সে ছুটে পালাত। কিন্তু মুরলী তাকে বলেছে, বৃন্দা সিং মিথ্যেই শাসায়নি। তার চোখ চারদিকে খোলা। পালাবার চেষ্টা করলেই টুটি চেপে ধরবে, তারপর গভীর বনের ভেতর কোথায় একটা পোড়ো পুরনো কালীমন্দির আছে, সেইখানে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দেবে।
কী হবে রাঘবলালের? কী করবে সে?
সেদিন বিকেলে বসে বসে এইসব কথাই সে ভাবছে, এমন সময় মুরলী এল। দুটো কুড়ল তার দুহাতে।
বললে, চল রঘুয়া।
–কোথায় যেতে হবে?
–সর্দার বলেছে, রান্নার কাঠ নেই। বন থেকে কেটে আনতে হবে।
দুজনে বেরিয়ে পড়ল।
এর আগে এত গভীর বনের ভেতরে রঘু কোনওদিন ঢোকেনি। বড় বড় গাছের ছায়া কী অন্ধকার হয়ে আছে এখানে ওখানে। পায়ের নীচে কী স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডা মাটি। কত লতা, কত ঝোঁপঝাড়, কত রকমের ফুল ফুটেছে। তার ভেতরে ঝাঁটি ফুলগুলোকে রাঘবলাল চেনে, তাদের গন্ধে বন যেন ভরে রয়েছে। কোথাও বা কালো ভিজে মাটি ছেয়ে শিমুলের ফুল ঝরেছে-যেন বনের মধ্যে কে একখানা লাল কার্পেট পেতে রেখেছে। টুই-টুই করে মিষ্টি গলায় কী একটা পাখি ডেকে চলেছে একটানা।
মুরলী বললে, আমার বনে বনে ঘুরতে বেশ লাগে। তোর ভালো লাগে না?
একেবারেই নয়। কিন্তু সেকথা রাঘবলাল মুখ ফুটে বলতে পারল না।
আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা শুকনো মরা গাছ পাওয়া গেল। মুরলী বললে, এইটেকেই কাটা যাক–কী বলিস?
আচ্ছা।
মুরলী কুড়ল তুলে জোরে গাছটায় কোপ বসালো। কিন্তু কুড়লটা তখুনি টেনে তুলতে পারলে না–অনেকখানি বসে গিয়েছিল। মুরলী কুড়ল ধরে টানাটানি করছে, আর সেই তখন—
গর্—র—র্–
শুধু একবার একটা আওয়াজ, ঝোঁপ নড়বার শব্দ, তারপরেই যেন একরাশ সোনালি আগুন ঠিকরে উঠল বনের ভেতর থেকে। পরক্ষণেই যা দেখল তাতে মাথার চুল একেবারে খাড়া হয়ে গেল রঘুর। দেখলে, আর্তনাদ করে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছে মুরলী, আর তার পিঠের ওপর চেপে বসেছে বিরাট এক চিতাবাঘ। এক সারি ছোরার মতো তীক্ষ্ণ দাঁত মেলে গর্জন করছে : গর্—র—র্–
.
সাত
রঘুর চুল খাড়া হল–টিকিটাও যেন সোজা দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিতেই যাচ্ছিল–হঠাৎ তার কানে এল মুরলীর চিৎকার : বাঁচাও–বাঁচাও–
সংসারে কোনও মানুষ ভীরু–কেউ সাহসী, রাত্তিরে গায়ে আরশোলা পড়লে কারও দাঁতকপাটি লাগে, কেউবা অমাবস্যার মাঝরাতে একা শ্মশানে যেতে ভয় পায় না হাতে লাঠি বাগিয়ে দশজন ডাকাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুধু কি গায়ের জোরের জন্যেই? আরে না–না। মনের জোর থাকলে শরীরে শক্তি আপনি এসে যায়। মানুষ ভীরু হয় কেন? আঁচল-চাপা হয়ে থাকে বলে, জুজুবুড়ির ভয়ে ছমছমানি লাগে–সেইজন্যে।
রাঘবেরও তাই হয়েছিল। কিন্তু তেমন অবস্থায় পড়লে ভীরুর বুকেও তিনটে হাতির বল আসে। রাঘবলাল পালাতে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল।
ওদিকে মুরলী ডাকছে : বাঁচাও—বাঁচাও–
একমিনিট কি দু মিনিট–কিংবা তাও নয়। রাঘব নিজেও জানে না কী করে অত বড় কুড়লটাকে সে মাথার ওপর তুলে ধরল। তারপরেই ঝপাংকুড়লের কোপ পড়ল সোজা বাঘটার ঘাড়ের উপর। খ্যাঁ–অ্যাঁ–অ্যাঁ খ্যাঁক–একটা আওয়াজ করল বাঘটা, মুরলীকে ছেড়ে ছিটকে সাত হাত দূরে গিয়ে পড়ল। রাঘবের মতো ছোট ছেলের হাতের ঘায়ে তার শক্ত গায়ে মারাত্মক চোখ হয়তো লাগেনি, কিন্তু যেটুকু লেগেছিল তাই যথেষ্ট। ঘা-খাওয়া বাঘ প্রায়ই রুখে দাঁড়ায় কিন্তু এই বাঘটার বোধহয় এতেই আক্কেল দাঁত গজিয়ে গিয়েছিল। আর-একবার সে ঘ্যাও বলে আওয়াজ তুলল, তারপর বনের ভিজে ভিজে কালো মাটি আর শুকনো পাতার ওপর রক্ত ছড়াতে ছড়াতে চক্ষের পলকে হাওয়া হয়ে গেল।
রাঘবের কপাল বলতে হবে। মুরলীকে ছেড়ে বাঘটা তারই ওপর চওড়া হলে কী যে ঘটত-সে কথা জোর করে বলা শক্ত।
–তুই আমায় বাঁচালি রঘু! একথা আমি কোনওদিনই ভুলব না।
কিন্তু কাকে বলছে মুরলী? হাতে কুড়লটা ধরাই আছে–সেই মরা গাছাটায় ঠেসান দিয়ে বসে পড়েছে রঘু। তার চোখ দুটো বোজা-শরীর নিঃসাড়। এতক্ষণে সে সত্যিই জ্ঞান হারিয়েছে।
মুরলী আস্তে আস্তে তাকে ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল : রঘুয়া–রঘুয়া–এ রাঘবলাল বনের ভেতর ঝিরঝির করে হাওয়া বইছিল, দূরে কাছে তিতিরেরা এ-ওর সঙ্গে কথা কইছিল, ঘুঘু ডাকছিল ঘুম-ঘুম্ শব্দে। ভিরমির ভাবটা কেটে গিয়ে রঘু চোখ মেলল।
তারপরই কাতর গলায় বললে, মুরলী।
মুরলী রাঘবের কাঁধে হাত বুলিয়ে বললে, ভাইয়া, এই তো আমি!
–বাঘটা কোথায়?
–তোমার চোট খেয়েই তো পালিয়েছে।
–আমার?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগল রাঘব–যেন তখনও কিছু বুঝতে পারছে না।
–আরে, বাঘটা তো হাঁ করে আমায় কামড়াতে যাচ্ছিল–একটু হলেই গলায় দাঁত বসিয়ে দিত! ঠিক সেই সময় তুই কুড়ল দিয়ে জব্বর ঘা মেরে দিলি ওকে। মনে নেই। তাইতেই ল্যাজ তুলে ছুটে পালাল।
রাঘব উঠে দাঁড়াল–চোখ কচলাল বারকয়েক। তখন তার মুরলীর কথা মনে পড়ল।
–ভাই তোমার লাগেনি তো?
–না–না, সামান্য আঁচড়ে দিয়েছে। ও কিছু নয়।
রাঘব হঠাৎ মুরলীকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে। এই কদিনেই মুরলীকে সে যে কতখানি ভালবেসে ফেলেছে, যেন এইবার বুঝতে পারল সেটা! আর তার কান্নায় মুরলীরও চোখ ছলছল করে উঠল।
মুরলী বলল, চল ভাইয়া ফিরে চল। চোট-লাগা বাঘকে বিশ্বাস নেই বিশেষ করে চিতা। ঝোঁপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আবার কখন এসে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে। তখন আর সামলানো যাবে না। এই বেলা পালাই।
বৃন্দা সিংয়ের আড্ডায় রাতারাতি নিদারুণ খাতির বেড়ে গেল রাঘবলালের।
বৃন্দা সিং তার মস্ত গোঁফজোড়ায় তা দিয়ে, হঠাৎ কোনও কথা না বলে, রাঘবকে একেবারে শূন্যে ছুঁড়ে দিলে। রঘু আঁতকে উঠে আঁই আঁই করে উঠল! তার মনে হল, আবার বোধহয় সেদিনের মতো তাকে তুলে দেওয়া হচ্ছে গাছের ডালে। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও গাছ ছিল না, আর পড়তে-পড়তেই আবার তাকে লুফে নিল বৃন্দা সিং। আর ধরাম ধরাম করে গোটা কয়েক পেল্লায় চাঁটি পড়ল রাঘবের পিঠে। যেন রামা হো–রামা হো গাইবার তালে বেশ করে ঢোলক বাজিয়ে নিলে বারকয়েক।
কিন্তু রাঘবের পিঠটা ঢোলক নয়–লাগলও বিলক্ষণ। তবু রাঘব কেঁদে উঠতে পারল না। সে বুঝতে পারছিল, তাকে আদর করা হচ্ছে।
বৃন্দা সিং বললে, শাবাশ–শাবাশ, এই তো চাই! ডর-পোক হয়ে ননীর পুতলা হয়ে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়? চর্বির টিবি ছিলি, এইবার মানুষ হচ্ছিস। শেষে একদিন হয়তো তুই ই এই দলের সর্দার হয়ে উঠবি। তখন সারা হিন্দুস্থানের তোক বলবে, হাঁ ডাকু বটে রাঘবলাল–তার নাম শুনলে মিলিটারি ভি ডর খায়।
এই কথা শুনেই রাঘবলালের খারাপ লাগল। বৃন্দা সিংয়ের মতো ভয়ঙ্কর লোকও তাকে বাহবা দিচ্ছে–এতে মনটা খুশি হতেই পারে, কিন্তু বড় হলে সে নামজাদা ডাকাত হবে, এইতে রঘু ভারি দমে গেল। এই লোকগুলো সাংঘাতিক ডাকাত-পুলিশের ভয়ে এখানে লুকিয়ে আছে রঘু প্রাণপণে তা ভুলে থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই ভোলা যায় না। এক-একদিন রাত্রে বাইরে পাতার আওয়াজ কিংবা শেয়াল-কুকুরের চলার শব্দে তার মনে হয়, এই বুঝি পুলিশের দল বল আসছে, এদের সঙ্গে তাকেও ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে লটকে দেবে।
পালাতে পারলে সে বাঁচে এখান থেকে। কিন্তু মুরলী বলে দিয়েছে, বৃন্দা সিংয়ের দুটো চোখ এই বনের হাজার হাজার জোনাকির মতো চারদিকে জ্বলছে। পালাতে গেলেই ধরা পড়বে, আর তারপর
ওদিকে বৃন্দা সিংয়ের কথা শুনে কিষণলাল বললে, খালি রঘুয়ারই প্রশংসা করছ কেন সর্দার? ওকে লাঠি খেলা শিখিয়ে, কুস্তি লড়িয়ে মানুষ করেছে কে, সেটাও বলল।
বৃন্দা সিং বললে, আলবাত–আলবাত! কিষণলালেরও বাহাদুরি আছে বইকি!
কিন্তু রঘুর প্রশংসা শুনে একজনের গা জ্বালা করছিল, তার নাম ভুট্টারাম। বেঁটে চেহারার লোক ভূট্টারাম, মুখে বসন্তের দাগ, একটা চোখ আবার তার কানা। এই বলরামপুরের আচ্ছায় ভুট্টারামকেই রঘু একদম পছন্দ করে না। যখন-তখন মাথায় গাঁট্টা মারে, রঘুর টিকি ধরে টেনে দেয়। এক-একদিন রাত্রে শোয়ার সময় রঘুকে গা-হাত-পা টিপে দিতে বলে, পছন্দ না হলে ঠাঁই করে চড় বসায়। মুরলীও দুচক্ষে ভুট্টারামকে দেখতে পারে না, বলে, ও একনম্বরের বিচ্ছু।
সেই ভুট্টারাম মুখ বাঁকিয়ে একটা ছড়া কাটল :
তুফান সে কৌয়া গিরে
মৌলা বোলো দেখো খেল্।।
(অর্থাৎ ঝড়ে কাক মরে–আর মোল্লা বলছে, আমার ওস্তাদিটা দ্যাখো একবার!)
