টিকটিকির ল্যাজ

ক্যাবলাদের বসবার ঘরে বসে রেডিয়োতে খেলার খবর শুনছিলুম আমরা। মোহনবাগানের খেলা। আমি, টেনিদা, আর ক্যাবলা খুব মন দিয়ে শুনছিলুম, আর থেকে-থেকে চিৎকার করছিলুম—গো-গো–গোল। দলের হাবুল সেন হাজির ছিল না–সে আবার ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। মোহনবাগানের খেলায় হাবলার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।

কিন্তু চেঁচিয়েও বেশি সুবিধে হল না– শেষ পর্যন্ত একটা পয়েন্ট। আমাদের মন-মেজাজ এমনি বিচ্ছিরি হয়ে গেল যে, ক্যাবলার মার নিজের হাতে তৈরি গরম গরম কাটলেটগুলো পর্যন্ত খেতে ইচ্ছে করছিল না। এই ফাঁকে টেনিদা আমার প্লেট থেকে একটা কাটলেট পাচার করল- মনের দুঃখে আমি দেখেও দেখতে পেলুম না। কিছুক্ষণ উদাস হয়ে থেকে ক্যাবলা বললে, দ্যুৎ!

আমি বললুম, হুঁ।

টেনিদা হাড়-টাড় সুদ্ধ চিবিয়ে কাটলেটগুলো শেষ করল, তারপর কিছুক্ষণ খুব ভাবুকের মতো চেয়ে রইল সামনের দেয়ালের দিকে। একটা মোটা সাইজের টিকটিকি বেশ একমনে কুপকুপ করে পোকা খাচ্ছিল, তাকে লক্ষ্য করতে করতে টেনিদা বললে, ওই যে!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ওই যে, কী?

মোহনবাগান।

–মোহনবাগান মানে?

টিকটিকি। মানে টিকটিকির ল্যাজ।

শুনে আমি আর ক্যাবলা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম, খবরদার টেনিদা, মোহনবাগানের অপমান কোরো না।

টেনিদা নাক-টাক কুঁচকে মুখটাকে পাঁপর ভাজার মতো করে বললে, আরে খেলে যা। বললুম কী, আর কী বুঝল এ-দুটো!

 

–এতে বোঝবার কী আছে শুনি। তুমি মোহনবাগানকে টিকটিকির ল্যাজ বলছ

-চুপ কর প্যালা–মিথ্যে কুরবকের মতো বকবক করিসনি। যদি বাবা কচুবনেশ্বরের কথা জানতিস তা হলে বুঝতিস-টিকটিকির রহস্য কী!

কচুবনেশ্বর। সে আবার কী? এবার ক্যাবলার জিজ্ঞাসা।

–সে এক অত্যন্ত ঘোরালো ব্যাপার। যাকে ফরাসী ভাষায় বলে পুঁদিচ্চেরি!

–পুঁদিচ্চেরি তো পণ্ডিচেরি। সে তো একটা জায়গার নাম। ক্যাবলা প্রতিবাদ করল।

-শট আপ। জায়গার নাম! টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, ভারি ওস্তাদ হয়ে গেছিস যে। আমি বলেছি যে, পুঁদিচ্চেরি মানে ব্যাপার অত্যন্ত সাংঘাতিক ব্যস! এ-নিয়ে তক্কো করবি তো এক চড়ে তোর কান

আমি বললুম–কানপুরে উড়ে যাবে।

রাইট।–টেনিদা গম্ভীর হয়ে বললে, এবার তা হলে বাবা কচুবনেশ্বরের কথাটা বলি। ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার, খুব ভক্তি করে শুনবি। যদি তক্কো-টকো করিস তা হলে…

আমরা সমস্বরে বললুম-না-না।

টেনিদা শুরু করল :

সেবার গরমের ছুটিতে সেজ পিসিমার কাছে বেড়াতে গেছি ঘুঁটেপুকুরে। খাসা জায়গা। গাছে গাছে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা

আমি বললুম-আহা, শুনেই যে লোভ হচ্ছে। ঘুঁটেপুকুরটা কোথায় টেনিদা?

