শীতের মিষ্টি নরম রোদে জয়ধ্বজ মণ্ডল–যার ডাকনাম জয়–নতুন ঝকঝকে সাইকেলটায় চড়ে বেরিয়ে পড়েছিল।
সাইকেলটা এত নতুন, এত সুন্দর, আর প্যাড়লে পা ছোঁয়াতেই এমন তরতর করে চলে যে, জয়ধ্বজের মনে হচ্ছিল সে যেন একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া কিংবা ময়ূরপঙ্খী নৌকোয় চড়ে এগিয়ে চলেছে। গ্রাম ছাড়িয়ে জয়ধ্বজ চলল স্টেশনের রাস্তায়। কোনও কাজ আছে, তা নয়। আজ রবিবার–দোকান বন্ধ। জয়ধ্বজের ছুটির দিন। এই দিনটাতে–স্টেশনের পাশে নেপালদার চায়ের দোকানে আড্ডাটা ভারি ভালো জমে। বিশেষ করে আচার্য বাড়ির সুকুমার–যাকে ট্যাঁপা বলে সকলে জানে, জয়ধ্বজের যে প্রাণের বন্ধু, তাকেও পাওয়া যাবে সেখানে। ক্রিসমাসে কলেজ বন্ধ, ট্যাঁপা কলকাতার হস্টেল থেকে দেশে এসেছে।
সাইকেলে করে যেতে যেতে ভারি ভালো লাগছিল জয়ধ্বজের। সাইকেলটা তাকে দিয়েছেন তার মামা ভীমরাজ পুরকায়েত। নাম ভীমরাজ হলেও মামা মোটেই ভীমের মতো দশাসই নন-লম্বা রোগা চেহারা, গলায় তুলসীর মালা, ভীষণ বৈষ্ণব–মাছ-মাংস-পেঁয়াজ স্পর্শ করেন না। মামীও খুব ভালো মানুষ-বাড়িতে বসে রঙ-বেরঙের দড়ি দিয়ে নানা রকম শিকে তৈরি করেন, থালার মতো সব বড় বড় ফুল-টুল কাটা বড়ি বানান, ক্ষীর আর নারকেল দিয়ে অনেক রকম মিষ্টি করতে পারেন। পলাশপুরের বাজারের সব চাইতে বড় কাপড়ের দোকানটার মালিক হলেন মামা। তাঁর ছেলেপুলে নেই, জয়ধ্বজ তাঁর একমাত্র ভাগনে। সবাই জানে, মামা তাঁর জমি-জমা, দোকানপাট সব জয়ধ্বজকেই দিয়ে যাবেন।
জয়ধ্বজের বাবা রেলে চাকরি করতেন। তার পাঁচ বছর বয়সের সময় তিনি একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। সেই থেকে মামা বিধবা ছোট বোন আর ভাগনেকে দেখাশোনা করছেন।
লেখাপড়ায় জয়ধ্বজ যে খুব ভালো তা নয়। একবার ফেল করে যখন থার্ড ডিভিশনে স্কুল-ফাইন্যাল পাশ করল, তখন মামা বললেন, খুব হয়েছে, আর পড়ে কাজ নেই।
শুনে জয়ধ্বজের চোখে জল এসে গেল।
বা রে, আচার্যিদের ট্যাঁপা যে কলেজে পড়তে যাচ্ছে।
ভুরু কুঁচকে মামা বললেন, ট্যাঁপা ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছে–দুটো লেটার পেয়েছে। ও কলেজে পড়বে না তো কে পড়বে? আর তুই? স্কুল-ফাইন্যালে একবার ডিগবাজি খেলি, একশো-দেড়শো টাকার চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াবি তো? কী লাভ তাতে, শুনি? ব্যবসাই লক্ষ্মী, জানিস তো? আমার দোকানে ভিড়ে পড় ব্যবসা শেখ–মানুষকে না ঠকিয়ে সৎপথে থাক–দেখবি, ধুলোমুঠো সোনা হয়ে যাবে।
জয়ধ্বজ গোঁ হয়ে বাড়ি চলে এল।
অবশ্য, জয়ধ্বজের নিজের যা জমিজমা আছে, তাতে এক রকম করে তার কলেজে পড়বার খরচটা যে চলে না যেত, তা নয়। ছেলের কষ্ট দেখে মারও দুঃখ হল। আর নিজের ছেলে বি-এ, এমএ পাশ করে পণ্ডিত হবে–কোন্ মা-ই বা তা চান না? কিন্তু দাদার বুদ্ধির ওপরে তাঁর অগাধ বিশ্বাস, তিনি জানেন, দাদা যা করেন তা ভালোর জন্যেই।
মা বললেন, মন খারাপ করিসনি বাবা-দাদা যা বলছেন, তাতে তোর ভালোই হবে। আমার বাবা তো সাত-আট বিঘে জমি আর বাস্তুভিটেটুকু ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। দাদা নিজের চেষ্টায় অত বড় ব্যবসা গড়ে তুলেছে, অত সম্পত্তি করেছে। দাদার কথা শুনে চল, তাতে তোর উন্নতিই হবে।
কী আর করা–ভীষণ মন খারাপ করে জয়ধ্বজ মামার দোকানে চাকরি করতে গেল।
প্রথম প্রথম বেজায় বিরক্তি লাগত। কোথায় ট্যাঁপা কলকাতায় মজা করে কলেজে পড়ছে কত নতুন জিনিস শিখছে, ফাঁকে ফাঁকে কখনও যাচ্ছে গড়ের মাঠে খেলা দেখতে, কখনও চিড়িয়াখানায়; আর সে এই দোকানে বসে সমানে শুনছে : নামা ধনেখালি, আন শান্তিপুরী, দেখা বেগমপুর।
তারপর আস্তে-আস্তে সয়ে গেল। তারও পরে ভালো লাগতে শুরু করল। মামা ভীমরাজ পুরকায়েত আগাগোড়া নজর রাখেন তার দিকে। ভুলচুক হলে ছোটখাটো ধমকও দেন–এ ব্যবসার কাজ বাপু, সব সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
অবশ্য মামার উদ্দেশ্য আলাদা। এত বড় ব্যবসাটা যার হাতে তুলে দিয়ে যাবেন, তাকে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে যাওয়া দরকার- সব সময় লক্ষ রাখা উচিত তার ওপরে। ত্রিশ বছরের পরিশ্রমে যে-দোকান তিনি গড়ে তুলেছেন, আনাড়ির হাতে তা নষ্ট হয়ে যাবে, ভীমরাজ তা কোনওমতেই সইতে পারবেন না।
আজ দুবছর ধরে ভাগনের কাজকর্ম দেখে মনে হয়েছে, না–ছেলেটার বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, ওর ওপর ভরসা করা যায়। খদ্দেরের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে, কথা কইতে জানে, আগের চাইতে বরং দোকানের কাটতি বেড়েছে। তাই খুশি হয়ে এবার ভীমরাজ জয়ধ্বজকে একখানা ভালো সাইকেল কিনে দিয়েছেন।
সাইকেল তো নয়–যেন রাজত্ব। যেদিন সকালে ব্রাউনপেপারে মোড়া নতুন সাইকেলটা তাকে দেখিয়ে মামা বললেন, ওটা তোর, তোকে দিলুম– সেদিন জয়ধ্বজ প্রথমটা বিশ্বাসই করতে পারেনি। একটা সাইকেলের শখ যে তার কতদিনের–সে কথা তার চাইতে বেশি আর কে জানে! এ যে না চাইতে হাতে স্বর্গ পেয়ে যাওয়া।
সাইকেলে চড়ে যেদিন প্রথম পথে বেরোল–মনে হল সে যেন মূর্তিমান সম্রাট।
নতুন সাইকেল-ঝকঝক তকতক করছে। তার রঙের গন্ধ, তার নতুন সিটের গন্ধ, তার চকচকে চেন, তরতর করে তার ছুটে চলা আঃ। গ্রামে তো আরও অনেক সাইকেলই আছে, কিন্তু রংচটা, ঝরঝরে, বুড়োটে। তার সাইকেল তাদের মাঝখানে রাজার রাজা।
বাঃ বেড়ে সাইকেলটি তো। লোকে মুগ্ধ হয়ে বলে।
হুঁ-হুঁ, মামা দিয়েছে।
তা দেবেই তো। ভীমরাজের তো আর পয়সার অভাব নেই।
এই সাইকেল নিয়ে জয়ধ্বজ পাগল। দুবেলা ধুয়ে-মুছে তকতকে করে রাখে। সবার সাইকেল থাকে বাড়ির বারান্দায় কিংবা উঠনে, কিন্তু জয়ধ্বজ রাত্রে তুলে রাখে শোওয়ার ঘরে। যতক্ষণ ঘুম না আসে, চেয়ে-চেয়ে সাইকেলটাকে দেখে। আলো-নেবানো ঘরে সাইকেলটা চিকচিক করে–মনে হয়, জয়ধ্বজের দিকে তাকিয়ে খুশির হাসি হাসছে সে।
নতুন সাইকেল পিচের রাস্তায় প্রাণের খুশিতে এগিয়ে যাচ্ছিল জয়ধ্বজ। সাইকেল তো চলেছে না, যেন উড়ছে। মাঠে তখনও শীতের শিশিরের গন্ধ–ছোলা আর কলাই শাকে ধানকাটা মাঠে সবুজের ছোপ, খেজুরগাছের ঝরা রসের কলসিতে ভিড় জমিয়েছে মৌমাছি আর ভীমরুলের ঝাঁক। জয়ধ্বজের মনে হল, জগতে এই মুহূর্তে তার মতো সুখী বোধহয় আর কেউ নেই!
সুখের মাত্রাটা আরও বাড়ল, যখন নেপালদার চায়ের দোকানের সামনেই চোখে পড়ল ট্যাঁপাকে।
ট্যাঁপা বললে, তোর নতুন সাইকেল বুঝি? চমৎকার হয়েছে তো।
কিন্তু সাইকেল তো আছেই। ট্যাঁপাকেই পাওয়া যাবে না। কদিন পরেই তার কলেজ খুলবে, সে চলে যাবে কলকাতায়। কত গল্প জমে আছে তার কাছে, কত খবর শোনবার আছে কলকাতার। সাইকেলটা দোকানের সামনে রেখে ট্যাঁপার গলা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে জয়ধ্বজ দোকানে ঢুকল। চেঁচিয়ে বললে, নেপালদা-দুগেলাস ভালো চা আর সব চেয়ে ভালো বিস্কুট।
.
ঘণ্টা দুই জমাট আড্ডা চলল। তারপর ট্যাঁপা বললে, চল, তোর নতুন সাইকেল দেখি।
তুই দেখে কী করবি?–জয়ধ্বজ হাসল : তুই তে পড়ুয়া ভালো ছেলে, সাইকেলে চাপতে পর্যন্ত জানিসনে।
তোর ক্যারিয়ারে উঠব।
খুব ভালো কথা। জয়ধ্বজ খুশি হয়ে বললে, আজ দিনটা ভারি সুন্দর, চল–তোকে ক্যারিয়ারে বসিয়ে ঈশানীতলার কালীমন্দির পর্যন্ত বেড়িয়ে আসি।
ট্যাঁপা আনন্দে হাততালি দিয়ে বললে, গ্র্যান্ড আইডিয়া।
কিন্তু বাইরে বেরিয়েই–
জয়ধ্বজ চমকে উঠল : ট্যাঁপা, সাইকেলটা তো দেখছি না।
সে কী রে।
এখানে–এই জায়গাতেই তো ছিল। তালা দিয়ে গিয়েছিলুম।জয়ধ্বজের মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল মাটিতে এই তো চাকার দাগ। কিন্তু সাইকেলটা কোথায় গেল? কেউ চুরি করে নিলে না তো?
চুরি!–ট্যাঁপা খাবি খায় : সে কী রে।
তা হলে যাবে কোথায়? নেপালদা–নেপালদা–
একটা ভাঙা পেয়ালায় ডিম ফেটাচ্ছিল নেপালদা, সেইটে হাতে করে লাফিয়ে বেরিয়ে এল সে। এল দোকানের আরও তিনজন খদ্দের। না, সাইকেলের খবর তারা কেউ জানে না। শীতের এই সকালে চারদিকের এই আলোর ভেতর-নতুন সাইকেলটা–জয়ধ্বজের ময়ূরপঙ্খী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
জয়ধ্বজ একেবারে ধপ করে বসে পড়ল ধুলোর উপর।
.
দুই
সত্যিই সাইকেলটা উধাও! দিনে-দুপুরে হাওয়া!
না–কেউ কিছু জানে না। অথচ নেপালদা যেখানে দাঁড়িয়ে চা বানায়, ওমলেট তৈরি করে কিংবা টোস্ট ভাজে, সেখান থেকে তিন-চার হাত দূরেই সাইকেলটা ছিল। সাইকেলটা ছিল, বলতে গেলে, নেপালদার একেবারে চোখের সামনে। যে বাচ্চা ছেলেটা নেপালদার অ্যাসিসট্যান্ট সে তো সারাক্ষণই বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল। তা হলে কে এর মধ্যে সাইকেলটা নিয়ে সরে পড়ল?
এ যে পি সি সরকারের ম্যাজিককে হার মানিয়েছে।
অবিশ্যি বাচ্চাটা একবার একটু দূরের টিউবওয়েলটায় জল আনতে গিয়েছিল; নেপালদাও হয়তো ভেতরে তখন চা-টা কিছু দিচ্ছিল তার খদ্দেরদের। সেই ফাঁকেই নিয়ে সটকেছে খুব সম্ভব। খুব ওস্তাদ চোর বলতে হবে! একেবারে তক্কে তক্কে ছিল।
ভারত্তিক বঙ্কিম পাণ্ডা বললেন, যা–নন্দীগ্রাম থানায় খবর দিয়ে আয়।
নেপালদা বললে, ছাই হবে। পুলিশের দারোগা থাকে তার হাজারো রকমের কাজকর্ম নিয়ে। সাইকেল-চোর খুঁজতে তার বয়ে গেছে।
বঙ্কিম পাণ্ডা মাথা নেড়ে বললেন, তা বটে, তা বটে। তবু চুরির ব্যাপার যখন, পুলিশে খবর একটা দিতেই হয়।
ট্যাঁপা বললে, তাই ভালো জয়, চল–আমরা থানাতেই যাই। অমন করে বসে পড়লে তো চলবে না–এমন চমৎকার ঝকঝকে সাইকেলটা, যেমন করে তোক উদ্ধার করতেই হবে।
সুরেশ হালদার গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে এতক্ষণ খুকখুক করে কাশছিলেন। এবার একটু সামলে নিয়ে বললেন, দিনে-দিনে দেশের হল কী? চারদিক চোর-হেঁচড়ে একেবারে। ছেয়ে গেল নাকি?