বৃন্দা সিং ধমক দিয়ে বললে, চোপরাও! তু তো একদম নিকম্মা; কারও ভাল দেখলে বুঝি সহ্য হয় না? ভাগ হিঁয়াসে!
সবাই হেসে উঠল, সব চাইতে বেশি করে হাসল রাঘবলাল। আর মুখটা গোঁজ করে সামনে থেকে সুড় সুড় করে চলে গেল ভুট্টারাম।
কিন্তু লোকটার পেটে পেটে কুবুদ্ধি। সেদিন রাতেই সেটা টের পাওয়া গেল।
সবাই তখন অঘোরে ঘুমুচ্ছে, হঠাৎ রাঘবলালের বাপ রে–মা রে চিৎকার।
মুরলী লাফিয়ে উঠল। বৃন্দা সিং, কিষণলাল, চামরি সিং, হনুমান প্রসাদ–যে যেখানে ছিল, টর্চ লাইট আর লাঠি-সোঁটা নিয়ে দৌড়ে এল। সেই বাঘটাই পিছে পিছে এসে চড়াও হল নাকি রঘুর ওপর।
–ক্যা হুয়া? ক্যা হুয়া?
–আমার গায়ের ওপর কী একটা জানোয়ার এসে লাফিয়ে পড়ল।
–জানবর? কাঁহা জানর!–বৃন্দা সিং খাঁটিয়ার তলায় টর্চ ফেলতেই দেখা গেল সেটাকে। প্রকাণ্ড একটা কোলা ব্যাঙ। রেগে বেগুন হয়ে বসে আছে আর ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে। তার কায়দাই আলাদা।
এই জানোয়ার! সবাই হেসে লুটোপুটি হল। আর এবারে সব চাইতে বেশি হাসল ভুট্টারাম।
–হো দেখা কেইসা পালোয়ান ব্যাঙের ভয়ে মুছা যায়! হাহা! ও আবার বাঘ মারবে। তুফানসে কৌয়া গিরে, মৌলা বোলে–
বৃন্দা সিং ব্যাঙটার ঠ্যাং ধরে বাইরে এনে ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দিলে। তারপর ধমক দিয়ে বললে, এতনা রাতমে হল্লা মত করো, সব কোই আব শো যাও।
সবাই শুতে গেলে মুরলী এসে বসল রঘুয়ার খাঁটিয়ায়। চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে, ব্যাঙটা এই ঘরের মধ্যে কেমন করে এল রে রঘুয়া?
–সে আমি কী করে জানব ভাই?
–বুঝলি, এ হচ্ছে ও বিচ্ছটার কাজ। ওই ভুট্টারামই বাইরে থেকে ওটাকে ধরে এনে তোর গায়ের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে। তুই যে বাঘটাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিস আর সবাই তোকে ভালো বলছে, এ ওর প্রাণে একেবারেই সইছে না। তাই সর্দারের কাছে তোকে বুন্ধু। বানাবার জন্যে কাণ্ডটা করেছে।
–ভুট্টারাম আমাকে একেবারেই দেখতে পারে না ভাই।–রঘু কাঁদো কাঁদো হল।
–দাঁড়া, ওকে মজা দেখাচ্ছি। কাউকে কিছু এখন বলিসনি, কাল রাত্তিরে এর বদলা নেব।
পরদিন বিকেলে লাঠি খেলা হয়ে গেলে রাঘবলাল যখন কোদাল নিয়ে কুস্তির জায়গায় মাটি কোপাচ্ছে, তখন কাউকে কিছু না বলে চুপি-চুপি বনের একদিকে চলে গেল মুরলী। ঝোঁপের ভেতর এক জায়গায় তার দরকারি গর্ত দেখেছে একটা। ফিরল অন্ধকার হলে–সকলের চোখ এড়িয়ে। দুটি ছোট-ছোট ঝাঁপির মতো নিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে যে কী লুকিয়ে নিয়ে এল রাঘবলালও তা জানতে পারলে না। কিন্তু জানল ভুট্টারাম। সেই মাঝরাত্তিরেই।
–জান গিয়া–জান গিয়া–মার দিয়া! সে কী বিকট চিৎকার! যেন সাতটা ষাঁড় এক সঙ্গে হাঁকাহাঁকি করছে ভুট্টারামের গলায়!
–কৌন মার দিয়া? কিসকো মার দিয়া? কেইসে মার দিয়া?
আবার দলবল নিয়ে, তেমনি লাঠি ঠ্যাঙা বাগিয়ে ছুটে এল বৃন্দা সিং। খাঁটিয়ায় বসে পরিত্রাহি চ্যাঁচাচ্ছে ভুট্টরাম। আট-দশটা লম্বা লম্বা কাঁটা বিঁধে আছে তার গায়ে, আর সে সমানে চিৎকার করছে : একদম মার দিয়া–জান মে মার দিয়া–
সবাই ব্যাপারটা ভালো করে বোঝবার আগেই ছোট একটা শজারু কিষণলালের পায়ের তলা দিয়ে ঝুমঝুম করে কাঁটা বাজাতে বাজাতে খোলা দরজা দিয়ে সুড়ৎ করে বাইরে নেমে গেল।
.
আট
এমনি করে সুখে-দুঃখে রাঘবলালের আরও কিছুদিন কাটল। কিন্তু মনের অস্বস্তি যেন কিছুতেই কাটে না। বৃন্দা সিং আর তার দলবলের মতিগতি কিছু বোঝা গাচ্ছে না। আপাতত বেশ আছে; রুটি পাকাচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ভালো মানুষের মতো দূরের গঞ্জে গিয়ে এটা-ওটা কিনে আনছে, আর এক-একদিন বেশ ঢোল বাজিয়ে প্রাণ খুলে গান গাইছে। আর রঘু কুস্তি করছে, লাঠি খেলছে, ডন-বৈঠক দিচ্ছে। এর মধ্যেই তার থলথলে ভুড়ি উধাও হয়েছে, গোলগাল মুখ ভেঙে চওড়া হয়ে উঠেছে চোয়ালের হাড়, ছাতি বেড়ে গেছে অনেকখানি, হাতের গুলি শক্ত হয়ে উঠেছে। এখন কিষণলাল তার সঙ্গে লাঠি খেলে, রঘু যখন ডান হাতে বাঁ হাতে চারের মতো ঘুরিয়ে তার মার আটকায়–তখন কিষণলাল খুশি হয়ে বলে, বহুৎ আচ্ছা-বহুৎ আচ্ছা।
আর মুরলী সবচেয়ে খুশি।
বলে–রঘুয়া, আর-একটু বড় হলে তুই আমাদের সব চাইতে জোয়ান হয়ে উঠবি। কেউ দাঁড়াতে পারবে না তোর সঙ্গে। এসব ভালো–খুব ভালো। কিন্তু–
কিন্তু যেই রাত হয়, বনের ওপর কালো ছায়া নামে, তারপর গাছপালাগুলো অন্ধকারে ভুতুড়ে হয়ে যায়, তখন রাঘবের মনের ওপরেও ছায়া পড়তে থাকে। আরও রাত বাড়ে, ঝাঁ ঝাঁ করে ঝিঁঝির ডাক উঠে সমস্ত বনটাকে যেন করাতের মতো চিরতে থাকে। কোথায় কীসব পাখি ডাকে কু কু কুক! মোটা গলায় মধ্যে মধ্যে হুতোম প্যাঁচা সাড়া তোলে, শেয়ালের আলাপ আসে, আর কখনও কখনও সব ছাপিয়ে অনেক দূরে গুমগুম করে শোনা যায় বাঘের ডাক।
সেই তখন—
রাঘবের ভয় করে? না!
কান্না পায়। মার কথা মনে পড়ে, বাবার জন্য ভারি কষ্ট হয়। বাবার যেসব কথা সে তখন শুনেও শুনত না, সেইগুলোও তার কানে বাজতে থাকে : তুই আমার একমাত্র ছেলে, তোর ওপরেই তো আমার সব ভরসা। দুদিন পরে বুড়ো হয়ে যাব–দোকানপাট আর। দেখতে পারব না–তখন তুই ছাড়া কে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে? কে আমাদের দেখবে? কে দুমুঠো খেতে দেবে? তুই মানুষের মতো মানুষ হ–তোকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করবার জন্যে আমার শেষ পয়সাটা অবধি আমি খরচ করব।
আরও মনে পড়ে, ক্লাসে মাস্টারমশাই বিলেতের কোন এক বড়লোকের গল্প বলেছিলেন। তাঁর বাবাও ছিলেন সামান্য দোকানদার। একদিন তাঁর অসুখ করেছিল, ছেলেকে বললেন, তুই আজ দোকানে যা! আদুরে ছেলে জবাব দিলে, এত রোদ্দুরে আমি যেতে পারব না। বাবা আর একটি কথাও বললেন না–সেই অসুখ নিয়েই রোদের মধ্যে দোকানে চলে গেলেন। বড় হয়ে সেই ছেলেটির সেজন্যে এত অনুতাপ হয়েছিল যে রোজ দুপুরে মাথার টুপি খুলে কিছুক্ষণ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেবেলার সেই অপরাধের শাস্তি নিত।
বাবার কথা, মাস্টারমশাইয়ের কথা তখন রঘুর এক কান দিয়ে ঢুকে আর কান দিয়ে গুলতির মতো ছিটকে বেরিয়ে অন্য কানে গেছে। সকালে ঘুম ভেঙেই ভাবত, এখন কী খাব। সরপুরিয়া না সরভাজা? দুপুরে থালার পাশে বারোরকম রান্না সাজানো থাকত। বিকেলে পাঁচ-সাতটা চমচম আর এক ভাঁড় রাবড়ি তো ছিল বাঁধা জলযোগ। আর রাত্তিরে খাওয়া-খাওয়া আর খাওয়া। ও-ই তখন একমাত্র লক্ষ্য, যাকে বলে ধ্যান-জ্ঞান-তপস্যা। কে শুনছে বাপের কথা,মাস্টারের কথা। চিরজীবন এমন করে খেয়েই দিব্যি কেটে যাবে।
কিন্তু রাতের বেলা বনের মধ্যে করাত চেরার মতো আওয়াজ করে যখন ঝিঁঝি ডাকে, যখন বাঘের ডাকে সমস্ত বলরামপুরের জঙ্গল গুমগুম করে ওঠে, যখন একা খাঁটিয়ায় রাঘবলালের আর ঘুম আসে না–তখন তার চোখ দিয়ে জল পড়ে। তারও সেই টুপি খুলে রোদ্দুরে। দাঁড়াবার মতো একটা কিছু করতে ইচ্ছে হয়। যদি সে কোনওদিন বাড়ি ফিরতে পারে তা হলে খাওয়ার কথা আর ভাববে না। বাবার কথা শুনবে-লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে চেষ্টা করবে।
অথচ, ফিরতে সে কি কোনওদিনই পারবে আর? বৃন্দা সিংয়ের চোখ এখন হাজার হাজার জোনাকি হয়ে পাহারা দেয়–এই বন থেকে সে প্রাণ নিয়ে বেরুতে পারবে না। ভয়টা আরও ঘন হয়ে রাঘবের বুকে চেপে বসতে চায়, যখন অনেক রাত পর্যন্ত গোল হয়ে বসে। দলবল নিয়ে বৃন্দা সিং চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে আলোচনা করে। তখন ওদের মুখগুলোকে মানুষের বলে বোধ হয় না–বাঘের মতো দেখায়।
রাঘব বুঝতে পেরেছে, ওরা কী একটা ভয়ঙ্কর ডাকাতির মতলব আঁটছে। আর তখনই রঘুর রক্ত আতঙ্কে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তার জীবন ডাকাতের দলের কাটবে। যারা মানুষ মারে, লুট করে! ফাঁসির আসামী হয়–দীপান্তরে যায়!
মুরলীকে জিজ্ঞেস করে : কী করি ভাই?