 

ক্যাবলা ব্যাজার হয়ে বললে আঃ, গল্প থামিয়ে দিস নে। ঘুঁটেপুকুর কোথায় হবে আবার? নিশ্চয় গোবরডাঙার কাছাকাছি।

টেনিদা বললেনা, না গোবরডাঙার কাছে নয়। রানাঘাট ইসটিশন থেকে বারো মাইল দূরে। দিব্যি জায়গা রে। চারদিকে বেশ শ্যামল প্রান্তর-টান্তর–পাখির কাকলি-টাকলি কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু তারও চাইতে বেশি আছে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা। খেয়ে খেয়ে আমার গা থেকে এমনি আম-কাঁঠালের গন্ধ বেরুত যে, রাস্তায় আমার পেছনে-পেছনে আট-দশটা গোরু বাতাস শুকতে-শুকতে হাঁটতে থাকত। একদিন তো-কিন্তু না, গোরুর গল্প আজ আর নয় বাবা কচুবনেশ্বরের কথাই বলি।

হয়েছে কী জানিস, আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুঁটেপুকুর ফুটবল ক্লাব তো আমায় লুফে নিয়েছে। আমি পটলডাঙার থাণ্ডার ক্লাবের ক্যাপটেন- একটা জাঁদরেল সেন্টার ফরোয়ার্ড–সেও ওদের জানতে বাকি নেই।

দুদিন ওদের সঙ্গে খেলেই বুঝতে পারলুম- ওদের নাম হওয়া উচিত ছিল বাতাবি নেবু স্পোর্টিং ক্লাব। মানে বাতাবি নেবু পর্যন্তই ওদের দৌড়, ফুটবলে পা ছোঁয়াতে পর্যন্ত শেখেনি। কিছুদিন তালিম-টালিম দিয়ে এক রকম দাঁড় করানো গেল। তখন ঘুঁটেপুকুরে পাঁচুগোপাল কাপের খেলা চলছিল। বললে বিশ্বাস করবিনে, আমার তালিমের চোটে ঘুঁটেপুকুর ক্লাব তিন-তিনটে গেঁয়ো টিমকে হারিয়ে দিয়ে একেবারে ফাইনালে পৌঁছে গেল। অবিশ্যি সব কটা গোল আমিই দিয়েছিলুম।

ফাইনালে উঠেই ল্যাঠা বাধল।

ওদিক থেকে উঠে এসেছে চিংড়িহাটা হিরোজ–মানে এ-তল্লাটে সব চেয়ে জাঁদরেল দল। তাদের খেলা আমি দেখেছি। এদের মতো আনাড়ি নয়–এক-আধটু খেলতে-খেলতে জানে। সব চেয়ে মারাত্মক ওদের গোলকিপার বিলটে ঘোষ। বল তো দূরের কথা, গোলের ভেতরে মাছি পর্যন্ত ঢুকতে গেলে কপাৎ করে লুফে নেয়। আর তেমনি তাগড়াই জোয়ান কাছে গিয়ে চার্জফার্জ করতে গেলে দাঁত-মুখ আস্ত নিয়ে ফিরতে হবে না।

স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, ঘুঁটেপুকুরের পক্ষে পাঁচুগোপাল কাপ নিতান্তই মরীচিকা!

 

ঘুঁটেপুকুর ক্লাব চুলোয় যাক– সে জন্যে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমি টেনি শর্মা, খাস পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাবের ক্যাপ্টেন আসল কলকাতার ছেলে, আমার নাকের সামনে দিয়ে চিংড়িহাটা ড্যাং-ড্যাং করতে করতে কাপ নিয়ে যাবে। এ-অপমান প্রাণ থাকতে সহ্য করা যায়? তার ওপর এক মাস ধরে ঘুঁটেপুকুরের আম কাঁঠাল এন্তার খেয়ে চলেছি–একটা কৃতজ্ঞতাও তো আছে?