ট্যাঁপা আবার বললে, ওঠ জয়–এখন বসে থাকলে হবে না। দেরি করলে চোর যে কোথায় পালিয়ে যাবে ঠিক নেই। চল–চল
নেপালদা, বঙ্কিম পাণ্ডা আর সুরেশ হালদার সবাই একসঙ্গে বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ–দেরি করা ঠিক নয়। সুরেশ হালদার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তক্ষুনি তাঁর ভীষণ কাশি এসে। গেল, আর বলতে পারলেন না।
জয়ধ্বজ উঠল, ট্যাঁপার সঙ্গে বেরিয়ে এল রাস্তায়। আর পেছনে নেপালদার দোকানে এই সাইকেল চুরির ব্যাপারটা নিয়ে দারুণ উত্তেজিত আলোচনা চলল, সুরেশ হালদার আরও বেশি করে কাশতে লাগলেন।
খানিকটা চুপচাপ করে–ট্যাঁপার সঙ্গে সঙ্গে গোঁজ হয়ে হাঁটতে লাগল জয়ধ্বজ। তারপর বললে, আমরা কোথায় যাচ্ছি রে ট্যাঁপা?
কেন, থানায়।
না, থানায় যাব না।
সে কী!–ট্যাঁপা আশ্চর্য হয়ে গেল; কী করবি তা হলে?
থানায় গিয়ে কী হবে?–জয়ধ্বজ বললে, ভূপেনকাকার বাড়িতে গত বছর চুরি হয়ে গেল, তারপর কী হল মনে নেই? পরদিন দারোগা এসে অনেক মিষ্টি-টিষ্টি খেয়ে বললেন, চোর ব্যাটাকে যদি একবার ধরে দিতে পারেন, তা হলে ওটাকে পিটিয়ে একেবারে তক্তা করে দেব। শুনে ভূপেনকাকা মনের দুঃখে বললে, চোরকে যদি ধরতেই পারব, তবে আপনাকে আর ডাকব কেন? আর ধরতে পারলে পিটিয়ে তক্তা করবার জন্য আপনাকে ডাকতে হবে না–ওটাও আমরাই পারব এখন। দারোগা রেগে বললেন, আপনার তো খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। যান–যান, আপনার চোর আপনিই ধরুন গে। বলে সেই যে গেলেন, একেবারেই গেলেন। না, থানা-টানায় সুবিধে হবে না।
ট্যাঁপা বললে, কিন্তু–
জয়ধ্বজ বললে, দাঁড়া, একটু মাথা ঠাণ্ডা করে নিই। ওসব দারোগা-ফারোগার দরকার নেই। তুই আমাকে একটু হেলপ করতে পারবি?
কেন পারব না? কিন্তু তুই কী করতে চাস, সেইটেই আমি ঠাহর পাচ্ছি না।
জয়ধ্বজ বললে, যা করব, তোতে আমাতে।
–তোতে আমাতে।
–ট্যাঁপা আরও আশ্চর্য হল : আমরা কী করতে পারব?
–সব করতে পারব। উদ্ধার করব সাইকেলটা।
ট্যাঁপা বললে, তোর মাথা খারাপ হয়েছে, জয়! আমরা কি হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত না প্রেমেন মিত্তিরের পরাশর বর্মা? তুই বাংলা ডিটেকটিভ বই পড়ে পড়ে
মোটেই ডিটেকটিভ বই না।–জয়ধ্বজ বিরক্ত হল : তুই এ রকম ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আর আমিও তো নেহাত হাঁদা গঙ্গারাম নই। দুজনে মিলে একটা কিনারা করতে পারব না? আয়, এই বাদাম গাছটার তলায় একটু বসা যাক। একটু ভেবেচিন্তে দেখা যাক সব–বুদ্ধি করা যাক একটা।
ট্যাঁপাকে প্রায় জোর করে টেনেই জয়ধ্বজ বাদাম গাছের তলায় এনে বসাল।
ট্যাঁপা বললে, কী পাগলামি করছিস তুই? মিথ্যে দেরি করে কী লাভ? বাদাম গাছের তলায় বসে আমরা প্ল্যান করব, আর সেই ফাঁকে চোর সাইকেলটা নিয়ে দশ মাইল রাস্তা পেরিয়ে যাবে।
জয়ধ্বজ বললে, না–যাবে না। আমার এই সাইকেল এদিক্কার সকলের চেনা। দিনে-দুপুরে ওটাকে নিয়ে কেউ বেশি দূর চালাতে সাহস পাবে না। যদি সরাতে হয় সরাবে রাতের বেলায়, দিনেও কোথাও লুকিয়ে রাখবে।
কিন্তু চোর যদি গাঁয়ের লোক না হয়? যদি পথ-চলতি কেউ ওটা নিয়ে সটকে থাকে?
পথ-চলতি কে এখন আসবে এদিকে? দুঘণ্টার মধ্যে ইস্টিশনে কোনও ট্রেন আসেনি, বাইরের কেউ খামকা এদিকে আসে না। নিয়েছে গ্রামেরই কেউ। কোনও চেনা লোক।
চেনা লোক।
সাইকেলটার ওপর অনেকেরই নজর পড়েছিল রে!
আচ্ছা জয়– ট্যাঁপার একটা কথা মনে হল :এমন তো হতে পারে, মজা দেখবার জন্যে কেউ ওটা নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে একটুখানি?
হতে পারে, নাও পারে। কিন্তু মজা দেখবার জন্যেও যদি কেউ নিয়ে থাকে, তাকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে, জয়ধ্বজ মণ্ডলের সঙ্গে চালাকি চলে না। মোদ্দা কথা, আমরা ওটা খুঁজে বের করবই।
যদি খুঁজে না পাই?
পেতেই হবে।–জয়ধ্বজ গম্ভীর হয়ে বললে, মামা সাইকেলটা দেবার সময় আমাকে বলেছিল যত্ন করে রাখিস–কেউ চুরি-টুরি করে নিয়ে না যায়। আমি বলেছিলুম, কোনও চোরের ঘাড়ে তিনটে মাথা নেই যে, জয়ধ্বজ মণ্ডলের সাইকেল চুরি করে নেবে। মামা বলেছিল, বেশ, দেখব, কেমন হুঁশিয়ার ছেলে তুই। সাইকেলটা উদ্ধার না করে মামার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারব আমি? প্রেসটিজ থাকবে আমার?
তা বটে–তা বটে– ট্যাঁপা ভাবনায় পড়ল।
তা ছাড়া সুরেশ হালদারকে তো জানিস। এক নম্বরের গেজেট। এখুনি খুকখুক করে কাশতে কাশতে মামার কাছে গিয়ে খবর দেবে–নেপালের চায়ের দোকান থেকে তোমার ভাগনের সাইকেল লোপাট। তখন আমার অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, বল? নাঃ, এ অপমান সত্যু করা যায় না। সাইকেল উদ্ধার করে তারপর মামার কাছে গিয়ে বলব; দেখলে তো–জয়ধ্বজ মণ্ডলের জিনিস কেউ হজম করতে পারে না।
ট্যাঁপা অধৈর্য হয়ে বললে, তা নয় হল। কিন্তু এখানে বসে বসে ভাবলে তো আর ওটা ফিরে পাওয়া যাবে না।
দাঁড়া না–একটু বুদ্ধি খাটাই। আমি তোকে বলছি ট্যাঁপা, সন্ধের আগে গাঁ থেকে সাইকেল বেরুবে না। এখন বেলা সাড়ে নটা। তার মানে, প্রায় ঘণ্টা দশেক সময় রয়েছে আমাদের হাতে। আগে ভেবে দেখা যাক–কাকে কাকে সন্দেহ করা যেতে পারে!
আচ্ছা–ভাব।
প্রথমেই মোনা পাল।
শুনেই ট্যাঁপা চমকে উঠল : ঠিক বলেছিস। মোনা পাল দাগী চোর, চার বার জেল খেটেছে। একাজ ও ছাড়া আর কারুরই নয়।
দাঁড়া–দাঁড়া। দাগী চোর হলেও মোনা পাল গাঁয়ের কারও কিছু কখনও চুরি করেনি। ওকে লিস্টে প্রথমে রাখব না। তারপর নেউলে–
নেউলে?
আরে নিয়োগীদের নেউলে। ওর হাতটান আছে, বুঝলি? একবার ওর বাবার হাতঘড়ি চুরি করে মহিষাদলে কাকে বেচে এসেছিল না? তারপর ধরা পড়ে বাপের হাতে রাম-ঠ্যাঙানি খেয়েছিল। আমার সাইকেলটার দিকে কবার ও আড়ে আড়ে তাকিয়েছে–আমি লক্ষ, করেছি।
তা হলে নিশ্চয় এ নেউলে নিয়োগীরই কাণ্ড।
জয়ধ্বজ বিরক্ত হয়ে বললে, নাঃ, তুই জ্বালালি ট্যাঁপা। আরে সবটা আগে ভাল করে ঠাউরে নিতে দে না। তিন নম্বর, পঞ্চ সামন্ত। লোকটা সুবিধের নয়-জানিস তো। তার ওপর একটা সাইকেলের দোকান আছে তমলুকে। সেখানে ওটা অনায়াসেই বেচে দিতে পারে।
ট্যাঁপা প্রায় বলতে যাচ্ছিল, তবে ওটা পঞ্চু সামন্তই নিয়েছে–কিন্তু জয়ধ্বজের চোখের দিকে তাকিয়ে সামলে গেল।
জয়ধ্বজ বললে, আপাতত এই তিনজনকে দিয়েই শুরু করি। তারপরে অন্যদের কথা ভাবা যাবে। প্রথমে কার কাছে যাওয়া যায় বল দিকি?
মোনা পাল।
না, মোনা নয়। আগে নেউলে নিয়োগী। বলেই উঠে দাঁড়াল জয়ধ্বজ : চল ট্যাঁপা–নাউ টু অ্যাকশন।
নেউলে নিয়োগীর দেখা পেতে দেরি হল না। তার বাড়ির দিকে এগোতেই চোখে পড়ল, এক হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে নিবিষ্ট মনে ডালমুট খেতে খেতে কোথায় চলেছে সে।
দূর থেকে ট্যাঁপা ডাকল :এই নেউলে, একটু দাঁড়া। তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।
শুনেই নেউলে দারুণ চমকে উঠল। হাত থেকে পড়ে গেল ডালমুটের ঠোঙাটা। তারপর আর কোনও দিকে না তাকিয়ে–মাঠের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে–টেনে দৌড়।
.
তিন
এই নেউলে, দৌড়চ্ছিস কেন? দাঁড়া না–আবার চেঁচিয়ে উঠল ট্যাঁপা।
কিন্তু কে কার কথা শোনে? নেউলে ছুটছে তো ছুটছেই–মনে হল, একেবারে হলদিয়ার বন্দরে পৌঁছবার আগে সে আর থামবে না। একটা পাটকিলে রঙের এঁড়ে গোৰু খুব যত্ন করে ঘাস-টাস খাচ্ছিলে, নেউলে উলটে পড়ল তার ঘাড়ে। গোরুটা লেজ তুলে দৌড় লাগাল–ম্যা ম্যা করে তিন-চারটে ছাগলও ছিটকে পড়ল চারদিকে।
আর নেউলে যে-ভাবে ছুটল, তাতে বোধহয় অলিম্পিক রেকর্ড হয়ে যেত একটা।
এই নেউলে–এই নেউলে–পালাচ্ছিস কেন?–পেছনে ছুটতে ছুটতে জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপা সমানে ডাকতে লাগল। নেউলে একবার ফিরে তাকায়, আবার দৌড়তে থাকে। যেন
অলিম্পিক রেকর্ডটা না করে কোনওমতেই সে থামবে না।
তা রেকর্ডটা হয়েও যেত, খুব সম্ভব হলদিয়ায় পৌঁছেও যেত সে। কিন্তু খেতের আলের ওপর একটা মাটির চাঙাড়ে টক্কর খেয়ে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থমকে গেল। একটা ঝোঁপের ওপরে উলটে পড়ে কোলা ব্যাঙের মতো হাত-পা ছুঁড়তে লাগল সে, আর সেই ফাঁকে ট্যাঁপা আর জয়ধ্বজ গিয়ে তাকে ক্যাঁক করে চেপে ধরল, নেউলে আর একবার উঠে পড়বার চেষ্টা করবার আগেই।
নেউলে হাঁসফাঁস করে জয়ধ্বজকে আঁচড়ে দিলে, ট্যাঁপাকে কামড়াবার চেষ্টা করল। রেগে আগুন হয়ে গেল জয়ধ্বজ।
ভালো করে ওর হাত দুটো চেপে ধর তো ট্যাঁপা! হতভাগা আঁচড়ে কামড়ে দেবার চেষ্টা করছে! এক চড়ে আমি ওর একপাটি দাঁত খসিয়ে দিচ্ছি।
ট্যাঁপা পটলডাঙার টেনিদাকে কোট করে বললে, কিংবা এক চাঁটিতে ওর কান কানপুরে পাঠিয়ে দেওয়া যাক।
বেগতিক দেখে নেউলে হাঁউমাউ করতে লাগল : তোমরা আমায় মারছ কেন? ছেড়ে দাও বলছি।
তুই আমাকে আঁচড়ে দিলি কেন? ট্যাঁপাকে কামড়াচ্ছিলি কী জন্যে?
তোমরা কেন আমাকে মারতে এলে?
আমরা তো তোকে মারতে আসিনি। কেবল একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলুম।
হুঁ, জিজ্ঞেস করতে!–নেউলে গজগজ করতে লাগল : আমি যেন কিছু জানি না। ভীম জ্যাঠার বাগান থেকে নারকোলী কুল পেড়ে খেয়েছি বলে তোমরা আমাকে ঠ্যাঙাতে এসেছ।
নারকোলী কুল!
