১১. ক্যাচ-কট-কট

চারটে কাঁচকলার ধাক্কা যদি বা সামলানো গিয়েছিল, পচা ডিম আমাদের একেবারে বিধ্বস্ত করে দিলে। বিশেষ যে লেগেছিল তা নয় কিন্তু তার কী খোশবু। সে-গন্ধে আমি তো তুচ্ছ স্বয়ং গন্ধরাজ ছুঁচোর পর্যন্ত দাঁতকপাটি লেগে যাবে।

হাবুল বললে–ইস, দফাখান সাইরা দিছে একেবারে। অখনি গিয়া সাবান মাইখ্যা চান করন লাগব।

আমি মিষ্টি গলায় পিনপিন করে বললুম—আমার এমন ভালো কোটটাকে—

কথাটা শেষ হল না। তার আগেই ক্যাবলা বললে–টেনিদা, উয়ো দেখ্‌খো।

ক্যাবলা অনেকদিন পশ্চিমে ছিল, চটে গেলে কিংবা খুশি হলে কিংবা উত্তেজিত হলে ওর গলা দিয়ে হিন্দী বেরুতে থাকে। পচা ডিমের গন্ধে টেনিদা তখন তিড়িং-মিড়িং করে লাফাচ্ছিল, দাঁত খিঁচিয়ে বললে– কী আবার দেখব র‍্যা? তোর কুবুদ্ধিতে পড়ে সেই জোচ্চোর কাগামাছিটার হাতে–

ক্যাবলা বললে–আরে জী, জেরা আঁখসে দেখোনা উধার–উয়ো পেড় কি পিছে।

টেনিদা থমকে গেল।

—আরে তাই তো! ওই গাছটার পেছনে কেউ লুকিয়ে আছে মনে হয়। ওই লোকটাই তাহলে ডিম ছুড়ে মেরেছে, নির্ঘাত! পীরের সঙ্গে মামদোবাজি–বটে।

টেনিদা এমনিতে বেশ আছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, আমাদের পকেটে হাত বুলিয়ে দিব্যি আলুকাবলি থেকে চপ-কাটলেট পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, কিছু বলতে গেলেই চাঁটি কিংবা গাঁট্টা বাগিয়ে তেড়ে আসছে, কিন্তু কাজের সময় একেবারে অন্য চেহারা—যাকে বলে সিংহ। তখনই আমাদের আসল লিডার। আমাদের পাড়ায় ওদিকে গত বছর বস্তিতে আগুন ধরে গেল, ফায়ার ব্রিগেড পৌঁছবার আগেই একটা বাচ্চাকে পাঁজাকোলা করে বেরিয়ে এল তিন লাফে! সাধে কি টেনিদাকে এত ভালবাসি আমরা।

 

গাছের আড়ালে শত্রুকে দেখতে পেয়েই টেনিদা গায়ের কোটটাকে ছুঁড়ে ফেলল। বললে–হা-রে-রে-রে! আজ এক চড়ে কাগামাছির মুণ্ডু যদি কাটমুণ্ডুতে পৌঁছে না দিই তবে আমি টেনি মুখুজ্যেই নই।

বলেই ডি-লা-গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস শব্দে এক রাম চিৎকার। তারপরেই এক লাফে ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে তীরের মতো গাছটার দিকে ছুটে গেল; আমরা হতভম্বের মত চেয়ে রইলুম, ইয়াক ইয়াক পর্যন্ত বলতে পারলুম না।

টেনিদাকে তীরের মতো ছুটতে দেখেই লোকটা ভোঁ দৌড়। ঝোপজঙ্গলের মধ্যে ভালো দেখা যাচ্ছিল না, তবু যেন মনে হল, লোকটা যেন আমাদের অচেনা নয়, কোথাও ওকে দেখেছি!

বনের মধ্যে দিয়ে ছুটল লোকটা। টেনিদা তার পেছনে। এক মিনিট পরেই আর কিছু দেখতে পেলুম না, শুধু দৌড়ানোর আওয়াজ আসতে লাগল। তারপরেই কে যেন ধপাস করে পড়ল, খানিকটা ঝটাপটির আওয়াজ আর টেনিদার চিৎকার কানে এল : হাবুল-প্যালা-ক্যাবলা, ক্যাচ- কট-কট! কুইক–কুইক!

ক্যাচ কট কট। তার মানে কাউকে ধরে ফেলেছে!