কিন্তু কী করা যায়।

দুপুরবেলা বসেবসে এই সব ভাবছি, এমন সময় শুনতে পেলুম, সেজ পিসিমা কাকে যেন বলছেন–বসেবসে ভেবে আর কী করবে–বাবা কচুবনেশ্বরের থানে গিয়ে ধন্না দাও।

কচুবনেশ্বর! ওই বিটকেল নামটা শুনেই কান খাড়া করলুম।

সেজ পিসিমা আবার বললেন- বাবার থানে ধন্না দাও–জাগ্রত দেবতা– তোমার ছেলে নির্ঘাত পরীক্ষায় পাশ করে যাবে।

গলা বাড়িয়ে দেখলুম, পিসিমা দত্ত-গিন্নির সঙ্গে কথা কইছেন। দত্ত-গিন্নি বললেন– তা হলে তাই করব, দিদি। হতচ্ছাড়া ছেলে দুবার পরীক্ষায় ডিগবাজি খেলে, উনি বলছেন এবারেও ফেল করলে লাঙলে জুড়ে চাষ করাবেন।

দত্ত-গিন্নির ছেলে চাষ করুক- আমার আপত্তি নেই, কিন্তু বাবা কচুবনেশ্বরের কথাটা কানে লেগে রইল। আর দত্ত-গিন্নি বেরিয়ে যেতে না যেতেই আমি পিসিমাকে পাকড়াও করলুম।

বাবা কচুবনেশ্বর কে পিসিমা?

শুনেই পিসিমা কপালে হাত ঠেকালেন। বললেন– দারুণ জাগ্রত দেবতা রে। গাঁয়ের পুব দিকে কচুবনের মধ্যে তাঁর থান। পয়লা শ্রাবণ ওখানে মোচ্ছব হয়- কচু সেদ্ধ, কচু ঘন্ট, কচুর ডালনা, কচুর অম্বল, আর কচুর পোলাও দিয়ে তাঁর ভোগ হয়।

টেনিদার গল্প শুনতে-শুনতে আমার জানতে ইচ্ছে হল, কচুপোড়াটাই বা বাদ গেল কেন। কিন্তু ঠাকুর-দেবতাদের কচুপোড়া খেতে বললে নিশ্চয় তাঁরা চটে যাবেন– তাই ব্যাপারটা চেপে গেলুম। জিজ্ঞেস করলুম, কচুর পোলাও খেতে কেমন লাগে টেনিদা!

 

টেনিদা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বললে- আঃ, কচু খেলে যা। আমি কি কচুর পোলাও খেয়েছি নাকি যে বলব! ইচ্ছে হয় পয়লা শ্রাবণ ঘুঁটেপুকুরে গিয়ে খেয়ে আসিস।

ক্যাবলা অধৈর্য হয়ে বললে, টিকটিক করিস নে প্যালা, গল্পটা বলতে দে। তুমি থেমো না টেনিদা, চালিয়ে যাও।

টেনিদা বললে, সেজ পিসিমার ভক্তি দেখে আমারও দারুণ ভক্তি হল। আর ভেবে দ্যাখ কচু সেদ্ধ, কচু ঘন্ট, কচুর অম্বল, কচুর কালিয়া–মানে এত কচু ম্যানেজ করা চাট্টিখানি কথা! আমার তো কচু দেখলেই গলা কুটকুট করে। কচু ভোগের বহর দেখে মনে হল, দেবতাটি তো তবে সামান্যি নয়।

জিজ্ঞেস করলুম– বাবা কচুবনেশ্বরের কাছে ধরনা দিয়ে ফুটবল ম্যাচ জেতা যায়, পিসিমা?

পিসিমা বললেন- ফুটবল ম্যাচ বলছিস কী? বাবার অসাধ্য কাজ নেই। এই তো, ওবাড়ির মেন্টির মাথায় এমন উকুন হল যে, তিনবার ন্যাড়া করে দিয়েও উকুন যায় না। কত মারা হল, কত কবিরাজী তেল–উকুন যে-কে সেই! শেষে মেন্টির মা কচুবনেশ্বরের থানে ধন্না দিয়ে আধ ঘণ্টা চুপ করে পড়ে থেকেছে–

ব্যস, হাতে টুপ করে কিসের একটা শেকড় পড়ল। সেই শেকড় বেটে লাগিয়ে দিতেই একদিনে উকুন ঝাড়ে বংশে সাফ। আর মেন্টির যা চুল গজাল–সে যদি দেখতিস! একেবারে হাঁটু পর্যন্ত।

আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলম। বললুম- বাবার থান কোন দিকে পিসিমা?