ট্যাঁপা আর জয়ধ্বজ আশ্চর্য হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, আলগা হয়ে গেল হাতের মুঠো, আর ফাঁক বুঝে নেউলে উঠে পড়ল এক লাফে, চম্পট দেবার চেষ্টা করল।
কিন্তু জয়ধ্বজের ফুটবল খেলার অভ্যাস আছে, বেকাদায় পড়লে কেমন করে ফাউল করতে হয়, সেটাও তার বিলক্ষণ জানা। বসা-অবস্থাতেই সে চট করে একখানা পা ছুঁড়ে দিলে এবং তৎক্ষণাৎ আর একবার চিত হল নেউলে।
ওরে বাবা রে, মেরে ফেলল রে–! নেউলে চেঁচাতে লাগল।
গোঁ গোঁ করে জয়ধ্বজ বললে, ফের পালাবার চেষ্টা করবি তো ঠ্যাং ভেঙে দেব এবার। হয়রান হয়ে নেউলে বললে, সত্যি বলছি, আমি পাঁচিল টপকে ঢুকেছিলুম বটে, কিন্তু আট-দশটার বেশি কুল আমি খাইনি। দোতলার বারান্দা থেকে ভীম জ্যাঠা কে রে বাগানে? বলতেই আমি দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। কুলগাছের ডাল কে ভেঙেছে তার কিছু জানি না কাঁদো কাঁদো হয়ে নেউলে সমানে বলে যেতে লাগল : সত্যি বলছি কিছু জানি না।
জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপা আবার চুপ। নেউলে বলতে লাগল : সত্যি ভাই, আমায় ছেড়ে দাও। হতে পারে, দুচারটে কুল আমি বেশি খেয়েছি, লাফিয়ে নামবার সময় কুলগাছের এক-আধটা ডাল ভেঙেও যেতে পারে কিন্তু তোমার দিব্যি, আর কোনওদিন আমি তোমার মামার বাগানে ঢুকব না।
জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপা আবার এ-ওর দিকে তাকাল। কী বলা যায় ভেবে পেল না।
তারপর একটু সামলে নিয়ে ট্যাঁপা বললে, আর সাইকেল?
কিসের সাইকেল?–নেউলে হাঁ করে তাকাল।
ট্যাঁপা আবার কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আঙুলের একটা খোঁচা দিয়ে জয়ধ্বজ থামিয়ে দিল তাকে। ট্যাঁপাকে একবার চোখ টিপে বললে, তুই নাকি কার সাইকেলে ঢিল মেরে দুটো স্পোক ভেঙে দিয়েছিস?
আমি?–নেউলে এবার চটে গেল–বেশ মজা তো! না হয় তোমার মামার বাগানে ঢুকে দুটো কুলই খেয়েছি, তাই বলে রাস্তার লোকের সাইকেলে আমি ঢিল ছুঁড়ব? আমি পাগল নাকি?
না, তুই একটা বুদ্ধ তোর মগজে কেবল খুঁটে–এই বলে জয়ধ্বজ টকাস করে একটা টোকা মারল নেউলের মাথায় : যা ভাগ। কিন্তু খবরদার, আর কখনও মামার বাগানে ঢুকেছিস তো–
শেষ কথা আর কে শুনছে? ছাড়ান পেয়ে নেউলে তখন বাড়ির দিকে ভোঁ-দৌড়!
আশ্চর্য হয়ে ট্যাঁপা বললে, ছেড়ে দিলি ওকে?
ব্যাজার মুখে জয়ধ্বজ বললে, ছেড়ে দেব না তো কী করব? ওর মুখ দেখে বুঝতে পারছিস না? মামার বাগানে ঢুকে কুল চুরি করেছে, ডাল ভেঙে পালিয়েছে। ভেবেছে, মামা আমাদের লেলিয়ে দিয়েছে ওকে পিট্টি দেবার জন্য। তাই অমনভাবে পালাচ্ছিল। সাইকেলের ও কিছু জানে না।
কিন্তু এমন তো হতে পারে যে, ও আমাদের ধোঁকা দিয়ে গেল?
জয়ধ্বজ একটু হাসল।
অতই যদি ওস্তাদ হবে তা হলে ও গোয়েন্দা-গল্পের কোনও দস্যু-সর্দার-টদার হতে পারত, বাবার ঘড়ি চুরি করে ঠ্যাঙানি খায়? না–নেউলে নয়, ও সাইকেল চুরির কিছু জানে না। ওকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে হল।
তা হলে?
মাথার ওপর মিষ্টি নীল আকাশ। টুকরো টুকরো সাদা মেঘে রোদের সোনা জ্বলছে। মাথার ওপর দিয়ে এক জোড়া চখা-চখী উড়ে গেল কোনও নদীর চরের দিকে। একটু চুপ করে থেকে জয়ধ্বজ বললে, চল, ওঠা যাক।
কোথায় যাবি? মোনা পালের ওখানে? না, পঞ্চ সামন্তের কাছে?
ভেবে দেখি।
দুজনে মাঠ পেরিয়ে একটা কাঁচা রাস্তায় এসে পড়ল। নেউলে দৌড় করিয়ে তাদের অনেকদূর নিয়ে এসেছে, অনেকটা হেঁটে তাদের গ্রামের দিকে ফিরতে হবে।
ভাবতে ভাবতে চলেছিল, হঠাৎ ট্যাঁপারই চোখে পড়ল। দারুণ উত্তেজিত হয়ে খপ করে জয়ধ্বজের জামা টেনে ধরল।
জয়, দেখেছিস?
কী দেখব?
লক্ষ কর কাঁচা রাস্তার ওপর। সাইকেলের টায়ারের দাগ।
দুজনেই ঝুঁকে পড়ল তক্ষুনি।
কাঁচা রাস্তায় সাইকেলের চাকার দাগ থাকা খুব স্বাভাবিক, কত লোকেরই তো সাইকেল আছে আশেপাশে। কিন্তু একটু বিশেষত্ব ছিল এই দাগগুলোর। প্রথম কথা, সাইকেলটা খুব অল্প আগেই এই রাস্তা দিয়ে চলে গেছে কারণ তার ওপরে এখনও পথচলতি মানুষের পায়ের ছাপ কিংবা গোরুর গাড়ির চাকার দাগ পড়েনি। আর দ্বিতীয় কথা–
দ্বিতীয় কথা, চাকার দাগগুলো ভারি স্পষ্ট। আনকোরা নতুন টায়ারের দাগ যেমন পড়ে। শিউরে উঠে ট্যাঁপা বললে, তোর সাইকেলের দাগ।
জয়ধ্বজ ভুরু কুঁচকে বললে, হতে পারে, না-ও হতে পারে।
না-ও হতে পারে মানে? একেবারে নতুন সাইকেল?
আর কেউ যে একটা নতুন সাইকেল কিনতে পারে না, এমন তো কথা নেই।
কিন্তু এদিকের কেউ নতুন সাইকেল কিনলে নিশ্চয়ই জানা যেত। বাজারে সে আসতই।
হয়তো আজকাল কেউ কিনে এনেছে, আমরা দেখিনি।
ট্যাঁপা বিরক্ত হয়ে বললে, তর্ক করিসনি। আমার মন বলছে, এ তোরই সাইকেল। চল, ফলো করি।
জয়ধ্বজ বললে, চল।
কিন্তু কত দূর চলে গেছে সাইকেল, এ পথ কোন গ্রাম থেকে কোথায় এগিয়ে গেছে, কে জানে তার খবর! তবু দুজনে সেই দাগ ধরেই এগিয়ে চলল। একটু দূরে আম-জামের ছায়ায় ছোট্ট একটা গ্রাম দেখা যায়–দাসপুকুর। হয়তো দাসপুকুরেই লুকিয়ে আছে সাইকেল চুরির চাবিকাঠি!
আর তখন তাদের দেখা হল সেই রাখাল ছেলেটার সঙ্গে। একপাল মোষ তাড়িয়ে নিয়ে আসছিল সে।
ট্যাঁপা তাকে ডাকল : এই শোন।
.
চার
রাখাল ছেলেটা আসছিল গান গাইতে গাইতে। বেশ খুশি মেজাজ। একটা লালচে মতন মোষের বাচ্চার গায়ে হাতের ছোট লাঠিটা দিয়ে টুকটুক করে তাল দিচ্ছিল, আর গাইছিল : দেখে এলেম নদীয়ায় সোনার গোরাচাঁদে রে–
ট্যাঁপা আবার ডাকল : এই গোরাচাঁদ, শুনছিস?
গান থামিয়ে ছেলেটা বললে, আমার নাম পেল্লাদ, গোরাঁচাঁদ নয়।
ঠিক আছে, পেল্লাই হল। তোর বাড়ি কোথায়?
ওই কুমিরডাঙায়। দাসপুকুরের বাঁয়ে।
তা বেশ। কিন্তু একটা লোককে তুই দেখেছিস?
পেল্লাদ হি-হি করে হাসল।
একটা লোক কেন গো, কত লোককেই তো দেখেছি। এই তোমাদেরও তো দেখছি।
কথাটা ভুল হয়েছে বুঝে ট্যাঁপা মাথা চুলকোল। বললেন, নানা, একটা সাইকেলে-চড়া লোক। সাইকেলে চেপে কেউ এদিক দিয়ে যায়নি?
হুঁ, গেছে বই কি। একটু আগেই তো গেল।
কী রকম সাইকেল? নতুন?
নতুন কিংবা পুরনো–সে আমি কেমন করে জানব? তবে পেল্লাদ একটু ভেবে নিল : তা রোদ্দুরে বেশ চিকিমিকি করছিল বটে।
ঠিক ধরেছি তা হলে।–ট্যাঁপা একই সঙ্গে উৎসাহ আর রোমাঞ্চ বোধ করল : বুঝলি জয়, তা হলে ওই লোকটাই। আচ্ছা পেল্লাদ, লোকটা সাইকেল নিয়ে কোনদিকে গেল বলতে পারিস?
দাসপুরের দিঘির বাগেই তো গেল মনে হচ্ছে।–পেল্লাদ এবার চোখ মিটমিট করল : কেন গো, বিত্তান্তটা কী? এত খোঁজখবর নিচ্ছ কেন?
সে খবরে তোর দরকারটা কী?–ট্যাঁপা বিরক্ত হল : মোষ চরাতে যাচ্ছিলি তাই চরা গে। চল জয়, আমরা দাসপুরের দিঘির দিকে এগোই।
পেল্লাদ ব্যাজার মুখে বললে, বেশ লোক তো। নিজেরা আমায় সাত কাহন কথা জিজ্ঞেস করলে, আর আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই দোষ? ঠিক আছে, আর কিছু বলব না। আমি। বলেই বাচ্চা মোষটার পিঠে আবার লাঠির ঠোকা দিয়ে গান ধরল : দেখে এলেম নদীয়ায়–
জয়ধ্বজ একটাও কথা বলছিল না এতক্ষণ, চুপ করে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিল। ট্যাঁপা তাকে একটা খোঁচা দিয়ে বললে, দাঁড়ালি কেন, চল না।
জয়ধ্বজ বললে, আমার কিন্তু একটা কথা মনে হচ্ছে ট্যাঁপা! সাইকেল গাঁয়ের ভেতরেই কোথাও আছে, বাইরে যায়নি।
তুই বললেই হল?–ট্যাঁপা চটে গেল : তা হলে একটা নতুন সাইকেল নিয়ে দাসপুরের দিঘির দিকে কে গেল? মাইন্ড ইট–দাসপুরের দিঘি। তার একদিকে ভাঙা একটা শিবমন্দির, দুদিকে জঙ্গল। গ্রাম বেশ খানিকটা দূরে। কেন লোকটা সাইকেল নিয়ে ওদিকে যাবে?
কেন?
এটাও বুঝতে পারলিনে?–ট্যাঁপার হঠাৎ মনে হল, সে শার্লক হোমস হয়ে গেছে : সাইকেলটা দিনকয়েক ওই ভাঙা মন্দিরে কিংবা জঙ্গল-টঙ্গলে লুকিয়ে রেখে দেবে। তারপর
এদিকের হইচই থেমে গেলে ওটাকে বের করে এনে সরিয়ে ফেলবে।
ভুরু কুঁচকে একটু চুপ করে রইল জয়ধ্বজ। তারপর বলল, আচ্ছা, চল।
দুজনে এগিয়ে চলল। ট্যাঁপার উৎসাহই বেশি।
একটু তাড়াতাড়ি পা চালা জয়! লোকটা সাইকেলটা লুকিয়ে ফেলে যদি একবার সরে পড়তে পারে, তা হলে মুস্কিল হবে।
পথের ধুলোয় টায়ারের দাগ মধ্যে মধ্যে পরিষ্কার চোখে পড়ছে। যাচ্ছে দাসপুরের দিকেই। পেল্লাদ মিথ্যে কথা বলেনি।
দুজনে দাসপুর পাশে রেখে দিঘির দিকে চলল।
পুরনো দিঘি, পুরনো শিবমন্দির। কতকাল আগেকার কেউ জানে না। দিঘির উঁচু পাড়িতে বেলগাছের সার, আশেপাশে জঙ্গল। অনেককাল আগে এখানে নাকি বাঘ আসত।
এখানেও টায়ারের দাগ। এতক্ষণে জয়ধ্বজেরও উৎসাহ হচ্ছিল। একটা গোলমাল কিছু আছে নিশ্চয়ই। নইলে খামকা একটা লোক কেন আসতে যাবে এই জংলা দিঘির ধারে?
দিঘির ভাঙা ঘাটটার ওপর ওরা এসে দাঁড়াল। জল চোখেই পড়ে না। হাওয়ায় শালুক দুলছে, পদ্মপাতা দুলছে। ফড়িং উড়ছে–পদ্মপাতার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে খঞ্জন আর জলপিপি। মাথার ওপর ঝিরঝির করছে বেল আর শিরীষের পাতা।
কিন্তু কোথায় সাইকেল–কোথায় কে!
লোটা এর মধ্যেই সরে পড়ল নাকি?
ট্যাঁপা বললে, শিবমন্দিরটা একবার দেখি, আয়।
মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। মাথার ওপর পাকে পাকে জড়িয়ে একটা অশ্বথের গাছ। মন্দিরের দরজা নেই–ভেতরে একরাশ কালো ছায়া, ভাঙা দেওয়াল দিয়ে রোদের দু-একটা টুকরো পড়েছে ফুটিফাটা বেদীর ওপর। কয়েকটা চামচিকে ইট আঁকড়ে ঝুলে আছে কোনায় কোনায়। আর কিছুই নেই।
জয়ধ্বজ বললে, এখানে নেই।
ট্যাঁপা বললে, তাই তো দেখছি।
হঠাৎ দিঘির পাড়ির তলা দিয়ে দুড়দাড় করে শব্দ। কেউ যেন ছুটে পালাচ্ছে।
জয়, সেই লোকটা!–ট্যাঁপা লাফিয়ে উঠল : পালাচ্ছে।
দুজনে দৌড়ল সেইদিকে। ঢালু পাড়ি বেয়ে হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে ট্যাঁপা পা পিছলে পড়ে গেল, গড়িয়ে পড়ল হাত তিনেক। জয়ধ্বজ তাকে টেনে তুলল।
কিন্তু পরিশ্রমটা মাঠেই মারা গেল।
যে দুড়দাড় করে দৌড়ে যাচ্ছে–তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। সে মানুষ নয়, পাটকিলে রঙের অল্পবয়েসী গোরু একটা। ওদের মধ্যে মধ্যে ওরকম আচমকা ফুর্তি জেগে ওঠে, তারপরে অকারণেই লেজ তুলে দৌড়ে বেড়ায় খানিকটা।
জয়ধ্বজ বললে, ধেৎ–গোরু!