ডি-লা-গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস, ইয়াক-ইয়াক। আমরা তিনজনে বোঁ-বোঁ করে ছুটলুম সেদিকে। পাহাড়ি উচু নিচু রাস্তায় ছুটতে গিয়ে নুড়িতে পা পিছলে যায়, ডান হাতে বিছুটির মতো কী লেগে জ্বালাও করতে লাগল, কিন্তু আর কি কোনওদিকে তাকাবার সময় আছে এখন! এক মিনিটের মধ্যেই টেনিদার কাছে পৌঁছে গেলুম আমরা।

দেখি, টেনিদা বসে আছে মাটিতে। তার এক হাতে একটা মেটে রঙের ধুসো মাফলার, আর এক হাতে দুটো চকোলেট। সামনে কতকগুলো কাগজপত্র ছড়ানো।

 

আমরা কিছু বলবার আগেই টেনিদা করুশ গলায় বললে– ধরেছিলুম লোকটাকে, একদম জাপটে। কিন্তু দেখছিস তো, পাথর কী রকম পেছল, স্লিপ করে পড়ে গেলুম। লোকটাও খানিক দূরে কুমড়োর মতো গড়িয়ে উঠে ছুট লাগাল। এদিকে দেখি, একটা পা একটু মচকে গেছে—আর তাড়া করতে পারলুম না।

ক্যাবলা বললে–কিন্তু এগুলো কী?

—সেই হতচ্ছাড়া কাগামাছি না বগাহাঁচির পকেট থেকে পড়েছে। আর ধুসো মাফলারটা আমি কেড়ে নিয়েছি। বলেই একটা চকোলেটের মোড়ক খুলে তার এক টুকরো ভেঙে নির্বিকারভাবে মুখে পুরে দিলে।

ক্যাবলা বললে–দাঁড়াও—দাঁড়াও, চকোলেট খেয়ো একটু পরে। এই মাফলারটাকে চিনতে পারছ?

—চিনতে বয়ে গেছে আমার। চকোলেট চিবোতে চিবোতে টেনিদা বললে–যেমন বিচ্ছিরি দেখতে, তেমনি তেল-চিটচিটে, বুঝলি, কাগামাছিটা বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হলে কী হয়, লোকটার কোনও টেস্ট নেই, নইলে অমন একটা বোগাস মাফলার গলায় জড়িয়ে রাখে!

ক্যাবলা বললে–দুত্তোর।

টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে–থাম।–দুত্তোর দুত্তোর করিসনি। পায়ে ভীষণ ব্যথা করছে কষ্ট হচ্ছে উঠে দাঁড়াতে। ওই যাচ্ছেতাই মাফলারটা দিয়ে আমার পাটা বেঁধে দে দিকিনি।

এতক্ষণ পরে হাবুল সেনের মাথাটা যেন সাফ হয়ে গেল একটুখানি। হাবুল বললে– হ-চিনছি তো। এই মাফলারটাই তো দেখছিলাম কদম্ব পাকড়াশির গলায়।

আমি বললুম-ঠিক-ঠিক।

টেনিদা বললে–তাই তো! আরে, এতক্ষণ তো খেয়াল হয়নি। সেই লোকটাই তো চকোলেট প্রেজেন্ট করে শিলিগুড়ি স্টেশনে আমাদের ঝাউ বাংলোয় আসতে নেমন্তন্ন করেছিল। আর সেই তো কাগামাছির চীপ অ্যাঁসিস্টান্ট-সাতকড়ি সাঁতার কী সব মুলোটুলো চুরি করবার জন্যে–

ক্যাবলা ততক্ষণে মাটিতে-পড়া গোটা দুই কাগজ কুড়িয়ে নিয়েছে। আমি দেখলুম, দুখানাই ছাপা কাগজ—হ্যাণ্ডবিল মনে হল। তাতে লেখা আছে :

 

শীঘ্রই প্রকাশিত হইবে
বিখ্যাত গোয়েন্দা-লেখক
পুণ্ডরীক কুণ্ডুর
রহস্য উপন্যাস–??
পাতায় পাতায় শিহরন-ছত্রেছত্রে লোমহর্ষণ!
প্রকাশক :
জগবন্ধু চাকলাদার এন্ড কোং
১৩ নং হারান ঝম্পটি লেন, কলিকাতা—৭২

ক্যাবলার সঙ্গে সঙ্গে আমি আর হাবুলও হ্যান্ডবিলটা পড়ছিলুম। ওদিকে টেনিদা তখন তেমনি নিশ্চিন্ত হয়ে চকোলেট চিবিয়ে চলেছে, বিশ্ব সংসারের কোনও দিকে তার কোন লক্ষ আছে বলে মনে হল না।

পড়া শেষ করে ক্যাবলা বললে–এর মানে কী?