মুরলী বলে, জানি না।
–চল না, পালাতে চেষ্টা করি।
–কালী মাঈজীর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দেবে।
–সেও ভালো। কিন্তু কিছুতেই ডাকাত হতে পারব না!
মুরলী একটু চুপ করে থাকে। ওর চোখ দুটো ছল-ছল করে।
–পালিয়েই বা কী হবে? তোর নয় ঘর আছে–আমার কে আছে? আমি কার কাছে থাকব?
–কেন, আমাদের বাড়িতে যাবে। আমার মা বাবা খুব ভালো লোক, তোমাকে কত আদর করবে–দেখে নিয়ো।
মুরলী আবার চুপ করে থাকে। তারপর বলে, না সর্দারকে ছেড়ে আমি যাব না।
–তুমি সর্দারকে ভক্তি করো? ওইরকম ভয়ঙ্কর লোকটাকে?
–জানি না। খুব ছোটবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। কোন্ গ্রাম–বাপের নাম কী, কিছুই মনে নেই। কিন্তু সেই থেকে সর্দার আমায় মানুষ করেছে। নেমকহারামি করতে পারব না আমি।
রাঘব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মুরলীর দিকে। এই ছেলেটাকে সে বুঝতে পারে না।
এমন সময় হয়তো দাঁত বের করে এসে হাজির হয় ভুট্টারাম। লোকটাকে দেখলে গা জ্বলে যায়।
–কী মতলব আঁটা হচ্ছে দুজনে? খইনি-খাওয়া কালোকালো দাঁত দেখিয়ে ভুট্টারাম জানতে চায়। মুরলী বলে, তা দিয়ে তোমার কী দরকার?
–দরকার কিছুই নেই, কিন্তু এই রঘুয়াটা ভারি বদমাশ। একদিন আমি ওর বদন বিগড়ে দেব।
রঘু মুরলীর পাশে সরে আসে। মুরলী বলে, কেন, কী করেছে ও?
–আমার গায়ে শজারু ছেড়ে দিয়েছে।
–আর তুমি ওরু খাঁটিয়ায় ব্যাঙ ছেড়ে দাওনি?
–চুপ রহো–ভুট্টারাম খইনি-খাওয়া দাঁতগুলোকে খিঁচিয়ে বলে : তু ভি পহেলা নম্বর কা বিচ্ছু!
–একদম জানসে মার দেগা।
–তো আও—
ভুট্টারাম নাক ফুলিয়ে গরগর করে ওঠে। একবার হাঁটু দুটো থাবড়ে তৈরি হয় কুস্তিগিরের মতো, তারপর বুনো মোষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় ওদের দিকে।
ঠিক তক্ষুনি চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।
–হাঁ হাঁ–দেখো দেখো ভুট্টারাম! তোমার পায়ের কাছে একটা কাঁকড়া বিছে।
–আরে বাপ! বলে ভুট্টারাম তিড়িং করে লাফ মারে একটা, আর সঙ্গে সঙ্গে শুকনো ডাঙাতে পা পিছলে দড়াম করে রাম-আছাড়।
তখন রঘু আর মুরলীকে কে পায়? হাসতে হাসতে দুজনে টেনে দৌড়। আর ওদের ধরতে না পেরে পেছন থেকে চেঁচিয়ে গাল দিতে থাকে ভুট্টারাম : একদম মার দেগা–জান লে লেগা–টিকি উখার দেগা। ই বাত হম আভি কহ দেলা—হুঁ–হুঁ।
.
দুপুর বেলা কে যেন কোন দিকে চলে যায়, রঘু বুঝতে পারে না। এই পোড়ো বাড়িটা অন্তত ফাঁকা হয়ে যায় তখন। কিষণলাল কি ভুট্টারামের মতো দু-একজন হয়তো বা খাঁটিয়া পেতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়। বাকি মানুষগুলোর কোনও পাত্তা পাওয়া যায় না। এমন কি মুরলী পর্যন্ত কোথায় যেন কোন দিকে চলে যায়। তখন রঘু আপন মনে বেড়াতে বেরোয়।
খুব ঘন বন যেদিকে–সেদিকে যায় না। সেই চিতাবাঘটার কথাটা এখনও মনে আছে তার–সে কি সহজে ভোলবার মতো? মানুষের পায়ে-চলা পথ লক্ষ করেই সে এগোয়। দেখে ফুল ফুটেছে, পাখি ডাকছে, খরগোশ ছুটে পালাচ্ছে। রঘুর মনে পড়ে স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটাকে। গঙ্গার ধার দিয়ে লাল কাঁকরের পথ–তার দুধারে ঝাউয়ের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর কৃষ্ণচূড়ার ফুলে একাকার।
সব এখন স্বপ্নের মতো লাগে।
আজও রঘু এমনি করে নিজের মনে চলেছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এ কী! এ কোথায় এল সে।
একটা পুরনো মন্দির, তার গা বেয়ে বটগাছ উঠেছে। তবু মন্দিরটা বেশ পরিষ্কার মনে হয়, লোকের আসা-যাওয়া আছে এখানে। মন্দিরের সামনেই একটা দিঘি, পদ্মফুলে আর কলমি শাকে ছাওয়া। আট-দশটা ফাটল-ধরা সিঁড়ি নেমে গেছে সেই দিঘিতে।
বেশ জায়গাটা তো।
রঘু গুটিগুটি পায়ে মন্দিরের দিকে এগোল, ভেতরে আধো-অন্ধকার। তবু রঘু দেখতে পেল বেদীর ওপর কালো পাথরের কালীমূর্তি। লকলক করছে লাল টকটকে জিভ–চোখ দুটি কিসের তৈরি কে জানে–যেন ঝকঝক করে জ্বলছে। হাতে টিনের খঙ্গ নয়, আসল খাঁড়া একখানা–তার এক কোপে মানুষের গলা নামিয়ে দেওয়া যায়।
তা হলে এই সেই বৃন্দা সিংয়ের কালী মন্দির! দরকার হলে যেখানে সে নরবলি দিতে পারে।
কালীমূর্তিকে প্রণাম করবে কি–এখান থেকে এখন ছুটে পালাতে পারলে বেঁচে যায় রাঘবলাল। কিন্তু পালাতে পারল না। কে যেন দুটো গজাল ঠুকে তার পা দুটোকে সেইখানে আটকে দিলে।
রঘু দেখল, ঠিক যেন কালীমূর্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এল স্বয়ং বৃন্দা সিং।
–রঘুয়া! বাজের মতো গলায় বৃন্দা সিং ডাকল। রঘু কাঠ। গলা দিয়ে তার স্বর ফুটল না।
–তু হিয়াঁ আয়া কেঁও?–বৃন্দা সিয়ের চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতো ঘুরতে লাগল :
কাহে?
বৃন্দা সিং যেভাবে পা বাড়াল তাতে মনে হল, এখুনি সে দুটো সাঁড়াশির মতো হাত দিয়ে গলা টিপে ধরবে। রঘু একভাবে দাঁড়িয়ে রইল–যেন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক তখুনি রঘু চেঁচিয়ে উঠল : সর্দার, সর্দার,–তোমার মাথার ওপর সাপ।
লাফিয়ে সরে গিয়ে বৃন্দা সিং দেখে, ফাটা দেওয়ালের ভেতর দিয়ে একটা গোখোর ফণা দুলছে। আর একটু দেরি হলেই তার কপালে ছোবল বসিয়ে দিত।
তীরবেগে কালীর হাতের খাঁড়াটা খুলে নিয়ে বৃন্দা সিং–এক কোপ। সাপের মাথাটা তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ল। আর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল বৃন্দা সিংয়ের।
–তোকে মাপ করলাম। আর তুই আমার জান বাঁচালি। এ-কথা কোনওদিন আমি ভুলব না।
.
নয়
রাঘবের ভয় তখনও কাটেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখছিল, কুচকুচে কালো সেই সাপটার প্রকাণ্ড শরীরটা দেওয়ালের ফাটলের ভেতর থেকে বাইরে ঝুলে পড়ছে একটু-একটু করে–তখনও থর-থর করে কাঁপছে। তার কাটা গলা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। তারপর এক সময়ে ঝুপ করে এক বান্ডিল দড়ির মতো সাপটা মেঝের ওপর খসে পড়ল।
বৃন্দা সিং কয়েকটা শুকনো ফুলপাতা কুড়িয়ে খাঁড়াটা মুছে ফেলল। কালীমূর্তির হাতে সেটা আবার বসিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়াল রাঘবের পাশে। কাঁধে হাত রেখে ডাকল : রঘুয়া!
রঘু চুপ করে রইল। সর্দার বললে, ঠিক আছে, কালী মাঈজীই আজ তোকে পাঠিয়েছিলেন এদিকে। নইলে ওই সাপটা আমার কপালেই ছোবল বসিয়ে দিত। দুনিয়ার কোনও রোজাই আমাকে বাঁচাতে পারত না।
রঘু হাসতে চেষ্টা করল, হাসতে পারল না। বুকটা তখনও সমানে ঢিপঢিপ করছে তার। সর্দার বললে, আয় আমার সঙ্গে। দুজনে বনের পথ ধরে আড্ডার দিয়ে এগিয়ে চলল।
বৃন্দা সিংয়ের কর্কশ গলাটা নরম হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল : তোর মা-বাপের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়?
রঘুর চোখে জল এসে গেল। হাতের পিঠে চোখটা মুছে বললে, হুঁ।
–ফিরে গিয়ে কী করবি?
–ভালো করে লেখাপড়া শিখব। ইস্কুলে যাব।
–বাপের দোকানে মিঠাই চুরি করে খাবি না? রসগোল্লা, মোণ্ডা, দহি, ছানার জিলাপি। তা যদি না হত, তা হলে কি সে এই বলরামপুরের জঙ্গলে এমন ভাবে এসে পড়ত! পড়ত এই ডাকাতদলের পাল্লায়?
–না, আর ও-সব খাব না।
বৃন্দা সিং হেসে বললে, কেন, অরুচি ধরে গেল?
–তা নয়। ও-সব বেশি খেলে পেটে চর্বি হয়ে যায়, বুদ্ধি মোটা হয়।
–ঠিক বাত! সর্দার একটু হাসল, তারপর গম্ভীর ভাবে কি যেন ভাবতে লাগল।
রঘু কিছুক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে চলল, শেষে আর থাকতে না পেরে ডাকল : সর্দার!
বৃন্দা সিং যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল : কী বলছিস?
–আমায় সত্যিই ছেড়ে দেবে? দেশে চলে যেতে দেবে?
–ভেবে দেখব! সর্দার আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। যেন নিজের সঙ্গেই কথা কইতে লাগল সে : জানিস রঘুয়া, আমিও ইচ্ছে করে ডাকু হইনি। কোনওদিন যে আমাকে এই পেশা নিতে হবে সে কথা ভাবতেও পারিনি আমি।
রঘু অবাক হয়ে সর্দারের মুখের দিকে তাকাল।
বৃন্দা সিং বলে চলল : আমার দেশ কোথায়–জানিস? রাজস্থানে। তুই বাঙাল মুলুকে থাকিস, সে-দেশের কথা তুই ভাবতেও পারবি না। শুধু বালি আর পাথর। জল নেই বললেই চলে। ফসল একরকম হয়ই না। বড় বড় শহর আছে। রাজা আছে। বড়াবড়া শেঠজী আছে। মন্দির-মঞ্জিল আছে। কিন্তু গাঁয়ের মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আমারও খাওয়া জুটত না। আমার মা জয়পুরে ভিখ মাঙতে গিয়ে এক শেঠজীর হাওয়া-গাড়ির তলায়। চাপা পড়ে মরে গেল। তখন আর মাথার ঠিক রইল না রাগে-দুঃখে আমি ডাকু হয়ে গেলাম। পেট ভরে যদি এক বেলাও রুটি খেতে পেতাম তা হলে সব অন্যরকম হয়ে যেত।
রঘু ভয়ে ভয়ে বললে, সর্দার! আমিও ডাকু হতে চাই না। আমায় ছেড়ে দাও।
হঠাৎ বৃন্দা সিংয়ের লাল-লাল ভয়ঙ্কর চোখ দুটো দপ দপ করে জ্বলে উঠল।
–তারপর কী করবি? বৃন্দা সিং গর্জে উঠল : পুলিশের কাছে গিয়ে বলে দিবি আমার দলের কথা? তারা আমায় ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি লটকে দিক–এই তোর মতলব?