ওই তো সোজা পুবদিক বরাবর একেবারে নদীর ধারেই। কচুবনের ভেতরে বাবার থান, অনেক দূর থেকেই তো দেখা যায়। তুই সেখানে ধন্না দিতে যাবি নাকি রে? তোর আবার কী হল?

 

-কিছু হয়নি বলে সোজা পিসিমার সামনে থেকে চলে এলুম। মনে-মনে ঠিক করলুম, কাউকে জানতে দেওয়া নয়- চুপিচুপি একাই গিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরনা দেব। একটা শেকড়-টেকড় যদি পেয়ে যাই–বেটে খেয়ে নেব, তারপর কালকের খেলায় আমাকে আর পায় কে? ওই ডাকসাইটে বিলটে ঘোষের হাতের তলা দিয়েই তিন তিনখানা গোল ঢুকিয়ে দেব।

একটু পরেই রামায়ণ খুলে সুর করে সূর্পনখার নাসাচ্ছেদন পড়তে-পড়তে পিসিমা যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি সোজা একেবারে কচুবনেশ্বরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লুম।

বেশি হাঁটতে হল না। আমবাগানের ভেতর দিয়ে সিকি মাইলটাক যেতেই দেখি সামনে একটা মজা নদী আর তার পাশেই কচুর জঙ্গল। সে কী জঙ্গল। দুনিয়া সুদ্ধ সব লোককে কচু ঘণ্ট খাইয়ে দেওয়া যায়- কচুপোড়া খাওয়ানোও শক্ত নয়, এমন বন সেখানে। আর তারই মাঝখানে একটা ছোট মন্দিরের মতো বুঝলুম ওইটেই হচ্ছে বাবার থান।

বন ঠেলে তো মন্দিরে পৌঁছানো গেল। কচুর রসে গা একটু চিড়বিড় করছিল কিন্তু ওটুকু কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে। গিয়ে দেখি, মন্দিরে মূর্তি-ফুর্তি নেই- একটা বেদী, তার ওপর গোটা কয়েক রং-চটা নয়া পয়সা, কিছু চাল, আর একরাশ কচুর ফুল শুকিয়ে রয়েছে। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে মন্দিরের বারান্দায় ধরনা দিলুম।

চোখ বুজে লম্বা হয়ে শুয়ে আছি। হাত দুটো মেলেই রেখেছি কোন্ হাতে টুপ করে বাবার দান পড়বে বলা যায় না তো। পড়ে আছি তো আছিই–একরাশ মশা এসে পিন-পিন করে কামড়াচ্ছে কানের কাছে গোটা দুই গুবরেপোকা ঘুরঘুর করছে, কচু লেগে হাত-পা কুটকুট করছে। কিন্তু মশা তাড়াচ্ছি না, গা চুলকোচ্ছি না, খালি দাঁত-মুখ সিঁটিয়ে প্রাণপণে প্রার্থনা করছি–দোহাই বাবা কচুবনেশ্বর, একটা শেকড়-টেকড় চটপট ফেলে দাও চিংড়িহাটার বিলটে ঘোষকে ঠাণ্ডা করে দিই। বেশি দেরি কোরো না বাবা-গা-হাত ভীষণ চুলকোচ্ছে, আর দারুণ মশা! আর তা ছাড়া থেকে-থেকে বনের ভেতর কী যেন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে ডাকছে– যদি পাগলা শেয়াল হয় তা হলে এক কামড়েই মারা যাব। দোহাই বাবা, দেরি কোরো না– যা দেবার দিয়ে দাও, কুইক কচুবনেশ্বর।

যেই বলেছি অমনি বাঁ হাতে কী যেন টপাস করে পড়ল।

ইউরেকা বলে যেই লাফিয়ে উঠেছি–দেখি, শেকড়ের মতোই কী একটা পড়েছে বটে! কিন্তু এ কী! শেকড়টা তুরুক-তুরুক করে অল্প-অল্প লাফাচ্ছে যে!