এইবার আমার পালা। ক্যাবলা ভারি বেরসিক ছেলে, ডিটেকটিভ বই-টই পড়ে না, বলে বোগাস। হাবুলের সমস্ত মন পড়ে আছে ক্রিকেট খেলায়—সেও বিশেষ খবর-টবর রাখে না। কিন্তু আমি? আমার সব কণ্ঠস্থ! রামহরি বটব্যালের রক্তমাখা ছিন্নমুণ্ড, কঙ্কালের হুঙ্কার, নিশীথ রাতের চামচিকে থেকে শুরু করে যদুনন্দন আঢ্যের কেউটে সাপের ল্যাজ, ভীমরুল বনাম জামরুল, অন্ধকারের কন্ধকাটা—মানে বাংলাভাষায় যেখানে যত গোয়েন্দা বই আছে সব প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছি। আর পুণ্ডরীক কুণ্ডু? হ্যা, তাঁর বইও আমি পড়েছি। তবে ভদ্রলোক সেরকম জমিয়ে লিখতে পারেন না, দাঁড়াতেই পারেন না রামহরি কিংবা যদুনন্দনের পাশে। কিন্তু তাঁর তক্তপোশের পোক্ত ছারপোকা আমার মন্দ লাগেনি। বিশেষ করে সেই বর্ণনাটা যেখানে হত্যাকারীর তক্তপোশের নীচে গোয়েন্দা হীরক সেন একটা মাইক্রোফোন লুকিয়ে ফিট করে রেখেছিলেন; হত্যাকারী ঘুমের ঘোরে কথা কইত, আর দু মাইল দূরে বসে গোয়েন্দা মাইক্রোফোনের সাহায্যে তার সব গোপন কথা শুনতে পেতেন।

দু নম্বর কাগজটাও ওই একই হ্যান্ডবিল! ক্যাবলা সেটাও একবার পড়ে নিলে। তারপর আবার বললে–এর মানে কী? এই হ্যান্ডবিল কেন? কে পুণ্ডরীক কুণ্ডু? জগবন্ধু চাকলাদার বা কে?

 

আমি বললুম-পুণ্ডরীক কুণ্ডু গোয়েন্দা বই লেখেন, কিন্তু ওঁর বই ভালো বিক্রি হয় না। আর জগবন্ধু চাকলাদার ওঁর পাবলিশার।

হুঁ। হাবুল ধুসো মাফলারটা নাড়াচাড়া করছিল, হঠাৎ উঃ বলে চেঁচিয়ে উঠে মাফলারটা ফেলে দিলে আর প্রাণপণে হাত ঝাড়তে শুরু করে দিলে।

আমি চমকে উঠে বললুম কী হল রে হাবুল? মাফলারের মধ্যে কী কোনও বিষাক্ত ইনজেকশন

—আর ফালাইয়া থো তোর বিষাক্ত ইনজেকশন! একটা লাল পিঁপড়ে আছিল, একখান মোক্ষম কামড় মারছে।

আহত পিঁপড়েটা তখন মাটিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়ছিল। ক্যাবলা একবার সেদিকে তাকাল, তারপর আমার কোটের দিকে তাকিয়ে দেখল। কিছুক্ষণ কী ভাবল—মনে হল, কী যেন একটা গভীর রহস্যের সমাধান করবার চেষ্টা করছে।

তারপর বললে–তোর কোটেও তো দেখছি কয়েকটা মরা পিঁপড়ে লেগে আছে প্যালা!

বললুম–বাঃ! গাছে উঠে ওদের সঙ্গেই তো আমাকে ঘোরতর যুদ্ধ করতে হচ্ছিল।

–হুঁঃ। আচ্ছা ভালো করে চারদিকের ঝোপজঙ্গল লক্ষ্য করে দেখ তো, এরকম পিঁপড়ে এখানে আছে কি না!

এতক্ষণ পরে টেনিদা বললে– কী পাগলামো হচ্ছে ক্যাবলা। কাগামাছিকে ছেড়ে শেষে পিঁপড়ে নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করবি নাকি? উঃ, কদম্বটাকে ঠিক জাপটে ধরেছিলুম—একটুর জন্যে ক্যাবলা বললে–একটু থামো দিকি। কদম্ব আর পালাতে পারবে না, ঠিক ধরা পড়বে এবার। কী রে হাবুল, প্যালা, আর লাল পিঁপড়ে পেলি এখানে?