–না সর্দার।
–না সর্দার? বাঘের ডাকের মতো ফেটে পড়ল বৃন্দা সিংয়ের গলা : গোয়েন্দা সব গোয়েন্দা! কাউকে বিশ্বাস করি না আমি। শোন রঘুয়া! তুই মুরলীর জান বাঁচিয়েছিস, আজ আমাকে বাঁচিয়েছিস। তাই এবার তোকে আমি মাপ করলাম। ফের যদি এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলবি, তা হলে তোকে সোজা কালী মাঈজীর মন্দিরে নিয়ে খতম করে দেব। ইয়াদ রাখনা-হুঁশিয়ার!
বলেই ঝড়ের মতো বন ভেঙে কোন দিকে এগিয়ে গেল। রাঘবলাল সর্দারকে আর দেখতেও পেল না।
কাঠ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। আশ্চর্য মেজাজ বৃন্দা সিংয়ের কিছু বোঝবার জো নেই। এই দিব্যি মিষ্টি মুখে কথা বলছে, তারপরেই হঠাৎ রেগে গোঁ গোঁ করে উঠল : তখন তার মুখ চোখের দিকে তাকায় কার সাধ্যি? মনে হতে থাকে, এখন সে জ্যান্ত মানুষ ধরে বাঘের মতো কচমচিয়ে চিবিয়ে খেতে পারে!
বেশ বলছিল, নিজের কথা, বলছিল রঘুকে সে ছেড়ে দেবে, কিন্তু একটু পরেই কী যে হল!
রঘু তাকিয়ে দেখল, আড্ডার কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। কিন্তু এখন আর ওখানে যেতে ইচ্ছে করল না। একটা প্রকাণ্ড আমলকী গাছে অসংখ্য ফল ধরেছে, সরু সরু পাতার আড়ালে গোছায় গোছায় আমলকী সবুজ মার্বেলের মত ঝুলছে, কয়েকটা পাকা ফল ছড়িয়ে আছে তলায়। জায়গাটা পরিষ্কার দেখে রঘু সেখানে বসে পড়ল, দুটো আমলকী কুড়িয়ে নিয়ে চিবুতে লাগল অন্যমনস্কভাবে।
এখন বেলা পড়ে এসেছে। রঘুর মনে পড়ল, এই সময় তাদের স্কুলের ড্রিল পিরিয়ড। রঘু ভালো ড্রিল করতে পারত না। অ্যাটেনশন বললে ফল ইন, রাইট টার্ন বললে, লেফট টার্ন নিত। তখন তার খিদেতে নাড়ি চিনবিনিয়ে উঠেছে, কেবল ভাবছে, বাড়িতে মা আজ কী নতুন খাবার রেখেছে তার জন্যে! কিন্তু কুস্তি লড়ে, লাঠি খেলে রঘু ভাবছে, ড্রিল করার মতো এমন ভাল জিনিসও তার ভালো লাগত না–এমনি অকর্মা ছিল সে! সাধে কি ফিগার ভুল হলে ড্রিল মাস্টার ধীরেনবাবু এসে তার কান ধরে চাঁটি লাগিয়ে দিতেন?
আবার যদি কখনও ফিরে যেতে পারি। কিন্তু বৃন্দা সিং তাকে কি আর ফিরতে দেবে? ডাকু হয়েই বোধহয় তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে শেষ পর্যন্ত।
–আব তুমকো মিলা—
রঘু চমুকে তাকাতেই দেখল, সামনে ভুট্টারাম দাঁড়িয়ে। রঘু উঠে পড়ল। আর কতগুলো উঁচু-উঁচু বিশ্রী দাঁত দেখিয়ে ভুট্টারাম বললে, সেদিন তো খুব চালাকি করে পালিয়ে গেলি মুরলীর সঙ্গে। এখন যদি তোকে পিটিয়ে তুলোধুনো করি–কী করবি?
সে-রাঘবলাল আর নয়–যে প্যাঁচার ডাকে মূছা যেত। ভুট্টারামের কথায় তার গা জ্বলে গেল।
–তুমি আমায় মারবে কেন?
–তুই আমার খাঁটিয়ায় শজারু ছাড়লি কেন? আমার পিঠ ফুটো হয়ে গেছে।
রাঘবের বলতে ইচ্ছে হল, তোমার তো গণ্ডারের চামড়া, দুটো শজারুর কাঁটায় আর কী হয় তোমার? কিন্তু সে-কথা না বলে সে জবাব দিলে : তুমি আমার গায়ে ব্যাঙ দিয়েছিলে কেন?
ভুট্টারাম দাঁত খিঁচিয়ে বললে, বেশ করেছি। এখন তোকে মেরে আমি হালুয়া করে দেব। দেখি কে বাঁচায়।
রঘু মাথা সোজা করে বললে, খবর্দার!
–খবর্দার! আচ্ছা, দেখো তব—
দুটো হাত সামনে ছড়িয়ে নিয়ে ভুট্টারাম ঝাঁপিয়ে পড়ল রঘুর ওপর। রঘু অমনি কাঠবেড়ালির মতো সড়াৎ করে সরে গেল, আর ভুট্টারাম সোজা গিয়ে ধাক্কা খেল আমলকী গাছটার সঙ্গে। চেঁচিয়ে উঠল : আরেঃ বাপ!
রঘু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল।
ভুট্টারাম আনন্দে হেসে উঠল। উঁচু-উঁচু দাঁতগুলো চকচক করে উঠল তার। ছোরাটা তুলে সে রঘুর দিকে এগিয়ে গেল–এখুনি ওর বুকে বসিয়ে দেবে।
প্রাণের দায়ে চেঁচিয়ে উঠল রঘু : মুরলী–মুরলী–ভেইয়া–
–কোই নেহি। কোই তুমকো নেই বঁচায় গা–দাঁতে দাঁত ঘষে ভুট্টারাম ছোরাটাকে বাগিয়ে ধরল, কিন্তু ছোরা আর নামল না। তার আগেই কে তার হাত মুচড়ে ধরল। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল ভুট্টারাম, ছোরাটা মাটিতে পড়ে গেঁথে গেল।
রঘু দেখল, বৃন্দা সিং দাঁড়িয়ে।
বৃন্দা সিং একটা প্রকাণ্ড চড় বসিয়ে দিল ভুট্টারামের গালে। ঢাকের চামড়া ফেটে যাওয়ার মতো আওয়াজ উঠল একটা। আর একটা চড় পড়ল, তারপরেই ভুট্টারাম লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল মাটির উপরে।
কিন্তু শুয়ে থাকতেও পারল না। একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে সর্দার তক্ষুনি দাঁড় করাল তাকে। ভুট্টারামের চোখ দুটো বোজা, সারাটা শরীর তার টলছে। মুখটা ফাঁক হয়ে আছে, রক্ত দেখা যাচ্ছে দাঁতের গোড়ায় গোড়ায়।
সর্দার বললে, শাবাশ রঘুয়া। সব দেখেছি আমি। চল এখন আমার সঙ্গে। আগে ভুট্টারামের বিচার হবে, তারপর দুসরা কাজ।
আজ রাতেই এই বদমাশকে আমি বলি দেব।
ভুট্টারাম সেই অবস্থায় হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
–সর্দার মুঝে মাপ–
–মাপ! কভি নেহি! এই বাচ্চার সঙ্গে কুস্তিতে হেরে গিয়ে তুই ছোরা বের করিস। চোট্টা, ডর-পোক বদমাশ কাঁহাকা! তোর মতো লোক সঙ্গে থাকলে বৃন্দা সিংয়ের দলের বদনাম। তোকে আমি সাবাড় করে দেব।
–সর্দার!
–চোপ রহো! টুটি চেপে ধরে যেমন করে বেড়াল ইঁদুরকে ঝাঁকুনি দেয়, তেমনি করেই সর্দার তাকে ঝাঁকি দিলে। বললে, তোকে মরতে হবে। জরুর।
আর তখন রাঘবলালই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বৃন্দা সিংয়ের পায়ের কাছে।
–সর্দার, তোমার পায়ে পড়ছি, ভুট্টারামকে এবার মাপ করে দাও।
বৃন্দা সিং রঘুর দিকে তাকাল। আর রক্তমাখা দাঁতগুলো বের করে ট্যারা-ট্যারা চোখ দুটোকে মেলে ধরে স্বয়ং ভুট্টারাম হাঁ করে চেয়ে রইল রঘুর দিকে–সমস্ত ভয়-ডর ব্যথা ভুলে গিয়েই।
এমন অসম্ভব ঘটনা জীবনে সে কখনও দেখেনি।
.
দশ
ভুট্টারামের ব্যাপারটা নিয়ে খুব হইচই হল খানিকটা, আর বৃন্দা সিংয়ের আড্ডায়, রঘুর খাতিরও বেড়ে গেল সাংঘাতিক। বাচ্চা তো কেয়া–দেখা? ভুট্টারামকে কেউ পছন্দ করত না। লোকটার মন ভারি নীচ, আর ভয়ঙ্কর কুঁদুলে। কিন্তু সহজেই পার পেল না ভুট্টারাম।
প্রথমে তো রঘুর কাছে মাফ চাইতে হলই, তারপর দলের মধ্যে থেকে অকারণ গণ্ডগোল বাধানোর জন্যে তাকে পুরো তিন হাত টেনে নাক খত দিতে হল : ম্যায় ক্যায়সা কাম কভি নেহি করুঙ্গা–কভি নেই করুঙ্গা–
তবু আর রাগ রইল না ভুট্টারামের। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল, রঘুর দয়াতেই এ-যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সে। নইলে যেরকম খেপে গিয়েছিল বৃন্দা সিং, তাকে নরবলি দিয়েই ছাড়ত।
সেদিন রাতের বেলা ঘরে রঘুকে একা পেয়ে ভুট্টারাম গুটিগুটি পায়ে হাজির হল তার কাছে। এ-ভাই রাঘবলাল।
ভুট্টারামের এমন চিনিমাখানো মিহি গলা যে থাকতে পারে এর আগে তা কখনও ভাবাই যায়নি। হাঁড়িচাঁচার মতো বিশ্রী আওয়াজে সে বরাবর চোখ পাকিয়ে ডেকেছে : রঘুয়া!
কিন্তু গলার মোলায়েম আওয়াজে রঘুর সন্দেহ গেল না। সাবধান হয়ে খাঁটিয়ার ওপর সোজা পিঠ খাড়া করে বসল। ভুট্টারামকে বিশ্বাস নেই–কী মতলব সে আঁটছে কে জানে!
রঘু বলল, কী চাই আবার?
ভুট্টারাম আবার সেই চিনিমাখানো আওয়াজে জানাল যে, বিশেষ কিছুই সে চাইতে আসেনি, রাঘব আজকে সর্দারের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছে। এই কৃতজ্ঞতাটাই সে ভুলতে পারছে না কিছুতেই।
-ঠিক আছে, যাও।
-না ভাই রাঘবলাল, এ-শুধু মুখের কথা নয়। তোমার দয়ার কথা ভেবে আমি তোমায় কিছু উপহার দিতে চাই।
সে কী! উপহার?
কুতার ভেতর থেকে একটা আঙটি বের করে ভুট্টারাম বললে, ইঠো তোম্ লে লো ভাইয়া! হাঁ মামুলি সোনেকা চিজ।
–আমি সোনার আঙটি দিয়ে কী করব?
–রাখবে তোমার সাছে। সকলকে বলবে, ভুট্টারাম মুঝে ই আঙগোটি দিয়া।–বলো জোর করেই রঘুর হাতে গুঁজে দিলে আঙটিটা। রঘু বুঝতে পারল, তাকে উপহার দিয়ে ভুট্টারাম সর্দারের নেকনজর ফিরে পেতে চায়।
–এ তুমি কোথায় গেলে?