ট্যাঁপা পায়ে হাত বুলাতে বুলোতে বললে, , গোরুই তো। কোনও মানে হয় না–মাঝখান থেকে হাঁটুটাই খানিক ছড়ে গেল আমার।
দুজনে কিছুক্ষণ চুপ।
জয়ধ্বজ মাটিতে বসে পড়ে একটা শুকনো বেল কুড়িয়ে নিয়ে ভাঙা ইটের ওপর ঠুকতে লাগল।
ট্যাঁপা বললে, কী করা যায়, জয়?
ভাবছি।
তুই তো খালি ভেবেই চলেছিস। কিন্তু লোকটা যে কোথায়–
জয়ধ্বজ জবাব দিল না, একমনে বেলটাকে ঠুকতে লাগল।
চটে, তার হাত থেকে বেলটাকে কেড়ে নিলে ট্যাঁপা।
নে–ওঠ ওঠ–আর বসে বসে ছেলেমানুষি করতে হবে না। চল, জঙ্গলের ভেতরে দেখি একবার।
কিন্তু ওকে কি আর পাওয়া যাবে! কোনদিকে চলে গেছে এতক্ষণে।
যাবে আর কোনদিকে, জঙ্গল ছাড়া? রাস্তার দিক দিয়ে যদি যেত, তা হলে তো আমরাই দেখতে পেতুম। চল জয় সামনের জঙ্গলে খুঁজে দেখি। নিশ্চয় কোথায় ঘাপটি মেরে আছে এখানে।
আচ্ছা, চল—
বেল, শিরীষ আর আগাছার বনের মধ্যে ওরা কয়েক পা কেবল এগিয়েছে, এমন সময়—
দুম্ করে একটা বন্দুকের শব্দ। একসঙ্গে দুজনের বুক চমকে উঠল একেবারে।
লোকটাকে দেখা গেল বনের মধ্যে, সাইকেলটাকেও। তার হাতে বন্দুক। সেই বন্দুক থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। আর জ্বলন্ত চোখে সে চেয়ে আছে ওদের দিকেই।
.
পাঁচ
লোকটির মাথায় শোলার হ্যাঁট, গায়ে সাদা হাফশার্ট। মালকোঁচা করে ধুতি পর। বন্দুক থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তখনও। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপার দিকে।
আর সাইকেলটা হেলান দেওয়া রয়েছে একটা শিমুল গাছের গায়ে, তার ক্যারিয়ারে বাঁধা একটা ক্যাম্বিসের থলে, একছড়া কলা বেরিয়ে আছে তা থেকে। হ্যাঁন্ডেলে ঝুলছে একটা জলের বোতল।
সাইকেলটা জয়ধ্বজের নয়। কস্মিনকালেও নয়।
আর বন্দুক-হাতে লোকটি কিছুক্ষণ এদের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, আরে–জয়ধ্বজ না? এখানে কী মনে করে?
আরে রাম রাম, সেই পেল্লাদের কথা শুনে–এ কী কাণ্ড! এ যে জেলা বোর্ডের ওভারসিয়ার মোহনলালবাবু! ভীমরাজ পুরকায়েতের সঙ্গে খুব খাতির, দোকানে প্রায় আসেন কখনও কাপড়-চোপড় কিনতে, কখনওবা নিছক গল্পগুজব করতে।
ট্যাঁপা গোটা দুই খাবি খেল। জয়ধ্বজ মাথা চুলকোতে লাগল।
আজ্ঞে কিছু না–এই একটু বেড়াতে বেড়াতে–
মোহনলাল বললেন, না হে, এদিকটায় বেশি এসো-টেসো না। পুরনো ইটের পাঁজা চারদিকে বিস্তর গোখরা সাপ আছে। আমি অবিশ্যি মধ্যে মধ্যে আসি, ঘুঘু মারি, বন-মুরগিও পাওয়া যায় এক-আধটা। আর আমার সঙ্গে তো বন্দুক থাকেই।
দুই বন্ধু চুপ। ট্যাঁপার হাঁটুটা টনটনিয়ে উঠল আবার। ধুত্তোরখালি খালি ক্রোশখানেক হাঁটার পণ্ডশ্রম। তায় আবার ধুড়ম করে একটা আছাড় খেতে হল। পেল্লাদটা তো আচ্ছা হতভাগা! চারদিকের সবাই ওভারসিয়ারবাবুকে চেনে, আর সে চেনে না!
জয়ধ্বজই সামলে নিলে। বললে, পাখি-টাখি কিছু পেলেন মোহনকাকা? মোহনলাল ব্যাজার হয়ে বললেন, কই আর পেলুম! বরাতটাই খারাপ আজকে। বেশ মোটাসোটা একটা তিতির পেয়েছিলুম ঝোঁপের ভেতরে, বন্দুকের ঘোড়া টিপতে যাচ্ছি, পুটুস করে ঠিক সেই সময় একটা গেছে পিঁপড়ে দিলে বাঁ কানটায় কামড়ে! ভীষণ চমকে গেলুম, হাত নড়ে গেল–একটা চার নম্বরের টোটাই বরবাদ। আর টোটার যা দাম আজকাল!
এই বলে বাঁ কানটা খুচখুচ করে একটু চুলকে নিলেন মোহনলালবাবু। তারপর বন্দুকটাকে দুভাঁজ করে ভেঙে কাঁধের ওপর ব্যালান্স করলেন।
গুলির আওয়াজে সব তো পালিয়েছে এদিক থেকে। দেখি, দিঘির পাড়ির ওপরে এক-আধটা ঘুঘু-টুঘু পাই কি না। তার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক, ভারি খিদে পেয়েছে।–ক্যাম্বিসের থলেটা থেকে কলার ছড়া আর একটা পাউরুটি বের করতে করতে বললেন, এসো হে জয়ধ্বজ, শেয়ার করো। আর তুমি–তোমাকেও চেনা-চেনা ঠেকছে–হুঁ, আচার্যি-বাড়ির ট্যাঁপা না?
ট্যাঁপা বললে, আজ্ঞে।
তা হলে ব্রাহ্মণ-সন্তানকেই আগে দিতে হয়। নাও ধরো বলে একটা কলা বাড়িয়ে দিলেন।
আজ্ঞে না, না, আমাদের কিছু দরকার নেই—আমরা—
কিন্তু কে শুনছে সেকথা। মোহনলাল দুজনের হাতে দুটো কলা প্রায় জোর করেই খুঁজে দিলেন। তারপর বললেন, রুটি?
আজ্ঞে আর না– জয়ধ্বজ প্রাণপণে প্রতিবাদ করল : আমরা একটু আগেই ভাত খেয়ে বেরিয়েছি।
তা হলে থাক। বনবাদাড়ে আর ঘুরো না–বলতে বলতে হঠাৎ মোহনলালবাবুর চোখ মিটমিট করে উঠল : বুঝলে জয়ধ্বজ, এদিকে আসবার সময় রাস্তায় তোমার মামার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
মোহনলাল একেবারে আধখানা কলা মুখে পুরে দিয়ে বললেন, তিনি কথায় কথায় তোমার খুব প্রশংসা করছিলেন। বলছিলেন, যেমন কাজের ছেলে, তেমনি সাবধানী আর সেই রকম দায়িত্বজ্ঞান।
শুনে জয়ধ্বজের মুখটা লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ল। সাবধানী আর দায়িত্বজ্ঞানই বটে! না হলে, সকালের এমন ঝিলমিলে রোদের ভেতরে নেপালদার চায়ের দোকান থেকে সাইকেলটা তার চুরি হয়ে গেল। এরপরে মামার সামনে গিয়ে সে দাঁড়াবে কোন মুখে?
কলার বাকিটুকু চিবুতে চিবুতে মোহনলাল আবার মিটমিট করে তাকালেন এদের দিকে।
যাও–যাও, রোদ্দুরে খামকা ঘুরতে নেই স্ট্রেট বাড়ি চলে যাও এবার। ভালো কথা ধাঁধার উত্তর-টুত্তর আসে তোমাদের?
ট্যাঁপা কলাটা ছুলতে যাচ্ছিল, থমকে গেল সে কথা শুনে। জয়ধ্বজ ভুরু কুঁচকে তাকাল।
ধাঁধা?
মোহনলাল মাথা নেড়ে বললেন, হুঁ–ধাঁধা। আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিল জবাব দিতে পারিনি। তোমরা ভেবে দেখো তো। ধাঁধাটা হল :
চিন্তামণি নেই রে বনে,
থাকেন তিনি ঘরের কোণে।
গৌ-মাতা তার বলেন হেসে
খড় দেবে যে, দুধ খাবে সে।
বুঝলে কিছু?
জয়ধ্বজ বললে, আজ্ঞে না।
ট্যাঁপা বিরক্ত হচ্ছিল। জয়ধ্বজের কানে কানে বললে, ধাঁধা-ফাঁধা নিয়ে কী পাগলামি আরম্ভ করলি জয়? ওদিকে এতক্ষণে সাইকেল-চোর–
মোহনলাল মুচকি মুচকি হাসলেন।
উত্তরটা বুঝি পেয়ে গেছ ট্যাঁপা?
আজ্ঞে না, উত্তর পাইনি। পেলে আপনাকে জানাব এখন। চল জয়, আমরা যাই
পাউরুটিতে মস্ত একটা কামড় দিয়ে মোহনলাল বললেন, হ্যাঁ, সেই ভালো। বাড়ি চলে যাও। তারপর কেমন মিটমটি করে তাকাতে লাগলেন ওদের দিকে। সেই তাকানোটা
জয়ধ্বজের ভালো লাগল না।
আবার সেই পুরনো রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরা। মন-মেজাজ দুজনেরই খারাপ।
ট্যাঁপা বললে, ধুং ফলস্ ক্লু।
জয়ধ্বজ বললে, বুঝতে পারিনি এখনও।
তার মানে?–ট্যাঁপা উত্তেজিতভাবে বললে, তুই কি ভাবছিস মোহনলালবাবুই সাইকেল-চোর? কিংবা চোরের দলের সঙ্গে যোগ আছে তাঁর?
জিভ কেটে জয়ধ্বজ বললে, আরে রাম!
তবে?
আমি ভাবছি ধাঁধাটার কথা।
দুত্তোর ধাঁধা–ট্যাঁপা চটে গেল : কোথাকার এক চিন্তামণি আর গৌ-মাতা! কোনও মানে হয় না। যত সব বোগাস লোক।
হয়তো একটা মজা করলেন।
তা হবে। কিন্তু ট্যাঁপা–তুই তো লেখাপড়ায় দারুণ ভালো ছেলে। ধাঁধাটা মনে আছে তোর?
কেন মনে থাকবে না?–
চিন্তামণি নেই রে বনে,
থাকেন তিনি ঘরের কোণে।
গৌ-মাথা তার বলেন হেসে
খড় দেবে যে, দুধ খাবে সে।
কিন্তু ধাঁধা চুলোয় যাক। এখন তাড়াতাড়ি পা চালা।
কোথায় যাওয়া যাবে এবার?
মোনা পালের কাছে। দাগী চোরকয়েকবার জেল খেটেছে।
জয়ধ্বজ বললে, কিন্তু মামা বলছিল, মোনা নাকি আজকাল আর চুরি-চামারি করে না–স্রেফ ভালোমানুষ হয়ে গেছে?
ধুর বাজে কথা। চোরের স্বভাব বদলায় কোনওদিন?
তা ছাড়া মোন কোনওদিন গাঁয়ের কারও জিনিস চুরি করেনি।
চোরের আবার ধম্মোজ্ঞান!
আরে যে দাগী চোর সে তো বোঝে, কারও কোনও কিছু খোয়া গেলে পুলিশ প্রথমেই তাকে সন্দেহ করবে, আর তাকে ধরেই পিটুনি লাগাবে।
তুই বড্ড এঁড়ে তক্কো করিস জয়! ট্যাঁপা ভীষণ বিরক্ত হল : পিটুনি খেলে চোরের কিচ্ছু হয় না। ওসব ওদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওরা জানে, পেটে খেলে পিঠে সয়।–রেগে গিয়ে ট্যাঁপা এবার খোসাসুদ্ধ কলাটাই মুখে পুরে ফেলল : আমি বলছি, মোনা পালকেই একবার বাজিয়ে দেখি।
আচ্ছা–চল।
মোনা পালকে খুঁজতে হল না। বাড়ির সামনেই ছিল সে। কালো কটকটে বেঁটে চেহারার লোক, মাথা ভর্তি সাদা সাদা কদমছাঁট চুল, গোঁফ আর ভুরু ধপধপে পাকা। সে তখন একটা দড়ির খাঁটিয়া তুলে দমাদম করে আছাড় মারছিল। আর সেই খাঁটিয়া থেকে টুপটাপ করে পড়ছিল প্রমাণ-সাইজের সব ছারপোকা। বিশ্রী রকম মুখ ভেংচে, পা দিয়ে ঘষে ঘষে সেইসব ছারপোকাকে সংহার করছিল মোনা পাল।
ট্যাঁপা ডাকল : ও মোনাদা!
মোনা জবাব দিল না, তেমনি যাচ্ছেতাই মুখ করে ছারপোকা মারতে লাগল।
ও মোনাদা! বলি, শুনছ?
উত্তরে মোনা পাল আবার খাঁটিয়া তুলে আছাড় মারল একটা।
জয়ধ্বজ বললে, ওভাবে ছারপোকা সাবাড় করতে পারবে না–খাঁটিয়ায় আগুন লাগাও। কিন্তু ব্যাপার কী, আমাদের কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?
মোনা পাল বললে, আমি আজকাল কানে কম শুনি।
কবে থেকে?–জয়ধ্বজ হেসে ফেলল : পরশুও তো হাটে তুমি বেশ দর-দাম করে বেগুন কিনছিলে?
মোনা পাল নিরুত্তরে আবার আছাড় মারল খাঁটিয়ায়।
মোনাদা, কবে থেকে কানে কম শুনছ?–আবার জিজ্ঞেস করল জয়ধ্বজ।
আজ থেকে।
কিন্তু আমি এবার এত আস্তে আস্তে বললুম, তবু তো শুনতে পেলে?