হাবুল বললে–না, আর দেখতে আছি না।

বলতে বলতে হাবুলের পিঠ থেকে কী একটা ঝোপের ওপর পড়ল। দেখলুম, সেই পচা ডিমের খোলার একটা টুকরো।

হাওয়ায় সেটা উড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্যাবলা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে সেটাকে ধরে ফেলল। একমনে কী যেন দেখেই সেটাকে রুমালে জড়িয়ে বুক-পকেটে পুরে ফেলল।

 

টেনিদা বললে–ও আবার কী রে! পচা ডিমের গন্ধে প্রাণ যাচ্ছে গিয়ে জামাকাপড় ছাড়তে পারলে বাঁচি, তুই আবার সেই ডিমের খোলা কুড়িয়ে নিচ্ছিস।

ক্যাবলা সেকথার জবাব দিলে না। বললে–টেনিদা, উঠতে পারবে?

—পারব মনে হচ্ছে! ব্যথাটা কমেছে একটুখানি।

—তবে চলো। আর দেরি নয়।

—কোথায় যেতে হবে?

–ঝাউবাংলোয়। এক্ষুনি।

আর সাঁতরামশায়? যদি তেনারে এর মইধ্যে কাগামাছি একেবারে লোপাট কইর‍্যা ফ্যালায়?—হাবুল সন্দিগ্ধ হয়ে জানতে চাইল।

—আরে, কাগামাছি কো বাত আভি ছোড় দো! আগে ঝাউবাংলোয় চলল। সব ব্যাপারগুলোরই একটা কু পাওয়া যাচ্ছে মনে হয়—শুধু একটুখানি বাকি। সেটা মেলাতে পারলেই–

–আর তখুনি একটা কথা আমার মনে পড়ল। বড় বড় লেখকের অটোগ্রাফ জোগাড় করবার বাতিক আছে আমার, সেই সুবাদে আমি বছর তিনেক আগে একবার পুণ্ডরীক কুণ্ডুর সালকিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলুম। একটা জলচৌকির উপর উবু হয়ে বসে পুণ্ডরীক তামাক খাচ্ছিলেন, গলায় একটা ঢোলের মত মস্ত মাদুলি দুলছিল। ছবিটা চোখের সামনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। গোয়েন্দা-গল্পের লেখক, অথচ শার্লক হোমসের মতো পাইপ খান না।বসে বসে হুঁকো টানেন আর তাঁর গলায় ঘাসের নীলচে রংধরা একটা পেতলের মস্ত মাদুলি থাকে, এটা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। কিন্তু সবটা এখন নতুন করে মনে জাগল, আর সেই সঙ্গে

 

আমার মগজের ভেতরে হঠাৎ যেন বুদ্ধির একটা জট খুলে গেল। তা হলে–তা হলে–

আমি তখুনি কানে কানে কথাটা বলে ফেললুম।

আর ক্যাবলা? মাটি থেকে একেবারে তিন হাত লাফিয়ে উঠল। আকাশ ফাটিয়ে আর্কিমিডিসের মতো চিৎকার করল—পেয়েছি—পেয়েছি!

কী পেয়েছিস? হাবুলের কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিল টেনিদা, চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কী পেলি হাতি না ঘোড়া? খামকা চেঁচাচ্ছিস কেন ষাঁড়ের মতো?

ক্যাবলা বললে–যা পাবার পেয়েছি। একেবারে দুইয়ে দুইয়ে চারচারে চার আট!

-মানে?

–সব জানতে পারবে পনেরো মিনিটের মধ্যেই। কিন্তু তার আগে প্যালাকেও কনগ্রাচুলেট করা দরকার। ওর ডিটেকটিভ বই পড়ারও একটা লাভ আছে দেখা যাচ্ছে। কলকাতায় ফিরেই ওকে চাচার হোটেলে গরম-গরম কাটলেট খাইয়ে দেব।

টেনিদা বললে–উহু উহু, মারা যাবে। ওর ওসব পেটে সইবে না। ওর হয়ে আমিই বরং ডবল খেয়ে নেব।

হাবুল মাথা নেড়ে বললে– সত্য কথা কইছ। আমিও তোমারে হেলপ করুম। কী কস প্যালা?

আমি মুখটাকে গাজরের হালুয়ার মতো করে চলতে লাগলুম। এসব তুচ্ছ কথায় কর্ণপাত করতে নেই।


© 2024 পুরনো বই