–এক ডাকাইতিসে মিলা থা। এক আউরত কি হাথসে ছিন লিয়া। ভুট্টারাম হাসল।
অর্থাৎ ডাকাতি করে পেয়েছিল আর একটি মেয়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল।
ভুট্টারাম চলে গেলে আঙটিটার দিকে চেয়ে বসে রইল রাঘবলাল। আঙটিতে একটা লাল পাথর ছিল, সেটি যেন এক ফোঁটা রক্তের মতো হয়ে জ্বলতে লাগল তার সামনে। একজনের কত আশার জিনিস এই আঙটি–সেটা জোর করে কেড়ে এনেছে। কে জানে তাকে মেরেও ফেলেছে কি না–যা নিষ্ঠুর লোক ভুট্টারাম। রঘুর চোখে জল এল।
এই আঙটি হাতে পরবে সে–এমন পাপের জিনিস! নিজের ভবিষ্যতের চেহারাটা যেন আঙটিটার ভেতর দেখতে পেল সে। সেও ডাকাত হবে–খুনী হবে–এমনি করে পরের জিনিস কেড়ে নেবে।
রাঘবলাল আর সইতে পারল না। আঙটিটা যেন হাতের মধ্যে আগুনের মতো জ্বলতে লাগল তার। ওটাকে সে অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যেই ছুঁড়ে ফেলে দিলে।
.
রাত তখন কত কেউ জানে না। বনের ওপর থমথম করছে অন্ধকার। আকাশে মেঘ হয়ে গুমট করে আছে–একটা পাতা পর্যন্ত নড়ছে না কোথাও। শুধু করাত দিয়ে কাঠ-চেরার মতো আওয়াজ তুলে ঝিঁঝি ডাকছে, পাখির ছানারা ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে উঠছে কখনও। একটু আগেই শেয়ালের ডাক উঠেছিল, অনেক দূর থেকে গুম গুম করে বেজে উঠেছিল বাঘের গর্জন। কিন্তু এখন কিছুই শোনা যাচ্ছে না আর।
গরমে ঘেমে-নেয়ে রাঘবলল অঘোরে ঘুমুচ্ছিল। স্বপ্ন দেখছিল, শনিবার তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, দুপুরবেলা, বই-খাতা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসছে সে। রাস্তায় ধুলো উড়ছে–আমের মুকুল থেকে গন্ধ উঠছে–একটা বকুল গাছের তলায় অনেকগুলো ফুল লাল হয়ে শুকিয়ে আছে।
সেই সময় কে তার কানে কানে ডাকল : রঘুয়া। স্বপ্নের ঘোরে রঘু ভাবল, মা। কিন্তু স্কুলের রাস্তায় মা কেমন করে আসবে?
আবার ডাক এল : রঘু!
রঘু ধড়মড় করে উঠে বসল। না, স্কুলের রাস্তা নয়। বলরামপুরের জঙ্গলে, সেই ভাঙা বাড়ির ঘরটায় মিটমিট করে জ্বলে একটা লণ্ঠনের আলো। পাশের খাঁটিয়ায় মুরলী অঘোর ঘুমে মগ্ন। তাকে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে ডাকছে তার গুরু কিষণলাল।
–কী হয়েছে গুরুজী?
–আও মেরা সাথ।
কোথায় যেতে হবে? হঠাৎ রঘুর দারুণ ভয় ধরল। সেই কালী মন্দিরে তাকেই বলি দিতে নিয়ে যাবে নাকি এখন?
কিছুই তো বলা যায় না–সর্দারের মেজাজকে একেবারেই বিশ্বাস নেই।
কিষণ হাসল : আও, কুছ ডর নেহি!
রঘু উঠে এল। তখনও চোখ থেকে ঘুমের ঘোরটা তার ভাঙেনি, তখনও আতঙ্কে বুকের ভেতরটা তার হাপরের মতো ওঠা-পড়া করছে।
কিষণলাল রঘুর হাত ধরে বললে, সর্দার বোলায়া।
–কেন?
–জরুরি কাম হ্যায়। আও!
কিষণলাল ভরসা দিল বটে, তবে রঘুর পা কাঁপতে লাগল। একটা পুতুলের মতোই কিষণলালের পেছনে পেছনে সর্দারের ঘরে এসে ঢুকল সে।
ঘরের মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে দলের সব বড়বড় জোয়ান। মাঝখানে বৃন্দা সিং। চাপা গলায় আলাপ চলছে তাদের মধ্যে।
রঘুকে দেখে সর্দারের চোখের দৃষ্টি যেন স্নেহে কোমল হয়ে গেল। বললে, আও বাচ্চা পাহালওয়ান, বৈঠো।
দলের সবাই হেসে উঠল।
রঘু ভয়ে ভয়ে বসে পড়ল কোনায়। এই সব চাঁইদের বৈঠকে কেন যে তাকে ডাকা হয়েছে তা সে বুঝতে পারল না। চিরদিনই সে আর মুরলী এসবের বাইরে থাকে।
সদর গম্ভীর হয়ে ডাকল :রঘুয়া।
–কহিয়ে সর্দার! দলে থাকতে থাকতে হিন্দীটা কিছু কিছু রপ্ত হয়ে এসেছে রাঘবের।
–তোমার সাহস আর বুদ্ধি দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। তাই একটা বড় কাজের ভার দেব তোমায়।
কিষণলাল রঘুর পিঠ চাপড়ে দিলে।
–শাবাশ রঘুয়া। সর্দার ডেকে কাজের ভার দিচ্ছে–আজ তুই জাতে উঠে গেলি।
সর্দার বললে, বলরামপুরের জঙ্গলে এই দুমাস আমরা কুটমুট বসে নেই। একটা বহুৎ ভারি মতলব আমাদের। সব ঠিক হয়ে গেছে এবার। কাল রাত দুটোর সময় ডাক-গাড়ি এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাবে, তখন আমরা সেটা লুট করব।
রঘুর চোখ কপালে উঠল।
সর্দার আস্তে আস্তে বলে চলল : সে তো এমনিতে হবে না, সে-গাড়ি উল্টে দিতে হবে, অ্যাকসিডেন্ট হবে–দুচারশো আদমি মরবে–সেই মওকায় আমরা লুট করে নেব সব।
সারা ঘরটা স্থির হয়ে রইল, একটা কথা বলছে না কেই। কেবল বাইরে থেকে একটানা করাত-চেরার মতো ঝিঁঝির ডাক উঠছে। লণ্ঠনের আলো বৃন্দা সিংয়ের প্রকাণ্ড মুখোনার ওপরে, ঠিক একটা রাক্ষসের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
–তাই,–সর্দার বলে চলল : লাইনের জোর খুলে দিতে হবে, ফিসপ্লেট সরাতে হবে। ব্যস–কাম পাকা।
দলের একজন আনন্দে বলে উঠল : আউর ডাক-গাড়ি কী দৌড় ভি খতম! বহুৎ রুপিয়া মিল জায়েগা সর্দার–সোনা চাঁদি ভি আ জায়গা।
–হাঁ, আয়েগা। উসি ওয়াস্তে–সর্দার আবার রঘুর দিকে তাকাল। তুমি কাল যাবে তেওয়ারির সঙ্গে। ফিসপ্লেট সরাতে হবে, ওর সঙ্গে কাজে হাত লাগাবে তুমিও। এই কাজই তোমাকে দিলাম। ইয়াদ রাখনা–তোমাদের কাজের ওপরেই ভরসা–মেল-গাড়ি যদি বেরিয়ে যায়, সব বরবাদ হয়ে যাবে। কারণ, এই জঙ্গলে আর আমরা বেশি দিন থাকতে পাব না–ডেরা ডান্ডা তুলতে হবে আমাদের। ক্যা রঘুয়া, পারবে তো?
কিষণলালই রঘুর হয়ে জবাব দিলে। আর একবার শিষ্যের পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বললে, জরুর। কাহে নেহি? আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি সর্দার, দেখে নিয়ে।
কিন্তু একটা কথাও বলতে পারল না রাঘব। সারা শরীরটা তার জমে পাথর হয়ে গেল, কপাল বেয়ে দরদর করে নামতে লাগল ঘামের স্রোতে। মনে হতে লাগল, যেন হাত-পা বেঁধে তাকেই কেউ একটা ছুটন্ত মেল-ট্রেনের চাকার তলায় ফেলে দিয়েছে।
.
এগারো
সমস্ত দিনটা রঘুর যে কী ভাবে কাটল, সে শুধু রঘুই জানে। রাত্রে যখন সর্দারের ঘর থেকে সে বেরিয়ে এসেছিল তখন তার সামনে সারা পৃথিবীটা ঘুরছে। সবাই যত বলছে, শাবাশ রঘুয়া, ততই তার হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইছে।
সর্দার তাকে সম্মান দিয়েছে। এমন বাচ্চা বয়সে এত বড় খাতির এর আগে কেউ পায়নি–এমন কি মুরলীও না। ভুট্টারাম তো ওদের চাইতে বেশ বড়, তবু তাকে কোনও বিশেষ কাজে সচরাচর ডাকা হয় না। আর রাঘব এই দুমাসের মধ্যেই একেবারে সর্দারের নিজের লোক হয়ে গেছে, কিষণলাল তো তার নাম করতে অজ্ঞান!
কাজটা কী? সব চাইতে দরকারি কাজ–অর্থাৎ মেল-ট্রেন আসবার একটু আগেই লাইনের জোড় খুলে দিতে হবে। তারপর গাড়িটা উল্টে পড়বে, কয়েকশো মানুষের প্রাণ যাবে, আর সেই ফাঁকে বৃন্দা সিংয়ের দলবল গাড়িটা লুট করে নেবে।
খুন? শুধু খুন নয়–কতকগুলো নিশ্চিন্ত নিরীহ মানুষ, কত বাচ্চা ছেলে, কত মা, কত বুড়োবুড়ি প্রাণ হারাবে। যারা বাঁচবে, কারও হাত কাটা যাবে, কারও পা উড়ে যাবে। এত বড় অন্যায় কি আর আছে? রাঘব কি কখনও এমন পাপ করতে পারে।
একবার ভাবল, মুরলীকে জাগিয়ে সব বলে, কিন্তু মুরলী কী করবে? সে যে কিছুতেই এ কাজ পারবে না–একথা সদাকে গিয়ে বলবার জো নেই। বৃন্দা সিংয়ের হুকুম না
পালানোটা হয়তো এখন একেবারে অসম্ভব নয়। সবাই তাকে বিশ্বাস করে, কেউ আর তার ওপর নজর রাখছে না। আজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আর কালই এখানকার আস্তানা তুলে ফেলবে বলে বাড়ির সামনেও কোনও পাহারা নেই। রঘু পালাতে পারে, সহজেই পালাতে পারে এখন।
সেই কখন বন কাঁপিয়ে, শেয়ালের ডাক উঠেছিল, এখন আবার ডাকল। তার মানে, রাত দুটোর কম নয়। এই সুযোগ। এদের সঙ্গে দুমাস কাটিয়ে রাঘবের এখন আর রাতকে ভয় নেই। সে দেখেছে মানুষের চাইতে বড় কেউ নয়, দুনিয়ার সব জন্তু-জানোয়ার মানুষকেই। ভয় করে চলে। যার গায়ে জোর আছে, মনে সাহস আছে–কোনও অন্ধকার, কোনও সাপবাঘ তার পথ আটকাতে পারে না।
রঘু নিজে খাঁটিয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওদিকের খাঁটিয়ায় মুরলী অঘোরে ঘুমুচ্ছে। এখান থেকে চলে গেলে ওর জন্যে মধ্যে মধ্যে রঘুর ভারি খারাপ লাগবে–ছেলেটা সত্যি-সত্যিই ভালোবেসেছিল ওকে। মুরলীর মা বাবা কেউ নেই, যাওয়ার কোনও জায়গা নেই, এদের। দলে থেকেই হয়তো ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে একদিন, নইলে কালাপানিতে গিয়ে পাথর। ভাঙবে।
মুরলীকে যদি সঙ্গে করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায় তো কেমন হয়? যদি বাবা-মার কাছে বলে, আমার একটি ভাই এনেছি, তোমরা ওকে আমার মতো করে মানুষ করো–তা হলে কী হয়? মাকে সে জানে–মা খুশিই হবে। কিন্তু বাবা? তার বাবাও তো ভালো লোক। শহরের সবাই বলে, রামগর্জন সিং খুব সাচ্চা আদমি, সে কখনও পচা মিঠাই বিক্রি করে না, কোনওদিন কাউকে ঠকায় না। তবু রাঘব পেটুক বলেই তাকে মাঝে মাঝে গালমন্দ করত আর নেহাত সইতে পারেনি বলেই তো অমন করে একটা রামলাঠি নিয়ে তাকে তেড়ে এসেছিল। এখন সে বুঝতে পারে, কী বিশ্রী লোভী ছিল সে, আর রাতদিন পেট-পুজোর। কথা ভাবলে মানুষ কত অপদার্থ হয়ে যায়। ভালো মানুষ বলেই রামগর্জন তাকে এতদিন। বাড়িতে রেখেছে। আর কারও বাপ হলে কবে পিটিয়ে রাস্তায় দূর করে দিত।
তা হলে মুরলীকে নিয়েই যাবে সঙ্গে করে? তাদের তো কোনও অভাব নেই। মুরলী তার আপন ভাইয়ের মতোই তো কাছে থাকতে পারবে।
ডাকবে মুরলীকে?