মধ্যে মধ্যে শুনতে পাই, কিন্তু আর পাব না–বলে মোনা পাল গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর মাটিতে চোখ নামিয়ে ছারপোকা খুঁজতে লাগল।
জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপা এ-ওর দিকে তাকাল।
হুঁ–পরিস্থিতি বেশ গুরুতর। সন্দেহের নিবিড় মেঘে আকাশ ঘনীভূত।
.
ছয়
ট্যাঁপা ডাকল : ও মোনাদা!
মোনাদার সাড়া নেই। মাটির দিকে চোখ রেখে সমানে ছারপোকা খুঁজছে সে। ট্যাঁপা বিরক্ত হয়ে বললে, আরে শোনোই না মোনাদা! কানে না হয় একটু পরেই কম শুনো, তার আগে সোজা বাংলায় দুএকটা কথার জবাব দাও দিকি?
মোনা পাল এবার কানে হাত দিয়ে কেমন ঘোলা ঘোলা চোখে ট্যাঁপার দিকে তাকাল। তারপর বললে, অ্যাঁ–জবাই? আমি তো মুরগি জবাই করি না। কালু মিঞার কাছে যাও।
না–না-জবাই না, জবাব। মানে উত্তর।
মোনা পাল বললে, উত্তরপাড়া? সে হল গে তোমার কোন্নগরের কাছে।
ট্যাঁপা চটে গিয়ে বললে, আমাদের, কী বলে, লাইফ অ্যান্ড ডেথ–মানে জীবন-মরণ সমস্যা, আর তুমি মস্করা করছ আমাদের সঙ্গে?
মোনা বললে, গুশকরা? না–না, সে ইদিকে কোথায়? নলহাটি লাইনে যেতে হয়।–আর… বলেই খাঁটিয়াটা তুলে আর একবার চিৎকার ছাড়ল একটা।
সোজা কথায় জবাব দাও মোনাদা-নইলে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে যাবে, তা বলে দিচ্ছি। জয়ের নতুন সাইকেলটা নেপালদার দোকানের সামনে থেকে চুরি হয়ে গেছে। সে সাইকেল তুমি দেখেছ?
মাইকেল? মাইকেল তো পদ্য লেখেন। পাঠশালার পণ্ডিতমশাইয়ের মুখে শুনিছি।
ট্যাঁপা আবার চেঁচিয়ে উঠল : ও–কিছুতেই কানে শুনবে না ঠিক করেছে? খানিকটা ফুটন্ত গরম জল এনে কানে ঢেলে দিচ্ছি তোমার, দেখি, শুনতে পাও কি না।
মোনা এটাও শুনতে পেল না। মাটিতে ছারপোকা খুঁজতে লাগল আবার।
ট্যাঁপা তড়াক করে লাফ মারল একটা, বোধহয় কারও বাড়ি থেকে এক কেটলি গরম জল আনার জন্যেই দৌড়ে যাচ্ছিল সে। জয়ধ্বজ চটে যায়নি, বরং সমস্ত ব্যাপারটায় তার বেশ মজা লাগছিল।
আঃ, থাম না ট্যাঁপা। মোনাদা যদি কানে শুনতে না-ই পায়, তা হলে কী করা যাবে আর।
না, কানে শুনতে পায় না! সবটাই চালাকি।
দাঁড়া–দাঁড়া, মাথা গরম করিসনি। আমি দেখছি।–ও মোনাদা!
মোনাদা তেমনি কানে হাত দিয়ে ঘোলা চোখে জয়ধ্বজের দিকে তাকাল।
পোনার কথা বলছ? তোমার মামা এবার অনেক পোনা ছেড়েছে তালডাঙার পুকুরে।
ট্যাঁপা খেঁকিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, জয়ধ্বজ তার মুখে হাত চাপা দিয়ে দিলে। তারপর বললে, মামা যে অনেক পোনা ছেড়েছে তালডাঙার পুকুরে, সে আমি ভালোই জানি। সে-খবর তোমায় দিতে হবে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করছি, আমার সাইকেলটার কথা।
মোনা বললে, কিছু শুনতে পেলুম না।
পাবে—পাবে–জয়ধ্বজ একটু হাসল : মামা আমার সাইকেলটার কথা তোমায় কিছু বলেছিল?
ট্যাঁপা লক্ষ করল না, কিন্তু জয়ধ্বজ টের পেল, মোনা পাল যেন চমকে উঠল একটু।
জামা? খামকা জামা গায় দেব কেন?
জামা নয়–মামা।
ধামা? কিনবে? তা আমাকে বলছ কেন? বুনোপাড়ায় যাও, ওরা ধামাকুলো তৈরি করে বেচে। যত ধামা চাও-দেবে।
ট্যাঁপা রাগে সাপের মতো ফুঁসছিল। বললে, কী ওর সঙ্গে বকবক করছিস জয়! ও কোনও জবাব দেবে না। সোজা আঙুলে যে ঘি ওঠে না–সে তো দেখতেই পাচ্ছিস। চল, থানায় যাই। সাইকেল এ-ই সরিয়েছে–নির্ঘাত।
মোনা বললে, ভাত খাবে? এই বেলা তিনটের সময়? কেন–দুপুরে খাওয়া হয়নি নাকি?
দাঁত কিড়মিড় করে ট্যাঁপা বললে, জয়, এর সঙ্গে আর দুমিনিট কথা বললে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে-রিয়্যালি! থানাতেই চল। দারোগা ধরে নিয়ে গিয়ে একে বেশ করে ঠ্যাঙাকসুড়সুড় করে সত্যি কথা আপনিই বেরিয়ে আসবে।
না। থানায় যাব না। মোনাদা যাতে এক্ষুনি কানে শুনতে পায়, সে ব্যবস্থা আমি করছি।–বলেই জয়ধ্বজ মুখটাকে মোনা পালের বাঁ কানের কাছে নিয়ে গেল। তারপর কানের ফুটোয় মুখ রেখে আকাশ কাঁপানো এক বাজখাঁই হাঁক ছাড়ল : মো-না-দা!
সেই নিদারুণ চিৎকারে ট্যাঁপার পর্যন্ত পিলে চমকে উঠল। আর মোনা আঁতকে গিয়ে এক লাফে হাতখানেক শূন্যে উঠে পড়ল, তারপর ধপাৎ করে বসে গেল মাটিতে।
জয়ধ্বজ বললে, এতেই শুনতে পাবে, না ডান কানেও আর একটা আওয়াজ দেব?
মোনা পাল একেবারে হাঁউমাউ করে উঠল।
উরিব্বাবা! তোমার এক চিৎকারেই আমার মগজে তালগোল পাকিয়ে গেছে বাবা জয়ধ্বজ! আর হাঁক ছেড়ো না–তা হলে মারা পড়ে যাব। তুমি মানুষ খুনের দায়ে ফেঁসে যাবে তাহলে।
এবার সব কথা শুনতে পাচ্ছ মোনাদা?
শুনতে পাচ্ছিনে আবার? আমার যে বুড়ি পিসিমা তিরিশ বছর বদ্ধ কালা হয়ে রয়েছে, তোমার ওই বোম্বাই হাঁক শুনলে তারও কান সাফ হয়ে যেত। বলল, কী বলতে চাও।
ট্যাঁপা বললে, এবার ডান কানে আমিও একটা ডাক ছাড়ি জয়। তখন থেকে বড্ড ভুগিয়েছে।
মোনা পাল সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে দুকান চেপে ধরল।
আরিব্বাস! এতেই আমার মাথায় ঘুরন-চক্কর চলছে তুমিও যদি একখানা ছাড়ো, তা হলে আর আমি নেই, স্রেফ গো-হত্যে হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি তোমাকে।
জয়ধ্বজ বললে, তা হলে সোজাসুজি কটা কথার উত্তর দাও।
বলো।
আজ সকাল থেকে তুমি কী করছিলে?
কী আর করব? ঘুম থেকে উঠে, মুখটুক ধুয়ে, বাসী ভাত খানিক ছিল, তাই খেয়ে—
তাই খেয়ে?
মাঠে গেলুম। সেখানে ধান কাটা হচ্ছিল। আমিও খানিকটা কাটলুম।
তারপর?
তারপর তোমার মামার সঙ্গে দেখা হল।
জয়ধ্বজ নড়ে উঠল একটু।
মামা কী বললেন?
কী আর বলবেন? কেমন আছ-টাছ এইসব। তা আমি বেশিক্ষণ মাঠে থাকতে পারিনি। আমার একজন সোয়ারি ছিল কিনা, তাকে গোরুর গাড়িতে করে ইস্টিশনে নিয়ে গেলুম–সকালের ট্রেন ধরাতে।
তারপর?
তার আর কী? বাড়ি এসে ডোবা থেকে কটা কুচো চিংড়ি ধরলুম, কলমি শাক তুলে তাই দিয়ে রান্না করলুম। তারপর ভাত বেঁধে–
ট্যাঁপা ছটফট করে উঠল : আচ্ছা জয়, কী পাগলামি হচ্ছে? এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মোনাদার আবোল-তাবোল শুনছিস, অথচ–
জয়ধ্বজ বললে, দাঁড়া–দাঁড়া, শুনেই নিই না। কিছুই বলা যায় না, কাজে লেগে যেতে পারে।–হ্যাঁ, ভাত রাঁধবার পরে কী করলে মোনাদা?
কী আর করব? খেলুম। কুচো চিংড়ি দিয়ে কলমি শাকের ঝোলটা যে কী ভালো হয়েছিল–
সে থাক। তারপর?
তারপর খাঁটিয়া পেতে ঘুমোবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু অ্যায়সা ছারপোকা বুঝলে, গোটা পিঠে যেন হালচাষ করে দিলে। ঘুমাব কী, পাঁচ মিনিট শুয়ে থাকে সাধ্যি কার! তারপর খাঁটিয়া এনে ছারপোকা মারছি–এমন সময় তোমরা এলে।
এর মধ্যে আর কিছু নেই?
কিসসু নেই। মা কালীর দিব্যি।
মা কালীর নাম নিয়ে মিথ্যে কথা বলছ মোনাদা? নাকি আবার চিৎকার ছাড়ব?
না–না, আর দরকার হবে না– মোনা পাল শিউরে উঠে বললে, এখনও আমার বুকের ধড়ফড়ানি থামেনি। তা–তা এর মধ্যে একটা কিছু হয়েছিল বই কি।
কী হয়েছিল?
সে ভীষণ ব্যাপার–মোনা একবার চারদিকে তাকিয়ে নিলে : সে তো এখানে বলা যাবে না, চুপি চুপি বলতে হবে।
কেউ শুনছে না, কোনও লোক নেই এদিকে। বলো তুমি।
মোনা বললে, না–না, বাইরে সে কথা বলবার জো নেই। চলো আমার ঘরের ভেতরে।
ট্যাঁপা আর জয়ধ্বজ বললে, বেশ, ঘরেই চলো তা হলে।
ট্যাঁপা আগে ঘরে ঢুকল, পেছনে জয়ধ্বজ। এবং তৎক্ষণাৎ–
তৎক্ষণাৎ এক টানে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলে মোনা পাল। তারপর–ঝনাৎ! সোজা শেকল তুলে দিল দরজায়।
ভেতর থেকে ট্যাঁপা আর জয়ধ্বজ চেঁচিয়ে উঠল : এ কী হচ্ছে মোনাদা-দরজা বন্ধ করে দিলে কেন? খোলো—খোলো–
অট্টহাসি করে মোনা পাল বললে, আমার কান খারাপ হয়ে গেছে, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না।
মোনা পালের ঘরে শেকলবন্দী হয়ে তো দুজনে থ।
ব্যপারটা যে সত্যি সত্যিই এত দূর গড়াতে পারে, এরকম ভাবাই যায়নি। এ যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুনো যাকে বলে। নেপালদার দোকানের সামনে থেকে জয়ধ্বজের নতুন সাইকেলটা চুরি হয়ে গেল, হতেই পারে, অনেক সাইকেলই তো চুরি যায়। কিন্তু গোটা জিনিস শেষ পর্যন্ত এমন প্যাঁচালো হয়ে যাবে, এ ওদের স্বপ্নেও ছিল না।
তা হলে কেবল একটা সাইকেল চুরিই নয়, যে-কোনও এক ছিচকে চোরের কাণ্ডকারবারও নয়! এর পেছনে গভীর চক্রান্ত আছে। কিন্তু কী চক্রান্ত? কী সে উদ্দেশ্য?
আর মোনা পাল—
কথা নেই, বার্তা নেই–দুম করে শেকল আটকে পালিয়ে গেল! কালা সাজবার ভান করে বাঁদর নাচাচ্ছিল ওদের। লোকটা তো দারুণ ঘুঘু।
ট্যাঁপা বিরক্ত হয়ে বললে, জয়, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কী? এই ঘরে কয়েদ হয়ে থাকব নাকি?
জয়ধ্বজ বললে, থাম, একটু ভেবে নিই।
এতে আবার ভাবাভাবির কী আছে। বেরুতে হবে না এখান থেকে?
জয়ধ্বজ বললে, বেরুবার জন্যে চিন্তা নেই, ও যা পলকা দরজা, একটা-দুটো লাথি মারলেই শেকল-টেকল সুদ্ধ উপড়ে পড়ে যাবে।
তবে তাই করা যাক, আয়।
ট্যাঁপা দরজার দিকে এগোচ্ছিল, জয়ধ্বজ তার হাত চেপে ধরে বললে, দাঁড়া।
দাঁড়াব কী? এটা কি একটা ঘর নাকি?ট্যাঁপা নাক কোঁচকাল : রামো–রামো, কী নোংরা বিছানাটিছানা পড়ে রয়েছে মেঝেতে। ওদিকে আবার কতগুলো হাঁড়িকুঁড়ি! যেন ছুঁচোরও গন্ধ পাচ্ছি।
তা কী করা যাবে, গরিব মানুষের ঘর এরকমই হয়ে থাকে।
তোর আবার মোনা পালের জন্যে দরদ দেখা দিল নাকি?ট্যাঁপা একটা হাঁ করল : হতে পারে গরিব, কিন্তু তাই বলে শয়তানী করবে আমাদের সঙ্গে? মানে কী এর?
মানে একটা আছেই, একটু একটু আঁচ পাচ্ছি যেন।
কী পাচ্ছিস?