মন্ত্রপূত জ্যান্ত শেকড় নাকি?

আর তখুনি মাথার ওপর ট্যাক-ট্যাক-টিকিস করে আওয়াজ হল। দেখি, দুটো টিকটিকি দেওয়ালের গায়ে লড়াই করছে তাদের একটার ল্যাজ নেই। মানে, মারামারিতে খসে পড়েছে।

রহস্যভেদ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। তা হলে আমার হাতে শেকড় পড়েনি, পড়েছে টিকটিকির কাটা ল্যাজ! টিপে দেখলুম রবারের মতো আর অল্প-অল্প নড়ছে তখনও।

 

দুবুদ্ধি হলে যা হয়–ভীষণ রাগ হয়ে গেল আমার মনে হল, বাবা কচুবনেশ্বর আমায় ঠাট্টা করলে। এতক্ষণ গায়ের কুটকুটুনি আর মশার কামড় সহ্য করে শেষে কিনা টিকটিকির ল্যাজ! গোঁ গোঁ করে উঠে পড়লুম। তক্ষুনি আবার সেই শিয়ালটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে ডেকে উঠল–মনে হল এখানে থাকাটা আর ঠিক নয়। মন্দির থেকে নেমে কচুবন ভেঙে সোজা বাড়ি চলে এলুম– আধ সের সর্ষের তেল মেখে এক ঘন্টা পরে পায়ের জ্বলুনি খানিকটা বন্ধ হল।

টেনিদা এই পর্যন্ত বলতে আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলুম না। ফস করে জিজ্ঞেস করলুম– সেই টিকটিকির ল্যাজটা কী হল?

আঃ থাম না–আগে থেকে কেন বাগড়া দিচ্ছিস? ফের যদি কথা বলবি, তা হলে দেওয়ালের ওই টিকটিকিটক পেড়ে তোর মুখে পুরে দেব বলে টেনিদা আমার দিকে বজ্ৰদৃষ্টিতে তাকাল।

ক্যাবলা বললে ছেড়ে দাও ওর কথা, তুমি বলো।

বলবার আর আছে কী–টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : ভুল যা হয়ে গেল, তার শাস্তি পেলুম পরের দিনই।

ইস্কুলের মাঠে পাঁচুগোপাল কাপের ফাইনাল ম্যাচ। ঘুঁটেপুকুর ক্লাবকে বলেছি, প্রাণ দিয়েও কাপ জিততে হবে। আর সত্যি কথা বলতে কী-বাতাবি নেবু স্পোর্টিং আজ সত্যিই ভালো খেলছে। এমন কি আমরা হয়তো দু-একটা গোলও দিয়ে ফেলতে পারতুম– যদি ওই দুরন্ত-দুর্ধর্ষ বিলটে ঘোষটা না থাকত। আমাদের গোলকিপার প্যাঁচাও খুব ভালো খেলেছে- দু-দুবার যা সেভ করলে, দেখবার মত।

হাফ-টাইম পর্যন্ত ড্র। কিন্তু বুঝতে পারছিলুম–ঘুঁটেপুকুরের দম ফুরিয়ে আসছে, পরের পঁচিশ মিনিট ঠেকিয়ে রাখা শক্ত হবে। হাফ-টাইম হওয়ার আগেই আমি একটা মতলব এঁটে ফেলেছিলুম। মাঠের ধারে বাদাম গাছ থেকে হাওয়ায় পাতা উড়ে উড়ে পড়ছিল, তাই দেখেই প্ল্যানটা এল। মানে, মতলবটা মন্দ নয়। কিন্তু জানিস তো– মরি অরি পারি যে-কৌশলে।

 

হাফ-টাইম হতেই সেজ পিসিমার বাড়ির রাখাল ভেটকির কানে কানে আমি একটা পরামর্শ দিলুম। ভেটকিটা দেখতে বোকা-সোকা হলেও বেশ কাজের ছেলে। শুনেই একগাল হেসে সে দৌড় মারল।