কিন্তু ডাকতে সাহস হল না। যদি মুরলী যেতে রাজি না হয়? যদি জানাজানি হয়ে যায়। থাক, দরকার নেই।
রঘু দরজা খুলল নিঃশব্দে। বাইরে ঝিঁঝির ডাকে ঝমঝম করছে বন। কী অন্ধকার চারদিকে! আকাশে এক-টুকরো চাঁদ হয়তো ছিল, কিন্তু গভীর কালো মেঘের তলায় সেটা ডুব দিয়েছে। আর সেই অন্ধকারে হাজার-হাজার জোনাকির সবুজ আলো জ্বলছে আর নিবছে।
একবারের জন্যে রঘুর হৃৎপিণ্ড কুঁকড়ে গেল, মনে হল, ওরা যেন বৃন্দা সিংয়ের হয়ে লাখ-লাখ চোখ মেলে পাহারা দিচ্ছে–এখনি বিকট স্বরে আকাশ কাঁপিয়ে উঠবে–সর্দার পালাচ্ছে, পালাচ্ছে—পালাচ্ছে–
রঘু থমকে দাঁড়াল।
সর্দারের ভয়ে, আর-একটা কথা তার মনে পড়েছে।
সে তো পালাবে! কিন্তু তারপর?
সর্দারের মেল-গাড়ি লুট করা তো বন্ধ থাকবে না, লাইনের জোড় খোলবার জন্যে লোকের অভাব ঘটবে না কোথাও। তেওয়ারি তো আছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে অন্য যে-কেউ চলে যাবে। গাড়ি ঠিকই ওলটাবে, মানুষ মরবে, আর
রঘুর মনে হল, সে তো পালাচ্ছে না–এতগুলো লোককে মরণের মুখে ঠেলে দিয়ে স্বার্থপরের মতো নিজের ঘরে চলে যাচ্ছে। কালকের মেল গাড়িতে তার বাব্রাও যে থাকবে না–একথাই বা কে জোর করে বলতে পারে? রঘু তো জানে, তার বাবাও নানা কাজকর্মে অনেক সময় রেলে চেপে কোথায় কোথায় চলে যায়।
কী করা যায়?
কোথাও থানায় গিয়ে খবর দেওয়া যায়, পুলিশের লোক ডেকে এনে বৃন্দা সিংকে দলবলসুদ্ধ ধরিয়ে দেওয়া চলে আজই। সকলেরই এই ঘুমন্ত অবস্থায়। কিন্তু তাই কি পারে রাঘবলাল? হোক ডাকাত, তবু তো বৃন্দা সিং তাকে ভালোবাসে, তাকে বিশ্বাস করে–শুধু শুধু নিমকহারামি করতে পারবে না।
তা হলে?
হঠাৎ আকাশের কালো মেঘে খানিক বিদ্যুৎ চমকাল, আর তারই সঙ্গে সঙ্গে রঘুর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তাদের স্কুলের একজন মাস্টারমশাই ছিলেন ব্রজবাবু। ছেলেরা তাঁকে খুব পছন্দ করত আর তাঁর ক্লাসে রঘুর মতো বোকা ছেলেও কান খাড়া করে একমনে বসে থাকত।
ব্রজবাবু পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ছেলেদের নানা গল্প বলতেন। সেই গল্পেরই একটা রঘুর মনের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল।
একটি ছোট ছেলে দেখল, রেলের পুলটা বর্ষায় ভেঙে গেছে আর সে-খবর না জেনেই একখানা রেলগাড়ি ঝকঝক করে ছুটে আসছে সেই পুলের দিকে। তখন ছেলেটি করলে কী–
রঘুর ভাবনা যেন সঙ্গে সঙ্গে সব কথার জবাব পেয়ে গেল। না, সে পালাবে না, তার চাইতে ঢের বড় কাজ তার করবার আছে। সে কাজ শেষ না হলে তার ছুটি নেই। তার জন্যে যদি তার প্রাণ যায়–সেও ভালো।
রঘু বুক ভরে একবার বাইরের ভিজে বাতাস টেনে নিলে শ্বাসের সঙ্গে, একবার চোখ ভরে দেখল, অন্ধকারে লাখো লাখো সবুজ জোনাকি জ্বলছে। তারপর দরজাটা আবার বন্ধ করে নিজের চারপাইতে ফিরে এল। শুতে পারল না, সারা রাত ঠায় বসে রইল আর শুনল, জঙ্গলের ওপর দিয়ে ঝড়ের আওয়াজ তুলে একটা ট্রেন ছুটে যাচ্ছে।
সেই ডাকগাড়ি!
পরের দিনটা রঘুর যেন আর কাটতে চায় না। মাথার ভেতরে সমানে ঝিমঝিম করে চলল, গলা শুকিয়ে উঠলে লাগল বার বার। ভালো করে সে খেতে পারল না, মন ভরে মুরলীর সঙ্গে গল্প করতেও পারল না।
মুরলী বললে, কী হল রে রঘুয়া?
–কুছ নেহি।
আজ রাতে কী একটা ভারি কাজ হবে–মুরলী ফিসফিসিয়ে বললে, সব তৈরি হচ্ছে।
তা হলে মুরলীকে এখনও কিছু বলেনি সর্দার! রঘু চুপ করে রইল।
মুরলী আবার বললে, তোর ভয় হচ্ছে না রঘুয়া?
রাঘব আস্তে-আস্তে বললে, যা হওয়ার হবে, মিথ্যে ভয় করে লাভ কী?
–এ হি তো ঠিক বাত! মুরলী বললে, আমার অবশ্য গোড়াতে খুব ভয় করত। এখন ভালোই লাগে।
–না-হক মানুষ মারতে ভালো লাগে?
ফস করে রাঘ রাঘব জিজ্ঞেস করে বসল।
মুরলী কেমন থতমত খেয়ে গেল। বললে, না খুন-জখম নয় তবে অনেক রুপেয়া আউর জেবরাত (গয়না) মিলে–
–এই টাকা-গয়না দিয়ে কী হবে মুরলী? মুরলী একটু চুপ করে রইল। তরপর বললে, ইয়ে সওয়াল তো ঠিক হয়, লেকিন
–লেকিন?
মুরলী আবার চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। যেন কী জবাব দিবে খুঁজে পাচ্ছে বা।
রঘু বললে, এখন হাতে কোনও কাজ আছে মুরলী?
কুছ না, কুছ না। কাজকাম যো কুছ হেবে, সে তো রাতের-বেলা। এখন ছুট্টি।
–তা হলে চল, বেড়িয়ে আসি।
–কোথায় যাবি?
–বনের ভেতর।
–বনের ভেতর! যদি বাঘ আসে?
–কিছু হবে না। রঘু হাসল : ডাকুকে বাঘেও ভয় পায়।
মুরলীও হাসল : চল তা হলে।
দুজনে বেরিয়ে পড়ল। ভিজে-ভিজে কালো মাটির ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়ে-চলা পথ–বৃন্দা সিংয়ের দলের মতোই দুজন বেপরোয়া মানুষ চলাচল করে কেবল তা দিয়ে। সরকারি জঙ্গল হলে হয়তো সরকারের লোকজনের আসা-যাওয়া থাকত, গাছের গায়ে নম্বর পড়ত, একটা জঙ্গল-অফিসও থাকত হয়তো। কিন্তু এই বনের মালিক কোন্ রাজাবাহাদুর–অনেক আগে বড় বড় সাহেবদের নিয়ে শিকার খেলতে আসতেন–এখন সেসব বন্ধ হয়ে গেছে। জঙ্গল পড়ে আছে–খুশিমতো কাঠুরিয়ারা এসে বাইরে থেকে দুটো-চারটে গাছ কাটে, কিন্তু বাঘের ভয়ে কেউ সাহস করে ভেতরে ঢোকে না। তাই বৃন্দা সিংয়ের পক্ষে একটা চমৎকার আস্তানা বলরামপুরের জঙ্গল। রাজাদের কালীবাড়িতে এখন ডাকাতেরাই পুজো চড়ায়।
দুজনে চলতে লাগল। এখানে-ওখানে থোকায় থোকায় আমলকী যেন সবুজ ফটিকের গুচ্ছের মতো দুলছে। ভাঁট ফুল ফুটেছে হলদে-লাল আরও নানারকম অজানা ফুলে ছেয়ে গেছে ঝোঁপঝাড়, মাটির বুক থেকে এক-একটা নীল আলোর মতো জেগে উঠেছে ভূঁইচাপা। কয়েকটা পলাশ-শিমুল লালে লাল। বনে বসন্ত।
রঘুর মনে পড়ল, এই সময় সরস্বতী পুজো হয়ে যায়–স্কুলের প্রতিমাকে তারা পলাশ ফুল দিয়ে ঢেকে দিত; তারপর আসত দোল। সেই আবির-পিচকারিকুম নিয়ে সারাদিন কী আনন্দ। রঘুর মাথায় টুপি পরিয়ে, গায়ে রং আর কালিঝুলি মাখিয়ে ছেলেরা তাকে হোলির রাজা সাজাত–সবাই তাকে ঠাট্টা করত। কিন্তু এখন তার মনে হল, এদের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার দোলের রাজা সাজতে পারাও কত সুখের কত আনন্দের ব্যাপার।
মুরলী বললে, এই রঘুয়া–কী ভাবছিস?
–কিছু না।
–আয়, বসি কোথাও।
–বোস।
এক জায়গায় অনেকখানি জুড়ে প্রকাণ্ড একটা গাছ দাঁড়িয়ে। মোটা মোটা অসংখ্য শিকড় মাটি খুঁড়ে উঠেছে তার। গাছটায় ফিকে লাল রঙের ফুল ফুটেছে অজস্র; একটা মিঠে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বনে, হাওয়ায় বৃষ্টির গুঁড়োর মতো পাপড়ি ঝরছে। অসংখ্য খুদে মৌমাছির ভিড় জমেছে গাছটাতে। দুজনে তারই দুটো শিকড়ে পড়ল।
–আচ্ছা মুরলী?
–কী রে?
–আজ রাতে একটা ডাকাতি হবে কোথায়–না?
–তাই তো মনে হচ্ছে। মুরলীকে নির্বিকার মনে হল। এসবে এখন আর ওর কিছু বিশেষ আসে-যায় না, অনেকদিন ধরে দলের সঙ্গে থাকতে থাকতে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে এ-সমস্ত।
–মানুষ মরবে?
–মরতে পারে দু-চারজন। আবার যদি কিছু গোলমাল না করে সব দিয়ে দেয়, তা হলে কাউকে কিছু বলবে না সর্দার। এদিকে সর্দারের দিল খুব দরাজ।
–আচ্ছা, দলের লোক মরে না কখনও।
–মরে বই কি ধরাও পড়ে। কভি কভি গাঁয়ের লোকের সঙ্গে জবর লড়াই ভি হয়–তখন দুদলেই পাঁচ-সাতজন ঘায়েল হয়ে যায়। এই তো তিন-মাহিনা আগে-মুরলী অন্যমনস্ক হয়ে গেল : ছারা জিলার এক গাঁয়ের মহাজনবাড়ি আমরা লুটতে গেলাম। বাড়িতে বন্দুক ছিল, গাঁওবালা আদমি ভি এসে হাজির হল। জোর লড়াই বাধল তখন। এদের পাঁচ-সাতজন খতম হল, আমাদের তিন-তিন জোয়ান ভি। মুরলীর চোখে জল এল : জানিস রঘুয়া, ফাগুলাল ছিল আমারই বয়েসী, তোর চাইতেও আমার ভারি দোস্তি ছিল তার সঙ্গে। মহাজনের গুলিতে তার পায়ে এমন চোট লাগল যে এক-পা আর চলতে পারে না। তাকে আনাও যায় না-ফেলে আসাও যায় না। পুলিশের হাতে পড়লে সব হয়তো কবুল করে দেবে। তখন সর্দার কী করলে জানিস? তলোয়ারে এক কোপে একদম জিন্দা ফাগুলালের মাথাটা কেটে নিলে, তারপর সেই মুণ্ডুটা খানিকটা দুরে দরিয়ায়
–থাক, থাক, আর বলতে হবে না- রঘু কান চেপে ধরল।
–এখন শুনতে খারাপ লাগছে, কিন্তু তোরও অভ্যেস হয়ে যাবে। হয়তো আজ রাতেই দেখছি, আমি ঘায়েল হয়ে পড়েছি–সর্দার তোকেই হুকুম দিয়ে বলবে, এ রঘুয়া, মুরলীকা শির কাট লে। তোকেও তাই করতে হবে।
–ও-কথা ছেড়ে দে মুরলী-রঘুর যেন দম আটকে এল : আচ্ছা, এই যে দল বেঁধে খুন-ডাকাতি হয়, টাকা-গয়না জোগাড় হয়, তারপর সেগুলো দিয়ে কী করে?