সাইকেলটা ও-ই সরিয়েছে।
সে তো এখন জলের মতো পরিষ্কার– ট্যাঁপা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল : তা হলে আর সময় নষ্ট করে কী হবে, চল–দরজা ভেঙে বেরিয়ে পড়ি। ধরে ফেলি মোনাকে।
ধরা যাবে না। বুড়ো হলে কী হয়, এখনও ঘোড়ার মতো ছোটে। ওকে দৌড়ে ধরা তোর-আমার কাজ নয়। ও যদি অলিম্পিকে যেত না, বুঝলি, ঠিক সোনার মেডেল পেয়ে যেত প্রিন্টে।
ট্যাঁপা বললে, জয়, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এদিকে মোনা পাল গেল পালিয়ে, আর তুই সোনার মেডেল পাওয়াচ্ছিস ওকে! ধরতে হবে লোকটাকে?
ধরা যাবে ওকে, আর ধরেও কোনও লাভ নেই। আমি ততক্ষণে একটু ভেবে আমাদের পরের প্রোগ্রামটা একটু ঠিক করে নিই।
এই ঘরে? এই ছুঁচোর গন্ধের ভেতর?
চুলোয় যাক ছুঁচো। আগে মোনার ওপর একটু প্রতিহিংসা নেওয়া যাক।– মিটমিট করে হাসল জয়ধ্বজ : শুধু ছুঁচোর গন্ধ পাচ্ছিস, আর কিছু না? ওদিকে দড়ি বাঁধা একছড়া পাকা চাঁপা কলা ঝুলছে, দেখছিস? নিয়ে আয়-সাবাড় করে দিই।
এই তোর কলা খাওয়ার সময়?
কলা খাওয়ার আবার সময়-অসময় আছে নাকি? পেলেই খেতে হয়। কলা খেতে খেতে প্ল্যান ঠাওরাব–
ট্যাঁপাকে দরকার হল না, জয়ধ্বজ নিজেই কলার ছড়াটা পেড়ে আনল। বললে, নে।
উৎসাহ ছিল না, তবু ট্যাঁপাকে কলা মুখে পুরতে হল।
জয়ধ্বজ বললে, বেশ কলাগুলো–না?
ট্যাঁপা রাগ করে বললে, সাইকেল তোকে পেতে হবে না, ওই কলাই খা।
আহা–দাঁড়া দাঁড়া।–কলা চিবুতে চিবুতে জয়ধ্বজ বললে, আচ্ছা, মোহনলালবাবুর সেই ছড়াটা মনে আছে?
দুত্তোর ছড়া! কী হবে তা দিয়ে?
দরকার আছে। বল না। তুই ভালো ছাত্র, ঠিক মনে করে রেখেছিস?
ট্যাঁপা গজগজ করে বললে,
চিন্তামণি নেইকো বনে,
আছেন তিনি ঘরের কোণে
গৌ-মাতা তার বলেন হেসে,
খড় দেবে যে, দুধ খাবে সে।
জয়ধ্বজ বললে, হুঁ। গৌ-মাতা তার–মানে এই দুটো লাইনই খটকা ঠেকছে।
এখন বুঝি ধাঁধার উত্তর বের করবি?
উঁহু, সাইকেল খুঁজে বের করব। চল–বেরাই এখান থেকে।
ট্যাঁপা তৎক্ষণাৎ বন্ধ দরজায় লাথি মারতে যাচ্ছিল, জয়ধ্বজ বললে, দরকার নেই।
মানে? বেরুব কী করে?
আরে ভেতরের ওই দরজাটা দেখছিস না? খিল দেওয়া রয়েছে? খুললেই বেরিয়ে যেতে পারব।
তাই তো-তাই তো! ট্যাঁপা লজ্জা পেল। এ-পাশে একটা খিল-দেওয়া দরজা যে রয়েছে তার সে-খেয়ালই হয়নি। আসলে, উত্তেজনায় তার মাথাই গরম হয়ে গিয়েছিল, আর জয়ধ্বজ ওটা ঢুকেই দেখতে পেয়েছে বলে একটুও ঘাবড়ায়নি।
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দুজনে পেছনের উঠনে। মোনা পালের বাড়িতে তো কোনও পাঁচিলের বালাই নেই, কাজেই বাইরের রাস্তায় ঘুরে আসতে আধ মিনিটও লাগল না।
বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুরের রোদ। কোনওদিকে জন-মানুষের চিহ্ন নেই। মোনা পাল যে কোথায় উধাও হয়েছে, ভগবানই জানেন। কেবল বাইরে তার ছারপোকা-ভর্তি খাঁটিয়াটা আকাশে চারটে ঠ্যাং তুলে চিতপাত হয়ে রয়েছে।
ট্যাঁপা বললে, কী করবি এখন? মোনাই নিশ্চয় সাইকেল-চোর, কিন্তু কোথায় পাচার করল সেটা?
পাশেই একটা জামগাছের তলায় মোনার গোরুর গাড়িটা। বলদ দুটো একটু দূরে মাঠে বাঁধা–ঘাস খাচ্ছে তারা।
কপাল কুঁচকে জয়ধ্বজ একটু ভাবল। তারপর এগিয়ে গেল গোরুর গাড়িটার দিকে।
ট্যাঁপা বললে, ওখানে কী?
দ্যাখ না–
জয়ধ্বজ দ্রুত হাতে গোরুর গাড়িতে বিছানো খড়গুলো সরাতে লাগল।
ওর তলায় সাইকেল লুকোনো আছে? তোর মাথা খারাপ?
জয়ধ্বজ জবাব দিল না। আর একটু পরেই তার গলা থেকে বেরুল একটা জয়ধ্বনি।
ট্যাঁপা–এই দ্যাখ।
একমুঠো খড় বাড়িয়ে ধরেছে জয়ধ্বজ। তাতে তেলকালিমাখা।
অ্যাঁ–এ যে—
হ্যাঁ, সাইকেল থেকে লেগেছে– জয়ধ্বজ হাসল : এই গোরুর গাড়িতে সাইকেল পাচার করেছে স্টেশন থেকে আসবার সময়। কিন্তু নেপালদা তো তখন বাইরে দাঁড়িয়ে চা করছিল– জয়ধ্বজ ভুরু কোঁচকাল : চল ট্যাঁপা।
নেপালদার কাছে?–উত্তেজনায় ট্যাঁপা হাঁপাতে লাগল।
না, পঞ্চু সামন্তের কাছে। ভুলে গেলি! তমলুকে তার সাইকেলের দোকান?
চল—চল–
দুজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল।
.
সাত
জয়ধ্বজ বললে, তা হলে এবার—
ট্যাঁপা বললে, হুঁ, পঞ্চু সামন্ত।
দাঁড়া–তা হলে ব্যাপারটা মনে মনে একটু গুছিয়ে নিই।–মোনা পালের এক কাঁদি চাঁপা কলা খেয়ে মেজাজটা খুব ভালো হয়ে গিয়েছিল জয়ধ্বজের : গোড়া থেকেই ধরা যাক। আমরা নেপালদার দোকানে ঢুকে চা খাচ্ছিলুম কখন? ধর, নটা–সাড়ে নটা। খড়গপুর লোক্যাল আমাদের স্টেশন পার হয়েছে কখন? ধর, আটটা চল্লিশ–এই রকম একটা সময়ে। তা হলে–
তা হলে সাইকেলটা নিয়ে ট্রেনে তুলে দেয়নি তো রে?
সে কী করে হবে? গাড়িতে সোয়ারি ছিল বলছে। তাদের সামনে আর সাইকেলটা চুরি করবে কী করে?
যদি সাঁট থাকে?
হতে পারে। কিন্তু তারও একটা মুস্কিল আছে। স্টেশনের ভেতর একটা সাইকেল নিয়ে গিয়ে ট্রেনে ভোলা লোকের চোখে পড়বেই। তা ছাড়া আটটা চল্লিশের গাড়িতে কাউকে তুলতে হলে দশ-পনেরো মিনিট আগে এসেছে নিশ্চয়ই, তাকেও তো টিকিট কাটতে হবে। তাহলে আটটা পনেরো থেকে আটটা ত্রিশের ভেতরে–আগেও হতে পারে–মোনা পাল এসেছে স্টেশনে। তখন তো আমরা নেপালদার দোকানে পৌঁছুইনি মোটেই।
ট্যাঁপা একটু ভেবে বললে, হুঁ, ঠিক কথা।
নিতে হবে ফেরবার সময়। সে কখন? নটার পর থেকে সাড়ে নটাৰু ভেতর।– জয়ধ্বজের ভুরুটা কুঁচকে এল : তখন তো নেপালদা দোকানের সামনে তার কাঠের টেবিলে চা তৈরি করছে। সাইকেল রয়েছে তার চোখের সামনেই।–একটু থামল জয়ধ্বজ : কী করে সম্ভব যে নেপালদা দেখতে পেল না?
ট্যাঁপা হঠাৎ শিউরে উঠল : আচ্ছা, এমন তত হতে পারে, নেপালদার সঙ্গে চোরের বন্দোবস্ত আছে?
জয়ধ্বজ হাসল।
যাঃ।
যাঃ কেন? অসম্ভব নাকি? ট্যাঁপা এবার গোয়েন্দা-গল্পের লাইনে ভাবতে আরম্ভ করেছিল : বুঝলি, বাইরে থেকে যাকে সবচেয়ে ইনোসেন্ট মনে হয়, আসলে হয়তো দেখা যায় সে-ই সব চাইতে বড় ক্রিমিন্যাল। শার্লক হোমসের একটা গল্পে
আরে দূর শার্লক হোমস!্যাঁপার এসব ভালো ভালো চিন্তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলে জয়ধ্বজ : গল্পের কথা রাখ। জানিস, অনেক সময় নেপালদা কলকাতায় গেলে মামা তার হাতে দুতিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে দেয় দোকানের জিনিস কেনবার জন্যে? এত বিশ্বাস করে যে, বলে–নেপালের কাছ থেকে হিসেব মেলাবারও দরকার নেই। আর যারই হোক, মামার কখনও লোক চিনতে ভুল হয় না।
তোর ভারি বিচ্ছিরি স্বভাব, জয়! ভেবেচিন্তে কু বের করি, আর সঙ্গে সঙ্গে তুই সব গুলিয়ে দিস।
জয়ধ্বজ বললে, কী করা যায় বল? মিথ্যে কুর পেছনে ছুটে তো কোনও লাভ নেই। আমার কেবল মনে হচ্ছে সবটাই যেন চোখের সামনে রয়েছে অথচ আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। যেন সেইসব প্রশ্নের অঙ্কের মতো–পড়লে ধাঁধা লাগে, কিন্তু জিনিসটা ধরতে পারলেই টক করে হয়ে যায়।
বিরক্ত হয়ে ট্যাঁপা বললে, মোনা পালকে ধরলেই অঙ্কের ফল মিলে যেত।
নিশ্চয়। একটুও সন্দেহ নেই।–জয়ধ্বজ মাথা নাড়ল : আমাদের ধোঁকা দিয়ে বেমালুম পালিয়ে গেল। আর সামনে থেকে পালালেই বা কী করা যেত? এখন চুরি করে না, কিন্তু চোরের ঠ্যাং তো–তার সঙ্গে দৌড়ে পাল্লা দেওয়া তোর-আমার কাজ নয়।
লোকটার কানে আরও গোটা দুই চিৎকার ছাড়তে পারলে কাজ হত–ট্যাঁপা গজগজ করতে লাগল।
তা হত। কিন্তু সেকান যে এখন কমাইল দূরে, তা কে জানে!
তাই বলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি?
নাঃ–চল, পঞ্চু সামন্তের ওখানে যাওয়া যাক। ওরই তো সাইকেলের দোকান আছে তমলুকে, চোরাই সাইকেল পাচার করে দেওয়া ওর পক্ষেই সম্ভব।
আবার চলা। ট্যাঁপা ক্রমশ বিরক্ত হচ্ছে, ভাবছে–এখন মোনা পালকেই খুঁজে বের করা উচিত, তা হলে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। আর মাথার ভেতর একটা চিন্তাই পাক খাচ্ছে জয়ধ্বজের : চোখের সামনে থেকে সাইকেলটা তুলে নিয়ে গেল, তবু কেন দেখতে পেল না। নেপালদা–কেন?
আর চোরের সঙ্গে কোনও যোগ আছে নেপালদার–এ কথা পাগলেও ভাবতে পারে না।
পঞ্চু সামন্তের একটা ছোট দোকান আছে এখানেও। সকালটা সে এখানে থাকে, বিকেলে বাসে চেপে তমলুক যায়।
দোকানের সামনে, একটা প্রকাণ্ড পাম্পারের ওপর প্রায় বৈঠকি দিয়ে একটা সাইকেল-রিকশার চাকায় হাওয়া ভরছিল মিচকে। পঞ্চুর ভাইপো। তার ভালো নাম একটা কিছু নিশ্চয় আছে, কিন্তু সবাই তাকে মিচকে বলেই ডাকে। নামটা বেমানান নয়, ভারি ঘুঘু ছেলে।
ওদের আসতে দেখেই কেমন যেন আড়চোখে তাকাল মিচকে, তারপরেই আবার পাম্পারের ওপর বৈঠকি দিতে লাগল।
ট্যাঁপা বললে, কেমন সন্দেহজনকভাবে তাকাল–দেখেছিস জয়?
জয়ধ্বজ বললে, হুঁ।
ওরা দাঁড়িয়ে রইল, মিচকে হুস হুস করে পাম্প দিতে লাগল। পাম্প হয়ে গেলে, রিকশাওলা নিতাই কৈরী তার পাঞ্জাব মেল নাম লেখা রিকশাটা নিয়ে বেল বাজাতে বাজাতে স্টেশনের দিকে রওনা হল।
তখন জয়ধ্বজ ডাকল :এই মিচকে!
দাঁড়াও না–একটু জিরিয়ে নিই। হাঁপিয়ে গেছি–দেখছ না?–হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটা তেলকালি-মাখা রুমাল বের করে মুখ মুছতে লাগল মিচকে। ওরা দাঁড়িয়ে রইল।
একটু সময় দিয়ে জয়ধ্বজ বললে, এই মিচকে, পঞ্চুমামা কোথায় রে?
গ্রাম সুবাদে পঞ্চ কীরকম মামা হয় জয়ধ্বজের। মিচকে বললে, মেজো কাকা? সে এখানে নেই, তমলুকে গেছে।
মিথ্যে কথা।–জয়ধ্বজ ধমকে উঠল : পঞ্চুমামা এ-বেলা কখনও তমলুকে যায় না, তায় আজকে ছুটির দিন।
তবু গেছে।
না–যায়নি।
মিচকে আবার সন্দেহজনকভাবে তাকাল। তারপর মিনমিন করে বলল, তবে তাই–তোমরা যখন বলছ, তা হলে যায়নি।
আছে কোথায় এখন?