আবার খেলা আরম্ভ হল। হাওয়ায় বাদামের পাতা উড়ে আসছে, আমি আড়চোখে তা দেখছি আর ভাবছি ভেটকি কখন আসে। এর মধ্যে চিংড়িহাটা আমাদের দারুণ চেপে ধরেছে– জান কবুল করে বাঁচাচ্ছে প্যাঁচা! আমিও ফাঁক পেলে ওদের গোলে হানা দিচ্ছি..কিন্তু বিলটে ঘোষটা যেন পাঁচিল হয়ে গোল আটকাচ্ছে।

আমি শুধু ভাবছি…ভেটকি গেল কোথায়?

অনেক দূর থেকে একটা বল গড়াতে গড়াতে আমাদের গোলের দিকে চলেছিল। একটা কড়ে আঙুল আলতো করে ছুঁইয়েও তাকে ঠেকানো যায়। কিন্তু এ কী ব্যাপার! হঠাৎ প্যাঁচা হালদার দারুণ চিৎকার ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল–প্রাণপণে পা চুলকোতে লাগল আর সেই ফাঁকে

সোজা গোল!

শুধু প্যাঁচা হালদার? ফুলব্যাক কুচো মিত্তির লাফাতে লাফাতে সেই-যে বেরিয়ে গেল, আর ফিরলই না। প্যাঁচা সমানে পা চুলকোতে লাগল, আর পর-পর আরও চারটে গোল। মানে ফাঁকা মাঠেই গোল দিয়ে দিলে বলা যায়!

হয়েছিল কী জানিস? ভেটকিকে বলেছিলুম, গাছ থেকে একটা লাল পিঁপড়ের বাসা ছিঁড়ে এনে উড়ো পাতার সঙ্গে ওদের গোলের দিকে ছেড়ে দিতে, তা হলেই বিলটে ঘোষ একেবারে ঠাণ্ডা! ভেটকি দৌড়ে গেছে, বাসাও এনেছে- কিন্তু ওটা এমন বেল্লিক যে, হাফ টাইমে যে সাইডবদল হয় সে আর খেয়ালই করেনি। একেবারে প্যাঁচা হালদারের গায়েই ছেড়ে দিয়েছে। যখন টের পেয়েছে, তখন আর

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেনিদা থামল।

–কিন্তু কচুবনেশ্বরের টিকটিকির ল্যাজ?– আমি আবার কৌতূহল প্রকাশ করলুম।

আরে, আসল দুঃখু তো সেইখানেই। চিংড়িহাটা যখন কাপ নিয়ে চলে গেল, তখন পরিষ্কার দেখলুম, ওদের ক্যাপ্টেন বিলটে ঘোষের কালো প্যান্টে একটা নীল তাপ্পি মারা।

–তাতে কী হল? ক্যাবলা জিজ্ঞেস করলে।

–তাইতেই সব। নইলে কি ভেটকিটা এমন ভুল করে, বিলটের বদলে প্যাঁচার গায়ে পিঁপড়ের বাসা ছেড়ে দেয়! সবই সেই বাবা কচুবনেশ্বরের লীলা।

–কিছুই বুঝতে পারলুম না–হাঁ করে চেয়ে রইলুম টেনিদার মুখের দিকে।

 

আর টেনিদা খপ করে আমার মুখটা চেপে বন্ধ করে দিয়ে বললে, আরে, বাবার থান থেকে বেরিয়েই দেখি সামনের নদীর ধারে দড়ি টাঙিয়ে ধোপারা জামাকাপড় শুকোতে দিয়েছে। হাতে টিকটিকির ল্যাজটা তখনও ছিল– কী ভেবে আমি সেটাকে একটা কালো প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিয়েছিলুম আর সেই প্যান্টটায় নীল রঙের একটা তাপ্পি মারা ছিল।

আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা। আর মাথার ওপরে টিকটিকিটা ডেকে উঠল : টিকিস-টিকিস ঠিক ঠিক?


© 2024 পুরনো বই