–কেন ভাগবাটোয়ারা হয়।
–তারপর?
–সবই নিজের নিজের ভাগ নিয়ে খরচা করে, ফুর্তি করে। তা ছাড়া যাদের ঘরবাড়ি দেশ-গাঁ আছে, তারা দো-চার মাহিনার জন্যে বাড়ি চলে যায় ভালো মানুষের মতো কাজকারবারও করে। পুলিশের ঝামেলা কম হলে আবার এসে দল বাঁধে, দুতিন মাহিনা এখানে-ওখানে ডাকাতি করে ফের ঘরে ফিরে যায়।
–ঘরে তাদের মা বাপ বহিন-ভাই বালবাচ্চা আছে?
মুরলী হাসল :হ্যাঁ অনেকেরই আছে। খালি আমি আর সর্দার একদম সাফ। তখন বৃন্দা সিং ইয়া বড় এক দাড়ি লাগিয়ে লাগিয়ে সাধু সেজে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরে, কোথায় কার ঘরে কেমন সোনা-দানা আছে তার খবর নেয়। আর আমি তার চেলা হয়ে পিছে পিছে বেড়াই।
–তোমাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের মা বাপ ভাই-বোন ছেলে-মেয়ে আছে, তারা কেমন করে মানুষ খুন করে ভাই মুরলী?
–বললুম তো হাত দুর হয়ে যায়। তখন মুরলী মারা আর মানুষ মারায় কোনও তফাত থাকে না।
–আর ধরা পড়লে?
–ফাঁসি কা তক্তা। গলায় দড়ি পরে ড্যাং ড্যাং করে দু-মিনিট বহুৎ মজাদার নাচ। ব্যস, উসকে বাদ খেল খতম।-মুরলী হি-হি করে হেসে উঠল আবার। আর রাঘবের মনে মুরলী কী অসহ্য নিষ্ঠুর–মন বলে, মায়া-মমতা বলে ওরও বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই আর।
আজকে রঘুর প্রথম রাত। তারও প্রথম হাতেখড়ি। কিন্তু কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য টদিয়ে। একজন-দুজন নয় কয়েকশো নিশ্চিন্ত নিরীহ মানুষকে খুন করে। চমৎকার।
ভাবতে ভাবতে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে আসে! তাই, ভেবে আর দরকার নেই। যা হওয়ার হবে।
রঘু আলোচনাটা ঘুরিয়ে নিলে।
–তোর ছেলেবেলার কথা কিছু মনে নেই মুরলী? বৃন্দা সিংয়ের কাছে আসবার আগেকার কোন কথা?
মুরলী যেন চমকে উঠল। তারপর চেয়ে রইল সামনের দিকে–যেখানে পলাশের মাথাগুলো লালে লাল, যেখানে সোনালি আলোয়লতার জালে কয়েকটা কুল গাছ ঢাকা পড়ে গেলেও একরাশ লাল-হলুদ পাকা ফল উঁকি মারছে তার ভেতর থেকে। একজোড়া ঘুঘু ওদের সামনেই উড়ে পড়ে মাটি থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল, ওদের বসে থাকতে দেখেও এতটুকু ভয় পেল না, পাখিদের সোনা নেই, টাকা-গয়না নেই–তাই ডাকাতদের তারা ভয়ও পায় না।
–আমার ছেলেবেলা? বচ্পন? মুরলী যেন ঘুমের মধ্যে থেকে জেগে উঠল : একটু-একটু মনে আসে ভাই। যেন স্বপ্নের মতো লাগে। একটা ভৈষাঁর পিঠে চড়ে বাবার সঙ্গে চলেছি। পথের ধারে জলের ভেতর পদ্মফুল ফুটেছেলতায় লতায় সিঙাড়া ধরেছে। দূরে মহাবীরজীর একটা লাল ঝাণ্ডা দেখা যায় বটগাছের মাথায়–সেখানে মেলা বসেছে–এতদূর থেকেও মানুষের গলার আওয়াজ শুনি। আমি যেন বাবাকে বলি, বাবা মেলায় গিয়ে আমাকে লাড়ু আর জিলাবি কিনে দিতে হবে।
–তারপর? রঘুর চোখ চকচক করে উঠল।
–আবার দেখি,–তেমনি ঘুমভাঙা গলায় বলে চলল মুরলী : কোথায় যেন রামলীলা হচ্ছে। ঢোলক বাজছে করতাল বাজছে সীতা মাইজী নেচে নেচে গান করছে, কোত্থেকে চলে এল দুশমন রাবোয়া। সীতাজীকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর বাবার কোলে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম।
মুরলী দীর্ঘশ্বাস ফেলল : আর কিছু মনে নেই।
–আমার মা বাবার কাছে যাবি মুরলী?
মুরলী অদ্ভুত উদাস দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। জবাব দিল না।
–যাবি মুরলী?
মুরলী হয়তো এবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, আবার চকচক করে উঠেছিল তার চোখ দুটো। কিন্তু কোনও কথা বলবার সে সুযোগ পেল না। তার আগেই বন কাঁপিয়ে বাঘের ডাকের মতো গম্ভীর গলা ভেসে এল : মুরলী–মুরলী–
দুজনেই চমকে কান খাড়া করল। কে ডাকছে?
আবর লহরে লহরে ভেসে আসতে লাগল সেই ডাক : মুরলী–এ মুরলী? কিধার গিয়া রে তুম?
–সর্দার।
মুরলী লাফিয়ে উঠল। চল রঘুয়া, শিগগির চল। কী কাজে যেন ডাক পড়েছে।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল সে। সাড়া দিয়ে বললে, আতা হুঁ সর্দার, আভি ম্যায় আতা হুঁ—
রাঘব ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে চলল পেছনে পেছনে। পা দুটো তার আর চলতে চায় না। মুরলীর কাছ থেকে কথাটার জবাব পাওয়া গেল না। আর পাওয়া গেলেই বা কী লাভ হত? আজকের এই দুঃস্বপ্নের রাতটার পরে রঘুই কি আর কখনও নিজের বাবা-মার কাছে ফিরে যেতে পারবে?
দিন কাটে–রোজ যেমন কাটে। এরই মধ্যে চলল আলাপ-আলোচনা, তলোয়ারে শান দেওয়া বন্দুক পরিষ্কার করা। চাপা উত্তেজনা থমথম করছে চারদিকে। ভুট্টারাম লাফিয়ে উঠছে থেকে থেকে, বহুৎ দিনোঁকে বাদ আজ এক ভারি কাম হোগা। কিন্তু সেই ভারি কাজটা যে কী, সে তা এখনও জানে না। ভুট্টারামের লাফানি দেখে এত দুঃখের মধ্যেও হাসি পাচ্ছে রাঘবের।
একবার কিষণলাল এসে জিজ্ঞেস করল, ভয় হচ্ছে নাকি রে রঘুয়া?
–নেহি গুরুজী।
কিষণলাল বললে, বহুৎ আচ্ছা। পহেলি দফে কলিজা সবারই একটু গড়বড়ায়, কিন্তু তোর দেখছি খুব শক্ত। বড়ে খুশিকা বাত।
দিন কাটল, সন্ধ্যা নামল, রাত হল। পোড়ো বাড়িটার ঘরে ঘরে মিটমিটে আলো জ্বলল। অন্য দিন নটা বাজতে-নাবাজতে জোয়ানের দল খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে, উঠে পড়ে রাত চারটের পরেই। কিন্তু আজ আর কারও চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। সবাই তৈরি হচ্ছে।
এগারোটা–বারোটা—
তখন তেওয়ারি এসে ডাকল :রঘুয়া চল—
মুরলী অবাক হয়ে বললে, ও কোথায় যাচ্ছে?
–কাম মে! তেওয়ারি হেসে বললে : আও রঘুয়া!
রঘু বেরিয়ে গেল তেওয়ারির সঙ্গে। অবাক হয়ে চেয়ে রইল মুরলী–ব্যাপারটা এখনও সে বুঝতে পারছে না।
দুজনে দুটো টর্চ নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে দিয়ে এগিয়ে চলল। আজও তেমনি লাখে লাখে জোনাকি জ্বলছে, চারদিকে সেই থরেথরে অন্ধকার–বনের গাছপালা কন্ধকাটার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু রঘু কিছু টের পাচ্ছিল না। ঝিঁঝির ডাক ছাপিয়ে তার কান ভরে বাজছিল নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ।
যেতে যেতে সব বুঝিয়ে বলল তেওয়ারি। রঘু শুনতে লাগল।
তেওয়ারির হাতে যে-থলেটি আছে তার মধ্যে রয়েছে হাতুড়ি, সাঁড়াশি, রেঞ্চ–এইসব। এইগুলো দিয়ে লাইনের তিন-চারটে জোড় সে খুলে দেবে। রঘু আলো ধরে তাকে সাহায্য করবে।
ব্যস, আধি ঘণ্টেকে কাম। এর মধ্যে সর্দার তার দলবল নিয়ে তৈরি হয়ে চলে আসবে। একটু পরেই আসবে ডাকগাড়ি। উসকে বাদ–ওর পরে কী যে হবে, সেটা আর তেওয়ারি বলল না। দু-তিনবার টেনে-টেনে হাসল, আর সেই হাসি শুনেই রঘুর রক্ত যেন জল হয়ে গেল।
জঙ্গল পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু-জনে যেখানে এল, সেখান থেকে স্টেশন প্রায় চার মাইল দূরে। এইখানটাই সবচেয়ে নিরিবিলি; এর ত্রিসীমানাতে জনমানুষেরও চিহ্ন নেই। তেওয়ারি বললে, ইধার বহুৎ শের (বাঘ) ভি হ্যায়। কিন্তু শেরাও ডাকুকে ভয় করে, তার কাছে এগোয় না।
দুপাশে ঘন বন, মাঝখান দিয়ে রেলের লাইন চকচক করেছ। চাঁদ নেই, কিন্তু আকাশ-ভরা তারার আলোয় আইন জ্বলছে, সাদা সাদা নুড়িগুলো পর্যন্ত ঝিকমিক করছে। তেওয়ারি বললে, হিয়াঁ–
তেওয়ারি বানিয়ে বলেনি। আধঘণ্টার মধ্যেই লাইন থেকে দুজনে গোটা-চারেক জোড় খুলে ফেলল, লোহার বলটুগুলোকে তেওয়ারি ছুঁড়ে-ছুঁড়ে দিল বনের মধ্যে। বললে, উপরসে কুছ মালুম নেহি হোগা, লেকিন গাড়ি যব আয়েগা, তব–
কাজ শেষ করে দুজনে জঙ্গলের মধ্যে নেমে এল। খানিকটা যেতেই চোখেমুখে টর্চের আলো এসে পড়ল একরাশ।
বৃন্দা সিং দলবল নিয়ে হাজির।
–হো গিয়া?