আমি জানিনে।
জানিসনে?–জয়ধ্বজ চেঁচিয়ে উঠল : আবার মিথ্যে কথা?
তখন মিচকে মুখটাকে অদ্ভুত কাঁচুমাচু করে বললে, জানি জয়দা, জানি। কিন্তু বলব না–কক্ষনো বলব না।
কেন বলবি না?–জয়ধ্বজ একটা কড়া ধমক দিল।–তোকে বলতেই হবে। এই ট্যাঁপা, ধর তো ওকে। কেমন ও না বলে দেখি।–জানি কিন্তু বলব নাকক্ষনো বলব না!–কেমন না বলে আমি দেখছি—
কিন্তু কথা জয়ধ্বজের মুখেই রইল। দারুণ ঘুঘু ছেলে মিচকে, সে প্রচণ্ড বেগে একটা দৌড় দিল।
ধর–ধর করে ট্যাঁপা আর জয়ধ্বজ তার পেছু পেছু ছুটল।
কিন্তু মিচকের পায়ে তখন অলিম্পিক স্পিড। খানিকটা ছোটার পর মিচকে ওদের ছাড়িয়ে জঙ্গল পার হয়ে কোথায় চলে গেল চোখের নিমেষে!
ট্যাঁপা দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।–আর যাব না। কী হবে গিয়ে? মিচকেকে কিছুতেই ধরা যাবে না।
জয়ধ্বজও বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল। খানিকটা পর একটু জিরিয়ে নিয়ে বললে, চল তো পঞ্চ সামন্তের বাড়ি, দেখি গিয়ে তাকে পাওয়া যায় কিনা।
.
আট
পঞ্চু সামন্তের বাড়ি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। ওরা হাঁটতে লাগল দ্রুত পায়ে।
পঞ্চু সামন্তের বাড়িতে কেউ নেই, আছে এক বুড়ি বোবা পিসি। সেই ওদের দেখাশোনা করে, বেঁধে-টেধে দেয়। পিসি বোবা হলে কী হবে, তোক খুব ভালো।
জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপা গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাক দিল : পঞ্চুমামা–ও পঞ্চুমামা!
পিসি বারান্দায় বসে বড়ি দিচ্ছিল, ফিরেও তাকাল না। আবার ডাক ছাড়ল জয়ধ্বজ : পঞ্চুমামা, বাড়ি আছ?
পিসির যেন ভ্রুক্ষেপও নেই।
এবার ট্যাঁপা বাজখাঁই গলায় এক পেল্লায় হাঁক ছাড়ল–ও পিসি, বলি পঞ্চুমামা, কোথায়?
পিসি বড়ি দেবার ছোট টিনটা হাতে নিয়ে বারান্দা থেকে নেমে সেটাকে উঠোনের রোদে রেখে ইশারায় বললে, ভালো তো ব?
জয়ধ্বজ বললে, ভালো, কিন্তু পঞ্চুমামা কোথায়?
পিসি আবার একগাল হেসে ইশারায় বললে, তোর মার শরীর—
ভালো; কিন্তু পঞ্চুমামা কোথায়?
পিসি এবার গম্ভীর হয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল।
ও পিসি, কাঁদো কেন? পঞ্চুমামা কোথায়?–ট্যাঁপা এবার চিৎকার করে বললে।
সমস্ত মুখে একটা প্রচণ্ড ভয়ের ছায়া পড়ল পিসির। তারপর হাঁউমাউ করে একটা শব্দ করল খানিকক্ষণ। তারপর চটপট বড়ি দিয়ে চড়চড়ে হাতটা ধোবার জন্যে কুয়োর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।
ট্যাঁপা ধপ করে বারান্দায় বসে পড়ল।–জয়, এই বোবা কালা বুড়ীর সঙ্গে এভাবে কতক্ষণ কথা বলব বল তো? ও তো কিছুই বোঝে না! আর বলতেও পারে না।
জয়ধ্বজ বসে বসে ভাবতে লাগল। বললে, বুঝতে যদি পারে, তা হলে ওর কাছেই পঞ্চুমামার একটা হদিস মিলতেও পারে।
কিন্তু পিসিকে বোঝানো যাবে কী করে? ট্যাঁপা বললে, বোঝাতেই হবে যেমন করে হোক। পিসি লোক খুব ভালো, কিন্তু ভারি সাদাসিধে মানুষ। বিশেষ ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। এজন্যে পঞ্চুমামা ওকে খুব বকাবকি করে।
দেখ না তুই চেষ্টা করে, ওকে বোঝানোই যে শক্ত কাজ। যাক, হাত ধুয়ে আসুক তো আগে!
পিসি দুগ্লাস জল হাতে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। একটা রেকাবিতে দুটো নারকেলের নাড়। ইশারায় বললে, খাও তোমরা।
কী বিপদ! পিসি আমাদের হাঁপাতে দেখে ভেবেছে যে, জলতেষ্টায় আমরা মরে যাচ্ছি, এখুনি জল না পেলে আমাদের প্রাণ যাবে। তাই তাড়াতাড়ি জল আর নাড় এনে দিয়েছে।
জয় টপ করে রেকাবি থেকে একটা নাড় তুলে নিয়ে পিসির হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে পিসিকে ইশারায় বললে, এখানে বসোকথা আছে। ট্যাঁপা, তুই নাড় আর জলটা খেয়ে ফেল, তারপর পিসিকে নিয়ে আমাদের পড়তে হবে।
নাড়ু আর জলটা খেয়ে জয় আর ট্যাঁপা কিছুটা সুস্থ হল। তারপর পিসির কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলে, পিসি, পঞ্চুমামা কোথায়?
পিসি ঘাড় নেড়ে জানাল, কী?–বুঝতে পারছি না।
পঞ্চুমামা–সাইকেলের দোকান করে যে।–ট্যাঁপা মুখ দিয়ে কিরিং-কিরিং শব্দ করে বারান্দায় খানিকটা দৌড়ে বোঝাতে চাইল–যে-গাড়ি বেল বাজায় আর দুপায়ে গড়গড় করে চলে।
পিসি অবাক হয়ে ওদের দুজনের মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন বুঝতে চাইল। তারপর খানিকটা কী ভেবে নিয়ে ইশারায় জানাল : ঘরেই তো ছিল খাটে ঘুমিয়ে, এখন সে কোথায় গেছে জানি না– তারপর নিজেই যেন অবাক হয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে রইল।
যত সব বোবা কালাকে নিয়ে পড়া গেছে!–ট্যাঁপা বললে।–আমার মনে হচ্ছে উনি কিছু বুঝতেই পারছেন না।
পারছে না আবার! এমনিতে তো ঠোঁট নড়লেই অন্যদিন সব বুঝতে পারে, আজ একেবারে ন্যাকা সেজে গেছে যেন! কিছুতেই কিছু বুঝবে না ঠিক করেছে। ওর কাছ থেকে যে করেই হোক কথা বের করতেই হবে ট্যাঁপা, ধৈর্য হারালে চলবে না।–জয় বললে।
পিসি এক-একবার করে ইশারা করে, আবার ঘরের দিকে তাকায়, আবার বারান্দার কোনে কী যেন দেখে।
জয় বললে, পিসি, মিচকে কোথায়?
পিসি মাথা নাড়ল। বুঝতে পারছে না।
ট্যাঁপা বললে, মিচকে কি এখানেই থাকে?
জয় বললে, হ্যাঁ। ও পিসির খুব আদরের, ওকে পিসি ছেলের মত করে মানুষ করেছে। পিসির কেউ নেই কিনা। কিন্তু পিসি ঘরের মধ্যে বার বার তাকাচ্ছে কেন? ওখানে কী আছে?
পিসি, মিচকে কি পঞ্চুমামার খোঁজে গেছে?
পিসি শুধু ফিক ফিক করে হাসতে লাগল, কোনও কথার উত্তর দিল না।
সব বুঝছে, কিন্তু ন্যাকামির ভান করছে। জয় বললে।
কিন্তু উনি যদি কিছু না বলেন এই না বোঝার ভান করে, তা হলে আমরা কী করব? আমাদের তো করবার কিছু নেই। চল, চলে যাই–
করবার কিছু নেই? কী করি দেখ তা হলে।
.
নয়
মিচকে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছিল।
জয়ধ্বজ বললে : তবে রে। যত শয়তানীর মূলে এই ছোঁড়াটা। ও সব জানে কিন্তু বলবে না। ধর তো ট্যাঁপা, ওকে।
ট্যাঁপা আর জয়ধ্বজ ওর পেছনে ধাওয়া করতেই ও সেই ছড়াটা আওড়াতে আওড়াতে ছুট দিল তীরের মত বেগে
চিন্তামণি নেই কো বনে,
আছেন তিনি ঘরের কোণে
গৌ-মাতা তার বলেন হেসে,
খড় দেবে যে, দুধ খাবে সে।
দৌড়ে মিচকের সঙ্গে পারে সাধ্য কার?
খানিকটা ছুটে ট্যাঁপা বসে পড়ল।
বসলি যে?–জয় বললে,।
না, বসব না! চটেমটে ট্যাঁপা উত্তর দিল, ওর পেছনে পেছনে ছুটে কি ওকে ধরতে পারা যাবে? শুধু দৌড়নোই সার হবে। মোহনলাল, মিচকে, নেপালদা, পঞ্চু সামন্ত–এদের সবার যোগ আছে সাইকেল-চোরের সঙ্গে।
জয়ধ্বজও হাঁপাচ্ছিল। বললে, আমারও মনে হচ্ছে ওদের মধ্যে যে-কোনও একজনের কাছ থেকেই সব ব্যাপারটা জানা যেতে পারে। ওদের নিজেদের মধ্যে সাঁট আছে। তা ছাড়া আর একটা কথা আমার কেমন মনে হচ্ছে, সবটাই যেন চোখের সামনে রয়েছে অথচ আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। যেন সেইসব প্রশ্নের অঙ্কের মত–পড়লে ধাঁধা লাগে, কিন্তু জিনিসটা ধরতে পারলেই টক করে হয়ে যায়।
ধরতে পারলে তো টক করেই হয়ে যায়, কিন্তু ধরতে পারাটাই তো সমস্যা। ট্যাঁপা বলল।
ওই মিচকে সব জানে। পঞ্চুমামাকে কোনওমতে যদি ধরা যায়, তা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, আমি মনে করি।–জয় বললে।–সে নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে। ওই মিচকে সব জানে, কিন্তু বলবে না। সে যায়নি, এখানেই কোথাও আছে।
কিন্তু কোথায় যে আছে সেই তো কথা। ট্যাঁপা বললে–এখন আর বসে থেকে লাভ নেই, চল আমরা এগিয়ে চলি। বড্ড খিদে আর তেষ্টা পেয়েছে। একটু দূরেই আমার এক দূর-সম্পর্কের পিসিমা থাকেন, তাঁর কাছে গিয়ে খেয়ে নিই নইলে আর চলতে পারছি না।
ওরা দুজনেই এগিয়ে চলতে লাগল। বেলা পড়ে আসছে। দূরে সূর্য মাঠের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। পাখিরা বাসায় ফিরছে ধীরে ধীরে। ওরা এগিয়েই চলতে লাগল। পিসিমার বাড়ি তখন দেখা যাচ্ছে।
পিসিমারা গ্রামের সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থ। অনেক খেতখামার, পুকুর, বাগান–গোয়াল-ভরা গোরু, মরাই-ভরা ধান।
ওরা এগিয়ে যেতেই লাগল। সন্ধে তখন, পিসিমা তুলসীতলায় আলো দিচ্ছেন। ওরা দুজন উঠনে এসে দাঁড়াতেই দেখল, পিসিমা তুলসীতলায় প্রণাম করলেন।
পিসিমা, আমি আর আমার এক বন্ধু এসেছি। বড্ড খিদে পেয়েছে আমাদের, শিগগির কিছু খেতে দাও–
ওরা ধপ করে বারান্দার ওপর বসে পড়তেই ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল, কে যেন একজন ছায়ার মতো টুক করে পাছ-দরজা দিয়ে বাগানের মধ্যে নেমে পড়ল।
পঞ্চুমামা না?–জয় চিৎকার করে উঠল।
.
দশ
ট্যাঁপা চিৎকার করে উঠল, পঞ্চুমামা! তারপর পটলডাঙার টেনিদাকে কোট করে বললে, ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।
জয় বললে, ইয়াক–ইয়াক–ছোট-ছোট–
খাওয়া রইল মাথায়, ওরা পঞ্চু সামন্তের পেছনে ছুটতে লাগল।
খানিকটা সোজা পথে ছুটে লোকটা জঙ্গলের বাঁকা পথ ধরল।
তখন অন্ধকার নেমে গেছে। জঙ্গল-পথ বাঁকা, তার ওপর একটা কালো চাঁদরে লোকটার মুখ ঢাকা। ওরা কিছু ঠাহর করবার আগেই লোকটা তার পরিচিত পথ ধরে কোথায় কোনদিকে উধাও হয়ে গেল। একে অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, তার ওপর অপরিচিত পথ। ওরা অনেকটা ছুটেও লোকটাকে ধরতে পারল না, কোথায় যেন মিলিয়ে গেল সে।
ওরা ঘুরতে ঘুরতে ফের একটা বড় গোয়ালঘরের পাশে চলে এল। জয়ধ্বজ বললে, আমরা আজ আর বাড়ি যাব না। রাতে এই গোয়ালঘরেই থাকব। পাশেই তো ওই পথুমামার বিরাট গোয়াল, সকালে ওখানে পঞ্চুমামা আসবেই। তখন–
একটু অন্যমনস্কভাবে আবার বলল জয়ধ্বজ, মামা সাইকেলটা দেবার সময় আমাকে বলেছিলেন, যত্ন করে রাখিস–কেউ চুরি-টুরি করে না নিয়ে যায়। আমি বলেছিলুম, কোনও চোরের ঘাড়ে তিনটে মাথা নেই যে, জয়ধ্বজ মণ্ডলের সাইকেল চুরি করে নেবে। মামা বলেছিলেন, বেশ, দেখব, কেমন হুঁশিয়ার ছেলে তুই। সাইকেলটা উদ্ধার না করে মামার কাছে দাঁড়াতে পারব আমি! প্রেসটিজ থাকবে আমার?