–হে গিয়া সর্দার।
–ঠিক হ্যায়।–একবার হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল বৃন্দা সিং–আউর পর (পনের) মিনট। সব কোঁই এইি বৈঠ যাও।
সব ছায়ামূর্তির মতো বসে রইল সেখানে। ঝিঁঝির ডাক বেজে চলল, বনের পাতায়-পাতায় হাওয়া উঠল, দূরে যেন বাঘের ডাকও শোনা গেল একবার। কারও মুখে কোন কথা নেই। মুরলী শুধু একবার ফিসফিস করে ডাকল, রঘু। কিন্তু রঘুকে পাশে দেখতে পেল না, কোথায় যেন উঠে গেছে সে।
ঝম্ ঝম্ ঝম্! চাকার আর লোহার শব্দ–একটা গভীর বাঁশির আওয়াজ। মেল ট্রেন আসছেদূরের বাঁকটা ঘুরছে। আর তিন মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে জোড় খোলা লাইনের ওপর।
সর্দার বললে, সব তৈয়ার?
–তৈয়ার?
ট্রেন আসছে–আরও কাছে আসছে। কিন্তু এ কী। জোড়ের মুখে আসবার ঠিক আগেই জোরালো একটা বাঁশি বাজিয়ে বিকট আওয়াজে থেমে গেল কেন? এমন তো কথা ছিল না। বারোজোড়া চোখ জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল বাঘের মতো।
ও কে? টর্চের মুখে লাল কাপড় বেঁধে এখনও লাইনের ওপর দোলাচ্ছে কে? ওই তো গাড়িটাকে ঠিক জোড়ের মুখে থামিয়ে দিয়েছে। ট্রেনের সার্চলাইটের আলোয় তাকে চিনতে আর কারও বাকি নেই।
–বঘুয়া! বেইমান!–এক মুরলী ছাড়া এগারোটা গলা একসঙ্গে গর্জন করে উঠল।
বৃন্দা সিং বন্দুক তুলল। দাঁতে দাঁত ঘষে বললে, পহেলে উসকো খতম কর দেনা–
বন্দুক তুলল, কিন্তু ট্রিগার টানতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, মন্দিরে সেদিন সাপের হাতে নির্ঘাত মরণ থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল রঘু। যো জান দিয়া, উসকো জান লেনা? রামরাম। রাজপুত কখনও একাজ করতে পারে?
কিন্তু ট্রিগার টানল কিষণলাল। দুম করে শব্দ, নীল আগুনের ঝলক, তারপর একটা চাপা চিৎকার করে রঘু লাইনের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
.
বারো
ততক্ষণে একটা বিরাট হইহই শুরু হয়ে গেছে চারদিকে।
ড্রাইভার ফায়ারম্যান সব নেমেছে, গার্ড এগিয়ে এসেছেন। ট্রেনের ঘুমন্ত যাত্রীদের কাছেও পৌঁছে গেছে খবরটা। দেখতে-দেখতে তিন-চারশো লোক জড়ো হয়ে গেছে সেখানে।
–ক্যা হুয়া?
–হোয়া দি ম্যাটার?
–কী হয়েছে কী হয়েছে?
ইঞ্জিনের দিনকরা আলোতে কী যে হয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই কারও। মাত্র সাত-আট হাত আগেই লাইনের দুধারে নাট বল্ট আর ফিসপ্লেট ছড়ানো। ঠিক সময়মতো গাড়িটা থেমে না গেলে কী যে হত তা ধারণাও করা যায় না। মারাত্মক অ্যাসিডেন্ট হত–গাড়ি উল্টে পড়ত, কতগুলো মানুষের যে প্রাণ যেত কে বলতে পারে!
আর এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা থেকে ট্রেনটাকে যে বাঁচিয়েছে সে–
যেন লাইনের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে রঘু। লাল কাপড়ে জড়ানো টর্চটা ছিটকে চলে গেছে দূরে, মাথা থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে।
কে এ? কোথা থেকে এল? ট্রেনের ড্রাইভার বলল, গাড়িটা থেমে যাওয়ার মিনিট খানেক পরেই সে বন্দুকের মতো আওয়াজ শুনেছে একটা। মনে হয়, পাশের জঙ্গল থেকে ছেলেটাকে গুলি করেছে কেউ।
পাশের জঙ্গল–তা বটে! লাইনের দু ধারে ঘন কালো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে যেন অন্ধকারের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। সেই জমাটি কালো বনের গায়ে হাজার হাজার জোনাকির আলো লাখ-লাখ ভূতের চোখের মতো জ্বলছে আর নিবছে। ট্রেন-থেমে-যাওয়া অদ্ভুত নিস্তব্ধতার ভেতরে তীব্র স্বরে ঝিঁঝির ডাক উঠছে-মনে হচ্ছে যেন হাজার করাত চালিয়ে আকাশটাকে কারা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে চাইছে।
কে একজন শুকনো গলায় বললে, এ বলরামপুরের জঙ্গল। বাঘ-ভালুক আছে–ভয়ানক জায়গা।
কিন্তু এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলের ভেতর কোথা থেকে এল এই ছোট ছেলেটি–ট্রেনটাকে এমন সাংঘাতিক অপঘাত থেকে বাঁচিয়ে দিলে? আর বনের মধ্যে থেকে কেইবা তাকে গুলি করে বসল?
চারদিকে তাকিয়ে গাড়ির তিন-চারশো যাত্রীর বুক ছমছম করতে লাগল!
যাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন ডাক্তার এগিয়ে এলেন। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন রাঘবের পাশে।
রঘু একবার নড়ল, একবার চাপা গলায় বললে, মা–তারপরেই আবার নিঃসাড় হয়ে গেল।
ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন। তখনও নিঃশ্বাস পড়ছে। কিন্তু–
বুকের ডান দিক থেকে রক্ত গড়িয়ে রেলের সিপার আর নুড়িগুলো রাঙা হয়ে গেছে। ডাক্তার রুমাল দিয়ে রক্ত মুছে ফেললেন। ঠিক কাঁধের নীচে বিঁধেছে গুলিটা। ডানদিক বলেই বেঁচে আছে এখনও। বাঁ দিক হলে সোজা হৃৎপিণ্ডে চলে যেত।
ডাক্তার দাঁড়িয়ে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে আমার ডাক্তারি বাক্সটা কেউ নিয়ে আসুন শিগগির।–দেরি করবেন না—
চার-পাঁচজন লোক তৎক্ষণাৎ তাঁর বাক্স আনতে ছুটল।
আর ঠিক সেই সময়—
ভিড় ঠেলে একটা মানুষ এসে দাঁড়াল। মেঘের মতো গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলে!-কেয়া দেখা ডাক্তার সাব? জিন্দা হ্যায়-ইয়া মর গিয়া?
দুতিনশো লোকের চোখ এক সঙ্গে তার দিকে গিয়ে পড়ল। বিরাট চেহারা, দুটো আগুনের ভাঁটার মতো চোখ, বুনো বাঘের মতে ভয়ঙ্কর হিংষ তার মুখ। কাঁধে বন্দুক ঝুলছে। লোকটা এমন বীভৎস দেখতে যে তার দিকে তাকানো মাত্র প্রাণ কেঁপে ওঠে।
সমস্ত যাত্রী তবু আতঙ্কে তারই দিকে চেয়ে রইল। একটা কথা বলতে পারল না কেউ।
লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলে জিন্দা হ্যায় ডাক্তার সাব?
ডাক্তার বললে, এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু কিছু বলা যায় না। গাড়ি ব্যাক করিয়ে এখুনি। একে কোনও শহরে নিয়ে যেতে হবে; যেখানে হাসপাতাল আছে। অপারেশন করার পরে বোঝা যাবে সব।
–নাও বাঁচতে পারে?
ডাক্তার বললেন, বলেছি তো, কিছুই বলা যায় না।
সেই বিরাট জোয়ানটা লাইনের ওপর বসে পড়ল–যেন শিকারির গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল একটা পাগলা হাতি। তারপর ঝুঁকে পড়ল রঘুর ওপর। ভাঙা গলায় বলতে লাগল : রঘুয়া, রঘুয়া, মুঝে মাপ করে দে! তুই বেইমান নোস–বেইমান এই বৃন্দা সিং।
যে জান দেয়, রাজপুত কখনও তার জান নেয় না। রঘুয়া, মুঝে মাফ কর দে—
ডাক্তার কেবল সাহস করে কথা বলতে পারলেন–কে–কে তুমি?
–আমি ডাকাত বৃন্দা সিং, আমিই গাড়ি লুটতে চেয়েছিলাম। বৃন্দা সিংয়ের দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল : এই গাড়িতে কোনও পুলিশ নেই? আমাকে গিরেফতার করো–থানে মে লে যাও, আমার ফাঁসি হোক। জান দেনেওয়ালার জান যে নিতে পারে, ফাঁসিকাঠই তার আসল জায়গা।
ডাক্তারের ব্যাগ এসে পড়েছিল। হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেও যেন ভুলে গেলেন তিনি।
.
রাঘবের জয়যাত্রা আমি এই পর্যন্ত লিখছি, এমন সময় ধড়াম করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। লম্বা-চওড়া হাসিমুখ সার্জেন্টটি এসে ঢুকল আমার ঘরে।
দাদা, কী লিখছেন?
আমি হেসে বললুম, তোমাদের কীর্তি কাহিনীই শোনাচ্ছিলাম রামধনুর হোট ছেলেমেয়েদের।
–বোসো রাঘব, বোসো।
হ্যাঁ, ঘরে ঢুকেছে রাঘবলাল সিং। সেই পেটুক ক্যাবলা ছেলেটি আর নেই। যেমন স্বাস্থ্য তেমনি বুদ্ধিতে ঝলমল করছে চোখ-মুখ।
ঘর কাঁপিয়ে হাহা করে হেসে উঠল রাঘব।
–আমার কীর্তি? তা বটে। জীবনে কী দিনগুলোই যে গেছে।
বললাম, সেই দুঃখের অভিজ্ঞতা না হলে তুমি তো মানুষ হতে পারতে না রাঘব। আর সেদিন নিজের প্রাণ দিয়েও তুমি ট্রেনটাকে বাঁচাতে পেরেছিলে বলেই তো ট্রেনের যাত্রী পুলিশ কমিশনারের চোখের ওপর পড়েছিলে। ভালো কথা, বৃন্দা সিংয়ের খবর কী?
–ভালই আছে বুড়ো। জেল থেকে বেরিয়ে জয়পুরের যে-ছোট দোকানটা করেছিল সেটা বড় হয়েছে এখন। আমাকে দেওয়ালির আশীর্বাদ করে পাঠিয়েছে।
–মুরলীর আর কোনও সন্ধান পাওনি?
রাঘবের মুখের ওপর ছায়া পড়ল। একবারের জন্য ছলছল করে উঠল চোখ।
–আজ পনেরো বছরের ভেতরেও তার কোনও খোঁজ পাইনি দাদা। সেই রাতে বলরামপুরের জঙ্গলে সে চিরদিনের মতো মুছে গেছে। হয়তো কিষণলালের সঙ্গে থেকে এখনও ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে, হয়তো কোথাও পুলিশের গুলি খেয়ে মরেছে, হয়তো বা সদরের মতো ভালো হয়ে ঘরে ফিরে গেছে–
রাঘবলাল বললে, জানি না দাদা।
মস্ত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। আমরা দুজনেই বিষগ্রভাবে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। সেই সময় ঘরে ঢুকলেন আমার কাকিমা। তাঁর হাতে প্রকাও একথালা মিষ্টি।
–রাঘবের গলার আওয়াজ পেয়ে বিজয়ার মিষ্টি নিয়ে এলুম।
রাঘব উঠে দাঁড়িয়ে কাকিমাকে প্রণাম করলে, তারপর আমাকেও।
–আরে, তাই তো ভুলে গিয়েছিলুম যে। কিন্তু কাকিমা, এ যে প্রায় সেরদেড়েক মিষ্টি! খেতে পারব?
কাকিমা বললে, এমন জোয়ান ছেলে—এ-কটা খেতে পারবে না কেন? খাওখাও।
–তোমার বাবার দোকান থেকেই এসেছে।
আমি হাসলুম : তুমি যদিও এখন আর নিজেদের মিষ্টি খাও না–তবু এই ছানার জিলিপিগুলো একবার পরখ করে দেখতে পারো। চমৎকার হয়েছে।
–ছানার জিলিপি! সেই মারাত্মক ছানার জিলিপি!
আবার অট্টহাসিতে ঘর কাঁপিয়ে তুলে রাঘবলাল খাবারের থালাটা কাছে টেনে নিলে।