তা বটে–তা বটে! ট্যাঁপা ভাবনায় পড়ল।
গেজেট সুরেশ হালদার এতক্ষণে খুকখুক করে কাশতে কাশতে গিয়ে নিশ্চয়ই খবর দিয়েছে মামাকে-নেপালের চায়ের দোকান থেকে তোমার ভাগনের সাইকেলটা লোপাট। জানি না মামা আমাকে এ-সব শোনবার পর কী ভাবছে। না ট্যাঁপা, আমি এই গোয়ালঘরেই বসলাম, সাইকেল উদ্ধার না করে আমি আর কোথাও যাব না। যদি পাই, তখন মুখ করে বলতে পারব–দ্যাখো মামা, এই সাইকেল–জয়ধ্বজ মণ্ডলের জিনিস কেউ হজম করতে পারে না।
ওরা গোয়ালঘরের ভেতরেই একপাশে বসে পড়ল। কিন্তু গোয়ালটা বড্ড নোংরা, পাঁক আর কাদায় ভরা। বসবার জায়গা নেই। ট্যাঁপা বললে, চল না, আমরা পাশের পঞ্চুমামার গোয়ালঘরে গিয়ে বসি, ওটা বরং বেশ পরিষ্কার আছে।
ওরা পাশের বেড়াটা পার হয়ে পথু সামন্তের গোয়ালঘরে গিয়ে ঢুকল।
গোয়ালটা পরিষ্কার বটে, তবে মশার হাত থেকে বাঁচা শক্ত। মেঘের মতো কালো হয়ে এসে মশারা ওদের হেঁকে ধরল। দুহাত দিয়ে সরিয়েও নিষ্কৃতি নেই, সর্বাঙ্গ যেন ফুলিয়ে দিল।
তার ওপর আর-এক উৎপাত। একটা গোরু পাশে দাঁড়িয়েছিল, খসখসে জিভ দিয়ে সমানে জয়ের গা চেটে চেটে চামড়া উঠিয়ে দিতে লাগল যেন সে। জয় যত পেছনে সরে যায়, গোরুটাও ততই এগিয়ে আসে। আর সরবে কোথায়? পেছনেও তো গোরুর পাল।
ট্যাঁপা বললে, পাশের ঘরে খড় জমা করা আছে। চল, খানিকটা খড় ওদের মুখের সামনে এনে দিতে পারলে আর গা চাটবে না–খড় খাওয়াতেই মন দিয়ে দেবে।
তাই চল, খানিকটা খড়ই এনে দিই গোরুটাকে। ও তো চেটে চেটে আমার গায়ে অর্ধেক চামড়া তুলে নিলে।
কিন্তু খড় টানতে গেলে তো শব্দ হবে। ওরা যদি চোর মনে করে আমাদের ওপর মারধোর করে!–ট্যাঁপা হঠাৎ ভেবে বললে।
তার তো সম্ভাবনা প্রচুর, কিন্তু কী করা যায় বল? যেভাবে গোরুগুলো আমাদের চাটতে আরম্ভ করেছে তাতে এখানে যদি একটুও বসে থাকি, ওরা আমাদের গায়ের আর একটু চামড়াও রাখবে না। তার ওপর মশা আর ডাঁশ তো আছেই।
কী করা যায়? চল দেখি, চুপি চুপি যাই।–ট্যাঁপা, তুই একটুও শব্দ করবি না। আর খড়ও টানবি খুব ধীরে ধীরে, যেন একটুও শব্দ না হয়। ওরা যেন কিছুই জানতে না পারে। তা হলে আমাকে আর তোকে ওরা আস্ত রাখবে না।
তা বটে! আগে তো হাতের সুখ করে নেবে চোর বলে; পরে জানতে পারলে হয়তো আপসোস করবে। কিন্তু তাতে তো আমাদের গায়ের জ্বালা কমবে না।
আচ্ছা চল, পা টিপে টিপে এগোই আমরা। না এগিয়ে তো কোনও উপায়ও নেই।
ওরা আস্তে আস্তে এগোতে লাগল।
ট্যাঁপা!–জয় ডাকল : মোহনলালের ধাঁধাটার কথা তোর মনে আছে?
হ্যাঁ, কেন থাকবে না? খুব মনে আছে–
চিন্তামণি নেই রে বনে,
থাকেন তিনি ঘরের কোণে।
গৌ-মাতা তার বলেন হেসে
খড় দেবে যে, দুধ খাবে সে।
কোত্থেকে এল ওই যে কে এক মোহনলাল-ধাঁধা-ফাঁধা নিয়ে কী যে, এক পাগলামি করতে লাগল। আর জয়, তোর মাথায়ও সেই পাগলামি ঢুকেছে দেখছি।কিসের বা চিন্তামণি, আর কিসের বা গৌ-মাতা! যত সব পাগলামো
জয় মাথা নাড়ল, চুপ কর–চুপ কর। আমি ভাবছি ধাঁধাটার কথা। আর অত কথা বলিস না, শেষে ধরা পড়ে যেতে হবে। একেই তো সকাল থেকে কার মুখ দেখে যেন আজ উঠেছি। সাইকেলটা চুরি গেল, তারপর থেকে সারা সকাল আমাদের ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে, তার কোনও তুলনা নেই। এরপরেও হয়তো আরও কত কষ্ট আছে কে জানে!
ওরা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল।
নিশুতি রাত। পঞ্চ সামন্তের বাড়ির সবাই অঘোর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। ওরা ধীরে ধীরে খড়ের গাদার কাছে এগিয়ে এল, কিন্তু খড় টানতে দ্বিধা করতে লাগল। যদি শব্দ হয়, তাহলে সবাই তো জেগে যাবে। ধরাও পড়ে যাবে, কাজও হবে না।
ট্যাঁপা বললে, এখানেই বসি না আমরা! গোয়ালঘরে যাবার আমাদের কী দরকার?
জয় বললে, না। জানলাটা ওদের ঘর বরাবর। ওটা খুললেই আমাদের স্পষ্ট দেখা যাবে। তার ওপর একটু যদি নড়াচড়া করি তারও শব্দ শোনা যাবে। আর গোয়ালঘরে থাকলে গোরুর নড়াচড়ায় ওরা ভাববে যে গোরই ওরকম করছে। ওখানে যে মানুষ আছে, ওরা তা ভাবতেও পারবে না। তুই ধীরে ধীরে খানিকটা খড় ওপাশ থেকে টেনে নে। গোরুগুলোকে একটু ঠাণ্ডা করতে না পারলে ওরা আমাদের ওখানে কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে দেবে না।
জয় এগিয়ে গেল পা টিপে টিপে; পেছনে ট্যাঁপা। ঘরের এক কোনে খড়ের গাদার কাছে গিয়ে গোরুকে দেবার জন্যে গাদায় টান পড়তেই কী যেন লাগল হাতে।
জয় চাপা গলায় ট্যাঁপা–! বলে ডাক দিয়ে জোরে টান দিতেই হুড়মুড় করে একটা কচকে নতুন সাইকেল মাটিতে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে পঞ্চ সামন্ত চোর–চোর! মিচকে, লাঠি নিয়ে আয়, গোয়ালে চোর ঢুকেছে। বলে কে হাতে ইয়া এক বোম্বাই গদার মত লাঠি আর এক হাতে লণ্ঠন নিয়ে ছুটে এল।
.
এগারো
না–না করতে করতেও জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপার পিঠে বেশ গোটা কতক জোর রদ্দা ধাঁই ধাঁই করে পড়ে গেল। পঞ্চুমামা যেন কথাগুলো শুনেও শোনেন না। ট্যাঁপা চিৎকার করে। বললে, এ যেমন রদ্দা হাঁকড়াচ্ছে–আমার কানটা কানপুরে, নাকটা নাগপুরে পাঠিয়ে আমায় টেনিদার ভাষায় মুগ্ধবোধ করে ছাড়বে! চিৎকার কর—
ও পঞ্চুমামা!–আমরা জয়ধ্বজ আর ট্যাঁপা!
এতক্ষণে যেন কথাটা পথুমামার কানে গেল।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে।
উঠনের ওপরে নতুন সাইকেলটা ভোরের আলোয় চকচক করছে। তাকিয়ে তাকিয়ে জয়ধ্বজের মনে পড়ছে–সাইকেল নয় তো, যেন রাজত্ব। যেদিন সকালে ব্রাউন পেপারে মোড়া নতুন সাইকেলটা তাকে দেখিয়ে মামা বললেন, ওটা তোর, তোকে দিলুম–সেদিন জয়ধ্বজ প্রথমটা বিশ্বাসই করতে পারেনি। একটা সাইকেলের শখ যে তার কতদিনের, সে কথা তার চেয়ে বেশি করে কে জানে! এ যেন না চাইতেই হাতে স্বর্গ পেয়ে যাওয়া!
হঠাৎ চমক ভাঙল। মোহনলাল আসছেন মিটমিট করে তার দিকে তাকাতে তাকাতে–
চিন্তামণি নেই রে বনে,
থাকেন তিনি ঘরের কোণে।
গৌ-মাতা তার বলেন হেসে
খড় দেবে যে, দুধ খাবে সে।
–বলি জয়ধ্বজ, ধাঁধার উত্তরটা এবার এল তোমার? কিছু চিন্তা করে পেলে?
জয়ধ্বজ মাথা নিচু করল। কোনও কথা বলল না।
তোমার মামা তোমার খুব প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, যেমন কাজের ছেলে, তেমনি সাবধানী আর সেই রকম দায়িত্বজ্ঞান। তার প্রমাণ পেলাম। কিন্তু পাবার আগে তো পরীক্ষার প্রয়োজন; তাই মোনাকে বলে তোমাদের সাইকেলটা খোঁজার সোজা পথটা একটু বাঁকা করে দিলাম। যাকে তার মামা এত প্রশংসা করছেন, তাকে একটু যাচাই করা প্রয়োজন বইকি! তুমি কী বলো ট্যাঁপা?
ট্যাঁপা এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
তবে ঘোরানোটা একটু বেশি হয়ে গেছে।–মোহনলাল দাওয়ার ওপর একটা জলচৌকি নিয়ে বসে পড়লেন।
দরজার কাছে একটা শব্দ হল। মিচকে ঢুকছে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে। সঙ্গে ভীমরাজ পুরকায়েত।
জয়ধ্বজ ছুটে মামার কাছে এগিয়ে গেল।
জয়।–মামা ডাকলেন।–আমার কাছে দাওয়ার ওপরে বসো।
পঞ্চু সামন্ত মিচকেকে নিয়ে একটু বেরিয়ে গেল–মামা, এক্ষুনি আসছি।
ভীমরাজ পুরকায়েত জয় আর ট্যাঁপাকে দাওয়ার ওপর বসিয়ে বললেন, দেখো, জয়ধ্বজ, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে। লম্বা রোগা চেহারার লোকটি এবার বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
তুমি জানো জয়ধ্বজ, আমি নিজের চেষ্টায় এত বড় ব্যবসা গড়ে তুলেছি। এত সম্পত্তি করেছি। আমি একটি দিন বিশ্রাম করিনি, কখনও অলস, অসাবধান হইনি।
দিদি তোমার কথা বলতেই, আমি তোমাকে আমার দোকানে কাজ শেখাবার জন্য নিয়েছিলাম। তুমি কাজে প্রথম বিরক্ত হতে। আমি নামা ধনেখালি, আর শান্তিপুরী, দেখা বেগমপুর বললেই তোমার ভুরু কুঁচকে আসত। আস্তে আস্তে তুমি কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলে। তোমার সবটাই সয়ে গেল। আস্তে আস্তে কাজটা ভালো লাগতে শুরু করল। আমি আগাগোড়াই নজর রেখে চললাম। ভুলচুক হলে ছোটখাটো ধমক দিতাম–এ ব্যবসার কাজ বাপু, সব সময় মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
আমার উদ্দেশ্য ছিল আলাদা। জানো, আমার ব্যবসার ভবিষ্যৎ মালিক তুমি। এত বড় ব্যবসা যার হাতে তুলে দিয়ে যাব, তাকে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে যাওয়া দরকার–সব সময় লক্ষ রাখা উচিত তার ওপর। ত্রিশ বছরের পরিশ্রমে যে-দোকান আমি গড়ে তুলেছি, আনাড়ির হাতে পড়ে তা নষ্ট হয়ে যাবে–আমি তা কোনওমতেই সইতে পারব না।
আজ দুবছর তোমার কাজকর্ম দেখে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলাম। মনে হল না, ছেলেটা পারবে ব্যবসা সামলে রাখতে। সব সময় লক্ষ করি, খদ্দেরদের সঙ্গে তুমি ভালো ব্যবহার করো– কথা কইতে জানো সব রকম লোকের সঙ্গে। তোমার গুণে ব্যবসার উন্নতিও হয়েছে।
তাই খুশি হয়ে তোমাকে একটা নতুন সাইকেল দিলাম। তুমি এটা পেয়ে কেমন যত্ন করে রাখা তাই দেখবার জন্যে–অল্প দিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম–বেশি পেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সব নষ্ট করে না ফেলো। কিন্তু দেখলাম, তুমি সাইকেলটাকে চাবি দিয়ে না রেখে চা খেতে নেপালের দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়লে। তোমার ইচ্ছে চাবি দেবার, কিন্তু আনন্দে ভুলে গেছ। আমিই সাইকেলটা তুলে নিয়ে যাই–পঞ্চু সামন্ত সেটা গোয়ালঘরের খড়ের গাদায় লুকিয়ে রাখে।
তা হলে মামা, ওঁরা আমাদের এত কষ্ট দিলেন কেন? ট্যাঁপা বললে।
কষ্ট দেওয়া হল কেন? জয়কে পরীক্ষা করছিলাম। যদি কিছু খোয়া যায় ওর, আবার তা ফিরিয়ে আনার ধৈর্য-যত্ন-শক্তি আছে কি না তাই দেখছিলাম। ও সে পরীক্ষায় পাশ করেছে। এখন আমার বিশ্বাস হল, বিপদে পড়লে শক্ত হাতে হাতল ধরে বিপদকে কাটিয়ে ওঠবার শক্তি ওর আছে। আমি তোমায় আশীবাদ করি জয়, তুমি জয়ী হও।
এক-হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে মিচকে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে এসে ঢুকল বাড়ির ভেতর। পেছন পেছনে পঞ্চ সামন্ত, নেপালদা, মোনা পাল। মিটমিট করে মোহনলালও রসগোল্লার হাঁড়িটার দিকে তাকাতে লাগলেন।
ভীমরাজ পুরকায়েত বললেন, ওটা তোমার অনার-এ আনিয়েছি জয়, তুমি ওগুলো সবাইকে ভাগ করে দাও। আয় ট্যাঁপা, তুই আমায় হেলপ কর।–বিজয়ীর হাসি হেসে জয়ধ্বজ ট্যাঁপাকে বললে।